১০৮
এই মাস গেল কন্যা
না পুরিল আশ।
লহরী যৌবন ধরি
নামিল আষাঢ় মাস ।।
আষাঢ় মাসেতে হে কন্যা
কিষাণে কাটে ধান।
কোড়া খির কান্দনেতে
শরীর কম্পমান ॥
হেঁওয়া পাখির কান্দনেতে
পাজর কৈল শেষ।
ডাউকির কান্দনেতে মুই
ছাড়িনু বাপের দেশ ॥
.
বরকত আলির বাড়ি থেকে বেরিয়ে আখড়ার দিকে যেতে থাকল সিদ্ধার্থ। যেতে যেতে তার মনে হল, পাড় ভেঙেছে আরও কিছুটা। পথ সরু লাগছে। এ পথে আসার সময় কাল ঘোড়ার গাড়ি একদিকে হেলে গিয়েছিল। এখন সে বুঝতে পারল, পথ থেকে নেমে গিয়েছিল চাকা।
ইসমাইলের দোকানের কাছে এসে থমকে দাঁড়াল সে। দোকানের পেছনের দেওয়ালটা নেই। খসে পড়ে গেছে। সামনে-পেছনে খোলা চালাঘরের মধ্যেই উনুন জ্বেলেছে ইসমাইল। ছাউনির নীচে যে-বসবার জায়গা, সেখানে এই বৃষ্টির বেলাতেও বসে চা খাচ্ছে কয়েকজন। সে ইসমাইলের দোকান পেরিয়ে এল। একটি বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে যেতে সে মিহি ডাক শুনল। যেন কোনও বালিকাই তাকে ডাকছে। সে দাঁড়াল। দেখল গাছপালার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে একজন। উচ্চতায় পৌনে পাঁচফুট। কুচকুচে কালো। চিবুকে কয়েকগাছি ঝুলন্ত দাড়ি। একটি হাত কনুই থেকে কাটা। অন্য হাতে একটি কালিমাখা বড় ন্যাকড়া। সেটি গিঁট বাঁধা লুঙ্গির খাঁজে গুঁজতে গুঁজতে ছেলেটি বলল—সিধুদা, ভাল আছেন?
সে দাঁড়াল। বলল—ভাল আছি।
ছেলেটিকে সে চিনতে পারছিল। পুজোর সময় মোহনলালের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে। কিন্তু ছেলেটির নাম সে জানে না। ছেলেটি অনায়াসে ভিজছে। কুঁতকুতে চোখে দেখছে সিদ্ধার্থকে। সে বলল—ভিজছেন আপনি।
— ও কিছু না।
—কিছু বলবেন?
—জি, আমার নাম মাতিন শেখ। মোহনদা আমাকে খুব ভাল চেনে।
—একবার যদি আসেন আমাদের বাড়ি। মানে গরিবের বাড়ি আমাদের। যদি মেহেরবানি করেন।
মেহেরবানির কী আছে? চলুন।
—জি, আমাকে তুমি বলেন।
—বেশ তো। চলো!
চকচক করে উঠল মাতিন শেখের চোখ। সিদ্ধার্থকে সঙ্গে নিয়ে আঙিনায় এল সে। বলল— একটু দাঁড়ান।
সিদ্ধার্থ দাঁড়াল। দেখল মাতিন শেখ উঠোনের কোণে একটি চালাঘরের দিকে যাচ্ছে। খড়ের ছাউনির নীচে দাঁড়িয়ে আছে বাইক একটি। কালিমাখা ন্যাকড়া চালাঘরের বাঁশে গুঁজে দিয়ে মাতিন শেখ বলল—মোহনদার থেকে এটা কিনেছি।
—ও।
—ভাল না?
—ভালই তো।
—প্ৰায় নূতন।
—তাই তো।
—একেবারে নূতন কেনার তো টাকা নাই। মোহনদা অল্পে ছেড়ে দিল।
—খুব ভাল।
—চলেন।
সিদ্ধার্থকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল মাতিন শেখ। তাদের একমাত্র ইটের ঘরে। বিছানা দেখিয়ে বলল—বসেন সিধুদা।
সিদ্ধার্থ বসল। হাত দিয়ে মাথার চুল থেকে জল ঝেড়ে নিয়ে মাতিন শেখ বলল—চা খাবেন সিধুদা?
—না, না। বলো মাতিনভাই। আমাকে ডাকলে কেন?
—না না। আমি কিছু বলব না। সিধুদা, আপনাকে আমার খুব ভাল লাগে। খুব ইচ্ছা ছিল, আপনি আসবেন, বসবেন আমার ঘরে।
—শুনে খুশি হলাম মাতিনভাই। তা তুমি কী করো?
মাতিন শেখ হাত দিয়ে নিজের দাড়ির গুচ্ছ টানল। তারপর বলল—এই, মানে, আপনাকে মিথ্যা বলে কী লাভ? বর্ডার থেকে মাল আনি। কখনও বেচি। কখনও ভারী মাল পেলে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিই। কী করব? লেখাপড়া জানি না। জমিজমা নাই। আমার আব্বা গোরু চরায়।
—ও! তা ওসব কাজে তো অনেক ঝামেলা মাতিন।
—হ্যাঁ। ঝামেলা আছে। ভয় আছে। কোন পুলিশ কীরকম বোঝাই যায় না। কেউ ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেয়। কেউ সোজা থানায় চালান করে দেয়।
—তুমি ধরা পড়েছ কখনও?
—গত মাসেই পড়েছিলাম। কী যে বলব সিধুদা, এমন প্যাঁদানি দিল, জ্বর এসে গেল আমার।
— তাই?
—তারপর থেকে ভয়ে আর কাজেই যাচ্ছি না। অবশ্য লক-আপে রেখেছিল দু’দিন মাত্র। সারা গায়ে তেলাপোকা চেটে ছাল তুলে দিচ্ছে। মোহনদা ছাড়িয়ে না আনলে সব জেলে যেতাম।
—সব মানে?
—আমাদের গোটা দল। আমি, সমির, কালু সব। মোহনদা আমাদের ভালবাসে বলে বেঁচে গেলাম।
—কোন থানায় ছিলে?
—হরিহরপাড়ায়। যেখানে আপনাদের লাফরা হয়েছিল।
—এই কাজ আর ভাল লাগছে না সিধুদা। ওঃ! পুলিশের প্যাঁদানি যে কী জিনিস, টের পাবার পর থেকে, কী বলব, ভয়ে তো আমার গাঁড় ফেটে গেছে। মাপ করবেন। মুখ খারাপ করে ফেললাম।
—ঠিক আছে।
—ভাবছি আর এসব কাজে যাব না। কাজটায় পয়সা আছে বুঝলেন সিধুদা। টাকা যখন আসে, যেন ছপ্পর ফুঁড়ে আসে। আমাদের মতো সংসারে সে অনেক টাকা। কিন্তু কী যে হয়, সব উড়ে উড়ে যায়। কিছুতেই ধরে রাখতে পারি না। বলে পাপের পয়সা নাকি থাকে না। তাই বোধহয়। অনেক কষ্টে পনেরো হাজার টাকা জমিয়ে এই বাইকটা কিনেছি। মোহনদা দিয়ে দিল পনেরো হাজার টাকায়। একটা বাইক থাকার প্রেস্টিজ আলাদা। না সিধুদা?
—তাই?
—তাই না? এই গ্রামে বাইক আছে একমাত্র মোহনদার আর আমার। আচ্ছা সিধুদা।
— বলো।
—আপনি তো জিগ্যেস করলেন না।
—কী?
—বাইকটা আমি কী করে চালাই!
—আমার জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করেনি তো।
—সবাই জিগ্যেস করে। জানেন? আমার তখন খুব কষ্ট লাগে। সবাই ক্ষ্যাপায়। আমি বেঁটে। কালো কুচ্ছিৎ। তার মধ্যে মাকুন্দ। হাতটা কাটা যাবার পর নুলো হয়ে গেলাম। লোকে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। সয়ে গেছিল জানেন। কিন্তু বাইকটা কেনার পর যখন হাসাহাসি বেড়ে গেল তখন নতুন করে কষ্ট লাগল।
বাইরে ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। মাতিন শেখ একবার ছুটে গেল বারান্দায়। আপনমনে বলল—নাঃ! একটা গার্ড না দিলেই নয়। বাইকটার গায়ে জল লাগছে।
তার কথা ভেসে গেল বৃষ্টির জলে। এমনকী সিদ্ধার্থর শ্রবণেও তা পৌঁছল না। সিদ্ধার্থ তবু গুছিয়ে বসল এবার। এই বৃষ্টিতে যাওয়া যাবে না কোথাও। যদিও মাতিন শেখ তাকে কেন ডেকে এনেছে সে বুঝতে পারছে না। কিন্তু এরই মধ্যে ছেলেটির প্রতি সে মায়া বোধ করছে। মাতিন শেখ বেঁটে কালো কুচ্ছিৎ। মাকুন্দে, নুলো। নিরক্ষর। সীমান্তে চোরাচালান তার পেশা তবু মাতিন শেখের জন্য তার মায়া বোধ হয় কেন? সে আপনমনে হাসে। মায়া! অপার অকুল মায়া নিয়ে সে জন্মেছে। হতে পারে এই মায়া সে পেয়েছে বোধিসত্ত্বর কাছ থেকে বংশগতি মাধ্যমে। হতে পারে, এই মায়াই তাকে এই পথের যাত্রী করেছে। অথচ তার মধ্যে আছে এক শীতল নির্মমতাও। না হলে সে কী প্রকারে বলে—ওদের মাছের খাবার করে দাও? তার নিজস্ব বিচারশালায় যারা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধী, তাদের প্রতি, সে, সচেতনভাবে নির্মম। সে জানে না শেষ পর্যন্ত সে পৌঁছবে কোথায়! নিজেকে নিয়ে, বিচ্ছিন্নভাবে, সে ভাবিত থাকে না আদৌ। একটিমাত্র বিষয়, আপনা ক্ষেত্রে, নাড়িয়ে দেয় তাকে। বোধিসত্ত্ব না থাকলে তার কী হবে!
কী হবে?
বিদ্যুৎ চমকায়।
মাতিন শেখ এল তখন। বলল— বস্তা চাপা দিয়ে এলাম।
—কাকে?
জিগ্যেস করল সিদ্ধার্থ। মাতিন শেখ বলল— বাইকটাকে। সারাক্ষণ মুছে মুছে চকচকে করে রেখেছি। শালার কাদাজল ছিটে লেগে গেল।
একটি গামছা দিয়ে মাথা-গা ডলে ডলে মুছে নিচ্ছিল সে। সিদ্ধার্থ বলল—কাজে যে যাচ্ছ না, তোমার চলছে কী করে?
মাতিন শেখ এক মুহূর্ত থমকাল। তার ইটের ঘরে ঘন বরষাময় আষাঢ়ের একটি দিনের অন্ধকারমাখা শেষ আলোর রেশ। সেই আলো পড়ল তার মুখে। সে হাসল বিষণ্ণ। বলল— আমি জানি সিধুদা, আপনি সবার থেকে আলাদা। লোক এইজন্য আপনাকে এত ভালবাসে।
—তাই বুঝি?
—একদম খাঁটি কথা বললাম। জানেন, আজ অবধি কেউ কখনও আমাকে জিগ্যেস করেনি, মাতিন, তোর চলছে কী করে? আপনি প্রথম করলেন। আগে যখন খেতে পেতাম না, তখনও জিগ্যেস করেনি। যখন হাত চলে গেল, তখনও করেনি। এখন কাজে যাচ্ছি না, এখনও করে না। সামান্য হাতে ছিল, তাই দিয়ে চলছে। বেশিদিন আর চলবে না।
—তোমার বন্ধুরা যাচ্ছে কাজে?
—হ্যাঁ। বৃষ্টির সময় তো মাল টানার সুবিধা।
—তোমাকে ডাকে না?
—না। এখানে কোনও ডাকাডাকি নাই। তবে কাজ বেশিদিন না করলে নজরে রাখবে। দেখবে মাল টিকটিকি হয়ে গেলাম, না ফেউ। তবে ইয়ার-দোস্ত সব আসে। বাইকটা নিতে আসে। আমি দিই। একটাই শর্তে।
—কী?
—আমাকে পিছে বসাতে হবে। খুব শখ ছিল জানেন, বাইক চালাব। গগলস পরব। তিরিশ চল্লিশ পঞ্চাশ ষাট সত্তর ইস্পিড দেব খুব! ওঃ! যা দারুণ লাগে না! কিন্তু হল না। দোস্তরা বলল, তুই পারবি না চালাতে। বললাম, চালাবই। শালার হাতটার জন্য হল না। ছিটকে পড়ে গেলাম।
কাটা হাতটা দোলাচ্ছে মাতিন শেখ। দোলাচ্ছে। যেন দারুণ উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠেছে একাই ওই হাত। সিদ্ধার্থর ইচ্ছে করল, হাত দিয়ে ওই দোলন থামিয়ে দেয়। সে দেখছিল মাতিন শেখকে। বাইকের প্রতি কী গভীর অনুরাগ ছেলেটির! ওই টাকায় বেশ কিছু মুরগি বা গোরু কিনে ব্যবসা করতে পারত! কথাটা মাতিন শেখকে বলবে কি না ভাবছিল সে। তখনই মাতিন শেখ বলল—বাইকটা হেঁ হেঁ, আমার কী, জানেন?
—কী?
—বিবি। আমার বিবি। কিছু মনে করলেন সিধুদা, বললাম বলে?
—না। তোমার যা মনে হয় বলেছ।
—আপনি আলাদা। আপনি আলাদা। কিন্তু কষ্ট হয় না বলেন? নিজের বিবির ওপর চড়তে গেলে যদি অন্যের সাহায্য লাগে, তবে কষ্ট হয় না?
মাতিন শেখের মুখ-চোখ রীতিমতো কাতর। তবু, এ কথায় হাসি পেল সিদ্ধার্থর। সে হাসি চেপে বলল—দেখো, মাতিনভাই, বৃষ্টি ধরল কি না। এবার যেতে হবে।
মাতিন শেখ তৎপর হয়ে উঠল এবার। বলল—অনেক সময় নিয়ে নিলাম সিধুদা আপনার।
—ঠিক আছে। সময় হাতে আছে আমার।
—কতদিন ভেবেছি আপনার সঙ্গে কথা বলব। সাহস হয় না। আজ ডেকে ফেললাম।
—বেশ করেছ।
—একটা কথা বলব?
—বলো।
—মোহনদা তো আপনার বন্ধু, না? জিগরি দোস্ত।
—নিশ্চয়ই।
—কিন্তু মোহনদার খুব রাগ আপনার ওপর। আপনি সি পি এম পার্টি ছেড়ে দিয়েছেন, তাই সিদ্ধার্থ হাসল। বলল—তা তো হতেই পারে মাতিনভাই। বন্ধু বন্ধুর ওপর রেগে যায় না?
—যায়। কিন্তু আমার ঠিক লাগে না।
—কী ঠিক লাগে না?
প্রশ্নটা করার আগে সামান্য দ্বিধান্বিত হল সিদ্ধার্থ। মোহনলাল তার বিষয়ে কী ভাবছে তা জানার জন্য সে মাতিন শেখের সাহায্য নেবে কেন? এটা কি নীচতা নয়? অনৈতিক নয়? যাই ঘটুক না কেন, মোহনলাল তার বন্ধু তো নিশ্চয়ই!
কিন্তু পরক্ষণেই একজন রাজনীতিকের মন ও যুক্তিবোধ সরিয়ে দিল দ্বিধাকে। তারা বলল, শুনতে হয়, জানতে হয়, বুঝতে হয়। শুধু আবেগ দিয়ে নয়। আবেগ এবং বুদ্ধি দিয়ে গড়ে নিতে হয় সামনের পথ। আগামীর সিদ্ধান্ত। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো হলে চলে না একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ন্যায়-নীতি।
অতএব, সে মাতিন শেখের জবাবের প্রতীক্ষা করল। মাতিন শেখ বলল-আপনার মিছিলে যেতে বারণ করেছিল মোহনদা।
—কাকে?
—সবাইকে। চমকেছিল। যে যাবে, তার ভাল হবে না। তা সত্ত্বেও যারা গিয়েছে, তাদের প্রতি মোহনদার দারুণ রাগ। একদিন শোধ তুলবেই। দেখবেন। ক্ষমতা আসুক। আসলে মোহনদার খুব তেল বেড়েছিল।
—কীসের?
—মোহনদা বলতে শুরু করেছিল, মোহনদাকে না জিগ্যেস করে এ গ্রামের একটা পাতাও নড়ে না। তা এখন গাছপালা মোহনদাকে জিগ্যেস না করেই হেঁটে-চলে বেড়ালে রাগ হবে না? হেঁ-হেঁ।
সিদ্ধার্থ বলল—তুমি আমাকে এত কথা বললে কেন মাতিনভাই? তুমি তো মোহনের লোক, তাই না? এটা তো গদ্দারি করলে তুমি?
শক্ত হয়ে গেল মাতিন শেখের মুখ। চোখদুটি জ্বলে উঠল তার। বলল—কীসের গদ্দারি? এক আনার নিমক যদি খেতাম আমি মোহনদার তো বলতে পারতেন আপনি গদ্দারি, নিমকহারামি! কিন্তু আমি কারও ধারি না। শালা হাত কাটা মাতিন শেখ এক পয়সা পরের খায় না।
সিদ্ধার্থ বলল—ঋণ তো বহুরকম মাতিনভাই। শুধু টাকা নেওয়াই কি ঋণ? মোহন তোমাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনেনি?
—এনেছে তো কী?
মাতিন শেখ দারুণ বেগে কাটা হাত দোলায়। গরগর করে। রাগী হিংস্র দেখায় তাকে। খাড়া হয়ে ওঠে তার চিবুকের কয়েকগাছি নুর। সে বলে—এমনি এমনি করেছে নাকি মোহনদা? আমাদের ছাড়া মোহনদার এত রোয়াব হত? যা বলেছে তাই করেছি। এখন মোহনদার হাত বেড়েছে। কী আর বলব আপনাকে? কত বলব? রেশমকুচির নুর মহম্মদের ঘর পোড়াল কে? জব্বারকে কে গোমাংস খাওয়াল? নতুন পয়োস্তি নিয়ে লোককে ভয় দেখিয়ে মত আদায় করেছিল কে? আর রাস্তা বানানোর টাকা? কত বলব সিধুদা? কত বলব? আরও আছে। এই এক বছরে মোহনদাকে মোহনদা বানিয়েছে কে? আমরা। এখন মোহনদা বড় নেতা হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা কথা না। তার জন্য আমি আপনাকে এসব বলছি না। আপনাকে দেখলে, সব কথা বলতে মন চায়। সত্যি। বিশ্বাস করেন। বিশ্বাস করলেন তো?
—করলাম।
—কী বলব,
—আমার একটা কথা আছে। মানে, কী বলব, সিধুদা, আপনাকে ভালবাসি বলে বলছি।
—বলো মাতিনভাই।
—একটা প্রতিবন্ধী সার্টিফিকেট দেবেন আমাকে? আর প্রতিবন্ধী কোটায় একটা চাকরি? দেবেন করে সিধুদা? এই জীবন আর ভাল্লাগে না। চোরাই মাল পাচার না করলে না খেয়ে মরব।
সিদ্ধার্থ বলল—তুমি হাঁস-মুরগি পালতে পারো না? ছোট করে শুরু করতে পারো।
—হাঁস মুরগি? ভাল্লাগে না। তা ছাড়া সব তো অসুখে মরে যায়।
—কেন? পঞ্চায়েত থেকে তো টিকা দেবার কথা।
—দেয়। মাঝে মাঝে। তাতে হয় না। তা ছাড়া আমার ওতে মন লাগে না। চাষবাসে মন লাগে না। কী জানেন, লাইনের কাজ করে করে অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে। বাবুয়ানির চোখ হয়ে গেছে সিধুদা।
সিদ্ধার্থ বলে—সার্টিফিকেট তুমি পেয়ে যাবে। করে দেব। কিন্তু চাকরির বিষয়ে কথা দিতে পারলাম না। তবে মনে রাখব আমি।
—ব্যস! ওইটুকুই! আপনি মনে রাখবেন বললেই অনেক।
—কিন্তু একটা কথা।
—কী সিধুদা?
—পুলিশের খাতায় নাম লেখালে চাকরি হবে না মাতিন ভাই।
—হবে না, না?
—না।
—সিধুদা আমি চেষ্টা করব অন্য কিছু করার, যতদিন আপনি না ডাকেন।
সিদ্ধার্থ চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। ভাবল। গাছের ডাল ধরে ঝুলছে অন্ধকার। এখুনি নামবে ঝুপ করে। আর এক মুহূর্ত বুঝি। মাতিন শেখ দেশলাই জ্বালল। চৌকির তলা থেকে টেনে নিল লণ্ঠন। সিদ্ধার্থর মনে হল, একটা চাকরি, সামান্য চাকরিই একজন প্রায় নিরক্ষর লোকের জন্য, প্রতিবন্ধী শংসাপত্র থাকলে, পাওয়া যেতে পারে। পারেই। কিন্তু সে এখন কাকে বলবে? তার পক্ষে ব্যবস্থা করে দেবার উপযুক্ত সময় এ নয়। তবে, সে রাসুদার কাছে পাঠাতে পারে একে। সে নিশ্চিত, সে পাঠালে, রাসুদা একেবারে ফিরিয়ে দেবেন না। হতে পারে, একটি চাকরি, একটি সামান্য চাকরি, এই ছেলেটিকে সৎ পথে ফিরিয়ে দিতে পারে।
মাতিন শেখ বলল তখন—রাগ করলেন, না সিধুদা?
—না তো।
—আপনি ভাবলেন, এই চাওয়ার জন্যই ডেকেছি আপনাকে?
—তা যদি হয়, তাতেই বা কী? হতে পারে আমি একদিন তোমার সাহায্য চেয়ে তোমাকে ডেকে নিলাম। তাতে কি অন্যায় হবে?
—হেঃ! কী যে বলেন! আমি হলাম গিয়ে নালির পোকের সমান। আমাকে আপনার কী কাজে লাগে?
—মানুষের কাজে মানুষ লাগে মাতিনভাই।
—মানুষের কাজে মানুষ, না? মানুষের কাজে মানুষ?
অপলক চেয়ে থাকে মাতিন শেখ কিছুক্ষণ। যেন এবম্বিধ বাক্য সে শোনেনি কখনও। ভাল হাত দিয়ে কাটা হাতে হাত বোলায় সে। বলে-চা খান। করতে বলি?
—বলো।
মাতিন শেখ ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়। কাঁচা ঘরে চলে যায় মাকে চা করতে বলার জন্য। জলজ বাতে লণ্ঠন দপদপ করে। মাতিন শেখ ফিরে আসে। সিদ্ধার্থ বলে—তুমি আগামী সপ্তাহে চলে যেয়ো বহরমপুর মাতিনভাই।
মাতিন শেখ হাসে। বলে—যাব সিধুদা।
তার হৃদয় জুড়ে আলোর শিখা দপদপ করে। একা পেলেই ছুঁয়ে ফেলার জন্য অপরূপ স্বপ্নরা তাকে ঘিরে ধোঁয়াটে পাক খায়। সে এক আনন্দ-সম্ভাবনায় বুঁদ হয়ে যেতে যেতেও হয় না শেষ অবধি। থমকায় কী যেন ভেবে। তার চোখের স্বপ্নিল আভাস উধাও হয়ে চিকচিক করে কালো মণি। সে বলে-– সিধুদা!
—বলো।
—একটা কথা এখনও পুরো করে বলা হয় নাই আমার।
—বেশ তো। বলো।
—কোন কথা, বলেন?
—তোমার আচরণকে কেন মোহনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বলা যাবে না।
—জি! একেবারে ঠিক! বলি তবে? বলি?
—বলো।
—সিধুদা, মোহনদা যেভাবে ব্যবহার করেছে আমাকে, যেভাবে অপমান করেছে, কুত্তাকেও কেউ করে না।
সিদ্ধার্থ শুনছে। কথা বলছে না। এ সময় কথা বলা তার রীতিবিরুদ্ধ। মানুষ যখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কিছু বলতে চায়, তখন তাকে বলতে দিতে হয়, খোলা, প্রশ্নহীন। অতএব মাতিন শেখ বলে যায়।
—বাইকটা কিনেছি, তা ধরেন দু’মাস হল। মোহনদা বলল, ‘এই টাকায় এত ভাল জিনিস আর পাবি না।’ ঠিক। পাব না। মোহনদারা পয়সাওলা লোক। ছাড়তে পারে। ছেড়েছে। আমি তো দাম বলিনি। মোহনদাই বলেছিল।
—আচ্ছা!
—ধরেন বৈশাখের শুরুর দিকে।
—বেশ!
—জ্যৈষ্ঠ থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে না এবার?
—হ্যাঁ। মোটামুটি তাই।
—এক বর্ষার রাত্রে, আমি ঘুমিয়েছি, দরজায় শব্দ।
উঠে গেল মাতিন শেখ। চা নিয়ে এল দু’গ্লাস। সঙ্গে ময়দা ও সুজির পিঠৌ সিদ্ধার্থর সামনে রেখে বলল—খান। আমার মা এটা খুব ভাল বানায়।
সিদ্ধার্থ তুলে নিল একটি। চায়ের গ্লাস নিল অন্য হাতে। মাতিন শেখ বলল—দরজা খুললাম। দেখি মোহনদা। পেছনে একটি মেয়েমানুষ। মুখ ঢাকা। মোহনদা বলল, ‘কিছুক্ষণ তোর ঘরটা আমার চাই।’ আমি বললাম, ‘আমি কোথায় যাব এই বৃষ্টিতে?’ বলল, ‘যাঃ! শুয়ে পড় বিছানার নীচে। আমি না ডাকা পর্যন্ত বেরুবি না।’ চলে গেলাম নীচে। ঠান্ডা মাটির মেঝেতে শুয়ে থাকলাম। আর বিছানায় সব চলতে লাগল। হয়ে গেলে, চলে গেল ওরা। যাবার আগে বলল, ‘কেউ জানতে পারলে বাকি হাতটাও যাবে তোর মাতিন।’ ওই শুরু। এ পর্যন্ত ওরা এসেছে দশদিন। মেয়েমানুষটাকে চিনে নিয়েছি আমি। ওই আখড়ার মেয়েছেলে! তখন বুঝলাম আখড়ার গোলমাল কেন ঠেকিয়েছিল মোহনদা। সে যা হোক, মোহনদার ব্যাপার মোহনদা বুঝবে। আমার সহ্য হচ্ছে না আমার ঘরে এইসব। আমার যদি আর একটা ঘর থাকত তা হলে কিছু ভাবতাম না। আসছে, করছে, ঠিক আছে। কিন্তু আমাকে বিছানার নীচে রেখে ওপরে নাদানাদগি, এসব কী! আর কারও ঘরে তো যেতে পারল না? কেন? না ওদের বিবি-বাচ্চা আছে। ওদের শরীর আছে। আর আমার শালা শরীর নেই! আমি শালা একটা কুত্তার অধম আছি। ঘরে কুকুর থাকলেও তো মানুষ সমঝে চলে, নাকি? বলেন? আমার সামনে মেয়েছেলেকে লাগানো যায়! আমার অপমান লাগে না? বলেন? আমাকে একটা… আমাকে একটা… মানুষের মর্যাদা দিল না মোহনদা! হ্যাঁ? বলেন?
সিদ্ধার্থ পিঠে নামিয়ে রেখেছে। খেতে পারছে না। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখেছে। খেতে পারছে না। মাতিন শেখ হাঁপাচ্ছে। তার চোখ জ্বলছে। তার কাটা হাত দুলছে অবিরত। সে বলছে—রাতে ঘুম হয় না। শরীরে জ্বালা-যন্ত্রণা হয়। মাথায় জ্বালা-যন্ত্রণা হয়। বারে বারে কুকর্ম করি। আপনার কাছে লুকোব না। কুকর্ম করি। আমি তো একটা মানুষ। একটা জোয়ান পুরুষ তো আমি। জেগে থাকি। কখন ওরা আসে। এলে ঘুম হয় না, না এলেও ঘুম হয় না। ইচ্ছে করে নিজের ঘরে নিজে আগুন লাগিয়ে দিই। ভেঙে ফেলি সব শালার ইট।
বজ্র-বিদ্যুতে ভরে গেল আকাশ। মৃত্তিকা বুঝি-বা লজ্জাশীলা। শ্যাওলার আবরণে ঢেকে ফেলল মুখ। বহুক্ষণ পর একটা সিগারেট ধরাল সিদ্ধার্থ। ধোঁয়া ছাড়ল অন্যমনস্কভাবে। খুব নিচু স্বরে, প্রায় ফিসফিস করে বলল— নিষেধ করে দিতে পারছ না?
—না। পারছি না
বিকৃত শোনায় মাতিন শেখের স্বর।
—বারণ করলে আমি জেলে যেতে পারি। এই গ্রাম থেকে আমাদের বাস উঠতে পারে। আগুনে পুড়ে মারাও যেতে পারি সবাই।
সিদ্ধার্থ বলে—এ বিষয়ে মোহনকে কিছু বলতে তো পারব না আমি।
—জি না। আপনাকে এত কথা বললাম, আমার বুক সাফা হল। আমি বেঁচে গেলাম। না হলে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম সিধুদা। আর, আমি যে নিমকহারামি করিনি, তা জানাবার জন্যও বললাম। আমি, একটা পৌনে পাঁচ ফুটিয়া মাকুন্দে লোক, কিন্তু আমারও তো ইমান আছে সিধুদা। বলেন?
—আছেই তো।
সিদ্ধার্থ সিগারেট শেষ করে। ঠান্ডা চায়ের সঙ্গে শক্ত পিঠে খায়। তারপর উঠে পড়ে। বলে—তুমি যেয়ো তা হলে। সামনের সপ্তাহে থাকব আমি। যদি না আসতে পারো তো পরে সুবিধেমতো যেয়ো।
—জি সিধুদা! আমার মনটা আজ ভরে গেল জানেন। এতক্ষণ কথা বললেন আপনি আমার সঙ্গে! আমি আজ অন্য মানুষ হয়ে গেলাম!
—আসি মাতিনভাই!
—আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি?
—না না। আমি চলে যাব।
আখড়ায় আর যাওয়া হল না। বাড়ির পথ ধরল সিদ্ধার্থ। অন্ধকার রাস্তায় একবার পেছনে তাকাল সে। দেখল অন্ধকারে মিশে গিয়ে, তার সঙ্গে দূরত্ব বাঁচিয়ে হাঁটছে একজন। সে চিনতে পারল। সফি। মির্জার ছেলেরা কর্তব্যে ভুল করে না। মির্জার প্রশিক্ষণ-ক্ষমতাকে সালাম জানায় সে মনে মনে। সম্পূর্ণ বেআইনি এবং অসৎ বিবিধ কর্মের হোতা মির্জাকে সে তার দেখা প্রথম সারির মানুষের মধ্যে রাখে। মির্জা তার অন্যতম শক্তি। অন্যতম ভরসাস্থল। অথচ ন্যায়ত, মির্জার কাজকর্মগুলি তার সমর্থন করার কথা নয়। জীবনের এই বৈচিত্রের দিকে চেয়ে সে বিস্মিত হয়ে যায় বারংবার! সত্য সরল, তবু জটিল। সত্য স্বচ্ছ, তবু দুর্বোধ্য!
সে কাঁধ তুলে ঘাড় দিয়ে ছাতার বাঁট চেপে ধরে। একটা সিগারেট ধরায়। ডপ্ ডপ্ শব্দে গাছ হতে জল পড়ে বড় বড় ফোঁটায়। সে সিগারেটে টান দিতে দিতে এক আশ্চর্য দেশের স্বপ্ন দেখে। যে-দেশ তারা গড়ে তুলবে একদিন। যে-দেশে মির্জার মতো মানুষকে চোরাচালানের আশ্রয় নিতে হবে না। যে-দেশে মির্জা তার অসামান্য পরিচালন-ক্ষমতাকে প্রয়োগ করতে পারবে অনেক বড় কাজে।