রাজপাট – ১০৭

১০৭ 

আষাঢ় মাসে ফতেমা গো
করুইন বড় আশা। 
দুই পুত্ৰ দিয়াছে আল্লা 
খেলিতাইন তারা পাশা। 
দিন ত গেল অবশেষে 
বেইল ত বেশি নাই। 
আইজকা অব্দি ইমাম উছেন 
কোথায় রইল দুই ভাই ি 
হায় হায় রে—
আয়রে ও আয়রে উছেন আয় আয় 
মায়েরই কোলে। 
আইছ রে আঙ্গিনার মাইঝে 
তুইল্যা লইব কোলে ॥ 
তর মায় ফইরাদি আইল 
ওই আল্লার দরবারে। 
হায় হায় রে—

.

শুকিয়ে যাওয়া, কুঁকড়ে যাওয়া নদীগর্ভ ভরে উঠছে ধীরে ধীরে। অল্পে অল্পে পূর্ণ হচ্ছে জলাশয়গুলি। জলের ভিতর মাছেরা গর্ভবতী অথবা প্রস্তুত হচ্ছে গর্ভিণী হয়ে ওঠার জন্য। বীজের অভ্যন্তরে প্রতীক্ষায় আছে বৃক্ষাদির ভবিষ্যৎ। প্রোথিত হবে মাটির তলায়। তারপর এ ধরণীতে দাঁড়াবে সবুজ 

এই বর্ষণ আগমনে বড় বাঁচা বেঁচে গেছে কৃষিজীবী মানুষ। এক বৎসরের অনাবৃষ্টিতেই অর্ধাহারে অনাহারে দিন গিয়েছে। সামান্য সোনা-রুপা বেচে খেয়েছে তারা। থালা-বাটি বাঁধা দিয়েছে এমনকী। প্রাণ আঁকড়ে এক বৎসর বলদকে জুগিয়ে গেছে ঘাস। অনাবৃষ্টি প্রলম্বিত হলে ধীরে ধীরে সব যেত। বলদ যেত। জমি যেত। তারপর হাত পড়ত ভিটেয়। শহরের ঝোপড়িতে ভিড় বাড়াত শীর্ণ আধপেটা জীবন। 

সকলেরই এমন হয় না। কারও হয়, কারও হয় না। এমনকী রাশি রাশি পঙ্গপালে শস্য খেয়ে গেলেও যে-ক্ষতি, তাতে সব কৃষকের হৃদি স্তব্ধ হয়ে যায় না। বেশি আছে যার, সে ক্ষতি সামলে নিতে পারে। ক্ষতি দিয়েই যাদের জীবন গড়া, তারা পড়ে মুখ থুবড়ে 

চিরকালেরই নিয়ম এই। আর এই নিয়ম সম্বল করেই বৃষ্টি দেখে পুলকিত কৃষিজীবী মাঝে-মধ্যে কেঁপে ওঠে শঙ্কায়। আষাঢ়ের এ বর্ষণ, কত কিছু আগাম বলে দেয়। ফলে কিছু, কিছু-বা ফলে না। আর এমন দ্বিবিধই ঘটে বলে আশঙ্কা উদ্বেগ সদা সঙ্গী হয়ে থাকে। ভগবানের এ দুনিয়ায় নিশ্চয়তা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। অতএব, আষাঢ়ের এই লাগাতার ছিকছিকানি, এরও মধ্যে আছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আভাস। 

এখন হল ধান রোয়ার সময়। কথায় বলে বৈশাখী বোনা আষাঢ়ী রোয়া, জায়গা হয় না ধান থোয়া। তাই সেই বিপুল পরিমাণ শস্যের জন্য চাই আরও আরও শর্ত। 

আষাঢ় মাসের নবমী তিথি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত শুক্লপক্ষের নবমী। এই দিনের বৃষ্টির পরিমাণের ওপর লেখা থাকে সারা বছরের বৃষ্টিপাত এবং ফসলের ইঙ্গিত। গত বৎসর সরাল গ্রামের অশ্বিনী হালদার শুনিয়েছিলেন এ বচন, সিদ্ধার্থর মনে আছে। 

।কী করো শ্বশুর লেখাজোখা।
আষাঢ়ে নবমী শুকল পাখা ।।
যদি বর্ষে মুষলধারে।
মাঝসমুদ্রে বগা চরে ।।
যদি বর্ষে ছিটেফোঁটা।
পর্বতে হয় মীনের ঘটা ।।
যদি বর্ষে ঝিমি-ঝিমি।
শস্যের ভার না সহে মেদিনী ।।
হেসে চাকি বসেন পাটে।
চাষার গোরু বিকায় হাটে ।।

.

আজ তারা তেকোনায় এসেছে। সে আর রেজাউল। তাদের পিছনে পিছনে আলাদাভাবে আছে সফি। সিদ্ধার্থ জানে। কিন্তু রেজাউল জানে না। তেকোনায় সফি থাকবে কোথায় সে জানে না। সফি বলেছে, সে দায়িত্ব তার। এই আষাঢ়ের শুক্লা নবমী পেরিয়ে যায়নি এখনও। তিথি-নক্ষত্রের হিসেব রাখে না সিদ্ধার্থ কোনও দিন। আসার পথে রেজাউলকে জিগ্যেস করে জেনেছিল। 

রেজাউল জানে এসব। এমনকী চাষ-বাস সংক্রান্ত প্রবাদ-প্রবচন তারও জানা আছে। হরিহরপাড়া থেকে ঘোড়ার গাড়িতে আসতে আসতে সে শুনিয়েছিল কিছু। তার মধ্যে একটি যেমন ইন্দ্ৰধনু নিয়ে। 

পশ্চিমের ধনু নিত্য খরা।
পুবের ধনু বর্ষে ধারা ।।
পুবেতে উঠিলে কাড়। 
ডাঙা-ডোবা একাকার ।।

বৎসরের প্রথম হলকর্ষণ কখনও করতে নেই পূর্ণিমায় বা অমাবস্যায়। এ বিষয়ের বচন হল—

পূর্ণিমায় অমায় যে ধরে হাল। 
তার দুঃখ সর্বকাল ।।
তার বলদের হয় বাত। 
ঘরে তার না থাকে ভাত ।।
খনা বলে—আমার বাণী।
যে চষে তার হবে হানি ।।

অনেকের ব্যাখ্যা—শুধু প্রথম হলকর্ষণই নয়। কোনও পূর্ণিমা বা অমাবস্যা তিথিতেই হাল ধরা অনুচিত। 

হতে পারে গবাদি পশুকে বিশ্রাম দিতেই এই নিয়ম। অবোলা পশুর জন্যও তো চাই কিছু বিশ্রাম ও খাদ্যের কানুন। আর গোরু হল চাষির সম্পদ। গাভী হল সকল মানবজাতির সম্পদ। চাষির কিন্তু বলদ ছাড়া চলে না। বড় কৃষক, যাঁরা ট্রাক্টর কিনে ফেলতে পারেন, তাঁদেরই একমাত্র বলদের প্রয়োজন নেই। 

সেইদিন এখনও বহু দূরে, যখন সাধারণ কৃষকের ঘরে গোহালের পরিবর্তে থাকবে ট্রাক্টরের গ্যারাজ। তাই গোরু কেনার বিষয়ে যে প্রবচন, তা জানতেই হয়। 

ন’ঘর ছ’ঘর ভাগ্যে পাই।
সাতুল দেখে দূরে পলাই ॥
গোরু চিন্ বা না চিন্।
ধলা ঘুঁচি দেখে কিন ॥

ন’দাঁতের বা ছ’দাঁতের গোরু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু সপ্তদন্তী ক্রয় করা উচিত নয় কখনও-ই। অন্য আর সবই বোঝা যাক বা না যাক, শ্বেতাভ পালান দেখে নেওয়া অবশ্য কর্তব্য। অতএব, গোরু-গাভী কেনার সময় খরিদের প্রাথমিক শর্তই হল মুখ হাঁ করিয়ে তার দাঁত গুণে নেওয়া। 

এমত সমস্তই এক জানার বিষয়। সিদ্ধার্থও আসছিল এমনই জানকারির ভিতর। এখন তেকোনায় আসার পরিকল্পনা রেজাউলের। হারাধনের অভাব সে বোধ করে পূর্ণমাত্রায়। অন্তত অবশিষ্ট দু’জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটাবার আকুলতায় সে রেখেছিল এই প্রস্তাব। 

সিদ্ধার্থ সন্দিহান। সে জানে না, কতখানি পূর্ণ হবে রেজাউলের অভিলাষ। সে বলেনি রেজাউলকে যে, মোহনলাল এর মধ্যে শহরে এসেছিল এবং তার সঙ্গে দেখা না করেই চলে গেছে। অতএব, কিছু-বা রূঢ়তার মুখোমুখি হতে পারে তারা, সে প্রস্তুত হয়েই এসেছে। এবং একপক্ষে ভাল হল, এমনই মনে হচ্ছে তার। মোহনলালের সঙ্গে মুখোমুখি সে হবে। তাদের উভয়ের পক্ষেই এই দেখা হওয়া নতুনতর সম্পর্কের সূচনা হতে পারে। 

আসতে আসতে দেখছিল সে। সারা পথ পিচ্ছিল। কর্দমময়। এই পথ প্রচুর ব্যয়ে সারানো হয়েছিল, সিদ্ধার্থ জানে। বর্ষা আসতে না আসতেই তা হয়ে গেছে পূর্ববৎ। সর্বত্র একই ছবি। একই পরিস্থিতি। পথ, ঘাট, সেতু, বাঁধ, স্পার, বাড়ি, যন্ত্র—সব সব সমস্ত সারানো হয় বহু অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু সারে না কিছুই। লেগে থাকে রোগ। ক্ষয় লেগে থাকে। এবং এতদ্দর্শন সত্ত্বেও বিষণ্ণতা পাশে রেখে সহসা হৃদয়ে লাগে আনন্দের দোলা। এবং আনন্দের পাশাপাশি পাথুরে বিষাদ। নন্দিনীকে দেখতে পাবার আনন্দ তার। আবার, এই প্রথম, এ বাড়িতে নয়াঠাকুমা নেই, এমন পরিস্থিতিতে সে আসছে। এমনকী কাজের অছিলায় শ্রাদ্ধবাসরও সে এড়িয়ে গিয়েছিল। নয়াঠাকুমার মৃত্যুর চেয়েও গাঢ়তর বিষাদ তাকে ঢেকে ফেলেছিল ধুলামাটি গ্রামে। 

দেউড়ি দিয়ে ঢুকছে যখন তারা, এক ঘোমটা-ঢাকা নারীমূর্তি দ্রুত পায়ে তাদের পাশ কাটিয়ে গেল। আকাশের চাপ-চাপ কালচে মেঘের নীচে, ঝিমি-ঝিমি বারিপাতের মধ্যে, সেই নারী, শীর্ণ দেহকাঠামো জীর্ণ শাড়িতে ঢেকে, যেন দুটি বৃষ্টিফোঁটার মধ্যে মধ্যে গলে চলে গেল ত্বরা করে। ছাতা নেই মাথায়। চটি নেই পায়ে। সেই নারী হতে চোখ তুলে ওপরে তাকাতেই তার মনে হল, যেন নয়াঠাকুমা এখুনি দাঁড়িয়েছিলেন ওই জানালায়। অতি স্পষ্ট সে দেখা। তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে দেখল, রেজাউল তাকিয়ে আছে জানালার দিকে। সে বলল—চল। ভেতরে যাই। 

তার দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাশে হাসল রেজাউল। বলল—মনে হল উনি দাঁড়িয়ে আছেন।

—কে? নয়াঠাকুমা? 

—হুঁ!

—আমারও মনে হয়েছিল। নয়াঠাকুমাকে ছাড়া এই বাড়ি যে কল্পনাও করা যায় না রেজাউল। তাই আমরা দেখলাম। হয় এরকম। চল। 

—চল। 

—একটা কথা… 

সিদ্ধার্থ, রেজাউলের হাত টেনে ধরে। 

—কী? 

—আমি জানি না রেজা, মোহন আমাকে কীভাবে নেবে! 

রেজাউল বলে—কেন? পার্টি ছেড়েছিস বলে? 

—তাই-ই। 

—পার্টির সঙ্গে বন্ধুত্বের কী? 

—তবুও! 

—বেশ তো। দেখি না! 

—দেখি! 

ছাতা বন্ধ করে সিঁড়ির নীচে রেখে দিল তারা। তারপর ধাপে ধাপে উঠতে লাগল। মেঘের কারণে ভেতরটা অনুজ্জ্বল। সিঁড়ির কাছটা অন্ধকারই বলা যায়। সিদ্ধার্থর মনে হল, এ ঘর বড় বেশি চুপচাপ। এই গৃহ বড় বেশি নিঃশব্দ। কে আছে বাড়িতে? নন্দিনী। একা নন্দিনী। আর হয়তো-বা রাজিয়া। চাটুজ্যেবাড়ির বহুদিনের পুরনো কাজের মেয়ে। আর আছে রহস্যের নতুন করে জট পাকিয়ে ওঠা। 

নয়াঠাকুমা একাই সমগ্র পরিবার হয়ে বিরাজ করছিলেন। এতগুলি ফাঁকা ঘর, এত জনবিরলতা বোঝা যায়নি আগে। গম্ভীর আঁধার ঢাকা এ আষাঢ়ে এ নির্জনতা নতুনরূপে প্রতীয়মান। 

সিদ্ধার্থ ডাকল-কাকিমা! কাকিমা! 

রান্নাঘর হতে বেরিয়ে এলেন নন্দিনী। নীল রঙের তাঁতের শাড়ি পরেছেন, তাতে চওড়া লাল পাড়। কপালে বড় সিঁদুরের টিপ। ভেজা চুল ছড়িয়ে দিয়েছেন পিঠময়। এই আষাঢ়ের নীলাঞ্জন-ছায়ায় তাঁকে দেখাচ্ছে অপরূপা। সিদ্ধার্থর মনে হল, নয়াঠাকুমা থাকলে এখন বলতেন—ছি ছি! চুল খুলে রান্নাঘরে গিয়েছ বউমা! এ কী অলক্ষ্মীপনা! 

কিংবা বলতেন—যাও যাও! দাঁড়িয়ে থেকো না নন্দিনী! ওদের জন্য রান্না চাপাও গে। এখন কি তোমার গল্প করার সময়? 

আজ নয়াঠাকুমা নেই। আজ নন্দিনী একা। কী উদ্ভাসিত তাঁর মুখ! সিদ্ধার্থর মনে হল, এই বিভা যেন প্রকাশিত হতে পারেনি এতদিন। মায়ের কথা তার মনে পড়ল। নিত্য-নতুন তাঁতের শাড়ি পরতে ভালবাসতেন তিনি। সে যখন স্কুল থেকে ফিরত, দেখত এমনই, একেকদিন একেক রঙের শাড়ি, এমনই খোলা চুল, সিঁদুরের টিপ, তার যে কী ভাল লাগত! সিঁদুর হতে, চুল হতে, তাঁতের শাড়ি হতে, মায়ের শরীর হতে বেরিয়ে আসত অসামান্য গন্ধ। বিশ্বের সেরা সুগন্ধীকেও তা হার মানায়। সে ফিরত মায়ের পাশে পাশে। মায়ের শাড়ির খস্থস্ শুনত। মাঝে মাঝে অকারণেই বলত মা! ও মা! ও মা! 

মা বলতেন—কীরে! 

সে বলত—–এমনিই 

আজ, এতদিন পর, নন্দিনীকে দেখে, তার গলার কাছে ব্যথা করে উঠল। ইচ্ছে করল, সেইরকম করে ডাকে—মা! ও মা! ও মা! 

তখন নন্দিনী বললেন—আয়! বোস! ঠাকুমা নেই বলে আসতে নেই বুঝি! 

ঘেরা বারান্দায় তেমনই সাজানো একখানি চেয়ার। মোড়া। যেন নয়াঠাকুমা এখুনি এসে বসবেন। 

সিদ্ধার্থ বলল— না। সময় পাইনি কাকিমা। 

—হ্যাঁ। তুই খুব ব্যস্ত। ওঁর কাছে খবর পাই। রেজাউলও তো আসে না। হ্যাঁ রেজাউল, তোমার বাচ্চারা ভাল আছে তো? 

—জি। সবাই ভাল। মোহন কোথায়? 

—হরিহরপাড়ায় গিয়েছে। ওর স্কুলের চাকরিটা তো হয়ে গেছে, জানিস তো? 

সিদ্ধার্থ বলল—না। জানি না তো। ভাল হয়েছে। 

—ও বহরমপুরে গিয়ে তোর সঙ্গে দেখা করেনি, না? 

সিদ্ধার্থ ম্লান হাসল। মাথা নাড়ল। 

নন্দিনী এ নিয়ে আর কথা বললেন না। পিঠময় ছড়ানো চুল তুলে খোঁপা করলেন। বললেন—সামনের অঘ্রানে বিয়ে দেব মোহনকে। 

—ওখানেই? 

—হ্যাঁ। 

নয়াঠাকুমার চেয়ারে বসেছেন নন্দিনী। তারা দু’জন মোড়ায় বসেছে। বাইরে আর বৃষ্টি নেই। আকাশে মেঘ থমকে আছে। নন্দিনী বলছেন—আমি চলে যাব এ মাসেই বহরমপুরে।—

—ওখানেই থাকবে? 

—হ্যাঁ। উনি আর একা থাকতে পারেন না। এ বাড়িতে আমারও আর প্রাণ ঢেঁকে না। খাওয়া আর ঘুমের সময়টুকু ছাড়া মোহন বাড়িতে থাকে না। মা নেই। এ বাড়ি যেন খাঁ-খাঁ করে। এতগুলো বছর কাটল তো ওই মানুষটার সঙ্গেই। ওঁকে ছাড়া কীভাবে বাঁচতে হয়, তা-ই যেন ভুলে গিয়েছিলাম। ক’দিনের জন্য বাপের বাড়ি গেলেও মনে হত, সারাক্ষণ উনি পাশে পাশে আছেন। এটা-ওটা বলছেন। এখনও তাই মনে হয়। উনি যেন সর্বত্র আছেন। সারাক্ষণ মনে হয়, এই বুঝি ডাকলেন, নন্দিনী, বউমা! ভুল করে সাড়া দিয়ে ফেলি কতবার! রাজিয়া বলে, কী করছ বউদি! কে ডাকল তোমায়! আমি জানি, কেউ ডাকুক না ডাকুক, আমি ঠিকই শুনতে পাই। শোনাই যে আমার অভ্যাস। 

কথা বলতে বলতে সোজা হয়ে বসেছেন নন্দিনী। সিদ্ধার্থর মনে পড়ে না, এভাবে একটানা নিজের কথা বলেছেন কখনও নন্দিনী। সে দেখল, নন্দিনীর চোখ থেকে জল পড়ছে। আঁচলে চোখ মুছে তিনি বললেন— তোদের ভালবাসতেন উনি। তোরা এলে কত খুশি হতেন। বলতেন, ‘ইচ্ছে করে, ছেলেগুলোকে রেখে দিই।’ ছেলেপিলে লোকজন ভালবাসতেন মানুষটা। অথচ কতগুলো বছর এই এক আমাকে নিয়েই তো কাটালেন! গ্রামের কত লোক ধার নিয়ে গেছে ওঁর কাছে। কেউ ঘটি-বাটি বাঁধা দিত। কেউ ওমনি নিত। ওঁর খাটের নীচে এখনও এক ট্রাঙ্ক জিনিসপত্র। সব বাঁধা দেওয়া থালা-বাসন। কোনটা যে কার, তা উনিই জানতেন। ওঁর কাছেই লোক আসত। সুখ-দুঃখের কথা বলত। এখন উনি নেই। লোকও প্রায় আসেই না। ধার চাইতেও আসে না। আমার কাছে কে চাইবে? আমি তো তেমন করে মিশলামই না এ গ্রামের সঙ্গে। ঘরের মধ্যেই দিন কাটল। 

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। সিদ্ধার্থর মনে হল, এই কথাগুলোর মধ্যে গভীর অভিমান আছে। ক্ষোভ আছে। যেন এ গ্রামের মানুষের মধ্যে মিশে যাবার ইচ্ছা তাঁর প্রবল ছিল। কিন্তু তা প্রতিহত হয়েছে। শাশুড়ির উত্তরাধিকার তিনি পেতে পারতেন। হতে পারতেন গ্রামের বউ- ঝিদের গোপন বলভরসা! কিন্তু হল কোথায়? তার মনে আছে, নন্দিনী বলেছিলেন, তাঁর অনেক কথা আছে। তিনি সিদ্ধার্থকে বলবেন কোনওদিন। আজও মনে হচ্ছে, বহু কথা তাঁর বুকের মধ্যে আটকে ছিল। প্রথম সুযোগেই তা অনর্গল বেরিয়ে আসছে। মনে পড়ল, তারা যখন ঢুকছিল এ বাড়িতে, তখন এক অবগুণ্ঠনবতী মহিলার ত্রস্তে চলে যাবার কথা। এমনভাবে লোকে আসে কখন? যায় কখন? সে বলল— কাকিমা, এই তো ছোট গ্রাম। তুমি চাইলে, এখনও সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারো। 

নন্দিনী ম্লান হাসলেন। বললেন—তা পারি। এই তো, জোছনা আরা এসেছিল একটু আগে। তোরা এলি, তখনই। একটা কাঁসার বাটি বাঁধা দিয়ে টাকা নিতে এসেছিল। আমি বাঁধা নিইনি। তিরিশটা টাকা। এমনিই দিয়ে দিলাম। বউটা কেঁদে ফেলল। বলল, ‘তুমি কি আমাকে চেনো?” বললাম, ‘না। চিনি না।’ সে বলল, ‘আমি আসগর মোল্লার বড় বিবি। আমার স্বামী কংগ্রেস করেন বলে মোহনবাবুর খুব রাগ। তা মায়ের কাছে এর আগে টাকা নিয়েছি আমরা। লোকে বলে, তুমি নাকি ধার-টার দেবে না। তোমার নাম তো দেমাকি বউ। তবু আমি সাহস করে এলাম। কই তুমি তো আমাদের মায়ের মতোই ভাল। বলব। সবাইকে বলব আমি। টাকা ফিরত দিয়ে যাব। দেখো তুমি।’ হয়তো এবার আস্তে আস্তে আরও অনেকেই আসবে। আজ ত্রিশ-বত্রিশ বৎসর হল দেমাকি বউ অপবাদ নিয়ে আছি। তা-ও ঘুচে যাবে। কিন্তু ওই জোছনা আরাকে টাকা দিয়ে আমার কী মনে হল জানিস? 

—কী? 

—আমি যেন মায়ের ভূমিকায় চলে যাচ্ছি ক্রমশ। মা মরে যাওয়ায় সে আসন শূন্য হয়েছিল, আমি তার অধিকার নিচ্ছি। ক’মাস পরে আমার ছেলের বিয়ে হবে। আমি শাশুড়ি হব। একইভাবে আমি… না না! সিধু, আমার মনে হচ্ছে, মা আড়াল থেকে আমাকে পরিচালিত করছেন, যেমন করতেন সারাক্ষণ! 

—তোমার বহরমপুরে চলে যাওয়াই উচিত কাকিমা। 

—হ্যাঁ। চলে যাব। এ মাসেই। 

রেজাউল বলল—মোহন একা থাকবে? 

—হ্যাঁ। ওর কোনও অসুবিধা হবে না। এই তো ক’টা মাস। তারপর বউ এসে যাবে। রাজিয়া রইল। ও তো সব পারে। মুনিষরা রাতে থাকে। আমাকে ছাড়াই তো মোহন বড় হয়ে গেল রেজাউল। 

নন্দিনীর কথার মধ্যে ব্যথিতের সুর। সিদ্ধার্থ তাকে হালকা করতে বলল— আহা! কী আনন্দ! রোজ হামলা চালাব তোমার বাড়িতে। যা ইচ্ছে খেতে চাইব। তুমি রেঁধে খাওয়াবে। 

নন্দিনী বললেন—ও তোর কথার কথা। কাজের চাপে ভুলেই যাবি। তোকে আমি চিনি না? রেজাউল বলল—আমি কিন্তু বিবি-বাচ্চা নিয়ে আসব। 

—একা এলে তোকে কিছু খাওয়াব আমি? 

নন্দিনী উঠলেন—তোরা স্নান করবি তো? 

—করব। 

—যা। মোহন সন্ধের আগে আসবে না। তোরা থাকবি তো আজ? 

—থাকব। 

.

দুপুরে যথারীতি পোস্তর বড়া ছিল পাতে। সঙ্গে বেগুনের ভর্তা, চুনো মাছের চচ্চড়ি, ছোলার ডাল এবং ডালের বড়া দিয়ে পেঁপের ডালনা। 

তাদের খাওয়াতে বসিয়ে কথা বলছিলেন নন্দিনী। সিদ্ধার্থর কষ্ট হচ্ছিল নন্দিনীর জন্য। কথা বলতে এত ভালবাসেন মানুষটা, আগে কখনও বোঝা যায়নি। যদিও নন্দিনীর কথার সমস্তই ছিল নয়াঠাকুমাকে ঘিরে। কী খেতে ভালবাসতেন তিনি, কী করতেন, কী বলতেন। 

প্রায় তিরিশ-বত্রিশ বছর ধরে গড়ে ওঠা সম্পর্ক, এ তো বন্ধুত্ব নয়। বরং, সিদ্ধার্থ দেখেছে, কোথাও একটা প্রভুত্ব ছিল নয়াঠাকুমার, নন্দিনীর ওপর। নন্দিনীরও সমস্ত অস্তিত্বের মধ্যে ছিল এক অসুখী প্রকাশ। দাঁতে দাঁত চেপে মেনে নেওয়া জীবন। তবু কী নিবিড় ছিল ওই সম্বন্ধ! যাকে নন্দিনী এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পর্যন্ত পারছেন না! শুধুমাত্র বসবাসের অভ্যাসেও গড়ে ওঠে অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠতা? নাকি এ ঘনিষ্ঠতাই! এর মধ্যে অন্তর কোথাও নেই। কেবল তর্জনী ও অবনত মাথার সম্পর্ক যেমন। বন্দির সঙ্গে সান্ত্রীর সম্পর্ক যেমন। 

খাওয়া সেরে সিদ্ধার্থ বেরুল বরকত আলির সঙ্গে দেখা করার জন্য। রেজাউল এল না। এমন ধ্যানগম্ভীর আঁধারতর দুপুরে সে নন্দিনীর সঙ্গে কথা বলে কাটিয়ে দেওয়াই মনস্থ করেছে। শরীর চাইলে একটু ঘুমিয়েও সে নিতে পারে। চতুষ্কোনা পেরিয়ে পেতনির চরে তার জীবন অতি পরিশ্রমের। এখন এতটুকু অবসরের সুযোগ সে ছাড়তে রাজি নয়। সে বলে-আমি আসলে বদ অলস। কাজ না করলে খেতে পাব না, আব্বা পিটবে, তাই কাজ করি। 

.

পেতনির চরের সমস্ত লোক সিদ্ধার্থকেই তাদের আন্দোলনের দায়িত্ব দিতে চায়। রেজাউলের দৃঢ় বিশ্বাস, একমাত্র সিদ্ধার্থর মাধ্যমেই তাদের আন্দোলন সফল হবে। কারণ সিদ্ধার্থ এই সাফল্য আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করে। সমস্ত দাবি-দাওয়া সমেত আন্দোলনের যে-সূচনা সে করেছে, তা লোক-দেখানো মাত্র ছিল না। রেজাউল জানে, লক্ষে না পৌঁছোনো পর্যন্ত সিদ্ধার্থ থামে না। থামবে না। 

তেকোনায় আসার পথে কিছু কিছু পরিকল্পনার বিষয়ে কথা বলেছিল তারা। সিদ্ধার্থ চায়, গ্রামে গ্রামে মেয়েদের কিছু সংগঠন হোক। যারা ধীরে ধীরে নারীপাচার বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলবে। প্রাথমিক পর্যায় হিসেবে তারা শুধু সতর্ক করার কাজটি করতে পারে। সেইসঙ্গে একটি পর্যবেক্ষণ পরিকাঠামোও তারা গড়ে তুলবে। কারণ, শুধু নারীপাচারের দুষ্টচক্র সম্বন্ধে বা এই সামাজিক অপরাধ কতখানি গর্হিত ও নির্মম এইটুকু বোঝালেই সমস্যার সমাধান হবে না। অনেক ক্ষেত্রেই বাবা-মায়েরা দালালের হাতে মেয়েদের তুলে দেয় যে আপাত অনুষ্ঠান বা প্রতিশ্রুতিকে সাক্ষী করে, যেমন বিবাহের মাধ্যমে বা চাকুরি দেবার ছলনায়, সেই সমস্তই তারা করে জেনেশুনে, চূড়ান্ত দারিদ্রের চাপে। 

অর্থাৎ দারিদ্র। দারিদ্র এবং অজ্ঞতা। অতএব, শুধু অজ্ঞতা দূরীকরণই নয়, চাই দারিদ্র্য হতে মুক্তি। চাই উপার্জনের অবলম্বন। 

এ কাজে এগিয়ে এসেছে বেশ কিছু বেসরকারি সমাজ-উন্নয়নমূলক সংগঠন। কিন্তু তাদের কাজ ব্যাপক নয়। স্থানীয় সংগঠনগুলি যুগ্মভাবে কাজ করলে যে-কোনও পরিকল্পনার রূপায়ণ ত্বরান্বিত করা যায়। 

মেয়েদেরই প্রয়োজন এ কাজের জন্য কারণ রক্ষণশীল পরিবারগুলির অন্দরে গিয়ে কাজ করার বা কথা বলার সুযোগ তাদের থাকে। অতএব সতর্কীকরণের পাশাপাশি যে-কাজ তারা করতে পারে, তা হল, প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ। কী কী ধরণের কাজ এই দরিদ্র পরিবারগুলিকে দিয়ে করানো যায়। কার কী বিষয়ে দক্ষতা আছে। কোনও বিশেষ কুটির শিল্প কারও জানা আছে কি না। বা কোনও বিশেষ শিল্পের প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব কি না। 

সরকারিভাবে এ কাজ করার বিবিধ পরিকল্পনা আছে। কিন্তু তার রূপায়ণ হয় নামমাত্র। সিদ্ধার্থ চায়, কোনও সরকারি নির্ভরশীলতা নয়, জনগণের নিজের মধ্যে তৈরি হোক প্রেরণা। নিজেদের মধ্যে প্রেরণা জাগলে সরকারের গাফিলতিময় দীর্ঘসূত্রী প্রকল্পও সফল করা সম্ভব। তার জন্য সময় দরকার। ধৈর্য দরকার। দরকার আর্থিক উপায়। সেজন্য প্রস্তুত হতে চায় সে। এবং চায়, মেয়েদের একটি সংগঠন। নিবেদিতা বাগচির ওপর সে দিতে চায় এই দায়িত্ব। আর এই দলে সে চায়, যোগ দিক, রেজাউলের স্ত্রী। 

রেজাউল এ কাজে তার স্ত্রীকে যেতে দিতে সম্মত আছে। রওশন, তার বিবি, বুদ্ধিমতী মেয়ে। সে ভরসা রাখে, রওশন এইসব কাজ করতে পারবে ভাল। কিন্তু তাকে কথা বলতে হবে বাড়িতে। সে আশা রাখে, বাড়িতে আপত্তি না-ও হতে পারে। কারণ সিদ্ধার্থর প্রতি তাদের আছে আস্থা ও নির্ভরতা। সিদ্ধার্থ এমন কিছু করতে বলবে না, যা রওশনের পক্ষে অসম্মানজনক হতে পারে। 

সে ভেবেছিল, সিদ্ধার্থ বুঝি-বা বিবিধ কাজের চাপে ভুলে গেছে কমলির কথা। সে বিস্মিত হয়েছিল। কারণ, সিদ্ধার্থর সম্পর্কে তার ধারণা এমনই, সে ভোলে না কিছুই। ভোলেনি। 

.

রেজাউলকে রেখে একাই বেরিয়ে এল সিদ্ধার্থ। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে আবার। সে দ্রুত পা চালাল বরকত আলির বাড়ির দিকে। নানারকম সম্ভাবনার কথা মাথায় ঘুরছিল তার। হতে পারে বরকত আলি বাড়িতেই নেই। উঠোনে পা দিয়ে সে ডাকল— চাচা! আছেন নাকি? 

দোতলার বারান্দায় দাঁড়ালেন বরকত আলি। সহর্ষে বললেন—আরে আসো আসো! অনেকদিন পরে এসেছ। ভিতরে এসো। 

এই প্রথম বরকত আলির বাড়ির দ্বিতলে এল সে। বৃষ্টির কারণে সকল জানালা বন্ধ বলে ঘরে অন্ধকার। সিদ্ধার্থ বলল— আপনার বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটালাম কি? 

—না না! ব্যাঘাত কী! এখন তো আমার মাঠে থাকার কথা। ক’দিন শরীরটা ভাল নাই।

—কী হয়েছে? একবার শহরে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে নেবেন? 

—না বাবা! অত উতলা হওয়ার মতো কিছু নয়। আসলে, মনেও যেন ইচ্ছা লাগে না। বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেছে বাবা আমার ঘরে। ভাবলে কোনও কার্যে হাত দিতে মন চায় না। 

সিদ্ধার্থ নীরবে চেয়ে ছিল বরকত আলির দিকে। প্রশ্ন করতে পারছিল না, কী হয়েছে! পারিবারিক কোনও দুর্ঘটনা বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ করা ঠিক নয়। 

বরকত আলি বলে চললেন—তোমার মিছিল সফল হয়েছে। হবে আমি জানতাম। মানুষ তোমাকে চায় সিদ্ধার্থ। আমি যেতে পারি নাই মিছিলে। তবে সকল শাসন অগ্রাহ্য করে অনেকে গিয়েছিল। সকল দলের সমর্থক গিয়েছিল। দল ছেড়ে দেবার পরে তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হয় নাই। 

সিদ্ধার্থ বলল— হ্যাঁ। মিছিলের প্রচারে তৌফিক এসেছিল এখানে। আমি আসতে পারিনি।

—তৌফিকের সঙ্গেও আমার দেখা হয় নাই। কারণ সে যেদিন এসেছিল, আমি ছিলাম না। 

—ও! 

—কী জানো সিদ্ধার্থ, তুমি দল ছেড়েছ শুনে প্রথমটায় বড় খারাপ লেগেছিল। মনে হয়েছিল তুমি আমাদের সঙ্গে মিরজাফরি করলে। বিশ্বাসঘাতকতা করলে তুমি। 

সিদ্ধার্থ চুপ করে আছে। শুনছে। বরকত আলি বলছেন—দল ছেড়ে যাওয়ার অর্থ বুঝিনি। পরমেশ্বর সাধুখাঁ পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তাঁকে হত্যা করার ওই নারকীয় পরিকল্পনা কখনও সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু প্রমাণ তো হয়নি সি পি এম-এর কেউ তাঁকে মেরেছে! রাজনীতি যারা করে, তাদের প্রতি বহুজনের বহুরকম আক্রোশ থাকে। সি পি এম-এর মিছিলকে ব্যবহার করে কেউ আক্রোশ মিটিয়েছে! তার জন্য তুমি দল ছাড়বে কেন? আমরা কি তা হলে সবাই খারাপ? অনেক ভাবলাম। পরে মনে হল, না, সিদ্ধার্থ ঠিকই করেছে। বড় একটা গাছকে আশ্রয় করে আছি আমরা। সে-গাছের ডালে পচন লাগলে আমাদের নিরাপত্তার স্বার্থে তা কেটে ফেলা উচিত। কিন্তু যদি কাটা না যায়? ওই একটা ডাল থেকে পুরো গাছে পচন লাগার সম্ভাবনা যদি থাকে? তখন অন্য কোনও সুস্থ গাছের সন্ধানে যাওয়াই ভাল। সিদ্ধার্থ ঠিকই করেছে। কিন্তু এর পরেও ধাঁধা লাগল। ভাবতে লাগলাম, সুস্থ গাছ কে? কংগ্রেস? বি জে পি? আর এস পি? আমরা বাঙালি? মুসলিম লিগ? কে? জানি না কাকে আশ্রয় করবে তুমি শেষ পর্যন্ত! কেন করবে! তোমার অনেক শক্তি। শেষ পর্যন্ত তুমি কি নিজেই গড়ে তুলবে কোনও দল? তাতে কতটুকু শক্তি পাবে? ধরো ফরোয়ার্ড ব্লকের কথাই। নামে একটি জাতীয় দল। সংগঠনও খুব ছোট নয়। কিন্তু কী তাদের শক্তি? কতটুকু? তোমার ওপর ভরসা আছে আমার। তুমি বিরাট হয়ে ওঠো। বিরাট হতে পারলে, তবেই ভেঙে বেরুবার সিদ্ধান্ত মর্যাদা পাবে। 

সিদ্ধার্থ বলল— আপনার আশীর্বাদ চাই। সহযোগিতা চাই চাচা। 

—আশীর্বাদ সবসময় আছে বাবা। সহযোগিতাও করব নিশ্চয়ই। তবে কিনা এই বয়সে দল ছাড়তে পারব না। তিরিশ বৎসরের এ সম্পর্ক। ছাড়তে পারব না। তোমরা তরুণ, তোমরা যা পারো, আমরা পারি না। তবে রাজনীতি থেকে সরে যাব আমি। প্রত্যক্ষ রাজনীতি আর করব না। আর যে-কোনও ভাল কাজে লাগার জন্য রাজনৈতিক দলের পরিচয় বড় কথা তো নয়। 

—না। তা নয়। আমি বলব না দল ছাড়ুন আপনি। রাজনীতি থেকে সরে যান বলব না। আমি চাই আপনি থাকুন। রাজনীতির জগতে আপনার মতো মানুষ প্রয়োজন। 

—না বাবা না। আমি আর কী! সামান্য মানুষ! তুমি কি তা হলে আলাদা দল গড়াই মনস্থ করলে? 

—জানি না চাচা। আলাদা দল, আলাদা নাম, এসবের প্রয়োজনীয়তা কত, এখনও জানি না। কখনও মনে হচ্ছে, ক্ষমতা দরকার। প্রভূত ক্ষমতার জন্য আগ্রাসী হওয়া দরকার। না হলে বিরুদ্ধ ক্ষমতার দ্বারা ধ্বংস হয়ে যাব। কখনও মনে হচ্ছে, জনগণের জন্য গড়ে তুলতে হবে জনগণের আন্দোলন। তার জন্য দল মুখ্য হবে কেন? 

—কাজে শৃঙ্খলা আনার জন্য, নিয়ন্ত্রণ আনার জন্যও তো দল গড়ে তোলা দরকার। তা ছাড়া তোমার ক্ষমতা না থাকলে সাধারণ মানুষ তোমার ওপর নির্ভর করবে কেন? 

—ঠিক। ঠিকই! তবু আমাকে ভাবতে হবে আরও। 

—ভাবো। তবে বেশি সময় নিয়ো না। বেশিদিন চুপচাপ থাকলে লোকের মন থেকে তুমি মুছে যাবে। তখন তোমার কাজ কঠিন হয়ে যাবে আরও। 

—আমি এরকমই চলে আসতে পারি তো আপনার কাছে চাচা? 

বরকত আলি বলেন—আমার বাড়িকে তোমার নিজের বাড়ি জানবে সিদ্ধার্থ। আমি সামান্য মানুষ, কিন্তু আমার স্নেহে কোনও ফাঁকি নেই। 

সিদ্ধার্থ প্রতিবাদ করে। বলে—আপনি সামান্য নন। 

—সামান্য! ক্ষুদ্র! আমার স্বপ্ন ছিল এম এল এ হওয়া! ভাবো! সামান্য এম এল এ হওয়ার দিকে এতকাল ছুটেছি! আমি সামান্য নই? 

—না। তাতে কিছুর বিচার হয় না। 

—হয় হয়! আরে কেউ ভাবেন আমি পঞ্চায়েত প্রধান হব, কেউ ভাবেন আমি এম এল এ, এম পি হব। মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী হব, এমনও ভাবেন। এঁরা কেউ সে-অর্থে ছোট নন। বিরাট। ক্ষমতাবান। মহানও হতে পারেন। কিন্তু এঁদের দৃষ্টি ছোট। এঁদের দৃষ্টি ঠেকে যায়। একটি আসনে ঠেকে যায়। এঁরা কেউ ভাবেন না আমি একজন সার্থক নেতা হয়ে উঠব। মহাত্মা গাঁধীর মতো নেতা। সুভাষচন্দ্র বসুর মতো নেতা। মাও সে তুঙ, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, চে গুয়েভারার মতো নেতা। পদের লোভ যাঁদের কাছে মুখ্য বিষয় ছিল না! সে কথা থাক। আমি বলছিলাম, তুমি এ বাড়িতে আসবে। তেকোনায় অন্য কোনও বাড়ির দরজা যদি তোমার জন্য না খোলে তো আমার দরজা খোলা থাকবে জেনো। আজ তুমি এলে, ভাল হল। মনে বড় বেদনা ভার হয়ে আছে বাবা। মেয়েটাকে নিয়ে বড় চিন্তায় আছি। 

—কী হয়েছে ফিরোজার? 

—গর্ভবতী হয়েছিল সে। 

—হয়েছিল? 

—হ্যাঁ। শ্বশুরবাড়ি থেকে খবর দিল মেয়েকে নিয়ে আসতে হবে। তোমার মিছিলের জন্য তৌফিক যখন এসেছিল, আমি চতুষ্কোনায় গিয়েছিলাম ফিরোজাকে নিয়ে আসতে। আমার ইচ্ছা ছিল ফিরোজা ওখানেই থাকুক। কারণ বহরমপুর শহর কাছে। সুবিধা হবে। কিন্তু তাঁরা বললেন, নিয়ম এই যে, প্রথম সন্তান হবে বাপের ঘরে। ফিরোজাও থাকতে চাইল না। নিয়ে এলাম। ঘোড়ার গাড়িতে করে এতটা পথ আসা, ভাল হল না মেয়েটার পক্ষে। এখানে আসার দিন পনেরো পরে অসময়ে পেটে বেদনা উঠল। বেদে বউকে ডেকে নিয়ে এলাম। সে বললে, শহরে নিতে হবে। বাচ্চা নড়ে গেছে। সারা গ্রামে একটা ঘোড়ার গাড়ি নেই তখন। বেরিয়ে গেছে সব। মেয়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। মোহন বলল বাইকে করে নিয়ে যাবে। কোনওক্রমে সে যতটা পারা যায় সামনে বসল। ফিরোজা বসল মাঝে। আমি ফিরোজাকে ধরে প্রায় পেছনদিকে স্টিলের মাল রাখার ঝুরিতে বসলাম। মোহন চেষ্টা করেছিল। পায়ে ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে চালাচ্ছিল যতখানি সম্ভব। কিন্তু রাখতে পারলাম না। মরালী পেরিয়ে যেতেই ফিরোজা প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেল। বাইক থামিয়ে ধু-ধু জমির ওপর শুইয়ে দিলাম তাকে। মোহন তার আপন ভাইয়ের মতো। মোহন কোল পেতে তার মাথা তুলে নিল। বাকি শরীরটা আমি কোলে নিলাম। দু’টি পুরুষের কোলে শুয়ে অসহায় গর্ভবতী। রক্তের ডেলা বেরিয়ে এল মেয়ের শরীর থেকে! ওঃ কী বলব সিদ্ধার্থ! আমার হাতের ওপর… আমার হাতের ওপর… 

গুড়গুড় করে মেঘ ডাকল। অন্ধকার নেমে এল ঝুপসি হয়ে। কিছুক্ষণ নীরব রয়ে গেল তারা দু’জনেই। সিদ্ধার্থর মনে পড়ছিল ধুলামাটি গ্রামের কথা। বুকে মৃত শিশুর শৈত্য। বরকত আলি প্রায় ফিসফিস করে বললেন—আমি, পঞ্চায়েত প্রধান, আমার মেয়ের গর্ভপাত হয়ে গেল বিনা চিকিৎসায়! এর জন্য কে দায়ী বলো? ভাল রাস্তা নাই। ডাক্তার নাই। হাসপাতাল নাই। এর জন্য কে দায়ী? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *