4 of 8

রাজনীতি

রাজনীতি

রাজনীতি নিয়ে আমি সাধারণত কিছু লিখি না, বিষয়টি যথাসাধ্য এড়িয়ে চলি।

কিন্তু ঘাড়ের ওপরে একটা নির্বাচনের গরম নিশ্বস মুহুর্মুহু পড়ছে। খবরের কাগজ, দূরদর্শন সব কেমন দিশেহারা হয়ে গেছে। কীসে কী হচ্ছে, কেউ ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।

আর রাজনীতির কুশীলবেরা অনেকেই এমন সব আচরণ করছেন, মুখ ফসকিয়ে কিংবা কিছু না ভেবে এমন সব কথা বলছেন, যার কোনও মানে হয় না। আর টেনেটুনে মানে বার করলে সে খুবই বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে।

নিজের প্রচার করতে গিয়ে বিপক্ষের অহেতুক নিন্দেমন্দ করা কিংবা বিপক্ষকে গালিগালাজ করা নিশ্চয় অশালীন এবং অনৈতিক কাজ। সাধারণ নাগরিক এগুলো যে বিশেষ পছন্দ করেন তাও নয়। কিন্তু চলছে, চলবে।

এমন অনেক রাজনৈতিক বক্তা আছেন যাঁরা স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা না করে অক্লান্তভাবে, ভগ্ন কণ্ঠে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা করে যেতে পারেন।

একবার বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে পার্কের একপাশে একটি জনসভার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখি বক্তা ভদ্রলোক বলে যাচ্ছেন তো বলেই যাচ্ছেন। সেটা অবশ্য নির্বাচনের সময় ছিল না। ভদ্রলোক রাজনৈতিক কোনও বিষয়ে বলছিলেন। মধ্যে মধ্যেই শুনছিলাম, ‘ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে’, ‘জাতির এহেন পরম দুর্দিনে’, ‘চতুর্দিকে চক্রান্তের বেড়াজাল’ এইরকম সব মার্কামারা পংক্তি।

পাশের ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই বক্তা কতক্ষণ বলছেন?’ উদাসীন প্রকৃতির ভদ্রলোক আলগোছে বললেন, ‘তা, প্রায় ঘণ্টাখানেক হবে।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী বিষয়ে বলছেন?’ ভদ্রলোক চিনেবাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন, ‘তা বলতে পারব না। উনি এখনও খোলসা করে কিছু বলেননি।’

নির্বাচনী বক্তৃতায় কিন্তু খোলসা না করে বলে কোনও উপায় নেই। সে বক্ততা অধরা, অছোঁয়া হলে চলবে না। মোদ্দা কথাটি বলতেই হবে, ‘আমরা ভাল। আমাদের ভোট দাও। ওরা খারাপ, ওদের ভোট দিয়ো না।’ খুব বেশি রাখ-ঢাক না করে একথাও বলতে হয়, ‘আমরা ভাল, তবু যদি আমাদের ভোট না দেন, তা হলে টের পাবেন আমরা কত খারাপ।’

নির্বাচন প্রার্থীকে সামনে নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় সেই সাবেকি পদযাত্রা ‘ভোট ফর’, ‘ভোট ফর’। মখে গদগদ হাসি, জোড়কর, বিনয়-বিহ্বল, ভদ্রতার জেরক্স কপি মাননীয় প্রার্থী পাড়ার মধ্যে ঘুরছেন।

বড় রাস্তায় বড় মিছিল। মোটর গাড়ি, জিপ, এসকর্ট কার, মোটর সাইকেল বাহিনী, সাইকেল মিছিল, আগে-পিছে লরিতে মাইক-ফেস্টুন-পতাকা—সে সমস্তই লোক দেখানো, খবরের কাগজ আর দূরদর্শনকে চমক দেওয়ার জন্যে। না হলে, এই চলমান জনতার মধ্যে, এই চৌমাথায়, বাজারে, রাজপথে ক’জনাই বা এলাকার ভোটার।

সুতরাং হাতজোড় করে গলির মধ্যে ঢুকতেই হয়। বউদির লাল চা। মাসিমার চিনি কম, নুন বেশি লেবুর শরবত। বড়মার সজনেভাঁটা-চচ্চড়ি খেতে খেতে নির্বাচন প্রার্থী গলির মধ্যে চলেছেন।

কোথাও কোনও বাড়ির একটা ভাল বাইরের ঘর পেলে কিংবা সামনে একটু উঠোন পেলে, কিংবা ছোটখাটো জমি পেলে প্রার্থী মহোদয়, একটা সভা সেরে নিচ্ছেন। একে বলে ঘরোয়া আলোচনা বা পথসভা।

শহরতলির একটা এলাকার কথা বলছি। পাশাপাশি দুটো প্রায় একই রকম বাড়ি। একটি বৃদ্ধাবাস, অন্যটি মানসিক হাসপাতাল।

ভুল করে দলবলসহ ভোট প্রার্থ উন্মাদ আশ্রমে প্রবেশ করেছেন। সেখানে উত্তেজনার কোনও অভাব হল না। প্রায় সকলেই ‘ভোটের লোক এসে গেছে। আসুন, আসুন,’ ইত্যাদি বলে সাদর অভ্যর্থনা জানান।

এমনিতেই নির্বাচনের বাজারে সাধারণ মানুষেরই কেমন একটা খ্যাপা-খ্যাপা ভাব। এরা যে পাগল, ও বাড়িটা যে পাগলগারদ সেটা ভোটের লোকেরা টের পেল না। বাড়ির পিছনে এক চিলতে উঠোন, সেখানে বৈশাখের প্রথম রৌদ্রে একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করলেন, মুহুর্মুহু হাততালি পড়তে লাগল। এইভাবে প্রায় এক ঘণ্টা চলল। বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর্যায়ে বক্তা লক্ষ করলেন দু’ ব্যক্তি একটু আলাদাভাবে দূরে নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে। বক্তৃতা শুনে হাততালি-টাততালি কিছুই দেয়নি। বক্তৃতা শেষে নির্বাচন প্রার্থী সেই দু’জনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হল, আপনারা আলাদা কেন?’

তারা বলল, ‘আমরা কি পাগল যে ভোটের বক্তৃতা শুনে হাততালি দেব। এটা পাগলাগারদ। আমরা এখানকার কর্মচারী। আপনার কথা শুনে যারা লাফালাফি করছে, হাততালি দিয়েছে তারা সবাই এখানকার পাগল।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *