রাজকুমারের পোশাকে

রাজকুমারের পোশাকে

‘বিশ্বাসের টি স্টল! বিশ্বাসের টি স্টল! আসুন দাদা আসুন। বিশ্বাসকে বিশ্বাস করুন, আসল দার্জিলিং টি! টেস্ট করে দেখুন একবার। এক কাপ খেলে দু-কাপ খেতে চাইবেন, সেকেণ্ড কাপের দাম হাফ! …বুঝে দেখুন দাদা, জলের দরে পেয়ে যাচ্ছেন!

লাল রঙা একটা টিনের চোঙায় মুখ রেখে চেঁচিয়েই চলেছে লোকটা! কে জানে বিশ্বাস নিজেই, না তার কোনো বিশ্বাসী খিদমদগার। যেই হোক গলা বটে একখানা! শুনে মনে হচ্ছে যেন ওই টিনের চোঙাটা ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে ছিটিয়ে পড়ল বলে। যতক্ষণ ফেটে না যাচ্ছে, শব্দটা তেড়ে তেড়ে প্রায় আকাশে উঠে যাচ্ছে।

আর তারপর আকাশ থেকে ঝরে পড়ে মেলার কলকল্লোল ছাপিয়ে সকলের কানের পর্দায় গিয়ে আছড়াচ্ছে ‘জলের দরে চা! জলের দরে চা!’

গলাও যেমন জোরালো, বলার ভঙ্গিও তেমনি ঘোরালো, দু-চারবার শুনতে শুনতেই যেন গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে ওঠে, চা তেষ্টা পেয়ে যায়।

অন্তত টিকলু আর বাপুর পেয়ে গেল। অবশ্য ঠিক চা তেষ্টা পেয়ে যাওয়ার বয়েস ওদের নয়, কিন্তু পরিবেশ কিনা করে?

একে তো ওই চোঙা ফাটানো আওয়াজের আকর্ষণীয় ডাক ‘জলের দামে চা’। তার ওপর মেলাতলায় ঘুরছে কি কমক্ষণ? খিদে তেষ্টা সবই পেয়ে গেছে।

ঘুরছে সেই কখন থেকে অথচ এক পয়সারও কিছু কিনে খায়নি। যদিও রামরাজাতলার এই মেলাতলায় দশদিক আচ্ছন্ন করে শুধু খাবারেরই সমারোহ। সুখাদ্য, অখাদ্য, শুধু খাদ্য, গুরুপাক খাদ্য, লঘুপাক খাদ্য, দামি সস্তা নানা ধরনের খাদ্য।

কিন্তু খাবে কী? বাড়ি থেকে কড়া হুকুম দিয়েছে—‘শুধু দুই বন্ধুতে একা একা মেলা দেখতে যেতে সাধ হয়েছে তা যাও। কিন্তু খবরদার, কিছু কিনে খাবে না। এক পয়সারও না। কলেরা বাধালে দেখবে কে?

বাপুর ছোড়দি আবার বাপুর ঠিক বেরোবার সময় বেচারার পকেট সার্চ করে যা কিছু ছিল কেড়ে নিয়ে তুলে রাখল। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারল না বাপু! আবার শুধু নিয়ে নিয়েই ক্ষান্ত হল না, ভেঁপু বাঁশির সুরে বাড়ির বড়োদের কানে তুলল, ‘মা, দুর্মতি দেখো তোমার ছেলের! বাবু পয়সা পকেটে নিয়ে মেলাতলায় যাচ্ছেন। কম নয়, তিন টাকা কুড়ি পয়সা।’

বেচারা বাপু, কত কষ্টেই না ওই পয়সা ক-টা জমিয়েছিল। নিয়ে নিল। চিলের মতো ছোঁ মেরে নিল, অথচ যেন দাবির সঙ্গে। ছোড়দি সব সময় ওইরকম করে। হয়তো বাপু কোথা থেকে না কোথা থেকে একটি গল্পের বই জোগাড় করে এনে একটু পড়ছে, ছোড়দির দৃষ্টিতে পড়ল কী গেল। বই হাতছাড়া।

বাপুর ছোড়দি অবশ্য খুবই নিষ্ঠুরতা করেছে বাপুর সঙ্গে, বাপুর অবস্থা শোচনীয়। টিকলুর কিন্তু অতটা নয়। তা ছাড়া টিকলুর তো ছোড়দি নেই। টিকলুর হাফপ্যান্টের পকেটে পয়সা আছে। তবে নিষেধবাক্যটাও আছে তারসঙ্গে। থাকবেই তো। টিকলুর সেছোকাকার যে বদ্ধমূল ধারণা মেলাতলা মানেই কলেরার জার্মের ডিপো।

তবু এখন হঠাৎ টিকলু ঘোষণার মতো ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘চল বাপু, বিশ্বাসের চা-টা একটু টেস্ট করে দেখা যাক।’

সত্যি বলতে টিকলুর এই সাড়ে বারো বছরের জীবনে একদিনের জন্যেও টিকলু স্বাধীনভাবে একা কোনো চায়ের দোকানে বা রেস্টুরেন্টে ঢুকে চেয়ার টেনে বসেনি, নিজে মুখে অর্ডার দেওয়ার সুখে বিগলিত হয়ে বড়োদের মতো করে বলবার সুযোগ পায়নি, ‘কই, দেখি একটা চা—’

অথচ টিকলুর ক্লাসের ছেলেদের মধ্যে অনেকেই এ সুখ পেয়েছে।

কারণটি ওই সেজোকাকা।

সেজোকাকার কড়া হুকুম, বাইরে যেখানে সেখানে কিছু খাবে না। অবশ্য তিনি নিজে দয়াপরবশ হয়ে কখনো কখনো ভাইপোকে উচ্চাঙ্গের কোনো রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে খাইয়েছেন ‘ভালোমন্দ’ অনেক কিছু। কিন্তু তাতে তো আর পূর্ণ সুখ নেই! সেতো সেই বোকা খোকা খোকা মুখে চুপ করে বসে থাকা, আর সেজোকাকা যখন দরাজগলায় প্রশ্ন করেন, কী রে, কী খাবি? তখন ঘাড় গুঁজে বলা, ‘তোমার যা ইচ্ছে।’

না বলে করবে কী? টিকলু নিজে যেটা পছন্দ করবে, সেটাই যে সেজোকাকার মতে ‘ওটা সুবিধের নয়’ হবে। এ টিকলুর খুব জানা।

আজ টিকলু নিজের ইচ্ছে প্রকাশ করবে। করবে বলে সংকল্প করেই বড়োদের ভঙ্গিতে বলল, ‘চল বাপু, বিশ্বাসের দোকানের চা-টা একটু টেস্ট করে আসা যাক।’

বাপুর মনও আন্দোলিত হচ্ছিল ওই ‘জলের দাম’টা শুনে, আর অনেকক্ষণ থেকেই বাপু তার হাফপ্যান্টের পকেট দুটোয় হাত ঢুকিয়ে খানাতল্লাশি চালাচ্ছিল, যদি কোনো খানাখন্দের মধ্যে ওই ‘জলের দাম’টা পড়ে থেকে থাকে। থাকতেও তো পারে সেলাই-টেলাইয়ের খাঁজে। যেমন চিনেবাদামের খোলার মধ্যে থেকে টিপতে-টিপতে হঠাৎ এক-আধটা আস্ত বাদাম পাওয়া যায়।

কিন্তু না:! ছোড়দির করাল হাত কোনো খানাখন্দকেই বাদ দেয়নি।

বাপু তাই ছিটকে উঠে বলে, ‘চা খেয়ে আসা যাক মানে? আসবার সময় কী কথা হয়েছিল?’

টিকলু গম্ভীরভাবে বলে, ‘জানি, কী কথা হয়েছিল। পৃথিবীর সর্বত্র কলেরার জার্ম, কোথাও কিছু খাওয়া চলবে না। কিন্তু এটাও তো ভেবে দেখা দরকার নিজেদের বাড়িগুলি কি পৃথিবী ছাড়া? আর এই যে এত এত লোক বাইরে এতসব খেয়ে বেড়াচ্ছে, তারা সবাই কলেরা হয়ে মরে যাচ্ছে?’

বাপু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায়।

উদাস উদাস দার্শনিক গলায় বলে, ‘তোর ইচ্ছে হয় খেগে যা! আমার অত পয়সা নেই।’

টিকলুও নিজের পকেটটা সার্চ করছিল এতক্ষণ, এখন আত্মস্থভাবে বলল, ‘আমার কাছে যা আছে দু-জনের হয়ে যাবে।’

‘না: তুই একাই খা।’

টিকলুর গলা কড়া হয়ে ওঠে, ‘বাপু, চিরদিনের জন্যে বন্ধুবিচ্ছেদ চাস? আমার পয়সায় খেলে তোর মান যাবে?’

‘আমি কী তাই বলছি?’ বাপু তাড়াতাড়ি নিজের ভুল শুধরে নেয়, ‘বলছি তোরটা তো সবই ফুরিয়ে যাবে তা হলে!’

‘যায় যাবে। তুই আয় তো।’

বন্ধুকে প্রায় টেনে নিয়ে আসে টিকলু ‘বিশ্বাসের স্টল’-এর সামনে।

তাকিয়ে দেখে স্টলের সামনেটা। দেখল মেলাটেলায় অস্থায়ী দোকানটোকান যেমন হয়, দুটো খুঁটির সঙ্গে টানটান করে বাঁধা চওড়া লাল শালুর টুকরোর ওপর সাদা রং দিয়ে লেখা ‘আদত দার্জিলিং চা। বিশ্বাসের টি স্টল।’

আর পাশে সরু লম্বা পিজবোর্ডের গায়ে মোটা কলমে লাল কালিতে ধরে ধরে লেখা:

চা—চিনির … … ৩০ প.

ওই—গুড়ের … … ২৫ প.

টোস্ট—মা. স. … … ২৫ প.

ওই—মা. বা. … … ২০ প.

ডি. অ.—সিঙ্গল … … ৬০ প.

ওই—ডবল … … ১১০ প.

ডি.—হা. ব. … … ৪৫ প.

ল. ম.—ফ্রি …. …. ……

বাপু টিকলু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বেশ কয়েকবার লেখাগুলো পড়ে, তারপর মুখ চাওয়াচায়ি করে। ব্যাপারটা কী!

লোকটা তো দিব্যি সাদা বাংলায় কথা বলছে, খাদ্যবস্তুর তালিকাটা কোন ভাষায় লেখা? জিজ্ঞেস করতেও লজ্জা। গাঁইয়া-টাঁইয়া ভেবে বসবে হয়তো।

টিকলুর পকেটে পয়সা, কাজেই টিকলু আত্মস্থ। তাই গম্ভীরভাবে বলে, ‘চায়ের সঙ্গে এর কোনটা অর্ডার দেওয়া যায় বল তো বাপু?’

বাপু আরও একবার পড়ে নিয়ে বলে, ‘কোনোটারই তো মাথামুন্ডু বোঝা যাচ্ছে না ছাই। টোস্টটা যদি বা বুঝলাম, মা. স. মানে?’

‘সেই তো—’ টিকলু চিন্তাকুল, ‘আবার—ওই মা. বা.? ওটাই বা কী?’

‘চাইনিজ কিছু হবে। ওদেরই তো ভাষার মধ্যে খন্ড-ৎ আর বিসর্গের ছড়াছড়ি।’

‘সেরেছে। তা হলেই তো বিপদ। না জেনেশুনে একটা কিছু অর্ডার দিয়ে বসা হবে, যদি আরশোলা হয়?’

‘হতে পারে! সোনাব্যাং-এর ব্যাপার হওয়াও আশ্চয্যি নয়।’

‘তা হলে?’

‘শুধুই চা বলা যাক তা হলে। কী বল?’ বলল টিকলু।

বাপুর অবশ্য কথাটা মনঃপূত হল না। নিয়ম ভেঙে যদি খেতেই হয় তো ভালোমতোই হোক।

বাপু বলল, ‘ডি. অ.-টা বলে দেখ না। আরশোলা-টোলা হবে না বোধ হয়। আর তারসঙ্গে চিনির চা। এটাই যা বাংলায় লেখা।’

টিকলু ততক্ষণে মনে মনে হিসেব করে ফেলেছে, চিনির চা দুটো ষাট পয়সা, ডি. অ. সিঙ্গল ষাট পয়সা, (ডবল হলে তো আরও বেড়ে গেল) তা হলে সত্যিই তো ফুরিয়ে যায় সব। নাগরদোলটা আর হয় না। যদিও সেটাও বারণ আছে, কিন্তু অত বারণ শুনলে চলে না। ভিড়ের জ্বালায় তো নাগরদোলার ধারেকাছেই যাওয়া যাচ্ছে না, সবাই বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে?

অত বারণ শোনা যায় না বাবা।

নাগরদোলার কথাটা ভেবে টিকলু বেশ বিজ্ঞভাবে বলে, ‘তার থেকে এই ল. ম.-টা অর্ডার দেওয়া যাক, বুঝলি? এটা যখন ফ্রি দিচ্ছে।’

বাপু ঈষৎ চিন্তিতভাবে বলে, ‘আচ্ছা, ফ্রি কেন দিচ্ছে বল তো?’

টিকলু আরও বিজ্ঞ অভিজ্ঞ হয়, ‘কেন আর। দোকানের বিজ্ঞাপন। একটা খাবার যদি ফ্রি দেয়, লোকে ছুটে আসবে।’

‘তবে ঢুকে পড়া যাক।’

ঢুকে পড়ল। নিয়তির অমোঘ আকর্ষণে। দু-জনেই একসঙ্গে।

আর ঠিক বড়োদের মতো ভঙ্গিতে দু-খানা টিনের চেয়ারে বেশ শব্দ করে বসে পড়ে বলে উঠল, ‘কই, দুটো চা দেখি। তার সঙ্গে দুটো ল. ম.।’

যে চোঙায় মুখ দিয়ে চেঁচিয়ে আকাশ ফাটাচ্ছিল, সেএখন ‘বিরতি’ দিয়েছে একটুক্ষণের জন্যে। ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তারসঙ্গে দুটো কী?’

‘বললাম তো ল. ম.। কানে কম শোনেন নাকি?’

‘ল. ম.! ও বিশ্বাসদা, এ ছেলেরা বলে কী! ল. ম. মানে?’

বিশ্বাসদা, অর্থাৎ দোকানের মালিকও ভুরু কুঁচকে বলেন, ‘লহ মহ? সেটা আবার কী হে ছোকরা?’

ছোকরা।

টিকলুর পকেটে পয়সা, তাই তার মুখটা বেশি লাল হয়ে ওঠে। তা ছাড়া টিকলু খুব ফর্সাও। সেই লাল লাল মুখে বলে ওঠে টিকলু, ‘ভদ্রভাবে কথা বলতে পারেন না? ছোকরা মানে?’

‘আরে ব্যস! ঘাট হয়েছে বাবু! কিন্তু কথাটা যে বুঝতে পারছি না। লহ মহ কী?’

টিকলু চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে ওঠে, ‘কী তা’ আমরা বলব? নিজেরাই লিখে রাখেননি বুঝি? এই তো দেখুন না কী এটা? ল. ম. ফ্রি। ফ্রি দেবার নাম করে লোককে ডেকে তারপর এইরকম করা! বা: বেশ।’

বিশ্বাস আর তার লোক, দু-জনে একবার সাইন (পিজ) বোর্ডটা দেখে নেয়, তারপরই হো হো করে হেসে ওঠে। থামতেই চায় না।

এত হাসির মানে?

রেগে চেয়ার ছেড়ে চলে আসে টিকলু, বলে ওঠে, ‘আয় বাপু, এ দোকানে আর নয়। এটা পাগলের দোকান। তা নইলে শুধু শুধু কেউ হাসে?’

বিশ্বাস কষ্টে হাসি থামিয়ে বলে, ‘শুধু শুধু কী দাদা, আপনারা যে না হাসিয়ে ছাড়ছেন না। ল. ম. মানে হচ্ছে লংকা মরিচ। রাখতে হয় না একটু লংকা মরিচের গুঁড়ো? তা কথাগুলোকে একটু সংক্ষেপ করে না নিলে একফুট বোর্ডে ধরবে কেন বলুন? তা ছাড়া আর্টিস্ট দিয়ে লেখাতে হয়েছে নগদ করকরে পয়সা খরচ করে। এক একটা অক্ষর লেখাতে পাঁচ নয়া। দরাজ হাতে যদি লেখাতে দিই ‘টোস্ট মাখনসহ, টোস্ট মাখন বাদ, ডিম হাফবয়েল, ডিমের অমলেট ডাবল সিঙ্গল’, তা হলে তো ফতুর হয়ে যাব। …যাক এখন বলুন কী দেব। একটা কিছু নিলে তবে না লংকা মরিচ ফ্রি? শুধু ফ্রি-টা চাইলে যে সেই ফাউয়ের গল্প হয়ে যাবে।’

‘ফাউয়ের গল্প মানে?’

গল্পের গন্ধে বাপু উশখুশ করে উঠে।

তা শুধু বাপুও নয়, স্টলের কোণের দিকে নতুন প্যাকিং কাঠের টেবিল জোড়া করে যে ক-জন চা টোস্ট ডিমের অমলেট নিয়ে বসে কষে খাওয়া চালাচ্ছিল তারাও যেন চঞ্চল হয়ে এদিকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে।

বিশ্বাস উৎসাহ পেয়ে খনাগলায় বলে, ‘আহা, ইয়ে জানেন না, একজন লোক খাবারের দোকানে গিয়ে চারটে হিঙের কচুরি চাইল, দোকানি শালপাতার ঠোঙায় করে চারটে হিঙের কচুরি দিয়ে তারসঙ্গে আর চারটে আলুর দম দিল। দেখে তো লোকটা মহাখাপ্পা, ‘আবার এগুলো চাপাচ্ছ কেন? বাড়তি খরচার মধ্যে আমি নেই।’ …দোকানি হেসে বলেল, ‘আলুর দমের জন্যে আলাদা পয়সা দিতে হবে না বাবু, ওটা ফাউ।’ …‘তাই নাকি?’ লোকটা একগাল হেসে বলল, ‘তবে এই ফাউটাই নিয়ে যাচ্ছি, কচুরিটা থাক। এতেই এ বেলাটা চলে যাবে।’ …সেই কথাই বলছি। তবে লংকা মরিচের গুঁড়ো তো আর আলুর দমের মতো শুধু খাওয়া যায় না?’

‘আপনি’ করেই বলছে, ‘বাবু’ও বলছে, কিন্তু সবটাই যেন তামাশার ছলে। যেন মজা করছে। ছোটোদের নিয়ে বড়োরা যেমন করে।

টিকলু এটা বুঝতে পারে, টিকলু মনে মনে চটে। চটার আরও কারণ, এদের কাছে টিকলুদের বোকামি ধরা পড়ে গেছে।

নেহাত চায়ের দোকানেটোকানে আসার অভ্যাস নেই বলেই এমনটা হল, নইলে টিকলু কখনো বোকা বনে? যে টিকলুর ঠাকুমা বলেন, ‘এ ছেলেকে নদীর এপারে পুঁতলে, ওপারে গাছ গজায়।’

এ ছাড়াও অনেক ভালো ভালো বিশেষণ আছে টিকলুর, যেমন ‘কীর্তিচন্দ্র’, ‘মহাপ্রভু’, ‘শাহানশা’, ‘বোম্বেটে’, ‘বিচ্ছু’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

সেই টিকলু কিনা কথার শর্টকাট বুঝতে পারল না। ফট করে ল. ম. চেয়ে বসল!

লোকটা বেজায় অভদ্র!

‘বাবু’ বলছিস, ‘আপনি’ বলছিস, ঠিক আছে, তারসঙ্গে অমন একটা ব্যঙ্গের সুর মিশিয়ে দেওয়া কেন? আর ওই কোণের মধ্যে যারা বসেছিল, তারাই বা এখানে এত উঁকিঝুঁকি মারছে কেন? খাচ্ছিলি খা না বাবা। এই বুড়ো হয়ে যাওয়া লোকগুলোর যদি কোনো ভব্যতা থাকে। টিকলুর দিকে এমন করে তাকাচ্ছে চোখ ড্যাবা করে। কেন, টিকলুর কপালে কি দুটো শিং আছে? সিন্ধুঘোটকের মতো দুটো দাঁত আছে?

ওদের তাকানো দেখে মাথা জ্বলে যাচ্ছে, দোকান থেকে বেরিয়ে চলে যেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু হঠাৎ চলে গেলেও মান থাকে না। অতএব টিকলু আবার গুছিয়ে বসে গম্ভীরগলায় বলে, ‘ঠিক আছে। দিন দুটো টোস্ট আর দুটো হাফ-বয়েল, আর দুটো চা। চিনির চা দেবেন। কী রে বাপু, হাফ-বয়েল খাবি, না অমলেট? অমলেট? আচ্ছা একটা হাফ-বয়েল, একটা অমলেট।’

চোঙাওয়ালা মিটিমিটি হেসে বলে, ‘পয়সাকড়ি সঙ্গে আছে তো ভাই?’

বটে! এই কথা! আর নয় এখানে।

টিকলু এবার চেয়ার ঠেলে ফেলে কড়াগলায় বলে, ‘বাপু, চলে আয়। এটা ভদ্দরলোকের জায়গা নয়।’

‘আহা-হা চটছেন কেন ভাই, ছেলেমানুষ, সঙ্গে গার্জেন নেই, ভুল-ভাল তো হতেও পারে; তাই শুধোচ্ছিলাম। যাক গে, বসুন, বসুন।’

‘না না, অন্য দোকানে যাব।’

‘যেতে চান যাবেন, তবে মিছিমিছি রাগ করছেন ভাই। আমি মন্দ কিছু বলিনি। দেখলাম কিনা রেস্টুরেন্ট-ফেস্টুরেন্টে আসার অভ্যেস তেমন নেই, তাই ভাবছিলাম—’

‘ভাবুন বসে বসে! নয় তো চোঙায় মুখ দিয়ে চেঁচান। লোককে কেমন জলের দরে চা খাওয়াতে পারেন বলুন ডেকে ডেকে।’

বলে স্টল থেকে নেমে পড়ে টিকলু।

মানে নেমে পড়তে যায়, কিন্তু পড়া হয় না, হঠাৎ এপাশ থেকে হাত বাড়িয়ে খপ করে ওর শার্টের কলারটা চেপে ধরে হুংকার দিয়ে ওঠে সেই ড্যাবড়া চোখে তাকানো আধাবুড়ো লোকটা।

লোকটার সাজসজ্জাসমেত চেহারাখানা যেন ঊনবিংশ শতাব্দীর! তৎকালীন ঘটক, নায়েব অথবা সওদাগরি অফিসের বড়োবাবু মার্কা। বেঁটেখাটো গড়ন, হলদে হলদে গায়ের রং, মাথায় পাকা-কাঁচা চুল কুচিয়ে ছাঁটা, পরনে খাটো ধরনের ধুতির ওপর গলাবন্ধ জিনের কোট, গলায় পাক দিয়ে কোঁচানো উড়ুনি, বগলে ছাতা, পায়ে ক্যাম্বিসের শু।

হুংকারটাও সেকালেরই মতো বাজখাঁই।

‘কী জাদু, এই একটা ছুটো তুলে কেটে পড়ছিলে, কেমন? আর পালাতে হচ্ছে না—।’

হঠাৎ সবাই থমকে যায়।

এ আবার কী!

তারপরই চিকলু ঘাড়টা ঝাঁকিয়ে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলে, ‘এর মানে?’

‘মানে বুঝছ না? তা বুঝবে কেন চাঁদ? ওদিকে দুটো বুড়ো-বুড়ি কেঁদে কেঁদে চক্ষু অন্ধ করে ফেলল, আর তুমি এখনও বোকা সেজে উড়ে পালাবার তাল করছ! বলি খোকা রাজাবাবু, প্রাণে কি তোমার মায়া মমতার বালাই নেই? বুড়ো ঠাকুমা-ঠাকুরদার কথাটা একবার ভাবছ না ভাই?’

হুংকার থেকে একেবারে সুর ঝংকার!

টিকলু তখনও ছাড়াবার চেষ্টা করতে করতে বলে, ‘পাগলের মতো কীসব যা তা বলতে শুরু করেছেন? ছেড়ে দিন বলছি। নইলে চেঁচিয়ে লোক জড়ো করব।’

ছাঁটাচুল জিনের কোট পরা আধবুড়ো ভদ্রলোক তাঁর পাশের লপেটা মার্কা সিকিবুড়ো লোকটার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করেন, তারপর দৃষ্টিপাত করেন পেছনের ‘না-বুড়ো’ মস্তানমার্কা ছোকরা দুটির দিকে।

সঙ্গে সঙ্গে তারা টিকলুকে এমনভাবে ঘিরে ধরে যে, হঠাৎ লাফ দিয়ে পালাবার পথ আর থাকে না টিকলুর। যাকে বলে ‘ঘেরাও’।

হঠাৎ এই হঠাতের ধাক্কায় বাপু বেচারি থতোমতো খেয়ে গিয়েছিল, এখন সেকিঞ্চিৎ ধাতস্থ হয়ে রুখে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ব্যাপারটা কী? হঠাৎ একে ধরছেন যে? পাগল নাকি আপনারা?’

‘এটি আবার কে? ফোঁস কেউটে ফোঁ! বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে এইরকম সব গুণনিধি বন্ধু জোটানো হয়েছে, কেমন? ছি ছি! আচ্ছা খোকা রাজাবাবু, হঠাৎ তোমার মাথায় কী ভূত চাপল বল তো, তাই পালিয়ে এলে? পালিয়ে এসে এইভাবে হতভাগার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছ, যেখানে সেখানে খাওয়াদাওয়া করছ, একবার ভাবছ নাকী বংশের ছেলে তুমি, কী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আরাম-আয়েশের মধ্যে প্রতিপালিত তুমি—’

‘টিকলু’, বাপু চেঁচিয়ে ওঠে, ‘এই পাগলের পাল্লা থেকে চলে আয় ; খুব চা খেতে ঢোকা হয়েছিল!’

কিন্তু চলে আসবে কী, টিকলু তো তখন ঘেরাও। শুধুই যে ওই গলায় উড়ুনি গায়ে জিনের কোট ও তার সম্প্রদায়কতৃক, তা তো নয়। বিশ্বাস তার চায়ের দোকানের ভবিষ্যৎ ভুলে, এবং বিশ্বাসের সহকারী তার চোঙা ফেলে, একেবারে ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছে, কাজেই টিকলুর অবস্থা ষষ্ঠরথীবেষ্টিত।

বাপু বলে ওঠে, ‘টিকলু, আমি মেলার অন্যসব লোকদের ডেকে আনব?’

টিকলু ঘাড় বাঁকিয়ে বলে, ‘এখুনি লোক ডেকে আনতে হবে না। এদের পাগলামির বহরটা দেখে নিই আগে, তারপর দেখছি কে আমায় ধরে রাখতে পারে।’

কিন্তু যতই হোক ছেলেমানুষের গলা, তাকে ছাপিয়ে বাজখাঁই গলা হেঁকে ওঠে, ‘খোকা রাজাবাবু, তুমি এবার পাগলামিটা ছাড়ো, বুড়ো-বুড়িকে আর কাঁদিয়ো না, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে চলো।’

বিশ্বাস কোম্পানি বোধ হয় এতক্ষণে রহস্যের সূত্র পায়, চোখ গোল গোল করে বলে, ‘ব্যাপার কী মশাই, পালিয়ে আসা ছেলে নাকি? কাদের ছেলে?’

ঊনবিংশ শতাব্দী হঠাৎ যেন আত্মস্থ হয়ে যান, মুখে ফুটে ওঠে একটি অলৌকিক হাসি। শান্তগম্ভীর গলায় বলেন, ‘কাদের ছেলে! ছেলে হচ্ছে হিঙুলগঞ্জের রাজা শ্রীল শ্রীযুক্ত রাজীবনারায়ণ পাট্টাদার বাহাদুরের পুত্র যুবরাজ শ্রীল শ্রীযুত অনন্তনারায়ণ পাট্টাদার বাহাদুরের একমাত্র সন্তান শ্রীল শ্রীমান দীপেন্দ্রনারায়ণ পাট্টাদার বাহাদুর।’

‘ওরে ব্বাস। তারমানে আপনি বলতে চান ছেলেটি হচ্ছে কোনো এক রাজপুত্তুর?’

চোঙাওয়ালা বলে ওঠে কথাটা।

‘জিনের কোট খাটো ধুতি’ এই বলে ওঠার দিকে তাকান, একটুক্ষণ তাকিয়েই থাকেন, তারপর বলেন, ‘বলতে চান কথাটার মানে? শুধু শুধু চাই? আর বলতে চাইলেই সব হয়ে যাবে, না চাইলে নয়? চাওয়াচায়ির কথাই নয়। যা সত্যি তাই বলছি, হ্যাঁ তাই।’

‘আপনি তো তাজ্জব করলেন, এ যুগে এখনও রাজা-রানি, রাজপুত্তুর, রাজকন্যা এ-সব আছে?’

‘আছে মশাই আছে। পৃথিবীতে সবই আছে, সবই থাকে। একদা কি মহাকবি কৃত্তিবাস ভগবানকে ডেকে বলে যাননি—‘প্রভু, তোমার মহাবিশ্বে কিছু হারায় নাকো কভু।’ জানেন, শ্রীবৃন্দাবনে এখনও শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি বাজে, রাধিকার নূপুরধ্বনি শোনা যায়, নদিয়ার পথে গৌরাঙ্গর কীর্তনের রোল ওঠে, আর নিজের নিজের কানে হাত চাপা দিলেই বুকের মধ্যে রাবণের চিতা হু হু করে জ্বলে ওঠে।’

বাপু অলক্ষিতে টিকলুকে টিপে আস্তে বলে, ‘রাবণের চিতার কথাই তো জানি, বুড়ো এতসব কী বলছে রে?’

‘যা প্রাণ চাইছে বলছে। শুনে যা একমনে, দেখ আরও কত কী বলে।’

‘এই তো তোকে রাজপুত্তুর বলছে—’ বাপু বলে ওঠে, ‘আমায় আবার মন্ত্রীপুত্তুর বলে বসবে না তো? তা কোথাকার রাজা?’ বাপু জোরে হি হি করে হেসে ওঠে, ‘লাঙুলগঞ্জের’? কী রে টিকলু, তুই তা হলে লাঙুলগঞ্জের রাজপুত্তুর?’

‘আঃ! এ তো আচ্ছা ফাজিল ছোকরা!’ ক্যাম্বিস শু ভদ্রলোক অবজ্ঞার গলায় বলেন, ‘এইসব ছেলের সঙ্গে মিশে তোমার কতটা অবনতি হয়েছে, তা অনুমান করতে পারছি খোকা রাজাবাবু!’

বিশ্বাস কোম্পানি ব্যগ্র হয়ে বলে, ‘ও মশাই, ওই লাঙুল না হিঙুলগঞ্জ সেটা আবার কোনখানে? জীবনে তো নাম শুনিনি!’

ছাঁটাচুল খোঁচাগোঁফ ধিক্কারের গলায় বলেন, ‘হিঙুলগঞ্জের নাম শোনেননি? মশাই তো দেখছি ভূগোলে খুব কাঁচা।’

বিশ্বাস একগাল হেসে বলে, ‘সেযা বলেছেন। ওই ভূগোলের গোলমালেই মাথা গোলমাল হয়ে গিয়েই লেখাপড়াটা আর হল না। তাই আজ এই অবস্থা। তা বলুন না মশাই।’

খাটো ধুতি এবার উদার হন, করুণাঘন গলায় বলেন, ‘তা’ যদি বললেন, অনেকেরই আপনার মতন অবস্থা। শুনেই বিশ্বাস চোখ কপালে তুলে বলে, ‘সেটা আবার কোনখানে মশাই?’ …আমি বলে দিই, ‘ওহে, সেটা হচ্ছে বকখালি পার হয়ে সাড়ে সাতক্রোশ দক্ষিণে। থানা কুমিরখালি, মৌজা ভাসানখালি, পত্তন হিঙুলগঞ্জ। …এই যে ছেলেটিকে দেখছেন—এর প্রপিতামহ রাজা বিজয়নারায়ণ পাট্টাদার বাহাদুরের দাপটে মহারানি ভিক্টোরিয়া চিন্তাযুক্ত হতেন। বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা? তা এর পিতামহ রাজা রাজীবনারায়ণ পাট্টাদার বাহাদুরের নামেও একদা বাঘে গোরুতে একঘাটে জল খেত। তবে বৃদ্ধ হলে যা হয়, প্রজারা আর মানতে চায় না, তা ছাড়া বর্তমান যুবরাজ, মানে এর পিতাঠাকুর অনন্তনারায়ণ রাজ্যে উপস্থিত না থাকার জন্যেও বটে। দিনকাল সব পালটে যাচ্ছে মশাই। আমি এই বক্রেশ্বর বাক্যবিনোদ তিন পুরুষ ধরে এই রাজবংশের অনুগত হয়ে আছি। অথচ আমার ছেলে, ব্যাটা বলে কিনা, রাজবাড়ির কাজ আর করবে না! বিশ্বাস করতে পারছেন?’

বিশ্বাসমশাই মাথা নেড়ে বলে, ‘কথাটা অবিশ্বাস্য বটে, তবে এ যুগের ছেলেপুলের পক্ষে সবই সম্ভব। কিন্তু কথা হচ্ছে, রাজাটাজা কি সত্যি আর এযুগে আছে মশাই? ‘রাজা’ নামটা তো উবে গেছে পৃথিবী থেকে। এখন তো শুধুই মন্ত্রী। …মন্ত্রীতে মন্ত্রীতে ধুলপরিমাণ। কিন্তু রাজা? কই শুনি না তো?’

‘তা শুনবেন কোথা থেকে?’

বক্রেশ্বর বাক্যবিনোদ রেগে উঠে বলেন, ‘এ যুগের যে সবাই সৃষ্টিছাড়া! মাথা নেই পাগড়ি, হাত নেই হাতিয়ার, রাজা নেই মন্ত্রী। …কিন্তু আমাদের হিঙুলগঞ্জে এখনও রাজা আছে। আর এই অবোধ বালকটিই হচ্ছেন সেই রাজার ভবিষ্যৎ মালিক।’

ইস!

বিশ্বাস মনে মনে জিভ কাটে।

এই ছেলেকে কিনা সেঠাট্টা তামাশা করেছে, পকেটে পয়সা আছে কি না বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। ছি ছি!

বিশ্বাস তাই নিজের ত্রুটি সামলাতে চেষ্টা করে।

এখন আর ব্যঙ্গের সুরে নয়, খোকা রাজাবাবুর দিকে সসম্ভ্রমে তাকিয়ে ভক্তির সুরে বলে, ‘ইস! এতবড়ো ঐতিহ্য আপনার, আর আপনি কিনা এইভাবে পালিয়ে এসে—না ভাই খুব অন্যায় হয়েছে আপনার। যান যান দেওয়ান মশায়ের সঙ্গে চলে যান। …আহা, ছেলেটির বুঝি বাপ-মা নেই বাক্যেশ্বর বক্রবাগীশ মশাই?’

‘কী? কী বললেন,’ বক্রেশ্বর বাক্যবিনোদ প্রায় ছিটকে ওঠেন, ‘নাম বদলাচ্ছেন কেন? এই যে আপনি বিশ্বাসের টি স্টলের বিশ্বাস, হঠাৎ যদি আমি আপনাকে নিশ্বাসমশাই বলে ডাকতে শুরু করে, আপনি পছন্দ করবেন? বলুন, করবেন পছন্দ?’

বিশ্বাস বিনয়ের অবতার হয়ে বলে, ‘ভুল হয়ে গেছে বক্রেশ্বর বাক্যবাগীশ মশাই। মাপ করবেন। জানেনই তো মূর্খের অশেষ দোষ। তা নিজগুণে ক্ষমা করে নিয়ে বলুন ঘটনাটা সব বিস্তার করে। মা-বাপ আছেন?’

এই যে বললাম এর পিতাঠাকুর দেশে না থাকাতেই যত বিপত্তি। হর-পার্বতীর মতো মা-বাপ আছেন, তবে এখানে নেই, একবছরের জন্যে পৃথিবী পরিক্রমায় বেরিয়েছেন।’

‘পৃথিবী পরিক্রমা? সেটা আবার কী জিনিস মশাই?’

‘উঃ! আপনাকে নিয়ে আর পারা যাচ্ছে না, মনে কিছু করবেন না নিশ্বাসমশাই, কী আর বলব। শহর বাজারে চায়ের দোকান দেন, আর ‘বিশ্ব পরিক্রমা’ মানে জানেন না? মানে হচ্ছে—পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে বেরিয়েছেন। এ কথাটার মানে জানেন? নাকি তাও জানেন না? তবে বলি—জগতের সব দেশ, রাজ্য দেখতে বেরিয়েছেন।’

বিশ্বাস চোখ কপালে তুলে বলে, ‘বলেন কী? তা আপনাদের হিঙুলগঞ্জেরও এত প্রগতি-টগতি হয়েছে? রাজা-রানি পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়েছেন?’

‘এতে এত আশ্চর্য হবার কী আছে মশাই? ভ্রমণের জন্যে আবার প্রগতি লাগে নাকি? যা লাগে সেহচ্ছে টাকা। একটা বেড়ালের গলায় আপনি টাকার থলি বেঁধে ছেড়ে দিন, সেও বিলেত আমেরিকা ঘুরে আসতে পারবে। আর এ তো জলজ্যান্ত দুটো মানুষ। তা ছাড়া এঁরা কি আর সেই জঙ্গলরাজ্যে পড়ে থাকেন মশাই? সারাবছরই ছেলেকে নিয়ে হিল্লি-দিল্লি করে বেড়ান। রাজ্যে থাকতে আছেন শুধু বৃদ্ধ রাজা ও রানিমা। তবে এবারে যুবরাজ যুবরানিমা নিজেরা পৃথিবী ভ্রমণের প্রাক্কালে এই বালককে পিতামহ পিতামহীর কাছে রেখে গিয়েছিলেন। ….কিন্তু এমনই অদৃষ্টের পরিহাস তাঁরা চলে যাবার ক-দিন পরেই হঠাৎ ছেলে হাওয়া। দেখুন ভেবে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মানসিক অবস্থাটি কেমন! সেআজ ছয় মাস হয়ে গেল। …তদবধি আমি এই তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে ভারত চষে বেড়াচ্ছি। ছেলে খোঁজার দৌলতে কত দেশভ্রমণ, কত তীর্থদর্শন হয়ে গেল, ইয়ে মানে বাধ্য হয়েই ঘুরতে হয়েছে আর কী। এর মা-বাপ ফিরে আসার আগে ছেলেকে খুঁজে বার করে রাখাই চাই। বুঝতেই পারছেন, রাখতে না পারলে মুখটা কোথায় থাকবে?’

‘তাই তো—’

বিশ্বাস বিজ্ঞের মতো বলে, ‘কথাটা সত্যি। কিন্তু ছবি ছাপিয়ে কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেই তো হত।’

‘চমৎকার বলেছেন! সেকাগজ যদি ‘ইন কেস’ যুবরাজ-যুবরানির হাতে পড়ে যায়? তখন? কী কেলেঙ্কারিটা হবে ভাবুন। তাঁরা ছেলে রেখে নিশ্চিন্ত হয়ে বেড়াতে বেরোলেন, আর—যাই হোক মশাই, ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন। এখন চলো ভাই—’

ভালো করে হাত ধরেন টিকলুর।

বাপু হাত পা ছুড়ে প্রায় ভেঙিয়ে বলে ওঠে, ‘আহা! এখন চলো ভাই!’ আবদার! শুনছিস টিকলু! বুড়োর চালাকি? বুঝেছি—আপনি বুড়ো হচ্ছেন একটি ছেলেধরা। দল নিয়ে বেরিয়েছেন মেলাতলায় ছেলে ধরতে। বুঝি না কিছু? টিকলু দাঁড়া তুই, আমি পুলিশ ডাকতে যাচ্ছি—’

কিন্তু এ কী? টিকলু হঠাৎ এমন ঠাণ্ডা মেরে যায় কেন? টিকলুর সেই রাগারাগি দাপাদাপি কোনফাঁকে অন্তর্হিত? টিকলুর মুখে যেন একটি অলৌকিক লাবণ্যময় হাসির আলো।

সেই হাসির আলো-মাখা মুখেই টিকলু অলক্ষে বাপুর গায়ে একটা খুদে চিমটি কেটে মোলায়েম গলায় বলে, ‘এই বাপু, ছি! ওভাবে কথা বলতে হয় না। যতই হোক উনি আমাদের গুরুজনের মতো।’

উনি আমাদের গুরুজনের মতো!

বাপুর মুখটা হাঁ হয়ে যায়।

‘তা তো নিশ্চয়ই। শুনলি তো তিন পুরুষ ধরে উনি আমাদের—’

বাপু চেঁচিয়ে উঠে বলে, ‘পাগলদের পাল্লায় পড়ে তুইও পাগল হয়ে গেলি নাকি রে টিকলু? কী বকতে শুরু করলি?’

টিকলু আবার অলক্ষ্যে হাত বাড়িয়ে বাপুর গায়ে একটি শ্যাম চিমটি কেটে ধ্যানী বুদ্ধ ধ্যানী বুদ্ধ মুখে বলে, ‘থাক বাপু! ধরাই যখন পড়ে গেছি, তখন আর লুকোবার চেষ্টা করে লাভ নেই। আমায় যেতে দে—’

বক্রেশ্বর বাক্যবিনোদ আকর্ণ হেসে ফেলে বলেন, ‘এই তো সোনাছেলের মতো কথা! ওরে গজগোবিন্দ, একখানা ট্যাক্সি ডাক। বলবি সোজা ডায়মণ্ডহারবার। যত টাকা লাগে।

সেই সিকিবুড়ো গোছের লোকটা সাঁ করে বেরিয়ে যায়।

আর বাপু হতাশমুখে ফেলে আসা টিনের চেয়ারটাতেই আবার বসে পড়ে বলে, ‘টিকলু, আমার মাথা ঘুরছে।’

‘আহা হা, বোধ হয় খিদেয়।’

বিশ্বাসমশাই তৎপর হয়ে বলেন, ‘ইস দেখো তো কী কান্ড। ছেলেরা চা খেতে এসেছিল! …সাধন, চটপট দুটো অমলেট, দু-পেয়ালা চিনির চা, আর দু-পিস করে মাখনদার টোস্ট। খবরদার বিল কাটবি না।’

বক্রেশ্বর গর্জে ওঠেন, ‘বিল কাটবে না মানে? আমার সামনে আপনি হিঙুলগঞ্জের রাজকুমারকে দাতব্যে খাওয়াবেন?’

‘আ ছি ছি, এ কী বলছেন!’

বিশ্বাস অবিশ্বাস্য রকমের লম্বা জিভ কেটে বলে, ‘আমার এমন আস্পর্ধা হবে? আপনি খুশি হয়ে যা দেবেন মাথা পেতে নেব। আমার দোকান থেকে আপনি হারানো মানিক খুঁজে পেলেন, আমায় তো আপনার সোনার মেডেল দেবার কথা।’

‘দেবার কথা, দেব। হিঙুলগঞ্জে গিয়ে পাঠিয়ে দেব। এখন ছেলেকে নিয়ে সেখানে পৌঁছে যেতে পারলে বাঁচি।’

তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে টিকলুর দিকে তাকিয়ে থাকেন বক্রেশ্বর, পাছে পালায়।

বিশ্বাস তার টেবিলে পরিপাটি করে দু-জনের মতো খাবার গুছিয়ে দেয়।

টিকলু চেয়ারটা টেনে নিয়ে আবার গুছিয়ে বসে বলে, ‘আয় বাপু, শেষবারের মতো দু-জনে একসঙ্গে খেয়ে নিই।’

বাপু আর সহ্য করতে পারে না, হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে বলে, ‘সত্যি সত্যি তুই ওই বুড়োর সঙ্গে চলে যাবি?’

টিকলু করুণাঘন কন্ঠে বলে, ‘যেতেই যে হবে ভাই। এখন বুঝতে পারছি চলে এসে কাজটা বড়োই খারাপ করেছিলাম। আহা ঠাকুরমা-ঠাকুরদা বুড়ো মানুষ! তাঁদের খুব কষ্ট দেওয়া হয়েছে।’

তারপর চায়ে চুমুক দিতে দিতে গলার স্বর খুব নামিয়ে আস্তে আস্তে বলে, ‘এই বাপু, মন খারাপ করিস না, মজাটা একটু দেখাই যাক না। দেখ গল্পের বইতে ছাড়া ‘অ্যাডভেঞ্চার’ যে কী জিনিস তা তো কখনো জানলাম না, ভাগ্যে যখন জুটে যাচ্ছে, দেখেই আসি না একবার।’

বাপু ধরাগলায় বলে, ‘আর ফিরবি তুই?’

‘ফিরব না? পাগল নাকি?’

‘ওরা তোকে ছাড়বে?’

‘ধরে রাখবে এত সাধ্যি আছে?’

‘আর মাসিমা যখন বলবেন, টিকলু কই?’

‘তুই বলে দিবি মেলার ভিড়ে কোথায় হারিয়ে গেল দেখতে পেলাম না।’

‘আচ্ছা, বুড়ো যা বলছে সত্যি বলে মনে হচ্ছে তোর? তুই কি ঠিক ওদের ছেলের মতন দেখতে?’

‘খুব সম্ভব। না হলে ঝাঁপিয়ে এসে পড়ল কেন?’

‘ছেলেধরা হতে পারে না?’

‘পৃথিবীতে এত ছেলে থাকতে আমাকেই বা ধরতে আসবে কেন?’

‘তা বটে!’ বাপু চুপ করে যায়।

বক্রেশ্বর বক্রদৃষ্টিতে তাকিয়ে আতঙ্কের গলায় বলেন, ‘আবার দু-জনে কী ফুসফুস গুজগুজ হচ্ছে?’

টিকলু খেয়ে প্যান্টে হাত মুছতে মুছতে টান টান হয়ে জোরগলায় বলে, ‘কী আবার? এতদিন একসঙ্গে থাকলাম, বন্ধুত্ব হল, চলে যাবার সময় গল্প করে যাব না?’

বক্রেশ্বর বোধ হয় ভয় খান, বাবেন খাঁচায় ভরে ফেলতে না পারা পর্যন্ত বেশি চাপ দিয়ে কাজ নেই। তাই ব্যস্ত হয়ে বলেন, ‘তা তো সত্যি, তা তো সত্যি, কও ভাই কও। আমার ভাবনা, পাছে আবার শিকলি কাটো।’

টিকলু বুক টান করে বলে, ‘দেখুন, হিঙুলগঞ্জের রাজবাড়ির ছেলে কখনো মিথ্যে কথা বলে না। একবার যখন বলেছি ফিরে যাব, তখন যাবই। বেশি ইয়ে করলে বিগড়ে যাব কিন্তু।’

‘না না, সেকী! চলো ভাই, তাই চলো।’

বক্রেশ্বর বাক্যবিনোদ ত্রস্তেব্যস্তে বলেন, ‘তোমার মা-বাপ ফিরে আসা পর্যন্ত অন্তত থেকো ভাই, যাতে এই বুড়োটার মুখ থাকে, মাথা থাকে।’

বক্রেশ্বর যেন বিনয়ে গলে পড়েন।

আর বক্রেশ্বর কেবল তাকাতে থাকেন ট্যাক্সি আসছে কি না দেখতে।

অবশেষে গজগোবিন্দ এসে খবর দেয়, ট্যাক্সি এসেছে, মেলার প্যাণ্ডেলের বাইরে আছে।

টিকলু বাপুর শার্টের কাঁধটা খামচে ধরে বলে, ‘বেশি মন খারাপ করবি না তো?’

‘আমি চলে গেলে তুই কী করতিস?’

‘আহা সেতো বুঝছিই। তবু।’

‘আমিও বাড়ি ফিরছি না, মেলাতলায় হারিয়ে যাব।’

‘এই বাপু খবরদার! একজন গিয়ে খবর না দিলে বাড়ির লোকেরা থানা-পুলিশ করবে।’

‘তোর মন কেমন করছে না?’

‘করছে না, তা বলছি না। কিন্তু মন কেমন করলে কোনো মহৎ কর্ম হয় না বাপু!’

‘তুই যে ওদের ছেলে নয় এটা বুঝতে পেরে তোকে যদি ওরা মেরে ফেলে?’

টিকলু আত্মস্থগলায় বলে, ‘দূর বোকা, তাই কখনো করে? যতদিন না সেই যুবরাজ যুবরানি পৃথিবী ঘুরে বাড়ি ফিরছেন, ততদিন পর্যন্ত আমায় না রাখলে ওদের চলবে?’

গজগোবিন্দ তাড়া দেয়, বক্রেশ্বর টিকলুকে প্রায় বেষ্টন করে নিয়ে স্টল থেকে নামেন। পিছু পিছু মস্তানমার্কা ছেলে দুটো।

বিশ্বাস হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। তৎক্ষণাৎ সোনার মেডেল অবশ্যই দেওয়া হয় না তাকে, তবে এ আশ্বাস দেওয়া হয় হিঙুলগঞ্জে গিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

কী চায় বিশ্বাস?

সত্যিই মেডেল? নাকি ঘড়ি, আংটি, কলম, সোনার বোতাম? যা চায় বলে রাখুক। বক্রেশ্বর দায়িক। আর চায়ের দামটা? সেএই খান দুই দশটাকার নোট রইল টেবিলের ওপর।

‘তোকে দেখে নিলাম!’

বলে গট গট করে চলে গেল বাপু। আর সেইমুহূর্তে টের পেল টিকলু, খেলাচ্ছলে নিজেই নিজেকে কী জালে ফেলেছে সে। এখন আর উপায় নেই। কারণ এখন সেট্যাক্সিতে চড়ে বসেছে, তারসঙ্গে অপর পক্ষের চার-চারজন লোক।

অতএব প্রাণের বন্ধু বাপু, চিরকালের এই রামরাজাতলা, মা, বাবা, ঠাকুমা, সেজোকাকা, ছোটোকাকু চারিদিকের যত আপন লোক সব কিছু ছেড়ে এক অজানা অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যেতে হবে টিকলুকে।

পেছনে মেলাতলার কলরোল ছাপিয়ে শব্দ উঠছে, ‘বিশ্বাসের টি স্টল! বিশ্বাসের টি স্টস! আসল দার্জিলিং টি! একবার খেলে দু-বার খেতে চাইবেন…সেকেণ্ড কাপ হাফ প্রাইজ…জলের দরে চা।’

টিকলু তার ঠাকুরমার ভাষায় মনে মনে বলে ফেলল, ‘কী কুক্ষণেই ওই বিশ্বাসের চায়ের দোকানে ঢুকেছিলাম।’

রামরাজাতলা থেকে বেরিয়ে এসে হাওড়া পার হয়ে কলকাতায় পড়ল টিকলুরা।

কলকাতার রাস্তা! কী রোমাঞ্চ তাকে ঘিরে!

মানিকতলায় বড়োমাসির বাড়ি, কখনো সখনো আসা হয়, কী উত্তেজনা, কী আনন্দ হতে থাকে আসবার আগে। তাও কি আর এমন আরামসে ট্যাক্সি চেপে আসা? ভিড়ে গাদাগাদি হয়ে দু-বার বাস বদলে বদলে তবে তো! কিন্তু তাতে কী? ঘাড় বাঁকিয়ে জানলায় চোখ মেলে রাস্তাটাকে যেন চোখ দিয়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়। অথচ এখন?

চোখ বুজে সিটে পিঠ ঠেসিয়ে বসে আছে টিকলু।

টিকলু সেই বোজাচোখের মধ্যে থেকেই ওদের বাড়ির উঠোনটা দেখতে পাচ্ছে।

সন্ধে হয়ে গেছে। (কারণ বাপু নিশ্চয় অনেকক্ষণ একা একা ঘুরে তারপর বাড়ি ফিরেছে) বাপু দাঁড়িয়ে আছে মলিনমুখে, আর টিকলুদের বাড়িসুদ্ধ সবাই বাপুকে জেরা করছে, কখন তারসঙ্গে ছাড়াছাড়ি হল টিকলুর, তারআগে কী কী ঘটেছিল।

সেজোকাকা তো বোধ হয় ছিঁড়েই খাচ্ছেন ওকে উকিলি জেরার প্যাঁচ চালিয়ে চালিয়ে।

বেচারি বাপু!

এখন মনে হচ্ছে টিকলুর, বাপুকেও সঙ্গে নিয়ে এলে হত। যদি বলতাম, ‘আমার এই বন্ধুকেও আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই, না হলে যাব না,’ তা হলে বড়ো ভালো হত।

তখন যে কেন বুদ্ধিটা মাথায় এল না!

তখন এই বক্রেশ্বর বুড়োর রাজাই-চালের কথাবার্তা শুনে হঠাৎ কেমন মজা লেগে গেল, প্রাণে অ্যাডভেঞ্চারের সাধ জেগে উঠল।

হঠাৎ নিজেকে চাঙ্গা করে নিল টিকলু।

গল্পের বইতে ছোট্ট ছোট্ট ছেলেদের কত দুঃসাহসিক অভিযানের কাহিনি পড়েছে টিকলু, আর সেতো একটা বুড়োধাড়ি ছেলে।

যদি ওখানে কেউ বুঝতে পারে টিকলু স্রেফ জাল রাজকুমার!

টিকলু বুকটান করে নিশ্বাস নিল।

আমার কী?

আমি বলব, আমি বন্ধুর সঙ্গে মেলা দেখছিলাম, এই বক্রেশ্বর কোম্পানি আমায় জোর করে ধরে এনেছে। আমি চেঁচাইনি কেন?……

কেন আবার? আমার নাকেমুখে ওষুধ-মাখা রুমাল চেপে ধরা হয়নি বুঝি? আমাকে কখন কীভাবে কোথা দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে টেরই পাইনি।

কিছুদিন আগেই পড়া একখানা ডিটেকটিভ বইয়ের গল্পের কাহিনি থেকে ভেবে নিতে থাকে টিকলু।

তবে খানিকটা ঠিকই; কোথা দিয়ে যে নিয়ে চলল টিকলুকে, তার কিছুই বুঝল না সে।

ওর শুধু মনে হতে থাকে যেন অনন্তকাল ধরে ট্যাক্সি চেপে চলেছে তো চলেইছে। যেন এই যাত্রাপথের শেষ নেই।

টিকলু কি তবে গল্পের সেই ভূতুড়ে রেলগাড়ির মতো কোনো ভূতুড়ে মোটরগাড়িতে চড়েছে? এ আর কোনোদিন থামবে না? টিকলুকে নিয়ে এক অশেষ অনন্তপথে নিয়ে যেতে যেতে, হঠাৎ কোনখানে আছড়ে ফেলে দেবে? আসল কথা একটানা মোটরগাড়ি চাপা টিকলুর জীবনে কখনো ঘটেনি।

চোখ বোজা, তবু অনুভব করছিল যেন অন্ধকার অন্ধকার পথ দিয়ে চলছিল, হঠাৎ টের পেল খুব একটা আলো-ঝলমলে জায়গায় এসে পৌঁছে গেছে তারা।

চোখ খুলল টিকলু।

ওরা সব নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছে।

শুনতে পেল বক্রেশ্বর গজগোবিন্দকে নির্দেশ দিচ্ছে, ‘এইখানেই আজ রাতটার মতো খাওয়া-শোওয়ার ব্যবস্থা করে নিতে হবে। কাল ভোরের আগে স্টিমার বা লঞ্চ কিছুই ছাড়বে না।’

খাওয়া-শোয়ার কথা শুনে মনটা একটু উৎফুল্ল হল টিকলুর।

তা হলে গাড়ি থেকে নামা হবে।

বাঁচা গেল বাবা!

এই হচ্ছে মানুষের মনের মজা!

যে টিকলু দৈবাৎ একটু মোটরগাড়ি চড়বার সুযোগ পেলেই মনে করে, হায় হায় এক্ষুনি কেন নামতে হচ্ছে, অনেক অনেকক্ষণ কেন চলল না, রেলগাড়িতে চাপলে মনে করে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস রেলগাড়িতেই কেন থাকা হয় না? সেই টিকলুই ভাবল নামা হবে! বাঁচা গেল বাবা!

এই জায়গাটার নামই নাকি ডায়মণ্ডহারবার। ওই আলো-ঝলমলে বাড়িটা হচ্ছে গভর্নমেন্টের রেস্ট হাউস। নাম ‘সাগরিকা’। চমৎকার জায়গা।

বক্রেশ্বর আর গজগোবিন্দর মতো গাঁইয়া লোককে এখানে মোটেই মানাচ্ছে না। কিন্তু তাতে তো ওদের বয়েই গেল। নিজেই তো বলেছেন বক্রেশ্বর বাক্যবিনোদ মশাই, টাকা জিনিসটা এমন যে একটা বেড়ালের গলায় বেঁধে দিলেও বেড়ালটা বিলেত আমেরিকা ঘুরে আসতে পারে।

এরা যেমনই হোক, টাকা আছে দেদার।

খাওয়াটা ভালো, বিছানাটা সুন্দর, আর এই চার-চারটে লোকের তোয়াজ, মন্দ লাগল না। কবে আবার ডানলোপিলোর গদিতে শুয়েছে টিকলু? আর কবেই বা তার কাছে কেউ এমন জোড়হস্ত থেকেছে?

বাড়িতে তো ভোর হতে না হতেই ছোটোকাকুর হুমকি শোনা যায়, ‘কী, শাহানশা বাদশা, এখনও নিদ্রামগ্ন? তা এবার গা তুলুন!’

ভোরবেলা উঠে ব্যায়াম করা ছোটোকাকুর এক বাতিক। তা শুধু নিজের বাতিক মিটিয়ে ক্ষান্ত হও না বাপু? তা নয়, বেচারি টিকলুকেও সেই দলে টানা চাই।

অতএব টিকলুকেও ভোরবেলা উঠে ডন-বৈঠক করতে হয়, আদা ছোলা খেতে হয়।

তারপরেই সেজোকাকার ডাক, ‘কই মহাপ্রভু গেলেন কোথায়? বই-খাতাগুলো নিয়ে একটু বসলে হত না? পড়তে হবে না বাপু, তুমি একবার ওগুলো নিয়ে পড়ার টেবিলে বোসো, দেখে চক্ষু সার্থক করি।’

পড়তে বসার সঙ্গে সঙ্গেই মায়ের ডাকাডাকি, ‘দুধ ডিম না খেয়েই পড়তে বসা হল? রোজই বলতে হবে এটুকু খেয়ে তবে পড়তে বসো।…..এসো, খেয়ে আমায় উদ্ধার করো।’

খাবার সময় আর এক শোরগোল।

কোথা থেকে যে আঁখিপাত করে বসে থাকেন ঠাকুমা, হঠাৎ হইচই শোনা যায়, ‘ওরে মা রে, আমি কোথায় যাই রে—মুরগির ডিম খেয়ে জামায় হাত মুছল! কেন, জগৎ-সংসারে জল নেই? হাতটা একটু ধুতে পারো না পাজি ছেলে?’

ঝাড়িয়ে কাটিয়ে যদি বা পড়তে বসল, পিসি এসে হানা দিল, ‘এই টিকলু, চট করে চার আনার পাঁচফোড়ন এনে দে তো, এই টিকলু, ছুট্টে একটু হলুদগুঁড়ো নিয়ে আয় তো, টিকলু, অমুক বেড়াতে এসেছে দুটো রাজভোগ আন তো—’

টিকলু যদি বিদ্রোহ করে, পিসি হাত মুখ নেড়ে বলবে, ‘গেরস্তর ছেলে, সংসারের এটুকু করতে পারবে না? খেলায় মত্ত থাকবার সময় তো পড়ার চাড় দেখি না। আরে বাবা, সারাদিনরাত পড়লেও তুমি ফার্স্ট সেকেণ্ড হবে না, এই আমি স্ট্যাম্প কাগজে লিখে দিলাম।’

টিকলুর ইচ্ছে অনিচ্ছে নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। টিকলু যদি গণেশকে এক-আধবার ডাকে ঘুড়ির ধরাই দিতে, কী বলে খেলার সঙ্গী হতে, অমনি তক্ষুনি বাড়িতে যেন ‘গণেশ গণেশ’ রব পড়ে যাবে।

‘গণেশ তোমার সঙ্গে খেলছে? কাজ নেই ওর? খেলার নেশা ঢুকিয়ে দিয়ে ওর পরকালটি ঝরঝরে করে দিতে চাও?’

অনেক চেষ্টা করে করে এইগুলো মনে আনে টিকলুর ‘মন কেমন’ ছাড়াবার জন্যে, কিন্তু আশ্চর্য, এতে মন বসা ছেড়ে, বেড়েই যায়। মনে হয় ঠাকুমা যখন অত হইচই করে, হাতটা একটু ধুলেই হয়। পিসির সঙ্গে তর্কাতর্কি করে সময় খরচ না করে এককথায় এনে দিলেই হয়। বাড়ির সামনেই তো দোকান।

হঠাৎ খেয়াল হল, এখন আর বর্তমান নয়, অতীত। ‘করলে হয়’ নয়, ‘করলে হত’।

তবু ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়েও পড়ল। বেশ শান্তির ঘুম।

ক্লান্ত ছিল তো।

সক্কালবেলাই লঞ্চ ছাড়বে।

সঙ্গের মস্তান-মার্কা দু-জনের একজন প্রায় করজোড়ে এসে ডাকল, ‘খোকা রাজাবাবু, এবার তো উঠে পড়তে হয়। ইস্টিম লঞ্চ ছাড়বার সময় হয়ে এল।’

চোখ খোলবার আগেই মনে পড়ে টিকলুর, এখন সেরাজপুত্তুর।

টিকলুর সেই পুজো প্যাণ্ডেলে দেখা পাড়ার শখের যাত্রাদলের সাজা নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে মনে পড়ে গেল। অবনীদা সেজেছিল, কিন্তু কে বলবে সে-ই অবনীদা। সাজসজ্জায় তো বটে, হাবে-ভাবে কোথাও কোনোখানে ‘অবনীদার’ চিহ্নমাত্র নেই, যেন সত্যিই নবাব।

টিকলুকেও তেমনি হতে হবে এখন থেকে।

টিকলু একটু হাই তুলে বলল, ‘ঠিক আছে।’

হাত মুখ ধোয়ার পর টিকলুকে এক প্রস্থ মিহি আদ্দির চুড়িদার চোস্ত আর কল্কাদার পাঞ্জাবি দেওয়া হল পরতে। দেখেই রাগ ধরে গেল টিকলুর। টিকলু খোকা নাকি?

এ-সব যে কোথা থেকে সংগ্রহ করল বুড়ো কে জানে বাবা। নেহাত আনকোরাও তো নয় যে ভাববে কিনে আনা হয়েছে।

না জিজ্ঞেস করে পারল না, ‘এটা কোথা থেকে এল?’

ওই ছোকরার নাম নিধিরাম, সেবলে ওঠে, ‘খোকা রাজাবাবু কি এই ক-মাসেই নিধিরামের নাম ভুলে গেছেন?’

নিধিরাম! নিজেই বলে ফেলেছে।

টিকলু গম্ভীরভাবে বলে, ‘বাজে কথা রাখো নিধি, যা জিজ্ঞেস করছি তার জবাব দাও।’

নিধিরাম মাথা চুলকে বলে, ‘দেওয়ানবাবু ঠিকই বলেছে, মেজাজেই মালুম। এগুলো তো দেওয়ানবাবু সঙ্গে নিয়ে নিয়ে ফিরছে। জানেই তো এতকাল কোথায় না কোথায় কী না কী ঘুরছে, হঠাৎ রাস্তায়ঘাটে দেখতে পেলেই তো ক্যাঁক করে ধরে ফেলতে হবে, কোন সাজে রাজ্যে নিয়ে ঢোকানো হবে।’

‘থামো, বেশি কথা বলতে হবে না।’

বলে পোশাকটা পরে ফেলে টিকলু।

দেখেই যে রেগে জ্বলে গিয়ে মনে হয়েছিল ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলবে, ‘এ-সব আমার কস্মিনকালেও পরা অভ্যাস নেই’, ভাগ্যিস বলেনি সেটা। তা হলেই তো ধরা পড়ে যেত।

সকালবেলা আর কালকের মতো খুব খারাপ লাগছে না। নতুন দৃশ্য, নতুন অবস্থা, নতুন একটা জীবনের পথে যাত্রা! মন্দ কী? এই তো অ্যাডভেঞ্চার।

স্টিমলঞ্চে চড়া টিকলুর জীবনে এই প্রথম। পাশে পাশে কাটিয়ে চলেছে কত ঝোপজঙ্গল, চালাঘর, ছোটো ছোটো গ্রাম। জিজ্ঞেস করবার জন্যে মন উশখুশ করছে, কিন্তু জিজ্ঞেসের উপায় নেই, এ পথ তো আর রাজকুমার দীপেন্দ্রনারায়ণ পাট্টাদারের অজানা হবার কথা নয়। কে জানে, কতবার এ পথে যাওয়া-আসা করতে হয়েছে তাকে।

বকখালি, কুমিরখালি, ভাসানখালি। অবশেষে হিঙুলগঞ্জ।

স্টিমলঞ্চ, গোরুরুগাড়ি, পালকি! অবশেষে রাজবাড়ির জুড়িগাড়ি।

জীর্ণ বিবর্ণ হলেও বেশ বিরাট দেউড়ি, দেউড়ির দু-ধারের থামের মাথায় থাবা উঁচানো সিংহমূর্তি বসানো, লোহার গেট, মরচে ধরা তবু জগদ্দল পাথরের মতো ভারী, সহজে ঠেলে খোলা সম্ভব নয়, দু-তিনটে লোকের দরকার, তাই ওই গেটের মাঝখানে একটা ছোটো কাটা দরজা, সর্বদা যাওয়া-আসা সেই দরজা দিয়েই।

তাতেও অবশ্য ভেতর থেকে তালাচাবি লাগানো।

বক্রেশ্বর বাক্যবিনোদ চড়াগলায় হাঁক দিলেন, ‘কৌন হ্যায়!’

সঙ্গে সঙ্গেই কড়াং করে একটা শব্দ হল। তারমানে তালা খোলা হল। তারমানে সেখানে লোক মোতায়েন ছিল।

চৌকো গড়নের কাচের লন্ঠন হাতে একটা লোককে সেই কাটা দরজার মধ্যে দেখা গেল। লোকটা আপাদমস্তক বাঙালি!

বক্রেশ্বরও বাঙালি।

তবু রাজবাড়ির কায়দা, তাই ডাকতে হল ‘কৌন হ্যায়।’

লোকটা কয়েক সেকেণ্ড হাতের আলোটা উঁচু করে ধরে দৃশ্যটাকে যাকে বলে অবলোকন করে নিয়ে বিচলিত গলায় বলে, ‘দেওয়ানবাবু! আপনি! সঙ্গে কে?’

দেওয়ানবাবু, অর্থাৎ বক্রেশ্বর বাক্যবিনোদ প্রায় খিঁচিয়ে উঠে বলেন, ‘সঙ্গে কে দেখতে পাচ্ছ না?’

‘আঁ—আঁগ্যে পাচ্ছি বই কী! নি—নিধিরাম, ভজ—ভজহরি, গ গ গ গজ—গোবিন্দবাবু, আর—’

‘আর কী? থেমে গেলি কেন?’

লোকটা ছাড়া ছাড়াভাবে বলে, ‘খোকা—রাজা—বা—বু!’

‘যাক। বুঝতে পারলে তা হলে? এখন সরো, দরজা ছাড়ো! তুমি ফোকর আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকলে আমরা কি মাছি হয়ে ঢুকব?’

লোকটা তটস্থ হয়ে সরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘খোকা রাজাবাবুকে তা হলে খুঁজে পেলেন?’

‘খুঁজে পাব না তো কি ঘোড়ার ঘাস কাটতে বেরিয়েছিলাম?’

‘আজ্ঞে তা বলছি না। মা হিঙুলরানি কালীর কী কৃপা তাই বলছি।’

বক্রেশ্বর খিঁচিয়ে ওঠেন, ‘হ্যাঁ অশেষ কৃপা! কৃপা না হলে লোহার দুর্গের ভেতর থেকে হঠাৎ ছেলেটাকে ‘হাওয়া’ করে দেন। তারপর এই ছ-মাস ধরে বেপাত্তা করে রেখে হতভাগা বুড়োকে দিয়ে গোরু-খোঁজা খোঁজালেন।…নাও সরো। মেলা বকবক করো না। কর্তারাজা আর কর্তারানিমা আছেন কেমন তাই বলো।’

‘আজ্ঞে তেনাদের আর থাকাথাকি। রাম বনে চলে যাওয়ার পর রাজা দশরথ আর মা কৌশল্যের যেমন অবস্থা হয়েছিল, সেই অবস্থায় আছেন।’

বক্রেশ্বরের আগেই গজগোবিন্দ ধমক দিয়ে ওঠে, ‘বৈকুন্ঠ, তুমি বুঝি সেই রাজা দশরথ আর মা কৌশল্যের যেমন অবস্থা দেখে এসেছিলে? এই লোকটা যদি কখনো কোনো সময় একটা সাদা বাংলায় কথা বলবে! সব সময় কথায় গহনার ছটা। বাবুর যেন বেদ পুরাণ সব মুখস্থ। বলি শরীর-গতিক কেমন আছে তাঁদের? খাওয়া-দাওয়া করছেন ঠিকমতো?’

‘বৈকুন্ঠ মাথা নেড়ে বলে, ‘সেটি বলতে পারব না ছোটো নায়েববাবু। ওসব হচ্ছে রান্নাশালার ডিপাটমেন্টো!’

টিকলু হঠাৎ জোরগলায় বলে ওঠে, ‘গেটে দাঁড়িয়ে এতকথা বলার কী আছে? প্রাসাদে ঢুকলেই তো জানা যাবে।’

রাজ্যের ভাবী মালিকের মতোই জোর শোনায় টিকলুর গলা। বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলে।

বক্রেশ্বরের কপালটা কুঁচকে যায়, ভুরুটা খাড়া হয়ে ওঠে, ঠোঁটটা ঝুলে পড়ে।

বক্রেশ্বর কিন্তু কথা বলে মধু ঢেলে, ‘এই তো। ঠিক তো। এমন মেজাজ না হলে মানায়! এসো ভাই এসো। ভিতরে বসবে এসো। হাতমুখ ধুয়ে বিশ্রাম করবে চলো। ততক্ষণে রাজাবাবুকে খবর দিয়ে রাখি। আচমকা সামনে নিয়ে গেলে অতিআহ্লাদে হার্টফেল করে বসতে পারেন। অবশ্য দুটি চক্ষে ছানি, দেখতে পাবেন না।’

টিকলু মনে মনে বলে, হুঁ! সেটাই সুবিধে হয়েছে। মুখে বলে ওঠে, ‘রাজা রানি, দু-জনের চোখেই ছানি?’

বৈকুণ্ঠ কাতর কাতর গলায় বলে, ‘আহা তা অবিশ্যি নয়। কিন্তুক কেঁদে কেঁদেই তো দু-চক্ষু অন্ধ করে ফেলেছেন রানিমা। একবার করে দেওয়ানবাবুর চিঠি আসে—‘এখনও সন্ধান নেই, আরও টাকা পাঠান’, আর কর্তারানিমা বিছানা নেন। বললে বিশ্বাস করবেন না দেওয়ানবাবু, মন খারাপের চোটে উনি একদিন ওনার মেয়েদের ঘুম পাড়াতে ভুলে গেছলেন।’

‘বটে নাকি? বলিস কী? অ্যাঁ! তা যাক, এতদিনে দুঃখ ঘুচল। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরল। চলো হে গজগোবিন্দ। নিধিরাম, ভজহরি, তোমরা এখন তোমাদের ‘স্ব স্ব’ গৃহে ফিরতে পারো! তোমাদের পাওনা-গন্ডার হিসেব পরে হবে।’

নিধিরাম বেজার গলায় বলে, ‘সমানে তো জপাতে জপাতে আসছিলেন দেওয়ানমশাই, ‘ওখেনে পৌঁছেই তোদের এই এতদিনের ঘুরুনির মজুরি দিয়ে দেব’, এখন আবার ‘পরে’ দেখাচ্ছেন?

‘এ তো আচ্ছা ইয়ে দেখছি। সাধে কি আর বলে ‘এ যুগের ছেলে!’ পেন্টুল পরতে শিখলেই বাছাদের সব মেজাজ গরম হয়ে যায়। বলি দৈনিক ‘ক পয়সা রোজগার করতিস তোরা? বাপের খেতখামারে তো খাটতে দেখিনি কখনও। কোথা থেকে না কোথা থেকে পেন্টুল পরতে শিখলি, আর গলায় রুমাল বাঁধতে শিখলি, ব্যস মস্ত তালেবর হয়ে গেলি, কেমন? বেকার বসে বাপের অন্ন ধ্বংসাচ্ছিলি, আমি এই ছ-মাস ধরে তোদের লালনপালন করিনি?

ভজহরি ঘাড় গোঁজ করে বলে, ‘তা আপনার সঙ্গে সঙ্গে ঘোরাও তো একটা চাকরি, তার বদলে লালনপালন করেছেন এ আর আশ্চয্যি কী? বলেছিলেন না এত টাকা দেব যে তোদের দু-জনার একটা করে ছাইকেল আর একটা করে ‘ট্যানজিস্টো’ হয়ে যাবে। কাজ গুছিয়ে এখন বুঝি কলা ঠেকাবেন?’

বক্রেশ্বর কী বলতেন কে জানে, কিন্তু টিকলুর মধ্যেকার ‘রাজকুমার’ জেগে উঠল, এবং রেগে উঠল।

টিকলু কড়াগলায় বলে উঠল, ‘নিধিরাম, ভজহরি, তোমাদের কথাটথা খুব খারাপ শুনতে লাগছে। এভাবে কথা বলবে না। রাজবাড়ি থেকে কখনো কারও পাওনা টাকা মারা গেছে দেখেছ?’

পাওনা টাকা মারা যাওয়া কথাটা তার ঠাকুরমার কাছে শেখা। প্রায়ই বলতে শোনে ঠাকুমাকে, ‘এ-বাড়ি থেকে কারও পাওনা টাকা মারা যেতে দেখেছ?’

ভজহরি আর নিধিরাম দু-জনে একযোগে আধ ফুট লম্বা জিভ বার করে কান মুলে বলে, ‘অপরাধ হয়েছে খোকাবাবু! আচ্ছা এখন যাচ্ছি।’

টিকলু নিজের ভূমিকায় সচেতন হয়।

টিকলু বেশ দরাজ গলায় বলে, ‘এখন যাবে কেন? এত খেটে-টেটে এলে, খাওয়া-দাওয়া সেরে যাবে তো? বাড়িতে তো তোমাদের জন্যে রান্না করা নেই?’

বক্রেশ্বর হঠাৎ রাগ প্রকাশ করে বলেন, ‘এখানেই বুঝি প্রভুদের জন্যে পোলাও কালিয়া রান্না করা আছে?’

টিকলু গম্ভীরভাবে বলে, ‘পোলাও কালিয়া না হোক কিছু তো আছেই? এরা এখান থেকেই খেয়ে যাবে।’ টিকলুর গলাটা জোরালো।

নিজের মহিমায় নিজেই চমৎকৃত হয়ে যাচ্ছে টিকলু। সত্যি, নিজেকে যেন মালিক মালিকই মনে হচ্ছে।

ওদিকে বক্রেশ্বর বাক্যবিনোদ আর গজগোবিন্দর মুখের চেহারা যেন পেঁচার মতো হয়ে ওঠে।

বেজার মুখে বলেন বক্রেশ্বর, ‘দেউড়িতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই রাত কাবার করতে হবে নাকি? গজগোবিন্দ, যাও অন্দরে খবর দাও গে।’

দেউড়ি পার হয়ে টানা লম্বা একটা দালানে পড়ল টিকলু। অন্ধকার-অন্ধকার ছায়া-ছায়া। দু-পাশের টানা দেয়ালে মাঝে মাঝেই একটা করে তালাবন্ধ করা দরজা, আর সেই দরজার মাথায় উঁচুতে দেয়ালে আঁটা একটা করে কাচঘরে কেরোসিনের আলো। কিন্তু সেই লালচে আলোয় থেকে অন্ধকারের ভয়াবহতাটাই যেন বেশি প্রকাশ পাচ্ছে।

টিকলুর বুকটা ছ্যাঁত ছ্যাঁত করছে, টিকলুর মনে হচ্ছে কোথায় যেন ভয়ংকর কোনো বিপদ থাবা তুলে বসে আছে।

কিন্তু কী আর করা?

নিজেই তো নিজের বিপদ ডেকে এনেছে টিকলু। টিকলু আবার মনকে জোরালো করে নেয়। সেই কথাটাই ভাবে, বিপদ কীজন্যে হবে? ওই বক্রেশ্বর বুড়ো তো টিকলুকে তোয়াজ করতেই ব্যস্ত। তা ছাড়া এত কষ্ট করে ধরে এনে তো আর মেরে ফেলবে না?

আচ্ছা, সত্যিই কি বুড়ো আমায় এই রাজবাড়ির রাজপুত্তুর বলে ভুল করেছে? নাকি কোনো অভিসন্ধির বশে আমায় রাজপুত্তুর বলে চালাতে চেষ্টা করছে? ডিটেকটিভ গল্পে তো লেখে এরকম সব।

যা শুনেছি, তাতে তো জানলাম ছেলেটা এখানে বেশি থাকত না, মাঝে মাঝে আসত; নেহাত বাপ-মা বিলেত আমেরিকা চলে যাবার সময় রেখে গিয়েছিল বলেই—তা তাও তো কিছুদিন থেকেই পালিয়েছে। এখানের লোকজন বোধ হয় খুব বেশি চেনে না। রাজপুত্তুররা তো আর বাইরে বেরিয়ে মাঠে বাগানে খেলে বেড়ায় না, বাড়ির মধ্যেই থাকে নিশ্চয়। বাইরের লোকেরা বোধ হয় বুঝতে পারবে না।

ছেলেটা যে অনেকটা টিকলুর মতোই দেখতে সন্দেহ নেই। আবার গালেও নাকি টিকলুর মতোই একটা তিল আছে। বাড়িতে নিশ্চয়ই ছবি-টবি আছে, কাল দেখা যাবে। এখন সেই চোখে-ছানি রাজা-রানির সঙ্গে যে প্রথম দেখাটা রাত্রে অন্ধকারে হচ্ছে সেটা ভালো।

কে জানে তারা কীরকম দেখতে।

টিকলু যখনই মনকে জোরালো করে বুক টান টান করে নিশ্বাস নিচ্ছে, তখনই বেশ আমোদ লাগছে, আর কীভাবে সাহসে ভর করে চটপট কথা বলবে, তার রিহার্সাল দিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু মাঝে মাঝেই নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। বুদ্ধুও মনে হচ্ছে।

তখন নিজের মনের হাত দিয়ে মনের গালে ঠাস ঠাস করে চড় কশিয়ে দিয়ে বলছে, ‘কী দরকার ছিল রে তোর বুদ্ধু, অ্যাডভেঞ্চার করতে আসার? কী লাভ হবে তোর এতে? তোর মা-র কথা ভাবলি না, বাড়ির লোকের কথা চিন্তা করলি না?’

কিন্তু এত ভাবলে চলবে কেন?

যেসব ছেলে বাড়ি থেকে পালিয়ে হাজার কান্ড করে বেড়ায়, তাদের বুঝি মা-বাপ থাকে না?

টিকলু যখন এসব কথা ভাবছে, তখন টিকলুর সামনে এক থালা খাবার।

তবে এই খাদ্যবস্তুগুলোর মধ্যে কোনোটাই টিকলুর পছন্দের নয়। একদলা ছানা, এতগুলো ফল, পাঁচ-ছ-টা মিষ্টি, খানিকটা হালুয়া, এই হচ্ছে থালার তালিকা।

ফলের মধ্যে শশাটাই যা টিকলুর প্রিয়, তাই তুলে নিয়ে খায় আস্তে আস্তে।

খাওয়ার সামনে বক্রেশ্বর বসে আছেন, আর আছে একটা মোটাসোটা ঝি। ঝিয়ের হাতে আবার সোনার বালা, গলায় সোনার হার।

ওকে গজগোবিন্দ ‘বামুনদি’ ‘বামুনদি’ বলে ডাকছিল।

টিকলু কী বলে ডাকবে সেটাই ভাবনা। কাকে যে কী বলে ডাকত সেই দীপেন্দ্রনারায়ণ পাট্টাদার বাহাদুর তা কে জানে। ওইখানেই ধরা পড়ার ভয়।

বামুনদি বলল, ‘খোকা রাজাবাবু এতদিন নিরুদ্দেশ হয়ে পিথিমি ঘুরে এলে, কিন্তুক খাওয়া-দাওয়ার ভাব তো বদলাল না। সেই তো খাবারের পাত্তর সুমুখে রেখে বসে বসে টুকছ।’

টিকলু মনে মনে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এটা তা হলে মিলে যাচ্ছে।

কিন্তু আর একটা কথা বেশ ভাবনার। বামুনদি বলে চলেছে ‘চেহারার কী ছিরিছাঁদ হয়েছে। দেখে আর চেনা যায় না। রং কালীবর্ণ, গনড় ঠকঠকে। আগে কেমনটি ছিলে ভাবো?’

টিকলু রেগে বলে, ‘কেমনটি আবার! যত সব ইয়ে—।’

বামুনদি আবার বলল, ‘আমরা হলাম বাইরের নোক, বললে শোভা পায় না, কিন্তুক বাড়ি থেকে চলে যাওয়া কি ভালো কাজ হয়েছেল তোমার খোকাবাবু? পেরানে একটু মায়া-মমতা নেই?’

‘আঃ তুমি আবার কী বকবক করতে এলে?’

বক্রেশ্বর ক্রোধেশ্বরের মূর্তিতে বলেন, ‘অন্দরে কর্তারানিমাকে খবর দেওয়া হয়েছে কি না সেখোঁজটা তো দিচ্ছ না।’

বামুনদি গালে হাত দিয়ে বলে, ‘ওমা সেকী! এই যে বলনু, ছোটো নায়েবমশাই খবর দেছল, কর্তারানিমা তখন তেনার মেয়েদের খাওয়াচ্ছেলো। বলল, ‘এদের খাইয়ে শুইয়ে একেবারে নিচ্চিন্দ হয়ে যাচ্ছি।’ …..আসল কথা ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে, এই খবর জেনে বুকটা ঠাণ্ডা হয়েছে, এই আর কী।’

বক্রেশ্বর বলেন, ‘আর কর্তারাজা?’

বামুনদি আর একবার গালে হাত দিয়ে বলে, ‘ওমা! আপনি যে আকাশ থেকে পড়া কথা বলছ দেওয়ান মশাই। কর্তারাজা আবার কবে কোনদিন এই সন্দেরাত্তিরে সজ্ঞানে থাকে? দু-পহর রাত পার হবে, তবে তো আপিঙের ঝিমুনি কাটবে। ত্যাখন উঠে মিছরির শরবত খাবে, ক্ষীর লুচি, কলা সন্দেশ খাবে, গুড়ুর গুড়ুর তামাক খাবে, আর পেরান খুলে কথা বলবে। খোকা রাজাবাবু কি আর অত রাত অবদি জেগে থাকতে পারবে? ওনার সঙ্গে দেখা হতে সেই কাল ভোর সকাল।’

টিকলু মনে মনে বেশ আমোদ পায়। ছেলে হারিয়ে এত কষ্ট হচ্ছিল ওনাদের, অথচ ছেলেকে পাওয়া গেছে শুনে অস্থিরতা-টস্থিরতা নেই। আপিং খাওয়া আবার কী? আপিং খেলে তো মানুষ মরে যায় বাবা!

আর ওই কর্তারানিমার ব্যাপারটা? ওটা কী?

মেয়েদের খাওয়াচ্ছেন, মেয়েদের শোওয়াচ্ছেন। কত ছোট্ট ছোট্ট মেয়ে? খুব বুড়ি-টুড়িদের কি ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়ে থাকে? কই ঠাকুরমার তো নেই! দিদিমারও নেই, বাপুর ঠাকুরমারও নেই। তা হলে?

জলখাবার খাওয়ার পর টিকলুকে এরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় আর একটা দালান পার হয়ে খুব বড়ো একখানা ঘরে নিয়ে এল। সিঁড়িটা খুব অদ্ভুত লাগল টিকলুর। রেলিং-টেলিঙের বালাই নেই, দু-দিকেই ভারী চাপা দেয়াল, সেদেয়ালে জানলা-টানলা কিছু নেই। একটু যেন বাদুড়-বাদুড় চামচিকে-চামচিকে গন্ধ।

দোতলার এই দালানটা ভাল। বড়ো বড়ো জানলা, জানলা দিয়ে বাইরে বাগান দেখা যাচ্ছে, জ্যোৎস্না রয়েছে বলেই এত সুন্দর দেখাচ্ছে।

টিকলুকে যে ঘরটায় এনে ঢোকানো হল, সেঘরের কড়িকাঠ থেকে মাঝারিগোছের একটা ঝাড়লন্ঠন ঝুলছে, ঝাড়ের সব আলোগুলো জ্বলছে না বটে, তবে যে ক-টা জ্বলছে, তাতেই ঘরটার সবকিছু বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

ঘরের মাঝখানে উঁচু এক পালঙ্ক, তার বাজু আর ছত্রিতে নানা কারুকার্য, এক হাত পুরু গদি, ফর্সা ধবধবে বিছানা, ঝালর দেওয়া বালিশের ঝালরগুলো খোলা জানলা থেকে বাতাস এসে উড়ছে, বিছানার চাদরের কোণগুলোও উড়ছে। জানলা দরজায় পর্দা বলে কিছু নেই, তাই বাতাসটা জোরে আসছে।

ঘরের কোণে কোণে অর্ধচন্দ্র গড়নের তিন চার থাক উঁচু সেলফ বসানো, তার তাকে তাকে কতরকমের যে খেলনা পুতুল সাজানো! টিকলু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, মাটির রাধাকৃষ্ণ, দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, দু-বাহু তোলা গৌর-নিতাই, পাথরের মহাদেব, জগন্নাথ, গণেশ, পেতলের লক্ষ্মী-সরস্বতী, নাড়ুগোপাল, কাঠের সেপাই, কাচের সাহেব মেম, ঝিনুকের হাঁস, শোলার ময়ূর, পুঁতির ফুলগাছ, টিনের রেলগাড়ি, মোমের ফল, আরও কত সব কী। টিকলু বুঝতে পারল না, কী দিয়ে তৈরি ওইসব ছোট্ট ছোট্ট হাঁড়িকুঁড়ি, চায়ের সেট, গেলাস, রেকাবি। সবই পুরু ধুলোয় ঢাকা, রং জ্বলা।

দেয়ালের ধারে একটা পালিশ জ্বলে যাওয়া প্রকান্ড টেবিল, তার ওপর কিছু বই, খাতা, দোয়াতদানি, কলম, পেনসিল! বাতিদানে বসানো বাতি, আর ঠিক টেবিলের মাঝখানে স্ট্যাণ্ডে বসানো দু-খানা ফোটো। একটা গ্রূপ ফোটো, আর একটা শুধু একটা ছোটোছেলের।

ছবিটা দেখে টিকলুর বুকটা ধুকধুক করে উঠল। এ নির্ঘাত এদের খোকা রাজাবাবুর। টিকলু বক্রেশ্বরের সামনে ছবিটার দিকে ভালো করে তাকাতে সাহস করল না। নিজের ছবি আবার কে নিজে দেখে নিরীক্ষণ করে?

বক্রেশ্বর বিনয়ে গলে পড়াগলায় বলেন, ‘তা হলে তুমি এখন একটু বিশ্রাম করো ভাই, একটু পরেই কর্তারানিমার ঘরে ডাক পড়বে। ওনার সঙ্গে একটু সাবধানে কথা বলবে, বুঝলে তো?’

টিকলু শক্তগলায় বলল, ‘সাবধানে মানে?’

বক্রেশ্বর ব্যস্তগলায় বলে, ‘আহা, মানে জানোই তো ওনাকে? একটুতেই দুঃখ অভিমান। এই যে তুমি এতদিন ধরে পালিয়ে বেড়িয়ে ওঁদের কষ্ট দিলে তারজন্যে তো অভিমান আরও বেশি। সেই আর কী। তবে কর্তারানিমার মেয়েদের খবর কী জানতে চাইলেই অবশ্য আহ্লাদে সব ভুলে যাবেন। মেয়েগুলি তো ওনার প্রাণতুল্য তা দেখেই গেছ। ওদের নিয়েই সব ভুলে মেতে থাকেন। জুঁই, মল্লিকা, শেফালি, মালতী, কমল, গোলাপ সবাই তো ওনার সমান আদরের!’

টিকলু গম্ভীরভাবে বলে, ‘সেতো জানিই।’

বক্রেশ্বরের গোঁফ দুটো ঝুলে পড়ে, বক্রেশ্বরের জোড়া ভুরুটাও যেন ঝুলে পড়ে। বক্রেশ্বর একটুক্ষণ টিকলুর দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে, ‘আচ্ছা’ বলে চলে যান।

টিকলু শুনতে পায় বাইরের কাকে যেন বলছে, ‘হ্যাঁ, এই দরজার পাশে বসে থাকবে, নড়বে না। খোকাবাবুর কখন কী দরকার হয়।’

টিকলু মনে মনে বলল, ‘তার মানে, পাহারা বসানো হল। তারমানে আমি এখন বন্দি। ‘অচিনদেশে অভীক’ বইটার সঙ্গে একেবারে ঠিক ঠিক মিলে যাচ্ছে। হঠাৎ বেজায় আহ্লাদ হল টিকলুর, একেবারে কাঁটায় কাঁটায় মিলে যাচ্ছে।

অভীকের দরজায় একটা দৈত্যের মতো গুর্খা প্রহরী বসানো হয়েছিল, আর টিকলুর দরজায় একটা মোষের মতো বাঙালি প্রহরী। শুধু এইটুকু তফাত।

যাক একটু শুয়ে পড়া যাক।

ঘরে কাগজ কলম দোয়াত কালি সবই তো মজুত রয়েছে দেখা যাচ্ছে, সময় বুঝে বাপুকে একটা চিঠি লিখে ফেলা যাবে। ওকে ছেড়ে চলে আসা থেকে যা কিছু ঘটেছে সব লিখে পাঠাবে। বেচারি বাপু!

টিকলুর খুব অস্বস্তি হচ্ছিল এত ফর্সা বিছানাটায় চট করে শুয়ে পড়তে। কিন্তু টিকলু এখন রাজপুত্র, ওর এরকম তুচ্ছ জিনিসে মায়া করা শোভা পায় না।

খাটের ধারে যে ছোট্ট জলচৌকিটা পাতা ছিল, তার ওপর চড়ে খাটের ওপর উঠে পড়ে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল টিকলু।

কিন্তু কতক্ষণের জন্যেই বা?

রাজা রাজীবনারায়ণ পাট্টাদার বাহাদুর আপিঙের ঘোরের মধ্যে একবার শুনলেন, ‘খোকা রাজাবাবুকে পাওয়া গেছে।’

শুনে রাজীবনারায়ণ চমকে ধড়মড় করে উঠে বসে বললেন, ‘কই, কই, কোথায়?’

কিন্তু হঠাৎ উঠে বসার জন্যে মাথা ঝিমঝিম করে এল, আবার গড়িয়ে পড়ে তাকিয়ার ওপর মাথা ফেললেন। ঝিমঝিম করা মাথার মধ্যে ভেঙে যাওয়া ঘুমটা রিমরিম করে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে আবার জুড়ে গেল, সেই জুড়ে যাওয়া ঘুমের গাঁট্টা খেয়ে পাট্টাদার বাহাদুর আবার এক অতল তলে ডুবে গেলেন।

গেলে হবে কী, এই খবরটা যেন অনবরত ওই অতল তলে গিয়েই মাথার মধ্যে ইলেকট্রিকের শক-এর মতো চিড়িক পাড়তে লাগল। পাট্টাদার আর একবার তাকিয়া থেকে মাথা তুলে উঠে বসলেন।

উঁচু খাটের তলায় একটা লোক শুয়ে ছিল, সেবলে উঠল, ‘রাজামশাই, কিছু চাই?’

পাট্টাদার ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বললেন, ‘চাই! তোর মাথাটা চাই।’ বলেই ফের ঘুমিয়ে পড়লেন। এইরকম বার আষ্টেক শুয়ে আর উঠে, শেষপর্যন্ত সত্যিই উঠে বসলেন তিনি।

তারপরই হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘মাথার মধ্যে কী যেন চিড়িক পাড়ছিল!’

তারপরই হঠাৎ খেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কৌন হায়!’

খাটের তলায় শুয়ে থাকা লোকটা হুড়মুড়িয়ে এসে হাতজোড় করে বলল, ‘কী হুকুম?’

পাট্টাদার বললেন, ‘আমার হারানো নাতিকে খুঁজে পাওয়া গেছে, আর আমাকেই দেখানো হচ্ছে না? কে কোথায় আছিস, নিয়ে আয় তাকে এখানে।’

লোকটা হাতজোড় করে বলল, ‘আজ্ঞে আপনি ঘুমোচ্ছিলেন—’

‘আমি ঘুমোচ্ছিলাম? আমি? আমি বলে সারারাত অনিদ্রার ব্যায়ারামে ভুগি, আর আমাকে ঘুমের বদনাম? রোসো মজা দেখাচ্ছি। ডাক তো গজগোবিন্দকে।’

‘গজগোবিন্দবাবু বাড়ি চলে গেছে।’

‘বাড়ি চলে গেছে? ছেলেটাকেও নিয়ে গেছে?’

‘আজ্ঞে না না, ছেলেকে নিয়ে যাবেন কেন? ছেলে এখানেই আছেন।’

‘তা আছেই যদি তো আমার এখানে আনা হচ্ছে না কেন? আন বলছি।’

বলার সঙ্গে সঙ্গে ছুটল লোকটা, হাঁফাতে হাঁফাতে বৈঠকখানা ঘরে গিয়ে বক্রেশ্বরকে জানাল কর্তা উঠেছেন।

বক্রেশ্বর চটপট চলে গিয়ে ডেকে নিয়ে এল টিকলুকে।

দালান পার হতে হতে বক্রেশ্বর নীচু গলায় বললেন, ‘খোকা রাজাবাবু, মনে রাখবেন উনি আপিঙের রুগি।’

টিকলু বুকটান করে বলল, ‘উনি যে আপিঙের রুগি সেকথা আপনি আমায় বলবেন তবে জানব? আমি জানি না?’

বক্রেশ্বরের নাকের ডগা ঝুলে গেল।

বক্রেশ্বর বললেন, ‘হুঁ।’

টিকলুর ইচ্ছে হচ্ছিল গটগট করে আগেই এগিয়ে যায়, কিন্তু উপায় তো নেই। ঘরবাড়িটা তো অচেনা, কোনখানে যেতে কোনখানে গিয়ে পড়বে।

বক্রেশ্বরের সঙ্গেই যেতে হল।

রাজা রাজীবনারায়ণের দু-চোখে ছানি, তায় আবার পাছে আলো বেগে যন্ত্রণা হয় তাই মোটা কালো চশমা পরা।

তবু বক্রেশ্বর কুর্নিশের ভঙ্গিতে নমস্কার করেন এবং ইশারায় টিকলুকে বলেন, ‘কই, প্রণাম করো?’

টিকলু কিন্তু মিটিমিটি হেসে বুড়ো আঙুলটি নেড়ে বুঝিয়ে দেয়, ‘করে লাভ? দেখতে তো পাবেন না।’

বক্রেশ্বর বেজার মুখে কটমট করে ওর দিকে তাকিয়ে নিয়ে নরম গলায় বলেন, ‘হুজুর, অবশেষে আমার সাধনা সফল হয়েছে। হারানিধিকে খুঁজে নিয়ে এসেছি।’

পাট্টাদার রেগে উঠে বললেন, ‘এসেছে সেকথা তো সাতদিন ধরে শুনছি, কই কোথায় সে, আমার দীপু? আমার দীপেন্দ্রনারায়ণ?’

হাতটা বাড়িয়ে হাতড়াতে থাকেন।

অগত্যাই টিকলুকে এগিয়ে গিয়ে ওনার বিছানার ধারে বসতে হয়।

রাজীবনারায়ণ ওর মাথাটা হাতে পান। অতএব মাথায় হাত বুলিয়েই আশীর্বাদ করতে যান কিন্তু হাত দিয়েই যেন চমকে সরিয়ে নেন।

বলে ওঠেন, ‘এ কী চুল এমন শক্ত শক্ত খোঁচা খোঁচা কেন? সেই রেশমের মতন চুলগুলো কুচিয়ে বুরুশ ছাঁট করেছিস? ছি ছি।’

এ কথা শুনে টিকলুর সেজোকাকার মুখটা মনে পড়ে যায়। নিজে সঙ্গে করে সেলুনে নিয়ে যান সেজোকাকা টিকলুকে, আর টিকলুর দুঃখ, অসন্তোষ, মর্মবেদনা, আক্ষেপ সবকিছু নস্যাৎ করে দিয়ে সেলুনের নাপিতকে জোরগলায় আদেশ দেন, ‘বেশ ছোটো করে ছেঁটে দাও। এই বয়সেই লম্বা লম্বা চুল রেখে মস্তান হবার দরকার নেই।’

তার প্রতিফল এই!

ছি ছি!

টিকলু কিছু বলার আগেই বক্রেশ্বর বলে ওঠেন, ‘এই ছ-মাসকাল রণে বনে অরণ্যে কোথায় না ছিল হুজুর, মাথার হয়তো তেলই জোটেনি—’

রাজীবনারায়ণ বকে ওঠেন, ‘তুমি থামো তো বাক্যবাগীশ, ওকে বলতে দাও। …বলি হঠাৎ বাড়ি থেকে পালাতে ইচ্ছে হল কেন?’

টিকলু গলা ঝেড়ে গম্ভীর হয়ে বলল, ‘এমনি।’

‘এমনি! এমনি তুমি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলে?’

‘হুঁ।’

‘উহুঁ! নির্ঘাত তোমার ওই কর্তারানিমার আহ্লাদী মেয়ের উৎপাতে। নিশ্চয়! হবেই তো, ওদের উৎপাতে ছেলে, ছেলের বউ দেশ-ছাড়া, আমিই মহল ত্যাগ করে এ মহলে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছি। বাক্যবাগীশ, আমি এই বলে দিচ্ছি দীপেন্দ্রর মহল আলাদা করে দেবে।’

‘আজ্ঞে সেআর বলতে!’

‘দীপেন্দ্র, অতএব তোমার আর ভয় নেই। কই, তোমার হাতটা দেখি—’

নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও টিকলু একটা হাত বাড়িয়ে দেয়।

রাজীবনারায়ণ নিজের ফুলো ফুলো তুলো তুলো হাতের মধ্যে ওর হাতটা চেপে ধরে বলেন, ‘ইস! এটা কী হয়েছে? এটা? হাতটা এমন কাঠ কাঠ করেছিস কীকরে? মোট বয়ে পেট চালিয়েছিস বুঝি? তা তো হবেই। পৃথিবী তো আর তোমার জন্যে রুপোর থালায় অন্ন বেড়ে নিয়ে বসে নেই। ছি ছি, হাতের চামড়াটা পর্যন্ত খসখসে হয়ে গেছে। সাটিনের মতন মোলায়েম আর পালিশ করা চামড়া ছিল তোমার। ছি ছি!’

কেবল ছি আর ছি।

টিকলু রেগে উঠে বলে বসে, ‘পুরুষ মানুষের ওরকম হবার দরকার কী?’

‘পুরুষ মানুষ!’

রাজীবনারায়ণ হা হা করে হেসে ওঠেন, ‘ও বাক্যবাগীশ, এ ছেলেটা বলে কী? এই তো সেদিন বোতলে মুখ দিয়ে দুধ খেতিস রে, সর্বক্ষণ চুষি মুখে দিয়ে বেড়াতিস। হঠাৎ তিন লাফে পুরুষ মানুষ হয়ে উঠলি কখন?’

টিকলু হাতটা টেনে নেয়।

রাজীবনারায়ণ একবার প্রশ্ন করেন, ‘এতদিন কোথায় ছিলে? কী খেয়েছিলে? কাদের বাড়িতে ছিলে?’

বক্রেশ্বর আগ বাড়িয়ে বলে ওঠে, ‘সেকী আর বলে বোঝাতে পারবে হুজুর? সেই যে বলে না, ‘ভোজনং যত্র তত্র শয়নং হট্ট মন্দিরে’, সেইরকমই আর কী। আমি তো একটা মেলাতলা থেকে—’

টিকলুর অসহ্য লাগে ওই বক্রেশ্বরের বকবকানি। ক্রমশই আর সন্দেহ থাকে না টিকলুর, ওই বুড়ো ভুল করে ‘খোকা রাজাবাবু’ বলে টিকলুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েনি, জেনে বুঝে ইচ্ছে করেই পড়েছিল। সাদৃশ্য অবশ্য আছেই কিছু, তাই সাহস করেছে।

টিকলু আর ওকে কেয়ার করবে না।

টিকলু তাই কড়াগলায় বলে ওঠে, ‘আপনি বুঝি আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দেখেছিলেন?’

রাজীবনারায়ণ আবার চমকে ওঠেন, ‘দীপু! এই ক-দিনে তোমার গলার স্বরই বা এমন বদলে গেল কীকরে?’

‘কীকরে আর,’ বক্রেশ্বর বলে উঠেন, ‘রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে, গরিব গেরস্ত ঘরের ছেলেদের সঙ্গে মিশে—’

‘বাক্যবাগীশ, তোমার জিভকে থামাবে? যাকে জিজ্ঞেস করছি তাকে বলতে দাও।’

রাজীবনারায়ণের গলায় একটা রাজকীয় স্বর ফুটে ওঠে।

এখন টিকলুর একটু সমীহ আসে।

টিকলু গলাটাকে যতটা সম্ভব নরম করে বলে, ‘এইরকমই তো ছিল। অনেকদিন পরে শুনছেন, তাই।’

‘তা হবে।’

রাজীবনারায়ণ একটু চুপ করে থেকে বলেন, ‘তা পালালে কীকরে?’

টিকলু শক্ত হয়ে বসে।

‘টিকলু ‘অচেনা দেশে অভীক’ বইটার কাহিনিটা মনে করে নেয়। নড়েচড়ে বসে বলে, ‘জানি না! রাত্তিরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মনে হল কে যেন আমায় ডাকছে। চলে গেলাম।’

চোখে দেখতে না পেলে মানুষ যে শুধু অসহায়ই হয় তা নয়, একটু যেন অসহিষ্ণু হয়ে যায়। রাজা রাজীবনারায়ণ সেই অসহিষ্ণু গলায় বলেন, ‘মনে হল আর চলে গেলে?…দেখলে না কে ডাকছে?’

‘আমি তো তখন স্বপ্নের মধ্যে ছিলাম।’

‘তা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে কীকরে? সিঁড়ির দরজা বন্ধ ছিল না? দেউড়িতে তালাচাবি ছিল না?’

‘জানি না তো। হঠাৎ যখন জ্ঞান হল, দেখলাম সকাল হয়ে গেছে, আমি একটা মাঠের মাঝখানে গাছতলায় শুয়ে আছি।’

‘হুঁ! নিশিতে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। ভগবান রক্ষে করেছেন। তরপর তুমি কী করলে?’

‘উঠে বসলাম। তখন দেখলাম কোথা একজন কাপালিকমতো লোক এসে আমায় এক গেলাস দুধ খেতে দিলেন—’

‘সর্বনাশ! তুমি খাওনি তো?’

টিকলু অবলীলায় বলে, ‘খেলাম তো—’

‘আহা হা! ছি ছি! সেই কাপালিকের হাতের দুধ তুমি খেলে? তোমার একবারও মনে হল না, ওটা মন্ত্রপূত দুধ হতে পারে।’

টিকলু অম্লানগলায় বলে, ‘বা:, কী করে মনে হবে? তখন তো আমি অলরেডি মন্ত্রপূত হয়েই গেছি।’

‘হুঁ! ঠিক! তারপর?’

‘তারপর? তারপর সেই কাপালিকের সঙ্গে কোথায় না কোথায় বেড়ালাম। বনে জঙ্গলে—ও কী দেওয়ান মশাই, আপনি হঠাৎ মেজেয় শুয়ে পড়ে ‘সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত’ নাকি, সেই করছেন যে!’

বক্রেশ্বর হিংস্রগলায় বলেন, ‘হ্যাঁ করছি!’

রাজীবনারায়ণ চমকে বলেন, ‘সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত? কেন? কাকে!’

বক্রেশ্বর আরও হিংস্রগলায় বলেন, ‘করছি আমার গুরুকে।’

‘গুরু! তুমি যে তাজ্জব করলে বাক্যবাগীশ! এখানে আবার তোমার গুরু পেলে কোথায়?’

‘পেলাম।’

‘তা হলে ভালো করে বসাও-টসাও গে। তোমার তো কখনো গুরু-টুরু ছিল না!’

‘ছিল না। হঠাৎ লাভ হয়েছে।’

বলে নিজের গায়ে ‘চটাস চটাস’ শব্দ করে মশা মারেন বক্রেশ্বর।

রাজীবনারায়ণ আর একবার হাত বাড়িয়ে বলেন, ‘কই দীপু? কোথায়! হাতটা দেখি আর একবার।’

টিকলু অনিচ্ছা সত্ত্বেও অগত্যাই সেটা বের করে।

রাজীবনারায়ণ একটুক্ষণ টিপে টিপে দেখে বলেন, ‘হুঁ বুঝেছি। গাঁজা-টাঁজা সাজিয়েছিল তোমায় দিয়ে, তাই হাতের গড়ন বদলে গেছে। ওই একই কারণে সবই গেছে। …..তোর মা-বাপ এলে যে কী বলব!’

টিকলু মনে মনে বলে, ততদিনে আমায় আবার কাপালিকে ধরে নিয়ে যাবে।

মুখে বলে, ‘কী আবার বলবেন! মানুষ কি চিরকাল একরকম দেখতে থাকে?’

রাজীবনারায়ণ মৃদুস্বরে বলেন, ‘কী জানি! কতটা বদলে গেছ বুঝতে তো পারছি না। মনে হচ্ছে যেন আর কার সঙ্গে কথা বলছি।’

বক্রেশ্বর তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, ‘কী যে বলেন। খোকারাজা ঠিকই বলেছেন, অনেকদিন পরে তো?’

‘তা হবে। ওর কর্তামার সঙ্গে দেখা হয়েছে তো?’

টিকলু বলে ওঠে, ‘না:।’

‘তার মানে?’ রাজীবনারায়ণ হঠাৎ চড়ে ওঠেন, ‘বাক্যবাগীশ, এটা কী হয়েছে?’

‘আজ্ঞে, আসামাত্রই খবর দেওয়া হয়েছিল।’

‘ওঃ, খবর দেওয়া হয়েছিল? তা ওই একটা সিঁড়ি উঠেই থেমে যাওয়া হল কেন? দেখাটা করানো হল না কেন?’

টিকলু ফট করে বলে ওঠে, ‘উনি এখন ওঁর মেয়েদের খাওয়াচ্ছেন। খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে তবে আসবেন।’

‘ওহো হো!’

রাজীবনারায়ণ হাসতে থাকেন হা হা করে। তারপর বলেন, ‘সাধে কি আর বাড়ির লোক বাড়ি ছেড়ে পালায়! কিন্তু পালিয়ে পালিয়ে খুবই কষ্টে থেকেছিলে মনে হচ্ছে। গলাটা তোমার একেবারে বদলে গেছে। অমন বাঁশির মতো সুরেলা গলা—’

হঠাৎ টিকলুর সেই না-দেখা খোকা রাজাবাহাদুর দীপেন্দ্রনারায়ণের ওপর ভারি রাগ হয়। তাঁর নাকি রেশমের মতো চুল, সাটিনের মতো গায়ের চামড়া, আবার বাঁশির মতো সুরেলা গলা।

তবে?

বুড়ো বক্রেশ্বর, কী দরকার ছিল তোর বেচারা টিকলুকে তার বদলে ধরে আনার?

এ কথা ভাবার পর টিকলু মনে মনে হাসে, ধরে কি আর এনেছিল? ধরে আনবার সাধ্য ছিল? টিকলু আর বাপু যদি দু-জনে মিলে পরিত্রাহি চেঁচাত, মেলাতলার সমস্ত লোক ছুটে এসে বুড়োকে গুঁড়ো করে ফেলত না?

রানি তুলসীমঞ্জরী পাট্টাদার বাহাদুরা আজ দারুণ মুশকিলে পড়েছেন। কোথায় ভাবছেন মেয়েগুলোকে তাড়াতাড়ি খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে নিশ্চিন্দি হয়ে গিয়ে ফিরে-পাওয়া হারানো মানিককে নিয়ে গুছিয়ে বসবেন, তা নয়, কিছুতেই ঘুমোতে চাইছে না মেয়েরা। যতবার শুইয়ে মশারি ফেলে দিতে চাইছেন, ওরা মশারি ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

তুলসীমঞ্জরী অনেক আদর করলেন, অনেক খোশামোদ করলেন, ‘জাদু সোনা, লক্ষ্মী মানিক, গোপালি বাবুরানি’ ইত্যাদি বলে, কিন্তু কী যে হল ওদের, ঘুমের নাম নেই।

‘বুঝেছি, ভাইপোকে না দেখে ঘুম আসছে না তোদের চোখে—’

তুলসীমঞ্জরী হতাশ হয়ে বলেন, ‘ভেবেছিলাম আজ রাত হয়ে গেছে, আজ আর হইচই-তে কাজ নেই, কাল সকালেই পিসি-ভাইপোতে দেখা-সাক্ষাৎ হবে। তা তোরা তো দেখছি ছাড়বি না, এখনই দেখতে চাস। তবে চল। —কই রে, কোথায় আমার দীপুসোনা? আমার আঁধার ঘরের মানিক, আমার হারানো ধন, আমার শিবরাত্তিরের সলতে, আমার দীপেন্দ্রনারায়ণ পাট্টাদার বাহাদুর! …মোক্ষদা! ভবতারিণী! জাহ্নবী! বামুনদি! কোথায় তোরা? কোন ঘরে রেখেছে তাকে?’

টিকলু তখন সবে রাজীবনারায়ণের কবল থেকে মুক্ত হয়ে ফের তার সেই ঘরটাতেই এসে বসেছে, হঠাৎ মোক্ষদা এসে হুড়মুড়িয়ে ঢুকল, ‘খোকা রাজাবাবু, কর্তারানিমা আসছেন।’

টিকলু তাড়াতাড়ি বিছানায় উঠে বসে। আর তারপরই দরজার কাছে কর্তারানিমাকে দেখেই লাফিয়ে উঠে খাট থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে চেয়ার উলটে ফেলে টেবিল ঠেলে বারান্দায় বেরিয়ে পড়ে এলোপাথাড়ি ছুটতে থাকে।

রানিমার পরনের গরদ শাড়ির বেদম চওড়া লাল পাড়, আর পেছনে তাঁর মেয়েদের মাথায়-বাঁধা লাল সিল্কের চওড়া ফিতের ফাঁস যেন একটা রক্তের ইশারা নিয়ে টিকলুর গলায় ফাঁস পরাতে আসছে।

টিকলু ছুটে যে ঘরে হোক ঢুকে পড়ে দরজায় খিল লাগিয়ে দেবে।

শুধুই যে লাল ফাঁসে রক্তের ইশারা, তা তো নয়, ওই লালের পেছনে অন্ধকার ভবিষ্যতের গভীর কালো ছায়াও।

রানি বাহাদুরার পেছন পেছন লাইন দিয়ে এগিয়ে আসা তাঁর ছোটো-বড়ো-মেজো-সেজো নানা মাপের মেয়েগুলির সকলের পরনেই ঘন কালো সাটিনের লম্বা-ঝুল রাত-জামা। কী ভয়াবহ সেই দৃশ্য!

টিকলু ছুটছে।

ছুটতে ছুটতে শিউরোচ্ছে, শিউরোতে শিউরোতে ছুটছে, আর বারান্দার ধারে ধারে যত দরজা পাচ্ছে দু-হাতে ধাক্কা মারছে। কিন্তু খুলছে কই? সব দরজাই যে ভেতর থেকে বন্ধ।

নাকি মন্দির প্রদক্ষিণের মতো পাক খেয়ে আবার একই জায়গায় ঘুরে আসছে সে? এই বাইরের দিকের বারান্দায় আলোর বালাই নেই। এ ধারে ঘরের দেয়াল, আর রেলিঙের ওধারে অন্ধকারে জমাট গাছপালার সারি। হয়তো আম, জাম, কাঁঠাল, জামরুল, তাল, নারকেলের বাগান। কিন্তু সেদিকে কে তাকাচ্ছে? ওই ঝাঁকড়া মাথা জমাট কালো গাছগুলোকে তো স্রেফ দৈত্য বলে মনে হচ্ছে।

ধাক্কা দিতে দিতে হঠাৎ একটা ঘরের দরজা দু-হাট করে খুলে গেল, আর টিকলু ঘরের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।

কিন্তু মাটিতে পড়ল কি?

‘কে! কে বাবা তুমি?’

আকস্মিকতায় চমকে ওঠা স্বর নয়, দিব্যি গা-ওড়ানো দীর্ঘ বিলম্বিত লয়ে উচ্চারিত শব্দ, ‘হুমড়ে এসে পড়লে কে?’

ঘরের এককোণে একটা কেরোসিনের আলো খুব কমিয়ে সরিয়ে রাখা ছিল, সেটা কেউ হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে দিল, ঘরটা আলো হয়ে গেল।

টিকলুর ভাগ্য, ও যে-ঘরে হুমড়ে এসে পড়ল, সে-ঘরের সারা মেঝেটায় পুরু গদি পাতা। অর্থাৎ ঘরের মেঝেটা বিছানায় মোড়া।

টিকলুদের নিজেদের বাড়িতে না থাকলেও অন্য অনেক বাড়িতে মেঝেটা কার্পেট মোড়া দেখেছে টিকলু। কিন্তু পুরু গদিদার বিছানায় মোড়া?

না, এমন কখনও দেখেনি।

যাক, ভাগ্যিস এমন অভিনব ব্যাপারটা রয়েছে, তাই না টিকলুর নাকমুখটা বাঁচল। নইলে এই মার্বেল পাথরের মেঝেয় ঠিকরে এসে পড়লে নাক মুখ কি আর থাকত?

তবু উঠে বসে নাকে মুখে হাত চাপা দিয়ে হাঁপাতে থাকে টিকলু।

যে লোকটি আলো বাড়িয়েছিল সেসেটা ধরে এনে টিকলুর মুখের কাছে দুলিয়ে তেমনি বিলম্বিত গলায় বলে, ‘কে হে ছোকরা! মাঝরাত্তিরে হঠাৎ ভূতে তাড়া খাওয়ার মতো আছড়ে এসে পড়লে! এলে কোথা থেকে? বাগান দিয়ে? রেলিং টপকে?’

টিকলু দেখে লোকটার সাজসজ্জা যারপরনাই শৌখিন। মিহি আদ্দির গিলে করা পাঞ্জাবি, পাট পাট করে কোঁচানো ফাইন শান্তিপুরি ধুতি, দু-হাতে মিলিয়ে গোটা পাঁচ-ছয় আংটি, মধ্যযুগের মতো সরু টেরির দু-পাশে থাক দেওয়া চুল, পায়ে রঙিন মোজা। ঘরে আর কেউ নেই।

এই সাজ করে যে কেউ রাত্রে ঘুমুতে পারে, টিকলুর ধারণার বাইরে। টিকলু নাক থেকে হাত সরিয়ে তাকিয়ে দেখে।

এ-ও সেই ‘ছোকরা’ বলছে।

‘ছোকরা’ শুনলেই টিকলুর মেজাজ চড়ে ওঠে, এখনও উঠল। টিকলু সেই চড়া গলায় বলে উঠল, ‘আপনি কে তাই শুনি?’

‘আমি? আমি আবার কে? এ বাড়ির সবাই জানে আমি কেউ না, কিছু না? তবে আছি এ বাড়িতে বছর চল্লিশ ধরে, আর একটা কিছু নামে ডাকতে তো হয় মানুষকে, তাই সবাই আমায় ‘জামাইবাবু’ বলে। কর্তা, কর্তামাও বলেন, যুবরাজ যুবরানিও বলেন, দাস দাসী, আমলা শামলা, নায়েব দেওয়ান, লেঠেল পাইক সবাই বলে। আমার জ্ঞান উন্মেষের আগে থেকে আমার এই নাম। কিন্তু এযাবৎকালের মধ্যে কই তোমায় তো কখনও দেখিনি।’

‘দেখেননি? বা: চমৎকার!’

টিকলু ঠিক করে ফেলে বেপরোয়া চালিয়ে যাবে। আর যাই হোক, ভয় খাবে না কিছুতেই। অবশ্য কর্তারানিমার মেয়েদের বাদে।

টিকলু জোরগলায় বলে, ‘দেখেননি? আগে কক্ষনো দেখেননি?’

‘কস্মিনকালেও না।’

টিকলু বুক ফুলিয়ে বলে, ‘বলছেন চল্লিশ বছর ধরে এ-বাড়িতে আছেন, অথচ রাজকুমার শ্রীদীপেন্দ্রনারায়ণ পাট্টাদার বাহাদুরকে দেখেননি?’

‘কী? কী হল? তুমি দীপেন্দ্রনারায়ণ? হা হা হা! হো হো হো! পাট্টাদার বাহাদুর! হা হা হা! না: বাবা গড়াগড়ি দিতে হল।’

জামাইবাবু হঠাৎ মেঝেয় পাতা গদি বিছানার ওপর প্রথমে বসে পেট চেপে, তারপর শুয়ে, গড়াগড়ি দিতে দিতে হাসতেই থাকেন, হা হা হা।

অমন পাটভাঙা জামাকাপড়গুলো গেল।

অসহ্য লাগে টিকলুর।

স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গিয়ে প্রায় ধমকের সুরে বলে ওঠে, ‘হচ্ছেটা কী? জামাকাপড়গুলো যে গেল।’

‘যাক বাবা! যাক! এ-বাড়িতে মাইনে করা ধোপা আছে, রোজ ধোপদস্ত করে দেয়। তা হঠাৎ রাজপুত্তুর হবার শক হল কেন জাদু?’

‘শখ আবার কী? আমিই তো ছিলাম, তারপর হারিয়ে গিয়েছিলাম—অনেকদিন না দেখে আপনি—’

‘ওহো হো! ওরে বাবারে! তুমি দেখছি আমার পেটটা ফাটিয়ে না দিয়ে ছাড়বে না। বাবা:।’

‘কী পাগলের মতো হাসছেন?’

‘তা হাসব না? পাগল যে করলে বাপ। ……..না বাপু আমায় একটু পেটভরে হাসতে দাও।’

বলে আবার গড়াগড়ি দিয়ে হাসতে থাকেন জামাইবাবু।

হাসি আর থামতে চায় না, হাসতে হাসতে বিষম খেয়ে যান, ‘তা হলে তুমিই সেই নিরুদ্দেশ রাজপুত্র? হ্যাঁ হে ওস্তাদ, নিজেই এই কারবারটি ফেঁদেছ, নাকি বক্রেশ্বর বাক্যবাগীশের নতুন কোনো কারসাজি?’

‘তার মানে?’

‘মানে আর তোমায় কী বোঝাব জাদু? কস্মিনকালেও যে তুমি পাট্টাদার বংশের কেউ নালো, তা নিজেই খুব ভালো জানো। কিন্তু এলে কোথা থেকে? কোথা থেকে জোগাড় করে আনল তোমায় বক্রেশ্বর? তবে হ্যাঁ, লোকটার ক্যাপাসিটি আছে। জোগাড় একখানা করেছে মন্দ নয়। কিন্তু গালের ওই কালো তিলটা অবশ্যই মেকআপ?’

‘মেকআপ?’

টিকলু রেগে জোরে জোরে গালে হাত ঘষে বলে, ‘এটা মেকআপ? উঠে যাচ্ছে?’

‘উঠছে না? তাই তো। তা হলে বলতে হবে বিধাতা পুরুষও মাঝে মাঝে মানুষের সঙ্গে খানিকটা ঠাট্টা-তামাশা করে ফেলেন। …এই যে তুমি, কে তা জানি না, কী নাম, কোথায় ধাম, কিছু জানি না, কিন্তু মানতেই হবে এ-বাড়ির ঘরপালানে ছেলেটার সঙ্গে বেশ সাদৃশ্য আছে তোমার। আবার বলছ ওই তিলটাও মেকআপ নয়। ঠিক আছে। জিতা রহ। দেখি নব যাত্রাপার্টিতে নতুন কী পালা শুরু হয় এবার।’

যদিও প্রথমে ‘ছোকরা’ বলেছিল, তবু, ভদ্রলোকের কথাটথাগুলো নেহাত মন্দ লাগছে না টিকলুর। গড়িয়ে গড়িয়ে বললেও কথার মধ্যে প্রাণ আছে।

টিকলু বলে, ‘আমি এ ঘরেই শোব।’

‘এ ঘরেই শোবে? বা: বা:! বেশ মামার বাড়ির আবদার তো! এ ঘরে আমি মাঝরাত্তির থেকে শেষরাত্তির অবধি গানের সুর ভাঁজি না?’

‘ভাঁজবেন, তাতে কী? আমি তো এককোণে শুয়ে থাকব। গান আমার ভালোই লাগে!’

‘বা: ছেলে! খুব চালাক। বক্রেশ্বর বুঝি তোমায় হতভাগা লোকটার ঘরে ভরতি করবার জন্যে ধরে নিয়ে এসেছে?’

‘ধরে?’

টিকলু বীরবিক্রমে বলে, ‘আমায় কেউ ধরে-টরে নিয়ে আসেনি। ধরে আনা অত সস্তা নয়। আমি নিজেই এসেছি।’

‘নিজেই এসেছ?’

আদ্দির পাঞ্জাবি ছড়িয়ে ভদ্রলোক গদির ওপর গদিয়ান হয়ে বসে বলেন, ‘ভ্যালা রে মোর জাদুমণি! কিন্তু কেন এসেছ বাপ?’

‘এমনি।’

‘এমনি! তা কবে কখন কোনসময় এই আবির্ভাবটি ঘটল?’

‘এই তো আজ সন্ধ্যাবেলা। কিন্তু এখন আমি শুচ্ছি। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।’

‘তা তুমি তো বাপু রাজকুমার, এ ঘরে এসে লুকিয়ে থাকলে বাড়িতে হুলিয়া পড়ে যাবে না?’

টিকলু গম্ভীরগলায় বলে, ‘মোটেই আমি লুকোতে আসিনি। ঘুম পাচ্ছে বলেই আর অন্য ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না।’

‘ঠিক আছে। ঘুমোও। কিন্তু খবরদার, সুরভাঁজার সময় বকবক করবে না।’

টিকলু অগ্রাহ্যের গলায় বলে, ‘একটা কথাও বলব না। আমার যা ঘুম পাচ্ছে, শুনতেই পাব না।’

টিকলু শুয়ে পড়ে হাত পা ছড়িয়ে।

জামাইবাবু কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে দেখেন ওকে।

তারপর আবার কথা বলে ওঠেন, ‘সবই তো একরকম বুঝলাম! কী সূত্রে, কী পরিস্থিতিতে আর কোন কৌশলে তুমি এই বুনো রাজবাড়ির দেউড়ি ডিঙোলে তাও জানতে চাই না, কিন্তু তখন হঠাৎ অমন বাঘে তাড়া খাওয়ার মতো ছুটে এসে পড়লে কেন তাই শুনি?’

টিকলু ধড়মড়িয়ে বলে ওঠে, ‘ওরে বাবা, সেকথা মনে করিয়ে দেবেন না! ভাবলেই আমার মাথা ঘুরে উঠবে।’

আবার ধপাস করে শুয়ে পড়ে।

আর বোধ হয় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়েও পড়ে।

সকাল থেকে মনে সুখ নেই রানি তুলসীমঞ্জরীর। গতকাল রাত্তিরে হঠাৎ ওরকম ঘটনা ঘটল কেন? এতদিন পরে যদি বা ছেলেটা বাড়ি ফিরে এল, সেকি মাথার গোলমাল ঘটিয়ে এল? পিসিদের এত ভালোবাসত সে, বিশেষ করে গোলাপপিসি আর মালতীপিসিকে, অথচ কাল ওদের দেখেই হুড়মুড়িয়ে পাগলের মতন ছুটে পালিয়ে গেল। সেই অবধি নাকি আর দেখতেও পাওয়া যাচ্ছে না তাকে। ভগবান কি দিয়ে আবার কেড়ে নিলেন? কূলে এসে তরি ডোবালেন?

শুনতে পেয়েছেন, দীপুকে নাকি নিশিতে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, দীপুর নাকি হাব-ভাব, ধরন-ধারণ, মাথার চুল, গলার স্বর সব বদলে গেছে। রঙেরও নাকি সেজেল্লা নেই। মন ভেঙে যাচ্ছে তুলসীমঞ্জরীর।

আর মাত্র মাসখানেক বাকি আছে, ছেলে ছেলে-বউয়ের ফিরে আসার, তারা এলে কী দেখাবেন? এখনও যদি ছেলেটাকে ঠিকমতো হাতে পাওয়া যেত, তা হলে আচ্ছা করে দুধ-ঘি, ছানা মাখন, ক্ষীর সর আর মাছের মুড়ো খাইয়ে এবং কবিরাজি তেল মাখিয়ে মাখিয়ে, আগের চেহারায় এনে ফেলা যেত। কিন্তু তার যদি মাথাটাই বেঠিক হয়ে গিয়ে থাকে? তা হলে তো কোনো আশাই নেই। হয়তো মাথায় মাখবার ফুলের তেলকে শরবত ভেবে খেয়ে ফেলবে, ডাবের জল মাথায় মেখে বসবে, হয়তো বা ভাত নিয়ে ছড়াবে, ধরতে গেলে পালাবে, হাত পা ছুড়বে।

রানি তুলসীমঞ্জরীর এক পিসেমশাইকে একবার ভূতে পেয়েছিল, তখন তিনি এইসব করেছিলেন! তখন তাঁর চেহারাও কি পালটে গিয়েছিল! উঃ! চোখ লাল, তার ওপর আবার সেচোখ সর্বদা ঘুরছে। মাথার চুল খাড়া খাড়া, মুখের রং বেগুনি। কতদিন ধরে, মাথায় কত হুঁকোর জল থাবড়ে, কত কবরেজি তেল ঘষে, গায়ে কত পানাপুকুরের পানা মাখিয়ে, আর কত পান্তাভাতের বাসি আমানি আর তেঁতুল গোলা খাইয়ে খাইয়ে তবে ধাতে আনা হয়েছিল পিসেমশাইকে।

‘খোকাকে আমার সেইসব করতে হবে নাকি গো—’

বলে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠলেন তুলসীমঞ্জরী।

আজ কোথায় মা হিঙ্গুলরানি কালীর মন্দিরে পুজো দিয়ে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরবেন, তা নয় এই!

‘ছেলেটাকে এখনও পর্যন্ত ভালো করে চোখেও দেখলাম না—’ আর একবার ভেউ ভেউ।

ছুটে এল মোক্ষদা, বামুনদি, তারিণীসুধা, দুঃখীর মা।

কেউ পাখা এনে বাতাস করতে থাকে, কেউ মুখে মাথায় জলের ঝাপটা দেয়, কেউ বা নিজেরাও গলা মিলিয়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লেগে যায়। ওদের দেখাদেখি তুলসীমঞ্জরীর জুঁই, মল্লিকা, শেফালি, মালতী কমল, গোলাপ সবাইমিলে একযোগে তারস্বরে সুরে সুর মেলায়, ‘ভেউ ভেউ ভেউ, ঘেউ ঘেউ ঘেউ।’

এদিকে রামরাজাতলায়—

বাপুর এখন কাজ হয়েছে, প্রতিক্ষণ প্রতিসময় মাথার মধ্যে ঠকঠক করে হাতুড়ি ঠোকা। আর দৈনিক আধঘণ্টা করে আনুষ্ঠানিকভাবে ধাঁই ধাঁই করে ঠোকা। মানে নিজেরই মাথায় এই আনুষ্ঠানিকটি হচ্ছে, যে কথাটা মনে পড়ছে না, সেটা মনে পড়াবার জন্যে তার মতন কিছু লেখা। ধরো, একজন চেনালোকের নামটা কিছুতেই মনে পড়ছে না, অথবা কোনো একটা মুখস্থ গানের কোনোলাইন মনে আসছে না, তখন ‘ভুলে গেছি’ বলে থেমে না থেকে, খাতার পাতায় কেবল সেই ধরনের কিছু লিখে চলা।

সামান্য একটা সুর, কী একটা শব্দঝংকার, একটু ধ্বনি, এ তো থাকবেই মনে?

ওইটা ধরে চালিয়ে যাওয়া।

‘শুধু মনে পড়াতে চেষ্টাটা হচ্ছে স্যাকরার হাতুড়ির মতো ‘ঠুক ঠুক’, আর পাতার পর পাতা লেখাটা হচ্ছে কামারের হাতুড়ির মতো ধাঁই ধাঁই—’ এটা বলেছেন বাপুর বাবা।

তাঁর মতে, মানুষের পক্ষে কোনোকিছুই একেবারে ভুলে যাওয়া অসম্ভব। সেএকবার যা চোখে দেখেছে, একবার যা কানে শুনেছে, অথবা একবার যা জিভে খেয়েছে, কিছুতেই তার ছাপ হারিয়ে যায় না। …মানুষের ব্রেনের মধ্যে মৌচাকের মতো অসংখ্য খুপরিওলা একটা ঘর আছে, তা কোনো না কোনো খুপরিতে গিয়ে আটকে পড়ে থাকে ওই দেখা, শোনা, জানা জিনিসগুলো। হয়তো কোনো কারণে ওই আটকা পড়া খুপরিটায় ঢাকনি চাপা পড়ে যায়, এক ডাকে বেরিয়ে আসতে পারে না, তখনকার কর্তব্য হচ্ছে অনবরত ঠোকার, অর্থাৎ ভাবার। ভাবতে ভাবতে, হঠাৎ একসময় ওই চাপা পড়ে যাওয়া ঢাকনিটা খুলে যাবে।

অতএব বাপুকে এখন সবসময় ভাবা ছাড়াও দৈনিক আধঘণ্টা করে খাতার খালি পাতা ভরতি করে খালি খালি লিখে চলতে হয়, ‘ময়নাখালি, শালিখখালি, কাকখালি, নেকড়েখালি, হাঙরখালি, কুমিরখালি, মোজাখালি, জুতোখালি, লাঙুলখালি, আঙুলখালি, গঞ্জখালি, থানাখালি—’

আরও কত খালি।

কারণ, বাপুর এইটুকু মনে আছে, টিকলুকে ওরা যে রাজ্যে নিয়ে গেল তার ঠিকানার মধ্যে বেশ কতকগুলো ‘খালি’ আছে। কিন্তু ঠিক যে কী আছে, তা ভাবতে ভাবতে মাথা খালি হয়ে যাচ্ছে বেচারার। একটির পর একটি ‘একসসারসাইজ বুক’ শেষ হয়ে গেল, এখন ওর ছোড়দি বলছে, এবার থেকে ফুলস্ক্যাপ কাগজে লেখ, খাতার দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে।

টিকলু হারানোর দিন থেকে বাপু বেচারা চোরের অধম হয়ে আছে।

বাপু এতখানি বয়সে সারাজীবনে যতটা না বকুনি খেয়েছে, তার থেকে একশো গুণ বকুনি এই ক-দিনে খেয়েছে।

তার ওপর দিয়ে লাঞ্ছনা গঞ্জনার ঝড় বয়ে গেছে, ধিক্কারের শিলাবৃষ্টি হয়ে গেছে, ধমকের বজ্রপতন হয়েছে, আর ব্যঙ্গ বিদ্রূপের মুশলধার বর্ষণ হয়ে গেছে। এখনও হচ্ছে।

সেই ভয়ংকর সময়ে বাপু সব সময় ছিল, সমস্ত কথার সাক্ষী আর সমস্ত দৃশ্যের দর্শক ছিল, অথচ বাপু লোকটার নাম ভুলে গেল, ভুলে গেল তার বলা ঠিকানাটা। তা ছাড়া বাপু বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে থেকে বন্ধুকে দিয়ে বাড়ি ফিরে এল।

সবাইয়ের এক কথা, ‘তুই মেলাতলার লোকেদের ডেকে বলে দিতে পারলি না? তারা সবাই এসে একযোগে ওই ছেলেধরা জোচ্চোরটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ‘বৃন্দাবন’ দেখিয়ে ছাড়ত! কাউকে ‘বৃন্দাবন দেখাবার’ সুযোগ পেলে মানুষ ‘আমার তোমার’ বোঝে না, আসল ঘটনাটা কী জানতেও চায় না বুঝলি? স্রেফ ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে দিত।’

আর কতবার যে বাপুকে আদ্যোপান্ত বলতে হয়েছে। সেই বাড়ি থেকে বেরোনো থেকে টিকলুকে হারিয়ে মেলায় ঘুরে ঘুরে বেড়িয়ে বাড়িফেরা পর্যন্ত।

তারপর কী হল?

তারপর কী করলি?

তারপর সেকী বলল?

কাহিল হয়ে গেল বাপু একই প্রশ্নের উত্তর একশোবার দিতে দিতে!

টিকলুর সেজোকাকা তো একেই চায়ের দোকান শুনে চমকে উঠেছিলেন, তার ওপর ডিমের অমলেট শুনে অজ্ঞান হয়ে যাবার জোগাড়।

তা হলে আর আক্ষেপ করার কিছু নেই, বাড়ি ফিরলেও তো সেই কলেরা হয়ে মরত।

বাপু রেগে বলে, ‘আমি বুঝি মরে গেছি?’

সেজোকাকা অনায়াসে বলেন, ‘তোমার কথা বাদ দাও।’

কেন যে বাদ দেওয়া হবে তা কিছু বলেন না।

আচ্ছা লোকগুলো কীরকম দেখতে?

একশোবার এ কথার উত্তর দিতে হয়েছে বাপুকে।

বাপু যতই বলে কীরকম দেখতে, সেকি কখনও বলে বোঝানো যায়?

ওঁরা ততই চাপ দিতে থাকেন, তা কিছুও তো দেখবি? কালো না ফর্সা, মোটা না রোগা, গায়ে কোট না শার্ট, পরনে ধুতি না পায়জামা, এইসব।

কিন্তু ঘুরে ফিরে আবার সেই একই কথায় এসে পৌঁছোয়।

কী বলে তুই ওকে ছেড়ে দিয়ে হাঁ করে ফিরে এলি?

তোর না চিরকালের বন্ধু?

ওর সঙ্গে না তোর অজ্ঞান বয়েস থেকে ভালোবাসা?

‘আশ্চর্য, এ তোর মাথায় এল না যে, লোকটা জোচ্চোর?’

‘বা:, আমি কী করে জানব? আমি কখনো জোচ্চোর দেখেছি?’

‘আহা! টিকলু যে কীরকম বিশ্বাসঘাতকতা করল!’

বলেছে বাপু কেঁদে ফেলে, ‘ও দিব্যি বলে দিল, ও সেই কী ‘খালি’র যেন রাজবাড়িরই ছেলে। তার বেলায় দোষ হল না?’

‘তাকে তো জাদু করে ফেলেছিল—’ সেজোকাকা বলেছিলেন, ‘স্রেফ মেসমেরাইজম। মানে ইন্দ্রজালের প্রভাবে আয়ত্ত করে ফেলা। ওর দোষ কী?’

তার মানে বাপুই সকল দোষে দোষী।

তাই বাপুকে এখন রোজ গভীরচিন্তায় ডুবে তলিয়ে গিয়ে লিখতে হচ্ছে ‘চড়াইখালি, মাছরাঙাখালি, পানকৌড়িখালি—লিখতে হচ্ছে, বক্কেশ্বর, চক্রেশ্বর, লক্ষ্যেশ্বর, যজ্ঞেশ্বর, মাথাশ্বর, মুন্ডুশ্বর।’

কত কতদিন হয়ে গেল, হাতুড়ি মেরে মেরে বাপুর ব্রেনটাই বোধ হয় জখম হয়ে গেল, কিন্তু সেই আসল খুপরির ঢাকনিটা আর খুলছে না।

গ্রীষ্মের ছুটি, একদিন সকালের দিকে খাতাকলম রেখে বাপু বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে একমনে ভাবতে চেষ্টা করছে, আচ্ছা তারপর বুড়ো কী বলল, তারপর টিকলু কী বলল। হঠাৎ পিয়োন এল চিঠি নিয়ে।

উদাসভাবে চিঠিগুলো নিচ্ছিল বাপু, হঠাৎ তার গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল, মাথার চুলও, ‘দু-বাহু তুলে দাঁড়িয়ে পড়ল।’

আর চোখ!

সেতো স্রেফ বাপুর ছোটোভাইয়ের খেলার রবারের বল!

বাপুর নামে চিঠি, হাতের লেখা টিকলুর।

বাপুর সর্বশরীর অবশ হয়ে এল, বাপুর হাত পা কাঁপতে লাগল, বাপু সাহস করে ওই ভারী ভারী খামগুলি খুলতে পারল না। বাপু নিজের নামের চিঠিটা নিয়েই ছুটে ভেতরে চলে এসে বলল, ‘বাবা! দেখো কান্ড!’

তা কান্ডই বটে।

দু-বাড়ির লোক একসঙ্গে কত কথা শোনার মতো একমনে, একধ্যানে জড়ো হয়ে টিকলুর চিঠি শুনতে বসল।

বাপুর গলা কাঁপছিল, তাই পাঠের ভার নিল বাপুর ছোড়দি।

ওর মায়ামমতা কম, গলা টনটনে, পড়তে পড়তে কেঁদে ফেলবে না, গলা বুজে যাবে না। টিকলু যে এত বড়ো চিঠি লিখতে পারে, এ কথা কে ভেবেছে? আসলে মানুষ কী পারে আর কী না পারে, তা সেনিজেই জানে না। অবস্থাই মানুষকে দিয়ে অভাবিত অসম্ভব সব কাজ করিয়ে নিতে পারে। না হলে টিকলুর হাত থেকে ছ-পৃষ্ঠা চিঠি বেরোয়?

টিকলু লিখেছে—

‘বাপু, তুই বোধ হয় আমার ওপর রেগে টং হয়ে আছিস। হতেই পারিস। পরে বুঝেছি আমার জন্যে তোকে অনেক বকুনি খেতে হয়েছে। আমি তো চলে এলাম, হাঁড়িকাঠে গলা দিতে হল একা তোকে। কিন্তু পরে যখন গিয়ে সব গল্প করব, তখন তোর সব রাগ জল হয়ে যাবে। তার আগে চিঠি পাঠাবার একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম রে।

আমায় যে ঘরে থাকতে দিয়েছে সেঘরের টেবিলে লেখবার সব জিনিস মজুত আছে। কাগজ কলম, কালির দোয়াত, পেনসিল, রবার, আলপিন, কাম, পোস্টকার্ড, ডাকের টিকিট। তার মানে রাজকুমারের কখন কী লাগে তার ব্যবস্থা।

আর আমি তো এখন রাজকুমার!

আমার যখন যা দরকার পেয়ে যাচ্ছি, শুধু বাইরে বেরোনো বন্ধ। অর্থাৎ বন্দি রাজপুত্র। কিন্তু বাড়ি এতবড়ো, সঙ্গে এতবড়ো বাগান যে বন্দি বলে সবসময় মনে পড়ে না।

সেযাক, এখানে এসে কেমন সব মানুষ দেখলাম, সেইকথাই বলি।

১। বক্রেশ্বর বাক্যবাগীশ। যে মহাপুরুষ ব্যক্তিটি আমায় হঠাৎ ‘খোকা রাজাবাবু’ বলে চিনে ফেলে ঝাঁপিয়ে এসে পড়েছিলেন। একের নম্বরের ভন্ড আর চালাক লোক। মোটেও ও আমায় ওদের রাজকুমার বলে বিশ্বাস করেনি, শুধু চেহারায় অনেকটা মিল দেখে আর সেই রাজকুমার দীপেন্দ্রনারায়ণের মতো আমার গালে তিল দেখে, চালাকিটা খেলল। ওর ওপর নাকি হুকুম হয়েছিল, আর একমাসের মধ্যে ছেলে খুঁজে বার করতে না পারলে গর্দান যাবে। কী আর করে বেচারা? গর্দানের মায়ার কাছে তো আর কিছু নয়? …আসলে ও ভেবেছিল আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে ভয়টয় দেখিয়ে কিংবা ভুলিয়ে ভালিয়ে দীপেন্দ্র সাজিয়ে, তালিম দিয়ে দিয়ে বুড়ো রাজারানির চোখে ধুলো দেবে। দেওয়া খুব শক্তও নয়, বুড়ো ভদ্দরলোকের দু-চোখে ছানি, তার ওপর কালো চশমা। আর রানিমা? তাঁর কথা পরে বলছি।

কিন্তু বক্রেশ্বর মশাই আমার ব্যাপার দেখে হাঁ। আমি নিজেই এমন ভাব দেখাচ্ছি, যেন আমি সত্যিই দীপেন্দ্রনারায়ণ পাট্টাদার বাহাদুর। দেখে শুনে থ’, আমায় ‘গুরু’ বলে পেন্নাম করেছে।

২। শ্রীগজগোবিন্দ, অর্থাৎ ছোটোনায়েব। লোকটা ভীষণ ভীতু। দেওয়ান মশাইয়ের ভয়ে কাঁটা। আমার সঙ্গে আড়ালে একটা কথা বলবার সাহস নেই। ওরই ধারণা আমি দেওয়ান মশাইয়ের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে এ-সব করছি। কিন্তু ভয়ে জিজ্ঞেস করতে পারে না। তবে বেজায় লোভী, কেবল আমার কাছে টাকাপয়সা চায়। তা আমাকে অবশ্য হাতখরচ বলে অনেক টাকা পয়সা দেওয়া হয়, সেসব একসময় দিয়েই দিই। বাইরেই বেরোতে পাই না, টাকাপয়সা নিয়ে করব কী বল? এক একসময় যদিও খুব মন খারাপ হয়ে যায়। ওখানে একটা দু-টো টাকা পেলেই মনে হত যেন রাজ্য পেলাম, অথচ তাও পেতাম না। কত কী-ই কিনতে ইচ্ছে করত। এক একদিন আস্ত এক টাকার বাদামচাকতি কেনবার এত ইচ্ছে হত, বেশ তোতে আমাতে খেতে খেতে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে যেতাম। …কিন্তু সেআর হয়নি। আর এখন? সব সময় পকেটে কুড়ি পঁচিশ তিরিশ টাকা। অথচ দোকানে যাবার উপায় নেই। এই বোধ হয় পৃথিবীর মজা। তবে টাকাগুলো থাকায় এই সুবিধে হয়েছে, বাড়িতে যারা কাজ-টাজ করে, তাদের দিয়ে দিই। তারা দারুণ খুশি। বলে, ‘খোকা রাজাবাবু সাধু-সন্নিসির সঙ্গে ঘুরে এসে দয়ালু হয়ে গেছে, আগে এমন মন ছিল না।’ …হ্যাঁ, আসল কথাটাই তো বলতে ভুলে গেছি, আমি দিব্যি বলে দিয়েছি আমি যে চলে গিয়েছিলাম, সেহচ্ছে নিশির ডাকে। আর আমি ওই ছ-মাস কাপালিকের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি এবং আমার যে অনেক কিছুই মনে নেই (মনে আর থাকবে কোথা থেকে বল?) তার কারণ আমার স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়ে গিয়েছিল..গল্পে….টল্পে এ-রকম দেখা যায় না?

এরা কবিরাজ ডেকে এনেছিল, তিনি বলেছেন, ‘হ্যাঁ, ওঁদের শাস্ত্রে নাকি এ-রকম রোগ আছে, তাকে ‘স্মৃতিলুপ্তি’ না, কী যেন বলে। …আর চেহারা? সেতো বনেজঙ্গলে ঘুরলে, খেতে না পেয়ে খুব কষ্টে থাকলে বদলে যাবেই। ….তাই সবাই বেশ মেনে নিয়েছে, সন্দেহ-টন্দেহ করে না।

আর ‘সবাই’ মানে তো ঝি, চাকর, দারোয়ান, মালি, সহিস, কোচম্যান? তাদের আর কতই বা বুদ্ধি? দীপেন্দ্রনারায়ণ তো থাকতও না বেশি।

৩। বামুনদি।

তার একমাত্র কাজ আমার মতো একটা ছোটোছেলের পেটের মধ্যে দশটা বড়ো মানুষের মতো খাবার চালান করার চেষ্টা। এত জ্বালাতন লাগে! তবে এমনিতে বেশ ভালো। আমার কাছে তার যত গল্প। নাকি আমার (অর্থাৎ দীপেন্দ্রর) বাবা হচ্ছে দারুণ ‘সাহেব’, অতএব তাঁর বউও ‘মেম’। এই জঙ্গলের রাজাগিরি ওঁদের অসহ্য। …বুড়ো রাজার সঙ্গে তাই বনে না। তাঁরা বেশি সময় তাই পালিয়ে, মানে বেড়িয়ে বেড়ান। তবে মাঝে মাঝে আসেন। এই বাড়িতে নাকি কোনো একটা দেয়ালের মধ্যে রাশি রাশি সোনার চাই পোঁতা আছে। কবে কোন কালে ডাকাতের ভয়ে তখনকার রাজামশাইরা এই কান্ড করে রেখে দিয়েছেন।

মজা হয়েছে কী, আসলে ‘আমার’ দাদু ওই কর্তারাজাও জানেন না সেই মোক্ষম দেওয়ালখানা কোন ঘরের মধ্যে আছে। ওঁর বাবাও জানতেন না, তাঁর বাবাও না। অথচ চিরকাল ধরে এই ধারণাটা চালু হয়ে আছে। ঠিক গল্পেরই মতো না রে? …বামুনদি আরও বলে, ‘আমি’ যখন জন্মেছিলাম, ঠিক তক্ষুনি নাকি খুব ভূমিকম্প হয়েছিল, আর ছাতের সিঁড়ির দেয়াল ভেঙে পড়েছিল।

ওঁরা ভেবেছিলেন, নির্ঘাত ওই দেওয়ালেই সেই সোনার বাসা, নাতি হয়েছে বলে পূর্বপুরুষরা আশীর্বাদ করে সেগুলো বার করে দিলেন। কাজেই ছেলে রইল পড়ে, সিঁড়ি দেখতেই সবাই ব্যস্ত। বামুনদি সেই ছোট্ট ছেলেটাকে আর তার মাকে আগলে বসে থেকেছে।

রাত্তিরে দোতলার বারান্দার ধারে ঘরে ভেলভেটের আসন পেতে আমায় খেতে দেওয়া হয়, রাশি রাশি সব খাবার, বামুনদির চেষ্টা গল্প বলে বলে সব চালান করবে।

বারান্দার ওধারে রাজবাড়ির বিরাট ফলের বাগান, অন্ধকারে ঝাঁকড়া মাথা দৈত্যের মতো মাথা নড়ে, শনশন করে শব্দ ওঠে, এলোমেলো হাওয়া বয়, কোথা থেকে না কোথা থেকে নাম-না-জানা সব ফুলের গন্ধ আসে, মনটা যেন কোথায় ভেসে যায়। …মনে হয় চিরকালই বুঝি আমি এই হাওয়া খেয়েছি, এই দৃশ্য দেখেছি, এইরকম বসেছি, খেয়েছি।

আমি যে রামরাজাতলার বিশ্বনাথবাবুর ছেলে সোমনাথ, সবাই যে টিকলু বলে ডাকে, তা যেন মনেই পড়ে না। মনে পড়লে বিশ্বাস হয় না যেন। কে জানে, আগের জন্মে আমি এই রাজবাড়িরই ছেলেটেলে ছিলাম কি না। হয়তো ছিলাম, তা নইলে এদের বাড়ির মতন চেহারাই বা হল কেন?

তা বলে দিনের বেলায় এ-সব কথা মনে হয় না। ওই রাত্তিরটায় যে কী আছে! দিনের বেলায় তোর কথা কেবলই মনে পড়ে। আহা তুইও যদি আসতিস। এখন ভারি দুঃখ হয়—তখন কেন বলিনি ‘আমার বন্ধুও আমার সঙ্গে যাবে।’ তা যদি হত, কী মজাই হত ভাব? ঝড়ের সময় আমবাগানের যে কী দৃশ্য আমরা তো জন্মেও দেখিনি। এখন স্কুলে গরমের ছুটি, এলে কোনো অসুবিধে হত না।

কিন্তু এখন আর বলে কী হবে?

যদির কথা নদীতে যাবে।

৪। এ-বাড়িতে আর একজন লোকের সঙ্গে আমার দারুণ ভাব হয়ে গেছে, যাকে বলতে পারি চার নম্বরের মেম্বার।

তাঁর নাম হচ্ছে ‘জামাইবাবু’।

ছেলেবেলা থেকেই নাকি তাঁর এই নাম। কেন কে জানে! আসলে যে তিনি এ-বাড়ির কে তাও জানলাম না। ভদ্দরলোক মোটে বিয়েই করেননি, অথচ ‘জামাইবাবু’। বাড়ির কর্তা থেকে জমাদার পর্যন্ত সবাই বলে ‘জামাইবাবু’। তা সাজেন খুব, ঠিক জামাইবাবুর মতন। বেশ মজার লোক। ওঁর ঘরটাও ওঁর মতোই মজার।

সারাঘরে এক হাত পুরু গদিপাতা, সেই গদির ওপর সর্বদা ফর্সা ধবধবে চাদর বিছানো। তাতে মাঝে মাঝে ছোট্ট ছোট্ট তাকিয়া ছড়ানো। ওঁর নাকি যখন ইচ্ছে শুয়ে পড়া একটা শখ, আর হাসি পেলে গড়াগড়ি দিয়ে হাসেন, তাই এই ব্যবস্থা। তা হাসেনও বটে।

আমি যখন বক্রেশ্বরের ওপর হম্বিতম্বি চালাই, আর বক্রেশ্বর মুখ চুন করে বিড়বিড় করে, তখন অ্যাইসা হাসি হাসেন! আমাকে পিঠ ঠুকে বলেন, ‘জিতা রহো বেটা!’ বলেন, ‘আসলে তোমার রাজপুত্তুর হওয়াই উচিত ছিল।’

হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি—ওই জামাইবাবুটি কিন্তু আমায় দেখেই বুঝে ফেলেছিলেন আমি জাল রাজকুমার। বক্রেশ্বর আমায় ধরে আনেনি, আমি নিজেই ‘অ্যাডভেঞ্চারে’র আশায় চলে এসেছি শুনে বেজায় আমোদ। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে আমাদের। ধরে ফেললেও উনি অন্য কারও কাছে ফাঁস করেননি। বেশ মজায় আছি আমরা।

ওনার কাজ হচ্ছে কী জানিস? …মাঝরাত্রে উঠে গানের সুর ভাঁজা। …কী একটা বাজনা, নামটাম জানি না বাবা, সেই নিয়ে এমন মিহিগলায় গলা সাধেন, ঘুমের ঘোরে মনে হয় যেন অলৌকিক কিছু হচ্ছে।

এই সময় ওঁর পরনে থাকে কোঁচানো ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি, গায়ে আতরের গন্ধ। খুব পরিপাটি টেরি। ভোরপর্যন্ত চলে এই সুর ভাঁজা। তারপর উঠে পড়েন, হাত মুখ ধুয়ে ছাতে চলে যান। হাতে করে নিয়ে যান বড়ো একবাটি ভিজে ছোলা আর এত আদার কুচি। ছাতে বসে বসে সেগুলোর সদব্যবহার করে, ফট করে জামাটামা সব ছেড়েটেড়ে কুস্তিগিরদের মতো একটা জাঙিয়া পরে নেন, আর গায়ে আষ্টেপিষ্ঠে মাটি মাখেন। ছাদেরই একটা ছোট্টঘরে ওঁর মাটি ভেজানো থাকে সেই গামলায়। আর থাকে একজোড়া লোহার মুগুর। মাটি মেখে জামাইবাবু সেই মুগুর দুটো নিয়ে ভাঁজতে শুরু করেন।

ওরে বাবা সেযে কী ভারী, আমি তো এক ইঞ্চিও নড়াতে পারি না। আর উনি সেদুটোকে ঘোরান যেন দু-হাতে দুটো পেনসিল ঘোরাচ্ছেন। না দেখলে বিশ্বাসই হয় না।

একই লোক সুর ভাঁজে, আবার মুগুর ভাঁজে। খুব আশ্চর্য্যি না? সত্যি বলতে, জামাইবাবু না থাকলে আমি হয়তো টিকতে পারতাম না।

বলতে পারিস টিকবার দরকারটা কী? পালিয়ে গেলেই তো হয়। সত্যি, বাড়ির কথা, তোদের কথা এ-সব মনে পড়লে ছুটে চলে যেতেই ইচ্ছে করে।

কিন্তু আমি এখন সেই দীপেন্দ্রনারায়ণের মা-বাবা আসার অপেক্ষায় আছি। ওঁরা এলে তখন তো একটা বেজায় মজা হবে। সেইটার অপেক্ষায় আছি। আর একমাসও নেই, এসে যাবেন।

আচ্ছা এইবার আসল লোক দুটির কথা বলি। প্রথম—

রাজা রাজীবলোচন।

তাঁর কাজের মধ্যে সারাক্ষণ আপিঙের নেশায় ঝিমোনো, আর মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ ‘কোই হ্যায়’ বলে চেঁচিয়ে ওঠা। চারিদিক থেকে লোকজন ছুটে আসে, ‘কী চাই, কী চাই’ বলে, উনি তখন বলেন, ‘কিচ্ছু চাই না বেটারা। তোরা মরে গেছিস, না আমি মরে গেছি, তাই দেখে নিচ্ছি।’

আমাকে রোজ সকালে একবার করে ওঁর কাছে গিয়ে বলতে হয় আর রোজই উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘তোমার সেই রেশমের মতো চুলগুলো যে কোথায় গেল! তার জায়গায় এই নারকোল ছোবড়ার মতো চুল!’

আচ্ছা তুই বল তো, আমার চুল নারকেল ছোবড়ার মতো? শুনে এইসা রাগ হয়। বুড়োর যদি চোখটা একেবারে পর্দাঢাকা না হত, নির্ঘাত আমায় মেরে তাড়াত, নয় তো পুলিশে দিত।

জামাইবাবু আমায় কী একটা কবরেজি তেল মাখতে দিয়েছেন, তাতে নাকি চুল রেশমি প্যাটার্নের হয়ে যায়। রাজারাজড়ারা মাখেন। কিন্তু চুল রেশমি হয়ে আমার কী হবে শুনি? আর একমাসের মধ্যেই তো খেল খতম। …সেইদিনের কথা ভেবে আমার প্রাণ কাঁপে। এই, ভাবিস না ভয়ে কাঁপে, আসলে আহ্লাদে কাঁপে। সেটাই তো হবে আসল মজা, যখন দীপেন্দ্রনারায়ণের মা-বাবা নিজের মা-বাবাকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘এ ছেলেটা কে? ……আর দেওয়ান বক্রেশ্বর বাক্যবাগীশকে প্রশ্ন করবেন, একে কোথা থেকে নিয়ে এসেছ, আর কেন নিয়ে এসেছ? …আর একটা গোপন কথা আছে, সেটা এখন বলছি না, পরে বলব। ইতিমধ্যে চেষ্টা করছি সেই সোনার দেয়ালটা খুঁজে বার করবার। জামাইবাবু সহায়।

আচ্ছা এবার ওই কর্তামহারানির কথা বলে চিঠি শেষ করি।

ওনার দেহটি প্রায় আমরা চিড়িয়াখানায় যে শ্বেতহস্তী দেখে এসেছিলাম তার মতন। হাতে ইয়া মোটকা সোনার বালা নাকি, হাতের উঁচু দিকেও তাই। ওখানে যে আবার বালা পরে জীবনে জানি না। তা ছাড়া—গলা থেকে, মাথা থেকে, সমস্ত শরীরটাই যেন সোনা চাপড়ে চাপড়ে ঢেকে রাখা। এত গহনা যে কখনো বুড়িরা পরে দেখিইনি। তুই দেখেছিস?

চুলটুল তো সব পাকা ধবধবে, তাতেও খোঁপা বেঁধে, খোঁপাতেও সোনা দিয়ে তৈরি ফুলে মালা জড়ানো। সোনার ফুলের মালা! সবই অদ্ভুত না?

আর শাড়ি?

তার পাড়টা এত চওড়া যে দেখলে হাসি পায়। খাওয়ার ব্যাপারও তেমনি।

সেঅবশ্য রাজারানি দু-জনেরই সমান। থালার পাশে কত যে বাটি গুনে শেষ করা যায় না। রোজ পুকুর থেকে প্রকান্ড একটা করে মাছ ধরা হয়, তার মুড়োটা খান রাজামশাই, বাকিটা খান রানিমা। আলাদা এক রুপোর থালায় করে শুধু মাছই থাকে ভাতের পাশে। তা ছাড়া দই, দুধ, আম-টাম, সেতুই ধারণা করতে পারবি না।

খাওয়ার শেষে নিজে নিজে আসন থেকে উঠতে পারেন না, দু-জন ঝি দু-দিক থেকে তুলে ধরে, তবে দাঁড়ান। সেএক দৃশ্য। আহা, এনার একটা হাত থেকে অর্ধেকটা মাংস নিয়েও যদি আমার ঠাকুরমার হাড়ের ওপর লাগিয়ে দেওয়া যেত!

সেযাক, আসল মজা হচ্ছে এঁর মেয়েগুলি। ছ-টি মেয়ে এঁর! জুঁই, মল্লিকা, শেফালি, মালতী, গোলাপ, কমল—মেয়েদের নিয়ে ইনি বিভোরা, মেয়েদের পরিচর্যা করতেই অত মোটা হয়েও রাতদিন খাটছেন, আর মেয়েদের খাওয়া, শোওয়া, ঘুম, বেড়ানো এইসব নিয়ে সারাক্ষণই দুর্ভাবনা করছেন।

ওদের ইনি নিজে হাতে দুধ খাওয়ান, ভাত খাওয়ার সময় তদারক করেন, ঘুমের সময় ঘুম পাড়ান। মেয়েরা সকালবেলা সাদা লেসের ঘাগরা পড়ে, বিকেলবেলা লাল নীল হলদে সবুজ সিল্কের ঘাগরা পরে, আর রাত্তিরে কুচকুচে কালো সাটিনের পা-ঢাকা লম্বা ঝুল নাইট গাউন না কী যেন পরে।

প্রত্যেকটি মেয়ের আলাদা আলাদা খাট বিছানা মশারি, ঝালর দেওয়া বালিশ, শীতকালে সিল্কের লেপ। গরমকালে টানা পাখা। রাত্তিরে উনি সবাইকে আদর করে ঘুম পাড়িয়ে মশারি গুঁজে দিয়ে তবে নিজে খেতে ঘুমোতে যান।

বুঝতে পারছিস এঁরা কে? পারবিই না।

জুঁই হচ্ছেন একটি বাঘ-মার্কা প্রকান্ড অ্যালসেশিয়ান! ওর আদরের নাম ‘জুঁইরানি’। মল্লিকা একটি ভোঁদামুখী সাদা বুলডগ, এঁর আদুরে নাম ‘মল্লিকামালা’। শেফালি নাকি ‘গ্রে হাউণ্ড’ নাকী জাতের। জামাইবাবু বলেছেন এ-সব। ওকে ডাকা হয়, ‘শেফালিবালা’ বলে। মালতী—মালতী হচ্ছে কী জানিস—‘ফক্স টেরিয়ার’, উনি হচ্ছেন, ‘মালতীকুসুম’। আর গোলাপ, কমল? ওরা নাকি স্রেফ দিশি কুকুর, কিন্তু খোকারাজা নাকি ওদের কোথা থেকে নিয়ে এসেছিল, তাই ওরা ‘কমলকলি’ আর ‘গোলাপ ফুল’।

ওদের জন্যে আলাদা রান্নাঘর, আলাদা রান্নার লোক। ‘রাজকন্যে’র থেকে অবস্থা কিছু খারাপ নয়।

এক সময় নাকি দেশে চোরের উপদ্রব হওয়ায় একটি কুকুর পোষার দরকার হয়, মেয়ে কুকুর, তাকে মহারানি আদর করে নাম রাখেন জুঁই। তারপর ওনার কুকুর পোষার নেশা লেগে যায়, একে একে মল্লিকা, মালতীরা এসে এসে জুটে গিয়ে ভরতি হয়েছে। ব্যস তারা এখন রাজকন্যার আদরে পালিত হচ্ছে। চোর-ডাকাত এলে পাছে তারা ওদের মারে-ধরে, তাই কর্তামা ওদের ঘুম পাড়িয়ে ঘরে তালা লাগিয়ে সেই চাবি নিজের আঁচলে বেঁধে শুতে যান।

একবার নাকি বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল, কর্তারাজা রেগে বলেছিলেন, ‘বাড়িতে ছ-ছ-টা কুকুর থাকতে, ডাকাতে সব লুঠ করে নিয়ে যাবে? ওদের ছেড়ে দাও।’

কিন্তু ছেড়ে দিলে আর কী হবে? ওদের মশারিটা এমন শক্ত করে গদির ধারে ভাঁজ ছিল যে, ওরা মশারি খুলে বেরোতেই পারল না। ঝালর দেওয়া বালিশের ওপর পা তুলে দিয়ে মশারির মধ্যে থেকেই ঘেউ ঘেউ করে পরিত্রাহি চেঁচাতে লাগল শুধু।

আর ডাকাতরা? বাড়ির লোককে একটা ঘরে বন্ধ করে রেখে যত পারল লুঠপাট করে নিয়ে গেল।

তবু—কর্তারাজা কুকুরদের ঘর খুলে দিয়েছিলেন বলে রানিমা নাকি রাগ করে সাতদিন কথা বলেননি, সাতদিন ভাত খাননি। শুধুমাত্র দুধ, ক্ষীর, সর, দই, সন্দেশ রসগোল্লা, মিহিদানা, মোতিচুর খেয়ে থেকেছিলেন। সাতদিন পরে বলেছেন, ‘তোমার টাকাকড়িই এতবড়ো হল যে বাছাদের আমার শত্রুর মুখে লেলিয়ে দিচ্ছিলে? যদি ওরা মশারি খুলে বেরিয়ে পড়তে পারত, তা হলে কী সর্বনাশ হত ভাবো।’

তা তারপর থেকে রানিমার মেয়েদের আদর নাকি আরও বেড়ে গেল। উনি বলেছেন, ‘এ বাড়ির সবাই ওদের শত্রু! যা করে ওদের সামলে রাখি, তা আমিই জানি আর ভগবানই জানেন।’

এখন দুপুরবেলা আমি চিঠি লিখছি আর ওদিকের ঘর থেকে গান আসছে:

 ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি

 ঘুম দিয়ে যাও,

 বাটা ভরে পান দেব

 গাল ভরে খাও।

 কোথায় পাব এমন নিদ্রা,

 আমি কাঙালিনি।

 দয়া করে দেবেন নিদ্রা,

 জীব গড়েছেন যিনি।

উঃ কী হাসি পায়, যখন উনি ওদের সারি সারি শুইয়ে একটির পর একটির মাথা চাপড়ে যান। ওদের নাকি একটু এদিক ওদিক হলে অভিমান হয়, ওরা নাকি আবার রান্না পছন্দ না হলে থালা ফেলে দেয়। এদের নিয়েই মনের আনন্দে আছেন রানিমা।

নাতি নাতি করে যে কান্নাকাটি করেছেন সেশুধু ছেলে-বউ ফিরলে তাদের কী বলবেন ভেবে। আমার দিকে তো ভালো করে তাকিয়েও দেখেন না। আমার পক্ষে অবশ্য ভালোই হয়েছে, ওঁর আর বিশেষ কিছু নজরে পড়ছে না, আর ভাবতে বসছেন না নাতির চুল খোঁচা হল কেন, রং ময়লা হল কেন, গায়ের চামড়া খসখসে আর হাতের আঙুল শক্ত হয়ে গেল কেন?

আজ এইপর্যন্ত।

তোরা কেমন আছিস? মা, বাবা সেজোকাকা, ছোটোকাকু, ঠাকুমা, ছোড়দি, মেসোমশাই?

আমার জন্যে কিচ্ছু ভাবনা নেই, আমি তো এখন তোফা আরামে রাজপুত্তুর হয়ে কাল কাটাচ্ছি। একমাস পরে দেখা হবে।

চিঠিটা লিখছি, কিন্তু বক্রেশ্বর কোম্পানি জানতে পারলে চিঠি ডাকে ফেলতে দেবে না। জামাইবাবু বলেছেন, চুপি চুপি দিয়ে দেবেন।’

ভালোবাসা জানাচ্ছি। ইতি—

 ‘টিকলু’

পু.—এই চিঠিটা না, দিন পনেরো ধরে লিখেছি, বুঝলি? এতকথা কি একদিনে লেখা যায়? রোজ একটু একটু করে লিখি। এখন না—দেখে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। বেশি ভারী চিঠি হলে শুনেছি স্ট্যাম্প বেশি লাগে, কত বেশি লাগে কে জানে! টেবিলে যতগুলো ছিল, তার বেশিরভাগই মেরে দিলাম। হয়তো অনেক বেশিই মারা হল, তাতে কী? আমি তো এখন রাজকুমার, যত ইচ্ছে খরচা করতে পারি।

চিঠি শেষ করে ছোড়দি নিশ্বাস ফেলে এক গেলাস জল খেল।

বলল, ‘বাববা, একটা মহাভারত লিখেছেন।’

চিঠি পড়ার ফাঁকে ফাঁকে অনেক মন্তব্য হচ্ছিল, ‘ওরে বাবা। কী কান্ড। কী সর্বনাশ! অ্যাঁ! যা:, তাই আবার হয় নাকি। ওরে বাবা—’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

এখন ব্যস্ততা দেখা দিল ঠিকানা দেখার। ‘ঠিকানা কী!’

চিঠি যখন এসেছে, তখন ছেলেকেও টেনে আনা যাবে।

কিন্তু এ কী! হরে কৃষ্ণ হরে রাম।

কোথায় ঠিকানা?

না আছে ঠিকানা, না আছে তারিখ।

তবে দেখ দেখ, ডাকঘরের ছাপ দেখ।

হায় কপাল!

তাই বা কই? ডাকঘরের ছাপটাপ কিছু নেই। তা আজকাল আর কোন চিঠিতেই বা থাকে?

খুঁজেপেতে আধখানা ছাপ থেকে ‘রাম রা’ এইটুকু পাওয়া গেল, আর কিছু না। অর্থাৎ রামরাজাতলা।

ব্যস। তাতে কী লাভ?

হরিষে বিষাদ, আশায় নৈরাশ।

এমন বুদ্ধু ছেলে যে ঠিকানা দেয় না? সব আশাই তো খতম হল।

সবাই বলছে, ‘কী বোকা! কী বোকা!’

শুধু টিকলুর ঠাকুমা, যিনি চিঠি শুনতে শুনতে হরিনামের মালা হাতে নিয়ে জপ করছিলেন, তিনি মালাটা ঠুকে নামিয়ে রেখে বলেন, ‘বোকা না হাতি! চালাকের ধাড়ি। ও ছেলেকে নদীর এপারে পুঁতে দিলে, ওপারে গজায়। বাপ-কাকাকে এক হাটে বেচে সাত হাটে কিনতে পারে ও। ঠিকানা দেয়নি ইচ্ছে করে। পাছে তোরা ঝাঁপিয়ে পড়ে গিয়ে নিয়ে আসিস। ওকে চিনতে তোদের অনেক বাকি আছে, শুধু আমিই চিনেছি।’

কিন্তু ঠাকুমার ধারণাটা ভুল। টিকলু বেচারা জানেই না ওখানের ঠিকানাটা কী।

অথচ জিজ্ঞেস করারও জো নেই। তা হলে তো সব ফাঁস হয়ে যাবে। ‘নিজের বাড়ির ঠিকানা জানো না বাপু?’

তা ঠাকুরমার কথা সত্যি হোক আর ভুলই হোক, ঠিকানা তো নেই-ই সত্যি, আর না থাকলে কীভাবে আনা যাবে তাকে?

একটা নামই শুধু পাওয়া গেছে ‘বক্রেশ্বর’। যে লোকটা নিয়ে গেছে ওকে। কিন্তু শুধু একটা নাম নিয়ে আর লাভ কী? সেতো বাপুটা খাতা ভরে লিখছেই কত। বক্কেশ্বর, লক্কেশ্বর, ফক্কেশ্বর, পক্কেশ্বর, টক্কেশ্বর! ‘ঈশ্বরের’ ছড়াছড়ি করছে একেবারে।

টিকলুর ঠাকুমা যে বলেন, ‘তোরা কেউ ওকে চিনিসনি এখনও, চিনলে আমিই চিনেছি।’ সেটা রাগ করেই বলেন অবশ্য, কিন্তু এখানে, মানে হিঙুলগঞ্জে অন্য ব্যাপার।

টিকলুর ধারণা, জামাইবাবু ছাড়া আর কেউ আমায় চিনতে পারেনি, সেটা ভুল। পারছে অনেকেই, বক্রেশ্বর তো বটেই, গজগোবিন্দও অবশ্যই। তা ছাড়া ভজহরি, নিধিরাম, বৈকুন্ঠ, মোক্ষদা, সুধা, দুঃখীর মা, ফুলির পিসি সবাই সন্দেহে সন্দেহে পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়, কিন্তু স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলে না। তাদের মধ্যে দুটো ধারণা পাক খাচ্ছে, এক হচ্ছে দেওয়ান বুড়ো প্রাণ-মান বাঁচাতে কোথা থেকে একটা ছেলেকে সাজিয়ে গুজিয়ে ধরে এনেছে, ছেলেটা তার শিক্ষায়-শিক্ষিত হয়ে পার্ট প্লে করে যাচ্ছে। আর একটা ধারণা, খোকা রাজাবাবু ‘ভূতাশ্রিত’ হয়ে ফিরে এসেছে। অথবা পুরোপুরি ভূত হয়েই। কে বলতে পারে ছেলেটাকে হঠাৎ ভূতেই উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল কি না, এবং তার পরিণতি এই কি না।

শুধু বামুনদির বিশ্বাস স্থির।

বামুনদির মতে নিশিতে পেলে মানুষ একেবারে অন্য মানুষ হয়ে যায়।

রাজাবাবু, রানিমারও ওই একইমত।

ছেলেটাই ভেজাল এ কথা ভাবেন না ওঁরা, অন্যরকম হয়ে গেছে সেটাই ভাবেন। তাই রানিমা সাধ্যপক্ষে ওর মুখের দিকে তাকান না।

অতএব টিকলু রাজপুত্তুরের ভূমিকায় দিব্যি রাজার হালেই কাটাচ্ছে। অবিরত ক্ষীর সর ছানা মাখন খেয়ে খেয়ে টিকলুর গায়ের চামড়া ক্রমশ বেশ সাটিন সাটিন হয়ে আসছে, বাইরে রোদে গরমে না বেরোনোর জন্যে গায়ের রং মাখনের মতো হয়ে আসছে, আর কবিরাজি ‘তিল আমলা নারিকেল সংযুক্ত’ তেল মেখে মেখে মাথার চুলও রেশমি হয়ে আসছে। দীপেন্দ্রর সঙ্গে সাদৃশ্য ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে।

বিকেলবেলা রোদ পড়লে জামাইবাবুর সঙ্গে বেড়াতে যায় টিকলু। হেঁটে হেঁটে অনেকদূর চলে যায়, জামাইবাবু ওকে সব বুঝিয়ে দেন, দেখিয়ে দেন। কবে কোন কালে এঁদের দুর্গ নাকি ছিল, ছিল কামান, দ্বাদশ শিবমন্দির ছিল একদা, এখন জঙ্গলে বুজে গেছে প্রায়, সেইসব দেখিয়ে নিয়ে বেড়ান জামাইবাবু। বোঝান তার ইতিহাস, আর বলেন, ‘তা বলে ভেবো না আমি কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এ-সব দেখাচ্ছি তোমায়। শুধু তোমার দেখতে ভালো লাগবে বলেই নিয়ে আসছি।’

তা ভালো লাগবার মতোই সত্যি।

বাগানে গাছে গাছে কতরকম ফল, কতরকমের ফুল, নানা পাখি, টিকলু মোহিত হয়ে দেখে আর ভাবে, কবে বাপুকে গিয়ে বলতে পারবে! মা-র কাছে গল্প করবে।

জামাইবাবু মাঝে মাঝে বলেন, ‘কী হে রাজকুমার, অমন অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছ কেন, বাড়ির জন্যে মন কেমন করছে?’

‘মন কেমন!’

টিকলুদের বয়সে সেটা ভারি লজ্জার ব্যাপার, তাই টিকলু সতেজে বলে, ‘মোটেই না। আমার শুধু মাঝে মাঝে মনে হয়, এ-সব তো আমি এই প্রথম দেখছি, অথচ কেনই যে মনে হয়, আগে অনেক অনেকবার দেখেছি।’

এটা কিন্তু বানানো কথা নয়, সত্যিই এরকম মনে হয় টিকলুর এক এক সময়। কেন কে জানে।

জামাইবাবু হেসে বলেন, ‘তা হলে হয়তো দেখেছ। আমি অবশ্য পূর্বজন্মটন্ম মানি না, তবে যারা মানে তারা হয়তো বলতে পারে তুমি আগে এই বংশেরই ছিলে কেউ। হয়তো এদের সেই প্রথম পুরুষ, যিনি দুর্গটুর্গ গড়েছিলেন, কামান নিয়ে পোর্তুগিজ জলদস্যুদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন, আর তাদের লুঠেরা সোনা নিজে ফের লুঠ করে নিয়ে, প্রাসাদের দেয়ালে গেঁধে রেখেছিলেন।’

হেসে হেসেই বলেন।

কিন্তু টিকলু কেমন অন্যমনা হয়ে যায়। টিকলুর মনে হয়, কে জানে ওই ঠাট্টার কথাটা সত্যিই কি না।

‘এই ছোঁড়া তুই ভেবেছিস কী?’

টিকলু জামাইবাবুর সঙ্গে ডন-বৈঠক করবে বলে ছাদে উঠেছিল, হঠাৎ বক্রেশ্বর ক্যাঁক করে ওর কাঁধটা চেপে ধরে চাপাগলায় বলে উঠলেন, ‘সাপের পাঁচটা পা দেখেছিস তুই? আমিই তোকে নিয়ে এলাম, আর তুই কিনা আমার ওপর টেক্কা দিচ্ছিস? ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাচ্ছিস? পাঁচজনের সামনে আমায় ধমক দিস তুই, এত তোর আসপদ্দা।’

টিকলু তাকিয়ে দেখে বক্রেশ্বরের পেছনে গজগোবিন্দ, তাঁর পেছনে নিধিরাম। তার মানে পরিকল্পিত কাজ।

কিন্তু টিকলু কি তা বলে ভয় খাবে?

টিকলুর এখনকার ভূমিকাটা কী?

রাজপুত্রের না?

টিকলু রাজপুত্রের মতোই চালের ওপর বলে, ‘সাহস তো আপনারও কম নয় দেওয়ান মশাই! আপনিই বা কোন সাহসে রাজা রাজীবনারায়ণের নাতিকে এভাবে কথা বলছেন?’

‘কী? তুই …তুই, তুই রা-রাজা রাজীবের নাতি?’

‘তা সেই পরিচয়েই তো আছি এখানে।’

‘হ্যাঁ আছিস, আছিস—’

বক্রেশ্বর বাক্যবাগীশ রাগে আরও তোতলা হয়ে গিয়ে বলেন, ‘কে তোকে নিয়ে এসেছিল রে শয়তান? অ্যাঁ! এতবড়ো বিচ্ছু তুমি তা জানলে কোন ব্যাটা নিয়ে আসত! তুমি কর্তারাজার সামনে আমায় নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করো, লোকজনের সামনে আমায় অপদস্ত করো। আচ্ছা, দেখাচ্ছি মজা তোমায়। নিধিরাম—’

সঙ্গে সঙ্গে নিধিরাম টিকলুর মুখটা চেপে ধরে পাঁজকোলা করে নিয়ে সিঁড়ি থেকে নেমে যায়। সঙ্গে সঙ্গে গজগোবিন্দ ও বক্রেশ্বর।

কোথা দিয়ে না কোথা দিয়ে নিয়ে গিয়ে আস্তাবলের পেছনদিকের একটা ঘরে ঠেলে পুরে দিয়ে বক্রেশ্বর বলেন, ‘থাক তুই এখানে, না খেয়ে পচে পচে মর। ত্রিভুবনের কেউ তোকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে পারবে না, বুঝলি?’

দরজা বন্ধ করে তাতে একটা ভারী তালা লাগিয়ে দিয়ে চাবি নিজের ফতুয়ার পকেটে পুরে গটগট করে চলে যান বক্রেশ্বর। আর বলে যান, ‘গজগোবিন্দ, নিধিরাম, এ কথা যদি প্রকাশ পায়, তা হলে তোদের জ্যান্ত পুঁতব তা বলে রাখছি।’

নিধিরাম দু-হাতে নিজের দু-কান মলে, আর গজগোবিন্দ আধফুট জিভ বার করে জিভ কাটে।

জামাইবাবু অনেকক্ষণ ছাদে অপেক্ষা করে, একটু অবাক হয়েই নেমে আসেন। এক্ষুনি যাচ্ছি বলে ছেলেটা গেল কোথায়?

নীচে নেমে এসেও তো কোথাও দেখতে পাচ্ছেন না। এ ঘর ও ঘর, এ দালান ও দালান, এ সিঁড়ি ও সিঁড়ি, এ মহল ও মহল, কোথাও না।

বামুনদি অবাক হয়ে বলে, ‘ও মা সেকী? এই তো খানিকআগে দুধ খেল, সন্দেশ খেল, পেস্তা বাদাম খেল, খেজুর—’

‘থাক থাক, কী খেল তা আমি জানতে চাই না, কোথায় গেল তাই জানতে চাইছি।’

কিন্তু বলবে কে?

দাসদাসী কেউই তো জানে না।

কর্তারাজা?

তিনি মাথায় হাত চাপড়ে বললেন, ‘সেই তো কাল সক্কালে আমার কাছে এসেছিল, আজ এখনও আসেনি। নিশ্চয়ই আবার চলে গেছে। আমি জানতাম! থাকবে না, তা জানতাম। ওর ভাবভঙ্গি সব সময় পালাই পালাই ছিল। উঃ আর ক-দিন পরেই অনন্তনারায়ণ আসবে, আর আজ সেআবার হারিয়ে গেল? বাগানে দেখেছ?’

‘দেখেছি।’

‘চাকরদের মহলে?’

‘হুঁ!’

‘মন্দিরে—’

‘দেখেছি নেই।’

‘ঠাকুরবাড়িতে?’

‘দেখেছি নেই।’

‘তার মানে নেই-ই-ই! জামাইবাবু, শিগগির কাউকে বলো, দুটো ডাব কেটে আমার মাথায় ঢালুক! এক্ষুনি! বেঁা বেঁা করে ঘুরছে মাথা।’

মহারানি তুলসীমঞ্জরী যেই শুনলেন দীপুকে আবার পাওয়া যাচ্ছে না, সঙ্গে সঙ্গে সেই বিরাট দেহভার আছড়ে মাটিতে ফেলে গড়াগড়ি দিয়ে মড়াকান্না শুরু করে দিলেন।

‘ওরে, যখনই দেখেছি তুই আমার জুঁই, মল্লিকা, গোলাপ, কমলকে আদর করছিস না, ওরা আহ্লাদ করে তোর গালটা একটু চেটে দিতে গেলে ছুট মারছিস, তখনই বুঝেছি তোকে কিছুতে পেয়েছে, তুই আর সেদীপু নেই। তুই থাকবি না, তুই আবার পালাবি—’

ডাবের জল মাথায় ঢেলে রাজীবনারায়ণ একটু সুস্থ বোধ করছিলেন, কানে এল এই কান্নার শদ।

‘কাঁদে কে? কাঁদে কে? মহারানি বুঝি?’

রাজীবনারায়ণ তেড়ে ওঠেন, রুপোর লাঠিটা বাগিয়ে ধরে ঠকঠকিয়ে এগিয়ে যান। চোখে দেখতে না পেলে কী হবে, চেনা জায়গা, চেনা মহল, এসে পড়েন, হুংকার দিয়ে দিয়ে লাঠি ঠুকতে থাকেন, ‘আবার এখন কান্না হচ্ছে, এই তোমার জন্যেই এটি হল। তোমার ওই আদুরি আহ্লাদী কুকুরগুলোর ভয়েই বেচারা—’

‘কুকুর? তুমি আমার মল্লিকা, মালতীদের কুকুর বলছ?’ ফোঁস করে ওঠেন মহারানি।

রাজীবনারায়ণ তাতে কেয়ার করেন না। তিনি সমানতালে চালিয়ে যান, ‘তা কুকুরকে কুকুর বলব না তো কী ঠাকুর বলব? একশোবার বলব, কুকুর, কুকুর, কুকুর। ওই কুকুরদের কুকরোমির জন্যেই দীপু আবার সটকান দিয়েছে।’

বসে পড়েন। বলে ওঠেন, ‘ওরে আর দুটো ডাব কাট।’

ওদিকে বামুনদি, সুধার পিসি, মোক্ষদা, দুঃখীর মা, এদের এলাকায় গোলটেবিল বৈঠক বসে যায়—হলটা কী? …..চলেই যদি গিয়ে থাকে, বলো তো, কীকরে গেল? দেউড়িতে পাহারা নেই? মাছি হয়ে উড়ে গেল নাকি?

তার মানে পায়ে হেঁটে হেঁটে নিজে নিজে যায়নি, ভূতে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। আসলে ভূতে পাওয়াই ছিল।

এখন সবাই বলছে, তাই কেবলই মনে হত, যেন সেছেলে নয়। যেন আর কে ঘুরছে ফিরছে। যেন আর কার সঙ্গে কথা বলছি।

আগে কেমন জেদি, বেয়াড়া আর আবদেরে ছিল ভাবো! আমাদের তো মাথা খারাপ করে দিত। আর এখন? সোনাহেন মেজাজ। জেদ নেই, বেয়াড়াপনা নেই, একেবারে পালটে গেছে। এ নির্ঘাত ভূতের কাজ।

তবে একবার কেন ফেরত দিয়েছিল? সেটাই ভাবনার কথা। ভূতেরা কি একবার ফেরত দিয়ে আবার উড়িয়ে নিয়ে যায়?

তাই হবে হয়তো। ভূতেদের ওই নিয়ম।

অন্য চাকররাও একত্র হয়ে জটলা করছে, গেল কীকরে ছেলেটা? শুধু গজগোবিন্দ আর নিধিরাম মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে।

ক্রমশ হইচই স্তব্ধ হয়ে যায়, বাড়িতে শোকের ছায়া নামে।…

টিকলু এ-সবের কিছুই টের পায় না।

টিকলু মশার কামড়ে ছটফটিয়ে আস্তাবলের বিশ্রী গন্ধঅলা সেই ছোট্টঘরটায় বসে আছে চারটি খড়ের ওপর।

এমন ঘর, জগতের কোথাও কোনোখান থেকে সাড়া আসে না।

খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে, আর মনে পড়ছে ক্ষীর, ছানা, সন্দেশ, রসগোল্লা, গজা, বেঁাদে কত কী থালায় ফেলে দিয়ে আসে টিকলু! উঃ, একদিন না খেলেই এরকম হয়?

বেলা কত হল কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, টিকলুর মনে হচ্ছে যেন অনন্তকাল ধরে সেএই পচা ঘরটায় পড়ে আছে। ইয়া বড়ো বড়ো সব মশা কামড়ে কামড়ে গা মুখ ফুলিয়ে দিল টিকলুর। ঘর ভরতি খড়ের গাদা, সাপও থাকতে পারে। একটামাত্র দরজা, সেটা তো তালাচাবি পড়ে গেছে। সাপে কামড়াতে এলে পালাবার উপায় নেই।

গল্পের যেসব ছেলেরা বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়, তারা এরকম বিপদে পড়লে কী করে, ভাবতে চেষ্টা করে টিকলু, কিন্তু ঠিক এইরকম অবস্থা কোনো গল্পের নায়কের হয়েছিল মনে করতে পারে না টিকলু। ভাবতে গিয়ে শেষ অবধি কান্নাই পায়। কেঁদে কেঁদে এক সময় ঘুমিয়েও পড়ে টিকলু, আবার মশার জ্বালায় উঠে পড়ে। পেটের জ্বালাও আছে। …ঘরটার মধ্যে তো ঘুটঘুটে অন্ধকার, দিন কী রাত বোঝবার উপায় নেই, তবু টিকলু হঠাৎ খড়ের গাদাটাকেই ঠেঙাতে লাগল। হঠাৎ হয়ে গেল একটা আবিষ্কার।

ঘরটার মধ্যে ওই দরজাটা ছাড়া যে আর কিছু আছে টের পায়নি টিকলু, হঠাৎ দেখতে পেল খড়ের গাদা পড়ে গিয়ে পাশ থেকে যেন চাঁদের আলো আসছে। তা হলে নিশ্চয় ওখানে জানলা আছে।

টিকলু আরও খড় সরাতে গিয়ে দেখে জানলার বাইরে একটা লোক। লোক, না ভূত?

টিকলু চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কে?’

লোকটা তাড়াতাড়ি বলে, ‘চুপ খোকাবাবু, চুপ! আমি নিধিরাম, আপনাকে বের করে আনব বলে জানলার শিক খসাচ্ছি।’

টিকলু এখন মেজাজ ফিরে পায়। তীক্ষ্ণগলায় বলে, ‘ওঃ তাই নাকি? নিজেই তো ধরে এনে বন্ধ করে যাওয়া হয়েছিল।’

‘কী করব বাবু, মনিবের হুকুম। না আনলে দেওয়ানবাবু আমায় জুতোপেটা করত। কিন্তু সেই অবধি, প্রাণ ফেটে যাচ্ছে।’

‘কর্তারাজাকে বলে দিতে পারো না?’

‘সাহস হয় না খোকাবাবু! দেওয়ানবাবুটিকে তো জানো না? সাংঘাতিক লোক।’

‘আচ্ছা, তুই আমায় বের করে দে, দেখছি কেমন সাংঘাতিক লোক।’

‘আমার নাম বলে ফেলবে না তো খোকা রাজাবাবু?’

টিকলু বলে, ‘পাগল হয়েছিস? তাই কখনো বলি?’

এখন টিকলুর হঠাৎ বেশ আহ্লাদ হয়। এতক্ষণ খেয়াল করেনি, এখন করছে। এই তো ঠিক ডিটেকটিভ গল্পের বইয়ের মতনই সব ঘটছে।

টিকলু সেগল্পের নায়ক।

জানলার শিক বাঁকিয়ে টিকলুকে বার করে নিয়ে বাগানের পেছনদিক থেকে বাঁশের মই দিয়ে ওকে স্রেফ ছাদে তুলে দিয়ে, নিধিরাম আবার বাঁকানো শিক সোজা করে নিজের বাড়ি চলে গিয়ে বাকি ঘুমটা ঘুমোতে থাকে।

আর টিকলু?

সেও মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়ে খোলাছাদের স্নিগ্ধ হাওয়ায়।

জামাইবাবুর আজ ভোরে ছাদে ওঠার সময় হাতে ছোলা ভিজের বাটি নেই। মন খারাপ, ছোলা ভিজোতে ভুলেই গেছেন জামাইবাবু। জীবনে এই প্রথম।

কিন্তু এ কী?

ছাদের মাঝখানে শুয়ে কে?

জামাইবাবু দু-বাহু তুলে একবার নেচে নিয়ে ওকে নাড়া দেন, ‘এই বোম্বেটে শয়তান, গোপাল আমার, জাদু আমার, গুণ্ডা, গাঁটকাটা, চাঁদুরে, মানিক রে, ভূত, প্রেত, দত্যি, দানো, শিব, শম্ভু, নারায়ণ, বলি, কোথায় ছিলি বাপ কাল? পরিতে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল? নাকি তোর সেই কাপালিক আবার এসে মন্ত্রবলে অদৃশ্য করে দিয়েছিল?’

টিকলু উঠে বসে।

চারদিকে অবলোকন করে, তারপর গম্ভীরমুখে বলে, ‘অ্যাডভেঞ্চার।’

কর্তারাজার ঘরে মলিনমুখে বসে আছে বক্রেশ্বর, মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে একটু কেঁদে উঠছেন।

কান্না থামিয়ে একবার বলে উঠলেন, ‘আবার যে এমনটা হবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি কর্তামশাই! এখন যুবরাজকে কী জবাব দেব?’

রাজীবনারায়ণ গম্ভীরভাবে বলেন, ‘পরকালে কী জবাব দেবে তাই ভাবো বক্রেশ্বর!’

‘আজ্ঞে এ-কথা বলছেন কেন?’

‘কেন বলছি? জানো না ন্যাকা?’ তুমি খোকাকে নিজের বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যাওনি আহ্লাদ করে?’

‘আমি? নিজের বাড়িতে?’

হঠাৎ পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে খোকারাজা দীপেন্দ্রনারায়ণ! অবাক গলায় বলে, ‘কী অদ্ভুত! এত ভুলোমন আপনার দেওয়ানবাবু? সেদিন বললেন না, ‘এতদিন এসেছ, একবার আমার বাড়ি বেড়াতে যাওনি, চলো নিয়ে যাই।’ ভুলে যাচ্ছেন? ছোটো নায়েববাবু, আপনি, নিধিরাম সবাই মিলে নিয়ে গেলেন না? ও কী, অমন চমকাচ্ছেন কেন? কী ভুল আপনার, উঃ! বললেন না, ‘থাকো একটা দিন।’ কত যত্ন আদর করলেন, কত খাওয়ালেন, আর এঁরা এখানে— ও কী, আবার সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত কেন?’

‘কেন? কেন?’

রাজীবনারায়ণ চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘প্রণিপাত কেন?’

‘কিছু না রাজামশাই, হঠাৎ বামন অবতারকে প্রত্যক্ষ করলাম কিনা, তাই।’

‘আঃ,কী যেসব বলো ছাই! নিয়ে গিয়েছিলে, বেশ করেছিলে, কিন্তু বলোনি কেন?’

‘আজ্ঞে ভুল ভুল! সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলাম।’

‘আর যেন এমন ভুল না হয়।’

‘পাগল! এই নাক মুলছি, কান মুলছি, মাথার চুল ছিঁড়ছি।’

কিন্তু রাজীবনারায়ণের ঘরের বাইরে অন্যের চোখের আড়ালে আর কি দেখা হবে না! হতেই হবে।

হওয়াবার জন্যে কম চেষ্টা তো করলেন না বক্রেশ্বর বাক্যবিনোদ। তক্কে তক্কে থেকে ধরে ফেললেন একদিন বাগানের ওই একধারে। একটা কাঠবেড়ালির পিছু পিছু ছুটতে ছুটতে টিকলু চলে গেছে একেবারে সেই ধারের দিকে সুপুরি গাছের সারির কাছে। বক্রেশ্বর ঝপ করে সামনে এসে পড়ে বলে ওঠেন, ‘আহা! আহা! এদিকে কেন? এদিকে কেন? এইদিকে সাপখোপ, ভাম ভোঁদড়ের আড্ডা।’

গলায় যেন মধু ঝরে বক্রেশ্বরের।

টিকলুর শুনে বেজায় মজা লাগে।

টিকলুর ভীষণ হাসিও পায় ওই ভাম ভোঁদড় শুনে। হি হি করে হেসে ওঠে সে, ‘ভাম ভোঁদড় আবার কী দেওয়ান মশাই! ভাম ভোঁদড়!’

বক্রেশ্বর এখন দুঃখী দুখী গলায় বলেন, ‘তুমি যে আমার সঙ্গে কেন এমন করো ভাই, ভেবে দেখো, আমি কি তোমার কিছু অনিষ্ট করেছি। রাজার হালে রয়েছ, খাচ্ছদাচ্ছ বেড়াচ্ছ, বাড়িসুদ্ধ সবাই তোমার কাছে জোড়হস্ত। পকেটভরতি টাকা, তবু আমার ওপর তুমি এত খাপ্পা। মানছি সেদিন ভুলক্রমে আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছিলাম, তারজন্যে মাপ চাইছি। …..এই তো ক-দিন পরে তোমার মা-বাপ আসছে, তখন যদি তুমি তাদের কাছে আমার নামে কিছু বলে দাও, আমার কি আর চাকরি থাকবে?’

বক্রেশ্বরের মুখে হঠাৎ এমন মধুর বচন শুনে টিকলু একটু হকচকিয়ে যাচ্ছিল, এখন বুঝতে পারল ব্যাপারটা কী? চাকরি যাওয়ার ভয় হয়েছে এখন।

টিকলুর দয়া হয়।

টিকলু উদারগলায় বলে, ‘আমি কিছু বলতেই যাব কেন? আমি কি তেমন ছেলে?’

বক্রেশ্বর মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করে মুখে বলে, ‘আহা, সেতো জানি, তবে কিনা রাগ করে যদি—’

‘আমার অত রাগ নেই।’

‘তা তো বটেই, তা তো বটেই—’ বলে বক্রেশ্বর তার ঝোলা ভুরু আরও ঝুলিয়ে বলে, ‘এ কথা খুব সত্যি কথা। নইলে সেদিন আমায় ওই বিপদ থেকে বাঁচাও! কর্তারাজা যদি টের পেতেন, আমি ভুলে ভুলে তোমায় খড়ের ঘরে বন্ধ করে রেখে চাবিটা নিয়ে ভুলে চলে এসেছিলাম, তা হলে কি আর আস্ত রাখতেন আমায়? ওই লাঠিখানি বাগিয়ে ধরে আন্দাজেই আমার মাথাটা ছাতু করে দিতেন।’

টিকলু সেই দৃশ্যটা ভেবে খুব মজা পায়। কর্তারাজা লাঠি উঁচিয়ে আসছেন, অথচ দেখতে পাচ্ছেন না কোথায় সেই আসামির মাথাটা।

টিকলু হেসে উঠে বলে, ‘আপনি মাথাটা নিয়ে সরে যেতে পারতেন না বুঝি?’

‘ও বাবা! ওনার হাত থেকে সরে যাব? একটা ঘাড়ে ক-টা মাথা আমার? তা যাক, তুমি আমায় বাঁচিয়েছ। সেইদিন থেকেই ভাবছি, তার বদলে তোমায় কী দিই!’

টিকলু চালাক ছেলে এ কথা ঠিক, তবু টিকলু একটা ছোটোছেলে, সরল ছেলে, তাই টিকলু অবাক হয়। ‘দেবেন আবার কী?’

‘আহা তা সত্যি, দেব আর কী! আমার আর তোমায় দেবার মতো কী আছে? তবে তোমায় একটা মজার জিনিস দেখাতে পারি।’

টিকলু এখন সম্পূর্ণ সন্দেহমুক্ত।

টিকলু এখন বুঝতে পারছে লোকটাকে যত পাজি ভাবছিল সে, তত পাজি নয় সে।

টিকলুর একটু লজ্জা হয়।

টিকলু তাই খুব আগ্রহে বলে ওঠে, ‘কী মজার জিনিস? কী মজার জিনিস?’

‘জিনিস’ বললে ভুল করা হবে খোকারাজা, বলতে পারো মজার জায়গা। এই পাট্টাদার বংশের কোনো এক পূর্বপুরুষ অনেককাল আগে দেয়ালের মধ্যে সোনা পুঁতে রেখেছিলেন শুনেছ নিশ্চয়? জামাইবাবু কি আর না বলেছে? কি? বলেনি?’

টিকলু বলে, ‘হুঁ!’

‘কিন্তু কোথায় রেখে গেছেন, কোন দেয়ালের মধ্যে, তা কি বলেছে?’

বক্রেশ্বরের মুখটা বক্রহাসিতে আরও বক্র হয়ে যায়।

টিকলু বলে, ‘বা: কীকরে বলবেন? উনি কি নিজেই জানেন নাকি?’

‘হুঁ সেই তো!’

বক্রেশ্বর রহস্যময় মুখ করে বলেন, ‘কেউ জানে না। বরাবর সবাই শুনেই এসেছে। কর্তারাজার যখন জোয়ান বয়েস, তখন উনি এক একদিন সারারাত্তির জেগে দেওয়ালে লাঠি ঠুকে ঠুকে দেখতেন, কোনোখানে ফাঁপা আছে কি না। কিন্তু ফোক্কা। সব নিরেট দেয়াল।’

টিকলু হতাশগলায় বলে, ‘তা হলে?’

কেউ কোথাও নেই, তবু বক্রেশ্বর ফিসফিস করে বলেন, ‘আসলে যে অন্য ব্যাপার। এটা তো বসতবাড়ি। মানে—থাকবার বাড়ি, ওখানে রাখবেনই বা কেন? রেখেছিলেন দুর্গের মধ্যেকার দেয়ালে।’

‘দুর্গ!’

টিকলু আহ্লাদে ছিটকে ওঠে, ‘আবার দুর্গও আছে? একেবারে সত্যি রাজাদের মতন?’

‘থাকবে না? একসময় তো সত্যিই রাজত্ব করে গেছেন।’

‘কোথায় সেটা?’

‘আছে! ওই নদীর ধারে। তবে এখনও কি আর আস্ত আছে? হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে গেছে, পাথরগুলো ছিটকে পড়ে আছে, আর দাঁড়িয়ে আছে দু-একটা ভাঙা থাম ভাঙা খিলেন।’

টিকলু সন্দেহ সন্দেহ গলায় বলে, ‘ওইরকম একটা ভাঙা দুর্গ তো দেখেছি নদীর ধারে জামাইবাবুর সঙ্গে। জামাইবাবু যে বললেন, ওটা পোর্তুগিজ জলদস্যুদের!’

বক্রেশ্বর মুখ বাঁকিয়ে বলেন, ‘জামাইবাবু যতটুকু জানেন, তাই বলেছেন। আসলে সেই তিনি, মানে পাট্টাদার বাহাদুর, ওই জলদস্যুদের যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে একেবারে দেশছাড়া করে দুর্গ দখল করে ফেলে রাজ্য পত্তন করেছিলেন। আর ওই দস্যুদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া তাল সোনা, পুঁতে ফেলেছিলেন দুর্গের পাথরের দেয়ালের মধ্যে।’

টিকলু উত্তেজিত হয়, সেইভাবেই বলে, ‘আপনি কীকরে জানলেন?’

‘কীকরে জানলাম!’

বক্রেশ্বর মৃদু হেসে বলেন, ‘জানতাম কী আর? জানলাম। মানে, মাত্র এই গতকালই জানতে পেরেছি।’

‘আঃ! কীকরে তাই বলুন না।’

‘বলছি তো ভাই! জানলাম—’

বক্রেশ্বর হঠাৎ দু-হাত জোড় করে কপালে তুলে গভীরগলায় বলেন, ‘জানলাম দেবাদেশে।’

‘দেবাদেশ মানে?’

‘মানে? দৈবাদেশ মানে জানো না?’

টিকলু বলে, ‘না।’

‘মানে হচ্ছে—স্বপ্ন। ভোররাত্তিরের স্বপ্ন তো বিফলে যায় না? গতকাল সেই ভোররাত্তিরে হঠাৎ দেখি ঘরটা হঠাৎ আলোয় আলো হয়ে গেল। অবাক হয়ে দেখি একজন রাজারাজড়ার মতো চেহারার লোক আমায় বললেন, ‘আমার সঙ্গে আয়।’ ……আমি তো ভয়ে ভয়ে উঠে পড়ে গেলাম।’

‘গেলেন?’

টিকলুর চোখ গোল, চুল খাড়া।

‘আহা, সত্যি কি আর হাত-পা নিয়ে গেলাম, স্বপ্নে গেলাম। পিছু পিছু যাচ্ছি তো যাচ্ছি, এসে গেলাম সেই ভাঙা দুর্গের কাছে। তখন তিনি গম্ভীরগলায় বললেন, ‘এই দুর্গের দেয়ালের মধ্যে অনেক সোনা পোঁতা আছে। আমার বংশধরদের বলে যেতে পারিনি, তুই দেখে যা। গিয়ে বলবি, যেন সব সোনা উদ্ধার করে নিয়ে যায়।’

টিকলু হাঁ করে তাকিয়ে বলে, ‘তা তিনি বংশধরদের বললেন না কেন?’

‘কেন?’

বক্রেশ্বর বিরক্তভাবে বলেন, ‘কেন তা আমি কী জানি! রাজারাজড়াদের খেয়ালের কোনো ‘কেন’ আছে? তবে মনে হয় বলবার লোক পাননি। কর্তারাজা তো চোখে দেখেন না, যুবরাজ দেশেই থাকেন না—’

টিকলু গম্ভীরভাবে বলে, ‘আমায় বলতে পারতেন।’

শুনে না, বক্রেশ্বরের চোখে দপ করে মশাল জ্বলে ওঠে। তবু রাগ সামলে নরম গলায় বলেন, ‘তা বটে! সেইটাই উচিত ছিল তেনার—তুমি যখন আসল মালিক! তা বুঝতে পারেননি বোধ হয়। তাই আমাকেই—যাই হোক, আমায় তো আরও ভিতরে নিয়ে গেলেন, কিছু না বলে একটা ভাঙা খিলেনের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, ‘ওর নীচে।’ ব্যস মুহূর্তে হাওয়া! আর দেখতে পেলাম না। দেখি সকালের আলো ফুটে উঠেছে, আমি বোকার মতো বিছানায় বসে আছি আর ঘামছি।’

‘ঘামছেন?’

‘তাই তো দেখলাম। কিন্তু তখন আর কারও সঙ্গে কথাটি নয়, চোঁ চোঁ দৌড়ে চলে গেলাম সেই দুর্গের দিকে। দেখি অবিকল সেইরকম ভাঙা খিলেন। চারদিকের পাথর পড়ে যেন একটা গহ্বরের মতো হয়ে গেছে। মানে ঠিক যেমনটি দেখেছিলাম। সেই তখন থেকে ভাবছি কাকে বলি। এখন তোমায় দেখে—’

টিকলু খুবই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। টিকলু মহোৎসাহে বলে, জামাইবাবুকে বলুন না।’

‘জামাইবাবু!’

বক্রেশ্বর দু-হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলেন, ‘সেআমার দ্বারা অসম্ভব। উনি এসব স্বপ্ন-টপ্ন বিশ্বাস করেন নাকি? ঠিক হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলবেন, ‘আর গুল মারতে আসবেন না দেওয়ানজি!’

টিকলু কিন্তু ভারি বিচলিত হয়। বলে, ‘আপনি বিশ্বাস করেন স্বপ্নটপ্ন?’

‘আরে বাবা! এতদিন কি আমিই বিশ্বাস করেছি? কিন্তু যখন দিনের আলোয় গিয়ে নিজের চক্ষে দেখে এলাম অবিকল সেই দৃশ্য, তাই না? তাই ভাবছি তোমার যদি ইচ্ছে হয়—’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমার খুব ইচ্ছে আছে। এক্ষুনি চলুন।’

বলে বক্রেশ্বরের হাত ধরে টানে টিকলু।

বক্রেশ্বর এখন ভারিক্কি হন, ‘এক্ষুনি যাবে? সকালের দুধ-টুধ খাওয়া হয়েছে?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সব হয়েছে। দুধ, মিষ্টি, বাদাম, পেস্তা, খেজুর, কলা, আরও কত কী?’

বক্রেশ্বর মনে মনে দাঁত কিড়মিড়িয়ে মনে মনেই বলেন, ‘হুঁ, এইরকম খেয়ে খেয়েই তোমার রঙের এমন জেল্লা খুলছে, চেহারার এমন চেকনাই বাড়ছে, চুলের বাহার হচ্ছে। প্রায় সত্যি রাজুপুত্তুরই হয়ে উঠছ। আচ্ছা! হওয়া বার করছি। আমি ব্যাটা তোমার মতন একটা খোকার কাছে জব্দ হচ্ছি আর কর্তারাজার কাছে ধমক খাচ্ছি, আর মনে মনে হরিনাম করছি যুবরাজ এলে পাছে ধরা পড়ে যাই। তোমার সব খেল খতম করছি।’

তা এ-সব কথা তো মনের মধ্যে, মুখে বাক্যি নেই। টিকলু অস্থিরগলায় বলে, ‘কই, চলুন?’

‘তা হলে এক্ষুনিই যাবে বলছ?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বলছি তো।’

বক্রেশ্বর তবু আলগা আলগা গলায় বলেন, ‘রোদে কষ্ট হবে না তো?’

‘আঃ বলছি তো কিচ্ছু কষ্ট হবে না।’

‘তবে চলো।’

বলে, যেন নিরুপায় হয়েই এগোন বক্রেশ্বর। ‘কিন্তু যদি তোমার খোঁজ পড়ে? বাড়িতে বলে গেলে হত না?’

টিকলু আঁতকে ওঠে, ‘ওরে বাবা! এখন এই বিরাট বাগানটা পার হয়ে দালান, বারান্দা ডিঙিয়ে বাড়িতে বলে আসতে তো একঘণ্টা হয়ে যাবে। ততক্ষণে আমরা চলেই আসব।’

ব্যস! তবে আর কী।

বক্রেশ্বরের কোনো দোষ নেই।

সত্যি বলতে, বাগানের এই শেষপ্রান্ত থেকে নদীর ধার খুব বেশিদূর নয়, খানিকক্ষণ হেঁটেই পৌঁছে গেল টিকলুরা।

এর আগে টিকলু শুধু দূর থেকেই দেখেছিল। এখন কাছে এসে যেন গা-ছমছম করে উঠল। কবে যে এমন হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছে কে জানে, হয়তো ভূমিকম্পে, হয়তো বা নদীর জোয়ারে। এখন চারিদিকে গাছ গজিয়ে গেছে। আর মাঝে মাঝে উঁকি মারছে বড়ো বড়ো পাথরের চাঁই। তাতে দিব্যি কারুকার্য। পা ফেলা শক্ত, তবু ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে, পা টিপে টিপে একটু এগোতেই টিকলু অবাক। একটা ভাঙা খিলেনের কাছে পুরো একটা সিংহের মুখ। কাত হয়ে পড়ে আছে।

কী কেশর, কী হাঁ! কী বড়ো বড়ো দাঁত। দুর্গাঠাকুরের সিংহের চাইতে ক—ত বড়ো।…

নিশ্চয়ই কোনো স্তম্ভের মাথার উপর ছিল!

বক্রেশ্বর বলেন, ‘এই, এই জায়গা। ওই সিংহীর মাথাটার পিছনে একটা গহ্বরমতো আছে। ওইখানে, কিন্তু এত সরু আমি তো ঢুকতেই পারলাম না তখন।’

টিকলু লাফিয়ে উঠে বলে, ‘আমি ঠিক পারব।’

‘পারবে? ভয় করবে না?’

ভয় যে একেবারে করছে না তা নয়, ঝোপেজঙ্গলে জায়গাটা এইদিনেরবেলাতেও অন্ধকার। তবু অ্যাডভেঞ্চার বলে কথা।

জীবনে কি আর এমন সুযোগ পাবে টিকলু? বাপুর ভাগ্যে সাতজন্মেও হবে?

বাপুর জন্যে খুবই মন কেমন করল টিকলুর, তবু এই সুযোগ তো ছাড়া যায় না। ভয়কে জয় করে টিকলু যত সব উঁচু-নীচু-ঢিপি-ঢাবায় পা দিয়ে দিয়ে সিংহের মাথাটায় চড়ে পড়ল।

টিকলুর মনে হল, সেযেন একটা দিগবিজয়ী বীর।

এদিকে বক্রেশ্বরের চোখ চকচকে হয়ে উঠেছে।

বক্রেশ্বর চেঁচিয়ে বলেন, ‘ওদিকে কী দেখতে পাচ্ছ?’

‘একটা ছোট্ট ঘরের মতো। বোধ হয় সিঁড়ির তলা।’

‘দরজা আছে?’

‘না। ভেঙে গেছে।’

‘ওই! ওইখানেই আছে।’

বক্রেশ্বর হাঁই-ফাঁই করে বলেন, ‘ওইটাই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।’

টিকলু তো বেশ খানিকটা উঁচুতে, চেঁচিয়ে বলে, ‘কই? সোনা কই?’

‘আহা, সোনা কি আর মাটিতে পড়ে আছে? দেখো কোনোখানে ফোকর আছে কি না! তার দরজা আছে কি না। নেমে দেখো ওদিকটায়।’

বেচারি টিকলু!

বক্রেশ্বরের ফাঁদে পা দিয়ে বসে।

টিকলু আবার এতে ওতে পা ঠেকিয়ে ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে নেমে যায় ওদিকটায়, আর সঙ্গে সঙ্গে বক্রেশ্বর বাক্যবিনোদ এক কাজ করে বসেন।

ওই সিংহের মাথাটাকে প্রাণপণে ঠেলেন।

এবড়ো খেবড়ো পাথরের গা দিয়ে গড়িয়ে গিয়ে সেটা ওই গহ্বরের মুখটা ঢেকে ফেলে।

টিকলু তার পেছনে অদৃশ্য হয়ে যায়।

কিন্তু টিকলুর গলা শোনা যায়, আর্তনাদের গলা!

‘এ কী! এখানটা যে বন্ধ হয়ে গেল। আমি কীকরে যাব? পাথরটা সরিয়ে দিন শিগগির।’

বক্রেশ্বরের এখন ফুর্তি দেখে কে?

বক্রেশ্বর হাহা, হোহো করে হেসে বলে ওঠেন, ‘পাথর আর এ জীবনে সরছে না জাদু! থাকো তুমি ওইখানে। আমার পাট্টাদার বাহাদুরের সাতপুরুষের নাতি, শ্রীল শ্রীমান দীপেন্দ্রনারায়ণ, পূর্বপুরুষদের সোনার তাল কুড়োও। ব্যাটা পাজি, বিচ্ছু, গরিলা, শিম্পাঞ্জি! ইঁদুর, আরশোলা, টিকটিকি, ছুঁচো! আমার সঙ্গে লাগতে আসিস তুই! আমাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য!…..আমি তোকে রাজপুত্তুর বানালাম, আর তুই কি না—’

ওদিকে টিকলুও চেঁচায়, ‘ভালো হবে না বলছি দেওয়ান মশাই! শিগগির পাথর সরিয়ে দিন। না হলে আপনাকে আমি মেরে ফেলব।’

নদীর ধার ধু ধু ফাঁকা। জনমনিষ্যহীন এই ভাঙা দুর্গের মধ্যেকার চেঁচামেচি জগতের কারওর কানে যায় না।

বক্রেশ্বর রেগে হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, ‘কী বললি? আমাকে তুই মেরে ফেলবি? কী করে? মরে ভূত হয়ে? তাই মারিস। এখন ওইখানে পচে পচে ‘ভূত হ’। সোনা না কাঁচকলা! এখানে কী আছে জানিস? বড়ো বড়ো সাপ!’

চলে যান গট গট করে।

উঃ! কম রাগ আছে ওঁর ছেলেটার ওপর! ভূতের কাছে মামদোবাজি! বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা! বক্রেশ্বরের কাছে চাল ফলাতে আসে! ভাব দেখায় যেন সত্যিই রাজকুমার। রাজকুমারের পোশাকটা তোকে পরাল কে? …তা ছাড়া এই তো ক-দিন পরেই যুবরাজ এসে যাবেন, ওই বিচ্ছুছেলে তাঁদের সামনে আবার কোন মূর্তি ধরবে, বক্রেশ্বরকে কী আপদেই ফেলবে কে জানে! এই ঠিক হয়েছে। বললেই হবে ঘরপালানে ছেলে আবার পালিয়েছে।

এদিকে খানিকক্ষণ পরেই রাজবাড়িতে তুমুল হুলুস্থুল। আবার আজ কোথায় গেল খোকারাজা! সেই সকালে দুধ-টুধ খেয়ে কোথায় যেন খেলছিল, আর পাওয়া যাচ্ছে না।

তবে খোঁজ খোঁজ! দেওয়ানজির বাড়িতে!

সেবার তো—

ছুটল পাঁচটা দাস-দাসী।

না: সেখানে নেই। দেওয়ানজি বক্রেশ্বর আকাশ থেকে পড়লেন, ‘বলিস কী। আবার পাওয়া যাচ্ছে না? না বাবা, এ নির্ঘাতই ভূতে পাওয়া ছেলে। ভূতেই উড়িয়ে নিয়ে গেছে।’

তার মানে, ছেলে আর ছেলের বউয়ের কাছে মাথা হেঁট হবেই কর্তারাজার।

ছেলে যখন বলবে, ‘বাবা, দীপেন্দ্র কই?’

কর্তারাজাকে তখন বলতে হবে, ‘তাকে একবার নিশিতে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে খুঁজে আনা হয়েছিল, আবার ভূতে উড়িয়ে নিয়ে গেছে।’

বাড়িতে শোকের ছায়া নামে।

কর্তারাজা ঘুমের নেশা ভেঙে যখন তখন লাঠি ঠকঠকিয়ে সারাবাড়িতে ঘুরে বেড়ান, আর মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘কোই হ্যায়।’

আর কর্তারানিমা?

তিনি মনের ভুলে তাঁর মেয়েদের চারবারের ওপর আর দু-বার খাইয়ে ফেলেন, আর তারা খেতে না চাইলে পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসেন।

বামুনদি, মোক্ষদা, সুধার মা, গজগোবিন্দ, নিধিরাম, নরহরি, সবাই আড়ালে ফিসফিস করতে থাকে।

তারা যে সর্বদাই সন্দেহ করেছে—এ ছেলে ভূতাশ্রিত, এটাই তাদের বক্তব্য।

কর্তারাজা বলেছেন, ‘বক্রেশ্বর! এই দু-দিনের মধ্যে ফের ছেলে খুঁজে বার করতে না পারো, তোমায় জ্যান্ত পুঁতব!’

বক্রেশ্বর জোরগলায় বলেছে, ‘তাই পুঁতুন কর্তারাজা। এ ধিক্কারের প্রাণে দরকার নেই আমার! লুঠ করবে ভূতে, আর দোষ হবে আমার, এই যখন বিচার আপনার, তবে এখনই জ্যান্ত পুঁতুন।’

কর্তারাজা বলেছেন, ‘তা হলে তাঁকে খুঁজবে কে? ডাকো খাজাঞ্চিবাবুকে, তোমায় নগদ পাঁচ হাজার টাকা দিক, আবার ছেলে খুঁজতে বেরোও।’

বক্রেশ্বর বলেন, ‘ভূত কি ঘুস খায় কর্তারাজা?’

‘ওসব জানি না। ছেলে আমার সামনে বুধবারের মধ্যে চাই-ই চাই।’

বক্রেশ্বর আহ্লাদ গোপন করে বলেন, ‘তবে বলুন খাজাঞ্চিবাবুকে। তবে পাঁচ হবে না। আরও কিছু চাই।’

‘বেশ তাই তাই। দশ হাজারই নাও তুমি। কিন্তু ছেলে আনা চাই।’

বক্রেশ্বর ভাবেন, আর আমি খুঁজছি সেই বিচ্ছু ছেলেকে! টাকাটা নিয়ে স্রেফ কলকাতায় চলে যাব। মনের সুখে থাকব, বছর দু-তিন পরে আসব। তখন আর কারও অত ছেলের জন্যে মন কেমন করবে না।

চললেন খাজাঞ্চিবাবুর কাছে।

কিন্তু আজ তো বৃহস্পতিবার, মানে লক্ষ্মীবার। আজ তো সিন্দুকে হাত দেওয়া নিষেধ। পাবেন সেই কাল দুপুরে। খাজাঞ্চিবাবু স্নানটান সেরে সিন্দুকে তেল-সিন্দুরের ফোঁটা দিয়ে তবে তো খুলবেন?

পেঁচার মতো মুখ করে ফিরে যান বক্রেশ্বর বাক্যবিনোদ।

আর ভাবতে থাকেন কীকরে পলায়ন করবেন।

জামাইবাবু যথারীতি সকালের ডন-বৈঠক সেরে বেড়াতে বেড়িয়েছিলেন। বেড়িয়ে এসে শুনলেন, এই ব্যাপার।

ভুরু কুঁচকে ভাবলেন কিছুক্ষণ।

সকালবেলা কী কী কথা হয়েছিল টিকলুর সঙ্গে। কই, পালাবার তাল তো কিছু ছিল না। তবে বলছিল বটে, দীপেন্দ্রনারায়ণের মা-বাপ এসে যাচ্ছেন শুনে ওর বেদম অস্বস্তি হচ্ছে।

কিন্তু তাই বলে পালাবে?

তা ছাড়া জামাইবাবুকে না বলে?

আর পালাবেই বা কোনদিক দিয়ে? এদিকে তো দেউড়ি, সিংদরজা, কাটা খুপরি। সেখানে দারোয়ান।

খোলা থাকবার মধ্যে নদীর ধারের দিক, তা সেদিকে তো এক মাইল চওড়া বাগান। অতখানি হেঁটে পার হয়ে, নদীতে গিয়ে খেয়া পার হয়ে তবে তো যাওয়া! সেকি আর ওইটুকু ছেলের পক্ষে সম্ভব?

সম্ভব নয়, তবু জামাইবাবু নিরুপায় হয়ে ওই নদীর ধারের দিকেই চলতে শুরু করেন।

কিন্তু টিকলু তখন কোথায়?

টিকলু তখন প্রায় পাথরের কবরের তলায়।

অনেকক্ষণ চেঁচামেচির পর টিকলু যখন বুঝতে পারে বক্রেশ্বর তাকে পাথর চাপিয়ে দিয়ে পালিয়েছে, তখন স্থির হয়ে ভাবতে চেষ্টা করে এরকম বিপদে পড়লে গল্পের ছেলেরা কী করে?

ভেবে ভেবে ঠিক মনে আনতে পারে না, এরকম কোনো গল্প পড়েছে কি না টিকলু। না, ঠিক এরকম? মনে পড়ছে না।

কী আর করা!

টিকলু সামনের দিকে কোনো আশার চিহ্ন না দেখে পেছনের দিকে তাকায়।

সেখানে?

সেখানে তো শুধু ইট-পাটকেল আর লতাগুল্ম। তবু টিকলু তারমধ্যে থেকেই এদিক ওদিক সরে সরে মাথা বাড়াবার চেষ্টা করে। আর টিকলুর ভাগ্যে, একটা পচা গাছ ঠেলা লেগে পড়ে যায় ঝপাত করে।

ভাগ্যিস টিকলুর ঘাড়ে না পড়ে ওদিকে পড়েছে। গাছটা পড়তেই একটু পথ বেরোয়। টিকলু সেইখান দিয়ে বেরিয়ে আসবার চেষ্টা করে।

টিকলুর গা ছড়ে যায়, জামা ছিঁড়ে যায়, তবু প্রাণপণে সেখান দিয়ে বেরিয়ে আসে।

আর এসেই হাঁ হয়ে যায়।

সামনেই নদী।

কোনজন্মে কোনকালে এদিকের দেওয়াল ধসে গিয়ে গাছ গজিয়েছিল, জঙ্গল হয়ে গিয়েছিল, কে আর দেখতে এসেছে? অতিচালাক বক্রেশ্বরও ওদিকটা দেখতে যায়নি।

একটা মোটা লতাগাছ জলে ভিজে, রোদে পুড়ে, পচে গিয়ে টিকলুকে বাঁচিয়ে দিল।

বেলা প্রায় পড়ে এসেছে তখন।

অনেক পরিশ্রমে ক্লান্ত টিকলু নদীরধারে বালির ওপর বসে পড়ে। বসেই থাকে।

সামনেই ওই নদীটায় যদি কোনো জাহাজ কী নৌকো থাকত, নিশ্চয়ই টিকলু তাদের দিকে রুমাল উড়িয়ে ডাকাডাকি করত, আর তাদের সঙ্গে পালাত। এ-রকম গল্প তো সেজোকাকার কাছে অনেক শুনেছে।

আর ওই রাজবাড়িতে ঢোকবার সাধ নেই টিকলুর। দু-দিন পরেই তো দীপেন্দ্রনারায়ণের মা-বাপ আসছেন, তখন টিকলুর ভাগ্যে কী হবে কে জানে!

কিন্তু কোথায় জাহাজ? কোথায় নৌকো?

শুধু রুপোর মতো ঝকঝকে জল বয়ে চলেছে ওই দূরে।

বালিটা এখনও বেশ গরম, বেশিক্ষণ বসা যায় না। টিকলু আবার হাঁটতে শুরু করল। দুরছাই, ওই রাজবাড়িতেই যেতে হবে।

একটু পরেই তো সন্ধে হয়ে যাবে।

কোনদিক দিয়ে গেলে রাজবাড়ির দেউড়ির দিকে পড়বে, তাও তো ছাই বোঝা যাচ্ছে না। তবু এগোবেই।

হঠাৎ দেখতে পেল কেউ একজন আসছে।

নির্ঘাত বক্রেশ্বর।

টিকলু আর ওর হাতে পড়তে রাজি নয়।

টিকলু উলটোমুখে ঘুরে দৌড়োতে থাকে।

কিন্তু টিকলুর তো জানা নেই নদীর ধারে কোথায় চাপবালি, কোথায় চোরাবালি। পাথরের কবর থেকে উদ্ধার হয়ে টিকলু বেচারি বালির কবরে পুঁতে যায়। টিকলুর পা বসে গিয়ে গিয়ে কোমর অবধি ডুবে যায়…ক্রমশ বুক….গলা….

টিকলুর রামরাজাতলার বাড়িটা মনে পড়ে যায়। বাড়ির সকলের মুখ মনে পড়ে যায়। আর কারও সঙ্গে দেখা হবে না ভেবে হঠাৎ খুব জোরে কেঁদে ওঠে টিকলু, তারপর আস্তে আস্তে ডুবে যেতে থাকে।

আর ডুবতে ডুবতেই টের পায় বক্রেশ্বরও তার পেছনে ধাওয়া করতে করতে কাছে এসে পড়েছে।

তার মানে এবার স্রেফ হাতে করেই মেরে ফেলবে।

টিকলুর ওপর তো দারুণ রাগ আছে ওঁর।

বাড়ির মধ্যে থেকে শোকের ছায়া, তবু আনন্দের ঢেউ বওয়াতে হচ্ছে।

আজ যুবরাজ যুবরানি আসছেন।

চারিদিকে আলপনা আঁকা হয়েছে। দরজায় দরজায় মঙ্গল কলস বসানো হয়েছে, বিরাট যজ্ঞির আয়োজন হয়েছে, গ্রামসুদ্ধ লোক খাবে।

কর্তারাজা আজ নিয়ম ছাড়া ভোরে উঠেছেন আর চেঁচাচ্ছেন, ‘কোই হ্যায়।’

ওদিকে কর্তারানি তাঁর মেয়েদের সাবান মাখিয়ে চান করিয়ে নাইলনের ঘাগরা পরিয়ে সাজাচ্ছেন।

যে যেখানে সবাই কাজে ব্যস্ত, শুধু মনের মধ্যে রেলগাড়ি চলছে। ওঁরা যখন ছেলে চাইবেন, কী বলা হবে?

শুধু জামাইবাবু নিশ্চিন্ত। জামাইবাবু তাঁর ঘরের মধ্যে বসে টিকলুকে তালিম দিচ্ছেন।

টিকলু বলছে, ‘আমি পালাই।’

জামাইবাবু ওর পিঠ ঠুকে দিয়ে বলছেন, ‘পালাবি কী রে? এতদিন এত কষ্ট করলি, আর আসল মজার সময় পালাবি? যা বলেছি ঠিক ঠিক মনে আছে তো?’

‘মনে তো আছে। কিন্তু যখন চিনতে পারবেন?’

‘আরে বাবা, ঘাবড়াচ্ছিস কেন? দেখবি আরও কী মজা তোলা আছে। দেখে তোরই তাক লেগে যাবে।’

‘ওঁরাও বুঝতে পারবেন না বলছেন?’

জামাইবাবু তবুও বলেন, ‘আহা দেখোই না, গল্পের শেষে কী আছে।’

কিন্তু তলিয়ে যাওয়া টিকলু আবার এল কোথা থেকে?

এল। টিকলুর পরমায়ু ছিল, তাই এল। টিকলুর যখন নাকের কাছাকাছি বালি, তখন বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে এসে যিনি তাকে হিঁচড়ে বার করে নিলেন তিনি হচ্ছেন জামাইবাবু।

হ্যাঁ, যাকে টিকলু বক্রেশ্বর ভেবে ছুট দিয়েছিল তিনি বক্রেশ্বর নন।

টেনে বার করা-টরা অবিশ্যি টিকলু টেরই পায়নি, অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল. যখন জ্ঞান হল, দেখল একটা অন্ধকার-অন্ধকার ঘরে শুয়ে আছে সে, পিঠের নীচে মোটা নরম গদি। এটা কোথায়? স্বর্গে কি?

টিকলু আস্তে বলল, ‘আমি কি মরে গেছি?’

টিকলু তখন একটা হাসি শুনতে পেল, তারসঙ্গে কথা, ‘মরে গেলে কেউ কথা বলে?’

এ হাসি টিকলুর চেনা।

জামাইবাবুর পরামর্শেই টিকলু দু-তিন দিন ওই ঘরেই লুকোনো ছিল।

তারপর?

তারপর যা ঘটল টিকলুর নিজের মুখেই শোনা যাক—

রামরাজাতলার বিশ্বনাথবাবুর দালানে জমিয়ে বসে সেই কাহিনি বর্ণনা করছে টিকলু, দু-বাড়ির লোক এক ঠাঁই। ওখানেই এক ঠাঁই বসে পড়লেই হল।

এরা বলছে, ‘তারপর?’

ও বলছে, ‘তারপর? তারপর হঠাৎ দেউড়িতে হইচই, ‘এসে গেছেন’ ‘এসে গেছেন।’

ছুটে গেলেন কর্তারাজা, কর্তারানি, মোক্ষদা, সুধা,জুঁই, মল্লিকা, মালতীরা। কর্তামা সকাল থেকে ওদের সাজিয়েছেন, সাবান মাখিয়ে চান করিয়ে, নাইলনের ঘাগরা পরিয়ে মাথায় সিল্কের ফিতে বেঁধে।

আমি বসে আছি জামাইবাবুর ঘরে।

পরনে ভেলভেটের সুট, পায়ে জরির জুতো, মাথায় পাগড়ি, ঠিক যেমন সাজে ফোটো তোলা আছে দীপেন্দ্রর।

বসে আছি, হঠাৎ যেন নীচের তলার সেই কলরোলটা ঠাণ্ডা মেরে গেল। শুধু আমার সেই পিসিদের সমবেত সংগীত শুনতে পাচ্ছি, ‘ঘেউ ঘেউ ঘৌ ঘৌ ঘু: ঘু:!’

আর থাকতে পারলাম না, বেরিয়ে পড়ে উঁকি মেরে দেখতে লাগলাম।

একটু পরে ঠিক ‘আমার বয়সের একটা ছেলে এসে পড়ল। সাটিনের মতন গায়ের চামড়া, গোলাপ ফুলের মতো রং, রেশমের মতো চুল। সুরেলাগলায় বলে উঠল, ‘এ কী? আমার জামা পরে তুই কে?’

আমি বুক টান করে বললাম, ‘শ্রীল শ্রীমান দীপেন্দ্রনারায়ণ পাট্টাদার বাহাদুর।’

ও চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘তুই যদি দীপেন্দ্রনারায়ণ, আমি তবে কে?’

আমি আমার নিজস্ব গলায় বললাম, ‘সেকথা তুমি জানো, আমি কীকরে বলব। তবে ভদ্রভাবে কথা বলতে হয়, বুঝলে?’

ও খিঁচিয়ে বলল, ‘ভদ্রভাবে কথা বলব? ওরে আমার কে রে? তুই আমার জামা জুতো পরে, আমার বাড়ি দখল করে বসে বলছিস, আমিই দীপেন্দ্রনারায়ণ, আর আমি ভদ্রভাবে কথা বলব? আমি জানতে চাই, তুই কোথা থেকে এলি? পাজি বদমাশ!’

গলা সুরেলা কিন্তু কথা যেন রাস্তা-ঝাড়ু দেওয়া বুরুশ। রাগে মাথা জ্বলে যায়।

আমি কিন্তু রাগছি না, তেমনি সতেজে বলি, ‘কোথা থেকে আবার আসব? বাবা-মা বিলেত যাবার সময় আমাকে ঠাকুমা-ঠাকুরদার কাছে রেখে গিয়েছিলেন, তাই আছি।’

ও রেগে হাত পা ছুড়ে বলে, ‘তাই আছ? চালাকির আর জায়গা পাওনি? রেখে গিয়েছিলেন তোকে? মিথ্যুক। রেগে গিয়েছিলেন তো আমাকে—’

আমি না খুব হেসে উঠলাম।

বললাম, ‘তোমায় রেখে গিয়েছিলেন? তা রেখেই যদি গিয়েছিলেন তো ছিলে কোথায়?’

ও প্রথমে বলে, ‘সেকথা তোকে বলতে যাব কেন রে?’ তারপরে কী ভেবে বলে, ‘ছিলাম বিলেতে আমেরিকায়, হোল ইউরোপ আমেরিকা ট্যুরে—বুঝলি?’

আমি বললাম, ‘অথচ তুমি বলছ, তোমায় এখানে রেখে যাওয়া হয়েছিল।’

ও পা ঠুকে বলে, ‘হ্যাঁ বলছি। হয়েছিল, আমি থাকিনি। শুনেছিলাম বাবা-মা বিলেত যাবার আগে দিন পনেরো বম্বেয় থাকবে। আমি জামাইবাবুকে বলে বলে পাগল করে চুপি চুপি ওঁর সঙ্গে বম্বে চলে গিয়েছিলাম।’

শুনে তো আমি নেই!

জামাইবাবু এত রহস্যের কর্তা। এতদিনের মধ্যে একদিনও তো বলেননি।

‘জামাইবাবু তোমায় বম্বে নিয়ে গিয়েছিলেন?’

‘না তো কি আমি বাজে কথা বলছি?’

‘কিন্তু আমি যে দীপেন্দ্রনারায়ণ, এটা এ-বাড়ির সবাই জানে।’

ও বলল, ‘তুই মিথ্যুক।’

আমায় জামাইবাবু যা যা বলেছিলেন তাই বলছি, অথচ অবাক হয়ে ভাবছি, জামাইবাবু আগাগোড়া রহস্যে মোড়া, আমায় এত কথা বলেছেন, এত গল্প করেছেন, অথচ—একবারের জন্যেও বলে ফেলেননি নিজেই উনি।

আমি এইসব ভাবছি, ও আবার বলে উঠল, ‘তুই শিগগির চলে যা বলছি।’

আমি বললাম, ‘বরং তুমিই চলে যাও। বলছি তো আমি যে দীপেন্দ্রনারায়ণ, এ-কথা সবাই জানে—’

‘ইস! জানলেই হল। আমি! এই আমি হচ্ছি—শ্রীল শ্রীমান দীপেন্দ্রনারায়ণ—’

আমি শান্তগলায় বলি, ‘ভুল-ভাল কথা বোলো না ভাই, আমি—’

‘ইস, আবার ভাই বলতে এসেছে! ভাগ। আমি আমি।’

‘না আমি।’

‘না আমি।’

হঠাৎ না ছেলেটা সেই মিহিসুরের গলাকে আকাশে তুলে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল। ও ‘মা রানি’, ও ‘বাবা রাজা’, দেখুন আমার ঘরের কাছে একটা পাজি ছেলে কী বলছে।’

ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে এক হুলস্থুল কান্ড! নীচে থেকে দুদ্দাড়িয়ে সবাই উঠে এল। আর এসে যেন পাথর হয়ে গেল।

দুই দীপেন্দ্রনারায়ণ মুখোমুখি।

আমার না সেদিন ওই পোশাকটা পরে চেহারা দারুণ বদলে গিয়েছিল। নিজেই নিজেকে চিনতে পারছিলাম না আরশিতে দেখে।

অনন্তনারায়ণ অবাক হয়ে বললেন, ‘তুমি কে?’

আমি গম্ভীরভাবে বললাম, ‘এই এক বছরেই ভুলে গেছেন? আমাকে এখানে রেখে আপনারা বিলেত যাননি?’

দীপেন্দ্র মা বাবাকে আপনি করে কথা বলল দেখে আমিও তাই বললাম।

অনন্তনারায়ণের রানি বলে উঠলেন, ‘রেখে আর গেলাম কই? ছেলে তো কেঁদেকেটে পালিয়ে গিয়ে আমাদের সঙ্গেই ঘুরেছে। তোমায় দেখে যে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।’

কখন যে কর্তারাজা লাঠি ঠুকে ঠুকে এসে হাজির হয়েছিলেন কে জানে? তিনি রেগে বলে ওঠেন, ‘ছেলে তোমাদের সঙ্গে গেল সেকথা তুমি আমাদের জানিয়েছিলে? …রানি বললেন, ‘আপনারাও জানাননি।’

‘আমরা কী জানাব?’ কর্তারাজা রেগে বলেন, ‘আমরা ছেলে হারিয়ে ফেলে খুঁজে খুঁজে পাগল হচ্ছি।’

অনন্তনারায়ণ তখন খুব হেসে উঠে বললেন, ‘তারপর এই ভেজাল মালটিকে খুঁজে পেলেন? আনল কে?’

বক্রেশ্বরও তো চলে এসেছে সেখানে, সেবলে ওঠে, ‘তা আমি কী করব বলুন? হন্যে হয়ে খুঁজছি, হঠাৎ একটা মেলাতলা থেকে বেরিয়ে এসে এই ছেলেটা বলল কি না, ‘দেওয়ানবাবু, আপনি এখানে? তা হলেই বুঝুন? আমি হাতে চাঁদ পেয়ে যাব না? অবিকল খোকারাজার চেহারা!’

দীপেন্দ্রনারায়ণ পা ঠুকে বলল, ‘তা তো হাতে চাঁদ পাবেনই। আমার বদলে একটা রাস্তার ছোঁড়াকে নিয়ে এসে—’

আমি গম্ভীরভাবে বললাম, ‘রাজবাড়ির ছেলে, রাজবাড়ির মতো কথা বলতে শিখতে হয়।’

অনন্তনারায়ণ গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘দীপু, দেখছ?’ সেইসময় জামাইবাবু এগিয়ে এসে বললেন, ‘দেওয়ানজি, আর কত পুকুর চুরি করবেন? ও নিজে থেকে বলেছিল?’

তখন না বক্রেশ্বর কেঁদে ফেলে বলে, ‘আর কর্তারাজা যে বলেছিলেন ছেলে খুঁজে না পেলে গর্দান নেবেন, তার কী!’ …..সত্যি বলতে, অতখারাপ লোক বক্রেশ্বর, তবু কাঁদতে দেখে খুব মায়া হল। বললাম, ‘তা হলে আসল কথাই বলি—চিনে টিনে নয়, তবে দেওয়ানবাবু যখন বলতে শুরু করলেন, ‘তুমিই খোকারাজা, তুমিই খোকারাজা’—তখন ইচ্ছে করেই এসেছিলাম বলতে পারেন।’

উনি বললেন, ‘আশ্চর্য তো! কেন বলো দেখি?’

আমি বুকটান করে বললাম, ‘জীবনে একটা অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগের আশায়।’ ওরে বাবা, তখন সেকী হাসির ধুম পড়ে গেল।

অনন্তনারায়ণ ওঁর মাকে বললেন, ‘কিন্তু মা, বাবার না হয় চোখ খারাপ, আপনি কী বলে নাতি চিনতে ভুল করলেন?’ শুনে না কর্তারানিমা কী বললেন জানো? বলে উঠলেন, ‘ভুল আবার করতে যাব কেন? যখনই দেখেছি ও আমার মালতী, মল্লিকা, গোলাপ, কমলকে দেখে বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে, তখনই বুঝেছি, ও ছেলে জালছেলে। কিন্তু কী করব বলো? তোমরা আমার কাছে ছেলে রেখে গেছ, এসে সেছেলে চাইবে তো? জোড়াতালি দিয়ে একটা মজুত না রাখলে কী দিতাম তোমাদের হাতে? কেমন করে জানব যে তোমরা ছেলেকে নিয়ে পালিয়েছ। জানি জম্মের শোধ পালিয়েছে।’

জামাইবাবু বললেন, ‘সত্যি, রাজাবাবু খুব অন্যায় কাজ করেছেন খবরটা না দিয়ে।’

উনি বললেন, ‘বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমিও তো জানাওনি। তুমি তো নিজেই বম্বে পৌঁছে দিয়ে এসেছিলে।’

‘আমি ভাবলাম যা জানাবার আপনারাই জানাবেন। তা যখন হল না, ভাবলাম বেশ একখানা মজার নাটক দেখি বসে বসে।’

উনি বললেন, ‘চমৎকার! কিন্তু এখন দুই দীপেন্দ্রনারায়ণকে নিয়ে করা যাবে কী বলুন? যমজ ভাই বলে চালিয়ে চলব। যা দেখেছি চালানো যায়।’

আমি তখন বলে উঠলাম, ‘আহা রে আমি কেন থাকতে যাব? আমার বুঝি নিজের বাড়ি নেই? বাবা-মা নেই? আমি তো শুধু একটু অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে—’

অনন্তনারায়ণ বললেন, ‘দীপু, দেখতে পাচ্ছ? তুমি এতবড়ো ছেলে মা-বাবাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না বলে কেঁদেকেটে লুকিয়ে পালিয়ে গেলে, আর এই ছেলে তোমারই বয়েস, শুধু একটু অ্যাডভেঞ্চারের আশায় কোন দূর জায়গা থেকে সবাইকে ছেড়ে—বাহাদুর ছেলে বলতে হবে।’

দীপেন্দ্রনারায়ণ রেগে বলল, ‘থাক থাক, আর বলতে হবে না। জানি তো পৃথিবীর সবাই আমার থেকে ভালো, আমিই খারাপ। আচ্ছা দেখাচ্ছি ও কেমন এখানে থাকে।’ তারপর না হঠাৎ মুখে একটা আঙুল দিয়ে বাঁশির মতো কেমন যেন একটা শব্দ করে ডেকে উঠল, ‘জুঁই, কমল, গোলাপ, মল্লিকা।’ …ব্যস সঙ্গে সঙ্গে এক ভয়ংকর কান্ড ঘটে গেল। কোথা থেকে যেন হুড়মুড়িয়ে ছুটে চলে এল সেই তারা। আর ওই একটা ছেলের ঘাড়ে এই ছ-টা পিসি ঝাঁপিয়ে লাফিয়ে ঘেউ ঘেউ করে ছ-ছ-টা জিভ দিয়ে ওর গাল চাটতে শুরু করল। সেই দৃশ্য দেখে না আমি চেয়ার ঠেলে টেবিল উলটে যাকে সামনে পেলাম তাকে ডিঙিয়ে একেবারে আমবাগানে।’

টিকলুর বাবা বলে উঠলেন, ‘তারপর?’

‘তারপর আর কী?’ টিকলু বলে, ‘তারপর খেল খতম। দেখতেই তো পাচ্ছ এই এতসব জামা-জুতো-খেলনা-খাবার-জিনিসপত্তরের বোঝা চাপিয়ে ওরা আমায় পৌঁছে দিয়ে গেল। যারা এসেছিল ওরাই হচ্ছে ভজহরি আর নিধিরাম। …আসবার সময় কিন্তু ভীষণ খারাপ লাগছিল। এমনকী কর্তামাকে খুশি করতে পিসিদের গায়েও একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে এলাম চোখ কান বুজে। …জামাইবাবুর দিকে তো তাকাতেই পারছিলাম না আসার সময়। …দীপেন্দ্রর বাবাও এত সুন্দর লোক। আমায় বললেন, ‘কী সুখীই হতে পারতাম, যদি সত্যি সত্যিই তুমি আমার ছেলে হতে। তোমার বাবার ওপর আমার হিংসে হচ্ছে।’ আর বললেন, যখন ইচ্ছে হবে একটা চিঠি লিখে জানিয়ো, নিয়ে আসার ব্যবস্থা করব। বেড়িয়ে যাবে কিছুদিন।’

হঠাৎ বাপুর মা একটা নিশ্বাস ফেলে বলে ওঠেন, ‘আমার ছেলের গালে যদি একটা তিল থাকত!’

আর বাপু বলল, ‘টিকলুটা করল বটে একখানা। কী মজাই হল ওর!’

টিকলু একটু গৌরবের হাসি হাসল।

কিন্তু রাত্রে বিছানায় শুয়ে টিকলুর আর মনে হয় না যে খুব একটা মজা করে এসেছে সে। বরং মনটা যেন বিষণ্ণ বিষণ্ণ হয়ে যায়। সে-মন ঘুরে বেড়ায় সেই পুরোনো প্রাসাদের ঘরে, দালানে, ছাদে, সিঁড়িতে, বেড়িয়ে বেড়ায় ভাঙা দুর্গের ধারেকাছে, ছড়িয়ে পড়ে থাকা কামানের ভাঙা টুকরোর আশপাশে, উঁচু দেয়ালে টাঙানো পাট্টাদার বংশের পূর্বপুরুষদের ভারী ভারী অয়েল পেন্টিং-এর তলায় তলায়।

পাট্টাদার বংশের সেই আদিপুরুষ, কী যেন নাম তাঁর, যিনি পোর্তুগিজ জলদস্যুদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের লুঠ করা সোনা লুটে আনতে পেরেছিলেন, সেই লোকটির কোনো ছবি নেই—এটিই বড়ো দুঃখ রয়ে গেছে টিকলুর। থাকলে টিকলু আরশির পাশে বসে নিজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখত।

টিকলু ভাবল, কাল বাপুকে বলব, ‘বাপু, কক্ষনো তুই কোনো পুরোনো রাজাটাজাদের বাড়িতে থাকতে যাসনি। গেলেই তোর মনটা একদম অন্যরকম হয়ে যাবে। যেন হারিয়ে হারিয়ে যাবে। মনে হবে, এসব জায়গা যেন তুই আগে কত দেখেছিস, বেশ কতবার ওখানে হেঁটেছিস, চলেছিস, কত কতবার সেই ঘরে ঘুমিয়েছিস। আর চলে আসার পর মনে হবে, কে যেন তোকে সব সময় পিছন থেকে টানছে। স্রেফ জালে আটকা পড়ে যাবি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *