রাজকুমারীর হাসি – রাজেশ বসু
রাজামশাই বললেন, ‘মন্ত্রী, এ কেমন কথা। কেউ হাসে না আজকাল। হাসলেও চেয়ে-চিন্তে লাভক্ষতি হিসেব কষে মেপেজুপে হাসে। ভারি অন্যায়। বলি, এ কেমন ধারা—উঁহু এমনটা মোটেই চলবে না আমার রাজ্যে। আজ থেকে হুকুমজারি, হাসতে হবে সক্কলকে। সে হাসি পাক, আর না-পাক। হাসতে হবে মন খুলে। বত্রিশপাটি উন্মোচন করে। নজরদারির দায়িত্ব তোমার।’
মন্ত্রীমশাইয়ের বয়স হয়েছে। তাঁর হাঁটুতে বাঁত। দৃষ্টি ক্ষীণ। রাজামশাইয়ের জরুরি তলবে এসেছেন সাতসকালে। সবে ঘুম থেকে উঠে নকল দাঁতের পাটি মুখে সেট করছিলেন, এমন সময় রাজামশাইয়ের ফোন। ইচ্ছে করছিল না। তবু এসেছেন। রাজামশাই মানুষ এমনিতে খুব ভালো। ভারি দরাজ। এরকম জরুরি তলব-টলবে ডানহাতের ব্যাপার-স্যাপার ভালোই থাকে। অনেকদিন রাজবাড়ির চা সেবনও হয়নি। সুতরাং চলে এসেছেন হুড়মুড়িয়ে।
বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। চারিদিকে টাকাপয়সার টানাটানি খুব। রাজ্যেও তার অল্পসল্প প্রতিক্রিয়া পড়েছে। ভেবেছিলেন রাজামশাই হয়তো সে-সব নিয়ে আলোচনা করবেন। গতকালই তো নিমখালির কৃষকেরা সব হরতাল ডেকেছিল। রাজবাড়ির সামনে ধর্নাতেও বসবে নাকি তারা। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় সেনাপতিকে ফোনও করেছিলেন মন্ত্রীমশাই। হয়তো চাষাগুলো সাতসকালেই রাজবাড়ির ফটক আটকে বসে পড়েছে। রাজামশাই মর্নিংওয়াকে বেরতে পারছেন না। সেনাপতিকে অবশ্য ফোনে পাননি। সে তার ফোন সুইচ অফ করে রেখেছে। টেনশন মাথায় নিয়ে আসতে হয়েছিল মন্ত্রীমশাইকে। যা হোক, রাজবাড়ির সামনে তেমন কিছু গোলমাল দেখতে না-পেয়ে দুশ্চিন্তাটা কেটেছিল তার।
কিন্তু, এখন এমন হুকুম শুনে বিরক্ত হলেন খুব। রাজামশাই তো আছেন আপন খেয়ালে। হুকুম করেই খালাস। রাজ্যি সামলানোর যে কত ঝক্কি!—যা খুশি হুকুমনামা জারি করলেই হল! হাসি কী ছেলের হাতের মোয়া, ঘোরালাম আর চলে এল! দুনিয়ার যা অবস্থা, মানুষের হাসার ফুরসতটাই বা কোথায়!
মুশকিল হল রাজামশাইয়ের সামনে তো আর বিরক্তি প্রকাশ করলে চলে না। সুতরাং নকলদাঁতের পাটি আদ্ধেক বের করে কাষ্ঠহেসে বললেন, ‘খুব ভালো কথা স্যার। কিন্তু হাসি তো খিদেতেষ্টার মতো স্বাভাবিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়া নয় যে এমনি-এমনি মুখে ফুটবে। এ হল কিনা মনের ব্যাপার। তা ছাড়া হেসে গড়িয়ে পড়ার খোরাকটাই যে এখন অমিল ভারি।’
রাজামশাই তার জোড়া ভুরু নাচিয়ে বললেন, ‘হাসির খোরাক নেই! তাই মনে হয় আপনার। এই দেখুন না, বয়সে আপনি রাজমাতার চেয়েও বরিষ্ঠ। গাল বসে গিয়েছে। মাথার চুল অধিকাংশ ঝরে গিয়েছে। তবুও যে ক-টি আছে সেগুলি রং করে জোয়ান সেজেছেন। এমন উদ্ভট দৃশ্য হাসির খোরাক নয় বুঝি? আমার তো দেখলেই হাসি পায়। আগে সামলে ছিলুম। আজ থেকে আর না।’
বলেই রাজামশাই ফিকফিকিয়ে হাসতে লাগলেন। রাজভৃত্য চা নিয়ে এসেছিল। রাজামশাইয়ের হাসিতে চায়ের পেয়ালা নামিয়ে সেও হাসতে শুরু করল।
‘দেখুন মন্ত্রীমশাই, ও-ও হাসি চাপতে পারছে না।’ বললেন রাজামশাই, ‘সুতরাং আর বিলম্ব নয়। আজই নোটিশ দিয়ে দিন। হাসার নোটিশ। আর আপনিও এরকম গোমড়া মুখে থাকবেন না। হাসুন। হাসতে থাকুন।’
মন্ত্রীমশাই আর কী করেন। রাজামশাইয়ের হুকুম। ইচ্ছে হোক-না-হোক, হাসতে হল তাকে। হাসতে-হাসতেই চা পান করলেন। তারপর সারা রাজ্যে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিলেন, হাসতে হবে সক্কলকে। গোমড়া মুখে মোটে থাকা চলবে না। শুতে বসতে খেতে ঘুমোতে মুখে হাসিটি থাকা চাই।
অতএব যা হয়, রাজার হুকুম। রাজ্যে হাসির ধুম পড়ল। কারণে-অকারণে হাসতে শুরু করল লোকে। বিদেশি নকলে রাজ্যে বিস্তর লাফিংক্লাব গজিয়েছিল। তাদের সভ্যবৃন্দদের ভারি পুলক হল। নিত্যকার হাস্যাভাষে তাদের যখন-তখন হাসতে অসুবিধে নেই কোনো। তারা রাজামশাইয়ের এমন পরোয়ানায় আরো উৎসাহ পেল। কাজকম্ম ফেলে কেবল হাসতেই শুরু করল তারা। অন্যেরা পড়ল মহাফাঁপরে। বেমক্কা মিছিমিছি বোকার মতো হাসা যায় নাকি! তারা প্রথমটায় রাজামশাইয়ের নির্বুদ্ধিতায় হেসেছিল বটে। কিন্তু পরে আর হাসল না। ভুরু কোঁচকালো। মুখ ভ্যাটকালো। নিন্দে করল রাজামশাইয়ের। রাজামশাই খবর পেলেন। পেয়াদা এসে ধরে নিয়ে গেল তাদের। হাসিয়ে হাসিয়ে হাসফাঁস করে ছাড়ল তাদের।
রাজামশাই খুব খুশি। রাজ্যে গোমড়ামুখো কেউ নেই আর। সবার মুখে লেগে আছে হাসি। আপন গৃহের নিভৃতকোণে কী হচ্ছে, জানা নেই। তবে জনসমক্ষে সবার মুখেই হাসি। শোক-দুঃখ, মান-অভিমান সবেতেই চওড়া হাসি। হাসতে-হাসতেই সব কাজ হাসিল হতে লাগল।
এরই মধ্যে একদিন রাজসভায় গোয়েন্দা এসে রাজামশাইয়ের কানে-কানে কী বলল। রাজামশাই হেসে-হেসে শুনলেন বটে, কিন্তু মুখে তার চিন্তার মেঘ। তিনি সভাভঙ্গ করে অন্তঃপুরে ফিরে গেলেন। সত্যি তো। রাজকুমারীর দিকে নজরই পড়েনি তার। মোটে ন-বছর বয়স তার। কিন্তু ভাবভঙ্গিতে যেন নববুইবছরের ঠানদিদি। চোখে মাইনাস পাঁচ পাওয়ারের চশমা ঝুলিয়ে গম্ভীর হয়ে থাকে সর্বক্ষণ। মুখখোলা হাসি তো দূরের কথা, ছোঁট বেকিয়ে একপেশে মিচকি হাসিও হাসে না সে। এ তো ঘোর সংকট। খোদ রাজকুমারীর মুখেই হাসি নেই! কথাটা পাঁচকান হলে ভারি লজ্জা। রাজামশাই ডাকলেন মহারানিকে।
‘কী ব্যাপার রানি, রাজকুমারী হাসে না কেন?’ সহাস্যে জিজ্ঞেস করলেন রাজামশাই।
মহারানি মুখে পঞ্চসবজির একটি প্যাক লাগাচ্ছিলেন। রাজামশাইয়ের হঠাৎ তলবে ছুটেই এসেছেন প্রায়। কারণ জেনে বিরক্ত হলেন তিনি। মানুষটা হুকুম করেই খালাস কেবল। ঘরগেরস্থালির খবর রাখে না এতটুকু। বললেন, ‘মেয়ে যে হেসে বেড়াবে এমন সময় কোথায় তার।’
‘মানে?’ বুঝলেন না রাজামশাই, ‘কী এমন রাজকার্য করে সে, যে মুখে হাসি আসে না? ভোরে উঠেই তো হেসে নিতে পারে একচোট।’
মহারানি ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন। ‘ভোরে উঠে! হু! রাত জেগে পড়ে তার চোখে এত ঘুম লেপটে থাকে ভোরে উঠে আর মুখে হাসি ফোটে না।’
‘রাজামশাই বললেন, ‘তবে ভোরে ওঠে কেন সে?’
‘লেকে জগিং করতে যেতে হবে না। তারপর জিম।’ বললেন মহারানি।
‘ঠিক। ঠিক। শরীরচর্চা তো করতেই হবে। ওটা মাস্ট।’ বললেন রাজামশাই, ‘কিন্তু তারপর?’
‘তারপর? তারপর ব্রেকফাস্ট সেরে ইস্কুল।’
‘ইস্কুল শেষে?’
‘সাঁতারের ক্লাস।’
‘তারপর?’
‘জুডোর ক্লাস।’
‘তারপর?’
‘নাচের ক্লাস।’
‘তারপর?’
‘গানের ক্লাস।’
‘তারপর?’
‘আঁকার ক্লাস।’
‘তারপর?’
‘গিটারের ক্লাস।’
‘তারপর?’
‘অ্যাবাকাস।’
রজামশাই বিরক্ত হলেন, ‘তবে সে পড়ে কখন?’ মুখে মিটিমিটি কৌতুকের হাসি ঝুলিয়ে প্রশ্নগুলি করে যাচ্ছিলেন। এখন সেটি পুরোপুরি মিলিয়ে গেল।
‘বাড়ি ফিরে টিউটর পড়িয়ে যাওয়ার পর।’ বললেন মহারানি। এতসব ফিরিস্তি বলার মতো সময় নেই তার। পঞ্চসবজির প্যাকটা অন্য গালে লাগানো হয়নি। উঠে পড়লেন তিনি।
রাজামশাই ভাবতে লাগলেন। ভুল হয়ে যাচ্ছে। রাজকুমারীর শিক্ষাদানে ত্রুটি হচ্ছে দস্তুরমতো। যুগ যা পড়েছে এসব মামুলি বিষয় না-শিখলে কী চলে? এতে হাসি কোথায় আটকাচ্ছে বুঝছেন না তিনি। এখনও তো অশ্বারোহণ, পর্বতারোহণ কিংবা টেনিস বা গলফ খেলাও শুরু করেনি রাজকুমারী। এটুকুতেই কাহিল হওয়া ভালো কথা নয়। সব বাচ্চাদেরই তো একরুটিন। খোঁজ নিয়ে জানলেন তারা মোটেই গোমড়া না, নিয়ম করে হাসে তারা। কেউ কেউ রীতিমতো হাসির ক্লাসেও যায়।
রাজামশাই ভাবলেন রাজকুমারীকে হাসির ক্লাসে ভর্তি করবেন। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল, তাতে মুশকিল। সকলে বুঝে যাবে খোদ রাজামশাইয়ের মেয়েই বাপের কথা শোনে না। সুতরাং বাড়িতেই হাসির খোরাকের ব্যবস্থা করতে হবে।
রাজকুমারীর গৃহশিক্ষকদের তলব করলেন তিনি। তারপর তাদের পরামর্শ মতো রাজকুমারীর জন্যে মজার মজার সব সিনেমার ডিভিডি আনা হল। হাসির গল্পের গুচ্ছের অডিয়োসিডি কেনা হল। রাজকুমারীর গল্পের বই পড়তে রুচি নেই। তাই অডিয়োসিডি। রাজামশাই নিজে ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেঁটে একহাজারটি দমফাটা হাসির জোক ডাউনলোড করলেন।
কিন্তু সব বৃথা। সব পণ্ডশ্রম।
রাজকুমারী সব দেখল। শুনল। পড়ল। কিন্তু হাসল না। রাজামশাই শেষে গোপনে রাজ্যের বাঘা-বাঘা সব কমেডিয়ানদের তলব দিলেন। তারা মাথা চুলকে, গোঁফ চুমড়ে, দাড়ি মুচড়ে, নেচে-কুঁদে, মুখে তোম্বা হাসি ঝুলিয়ে বিস্তর চেষ্টা করল। রাজকুমারী তো হাসলই না, শেষে ‘আমার ইউনিট টেস্ট আছে’ বলে উঠেই গেল গম্ভীরমুখে।
ইতিমধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ল বাইরে। অকারণে হেসে ক্লান্ত সবাই। একজন দুজন করে হাসা বন্ধ করতে শুরু করল প্রজারা। রাজামশাই নিজেও এখন মাঝে-মাঝে হাসতে ভুলে যান। তার চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে। এমন সময় একদিন রাজকুমারীর ঠাকুমা স্বয়ং রাজমাতা এসে হাজির। নগর থেকে বহুদূরে একটি গ্রামে থাকেন তিনি। রাজামশাইও একসময় থাকতেন সে গ্রামে। রাজ্যপরিচালনার দায়ে এখন নগরে থাকেন। রাজমাতার নগরের এত কোলাহল ভালো লাগে না। গ্রামের মাঝে প্রকৃতির আপন কোলে ভালোই আছেন তিনি। তবু মন যখন আকুল হয় চলে আসেন নাতনির কাছে। রাজামশাই ভারি ব্যস্ত। তার মায়ের কাছে যাওয়ার ফুরসতই হয় না।
রাজমাতা সব দেখেশুনে বললেন, ‘আমি নিয়ে যাচ্ছি ওকে। গরমের ছুটিটা ও আমার কাছেই থাকবে। বড়ো কষ্ট দিচ্ছ তোমরা ওকে।’
রাজামশাই দোলাচলে পড়লেন। ইস্কুল বন্ধ বটে, তা বলে পড়াশোনা বন্ধ হতে পারে না। ভেবেছিলেন গরমের ছুটিতে মেয়েকে বেহালাটা ধরাবেন। বেহালা শিখলে নাকি অঙ্কে মাথা খোলে। কী বলবেন বুঝলেন না। মহারানিও ক্ষুণ্ণ হয়েছেন। মেয়েকে মোটেই কষ্ট দিচ্ছেন না তারা। গোটা ছুটিটা ঠাম্মার কাছে থাকলে লেখাপড়ার যদি ক্ষতি হয়! মুশকিল আসান করল রাজকুমারী নিজে। সে ঠোঁট ফুলিয়ে ঘাড় গুঁজে এমন বায়না জুড়ল যে রাজামশাইয়েরা আর না-করতে পারলেন না। রাজকুমারীকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে এলেন রাজমাতা।
পাহাড় নদী ঝরনা দিয়ে ঘেরা সুন্দর গ্রাম রাজমাতার। কতরকমের পাখি। কতরকমের প্রজাপতি। আর কী সুন্দর মনজুড়ানো ঠান্ডা বাতাস। বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যায়। মুগ্ধ হয়ে গেল রাজকুমারী। কতদিন পর সে এসেছে ঠাম্মার কাছে। পড়াশোনার চাপে আসতেই পারে না সে।
রাজামশাই কেক-বিস্কিট, প্যাটিস-কোল্ডড্রিঙ্ক সব পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সঙ্গে। ড্রাইভার গাড়ি থেকে সব নামাতে যাচ্ছিল। রাজমাতা সব ফিরিয়ে দিলেন। তারপর নিজে হাতে আতপ চাল আর সোনামুগ ডালে রাঁধলেন খিচুড়ি। সঙ্গে মুচমুচে কুমড়োফুলের বড়া আর আমের চাটনি।
রাজকুমারীর খাওয়া নিয়ে ভারি সমস্যা। রাজ্যের সেরা ডায়েটিসিয়ানের বানিয়ে দেওয়া খাদ্যতালিকা অনুযায়ী খাবার বরাদ্দ তার জন্যে। সুপ, স্টু, ডেজার্ট, মার্মালেড, এসব খেতে অভ্যস্ত সে। যদিও সেসব ‘নিউট্রিশাস’ খাবারে ভয়ানক অরুচি তার। ফলে চেহারা হয়ে গিয়েছে ললিপপের স্টিকের মতো।
এখন কাঠের আগুনে মাটির হাঁড়িতে করা রাজমাতার রান্না জিভে দিয়ে তো অবাক রাজকুমারী। আহা, কী অপূর্ব স্বাদ! অনেকদিন পর পেটভরে মনের সুখে খেল সে। তারপর ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে জম্পেশ একটি ঘুম।
কয়েকদিনের মধ্যে চেহারাই ফিরে গেল রাজকুমারীর। নিটোল সুন্দর স্বাস্থ্য হল। পাকাগমের মতো হল গায়ের রং। যে দেখে সে-ই বলে, এই না-হলে রাজার মেয়ে, রাজকুমারী!
খালি চেহারার পরিবর্তন নয়, রাজকুমারী জেনেও ফেলল কত কী! পাখ-পাখালি, গাছ, ফল-ফুল তো আছেই ; কামারশালায় গিয়ে দেখল কেমন করে লোহা পিটে জিনিসপত্র সব তৈরি হয়, হাঁপর চলে কেমন করে। তাঁতিপাড়ায় গিয়ে দেখল তাঁত বোনা হয় কেমন করে। সবচেয়ে মজা অবশ্য হল কুমোরের চাকা দেখে। কী আশ্চর্যভাবে কুমোরকাকা মাটির সরা হাঁড়ি খুরি সব বানিয়ে ফেলছে। রাজকুমারী নিজেও চেষ্টা করে দেখতে গিয়ে কাদায় মাখামাখি। সকলে হা হা করে উঠল, আর রাজকুমারী হেসে কুটিপাটি। এত মজা কক্ষনো পায়নি সে। তাই দেখে রাজমাতাও হেসে উঠলেন ফোঁকলা দাঁতে। এতদিন পর মনটা হালকা হল তাঁর, কে বলে রাজকুমারী হাসে না!
এমনি করে দিন কেটে গেল। রাজকুমারীর ইস্কুল খোলার সময় হয়েছে। রাজামশাই হালফিলের গাড়ি চেপে এলেন তাকে নিয়ে যেতে। সেদিন আবার খুব বৃষ্টি। এঁটেল মাটির রাস্তায় গাড়ির চাকা চলে না। তবু রাজা গাড়ি থেকে নামবেন না। নোংরা কাদায় পা দেবেন কী করে! ড্রাইভার কোনোমতে হেঁচড়ে-পেঁচড়ে গাড়িটি রাজমাতার দু-তলা মাটির বাড়ির সামনে এনেছে। বাকি দশ-বিশ গজ রাস্তা না-হাঁটলেই নয়। গাড়ি আর চলে না। কাদার মধ্যে চাকা ঘুরে যাচ্ছে এমনি-এমনি। রাজমাতার সঙ্গে রাজকুমারী দেখছেন বাবার কাণ্ডকারখানা।
‘বাবা, গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে এসো, দেখবে কী মজা হবে!’ গোবর নিকোনো বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে বলল রাজকুমারী।
রাজামশাই মহাসংকটে পড়েছেন। সাধ করে আজ মসলিনি ধুতি আর আদ্দির ফিনফিনে পাঞ্জাবি পরেছিলেন। গায়ে শুঁড়তোলা খানদানি নাগরা। এসব পরে কী আর প্যাঁচপেচে কাদার মধ্যে নামা যায়। কিন্তু মেয়ের মুখে খুশির ঝলক দেখে তিনি আর গাড়িতে বসে থাকতে পারলেন না। নেমে পড়লেন গাড়ি থেকে। রাজমাতা কিছু একটা ব্যবস্থা করতে যাচ্ছিলেন। চেঁচিয়ে উঠেছেন, ‘পারবি না। যা কলেবর বানিয়েছিস, হবে না তোর দ্বারা। দাঁড়া আমি ইট বিছনোর ব্যবস্থা করি।’
কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। দু-তিন পা হাঁটতে না-হাঁটতেই রাজামশাই কাদায় পা পিছলে পড়লেন ছপাত করে। কাছেপিঠে যারা ছিল হা হা করে উঠল সঙ্গেসঙ্গে। ড্রাইভার গাড়ির ইঞ্জিন নিবিয়ে নেমে পড়েছিল রাজামশাইকে তুলতে, কিন্তু তারও একই অবস্থা। সে পড়ল একেবারে রাজামশাইয়ের ঘাড়ে।
রাজামশাই হয়তো গর্দানই নিতেন তার, কিন্তু সেই মুহূর্তে ‘কী মজা, কী মজা, পা পিছলে আলুরদম’ বলে হাততালি দিয়ে হাসিতে ফেটে পড়েছে রাজকুমারী। দেখে তো রাজামশাইয়ের চক্ষু-চড়কগাছ! ড্রাইভার যে তার কোলে বসে আছে সেটাও ভুলে গেলেন। —কী অবাক কাণ্ড! মেয়ে হাসছে তার। জুঁইফুলের মতো সুন্দর দাঁতগুলি বের করে হেসে লুটোপাটি খাচ্ছে সে। আহা, কী সোনাবরণ সতেজ চেহারা হয়েছে তার।
রাজমাতা বললেন, ‘অবাক হোসনি। হাসি তো ওর মনের মধ্যেই ছিল। কিন্তু হাজারো নিয়মনীতির বেড়াজালে মনের সব আনন্দটুকু বন্দি হয়ে পড়েছিল অ্যাদ্দিন। এমন হাঁসফাস অবস্থায় হাসে কী করে বেচারি! আমি খালি বেড়ার আগলটা খুলে দিয়েছি।’
রাজামশাই প্রণাম করলেন রাজমাতাকে। ‘বুঝেছি মা। মূর্খ ছিলাম আমি। যে বেড়ার আগল তুমি খুলেছ, তা আমি আর লাগাব না। খালি তোমার নাতনি নয়, রাজ্যের সকল প্রজারা যাতে মনের আনন্দে হাসতে পারে এখন থেকে সে চেষ্টাই করব আমি।’