০৫. রাজকীয় ক্ষমতা

রাজকীয় ক্ষমতা

রাজাদের উৎস যাজকদের মতো প্রাগৈতিহাসিক। অধুনা বিরাজমান সবচেয়ে পশ্চাৎপদ বর্বর সমাজের অবস্থা থেকেই শুধু ধারণা লাভ করা যেতে পারে রাজতান্ত্রিক ক্রমবিকাশের প্রাথমিক পর্যায় সম্পর্কে। রাজার সম্প্রদায় বা জাতিকে যুদ্ধে নেতৃত্ব দান করেন প্রাতিষ্ঠানিক পূর্ণতালাভের পর পতন শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। তিনিই স্থির করেন কখন যুদ্ধ করতে হবে এবং কখন শান্তি স্থাপন করতে হবে। তিনি প্রায়ই আইন প্রণয়ন করেন এবং নিয়ন্ত্রণ করেন বিচার বিভাগীয় প্রশাসন। সিংহাসনে তার অধিকার কমবেশি বংশগত। তার ওপর তিনি একজন পূতপবিত্র ব্যক্তি। দেবতা না হলেও তিনি প্রভুর আশীর্বাদপ্রাপ্ত।

কিন্তু এ ধরনের রাজতন্ত্রে ইঙ্গিত পাওয়া যায় সরকারের দীর্ঘ ক্রমবিকাশ ও বর্বরদের তুলনায় উন্নততর সুসংগঠিত সম্প্রদায়ের। সেকেলে সমাজেও অধিকাংশ ইউরোপীয়র কল্পনা অনুরূপ কোনো বর্বরপ্রধান প্রকৃত খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা যাকে প্রধান বলে ধরে নেই। তিনি শুধু ধর্মীয় ও সামাজিক আনুষ্ঠানাদি পরিচালনা করে থাকেন। কখনও লর্ড মেয়রের মতো ভাষণদান করেন ভোজসভায়। কখনও যুদ্ধ ঘোষণা করেন তিনি। কিন্তু তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন না, কারণ অতিমাত্রায় পবিত্র তিনি। কখনও তার মানা (MANA) এমন যে কোনো প্রজা তার উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে না। কার্যত তিনি বিরত থাকেন জনগণের কাজে অধিকমাত্রায় অংশগ্রহণ থেকে। তিনি আইন তৈরি করতে পারেন না, কারণ তা গঠিত হয় প্রথা অনুযায়ী। তার প্রয়োজন হয় না প্রশাসনে, কারণ ছোট সম্প্রদায়ে প্রতিবেশিদের দ্বারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে শাস্তি প্রদত্ত হয়ে থাকে। দুজন প্রধান থাকেন কিছু বর্বর সমাজে : একজন নিরপেক্ষ ও অন্যজন ধর্মীয়। প্রাচীন জাপানের সগোন ও মিকাডোর মতো নয়। কারণ নিয়মানুযায়ী শুধু আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা রয়েছে ধর্মীয় প্রধানের। প্রাচীন বর্বর সমাজে সাধারণত সিদ্ধান্তমূলক প্রশ্নে আনুষ্ঠানিক সরকারের চেয়ে প্রথার গুরুত্ব এত বেশি যে ইউরোপীয়দের কাছে প্রধান হিসেবে খ্যাত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ভেতর থেকেই শুধু রাজকীয় ক্ষমতার সূত্রপাত হয়।

হিজরত ও বিদেশি আক্রমণ প্রথা ধ্বংস ও পরিণামে সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টিতে বড় ধলনের শক্তি। শাসকরা সভ্যতার সর্বনিম্ন স্তরে রাজা বলে খ্যাত। রাজ-পরিবারগুলো কখনও বিদেশি হয়ে থাকে এবং প্রাথমিকভাবে নির্দিষ্ট শ্রেষ্ঠত্বের দ্বারা শ্রদ্ধা অর্জন করে। কিন্তু রাজতান্ত্রিক বিবর্তনে প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে এটা সাধারণ বা অসাধারণ যে স্তরেই থাকুক না কেন তা একটি বিবর্তনমূলক প্রশ্ন।

এটা পরিষ্কার যে যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে রাজশক্তি বৃদ্ধির ব্যাপার। কারণ সাধারণ ঐক্যের প্রয়োজন খুবই স্পষ্ট যুদ্ধকালীন সময়ে। বিবর্তনমূলক উত্তরাধিকার সংক্রান্ত অশুভ প্রভাব এড়ানোর সবচেয়ে সহজ পন্থা হচ্ছে রাজতন্ত্রে উত্তরাধিকারমূলক বৈশিষ্ট্য অর্জন। রাজা যদিও তার উত্তরসূরি নিযুক্ত করার ক্ষমতা রাখেন তারপরও তিনি প্রায় নিশ্চিতরূপেই তার পরিবারের সদস্যদের ভেতর থেকে তা করে থাকেন। কিন্তু চিরকাল স্থায়ী হয় না রাজবংশ।

রাজপরিবারের সূচনা হয় জোরপূর্বক উচ্ছেদ বা বিদেশ জয়ের মাধ্যমে। সাধারণত ধর্মই নতুন পরিবারকে প্রথাগত উৎসবের মাধ্যমে বৈধ করে তোলে। এসব সুযোগ রাজকীয় ক্ষমতা লাভবান হয়। কারণ তা রাজকীয় ক্ষমতায় অপরিহার্য সমর্থন দান করে। প্রথম চার্লস বলেছিলেন কোনো বিকল্প নেই, কোনো রাজা নেই। সর্বযুগব্যাপী সত্য ছিল এ জাতীয় মেক্সিম রাজতন্ত্রের। উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষের কাছে রাজপদ এতে লোভনীয় যে একমাত্র শক্তিশালী ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞাই তারেকে বাধ্য করতে পারে এ ধরনের লোভ পরিত্যাগে।

বর্বর প্রধান ও রাজার মধ্যবর্তী যতগুলো স্তরই থাকুক না কেন, এই প্রক্রিয়া ইতিহাস যুগে সর্বপ্রথম মিসরে ও ব্যাবিলনে সমাপ্ত হয়। খ্রিঃ পূঃ ৩০০০ অব্দে নির্মিত মহান পিরামিডের নির্মাণ সম্ভব ছিল একমাত্র প্রজাদের উপর প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী কোনো রাজার পক্ষেই। এ সময় ব্যাবিলনে কিছু সংখ্যক রাজা ছিলেন, কিন্তু মিসরের সঙ্গে তুলনা হতে পারে এমন কোনো রাজা ব্যাবিলনে ছিলেন না। কিন্তু রাজারা তাদের নিজ নিজ এলাকায় পরিপূর্ণ শাসক ছিলেন।

আমরা এমন মহান রাজার কাছে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্র বর্ষ শেষ হওয়ার আগে পৌঁছে যাই যার নাম ছিল হামুরাবি। একজন রাজার পক্ষে যা সম্ভব তার সবই তিনি করেছিরেন। আইন প্রণয়নের জন্য সুপরিচিত তিনি। সূর্যদেবতার কাছ থেকে তিনি আইন ক্ষমতা পেয়েছিলেন এবং তিনি দেখিয়েছিলেন যে মধ্যযুগীয় রাজপুরুষরা যা করতে পারেননি তা অর্জন করতে সফলকাম তিনি। যেমন আদালতে যাজকদের অধীনতা। সৈনিক ও ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বৈশিষ্ট্য অর্জন করেন তিনি। তার বিজয়ের প্রশংসা করেছেন দেশপ্রেমিক কবিরা।

তিনি লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন সেচ ব্যবস্থায় তার কৃতিত্ব। আমু এবং এনলিন। (একজন পুরুষ দেবতা এবং একজন স্ত্রী দেবতা) শাসন করার জন্য শুমার ও আক্কাদের ভূমি দান করলেন এবং তাদের শাসন করার জন্য রাজদন্ড প্রদানের দায়িত্ব আমার উপর অর্পন করলেন। আমি হামুরাবি খনন করলাম যা শুমার ও আক্কারেদ জমিতে পানি আনল। আমি শুমার ও আক্কাদের বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত মানুষগুলোকে একত্রিত করলাম এবং তাদের জন্য ব্যবস্থা করলাম পশু চারণ ও জল ব্যবহারের। আমি তাদের প্রচুর চারণভূমি দিলাম এবং প্রতিষ্ঠিত করলাম শান্তিপূর্ণ বসবাসে।

মিসরে পিরামিড যুগে রাজতন্ত্র উন্নতির সর্বোচ্চ শিকরে পৌঁছে। বিশাল এলাকা ছিল পরবর্তী রাজাদের, কিন্তু কারোরই পূর্ণমাত্রায় শাসন ছিল না রাজ্যের উপর। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের ফলে নয়, মিসর ও ব্যাবিলনে রাজাদের ক্ষমতা শুধু বিদেশি আক্রমণের ফলে নিঃশেষ হয়। এটা সত্য যে, তা যাজক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ অবতীর্ণ হতে পারেনি। কারণ প্রজাদের অধীনতা নির্ভর করতে রাজতন্ত্রের ধর্মীয় তাৎপর্যের উপর। কিন্তু এই দিক ছাড়া অপরিসীম ছিল তাদের

অধিকাংশ শহরেই ইতিহাস যুগের সূচনা পর্যন্ত গ্রিকরা রাজাদের রাজনৈতিক শাসন থেকে মুক্ত ছিল। ইতিহাসব্যাপী রাজার প্রতি রোমানরা তাদের জাতির অনীহা বজায় রাখে। সঠিক অর্থে রোমান সম্রাট পশ্চিমে তাদের জাতির অনীহা বজায় রাখে। সঠিক অর্থে রোমান সম্রাট পশ্চিমে রাজা ছিলেন না। আইনবহির্ভূত ছিল তাদের উৎস। সবসময় তিনি নির্ভর করতেন সেনাবাহিনীর উপর। জনসাধারণের কাছে নিজেকে ঈশ্বর ঘোষণা করতে পারতেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর কাছে তিনি একজন জেনারেল। তিনি প্রচুর পরিমাণে দান করতেন অথবা করতেন না। সাম্রাজ্য স্বল্পকাল ছাড়া কখনও উত্তরাধিকারজাত ছিল না। সেনাবাহিনীর হাতে ছিল প্রকৃত ক্ষমতা। সম্রাট শুধু সাময়িকভাবে এমন মনোনীত ব্যক্তিমাত্র।

কিছু পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বর্বর আক্রমণের ফলে পুনরাবির্ভাব ঘটে রাজতন্ত্রের। নতুন রাজারা জার্মান গোষ্ঠীপতি ছিলেন। পরম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না তারা। সবসময়ই তাদের ক্ষমতা নির্ভর করত কোনো পরিষদ বা সগোত্রীয় সহযোগিতার উপর। কিন্তু জার্মান গোষ্ঠী রোমান প্রদেশ জয় করলে এর প্রধান হতো রাজা এবং গুরুত্বপূর্ণ সহযোগীরা লাভ করতেন বিশেষ স্বাধীনতাসহ এর আভিজাত্য। এভাবে যে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হয় তা পশ্চিম ইউরোপের সব রাজাকে অবাধ্য বেরনদের করুণার উপর ফেলে দেয়।

রাজতন্ত্র দুর্বল ছিল চার্চ ও সামন্ত অভিজাত সম্প্রদায়ের অধিকাংশ জিনিস গ্রহণ করার আগে। আমরা এর আগে চার্চের দুর্বলতার কারণ আলোচনা করেছি। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে রাজার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অভিজাত শ্রেণি ধ্বংস হয়, কারণ তা সুশৃংখল সরকারের প্রতি বাধাস্বরূপ ছিল। জার্মানিতে এর নেতারা উন্নীত হয় ছোট ছোট রাজায়। ফলে জার্মানি ফ্রান্সের কৃপায় পতিত হয়। বিভাগপূর্ব পর্যন্ত পোল্যান্ডে অভিজাত শ্রেণির অরাজকতা চলছিল। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে শতবর্ষের যুদ্ধ ও গোলাপযুদ্ধের পর সাধারণ নাগরিকরা বিশ্বাস স্থাপন করে শক্তিশালী রাজার উপর। চতুর্থ এডওয়ার্ড বিজয়ী হন লন্ডন নগরীর সাহায্য পেয়ে এবং তিনি তার রানী লন্ডন থেকেই বেছে নেন। সামন্ত অভিজাত শ্রেণির শত্ৰু একাদশ লুইস উচ্চশ্রেণির বুর্জোয়াদের বন্ধু ছিলেন, যারা তাকে অভিজাতদের বিরুদ্ধে সাহায্য করে এবং তিনি তাদেরকে সাহায্য করেন আর্টিসামদের বিরুদ্ধে। ENCY CLOPAEDIA BRITANICA-র রায় হচ্ছে, তিনি বড় পুঁজিপতির মতো শাসন করেন।

শিক্ষা যাজকদের এখন একচেটিয়া অধিকার নয়। চার্চের সঙ্গে সংঘর্ষে এ নিয়ে আগেকার রাজাদের তুলনায় রেনেসাঁ রাজতন্ত্রের সুবিধা ছিল বড় ধরনের। অপেশাদার আইনজ্ঞদের সাহায্য অতুলনীয় নতুন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়।

নতুন রাজতন্ত্র ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও স্পেনে চার্চ ও আভিজাত্যের ঊর্ধ্বে ছিল। তাদের ক্ষমতা নির্ভরশীল ছিল জাতীয়তাবাদ ও বাণিজ্য-এই দুই উদীয়মান শক্তির উপর। যতদিন পর্যন্ত মনে করা হতো যে তারা এই দুই শক্তির জন্য কার্যকর ততদিন তারা শক্তিশালী ছিল। কিন্তু তারা ব্যর্থ হলেই বিপ্লব সংগঠিত হয়। নতুন বিশ্বজয়ের মাধ্যমে স্পেন একপাশে সরে দাঁড়ায়; কিন্তু স্পেনীয় নতুন জগৎ বাণিজ্যের জন্যেই বিদ্রোহ করছিল ইংল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে।

যদিও বাণিজ্যিক বলয় সামন্তবাদীদের অরাজকতার বিরুদ্ধে রাজাকে সমর্থন দেয়, তারপরও যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়ার পর তা প্রজাতন্ত্রী ধরনের বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। প্রাচীনকালে উত্তর ইতালি ও মধ্যযুগীয় হেনসিটিক শহরগুলোতে এবং হল্যান্ডের মহান দিনগুলোতে তা একই ছিল। সুতরাং বেদনাদায়ক ছিল রাজার বাণিজ্য মৈত্রী। রাজা স্বর্গীয় কর্তৃত্বের কাছে আবেদন করেন, তাদের ক্ষমতা যেন সিক্ত হয় প্রথাগত ও আংশিকভাবে ধর্মীয় উপাদানে। এ ব্যাপারে তারা শুধু অপরাধীই নয়, বরং তা ছিল অধার্মিকতা। ফ্রান্সে সেইন্ট লুইসকে রূপকাহিনীর ব্যক্তিত্বে পরিণত করা হয়, যার কিছু ধার্মিকতা পৌঁছে পঞ্চদশ লুইস পর্যন্ত। নতুন কোর্ট আভিজাত্য সৃষ্টি করে। রাজারা একে গুরুত্ব দেয় বুর্জোয়াদের চেয়ে। ইংল্যান্ডে উচ্চতর অভিজাত ও মধ্যবিত্তরা একত্রিত হয়ে নামমাত্র সংসদীয় শিরোনামে একজন রাজা বসায়, যার কোনোরকম অতিপ্রাকৃত সংসদীয় গুণাগুণ ছিল না। উদাহরণস্বরূপ রাজার ক্ষতিকর দিকের কোনো উপশ্রম দিতে পারেননি জর্জ-১, কিন্তু রানী এনি দিতে পেরেছিলেন। ফ্রান্সে রাজারা জয়লাভ করলেন অভিজাত শ্রেণির উপর এবং তাদের মাথা শিরোচ্ছেদ যন্ত্রের নিচে পতিত হলো।

ফ্রেডারিক বারবারেসার সময় লম্বৰ্ড লীগের সাথে বাণিজ্য ও জাতীয়তার ঐক্য শুরু হয় এবং রাশিয়ায় ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে সর্বশেষ ও সংক্ষিপ্ত বিজয় অর্জন করে ক্রমাগতভাবে সমগ্র ইউরোপে তা ছড়িয়ে পড়ে। যেখানেই এই মৈত্রী ক্ষমতা লাভ করে সেখাইে প্রথমত রাজতন্ত্রের সহযোগ ও পরে এর বিপরীতে তা ভূমির উপর নির্ভরশীল প্রথাগত ক্ষমতার বিরোধী হয়ে পড়ে। অবশেষে রাজারা সর্বত্র বিলীন হয়ে পরিণত হয় ঠুটো জগন্নাথে। বর্তমানে কমপক্ষে পৃথক হয়েছে জাতীয়তা ও বাণিজ্য। ইতালি, জার্মানি ও রাশিয়ায় বিজয়ী হয়েছে একমাত্র জাতীয়তাই। দ্বাদশ শতাব্দীতে মিলানে সূচনালাভের পর স্বাভাবিক পরিণতি লাভ করে উদারনৈতিক আন্দোলন।

বাহ্যিক কারণে প্রথাগত ক্ষমতা ধ্বংস না হলে সবসময়ই তা এক বিশেষ স্তরে উন্নতি লাভ করে এবং অমনযোগী হয়ে পড়ে সাহস ও শ্রদ্ধায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাধারণ অনুমোদনের ব্যাপারে। কারণ বিশ্বাস করা হয় যে তা কখনও ধ্বংস হবে না। মূর্খতা ও নিষ্ঠুরতার জন্য মানুষ ক্রমান্বয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে এর স্বর্গীয় কর্তৃত্বের প্রতি। যেহেতু অভ্যাসের চেয়ে এসব দাবির ভালো উৎস নেই তাই সমালোচনা একবার শুরু হলে সহজেই এগুলোকে নিঃশেষ করে দেয়। বিদ্রোহীদের কাছে প্রয়োজনীয় ধর্মমত স্থান নেয় পুরনোর। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় ফ্রান্সের কাছ থেকে হাইতি স্বাধীন হলে শুধু বিশৃঙ্খলাই জন্ম নেয়। সাধারণত মনোগত বিদ্রোহ ব্যাপকতা লাভের আগে একটি দীর্ঘজীবী কুশাসন জরুরি হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রেই বিদ্রোহীরা পুরনো শাসন বৈশিষ্ট্যের পুরোটা অথবা অংশবিশেষ অর্জন করে। অগাস্টাস তাই সিনেটের প্রথাগত মর্যাদা আত্মস্ত করেছিলেন এবং প্রটেস্ট্যান্টরা বাইবেলের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখলেও রাখতে পারেনি তা ক্যাথলিক চার্চের প্রতি। রাজতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অক্ষুণ্ণ রেখেই ব্রিটিশ সংসদ ধীরে ধীরে রাজক্ষমতা আত্মস্ত করে।

যা হোক, সীমিত বিপ্লব ছিল এগুলো : অধিকতর ব্যাপকতাসম্পন্ন বিপ্লবগুলো সৃষ্টি করত কঠিনতর সমস্যা। উত্তরাধিকারমূলক রাজতন্ত্রের স্থলে হঠাৎ প্রজাতন্ত্রী সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দেয়, কারণ নতুন সংবিধান সম্পর্কযুক্ত হয় না জনগণের মানসিক অভ্যাসের সঙ্গে। সংবিধান ব্যক্তির স্বার্থের অনুকূল হলেই এর প্রতি সম্মান প্রদর্শিত হয়। উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিরা একনায়ক হওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে অকৃতকার্য থাকার পর পরিত্যাগ করে সে চেষ্টা। একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে টিকে না থাকলে প্রজাতন্ত্রী সংবিধান ব্যর্থ হয় জনগণের চিন্তা-চেতনার উপর প্রভাব অর্জনে। অথচ স্থিতিশীলতার জন্য তা-ই ছিল জরুরি। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ করা যায় নতুন প্রজাতন্ত্রের দৃষ্টান্ত হিসেবে, যা সূচনা থেকেই রয়েছে স্থিতিশীল।

ব্যক্তি মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষমতার উপর সমাজবাদ ও সাম্যবাদের আক্রমণ হচ্ছে আমাদের সময়ের প্রধান বৈপ্লবিক আন্দোলন। আমরা এ ধরনের আন্দোলনের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য আশা করতে পারি। উদাহরণস্বরূপ উপস্থাপন করা যায় খ্রিস্টবাদের উত্থানের সময় প্রটেস্ট্যান্টবাদ ও রাজনৈতিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো। আমি পরবর্তী পর্যায়ে আরও আলোচনা করব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *