রাঙিয়ে দিয়ে যাও

রাঙিয়ে দিয়ে যাও

‘দেখ, আমার আর এসব ভালো লাগছে না৷’

‘না লাগাটাই স্বাভাবিক৷ আমার ব্যাপার তো৷’

‘আশ্চর্য৷ সবকিছু এমন বাঁকা করে নাও কেন বলতো?’

‘নিজের মনটা একটু সোজা কর৷ সব কিছু সোজাসুজি দেখতে পাবে৷’

‘থামো তো৷ ফালতু মেয়েদের মতো ঝগড়া কোরো না৷’

‘মেয়েদের মতো ঝগড়া করো না৷ অক্সিমরন৷’

অদিতি কিছু একটা ঝাঁঝালো উত্তর দিতে যাচ্ছিল৷ হঠাৎ কী যেন একটা চোখে পড়ায় সে দাঁড়িয়ে গেল৷ জলার একপাশে দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল দু-জনে৷ এতক্ষণে চারিদিক সন্ধের অন্ধকার আর আধখানা চাঁদের জ্যোৎস্নায় আলোছায়া হয়ে আছে৷ বিকেলের দিকে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে৷ একটা ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে থেকে থেকে৷

অদিতি থেমে যেতে তার দিকে একবার তাকাল মৃন্ময়৷ ঝাঁঝালো উত্তরটা না পেয়ে বেশ অবাক হয়েছে সে৷ অদিতির চোখ কিন্তু জলার অন্ধকারে থমকে আছে৷ দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকিয়ে মৃন্ময়ও অবাক হল৷ ঘাস আর ঝোপঝাড়ের ঘন অন্ধকারের মধ্যে একটা উজ্জ্বল আলো জ্বলছে৷ আশেপাশে অন্য আলো নেই৷ অর্থাৎ জলের উপর কোন কিছুর রিফ্লেকশন নয়৷ সব থেকে বড়ো কথা আলোটা পুরোপুরি সাদা নয়৷ হালকা লাল আর সোনালি রং মিশে আছে তাতে৷

‘কী বলতো ওটা?’

বিড়বিড় করে জিজ্ঞেস করে অদিতি৷ মৃন্ময় কিছু উত্তর দেয় না৷ তারও মনটা কৌতূহলী হয়ে উঠেছে৷ চারপাশে তেমন বাড়িঘর নেই৷ এদিকটায় বেশি লোকজনও যাওয়া আসা করে না৷ ফাঁকা জমির মাঝখানে এমন একটা অদ্ভুত আলো ফেলে যাবে কে? খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে সে জবাব দেয়, ‘বাল্ব জাতীয় কিছু মনে হচ্ছে৷ এসো দেখি একবার৷’

মুখ ফিরিয়ে নেয় অদিতি৷ তারপর মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এত হাঘরে অবস্থা হয়েছে তোমার? রাস্তা থেকে বাল্ব কুড়িয়ে নিচ্ছ?’

‘কুড়িয়ে নেব বলেছি? একবার দেখে আসতে ক্ষতি কী?’ অদিতি আর আপত্তি করে না৷ তার নিজের মনেও বেশ কৌতূহল হচ্ছে৷ যদি বাল্বজাতীয় কিছুও হয়, সেটাই বা জ্বলছে কী করে?

সাবধানে ভিজে ঘাসের উপর পা ফেলে সেদিকে এগিয়ে যায় মৃন্ময়৷ খানিক দূর গিয়েও সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে৷ অদিতি কয়েক-পা এগিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী হল?’

মৃন্ময় প্রায় আধমিনিট চুপ করে থেকে উত্তর দেয়, ‘বাল্ব না৷ একটা বাক্স৷’

‘বাক্স! কীরকম বাক্স?’

‘মনে হয় কাচের৷ ভিতরে কিছু একটা আছে৷ সেখান থেকেই আসছে আলোটা৷’ কাদাজলের উপর আরও দু-একপা হেঁটে সেটার দিকে এগিয়ে যায় মৃন্ময়৷

তারপর নীচু হয়ে তুলে নেয় জিনিসটা৷ সেটা ভালো করে দেখতে দেখতে দ্রুত পা চালিয়ে আবার রাস্তায় ফিরে আসে৷ কাচের বাক্সটার ভিতর থেকে গোলাপি আলো এসে তার মুখে পড়েছে৷ ভিতরের তরল পদার্থটা কেঁপে উঠছে বারবার৷ কী বলতো এটা?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে সে৷

অদিতি ভুরু কুঁচকে এতক্ষণ বাক্সটার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ এবার কাচের উপর হাত রেখে বলে, ‘কী জানি৷ এমন অদ্ভুত জিনিস জীবনে দেখিনি৷’

‘আমিও৷’ দু-জনের চোখই এখন গোলাপি তরলের উপর স্থির৷

‘খারাপ কিছু নয় তো?’

‘মানে বোম-টোম বলছ?’

‘কী জানি৷ আজকাল তো কত কী শুনি৷ কৌটো বোমা৷ বোতল বোমা৷’

‘উঁহু, তাহলে এমন জনশূন্য মাঠের মধ্যে পড়ে থাকবে কেন? আর তার থেকেও বড়ো কথা…’

কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল মৃন্ময়৷ তার বাঁ হাতের আঙুলটা বাক্সের একটা বিশেষ জায়গায় এসে স্থির হয়ে যায়৷ নীচে গলায় অদিতিকে একটা নির্দেশ দেয় সে, ‘এখানটায় দেখ৷’

‘কী দেখব?’

মৃন্ময়ের আঙুলটা তরলের একটা বিশেষ জায়গায় নির্দেশ করছে৷ সোনালি রং সেখানে একটু বেশি জমাট বেঁধেছে৷ আস্তে আস্তে অদিতির মনে হয় কিছুর একটা আকার নিয়েছে সেটা৷ কিছুক্ষণ একদৃষ্টে সেটা লক্ষ্য করতেই শিউরে ওঠে অদিতি৷ মুখ দিয়ে ভয়ার্ত একটা শব্দ বেরিয়ে আসে তার৷

চোখ৷ দুটো জীবন্ত সোনালি চোখ ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে সেখানে৷

* * *

‘হ্যাঁ৷ না আজ হবে না৷’

‘এমনিই৷ আমার শরীরটা কেমন লাগছে৷ অদিতি যাবে তো৷’

‘সে তো আমি বরাবরই আনসোশ্যাল৷’

‘একদম৷ একদম৷ তোরা আগে আয় একদিন৷’

‘হ্যাঁ সেই৷ আচ্ছা রাখলাম রে…’ ফোনটা রেখে আবার চেয়ারে ফিরে এল মৃন্ময়৷ এতক্ষণে বুক ভরে খানিকটা নিঃশ্বাস নিল সে৷ শ্রীময়ীর ছেলের অন্নপ্রাশনে যাওয়ার একটুও ইচ্ছা নেই তার৷

অথচ না গেলেই অদিতির গাল ফুলে যাবে৷ সকাল থেকে কিছু একটা ছুতো খুঁজছিল সে৷ গাটা একটু গরম লাগতেই শরীর খারাপের বাহানা করে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে৷ অদিতি প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি৷ পরে কপালে হাত দিয়ে বুঝেছে গায়ে সত্যি জ্বর৷

লোকজন এমনিতেই বেশি পছন্দ হয় না মৃন্ময়ের৷ তারপর এইসব পার্টিতে যারা আসে তাদের বেশিরভাগই টিপিক্যাল হিংসুটে ধরনের৷ বেশিক্ষণ তাদের মাঝেখানে থাকলে মাথা ধরে যায়৷ কে কীরকম জামাকাপড় পরেছে, কত দামি গয়না পরেছে, কে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে-এর বাইরে আর কোনও আলোচনা নেই৷ অদিতি অবশ্য ভালোইবাসে এসব৷ কিন্তু একা যেতে সে কোনওমতে রাজি হয় না৷

চেয়ারে বসে একবার মাথায় হাত দিয়ে দেখে নেয় মৃন্ময়৷ আপাতত জ্বরটা বেশি নেই৷ শুধু মাথাটা ধরেছে৷ কিছুই ভালো লাগছে না৷ চেয়ারে বসতেই সামনের টেবিলের উপরে চোখ পড়ল তার৷ বেশ খানিকটা ঝুঁকে এসে ভালো করে কিছু দেখার চেষ্টা করল৷ টেবিলের উপরে কাল রাতে পাওয়া সেই কাচের বাক্সটা রাখা আছে৷ এই প্রথম সেটা মন দিয়ে দেখল মৃন্ময়৷ আকারে একটা টিফিনবাক্সের মতোই৷ তবে বাক্সটা আশ্চর্যরকম শক্ত৷ প্রথমে আলতো টোকা এবং পরে বেশ জোরে ঘা মেরেছিল কাল রাতে৷ কিন্তু একটা আঁচড়ও পড়েনি তার গায়ে৷ সম্ভবত কাচ নয় সেটা৷ অন্যকিছু৷ গোলাপি তরলের ভিতরে ছোটো চোখ দুটো এখনও আগের মতোই স্থির৷ তাতে মণি আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না৷ বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থাকে মৃন্ময়৷ কিছু একটা যেন মনে পড়ে তার৷ পরক্ষনেই তার ভুরুদুটো কুঁচকে যায়৷ মাথা তুলে দু-মিনিট কী যেন ভেবে নিয়ে আবার সেদিকে তাকিয়ে থাকে৷

‘বাঃ৷ যাওয়ার টাইম পেরিয়ে যেতেই জ্বর সেরে গেছে দেখছি৷’ অদিতি ঘরে ঢুকেই বলেছে কথাটা৷ মৃন্ময় সেদিকে না তাকিয়েই বলে, ‘এখন একটু কম আছে৷’

‘তাহলে শুয়ে থাকো৷ চেয়ারে বসে গবেষণাটা না হয় আমি বেরিয়ে গেলে কর৷’

‘আমি ভাবলাম বেরিয়ে গেছ৷’

উদাস গলায় কথাটা বলে মৃন্ময়৷ একই ভাবে ভুরু কুচকে সেদিকে তাকিয়ে থাকে৷

‘অত মন দিয়ে কী দেখছ বলতো?’ ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসে অদিতি৷ মৃন্ময় আবার আগের মতোই জড়ানো গলায় উত্তর দেয়, ‘কী যে দেখব সেটাই বুঝতে পারছি না৷’

‘মানে?’

‘মানে ধর এই যে ভিতরে যেটা আছে সেটা কাল রাতের থেকে একটু ঘন হয়েছে মনে হচ্ছে৷’

‘কী জানি৷ আমি অত মন দিয়ে দেখিনি৷’

‘হুম…’

‘তবে রংটা একটু গাঢ় হয়েছে৷’

‘আর এই জায়গাটায় তাকাও… সরু সরু কয়েকটা দাগ৷’

ভালো করে সেদিকে তাকিয়ে দাগগুলো লক্ষ্য করে অদিতি৷ তারপর মুখ তুলে নিয়ে বলে, ‘আমার তো খেলনা মনে হচ্ছে৷ গাড়ি করে কেউ নিয়ে যাচ্ছিল মাঠের মাঝে পড়ে গেছে৷’

‘হুম… তাও হতে পারে৷’

মৃন্ময়ের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হয় অদিতি৷ বলে, ‘এটা নিয়ে তুমি এত ঘাবড়াচ্ছ কেন বলতো?’

এইবার বাক্স থেকে মুখ ফেরায় মৃন্ময়৷ মাথা নামিয়ে কী যেন ভাবে, তারপর মুখ তুলে ধীরে ধীরে বলে, ‘আমার খালি মনে হচ্ছে চোখ দুটো আমি আগে দেখেছি৷’

অদিতির ঠোঁটের কোনায় একটা মিহি হাসি ফুটে ওঠে, ‘ডিডিএলজিতে শাহরুখ খান বলেছিল কাজলকে৷ আর তুমি বললে একটা বিদঘুটে কেমিক্যালকে৷ ভারী রসালো মানুষ কিন্তু তুমি৷’

মৃন্ময় কথাটায় কান দেয় না৷ টেবিলের উপর একটা কনুই রেখে মাথাটা রাখে হাতের উপর৷ অদিতি দরজা দিয়ে বেরোতে বেরোতে বলে, ‘আচ্ছা দুপুরে ঘুমিয়ে নিও৷ আর ওষুধপত্র সব রেখে গেছি, খেতে ভুলো না৷’

অদিতি বেরিয়ে যেতে চেয়ার থেকে উঠে পড়ে মৃন্ময়৷ তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় বুকশেলফটার দিকে৷ দেওয়ালের প্রায় আধখানা জুড়ে বুকশেলফ৷ নানারকম বইতে ঠাসা সেটা৷ কী যেন দেখে একটু থমকে দাড়ায় সে৷ রাশিরাশি বইয়ের ফাঁকে একটা ছোট্ট ফাঁক৷ মনে মনে কিছু ভেবে নিয়ে টেবিল থেকে মোবাইলটা তুলে নেয় মৃন্ময়৷ তারপর একটা নাম্বার ডায়াল করে৷ ‘হ্যাঁ রে, বল৷’

‘আমার নরস মিথোলজির বইটা তুই নিয়ে গেছিলিস না?’

‘হ্যাঁ তাই তো মনে হচ্ছে৷ প্রায় মাসখানেক আগে৷’

‘ওটা নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আয় আমার বাড়িতে৷’

‘এক্ষুনি৷ কাল সকালে নাহয়…’

‘না এক্ষুনি৷ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব৷’

‘কী ব্যাপার বলতো?’

‘সেটা এলেই বলব৷ শরীর ভালো নেই৷ এখন রাখছি৷’

ফোনটা কেটে দিয়ে আবার চেয়ারে এসে বসে পড়ে মৃন্ময়৷ তার মাথাটা এখন আগের থেকে বেশি ব্যথা শুরু হয়েছে৷ কোথা থেকে যেন গুনগুন করে একটা সুর ভেসে আসছে৷ কাচের বাক্সটার ভিতরে ভালো করে তাকায় সে৷ সোনালি রং এখন আর একটু বেশি ছড়িয়ে পড়েছে তাতে৷ থেকে থেকে যেন কেঁপে উঠছে সমস্ত তরলটা৷ ধীরে ধীরে প্রাণের স্পন্দন ফুটছে যেন তাতে৷

মৃন্ময়ের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ে সুমন্ত৷ ঘরের ভিতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ আসছে না৷ দরজাটা যদিও পুরোপুরি বন্ধ করা নেই৷ আলগা করে ভেজানো৷ হালকা হাতে চাপ দিয়ে ভিতরে ঢুকে আসে সে৷ বিছানার উপর শুয়ে আছে মৃন্ময়৷ তার একটা হাত মাথার নীচে রাখা৷ মাথার চুল বেশ এলোমেলো৷ ঘরের আশেপাশে তাকিয়ে বিশেষ কিছু চোখে পড়ে না তার৷ ধীরে সুস্থে মৃন্ময়ের দিকে এগিয়ে আসে সুমন্ত৷ মাথায় হাত রেখে হালকা ঠেলা দেয়৷ চোখ খুলেই ধড়ফড় করে উঠে বসে সে৷ একটু হাসে সুমন্ত তারপর হাতের বইটা তার সামনে রাখতে রাখতে বলে,

‘বাবা! স্বপ্ন দেখছিলি নাকি?’ হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে সুমন্ত৷ চোখ রগড়াতে রগড়াতে মৃন্ময় বলে, ‘ধুর শালা৷ বোস৷’

মৃন্ময়ের মুখের দিকে একবার ভালো করে তাকায় সুমন্ত৷ বেশ রুগন দেখাচ্ছে তাকে৷ সমস্ত মুখ জুড়ে নিষ্প্রভ লালচে ভাব৷ অথচ ক্লান্ত চোখের মাঝে যেন একটা ঝিলিক খেলে যাচ্ছে বারবার৷

‘কিছু ঝামেলায় পড়েছিস নাকি রে?’ বিছানার উপরে বসতে বসতে সুমন্ত জিগেস করে৷

‘ঝামেলাই বটে, তবে নিজেকে নিয়ে নয়৷’

‘তাহলে অদিতির কিছু হয়ছে? তোদের এই এক ব্যাপার বটে৷ বেশিরভাগ সময়টা হয় ঝগড়া নয় কথা কাটাকাটি৷ এখন কোথায় তিনি?’

‘কোথায় একটা গেল৷ পার্টি না কী যেন…’

‘তুই গেলি না?’

‘না৷’

‘কেন?’

‘আমার শালা ওসব ভালো লাগে না৷’

‘ভালো না লাগলেও মাঝেমাঝে যাওয়া উচিত৷ অন্তত বেঁচে যে আছিস সেটা লোকজনকে জানানো দরকার৷’

‘জানিয়ে লাভ?’

‘আরে বাবা অন্তত অদিতিকে খুশি করার জন্য…’

‘ওকে খুশি করা আমার সাক্ষাৎ মহাদেবেরও অসাধ্য৷’

বড়োসড়ো একটা নিঃশ্বাস ফেলে সুমন্ত৷ তারপর বইয়ের পাতা ওলটাতে ওলটাতে বলে, ‘যা-ই হোক৷ আমাকে জরুরি তলব কেন সেটা বল৷’

‘হ্যাঁ সেটাই বলছি৷’

বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে মৃন্ময়৷ বেসিনের কাছে এগিয়ে গিয়ে মুখ ধুতে ধুতে বলে, ‘বইটা পড়েছিস মন দিয়ে?’

প্রশ্নটা শুনে একটু ঘাবড়ে গেছিল সুমন্ত, ভুরু কুচকে বলে, ‘পুরোটা না৷ তবে বেশ ইন্টারেস্টিং৷ কিন্তু এইজন্য তুই আমাকে সাতসকালে…’

‘হেব্রক নামটা চেনা লাগছে তোর?’

খানিকক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবে সুমন্ত৷ তারপর আচমকা কী মনে পড়তে বলে, ‘হেব্রক… নামটা শুনেছি কিন্তু নাম…’

‘নাম সেটা কোথাও লেখা নেই৷’

‘কী জানি৷ হতে পারে৷ কিন্তু তুই হঠাৎ এসব নিয়ে মেতেছিস কেন?’

মৃন্ময় আর কিছু বলে না৷ মাথা নীচু করে কী যেন ভাবতে থাকে৷ সুমন্ত বিছানার উপর ভালো করে চড়ে বসতে বসতে বলে, ‘একেকদিন মাথায় একেকটা ভূত চাপবে আর আমাদের হয়েছে…’

‘মোরি স্টার্লসন… স্নোরি স্টার্লসনের লেখাতেই আছে কথাটা৷’

‘সেটা আবার কে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে সুমন্ত৷

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় না মৃন্ময়৷ মুখ ধোয়া শেষ করে বিছানার কাছে ফিরে এসে বসে পড়ে৷ টেবিল থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট তুলে নিয়ে সেটা ধরাতে ধরাতে বলে, ‘আজ থেকে হাজার বছর আগে প্রায় একা হাতে নরস মিথোলজির বেশিরভাগটা লিখেছিলেন ভদ্রলোক৷ তবে নিজে বানিয়ে নয়৷ সেসময়কার মুখে মুখে চালু গল্পগুলোকে লেখায় ধরে রেখেছিলেন৷ হেব্রকের কথা তিনি শুনেছিলেন এক মরণোন্মুখ বৃদ্ধের মুখে৷ ফলে ঘটনার সত্যতা যাচাই করার সুযোগ পাননি৷’

‘আমি এখনও বুঝতে পারছি না এর সঙ্গে আমার বা তোর সম্পর্ক কী…’

‘তবে সেই বৃদ্ধের কাপড়ের ভাঁজে একটা হাতে আঁকা ছবি পেয়েছিলেন স্টার্লসন৷ সে ছবিখানা আছে ওই বইতে৷’

‘এতে?’

বইখানার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে সুমন্ত৷ তারপর বইখানা হাতে তুলে নিয়ে পাতা ওলটাতে থাকে৷

‘একটা চোখের ছবি৷ তবে হাতে আঁকা চোখ বলে বোঝার উপায় নেই সেটা মানুষের, কোন প্রাণীর নাকি অন্য কিছুর?’

‘অন্য কিছু?’ বইটা বন্ধ করে সন্দেহের চোখে তাকায় সুমন্ত৷ মৃন্ময় মাথা নাড়ে৷ একটা বড়োসড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘স্টার্লসনের থেকে এর বেশি কিছু পাওয়া সম্ভব না৷ তিনি এ নিয়ে আর কিছুই লিখে যাননি৷’

সুমন্ত আর কিছু জিজ্ঞেস করে না৷ বইতে চোখের ছবিটা এতক্ষণে খুঁজে পেয়েছে সে৷ সেটাকেই ভালো করে উলটে পালটে দেখার চেষ্টা করে৷ বেশ বোঝা যায় আসল হাতে আঁকা ছবিখানা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেশ পালটে গেছে৷ কিছুক্ষণ পড়ে সে বিরক্ত হয়ে বইটা রেখে দিয়ে বলল, ‘এবার এসব ইতিহাস ঘাঁটা ছাড়৷ শরীর ঠিক হলে চল কদিন ঘুরে আসি কোথা থেকে৷’

‘হ্যাঁ সেই ভালো৷ ঘেন্না ধরে গেল শালা৷’

‘বাবা! এর মধ্যে সন্ন্যাসী? ব্যাপার কী বলতো?’

‘ওকে সহ্য হয় না আমার৷’

‘কেন?’

‘কেমন যেন টিপিক্যাল টাইপের৷ মেয়েলি হয়ে যাচ্ছে দিনদিন৷ কালকে আবার জন্মদিন আছে৷ কিছু একটা ন্যাকা ন্যাকা জিনিস দাবি করে বসবে৷’

‘মেয়েরা মেয়েলি হবে এতে আর আশ্চর্য কী৷ আমার কিন্তু একটা ব্যাপার আশ্চর্য লাগছে৷’

‘কী ব্যাপার বল তো?’

‘বইটা এতদিন আমার কাছে পড়েছিল৷ ভেবেছিলাম ফেরত দেব না৷ তুইও হয়তো ভুলে গেছিলি৷ অথচ মনে পড়তে একবারও কোথা শোনালি না৷ বইপত্র নিয়ে এত উদার তো আগে হতে দেখিনি তোকে৷’

মৃন্ময় অল্প হেসে বলে, ‘আমার তো পড়াই আছে৷ খামোখা ঝগড়াঝাঁটি করতে ইচ্ছা করে না৷

এমনিতেই বাড়িতে সারাদিন চলছে৷’

‘সেজন্যেই এত সকালে ডেকে আনলি আমাকে?’

‘উঁহু… একটা জিনিস তোকে দেখানোর আছে৷’

‘কী জিনিস?’

মৃন্ময় ধীরে ধীরে আলমারিটার দিকে এগিয়ে যায়৷ পাল্লা খুলে কাপড়ে মোড়া কিছু একটা বের করে আনে৷ সুমন্ত অবাক হয়ে দেখে জিনিষটা৷ কাচের বাক্সের ভিতর একটা লালচে হলুদ পদার্থ৷ অনেকটা জেলির মতো৷ অল্প অল্প নড়ে উঠছে যেন সেটা৷

‘এটা কী রে? পেলি কোথায়?’

‘সেটা পরের কথা৷ আগে দেখ ভালো করে৷’

কাচের বাক্সটা সাবধানে হাতে নিয়ে ভালো করে দেখে সুমন্ত৷ জেলিটা প্রথমে সাধারণ মনে হলেও এখন সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করে অদ্ভুত কয়েকটা নকশা ফুটে উঠেছে তার উপর৷ যেন সরু পেন্সিল দিয়ে অজানা ভাষায় কেউ কিছু লিখতে চেয়েছে তার উপর৷ সমস্ত জিনিসটা ছড়িয়ে গিয়ে যেন একটা আকৃতি নিতে চাইছে জেলিটা৷ অথচ ঠিক, সেটা বোঝা যাচ্ছে না৷

‘কাল রাতে জলার ধার দিয়ে ফিরতে ফিরতে কুড়িয়ে পেলাম জানিস, তখন অবশ্য এতটা ঘন ছিল না৷ তুই কিছু বুঝতে পারছিস?’

‘যাঃ… ভাবলাম তোর এসব দিকে নলেজ আছে কিছু একটা ভেবে বের করতে পারবি৷’ ‘কাচের বাক্সের ভিতর রঙিন জেলি, দারুণ জিনিস কুড়িয়ে পেয়েছিস তো…’

সুমন্ত ব্যঙ্গের সুরে কথাটা বলে ভালো করে দেখতে থাকে বাক্সটা৷

‘চোখ দুটো অবিকল হাতে আঁকা ছবিটার মতো৷ যেন ওটা দেখেই জেলির গায়ে চোখ এঁকেছে কেউ… অথবা উলটোটা…’

বাক্সটা পাশে রেখে উঠে দাঁড়ায় সুমন্ত, কিছু একটা চিন্তা তার কপালে ভাঁজ ফেলেছে৷ মন দিয়ে কিছু ভাবতে থাকে সে৷

‘আমি শুধু ভাবছি যদি সত্যি এটা কোন প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর প্রাথমিক অবস্থা হয় তাহলে সে এখানে এল কী করে? সব থেকে বড়ো কথা এখনও যদি তারা টিকে থাকে তাহলে দেখা যায় না কেন?’

সুমন্তর মুখের দিকে তাকিয়ে একটু থমকে যায় মৃন্ময়৷ তার ভুরু দুটো ভয়ানক কুঁচকে গেছে, গালের পাশ দিয়ে একটা লাল আভা ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে….

‘কী হল রে? চুপ করে গেলি যে…’

‘তোর চোখ দুটো চেনা লাগছে৷ উলটোদিকের এই দাগগুলো চেনা লাগছে আমার, কোথায় যেন দেখেছি…’

‘দাগ!’

মৃন্ময় কিছু বুঝতে পারে না৷ জেলির উপর নকশাগুলো এখন আরও একটু স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ যেন হাতে এঁকে কেউ একটু একটু করে ছবি ফুটিয়ে তুলছে সেখানে৷

‘মাড গ্লিফস৷’ প্রায় ফিসফিস করে কথাটা বলে সুমন্ত৷

‘কী বললি?’

‘এম ইউ ডি, জি এল ওয়াই পি এইচ এস… মাড গ্লিফস… টেনেসিতে নতুন আবিষ্কৃত গুহার দেওয়ালে আঁকা একটা বিশেষ ছবি৷ আজ থেকে চার অথবা পাঁচ হাজার বছর আগের মানুষ এঁকেছিল সেগুলো৷’

‘সেখানেই দেখেছিস দাগগুলো?’

‘শুধু সেখানে নয়… ইজিপ্টের পিরামিডের দেওয়ালে মাঝেমাঝে অদ্ভুত দুটো ডানার ছবি দেখতে পাওয়া যায়৷ শরীর নেই… শুধু ডানা… হিইয়েরোফিনক্স…. সেখানেও আছে দাগগুলো… আরব দেশের মিথোলজিক্যাল ক্রিয়েচার হুপি…’ কথাগুলো বলতে গিয়েও থেমে যায় সুমন্ত৷ তারপর একদৃষ্টে কাচের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে, ‘হাজার হাজার বছর আগের সভ্যতা… পৃথিবীর সম্পূর্ণ আলাদা প্রান্তে, কয়েক হাজার বছর সময়ের ব্যবধানে অথচ একই প্রাণী বারবার ফিরে আসছে তাদের শিল্পে… এর কী মানে হতে পারে?’

‘কী?’

‘আমার অনুমান যদি সত্যি হয় তাহলে প্রাণীটা শুধু প্রাগৈতিহাসিক নয়… মহাজাগতিক…’

বাড়ি ঢুকতে আজ বেশ রাত হয়েছে অদিতির৷ দেরি হবে জানাতে কয়েকবার ফোনও করেছিল মৃন্ময়ের মোবাইলে৷ কিন্তু ফোন বেজে গেছে বারবার৷ খানিকটা চিন্তাও হচ্ছিল তার৷ জ্বরটা বাড়েনি তো? দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে আসে সে৷

এবং ঢুকেই চমকে যায়৷ একটা লম্বাটে চেহারার লোক কী একটা যেন বগলদাবা করে বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে৷ অদিতি চিৎকার করে উঠতে গিয়েও থেমে যায়৷

লোকটাকে সে চেনে—সুমন্ত৷ হাত বাড়িয়ে ঘরের আলো জ্বেলে নেয় সে৷ তারপর সন্দেহের সুরে বলে, ‘তুমি এখানে হঠাৎ৷ আর মৃন্ময় কই?’

কী যেন ভেবে একটু থতমত খেয়ে যায় সুমন্ত৷ অদিতি যে ঠিক এইসময় ঘরে ঢুকে পড়বে সে কথা আগে ভাবেনি সে৷ হাতের কাপড়ে মোড়া জিনিসটাকে আর একটু শক্ত করে ধরে বলে, ‘আসলে… ও একটু পরে ফিরবে… আমাকে একটা জিনিস নিয়ে যেতে বলল৷’

‘কী জিনিস? আর ও নিজে আসেনি কেন?’

এক পা এগিয়ে আসে সুমন্ত, ‘ও আসলে একটা কাজে আটকা পড়েছে৷’

এতক্ষণে অদিতি বুঝতে পারে কিছু একটা গন্ডগোল ঘটেছে৷ সারাদিনের ক্লান্তি আর ঘরে ঢুকেই অচেনা মানুষকে বেরোতে দেখে এতক্ষণে তার রাগ চরমে উঠছে৷ এগিয়ে এসে কিছু একটা বলতে যায় সে৷ কিন্তু পারে না৷ অবাক হয়ে যায় অদিতি৷ কথাটা যেন গলার কাছে এসেও আটকে গেছে৷ একটু একটু করে কমে আসছে রাগটা৷ সাধারণত এমনটা হয় না৷ একবার রাগ বাড়তে থাকলে আর কমে না তার৷ গুনগুন করে যেন একটা আওয়াজ আসছে কানে৷ সেটা শুনতে শুনতে সে বলে, ‘আচ্ছা ওকে বোলো আমার ফোনটা ধরতে৷’

আচমকা অদিতির মুখের রং পালটে যাওয়াতে খানিকটা অবাকই হয়েছিল সুমন্ত৷ সে আস্তে আস্তে কাপড়ে মোড়া বাক্সটা এগিয়ে দেয় তার দিকে৷ তারপর মাথা নামিয়ে বলে, ‘এটাই নিয়ে যেতে এসেছিলাম৷’

কাপড়টা খোলে না অদিতি৷ জিনিসটা হাতে না নিয়েও সে বুঝতে পারে ভিতরে কী আছে৷ মুখ তুলে জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় আছে ও?’

‘বড়ো ব্রিজের মাথায়৷ ওখান থেকেই ছুড়ে ফেলে দেবে ওটা৷ জলে পড়লে অনেক দূর বয়ে যাবে৷’

‘ছুড়ে ফেলে দেবে! কিন্তু কেন?’ অবাক হয়ে যায় অদিতি৷

‘সে কথা বলার সময় নেই এখন৷ এসো তাড়াতাড়ি৷’

সুমন্তর দেরি হচ্ছে দেখে বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল মৃন্ময়ের৷ দ্রুত পায়ে ব্রিজের উপরে পায়চারি করছিল সে৷ রাত প্রায় সাড়ে বারোটার কাছাকাছি৷ এতক্ষণে রাস্তাঘাট পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে গেছে৷ উলটোদিকের রেলিংয়ে দুটো কুকুর নিশ্চিন্তে শুয়ে ঘুমাচ্ছে৷ লম্বা খাম্বা থেকে সাদা আলো এসে পড়েছে তাদের গায়ে৷ মৃদু হাওয়া বইছে সেই সঙ্গে৷ অবশ্য উত্তেজনায় সেটা খেয়াল করছে না মৃন্ময়৷

দূরের দিকে তাকিয়ে এবার দুটো ছায়ামূর্তিকে দেখতে পেল সে৷ কিছুটা অবাক হল৷ তারপর পা চালিয়ে এগিয়ে গেল সেদিকে৷ খানিকটা এগোনোর পর সে থমকে দাঁড়াল৷ অদিতির তো এখানে আসার কথা ছিল না৷ সে তো প্রায় কিছুই জানে না৷ সুমন্তর হাতে কাপড়ে মোড়ানো বাক্সটা ধরা ছিল, সেটা সাবধানে হাতে নিতে নিতে একবার অদিতির দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি ওকে পেলে কোথায়?’ কী যেন একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল অদিতি৷ সুমন্ত বলল, ‘আমি ঘর থেকে বেরচ্ছিলাম৷ ও ঢুকল৷ অবশ্য কিছু বলা হয়নি ওকে৷’

‘হুম… সেটা ভালোই করেছিস৷ আগে এটাকে বিদায় করতে হবে৷’

‘কিন্তু হঠাৎ ফেলে দিচ্ছ কেন?’ এতক্ষণে প্রতিবাদ করে ওঠে অদিতি৷ মৃন্ময় খানিকটা এগিয়ে আসে তার দিকে৷

‘তোমাকে সব বলব৷ আগে এটার একটা ব্যবস্থা করি৷ আপাতত শুধু এটুকু জেনে রাখো এর ভিতরে যা আছে সেটা জীবিত৷’

‘জীবিত!’ আঁতকে ওঠে অদিতি, ‘কিন্তু এরকম কিছুর কথা…’

‘শোননি কোনওদিন৷ সম্ভবত কয়েক হাজার বছর আগে হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া এর কথা শোনেনি কেউ৷’

আর কিছু জিজ্ঞেস করে না অদিতি৷ মৃন্ময় কাপড়ের বাক্সটাকে শক্ত করে চেপে ধরে ব্রিজের একদিকের রেলিং বরাবর এগিয়ে যায়৷ মৃদু হাওয়াটা ঘন রাতের সুযোগে এতক্ষণে একটু বেড়ে উঠছে, সেই হাওয়ার টানে একবার একটু সরে যায় কাপড়টা৷ মুহূর্তের জন্য অবাক বিস্ময়ে অদিতির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে৷ কাচের বাক্সটা এখন আর শক্ত নেই৷ বরঞ্চ অজস্র ফুটোফাটা দাগে ছেয়ে গেছে সেটা৷ ভিতর থেকে আর একটু চাপ পড়লেই ভেঙে যাবে৷ ছিটকে আসা গোলাপি আভায় চোখ ধাঁধিয়ে গেছিল অদিতির৷ সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়৷ ব্রিজের নীচে জলের বেগ খানিকটা বেশি৷ সেদিকে লক্ষ্য করে কাপড় সুদ্ধ বাক্সটা ছুড়ে দেয় মৃন্ময়৷ হাওয়াতে ছিটকে গিয়েই কাপড়টা উড়ে যায় দূরে৷ একটা তীব্র গোলাপি আভায় ভরে যায় নদীর বুক৷ বাক্সের ভিতরটা এখন আর চৌকো নেই৷ কিছুর একটা আকৃতি ধারণ করছে সেটা৷ তার মাথাটা সরু, ঘাড়ের কাছে অজস্র কাঁটা ফুটে উঠছে, সেই সঙ্গে দুটো আশ্চর্যরকম লম্বা উজ্জ্বল ডানা৷ মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছিল তিনজনেই৷ গোলাপি আলোটা জলের উপর গিয়ে পড়তেই বাকি দু-জন ছুটে গেল ব্রিজের কিনারায়৷ ডুবে যাওয়ার মিনিট খানেক পরে গোলাপি আভাটা জলের উপর থেকে ধীরে ধীরে মিলিয়ে এল৷ একটা বড়োসড়ো নিঃশ্বাস নিল মৃন্ময়৷ তারপর মুখ তুলে বলল, ‘চল, আর ভয়ের কিছু নেই৷’

‘তুমি এখনও বললে না কী ছিল ওটা৷’

সুমন্তর মুখের দিকে একবার তাকাল মৃন্ময়৷ তারপর পা চালাতে চালাতে বলল, ‘পৃথিবীর ইতিহাস জুড়ে ছড়িয়ে থাকা রহস্যময় মহাজাগতিক প্রাণী—হেব্রক৷ এটা সম্ভবত তার জন্মদশা৷ পূর্ণাঙ্গ প্রাণী মানুষের থেকে আয়তনে কয়েকগুণ বড়ো৷ এখন এর বেশি আর কিছু জানা সম্ভব নয় তার সম্পর্কে৷’

‘তাহলে এভাবে ফেলে দিলে কেন?’

‘কেন ফেলে দিলাম তার কারণ জানতে গেলে ইতিহাস ঘেঁটে দেখতে হবে৷ অন্তত কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস৷ সেটা না হয় কাল হবে… আজ আমাদের মনের অবস্থা…’

‘আচ্ছা ঠিক আছে৷ পরে হবে না হয়৷’ কথাটা বলে অদিতি নিজেও দ্রুত পা চালায়৷ একটু আগের অদ্ভুত গোলাপি আভাটা এখনও লেগে আছে তার চোখে৷ নীচ থেকে দ্রুতগামী জলের শব্দ৷ একটু একটু দুলে উঠছে ব্রিজটা৷ একটা চেনা শব্দ কানে আসে অদিতির৷ ভালো করে কান পাতে সে৷ নাঃ বেড়ে ওঠা হাওয়ার শনশন শব্দ৷ আর কিছু নয়৷ একটু ডানদিকে সরে এসে মৃন্ময়ের হাতটা চেপে ধরে সে৷ আজকের দিনটা একটু বেশি ঝলমলে৷ সকালে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে৷ গরমটাও খানিকটা কমেছে তাতে৷ দুপুরের ঠান্ডা আলো গায়ে মেখে সচল হয়েছে শহর৷ জলেভেজা রাস্তার উপর দিয়ে থেকে থেকে ছুটে যাচ্ছে গাড়ি৷ চারপাশের দোকানগুলোকে যেন কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে৷ এইসব দোকানের মাঝে দোতলা একটা রেস্তোরাঁ৷ তারই দোতলায় একটা টেবিলে বসে আছে দুটো মানুষ৷ বেশ খানিকক্ষণ আগে খাবারদাবার দিয়ে গেছে বেয়ারা৷ আপাতত সেগুলো অভুক্ত অবস্থায় পড়ে আছে৷ দু-জনেরই সামনে খোলা আছে কয়েকটা মোটাসোটা বই৷ গোটা কয়েক ছাপানো কাগজপত্র৷ তার মধ্যে থেকেই একটা হাতে তুলে নেয় অদিতি৷ তারপর উপর থেকে নীচ অবধি চোখ বোলাতে বোলাতে বলে, ‘দেখে তো মনে হচ্ছে দুটো ডানা৷’

‘এবং ডানার গায়ে কিছু বিশেষ নকশা কাটা৷’ মৃন্ময় জবাব দেয়৷

‘ডানা তো পাখিদেরও থাকে৷

‘কিন্তু সে পাখির অর্থ মৃত্যু হয় না৷’

‘কীরকম মৃত্যু?’

মৃন্ময়ের মুখ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে৷ হাতের সামনের বইটা বন্ধ করে সে বলে, ‘ডানাওয়ালা গোলাপি প্রাণী৷ যার ঘাড়ের কাছে কাঁটা আছে, আর ডানায় আছে বিশেষ কিছু নকশা, এ ধরনের প্রাণীর কথা ইতিহাসে বেশ কয়েকবার শোনা গেছে৷ শুধু ইতিহাসে নয়, দেশ-বিদেশের মিথোলজিতেও৷ আগে ইতিহাসের কথায় আসি৷ এখন যেখানে সিরিয়া আর লেবাননের বর্ডার আজ থেকে সাড়ে তিনহাজার বছর আগে সেখানে এক ভয়ানক যুদ্ধ হয়েছিল৷ কাদেসের যুদ্ধ৷ একদিকে ফারাও রামেসিস টু আর একদিকে হিতিত সাম্রাজ্যের মোয়াতাই৷ এই যুদ্ধের আঁচ এসে পড়েছিল দামাস্কাসের কাছাকাছি একটি ছোটো গ্রামে৷ রামেসিসের সৈন্যরা খবর পেয়েছিল এই গ্রামেই নাকি মোয়াতাইয়ের যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র লুকানো আছে৷ দলবল নিয়ে তারা গ্রাম আক্রমণ করে৷ গ্রামে পৌঁছে কিন্তু তারা অবাক হয়ে যায়৷ অস্ত্রশস্ত্র সেখানে কিছু নেই৷ এমনও গ্রামের মানুষেরও যুদ্ধ করার তেমন কোনও ইচ্ছাই নেই৷ যুদ্ধরত সৈন্যরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করে গ্রামের মাঝখান থেকে হালকা গোলাপি রঙের ডানাওয়ালা কিছু একটা প্রাণী আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে৷ রামেসিসের বেশিরভাগ সৈন্যর খোঁজ আর পাওয়া যায়নি৷ যে ক’জন ফিরে আসে তাদের জবানবন্দিতেই লেখা হয় ঘটনাটা৷’

‘বাবা! এত আশ্চর্যের ব্যাপার৷’

‘এরপরের ঘটনা প্রায় দেড় হাজার বছর পড়ে৷ যিশুখ্রিস্টের জন্মের পঁচাত্তর বছর আগে৷ গ্রিক দার্শনিক প্লুতারকের জবানবন্দি৷ সাক্ষী প্রায় কয়েক হাজার রোমান সৈন্য৷ এখনকার তুরস্কের কাছাকাছি কোনও একজায়গায় তারা অদ্ভুত এক দৃশ্য লক্ষ্য করে৷ আকাশ থেকে মেঘের বুক চিরে লালচে ও সোনালি রঙের মাঝামাঝি ডানাওয়ালা কিছু একটা প্রাণী আচমকাই নেমে আসে৷ তার ডানার উপর নির্দিষ্ট কিছু চিহ্নের কথা জানা যায়৷ একটানা গুনগুন শব্দে ভরে ওঠে চারপাশ৷ মিনিট খানেক স্থায়ী হওয়ার পর আবার আকাশের বুকে মিলিয়ে যায় সেটা৷ যথারীতি একটা বড়ো অংশের রোমান সৈন্য গায়েব হয়ে যায়৷’

‘কিন্তু একই প্রাণী দেড় হাজার বছর পরে কী করে ফিরে আসতে পারে?’

‘দুটো আলাদা সময়, দুটো আলাদা জায়গা অথচ ঘটনা একই৷ এবং দুটো ঘটনাতেই একটা আশ্চর্য মিল৷ প্রাণীটা এসেছিল আকাশের দিক থেকে৷ মাটির উপর থেকে নয়৷’

‘আর সৈন্যদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া৷’

‘সেটার একটা কারণ আমরা ঠিক করেছি৷’

‘কী কারণ?’

‘ওটা বাড়িতে আনার পর থেকে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছে আমার সঙ্গে৷

তোমার হয়েছে কি না জানি না৷’

এক মুহূর্ত কী যেন ভেবে নেয় অদিতি, তারপর বলে, ‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে৷ খারাপ কথা বলতে গিয়েও বলতে পারিনি৷ গলাতেই আটকে গেছে৷’

‘একজ্যাক্টলি৷ এ প্রাণীটা মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে৷ অনুভূতি বুঝতে পারে৷’

চামচ তুলে নিয়ে খানিকক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে অদিতি, তারপর টেবিলের উপর পড়ে থাকা ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এখনও তো আমি খারাপ কিছু দেখতে পাচ্ছি না৷’

‘পাবে৷ ইতিহাস ছেড়ে পুরাণে এলেই পাবে৷’

কথাটা বলে বইয়ের ফাঁক থেকে একটা ছবি বের করে আনে মৃন্ময়৷ সেটা অদিতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘যেহেতু হায়ারোগ্লিফিক ছিল ছবির ভাষা তাই নির্দিষ্ট কোনও গ্রামার ছিল না তাতে৷ খাপছাড়া শব্দকে ছবি এঁকে বোঝানো হত৷ একই শব্দের যেমন অনেক প্রতিশব্দ থাকে তেমনি নানারকম ছবির একই মানেও হতে পারত৷ শোয়ানো মমি, মাথাবিহীন শরীর, অস্ত্র বেঁধা মানুষ এসবই ছিল মৃত্যুর চিহ্ন৷ কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল, এইসবের সঙ্গে বিশেষ একধরনের পাখি দিয়ে তারা মৃত্যুকে বোঝাত৷ শিয়াল মড়া খায়, তাই শিয়াল মৃত্যুর চিহ্ন হতে পারে, কিন্তু পাখি কী করে হয়? কিছুদিন আগে মারসা মাত্রুহ নামে ইজিপ্টের মরুভূমিতে মাটির তলায় নতুন একটা পিরামিড আবিষ্কার হয়েছে৷ তার দেওয়ালেও নতুন জাতের কিছু হায়ারোগ্লিফিক পাওয়া গেছে৷ বিশেষ কিছু চিহ্ন৷ কন্টেক্সট দেখে ধারণা করা গেছে সেগুলো মৃত্যুর সংকেত৷ এই যে ছাপিয়ে এনেছি৷’

কাগজটা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায় অদিতি৷ চিহ্নগুলো অবিকল এক৷ ছড়ানো ডানার উপরে সেই একই রকম দাগকাটা৷ ভয়ে চোখ নামিয়ে নেয় সে৷ বুকের মাঝখানটা কেঁপে ওঠে একবার৷ আর উত্তর দিল না সে৷ আশেপাশের লোকজন আলোচনায় মশগুল৷ সেদিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিল৷ চিহ্নগুলো দেখার পর থেকে কাল রাতের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে৷ সেই আশ্চর্য স্বচ্ছ গোলাপি প্রাণীটার ডানা ছিল৷ অথচ সে একবারও ওড়ার চেষ্টা করেনি৷ সম্ভবত তখনও উড়তে শেখেনি সে৷ সামনের পড়ে থাকা কাগজগুলোর উপর ডানার নকশাটা আঁকা রয়েছে৷ অনেকটা মশার কয়েলের মতো নকশাটা৷ সেই সঙ্গে সরু সরু ফুটকি লাইন দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে রেখাগুলোকে৷ একটা ব্যাপার ভেবে অবাক লাগে অদিতির৷

‘হেব্রক আর যা-ই হোক পৃথিবীর প্রাণী সে নয়৷ তবে কয়েক শতাব্দী পরে সে পৃথিবীতে আসে৷ আমরা যে কাচের বাক্সটা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম সেটা হয়তো সদ্যোজাত৷’

‘কিন্তু এমনও তো হতে পারে প্রাণীটা ক্ষতিকর কিছু নয়৷’

‘হতে পারে৷ তবে তার ট্র্যাক রেকর্ড বলছে উলটোটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি৷’

ঘণ্টাখানেক পরে সেখান থেকে উঠে পড়ে দু-জনে৷ দুপুর গড়িয়ে ধীরে ধীরে বিকেল নামে৷ এর মধ্যে সুমন্ত একবার ফোন করে খবর নেয় সব কিছু ঠিকঠাক আছে কি না৷ মৃন্ময় জানিয়ে দেয় যে আর কোনও সমস্যা হয়নি৷ ফিরতে ফিরতে রাতই হয়ে গেছিল৷ জলার ধারটা দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে আবার সেদিনের কথা মনে পরে যায় অদিতির৷ সেই জায়গাটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় সে৷ না অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না৷ মৃন্ময় অনেকক্ষণ কোনও কথা বলেনি… আড় চোখে একবার ঘড়ির দিকে তাকায় সে৷ রাত প্রায় পৌনে এগারোটা বেজেছে৷

‘যাই বল৷ প্রাণীটা থাকলেই কিন্তু ভালো হত৷’

‘কেন?’ অদিতি হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করে৷

‘তোমার ঝগড়াঝাঁটি কমত একটু৷’

‘আমি ঝগড়া করি?’

‘কর মানে৷ হাজারখানেক রোমান সৈন্যও তার সামনে নস্যি৷’

‘তাহলে ফেলে দিলে কেন? রেখে দিতে পারতে৷’

‘বাবা! তোমার তো দেখছি খাঁচায় রেখে পোষার শখ ছিল…’

‘তা নয়… তবে…’

‘মানে প্রাণীটা যেহেতু গোলাপি তাই সেটা খারাপ হতে পারে না…’

‘তা নয়, তবে অন্য একটা কথা ভাবছি…’

‘কী কথা?’

‘আমরা মৃত্যুকে কী দিয়ে বোঝাই?’

‘মাথার খুলি আর তার নীচে দুটো হাড়৷’

‘কিন্তু মরার সঙ্গে কঙ্কালের সম্পর্ক কী?’

‘সম্পর্ক কিছু নেই৷ কঙ্কাল জিনিসটা হরিফাইং, মৃত্যুটাও তাই… ফলে রূপক অর্থে…’

‘কিন্তু ইজিপ্সিয়ানদের কাছে মৃত্যুটা খারাপ কিছু ছিল না৷ মৃত্যু মানে ছিল নতুন জীবনের শুরু, আরও শান্তিপূর্ণ স্পিরিচুয়াল জীবনের শুরু৷ তাহলে তার চিহ্ন হিসেবে খারাপ কিছু ব্যবহার হবে কেন?’

চলতে চলতে আচমকাই থমকে দাঁড়িয়েছে মৃন্ময়৷ এই সহজ ব্যাপারটা সে এতক্ষণ ভেবে দেখেনি৷ মৃত্যু ছিল ইজিপ্সিওদের কাছে শান্তি৷ পার্থিব জীবন আর ঐশ্বরিক জীবনের মাঝের খেয়া৷ অদিতি আবার হাঁটতে শুরু করেছিল, মৃন্ময় কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল৷ চারপাশে এতক্ষণের অন্ধকারটা একটু একটু করে ফিকে হয়ে আসছে৷ একটা হালকা লালচে সোনালি রঙে ভরে যাচ্ছে জলার ধারটা৷ সেই সঙ্গে মিহি একটা সুর ভেসে আসছে, এ সুরটা ওরা দু-জনেই চেনে৷ শুধু আগের থেকে এখন আর একটু বেশি স্পষ্ট…

ডানা ঝাপটানোর আওয়াজে মাথার উপর তাকায় সুমন্ত… তাদের মাথা থেকে ঠিক মিটার দুয়েক উপরে যেন একটা নতুন নক্ষত্র জন্ম নিয়েছে৷ তার উজ্জ্বল রং নিয়ন আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে৷ স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ শরীর তার৷ সোনালি চোখের মণিটা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে অদিতির দিকে, একটু একটু করে নীচের দিকে নেমে আসছে যেন৷

দু-জনের কারওর মুখেই কথা ফোটে না৷ অদ্ভুত মায়াজালে যেন তাদের বন্দি করেছে পাখিটা৷ মৃন্ময়ের ডান হাতটা নিজে থেকেই উঠে আসে উপরে৷ ধীরে ধীরে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে আঙুলের উপরে দুটো পা রাখে পাখিটা৷ মৃন্ময়ের মুখ থেকে অস্পষ্ট একটা শব্দ বেরিয়ে আসে, ‘হেব্রক…’

এতক্ষণে অদিতিও এগিয়ে এসেছে কাছে৷ সেও সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে থাকে পাখিটার দিকে৷ গোলাপি আভায় ঢেকে গেছে তার সমস্ত মুখ৷ ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি৷

বাঁ-হাতটা পাখিটার পিঠে বুলিয়ে দিচ্ছিল মৃন্ময়৷ পাখিটাও এতক্ষণ এদিকওদিক মুখ ফিরিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করছিল৷ সম্ভবত চারপাশটা এখনও ভালো করে বুঝে উঠতে পারেনি সে৷ আচমকাই মুখ ফিরিয়ে মৃন্ময়ের বাঁ-হাতের আঙুলে সজোরে কামড়ে দিল সে৷ ছটফটিয়ে উঠে হাত সরিয়ে নিল সে৷ আঙুলের উপর ধীরে সরু ধারায় রক্ত নেমেছে৷ ঘাবড়ে গিয়ে ডানা ঝাপটে বেশ খানিকটা উপরে উড়ে গেল পাখিটা৷ একবার নীচে তাকাল, তার উপর উন্মুক্ত ডানায় ভর দিয়ে উঠতে লাগল আরও উপরে৷ রাতের আকাশে একমাত্র চাঁদটাকেই ভালো করে দেখতে পেল সে৷ সেটার দিকেই উড়ে একটু একটু করে ছোটো হয়ে এল৷ গোলাপি আভাটা মিলিয়ে আসতেই দূরে গির্জার ঘণ্টা বেজে উঠল৷ ঘড়ির দিকে তাকাল অদিতি৷ রাত বারোটা বাজছে৷

‘একেই বলে হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা৷’ চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল অদিতি৷

‘ও লক্ষ্মী পৃথিবীর নয়৷ রাখলেও থাকত না৷’ মুখ নামিয়ে হাঁটতে শুরু করে মৃন্ময়৷

‘অন্তত কাল ফেলে তো দেওয়া হত না৷ বেশ হয়েছে হাতে কামড়ে দিয়েছে৷’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মৃন্ময়, ‘ব্যস! পাখিও বিদায় নিয়েছে তোমার ঝগড়াও শুরু হয়েছে৷’

‘নিজের দিকে তাকাও একবার৷ ভুলে মেরে দিয়েছ৷’

‘কী ভুলেছি বল তো?’ মৃন্ময় অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে৷ অদিতি উত্তর দেয় না৷ গটগট করে সামনের পথ ধরে৷

‘ওহো… মনে পড়েছে বারোটা বেজে গেছে, তোমার তো আজ জন্মদিন৷’

অদিতি আগের মতোই সামনের দিকে এগিয়ে যায়৷ মৃন্ময় আচমকাই তাকে থামিয়ে দিয়ে একটা হাত সামনে বাড়িয়ে দেয়, ‘এই যে তোমার গিফট৷’

‘হাত খালি৷ তোমার চালাকি জানি না আমি?’

‘খুলে দেখ৷’

‘না৷’

‘ধুর বাবা৷ খোলোই না৷’

একটু ইতস্তত করে হাতটা খুলে ফেলে অদিতি৷ এবং খুলতেই সে অবাক হয়ে যায়৷ মৃন্ময়ের খোলা মুঠোয় ধরা আছে স্বচ্ছ গোলাপি রঙের একটা পালক৷ ‘এটা কখন পেলে?’

‘কখন আবার? তুমি কী ভাবলে এমনি এমনি আমার হাতে কামড়ে দিয়েছে?’ অদিতির হাসিটা এতক্ষণে গোটা মুখে ছড়িয়ে পড়ে৷ পালকটা আলতো করে হাতে ধরে সে৷ দু-জনে এগিয়ে যায় সামনের দিকে৷

জলার ধারের এই ঘুটঘুটে রাতেও এক টুকরো পালকের আভা অন্ধকারটাকে একটুখানি ফিকে করে দেয়৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *