রাগনারক : দেবতাদের শেষ পরিণতি
আজ পর্যন্ত আমি যেসব ঘটনার কথা বলেছি, সেগুলো অতীতে ঘটে গেছে, অনেক অনেক সুদূর অতীতে।
এখন আমি তোমাদের বলব, ভবিষ্যতে কী ঘটবে।
আমি তোমাদের বলব, কীভাবে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে আর আবার কীভাবে সবকিছু শুরু হবে। এগুলো সব খারাপ সময়ের কথা, গোপন কথা, যখন দুনিয়া ধ্বংস হবে আর দেবতাদের মৃত্যু হবে। মনোযোগ দিয়ে শোনো, তুমি অনেক কিছু জানতে পারবে।
আমি এখন বলব, কীভাবে আমরা বুঝব শেষ সময় এসে গেছে। এসব ঘটনা ঘটবে দেবতাদের সময়ের অনেক পরে, মানুষের যুগে। সেই সময়ে, যখন সকল দেবতারা ঘুমিয়ে থাকবে, একমাত্র সর্বদ্রষ্টা হাইমডেল বাদে। হাইমডেল ধ্বংসযজ্ঞের শুরু হতে দেখবে, কিন্তু সেটা থামানোর শক্তি তার থাকবে না।
শীতকালের আগমনের মধ্য দিয়ে সবকিছুর সূত্রপাত হবে।
এটা কোনো সাধারণ শীতকাল হবে না। শীতকাল শুরু হবে, আর সেটা চলতে থাকবে,
শীতের পর আবার শীত আসবে। কোনো বসন্ত আসবে না, কোনো উত্তাপের দেখা মিলবে না। লোকেরা ক্ষুধায় কাতর হবে, শীতে কাবু হবে আর তারা খুব ক্ষুব্ধ হবে। সারা দুনিয়ায় বড় বড় যুদ্ধ সংঘটিত হবে।
ভাই ভাইয়ের সাথে যুদ্ধ করবে, পিতা পুত্রকে হত্যা করবে। মা আর মেয়ে একে অপরের সাথে লড়াই করবে। বোনেরা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত হবে আর নিজেদের সন্তানদের হত্যা হয়ে যেতে দেখবে।
ঝড়ো বাতাসের দিন আসবে, মানুষ নেকড়ের মতো হিংস্র হয়ে যাবে, জংলী জানোয়ারের মতো হয়ে যাবে আর একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। মানব সভ্যতার গোধূলিলগ্ন এসে যাবে, মানুষের বসতিগুলোতে আগুন লেগে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে আর ধ্বংস হয়ে যাবে।
তারপর, যখন অল্প কিছু বেঁচে যাওয়া মানুষ পশুর মতো দুনিয়ার বুকে অবশিষ্ট থাকবে, আকাশ থেকে সূর্য হারিয়ে যাবে, নেকড়ে সেটা খেয়ে ফেলবে, চাঁদও হারিয়ে যাবে, আকাশে কেউ আর কোনো তারাও দেখতে পাবে না। বাতাস, ছাই আর কুয়াশার মতো অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে।
সময়টা হবে শেষ না হওয়া অনন্ত শীতকাল, যাকে বলা হয় ফিমবুলউইন্টার।
চতুর্দিক থেকে তুষার আসতে থাকবে, ঝড়ো হাওয়া চলতে থাকবে, এতটাই ঠান্ডা পড়বে, যেটা কল্পনারও অতীত, সেই বরফ ঠান্ডায় শ্বাস নিলে মনে হবে বুকে ব্যথা হচ্ছে, চোখের জলও চোখেই জমে বরফ হয়ে যাবে। এই শীত থেকে বাঁচার জন্য কোনো বসন্ত আসবে না, আসবে না কোনো গ্রীষ্ম বা শরৎকাল। শুধু শীতের পর শীত আসবে, তার পরেও শীত আসবে।
তারপর আসবে মহা ভূমিকম্পের সময়। পাহাড়গুলো সেই ভূমিকম্পে ধসে পড়বে। গাছপালা সব উপড়ে যাবে। মানুষ বাস করত, এমন অবশিষ্ট সব জায়গা ধ্বংস হয়ে যাবে।
ভূমিকম্প এত শক্তিশালী হবে যে, সকল বাঁধন টুটে যাবে, সকল রশি আর শিকল ছিঁড়ে যাবে।
সকল বন্ধন মুক্ত হয়ে যাবে।
বিরাট নেকড়ে ফেনরির নিজেকে শিকল থেকে মুক্ত করে নেবে। সে তার মুখ হা করবে, তার উপরের চোয়াল স্বর্গের কাছে পৌঁছে যাবে আর নিচের চোয়াল পৃথিবী স্পর্শ করবে। তার সামনে কোনোকিছুই টিকতে পারবে না, সে যে কোনোকিছুকে খেয়ে ধ্বংস করে ফেলতে পারবে। তার চোখ আর নাসারন্ধ্র দিয়ে আগুন বেরিয়ে আসতে থাকবে।
নেকড়ে ফেনরির যেদিকে যাবে, সেখানে শুধু আগুন আর ধ্বংস চোখে পড়বে। বিশাল জলোচ্ছ্বাস হবে, সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি পেয়ে ভূমিকে গ্রাস করবে। বিশাল আর ভয়ানক মিডগার্ডের সর্প জরমুনগুন্ডার, ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ক্রমেই ভূমির কাছে আসতে থাকবে। তার বিষদাঁত থেকে বিষ বেরিয়ে আসতে থাকবে আর সমুদ্রের পানিতে মিশে সমুদ্রের সব প্রাণীকে হত্যা করবে। সে বাতাসে কালো বিষ কুয়াশার মতো ছিটাবে, আর তাতে সকল সামুদ্রিক পাখি সেই বাতাসে শ্বাস নিয়ে মারা যাবে। সমুদ্রে কোনো প্রাণী জীবিত থাকবে না। সামুদ্রিক তিমি আর অন্যান্য সব মাছ, সীল আর সমুদ্র দানবদের মরা-পচা দেহ ঢেউয়ের সাথে তীরে উঠে আসবে।
তখনো জীবিত লোকেরা, যারা লোকির পুত্র দুই ভাই নেকড়ে ফেনরির ও মিডগার্ডের সর্পের দেখা পাবে, দুই ভাইয়ের হাতেই তাদের মৃত্যু হবে।
এটাই সকল কিছু শেষ হওয়ার প্রারম্ভ হবে।
কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ দুই টুকরো হয়ে যাবে আর বাচ্চাদের চিৎকার শোনা যাবে, মাসপেলের সন্তানেরা আকাশ থেকে নেমে আসবে, তাদের সামনে থাকবে সুরটার, তার হাতে থাকবে জ্বলন্ত তলোয়ার, সেটা এত উজ্জ্বল হবে যে, কোনো মরণশীল মানুষ তার দিকে তাকাতে পারবে না। তারা রংধনু সেতু দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বাইফ্রস্টের দিকে এগুতে থাকবে, তাদের পায়ের নিচে রংধনুর সেতু কাঁপতে থাকবে, রংধনুর উজ্জ্বল রং কয়লা আর ছাইয়ের মতো কালো হয়ে যাবে। তারপর থেকে আর কোনোদিন আকাশে রংধনু দেখা যাবে না।
পৃথিবীর গভীরে বন্দি থাকা লোকি তার বন্ধনমুক্ত হয়ে নাগালফার নামক জাহাজের নাবিক হবে। এটা হলো সবচেয়ে বড় জাহাজ, এত বড় জাহাজ আর কখনো তৈরি হয়নি, এটা মৃতদের নখর থেকে তৈরি হয়েছে। নাগালফার উত্তাল সমুদ্রে ভেসে আসবে, নাবিকেরা বাইরে তাকিয়ে শুধু মৃতদেহ দেখবে, দেখবে পচা মৃতদেহ সমুদ্রের পানিতে ভেসে আছে।
লোকি জাহাজটা চালিয়ে নিয়ে আসবে কিন্তু জাহাজের ক্যাপ্টেন হবে হাইরাম, তুষার দানবদের নেতা। বেঁচে যাওয়া বিশাল সব তুষার দানবরা সবাই হাইরামের সাথে আসবে। শেষ যুদ্ধে তারা হাইরামের অধীনে যুদ্ধ করবে।
হেলের সৈন্যবাহিনী লোকির সহযোদ্ধা হবে। এর হলো সেই মৃতের দল, যারা লজ্জাজনক মৃত্যু লাভ করেছিল। তারা আবার জীবিত হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসবে, পৃথিবীর বুকে যারা তখনো জীবিত আছে তাদের শেষ করার জন্য।
মৃতরা, দানবেরা আর মাসপেলের জ্বলন্ত সন্তানেরা সবাই ভিগ্রিড নামক যুদ্ধক্ষেত্রে এসে জড়ো হবে। ভিগ্রিড এক বিশাল প্রান্তর, লম্বায় তিনশ মাইল। নেকড়ে ফেনরির সেখানে উপস্থিত হবে, আর মিডগার্ডের সর্পও উত্তাল সমুদ্র পেরিয়ে ভিগ্রিডের খুব কাছে এসে যাবে আর শরীর মুচড়ে তীরের বালিতে নিজেকে উঠিয়ে দেবে, তার মাথা আর প্রথম এক মাইল অংশই শুধুমাত্র ডাঙায় দেখা যাবে, বাকি অংশ তখনো সমুদ্রেই থেকে যাবে।
তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবে, সুরটার আর মাসপেলের সন্তানেরা আগুন নিয়ে তৈরি থাকবে, তাদের সাথে থাকবে মাটির গভীর থেকে আসা লোকি আর হেলের যোদ্ধারা, থাকবে হাইরাম আর তুষার দানবেরা, তারা যেখানে দাঁড়াবে কাদামাটি জমে বরফ হয়ে যাবে। তাদের সাথে নেকড়ে ফেনরির থাকবে আর থাকবে মিডগার্ডের সর্প। কল্পনারও অতীত সবচেয়ে ভয়ংকর শত্রুরা সেদিন সবাই একজোট হবে।
হাইমডেল সবকিছুই ঘটতে দেখবে। সে সবকিছুই দেখে, কারণ সে হলো দেবতাদের প্রহরী। আর এ সবকিছু ঘটে যাওয়ার পরই হাইমডেল তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে।
হাইমডেল গেলারহর্নে তার সর্বশক্তিতে ফুঁক দেবে, যে গেলারহর্ন একসময় জ্ঞানী মিমিরের ছিল। গেলারহর্নের শব্দে এসগার্ড কেঁপে কেঁপে উঠবে আর শুধুমাত্র তখনই ঘুমন্ত দেবতারা জেগে উঠবে আর তাদের অস্ত্র হাতে বিশ্ববৃক্ষ ইগড্রাসিলের তলায় উরদের কূপের কাছে সমবেত হবে আর ননদের সাথে পরামর্শ করবে।
ওডিন তার ঘোড়া স্লেইপনিরে চড়ে মিমিরের কূপের কাছে গিয়ে মিমিরের কাটা মুন্ডুর কাছে পরামর্শ চাইবে, নিজের ও দেবতাদের জন্য। মিমিরের মাথা ওডিন ও দেবতাদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে ওডিনের কানে কানে ফিসফিস করে তথ্য দেবে, যেমন করে আমি তোমাদের কাছে সব ঘটনা খুলে বলছি।
ভবিষ্যৎ খুবই অনিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও মিমিরের মন্ত্রণা বিশ্বপিতাকে আশার আলো দেখাবে।
মহাবৃক্ষ ইগড্রাসিল, যাকে বিশ্ববৃক্ষ বলা হয়, বাতাসে একটা পাতা যেমন করে কাঁপে, ঠিক তেমন করে কাঁপতে থাকবে আর এসির দেবতারা যুদ্ধের পোশাক পরে তৈরি হবে, তাদের সাথে যোগ দেবে আইনহারজারেরা, এরা হলো সেই লোকেরা যারা যুদ্ধে বীরের মতো মৃত্যু লাভ করেছিল। দেবতারা আর আইনহারজাররা মিলে ঘোড়ায় চড়ে শেষ যুদ্ধের ময়দান ভিগ্রিডে এসে হাজির হবে।
তাদের সবার সামনে থাকবে ওডিন। তার বর্ম জ্বলজ্বল করবে আর তার মাথায় থাকবে সোনালি শিরস্ত্রাণ। মিওলনির হাতে ধর তার সঙ্গী হবে।
তারা সবাই যুদ্ধের ময়দানে পৌঁছাবে আর শেষ যুদ্ধ শুরু হবে।
ওডিন সোজা ফেনরিরের দিকে তার ঘোড়া ছোটাবে। নেকড়ে ফেনরির এখন কল্পনাতীত আকারের বড় হয়ে গেছে। বিশ্বপিতা হাতের মুঠিতে তার বর্শা . গাংনীর শক্ত করে ধরে সামনে অগ্রসর হবেন।
থর দেখবে ওডিন নেকড়ের মোকাবিলা করতে গেছে। দেখে থর মুচকি হাসবে আর আরো দ্রুত চলার জন্য তার ছাগলগুলোর ওপর চাবুক হানবে আর তার হাতুড়ি হাতে সোজা মিডগার্ডের সর্প জরমুনগুন্ডারের দিকে এগিয়ে যাবে।
ফ্রে দানবাকৃতির জ্বলন্ত সুরটারের মুখোমুখি হবে। সুরটারের হাতে থাকবে বিশাল এক জ্বলন্ত তরবারি। ফ্রে প্রাণপণে যুদ্ধ করবে, কিন্তু সুরটারের জ্বলন্ত তরবারির কাছে ফ্রের তরবারি আর বর্ম পরাজিত হবে আর দেবতাদের মধ্যে ফ্রেই প্রথম ধরাশায়ী হবে। মৃত্যুর সময় ফ্রে তার তরবারিটির জন্য আফসোস করবে, যে তরবারিটি বহুদিন আগে সে জার্ডের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য স্কিরনিরকে দিয়ে দিয়েছিল। আজ সেটি থাকলে সে নিজেকে বাঁচাতে পারত।
যুদ্ধের নিনাদে চতুর্দিক ভারী হয়ে উঠবে। ওডিনের যোদ্ধা আইনহারজারেরা লোকির সেনা নরকের মৃতদের সাথে ভয়ানক সংঘর্ষে লিপ্ত হবে।
নরকের হাউন্ড জার্ম ক্রোধে গর্জন করতে থাকবে। সে আকারে ফেনরিরের চেয়ে ছোট, কিন্তু তবুও সে সকল কুকুরের চেয়ে বড় আর ভয়ংকর। সেও মাটির নিচ থেকে তার বাঁধন ছিঁড়ে পৃথিবীর যোদ্ধাদের গলা ছিঁড়ে ফেলে হত্যা করার জন্য ফিরে আসবে।
টীর এক হাতবিশিষ্ট টীর তাকে থামাবে আর তাদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হবে। সাহসিকতার সাথে লড়াই করবে, কিন্তু লড়াইতে তাদের দুজনেরই মৃত্যু হবে। টীরের গলা কামড়ে ধরা অবস্থায় জার্মের মৃত্যু হবে।
থর অবশেষে মিডগার্ডের সর্ম্পকে হত্যা করতে সক্ষম হবে, যেটা করার জন্য অনেকদিন থেকেই ইচ্ছে পোষণ করত।
থর তার হাতুড়ি দিয়ে বিশাল সর্পের মাথা খ্যাতলে দেবে, সর্পের মাথা মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগেই সে লাফিয়ে পিছনে সরে আসবে।
সর্পের মাথা যখন মাটিতে আছড়ে পড়বে, থর সেটা থেকে নয় ফুট দূরে থাকবে, কিন্তু সেটা যথেষ্ট হবে না। মরার আগে, সর্প থরের ওপর কালো বিষ ছিটিয়ে তার বিষথলি খালি করে ফেলবে।
থর ব্যথায় কাতরে উঠবে আর তার হত্যা করা সর্পেরই বিষে মৃত্যুবরণ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে।
ওডিন সাহসিকতার সাথে ফেনরিরের সাথে যুদ্ধ করবে, কিন্তু নেকড়ে তখন দুনিয়ার যেকোনোকিছুর চেয়ে বড় আর ভয়ংকর হবে। চন্দ্রের চেয়ে বড়, বড় সূর্যের চেয়েও। ওডিন নেকড়ের মুখের ভিতর তার বর্শা চালাবে, কিন্তু ফেনরিরের এক কামড়ে সেটা অদৃশ্য হয়ে যাবে। নেকড়ে আরেকটা কামড় বসাবে আর কুড়মুড় শব্দ হবে, আর বিশ্বপিতা, দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী আর জ্ঞানী ওডিন, নেকড়ের পেটে অদৃশ্য হয়ে যাবে, তাকে আর কখনো দেখা যাবে না।
চুপচাপ আর নির্ভরযোগ্য দেবতা, ওডিনের পুত্র ভিডার, তার পিতার মৃত্যু দেখবে। সে সামনে এগিয়ে যাবে আর তার পা দিয়ে নেকড়ের নিচের চোয়াল মাটিতে চেপে ধরবে।
ভিডারের দুই পা দেখতে দুই রকম। তার এক পায়ে সাধারণ জুতা। কিন্তু অন্য পায়ের জুতা সেই সময়ের শুরু থেকেই বানানো হচ্ছে। মানুষ নিজেদের জুতা বানানোর সময় গোড়ালির দিক হতে যে চামড়ার অংশ কেটে ফেলে দেয়, এগুলো জোড়া লাগিয়ে লাগিয়ে এই জুতা তৈরি হচ্ছে।
(যদি তুমি দেবতাদের শেষ যুদ্ধে সাহায্য করতে চাও, জুতা বানানোর পর চামড়ার টুকরো অংশ ফেলে দাও। চামড়ার টুকরো আর ফেলে দেওয়া অংশ ভিডারের জুতায় পরিণত হবে)
এই বিশেষ জুতা বিশাল নেকড়ের নিচের চোয়াল মাটির সাথে চেপে রাখবে, ফলে নেকড়ে আর নড়াচড়া করতে পারবে না। তখন ভিডার এক হাত বাড়িয়ে নেকড়ের ওপরের চোয়াল ধরবে আর সেটা নেকড়ের মুখ থেকে ছিঁড়ে নিয়ে আসবে। আর তাতে ফেনরির মারা যাবে এবং ভিডাল তার পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে।
ভিগ্রিড ময়দানের যুদ্ধক্ষেত্রে দেবতারা তুষার দানবদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুবরণ করবে, তুষার দানবেরা দেবতাদের সাথে লড়তে লড়তে মারা যাবে। হেলের অর্ধমৃত সৈন্যরা শেষ যুদ্ধের ময়দানে কচুকাটা হয়ে মরে পড়ে থাকবে, আর তাদের পাশেই আইনহারজারেরা মৃত কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশের নিচে শেষবারের মতো মৃত অবস্থায় পড়ে থাকবে, যুদ্ধ করার জন্য আর কখনো তারা বেঁচে উঠবে না।
লোকির বাহিনীর মধ্যে একমাত্র লোকি বেঁচে থাকবে, তার মুখ রক্তাক্ত, চোখে পাগলা দৃষ্টি আর কাঁটা ঠোঁটের কোণে সন্তুষ্টির হাসি।
দেবতাদের রক্ষী, রংধনু সেতুর রক্ষক হাইমডেল তখনো জীবিত থাকবে। সে তার রক্তে ভেজা তরবারি হফুড হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে দণ্ডায়মান থাকবে।
ভিগ্রিডের ভিতর দিয়ে মৃতদেহ, রক্ত আর আগুন পেরিয়ে তারা একে অপরের মুখোমুখি হবে।
“আহ” বলবে লোকি, “দেবতাদের প্রহরী হাইমডেল। তুমি দেবতাদের জাগাতে অনেক দেরি করে ফেলেছ, হাইমডেল। তাদের একে একে মরতে দেখাটা খুবই মজাদার ছিল, তাই না?”
লোকি হাইমডেলের চেহারায় দুর্বলতা আর আবেগ খুঁজল, কিন্তু হাইমডেল নির্লিপ্তই থাকল।
“তোমার তাহলে কিছুই বলার নেই, নয় মায়ের সন্তান হাইমডেল? যখন আমি মাটির গভীরে বন্দি ছিলাম, সাপের বিষ আমার মুখের ওপর পড়ছিল, অসহায় সিজিন পাত্র হাতে বিষ ধরতে চেষ্টা করছিল, যখন আমি নিজের ছেলের অস্ত্র দিয়ে বাঁধা ছিলাম, এই সময়টার কথা ভেবেই আমি নিজেকে পাগল হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছি, মনে মনে এই দিনটির কথাই চিন্তা করেছি, যখন আমি আর আমার সন্তানেরা দেবতাদের যুগের ইতি ঘটাব আর দুনিয়া ধ্বংস করে দেব।”
হাইমডেল তখনো কিছুই বলবে না, কিন্তু সে লোকিকে সজোরে আঘাত করবে, আর তার তরবারি লোকির বর্মে আঘাত করবে, লোকি সেই আঘাত ঠেকাবে আর ক্ষিপ্রতার সাথে পালটা আঘাত করবে।
যুদ্ধ করতে করতে তারা স্মরণ করবে, অনেক দিন আগে তারা একবার যুদ্ধ করেছিল, যখন দুনিয়া অনেক সহজ ছিল। তারা সীলরূপে ফ্রেয়ার কণ্ঠহারের জন্য লড়াই করেছিল, যে কণ্ঠহারটি লোকি ওডিনের কথায় ফ্রেয়ার কাছ থেকে চুরি করেছিল, আর হাইমডেল সেটি উদ্ধার করে ফেরত দিয়েছিল।
লোকি তার অপমানের কথা কখনো ভোলে না।
তার যুদ্ধ করতে থাকবে, একে অপরকে কেটে ফেলা, তলোয়ার দিয়ে ফুঁড়ে ফেলার আর আঘাত করার চেষ্টা করতে থাকবে।
যুদ্ধ করতে করতে একসময় হাইমডেল আর লোকি দুজনেই মাটিতে লুটিয়ে পড়বে, দুজনেই ভীষণভাবে আহত থাকবে।
“সবকিছু শেষ হয়েছে,” ফিসফিস করবে লোকি, “আমি জিতে গেছি।”
কিন্তু হাইমিডেল তার রক্তাক্ত সোনালি দাঁতের ফাঁক দিয়ে মুচকি হাসবে, “আমি তোমার চেয়ে ভবিষ্যৎ বেশি দেখতে পাই,” হাইমডেল লোকিকে বলবে। “ওডিনের ছেলে ভিডার নেকড়ে ফেনরিরকে হত্যা করেছে আর ভিডার বেঁচে আছে। ওডিনের আরেক ছেলে ভালিও বেঁচে আছে। থর মারা গেছে, কিন্তু সন্তান মাগনি আর মডি বেঁচে আছে। তারা তাদের মৃত বাবার হাত থেকে মিওলনির তুলে নিয়েছে। তারা সেটা ব্যবহার করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী।”
“তাতে কিছু আসে যায় না। সমস্ত দুনিয়া জ্বলছে,” বলল লোকি। “মরণশীল মানুষেরা সব মরে শেষ হয়ে গেছে। মিডগার্ড ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি জিতে গেছি।”
“তুমি যা দেখছো, আমি তারচেয়ে অনেক বেশি দেখতে পাই, লোকি। আমি এমনকি বিশ্ববৃক্ষ পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি,” হাইমডেল শেষ নিশ্বাসে বলল, “সুরটারের আগুন বিশ্ববৃক্ষকে স্পর্শ করতে পারে না আর দুজন মানব-মানবী ইগড্রাসীলের গুঁড়ির মধ্যে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছে। নারীটি হলো জীবন আর পুরুষটি হলো জীবন-তৃষ্ণা। তাদের বংশধরেরা আবার পৃথিবীকে মানুষে পূর্ণ করবে। এখনই সব শেষ নয়। আসলে শেষ বলে কিছু নেই। এটা শুধুমাত্র পুরাতন সময়ের সমাপ্তি, লোকি, আর নতুন এক সময়ের শুরু। মৃত্যুর পরই জীবন আসে। তুমি হেরে গেছ।”
লোকি কিছু বলতে চাইবে, কটু আর খোঁচা দেওয়া কোনো কথা, কিন্তু মৃত্যু তাকে গ্রাস করবে, তার সকল বুদ্ধি আর নিষ্ঠুরতাও বিদায় হবে, সে আর কিছুই বলতে পারবে না, আর কখনোই না। বরফে জমাট যুদ্ধক্ষেত্রে লোকি হাইমডেলের পাশে মরে পড়ে থাকবে।
তখন সুরটার, জ্বলন্ত দানব, যে সৃষ্টির শুরু থেকেই বর্তমান ছিল, সুবিশাল মৃত্যু উপত্যকার দিকে তাকাবে আর তার জ্বলন্ত তরবারি স্বর্গের দিকে উঁচু করে ধরবে। হাজারটা বনে একসাথে আগুন লেগে যাওয়ার মতো বিকট শব্দ হবে আর বাতাসে আগুন লেগে যাবে।
সুরটারের আগুনে সমস্ত দুনিয়া পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। সমুদ্রের পানি টগবগ করে ফুটতে ফুটতে বাষ্প হয়ে উড়ে যেতে থাকবে। আগুন শেষবারের মতো জ্বলে উঠবে আর তারপর নিভে যাবে। আকাশ থেকে তুষারের মতো কালো ছাই ঝরে ঝরে পড়বে।
সেই গোধূলিলগ্নে, যেই স্থানটিতে লোকি আর হাইমডেলের দেহ পড়ে ছিল, সেখানে কালো হয়ে যাওয়া মাটির ওপর ধূসর ছাইয়ের দুটি স্তূপ পড়ে থাকতে দেখা যাবে, সেগুলো থেকে ধোঁয়া উঠে ভোরের কুয়াশার সাথে মিশে যাবে। জীবিত আর মৃত সৈন্যদলের কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না, দেবতাদের স্বপ্ন, যোদ্ধাদের বীরত্ব, সবই ছাইয়ের মতো মিলিয়ে যাবে।
এর কিছু সময় পরই সমুদ্র জেগে উঠবে আর সমস্ত ভূমি ভাসিয়ে দেবে আর সব ছাই ধুয়ে নিয়ে যাবে। আর সূর্যবিহীন আকাশের নিচে জীবিত সকল প্রাণীর নাম ও নিশান চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
এভাবেই ছাই আর বন্যা, অন্ধকার আর বরফে দুনিয়া ধ্বংস হবে। এটাই দেবতাদের শেষ পরিণতি।
এভাবেই সবকিছু সমাপ্ত হবে। কিন্তু শেষের পরেই আবার শুরু আছে।
ধূসর সমুদ্রের পানির নিচ থেকে আবার ভূমি জেগে উঠবে।
সূর্যকে নেকড়ে খেয়ে ফেলবে কিন্তু সূর্যের কন্যা তার মায়ের স্থানে কিরণ দেবে। আর নতুন সূর্য আগের সূর্যের চেয়ে আরো উজ্জ্বল আলো বিকিরণ করবে, নতুন আর নবীন কিরণ নিয়ে।
দুই নারী-পুরুষ, জীবন আর জীবনতৃষ্ণা, এশ গাছের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসবে। তারা মাটিতে জন্মানো সবুজ গাছপালায় জমা শিশির পান করে বেঁচে থাকবে। আর তাদের ভালোবাসা থেকে নতুন মানব জাতির জন্ম হবে।
এসগার্ড ধ্বংস হয়ে যাবে কিন্তু তার স্থানে থাকবে ইডাভল, এসগার্ডের চেয়েও মনোরম।
ওডিনের দুই পুত্র ভিডার আর ভালি ইডাভলে পৌঁছাবে। তাদের পর সেখানে পৌঁছাবে থরের দুই পুত্র মোডি আর মাগনী। তার দুজনে মিলে মিওলনির বহন করে নিয়ে আসবে, তখন থর থাকবে না, তাই মিওলনির বহন করতে তাদের দুই ভাইয়ের প্রয়োজন হবে। পাতাললোক থেকে বান্ডার আর হড ফিরে আসবে আর তারা ছয়জন মিলে নবীন সূর্যের আলোয় বসে ঘটে যাওয়া সব ঘটনার রহস্যভেদের চেষ্টা করবে। ঘটনাগুলো অন্যভাবে ঘটলে শেষ পরিণতিটা ভিন্ন হতে পারত কি না, সেই বিষয়ে আলোচনা করবে। যা ঘটেছে তা কি অবশ্যম্ভাবী ছিল কি না, এই নিয়ে জল্পনাকল্পনা করবে।
আলোচনা তারা নেকড়ে ফেনরিরের কথা বলবে, যে চন্দ্র-সূর্যকে খেয়ে ফেলবে, করবে মিডগার্ডের সর্প জরমুনগুন্ডারকে নিয়ে, তারা লোকিকে স্মরণ করবে, যে দেবতাদের একজন ছিল, কিন্তু কখনোই তাদের আপন ভাবেনি, যে দেবতাদের রক্ষা করেছিল, একই সাথে তাদের ধ্বংসেরও কারণ হবে।
তারপর হঠাৎ বান্ডার বলে উঠবে, “দেখো, দেখো, ওইটা কী?”
“কোনটা কী?” জানতে চাইবে মাগনি।
“ঐ যে, লম্বা ঘাসের ভিতরে ওই চকমকি জিনিসিটা। দেখতে পাচ্ছ? আরে, আরেকটাও দেখা যাচ্ছে।”
তারা হাঁটু গেড়ে লম্বা ঘাসের ওপর বসবে।
মাগনী সবার প্রথমে একটা চকমকে জিনিস লম্বা ঘাসের মধ্যে খুঁজে পাবে, আর সাথে সাথেই বুঝতে পারবে জিনিসটা কী। ওটা একটা দাবা খেলার সোনালি ঘুটি, দেবতারা যখন জীবিত ছিল, তারা পরস্পরের সাথে দাবা খেলে সময় কাটাত। ঘুটিটা ওডিনের একটা ছোট মূর্তি, সিংহাসনে বসা, মানে ওটা দাবার রাজা।
তারা অন্য ঘুটিগুলোও খুঁজে পাবে। তারা থরকে খুঁজে পাবে, তার হাতে থাকবে মিওলনির। গেলারহর্ন মুখে হাইমডেলকে পাওয়া যাবে, রানিকে পাওয়া যাবে, সেটা হবে ওডিনের স্ত্রী ফ্রিগার মূর্তি।
বান্ডার একটা সোনালি ঘুটি তুলে ধরবে, “এটা তো তোমার মতো লাগছে,” তাকে বলবে মোডি।
“হ্যাঁ,” বলবে বোল্ডার। “এটা আমিই, অনেকদিন আগের আমি, যখন আমি এসির দেবতা ছিলাম।”
তারা ঘাসের মধ্যে অন্য ঘুটিগুলো সব খুঁজে পাবে, কিছু খুব সুন্দর, কিছু ততটা সুন্দর নয়। কালো মাটিতে গাঁড়া অবস্থায় তারা লোকি আর তার দৈতাকৃতি সন্তানদের খুঁজে পাবে। একটা তুষার দানবও পাওয়া যাবে। সুরটারকে পাওয়া যাবে, তার মুখ থাকবে জ্বলন্ত লাল।
অল্প সময়ের মধ্যে তারা একটা দাবা খেলার মতো সবগুলো ঘুটি খুঁজে পাবে। তারা খেলা শুরু করার জন্যে দেবতাদের দাবা খেলার টেবিলে ঘুটিগুলো সবগুলো সাজিয়ে নেবে। নবীন সূর্য চমৎকার বিকেলে দাবার সোনালি ঘুটিগুলোর ওপর তার আলো বিকিরণ করবে।
বান্ডার মুচকি হাসবে, যেমন করে আকাশে সূর্য হাসে, আর সে তার প্রথম ঘুটি সামনে বাড়াবে।
আর এভাবেই খেলাটা আবার শুরু হবে।
(সমাপ্ত)