রাক্ষুসে পাথর
বুড়ো মাঝি বলল, বাবু, বেড়াতে এসেছেন, বেড়িয়ে ফিরে যান৷ ওই দ্বীপে যাবেন না৷ ওখানে দোষ লেগেছে৷
আমরা একটু অবাক হলুম৷ দোষ লেগেছে মানে কী? দ্বীপের আবার দোষ লাগে কী করে?
বিমান বলল, বুড়ো কর্তা, তুমি যা টাকা চেয়েছ, তাই দিতে আমরা রাজি হয়েছি৷ তবু তুমি আমাদের নিয়ে যাচ্ছো না কেন? ওই দ্বীপে কি আছে!
বুড়ো মাঝি তার সাদা দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে বলল, কিছুই নেই৷ সেই কথাই তো বলছি৷ শুধু শুধু ওখানে গিয়ে কী করবেন?
বুড়ো মাঝি হাল ধরেছে, আর দাঁড় বাইছে তার নাতি৷ এই নাতির বয়েস তেরো চৌদ্দো বছর হবে, ওর নাম সুলেমান৷ সে কেমন যেন ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে৷
বুড়ো মাঝি যতই না বলছে, ততই আমাদের জেদ চেপে যাচ্ছে৷ একটা সাধারণ দ্বীপ, সেখানে কি এমন ভয়ের ব্যাপার থাকতে পারে? কত জাহাজ যাচ্ছে এখান দিয়ে, সেরকম কিছু থাকলে সবাই জানতে পারত৷
হলদিয়াতে বিমানের দাদা চাকরি করে৷ আমি আর বিমান কয়েকদিনের জন্য এসেছি এখানে বেড়াতে৷ হলদিয়া জায়গাটা বেশ সুন্দর৷ নতুন বন্দর নতুন শহর গড়ে উঠেছে৷ চারিদিকে সবই নতুন নতুন বাড়ি আর অনেক ফাঁকা জায়গা৷ শহরটার একদিকে গঙ্গা আর একদিকে হলদি নদী৷
সকালবেলা নদীর ধারে জেলেরা মাছ বিক্রি করতে আসে৷ মাছ কিনতে গিয়েছিলুম৷ ঘাটে অনেকগুলো নৌকো বাঁধা৷ নৌকো দেখেই আমাদের মনে হল, একটা নৌকো ভাড়া করে নদীতে বেড়িয়ে এলে কেমন হয়৷ একজন মাঝিকে জিজ্ঞেস করতেই সে রাজি হয়ে গেল৷ তিরিশ টাকা দিলে সে যতক্ষণ ইচ্ছে আমাদের ঘুরিয়ে আনবে৷
আমি আর বিমান দু’জনেই সাঁতার জানি, সুতরাং আমাদের জলের ভয় নেই৷ বিমান তো সুইমিং কমপিটিশনে অনেকবার প্রাইজ পেয়েছে!
আমি আগেই শুনেছিলাম যে হলদিয়ার কাছে একটা দ্বীপ আছে, তার নাম আগুনমারির চর৷ আগে সেই চরটা মাঝে মাঝে ডুবে যেত আবার মাঝে মাঝে জেগে উঠত৷ এখন আর ডোবে না৷ এখন সেখানে গাছপালা জন্মে গেছে৷ কোনো মানুষজন অবশ্য সেখানে এখনো থাকে না৷
নৌকো দেখেই আমার ওই দ্বীপটার কথা মনে এসেছিল৷ নতুন দ্বীপ মানেই তো নতুন দেশ৷ ওখান থেকে ঘুরে এলেই একটা নতুন দেশ দেখা হয়ে যাবে৷ অনেকদিন বাদে, যখন ওই দ্বীপেও অনেক ঘরবাড়ি হয়ে যাবে, কলকারখানা বসবে, তখন আমরা বলব, জানো, যখন আমরা আগুনমারিতে গিয়েছিলুম, তখন এসব কিছু ছিল না, শুধু গাছপালা, আর….৷
গাছপালা ছাড়া আর কী আছে সেই দ্বীপে; বুড়ো মাঝি ভয় পাচ্ছে কেন!
নৌকোয় চড়বার সময় মাঝিদের কক্ষনো চটাতে নেই৷ সেইজন্য আমি অনুনয় করে বললুম, ও বুড়ো কর্তা বলো না সেখানে কী আছে? কেন আমাদের যেতে বারণ করছ?
বুড়ো মাঝি বলল, কিছু নেই তো বলছি গো বাবু, শুধু কয়েকটা গাছ আর বালি৷ আর ওই শামুক ঝিনুক ভাঙা৷
বিমান বলল, তাহলে আমাদের সেখানে নিয়ে যেতে চাইছ না কেন? সেখানে কি ভয়ের কিছু আছে?
বুড়ো মাঝি বলল, আকাশে মেঘ দ্যাখো না, বাবু৷ এখন আর অতদূরে যাওয়া ঠিক নয়৷ এই কিনারায় কিনারায় থাকা ভালো৷
বিমান বলল, তুমি কি আমাদের ছেলেমানুষ পেয়েছ? সামান্য মেঘ, এতে কখনো ঝড় ওঠে? তুমি আমাদের নিয়ে যেতে চাও না তাই বল৷
আমি বুড়ো মাঝির নাতিকে জিজ্ঞেস করলুম, সুলেমান তুমি গেছ সেই দ্বীপে? সেখানে ভয়ের কিছু আছে?
সুলেমান তার দাদুর দিকে তাকাল একবার৷ তারপর বলল, ভয়ের কিছু নেইকো! অন্য কিছু দেখা যায় না৷ তবে সেখানে গেলি যেন মনটা কেমন কেমন করে! মনটা খারাপ হয়ে যায়৷
এ তো আরও অদ্ভুত কথা! একটা দ্বীপে গেলে মন খারাপ হয়ে যায়? আমি আর বিমান দু’জনেই হেসে উঠলুম৷ তা হলে তো যেতেই হবে সেখানে৷
বুড়ো মাঝিকে বললুম, তুমি যদি না নিয়ে যেতে চাও তো আমাদের ফেরত নিয়ে চল৷ আমরা অন্য নৌকো ভাড়া করব৷
বুড়ো মাঝি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আপনাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি, সে টাকা ফেরত দেওয়া পাপ৷ তবে চলেন নিয়ে যাই৷ পরে যেন আমাকে দোষ দেবেন না৷ ওরে সুলেমান ভালো করে টান!
আকাশে মেঘ আছে বটে কিন্তু জমাট কালো নয়৷ সেই মেঘের ছায়া পড়েছে জলে৷ রোদ নেই, বেশ ছায়া ছায়া ছিল৷ নদীতে বড় বড় ঢেউ৷ এখানে নদী প্রায় সমুদ্রের মতন৷ এপার-ওপার দেখাই যায় না৷ পাশ দিয়ে জাহাজ কিংম্বা স্টিমার গেলে আমাদের নৌকোটা দুলে দুলে উঠছে৷
খানিকক্ষণ পরে বুড়ো মাঝি ডান দিকে হাত তুলে বলল, ওই যে দ্যাখেন, আগুনমারির চড়া৷ দেখলেন তো?
আমি আর বিমান দু’জনেই ঘাড় ফেরালুম৷ মনে হল নদীর বুকেই যেন কয়েকটা গাছ মাথা চাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ মাটি দেখা যাচ্ছে না৷
বুড়ো মাঝি বললে, দেখা হল তো? এবারে নৌকা ঘোরাই?
আমি আর বিমান একসঙ্গে বলে উঠলুম, সে কি, আমরা কাছে যাব না?
কাছে গিয়ে আর কী করবেন? আর তো দেখার কিছু নাই!
বিমান এবারে বেশ রেগে গিয়ে বলল, তোমার মতলব কি বল তো, বুড়ো কর্তা? ওই দ্বীপে কি তোমার কোনো জিনিসপত্তর আছে? ওখানে আমাদের যেতে দিতে চাও না কেন?
বুড়ো মাঝি আমতা আমতা করে বলল, দেখা তো হলই, আরও কাছে গিয়ে লাভটা কী৷
বিমান বলল, লাভ-লোকসানের কথা নয়৷ আমরা ওই দ্বীপে নেমে হাঁটতে চাই৷
বুড়ো মাঝি এবারে খুব জোরে হাল ঘোরাতেই নৌকো তরতরিয়ে এগিয়ে গেল দ্বীপটার একেবারে কাছে৷ দ্বীপে পৌঁছে নৌকোটার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বুড়ো মাঝি বলল, এবারে নামুন৷
সেখানটায় অন্তত এক হাঁটু জল৷ তারপর কাদামাটি৷ বিমান বলল, আর একটু এগোও, এখানে নামব কি করে?
বুড়ো মাঝি এবার রাগে গড়গড়িয়ে বলল, আপনাদের বাবু এখানেই নামতে হবে৷ আমার নৌকো ওই চরের মাটি ছোঁবে না৷ ও মাটি অপয়া৷
বিমান আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, আমি বললুম, ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমরা এখানেই নামব৷
জুতো খুলে রাখলুম নৌকোয়৷ তারপর হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গুটিয়ে নেমে পড়লুম জলে৷ ছপছপ করে এগিয়ে গেলুম দ্বীপটার দিকে৷ বুড়ো মাঝি নৌকোটাকে আরো গভীর জলের দিকে নিয়ে গিয়ে ঝপাৎ করে নোঙর ফেলে দিল৷
দ্বীপটাতে ছাড়া ছাড়া গাছপালা রয়েছে৷ তারপর ধূ ধূ করছে বালি৷ সেই বালিতে কোথাও কোথাও ঘাস হয়েছে৷ একটা খড়ের চালাঘরও রয়েছে একপাশে৷ সেই ঘরে কিন্তু কোনো মানুষ নেই৷
কাদামাখা পায়ে ওপরে উঠে আমরা বালিতে পা ঘষে নিলুম৷ বিমান বলল, একটা ফ্ল্যাগ সঙ্গে নিয়ে এলে হত৷ তাহলে সেই ফ্ল্যাগটা পুঁতে আমরা এই দ্বীপটা দখল করে নিতুম৷
আমি বললুম, তা কি করে হবে৷ আগেই তো এখানে মানুষ এসেছে৷ দেখছিস না, ঘর রয়েছে?
আমরা ঘরটার কাছে গিয়ে দেখলুম, তার মধ্যে পাতা আছে একটা খাটিয়া৷ আর চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে শুকনো গোবর৷ জায়গাটায় বিচ্ছিরি গন্ধ৷
বিমান বলল, এখানে লোকেরা গরু চরাতে আসত৷ কিন্তু গরুগুলোকে নিয়ে আসত কী করে?
আমি বললুম, বড় বড় নৌকোয় করে নিয়ে আসত৷ আমি নৌকোয় করে গরু-মোষ পার করতে দেখেছি৷
তারা এখন আর আসে না কেন?
বর্ষাকাল এসে গেছে, সেইজন্য এখন আসে না৷ এ তো সোজা কথা!
দ্বীপটা কীরকম চুপচাপ লক্ষ করেছিস? কোনো শব্দ নেই৷
মানুষজন নেই৷ শব্দ হবে কী করে? তবু আমি কিন্তু একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি৷ কান পেতে শোন!
দু’জনেই চুপ করে দাঁড়ালুম৷ সত্যি খানিকটা দূরে গাছপালার আড়াল থেকে মাঝে মাঝে একটা ফোঁস ফোঁস শব্দ পাওয়া যাচ্ছে৷ কেউ যেন নিশ্বাস ফেলছে খুব জোরে৷ কোনো মানুষ অবশ্য অত জোরে নিশ্বাস ফেলতে পারে না৷
বিমানের মুখটা শুকিয়ে গেল৷ চোখ বড় বড় করে বলল, ওটা কিসের শব্দ বল তো সুনীল? সাপ নাকি?
আমি বললুম, সাপ অত জোরে ফোঁস ফোঁস করে?
সমুদ্রে বড় বড় অজগর সাপ থাকে শুনেছি৷ সমুদ্র থেকে যদি এখানে চলে আসে, ওই জন্যই বোধহয় মাঝিরা এখানে আসতে ভয় পায়৷
একটা অজগর সাপ থাকলেও সেটাকে মেরে ফেলতে পারত না? চল, এগিয়ে গিয়ে দেখি!
সঙ্গে লাঠি-ফাঠি কিছু একটা আনলে হত৷
ভয় পাচ্ছিস কেন, বড় সাপ তো আর তাড়া করে এসে কামড়াতে পারে না৷
ডান দিকের খানিকটা দূরে দু’তিনটে গাছের পাশে কিছুটা জায়গা ঝোপ- ঝাড়ের মতন৷ শব্দটা আসছে সেদিক থেকেই৷
আমরা গুটি গুটি পায়ে এগোলুম সেদিকে৷ শব্দটা মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে৷ কাছাকাছি গিয়ে আমিই ভয় পেয়ে বিমানের হাত চেপে ধরলুম৷ ঝোপের মধ্যে কী যেন বিশাল একটা জন্তু রয়েছে৷
বিমান বললে, ওটা তো একটা মোষ! কাত হয়ে শুয়ে আছে৷
এবারে আর একটু এগিয়ে আমরা মোষটার মাথাটা দেখতে পেলাম৷ দেখলেই বোঝা যায়, মোষটা মরে যাচ্ছে৷ মোষটার দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল৷ ওরকম করুণ চোখ আমি কখনো দেখিনি৷ মোষটা মাঝে মাঝে নিশ্বাস ফেলছে, তখন তার পেটটা ফুলে উঠছে৷ ওইটুকুতেই বোঝা যায় যে ও বেঁচে আছে৷
আমি বললুম, এত বড় একটা মোষ…কী হয়েছে ওর? সাপে কামড়েছে?
বিমান বলল, অসুস্থও হতে পারে৷ মোষেরাও তো অসুস্থ হয়৷
কিন্তু কোনো লোকজন নেই৷ একলা একলা একটা মোষ এখানে পড়ে আছে?
মোষের মালিক বুঝতে পেয়েছে, ও আর বাঁচবে না৷ সেইজন্য ওকে ফেলে রেখে চলে গেছে৷
আমরা আর ঝোপটার মধ্যে না ঢুকে এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগলুম৷ যতবার মোষটার নিশ্বাসের শব্দ শুনছি, ততবার মন খারাপ লাগছে৷
বিমান বলল, একটা জিনিস লক্ষ করছিস, এখানে গাছের পাতাগুলো কেমন যেন শুকনো শুকনো৷ এখন বর্ষাকালে তো গাছের পাতা শুকিয়ে যায় না!
আমি বললুম, গাছের ছাল খসে পড়েছে অনেক জায়গায়৷ এখানে তো জল নোনা, তাই বোধহয় গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকে না৷
বিমান বলল, বাজে বকিস না৷ সুন্দরবনে অত গাছ রয়েছে না? সেখানকার জল তো আরও বেশি নোনা৷ এখানকার গাছগুলোর বোধহয় কিছু একটা রোগ হয়েছে৷ ওটা কী রে?
ওটা তো পাথর!
আশ্চর্য তো! খুবই আশ্চর্য ব্যাপার!
কিসের আশ্চর্য?
তুই বুঝলি না? গঙ্গানদীর দ্বীপে পাথর আসবে কী করে!
কেন?
এখানে কি কোথাও পাহাড় আছে? এখানে এত বড় একটা পাথর কে নিয়ে আসবে?
পাথরটা এমনিতে খুবই সাধারণ৷ একটা মাঝারি ধরনের আলমারির সাইজের৷ যে-কোনো পাহাড়ি জায়গায় গেলে এরকম পাথরের চাঁই পড়ে থাকতে দেখা যায়৷ কিন্তু নদীর ওপরে একটা নতুন দ্বীপে ওরকম পাথর তো দেখতে পাওয়া স্বাভাবিক নয়!
আমরা পাথরটার কাছে গেলুম৷ সেটার গায়ে শ্যাওলা জমে গেছে৷ আমি পাথরটার গায়ে হাত দিয়ে বললুম, সমুদ্রের তলায় অনেক জায়গায় ডুবো পাহাড় থাকে৷ হয়তো গঙ্গার ওখানটাতেও ডুবো পাহাড় আছে৷ দ্বীপটা তৈরি হবার সময় পাথরটা উঠে এসেছে৷ বিমান হাঁটু গেড়ে বসে বলল, তোর কী বুদ্ধি! পাথর কি হালকা জিনিস যে জলের উপরে ভেসে উঠবে? তা ছাড়া দ্যাখ, এর তলায় কিছু ঘাস চাপা পড়ে আছে৷ এই দ্বীপটা হবার পরে কেউ পাথরটা এনেছে৷ কিন্তু শুধু শুধু এতবড় একটা পাথরকে এখানে বয়ে আনবে?
আমি পাথরটার গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বললুম, উল্কা নয় তো! অনেক উল্কার টুকরো পৃথিবীতে এসে পড়ে—
বলতে বলতে আমি মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে গেলুম৷
বিমান দারুণ ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, কী হল সুনীল! কী হল তোর?
আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলুম৷ আমিও অবাক হয়ে গেছি খুব৷ কী হল কিছুই বুঝতে পারছি না৷ এরকম তো আমার কখনো হয় না৷
বিমান আমায় ঝাঁকুনি দিয়ে বলতে লাগল, কী হল রে, কী হল?
আমি বললুম, জানি না৷ হঠাৎ কেমন মাথাটা ঘুরে গেল৷
চুপ করে বসে থাক, উঠিসনি!
আমার কিছু হয়নি৷
তবু বসে থাক৷ একটা জিনিস দ্যাখ, সুনীল, এই পাথরের নীচের ঘাসগুলো দ্যাখ? কেমন যেন খয়েরি হয়ে গেছে! ঘাস চাপা পড়লে হলদে হয়ে যায়, কিন্তু খয়েরি? তুই কখনো খয়েরি ঘাস দেখেছিস?
এ বোধহয় অন্য জাতের ঘাস!
পাশের এই গাছটা দ্যাখ৷ এই গাছটার গা-টা লাল৷ আমি লাল রঙের গাছও কখনো দেখিনি৷
বিমান ওই যে মোষটা মরে যাচ্ছে, ওর জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে!
আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে রে! এমনি এমনি একটা মোষ মরে যাচ্ছে, ইস! মোষটাকে ওর মালিক কেন যে ফেলে গেল!
বিমান, আমার ইচ্ছে করে এখানে শুয়ে পড়তে!
মন্দ বলিসনি৷ এখানে খানিকক্ষণ শুয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিলে বেশ হয়৷
যদি নৌকোটা চলে যায়৷
ইস গেলেই হল, পুরো পয়সা দিয়েছি না? তা ছাড়া যদি যায় তো চলে যাক! আমরা এখানেই থেকে যাব!
হঠাৎ আমি লাফিয়ে উঠে পড়লুম৷ দারুণ জোরে চেঁচিয়ে উঠলুম, বিমান, বিমান, এই পাথরটা জ্যান্ত৷
বিমান বলল, কী বলছিস? তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
না রে, আমি সত্যি দেখলুম! পাথরটা নড়ে উঠল৷
কী বলছিস যা-তা! পাথরটা নড়বে কী করে?
আমি স্পষ্ট দেখলুম; পাথরটার পেটের কাছে একবার যেন চুপসে গেল, আবার ফুলে উঠল৷ ঠিক ব্যাঙের মতন!
দূর, পাথরের আবার পেট কী? তুই ভুল দেখেছিস!
মোটেই ভুল দেখিনি!
বিমান গিয়ে পাথরটার গায়ে হাত দিতেই আমি বিমানের অন্য হাতটা ধরে এক হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে আনলুম ওকে৷ আমার বুকের মধ্যে দুম দুম আওয়াজ হচ্ছে৷ ওই পাথরটার গায়ে হাত দিয়েই আমি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলুম৷ ওই পাথরটার কিছু একটা ব্যাপার আছে!
দূরে শুনতে পেলুম বুড়ো মাঝি আর সুলেমান চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকছে, বাবু! বাবু!
আমি বললুম, চল, বিমান, নৌকোয় ফিরে যাই!
বিমান বলল, নাঃ এক্ষুনি যাব না! এখানে শুয়ে থাকব বললুম যে!
না, আমার মোটেই ভালো লাগছে না! চল, নৌকোয় ফিরে যাই!
বিমানকে প্রায় জোর করেই আমি টানতে টানতে নিয়ে চললুম৷ তারপর নৌকোয় উঠেই বুড়ো মাঝিকে বললুম, চল, শিগগির চল!
নৌকোয় উঠে বিমান লম্বা হয়ে শুয়ে রইল৷ তার চোখ দুটো ছলছল করছে৷ ভাঙা গলায় বলল, আমার কিছুই ভালো লাগছে না রে!
সুলেমান আমাদের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে৷ আমি তাকে জিজ্ঞেস করলুম, ওই দ্বীপে গেলে তোমাদের কী হয় বলো তো?
সুলেমান বলল, কী জানি, বাবু! ওখানে গেলেই মনটা যেন কেমন কেমন করে৷ কাজ করতে ইচ্ছে করে না৷ শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে৷
বুড়ো মাঝি বলল, বাবু৷ আগে তো আমরা ওই চরে যেতাম! বেশি ঝড়, বৃষ্টি হলে ওখানে নৌকো বেঁধে চালাঘরটায় বসে জিরোতাম৷ অনেক লোক আগে ওখানে গরু-মহিষ চরাতে আসত৷ এখন আর কেউ যায় না৷
কেন যায় না বল তো?
ওখানে গেলেই শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে৷ গরু-মোষগুলোও আলসে হয়ে পড়ে৷ কেমন যেন মনমরা লাগে!
আমাদেরও সেই রকম লাগছিল৷ কিন্তু কেন হয় ওরকম বল তো?
কী জানি! গাছ-পালাগুলোও কেমন ধারা শুকিয়ে যাচ্ছে দেখলেন না? ও দ্বীপে খারাপ নজর লেগেছে৷
ওখানে একটা বড় পাথর আছে দেখেছ! আগে ওটা ছিল?
না, আগে ছিল না! এই তো মাসখানেক ধরে দেখছি৷
কী করে পাথরটা ওখানে এল!
কেউ তা জানে না৷ কেউ কেউ বলে ওটা আকাশ থেকে খসে পড়েছে!
আমার মাথাটা এখনও দুর্বল লাগছে৷ আমি আর কথা বলতে পারলুম না৷ শুয়ে পড়লুম বিমানের পাশে৷
হলদিয়ায় ফিরে এসে আমরা দু’জনেই সোজা চলে গেলুম বিছানায়৷ রাত্তিরে কিছু খেতেও ইচ্ছে করল না৷ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নানারকম দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগলুম৷ তার মধ্যে বারবারই দেখতে লাগলুম সেই পাথরটাকে৷ ঠিক একটা ব্যাঙের মতো তার পেটটা একবার চুপসে যাচ্ছে৷ একবার ফুলছে৷ একটা জ্যান্ত পাথর৷ আমি শিউরে শিউরে উঠতে লাগলুম৷
সকালবেলা বিমানের দাদা স্বপনদা জিজ্ঞেস করলেন, তোদের কাল কী হয়েছিল? সন্ধে থেকে খালি ঘুমোচ্ছিলি?
স্বপনদাকে সব কথা বলতেই হল৷ স্বপনদা সবটা শুনে হো-হো করে হেসে উঠে বলল, গাঁজাখুরি গল্প বলার আর জায়গা পাসনি! একটা জ্যান্ত পাথর…সেটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালে মন খারাপ হয়ে যায়, শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে৷ দূর! যত সব!
বিমান বলল, দাদা আমি পাথরটাকে নড়তে দেখিনি! সুনীল দেখেছে কিন্তু আমারও ওখানে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল!
বেশ করেছিল! শুয়ে থাকলেই পারতিস!
তাহলে আমাদেরও নিশ্চয়ই ওই মোষটার মতো অবস্থা হত!
আমি বললুম, স্বপনদা, নৌকোর মাঝিরাও কেউ ওই দ্বীপটায় এখন যেতে চায় না৷ ওরাও ভয় পায়৷ পুলিশে একটা খবর দেওয়া দরকার৷
স্বপনদা বললেন, পুলিশও তোদের কথা শুনে আমার মতন হাসবে৷ দেখবি, মিঃ দাসকে ডাকব?
হলদিয়ার ডি এস পি মিঃ দাস স্বপনদার বন্ধু৷ স্বপনদা তাঁকে টেলিফোনে ডেকে পাঠালেন, মিঃ দাস একবার আমার বাড়িতে চলে আসুন, ব্রেকফাস্ট খেয়ে যাবেন৷ আর একটা মজার গল্প শোনাব৷
দশ মিনিটের মধ্যে মিঃ দাস এসে গেলেন৷ তিনি বললেন, শুধু এক কাপ চা খাব৷ বড্ড কাজ পড়েছে, এক্ষুনি যেতে হবে৷ কাল রাত্তিরে একটা লঞ্চডুবি হয়েছে গঙ্গায়!
স্বপনদা বললেন, বসুন, বসুন৷ কাল দুপুরে এই দুই শ্রীমান নৌকা ভাড়া করে গিয়েছিল আগুনমারির চরে৷ সেখানে নাকি ওদের এক সাঙ্ঘাতিক অভিজ্ঞতা হয়েছে৷ ওরা দু’জনে—
স্বপনদাকে থামিয়ে দিয়ে পুলিশ সাহেব আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা দু’জনে কাল আগুনমারির চরে গিয়েছিলে? আশ্চর্য ব্যাপার, ওই দ্বীপটার পাশেই তো কাল রাত্তিরে লঞ্চটা ডুবেছে৷ ঝড়-বৃষ্টি কিছু নেই৷ শুধু শুধু একটা লঞ্চ ডুবে যাওয়া খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার৷
স্বপনদা জিজ্ঞেস করলেন, কেউ মারা গেছে?
পুলিশ সাহেব বললেন, নাঃ৷ মরেনি কেউ৷ সবাইকে উদ্ধার করা গেছে৷ আমাদের পুলিশের লঞ্চ খুব তাড়াতাড়ি গিয়ে পৌঁছোয়৷ কিন্তু লঞ্চটা যে কী করে ডুবল, তা ওরা ঠিক ঠিক বলতে পারছে না৷ সবাই বলছে, কী যেন হল কিছুই জানি না৷ হঠাৎ একটা ধাক্কাতে লঞ্চটা কেঁপে উঠল, তারপরই হুড়মুড়িয়ে জল ঢুকতে লাগল৷
স্বপনদা বললেন, লঞ্চটা একদম ডুবে গেছে বলতে চান?
পুলিশ সাহেব বললেন, হ্যাঁ৷ সেটা তোলার ব্যবস্থা করতে হবে৷ ওই লঞ্চের একজন খালাসি শুধু অদ্ভুত একটা গল্প বলেছে৷ আগুনমারির চর থেকে একটা মস্ত বড় পাথর নাকি উড়ে এসে প্রচণ্ড জোরে লঞ্চটাকে ফুটো করে দেয়৷ এরকম গাঁজাখুরি কথা কেউ শুনেছে? গঙ্গার ওপরে দ্বীপ! সেখানে পাথর আসবে কী করে? যদি বা পাথর থাকে, সেটা কেউ না ছুড়লে এমনি এমনি উড়তে উড়তে আসবেই বা কী করে?
স্বপনদা বললেন, এরাও ওই দ্বীপে একটা বড় পাথর দেখেছে বলছে৷
পুলিশ সাহেব বললেন, ভোরবেলা আমি আমার লঞ্চে সেই দ্বীপটা ঘুরে দেখে এসেছি৷ সেখানে পাথর-টাথর কিছু নেই৷ মানুষজনের কোনো চিহ্ন নেই৷ শুধু একটা মরা মোষ রয়েছে দেখলুম৷
আমি আর বিমান চোখাচোখি করলুম৷ আগুনমারির চরের পাথরটাই যে লঞ্চটাকে ডুবিয়েছে, তাতে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই৷
—