রাক্ষসী
আরাম-আয়েশ ফুর্তি-ফার্তির কথা বলতে গেলেই ইংরেজকে ফরাসী শব্দ ফরাসী ব্যঞ্জনা ব্যবহার করতে হয়। ‘জোয়া দ্য ভিভ্র্’ (শুদ্ধমাত্র বেঁচে থাকার আনন্দ), ‘বঁ ভিভ্র্’ (আরামে আয়েশে জীবন কাটানো), ‘গুরমে’ (পোষাকি খুশখানেওলা), ‘কনেস্যর’ (সমঝদার, রসিকজন) এসব কথার ইংরিজি নেই। ভারতবর্ষে হয়তো এককালে ছিল, হয়তো কেন, নিশ্চয়ই ছিল—মৃৎশকটিকা, মালতীমাধব নাট্যে আরাম-আয়েশের যে চৌকশ বর্ণনা পাওয়া যায় তার কুল্লে মাল তো আর গুল-মারা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না—আজ নেই এবং তার কারণ বের করার জন্যও ঘেরণ্ড সংহিতা ঘাটতে হয় না। রোগশোক অভাব অনটনের মধ্যিখানে ‘গুরমে’ হওয়ার সুযোগ শতেকে গোটেক পায় কিনা সন্দেহ—তাই খুশ-খানা, খুশ-পিনা বাবদের কথাগুলো বেবাক ভারতীয় ভাষা থেকে লোপ পেয়ে গিয়েছে, নতুন বোল-তানের প্রশ্নই ওঠে না।
তবু এই ‘বঁ ভিভ্রের’ কায়দাটা এখনো কিছু জানে পশ্চিম ভারতের পার্সী সম্প্রদায়। খায়দায়, হৈ-হুল্লোড় করে, মাত্রা মেনে ফষ্টিনষ্টি ইয়ার্কি-দোস্তি চালায় এবং তার জন্য দরকার হলে ঋণং কৃত্বা নীতি মানতেও তাদের আপত্তি নেই। তাজ হোটেলে বসে মাসের মাইনে এক রাত্তিরে ফুকে-দেনেওলা বিস্তর পার্সী বোম্বাইয়েই আছে। আর গোলাপী নেশায় একটুখানি বে-এক্তেয়ার হয়ে কোনো পার্সী ছোকরা যদি ল্যাম্পপোস্টটাকে জড়িয়ে ধরে ভাই, এ্যাদ্দিন কোথায় ছিলি’ বলে ঝপাঝপ গণ্ডাদশেক চুমো খেয়ে ফেলে তাহলে তার বউ হয় স্ন্যাপশট তোলে, নয় ‘চ, চ, বাইরাম তোর নেশা চড়েছে বলে ধাক্কাধাক্কি দিয়ে বাড়ি নিয়ে যায়। পরদিন ক্লাবে বসে বউ পাগলা বাইরামের কীর্তি-কাহিনীতে বেশ একটুখানি নুন-লঙ্কা লাগিয়ে মজলিস গরম করে তোলে, আর বাইরামের বাপ গল্প শুনে মিটমিটিয়ে হাসে, ব্যাটার এলেম’ হচ্ছে দেখে আপন ঠাকুর্দার স্মরণে খুশি হয়ে দু ফোঁটা চোখের জল ফেলে।
গাওনা বাজনায় ভারি শখ। একদল বেটোফেন-ভাগনার নিয়ে মেতে আছে, আরেকদল বরোদার ওস্তাদ ফৈয়াজ খানের সাকরেদী করে। আর লান্না লালা লা’ গান গেয়ে নাকি বহু পাসী বাচ্চা মায়ের গর্ভ থেকে নেমে এসেছে।
অন্য কোনো সম্প্রদায় সম্বন্ধে এ-সব কথা বলতে আমি সাহস পেতুম না, কিন্তু পার্সীদের ঈষৎ রসবোধ আছে, তা সে সূক্ষ্মই হোক, আর স্কুলই হোক। আলাপ জমাতেও ভারি ওস্তাদ। বিদেশীকে খাতির করে ঘরে নিয়ে যায়, বাড়ির আর পাঁচজনকে নতুন চিড়িয়া দেখাবে বলে। তাকে কাঠি বানিয়ে সবাই মিলে তার চতুর্দিকে চর্কিবাজির নাচন তুলবে বলে।
তাই বরোদা পৌঁছবার তিনদিনের ভিতরই রুস্তম দাদাভাই ওয়াডিয়া গায়ে পড়ে আমার সঙ্গে আলাপচারী করলেন, বাড়ি নিয়ে গিয়ে বুড়ো বাপ, বউ, তিন ছেলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরের দিনই পার্সী সম্প্রদায়ের ধানসাক (আমাদের লুচিমণ্ডা) খাবার নেমন্তন্ন পেলুম। এবং সেদিনই খানা শেষে বললেন, আসছে রোববার সন্ধ্যেয় বোমানজী নারিমানের দু’ছেলের নওজোত। আপনার নেমন্তন্ন রয়েছে। আসবেন তো?
আমি তো অবাক। এ দুনিয়ায় পার্সী বলতে আমি মাত্র এই.ওয়াডিয়া পরিবারকেই চিনি। বোমানজী নারিমান লোকটি কে, এবং আমাকে নেমন্তন্ন করতে যাবেই বা কেন? আমি বললুম, নারিমানকে তো চিনিনে।
ওয়াডিয়া বললেন, চিনে আপনার চারখানা হাত গজাবে নাকি (পার্সীরা ইয়ার্কি না করে কথা কইতে পারে না)? খাওয়ায় ভালো-সেইটে হল আসল কথা। এই নিন আপনার কার্ডও দিয়েও আপনার চারখানা হাত গজাবে না। আপনি ভাববেন না আমি নারিমানের দোরে ধন্না দিয়ে এ কার্ড বের করেছি। আপনার সঙ্গে আমাদের জমে গিয়েছে নারিমান সেটা নিজের থেকেই জানতে পেরে কার্ডটা পাঠিয়ে দিয়েছে। না পাঠালে অবিশ্যি আমি একটুখানি নল চালাতুম—আপনার মতো গুণীকে বাদ দিয়ে—
আমি বাধা দিয়ে বললুম, ‘আমি গুণী!
ওয়াডিয়া বললেন, ‘বাঁধা ছালার দাম পঁচিশ লাখ। দু দিন বাদে সব শালা (পার্সীরা এই শব্দটি প্রায় সবকথার পিছনেই লাগায়) আপনাকে চিনে নেবে, কিছু ভয় নেই। তদ্দিন দু পেট খেয়ে নিন। নারিমানের ছেলেদের নওজোতের পরে আসছে সোরাবজীর মেয়ের বিয়ে, তারপর আসছে—
আমি জিজ্ঞেস করলুম, নওজোত পরবটা কী?
বললেন, ‘এলেই দেখতে পাবেন। হিন্দুদের যেমন পৈতে হয়, পার্সীদের তেমনি নওজোত। শুধু কস্তি’ অর্থাৎ পৈতেটা বাঁধতে হয় কোমরে, আর সঙ্গে পরতে হয় একটি ছোট্ট ফতুয়া—তার নাম সদরা। এই ‘কস্তি’-‘সদরা’ দুয়ে মিলে হল পার্সীদের দ্বিজত্বপ্রাপ্তি।
ওয়াডিয়ার বউ রৌশন বললেন, যত্ত সব সিলি সুপারস্টিশনস!
রুস্তম বললেন, লঙ লিভ সচ সুপারস্টিশনস। এদেরই দৌলতে দু মুঠো খেয়ে নিই। শালা বোমানজীর পেটে বোমা মারলেও সে এক পেট খাওয়ায় না। তার বাপ শালা (সবাই শালা!) বিয়ে করেছিল বিলেতে, শ্যাম্পেনটা-কেকটা ফাঁকি দেবার জন্য।
পার্সীদের পাল্লায় পড়লে বুঝতেন। রোববার বিকেলবেলা রুস্তম বউ, বেটাবাচ্চা নিয়ে গাড়ি করে আমার বাড়িতে উপস্থিত—পাছে আমি ফাঁকি দিই।।
গাড়িতে বসে বললেন, ‘পার্সীদের কী নাম দিয়েছে আর সব গুজরাতিরা জানেন? কাগড়া’ অর্থাৎ ক্রো। তার প্রথম কারণ, আমরা কালো কোট টুপি পরি, দ্বিতীয় কারণ পাঁচটা পার্সী একত্র হলেই কাকের মতো কিচিরমিচির করি, তৃতীয় কারণ কাকের মতো খাদ্যাখাদ্য বিচার করিনে—জানেন তো আর সব গুজরাতিরা শাকখেকো—চতুর্থ কারণ আমাদের নাকটা কাকের মতো বাঁকানো, আর শেষ কারণ মরে গেলে কাকে আমাদের মাংস খায়। তারপর হো-হো করে খুব খানিকটা হেসে বললেন, ‘গুজরাতিদের রসবোধ নেই সবাই জানে, কিন্তু এ রসিকতাটা মোক্ষম।
আমি বললুম, সব হিন্দুই একবার স্মোক করে, সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস থাক আর নাই থাক, সেটা জানেন?
বললেন, কী রকম?
তাদের তো পোড়ানো হয়, দেন দে স্মোক।
কশফদরৌশন বললেন, ‘তবু ভালো, শকুনির ছেড়াঘেঁড়ির চেয়ে স্মোক করা ঢের ভালো।
আমি বললুম, ‘কেন? চারটে শকুনি যদি এক পেট খেতে পায় তাতে আপত্তিটা আর কী? এই আপনাদের বোমানজী যদি জ্যান্ত অবস্থায় কাউকে খাওয়াতে না চায় তবে না হয় মরে গিয়েই খাওয়ালো।
রৌশন বললেন, আপনি জানেন না তাই বলছেন। বোম্বায়ে টাওয়ার অফ সায়লেন্সের আশপাশের কোনো বাড়িতে কখনো বাসা বাঁধলে জানতেন। একটা শকুনি হয়তো একটা মরা বাচ্চার মাথাটা নিয়ে উড়ে যাচ্ছে আপনার বাড়ির উপর দিয়ে, আরেক শকুনির সঙ্গে লাগলো তখন তার লড়াই। ছিটকে পড়ল মুণ্ডুটা আপনার পায়ের কাছে, কিংবা মাথার উপরে। ভেবে দেখুন তো অবস্থাটা। তিন বছরের বাচ্চার মুণ্ডু, গলাটা ছিঁড়েছে শকুনে—’
আমি বললুম, ‘থাক, থাক।’ কিন্তু আশ্চর্য, ওয়াডিয়ার বাচ্চা দুটো শিউরে উঠলো না কিংবা মাকে এ সব বীভৎস বর্ণনা দিতে বারণ করল না। অনুমান করলুম, এরা ছেলেবেলা থেকেই এ-বিষয়ে অভ্যস্ত।
নওজোত অনুষ্ঠান হচ্ছিল একটা প্ল্যাটফর্মের উপর। সাদা জাজিমে মোড়া। দুটি আটন বছরের বাচ্চা দাঁড়িয়ে, আর চারজন দস্তুর’ (পুরোহিত) আবেস্তা, পহুবী ভাষায় গড়গড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। এককালে যজ্ঞোপবীত দেবার সময় পুরোহিত ছেলেটাকে মন্ত্রোচ্চারণ দিয়ে বোঝাতেন যজ্ঞোপবীতের দায়িত্ব কী, আজ যে সে উপবীত ধারণ করতে যাচ্ছে তার অর্থ-মায়ের কোল আর খেলাধুলো তার জন্য শেষ হল, সে আজ সমাজে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এখন কটা ছেলে এ সব বোঝে তা জানিনে, কিন্তু এটা স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, নওজোত’-ও উপনয়নের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে—যে মন্ত্র উচ্চারণ করা হচ্ছে তার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ হচ্ছে।
ফিসফিস করে কথা বলতে মানা নেই। আমি রুস্তমকে আমার গবেষণামূলক তত্ত্ব চিন্তাটি অতিশয় গাম্ভীর্য সহকারে নিবেদন করাতে তিনি বললেন, আপনার তাতে কী, আমারই বা তাতে কী? রান্নাটা ভালো হলেই হলো।
বুঝলুম, ইতর জনের জন্য মিষ্টান্ন’—প্রবাদটি সর্বদেশে প্রযোজ্য।
নওজোত শেষ হয়েছে আর সঙ্গে সঙ্গে নামল ঝমাঝঝম বৃষ্টি। অকালে এ রকম বৃষ্টির জন্য কেউ তৈরি ছিলেন না। নিমন্ত্রিত-রবাহূত সবাই ছুটে গিয়ে উঠলেন বাড়ির বারান্দায়। তারপর বৃষ্টির ঝাপটা খেয়ে, একদল ড্রইংরুমে, আরেক দল ডাইনিং রুমে, আত্মীয়-কুটুমরা বেডরুমে ঢুকলেন। আমাকে রুস্তম নিয়ে গেলেন ছোট্ট একটা কুঠুরিতে, বোধ হয় বাচ্চা দুটোর পড়ার ঘর।
আমরা জনা বারো সেই কুঠুরিতে কাঁঠাল-বোঝাই হয়ে বসলুম। সকলের শেষে এসে ঢুকলেন এক বুড়ো পার্সী দু’বগলে দু’বোতল মদ নিয়ে। আমরা কয়েকজন হিন্দু-মুসলমান নিরামিষ ছিলুম, আমাদের জন্য এল আইসক্রীম, লেমনেড।
বুড়ো একটা বোতল ছেড়ে দিলেন মজলিসের জন্য। অন্য বোতলটা নিজে টানতে লাগলেন নির্জলা। বিলেতে পালা-পরবে, ঘরে-বাইরে সর্বত্রই মদ খাওয়া হয়, তাই আমি এন্তার মদ খাওয়া দেখেছি। কিন্তু দশ মিনিট যেতে না যেতেই বুঝলুম, এ বুড়ো তালেবর ব্যক্তি। শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণে পেশাদারী ব্রাহ্মণের পাইকারি বহান্ন ভক্ষণের মতো এর পাইকারি পান দ্রষ্টব্য বস্তু।
মদ খেলে কেউ হয়ে যায় ঝগড়াটে, কেউ বা আরম্ভ করে বদ রসিকতা, কেউ করে খিস্তি, কেউ হয়ে যায় যীশুখ্রষ্ট-দুনিয়ার তাবৎ দুঃখকষ্ট সে তখন আপন স্কন্ধে তুলে নিতে চায়, আর সবাইকে গায়ে পড়ে টাকা ধার দেয়। পরের দিন অবশ্য চাকরের উপর চালায় চোট-পাট, ভাবে (পার্সী হলে) ঐ শালাই মোকা পেয়ে টাকাটা লোপাট মেরেছে।
আমি গিয়েছিলুম এক কোণে, দেয়ালে হেলান দিয়ে বসব বলে। বোতলটি আধঘন্টার ভিতর শেষ করে বুড়ো এসে বসলেন আমারই পাশে। আমি একটু সঙ্কুচিত হয়ে স্থান করে দিলুম। বুড়ো শুধদলেন, আপনি এশহরে নতুন এসেছেন? আমি কীর্তিটা অস্বীকার করলুম না। বললেন, তাই ভাবছেন আমি মাতাল?
বুঝলুম ইনি যীশুখ্রীষ্ট টাইপ নন, ইনি হচ্ছেন মেরি ম্যগডলীন টাইপ। অনুশোচনায় ক্ষতবিক্ষত। বললুম, কই আপনি তো দিব্য আর পাঁচজনের মতো কথা কইছেন!
বললেন, এক বোতলে আমার কিছু হয় না, পাঁচ বোতলেও কিছু হয় না, দশ বোতলেও না—যদিও অতটা কখনো খেয়ে দেখিনি।
সত্যি লোকটার গলা সাদা, চোখের রঙ থেকেও বিশেষ কিছু অনুমান করা যায় নাবুড়োবয়সের ঘোলাচোখে রঙের ফেরফার সহজে ধরা পড়ে না। পাকা বাঁশে তেল লাগালেও একই রঙ।
বললুম, তাহলে না খেলেই পারেন।
বললেন, ‘খাই না তো, হঠাৎ ও রকম অকালে বৃষ্টি না নামলে।
মদ খাওয়ার নানা অজুহাত বাজারে চালু আছে। এটা নতুন। বৃষ্টির জলের সঙ্গে নামল বটে, কিন্তু ধোপে টিকবে না। বললুম হু’।
আপনিও খেতেন।
‘? ? ? ?’
‘সে অবস্থায় পড়লে।’
আমি শুধালুম, ‘কোন অবস্থায়?’ তারপর বললুম, ‘কিন্তু আপনি আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করছেন কেন? বিশেষত আপনার ধর্মে যখন ও জিনিস বারণ নয়।’
‘আপনাকে বোঝাবার চেষ্টা করছি কারণ আর সবাই জানে—
আমি বললুম, তাহলে বলুন।
বললেন, ‘রুস্তম বলছিল, আপনি নাকি পুব-ভারতের লোক, পার্সীদের আচারব্যবহার পালা-পরব সম্বন্ধে কিছুই জানেন না। টাওয়ার অফ সায়লেন্স কাকে বলে জানেন?
আবার ‘মৌন শিখর’! বললুম, আজই প্রথম শুনেছি।
বললেন, ‘কুয়োর মতো গোল করে গড়া হয়। আর দেয়ালের ভিতরের দিকে বড় বড় শেলফের মতো কুলুঙ্গি বা নিশ’ কাটা থাকে। সেগুলোর উপর মড়াকে বিবস্ত্র করে শুইয়ে দেওয়া হয়। বোম্বাই-টোম্বাই অঞ্চলে বিস্তর শকুনি ওত পেতে বসে থাকে, তিন মিনিটের ভিতর হাড্ডিগুলো ছাড়া সব কিছু সাফ করে দেয়। কিন্তু ভিতরে গিয়ে এসব দেখবার হুকুম নেই। একমাত্র শববাহকই ভিতরে যায়। এই যে নওজোতের সময় ‘দস্তুর’দের দেখলেন তেমনি পার্সীদের ভিতরে বিশেষ ‘শববাহক’ সম্প্রদায় আছে। টাওয়ার অফ সায়লেন্সের ভিতর যা কিছু করার তারাই সব করে। এমন কি ‘দস্তুর’দেরও ভিতরে যাওয়া বারণ।
আমার জন্ম মধুগাঁয়ে, সেখানেই প্রায় সমস্ত জীবন কাটিয়েছি। মধুগাঁও সি. পি.-তে। আ’নি কখনো যাননি? তাহলে বুঝতেন গ্রীষ্মকালে সেখানে কী রকম গরম পড়ে। আর সে গরম একদম শুকনোবোন-ড্রাই। দেয়ালের কেলেন্ডার বেঁকে যায়, বইয়ের মলাট বাঁকতে বাঁকতে কেতাব থেকে খসে পড়ে, টেবিলটা পর্যন্ত পিঠ বাঁকিয়ে বেড়ালটার মতো লড়াইমুখো হয়ে ওঠে। এমনকি মানুষদেরও রসকষ শুকিয়ে যায়। হাতাহাতির ভয়ে গরমের দিনে একে-অন্যে কথাবার্তা পর্যন্ত হয় নিক্তি-মেপে।
সেই গরমে মারা গেল এক আশী বছরের হাড্ডিসার বুড়ি। আমার ছেলেবেলায় তিনি ছিলেন যুবতী–বকা ছোঁড়ারা তখনই তার নাম দিয়েছিল ‘ঝরাপাতা’, ‘কুকুরের জিভ’। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুকোতে শুকোতে শেষ পর্যন্ত রইল চামড়ায় জড়ানো খানকয়েক হাড্ডি। আর স্বভাব ছিল এমনি খিটখিটে যে আমরা পারতপক্ষে তার বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে যেতুম না। বিশ্বাস করবেন না, বেটি বারান্দায় বসত এক গাদা নুড়ি নিয়ে। কেউ ভুলেও তার বাড়ির সামনে দাঁড়ালে নুড়ি ছুঁড়তে আরম্ভ করত তাগ করে আর সে কী মোক্ষম তাগ! ‘প্র্যাকটিস মেকস পার্ফেক্ট’ রচনায় এক ছোঁড়া বুড়ির উদাহরণ দিয়ে আমার কাছ থেকে ফুলমার্ক পেয়েছিল।
বুড়ির ত্রি-সংসারে কেউ ছিল না, প্রকাণ্ড একটা কুকুর ছাড়া। কিন্তু কুকুরটার উপর তো আর বুড়ির শেষ ক্রিয়ার ভার ছেড়ে দেওয়া যায় না। ভারটা পড়লো আমাদের ঘাড়েই। মহাবিপদে পড়ল মধুগাঁয়ের পার্সী সম্প্রদায়।
এককালে মধুগাঁয়ে বিস্তর পাসী বসবাস করতো বলে তারা শহরের মাইলখানেক দূরে ভাল টাওয়ার অফ সায়লেন্স বানিয়েছিল। আপন শববাহক’ও জনআষ্টেক ছিল। কিন্তু সে হল সত্তর-আশি বৎসরের কথা। ইতিমধ্যে পার্সী সংখ্যা ক্রমে-ক্রমে কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র দশ-বারোটি পরিবারে। তাই মৃত্যুর হার এসে দাঁড়িয়েছে বছরে এক কিংবা তার চেয়েও কম। টাওয়ার অফ সায়লেন্সের শকুনগুলো পর্যন্ত পালিয়েছে না খেয়ে মরমর হয়ে। মানুষের বুদ্ধি শকুনের চেয়ে বেশি, তাই শববাহকের দল শকুনগুলোর বহুপূর্বেই মধুগাঁও ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
তাই সমস্যা হল বুড়িকে বয়ে নিয়ে যাবে কে? এসব ব্যাপারে পার্সীরা বামুনদের চেয়ে তিনকাঠি বেশি গোঁড়া। শববাহক’ না হলে তো চলবে না—বরঞ্চ পার্সী সম্প্রদায় নিশ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করে তিন দিন কাটিয়ে দেবে তবু শববাহক’ ভিন্ন কেউ মরা ছুঁতে পারবে না।
টেলিগ্রাম করা হল এক আঁটা—চতুর্দিকের পার্সীদের কাছে, পাসী-ধর্ম লোপ পায়, পার্সী-ঐতিহ্য গেল গেল, তোমরা সব আছো কী করতে, চারটে শববাহক না পেলে মধুগাঁও উচ্ছন্নে যাবে, সৃষ্টি লোপ পাবে।
শববাহকেরা শেষটায় এল। এক ছোকরা দস্তুর’ তখনো মিসিং লিঙ্কের ন্যাজের মতো খসি-খসি করে মধুগাঁয়ের পশ্চাদ্দেশে ঝুলছিল, সে মন্তর-ফন্তরগুলো সেরে দিলে— হোলি জিসসই জানেন তার কতটা শুদ্ধ কতটা ভুল।
সেই মার্চ মাসের আগুনের ভিতর দিয়ে চারটে শববাহক, দস্তুর’জী আর আমারই মতো আরো দুই মুখ গেলুম টাওয়ার অফ সায়লেন্সে। গেটের কাছে শববাহক ছাড়া আর সবাইকে দাঁড়াতে হল। একটা গাছ পর্যন্ত নেই যার ছাওয়ায় একটু কম গরম হই। সান্ত্বনা এইটুকু যে শববাহকেরা রেকর্ড টাইমের ভিতর বেরিয়ে এল। গেটে তালা মেরে আমরা সবাই ধুকতে ধুকতে শহরে ফিরে এলুম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলুম আর যদি কখনো ঐ হতভাগা টাওয়ারে যেতে হয় তবে যাব, শেষবারের মততা, শববাহকদের কাঁধে চেপে।
কিন্তু খুদার কেরামতির কে ভেদ করবে বলো? তিন মাস যেতে না যেতে মরলেন আমার বিধবা পিসি—বাবা বিদেশে, মা বহুকাল পূর্বেই গত হয়েছেন। বাড়িতে সোমখ আর কেউ নেই। আমি পাগলের মতো শববাহকের সন্ধানে দুনিয়ার চেনা-অচেনা সবাইকে তার করলুম। মে মাসের অসহ্য গরম পড়েছে আকাশ ভেঙে—মধুগয়ে যে ক’ ফোঁটা বিষ্টি হয় সে জুলাই মাসে, তার পূর্বে ও-মুলুকে কখনো মেঘ করেনি, বৃষ্টি ঝরেনি। ধরণী যে ঠাণ্ডা হবেন তার কোনো আশা-ভরসা নেই জুলাই মাস পর্যন্ত। দস্তুরটিও ইতিমধ্যে ন্যাজটার মতো খসে পড়েছেন, তারই বা সন্ধান পাই কোথায়?
ভাগ্যিস, আমি ইস্কুল মাস্টার। আমার ছেলেরা ছুটলো এদিক-ওদিককার শহরে। তারা সব হিন্দু, দু-একটি মুসলমান, কিন্তু গুরুর দায় বুঝতে পেরে কেউ সাইকেলে চড়ে, কেউ লোকাল ধরে এমনি লাগা লাগলো যে মনে হল তারা বুঝি কুয়েশচেন পেপার লীক হওয়ার সন্ধান পেয়েছে। ভগবান তাদের মঙ্গল করুন, সব কিছুরই ব্যবস্থা হয়ে গেল।
ছেলেদের বললুম, ‘বাবারা আমায় বাঁচালে। কিন্তু আর না। তোমাদের আর সঙ্গে আসতে হবে না। আর শোননা, এই গরমে যদি টাওয়ার যেতে-আসতে আমি মরি তাহলে আমাকে পুড়িয়ে ফেলল, না হয় গোর দিয়ো।
আমি বললুম, সে কী কথা!
আমার কথা যেন আদপেই শুনতে পাননি সেইরকম ভাবে বলে যেতে লাগলেন, ‘যেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কড়াইয়ে গরম তেল ফুটছে আর আমি তারই ভিতর সাঁতার কেটে কেটে টাওয়ারের দিকে চলেছি। এক পা ফেলি আর ভাবি এ-দুনিয়ায় এই শেষ পা ফেলা, পরের কদমেই দেখব জাহান্নমের বুকিং আপিসের সামনে কিউয়ে পৌঁছে গিয়েছি স্বর্গে যাওয়ার হলে ভগবান এই কড়াই-ভাজার প্র্যাকটিস কপালে লিখবেন কেন?
টাওয়ার অফ সায়লেন্সের সামনে এসে বসে পড়েছি। দস্তুর’জীর শেষ মন্ত্রোচ্চারণ আমার কানে এসে পৌচ্ছে যেন কোন দূরদূরান্ত থেকে। বোঝা-না-বোঝার মাঝখান দিয়ে যেন কিছু দেখছি, কিছু শুনছি। শববাহকেরা ক্লান্ত শ্লথ গতিতে মড়া নিয়ে টাওয়ারের ভিতর ঢুকল।
তার পরমুহূর্তেই আমার সমস্ত চৈতন্য ফিরে এল, টাওয়ারের ভিতর থেকে এক সঙ্গে অনেকগুলো তীব্র তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে। সে চিৎকারে ছিল মাত্র একটা জিনিস—ভয়! যারা চিৎকার করলো তারাই যে শুধু ভয় পেয়েছে তা নয়, সে চীৎকার যেন স্পষ্ট ভাষায় বললো, আর কারো নিস্তার নেই।
সঙ্গে সঙ্গে চারজন শববাহকের দুজন পাগলের মতো হাত-পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে এদিকওদিক টাল খেয়ে খেয়ে ছুটে বেরিয়ে এল গেট দিয়ে। একজন আমাদের দিকে তাকিয়েই একমুখ ফেনা বমি করে পড়ল ‘দস্তুর’জীর পায়ের কাছে, আরেকজন দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে সেইরকম টাল খেয়ে খেয়ে যে কোন দিকে চলল সে জানে না। দস্তুর’জীও একবার তার দিকে তাকান আরেকবার তাকান ভিরমি-যাওয়া লোকটার দিকে। টাওয়ারের ভিতর থেকে আর কোনো শব্দ আসছে না, কিন্তু যে পাগলটা ছুটে চলেছে সে চিৎকার করে করে যেন গলা ফাটিয়ে দিচ্ছে-সে কী অমানুষিক বীভৎস কণ্ঠস্বরের বিকৃত পরিবর্তন।
‘দস্তুর’জী আর আমি এমনি হতভম্ব হয়ে গিয়েছি যে আমাদের মাথায় কর্তব্যাকর্তব্য কিছুই খেলছে না, পা দুটো যেন মাটিতে শেকড় গেড়ে বসে গিয়েছে। হতভম্ব হয়ে গিয়েছি বললে অল্পই বলা হল, কারণ অদ্ভুত এক ভীতি আমাকে তখন অসাড় করে ফেলেছে।
কতক্ষণ এ রকম ধারা কাটলো আমার মনে নেই। আস্তে আস্তে মাথা সাফ হতে লাগল, কিন্তু ভয় তখনো কাটেনি। দস্তুর’জী বললেন, ‘আর দুটো শববাহকের কী হল? তারা বেরচ্ছে না কেন? আমার মনেও সেই প্রশ্ন, উত্তর দেব কী?
‘দস্তুর’জী—আমার দুজনেরই ভিতরে যাওয়া বারণ। দস্তুর’জীর কর্তব্যবোধ হয়েছে না কি, কে জানে, বললেন, চলুন, ভিতরে যাই।
আমার এখনো মনে হয়, ‘দস্তুর’জী তখন সম্পূর্ণ সম্বিতে ছিলেন না। আমি জানি আমি নিশ্চয়ই ছিলুম না। তার পিছনে পিছনে কোন সাহসে ভর করে গেলুম বলতে পারব না। আমি এ-বিষয়ে বহু বৎসর ধরে আপন মনে তোলপাড় করেছি। খুব সম্ভব যুগ যুগ ধরে দস্তুর’জীদের হুকুম তামিল করে করে আমরা সাধারণ গৃহী বিপদকালে মন্ত্রমুগ্ধের মতো এখনো তাদের অনুসরণ করি।
ভিতরে ঢুকে বাঁ দিকে মোড় নিয়েই দেখি—
ভদ্রলোক হঠাৎ থেমে গেলেন। আমি বললুম, কী, কী?
আমার দিকে প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে বললেন, এই যেরকম আমি আপনার দিকে তাকালুম, ঠিক সেইরকম তাকিয়ে আছে টাওয়ারের দেয়ালের একটা শেলফের ভিতর পা ছড়িয়ে বসে, ঘাড় আমাদের দিকে ফিরিয়ে সেই হাড্ডিসার বুড়ি যাকে আমরা তিন মাস আগে এই টাওয়ারে রেখে গিয়েছিলুম। গায়ের চামড়া আরো শুকিয়ে গিয়েছে, আরআর, চোখের কোটর দুটো ফাঁকা, কালো দুই গর্ত। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লুম।’ হুঙ্কার দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, কেউ আমাকে একটা পোতল দেবে না, নাকি রে?’
অথবা ঐ রকম কিছু একটা। আমি স্পষ্ট শুনতে পাইনি। ভয়ে আমার সর্বাঙ্গে কাটা দিয়ে উঠেছে। কী করে যে এ রকম ব্যাপার সম্ভবপর হতে পারে সে কথা জিজ্ঞেস করবার মতো হিম্মৎ বুকে বেঁধে উঠতে পারছিনে, পাছে আরো ভয়ঙ্কর কোনো এক বিভীষিকা তিনি আমার চোখের সামনে তুলে ধরেন।
হঠাৎ যেন আমার প্রতি ভদ্রলোকের দয়া হল। আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘ভয় পাবেন না। আপনাকে সব কিছু বুঝিয়ে বলছি।।
যখন জ্ঞান ফিরে পেলুম তখন দেখি আমার উপর কে যেন বালতি বালতি জল ঢালছে। তারপর বুঝলুম বৃষ্টি নেমেছে। আমার চতুর্দিকে স্কুলের ছেলেরা দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সেই যে শববাহক পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিল তাকে ও রকম অবস্থায় একা দেখতে পেয়ে ছেলেরা আমাদের সন্ধানে এখানে এসে পৌঁচেছে।
যে দুজন শববাহক ভিতরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল তারা আর কখনো জ্ঞান ফিরে। পায়নি। যে বাইরে এসে ভিরমি গিয়েছিল, সে পরে সুস্থ হল বটে, কিন্তু তার মাথা এখনো সম্পূর্ণ ঠিক হয়নি—আর যে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে এসেছিল তাকে এখনো পাগলা গারদে বেঁধে রাখা হয়েছে। একমাত্র দস্তুর’জীই এই বিভীষিকা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন।
অথচ ব্যাপারটা পরে পরিষ্কার বোঝা গেল। বুড়ি ছিল হাড্ডিসার, গায়ে একরত্তি চর্বি ছিল না, যেটুকু মাংস ছিল তা না থাকারই শামিল। তিন মাসের গরমে বুড়ী শুটকি হয়ে এমনি এক অদ্ভুত ধরনে বেঁকে গিয়েছিল যেন পা দুটো ছড়িয়ে দিয়ে উঠে বসেছে—শুধু চোখ দুটো একদম উপে গিয়েছে। সর্বশরীরের কোথাও এতটুকু আঁচড় নেই—আপনাকে আগেই বলেছি মধুগাঁও থেকে সব শকুন বহুদিন পূর্বেই পালিয়ে গিয়েছিল।
এক সাধুর কৃপায় আমি সুস্থ হয়ে উঠলুম। কিন্তু অকালে বৃষ্টি নামলে আমাকে এখনো বোতল বোতল মদ খেয়ে ছবিটা মগজ থেকে মুছে ফেলতে হয়।