রাইম
মাঝরাস্তায় আচমকাই ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িটা৷ অভিজিতের পাশের সিটে ঘুমিয়ে পড়েছিল ভূমি৷ সে ধড়ফড়িয়ে জেগে উঠল৷ চারপাশটা একবার ঠাওর করে বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘কী হল গো? কিছু বিগড়োল নাকি?’
অভিজিৎ ঠোঁট ওলটাল৷ পিছনের সিটে একবার চোখ বুলিয়ে নিল৷ চোখ বুজে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে পাপড়ি৷ হঠাৎ ঝাঁকুনিতে তার ঘুম ভাঙেনি৷ দ্রুতহাতে গাড়ির দরজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল অভিজিৎ৷ সেটা বন্ধ না করেই একছুটে গাড়ির সামনে গিয়ে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে কী যেন দেখে নিয়ে একটু আশ্বস্ত হল৷ কবজির উলটোদিক দিয়ে কপালের ঘাম মুছল একবার৷
দশ বছরের মেয়ে আর স্ত্রী-কে নিয়ে এক অফিস কলিগের পার্টি অ্যাটেন্ড করতে গেছিল অভিজিৎ৷ জায়গাটা চেনা নয়, তা-ও ম্যাপ দেখে গাড়ি চালিয়ে গিয়েছিল৷ ফিরতে যে এতটা রাত হয়ে যাবে, সেটা আগে আন্দাজ করতে পারেনি৷
ভূমি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল, গাড়িটা একটা ফাঁকা মাঠের বুক-চেরা রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে৷ চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢেকে আছে৷ মাঠের দূর প্রান্তের দিকে তাকালে কয়েকটা প্রাচীন দৈত্যাকৃতি গাছের আউটলাইন চোখে পড়ে৷ তার উপর তুলিতে টানা রঙের মতো কালচে-লাল আকাশ চোখে পড়ছে৷ ঘড়িতে সময় দ্যাখে সে, রাত সাড়ে বারোটা বাজতে চলেছে৷ নাঃ, যতটা ভেবেছিল ততটা রাত হয়নি৷ কিন্তু অভিজিৎ এখনও গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে করছেটা কী? জানলার কাচ নামিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় সে, ‘কী দেখছ বলো তো?’
—‘একটা বাচ্চা মেয়ে…’ গালে হাত রেখে চাপাস্বরে উত্তর দেয় অভিজিৎ৷
—‘এখানে বাচ্চা মেয়ে কোথা থেকে আসবে?’ ভূমি অবাক হয়৷
গাড়ির বাইরেটা আর-একবার ভালো করে দেখে নিয়ে আবার ভিতরে এসে বসে অভিজিৎ৷ ঘাড়ের পিছনে একটা হাত রেখে বলে, ‘সেটাই ভাবছি, গাড়ি চালাতে চালাতে চোখটা লেগে গিয়েছিল হঠাৎ মনে হল, গাড়ির সামনে একটা বাচ্চা মেয়ে এসে পড়েছে৷ তাতেই ব্রেক মারলাম৷’
‘তাহলে তো বাইরে…’
—‘নাথিং৷ কিচ্ছু নেই৷’ ভূমির কথা শেষ হতে দেয় না অভিজিৎ৷
পিছন ফিরে আর-একবার পাপড়ির দিকে চেয়ে নিল ভূমি৷ গাড়িতে উঠে থেকে ঘুমোতে শুরু করেছে মেয়েটা৷ মুখের দু-পাশ বেয়ে ঝুলন্ত চুলগুলে গাল ঢেকে রেখেছে৷ একটা হাত দিয়ে চোখ রগড়ে হাই তুলতে তুলতে বলল, ‘তাহলে ভুল দেখেছ৷ চারপাশে তো যতদূর দেখা যায় শুধু ফাঁক মাঠ৷ মেয়ে আসবে কী করে?’
—‘হুম…’ অন্যমনস্ক হয়ে উত্তরটা দিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করলল অভিজিৎ৷ ঘরঘর শব্দ করে গাড়ি থেমে গেল৷ স্টার্ট নিতে চাইছে না৷
—‘হায় ভগবান৷ এটাকেও বিগড়োতে হল৷’ বিরক্ত গলায় বলল অভিজিৎ৷ বাঁ হাতে ড্যাশবোর্ডে আলগা চাপড় মারল একটা, ‘কোথায় এসেছি সেটাও তো বুঝতে পারছি না৷ তোমার ফোনে নেটওয়ার্ক আছে?’ পাশে রাখা ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে ভূমি, স্ক্রিন আনলক করে বলে, ‘কম, তবে আছে৷’
—‘গুগল ম্যাপে দেখো কতদূর এসেছি৷ আমি একটু বাইরে নেমে দেখি কী গন্ডগোল করল৷’
সামনে গিয়ে বনেট খুলে খুটখুট করতে লাগল অভিজিৎ৷ ভূমি কারেন্ট লোকেশন দেখে একটু গলা তুলে বলল, ‘এ জায়গাটার কোনও নাম নেই৷ তিন কিলোমিটার দূরে একটা গ্রাম আছে, খামারি৷ নাম শুনেছ আগে?’
—‘উহু… এত গ্রাম কেউ চিনে রাখে নাকি? ম্যাপে আর কিছু দেখাচ্ছে?’
—‘নাঃ, শুধু সবুজ আর নীল, বাড়িঘর কিছু তো দেখছি না৷’
—‘আচ্ছা ঝামেলায় পড়লাম,’ জিভ দিয়ে একটা আওয়াজ করল অভিজিৎ, ‘আজ যে কার মুখ দেখে বেরিয়েছিলাম, কী হয়েছে, কিছুই বুঝতে পারছি না৷’
—‘গাড়ি কি চলবে না আর?’ কথাটা বলে গাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে ভূমি, ‘হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে গেল? তুমি সত্যি ধাক্কা মারোনি কিছুতে?’ রাগত চোখে স্ত্রী-র দিকে তাকাল অভিজিৎ, ‘যদি মেরেই থাকি তো বডিটা গেল কোথায়?’
ভূমি উত্তর দিল না৷ ফোনটা হাতে নিয়ে কিছু দেখে একটু থমকে গেল, ফোনটা আরও কিছুটা চোখের কাছে এনে বলল, এই জায়গাটা নিয়ে ‘একটা নিউজ আর্টিকল আছে৷ দ্যাখো৷’
—‘এই জায়গাটা নিয়ে আর্টিকল দিয়ে কী করব আমি?’ বিরক্ত হয়ে বলে অভিজিৎ৷
—‘আঃ, দ্যাখোই না৷’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা হাতে নিয়ে আর্টিকেলটায় চোখ রাখতেই হার কেঁপে উঠল তার৷ লিংকে ক্লিক করতে পাতা জুড়ে পুরো খবরটা ফুটে উঠল৷ খামারি নামের ন্যাশনাল হাইওয়ের ধারের একটা গ্রামের আশপাশে গত দু-বছরে বেশ কয়েকটা মৃতদেহ পাওয়া গ্যাছে৷ পুলিশ সন্দেহ করছে যে খুনগুলো কোনও সিরিয়াল কিলারের কাজ৷ কারণ সব-কটা খুনই করা হয়েছে ভিকটিমের গলার ভিতরে কাঁচি দিয়ে আঘাত করে৷
নিচের দিকে ছোট একটা আর্টিকেল করে লেখা, এলাকায় গুজব রটেছে এই দু-মাস ওই অঞ্চলে অনেকে নাকি একটি বছর দশেকের বাচ্চা মেয়েকে ঘুরতে-ফিরতে দেখেছে৷ সাদা রঙের ফ্রক থাকে মেয়েটির গায়ে, হাতে থাকে একটি বড় ধারালো কাঁচি৷ পুলিশ অবশ্য মেয়েটির ব্যাপারটাকে আজগুবি গল্প বলে উড়িয়ে দিয়েছে৷
মাঠের উপরে ইরিগেশন পাম্প বসানোর কাজ চলছিল দু’বছর আগে, রাত জেগে মাটি খুঁড়ছিল কিছু শ্রমিক৷ সকালে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করে গ্রামবাসীরা৷ প্রত্যেকের গলায় কাঁচিজাতীয় কিছু দিয়ে আঘাত করে খুন করা হয়েছে৷ এরপর থেকে বেশ কয়েকটা একই ধরনের খুনের ঘটনা ঘটেছে এই এলাকায়৷
খবরটা পড়তে গিয়ে হাত কেঁপে উঠল অভিজিতের৷ মৃদু শব্দ করে সেটা খসে পড়ল হাত থেকে৷
—‘কী হল তোমার?’ ভূমি তার দিকে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল৷
—‘ওই মেয়েটা… ফ্রক পরে ছিল, ওর হাতেও একটা কাঁচি ছিল৷’
—‘কোন মেয়ে?’
—‘গাড়ির সামনে যাকে দেখেছিলাম৷’
—‘এই যে বললে ওটা মনের ভুল৷’
কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিল অভিজিৎ৷ থেমে গেল৷ সামনের রাস্তার উপর একটা বাতিস্তম্ভ জ্বলছে৷ তার আলো ত্যারচাভাবে এসে পড়েছে পিচের রাস্তার উপরে, তাতে কিছুটা আলোকিত হয়ে আছে মাঠের ধারের ঘাসগুলো৷ রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা নিচে নেমে শুরু হচ্ছে মাঠটা৷ সেই ঢালের উপরে একটা সরু পায়ে-চলা পথ চোখে পড়ে৷ দু-পাশ থেকে ঝুঁকে লতাগুল্মের ঝোপ এখন ঢেকে রেখেছে রাস্তাটা৷
—‘যে করেই হোক গাড়িটা স্টার্ট করতে হবে৷’ থমথমে গলায় কথাটা বলে বনেটের ভিতরে আবার হাত চালায় অভিজিৎ৷ ভেবেছিল, ইঞ্জিন গরম হয়ে গেছে৷ কিন্তু না, কুলার ভর্তি হয়ে আছে জলে৷ তবে?
—‘কাউকে ফোন করব? যদি গাড়ি নিয়ে আসে?’ ভূমি ফোন থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে৷
—‘ডু ইট৷’
একটা নম্বর ডায়াল করল ভূমি৷ কয়েকবার রিং হয়ে কেটে গেল৷ রাত একটার কাছাকাছি বেজেছে৷ হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে৷ আর-একটা নম্বরে কল করতে যাচ্ছিল, এমন সময় ঘুম জড়ানো একটা গলা শুনতে পেল সে—‘মা…’
বেশ জোর গলাতে গাড়ির ভিতর থেকে ডেকে উঠছে পাপড়ি৷ ভূমি দ্রুত এগিয়ে গেল তার দিকে৷ গাড়ির পিছনের জানলার কাচ নামানোই ছিল৷ সেখানে মুখ রাখল, মেয়ের মাথায় একটা হাত রেখে বলল, ‘দেখ-না গাড়িটা মাঝরাস্তায় খারাপ হয়ে গেল৷’
—‘একটা মেয়ে এসেছিল৷’ উদ্বিগ্ন মুখে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল পাপড়ি, ‘ডাকছিল আমাকে৷’
‘মেয়ে! কোন মেয়ে?’
—‘কী জানি৷ জানলার বাইরে টোকা দিচ্ছিল আঙুল দিয়ে৷’
একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল ভূমির শিরদাঁড়া দিয়ে৷ এক ঝটকায় দরজাটা খুলে পাপড়ির পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরল সে, ‘তারপর? তারপর কোন দিকে গেল?’
মায়ের বুকের ভিতর থেকেই চাপা গলায় উত্তর দিল পাপড়ি, ‘পিছন দিয়ে চলে গেল, মেয়েটা কে ছিল গো?’
মেয়েকে একহাতে বুকে চেপে রেখেই অন্য হাতে পুলিশের নম্বর ডায়াল করল ভূমি৷ কিছুক্ষণ ঘড়ঘড় করে একটা শব্দ হয়ে কেটে গেল লাইনটা৷ নেটওয়ার্ক কমে আসতে শুরু করেছে৷ বিড়ালের মতো ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে চারদিক দেখতে লাগল সে৷ এতক্ষণে অভিজিৎ গাড়ির বনেট নামিয়ে দিয়েছে৷ মুখের উপরে ছায়া নেমেছে তার৷
মৃদু হাওয়া বয়ে যাচ্ছে ফাঁকা মাঠের উপর দিয়ে৷ ঝোপঝাড়ের ভিতর থেকে ঝিঁঝি ডেকে চলেছে একটানা৷ চতুর্দিক আশ্চর্যরকম নিথর নিস্পন্দ হয়ে আছে৷ যেন একটা বড়সড় নাটকের জন্যে মঞ্চ সাজিয়ে রেখেছে কেউ৷ সামনের সিটে এসে বসে নিজের কপালে একটা হাত রাখল অভিজিৎ ‘নাঃ, কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছি না৷’
—‘মেয়েটা আমাদের আশেপাশেই আছে৷ পাপড়িকে জানলা দিয়ে ডাকছিল৷’ কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল ভূমি৷
—‘হোয়াট!’ অভিজিৎ ফিরে তাকাল—‘তারপর?’
—‘শি জাস্ট ওয়েন্ট অ্যাওয়ে৷’
মাথা নাড়াল অভিজিৎ—‘অ্যাবসার্ড! একটা বছর দশেকের মেয়ে মাঝরাতে এই জনশূন্য প্রান্তরে ছুরি হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে?’
—‘খুনগুলো যদি ও-ই করে থাকে?’ থমথমে গলায় বলে ভূমি৷
—‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’ ধমকে ওঠে অভিজিৎ, ‘ওইটুকু বয়সের একটা বাচ্চার পক্ষে খুন করাই অসম্ভব, তার উপরে আবার গলায় কাঁচি ঢুকিয়ে৷ আমাদের ভুল হচ্ছে কিছু৷’
সামনে তাকায় ভূমি৷ গাড়ির রিয়ার ভিউ মিররে নিজের মুখটা চোখে পড়ছে তার৷ বুকের মধ্যে জড়ানো আছে পাপড়ির মাথাটা৷ মুখটা দেখা যাচ্ছে না৷ ধীরে ধীরে মুখ ফেরায় পাপড়ি, আয়নার দিকে তাকায়৷ মুখের কোণে একটা হাসি খেলছে তার, কিন্তু কে ও?
এক ধাক্কায় মেয়েকে দূরে সরিয়ে দেয় ভূমি৷ আয়না থেকে মুখ ফিরিয়ে ফিরে তাকায় পাপড়ির মুখের দিকে৷
—‘কী হল মা?’ অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে পাপড়ি৷ একটা কান্নার দমক এসে কাঁপিয়ে দেয় ভূমিকে৷ একটা হাতে নিজের চুল চেপে ধরে৷ আবার মেয়েকে দু-হাতে চেপে ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘কিছু একটা হচ্ছে অভি, সামথিং ইস হরিবলি রং৷’
এর মধ্যে আরও দু-বার ফোন করার চেষ্টা করেছে অভিজিৎ, কিন্তু কল কানেক্ট হচ্ছে না৷ ঘড়ঘড় আওয়াজটা হয়েই কেটে যাচ্ছে ফোনটা৷ সে পিছনে ফিরে বলল, ‘তোমার ফোনটা কাজ করছে?’
ভূমি ফোনটা এগিয়ে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই কেঁপে উঠল সেটা৷ একটা কল আসছে, নম্বরের জায়গাটা খালি৷ সেটা খেয়াল না করে ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে কলটা রিসিভ করে কানে চেপে ধরে অভিজিৎ৷ তার বুকের ভিতবে জমাটবাঁধা ভয়টা কয়েক ধাপ বেড়ে যায়৷ একটা মেয়েলি গলায় চিৎকার ভেসে আসছে ফোনের ভিতর থেকে, যেন কোনও বাচ্চা মেয়ে তারস্বরে চিৎকার করে সাহায্য চাইছে কারও কাছ থেকে৷
—‘কে… কে বলছ… কে তুমি?’ অভিজিৎ ডুকরে চিৎকার করে ওঠে৷ আর একটু একটু করে সেই আর্ত চিৎকার বদলে যায় মিহি হাসির শব্দে, বাচ্চা মেয়েটা আর ভয় পাচ্ছে না, এবার সে ভয় দেখাতে চায়৷
ফোনটা লাউডস্পিকারে করে দেয় অভিজিৎ৷ ভূমি কান খাড়া করে শুনতে থাকে সেই হাসির শব্দ, কয়েক সেকেন্ড পরে থেমে যায় হাসিটা৷ তার বদলে এবার একটা চেনা নার্সারি রাইম পড়তে শুরু করে মেয়েটা, দম বন্ধ করে শুনতে থাকে ওরা, ফোনের ওপাশ থেকে একটানা খেলার ছলে পড়ে চলেছে মেয়েটা—
Mary Mary quite contrary–
How does your garden grow.
With silver bells and cockle shells
And pretty maids all in a row.
স্পষ্ট ইংরেজি উচ্চারণ৷ এই চারটে লাইনই খারাপ হয়ে যাওয়া ক্যাসেটের মতো বারবার পড়ে চলেছে মেয়েটা৷ ফোনটা হাতে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় ভূমি৷ ডুকরে-ওঠা কান্নায় ভেঙে পড়ে সে৷ অভিজিৎ অবাক হয়ে বলে, ‘এটা তো একটা বাচ্চাদের রাইম৷ মানে কী এসবের?’
—‘এই রাইমটা বাচ্চাদের নয়৷’ মাথায় হাত রেখে বলতে থাকে ভূমি, ‘মেরি টুডর ছিলেন হেনরি এইটের মেয়ে৷ পরে ইংল্যান্ডের রানি হন৷ প্রচুর নিরপরাধ প্রজাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলেন বলে ‘ব্লাডি মেরি’ বলা হয় তাঁকে৷ মাথার কিছু সমস্যা ছিল৷ একটার পর একটা খুন করে তাদের সমাধিস্থ করতেন৷ সেখান থেকেই How does your garden grow, সিলভার বেল আর ককল শেল দুটোই টর্চার ডিভাইজ৷ প্রিটি মেইডস অল ইন আ রো, মানে খুনের আগে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা তার ভিকটিমরা৷ এই রাইমটা মেরি টুডরকে নিয়ে৷’
—‘কিন্তু তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী?’ হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে অভিজিৎ৷
—‘আমি জানি না, আমি কিছু জানি না৷’ কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে ভূমি৷
নিস্তব্ধ কয়েকটা মুহূর্ত কেটে যায়৷ একটু আগের ঢিমে হাওয়াটার জোর এখন আরও খানিকটা বেড়েছে৷ গাড়ির ভিতরে জ্বলন্ত নীলচে আলোয় শুধু তিনটে মানুষের চাপা নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না৷ ক্রমশ পাপড়ির একটা হাত উঠে আসে সামনের দিকে৷ আঙুল দিয়ে কিছু একটা যেন দেখাতে চায় সে৷
—‘বাবা… ওই যে…’
আঙুল লক্ষ্য করে গাড়ির সামনে তাকায় অভিজিৎ৷ বাইরে বাতিস্তম্ভের আলোয় যেটুকু হলদে কুয়াশা দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে গাড়ির দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে একটা মানুষের শরীর, শিশু৷ তার গায়ে একটা সাদা রঙের হাঁটু অবধি ফ্রক৷ ফ্রকের নীচ থেকে বেরিয়ে থাকা দুটো পায়ে অসংখ্য কাটাকুটি দাগ৷ ডান হাতের আঙুলের ফাঁকে ধরা আছে একটা কাঁচি, বারবার কাঁচির দুটো ফলাকে খুলে আবার বন্ধ করে দিচ্ছে সে৷ ধাতব একটা আওয়াজ ভেসে আসছে সেটা থেকে৷
বিড়বিড় করে কিছু একটা আওড়াতে শুরু করেছে ভূমি, অভিজিৎ ঠোঁটের সামনে একটা আঙুল তুলে ধরে ইশারায় চুপ করতে বলে৷
—‘আমি দেখছি৷ যা-ই হয়ে যাক, তোমরা গাড়ি থেকে বেরিয়ো না৷’
—‘তুমি… বাইরে যেয়ো না প্লিজ…’
—‘এখানে বসে লাভ হচ্ছে কিছু?’
ভূমি আর কিছু বলে না৷ অভিজিৎ বাইরে বেরিয়ে এসে মৃদু শব্দে গাড়ির দরজাটা বন্ধ করে দেয়৷ ধীরপায়ে এগিয়ে যায় মেয়েটার দিকে৷ তার দৃষ্টি মেয়েটার কাঁধ অবধি নেমে আসা চুলের উপরে স্থির৷
—‘কে তুমি? কী চাও?’
গলা ধরে এসেছে অভিজিতের৷ কোনও উত্তর এল না৷ শুধু একটানা সেই কাঁচির কচকচ শব্দ৷ আর-একটু এগিয়ে গেল অভিজিৎ৷
এবারে মেয়েটার পা দুটো সচল হয়ে উঠল৷ পিছন ফিরেই সামনের দিকে হাঁটতে লাগল সে৷ হলদে আলোর কুয়াশাটা ছেড়ে আরও কিছুটা এগিয়ে গেল৷ তাকে অনুসরণ করে অভিজিতও এগোতে লাগল পায়ে পায়ে৷ কিছুক্ষণের জন্যে গাড়িতে বসে-থাকা দুটো মানুষের কথা ভুলে গেল সে৷ মেয়েটা কি কিছু দেখাতে চাইছে? কোথাও নিয়ে যেতে চাইছে?
কয়েক পা এগোতেই কিন্তু দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল তার৷ মেয়েটা কুয়াশা পেরিয়ে প্রায় অন্ধকারে মিশে গেছে৷ আরও ঝাপসা হয়ে আসার আগেই পকেট থেকে ফোনটা বের করে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করল অভিজিৎ, জ্বলল না৷ তবে কি হারিয়ে যাবে মেয়েটা?
বিদ্যুৎ ঝলকের মতো মনে পড়ে গেল পকেটে সিগারেট জ্বালানোর জন্যে দেশলাই আছে৷ চকিতে সেটা বের করে আলো জ্বালাল অভিজিৎ৷ খয়েরি শিখা জ্বলে উঠে সামনের কিছুটা অংশ ভরে দিল ফিকে আলোয়৷ সামনের রাস্তা ফাঁকা— কেউ নেই সেখানে৷
দেশলাইটা আর একটু তুলে ধরে দেখার চেষ্টা করল সে৷ আর সঙ্গে সঙ্গে কবজির কাছে একটা আলগা হাতের স্পর্শে হাত থেকে দেশলাই ছিটকে পড়ল তার৷ একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার করে মাটির উপরে বসে পড়ল সে৷ পরমুহূর্তে আতঙ্কিত চোখে লক্ষ করল যতটা পথ সে গাড়ি থেকে এগিয়ে এসেছে সেই সমস্ত পথ জুড়ে একটা তরলের রেখা এগিয়ে এসে মিশেছে পায়ের কাছে৷ গন্ধটা চিনতে পারল৷ ছিটকে-পড়া দেশলাই থেকে নির্গত আগুনের ঢেউ সেই তরলের রেখা ধরে এগোচ্ছে গাড়ির দিকে৷ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাটি থেকে উঠে দৌড়োতে শুরু করল সে৷
তাকে দৌড়ে আসতে দেখে গাড়ি থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়েছিল বাকি দু-জন৷ ভূমি আর পাপড়ির হাত ধরে একটা টান দিল অভিজিৎ, ‘পালাও এখান থেকে গাড়িটা বার্স্ট করবে৷’
কয়েক সেকেন্ড কাটার আগেই কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ঝরে-পড়া পাথরের মতো রাস্তার ঢাল বেয়ে ঘাসের জমির উপরে নেমে এল ওরা৷ আর সঙ্গে সঙ্গে চতুর্দিক বজ্রপাতের মতো শব্দে কাঁপিয়ে দিয়ে আগুনের গর্ভে তলিয়ে গেল গাড়িটা৷ যেন মাটির তলা থেকে হাত বাড়িয়ে লেলিহান শিখা গ্রাস করল সেটাকে৷ গোটা রাস্তাটা ভরে গেল ক্ষণিকের আলোয়৷ সেই আলোয় চোখে পড়ল, জ্বলন্ত গাড়িটার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চা মেয়েটি৷ হাতে এখনও ধরা আছে কাঁচি৷ চোখের পলক পড়তেই মিলিয়ে গেল সে৷ ছাইয়ের গন্ধে ভরে উঠল বাতাস৷
—‘কেন এরকম করছে? কী চায় ও?’ কান্না-মাখানো গলায় চিৎকার করে উঠল ভূমি৷
পাপড়িকে নিজের পাশে টেনে নিল অভিজিৎ৷ ভূমির মোবাইল ফোনটা গাড়ির ভিতরেই ছিল৷ সেটার সঙ্গে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে৷ মাঠের উপরে এসে পড়ায় কিছুটা আঘাত লেগেছে পাপড়ির মাথায়৷ হাত দিয়ে জায়গাটা ঘষতে থাকে সে৷ এতক্ষণ ভয়ে খুব বেশি কথা বলতে পারেনি সে৷ একটা আচ্ছন্ন ভাব গ্রাস করছে তাকে৷
—‘উই হ্যাভ টু নো হোয়াট শি ওয়ান্টস৷’ নিজের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে নেয় অভিজিৎ৷ একটু আগের নিউজ আর্টিকেলটা আবার মেলে ধরে চোখের সামনে৷ গত দু’বছরে মোট তেরোজন খুন হয়েছে এইভাবে৷ আর্টিকেলের সঙ্গে ভিকটিমদের নাম আর পরিচয়ের একটা ছোট তালিকা দেওয়া আছে৷ সেটায় চোখ বুলোতে গিয়েই থমকে যায় অভিজিৎ৷ ভূমির আরও কাছাকাছি সরে এসে ফোনটা তুলে ধরে সে বলে, ‘একটা প্যাটার্ন লক্ষ করেছ? বারবার মেয়েটা তাদেরই খুন করেছে যাদের সঙ্গে বাচ্চা ছিল৷ দ্যাখো…’
দ্রুত মেলাতে থাকে ভূমি, হ্যাঁ… মাঠের উপর যতবার কারও লাশ পাওয়া গেছে ততবার সেই লাশের মধ্যে একটা না একটা বাচ্চা ছিল৷
—‘এবং বাচ্চাটাকেই খুন করা হয়েছে সবার আগে… ওঃ গড!’ পাপড়িকে প্রায় কোলের উপরে টেনে নেয় ভূমি- “pretty maids all in a row, খুনগুলো সে একসঙ্গে নয়, একটা সিকোয়েন্সে করে৷ যার বয়স সব থেকে কম, তাকে সবার আগে…’’
—‘মানে ও যতক্ষণ সেফ আছে, আমাদের ভয়ের কিছু নেই৷’
—‘কিন্তু কতক্ষণ?’
ঘাসের উপরে একটা পায়ের আওয়াজ হতেই উঠে দাঁড়াল অভিজিৎ৷ মোবাইলের আলোটা জ্বেলে মাঠের একটা বিশেষ জায়গায় তাকাল৷ চোখ দুটো ছোট হয়ে এল তার৷ ঘাসের জমির উপরে একটা ছোট গর্ত তৈরি হয়ে রয়েছে৷ সেটার দিকে এগোতে এগোতে অভিজিৎ বলে, ‘এই মেরি টুডর ব্যাপারে আর কী জানা যায়?’
চোয়াল শক্ত করে ভূমি বলে, ‘তেমন কিছু না৷ শেষ বয়সে এসে ওভারিয়ান ক্যানসারে মারা যান৷’
—‘ছেলেমেয়ে ছিল না কিছু?’
—‘না, সেটাই আশ্চর্যের৷’ ভূমি একটু ভেবে বলতে থাকে, ‘সারাজীবনে দু-বার তাঁর শরীরে প্রেগন্যান্সির সমস্ত লক্ষণ দেখা যায়৷ কিন্তু আশ্চর্যের কথা, একবারও সন্তান জন্মায় না৷’
গর্তটার দিকে আরও কিছুটা এগিয়ে যায় অভিজিৎ৷ ভূমি একটা হাতে পাপড়িকে আগলে রেখে এগোতে এগোতে বলে, ‘মাঝবয়স থেকে ব্যক্তিগত জীবনে সমস্যায় জর্জরিত হয়ে শোনা যায়, গোপনে নাকি তন্ত্রসাধনা শুরু করেন তিনি৷ ডেভিল ওরশিপিং৷’
গর্তটার ধারে গিয়ে তার ভিতরে ঝুঁকে পড়ে অভিজিৎ৷ অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই সেখানে৷ ভিতরে আলো ফেলে সে দেখে একটা ঢালু দেওয়াল গর্তের ভিতরের দিকে এগিয়ে গিয়েছে৷ মুখটা গর্তের আর-একটু কাছে নিয়ে গিয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করে সে৷ খুব ক্ষীণ একটা আওয়াজ আসছে গর্তের ভিতর থেকে৷ কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলে চলেছে একটানা৷ ‘আর্টিকেলে এই গর্তটার কথাই বলা আছে মনে হয়৷ এটা খুঁড়তে গিয়েই প্রথম খুনগুলো হয়৷’ অভিজিৎ মাথায় একটা হাত রেখে বলে৷ ‘হয়তো এর ভিতরেই কিছু একটা ছিল৷’ ভূমি গর্তটার দিকে চেয়ে বলে৷
—‘তুমি ওকে চোখে চোখে রাখো, আমি নিচে যাচ্ছি৷’
—‘নীচে! কেন? ওর ভিতরে কী আছে, কেউ জানে না৷’
—‘সেইজন্যেই যাচ্ছি৷ এই শয়তানের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারব না আমরা৷ একমাত্র উপায় হল, এ কী চাইছে, সেটা বোঝা৷’ এগিয়ে এসে ভূমির কাঁধে একটা হাত রাখল সে, ‘চিন্তার কিছু নেই৷ পাপড়ি যতক্ষণ ঠিক আছে, আমাদের কিছু হবে না৷’
মাথা নেড়ে কিছুটা পিছিয়ে এল ভূমি৷ ঘাসের উপরে একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে বসে পড়ল৷ মাথার ভিতর সমস্ত চিন্তাভাবনা গুলিয়ে গেছে তার৷ আজকের এই ভয়াবহ রাতে তাদের সঙ্গে পাঁচশো বছর আগে তৈরি হওয়া একটা ছড়া কোনওভাবে জড়িয়ে গেছে৷ এর হাত থেকে বাঁচার কি কোনও উপায় নেই?
আপাতত দু-হাতের মাঝে মেয়েকে আগলে রাখা ছাড়া আর কিছু করার নেই৷ মেয়েটা ঝিমিয়ে পড়তে শুরু করেছে ধীরে ধীরে৷ মাটির উপরে বসে গর্তের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল ভূমি৷
অন্ধকার হাতড়ে কিছুটা নেমে আসতে অভিজিতের মনে হল, মাটির একটা বিশেষ জায়গায় এসে পা আটকে যাচ্ছে তার৷ উপরে তাকিয়ে বেশ কিছুটা আকাশ দেখতে পেল৷ তার মানে গর্তটার মধ্যে বেশিদূর নামেনি৷ আর যাই হোক গর্তটা ভৌতিক না৷ মানুষের হাতেই তৈরি হয়েছে সেটা৷
কিছুক্ষণ সেইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে অভিজিতের মনে হল মাটির দেওয়ালের ওপাশ থেকে কার গলার আওয়াজ আসছে৷ সে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল৷ ভাষাটা পরিষ্কার বুঝতে পারল না৷ তবে ইংরেজির সঙ্গে খানিকটা মিল আছে৷ একটা মহিলাকণ্ঠ৷
চমকে পিছিয়ে এল অভিজিৎ, মাটিতে যেন পা আটকে গেল তার৷ নিচের দিকে আলো ফেলে চকচকে কিছু চোখে পড়ল— নীচু হয়ে জিনিসটা ভালো করে দেখতে পেল সে৷ মাটির ভিতর গেঁথে আছে একটা কালচে ধাতুর তৈরি কাঁচি৷ দেখে বোঝা যায়, দীর্ঘদিন ধরে সেখানেই পড়ে আছে৷
একটা দিক চেপে ধরে সজোরে টান দিতে মাটি থেকে উঠে এল কাঁচিটা৷ অসম্ভব ভারী৷ মৃত শরীরের মতো ঠান্ডা স্পর্শ অভিজিতের হাড় কাঁপিয়ে দিল৷ হাতের পেশি থেকে সমস্ত জমাট বাঁধা শক্তি যেন টেনে নিতে লাগল কাঁচিটা৷ অভিজিতের মনে হল, বহু দূর থেকে কিছুর আওয়াজ ভেসে আসছে৷ যেন মাটির তলার গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি ছুটছে৷
তার চোখের সামনে জমাট অন্ধকার চিরে আলো ফুটে উঠছে একটু একটু করে, সাদা কুয়াশার মতো ছেঁড়া ছবি চোখে পড়ছে৷ সেই কুয়াশার ভিতরে আবছাভাবে ফুটে উঠছে একটা ছায়ামূর্তি— মেরি টুডর৷ মেরি টুডরকে চিনতে পেরেছে সে৷ অবাক হয়ে সে তাকিয়ে দ্যাখে একটু আগে যে কাঁচিটা তার নিজের হাতে ধরা ছিল সেটা এখন মহিলার হাতে৷ লোলুপ দৃষ্টিতে সেটার দিকে তাকিয়ে পৈশাচিক স্বরে কী যেন মন্ত্র পড়ে চলেছেন মহিলা৷ একটা সদ্যোজাত শিশু শুয়ে আছে তার পাশে—হাসছে৷ সে হাসিটা দেখে অভিজিতের রক্ত জল হয়ে যায়৷ এত নারকীয় হাসি একটা শিশুর মুখে ফুটতে পারে?
শিশুর শরীর থেকে বেরিয়ে এসে একটা কালো ধোঁয়া ঘিরে ধরছে কাঁচিটাকে৷ চোখ তুলে অভিজিতের দিকে তাকিয়ে কাঁচিটা এগিয়ে দেন মহিলা৷ চমকে পিছিয়ে আসে সে৷ সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা মিলিয়ে যায়৷
অভিজিৎ বুঝতে পারে, কোনও অলৌকিক শক্তি সংকেতে কিছু বলতে চাইছে তাকে, দেখাতে চাইছে কয়েকশো বছর আগের কোনও দৃশ্য৷
আগের ছবি মুছে গিয়ে দূর থেকে এগিয়ে-আসা হর্স ক্যারেজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এখন৷ তার পাশে ফুটে উঠছে একটা মাঠ৷ মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই চলমান ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে সে৷
এতক্ষণে ঘোড়ার গাড়ির আওয়াজটা আরও বেড়ে উঠেছে৷ সেই সঙ্গে অঝোর ধারায় বৃষ্টির শব্দ৷ ঘনঘন বাজ পড়ছে৷ অভিজিৎ অবাক হয়ে দ্যাখে, তার চোখের সামনে পড়ে আছে বিস্তীর্ণ মাঠ৷ একটু আগে যে মাঠের উপরে তাদের গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়েছিল, এখন সেই মাঠটাই ফিরে গেছে দু-শো বছর আগে৷ রাস্তাটা উধাও হয়েছে৷ বৃষ্টির জলে ডুবে ঘাসগুলো দেখা যাচ্ছে না৷ মাঠের মাঝখান দিয়ে ছুটে আসছে ঘোড়ার গাড়ি৷ মহুর্মুহু বজ্রপাত হচ্ছে খোলা মাঠের উপরে৷ চালক থামছে না৷ যত দ্রুত সম্ভব পার হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে সে৷
অভিজিতের বুক কাঁপিয়ে একটা আকাশচেরা বিদ্যুতের ঝলক আছড়ে পড়ল ঘোড়াগুলো থেকে মিটার দশেক দূরে৷ আতঙ্কে দিশহারা হয়ে গেল সামনে বাঁধা ঘোড়া দুটো৷ গাড়িটা রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ল বেশ কিছুটা দূরে৷ পরপর আরও কয়েকটা বজ্রপাত৷ চুরমার হয়ে গেল কাঠের ক্যারেজটা৷ দু-চারটে ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ এসে পড়ল মাটির উপরে৷ ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে ভারী কিছু একটা ছিটকে এল অভিজিতের দিকে৷ মুখ বাঁচাতে একটা হাত বাড়িয়ে জিনিসটা ধরে ফেলল সে৷
বৃষ্টির আওয়াজ থেমে গেছে৷ ঘোড়ার গাড়িও রাতের স্বপ্নের মতোই মিলিয়ে গেছে তার সামনে৷ চোখ বন্ধ করেও অভিজিৎ বুঝতে পারল, রাত আবার শান্ত হয়ে আসছে৷ আবার ঝিঁঝির ডাক কানে আসছে৷ ত্রিমাত্রিক সিনেমার মতো অতীতের দৃশ্য শেষ হয়ে আবার ফিরে এসেছে বর্তমানে৷
—‘কী হল তোমার? সাড়া দিচ্ছ না কেন?’ উপর থেকে ভূমির চিৎকার ভেসে এল৷
তার উত্তর না দিয়ে হাতের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে অভিজিৎ দেখল, এখনও তার হাতে ধরা আছে সেই কাঁচিটা৷ মেরি টুডরের কাঁচি৷ সেই কাঁচি, যার ভিতরে তিনি বন্দি করে রেখেছিলেন নিজের অতৃপ্ত বাসনাকে৷ দু-শো বছর ধরে এই মাঠের মাটির তলায় চাপা পড়ে ছিল কাঁচিটা৷
সব প্রশ্নের উত্তর এখন জলের মতো পরিষ্কার অভিজিতের কাছে৷ অতীত তার রহস্যের আগল ভেঙে চোখের সামনে উজাড় করে দিয়েছে সব কিছু৷ কাঁচিটা মাটির উপরেই ছুড়ে ফেলে সে ঢাল বেয়ে আবার উপরের দিকে উঠে আসতে থাকে৷ আতঙ্কে ঘনঘন নিশ্বাস পড়তে থাকে তার৷ একটু আগে যে দৃশ্য সে দেখেছে তা আর ভুলতে পারবে না কোনওদিন৷ মাটি লেগে সমস্ত শরীর ভরে উঠেছে এতক্ষণে৷ বাইরে ছাইয়ের গন্ধ মাখা বাতাস শনশন করে বয়ে চলেছে গর্তের উপর দিয়ে৷
গর্তের বাইরে মুখ বাড়িয়েই ছিল ভূমি আর পাপড়ি৷ তাকে উঠে আসতে দেখে ভূমি উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করে, ‘কী হল? কী আছে নীচে?’ কথার উত্তর দিতে দিতেই ঝলসে যাওয়া গাড়ি লক্ষ্য করে দৌড়োতে থাকে অভিজিৎ,—‘যেভাবেই হোক এই গর্তটা বুজিয়ে ফেলতে হবে আমাদের৷’
—‘কিন্তু কেন?’
ঘুরে দাঁড়ায় অভিজিৎ, ‘এই গর্তটা খোঁড়ার পর থেকেই খুনগুলো শুরু হয়েছে এখানে৷’ কথাটা বলে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে পিছন ফেরে সে- ‘গর্ত খোঁড়ার আগে মাটির নীচে এমন কিছু ছিল, যা গর্ত দিয়ে উপরে উঠে এসেছে… তার জন্যেই এতগুলো খুন…’
—‘কী ছিল?’
ভূমির কাঁধে একটা হাত রেখে বলতে থাকে সে, ‘আজ থেকে দু-শো বছর আগে এই মাঠের ঠিক এই জায়গাটায় একটা ব্রিটিশ হর্স ক্যারেজ বাজ পড়ে ধ্বংস হয়ে যায়৷ সেই ক্যারেজের ভিতরে এমন একটি জিনিস ছিল, যা মেরি টুডরের সম্পত্তি৷ মেরি টুডর শয়তানের উপাসনা করতেন৷ শয়ে শয়ে মানুষকে নৃশংস হত্যা করেছিলেন৷ তাতেও রক্তপিপাসা মেটেনি তাঁর৷ নিজের গর্ভে দু-বার শয়তানকে ধারণ করার চেষ্টা করেন৷ সে সন্তানের শরীর ছিল না৷ শরীরহীন সেই আত্মাকে কোথাও লুকিয়ে রেখে যান তিনি যাতে তার মৃত্যুর পরেও হত্যালীলা চালিয়ে যায় তাঁর সন্তান৷ সে জিনিসটাই এতকাল সভ্যতার আড়ালে চাপা পড়ে ছিল মাটির নীচে৷’
—‘তার মানে আমরা যে বাচ্চা মেয়েটিকে দেখছি সে…’
—‘পিশাচ, ডেভিল অনেক নাম আছে৷ আমাদের ভাবার সময় নেই৷’
খিলখিল করে একটা হাসির শব্দে বাতাস ভরে ওঠে৷ মনে হয়, ওদের তিনজনকে ঘিরে দৌড়ে দৌড়ে খেলা করছে বছর দশেকের বাচ্চা মেয়ে৷ মাঝে মাঝে তার সাদা ফ্রকের একটা অংশ অন্ধকারে ফুটে উঠছে৷ ‘কিন্তু সে এখানে এল কী করে?’ ভূমি ভয়ার্ত চোখ ফিরিয়ে প্রশ্ন করে৷’
—‘আমি জানি না৷ সব কিছু আমার কাছে স্পষ্ট নয়৷ এটুকু জানি, নিজের মৃত্যুর পরেও তাঁর সন্তানকে, তাঁর রক্তলোভী সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন মেরি৷ দু-শো বছর ইংল্যান্ডেই ছিল সেটা৷ কেউ বা কারা তাকে ভারতে নিয়ে আসে৷ তারা সকলেই মৃত, আজ আর জানার উপায় নেই৷ গাড়ির ডিকিতে একটা শাবল ছিল না?’
—‘হ্যাঁ, কিন্তু সেটা এতক্ষণে…’
—‘ভাবার সময় নেই, যেভাবেই হোক পাপড়ির ক্ষতি হতে দিয়ো না তুমি৷ ও ঠিক থাকলে কিচ্ছু হবে না আমাদের৷’
তিনজনে মিলে দৌড়ে যায় গাড়িটার দিকে৷ এখনও কোথাও কোথাও আগুন জীবন্ত আছে তার৷ রাস্তার হলদে আলোটা এখনও আগের মতোই জ্বলছে৷ সেটাকে ঘিরে জমে থাকা ধোঁয়ার বাষ্প আর কুয়াশা অবিচ্ছেদ্য মায়াজালের সৃষ্টি করেছে৷
পাপড়ির চোখ দুটো প্রায় বুজে এসেছে৷ ভূমি তাকে জোর করে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করে৷ অভিজিৎ এতক্ষণে গাড়িটার প্রায় পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে৷ গাড়ি বার্স্ট করায় ডেকের পাল্লাটা ভেঙে বেরিয়ে এসেছে৷ তার ভিতরটা এখন অন্ধকার৷ পকেট থেকে ফোনটা বের করে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করে অভিজিৎ৷
পাপড়ির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তার দিকে তাকায় ভূমি৷ কিছু একটা খটকা লাগে তার৷ ভুরু কুঁচকে সে বলে, ‘একটা ব্যাপার আশ্চর্য লাগছে৷ আমি যত দূর জানি, মেরি টুডরের দু-বার ফলস প্রেগন্যান্সি হয়৷ একটা ভ্রূণ যদি এখানে থাকে তাহলে দ্বিতীয়টার কী হল?’
—‘জানি না…’ অভিজিৎ উত্তরটা দিয়ে গাড়ির দিকে ফিরতে যাচ্ছিল, একটু থেমে গিয়ে নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলে, ‘গাড়িটা যদি তখন তোমাদেরকে নিয়ে বার্স্ট করত তাহলে তোমরা দু-জনেই একসঙ্গে মারা যেতে, সেক্ষেত্রে তো মেইডস ইন আ রো হত না… তাহলে?’
একটা চাপা চিৎকার বেরিয়ে আসে পাপড়ির অবসন্ন গলা দিয়ে, ‘বাবা, গাড়িটার ভিতরে কেউ আছে৷’
থেমে যায় অভিজিৎ৷ পাপড়ির বুজে-আসা ক্লান্ত চোখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কে আছে?’
—‘যে মেয়েটাকে দেখে তুমি গাড়ি থামিয়েছিলে…’ থমথমে গলায় একটা ঢোক গিলে উচ্চারণ করে পাপড়ি৷ তার চোখ দুটো ঝলসে ওঠে৷
—‘আই ডোন্ট কেয়ার! ও আমাদের কোনও ক্ষতি…’ বলতে গিয়ে থেমে যায় অভিজিৎ৷ ধীরে ধীরে পিছন ফিরে পাপড়ির মুখের দিকে তাকায় সে৷ ভূমির চোখও ঘুরে গেছে সেইদিকে, বিড়বিড় করে একটা প্রশ্ন করে, ‘তুই তো ঘুমিয়ে ছিলি তখন৷ জানলি কী করে, বাবা কেন গাড়ি থামিয়েছিল?’ মুহূর্তে পাপড়ির মুখ থেকে আতঙ্ক আর ক্লান্তি মুছে গিয়ে একটা চেরা হাসি ফুটে ওঠে৷ কান ছুঁয়ে ফ্যালে হাসিটা৷ দুটো পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়৷ ফুলহাতা জামার হাতার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা প্রাচীন কালো কাঁচি৷ সেটা সজোরে বসিয়ে দেয় ভূমির গলার ঠিক নীচে৷
অভিজিতের পা দুটো এতক্ষণে অকেজো হয়ে এসেছে৷ সে একহাতে ডেকের পাল্লাটা তুলে ধরে অবাক হয়ে তাকিয়ে দ্যাখে, সেখানে শুইয়ে রাখা আছে একটা দশ বছরের বাচ্চার ঝলসানো মৃতদেহ৷ তার গলার কাছে একটা সমূলে ঢুকে-যাওয়া কাঁচির দাগ… অর্থাৎ যে মেয়েটাকে এতক্ষণ ওরা পাপড়ি ভেবে ভুল করছিল, সে-ই মেরি টুডরের দ্বিতীয় ভ্রূণ৷
কিন্তু কখন? পাপড়িকে তো একবারও কাছছাড়া করেনি ওরা৷ মুহূর্তে মনে পড়ে যায়৷ মেয়েটা গাড়ির সামনে এসে পড়ায় ওরা দু-জনেই এসে দাঁড়িয়েছিল গাড়ির সামনে৷ পাপড়ি একা ঘুমোচ্ছিল পিছনের সিটে৷ তারপর থেকেই…
দূরের অন্ধকার থেকে আর-একটা বাচ্চা মেয়ে ছুটে চলে আসে পাপড়ির পাশে৷ অভিজিৎ পিছোতে গিয়ে বুঝতে পারে তার পায়ের উপর আর নিয়ন্ত্রণ নেই৷
কাঁচি হাতে দুটো মেয়ে এগিয়ে আসে ওর দিকে৷ ওদের শিশুসুলভ গলায় একটা পুরোনো নার্সারি রাইম ফুটে উঠছে৷ রাতের খোলা হাওয়ায় মিশে ছড়িয়ে পড়ছে মাঠের উপরে
Mary Mary quite contrary—
How does your garden grow.
With silver bells and cockle shells
And pretty maids all in a row.