রাইটার্স দখল
সময়টা প্রাকস্বাধীনতা যুগের অগ্নিগর্ভ বাংলা।
মেদিনীপুর থেকে শুরু করে ঢাকা, বরিশাল থেকে কলকাতা গোটা অঞ্চল ভুগছে স্বাধীনতা আস্বাদনের জ্বরে। ভারতমায়ের দামাল বিপ্লবী ছেলে—মেয়েদের দল ভীষণ সক্রিয়, তার চেয়েও বেশি সক্রিয় পুলিশ।
মহাবিক্রম ব্রিটিশ সিংহের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অকুতোভয় বিপ্লবীদের মৃত্যুমিছিলে দিশেহারা প্রশাসন।
ছোটো ছোটো সতেরো—আঠেরো বছর বয়সের ছেলে—মেয়েগুলো যে মরতেই ভয় পায় না; তাদেরকে কাবু করা যাবে কী করে!
আগের কাহিনি ছিল হরিয়ানার রুচিকা গিরহোত্রা—কে নিয়ে। স্বাধীন ভারতবর্ষের বুকে ঘটে যাওয়া আমাদের আইনব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিয়ে। লিখেছিলাম কীভাবে আই পি এস রাঠোরের মতো এক আই পি এস অফিসার ব্যুরোক্র্যাটিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে তিল তিল করে একটি সুন্দর পরিবারকে শেষ করে দিতে পারে।
সেই ঘটনার নৃশংসতা ও নির্মমতা এতটাই হৃদয়বিদারক ছিল যে অসংখ্য পাঠক হয়তো ভেবেছেন,—ভারতবাসী হিসেবে লজ্জায় তো মাথা আমার হেঁট হয়ে গেল! এই কি আমাদের দেশ? এই কি আমাদের বিচারব্যবস্থার প্রকৃত চিত্র; যেখানে এভাবেই অনৈতিকতার বলি হতে হয় সাধারণ মানুষকে?
তাঁদের সবাইকে বলি, একটা—দুটো মানুষের জন্য কখনো সামগ্রিক পরিস্থিতি বদলায় না। আমাদের এই দেশমাতৃকা ভারতবর্ষ হাজার বছরের গর্বে সমুজ্জ্বল। এখানে এমন অনেক সত্য ঘটনাও আছে, যা পড়লে লজ্জায় নয়, গর্বে বুক ফুলে উঠবে প্রতিটি ভারতবাসীর।
চলে যাই স্বাধীনতার আগের যুগে।
গোটা বাংলা তখন আন্দোলনের স্পৃহায় মেতেছে। আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার লোভে পতঙ্গের মতো বিপ্লবীরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে। কলকাতার সিপি অর্থাৎ কমিশনারের পদে তখন আসীন চার্লস টেগার্ট।
সেই কুখ্যাত টেগার্ট, যাঁর ভয়ে তখন বাগে—গরুতে একঘাটে জল খায় কলকাতায়, যাঁর রক্তহিম করা দৃষ্টিতে ট্রায়ালে থাকা অপরাধী চেতনা হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে, যাঁর নাম উঠলে ঘৃণায়, আক্রোশে মাটিতে থুতু ফেলে বিপ্লবীরা।
টেগার্টের চাকরি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, আর মাত্র কয়েকটা মাস। কিন্তু এই শেষ কিছুদিন যেন আর কাটতেই চাইছে না।
মিসেস টেগার্ট সারাক্ষণ ভয়ে দুশ্চিন্তাায় কাঁটা হয়ে থাকেন। দু—নম্বর কিড স্ট্রিটের বিশাল কমিশনারের বাংলোয় সারাদিন একাকী জীবনযাপন করতে করতে তাঁর মন আচমকাই কু গেয়ে ওঠে। এই বুঝি কোনো বিপ্লবী বোমা ছুড়ল টেগার্টের গাড়ি লক্ষ্য করে।
পুলিশের সর্বময় কর্তার গাড়ি, আগু পিছু সারাক্ষণ থাকে সার্জেন্টের বাইক; তবু বিপদ তো না বলে কয়েই আসে!
যেদিনকার কথা বলছি, সেই দিনটা বাঙালির ইতিহাসে চিরকাল সোনার জলে লেখা থাকবে।
১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর।
সেদিন সকালে অলস ব্যালকনিতে মিসেস টেগার্ট কেন কে জানে বার বার উল বুনতে বুনতে চমকে উঠছিলেন।
দিন দিন স্বাধীনতাসংগ্রামীদের বিপ্লব বাড়ছে। ঠিক এক—শো দিন আগে ঢাকায় মেডিক্যাল কলেজ পরিদর্শনে গিয়ে খুন হতে হয়েছে ইনস্পেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ মি লোম্যানকে। আর টেগার্ট তো বলতে গেলে প্রায় কপালজোরে বেঁচে গিয়েছিলেন সেইসময়।
উফ! ভাবলেই এখনও বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে মিসেস টেগার্টের।
দিনটাও তাঁর স্পষ্ট মনে আছে।
২৫ আগস্ট।
রোজকার মতো সেদিনও সকালের প্রাতরাশ সেরে গাড়িতে করে টেগার্ট রওনা দিয়েছিলেন তাঁর কর্মস্থল লালবাজারের দিকে। মাত্র দশ পনেরো মিনিটের রাস্তা। অথচ তারমধ্যেই ঘটে গিয়েছিল কী দুঃসহ কাণ্ড!
কী যেন নাম ছেলেদুটোর?
মিসেস টেগার্ট উলের কাঁটা থামিয়ে একটুক্ষণ মনে করার চেষ্টা করেন।
হ্যাঁ, দীনেশ মজুমদার আর অনুজা সেন। দিনের পর দিন তারা নাকি লাল দীঘির উত্তরপাড়ের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে হিসাব রেখেছিল, ঠিক কখন কমিশনারের গাড়ি এই পথ দিয়ে যায়, গাড়ির নম্বর থেকে শুরু করে ড্রাইভারদের মুখ—সব নাকি তাদের কাছে হয়ে উঠেছিল হাতের তালুর মতোই পরিচিত।
মেরি এসে ডাকতেই মিসেস টেগার্টের চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায়।
”ম্যাডাম, আপনি কি বেদানা খাবেন? ভালো বেদানা এনেছে বাবুর্চি।”
ঈষৎ বিরক্ত হয়ে মিসেস টেগার্ট বলে ওঠেন, ”এখন নয়। স্যার দুপুরে লাঞ্চে আসবেন, তখন দিও। এখন তুমি যাও।”
মেরি প্রস্থানে উদ্যত হলে মিসেস টেগার্ট মুখ ফেরান সামনের কেয়ারি করা সুসজ্জিত বাগানের দিকে। ওই ঘটনা মনে পড়লে এখনও মনে মনে তিনি যিশুকে ধন্যবাদ দেন। ভাগ্যিস সেদিন মি টেগার্টের গাড়ি জ্যামে পড়েছিল। তাই তো বিপ্লবীগুলোর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল!
গোটা ঘটনাটা পরে টেগার্টের সহকারী ম্যাকফ্রেড এসে বলেছিল তাঁকে।
সেদিন এসপ্ল্যানেড থেকে ডালহৌসি ঢোকার মুখে বিশ্রী এক জ্যামে আটকে পড়েছিল টেগার্টের গাড়ি। একটা ঘোড়ার গাড়ির চাকা মাঝপথে খুলে গিয়ে রাস্তাটাকেই জ্যাম করে দিয়েছিল। সব গাড়ির মতো প্রায় আধঘণ্টা ধরে জ্যামে দাঁড়িয়ে ছিল কমিশনার টেগার্টের গাড়ি।
ওদিকে অনুজা সেন আর দীনেশ মজুমদার বার বার ঘড়ি দেখছে। দীনেশ অনুজাকে বলল, ”কী ব্যাপার বলত! আজ কি এদিক দিয়ে যাবে না নাকি!”
অনুজা ভিড়ের মধ্যে মিশে বিড়বিড় করে উত্তর দেয়, ”যাওয়ার তো কথা। সব শিডিউল দেখা আছে। আজ অন্য কোথাও কোনো মিটিং নেই শয়তানটার।”
দীনেশ দাঁতে দাঁত চেপে। কাল সারারাত সে ঘুমোয়নি। ওদের এই চরম শত্রুকে নিকেশ করার অ্যাসাইনমেন্টটা অনেক কষ্টে দল কর্তৃপক্ষের থেকে পেয়েছে ও। কতদিনের ইচ্ছে ওর টেগার্ট কে শেষ করবে।
ওদের শয়ে শয়ে বিপ্লবী বন্ধুর ওপর পুলিশের অকথ্য অত্যাচারের নায়ক তো এ—ই! একে শেষ করে মরার মতো সুখ কিছু আছে নাকি?
অনুজা মৃদু কনুইয়ের খোঁচা দেয় দীনেশকে, ”এই! কমিশনারের গাড়ি আসছে! অ্যাকশন!”
দ্রুত পকেটে বোমাটার ওপর হাত একবার বুলিয়ে নিয়ে পজিশন নেয় অনুজা আর দীনেশ। অস্ফুটে দীনেশ বলে, ”ঠিক দেখতে পেয়েছিস তো? টেগার্ট বসে আছে গাড়ির মধ্যে!”
অনুজা কথা না বলে মাথা নাড়ে।
যে ভুল ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকী করেছিল, কুখ্যাত কিংসফোর্ডকে মারতে গিয়ে বোম ফেলেছিল দু—জন নিষ্পাপ ইউরোপিয়ান মহিলার ওপর, সেই ভুল তারা কিছুতেই করবে না।
ওই তো! ওই তো দেখা যাচ্ছে টেগার্ট বসে আছে গাড়ির মধ্যে। অপ্রত্যাশিত জ্যামের জন্য দেরিতে যেন কিছুটা বিরক্ত পশুটার মুখ।
দীনেশ আর দেরি করল না। ‘বন্দেমাতরম!’ বলে বোমাটা হাতে নিয়ে সজোরে ছুড়ে দিল দূরের কমিশনারের গাড়ির দিকে।
মুহূর্তে বিকট শব্দে কেঁপে উঠল গোটা অফিস পাড়া। পথচলতি মানুষজন সম্পূর্ণ দিশেহারা হয়ে গিয়ে ছুটতে শুরু করল দিগবিদিক হারিয়ে। কালো ধোঁয়ায় ভরে গেল টেগার্টের বিলিতি দামি গাড়ি।
দীনেশ লক্ষ্যভেদের আনন্দে মেতে উঠতে যাবে, এমন সময় প্রচণ্ড শব্দে আরেকটা বোমা ফাটল তার ঠিক পাশেই।
কী হল? দীনেশ হতভম্ব হয়ে গেল। প্ল্যান ছিল, ও প্রথমে বোমা ছুড়বে, তার ঠিক পাঁচ সেকেন্ডের মাথায় অনুজা ছুড়বে দ্বিতীয় বোমা। ডাবল বোমার আঘাতে চিরকালের মতো নিকেশ হবে ওদের শত্রু।
কিন্তু না। ভবিতব্যের বিধি খণ্ডায় কে?
দীনেশ হিমচোখে দেখল তাড়াহুড়োয় অনুজার বোমাটা ফেটেছে অনুজারই হাতে। হাতের সামনের অংশ উড়ে গেছে, সেখান থেকে গলগল করে বেরোচ্ছে রক্ত।
ওদিকে দীনেশের বোমাটাও গিয়ে পড়েছে টেগার্টের বনেটে। ড্রাইভার তাল সামলাতে না—পারায় গাড়িটা ঘুরে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছে একটা লাইট—পোস্টে।
সেদিনের আঠেরো—কুড়ি বছরের ছেলে—মেয়েগুলোর সাহস, উৎসাহ ছিল অসীম। কিন্তু হাজার ট্রেনিং—এও চূড়ান্ত পেশাদারিত্বের অভাবে প্রায়শই লক্ষ্যভ্রষ্ট হত তাদের নিশানা।
টেগার্টের পুরো ব্যাপারটা বুঝতে লেগেছিল মাত্র কয়েক সেকেন্ড। গাড়ি লাইট—পোস্টে ধাক্কা মারার সঙ্গে সঙ্গেই এক ঝটকায় তিনি লাফিয়ে পড়লেন, হাতে উদ্যত রিভলভার, এখনই নিকেশ করবেন ব্লাডি বিপ্লবীগুলোকে।
কিন্তু কোথায় তারা?
দীনেশ মজুমদার ততক্ষণে পালিয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন স্রোতের মতো এদিক থেকে ওদিকে ছুটোছুটি করছে পথচলতি জনতা। ইতিমধ্যেই খবর পেয়ে লালবাজার থেকে ছুটে আসছে ফোর্স।
ওই তো, ওই তো একটা ছেলে ওদিকের ফুটপাথে পড়ে কাতরাচ্ছে।
টেগার্ট মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। উল্কার গতিতে তিনি ছুটে চলে যান রাস্তার ওইপাশে। রিটায়ারমেন্টের বয়স হতে চললেও তিনি এখনও বাজপাখির মতোই ক্ষিপ্র।
অনুজা সেন তখন প্রায় বাহ্যজ্ঞানশূন্য। রক্তে তার শরীর ভেসে যাচ্ছে। তবু সে অস্ফুটে বলে ওঠে, ”বন্দেমাতরম!”
টেগার্টের অভিজ্ঞ চোখ দেখেই বুঝে নেয়, গুলি চালিয়ে লাভ নেই; এর আয়ু আর কয়েক মিনিট মাত্র!
পুরো ঘটনাটা লোকমুখে ততক্ষণে অতিরঞ্জিত হয়ে সারাশহর ছড়িয়ে পড়েছে।
লালবাজারের ছোটোবড়ো কর্তারাও জেনে গিয়েছিলেন, ”টেগার্ট ইজ ডেড!”
মিসেস টেগার্ট পুরো ঘটনাটা মনে করে আরও একবার খ্রিস্টের নাম জপ করলেন। আর ক—টা মাস কাটলেই তিনি কোনোরকমে স্বামীকে নিয়ে বিলেত ফেরত যেতে পারলে যেন বাঁচেন!
উলের কাঁটা সরিয়ে রেখে ডাইনিং—এ গিয়ে তিনি অফিসে স্বামীকে ফোন করেন, ”তুমি ঠিক আছ তো?”
ওপাশ থেকে টেগার্টের গলা শোনা যায়, ”কেন ঠিক থাকবো না! তুমি কেন শুধু শুধু চিন্তা করো বলো তো!”
মিসেস টেগার্ট অস্ফুটে বলেন, ”সে—সেই পঁচিশে আগস্টের কথা মনে পড়ে গেল। আবার যদি ওরকম কিছু …!”
”আমার কিচ্ছু হবে না ডিয়ার! তুমি শুধু খেয়েছ ঠিকমতো?” টেগার্ট স্ত্রীর স্বাস্থ্যচিন্তায় উদবিগ্ন হয়ে ওঠেন। ”হবে না কী করে বলছ তুমি?” মিসেস টেগার্ট এবার ঝংকার দিয়ে ওঠেন, ”সেদিন তুমি না হয় মাদার মেরির কৃপায় বেঁচে গিয়েছিলে। তার চারদিন পরে কী হল মনে নেই? ওই বিনয় বোস নামে ডাক্তারির ছেলেটা কেমনভাবে ঢাকায় খুন করল মি লোম্যানকে?”
টেগার্টের কণ্ঠস্বর যে শক্ত হয়ে গেল, তা স্পষ্ট বোঝা গেল, ”ওই বিনয় বোসকে আমি ছাড়ব না। আমার সারা ফোর্সের সবচেয়ে এফিশিয়েন্ট অফিসারদের আমি অ্যাপয়েন্ট করেছি ওকে খুঁজে বের করার জন্য। ওই স্কাউন্ড্রেলটার এতবড়ো সাহস…।”
সত্যিই তাই। ঢাকার মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র বিনয় বসু যেন ধীরে ধীরে কিংবদন্তীতে পরিণত হচ্ছে। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স অর্থাৎ বিপ্লবীদের ওই দলের পোস্টারে ছেয়ে যাচ্ছে সারা শহর। সব জায়গায় একটাই আকুতি, ওদের নাকি রক্ত চাই। স্বাধীনতার জন্য তাজা রক্ত চাই ওদের! সেই গা—গরম করা পোস্টারে পতঙ্গের মতো এসে ঝাঁপ দিচ্ছে হাজার হাজার তরুণ।
মি টেগার্টের ওপর চিফ সেক্রেটারি, এমনকী খোদ ছোটোলাটেরও চাপ বাড়ছে ক্রমশ। বিনয় বসুকে চাই—ই। এত সাহস, খোদ আই জি লোম্যানকে খুন করে সে?
আরেকটা ফোন ঢুকছিল, মি টেগার্ট স্ত্রীর ফোন কেটে দিয়ে সেই ফোনটা রিসিভ করলেন, ”ইয়েস? কমিশনার স্পিকিং!”
ওপাশের কথাগুলো শুনতে শুনতে অসমসাহসী টেগার্টেরও যেন স্নায়ু মুহূর্তের জন্য দুর্বল হয়ে পড়ল।
মানে? যা শুনছেন তা কি সত্যি?
ব্রিটিশ সিংহের সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি, রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করেছে তিন বাঙালি যুবক?
মি টেগার্ট এবং মিসেস টেগার্ট যখন নিজেদের মধ্যে টেলিফোনিক আলাপ করছিলেন, তখন তাঁরা সম্ভবত কল্পনাও করতে পারেননি যে তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু বিনয় বসু ততক্ষণে আরও দুই সঙ্গী বাদল গুপ্ত আর দীনেশ গুপ্তকে নিয়ে ঢুকে পড়েছে খোদ রাইটার্স বিল্ডিং—এ।
কিছু করার নেই। লোম্যানকে মেরেছেন তাও চারমাস হয়ে গেল। বিনয় ছটফট করছিলেন নতুন অ্যাসাইনমেন্টের জন্য। কিন্তু বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের শীর্ষনেতাদের সায় নেই।
”তুমি বুঝতে পারছো না বিনয়। কমিশনার টেগার্ট তোমার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে। মেদিনীপুর, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সবজায়গায় চর রয়েছে পুলিশের। তোমার ছবি লাগিয়েছে সব শহরে। ধরিয়ে দিতে পারলে দশ হাজার টাকা। ভাবতে পারছো? তোমাকে দেখতে পেলেই কেউ—না—কেউ ঠিক ধরিয়ে দেবে!”
কিন্তু শত বারণ সত্ত্বেও বিনয় শুনলেন না। তাঁর তখন রাগ গনগন করে ফুটছে ইনস্পেক্টর জেনারেল অফ প্রিজন সিম্পসনের ওপর। লালমুখোটার এত সাহস সুভাষ বোসের গায়ে হাত দেয়?
বিনয় সাফ জানিয়ে দেন দলকে, ”আমি সিম্পসনকে শেষ করবই। আমাকে স্রেফ দুটো ছেলে দিন।”
বিনয়ের জেদের কাছে হার মানে দল। অবশেষে স্থির হয় সিম্পসন হত্যা মামলার ছক।
৮ ডিসেম্বর, অর্থাৎ যেদিনকার কথা বলছি, তার প্রায় চারমাস আগে শুরু হল সট্র্যাটেজি আলোচনা। বিনয় বসু তখন লুকিয়ে রয়েছেন মেটিয়াবুরুজে রাজেনবাবুর বাড়ি। আর বাদল ও দীনেশ ছিল নিউ পার্ক স্ট্রিটে বিপ্লবীদের গোপন ডেরায়।
৮ ডিসেম্বর খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলেন বিনয়। ততক্ষণে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের অ্যাকশন স্কোয়াডের নেতা রসময় শূর এসে পৌঁছেছেন বিনয়ের কাছে, ”কি হে নার্ভাস নাকি?”
”কী যে বলে রসময়দা! নার্ভাস কেন হব! যে পরীক্ষার রেজাল্ট তুমি জানো সেই পরীক্ষা নিয়ে কি তুমি ভয় পাবে?” হেসে বললেন বিনয়।
”সিম্পসনকে মারতে পারার কথা বলছিস?” রসময় বললেন।
”দুটোই।” বিনয় জামা পরতে পরতে বললেন, ”সিম্পসনকে তো মারব। কিন্তু রাইটার্সে ঢুকে কি আমরা আর বেরিয়ে আসতে পারব? কখনোই না। পুলিশের সবচেয়ে বড়ো আখড়া ওটা। শুধু এটাই আশীর্বাদ করো, যেন ওদের হাতে মরার আগে নিজেই মরতে পারি।”
রসময় আর কিছু পারলেন না। শুধু কম্পিত হাত রাখলেন বিনয়ের মাথার ওপর।
কিছুপরেই দু—জনে ট্যাক্সি করে এসে নামলেন খিদিরপুরের পাইপ রোডের মোড়ে। সেখানে দলের আরেক নেতা নিকুঞ্জ সেন অপেক্ষা করছিলেন বাদল আর দীনেশকে নিয়ে।
চোখে চোখে সামান্য কিছু কথার পর বিনয়, বাদল আর দীনেশ উঠে বসলেন আরেকটা ট্যাক্সিতে।
তিনজনেরই পরনে ধোপদুরস্ত কোট—প্যান্ট, মাথায় ইউরোপিয়ান টুপি।
রসময় আর নিকুঞ্জ ততক্ষণ পর্যন্ত নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে রইলেন ওদের ট্যাক্সির দিকে, যতক্ষণ না সেটা সম্পূর্ণ চোখের আড়াল হয়।
রাইটার্স বিল্ডিং তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বাড়ি। তার চারপাশে সর্বক্ষণ মোতায়েন আগ্নেয়াস্ত্র হাতে পুলিশ। একটা মাছিও গলবার জো নেই তাদের অলক্ষে।
ব্রিটিশ স্থাপত্যের চূড়ান্ত আভিজাত্য পরতে পরতে লেগে রয়েছে গোটা বাড়িটার গায়ে। প্রাসাদসম এই বাড়ির একদম ছাদে সমান ব্যবধানে বিরাজমান চারটি দেবীমূর্তি। বিজ্ঞান, কৃষি, বাণিজ্য এবং বিচারের দেবী তাঁরা। তার সামনেই মুখোমুখি বসে তিনজোড়া সিংহ মূর্তি যেন পাহারা দিচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে।
তখন রাইটার্সে বসতেন উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসারেরা। আগে থেকেই ঠিক ছিল, বিনয়, বাদল আর দীনেশ গাড়ি থেকে নেমেই চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে গটগটিয়ে হেঁটে যেতে লাগলেন রাইটার্সে প্রবেশ পথের দিকে।
গেটের পুলিশরা দেখেই বুঝল, এমন দৃপ্ত হাঁটার ভঙ্গি, এমন পোশাক, নিশ্চয়ই বড়ো কোনো অফিসার।
এক প্রহরী আরেক প্রহরীকে টেপে, ”আই সি এস হয়ে এল বোধ হয় বিলেত থেকে, বল?”
দ্বিতীয় প্রহরী কিছু বলার আগেই ততক্ষণে কাছে এসে পড়েছেন বিনয়রা।
প্রহরী নিখাদ অর্ধশিক্ষিত দেশীয় লোক। সে সম্ভ্রমভরে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বিনয় খাঁটি ইউরোপিয়ান উচ্চরণে কিছু একটা বাক্য বললেন।
প্রহরী কিছু বুঝলই না। না—বুঝুক, সমীহের সঙ্গে সে পেল্লায় সেলাম ঠুকল এই তিন নবাগত সাহেবের উদ্দেশ্যে, ”ইয়োর মোস্ট ওবিডিয়েন্ট সারভেন্ট স্যার!”
বিনয় সামান্য ঘৃণার দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে বাদল আর দীনেশকে নিয়ে সোজা ঢুকে এলেন রাইটার্সের ভেতরে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় চলে গেলেন সটান।
তিনজনেরই বুকের মধ্যে তখন হাতুড়ি পিটছে। দোতলা অত্যন্ত সুরক্ষিত স্থান, সেখানে বসেন সব হোমরাচোমরা কর্তারা। দু—একজন পাশ দিয়ে যেতে যেতে হাসলেন, বিনয়, বাদল, দীনেশ প্রতিসৌজন্যের হাসি ছুড়ে দিলেন তাদের দিকে।
বহুমূল্য পাথরের মেঝেতে বুটের খটখট শব্দ তুলে তাঁরা সোজা চলে গেলেন ইনস্পেক্টর জেনারেল অফ প্রিজন সিম্পসনের ঘরে। স্যুইং ডোর ঠেলে ঢুকে পড়লেন তিনজনে একসাথে।
সিম্পসন তখন তাঁর একান্ত সচিব জ্ঞান গুহর সঙ্গে কথা বলছিলেন। আচমকা এই তিনজন সুসজ্জিত যুবক ঢুকতে জ্ঞান গুহ সরে দাঁড়াতে যাবেন, এমন সময় একসঙ্গে বিনয়, বাদল, দীনেশ তিনজনেরই পিস্তল গর্জে উঠল সিম্পসনের বুক লক্ষ্য করে।
না, এবার আর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। সুভাষ বোসের গায়ে হাত তুলেছিলেন বলে কথা, এই অপরাধের কোনো ক্ষমা হয়?
ভারতমায়ের সেই তিনজন সোনার সন্তান তারিয়ে তারিয়ে দেখলেন চেয়ারে বসে বসেই মৃত্যুর কোলে সিম্পসনের ঢলে পড়া।
তৃপ্তিতে তিনজনেরই মুখ দিয়ে আনন্দের উচ্ছ্বাস বেরিয়ে এল। বিনয় ছিলেন দলের নেতা, বললেন, ”নেক্সট টার্গেট হোম সেক্রেটারি অ্যালবিয়ান। এই দোতলাতেই বসেন। চলো ক্যুইক!”
কিন্তু ততক্ষণে গুলির শব্দে কেঁপে উঠেছে গোটা রাইটার্স বিল্ডিং। নীচ থেকে রাশি রাশি বন্দুক নিয়ে ছুটে আসছে পুলিশের দল। অ্যালার্ম বাজছে ঘনঘন।
অসমসাহসী তিন যুবক তাতে ভ্রুক্ষেপই করলেন না। সিম্পসনের ঘর থেকে সোজা বেরিয়ে এসে এগিয়ে চললেন অ্যালবিয়ানের ঘরের দিকে।
ততক্ষণে ছুটে এসেছে দোতলায় ডিউটিরত এক কর্মী। উল্কার গতিতে তাকে গুলি করে শুইয়ে দিলেন বাদল। তিনজন ঢুকে পড়লেন হোম সেক্রেটারির ঘরে। আবার সেই গুলির আওয়াজ।
কিন্তু ততক্ষণে বিপদের আভাষ পেয়ে নিজের ঘরেই কোথাও লুকিয়ে পড়েছিলেন অ্যালবিয়ান।
ওদিকে ছুটে এসেছেন ইনস্পেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ মি ক্রেগ।
”সাংঘাতিক বিপদ! রাইটার্স আক্রমণ করেছে তিন বিপ্লবী! শিগগিরই লালবাজারে ফোন করো টেগার্ট স্যারকে!” কোনোমতে ইন্সট্রাকশন দিয়ে মি ক্রেগ বেরিয়ে এলেন অলিন্দে।
শুরু হল ইতিহাসের সেই বিখ্যাত অলিন্দযুদ্ধ।
অসম সেই যুদ্ধ। একদিকে বাঘা বাঘা পুলিশ, অন্যদিকে তিনজন সদ্যযুবা।
কিন্তু না, এই তিন যুবা অনেক এগিয়ে ওইপক্ষের থেকে। কারণ তিনজনেরই তো কোনো মৃত্যুভয় নেই! তাঁরা তো মরতেই এসেছেন!
মি ক্রেগের অজস্র গুলিবর্ষণে ক্রমাগত উত্তর দিয়ে চলল বিনয়—বাদল—দীনেশের বন্দুক। স্তম্ভিত ক্রেগকে সরিয়ে এবার এলেন মি ফোর্ড। তিনিও বেশিক্ষণ টিকতে পারলেন না। অস্ফুটকণ্ঠে তিনি বললেন, ”দে আর ফিয়ারলেস!”
মি ফোর্ডকে পিছিয়ে আসতে দেখে এবার হাল ধরলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ইনস্পেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ মি জোনস। কিন্তু তাঁর কয়েক রাউন্ড গুলি বিপ্লবীদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারল না।
এদিকে তাঁর দলের তিন—চারজনের হাত এর মধ্যেই উড়ে গেছে। পড়ে কাতরাচ্ছে তারা।
মি জোনস আর ঝুঁকি নিলেন না। এরমধ্যেই তাঁর এক সহকারী তাঁকে ফিসফিস করে বলেছে, ”এ যা গুলির টিপ, নির্ঘাত ওই বিনয় বোস ফিরে এসেছে স্যার!”
ঢাকায় বিনয় বোসের প্রায় ফুটবিশেক দূর থেকে গুলি করে লোম্যান সাহেব হত্যার পর তাঁর অব্যর্থ নিশানা তখন প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছিল।
মি জোনস এদিক—ওদিক তাকালেন, তারপর পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে পালালেন।
যখন ওদিকে আর কেউ নেই, ঠিক তখনই রাইটার্স বিল্ডিং—এর গেট দিয়ে ঢুকলেন কমিশনার টেগার্ট। তাঁর কাছে ফোন যাওয়ার পর তিনি আর একমুহূর্তও দেরি করেননি, বিশাল ফোর্স নিয়ে ছুটে এসেছিলেন লালবাজার থেকে।
যত অফিসারই পালাক, আগেই বলেছি টেগার্ট ছিলেন একেবারে বেপরোয়া। হাতে রিভলভার উঁচিয়ে তিনি লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিমেষের মধ্যে উঠে এলেন দোতলায়। তাঁর পিছু পিছু এল বিশাল বাহিনী।
এইবার শুরু হল রাজায় রাজায় লড়াই।
বিনয়দের ভয় কি! তাঁরা তো মরতেই এসেছেন! ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসতে লাগল দু—দিক থেকে।
মি টেগার্ট প্রথমে থমকে গেলেন; এতটা বড়ো হামলা তিনি কল্পনাও করেননি। ততক্ষণে মি জোনস এসে তাঁর কানে ফিসফিস করলেন, ”বিনয় বোস স্যার! শিয়োর!”
বিনয়ের নামটা যেন বিষ ঢালল টেগার্টের কানে, মুহূর্তে তাঁর মুখটা রাগে বিকৃত হয়ে গেল। চিৎকার করে তিনি বললেন, ”ফায়ার!”
প্রায় পঞ্চাশজন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কর্মচারীদের গুলি গর্জে উঠল, কান পাতা দায় হয়ে উঠল। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হল না।
কিছুক্ষণ পর টেগার্ট সবিস্ময়ে দেখলেন জুডিশিয়াল সেক্রেটারি নেলসন বিপ্লবীদের গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়েছেন মাটিতে।
কিছুক্ষণ পর লুটিয়ে পড়লেন আরও এক কর্তা, মি টায়নাম।
রণকৌশলী টেগার্ট মনে মনে দ্রুত ঘুঁটি সাজাতে লাগলেন। বিপ্লবীরা যতই পারদর্শী হোক, তাদের কাছে গুলি আছে সীমিত। সেই সুযোগটাই কাজে লাগাতে হবে।
অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার মি গর্ডনকে তিনি বললেন, ”কন্টিনিউয়াস ফায়ারিং করতে বলো সবাইকে।”
ওদিকের নেতা বিনয়ও কিন্তু সেই নির্দেশই দিয়েছিলেন তাঁর দলকে। গুলি ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে আসছে। ”শেষ গুলিটা শুধু নিজেদের জন্য রাখিস বুঝলি!” বললেন তিনি।
এইভাবে লড়াই চলল। তিন বিপ্লবী লড়াই করছেন, কিছুক্ষণ পরে পরেই চিৎকার করে উঠছেন, ”বন্দেমাতরম!” অর্থাৎ, ”মাকে জানাই প্রণাম!”
সেই বন্দেমাতরমের তেজে গোটা বাহিনী তো বটেই, খোদ টেগার্টও যেন মাঝে মাঝে দুলে যাচ্ছেন কীসের এক ভয়ে।
অবশেষে হঠাৎ গুলি এসে লাগল বিনয়ের হাতে। তারপর দেখা গেল প্রত্যেকের কাছেই রয়েছে আর একটি করে গুলি। উত্তেজনায় বাদল সেই গুলিটাও খরচ করে ফেললেন।
তিনজন একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। ভয়ের কোনো কারণ নেই। সব আগে থেকেই ঠিক করা আছে।
নেতা বিনয়ের নির্দেশে মুহূর্তের মধ্যে পকেট থেকে পটাশিয়াম সায়ানাইডের গুলি বের কেরে বাদল পুরে দিলেন নিজের মুখে। দীনেশও পুরলেন, কিন্তু পেটে যাওয়ার আগেই বমি হয়ে গেল সেটা। বাধ্য হয়ে নিজেকেই গুলি করলেন দীনেশ।
বিনয় ও এর মধ্যেই নিজের কপালে গুলি করেছেন।
টেগার্ট কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলেন ওদিকের গুলি শেষ। তিনি সামান্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দৌড়ে এলেন অলিন্দের এপাশে।
বাদল ততক্ষণে মৃত। বিনয় তখনও জীবিত, মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি।
টেগার্ট হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ”হোয়াট’স ইয়োর নেম, ইয়ং ম্যান?”
বিনয় ব্যাঙ্গের সুরে বলেন, ”আমি আপনার খুব পরিচিত মি টেগার্ট! যার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছিলেন। আমার নাম শ্রী বিনয় বসু।”
গোটা অলিন্দে তখন ভাঙা কাচ আর গুলির খোলের ছড়াছড়ি। তার মধ্যেই চমকে উঠলেন টেগার্ট।
এই সেই বিনয়! এরজন্যই দিনের পর দিন ঘুমোতে পারেননি তিনি! নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারেন না টেগার্ট, এগিয়ে গিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী বিনয়ের হাতের আঙুল চেপে ধরলেন তাঁর বুট দিয়ে।
ব্রিটিশরা সাধারণত মৃত্যুপথযাত্রীকে শান্তিতে ইহলোক ত্যাগ করতে দিতে চায়, টেগার্ট নিজে কখনো মুমূর্ষু ব্যক্তির ওপর অত্যাচার করতেন না।
কিন্তু বিনয় বসুর ক্ষেত্রে বহুদিনের জমে থাকা রাগ যেন তাঁর সমস্ত মূল্যবোধকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল।
বিনয়ের প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাওয়ার আগেই হাতের আঙুলগুলো ভেঙে গেল।
তবু তিনি বললেন, ”বন্দেমাতরম!”
টেগার্ট আর দেরি করলেন না, বিনয় আর দীনেশ দু—জনকেই পাঠালেন মেডিক্যাল কলেজে।
সেখানে কয়েকদিন পর ১৩ ডিসেম্বর নিজের ক্ষতস্থান খুঁটে সেপ্টিক করে হাসতে হাসতে মারা যান ডাক্তারি ছাত্র বিনয়। ব্রিটিশ সরকারের ফাঁসির দড়ি গলায় পরবার চেয়ে এই মৃত্যু অনেক গৌরবের যে!
অলিন্দযুদ্ধের একমাত্র জীবিত নায়ক দীনেশ সুস্থ হয়ে উঠলেন অচিরেই। শুরু হল বিখ্যাত রাইটার্স হত্যা মামলা।
দীনেশের বিচার শুরু হল স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে। সভাপতি ছিলেন দায়রা জজ মি গার্লিক।
দিনের পর দিন শুনানি চলতে লাগল। আদালত প্রাঙ্গণ উপচে পড়তে লাগল মানুষের ভিড়ে। সবাই যে দেখতে চায় বাংলার নয়নের মণি দীনেশকে!
রায় ঘোষণার পর কেঁদে ফেললেন হাজার হাজার মানুষ। গ্রামেগঞ্জে বের হতে লাগল দীনেশের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল।
মৃত্যুদণ্ডে শেষ ছাপ এসে গেল প্রিভি কাউন্সিল থেকেও।
গোটা দেশের মানুষের কান্না অতিক্রম করে ৭ জুলাই সকালে দীনেশ স্নান করে এসে দাড়ালেন ফাঁসির মঞ্চে।
শোনা যায়, সেন্ট্রাল জেলের রাজবন্দিরা তো বটেই—সাধারণ বন্দিরাও সেদিন দীনেশের জন্য চোখের জল ফেলেছিল।
অচঞ্চল ধীর হাস্যমুখ দীনেশ তিন বার বললেন, ”বন্দেমাতরম!” আবৃত্তি করলেন তাঁর প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথের কবিতা, তারপর নিজেই টেনে গলায় পরে নিলেন দড়ি।
জেলের বাইরে তখন ভেঙে পড়েছে মানুষ। সবাই কাঁদছে। কাঁদছে ওদের তিনজনের জন্য। এমন তিনটে ছেলে এভাবে চলে গেল? কতই—বা বয়স! মারা যাওয়ার সময় বিনয় বাইশে পড়েছিলেন সবে, দীনেশ উনিশে, আর সকলের ছোটো ছিলেন বাদল, সবেমাত্র আঠেরো বছর বয়স হয়েছিল তাঁর।
না, মিসেস টেগার্টের আশঙ্কা কোনোদিন সত্যি হয়নি। সুনামের সঙ্গে নিজের কর্মজীবন শেষ করে টেগার্ট সস্ত্রীক পাড়ি দিয়েছিলেন বিলেতে।
আজও রাইটার্সের বারান্দা দিয়ে যখন হাঁটি, তখন গর্বে বুক ফুলে ওঠে এই খুনিদের জন্য! ভাবি কোথা থেকে পেয়েছিলেন এমন অসম্ভব মনোবল?
বিনয়—বাদল—দীনেশকে তবু নামে চেনেন মানুষ, কিন্তু অনুজা সেন, রসময় গুহের মতো বিপ্লবীরা তলিয়ে গেছেন স্মৃতির অতলে। সবাই কিন্তু নিজেদের উজাড় করে দিয়েছিলেন!
তাঁরা দিয়ে গেছেন আঁজলা ভরে, বিনিময়ে চাননি কিছুই!