রাঁধে মেয়ে কি চুল বাঁধে না?

“রাঁধে মেয়ে কি চুল বাঁধে না?”

চীনেদের ঠেঙিয়ে বের করতে হবে, এ তো বাঙলা কথা। কিন্তু রাধে মেয়ে কি চুল বাঁধে?– এর অর্থটি সরল। যে মেয়ে রাঁধছে তার যদি খোঁপাটি তখন ঢিলে হয়ে যায় তবে সে কি রাঁধতে রাঁধতেই চুল বাঁধে না? রান্না বড়ই প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান, কিন্তু চুল বাধাটা এমন কিছু মারাত্মক অপরিহার্য শুভকর্ম নয় যে, তদভাবে বাড়িসুদ্ধ লোক মারমুখো হয়ে চেলি নিয়ে বাড়ির বউয়ের দিকে তাড়া লাগাবে। তবু বাড়ির বউ জানে, রাঁধতে হয়, চুলও বাঁধতে হয়।

অর্থাৎ চীনাকে ঠ্যাঙাবার ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে আরও পাঁচটা কাজ আছে। সেগুলো আপাতদৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় মনে না হলেও দেশসুদ্ধ লোকের কঠোর কৃসাধনে লিপ্ত হয়ে শিবনেত্র হয়ে যাওয়ারও কোনও অর্থ হয় না। অবশ্য এ কথা সত্য, যুদ্ধের বাজারে কোনটা যে রাধা অর্থাৎ অত্যাবশ্যক আর কোনটা যে চুল বাঁধা অর্থাৎ দোহার, এ দুটোতে আকছারই ঘুলিয়ে যায়। ধড়িবাজ মেয়ে যে চুল বাঁধার ছল করে রান্নার গাফিলি করে এটা জানা কথা এবং কট্টর গিন্নি যে বেধড়ক রান্নার তোড়ে খাটাশের মতো চেহারা বানিয়ে তোলেন সে-ও জানা কথা।

এ দুটোর তফাত করবেন দেশের কর্তাব্যক্তিরা। আমার শাস্রাধিকার নেই। তবে কিঞ্চিৎ অতি সামান্য অভিজ্ঞতা আছে। একবার আমি অতিশয় অনিচ্ছায় এক খণ্ড যুদ্ধের মাঝখানে তুচ্ছ উলুখড়েরও জীবন যে কী মর্মান্তিক নিদারুণ হতে পারে তার প্লীহাতঙ্কী– পীতাতঙ্কের সঙ্গে ঘুলিয়ে ফেলবেন না, ওটা আমার নেই– অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলুম। সে দুর্দিনে পেটের ভাত জুটছিল না বলে ভয়ের চোটে সেটা শুকিয়ে চাল হতে পারেনি। তার বর্ণনা পুস্তকাকারে ছাপিয়েও ছিলুম। তবে আপনারা সেটি পড়েছেন বলে মনে হয় না– বঙ্কিম চাটুয্যে স্ট্রিট তো তাই বলে।

দ্বিতীয়বার আমি স্যানা হয়ে গিয়েছি– কথায় বলে, একবার ঠকলে ঠকের দোষ, দুবার ঠকলে তোমার দোষ। সাল ১৯৩০ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত উভয় পক্ষের যুযুধানকে উত্তমরূপে পর্যবেক্ষণ করার পর যখন আমার প্লীহা দ্বিতীয়বার উলুখড় হতে কবুল জবাব দিল, তখন নিরপেক্ষ স্থল অকুস্থলে পরিণত হওয়ার পূর্বেই আমি আমার যুবতী স্ত্রী নিয়ে পলায়ন করি (য পলায়তি স জীবতি–কে বলে আমি সংস্কৃত জানিনে!)।

দেশে ফিরেই কানটি সেঁটে দিলুম বেতারের লাউড়স্পিকারের সঙ্গে। জর্মন কী বলছে না বলছে সে তো ইংরেজ এই কালা আদমিকে সদয় হয়ে শোনাবে না। তার পর মস্কো বেতার। সেটা যখন হিটলার গুঁড়িয়ে দিল তখন কুইবিশেফ। সেটাও যখন দাঁতমুখ খিঁচিয়েও শোনা যায় না, তখন রুশদেশেরই ছোট্ট বেতারকেন্দ্র আজারবাইজান ভাগ্যিস তারা ফারসিতেও খবর প্রচার করত।

যুদ্ধের পর হালের বলদ নৌকোর পাল বিক্রি করে যুদ্ধ বাবদে জর্মন এবং ফরাসি বই কিনেছি দেদার। ইংরেজি বই এদেশে পাওয়া যায়। চুরি করে চালিয়ে নিই।

মোকা পাওয়ামাত্রই দুবার জর্মন ঘুরে এসেছি। ১৯৫৮ এবং এই গ্রীষ্মের ১৯৬২-তে। এবং জোর গলায় পরিষ্কার করে ফের বলতে হল, প্রধানত মিশেছি নিম্নমধ্যশ্রেণি এবং ফ্যাক্টরিতে যারা কাজ করে তাদের সঙ্গে তাদেরই মিলনকেন্দ্র ক্লাইপেতে, লকালে বা বিয়ারখানায়, যা খুশি বলতে পারেন। বড়লোকদের সঙ্গে মিশেছি অল্পই। তবে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে ইচ্ছায়, কিছুটা অনিচ্ছায় মিশতে হয়েছে খানিকটা। কুপ স্টিনেসদের সঙ্গে মেশবার কোনও সুযোগই হয়নি। আমার লেখা গোগ্রাসে না গিলে আস্তে আস্তে পড়লেই এ কথাটা পাঠক মাত্রই বুঝতে পারবেন। জর্মনি সম্বন্ধে আমার যা জ্ঞান-গম্যি তার ৯০ নঃ পঃ বিয়ারখানা থেকে সংগৃহীত, বাকিটা বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি থেকে। তাদের সক্কলেরই মোটরগাড়ি ছিল কিন্তু দাসী, হাউস-টখটর, এমনকি হেল্পিং হ্যান্ডও ছিল না।

এর থেকে আমার যা সামান্য অভিজ্ঞতা হয়েছে, তারই জোরে দু-একটি কথা নিবেদন করি।

 এই চুল বাধার কথা ধরা যাক্।

১৯৩৯-এ হিটলার যখন লড়াইয়ের জিন্ বোতল থেকে বের করে আসমানে ছেড়ে দিলেন তখন যুদ্ধ বাবদে তাঁরও অভিজ্ঞতা ছিল কম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি করপোরেলরূপে লড়েছিলেন সত্য, কিন্তু তাতে করে তো অল আউট ওয়োর সম্বন্ধে ওকিবহাল হয়ে যাওয়ার কথা নয়। তাই তিনি ভাবলেন, সর্বপ্রথম উচিত-কর্ম হচ্ছে, বিলাসব্যসন ত্যাগ করা। তাই বন্ধ করে দাও হেয়ার ড্রেসিং সলুনগুলো।

এস্থলে একটুখানি সবিস্তর বুঝিয়ে বলতে হয়, জর্মনির শহুরে মেয়েরা এই ড্রেসিং সলুনের ওপর কতখানি নির্ভর করে। এবং আজকের চেয়ে ১৯৩৯ সালে নির্ভর করত আরও অনেক বেশি। তখনও পার্মানেন্ট ওয়েভ-এর জোর রেওয়াজ। সলুনওলী প্রথম চুলে ঢেউ খেলিয়ে দিয়ে পরিয়ে দেয় এক মুকুট, চালিয়ে দেয় ইলেটিরি যন্ত্র। এসবের মারপ্যাঁচ আমি বুঝিনে। তবে মুকুট খোলর পর দেখা যায়, দিব্যি ঢেউ-খেলানো চুল হয়ে গিয়েছে। নতুন করে গোড়ার দিকের চুল বেশ খানিকটে না গজানো পর্যন্ত এ ঢেউ লোপ পায় না।

যারা সলুনে ঢেউ-খেলানো চুলের মাথা বানিয়ে নিয়ে আসে, তাদের মস্তকে হল বজ্রাঘাত হিটলারের এই হুকুম শুনে। শহরের বহু বহু মেয়ে আপন চুলের তদারকি নিজে করতে পারে না। এক মাসের ভিতরই দেখা গেল মাথায় মাথায় বাবুইয়ের বাসা। কিন্তু কার ঘাড়ে দুটো মাথা যে হুজুর হিটলারের কাছে এর প্রতিবাদ জানায়! সবাই গিয়ে কেঁদে পড়লেন ফ্রাউ গ্যোবেসের পায়ে। এভা ব্রাউন, রিফেনটালের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পূর্বে হিটলার প্রায় প্রতিদিন গ্যোবেলদের বাড়ি যেতেন। শেষ দিন পর্যন্ত হিটলারের ওপর ছিল তাঁর অসাধারণ প্রতিপত্তি– স্বৈরতন্ত্রের সর্বাধিনায়কের ওপর যতখানি হতে পারে। (তাই ফ্রাউ গ্যোবেলস্ যখন জানতে পারলেন হিটলার আত্মহত্যা করবেন, তখন তিনি বললেন, ফুরার-হীন পৃথিবীতে বেঁচে থেকে কী লাভ, আমিও আত্মহত্যা করব, এবং তিনি তাই করেও ছিলেন।)

 ফ্রাউ গ্যোবেলস্ হিটলারের সামনে গিয়ে বললেন, মাই ফুরার (প্রভু আমার)! আপনি কি চান যে আপনার জওয়ানরা রণক্ষেত্র থেকে ছুটিতে ফিরে এসে দেখুক কতকগুলো উস্কোখুস্কো চুলওলী খাটাশীদের?

হিটলার আইন নাকচ করে দিলেন।

তাই বলছিলুম রাধে মেয়ে কি চুল বাঁধে না?

***

এখন প্রশ্ন, কোন কোন কর্ম স্থগিত রাখতে হবে, আর কোন কোন কর্ম আরও জোরসে চালাতে হবে। পূর্বেই এ প্রশ্নের আভাস দিয়েছি এবং এখনও বলছি, আমি সমাজপতি নই, কাজেই আমি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম। তবে একটা কথা বলতে পারি, বুক ঠুকে বলতে পারি– আমরা যেন হাসতে ভুলে না যাই। অর্বাচীন চীনের আচরণে ব্যথিত হয়ে আমাদের শিবুদা (শিবরাম চক্রবর্তী) যদি মশকরা করতে ভুলে যান তবে আমি হাসতে হাসতে তাঁকেই জবাই করব।

এই হাসতে পারাটা গণতন্ত্রের প্রধান লক্ষণ। পণ্ডিতজি চীনকে বিশ্বাস করে যে ঠকেছেন তাই নিয়ে সুবে বিলেত-মার্কিন পশ্চিম ইয়োরোপ হাসছে। কত না কার্টুন ব্যঙ্গচিত্র বেরোচ্ছে। আমরা প্রাণ খুলে হাসতে পারছিনে সত্য কিন্তু শীতকালে ঠোঁট ফেটে গেলে তোক যেরকম হাসে সে-রকম হাসছি তো সত্য। কারণ একা পণ্ডিতজি তো চীনকে বিশ্বাস করেননি, আপনি-আমি রামা-শ্যামারাও করেছিলুম। এখন সবাই আমাদেরই নিয়ে হাসছে। এ অবস্থায় আমাদের চটে যাওয়াটা অতিশয় অরসিকের কর্ম হবে। আমরাই শুধু দুনিয়ায় পাগলামি, দুষ্টামি দেখে হাসব, আর আমাদের সরলতা আমাদের ভালো-মানষামি দেখে অন্য লোকের হাসি আমরা সইব না, এটা কোনও ভালো কথা নয়।

এই তো সেদিন একটা রসিকতা পড়ছিলুম।

পূর্ব জর্মনির এক কুকুর পশ্চিম জর্মনির মামাতো ভাইয়ের বাড়িতে কয়েকটা দিন কাটাতে এসেছে। অতিথিবৎসল দাদা শুধাল, তোকে কী খেতে দেব বল দিকিনি, ভাইয়া! গুটিকয়েক সরেস, তাজা খাজা হাড্ডি চিবুবি?

পূর্ব জর্মনির কুকুর বলল, না, থ্যাঙ্কু! আমাদের ওদিকে মেলাই খাবার রয়েছে! তোদের চেয়ে অনেক ভালো!

দাদা শুধাল, তবে, তবে কিছু একটা চাটবি? জল? শরবত? দুধ? মদ?

না, ওসবের আমার দরকার নেই। বাড়িতে ঢের রয়েছে।

তা হলে চল, আমার ঘরে একটু জিরিয়ে নে।

কিছু দরকার নেই। আমার দিব্যি সুন্দর ঘর রয়েছে বাড়িতে।

বড়দা তখন চটে গিয়েছে। হুঙ্কার ছেড়ে বলল, তবে এখানে মরতে এসেছিস কেন? তোর যখন সবই রয়েছে?

ও দাদা! এখানে যে প্রাণভরে ঘেউ ঘেউ করা যায়। আমি ঘেউ ঘেউ করব।

***

ওই হল লৌহ-যবনিকার ওপারের দেশের আইন। সেখানে আপন আপত্তি অজুহাত চেঁচিয়ে জানানো বারণ। সেখানে আইনকানুন সর্বনেশে। আমরা এদিকে যত খুশি ঘেউ ঘেউ করতে পারি কিন্তু হাসতে যেন না ভুলি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *