রাঁড় কাহিনি

রাঁড় কাহিনি

১৮৫৭ সালের সিপাহিবিদ্রোহের কিছু পরের কথা।

জোব চার্ণকের কলিকাতা নগরী যখন বিলিতি লন্ঠনের আলোয় ধীরে ধীরে জেগে উঠছে, ধনী বাবুরা যখন গ্রামের জমিদারি নিংড়ে প্রজা শোষণ করে মহানগরীর অলিতেগলিতে নিজের প্রতিপত্তি দেখাতে রক্ষিতার বাড়ি বানিয়ে, তাকে আপাদমস্তক অলংকারে সাজিয়ে সুরা, নারী ও বুলবুলি বিলাসে মত্ত, অন্তঃসারশূন্য নব্য যুবকেরা যখন ইংরেজির অন্ধ অনুকরণে মাতোয়ারা, মালকোচা মারা ধুতি আর বেনিয়ান গায়ে বাঙালি যখন ইয়ারবকসি নিয়ে ফুর্তি করতে এসে গড়াগড়ি যায় সোনাগাজির নর্দমার ধারে, অন্যদিকে বিদ্যাসাগর যখন গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত স্থানে স্থানে প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন একের পর এক বালিকা বিদ্যালয়, মাইকেল মধুসূদন যখন পিলসুজের আলোয় রচনা করছেন মেঘনাদবধ কাব্য, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্ম নিচ্ছে দেবেন্দ্রনাথের একের পর এক সুসন্তান, এই অবিশ্বাস্য, মেরুদণ্ডে হিমধরানো অপরাধ কাহিনি ঠিক তখনকার।

ভদ্রপরিবারের নারী তখনও অবগুণ্ঠিতা, আইনের ফাঁসে সতীদাহ রদ হলেও আড়ালে আবডালে চলছে সেই নির্মম মারণযজ্ঞ। তখনও দশ পেরোলে বাবা মা কন্যার বিয়ে দিতে না পারলে কানাঘুসো শুরু হয়ে যায় পল্লীতে। ভয় থাকে সমাজে একঘরে হওয়ার। লেখাপড়া শিখলেই বিধবা হতে হবে, এমন ভয় তখনও আমূল গেঁথে বসে আছে মানুষের মনে। জাতপাত, কুসংস্কার, অশিক্ষা সব দিক থেকে অজগরের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে সকলকে।

সেই সময়ের এক কুলীন ব্রাহ্মণকন্যা কিভাবে লজ্জাশীলা রমণী থেকে হয়ে উঠল পোড় খাওয়া এক খুনি, অবলীলায় করে চলল একের—পর—এক খুন, শিহরণ জাগানো অপরাধ, হয়ে উঠল উনবিংশ শতাব্দীতে একমাত্র বাঙালি সিরিয়াল কিলার রমণী, এই কাহিনির ছত্রে ছত্রে রয়েছে তারই রুদ্ধশ্বাস বর্ণনা।

সিপাহিবিদ্রোহ তখন সবে শেষ হয়েছে। শিক্ষিত ভারতীয় বিশ্বাস করতে শিখছে ব্রিটিশ শিকলের পরাধীনতাই আপাতত ভবিতব্য, মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ অধীশ্বর বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফর বর্মায় বসে অপেক্ষা করছেন জান্নাতের ডাকের, এমন সময় গ্রামবাংলার বর্ধমান জেলার একটি ছোট্ট গ্রামের এক কুলীন ব্রাহ্মণ বড়ই বিপদে পড়লেন।

তিনি জাতে স্বভাব কুলীন, অর্থাৎ এখনও পর্যন্ত পৈতৃক সূত্রে পাওয়া কৌলীন্য যথাযথ মর্যাদায় ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু এবার বোধ হয় এই রক্ষণশীল ব্রাহ্মণের মান যায়।

চিন্তিতভাবে তিনি রাত্রিবেলা কাজকর্ম সেরে হুঁকোয় টান দিয়ে তাঁর স্ত্রীকে বলেন, ‘ওগো, ত্রৈলোক্যর জন্য যে কোন পাত্তরই পাচ্চি না!’

তাঁর ব্রাহ্মণী বলেন, ‘কেন, এই যে বল্লে কাটিগ্রামে একটা ভাল সম্বন্ধ পেয়েচ?’

ব্রাহ্মণ দ্রুত মাথা নাড়েন, ‘উঁহু। হবে না। পরিবারের দোষ আচে। ভণ্ড কুলীন। পেত্থমে খপর পাইনি, তাই রাজী হয়েচিলুম, পরে আসল কতা কানে এল। ঘটক ব্যাটা টাকার পিশাচ, বেমালুম নুকিয়ে গিয়েচিল।’

ব্রাহ্মণী স্বামীর দৃষ্টি এড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আড়চোখে তাকান অনতিদূরে ঘুমন্ত কন্যার দিকে। ঈশ্বরের কৃপায় এই একটামাত্র সন্তান তাঁদের। অনেক সাধ করে নাম রেখেছিলেন ত্রৈলোক্যতারিণী। নিজের মেয়ে বলে নয়, এই পাড়াগাঁয়ে সবাই স্বীকার করে, ত্রৈলোক্যর মতো সুন্দরী এই গ্রামে আর একটিও নেই। বয়স সাত পুরে আটে পড়তে না পড়তেই বন্যার মতো সম্বন্ধ আসা শুরু হয়েছিল। মেয়ে বেড়েও উঠছিল একেবারে পুঁইডগার মতো তরতরিয়ে।

কিন্তু ওই যে মেয়ের বাপের ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা! একেবারে দোষ ত্রুটিহীন সমান কুলীন ঘর ছাড়া বিয়ে দেবেন না। একে একে সম্বন্ধ কমতে লাগল, ওদিকে বয়স তো আর থেমে থাকার নয়, সে তো বেড়েই চলেছে।

কি যে হবে কে জানে! ব্রাহ্মণীর দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না। একচিলতে তক্তায় শুয়ে শুয়ে বাতায়ন পেরিয়ে ওপাশের অন্ধকার একফালি উদ্যানের দিকে চোখ চলে যায় তাঁর। ত্রৈলোক্য গত আশ্বিনে বারো পেরিয়ে তেরোয় পড়েছে। ইতিমধ্যেই গ্রামে গুঞ্জন উঠেছে। এরপর মুখ দেখানো দায় হয়ে উঠবে।

ত্রৈলোক্য বারো বছরের বালিকা, তখনকার গ্রামের প্রতিটি মেয়ের মতোই লেখাপড়া সে শেখেনি। জ্ঞান হওয়া ইস্তক সে জানে, বাবা তার জন্য সুপাত্র খুঁজছেন, বাকি আর পাঁচটা মেয়ের মতোই সে সারাদিন খায়, দায়, ঘোরে ফেরে আর শ্বশুরবাড়ি গমনের প্রতীক্ষা করে।

তাঁদের বাসস্থান লাগোয়া একটি ছোট্ট খড়ের ঘর রয়েছে, তাতে থাকে তারা নামে একজন বৈষ্ণবী স্ত্রীলোক। তার খড়ের ঘরটি আগে ত্রৈলোক্যের বাবারই ছিল, কয়েক বছর আগে তারা বৈষ্ণবী সেটি কিনে নিয়েছে।

তারা বৈষ্ণবীর বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ, শ্যামবর্ণা, শরীরের গড়ন এখনো সুশ্রী। এককালে যে সে সুন্দরী ছিল, তা বিলক্ষণ বোঝা যায়। এখন অবশ্য সে সৌন্দর্য সম্পর্কে উদাসীন, গলায় তুলসীর মালা, নাকে রসকলি আর হাতে হরিনামের ঝুলি ছাড়া তাকে দেখা যায় না।

গোটা গ্রামের কাছে এই তারা বৈষ্ণবী ছিল সর্বঘটের কাঁঠালিকলার মতো। গ্রামের যে কোনো পরিবারের আকস্মিক বিপদ হোক, বা দুই প্রতিবেশিনীর মেয়েলি ঝগড়া, তারা বৈষ্ণবী সব স্থানেই উপস্থিত থাকে। তারা বৈষ্ণবী সম্পর্কে গ্রামের কেউ কেউ অবশ্য বলে থাকে যে তার স্বামী ছিল, বহুদিন হল সে দেশান্তরী হয়েছে, কিন্তু কেউ তাকে দেখেনি। বৈষ্ণবী আগে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে ভিক্ষা করে বেড়াত, ইদানীং তাও করেনা, অথচ তাতে তার গ্রাসাচ্ছাদনের কোনো অভাব হয় না। এ ভারি আশ্চর্যের কথা বটে। যাইহোক, তেরো বছরের ত্রৈলোক্যর অত কিছু ভেবে কাজ নেই, সে তার তারাদিদিকে বড়ো ভালোবাসে। পাড়াগেঁয়ে মেয়ে, বিনোদনের কোনো অবকাশ নেই, এত বয়সেও অনূঢ়া থাকায় ইতিমধ্যেই সমবয়সী সখীর অভাব ঘটছে তার। এমন অবস্থায় তারাদিদির কাছে গিয়ে সে বড়ো আনন্দ পায়।

এই বয়সে মন এমনিই চঞ্চল থাকে, তার ওপর নিজবয়সি বান্ধবীরা স্বামীসংসর্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, ক্বচিৎ কদাচিৎ তারা পিত্রালয়ে এলে পুকুরপাড়ে স্নানের সময় ত্রৈলোক্যর নাক টিপে দেয়। বলে, ‘ইস, ওর এখনও নাক টিপলে দুধ গলে, আহা রে, খুকি আমাদের!’

ত্রৈলোক্য ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড রেগে যায়, মনে হয় সবাই যেন ওকে উপহাস করছে। এঁদের সবারই কি জানি অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছে, যাতে সে একেবারে অজ্ঞ। ধীরে ধীরে সখীসঙ্গ তার আর ভাললাগে না, সাংসারিক কাজ সামলে অবসর পেলেই সে ছুটে চলে যায় তারাদিদির কাছে।

আর তারাদিদিও তার কন্যাসমা এই বালিকাটিকে যে কেন এত স্নেহ করে তা বোঝা যায় না। ব্রাহ্মণের অভাবের সংসারে ত্রৈলোক্য কিছুই বাপ-মায়ের কাছে পায় না, কিন্তু তার গন্ধতেলটা, নতুন কাপড়টা সবই প্রায় লুকিয়ে দেয় তারাদিদি। সঙ্গে শোনায় পুরুষ-নারীর আদিরসের কথা, যৌবনের নিগূঢ় রহস্যের কথা।

প্রথম প্রথম ত্রৈলোক্যর লজ্জা লাগত, আড়ষ্ট হয়ে উঠত মন। মনে হত, এগুলো শুনেও যেন সে পাপ করে ফেলছে কিছু। কিন্তু তারাদিদি তাকে বোঝায়, ‘দুর মুখপুড়ি, এতে এত লজ্জার কি আচে? মেঘে মেঘে এত বেলা হল, ঠিক বয়সে বে হলে অ্যাদ্দিনে দুটো ছেলে পেটে ধরে ফেলতিস। এই ধিঙ্গি বয়সে বে হলে তখনো যদি কিচুই না বুজিস, বর ছেড়ে দেবে ভেবেচিস? ওরে, পুরুষ মানুষ সোমত্থ বউয়ের কাচে এগুলো চায়, বুজলি?’

ত্রৈলোক্য অত কিছু বোঝে না। তারাদিদির অন্ধকার ঘরে পিদিমের বিবর্ণ আলোয় দেহতত্ত্বের কথা শুনতে শুনতে তার কর্ণমূল লজ্জায় আরক্ত হয়ে আসে, আবার ভালোও লাগে কেমন যেন, শরীরে ঝিমঝিম ধরে, কেমন এক সুখানুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে মন। রাত গভীর হলে একান্ত অনিচ্ছায় নিজের বাড়ি গিয়ে ঘুমনোর সময়ও মানসচক্ষে ভাসতে থাকে সেই সব রতিদৃশ্য।

ত্রৈলোক্যর বাপকে বেশিদিন আর গ্রামের মান্যগণ্যদের গঞ্জনা সহ্য করতে হল না। তেরো পূর্ণ হওয়ার আগেই ত্রৈলোক্যর জন্য যেমন খুঁজছিলেন, তেমনই একটি পাত্র পেয়ে গেলেন তিনি।

পাত্রের বাড়ি পূর্ববঙ্গে, বয়স একটু বেশি, তা প্রায় পঞ্চাশ। সে হোক, নিজেদের ঘর, একেবারে স্বভাব কুলীন, যেমনটা ত্রৈলোক্যের পিতা চাইছিলেন।

ব্রাহ্মণী একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘হ্যাঁগা, পাত্রের বিষয়-আশয় ক্যামন আচে গিয়ে একবার দেকে এলে হয় না?’

‘আহ, ত্রৈলোক্য কি শ্বশুরঘর করবে নাকি যে গিয়ে সব দেকে আসতে হবে? বাবাজীবনের তো পনেরোটার ওপর বে, ত্রৈলোক্য একানেই থাকবে। জামাই বাবাজীবন বছরে একবার করে হয়ত আসবে।’ ব্রাহ্মণ গড়গড়া থেকে মুখ তুলে বিরক্তির সুরে বলেছিলেন, ‘তুমি আর বাগড়া দিও না তো বাপু, একেই এত কম ট্যাকায় কোন কুলীন পাত্তর বে করতে রাজি হয় না। এ যে হয়েচে, তা আমার চোদ্দো পুরুষের ভাগ্যি!’

‘রাজি হবে না কেন!” ব্রাহ্মণী ম্লানমুখে নিজের মনেই গজগজ করেন, ‘পঞ্চাশ বছর বয়স, আর কদ্দিন বে-র ব্যবসা করবে? দাম তো কমাতেই হবে।’

ত্রৈলোক্য অত কিছু জানেনা, নিজের বিবাহ স্থির হওয়ার সংবাদ পেয়েই সে উৎফুল্ল মনে গিয়ে খবর দেয় তারাদিদিকে, ‘তারাদিদি, আমার বে ঠিক হয়ে গ্যাচে। সামনের পূর্ণিমায় লগ্ন আচে না? সেইদিন।’

‘ওমা এ যে মোক্ষম সংবাদ!’ তারাদিদি এসে ত্রৈলোক্যর পানপাতার মতো মুখখানা স্নেহের আতিশয্যে চেপে ধরে নিজের বুকে, ‘তা বরের কাচে কি কি রসের কতা কইবি সব মনে আচে তো?’

ত্রৈলোক্যর মুখ লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে, ”যাহ, কি যে বল না তুমি তারাদিদি! আমি ওসব পারব না।”

‘শোনো মেয়ের কতা!” তারাদিদি ছদ্ম-বিস্ময়ে ত্রৈলোক্যর দিকে চোখ বড়োবড়ো করে তাকায়, ”পারবি না কি লো! অ্যাতো করে যে শেকালুম…!’

ত্রৈলোক্য বোঝে তারাদিদি এখনই শুরু করবে আবার সেই শরীরী রসের কথা, অন্যদিন আগ্রহভরে শুনলেও আজ যেন কোথা থেকে এ-রাজ্যের লজ্জা এসে ভর করে তার শরীরে। এক ছুট্টে সে পালিয়ে যায় ঘর থেকে।

অবশেষে এক পুণ্যলগ্নে আমাদের ত্রয়োদশবর্ষীয়া ত্রৈলোক্যর বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের শুভলগ্নে শুভদৃষ্টির সময় ত্রৈলোক্য অনেক আশা নিয়ে চোখ মেলেছিল, কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে তার সব স্বপ্ন তখনই খানখান হয়ে গেল।

বর যে তার বাপের চেয়েও বড়ো!

পঞ্চাশ বছরের শীর্ণ ক্লিষ্ট স্বামী পেয়ে তারাদিদির কাছে আহরণ করা শিক্ষা ব্যর্থ তো হলই, রাগে দুঃখে ত্রৈলোক্য অস্থির হয়ে উঠল। বিয়ের আয়োজন মিটে যেতেই তার মনে হতে লাগলো, তার এই দুর্দশার জন্য দায়ী আর কেউ নয়, তার নিজের বাপ-মা। কুলীন কুলীন করে গোঁড়ামির জন্য বলি হতে হয়েছে তাকে।

বিয়ের পরে ত্রৈলোক্যর স্বামী অবশ্য বেশি সময় অপচয় করলেন না, বিবাহ বাবদ যৌতুক ও দেনা পাওনা আগেই বুঝে নিয়েছিলেন, বিয়ের পরের কিছুদিন শ্বশুরালয়ে অবস্থান করে আরও কিছু উপঢৌকন সঞ্চয় করে তিনি তেরো বছরের স্ত্রীকে পিত্রালয়ে রেখে রওনা দিলেন। গোটা বছরটা তাঁকে নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কিছুদিন করে থেকে স্ত্রীদের স্বামীসেবা করার সুযোগ দিতে হয়, এক জায়গায় থাকার অবকাশ কোথায়?

স্বামী বিদায় নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যে ত্রৈলোক্য নিজের অবসাদ কাটিয়ে উঠে আবার সময় কাটাতে শুরু করল তারাদিদির সঙ্গে। সে আসলে নিজের মনকেই বোঝাল, ‘বুড়ো সোয়ামি পেয়েচি ঠিক, সে তো কত মেয়েই পায়, কিন্তু বাড়ির পাশে এমন দিদি পাওয়ার সৌভাগ্যি ক-জনার হয়? আমাকে তো আর ওই বুড়োর সংসার করতে যেতে হচ্চে না। যেমন বে—র আগে ছিলুম, তেমনই রয়েচি। তাই সই!’

তারা বৈষ্ণবী তাকে নিরাশ করল না, কুমারী অবস্থায় যেমন ভালোবাসত, সধবা হওয়ার পর ভালোবাসার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল। একটা সময় এমন হল, রাতটুকু ছাড়া ত্রৈলোক্য গোটা দিনটাই কাটাতে শুরু করল তারাদিদির ঘরে।

তারাদিদি বলল, ‘মন খারাপ করিস না লো। সবাই তো আর জোয়ান মদ্দ সোয়ামি পায়না বল। তাই বলে কি এই যৌবন বইয়ে দিবি নাকি? না দেওয়াটা কোন বুদ্দিমানের কাজ!’

‘মানে!’ ত্রৈলোক্য কুল খাচ্ছিল, খেতে খেতে তারাদিদির কথা শুনে কিছুই বুঝতে পারেনা, হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, ‘সোয়ামি না থাকলে কার সাথে পিরিত করব গা? তুমি কি যে মাঝেমধ্যে হেঁয়ালি করো, কিছুই বুজি না বাপু!’

‘নিজের সাথে করবি।’ তারাদিদি অপাঙ্গে তাকায় ত্রৈলোক্যের দিকে।

সেই দৃষ্টির মধ্যে এমন কিছু নিহিত থাকে, তা দেখে ত্রৈলোক্যর শরীর যেন ঝিমঝিম করে ওঠে। কোনোমতে সে বলতে পারে, ‘সে কি করে গা!’

‘কোনো সোয়ামি যদি নিজের মাগকে সুখ দিতে না পারে, তখন ইস্তিরি নিজেই নিজেকে সুখ দিতে পারে বুজলি? ওতে কোন অধম্ম হয় না-কো!’ তারাদিদি পান চিবোতে চিবোতে বলে।

তারপর ধীরেসুস্থে ত্রৈলোক্যকে সে শেখায় কি করে শুধুমাত্র স্পর্শ দিয়ে নিজের শরীরকে পৌঁছে দেওয়া যায় মৈথুনের চূড়ান্তে।

অবগাহন করা যায় সুখের সাগরে। একা। লাগে না কোনো পুরুষ।

ত্রৈলোক্য প্রথমে সেই সুখ উপলব্ধি করে হতভম্ব হয়ে যায়, তারপর অপরাধবোধ মেশানো এক মিশ্র অনুভূতি গ্রাস করে ওকে। নিষিদ্ধ মাদকের আকর্ষণের মতোই নেশাতুর হয়ে সে রোজ ছুটে যায় তারাদিদির ঘরে, পান করতে চায় যৌবনের সুখ-সুধা, যতটা পারা যায়।

এভাবেই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন এক কাণ্ড ঘটল। পূর্ববঙ্গে ত্রৈলোক্যর শ্বশুরালয় থেকে হঠাৎ সংবাদ এল, দিনকয়েক রোগে ভুগে ত্রৈলোক্যর স্বামী আকস্মিক মারা গিয়েছেন। গোটা বাংলায় ছড়ানো তাঁর স্ত্রী, সন্তান। সব জায়গাতেই এই দুঃসংবাদ পাঠানো হয়েছে।

ত্রৈলোক্যর মা শুনে বাড়ির দালানে হাত পা ছড়িয়ে বসে বিলাপ করতে শুরু করলেন। ত্রৈলোক্যর বাবা তাড়াতাড়ি ছুটলেন স্থানীয় পুরোহিতের কাছে, নিয়মাদি কি করতে হবে সেই বিষয়ে জানতে।

আশপাশের বাড়ি থেকেও কিছু গৃহস্থ গিন্নিবান্নি ছুটে এলেন। সবার মুখেই এক কথা, ‘আহা গো, এইটুকু কাঁচা বয়সে মেয়েটা বেধবা হল, স্বামীসোহাগ কিচুই তো পেল না কো!’

যথাসময়ে ত্রৈলোক্যকে সধবার বেশ থেকে মুক্ত করা হল। ভেঙে ফেলা হল হাতের শাঁখা, মুছে দেওয়া হল সীমন্তের সিঁদুর। মা, প্রতিবেশিনীদের উচ্চৈঃস্বরে বিলাপের মাঝে ত্রৈলোক্য প্রবেশ করল বৈধব্যের চিরন্তন ঘূর্ণিপাকে।

কিন্তু সবাই আশপাশে এত কাঁদলেও কেন ও জানেনা, ওর তেমন কোনো কষ্ট হচ্ছিল না। যে বৃদ্ধপ্রায় মানুষটাকে একদিন মাত্র শুভদৃষ্টির মুহূর্তে ছাদনাতলায় ও দেখেছিল, যিনি বিয়ের অনতিকাল পরেই ওর বাবামায়ের থেকে সমস্ত যৌতুকের হিসেব বুঝে নিয়ে মুখে পান চিবুতে চিবুতে হাঁটা দিয়েছিলেন অন্য কোনো শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে, তিনি থাকলেন কি গেলেন, তা ওর জীবনে কি প্রভাব ফেলবে?

অশৌচ ইত্যাদি মিটলেই ত্রৈলোক্য আবার যাতায়াত শুরু করল তারাদিদির কাছে। এই বিশাল পৃথিবীতে একমাত্র এই মানুষটির কাছেই যে সে সবচেয়ে শান্তি পায়, নিঃসংকোচে নিজেকে উজাড় করে দিতে পারে, তা এতদিনে সে ভালোই বুঝেছে।

প্রফুল্ল বলে ত্রৈলোক্যর একটা সই ছিল। তার বিয়ে হয়েছিল অন্যগ্রামে। প্রিয় সখীর এতবড়ো বিপর্যয়ে সে সান্ত্বনা দিতে এল, কিন্তু ত্রৈলোক্য ততদিনে অনেক দূরে সরে গিয়েছে। তার সারাদিনই এখন কাটে তারাদিদির কাছে। তারাদিদি শুধুই যে তাকে যত্ন করত, ভালোবাসত তা নয়, এবার থেকে তার নিত্য প্রয়োজনীয় অনেক জিনিসই তারাদিদি দিতে শুরু করল।

দিনে দিনে এমন হয়ে উঠল, নিজের ব্যবহারের জন্য গামছা, সিকি, কাপড় সবই ত্রৈলোক্য পেতে লাগল তারা বৈষ্ণবীর কাছে।

কী ছিল এই তারা বৈষ্ণবীর উদ্দেশ্য? যে নিজেই ভিক্ষা করে জীবন নির্বাহ করে, সে কেন নিয়মিত ত্রৈলোক্যর পেছনে খরচ করত? সেই খরচের পেছনে কি শুধুই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ছিল, নাকি ছিল কোনো ভয়ংকর স্বার্থ?

দেড়-শো বছরেরও বেশি সময় আগে পল্লিবাংলার কিশোরী ত্রৈলোক্য যদি এত কিছু বুঝত, তবে কি সে একবারও নিজেকে সংবরণ করত না?

ত্রৈলোক্যর বাবা-মা তারা বৈষ্ণবীর সঙ্গে মেয়ের এত হৃদ্যতা ঠিক পছন্দ করছিলেন না। একেই এই বৈষ্ণবীর পূর্বজীবন সম্পর্কে কিছু জানা যায় না, তারপর ইদানীং তারা বৈষ্ণবীর অর্থের যেন কোনো হিসেব পাওয়া যাচ্ছিল না। তারা অনেকদিন হল ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করে দিয়েছিল, তবু তার সমৃদ্ধি যেন ক্রমশ বেড়েই চলেছিল।

এর মধ্যে ত্রৈলোক্যর বাবা-মায়ের সংসারে টানাটানি শুরু হলে সে ত্রৈলোক্যর হাত দিয়ে তাঁদেরকেও সাহায্য করতে শুরু করল। ত্রৈলোক্যর বাবা-মা প্রথম প্রথম একেবারেই সম্মত না হলেও পেট বড়ো বালাই। অন্য কোনোদিকে কোনো উপায় না দেখে তাঁরা সেই সাহায্য নিতে শুরু করলেন।

গোটা পরিবার ধীরে ধীরে তারা বৈষ্ণবীর বশীভূত হয়ে পড়ল। ত্রৈলোক্য বলতে গেলে একরকম তারাদিদির বাড়িতেই থাকতে শুরু করল।

একদিন তারা বৈষ্ণবী কথায় কথায় বলল, ‘অ মুখপুড়ি, তাড়াতাড়ি নেয়ে ভালো একটা কাপড় পর দিকি! আয় মুখটা এট্টু ঘষে দিই।’

বেলা হয়েছে, সূর্য মাথার ওপর গনগন করছে। ত্রৈলোক্য অলস হাতে কি যেন রান্না করছিল। তারাদিদির কথায় বিস্মিত হয়ে বলল, ‘ক্যান তারাদিদি, কে আসবে এখন গা?’

‘আমার এক ভাই।’ তারা বলল, ‘যা যা দেরি করিস নে!’

ত্রৈলোক্য অবাক চোখে তারাদিদির দিকে তাকায়। এত বছর হয়ে গেল তারা বৈষ্ণবী এখানে রয়েছে, আজ ইস্তক ভাই তো দূর, বোন, খুড়ো, মামা কাউকে আসতে দেখেনি। এখন বলা নেই কওয়া নেই, ভাই আসছে কোথা থেকে?

যাইহোক, ত্রৈলোক্য কথা বাড়ায় না। স্নান করে তারাদিদিরই কিনে দেওয়া একটা কস্তাপেড়ে শাড়ি পরে বসে, তারাদিদি ভালো করে গন্ধতেল দিয়ে চুল বেঁধে দেয়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই বোষ্টম ভাই এসে উপস্থিত হয়। ত্রৈলোক্যর চেয়ে বয়স একটু বেশি, কিন্তু ত্রিশের নীচেই। পরিষ্কার রং, গোলগাল গড়ন, মুখটা হাসিহাসি। চুলে টেরিটি বেশ ভালো করে বাগানো।

ত্রৈলোক্য মাথায় ঘোমটা দিয়ে ত্রস্ত পায়ে ভেতরে চলে যাচ্ছিল, তারাদিদি হাসিমুখে ডাকে, ‘কোথায় যাচ্চিস লো? এখেনে এসে বোস! আমার ভাইকে অত নজ্জা পেতে হবে না কো!’

ত্রৈলোক্যর তবু আড়ষ্টতা কাটে না। আজ পর্যন্ত কোন সোমত্থ পুরুষের সঙ্গে বসেনি সে, এখন কি করে বসবে? তারাদিদির কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই! তার নাহয় ভাই, ত্রৈলোক্যর তো নয়!

তারাদিদির ভাইটিও তেমনই, অপরিচিত স্ত্রীলোককে দেখেও কোনো সংকোচ নেই, কেমন হাসিহাসি মুখে ত্রৈলোক্যর আপাদমস্তক দেখতে দেখতে বলে উঠল, ‘এই তোমার সেই বোন? কী নাম গো তোমার?’

তারাদিদির নির্জন কুঁড়েঘরে তপ্ত দুপুরে ত্রৈলোক্য নির্লজ্জতার বহর দেখে মরে যায় আর কি! এমনভাবে যে কোনো পুরুষ সোজাসুজি কথা বলতে পারে, তা তার বিশ্বাস হয় না।

তারাদিদি বলে, ‘ওর নাম ত্রৈলোক্যতারিণী। ভারি ভালো মেয়ে। কপাল যদিও মন্দ, এই বয়সেই সোয়ামিকে খুইয়েচে রে গৌর! ওর এট্টু ভালোবাসা দরকার।”

ত্রৈলোক্যর বৈধব্য সংবাদ শুনে গৌর নামক লোকটির পুলক যেন আরও বেড়ে যায়। সে পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায় ত্রৈলোক্যর সামনে। এত কাছে যে তার নিশ্বাসের ওম এসে লাগে ত্রৈলোক্যর মুখে-চোখে। তারপর একসময় হাত দিয়ে খুলে দেয় ত্রৈলোক্যর মুখের আড়ালকে। আড়ষ্টতায় ত্রৈলোক্য কেঁপে ওঠে।

হাজার সংকোচের মাঝেও সেই অনুভূতিকে নতুন করে আবিষ্কার করে ত্রৈলোক্য, বোঝে এমন অভিজ্ঞতা তার আগে কখনো হয়নি। স্বমেহনের সুখও যেন এর কাছে তুচ্ছ!

সেদিন একটু পরেই গৌর চলে যায়। ত্রৈলোক্য ম্লানমুখে দাওয়ায় বসেছিল। তারাদিদি প্রথমে কিচ্ছু বলেনি, বোধ হয় ত্রৈলোক্যকে গুছিয়ে নিতে সময় দিচ্ছিল।

তারপর একসময় কাজ করতে করতে বলে ওঠে, ‘আমাদের বোষ্টুমিদের কি নিয়ম জানিস ত্রৈলোক্য? সোয়ামী মরে গেলেও বোষ্টুমিরা অন্য পুরুষের কাছে আশ্রয় নিতে পারে। ওতে কোনো অধম্ম হয় না কো, বরং একালে পরমসুখ পাওয়া যায়, আর পরকালে সগগলাভ! বুজলি কিছু? তোর এত নজ্জার কি আচে? আমার গৌর কি খারাপ ছেলে নাকি?’

ত্রৈলোক্য কোনো উত্তর দেয় না। কিন্তু তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় জানান দেয়, এই সবে শুরু। গৌর আসবে।

আবার আসবে। আসবে শুধু ওরই জন্য।

ত্রৈলোক্যতারিণী তৎকালীন হিন্দু সমাজ তো বটেই, সমগ্র বিশ্ব অপরাধ জগতের কাছেই ছিল এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব। সেইসময়ে হিন্দু নারীকে দেখা হত পুণ্যবতী, পতিব্রতা রমণীর চোখে, সেই আঙ্গিকের সম্পূর্ণ বিপরীত স্রোতে হেঁটে কোনো স্ত্রীলোক যে এত নিষ্ঠুর হতে পারে, অবলীলায় করতে পারে একের-পর-এক নৃশংস খুন, তা যেন অকল্পনীয় হয়ে উঠেছিল অধিকাংশ নাগরিকের মনে।

তৎকালীন লালবাজারের গোয়েন্দা দপ্তরের কর্তা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় ত্রৈলোক্যর অধিকাংশ অপরাধের তদন্ত করেছিলেন। ‘দারোগার দপ্তরে’ লেখা তাঁর ক্ষুরধার বর্ণনায় যেন মূর্ত হয়ে উঠেছিল এই পিশাচিনীর ব্যক্তিত্ব।

সেই সময়ে বিদেশে আরেক সাড়া জাগানো সিরিয়াল কিলার ছিল জ্যাক দ্য রিপার। ১৮৮৮ সাল নাগাদ লন্ডনের দরিদ্র হোয়াইটচ্যাপেল অঞ্চলে তার একের-পর-এক হত্যাকাণ্ড জনসমাজে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। অন্যদিকে ত্রৈলোক্যরও টার্গেট ছিল মূলত বেশ্যা ও ইন্দ্রিয়সুখ চরিতার্থ করতে আসা মানুষজন। তাই দুই অপরাধীর মানসিকতার মিলে অনেকেই ত্রৈলোক্যকে এ-দেশের জ্যাক দ্য রিপার বলতে শুরু করে।

কিন্তু কোন পরিস্থিতির শিকার হয়ে সাধাসিধে এক গ্রামবাংলার কিশোরী এমন ভয়ংকর দাগি আসামিতে রূপান্তরিত হতে পারে, সেই রূপান্তরের পেছনে কতরকম আর্থসামাজিক পরিস্থিতি ও সংস্কারের দোহাই কাজ করে, তা বোধ হয় আমাদের চোখে পড়তে চায় না।

যাইহোক, ফিরে আসি ঘটনায়।

ত্রৈলোক্যর আশঙ্কা সঠিক ছিল। গৌর নামক লোকটি এবার খুব ঘন ঘন আসতে শুরু করল। তারাদিদির বাড়ি আসার নাম করে এলেও তার সঙ্গে প্রায়ই আসতে লাগল ত্রৈলোক্যর জন্য নানারকমের মনিহারি দ্রব্য।

ত্রৈলোক্যও ইদানীং অনেকটা সহজ হয়ে উঠেছে, আজকাল সে নিজে থেকেই উন্মুখ হয়ে থাকে কখন গৌর আসবে, এসেই তার জন্য খুলে বসবে উপহারের পসরা, রসিকতার ছলে খুলে দেবে ওর চুলের বেণী।

বাড়ির পাশেই দিনের পর দিন এই লীলা সংঘটিত হতে থাকলেও তারা বৈষ্ণবীর চাতুর্যে আর সতর্কতায় ত্রৈলোক্যর বাবা-মা এসবের কিছুই টের পেতেন না। অবশ্য টের পেলেও কী করতেন বলা শক্ত, কারণ ততদিনে ওঁরা প্রত্যেকেই অর্থের জোরে তারা বৈষ্ণবীর করায়ত্ব হয়ে পড়েছিলেন।

তারা বৈষ্ণবী যে আসলে একজন পাকা দালালের মতো ত্রৈলোক্যকে ধীরে ধীরে পাপের পথে ঠেলে দেওয়ার জন্য মধ্যস্থতার কাজ করছিল, তা বুঝতে অসুবিধা হয়না। সম্ভবত বোষ্টমের ছদ্মবেশে আসতে থাকা গৌর নামক সোনাগাজির সেই লোকটির সঙ্গে তার কোনো লাভজনক চুক্তি হয়েছিল।

কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর হয় আর এক! তারা বৈষ্ণবী কতদিনের মধ্যে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্য নিয়ে চলেছিল তা জানা যায় না, কিন্তু হঠাৎ সে অসুখে পড়ল এবং দু-দিনের সান্নিপাতিক জ্বরে তার প্রাণযন্ত্র চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে গেল।

ত্রৈলোক্য প্রথমে খুব কাঁদল, ত্রৈলোক্যর বাবা-মা-ও শোকাচ্ছন্ন হলেন। গ্রামের কারুর সঙ্গেই ওঁদের মতো এত বেশি ঘনিষ্ঠতা তারা বৈষ্ণবীর ছিল না, কাজেই তারার অবর্তমানে তার সকল সম্পদ তাঁরাই পেলেন।

কিন্তু এরপরই গোলমাল শুরু হল। গৌর নামক সেই পুরুষটি আসা তো কমালই না, বরং সম্পূর্ণ বিনা বাধার পরিবেশে তার সাহস ভয়ংকরভাবে বেড়ে যেতে লাগল।

আগে অভিজ্ঞ ঘুড়ি উড়িয়ের মতো তারা বৈষ্ণবী কখনো তাকে সীমানা লঙ্ঘন করতে দিত না, একটু-আধটু সোহাগেই বেঁধে রাখত, পুরো পয়সা হাতে পাওয়ার আগে কে-ই বা শিকারকে খাদকের হাতে তুলে দেয়?

কিন্তু এখন সেই আগল আর রইল না। তারা বৈষ্ণবীর নির্জন ঘরে খুব শিগগিরই গ্রীষ্মের এক তপ্ত দুপুরে শরীরের সমস্ত ঘাম গৌর মাখিয়ে দিল ত্রৈলোক্যর দেহে।

ত্রৈলোক্য অবশেষে তার কৌমার্য হারাল।

তারা বৈষ্ণবী কী উপায়ে সকলের কাছ থেকে লুকিয়ে এত কিছু করত কে জানে, এতদিন কাকপক্ষীও টের পায়নি ত্রৈলোক্যর এই অভিসারের বিষয়ে। কিন্তু এখন এই সংবাদ আর চাপা রইল না।

ত্রৈলোক্যর এই কেচ্ছার কথা বলতে গেলে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল পল্লির ঘরে ঘরে। ক্রমে তা এসে উঠল ত্রৈলোক্যর বাবা—মায়ের কানেও।

ত্রৈলোক্য অবশ্য এসবের কিছু টের পেল না। একদিন সন্ধ্যের সময় সে গৌরের সঙ্গে তারা বৈষ্ণবীর নির্জন গৃহে রতিক্রিয়ায় ব্যস্ত, ত্রৈলোক্যর মা ও তাঁর কিছু প্রতিবেশিনী সখী আকস্মিক হুড়কো খুলে ঢুকে পড়লেন।

‘ও মাগো, একী অনাছিস্টি কাণ্ড গো! ভর সন্দেবেলা গেরস্থ ঘরের বেধবা …ছি ছি ছি!’ মুহূর্তে মহিলাদের আর্তনাদে সারা পাড়া মুখরিত হয়ে উঠল।

ত্রৈলোক্য নিজের বিস্রস্ত বেশবাস ঠিক করার আগেই গৌর লাফ দিয়ে উঠে অন্ধকারের মধ্যে পালিয়ে গেল।

‘নষ্ট মেয়েমানুষ, চল বাড়ি, বিষ দিয়ে আজ যদি না তোকে মেরেচি …!’ ত্রৈলোক্যর মা এসে মেয়ের চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে চললেন ঘরে।

পাড়াগেঁয়ে ব্যাপার। কান পাতা দায় হয়ে উঠল। পুকুরে, হাটে, বাজারে, রান্নাঘরে সর্বত্র চলতে থাকল ত্রৈলোক্যর এই কেচ্ছার সরস রসালাপ। ত্রৈলোক্যর বাবার পথে-ঘাটে বেরনো তো বটেই, নিজের জীবিকাটুকু নির্বাহ করা দায় হয়ে উঠল।

‘ধুতরোর বিচি খাইয়ে মেরে ফেলব?’ ত্রৈলোক্যর মা জলভরা চোখে এক রাতে শুধোলেন স্বামীকে, ‘এমন নচ্ছার মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। অন্তত গাঁয়ে আমাদের এই দশা হবে না।’

ত্রৈলোক্যর বাবা কি বলবেন ভেবে পেলেন না। একদিকে অপত্যস্নেহ, অন্যদিকে ত্রৈলোক্যর এই সাংঘাতিক অপমান, বাজারে হাটে প্রতিনিয়ত পাড়াপড়শির অপমান তাঁকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে তুলছিল। হতবুদ্ধি অবস্থায় তিনি বললেন, ‘তোমার যা ভালো মনে হয় তাই করো গে যাও।’

কুলটা চরিত্রহীন বিধবা জ্যান্ত মেয়ে ঘরে থাকার চেয়ে বিষ খেয়ে আত্মঘাতিনী হওয়া মরা মেয়ের যে সমাজে অনেক বেশি কদর, তা ত্রৈলোক্যর মা বিলক্ষণ জানতেন। তাই বুকে পাথর চেপে রেখে সেই তোড়জোড়ই করতে শুরু করেছিলেন।

কিন্তু ত্রৈলোক্য মা-কে মহাপাতকী করল না। বাবা-মায়ের এই ষড়যন্ত্র সে আগে থেকেই শুনে ফেলেছিল কিনা জানা যায় না, এক মধ্যরাতে প্রেমিক গৌরের সঙ্গে সে বাড়ি ছেড়ে পালাল।

গৌরের পরিবার পরিজন সম্পর্কে ত্রৈলোক্য কিছুই জানত না, ভোর রাতে নিজের সমস্ত আত্মীয়স্বজন, স্বদেশকে চিরকালের জন্য ত্যাগ করে বর্ধমান স্টেশন থেকে রেলগাড়িতে চেপে সে যখন হাওড়া স্টেশনে এসে নামল, জনসমাগম আর ব্যস্ততা দেখে হাঁ হয়ে গেল।

‘হ্যাঁগা, অ্যাতো লোক কোথায় চলেচে এমন হুড়মুড়িয়ে? কলকাতা শহুরে অ্যাত্ত লোক থাকে আপনি আগে বলেননি কখুনো!’ বিস্ময়ে বিহ্বল ত্রৈলোক্য ভয়ে হাত আঁকড়ে ধরে গৌরের।

‘সব কাজের খোঁজে যাচ্চে যে!’ গৌর আর কালবিলম্ব না করে একটা ঘোড়ার গাড়িকে হাঁক দেয়, ‘এইয়ো! ইদিকে এসো!’

ত্রৈলোক্য ভয়ে ভয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে বসে। একটা ছোটো ঢোঁক গিলে বলে, ‘আপনার বাড়ির লোক জানে তো আমি বেধবা?’

কথাটা উচ্চারণ করতে গিয়ে তার গলার স্বর কেঁপে যায়। মনে হয় এখুনি গাড়ির কোচোয়ান এত বড়ো পাপের কথা শুনতে পেলে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেবে বুঝি!

কিন্তু পরক্ষণেই ওর মনে হয়, কেন? এটাই তো কলকাতা শহর, এখানেই তো কীসের যেন একটা সাগর থাকেন। যিনি নাকি দু’বছর আগেই বেধবাদের বিয়ে হওয়ার বিধান দিয়েছেন। শুধু বিধানই না, সাহেবদের আদালতে সওয়াল করে জিতেওছেন দেশসুদ্ধ লোকের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে? সেই গল্পই তো গৌর শুনিয়ে শুনিয়ে ওকে রাজি করিয়েছে আসার জন্য।

তবে আর কীসের ভয়?

ফিসফিসিয়ে ও বলে, ‘হ্যাঁগা, আপনি আমাদের বে-র আগে একবার ওই সাগর মশাইয়ের কাচে আমায় নিয়ে যাবেন?’

‘সাগর মশাই?’ গৌর হাওড়ায় নেমে এক খিলি পান মুখে দিয়েছিল, এখন গাড়ির পর্দা সরিয়ে পিক ফেলে তিরিক্ষি গলায় বলল, ‘কে সাগর অ্যাঁ? সাগরটা কে?’

ত্রৈলোক্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বর্ধমানের সেই অজপাড়াগাঁয়ে ওর জন্য ডুরে কাপড় নিয়ে আসা গদগদ গৌরের সঙ্গে কলকাতার এই ব্যস্ত রাজপথের গৌরকে যেন মেলাতে পারে না। তবু সাহস সঞ্চয় করে বলে, ‘ওই যে, বলেচিলেন না, যিনি শাস্তর দেকিয়ে সাহেবদের আদালত থেকে ফিরে বেধবাদের বে দিচ্চেন…!’

‘অ!’ গৌর বেঁকা হাসে, ‘বিদ্যেসাগর! তা তেনার কাচে গিয়ে তুই কী করবি শুনি? তুই মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, উনি কতবড়ো পণ্ডিত জানিস? কতাই বলতে পারবিনে!’

ত্রৈলোক্য বলে, ‘কতা বলব না তো। শুদু একটা পেন্নাম করব। তাও দূর থেকে।’

গৌর আবার পিচিক করে পিক ফেলে রাস্তায়, ‘সে দ্যাকা যাবে খন। একন বাড়ি যাই, সেখেনে কিচুদিন থেকে তারপর বে-র বন্দোবস্ত …!’

‘সে কী কতা! একেনে এসে বে না করে এমন একসাথে থাকা, পাপ হবে না? আপনার বাড়ির লোকই বা কি ভাববে! যত যাই হোক, গাঁয়ে যা হয়েচে হয়েচে, একেনে এসে ওসব না করাই ভাল …!’ বলতে বলতে ত্রৈলোক্য থেমে যায়।

কারণ ততক্ষণে একটা পাকা দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ওঁদের গাড়ি।

গৌর নেমে ভাড়া মেটায়, তারপর ত্রৈলোক্যর দিকে হাত বাড়ায়, ‘নেমে আয়।’

‘এই জায়গাটার নাম কী গা? এটাই কি আপনার বাড়ি?’ ত্রৈলোক্য ঘোমটা টেনে বাড়ির মধ্যে ঢুকে হাঁ হয়ে যায়, ‘অ্যাত বড়ো বাড়ি আপনার?’

ত্রৈলোক্য তো পাড়াগেঁয়ে মেয়ে, এমন বাড়ি দেখে তার বিস্মিত হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবিকই বাড়িটা যেমন বিশাল তেমনই প্রচুর মানুষে ভরতি। উপর নীচ মিলিয়ে সতেরো আঠারোটা ঘর, প্রতিটি ঘর থেকেই বেরিয়ে আসছে বা ঢুকছে স্ত্রীলোক। তাদের সঙ্গে ত্রৈলোক্যর গ্রামের মহিলাদের কোনো সাদৃশ্য নেই। এঁদের নেই কোনো অবগুণ্ঠন, বা নেই কোনো জড়তা। মেয়েলি হাসি-ঠাট্টা-রসিকতায় খিলখিলিয়ে উঠছে যেন গোটা বাড়িটা।

দু-একটা পুরুষও দেখা যাচ্ছে এদিক ওদিক, তবে তারা নেহাতই ভৃত্যস্থানীয়। দেখেই বোঝা যায়, এখানে মহিলাতন্ত্র কায়েম রয়েছে।

গৌর এগোতে এগোতে মুচকি হাসে, ‘হ্যাঁ। এ-জায়গার নাম সোনাগাজি। এখেনেই তোর শ্বশুরবাড়ি হবে, বুজলি?’

সোনাগাছি নামটার উৎপত্তি কোথা থেকে? সোনাঝুরি গাছ না সোনার মতো কোনো গাছ?

কোনোটাই নয়।

সোনাগাছি আসলে ছিল সোনাগাজি। প্রখ্যাত ‘Barefoot Historian’ P T Nair, যিনি নিরলসভাবে কলকাতার অলিগলির ইতিহাস নিয়ে সারাজীবন কাজ করে চলেছেন, তাঁর লেখায় এশিয়ার বৃহত্তম নিষিদ্ধপল্লি সোনাগাছির নামকরণের ইতিহাস সম্পর্কে একটা প্রামাণ্য তথ্য পাই। বহুকাল আগে ওই এলাকায় সানাউল্লাহ নামে এক কুখ্যাত মুসলিম ডাকাত থাকত। সানাউল্লাহ—র ডেরায় সে তার মায়ের সঙ্গেই থাকত। হঠাৎ সানাউল্লাহ মারা যেতে তার শোকসন্তপ্ত মা একদিন সকালে সানাউল্লাহর কুঁড়েঘর থেকে এক আশ্চর্য কণ্ঠস্বর শুনতে পায়।

‘মা, কাঁদিস না। আমি মরে গিয়ে গাজি হয়েচি। দুঃখ করিস না।’

গাজি অর্থাৎ মুসলিম পীর, ফকির বা ধর্মপ্রচারক। এই ঘটনার পর লোকজন সানাউল্লাহ-র কুঁড়েঘরে গিয়ে যা প্রার্থনা বা কামনা করতে থাকে, তাই মিলে যেতে লাগল। কেউ যায় রোগ সারাতে, কারুর উদ্দেশ্য সন্তানের মঙ্গলকামনা। সানাউল্লাহ গাজি সবার মনস্কামনা পূরণ করতে লাগল।

P T Nair লিখছেন, তখন গাজির মা সেখানে একটা বিরাট মসজিদ বানাল, যার নাম লোকমুখে সানা গাজি বা সোনাগাজির মসজিদ হয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। যদিও কালের নিয়মে সেই মসজিদ কিছুবছর পরেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, কিন্তু ওই অঞ্চল চিরকালের জন্য সোনাগাজির নামে পরিচিত হল। মসজিদের প্রমাণ এখনও সোনাগাছি সংলগ্ন রাস্তা ‘মসজিদ বাড়ি স্ট্রিট’এর নামে রয়েছে।

যাইহোক, ফিরে যাই আমাদের ত্রৈলোক্য আর গৌরের কাছে যারা সবেমাত্র এসে প্রবেশ করেছে সোনাগাজির এক বাড়িতে।

ত্রৈলোক্য গৌড়ের কথার অর্থ বুঝেছিল। ঐ বয়সেই সে এটুকু বুঝেছিল আর যাইহোক এই অট্টালিকা কোনো গৃহস্থ মানুষের আবাস হতে পারে না। এখানে একেকটি ঘরের মালিক একেকজন স্ত্রীলোক, তাদের একেকজনের বয়স্ক দাসী, কারুর আবার দেহাতী ভৃত্য। প্রত্যেকের খাওয়ার আয়োজন আলাদা, কেউ কারুর অনুগত নয়।

গৌর সোজা তাকে নিয়ে গিয়ে তার জন্য একটা ঘর নির্দিষ্ট করে দিল। তারপর বলল, ‘তুই গা ধুয়ে নে, সেই কখন বেরিয়েচিস, আমি কিছু কেনাকাটা করে আনচি’খন বাজার থেকে।’

ত্রৈলোক্য চারপাশের সব কিছু দেখে বিস্ময়ের চূড়ান্তে পৌঁছে যাচ্ছিল, এবার সে প্রাণপণ গৌরের হাত চেপে ধরল, ‘আমায় ফেলে যেও না গো! তোমার দুইটি পায়ে পড়ি!’

‘পোড়াকপাল আমার, যাচ্চি কই!’ গৌর অবাক, বিরক্তও, ‘তোর তেল, ইস্নো, কাপড় এইসব লাগবে না বুজি? এয়েচিস তো হাভাতে ঘরের মাগির মতো! পরনের কাপড়খানা ছাড়া কিচুই নেই। ছাড় ছাড়!’

গৌর চলে যেতে ত্রৈলোক্য কিছুক্ষণ পাথরের মতো ঘরের একমাত্র পালঙ্ক ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর কেবলই মনে থাকে, এতদিন যা হয়েছে হয়েছে, এবার থেকে ওর জীবনটা চিরকালের জন্য বদলে গেল। হঠাৎ করে ওর সই প্রফুল্লর কথা মনে পড়তে লাগল। ওদের সবুজ-শ্যামল গাঁয়ের পুকুরপাড়, গাছগাছালি, ঢেঁকিতে ধান ভানা, শীতের দুপুরে খেজুর রস তৈরি, এইসব ছোটখাটো স্মৃতি কোথা থেকে এসে ওর হৃদয়কে দুর্বল করে দিতে থাকে। ভাবতে ভাবতে ওর চোখ জলে ভরে ওঠে।

‘আ মরণ, এ-মাগি যে এসেই চোখের জলে বুক ভাসাতে লেগেচে!’

দরজার কাছে কাদের শব্দ পেয়ে ত্রৈলোক্য চমকে তাকায়।

এক বয়স্কা পৃথুলা ভদ্রমহিলা। বয়স আনুমানিক পঁয়তাল্লিশ হবে, গাত্রবর্ণ গৌর, হাতে গলায় স্বর্ণালংকার, পরনে মিহি পাছাপেড়ে সাদা ধুতি, নাকের ওপর তিলক। খনখনে গলায় বলে তিনি বলে উঠলেন, ‘কোত্থেকে আসা হল গা? আমি এ-বাড়ির বাড়িউলি।’

নাকের ওপর তিলক দেখে ত্রৈলোক্যর তারা বোষ্টমির কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। ও চোখ মুছে কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু গলা থেকে কোনো শব্দই বের হল না।

ততক্ষণে বাড়িওয়ালি মহিলার পেছন পেছন আরও অনেক নানাবয়সি স্ত্রীলোক এসে ঢুকেছে ঘরে। কেউ ফর্সা, কেউ কালো, কেউ রোগা, কেউ মোটা, কেউ কোমরে হাত দিয়ে সরস ভঙ্গিতে ত্রৈলোক্যকে দেখছে, কেউ মুখ বেঁকিয়ে। তবে সবারই হাতে গলায় ভারী স্বর্ণালংকার, ধবধবে পোশাক।

সামনের অল্পবয়সি ফর্সা মেয়েটা ভারী কাঁকন দুলিয়ে বলল, ‘কুমারী, সধবা না বেধবা গা? সঙ্গে যে বাবু এল, উটি কে? লাগর?’

গৌরের পরামর্শে ত্রৈলোক্য গ্রাম ছেড়েছিল কুমারীবেলার একটা রঙিন শাড়ি পরে, কাজেই ও মিনমিন করে উত্তর দিল, ‘বেধবা।’

‘আহা বড়ো কষ্টে ছিল লো!’ আরেকজন মুখে চুকচুক শব্দ করল, ‘বেশ করেচ একানে এয়েচ, একানে ভালো থাকবে, ভালো পরবে, কেউ কিছু বলার নেই।’

এখানে যে কেউ কিছুতে কর্তৃত্ব ফলানোর নেই, সেটা ত্রৈলোক্য আগেই বুঝেছে। এখন সে এদের দেখতে দেখতে আরও একটা বিষয়ে নিঃসন্দেহ হল, এখানে থাকলে সবাই বড়োলোক হয়, আর এখানে কারুর কোনো দুঃখ নেই।

গৌর একটা কাহার চাকরের কাঁধে মোট বইয়ে যখন ঘরে ফিরল, ততক্ষণে ত্রৈলোক্যর স্নান সারা হয়ে গেছে।

গৌর এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘নে! তোর সব নিয়ে এলাম। বিছানা, বালিশ, বাক্স, বাসনকোসন … সব সাজিয়ে নে। আর যখন যা দরকার একে বলবি। এ তোর চাকর। যখন যা বলবি, ফাইফরমাশ খাটবে। বুজলি?’

ত্রৈলোক্য বিস্ময়ের শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। তার নিজের চাকর? সেও তাদের গ্রামের জমিদারবাবুর মতো বসে বসে আদেশ করবে, আর লোকে তা শুনবে? এত সৌভাগ্য এ-জীবনে তার লেখা ছিল?

সন্ধ্যার পর থেকে বাড়ির রূপ বদলাতে শুরু করল। যে অট্টালিকা শুধুই স্ত্রীলোকপুরী বলে ত্রৈলোক্য ভুল করেছিল, তার আনাচে কানাচে প্রবেশ করতে শুরু করল নানা বয়সের নানা ধরনের পুরুষ। এই বাড়ির মহিলারাও নিজেদের সুসজ্জিতা করে উপরের বারান্দায় কিংবা নীচের জানলা বা প্রবেশদ্বারের দুই পাশে দাঁড়াতে শুরু করল। কোনো ঘরে গানবাজনা, কোনো ঘরে নাচ, কোনো ঘরে হাসিঠাট্টা, আবার কোনো ঘরে চটুল রসিকতার বন্যা বয়ে যেতে লাগল।

ত্রৈলোক্যর এত কিছু ভালো লাগছিল না, সে নিজের ঘরে শিকল দিয়ে চুপচাপ শুয়ে রইল। গোটা বাড়িটাকেই তার রূপকথার বিস্ময়পুরী বলে ভ্রম হচ্ছিল।

তবে এত কিছু নেতি বাচক উপকরণের মাঝে সে একটা বিষয়কেই প্রাধান্য দিল, তা হল তার আসন্ন স্বাধীনতা। যে বস্তুটি সে বর্ধমানের গ্রামে কখনো পায়নি, মেয়েমানুষও যে হুকুম করতে পারে, একটা গোটা ঘরের মালকিন হতে পারে, নিজের খুশিমতো ঝনাৎ ঝনাৎ পয়সার শব্দ করতে পারে, এইটাই তার কাছে বড়ো মধুর ঠেকল।

তার মনে হল, সোহাগের সময় গৌরের বলা মিছি মিছি রানি নয়, সে সত্যিই এতদিনে রানি হল।

* * *

সেই রাতের পর তিনমাস কেটে গেছে। এই তিনমাসে পৃথিবীর সব কিছু যতই এক থাকুক, সূর্য একই নিয়মে উদিত হোক, অস্ত যাক, ত্রৈলোক্যর জীবনে আমূল পরিবর্তন এসেছে।

সে বহুগামিনী হয়েছে, সুরাপান শিখেছে, ধূমপানে অভ্যস্ত হয়েছে। বাড়ির আর পাঁচজন স্ত্রীলোকের ভাবভঙ্গি, আদবকায়দা, চালচলন অনুকরণ করে ছলা কলা প্রয়োগে সে হয়ে উঠেছে বিশেষ পারদর্শিনী। ইদানীং তার ঘরে পুরুষের ভিড় লেগেই থাকে, প্রথম দিনের স্বপ্নের মতো পয়সা ফেলে সে আদেশ করে ভৃত্যকে।

গৌরের ভূমিকা ত্রৈলোক্যর জীবনে খুব দ্রুত বদলে চলেছিল। এখানে সে ত্রৈলোক্যকে যখন নিয়ে এসেছিল, তখন ত্রৈলোক্যর চোখে সে ছিল প্রেমিক, ক্রমে সে হয়ে উঠল ত্রৈলোক্যর খদ্দের ধরার দালাল।

ত্রৈলোক্য ইদানীং ওকেও ওর সেই চাকরের মতোই ফাইফরমাশ খাটায়, গালিগালাজ করে আর মাসান্তে গুঁজে দেয় কিছু পয়সা। নিজের এমন অধঃপতনে গৌরের অবশ তেমন কোনো অভিযোগ নেই। সে নিছকই সোনাগাজির খেপ খাটা দালাল ছিল, উঠতি এক রূপোপজীবিনীর ছায়ার তলায় থাকলে তো ভালোই, নিরাপত্তা অনেক বেশি।

দিনে দিনে ত্রৈলোক্যর রূপযৌবন, সর্বোপরি তার ছলাকলার খ্যাতি এমনভাবে ছড়িয়ে পড়তে লাগল সোনাগাজিতে, অনেক পুরুষই শুধুমাত্র ত্রৈলোক্য রাঁড়ের সঙ্গলাভের আশায় হানা দিতে লাগলেন ওই বাড়িতে। ফলত ত্রৈলোক্যর সারা অঙ্গ সোনা ও বহুমূল্য অলংকারে ভরে যেতে লাগল, সঞ্চয় উপচে পড়তে লাগল।

কালীপ্রসন্ন সিংহ এই শহরকে ‘বেশ্যাশহর’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘এমন পাড়া নাই, যেথায় অন্তত দশঘর বেশ্যা নাই, হেথায় প্রতি বৎসর বেশ্যার সংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে বই কমছে না। … দিন দিন যেভাবে তাদের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে কোন ব্যক্তি আর কলকেতার গর্ব্ব কর্তে পারেন?’

বাস্তবিকই তাই। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে কলকাতা শহরে পতিতাদের সংখ্যা এত বেড়ে উঠেছিল যে ১৮৫৭ সালের ১১ ই মার্চ ‘সংবাদ প্রভাকর’ লিখল, ‘গৃহস্থ বেশ্যায় মিশিয়া গিয়েছে, বাটীর প্রভেদ বুঝা যায় না।’

তবে বেশ্যার জোগান এত বৃদ্ধি পাওয়াতে যে তারা কিছুমাত্র উপার্জন কম করত না, তা ত্রৈলোক্যর অতি অল্প সময়ে ধনী হয়ে ওঠা থেকেই বোঝা যায়।

অবশেষে কয়েক বছরের মধ্যেই সোনাগাজিতে ত্রৈলোক্য একখানা বেশ বড়সড় তিনতলা বাড়ি কিনে ফেলেছিল। সেই বাড়ির বাহার দেখলে হাঁ হয়ে যেতেই হয়, তার ওপর বাড়ির বাইরে দু-জন সশস্ত্র দারোয়ান, ভেতরে পাঁচ-ছ-জন দাসী, সব মিলিয়ে একেবারে যেন একটা ছোটোখাটো সাম্রাজ্য, যার অধিশ্বরী ত্রৈলোক্য নিজে।

ত্রৈলোক্য নিজে আমূল বদলে গিয়েছে এই কয়েক বছরে। তার মেজাজ এখন সবসময়েই সপ্তমে চড়ে থাকে, পান থেকে চুনটুকু খসলে বাড়ির কড়িবরগাগুলো পর্যন্ত ভয়ে কেঁপে ওঠে। সবাই তাকে তোষামোদ করে চলে।

পরিবর্তন এসেছে তার চেহারাতেও। গ্রামের গুল্মলতার মতো জড়সড় কিশোরীটি সে আর নেই, তার চেহারায় এখন সৌন্দর্যের সঙ্গে এসেছে পরিণত মেদ। লজ্জা, আড়ষ্টতা এইসবও তার চরিত্র থেকে এখন উধাও হয়ে গিয়েছে।

পায়ের ওপর পা তুলে মুখে একখিলি পান গুঁজে সে এখন অবলীলায় গায় প্রবোধ সরকারের লেখা অশ্লীল গান,

‘আয় কে তোরা নিবি আমার সাধের আনারস

নয় পাকানো নয় ডাঁসানো, রস পড়ে টস টস

আমার এই আনারসে—

কত ছোড়ার মন বসে

ফিরি করি দেশ বিদেশে

লোকে করে যশ!”

কিছু গান সে নিজে লেখে। সে একা নয়, সোনাগাজির অনেক বেশ্যাই তখন নিজে গান বাঁধত। সেগুলো পরবর্তীকালে ‘বেশ্যাসঙ্গীত’ নামে প্রকাশিতও হয়েছে। মজার ব্যাপার, এই ‘বেশ্যাসঙ্গীত’ নামক বইতে অনামী বেশ্যাদের রচিত গানের সঙ্গে সংকলিত করে দেওয়া হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গিরীশ ঘোষ বা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা কিছু প্রণয়গীতিও।

যাই হোক, ত্রৈলোক্যের সুর, তাল, ছন্দের জ্ঞান ছোটোবেলা থেকেই বেশ ছিল। পুরদস্তুর দেহব্যবসায় নেমে গানের শিক্ষক রেখে সে সংগীতে আরও পোক্ত হয়ে উঠল। শিখল ঠুংরি, গজল, কীর্তন। সঙ্গে নাচও শিখল কিছুটা।

এতে তার খ্যাতি কয়েক দিনের মধ্যে আরও ছড়িয়ে পড়ল। সোনাগাজিতে সবাই এক ডাকে ত্রৈলোক্য রাঁড়কে চেনে। এখন গৌর আর ওর দালাল হিসেবে তেমন কাজ করতে পারেনা, প্রায়ই সে রোগে ভোগে, ত্রৈলোক্যর জন্য রয়েছে তিন থেকে চারজন দালাল, ত্রৈলোক্যর সঙ্গসুখ পেতে গেলে আগে তাদের সঙ্গে খদ্দেরকে যোগাযোগ করতে হয়।

দিন যায়। ত্রৈলোক্যর সমৃদ্ধি ক্রমশ ফুলে ফেঁপে ওঠে। এরমধ্যে বিসূচিকা রোগে মারা যায় গৌর। ত্রৈলোক্য বাইরের কাঠিন্যের বর্মের মাঝে একটু হলেও দুর্বল হয়ে পড়ে। হাজার হোক, এই মানুষটির হাত ধরে সে ঘর ছেড়েছিল। ভালো যে বেসেছিল তা বলা যায় না, বরং কৈশোরের প্রথম পুরুষস্পর্শ পাওয়ার জন্য উন্মুখ শরীরের ক্ষুধা নিবৃত্তিতেই সে গৌরকে ব্যবহার করেছিল বেশি।

তবু, গৌর মারা যাওয়ার পর ওর মনে হল, বর্ধমানের ওর সেই জন্মভিটের শেষ যোগাযোগটুকুও যেন মুছে গেল। চিরতরে হারিয়ে গেল বাবা, মা, তারাদিদি, ওর ছোট্টবেলার সই প্রফুল্ল সবাই। ও যেন আরও একা হয়ে পড়ল। চারপাশে এত টাকা, এত বিত্ত, এত ঐশ্বর্যের মাঝেও থেকে থেকেই ও অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ত। তখন আরও তিরিক্ষি হয়ে উঠত তার মেজাজ, মনে হত অসীম এক কালো গহ্বরে সে যেন ক্রমশই ডুবে যাচ্ছে, বন্ধ হয়ে আসছে নিশ্বাস।

যাইহোক, সময় বয়ে চলল। ত্রৈলোক্যর জীবনেও এরপর সত্যিকারের প্রেম এল।

আর সেই প্রাণের পুরুষের হাত ধরেই ত্রৈলোক্যর হাতেখড়ি হল অপরাধ জগতে।

ত্রৈলোক্যর সেই প্রেমিকের নাম কালীবাবু। কালীবাবু নেহাতই একজন দরিদ্র ভদ্রলোক, দালালি ছিল তাঁর জীবিকা। নিজের ক্ষমতার মধ্যেই সোনাগাজির নিম্নবর্গীয় বেশ্যাদের কাছে গিয়ে তিনি নিজের ইন্দ্রিয় চরিতার্থ করতেন, ত্রৈলোক্যর কাছে আসার মতো আর্থিক ক্ষমতা তাঁর ছিল না।

তবু ভাগ্যের বিধান খণ্ডায় কে! একদিন তাই দেখা হল দোঁহে, কালীবাবু এক ধনী ইয়ারবকসি সমভিব্যাহারে সোনাগাজির প্রখ্যাত ত্রৈলোক্য রাঁড়কে কিছুটা কৌতূহল, কিছুটা সম্ভ্রম নিয়ে দেখতে এলেন।

প্রথম দেখাতেই কি যে হল, ত্রৈলোক্য কালীবাবুর প্রেমে পড়ে গেল। কালীবাবুর পয়সা না থাক, রূপ ছিল প্রচণ্ড। অত্যন্ত সুপুরুষ কালীবাবুকে ত্রৈলোক্য এমন ভালোবাসতে লাগল যে কয়েক মাসের মধ্যেই কালীবাবু নিজের মেসের পাট চুকিয়ে দিয়ে উঠে এলেন ত্রৈলোক্যর প্রাসাদোপম অট্টালিকায়।

ত্রৈলোক্য সম্ভবত এই পরিণত বয়সে এসে প্রকৃত প্রেম কী, তা অনুভব করেছিল। তার ভালোবাসার প্রাবল্য এমনই ছিল যে কাজের জন্য কালীবাবু কয়েকঘণ্টা বাইরে গেলে অবধি সে অস্থির হয়ে পড়ত।

‘আপনাকে কতবার না বলেচি, আপনি আমাকে ছেড়ে কোতাও যাবেন না!’ কালীবাবু একদিন বাড়ি ফিরতেই তাকে নিয়ে গিয়ে ঘরে খিল দিল ত্রৈলোক্য।

কালীবাবু হাসেন, ‘পাগলির কতা শোন! কাজে না বেরোলে বাড়িতে পয়সা পাঠাব কি করে? পরিবার না খেতে পেয়ে মরবে যে! ছেলেটা তো মাত্তর এক বছরের!’

‘ঠাট্টা করবেন নাকো!’ ত্রৈলোক্য ঠোঁট ফুলিয়ে কালীবাবুকে চুপ করিয়ে দেয়, ‘আপনাকে কতবার না বলেচি এই অনাছিস্টি দালালি আপনি ছাড়ুন, আপনার যা লাগবে সব আমি দেব। বাড়িতেও পাটাবেন সেকান থেকে। আপনি শোনেন কতা?’

‘আচ্ছা আচ্ছা তাই হবে’খন।’ কালীবাবু হাসতে হাসতে ত্রৈলোক্যর নাক টিপে দেন।

উনবিংশ শতকের নারী, তা সে সম্ভ্রান্ত ঘরের লজ্জাশীলা গৃহবধূ হোক, বা ঘাগী বেশ্যা, মাথার ওপর একটা পুরুষ আশ্রয় পেলে আর কিছু চাইত না। অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও তাদের সেই আশ্রয়াধীন থাকার আকাঙ্ক্ষাকে দমন করতে পারত না, এটাও স্পষ্ট।

নাহলে অতবড়ো তিনতলা অট্টালিকার মালকিন, অত সম্পদের অধিকারিণী প্রসিদ্ধ ত্রৈলোক্য রাঁড় এভাবে কালীবাবুর অধীনে নিজেকে সঁপে দিত না।

ক্রমে এমন দিন এল, দেনাপাওনা, খরচ-খরচা থেকে শুরু করে আলমারির চাবি অবধি কালীবাবুর করায়ত্ব হল। ত্রৈলোক্যরও সবকিছু কালীবাবুরই ইচ্ছেমতো হতে শুরু করল।

এর ফলে ভাঁড়ারে টান পড়ল। ত্রৈলোক্য কালীবাবুর বাঁধা মেয়েমানুষ এমন কথা চাউর হয়ে যাওয়ার পর যে উল্কার গতিতে সোনাগাজিতে তার উত্থান হয়েছিল, প্রায় সেই গতিতেই তার পতন শুরু হল। যারা তবু আসতে লাগল, এসে যখন কালীবাবুকেই সবসময় ঘরে উপস্থিত থাকতে দেখত, তারাও হতোদ্যম হয়ে পড়ল। যাদের আগে ত্রৈলোক্য দুরদুর করত, তবু তারা নিরলস ধৈর্যের সঙ্গে পড়ে থাকত, তাঁরাও এখন আর ফিরে তাকায় না।

ত্রৈলোক্যর পসার বলতে গেলে শেষ হল, হাত পড়ল সঞ্চয়ে।

তা বসে বসে খেলে কুবেরের ধনও যে একদিন নিঃশেষ হয়, সে তো জানা কথাই। সেখানে রোজগার যতই না থাক, কালীবাবুর বাড়িতে টাকা পাঠাতে হবে, তাঁর বেড়ানোর জন্য জুড়িগাড়ি লাগবে, আমোদপ্রমোদের জন্য নাচগানের আসরে যেতে হবে, এই সবের মাঝে কালীবাবুর মদ্যপানের খরচও দিনদিন বাড়তে লাগল।

অতঃপর বছর চার-পাঁচেকের মধ্যে ত্রৈলোক্যর সঞ্চয় একেবারে ফুরিয়ে এল। ত্রৈলোক্য সব বুঝেও কিছু বলতে পারেনা। তার কথায় অপমানিত হয়ে কালীবাবু যদি তাকে ছেড়ে চলে যায়? এই ভয় তাকে দিনরাত কুড়ে কুড়ে খায়।

একদিন ত্রৈলোক্য দেখে কালীবাবু কারুর একটা চিঠি হাতে নিয়ে বিবর্ণমুখে বৈঠকখানায় বসে আছেন।

‘কি হল গা? কার চিঠি এল?’ ত্রৈলোক্য এসে শুধোয়।

কালীবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘দেশ থেকে। আমার পরিবার মরতে বসেছে। এখন-তখন দশা। আমাকে দেখতে চেয়েচে সে।’

ত্রৈলোক্য ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলে, ‘তো যান। আজকের গাড়িতেই চলে যান। কার্ত্তিককে বলচি, আপনাকে গাড়ি করে ইস্টিশানে তুলে দিয়ে আসবে।’

‘না না।’ দ্রুত মাথা নাড়েন কালীবাবু, ‘তোকে ছেড়ে যেতে মন চাইচে না ত্রৈলোক্য!’

‘ওমা!’ মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হেসে ওঠে ত্রৈলোক্য, ‘আমি কি মরে যাচ্চি নাকি! আমি তো রইলামই। আপনার ইস্তিরির এমন অবস্থা, আর আপনি দেকতে যাবেন না? তাই হয় কখনো? দুধের ছেলেটাকে তো আজ অবধি চোকে দেকলেন না!’

কথাটা সত্যি। আজ চার বছর হয়ে গেছে কালীবাবু বাড়ি যাননি। বাড়ি থেকে আসার কয়েকমাসের মাথায় তার পুত্রসন্তান জন্মেছে সেই খবরও চিঠিতেই পেয়েছেন। তা সে ছেলের এখন সাড়ে তিন বছর বয়স হতে চলল। কালীবাবু এখনও তার মুখ দেখেননি।

‘সে না দেকলে আর কী করবো বল।’ কালীবাবু থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকেন, তারপর ত্রৈলোক্যকে কাছে টেনে নেন, ‘আমার এই পটের বিবিটিকে ছেড়ে তো আর গিয়ে শান্তি পাব না।’

কালীবাবুর শান্তি না পাওয়ার কারণ ত্রৈলোক্যর সাহচর্য না পাওয়া নাকি কয়েকদিনের জন্য হলেও এই অতুল সম্পদের সর্বময় কর্তা পদ থেকে সরে থাকা তা অবশ্য বোঝা যায় না, কিন্তু ত্রৈলোক্য এবার আর কিছুতেই কালীবাবুকে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকতে দেয় না।

একরকম জোর করে সে কালীবাবুকে প্রস্তুত করে গাড়ি করে নিয়ে আসে হাওড়া স্টেশনে, তারপর তুলে দেয়ে রেলগাড়িতে। কালীবাবুর দেশের বাড়িতে কি অবস্থা জানা নেই, সেখানে গিয়ে টাকাপয়সা লাগতে পারে, সেই বাবদ বেশ কিছু অর্থও তুলে দেয়।

যতক্ষণ না কালীবাবু যাচ্ছিলেন, ত্রৈলোক্য যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করছিল। কিন্তু শেষমেশ যে মুহূর্তে কালীবাবুর মুখটা চলন্ত রেলগাড়ির কামরার জানলা দিয়ে ক্ষুদ্র হতে হতে একসময় অদৃশ্য হয়ে গেল, প্রচণ্ড মনকষ্টে ত্রৈলোক্য যেন কেঁপে উঠল।

একী! তার কালীবাবু চলে গেলেন! সে একা একা থাকবে কী করে! এই কয়েকবছর সে যে কালীবাবুকে এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করতে চায়নি। কিন্তু এই যে কালীবাবু চলে গেলেন, উনি … উনি আবার ফিরে আসবেন তো? নিজের ঘরের বউকে ছেড়ে, সন্তানকে ছেড়ে ত্রৈলোক্যর মতো বেবুশ্যের কাছে ফিরে আসতে ওঁর মন চাইবে তো?

যদি না চায়? ত্রৈলোক্য সেই পরিস্থিতির কথা কল্পনা করতেই যেন থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে। তার এই পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনে অর্থ, অলংকার সে অনেক পেয়েছে, কিন্তু সত্যিকারের প্রেম? কালীবাবু ছাড়া কারুর মধ্যে পায়নি।

তবে কালীবাবু বেশি দেরি করলেন না।

পঞ্চমদিনের মাথাতেই তিনি আবার কলকাতায় এসে উপস্থিত হলেন। এই পাঁচটা দিন ত্রৈলোক্যর যে কিভাবে কেটেছে তা সে-ই জানে। নাওয়া নেই খাওয়া নেই, সারাক্ষণ জানলায় বসে উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। দাস-দাসীরা খাওয়ার কথা বলতে গেলে ঝাঁঝিয়ে উঠেছে।

কালীবাবু ফিরলেন ঠিকই, কিন্তু একা নয়। সঙ্গে একটি বছরচারেকের শিশুপুত্রকে নিয়ে।

‘প্রতিমা চলে গ্যাচে দু-দিন আগে। সান্নিপাতিক হয়েচিল। আমার না যাওয়া অবধিই প্রাণবায়ুটুকু বেরুচ্চিল না। বড্ড ভালোবাসত তো আমায়। সোয়ামী সোয়ামী করে কেঁদে ককিয়েচে এতকাল।’ ভগ্নকণ্ঠে বললেন কালীবাবু, ”ওখেনে তো আমাদের আত্মীয়পরিজন বলতে তেমন কেউ নেই, যারা আচে তারা হরিকে রাখতে চাইলে না। তাই সঙ্গে করে নিয়েই এলাম।’

‘বেশ করেচেন।’ ত্রৈলোক্য দ্রুত এগিয়ে গিয়ে কালীবাবুর পুত্রকে কোলে তুলে নেয়। শিশুটি অত্যন্ত সুন্দর দেখতে। মাথায় ঘন ঝাঁকড়া চুল, চোখদুটো ভীষণ মায়াময়, ভাসা ভাসা। গাত্রবর্ণ কাঁচা হলুদের মতো। দেখলেই বোঝা যায় এই ছেলে বড়ো হয়ে বাপের চেয়েও সুপুরুষ হবে।

‘কি সুন্দর ছেলে আপনার!’ ত্রৈলোক্য চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয় শিশুটিকে, ‘নামটিও খুব সুন্দর, হরি।’

কালীবাবুকে পেয়ে ত্রৈলোক্য যেমন বুঝেছিল প্রকৃত ভালোবাসা কী, হরিকে পেয়ে তার শূন্য মাতৃক্রোড় যেন উজ্জীবিত হয়ে উঠল, সে যেন অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করল সন্তানসুখ, বাৎসল্যস্নেহ কী। ক্রমে এমন দিন এল যে কালীবাবু বাড়ির সব কিছু দেখেন আর ত্রৈলোক্য দিনের সবটুকু সময় অতিবাহিত করে হরির পেছনে। তাকে স্নান করানো, খাওয়ানো, পরিপাটি করে সাজানো এইসব কিছু কাজের মধ্যে সে যে কি অসম্ভব তৃপ্তি পেতে লাগল, তার মনে হতে লাগল এতদিনে সে বুঝি জীবনের পরম সুখ পেল।

ওদিকে কালীবাবুর কল্যাণে খদ্দের এমনিতেই তলানিতে এসে ঠেকেছিল, এরপর হরির আগমনে বাড়ি পুরোপুরি খদ্দেরশূন্য হয়ে পড়ল। কেউ আর ত্রৈলোক্য রাঁড়ের কাছে আসে না। বিশাল সেই প্রাসাদোপম বাড়ির দাসদাসীর সংখ্যা ক্রমে কমতে কমতে শূন্যে এসে ঠেকল, লাল পাগড়ি দারোয়ানরাও বিতাড়িত হল, এমনকী ত্রৈলোক্যর জুড়িগাড়িটিও কালীবাবু বিক্রি করে দিলেন।

না করে উপায় কি! ঘরে তো কোনো অর্থই নেই।

অতএব কালীবাবু হাত দিলেন ত্রৈলোক্যর স্বর্ণালংকারের ওপর। সেগুলোও একের-পর-এক বন্ধক পড়তে পড়তে খুব শিগগিরই অদৃশ্য হয়ে গেল। কালীবাবু কি করেন, আবার নিজের পুরনো পেশা দালালি করতে সচেষ্ট হলেন। কিন্তু এতদিনের অনভ্যাসে এই লাইন ভুলে গিয়েছেন, সবচেয়ে বড়ো কথা, শরীর এখনও অনেক বেশি আরামপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ওদিকে তিনি কোনো সুবিধাই করতে পারলেন না।

আর ঠিক এইসময়েই ঘটল কালীবাবু-ত্রৈলোক্যর প্রথম দিককার অপরাধের সূত্রপাত।

কালীবাবু বললেন, ‘এভাবে তো আর চলচে না। একটা ফন্দি ঠাউরেচি ত্রৈলোক্য।”

ত্রৈলোক্য হরিকে খাওয়াতে ব্যস্ত ছিল। আজ দিন কয়েক হল বাড়িতে খাবারদাবার সব তলানিতে এসে ঠেকেছে, নিজেরা আধপেটা খেয়ে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু বাচ্চাটাকে তো আর অভুক্ত রাখা যায় না। সে বলল, ‘কী ফন্দি? বাড়িতে মেয়েমানুষ ভাড়া দেবেন ভাবচেন?”

‘ধুর না না।’ কালীবাবু তাচ্ছিল্যভরে উড়িয়ে দিলেন, ‘মাগিগুলো থাকবে, খদ্দের আনবে, ঘরদোর নোংরা করবে, এদিকে ঠিকসময়ে ভাড়া দিতে বললেই মুখ শুকিয়ে মরা মাচের মতো তাকিয়ে থাকবে। ওসবে কিচু হবে না। আমি একটা অন্য রাস্তা ভেবেচি শোন।’

পরেরদিন পরিকল্পনামাফিক কালীবাবু শিং ভেঙে বাছুরের দলে মিশতে চলে গেলেন। সোনাগাজীর স্থানে স্থানে সন্ধ্যা থেকে ছেলেছোকরাদের আড্ডা জমে। যারা এই পাড়ায় এসে এসে ইতিমধ্যেই চুলদাড়ি পাকিয়ে ফেলেছেন, তাঁরা এইসব আড্ডায় সময় অপচয় না করে সোজা চলে যান অভীষ্ট রমণীর গৃহে।

কিন্তু যে সব নব্যযুবকেরা প্রথম প্রথম আসে, প্রথমেই তাদের আড়ষ্টতা অতটা কাটতে চায় না, তারা এইসব আড্ডায় ভিড় জমায়, মদ্যপান করে আর লোকের থেকে অভিজ্ঞতা শুনে সমৃদ্ধ হয়।

কালীবাবু নিশানা করলেন ঠিক এই জাতীয় ধনী সদ্য যুবকদের। ভুলিয়ে ভালিয়ে ত্রৈলোক্য রাঁড়ের সুখ্যাতির কথা বড়াই করে তিনি একজন করে বলির পাঁঠাকে রোজ নিয়ে আসতে লাগলেন ঘরে।

নিয়ে আসামাত্র ত্রৈলোক্য তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে মদ্যপানের আয়োজন শুরু করে।

খদ্দেরটির নিজেরই টাকা দিয়ে বাইরে থেকে মদ কিনে আনা হয়। তাতে মদের চেয়ে জল অনেকটাই বেশি থাকে, তা থেকে বেশ কিছুটা লাভ হয়। তবে আসল লাভ এটা নয়।

যুবকটির হাতে মদের পাত্র ধরিয়ে কালীবাবু বসেন পাশে, তাঁর হাতে লম্বা চুরুট।

যুবক বলে, ‘আরে মশাই, আপনি পান করবেন না?’

‘না!’ কালীবাবু হেসে নিজের চুরুটের দিকে দেখান, ‘আমার এই একটিই নেশা। আপনি খান খান, সংকোচ করবেন না। অ্যাই, বাবুকে গ্লাস ভরে দে।’

এমনি সময় কিন্তু কালীবাবু পারতপক্ষে চুরুট খান না, তাঁরও আকর্ষণ ওই লাল পানীয়ের দিকেই। কিন্তু এখন তাঁর অভিসন্ধি অন্য। ত্রৈলোক্য একপাশে মনোরঞ্জন করে যাবে আর তিনি চুরুট খেতে খেতে যুবকের অমনোযোগিতার সুযোগ নিয়ে ক্রমাগত চুরুটের ছাই মিশিয়ে যাবেন মদের গ্লাসে। মদের মধ্যে চুরুটের ছাই মিশলে যে ভয়ংকর নেশা হয় তা অনেকেই জানেনা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই প্রবল নেশার ভারে যুবক অচৈতন্য হয়ে পড়লে তার হাত থেকে একে একে খুলে নেওয়া হবে অঙ্গুরীয়, জেব থেকে বের করে নেওয়া হবে তার সর্বস্ব। এমনকী পরিধানের পোশাকটাকেও নিষ্কৃতি দেওয়া হবে না।

অন্তর্বাস পরা অবস্থায় তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসা হবে সামনের কোন এক নর্দমায়। সোনাগাজীর রাস্তার দু-পাশের নর্দমায় মাতালদের পড়ে গড়াগড়ি যাওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়, এও তেমনভাবেই সেখানে পড়ে থাকবে সারারাত। তারপর পুলিশ এসে নিয়ে যাবে থানায়।

এইধরণের যুবকেরা সকলেই ধনী পিতার অধঃপাতে যাওয়া সন্তান, অনেকেই রীতিমতো নামী দামী বুনিয়াদী বংশের ছেলে। নতুন নতুন এই পাড়ায় আসার আড়ষ্টতা কাটেনি। কাজেই বেবুশ্যেবাড়ি গিয়ে সর্বস্ব খুইয়েছে এমন কথা তারা নিঃসংকোচে থানায় বলে অভিযোগ দায়েরও করতে পারবে না।

এইভাবে একটি করে রাহাজানি ত্রৈলোক্য আর কালীবাবু মিলে চালিয়ে যেতে লাগল।

* * *

কিন্তু এভাবে আর কতদিন? প্রতারিত ছেলেছোকরার দল লজ্জার মাথা খেয়ে থানায় অভিযোগ করতে না পারুক, আরও পাঁচজন ইয়ারবকসিকে সাবধান তো করে দিতে পারে!

কয়েক মাসের মধ্যেই মোটামুটি এককালের প্রসিদ্ধ বেবুশ্যে ত্রৈলোক্য রাঁড়ের এখনকার কীর্তিকলাপ লোকমুখে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। এখন নতুন কেউ আড্ডার ঠেকে এলে আগে থেকেই এমন বিপদের কথা জেনে সাবধান হয়ে যায়।

অতঃপর বিপদের ঘূর্ণিপাকে ত্রৈলোক্য আর কালীবাবু আবার একই বিন্দুতে এসে পড়লেন। ওদিকে হরি বড়ো হচ্ছে, সেই বাবদ খরচ বাড়ছে, দুশ্চিন্তায় কালীবাবুর নেশাও বাড়ছে, অথচ কোনো রোজগার নেই।

ত্রৈলোক্যর কোনো গয়নাই আর অবশিষ্ট নেই। শুধু রয়েছে বিশাল বাড়িখানা।

সেখানা চলে গেলেই ষোলকলা পূর্ণ হয়।

একদিন ত্রৈলোক্য স্নান সেরে বেরিয়ে সবে মাথা মুছছিল, কালীবাবু হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, ‘এই দ্যাখ কাকে ধরে নিয়ে এলুম।’

‘ওমা! এ যে গণেশবাবু! অনেকদিন পায়ের ধুলো পড়েনি, কি খপর আপনার?’ ত্রৈলোক্য সবিস্ময়ে বলে উঠল।

কালীবাবুর সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিকে বেশ কয়েকবার এই গণেশ নামক ব্যক্তিটি এখানে এসেছিল কালীবাবুর সঙ্গে। ইনি কালীবাবুর একজন পেয়ারের দোস্ত। আগে দালালির সময় একসাথে কাজ করতেন। এখন অনেককাল যোগাযোগ নেই।

গণেশ কান অবধি এঁটো করা হাসি হেসে বলল, ‘এই তো। চলে যাচ্চে।’

কালীবাবু গণেশকে নিয়ে বৈঠকখানার দিকে যেতে যেতে বললেন, ”তাড়াতাড়ি আয় ত্রৈলোক্য, একটা ভালো কতা আচে।”

ত্রৈলোক্য কিছুক্ষণ পর যখন বৈঠকখানায় প্রবেশ করল, তখন সেখানে গভীর আলোচনা চলছে।

কালীবাবু এক হাতে মদের গ্লাস নিয়ে বলে চলেছেন, ‘তোমার সঙ্গে তো বলচ বরকর্তার কোনো পরিচয়ই নেই। তিনি তোমার মুকের কতা বিশ্বেস করবেন কেন? একেই পাড়াগেঁয়ে মানুষ!’

‘আহা! তুমি বুজতে পারচ না কালী!’ গণেশ হাত নেড়ে বলল, ‘বরকর্তার সঙ্গে আমার আলাপ নেই তো কি, আমি যাকে পাকড়েচি তিনি থাকেন কলকেতায়, কিন্তু বাড়ি ওই গাঁয়েই। বরকর্তার কেমনধারা কুটুম হয়। তিনিই যোগাযোগ করবেন বরকর্তার সাথে। এবার বুজলে কিনা!’

‘মানে তুমি বলচ এই কলকেতায় থাকা কুটুম লোকটি আমাদের মতলব জানে?’ কালীবাবু শঙ্কিতস্বরে বললেন।

‘আরে না না।’ গণেশ মাছি তাড়ানোর ভঙ্গী করল, ‘তিনি ভালো মানুষ, মনে কোনো কাদা নেই। ওসব দিকে এক্কেরে নিশ্চিন্তি থাকো দিকি! শুদু দরকার একটা কচি মেয়েমানুষের, ব্যাস!”

ত্রৈলোক্য কিছুই বুঝতে পারছিল না, ও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে কালীবাবুকে বলল, ‘কি কতা আপনারা বলচেন কিচুই বুজচি না যে! কার বে দেবেন গা?’

‘রোস, সব বুজিয়ে বলি। গণেশ একখানা সরেস মতলব ফেঁদেছে বুজলি?’ কালীবাবু মদের গ্লাসটা রেখে নড়েচড়ে বসলেন, ‘শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণদের নাম শুনেচিস?’

‘শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ?’ ত্রৈলোক্য আকাশ থেকে পড়ল। বাস্তবিকই সে কুলীন ব্রাহ্মণকন্যা হয়েও শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ বলে কোনো কুলের নাম শোনেনি, ” না। এই পেত্থম শুনলাম।’

‘স্বাভাবিক।’ কালীবাবু মাথা নাড়লেন, ‘বাংলাদেশে খুব অল্পই আচে। এই শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণদের মধ্যে মেয়েদের দাম আকাশছোঁয়া। এদের নিয়ম হল আমাদের উলটো, অর্থাৎ কিনা এদের বে হওয়ার সময় পাত্তরপক্ষ কনেপক্ষকে যৌতুক দেয়। বুজলি? তাছাড়া এদের স্বঘর নাহলে বে দেওয়ার নিয়ম নেই। তাই দিন দিন শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ ছেলেদের বে হওয়া খুব কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্চে। তো, আমাদের গণেশ একখান সরেস শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণদের পাত্তরের খোঁজ নিয়ে এসেচে। বীরভূমির দিকে এক অজ পাড়াগাঁয়ে বাড়ি, যে কয়েক ঘর শ্রোত্রিয় বামুন গোটা বাংলাদেশে আচে, তাদের মধ্যে কিচুতেই সম্বন্ধ হচ্চে না এই ছেলের।’

‘কেন?’ ত্রৈলোক্য মুখে এক খিলি পান গুঁজে সোৎসাহে প্রশ্ন করে, ‘বে হচ্চে না কেন? পাত্তর কি নুলো না ল্যাংড়া?’

‘আহা-হা! কোনোটাই নয়।’ কালীবাবু মাথা নাড়লেন, ‘তবে কিনা বে-র বাজারে তার তেমন দাম নেইকো। একে তো বয়স চল্লিশ পেরিয়েচে, তায় বিষয়সম্পত্তিও বলতে গেলে তেমন কিচু নেই। তার ওপর এক্কেরে আকাট মুখ্যু, অক্ষর জ্ঞানটুকু নেই। এমন পাত্তরের হাতে কে মেয়ে দেবে? তার ওপর এখন ওদের জাতে মেয়ে এত কমে গেচে যে তিন-চার হাজার টাকা অবধি যৌতুক দিতে হয়। সঙ্গে গয়নাপত্তর তো ছেড়েই দিলুম। অত টাকাপয়সা এরা পাবে কোথায়? তায় বুড়ি বেধবার ওই একটাই ছেলে।’

‘তো এতে আমরা কি করবো সেটাই তো বুজচি নে। আমি আপনি কেউই ত শ্রোত্রিয় না কি বলচেন, তা নই।’ ত্রৈলোক্য বলে ওঠে।

কালীবাবু এবার মুচকি হাসলেন, ‘নই তো কি, হতে কতক্ষণ ত্রৈলোক্য? মন দিয়ে শোন, তুই একটা লাইনের মেয়ে জোগাড় কর। ওই পাত্তরের বাড়ি এখন থেকে হন্যে হয়ে একখানা গরীব ঘরের কনে খুঁজচে, যাতে চার-পাঁচশো টাকার মধ্যে একটা ভালো মেয়ে পাওয়া যায়। তবে বংশ রক্কেটুকু হয় আর কি! ওইটুকু খ্যামতা ওদের আচে।’

‘মেয়ে নাহয় জোগাড় করলুম, তারপর?’ ত্রৈলোক্য চোখ বড়োবড়ো করে বলে।

‘তারপর বে হবে।’ কালীবাবু গ্লাসের তলানি মদটুকু ঢকঢক করে গলায় ঢেলে দেন, ‘বে হয়ে মেয়ে শ্বশুরঘর যাবে, তারপর সুযোগ বুজে কেটে পড়বে। মাঝখান থেকে ট্যাকাপয়সা, গয়না সব আমাদের বখরা। কেমন?’

গণেশ এতক্ষণে মুখ খোলে, ‘আমি ওদের কলকাতার ওই কুটুমকে মোটামুটি জপিয়েই ফেলেচি। বলেচি মেয়েটার বয়স এট্টু বেশি, ওই চোদ্দো-পনেরো মত, গরীব বেধবার মেয়ে। অবস্থা তেমন নয়। বয়স বেশি বলেই এত কম টাকায় রাজি হচ্চে। মেয়ের মামার কাচে এখন মা-মেয়ে রয়েছে, মামা-ই সব তদারক কচ্চেন। চার-পাঁচশো টাকা নগদ আর পাঁচশো টাকার গয়না হলেই ওঁরা বে দিয়ে দেবেন। তবে হ্যাঁ, বে-র সময় লোকজন খাওয়ানোর খরচখরচাও কিন্তু পাত্তরকেই দিতে হবে। কিন্তু সে আর কত? বড়োজোর দুশো? তা সেই পাঁঠা পাত্তরটা বিয়ের লোভে শুনেই রাজি হয়ে গ্যাচে। হে হে!’

‘রাজি হবে না কেন?’ কালীবাবু হাঁ হাঁ করে ওঠেন, ‘ওরা তো আর জানে না যে গোটাটাই ভুয়ো। ওরা দেখচে যেকানে ছেলের তিন-চার হাজারের কমে বে হত না, সেখানে সব মিলিয়ে হাজারের মধ্যেই সব নেমে যাচ্চে। তার ওপর মেয়ের গায়ের ওই পাঁচশো টাকার গয়না, তাতো ওদের ঘরেই থাকবে। শোনো গণেশ, তুমি আর দেরি করো না। আমাদের এইভাবে আর চলচে না। আসচে হপ্তায় এসে আশীর্বাদ করে যেতে বল ওদের।’

গণেশ হাত উলটে বলল, ‘আরে সে নাহয় বলব। কিন্তু মেয়ে কোথায়? সে তো উনি জোগাড় করবেন।’ ত্রৈলোক্যর দিকে ইশারা করে ও।

ত্রৈলোক্য একটু ভেবে বলে, ‘তুমি আসতে বলে দাও। মেয়ে ঠিক দিনে এসে যাবে।’

গণেশ চলে যাওয়ার পর কালীবাবু আর ত্রৈলোক্যতে আর তেমন কথা হল না। ত্রৈলোক্য হরিকে খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে নিজের খাওয়া সেরে যখন বাইরের বারান্দায় এসে চুল ছাড়াচ্চে, তখন কালীবাবু দ্বিপ্রহরের ঘুম ভেঙে উঠে এলেন, ‘গণেশকে বড়ো মুখ করে বলে তো দিলি। এমন মেয়ে কোথায় পাবি? তার বাপ-মা-ই বা এমন কুকাজে মেয়েকে ছাড়বে কেন?’

ত্রৈলোক্য উত্তর না দিয়ে চুল আঁচড়াতে থাকে। কিছুক্ষণ হাত তুলে দূরের দিকে ইশারা করে, ”ওই যে ক-টা খোলার ঘর রয়েছে ওইখানে, দেকতে পাচ্চেন?”

‘পাব না কেন?’ কালীবাবু বিরসকণ্ঠে বললেন, ”বয়সের গাচপাত্থর নেই এমন ক-টা বুড়ি বেবুশ্যে থাকে তো। বাড়ি বাড়ি বাসন মেজে বেড়ায়। মাগিগুলোকে একবার দেকলে দু-বার তাকাতে ইচ্ছে যায় না।’

‘ইচ্ছে হতেও হবে না। আমি রয়েচি কিজন্য?’ ত্রৈলোক্য ঝংকার দিয়ে বলে, ”ওকানে একটা বুড়ি থাকে, নাম দিগম্বরী। শুনেচিলাম আগে বাগদী ঘরের মেয়ে ছিল, কিন্তু একানে আসা ইস্তক ব্যবসা করত কায়স্ত-বেবুশ্যে হয়ে। সে যাই হোক, বছরকয়েক আগে আরেকটা গরীব বেবুশ্যের থেকে তার দেড় মাসের মেয়েটাকে কিনেচিল ওই দিগম্বরী, নিজের মেয়ের মতো মানুষ করবে বলে।’

‘বটে?’ কালীবাবু খরচোখে তাকান, ‘তুই থাকিস রাজপ্রাসাদে, তুই ওই খোলার ঘরের এত কতা ক্যামন করে জানলি?’

‘কারণ তখন দিগম্বরী আমার বাড়িতে ঠিকে ঝি-র কাজ করত। আমার থেকেই তিন টাকা ধার নিয়ে মেয়েটাকে কিনেচিল, বেশ মনে আচে। মেয়েটার নাম বিধু। সে এখন ওই চোদ্দো-পনেরোই হয়েচে। ব্যবসা টুকটাক শুরু করেচে, কিন্তু নিয়মিত নয়। আমার মনে হয় দিগম্বরীকে প্রস্তাব দিলে সে লুফে নেবে।’ ত্রৈলোক্য কথা শেষ করল।

‘হুম।’ কালীবাবু চিন্তা করলেন, ‘মন্দ বলিসনি। মেয়েটা দেকতে ক্যামন?’

‘ভালই। বেশ ডাগরডোগর হয়েচে।’ ত্রৈলোক্য হেসে চোখ টিপল, ‘দেকবেন, আপনি এখন নজর দিতে শুরু করবেন না যেন! গলায় কলসি দড়ি দিয়ে ডুবে মরতে হবে তাহলে আমায়!’

কালীবাবুর মেজাজ এবার সুপ্রসন্ন হয়ে ওঠে। ত্রৈলোক্যকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলেন, ‘তুই আচিস বলেই আমার কোন চিন্তা নেই রে ত্রৈলোক্য!’

দিগম্বরী প্রস্তাব শুনে হাতে চাঁদ পেল। এই মাগগিগণ্ডার বাজারে হাজার টাকা রোজগার কি কম কথা? কিন্তু সে শর্ত দিল, তার মেয়েই যেহেতু আসল, তাকে আধাআধি বখরা দিতে হবে। তার এক আনাও কম হলে চলবে না।

ত্রৈলোক্য আর কালীবাবুকে বেগতিক দেখে তাতেই রাজি হতে হল। হাজার হোক, পাঁচশো টাকাও অনেক, আর বললেই তো এমন বয়সের মেয়ে পাওয়া যায়না। লোক জানাজানি হওয়ারও একটা ব্যাপার আছে।

গণেশ লোকটা বেশ করিৎকর্মা, দিনকয়েকের মধ্যে ভদ্রপল্লিতে এক মাসের জন্য সে একখানা একতলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে ফেলল। হাজার হোক, আশীর্বাদ করতে পাত্রপক্ষকে তো আর সোনাগাজি আনানো যায় না। প্রথম দিনেই তো সব ফাঁস হয়ে যাবে তাহলে!

”ওমা জানা নেই শোনা নেই, হুট করে এক মাসের জন্য ভাড়া দিতে রাজি হল বাড়িওয়ালা?” মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বলল ত্রৈলোক্য।

”ওরে বাবা, এ হল কলকেতা শহর। একেনে পয়সা দিলে বাঘের দুধ অবধি মেলে, তো বাড়ি। একমাসের গোটা ভাড়া অগ্রিম দিতেই সুড়সুড় করে দিয়ে দিল।” গোঁফে তা দিতে দিতে বলল গণেশ।

আর দেরি করে লাভ নেই, সেদিন সন্ধ্যাতেই কালীবাবু ত্রৈলোক্য, দিগম্বরী আর বিধুকে নিয়ে গিয়ে উঠলেন সেই নতুন বাড়িতে। ত্রৈলোক্য সাজলো মেয়ের গরীব বিধবা মা, আর কালীবাবু সাজলেন মেয়ের একমাত্র অভিভাবক মামা।

যথাসময়ে পাত্রপক্ষ দেখতে এল বিধুকে। ত্রৈলোক্য আগে থেকেই বিধুকে ভদ্র মেয়ের মতো ছিমছাম শাড়ি পরিয়ে মার্জিত ব্যবহার শিখিয়ে পড়িয়ে পোক্ত করে রেখেছিল। বিধুও নিজের বারবণিতাসুলভ আচরণ লুকিয়ে রেখে পরিমিত লজ্জা-সংকোচ দিয়ে গোটা পাত্রপক্ষকে মুগ্ধ করে তুলল।

পাত্রপক্ষ আর দেরি করতে চাইল না, তারা এতদিন বাদে সবদিক থেকে উপযুক্ত পাত্রী পেয়ে হাতে চাঁদ পেয়ে গিয়েছিল। পাত্রের এক মাতুলস্থানীয় অভিভাবক একখানা স্বর্ণমোহর দিয়ে কনেকে আশীর্বাদ করে এক মাস পর বিবাহের দিন স্থির করে ফেললেন।

পাত্র কিছু মনমরা ছিল, কারণ এই বিয়ে বাবদ তাকে একরকম নিঃস্ব হয়ে যেতে হচ্ছে, কিন্তু ভাবী বধূর সুন্দর মুখখানির দিকে তাকিয়ে তার কষ্ট কিছুটা হলেও কমল।

পাত্রপক্ষ প্রস্থান করলে সবাই মিলে একচোট রঙ্গতামাশা হল। এক ফাঁকে কালীবাবু গিয়ে সেই স্বর্ণমোহর সোনাগাজিরই এক চেনা স্বর্ণকারকে বিক্রি করে চলে এলেন।

তারপর আনন্দের আতিশয্যে গণেশ বিধুকে নিয়ে দোরে খিল দিতে চলল, ‘যাই, শ্রোত্রিয় বামুনের মেয়ে বলে কতা, তাকে নিয়ে এট্টু রঙ্গ করে আসি। হে হে!’

বিয়ের দিন আসতে আসতে সব আয়োজন সম্পূর্ণ হতে লাগল। ইতিমধ্যে গণেশ পাত্রপক্ষের কাছ থেকে গিয়ে বিয়ের আয়োজন ও লোক খাওয়ানো বাবদ দু-শো টাকা নিয়ে এসেছে, সেই টাকার অর্ধেক নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে বাকিটা দিয়ে বরযাত্রীদের আতিথেয়তার আয়োজন হতে লাগল।

‘সবই হল। কিন্তু আমাদের দিকে লোকজন কোতায়?’ ত্রৈলোক্য বলল, ‘বরযাত্রীরা তো সন্দেহ করবে। ভাববে আত্মীয়স্বজন কিচু দেখচি না কেন।’

‘কিচ্চু সন্দেহ করবে না।’ গণেশ পা নাচাতে নাচাতে বলে, ‘মোটামুটি এ-তল্লাটের পঁচিশ-ত্রিশটা মাগিকে বলে এসেচি, বিয়ের দিন সকাল থেকেই সব চলে আসবে।’

‘কিন্তু তারা তো কেউ ভদ্দরঘরের মেয়ে নয়, ওরা সন্দেহ করবে না তো?’ সন্দিগ্ধস্বরে বলেন কালীবাবু।

‘ওরে বাবা, সবাইকে বুজিয়ে রাখা হয়েচে, এসেই সবাই ভদ্দর হয়ে যাবে, হে হে!” গণেশ সবাইকে বরাভয় দেয়।

বিয়ের তিনদিন আগে বরের বাড়ি থেকে গায়েহলুদ এল। সেই গায়ে হলুদ রীতি অনুযায়ী কনের অঙ্গে মাখানোর কথা। কিন্তু আদতে সেসব কিছুই হল না। বিয়ের আগেরদিন অবধিও বিধু তার খদ্দেরদের সঙ্গে রাত কাটাতে লাগল।

কালীবাবু একটু গাঁইগুই করলে দিগম্বরী ঝংকার দিয়ে উঠল, ‘তাতে আপনার অ্যাত জ্বলচে কেন শুনি? মেয়ে তো একন বসেই আচে, একন ব্যবসা করলে খেতি তো কিচু নেই! এরপর কয়েক হপ্তা তো বন্দ রাখতে হবে বে-র চক্করে।’

বাকি ছিল বিয়ের পুরোহিত ও নাপিত। গণেশের কল্যাণে তাও জোগাড় হল। নাপিত তো এলই, এক গরিব ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ বেশ্যাকন্যাকে বেমালুম ব্রাহ্মণকন্যা বলে বিবাহ দিতে রাজিও হয়ে গেলেন। মোটা দক্ষিণার লোভে তখনকার আঙ্গিকে বেশ্যার বিবাহ দেওয়ার মতো গুরুতর অপরাধ করতে গিয়েও তাঁর কোনো চিত্তবৈকল্য হল না। অর্থের এমনই মহিমা।

বিবাহের দিন সন্ধ্যায় যথাসময়ে বরযাত্রী সঙ্গে নিয়ে টোপর মাথায় বর উপস্থিত হল। বরের বয়স বেশি হলেও বিবাহের আনন্দের আতিশয্যে সাজসজ্জা সে কিছু কম করেনি। তার কপালের চন্দন থেকে শুরু করে পরনের ধুতি, সবই একেবারে ঝকমক করছে। হাতে ধরা সিল্কের রুমালটি দিয়ে সে বারবার মুখ মুছছে।

গণেশের আনা মহিলারা শিখিয়ে দেওয়া মতো বরের সঙ্গে গিয়ে রঙ্গরসিকতা করতে শুরু করল।

সবই হল। একটা ছোটো ব্যাপারে গণেশ আর কালীবাবুর একটু ভুল হয়ে গিয়েছিল। বিবাহে শুধু আড়ম্বর ও মহিলাবর্গ থাকলেই হয়না, কিছু ছোটো ছেলে-মেয়েরও প্রয়োজন পড়ে। বস্তুত তারাই কোলাহল, দৌড়োদৌড়ি করে বিবাহবাসরকে মাতিয়ে রাখে।

কিন্তু এই অনুষ্ঠানে তেমন কেউ নেই। উপরন্তু মহিলাদের রসিকতার মানও যেন একটু বেশিই প্রগলভ।

বরের সঙ্গে আসা এক বৃদ্ধ কুটুম পাশের জনের কানে ফিসফিস করলেন, ‘আচ্ছা, আপনার কেমন ধারা বোধ হচ্চে না?’

পাশের জন তখন মহিলাদের দেওয়া ঠান্ডা শরবত পানে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি আলগোছে বললেন, ‘কেন, ভালোই তো। আরে এ কি আপনার পাড়াগাঁ নাকি মশাই, যে মেয়েছেলেরা ঘোমটা দিয়ে বসে থাকবে? এরা হল গিয়ে কলকেতার মেয়ে সব। অত লাজলজ্জা এদের নেই কো! নিন নিন শরবত খান।’

‘আহা, শুধু মেয়েদের কতা বলচি নে।’ প্রথম বৃদ্ধ বোঝাতে চেষ্টা করেন, ‘মেয়ের মামা আর ওই সম্বন্ধ করা লোকটা ছাড়া কোনো পুরুষমানুষ নেই, দেকেচেন? বলা যায়না, কলকেতায় শুনেচি অনেকরকমের জোচ্চুরি হচ্চে আজকাল…!’

‘আরে মশাই, আপনি এট্টু বেশিই ভাবচেন। বরের যে আত্মীয় কলকেতায় থাকে, মানে যিনি সম্বন্ধ করেচেন, তিনি এক্কেরে পাকা লোক, বুজলেন? ওইসব ভুল উনি করবেন না। আপনি বুড়ো মানুষ, অত ভাববেন না। নিশ্চিন্তে শরবত খান।’

বৃদ্ধ আরও কী সব বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় বরের মামা, যিনি বরকর্তা হয়েছেন, তিনি এসে ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললেন, ‘আপনারা সব আসুন। মেয়ের মামা বলচেন দেনাপাওনার ব্যাপারটা বে-র আগেই চুকিয়ে দেওয়া ভাল। আমিও বলি আর দেরি করে লাভ নেই।’

দেনা-পাওনা বাবদ সমস্ত টাকাপয়সা কিছুক্ষণের মধ্যেই কালীবাবুর হাতে চলে এল। কালীবাবুও আর কালবিলম্ব না করে ছাদনাতলায় কনেকে নিয়ে আসতে হুকুম দিলেন, ‘ওরে, মেয়েকে নিয়ে আয়। লগ্ন যে এবার শেষ হতে চলল!’

রাঙা চেলি আর চন্দনসাজে সজ্জিতা বিধু ছাদনাতলায় আসতেই বরপক্ষের কিছু মুষ্টিমেয় মানুষের কিন্তু কিন্তু অবশ্য উধাও হয়ে গেল। নাহ, কনে সত্যিই সুন্দর। বয়স একটু বেশি, তা হোক। পাত্রই বা কি কম!

‘এমন পাত্রী যে পাওয়া গেছে, তাও এত কম পয়সায়, এই আমাদের ছেলের চোদ্দপুরুষের ভাগ্যি!’ সবাই উৎফুল্লচিত্তে বলাবলি করতে লাগল।

বর তো আহ্লাদে আটখানা।

ক্রমে বিবাহের অনুষ্ঠান শুরু হল। স্ত্রী-আচার, শুভদৃষ্টি, সাতপাক ঘোরা, সিঁদুরদান সব একে একে সম্পন্ন হল। বাসররাতও মিটল। গণেশ খুব ভেবেচিন্তে তিন-চারজন অল্পবয়সি মেয়েকে বাসররাতে রেখেছিল রঙ্গরসিকতার জন্য। তাদের পরিচয় দেওয়া হল কনের তুতো বোন হিসেবে। বরের বন্ধুদের সঙ্গে ঠাট্টা করতে করতে রাত কাবার হয়ে গেল।

বর বাবাজীবনের নাম মধুসূদন। সে অবশ্য আসরে তেমন যোগ দিতে পারল না, মাঝেমাঝেই ব্রীড়াবনতা স্ত্রী-র দিকে তাকাচ্ছিল, আর মনে মনে অধীর হয়ে উঠছিল কখন নিজের গৃহে গিয়ে এইটুকু মেয়েমানুষটিকে নিজের মত করে পাবে। নিজের এমন শিশুসুলভ অস্থিরতায় সে নিজেই মাঝেমাঝে লজ্জিত হয়ে পড়ছিল, আবার না চাইতে পরক্ষণেই তার চোখ চলে যাচ্ছিল একটু দূরেই বসে থাকা নববধূর লাল টুকটুকে আলতা রাঙা পায়ের দিকে।

‘যাই বল মধু, বৌঠান খুব সুন্দর হয়েচে, কিন্তু একটা কতা না বলে পারচি না ভাই!’ ভোররাতে সবার যখন চোখ ঘুমে ঢুলে এসেছে, মধুসূদনের অন্তরঙ্গ বন্ধু নিতাই ফিসফিস করল মধুর কানে।

মধুসূদন তখন নির্নিমেষ নয়নে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ছিল। বিধু ঘুমিয়ে পড়েছে। তার কপালের দু-পাশের চুলগুলো এসে পড়েছে চোখের ওপরে। গতরাতের চন্দনফোঁটাগুলো সামান্য গলে গিয়ে পানপাতার মুখখানি আর সুন্দর দেখাচ্ছে।

আহা! এমন অনির্বচনীয় দৃশ্য তার ভাগ্যে ছিল?

নিতাইয়ের উপর্যুপরি ঝাঁকানিতে সে খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কী কতা আবার না বলে পারচিস নে?’

নিতাই বলল, ‘আরে এই মেয়েগুলো, মানে বউঠানের বোনগুলো কিরকম দেকেচিস? কলকেতার ভদ্দরঘরের মেয়েরা অনেক কেতা জানে জানতুম কিন্তু এমন বেহায়া জানতুম না ভাই! কীরকম ঢলে ঢলে পড়চিল।’

পরেরদিন সকালে কন্যাবিদায়ের সময় বরপক্ষ মেয়ের মামা অর্থাৎ কালীবাবুর নির্দেশে নিজেদের দেওয়া গয়নাগুলোও কনের গায়ে পরিয়ে দিলেন। যৌতুকবাবদ পাওয়া পাঁচ-শো টাকার গয়না ও শ্বশুরবাড়ি থেকে উপহার পাওয়া অলংকার সারা দেহে ঝলমলিয়ে সোনাগাজির উঠতি বেশ্যা বিধু চলল শ্বশুরালয়ে। সঙ্গে চলল তার মামা ও এক ঝি।

বলাই বাহুল্য সেই মামা হলেন কালীবাবু ও ঝি হল বিধুর নিজের পালক মাতা দিগম্বরী।

সবাই মিলে বরপক্ষের সঙ্গে রেলগাড়িতে চড়ে বিধুর শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ার পরের দিনই গণেশ চলল অষ্টমঙ্গলায় দ্বিরাগমনে কন্যাজামাতাকে নিয়ে আসতে।

ত্রৈলোক্য পরিকল্পনামাফিক সেই নতুন বাড়ি ছেড়ে সোনাগাজির বাড়িতে ফিরে এল।

* * *

এই ঘটনার দশদিন পর কালীবাবু, বিধু, দিগম্বরী ও গণেশ ত্রৈলোক্যর বাড়িতে ফিরল। কন্যার দ্বিরাগমনে জামাতাকে দেখতে না পেয়ে ত্রৈলোক্য কিছুমাত্র বিস্মিত না হয়ে আগেই দ্রুত বিধুর গায়ের সমস্ত গয়না খুলে নিল। আগে থেকেই অঞ্চলের এক স্বর্ণকারকে বলে রাখা ছিল। একঘণ্টার মধ্যে সব গয়না সেখানে বিক্রি হয়ে গেল। যদিও খানিকটা ক্ষতিই হল। পাঁচ-শো টাকার বেশি গয়না, মাত্র সাড়ে তিন-শো টাকায় রফা করতে হল।

‘কিচু করার নেই।’ ত্রৈলোক্য এসে মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘এই স্যাকরা আমার চেনা, কাউকে কিচু বলবে নাকো। পরে যদি কখনো খোঁজ পড়ে, পুলিশ টুলিশ এলে তকন নয়ত মুশকিল হয়ে যেত।’

‘না সে ঠিকই করেচিস।’ কালীবাবু গদিতে বসে গয়নার টাকার ভাগবাটোয়ারা করছিলেন, ‘বড়ো কিচু করতে গেলে এইসব ছোটোখাটো খেতির কথা চিন্তা করলে কি চলে? কি গণেশবাবু?’ পরক্ষণেই গণেশের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন কালীবাবু, ‘মেয়ের বাড়িতে কেমন আদর পেলে ত্রৈলোক্যকে বলেচ?’

‘সে আর বলতে!’ গণেশ বিগলিত কণ্ঠে বলতে লাগল, ‘কী খাওয়া কী খাওয়া বাপরে বাপ! গাণ্ডেপিণ্ডে গিলেচি এক্কেরে!’

‘হ্যাঁ গা, এখান থেকে যাওয়ার পর কী হল ওকানে?’ ত্রৈলোক্য আর কৌতূহল সংবরণ করতে পারে না।

‘যা সব হয়।’ গণেশ বিধুকে একটানে কাছে টেনে নিয়ে কোলে বসিয়ে বলল, ‘আমার বিধুরাণি সক্কলের জন্য ভাত রান্না করল, ওই যে বউয়ের হাতের অন্ন সবাইকে খেতে হয় না? সব্বাই গদগদ হয়ে খেয়ে নিলে। বড় সাধাসিধে লোক সব।’

‘এমা!’ ত্রৈলোক্য গালে হাত দেয়, ‘বেবুশ্যের হাতের রান্না খেলে তারা? সব্বার জাত গ্যাল যে! আর তা ছাড়া দ্বিরাগমনে বর সঙ্গে আসতেও চাইলে না এবড়ো তাজ্জবের কতা কিন্তু!’

‘তোকে কে বলল আসেনি? বেচারা বউকে চোকে হারাচ্চিল, আর একানে একা ছেড়ে দেবে? তাই আবার হয়?’ কালীবাবু একটা ঢেঁকুর তুললেন, ‘সে ব্যাটা একেবারে কাঁঠালের আঠা, কিচুতেই পিচু ছাড়েনা কো বউয়ের। শেষমেস ইস্টিশানে এসে বললাম, যাও তো বাবাজীবন, এট্টু মিঠাই কিনে নিয়ে এসো, তোমার বউয়ের খিদে লেগেছে। সে ব্যাটা যেই গেছে, ওমনি আমরা ধাঁ। সোজা একটা গাড়ি ভাড়া করে দুটো ইস্টিশান এগিয়ে এসে সেখান থেকে রেলগাড়ি চেপে চলে এলাম।’

‘আহা গো!’ ত্রৈলোক্য এবার বিধুর থুতনি ধরে একটু নাড়িয়ে দিল, ‘গোবেচারা বরটাকে এভাবে ছেড়ে আসতে পারলি বিধু?’

বিধু এতক্ষণে মুখ খুলল, ‘গোবেচারা না ছাই! এই ক-টাদিনরাত এক ফোঁটা ঘুমোতে দেয়নি মিনসেটা। সোহাগের হাঁড়ি এক্কেরে, রস যেন উথলে পড়চে। ড্যাকরা কোতাকার!’

সবাই হেসে উঠল হো হো করে। কিন্তু ত্রৈলোক্য হাসতে গিয়েও যেন প্রাণ খুলে হাসতে পারল না। এত টাকা, এত ছলচাতুরির মধ্যে ওর হঠাৎ মনে হল, আহা! বিধবা তো বিশ্বাস করে সর্বস্ব টাকাপয়সা তুলে দিল, বিশ্বাস করে বাড়ির বউকে দিয়ে সারা গ্রামের লোককে খাওয়াল, তারপর আবার নিঃস্ব রিক্ত স্বামীটিকে একা ফেলে চলে আসা হল। ওদের তো কোনো দোষ নেই।

যত যাই হোক, এটা কি ঠিক হল? নিজেদের সুখের জন্য কারুর এত বড়ো ক্ষতি করাটা কি ঠিক?

‘কী ভাবচিস তুই।’ কালীবাবু আরাম করে ত্রৈলোক্যকে টানলেন কাচে, ‘একন ক-দিন আরামে কাটবে, আর চিন্তা নেই। আয়, কাচে আয়। এই ক-দিন তোর মুখটা তো দেখতেই পাইনি!’

ত্রৈলোক্য চেষ্টা করেও হাসতে পারল না। সেই বহুদূরের অজানা গ্রামের অচেনা সেই বিধবা আর তার পুত্রের কথা মনে পড়ে তার মনটা কেমন যেন ভারী হয়ে উঠল।

ত্রৈলোক্যকে গম্ভীর দেখে কালীবাবু ভাবলেন, সে বুঝি তাঁর ওপর এত দিনের অসাক্ষাতের জন্য অভিমান করেছে। ত্রৈলোক্যর চিবুকটি হাতে করে নড়িয়ে দিয়ে তিনি গেয়ে উঠলেন,

কার কথায় করেচ অ্যাত মন ভারী সুন্দরী

আমি যেকানে-সেকানে থাকি, অনুগত তোমারি।

প্রিয়ে তুমি বালাম চাল, তুমি অড়র ডাল

তুমি আমার মাছের অম্বল, জানি চিরকাল।

গোল আলু বাগদা চিংড়ি, উচ্ছে পটল চচ্চড়ি

প্রিয় তুমি পাউরুটি, যেন জিবে গজাটি

রসগোল্লা রসে ভরা মোহনভোগ রুটি

প্রিয়ে তুমি আমার কাঁচাগোল্লা

তুমি আমার ডালপুরি।

 শুনতে শুনতে ত্রৈলোক্যর মুখে হাসি ফুটল, সে হেসে গড়িয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরল কালীবাবুকে।

এই ঘটনার পর প্রায় ছ-মাস কেটে গেল।

ত্রৈলোক্যতারিণী আর কালীবাবুর সংসার চলছে।

ততদিনে বিধু রীতিমতো আবার বেশ্যাবৃত্তি করছে, হরিও বেশ খানিকটা বড়ো হয়ে উঠেছে। সে এখন সোনাগাজির পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়ায়, চ্যাংড়া ছেলেদের সঙ্গে দিনরাত মেশে আর নিজের অবশ্যম্ভাবী অধঃপাতে যাওয়ার পথটি তৈরি করে। লেখাপড়ার কোনো পাট নেই।

একদিন সকালে হঠাৎ চার-পাঁচ জন লোক বাড়িতে চড়াও হলেন।

‘ওই তো! ওই তো মেয়ের মামা! ধর ব্যাটাকে … আমাদের বউকে নিয়ে পালিয়েচে!’

কালীবাবু কী একটা কাজে বাইরে বেরোতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ এমন সম্মিলিত আক্রমণে হতচকিত হলেন, কিন্তু ভয় পেলেন না। তিনি এইসবে অভ্যস্ত। মুখে নিদারুণ বিস্ময়ের ভান করে পান চিবোতে চিবোতে লাল জিভ বের করে বললেন, ‘কে মশায় আপনারা! চিনতেই পারচি না যে!’

‘বটে! চিনতে পারচেন না, না! চিনবেন কী করে। গয়নাগাটি, টাকাপয়সা সব গাপ করা হয়ে গ্যাচে যে!’ সামনের ভদ্রলোক রোষকষায়িত নেত্রে বললেন, ‘শিগগিরই আমাদের সবকিচু ফেরত দিন। নইলে আমরা পুলিশে খবর দেব।’

‘বেশ তো। তাই দিন না।’ কালীবাবু মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘তবে তার আগে আপনাদের বউমাটিকে একবার চাক্ষুষ করে যাবেন না?’

বিধুর কয়েকদিনের স্বামী মধুসূদন ছিল একদম পেছনে। এই কয়েকমাসে সে শুধু আর্থিকভাবেই সর্বস্বান্ত হয়নি, মানসিক দিক থেকে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। তার দুটো চোখ কোটরাগত প্রায়, গায়ের রঙও অনেক নিভে গেছে, এই সব ঝামেলায় সে আসতে চায়নি, কিন্তু তার মামা-কাকারা একরকম জোর করেই তাকে নিয়ে এসেছে।

কালীবাবুর কথায় মধু হঠাৎ বলে বসল, ‘হ্যাঁ, সে কোতায়। একবার ডেকে দিতে পারেন তাকে?’

কালীবাবু রগড় দেখার ভঙ্গিতে বললেন, ‘নিশ্চয়ই বাবাজীবন। ওই যে দেখছ রাস্তার ওপাশে খোলার ঘরগুলো? ওকানেই তোমার পরিবার রয়েছে যে! যাও না যাও, দেকে চক্কু সার্থক করে এসো।’

এই আকস্মিক কাণ্ডের জন্য পাত্রপক্ষ খুব একটা প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁরা ধারণা করেছিলেন মেয়ের মামাই সব নষ্টের গোড়া, টাকাপয়সা নিয়ে এখন মেয়েকে শ্বশুরালয়ে পাঠাচ্ছেন না। নরম গরম কথা বলে বউকে ফেরত নিয়ে যাওয়াই ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। কাজেই, কালীবাবুর কথা শুনে তাঁরা খোলার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।

যাওয়ার আগে কর্তাস্থানীয় লোকটি শাসিয়ে যেতে ভুললেন না, ‘যদি ওকানে গিয়ে আমাদের বউমাকে না পাই, সোজা থানায় যাব কিন্তু মশায় বলে রাকলাম!’

‘নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই! সে আর বলতে!’ কালীবাবু কান এঁটো করে হাসলেন।

লোকগুলো অন্তর্হিত হতেই ত্রৈলোক্য উৎকণ্ঠার সুরে বলল, ‘আপনি ওদের বিধুর কাচে পাঠালেন, ওকানে গিয়ে যখন দেখবে বিধু বেবুশ্যে, তকন তো আরও ঝামেলা হবে।’

‘ওইজন্যই তো পাঠালাম।’ কালীবাবু ক্রুরচোখে হাসলেন, ‘তুই কি ভেবেচিস সোনাগাজির লাইনের মেয়েকে বিয়ে করেচে, তাকে দিয়ে গুষ্টিশুদ্ধু লোককে খাইয়েচে, ঘর করেচে, এতগুলো বামুনের জাত গ্যাচে, এইসব খপর জানলে ওরা আর থানায় গিয়ে ঝামেলা করবে? দুর দুর! চোরের মতো সুড়সুড় করে গাঁয়ে ফিরে যাবে, বুজলি?’

‘আমার কিন্তু খুব ভয় করছে গা!’ ত্রৈলোক্য তবু শঙ্কিত চিত্তে বলে।

‘ভয়ের কিচ্চু নেই। আমি থাকতে কিচ্চু হবে না।’ কালীবাবু নিশ্চিন্তসুরে বলেন, ‘এসব ছাড় দিকিনি! তুই আমার গায়ে মাখার তেল দে। নাইতে যাই।’

কালীবাবুর ভবিষ্যদবাণীই অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। লোকগুলো হম্বিতম্বি করতে করতে সেই যে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে দিগম্বরীর খোলার ঘরের দিকে গেল, তারপর তাদের আর টিকিটিও দেখা গেল না।

নিজের স্ত্রী-র আসল রূপ দেখে মধুসূদনের মনের কি অবস্থা হয়েছিল, সেটাও আর জানা যায়নি।

তবে এইটুকু খোঁজ পাওয়া গেল যে লজ্জায় ও নিজেদের বোকামির প্রায়শ্চিত্ত করতে ওই ভদ্রলোকেরা নিজেদের গ্রামে ফিরেই রটিয়ে দিয়েছেন নববধূ দ্বিরাগমনে কলকাতা এসেই ওলাওঠায় মারা গিয়েছে।

কালীবাবু সেদিন মোচ্ছব লাগিয়ে দিলেন বাড়িতে।

গণেশ ছোটাল মদের ফোয়ারা, বিধু মনের সুখে নাচল কোমর বেঁকিয়ে। আহা, এত বড়ো বিপদ থেকে এত সহজে উদ্ধার পাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়।

এই ঘটনা এক লাফে সাহস অনেকটাই বাড়িয়ে দিল।

এরপর আরও পাঁচ থেকে ছ-টা পরিবারকে ঠিক এইভাবেই প্রতারিত করে সর্বস্ব হাতিয়ে নেওয়া হল। প্রতিবারই লজ্জাশীলা কনে সাজল বিধু। আর প্রতিবারই পাত্রপক্ষ এত বড়ো প্রতারণার শিকার হয়েও ‘যা গেছে তা যাক’ নীতি মেনে আর জলঘোলা না করে নিজেদের মুখ বাঁচাতেই সচেষ্ট হলেন।

এইভাবে বছরকয়েক চলল। এর মধ্যে দুটো ঘটনা বলার। এক, এই কয়েক বছরে ত্রৈলোক্য-কালীবাবুর আর্থিক কষ্ট আর হয়নি বললেই চলে। দুই, এর মধ্যেই হরি সোনাগাজির উঠতি মাতাল ও লম্পট হিসেবে নিজের প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটাতে শুরু করেছে। ত্রৈলোক্যও ছেলেকে কারণে অকারণে অর্থের জোগান দিয়ে তার পথ আরো সুগম করে তুলেছে।

কিন্তু গোল বাধল অন্য জায়গায়। ধীরে ধীরে বিধুর বয়স এতটাই বেড়ে গেল, যে হাজার অজুহাতেও ওই বয়সের মেয়ের বিবাহ দেওয়া যায় না। কুড়ি একুশ বছরে কোন ভদ্র পরিবারের মেয়েই অবিবাহিত থাকে না। ওদিকে বিধুর বিকল্পও কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না।

কালীবাবু বিমর্ষমুখে রোজ ত্রৈলোক্যকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কি রে, পেলি কাউকে?’

‘নাহ!’ ত্রৈলোক্য জবাব দেয়, ‘ছুঁড়িগুলোর মায়েরা অনেক সেয়ানা হয়ে গ্যাচে। বলচে ওসব দরকার নেই বাবা, নেচেগেয়ে, ব্যবসা করে যা হয় হোক। এইসব করে পুলিশের খপ্পরে পড়লে তকন কে বাঁচাবে?’

‘যতসব ভীতুর ডিম!’ কালীবাবু বেজার মুখে বলেন, ‘একন উপায় কী?’ এমন চললে তো লাটে উঠবে সব।’

এই ধান্দা লাটে ওঠার আগেই অবশ্য কালীবাবু নতুন ফিকির বের করে ফেললেন। নতুন এই পন্থা যেমন অভিনব তেমনই রোমহর্ষক।

তখন কলকাতা শহরে প্রায়ই ছোট ছেলে-মেয়ে হারানোর খবর পাওয়া যেত। ধরা যাক, কোন বাচ্চা ছেলে বা মেয়ে পথের ধারে বসে খেলা করছে, তার গলায় ঝুলছে কোন সোনার হার। প্রায়শই দেখা যেত, বাচ্চা খেলে যাচ্ছে, এদিকে গলার হার বা কানের দুল গায়েব হয়ে গেছে। সেটা নতুন কিছু নয়।

কিন্তু কালীবাবু যে রাস্তা ধরলেন সেটা অনেক বেশি ভয়ংকর। কলকাতার পথঘাট থেকে এবার প্রায়ই বাচ্চা মেয়ে অদৃশ্য হতে লাগল, সে তার গলায় কানে অলংকার থাকুক বা না থাকুক।

বাচ্চা মেয়েটিকে ঘরে এনে মায়ের মতোই যত্নআত্তি করতে লাগল ত্রৈলোক্য। ছোটো ছেলে-মেয়েরা এমনিই স্নেহ ভালোবাসা পেলে বাবা-মা-কে ভুলে যায়, বাচ্চা মেয়েগুলোও তাই ভুলে যেতে লাগল। তারপর তাদের খাইয়ে দাইয়ে বড়ো করে কখনো ব্রাহ্মণকন্যা, কখনো কায়স্থকন্যা, কখনো বা বণিককন্যা সাজিয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতে লাগল দূরদুরান্তের গ্রামে। প্রতিবারই মা সাজত ত্রৈলোক্য আর বাবা সাজতেন কালীবাবু নিজে। পাত্রপক্ষ বাছা হত এমনভাবে যাতে পণ দেওয়ার কোনো ব্যাপার না থাকে, মেয়ের বাড়ি গরিব, যা দেবে ধনী পাত্রপক্ষই দেবে।

পাঁচ-ছয় বছরের মেয়ে সব, তাদের নিজেদের বুদ্ধি নেই বললেই চলে, তারাও কোন গোলযোগ করত না।

তারপর কিছুদিন কন্যার শ্বশুরালয়ে দিনযাপন, অতঃপর যতটা পারা যায় টাকাপয়সা, গয়নাগাটি নিয়ে বাবারূপী কালীবাবুর সঙ্গে পিত্রালয়ে ফেরার নাম করে পালিয়ে আসা। তারপর আবার নতুন বিয়ে, নতুন শিকার। আর বয়স নিতান্তই বেড়ে গেলে সোনাগাজির সাবেক ব্যবসায় নামিয়ে বখরা নেওয়া।

অল্প কথায় বলতে গেলে, একসঙ্গে এবার একাধিক বিধুকে নিয়ে রমরম করে চলতে লাগল কালীবাবুর এই নতুন ব্যবসা।

কিন্তু শেষরক্ষা হল না এবারেও। কলকাতা শহরে হঠাৎ এত বালিকা নিরুদ্দেশ অত্যন্ত শোরগোল ফেলে দিল, এবং এই বিষয়ে পুলিশের দপ্তরে হইচই পড়ে গেল।

সময়টা তখন আন্দাজ ১৮৭০। তার দু-বছর আগে, অর্থাৎ ১৮৬৮ সালে ব্রিটিশ সিভিল সারভেন্ট স্যার স্টুয়ার্ট হগ কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেছেন। ইউনান সাহেব হয়েছেন সুপারিন্টেন্ডেন্ট আর ল্যাম্ব সাহেব ফার্স্ট ক্লাস ইনস্পেকটর।

এই তিনজন কর্তাই কর্মীদের কঠোর আদেশ দিলেন, যে করে হোক, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বালিকা নিরুদ্দেশের গ্যাং-কে যেন ধরা হয়। নচেৎ প্রত্যেককে শো কজ করা হবে।

ঠেকায় পড়ে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বাহিনী সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অপরাধমূলক কাজকর্মে সোনাগাজি চিরকালই প্রথম সারিতে, তার ওপর নিরুদ্দিষ্ট বালিকাদের অধিকাংশই নিখোঁজ হয়েছিল সোনাগাজি সংলগ্ন ভদ্রপল্লি থেকে। গোয়েন্দারা তাই সোনাগাজিতে কড়া নজরে তল্লাশি করতে লাগল। এমন হল, দিনেদুপুরে বাড়ির কড়া নেড়েও খানাতল্লাশি চলতে লাগল।

ত্রৈলোক্য তো ভয় পেয়েছিলই, এবার ভয় পেলেন কালীবাবু নিজেও। হাজার হোক, সেই ধনী যুবকদের ফুঁসলিয়ে বাড়ি এনে ছিনতাই করার সময় থেকেই গোটা এলাকায় ত্রৈলোক্য রাঁড়ের একটা কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। তার ওপর বিধুর সময় থেকে বিয়েতে বিশ্বাসযোগ্য দেখানোর জন্য কিছু মেয়েমানুষকে বিবাহবাসরে আনতে হয়। পুলিশি জেরায় এখানকার কোনো মেয়ে কথায় কথায় এই ব্যাপারগুলো ফাঁস করে দিতেও পারে। তখন এই বাড়ির ওপর আলাদা করে নজর রাখতে শুরু করবে গোয়েন্দারা।

কালীবাবু শুকনো মুখে বললেন, ‘এই কাজ চালিয়ে আর লাভ নেই বুজলি!’

‘তবে?’ ত্রৈলোক্য বিবর্ণমুখে বলল, ‘এবার কি করবেন ভেবেচেন কিচু?’

‘ভাবতে তো হবেই!’ কালীবাবু চোখ সরু করে বললেন, ‘বসে থাকলে কি চলবে?’

হ্যাঁ, কালীবাবু ভেবেছিলেন।

আর ভেবে শেষমেশ এমন কাজ শুরু করেছিলেন যে সেই অপরাধে বছরখানেকের মধ্যেই তাঁকে সটান লটকে পড়তে হয়েছিল ফাঁসিতে।

ত্রৈলোক্যতারিণী টাকাপয়সা, ভালোবাসা কিছু দিয়েই বাঁচাতে পারেনি তার কালীবাবুকে। কয়েকবছরের মধ্যে সে-ও অবশ্য তার প্রেমিকের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিল।

বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে সে-ই ছিল প্রথম মহিলা আসামি, যার ফাঁসি হয়েছিল ভয়ংকর সব হত্যাপরাধে।

এবার আসা যাক সেই কাহিনিতে।

ব্রিটিশরা যবে প্রথম এসে হুগলি নদীতে নোঙর ফেলেছিল, সেইসময় সুতানুটি অঞ্চলে সবচেয়ে প্রতিপত্তি ছিল শেঠ আর বসাকদের। ব্রিটিশরা ধীরে এদেশকে শোষণ করার জন্য কাঁচামাল উৎপাদন বন্ধের সবরকম পন্থা অবলম্বন করলেও কিছু মুষ্টিমেয় দেশীয় ব্যবসায়ী তাদের সঙ্গে আঁতাত করে নিজেদের আখেরই শুধু গোছাননি, তখনকার দিনে রীতিমতো কোটিপতি হয়ে গিয়েছিলেন।

একেই বলে কারোর পৌষ মাস, কারুর সর্বনাশ।

গরিবরা যতই সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ুক, জনার্দন শেঠ, শোভারাম বসাকের মতো সেই ব্যবসায়ীরা সুতানুটি হাট থেকে শুধু বস্ত্রের কাঁচামাল জোগান দিয়েই ফুলে ফেঁপে উঠেছিলেন।

সেই সুতানুটির হাটই কালের নিয়মে বাড়তে বাড়তে প্রায় ৫০০ বিঘা জায়গা নিয়ে বিশাল এক বাজারে পরিণত হল। ৫০০ বিঘা শুধু বাজারেরই আয়তন, এছাড়া ব্যবসায়ীদের থাকার জন্য আরো প্রায় ৪০০ বিঘা।

এত বড়ো বাজার, লোকমুখে নামই হয়ে গেল বড়োবাজার।

শুধু শেঠ, বসাকরা প্রথমে থাকলেও পরে সেখানে এসে ব্যবসা শুরু করল বিখ্যাত স্বর্ণ ব্যবসায়ী মল্লিকেরাও। এবং তাদের দেখাদেখি আরও অনেকে।

দেখতে দেখতে পঞ্চাশ ষাট বছরের মধ্যে বড়োবাজার এলাকাটা হইহই করা এমন এক বাজারে পরিণত হল, যেখানে কাঁচা টাকা বাতাসে ওড়ে। যেখানে সোনাদানা থেকে জামা, জুতো থেকে বিছানা সব পাওয়া যায়।

ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, কাশিমবাজার থেকে অহরহ মাল আমদানি-রপ্তানিতে সকাল থেকে রাত গরম হয়ে থাকে গোটা পট্টি।

বড়োবাজারের এমনই এক ব্যস্ত দোকান চন্দ্র স্বর্ণ প্রতিষ্ঠান।

দোকানটি আয়তনে সুবিশাল, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেখানে প্রায় পনেরো থেকে কুড়িজন কর্মচারী অক্লান্ত পরিশ্রম করে।

দোকানের কর্ণধার সতীশ চন্দ্রের বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ, স্ফীত বপু ও হাতে হিসাবের খাতা নিয়ে তিনি দোকানের একেবারে কেন্দ্রস্থলে প্রশস্ত গদিতে বসে থাকেন। তিনি জাতে সুবর্ণবণিক, কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা হোক বা গয়না বন্ধক দেওয়া কোনো দুঃস্থ বিধবা, পয়সা উশুলের সময় কোনোদিনও কাউকে এক আনাও ছাড় দিয়েছেন, এমন অপবাদ তাঁকে অতি বড়ো শত্রুও দিতে পারবে না।

তাঁর তিনতলা বসতবাড়িটি চিতপুরে। বাড়িতে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে জমজমাট সংসার। তা ছাড়া ওইসময়ের যে কোনো ধনী বণিকের মতোই তাঁর বাঁধা মেয়েমানুষও রয়েছে, নাম কমলা।

কমলাকে আলাদা বাড়ি ভাড়া করে পরিচারিকা সমেত রেখেছেন বাগবাজারে। সপ্তাহান্তে বা মন খুব কখনো উচাটন হলে দোকান শেষে চলে যান সেখানে। রাত কাটিয়ে ভোরবেলা সতীশ চন্দ্রের জুড়িগাড়ি ঘোড়া হাঁকায় চিতপুরের বাড়ির দিকে।

দুর্মুখেরা বলে সতীশ বেনের যে শুধু পেছনেই দুটো চোখ আছে তা নয়, ডাইনে বাঁয়েও দৃষ্টি রয়েছে। সারা দোকান তাঁর দাপটে তটস্থ হয়ে থাকে।

এখনও তাই হল।

দোকানে পাঁচ-ছ-জন খদ্দের থাকলেও এতক্ষণ চন্দ্রবাবু সেদিকে খুব একটা দৃকপাত করেননি, আগের দিনের হিসেব নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন।

কিন্তু সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ দোকানের সঙ্গে টগবগ করতে করতে এসে দাঁড়াল একখানা বিশাল ঘোড়ার গাড়ি। গাড়িটা থামতেই সামনের দুধসাদা বলিষ্ঠ ঘোড়া দুটো ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলতে লাগল।

আর পেছন থেকে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন একটা বেনিয়ানকুর্তা পরা মধ্যবয়সি ভদ্রলোক। মাথায় বড় লাল পাগড়ি, মুখের ওপর পুরুষ্টু গোঁফ, চাপ দাড়ি, কপালে লাল তিলক, হাতে কারুকার্য করা লাঠি।

চন্দ্রবাবু আড়চোখে দেখলেন, লোকটার পায়ের নাগরা জুতোটা পর্যন্ত একেবারে চকচক করছে।

লাঠিটাকে আলগা করে ঠুকতে ঠুকতে ভদ্রলোক দোকানের সাইনবোর্ডটা একবার পরখ করলেন, তারপর এগিয়ে আসতে লাগলেন এদিকে।

‘অ্যাই, অ্যাই ফটিক!’ চন্দ্রবাবু চাপা গলায় গর্জে উঠলেন, ‘ভালো খদ্দের আসচে, এবার ওদিকটা ছাড়। এখানে এসে খাতির কর লোকটাকে। দ্যাখ কী চাইচে।’

ফটিক নামক অল্পবয়সি কর্মচারীটি একটি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের সঙ্গে করে নিয়ে আসা কিছু পুরোনো অলংকার গলিয়ে নতুন বানাতে গেলে কী খরচ হতে পারে, তা বোঝাচ্ছিল, মালিকের উপর্যুপরি ডাকে সে মাঝপথেই দরিদ্র ব্রাহ্মণকে অপেক্ষা করতে বলে এদিকে এল, ”ডাকচেন বাবু?”

‘ডাকচেন বাবু?’ সতীশ চন্দ্র ফটিকের গলার বিকৃত অনুকরণ করে ধমকে উঠলেন, ‘হতভাগা, তোকে কতবার বলেচি যে খদ্দের বুজে নিজের সময় দিবি? ওই ঘাটের মড়াটাকে নিয়ে তকন থেকে কি করচিস তুই?’

‘আজ্ঞে বাবু, উনার মেয়ের বে-তো, ধারধোর করে চেয়েচিন্তে দিচ্চেন, কী কী গয়না গড়ালে খরচাপাতি কম হবে তাই নিয়ে এট্টু পরামর্শ …।’ ফটিক আমতা আমতা করতে থাকে। তার আবার দয়ার শরীর, এই বৃদ্ধের আকুতি শুনে তার মনে পড়ে যাচ্ছিল বাড়িতে নিজের অবিবাহিতা বোনটির কথা। এরমধ্যেই এগারোয় পড়ে গেছে সে। বোনের বিয়ের কথা ভাবলেই চিন্তায় রাতের ঘুম তার উড়ে যায়।

‘তোকে আর পরামর্শ দিতে হবে না, কী আমার মোক্তার এলেন রে! জুড়িগাড়ি থেকে এখুনি একটা খদ্দের নামল, তাঁকে দ্যাখ গে যা। সরেস লোক, দেকেই বোঝা যাচ্চে।’ বলতে বলতে সতীশ চন্দ্রের মুখের ভাবগতিক পালটে যায়, কান পর্যন্ত এঁটো করা হাসি হেসে ঘাড় দুলিয়ে বলে ওঠেন, ‘বলুন।’

ফটিক তাকিয়ে দেখে, গাড়ি থেকে নামা সেই পাগড়ি পরা ভদ্রলোক একেবারে গদির কাছে এসে পড়েছেন, একহাতে লাঠি নিয়ে তিনি নাকের কাছে হাতদুটো নিয়ে এসে নমস্কার করলেন, তারপর চোস্ত হিন্দিতে বললেন, ‘নমস্তে বাবু। আমি সরাইকেলা ষ্টেটের রাজা কুনওয়ার চক্রধর সিংহের কাছ থেকে আসছি। হামি উনার ম্যানেজার আছি। হামার নাম শত্রুঘ্ন পাণ্ডে।’

‘নমস্তে নমস্তে। আস্তাজ্ঞে হোক, বস্তাজ্ঞে হোক পাণ্ডেজি।’ সতীশ চন্দ্র চোখ বড় বড় করে প্রায় সবকটা দাঁত বের করে ফেললেন, ‘কীভাবে আপনার সেবা করতে পাড়ি বলুন হুজুর।’ কথাটা বলেই তিনি ফটিকের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চিপে চাপা গলায় বললেন, ‘শিগগিরই ঠান্ডা ঘোলের শরবত নিয়ে আয়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেকচিস কী!’

শত্রুঘ্ন পাণ্ডে সামান্য মাথা নেড়ে চন্দ্রবাবুর সামনের গদিতে বসলেন, তারপর নিজের গোঁফে খানকতক তা দিয়ে বললেন, ‘আপনিই তো এই দোকানের মালিক আছেন, বাবু সতীশ চন্দ্র। হ্যায় না?’

‘আলবাত হ্যায় হুজুর! এক-শো শতাংশ হ্যায়!’ সতীশ চন্দ্র এবার আনন্দে কি বলবেন ভেবে পেলেন না, তাঁর এত সাধের চন্দ্র স্বর্ণ প্রতিষ্ঠানের সুনাম বাংলাদেশে ছড়িয়েছে বলেই তিনি এতকাল জানতেন, কিন্তু বাংলা পেরিয়ে খ্যাতি যে বিদেশের রাজারাজড়ার ঘরে পৌঁছেছে তা উনি ধারণাও করতে পারেননি।

‘আসলে কি হয়েছে চন্দ্রবাবু, হামাদের রাজা চক্রধর সিং আপনার দুকানের গয়নার অনেক সুনাম শুনছেন বেশ কিছুদিন ধরে। সামনেই ওঁর একলৌতে বেটির শাদি। তো উনি চান কি সব গয়না এই দোকান থেকেই খরিদ হোক। সেজন্য পাঠিয়েছেন আমাকে। বুঝলেন কি না!’

চন্দ্রবাবু বুঝেছেন।

বিলক্ষণ বুঝেছেন।

বুঝে তিনি মনে মনে বেশ কিছুবার ইষ্টদেবতার নামও জপ করে ফেলেছেন।

আজ কার মুখ দেখে উঠেছেন ঘুম থেকে? ওহ, আজ তো কমলার বাড়ি থেকে সোজা এসেছেন দোকানে। নাহ, এই পুরো দাঁওটা ভালোভাবে মারতে পারলে সামনের সপ্তাহেই কমলাকে একখানা ভালো হার গড়িয়ে দেবেন, মনে মনে মনস্থির করে ফেললেন চন্দ্রবাবু।

রাজার মেয়ের বিয়ের গয়নার বরাত, ভাবা যায়?

শত্রুঘ্ন পাণ্ডে বিচক্ষণ মানুষ, বেশি সময় নষ্ট করলেন না। তবে তাঁর নজর যে আকাশ সমান উঁচু দেখেই বোঝা যায়।

আর হবেনাই বা কেন! যেমন রাজা, তার তেমনই তো উজির হবে। হালফ্যাশানের হালকা গয়নায় এঁদের মন ভরে না, এঁদের নজর সবসময় থাকে খাঁটি জিনিসের দিকে।

 চন্দ্রবাবু নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এটা-ওটা বেছে দিতে লাগলেন।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই শত্রুঘ্ন পাণ্ডে দু-তিনটে সীতাহার, রতনচুড় থেকে শুরু করে মানতাসা, কোমরবিছা, কানবালা, ঝুমকো, হাতপদ্ম সব কিছু বেছে ফেললেন। মোটা মোটা চুড়ি ছাড়াও হাঙরমুখো একজোড়া বালাও নেবেন বলে সরিয়ে রাখলেন তফাতে। তারপর কি চিন্তা করতে করতে বললেন, ‘আর কী কী নেওয়া যায় বলুন তো বাবু?’

রাজার ম্যানেজারের পছন্দের বহর দেখে সতীশ চন্দ্রের চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। গোটা মাসে এত টাকার গয়না বিক্রি হয়না, এক বেলায় যতটা হতে চলেছে।

‘বাবু?’ পাণ্ডেজি সতীশ চন্দ্রের চোখের সামনে হাত নাড়ালেন, ‘খোয়াব দেখছেন নাকি? হা হা!’

‘আ-আজ্ঞে না না!’ চটকা ভেঙে সতীশ চন্দ্র দুই হাতের তালু ঘষতে ঘষতে বললেন, ‘তা আপনি পুরুষ মানুষ, কোনো মেয়েছেলে সঙ্গে নিয়ে এলে বোধ হয় আরও ভালো হত। হাজার হোক, গয়নাগাটির ব্যাপার তো …!”

‘বটেই তো। আপনি একদম সাহি বাত বলেছেন বাবু।’ শত্রুঘ্ন পাণ্ডে মাথা নাড়লেন, ‘কিন্তু কুছু করার ভি নেহি। রানিসাহেবা মানে হামাদের রাজা কুনওয়ার চক্রধর সিংহের বিবির তো বহুদিন আগেই ইন্তেকাল হয়ে গেছে। রাজার বেটি ছাড়া ভেতর মহলে আর কোনো খানদানী জেনানা ভি নেহি হ্যায়। ইসি লিয়েই তো মুঝকো আনা পড়া!”

‘না না ঠিক আচে ঠিক আচে।’ সতীশ খদ্দের হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘আপনি এসেচেন বড়োবাজারের সবচেয়ে বড়ো আর বিশ্বস্ত দোকানে। আমরা এমন পচুন্দ করে আপনাকে গয়না দেব, যে মা জননী চোক ফেরাতেই পারবেন না, হে হে। শ্বশুরবাড়ি হাঁ হয়ে যাবে।’ পরক্ষণেই তিনি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রমেশকে বললেন, ‘এক জোড়া কানপাশা আর আংটিও দিয়ে দে।’

পছন্দ পর্ব মিটে যাওয়ার পর মোট দাম হল প্রায় দু-হাজার টাকা। এত টাকার গয়না এক লহমায় বিক্রি হয়ে যাচ্ছে দেখে সতীশ চন্দ্রের ইচ্ছে হচ্ছিল এখনই বাগবাজারে গিয়ে কমলার গলা জড়িয়ে ধরে একটু সোহাগ করেন।

আহা! কে বলেচে বাঁধা রাঁড় লক্ষ্মী হয় না?

শত্রুঘ্ন পাণ্ডে উঠে দাঁড়ালেন, ‘বহত বহত শুক্রিয়া। আচ্ছা, মেহেরবানি করে আপনার কোনো বিশোয়াসি লোককে সঙ্গে দিয়ে দিন বাবু। এত পয়সা তো সাথে লিয়ে আসিনি। আপাতত হামরা এই বড়োবাজারেই একটা ভাড়া বাড়িতে উঠেছি। এখান থেকে চল্লিশ পা মতো। আপনার লোক গয়না লিয়ে হামার সাথে চলুক, হামি হাতে হাতে পয়সা ভি দিয়ে দেব, গয়না ভি লিয়ে লেব। কি বলেন!’

‘বিলক্ষণ!’ চন্দ্রবাবু সঙ্গে সঙ্গে ফটিককে কাছে ডাকলেন।

ছেলেটা অল্পবয়সি হলেও খুব বিশ্বাসী আর কর্তব্যপরায়ণ। এতগুলো টাকা নিয়ে আসবে, যাকে তাকে তো পাঠালে হবেনা, চাপা গলায় বললেন, ‘এই তুই চলে যা হুজুরের সঙ্গে। সাবধানে ফিরবি।’

‘ওয়াপস লৌটনে কে লিয়ে পরেশান হোবে না বাবু। হামার গাড়িই এসে ওকে নামিয়ে দিয়ে যাবে।’ পাণ্ডেজি কথাটা বলে নমস্কার করলেন, ‘আসি তবে? বহত বহত ধনিয়াবাদ!’

চন্দ্রবাবু একবার ভাবলেন পাণ্ডেজি কোথায় উঠেছেন সেটা জেনে নেবেন। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলেন, বড়োঘরের লোক, জিজ্ঞেস করলে যদি কিছু মনে করেন? বলছে তো বড়োবাজারেই। বড়োবাজারে থাকার জন্য ভাড়াবাড়িগুলোর ঘাঁতঘোত সব চন্দ্রবাবুর চেনা। চিন্তার কিছু নেই।

‘ধন্যবাদ, ধন্যবাদ হুজুর! আবার আসবেন। মা জননীকে আমার আশীর্বাদ দেবেন।’

গয়নাসমেত ফটিক আর শত্রুঘ্ন পাণ্ডে জুড়িগাড়ি হাঁকিয়ে চলে যাওয়ার পর চন্দ্রবাবু কিছুক্ষণ তৃপ্ত মনে সেদিকে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর গুনগুন করে একটা শ্যামাসংগীত গাইতে গাইতে ক্যাশবাক্স বন্ধ করে দোকানের পেছনে গিয়ে মধ্যাহ্নভোজের আহারে বসলেন।

চিতপুরের বাড়ি থেকেই তাঁর জন্য ফি দিন খাবার আসে। আজও এসেছে। ভাত, ডাল, ভাজা, শুক্তো, ইলিশ মাছ, চাটনি।

বাড়িতে যতই দাস-দাসী থাকুক, স্বামীর রান্না চন্দ্রবাবুর স্ত্রী নিজে হাতে করেন। তাঁর গিন্নির রান্নার হাতটি যেন সাক্ষাৎ মা অন্নপূর্ণা।

সতীশ চন্দ্র মৌজ করে খেতে শুরু করলেন। খাওয়াটা তাঁর কাছে আবার একটু বিলাসিতার বস্তু। সারাদিন দোকানের ওইটুকু গদিতে বসে থাকেন, খাওয়ার সময় তাড়াহুড়ো একেবারে পছন্দ হয়না।

প্রথমেই তিনি ইলিশমাছটা একপাশে সরিয়ে রাখলেন। ওটা একেবারে শেষে খাবেন। শুক্তো দিয়ে ভাত খেয়ে ডাল, ভাজাভুজি সব ধীরেসুস্থে শেষ করলেন।

তারপর একে একে ইলিশমাছ, চাটনি খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে পেটে হাত বোলাতে বোলাতে দোকানে এসে বললেন, ‘কইরে ফটিক, এক খিলি পান সেজে নিয়ে আয় তো নন্দর দোকান থেকে।’

‘ফটিক তো এখনো ফেরেনি বাবু!’ রমেশ ওদিক থেকে চেঁচিয়ে বলল।

‘অ্যাঁ!’ সতীশ চন্দ্র চোখ বড়োবড়ো করে বললেন, ‘ফেরেনি মানে? এতক্ষণ হয়ে গেল, ফেরেনি কেন?’

দোকানে এরমধ্যেই কর্মচারীরা কিছু গুঞ্জন করছিল, এবার সবাই এসে কাছে দাঁড়াল, ”আমরাও তো তাই ভাবচি বাবু! ভাড়াবাড়িগুলোর দিকটায় একবার গিয়ে দেকে আসব?”

ফটিক সত্যিই তারপর আর কোনোদিনই ফেরেনি।

কারণ হেঁটে দোকানে ফেরার জন্য যে একটা রক্তমাংসের শরীর প্রয়োজন হয়, তার সেই শরীর থেকে প্রাণবায়ু উড়ে গিয়েছিল চন্দ্রবাবুর চিন্তা শুরু হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ আগেই।

শত্রুঘ্ন পাণ্ডেরূপী কালীবাবু বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তার ঘাড়ে আচম্বিতে রদ্দা মেরে অজ্ঞান করে দিয়েছিলেন।

তারপর ত্রৈলোক্য এসে বালিশ ঠেসে ধরেছিল মুখে। ত্রৈলোক্যর জনশূন্য বিশাল বাড়িতে এক ফোঁটা বাতাসের জন্য ছটফট করতে করতে ফটিক ঢলে পড়েছিল মৃত্যুর কোলে। তার চোখ দুটো শেষ সময়ে বাইরে ঠিকরে বেরিয়ে এসেছিল, হয়ত বা অবিবাহিতা বোনটির ভবিষ্যতের চিন্তাতেই।

দু-জনেই যখন বুঝল গয়নার দোকানের কাজের লোকটি সত্যিই পরপারে চলে গিয়েছে, ত্রৈলোক্য প্রথমেই ফটিকের পেটে শক্ত করে বেঁধে রাখা গয়নার ভারী বাক্সটা খুলে নিজের ঘরে গোপন কুঠুরিতে রেখে এল।

তার বুকের ভেতরটা ধড়াস ধড়াস করছিল।

এই প্রথম সে একটা খুন করল। কালীবাবু যতই মদত দিক, সেও তো বালিশ চেপে রেখেছিল প্রাণপণ জোরে।

সাদা গলায় ও বলল, ‘লাশটা কোথায় ফেলবেন গো কালীবাবু? আ-আমার কিন্তু খুউব ভয় করচে!’

কালীবাবু এতক্ষণের পরিশ্রমের পর হাঁপাচ্ছিলেন। গালের নকল দাড়ি, গোঁফ, পড়চুলা, পাগড়ি সব খুলতে খুলতে বললেন, ‘ভয়ের কিচু নেই। সব ভাবা আচে। চিন্তা করিসনি। পেছনের পুকুরে পুঁতে দেব। তবে একন না। ওদিকে তো আবার একন মেয়েচেলেগুলো নাইতে আসে। রাতের বেলা কাজ সারতে হবে।’

ত্রৈলোক্য তবু স্বাভাবিক হতে পারে না। মৃতদেহের পাশে বসে সে কেঁপে কেঁপে ওঠে, ‘জুড়িগাড়ির কোচোয়ানটাকে কি বললেন?’

‘কি আবার বলব? তাকে ভাড়া করেচিলুম, বাড়ির একটু আগে ভাড়া মিটিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েচি।’ কালীবাবু সতীশ চন্দ্রের দোকানে খাওয়া ঘোলের ঢেঁকুর তুলতে তুলতে বলেন, ‘আমরা এখন রাজা হয়ে গেলুম বুজলি! রাজার ঘরেও অ্যাত গয়না নেই আমাদের কাচে যা আচে। সব ধীরেসুস্থে চোক কান খোলা রেখে বেচতে হবে। এট্টু জল দে দিকি! এতক্ষণ ধরে অ্যাক্টো করতে করতে তেষ্টায় গলাটা কাঠ হয়ে গ্যাচে। ওফ, ওই যে গিরীশ ঘোষ আচে না, ন্যাশনাল থিয়েটারে অ্যাক্টো করে, সে অবধি দেকলে লজ্জা পেয়ে যেত আজ।’

ত্রৈলোক্য জল আনতে যায়। আর তার অট্টালিকাসম বাড়ির মাঝের প্রশস্ত উঠোনে পড়ে থাকা নিষ্পাপ ফটিকের নিঃস্পন্দ দেহ শেষ বারের জন্য কেঁপে ওঠে, তারপর নিশ্চল হয়ে যায়, চিরকালের জন্য।

১০

কথায় আছে—লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। এই প্রবাদটি কালীবাবুর ক্ষেত্রে অক্ষরে অক্ষরে খাটে।

অগুনতি অপরাধ এযাবৎ কাল করে এলেও বিধাতা সম্ভবত তাঁকে একের- পর-এক সুযোগ দিতে চাইছিলেন, একটার-পর-একটা অপরাধে ক্ষমা করে। তাই প্রতিটি বার দোষ করেও ছাড় পেয়ে যাচ্ছিলেন কালীবাবু। কিন্তু ভগবানেরও ধৈর্যের সীমা আছে।

কিন্তু এবার দোষ করে ছাড় পাওয়া হল না। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য চরম দণ্ডে দণ্ডিত হলেন কালীবাবু।

আর যে পুলিশকর্তার অক্লান্ত পরিশ্রমে কালীবাবু ধরা পড়লেন ও দোষী সাব্যস্ত হলেন, তিনি এই গোটা ত্রৈলোক্যতারিণীর জীবন সুচারু হাতে তাঁর ডায়রিতে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। তাঁর লেখা থেকেই জানতে পারা যায় এই ভয়ংকরী নারীর জীবনবৃত্তান্ত।

তিনি দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে তাঁর পুলিশি জীবনের রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা তিনি একের-পর-এক লিখে গিয়েছিলেন তাঁর ‘দারোগার দপ্তরে’। সেখানেই বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে সিরিয়াল কিলার ত্রৈলোক্যতারিণীর কথা।

চন্দ্র স্বর্ণ প্রতিষ্ঠানের কর্তা সতীশ চন্দ্র সেদিন যখন লোক পাঠিয়ে বড়োবাজারের ভাড়া বাড়িগুলোর একটাতেও তথাকথিত সরাইকেলা এস্টেটের রাজা চক্রধর সিংহের ম্যানেজারের টিকিটি দেখতে পেলেন না, তখন কালবিলম্ব না করে খবর দিলেন থানায়।

থানা থেকে যখন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ এল, ততক্ষণে সতীশ চন্দ্র বারদুয়েক ফিট হয়ে গেছে। দু’হাজার টাকারও বেশি গয়নার শোকে ঘনঘন মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি।

দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন অত্যন্ত জবরদস্ত পুলিশ। চন্দ্রবাবুর দোকান থেকে জুড়িগাড়ির কোচোয়ান, কোচোয়ান থেকে সোনাগাজী অঞ্চল, সেখান থেকে পথচারিদের খোঁজ করতে করতে ত্রৈলোক্যতারিণীর বাড়ির সন্ধান পেতে তাঁকে খুব বেশি বেগ পেতে হল না।

কথায় কথায় ত্রৈলোক্য আর কালীবাবুর অতীতের গুণকীর্তির কথাও তাঁর কানে এসে পৌঁছেছিল, ফলে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হল।

ওদিকে সতীশ চন্দ্রের দোকানের সবাই ছদ্মবেশ না থাকা সত্ত্বেও কালীবাবুকে সহজেই শনাক্ত করল।

কিছুদিনের মধ্যেই পুলিশ কালীবাবুকে গ্রেফতার করল। ত্রৈলোক্যকে কেউ খুন করতে বা হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকতে দেখেনি, তাই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া পুলিশ প্রাথমিক পর্বে আর কিছু করল না।

খুনের মামলা বলে কথা, শীঘ্রই কেস আদালতে উঠল।

ত্রৈলোক্য একদিকে কালীবাবুর বিরহ, অন্যদিকে পুত্র হরির মুহুর্মুহু প্রশ্নবাণে উন্মাদিনী হয়ে গেল প্রায়।

যে কালীবাবুকে সে চোখের আড়াল হতে দেবে না বলে জীবিকা নির্বাহ থেকে পর্যন্ত ছাড়িয়ে দিয়েছিল, সেই কালীবাবুকে এখন পুলিশের নির্মম অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে ভাবলেই ওর মাথার ভেতরটা কেমন করে ওঠে, নিশুতি রাতে একা একা জানলা ধরে সে তাকিয়ে থাকে ভূতের মতো।

লাঠি, ছুরি, হাতের কাছে যা পায় তাই দিয়ে নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে আঘাত করতে চায়, ভাবে এতে যদি কালীবাবুর অত্যাচারিত হওয়ার কষ্ট সে একটু হলেও অনুভব করতে পারে।

এই কাহিনী লিখতে গিয়ে ত্রৈলোক্যতারিণীর আশৈশব চরিত্র যতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছি, সে যে splitted personality অর্থাৎ dissociative personality disorderএর শিকার ছিল এমনটাই বারবার মনে হয়েছে। তার চরিত্রের মধ্যে একইসঙ্গে সাদা ও কালো রং প্রবলভাবে উপস্থিত ছিল। গৌরের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া থেকে শুরু করে, ব্যভিচারিণী হয়ে নিজেকে সোনাগাজির প্রসিদ্ধ বারবণিতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, ছলাকলা দিয়ে বালিকা মেয়েদের নকল বিবাহ দিয়ে প্রতারণা করা এই সমস্ত অপরাধমনস্ক মানসিকতার সঙ্গে তার চরিত্রে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে রয়েছে কালীবাবুর প্রতি তার অকৃত্রিম ও অকুণ্ঠ প্রেম এবং হরির প্রতি নিখাদ মাতৃস্নেহ।

কালীবাবুর জন্য তার আত্মত্যাগ আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি, এবার তার জীবনের পরবর্তী অধ্যায়গুলোয় দেখব একদিকে ভয়ংকরতম সিরিয়াল কিলার হয়েও অন্যদিকে কিভাবে হরিকে সে বাৎসল্যস্নেহে আগলে রেখেছিল। এমনকী হরিকে রক্ষা করার মাশুলও তাকে একসময় দিতে হয় নিজের জীবন দিয়ে।

রাঁড় কাহিনি সম্পূর্ণ পড়ার পর ত্রৈলোক্য সম্পর্কে কোন পাঠকের কি ধারণা হবে জানিনা, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তার চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, ত্রৈলোক্য যে ক-টা-লঘু-গুরু অপরাধ করেছিল, সবই অভাবের তাড়নায়, এবং কখনো কালীবাবুর কথা, কখনো হরির মুখে দুবেলা অন্ন তুলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষায়।

স্বভাবগত অপরাধী সে সম্ভবত ছিল না। থাকলে ফাঁসি হওয়ার আগে দারোগা প্রিয়নাথের কাছে সে অনুশোচনায় ভেঙে পড়ত না।

যাইহোক, ফেরত আসা যাক ঘটনাক্রমে।

ত্রৈলোক্যতারিণী নিজের তলানী সঞ্চয়টুকু জলের মতো খরচ করতে লাগল কালীবাবুর উকিলের পেছনে। হাতে গলায় সামান্য যে ক’গাছা গয়না ছিল, বিক্রি তো করলই, সঙ্গে বিক্রি করে দিল ওর অত সাধের বিশাল বাড়িটাও। একখানা উকিলে তার স্বস্তি হল না, আরও কয়েকজন মোক্তারকে টাকা দিয়ে সে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল কালীবাবুর মুক্তির জন্য।

মোক্তাররাও তেমনই, এই নির্বোধ স্ত্রীলোককে যাহোক কিছু বুঝিয়ে তাঁরা সব অর্থ গুছিয়ে নিতে লাগল নিজেদের নামে। ওদিকে কাজের কাজ কিছুই হল না।

কালীবাবুর বিরুদ্ধে এমনই সব শক্ত প্রমাণ ছিল যে হাইকোর্টে জুরিদের বিচারে তাঁর ফাঁসি দেওয়া হবে এমনই সাব্যস্ত হল।

ত্রৈলোক্য তবু হাল ছাড়ল না, সে আগেই হরির হাত ধরে উঠে গিয়েছিল এক খানা সামান্য খোলার ঘরে, সেখান থেকে প্রত্যহ গিয়ে সে পায়ে পড়তে শুরু করল পুলিশদের।

যার বিশাল অট্টালিকা, দাস-দাসী ও অর্থপ্রাচুর্যে গমগম করত, যার মুখের সামান্য কথায় অনুরাগীর দল হাজির করত মহার্ঘসব বস্তু, তার আজ সেই রূপ, যৌবন, অর্থ কিছুই নেই। আছে শুধু অতীতের স্মৃতিচারণ আর প্রিয়জনকে হারানোর দুঃখ। সারাদিন সে বিচারের আশায় ছুটে বেড়ায় আর রাতের অন্ধকারে এঁদো গলির খোলার ঘরে বসে পুরনো দিনের কথা ভাবে আর নিশ্বাস ফেলে।

চোখের জলও যেন তার শুকিয়ে গেছে। ঠিকমতো চুল আঁচড়ায় না, খায় না, বিস্রস্তবসনে আলুথালু হয়ে সে সারাদিন বসে থাকে।

ওদিকে প্রমাণাভাবে ত্রৈলোক্য যতই নিষ্কৃতি পাক, দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় কিন্তু ঠিক সন্দেহ করেছিলেন যে ফটিক হত্যার পেছনে ত্রৈলোক্যরও হাত ছিল। তিনি প্রায়শই বাড়িতে এসে জেরায় জেরায় অস্থির করে তুলতে লাগলেন ত্রৈলোক্যকে।

যাইহোক, নিজের সাধ্যাতীত চেষ্টা করেও ত্রৈলোক্য কালীবাবুকে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাতে পারল না। এক বিষণ্ণ প্রভাতে তাকে নিঃস্ব রিক্ত করে দিয়ে কালীবাবু চলে গেলেন। ফাঁসিমঞ্চে যাওয়ার আগে ত্রৈলোক্যর হাত ধরে বলে গেলেন, ‘তোকে বারবার বলে যাচ্চি, কখনো যেন কিচু স্বীকার করিসনি ত্রৈলোক্য।’

‘আমি তো স্বীকার করতেই চাই কালীবাবু!’ কাঁদতে কাঁদতে বলল ত্রৈলোক্য, ‘আপনি চলে গেলে আমি কী নিয়ে বাঁচব? এই জীবন নিয়ে কী করবো আমি?’

কালীবাবু আবার বোঝালেন, ‘তুই হরির কথা ভাব ত্রৈলোক্য। আমি তো চলে যাচ্চি, তুইও চলে গেলে হরিকে কে দেকবে সেটা ভেবেচিস! ছেলেটা তো এইবয়সে অনাথ হবে রে!’

ত্রৈলোক্য চুপ করে যায়। এই একটা কারণ দেখিয়ে কালীবাবু কিছুতেই ত্রৈলোক্যকে পুলিশের কাছে অপরাধ স্বীকার করতে দেননি, সেই প্রথম দিন থেকে। কিন্তু কালীবাবু বুঝছেন না, তিনি না থাকলে ত্রৈলোক্যর কি মানসিক জোর বলে কিছু থাকবে?

কালীবাবু চলে যাওয়ার পর ত্রৈলোক্য কিছুদিনের জন্য কেমন পাগল হয়ে গেল, তারপর এমন মৌনব্রত অবলম্বন করল যে হরি পর্যন্ত শঙ্কিত হয়ে উঠল। হরি ত্রৈলোক্যকে মা বলেই জেনে এসেছে এতকাল। সে বলল, ‘মা, তোর কি হয়েচে? সারাদিন বাড়ির মধ্যে একভাবে বসে থাকিস। কোতাও বেরোতেও তো পারিস!”

ত্রৈলোক্য প্রস্তরবৎ বসে থাকে, হরির কথার কোন উত্তর দেয় না। তার চোখ বেয়ে নীরবে অশ্রুধারা নামে। একলা বসে থাকতে থাকতে সে কখনো চলে যায় বর্ধমানের সেই সবুজ গ্রামে, কখনো চলে যায় তার জীবনের প্রথম পুরুষ গৌরের কাছে, কখনো বা মনে করতে চেষ্টা করে তারাদিদির ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া মুখটাকে।

এমনিতে এখন তারা দু-জনে যে খোলার ঘরটিতে থাকে, সেটা সোনাগাজিতে নয়। বাড়ি বিক্রির সময় ইচ্ছে করেই ত্রৈলোক্য সোনাগাজি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল, পুলিশি উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য। এখানে সে কাউকেই চেনে না। কাজেই তাকে কেউ বিরক্ত করার নেই।

কথায় বলে, সময় পুত্রশোকও ভুলিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে কালীবাবুর মৃত্যুর নিদারুণ শোক ত্রৈলোক্য ভুলল না বটে, কিন্তু পুত্রের দিকে চেয়ে তাকে আবার জীবনের মূলস্রোতে ফিরতেই হল।

 সংসারের অবস্থা দিনের পর দিন ভয়াবহ হয়ে উঠতে লাগল। শেষে এমন দিন এল, হরিকে কোনোমতে খাইয়ে ত্রৈলোক্য একবেলা উপবাস করতে লাগল।

তাতেও কিছু সুরাহা হল না। নিয়মিত কোনো রোজগার না থাকায় রোজ ভোরে ঘুম ভেঙ্গেই ত্রৈলোক্য অস্থির হয়ে ওঠে, আজ ছেলেটাকে কি খাওয়াবে!

হরি উঠতি বয়সের ছেলে, তার পেট ঠিকমতো ভরে না, ত্রৈলোক্য ঠিকই বোঝে। হরির মুখের দিকে সে তাকাতে পারে না। অহরহ তার মনে হয়, স্বর্গ থেকে কালীবাবু যেন তার দিকে ঘৃণার চোখে তাকাচ্ছেন, বলছেন, ‘তোর হাতে ছেলেটাকে দিয়ে গেলাম, তুই ওকে পেটভরে খাওয়াতেও পারচিস না ত্রৈলোক্য? নিজের পেটের ছেলে হলে এমন পারতিস?’

ত্রৈলোক্য এসব ভাবলেই থরথর করে কেঁপে ওঠে। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে সে মনে মনে কালীবাবুর পা-দুটো জড়িয়ে বলতে থাকে, ‘আপনি বিশাস করুন কালীবাবু, আমি হরিকে কখনো পর ভাবিনি। ও যে আমারই ছেলে, পেট ধরিনি তো কি! ও ছাড়া আমার আর কেউ নেই। কিন্তু কি করবো … কিচুতেই তো রোজগারের কোনো পথ দেকতে পাচ্চি নে।’

কালীবাবু যেন ত্রৈলোক্যের আকুতি উপেক্ষা করেই পরিহাসচ্ছলে গর্জে ওঠেন, ‘একসময়ে গোটা সোনাগাজি তোর কথায় উঠত বসতো, তোর রোজগারের ভাবনা কিসের? আগের মতো ব্যবসা শুরু করলেই হয়।’

ত্রৈলোক্য স্তব্ধ হয়ে যায়। একসময়ে যা ছিল ছিল, এখনো কি সত্যিই তার সেই রূপ যৌবনের লেশমাত্র আছে যে কোনো পুরুষ আকৃষ্ট হবে? নেই। তবু পেটের দায় বড় দায়। ত্রৈলোক্যর ডাকে এবার ঘরে আসতে লাগল একেবারেই নীচুশ্রেণীর মানুষজন। কখনো ভিস্তিওয়ালা, কখনো মেথরপট্টির কেউ, আবার কখনো একেবারেই নিঃস্ব লম্পট কোনো মাতাল।

যেমন তাদের নিকৃষ্ট রুচি, তেমনই তাদের কদাকার ব্যবহার ও অত্যাচারের মাত্রা। তবু ত্রৈলোক্য নিরুপায়। এদের মনোরঞ্জন করে কুড়িয়ে বাড়িয়ে সে অতিকষ্টে সংসার চালাতে লাগল। তবু সে ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে মায়ের কাছে শপথ করে এসেছে, যা হয়েছে হয়েছে, আর কখনো সে কোনো অসৎ কাজে প্রবৃত্ত হবেনা।

ধীরে ধীরে কাজেকর্মে ব্যস্ততার জন্যই হোক, আগের চেয়ে ত্রৈলোক্য অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠল।

বিকেলের দিকে সামান্য বিনোদনের জন্য একটু বাইরে হেঁটে আসতেও আরম্ভ করল। সারাদিন ঘরের মধ্যে একাকী যেন দমবন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু এই এলাকায় সে কাউকেই চেনেনা। অগত্যা প্রতিদিন বিকেলে ত্রৈলোক্য হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় তার পুরনো পাড়া সোনাগাজিতে। সেখানে এখনো তার পরিচিত মহিলারা আছে। তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ বসে সুখদুঃখের কথা বলে মনটা হালকা করে সে রোজ বাড়ি ফেরে।

ওদিকে হরি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বাপের পদাঙ্ক অনুসরণে পটু হয়ে উঠেছে। ইদানীং সে সারাদিন বাড়ি থাকেই না বলতে গেলে। এই আঠেরো উনিশ বছর বয়সেই এমন কোনো হীন কাজ নেই যাতে সে প্রবৃত্ত হয়নি। সারাদিনে শুধু দু’বার খাওয়ার জন্য বাড়িতে ফেরে হরি। অন্যসময় কখনো কোনো দুষ্কার্যে কিংবা কোনো কিশোরী বারবনিতার কাছে সময় কাটায়। ত্রৈলোক্য বারণ করলেও শোনে না, মা-কে সে গুরুত্বই দেয় না। মায়ের সঙ্গে তার কথা শুধুমাত্র টাকা চাওয়ার সময়ে।

হরির উত্তরোত্তর চাহিদা বৃদ্ধিতে ত্রৈলোক্যর আবার আর্থিক সংকট দেখা দিতে লাগল। কিন্তু আপত্তি করলেই হরি হুমকি দিত, ‘ভালো চাস তো এখুনি বের করে দে। নইলে আর ঘরেই ফিরব না দেকে নিবি!’

নির্বোধ ত্রৈলোক্য হরির চালাকি বুঝত না। বাড়ি না ফিরলে সে যাবে কথায়? খাবে কি? তার নিজের কি কোনো যোগ্যতা আছে? কিন্তু ত্রৈলোক্য সেই চাতুর্য বুঝতে না পেরে ছটফট করে উঠত। কালীবাবু চলে গেছেন, তার প্রাণের ধন হরিও যদি তাকে ফেলে চলে যায়, সে কি নিয়ে বাঁচবে? তটস্থ হয়ে সে অমনি টাকা তুলে দিত হরির হাতে।

এইভাবেই নিয়তি তাকে ধীরে ধীরে বাধ্য করল আবার পাপের পথ অনুসরণ করতে।

১১

ত্রৈলোক্য সেদিন বিকেলে সোনাগাজিতে একাকী অলস পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে, এমন সময় একটা বাড়ির দোতলা থেকে মেয়েলি গলায় কে যেন ডেকে উঠল, ‘অ ত্রৈলোক্যদিদি, কেমন আচ?’

ত্রৈলোক্য মুখ তুলে দেখল এক মহিলা হাসি হাসি মুখে তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, ‘কীগো, হাঁ করে কি দেকচ! আ মরণ! চোকের কি মাতা খেয়েচ? না চিনতে পারচ না। আমি কুসুম গো, কুসুম। ওপরে এসো। এই যে, ইদিক দিয়ে সিঁড়ি গো!’

ত্রৈলোক্য এবার চিনতে পারে। অনেকদিন আগে যে বাড়িতে প্রথম গৌর তাকে নিয়ে গিয়ে উঠিয়েছিল, সেই বাড়িরই আরেক ভাড়াটে ছিল কুসুম। তখন অবশ্য সে ছিল রোগা পাতলা শ্যামলা মেয়ে। এখন বয়সের সঙ্গে পৃথুলা হয়েছে। তাই ত্রৈলোক্য তাকে চিনতে পারেনি। বহুবছর আগের কুসুমের সেই রোগা হাসিখুশি মুখটাই তার মনে আঁকা আছে। মেয়েটা খুব মিশুকে ছিল।

প্রায়ই ত্রৈলোক্যর ঘরে আসত গল্পগাছা করার জন্য। শেষে ত্রৈলোক্য যখন নিজের বিশাল বাড়ি কিনে উঠে গেল, তখনও বারদুয়েক সেই নতুন বাড়িতে গিয়েছিল। তারপর বহুকাল আর যোগাযোগ নেই।

ত্রৈলোক্য হাসি হাসি মুখে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়। বহুকাল পর এক পুরনো বান্ধবীকে পেয়ে সত্যিই তার মনটা খুশীতে ভরে যায়। সেদিন অনেক গল্প হয় দুজনে। কুসুমের দশা এখন ত্রৈলোক্যর মতো এতটা খারাপ না হলেও যৌবনে ভাঁটা পড়ায় তারও ব্যবসায় টান পড়েছে।

রাত বাড়তে ত্রৈলোক্য তৃপ্ত চিত্তে বাড়ি ফেরে।

এরপর থেকে সে মাঝে মাঝেই কুসুমের বাড়ি চলে যেত। এই এতবড়ো পৃথিবীতে সে একেবারে একা, এতদিন পর একটা কথা বলার সঙ্গী জুটেছে। কুসুমও তাকে পেয়ে খুশী হত।

কিন্তু ত্রৈলোক্যর জীবনে আর যাইহোক নিরবচ্ছিন্ন স্বস্তিও সম্ভবত বিধাতা লেখেননি। তাই নিকৃষ্ট সব মানুষের সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হয়ে রোজগার করে সংসার চালাতে সে প্রাণপাত করে চললেও ঈশান কোণের মেঘের মতোই বিপদ যেন আবার ধেয়ে আসতে লাগল তার জীবনে।

হরির চাহিদা বাড়তে বাড়তে এতটাই বেড়ে যেতে লাগল, যে ত্রৈলোক্য সব দিয়েও তাকে তুষ্ট করতে পারত না। নেশায় মত্ত হরি তখন ত্রৈলোক্যর গায়ে হাত তুলতে শুরু করল। যে নারী তাকে আশৈশব মাতৃস্নেহে বড় করে এসেছে, তাকে কুৎসিততম গালি দিতেও তখন তার মুখে বাধত না।

একদিন ত্রৈলোক্য স্নান সেরে বেরিয়েছে, দরজায় এত জোরে শব্দ করে হরি বাড়ি ঢুকল যে, ত্রৈলোক্য চমকে উঠল। এমনিতে হরি আজকাল দিনের বেলা বাড়ি ফেরে না বললেই চলে, ভোরবেলা ফেরে মদে চুর হয়ে। তারপর আবার খেয়েদেয়ে বেরিয়ে যায়।

কিন্তু আজ তার চোখ রক্তবর্ণ, ঠোঁটের একপাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানের রস। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে এতটাই মদ্যপান করেছে যে ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না। টলে টলে পড়ে যাচ্ছে।

তার কাঁধে ভর দিয়ে শক্ত করে দাঁড় করিয়ে রেখেছে একটা অল্পবয়সী মেয়ে। হরি তাকে একবার করে কাছে টানছে, আবার নিজে হেলে পড়ে যাচ্ছে। গলা দিয়ে গুনগুন করছে একটা গান।

এসো এসো চাঁদবদনি।
এ রসে নিরস কোরো না ধনি।
তোমাতে আমাতে একই অঙ্গ
তুমি কমলিনী আমি সে ভৃঙ্গ।
অনুমানে বুঝি আমি সে ভুজঙ্গ
তুমি আমার তায় রতনমণি
তোমাতে আমাতে একই কায়া
আমি দেহপ্রাণ, তুমি লো ছায়া,
আমি মহাপ্রাণী তুমি লো মায়া,
মনে মনে ভেবে দেখ আপনি।

গানের সঙ্গে হরি একটা করে তাল দিচ্ছে, আর গলা বাড়িয়ে চুমু খাচ্ছে মেয়েটাকে।

ত্রৈলোক্য চমকে উঠল। এই প্রথম হরি মেয়েমানুষ নিয়ে বাড়ি এল। যে গানটা গাইছে সেটা বহু পুরনো গান, গোঁজলা গুঁইয়ের গাওয়া। এইসব কবিগান এখন আর শোনাই যায় না। ত্রৈলোক্য কলকাতা আসার পর পর সেই প্রথম দিকের ভাড়া বাড়ির বাড়িওয়ালির কাছে শিখেছিল এসব।

মেয়েটাকে দেখেই ত্রৈলোক্যর অভিজ্ঞ চোখ বুঝে ফেললো এদিককার কোনো বেশ্যাবাড়ির মেয়ে। লাইনে নতুন নেমেছে, আড়ষ্টতা এখনও কাটেনি পুরোপুরি, কিছুটা লজ্জিত মুখে, কিছুটা জোর করে হেসে সে হরিকে ধরে রেখেছে। হরি যখন চুমু খাচ্ছে, লজ্জায় তার গালটা রাঙা হয়ে উঠছে।

হরির নেশার ঘোরে চোখ বুজে যাচ্ছে, কোন ভণিতা না করেই অনেক কষ্টে চোখ খুলে সে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘পয়সা দে।’

ত্রৈলোক্য বলল, ‘কিসের পয়সা?’

‘কিসের আবার পয়সা বেবুশ্যে মাগি? দিনরাত তো কামাচ্চিস।’ হরি চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘আচ্চা তোর পয়সা তোর কাচে রাক। আমার বাপ তোর কাচে যে পয়সা রেকে গ্যাচে, সেকান থেকেই দে নাহয়!”

ত্রৈলোক্য চমকাল না। ইদানীং হরি তার সঙ্গে এই ভাষাতেই কথা বলে। কিন্তু মেয়েটার সামনে তার কেমন লজ্জা করতে লাগল। নিজের ক্রোধ প্রাণপণ সংবরণ করতে করতে সে বলে ফেললো, ‘তোর বাপ আবার কি রেকে গ্যাচে হরি? সব তো আমারই পয়সা। তোর বাপ কিচ্চু রেকে যাননি।’

‘চোপ!’ হরি এবার আর সহ্য করতে পারল না, মেয়েটাকে ছেড়ে সোজা এগিয়ে এল ত্রৈলোক্যর দিকে, তারপর তার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে এলোপাথাড়ি চর মারতে লাগল, ‘দিবি কি দিবি না বল গতরখাকি বারোভাতারি মাগি! নইলে তোকে আজ কেটেই ফেলব!”

বেশ কিছুক্ষণ পুরুষত্ব দেখানোর পর হরি ক্ষান্ত হয়ে ঘরের সামনেই বসে পড়ল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘কান খাড়া করে শোন। আমি একন আমার রতনমণির সঙ্গে সোহাগ করতে যাচ্চি। ফিরব কাল ভোরে। এসে আমার এক-শো টাকা চাই বলে দিলুম। নাহলে এমন মার মারব, তোর কোনো নাগর এসে বাঁচাতে পারবে না। মনে রেকে দিস কতাটা!’

ত্রৈলোক্য ততক্ষণে মাটিতে পড়ে গেছে। হরি তাকে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে ঘরের মেঝেতে। তার ঠোঁটের একপাশ দিয়ে রক্তের ধারা গড়াচ্ছে।

হরি মেয়েটাকে নিয়ে টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে সে নোনতা রক্ত চাটতে চাটতে উঠে বসলো।

অন্যসময় কিছু হলেই ঝাঁপিয়ে চোখে জল চলে আসে। কিন্তু এখন তার চোখে একফোঁটা জল নেই। পাথর হয়ে বসে রইল সে।

এই দিনটাও তার অদৃষ্টে লেখা ছিল! যে মা-মরা শিশুকে সে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে, নিজে না খেয়ে খাইয়েছে, এত বিপদ-আপদে কোনো কষ্ট কখনো বুঝতে দেয়নি, সে আজ বাইরের লোকের সামনে গায়ে হাত তুলল!

এসবই কি তার পাপের শাস্তি?

হরি এরপর থেকে মাঝেমধ্যেই যে শুধু গায়ে হাত তুলতে লাগল তাই নয়, রীতিমতো অমানুষিক প্রহারে আধমরা করে দিতে লাগল ত্রৈলোক্যকে। সে অত কিছু বোঝেনা, তার টাকা চাই।

মার খেয়ে খেয়ে ত্রৈলোক্যের সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেছে, হরি বুঝেছে এখন আর বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার ভয় দেখালে কিছুই হবেনা, তাই ভুলেও সে ওইকথা উচ্চারণ করেনা। রোজ নিয়ম করে বাড়িতে খেতে আসে, আর টাকা চেয়ে অত্যাচার চালায়।

সেদিন ত্রৈলোক্য বিকেলবেলা সোনাগাজির পথে ঘুরছিল বটে, কিন্তু তার মন পড়েছিল অন্যদিকে।

আগের দিন রাত থেকেই হরি বাড়ি নেই, যাওয়ার আগে ত্রৈলোক্যকে উত্তম মধ্যম প্রহার করে বলে গেছে যদি কাল বাদ পরশু-র মধ্যে পাঁচ-শো টাকা না পায়, তবে ত্রৈলোক্যকে সে খুন করবে।

না, নিজের প্রাণের পরোয়া আর ত্রৈলোক্য করেনা, জীবনের ওপর ঘৃণা জন্মে গেছে তার। কিন্তু কেন জানি না তার মনে হয়, সে এইভাবে হাল ছেড়ে দিলে ওপর থেকে কালীবাবু কিছুতেই তাকে ক্ষমা করবেন না। সে মরে গেলে হরি একেবারেই অধঃপাতে চলে যাবে। তাই যে করেই হোক, এই টাকা তাকে জোগাড় করতেই হবে।

ভাবতে ভাবতে ত্রৈলোক্য আনমনে কুসুমের বাড়ির সিঁড়িতে পা রাখল। মাথাটা বড্ড ভারী হয়ে আছে, শরীরেও মার খেয়ে এত ব্যথা, গা-টা ম্যাজম্যাজ করছে। একটু গল্প করে বাড়ি ফিরবে’খন।

কুসুমের ঘরের সামনে গিয়ে ও ডাকে, ‘কুসুম। অ কুসুম! কোতায় গেলি লো?’

১২

কুসুম ম্লানমুখে দরজা খোলে। অলসভাবে হাই তুলে বলে, ‘এসো দিদি।’

ত্রৈলোক্য লক্ষ করে কুসুমের চোখ ভেজা। সে বলে, ‘তোর আবার কী হল? কাঁদচিস ক্যান?’

‘কিচু হয়নি গো। তুমি বোসো। আমি তোমার জন্য এট্টু মুড়ি বাতাসা নিয়ে আসি।’ কুসুম তড়িৎ গতিতে ঘরের ভেতরে চলে যায়।

ত্রৈলোক্য চুপ করে বসে থাকে। যতই সে নিজের মনকে অন্যদিকে ঘোরাবার জন্য কুসুমের কাছে আসুক, তার মাথায় ঘুরছে হরির কাল রাতের সেই শাসানি, ‘যদি কাল বাদ পরশুর মধ্যে পাঁচ-শো টাকা না পাই, তোকে আমি খুন করব!’

একটা সময় ছিল যখন দুটো হাঁক দিলে পাঁচ-শো টাকা নিয়ে ত্রৈলোক্য রাঁড়ের পাণিপ্রার্থীদের ঢল নেমে যেত বাড়ির সামনে। কিন্তু এখন সেই রামও নেই, রামরাজত্বও নেই, ত্রৈলোক্য ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে।

পরনের কাপড়টায় একটা বড়ো ফুটো হয়ে গেছে, আনমনে সেটা ধরে পাকাতে থাকে।

কুসুম এসে সামনে একটা কাঁসার বাটি রাখে, ‘এই নাও। বাতাসা পেলুম না, নারকেল মেকেছি মুড়ি দিয়ে। চলো দু-জনে খাই।’

‘সে হবে’খন।’ ত্রৈলোক্য বলে, ‘কিন্তু তোর কী হয়েচে বলবি কি? স্পষ্ট দেকতে পাচ্চি মুখ ভার করে রয়েচিস …!’

এবার কুসুম কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। চুপ করে থাকতে গিয়ে ওর চোখ দিয়ে বড়োবড়ো জলের ফোঁটা গড়াতে শুরু করল। তারপর ত্রৈলোক্যর হাত ধরে ও হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল, ‘আমার খুব বিপদ গো ত্রৈলোক্য দিদি। নিজেরই বোকামির জন্য। এখন কি করবো কিচু বুজতে পারচি না কো!’

‘কি হয়েচে? বল আমাকে।’ ত্রৈলোক্য কুসুমের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। নাহ, কারুর জীবনে শান্তি নেই।

কুসুম কিছুটা সামলে নিয়ে বলতে শুরু করল, ‘তুমি তো জানো আমার এক বাঁধা বাবু ছিল, নীলমাধববাবু। তিনিই আমাকে একানে ভাড়া করে রেকেচেন। তা প্রায় চারবচ্ছর হয়ে গ্যাল।’

‘হ্যাঁসে তো আগেরবারই দেকে গেলুম। বেশ গানবাজনা জানে তোর বাবু। আহা, সেই নিধুবাবুর টপ্পাটা কী সুন্দরই না গাইলে!”

ত্রৈলোক্য গানবাজনা চিরকালই ভালোবাসে, তার গানের গলাও অতি মধুর, সেইজন্যই অত তাড়াতাড়ি সোনাগাজিতে তার সুখ্যাতি হয়েছিল।

কুসুমের বাঁধা বাবুর থেকে সেদিনের শোনা গানটা সে নিজেই গেয়ে উঠল,

‘পীরিতি পরম সুখ সেই সে জানে

বিরহে না বহে নীর যাহার নয়নে।’

দু’কলি গেয়ে সে বলল, ‘বড় ভালো গায় তোর বাবু। তা কি হয়েচে তার? শরিল খারাপ?’

কুসুম কিছুক্ষণ তার অধর দাঁত দিয়ে কামড়ে থেকে বলল, ‘আমি খুব বড়ো পাপ করেচি দিদি গো। অমন দেবতার মতো মানুষটাকে আমি লোভে পড়ে তাড়িয়ে দিয়েচি। লাথিও মেরেচি।’

‘সে কি! ক্যান?’ ত্রৈলোক্য অবাক, ‘তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকতে চলল, তোর চোদ্দোপুরুষের ভাগ্যি ভালো যে একটা বাঁধা বাবু পেয়েচিলি, তাড়ালি ক্যান?’

‘বেশি লোভ করতে গিয়ে গো দিদি!’ কুসুম ম্লানমুখে বলল, ‘নতুন একটা ছোঁড়া ক-দিন খুব এসে সোহাগ করচিল, তার কতায় মজে নীলমাধববাবুকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েচিলাম। ভেবেচিলুম ওই বুড়োকে ছেড়ে এই ছোকরার কাচে বাঁধা থাকলে বেশি লাভ। ছোঁড়া তকন কতায় কতায় টাকার ফোয়ারা ছোটাচ্চিল কিনা! কিন্তু এমনই ভাগ্যি আমার দিদি, নীলমাধববাবুকেও তাড়ালাম, আর সেই পোড়ার মুখো ছোঁড়াটাও আর এদিকমুকো হয় না কো। আজ সকালে খপর পেলুম সোনাগাজিতে সে এক কচি রাঁড়কে ধরেচে।’

‘তো নীলমাধববাবুর হাতে পায়ে ধরে আবার নিয়ে আয়।’ ত্রৈলোক্য একগাল নারকেলমুড়ি মুখে পুরে নিদান দিল, ‘ওসব লাথি ঝ্যাঁটা তো এ-লাইনে কতই হয়। ওসবে কিচু খেতি হয় না কো!’

‘না গো দিদি। আমার ওতেই সব্বোনাশ হয়ে গ্যাচে।’ কুসুম ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো, ‘নীলমাধববাবুকে এমনিতেই একান ছেড়ে যাওয়ার জন্য হুজ্জতি করচিল ওর ইয়ারবন্ধুরা। খপর পেলাম উনি গিয়ে রূপচাঁদ পক্ষীর গানের দলে যোগ দিয়েচেন। আমি পায়ে পড়তে গেলাম, ফিরেও তাকালেন না। ওনার নাকি এসব থেকে মন উঠে গ্যাচে। একন থেকে শুধু গানবাজনা নিয়েই থাকবেন। ইদিকে আমি তো এবার না খেতে পেয়ে মরব গো দিদি।’

‘রূপচাঁদ পক্ষী!’ ত্রৈলোক্য চমকে উঠল, ‘উনি একনো গান করেন, না রে?’

‘ক্যান করবেন না?’ কুসুম বলল, ‘কত নাম বল তো? এখন তো তাঁর দল আরও বড় হয়েচে।’

ত্রৈলোক্য রূপচাঁদ পক্ষীর নাম শুনে বহু পুরোনো দিনে পৌঁছে গিয়েছিল।

তখন সে সবে সোনাগাজিতে নাম করতে শুরু করেছে। তার মতো নাচে গানে পটু বারবনিতা সে সময় তেমন কেউ আর নেই।

একদিন তার কাছে এলেন দুই ব্যক্তি। দু-জনকে দেখলেই বোঝা যায় তাঁরা সোনাগাজিতে আসতে অভ্যস্ত নন। ত্রৈলোক্যর দেওয়া মদের গ্লাস তাঁরা ছুঁয়েও দেখলেন না। কোনোরকম স্থূল রসিকতায় যোগ না দিয়ে তীক্ষ্ন চোখে ত্রৈলোক্যর দিকে চেয়ে একজন বললেন, ‘টপ্পা গাইতে পারো?’

‘পারি।’ যুবতী ত্রৈলোক্য মনে মনে বিস্মিত হলেও খুশিই হয়েছিল।

সস্তা কোমরনাচানো রঙ্গ দেখার লোকই আসে বেশি, টপ্পা শোনার বাবু আসে আর ক-টা? ততদিনে সে নিজের চেষ্টায় সেই ভাড়াবাড়ির অনেকের থেকে অনেক রকমের গান আয়ত্ব করে ফেলেছে। গানে সে আনন্দ পায়, ভালো লাগে তার গাইতে। গাইলে তার দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে যায়, অন্তত কিছুক্ষণের জন্য।

সময় নষ্ট না করে তখন সে গান ধরেছিল,

ধীরে ধীরে যায় দেখ চায় ফিরে ফিরে

কেমনে আমারে বলো যাইতে ঘরে …।

দু-জন বাবুই মন দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুনেছিলেন, তারপর অকস্মাৎ উঠে দাঁড়িয়ে একতাড়া নোট সামনে ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের এক বন্ধু রূপচাঁদ পক্ষী, চেনো নিশ্চয়ই। সে নতুন একটা গানের দল খুলচে। এমনি গান নয়, ঢপ আর কবিগান। সেখেনে সে মেয়েমানুষ গাইয়ে চায়। এই পেত্থম কলকেতায় গানের দল হবে যেখানে মেয়েরা গাইবে। তুমি যাবে?’

‘রূপচাঁদ?’ বিহ্বল ত্রৈলোক্য চিনতে না পেরে তাকিয়েছিল হাঁ করে।

‘আহা! রূপচাঁদ পক্ষীর নাম শোনোনি?’ প্রথম বাবু বোঝাচ্ছিলেন, ‘নাম না শোনো, তার গান তো শুনেছ নিশ্চয়ই।’

ত্রৈলোক্য তখনও মাথা নেড়েছিল দু-পাশে।’

‘সে কী গো। তোমাদের নিয়ে রূপচাঁদের কত বিখ্যাত গান আছে, আর তুমি শোনোইনি?’ দ্বিতীয়বাবু কথা শেষ করেই গেয়ে উঠেছিলেন,

কলকাতাতে তয়ফাওয়ালি, খেমটাআলি, ঢপআলি, মেয়ে পাঁচালি

যাত্রাআলি, গলি গলি তর বেতর —

খেয়ালি, টপ্পাআলি, মদমাতালি ঘর ঘর।’

‘এই গান শুনিনি বাবু!’ গান শেষ হতে-না-হতেই ত্রৈলোক্য হাত নেড়ে বলেছিল। যদিও গানটার সুরটা বেশ।

‘কি মুশকিল! বেবুশ্যে মেয়েমানুষ, রূপচাঁদকে নাকি চেনে না।’ প্রথম বাবু এবার বিরক্তমুখে তাকিয়েছিলেন, ‘আরে সেই যে পাখির মতো সেজে থাকে একটা লোক, তার গানের দলের লোকেরাও একেকটা পাখি সাজে। ঠোঁট লাগায়, পাখনা লাগায়। পাখি সাজেই সবাই রাস্তা দিয়ে গাইতে গাইতে যায় গো!’

‘হ্যাঁহ্যাঁ।’ ত্রৈলোক্য এবার সোৎসাহে লাফিয়ে উঠেছিল প্রায়, ‘বাগবাজারের একটা গলিতে মাসকয়েক আগে একদিন দেকেচিলুম … গাইতে গাইতে যাচ্চিল দলটা। কী ঠাকুর কোম্পানির গান না কি যেন …’

‘বাহ, তুমি তো জানো দেখচি।’ দ্বিতীয় বাবু এবার সপ্রশংস চোখে তাকিয়েছিলেন, ‘ঠিকই বলেচ। ওটা রূপচাঁদের আর এক বিখ্যাত গান। জোড়াসাঁকো-র দ্বারকানাথ ঠাকুর মদের ব্যবসা খুলেচিলেন না? কার টেগোর অ্যান্ড কোম্পানির নামে? সেই মদ খেতে ভালো হলে বিদেশে যেত, নাহলে দেশেই বিক্রি হত। তারপর কলকেতার রাস্তাঘাটে এমন লোকজন মদ খেয়ে গড়াগড়ি যেতে লাগল যে, সবাই দ্বারকানাথ ঠাকুরকেই এইজন্য দুষতে লাগল। রূপচাঁদ তখন গান বাঁধল,

কি মজা আছে রে লাল জলে

জানেন ঠাকুর কোম্পানি,

মদের গুণাগুণ আমরা কি জানি

জানেন ঠাকুর কোম্পানি।

গানটা শেষ করে তিনি হাসিতে ফেটে পড়েছিলেন, ‘সেই গান নিয়ে দ্বারকানাথ ঠাকুরের আবার কি রাগ বাপরে বাপ! ইংরেজিতে বত্তৃ«তাও দিয়েছিলেন গোপীমোহনের বাগানবাড়িতে। যাইহোক, তুমি যাবে তো গাইতে?’

কুসুম হঠাৎ ত্রৈলোক্যকে ধরে ঝাঁকায়, ‘কীগো দিদি, তকন থেকে আমি বকে চলেচি, তুমি তো শুনচই না কিচু!’

ত্রৈলোক্য সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বর্তমানে ফিরে আসে।

সেদিনের সেই প্রস্তাবে ত্রৈলোক্য রাজি হতে পারেনি। পারেনি নিজের জমাটি ব্যবসা ছেড়ে রূপচাঁদ পক্ষীর দলে যোগ দিতে। আসলে ওদের মতো রূপোপজীবিনী মেয়েদের সংযমের মাত্রা এতই লঘু ও অপরিমিত হয়ে গিয়েছিল যে এই চটুল, দেহসর্বস্ব জীবন থেকে পালাতে পারেনি।

ত্রৈলোক্য একটা বড়ো নিশ্বাস ফেলে। পারলে আজ হয়ত জীবনটা অন্যরকম হত। অন্তত পাঁচ-শো টাকার জন্য খুন হওয়ার ভয় পেতে হত না। জীবনে এত পাপের ভাগীদারও হতে হত না।

‘ও ত্রৈলোক্য দিদি!’ কুসুম এবার রেগে যায়, ‘আমি কি করবো বলো না। টাকাপয়সা হাতে কিচুই নেই, বাড়িওয়ালি দিনরাত শাসিয়ে যাচ্চে। খাওয়ার টাকাই নেই, কোনো খদ্দেরও পাচ্চিনে।’ তারপর গলা নামিয়ে বলল, ”থাকার মদ্যে আচে কেবল নীলমাধব বাবুর দেওয়া বেশ কিচু গয়না, সেগুলোও এবার মনে হচ্চে একটা একটা করে বাঁধা দিতে হবে।”

‘তবে কি করবি?’ ত্রৈলোক্য বর্তমানে ফিরে এসেই নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে কেমন যেন অন্য মানুষে পরিণত হতে শুরু করেছিল।

রূপচাঁদ পক্ষীর স্মৃতিচারণ ছেড়ে তার মাথায় খালি বাজছিল একটাই কথা, ‘কাল বাদ পরশুর মধ্যে যদি পাঁচ-শো টাকা না পাই, তোকে আমি খুন করবো।’

‘তুমি বলো না দিদি!’ কুসুম বলল, ‘কি করে নীলমাধববাবুর মন পাব। ওই পক্ষীর দল থেকে ওনাকে না ফিরিয়ে আনলে আমি যে মারা পড়ব না খেতে পেয়ে দিদি।’

ত্রৈলোক্য তীক্ষ্নচোখে কুসুমকে দেখছিল। তার চোখের দৃষ্টি হঠাৎ যেন কেমন বদলে গেল।

 ‘কীগো।’ কুসুম এবার ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘তুমি কি শুনচ না তকন থেকে আমি মাতা কুটে কি বকে চলেচি?’

ত্রৈলোক্য নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘তুই যে কী বোকামি করেচিস কুসুম!’

‘ক্যান?’

‘এ-কতা যদি একবার আগে আমাকে বলতিস, না তোর পুরোনো বাবু ফিরে যেত, না তোর নতুন বাবু ওই কচি রাঁড়টাকে ধরত। উলটে তোর গয়নাগাটি যা আচে, টাকাপয়সা যা কিচু, সব দু-গুণ হয়ে যেত।’

‘মানে?’ নিরক্ষর কুসুম ফ্যালফ্যাল করে তাকায়, ‘কি বলচ আমি কিচুই বুজচি নে ত্রৈলোক্য দিদি!’

‘আমি বুজিয়ে বলচি।’ ত্রৈলোক্য একটুও গলা না কাঁপিয়ে বলে চলল, ‘আমার এক গুরুদেব আচেন। তিনি সবার মনস্কামনা যে শুধু পূরণ করেন তাই নয়, গয়নাগাটি টাকাপয়সা সব মন্তর বলে দু-গুণ করে দিতে পারেন। তুই যদি আগে বলতিস, কবেই আমি তোকে ওঁর কাচে নিয়ে চলে যেতুম!’

‘সত্যি বলচ দিদি!’ কুসুম কম্পিত হাতে ত্রৈলোক্যর হাতদুটো জড়িয়ে ধরে।

‘তবে আর বলচি কি!’ ত্রৈলোক্য বলে যায়, ‘এই তো, গেল বছর দু-জনকে নিয়ে গেছলুম, গুরুদেব তো সবসময় একানে থাকেন না, হিমালয়েই থাকেন। তো তকন এসেচিলেন। এমন মন্তর পড়ে দিলেন, তাদের আজ গাড়ি-বাড়ি রমরমা অবস্থা!’

‘একন?’ কুসুম উদগ্রীব হয়ে উঠল, ‘একন আচেন উনি? নিয়ে যাবে গো আমায়?’

ত্রৈলোক্য মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ, একন ক-দিন এসেচেন বটে, কিন্তু ওইভাবে যকন-তকন উনি কারুর সাথে দেকা করেন না। মন্ত্রসিদ্ধ পুরুষ তো, অনেক নিয়মকানুন আচে।’

‘তোমার দুটি পায়ে পড়ি দিদি, আমাকে একবার নিয়ে চলো ওনার কাচে।’ কুসুম এবার সটান ত্রৈলোক্যর পা-দুটো জড়িয়ে ধরে, ‘নইলে আমি শেষ হয়ে যাব গো!’

‘আচ্চা আচ্চা, পা ছাড়।’ ত্রৈলোক্য যেন নিমরাজি হচ্ছে এইভাবে বলে, ‘উনি একন অবস্তান করচেন নির্জন একটা বাগানে। সেকানে যেতে হবে তোর সব গয়নাগাটি নিয়ে। উনি প্রথম সাক্কাতেই হাত তুলে আশীর্বাদ করেন, সঙ্গের সব অলংকার দ্বিগুণ হোক বলে। তকনই দেকবি তোর গয়নাগুলো দুগুণ হয়ে গ্যাচে।’ কথাটা বলেই কি ভাবতে ভাবতে সে বলে, ‘কাল ভোর চারটের সময় মানিকতলা পুলে আসতে পারবি? সাবধান। একা আসতে হবে কিন্তু। বাবা সব বুজতে পারেন, কোন অনিয়ম হলে এমন কোপ দেবেন…।’

‘নানা, একাই যাব।’ কুসুমের আনন্দে গলা কাঁপছিল, ‘বেশ আমি ওকানে থাকব।’ ত্রৈলোক্য উঠে পড়ে বাড়ি ফেরার উদ্যোগ করে।

কুসুমের মুখটা আগত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে ঝলমল করতে থাকে। সে ভালো করে ত্রৈলোক্যর দিকে তাকায় না।

তাকালে হয়তো দেখতে পেত, মধ্যবয়সি ত্রৈলোক্য রাঁড়ের মুখটা কেমন বদলে গিয়েছে।

সেখানে খেলা করছে অদ্ভুত এক ক্রুরতা।

১৩

সূর্যদেব তখনও ভালো করে পূর্ব দিকে উদিত হননি, তাঁর আভায় সবে পরিষ্কার হচ্ছে চারপাশ।

ত্রৈলোক্য হনহন করে মানিকতলা পুলের দিকে হেঁটে আসছিল। অনেক ভোরে সে বেরিয়েছে, তখন রীতিমতো অন্ধকার ছিল। পুলের ওপর কিছুটা উঠেই সে কুসুমকে দেখতে পেল। একটা ভালো শাড়ি পরে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, হাতে একটা পুঁটুলি।

ত্রৈলোক্য কাছে গিয়ে ওকে ভালো করে নিরীক্ষণ করে বলল, ‘একী! গয়নাগাটি কিচু পরে আসিসনি ক্যান? তোকে যে বললাম …!’

‘সব সাথে করে নিয়ে এসেচি গো।’ কুসুম সতর্কভাবে সঙ্গের পুটুলির দিকে ইশারা করল, ‘ভোররাতে এতদূর একা একা আসব তো, তাই পরে আসতে সাহস পেলুম না। পেটের মধ্যে করে নিয়ে এসেচি।’

‘বেশ করেচিস। একন চল। রোদ উঠে গেলে গুরুদেব আর দেকা করেন না।’ ত্রৈলোক্য হাঁটতে উদ্যত হল।

হাঁটতে হাঁটতে দু-জনে অনেক গল্প করতে লাগল। কুসুম মেয়েটা এমনিতেই সরল, তার ফেলে আসা জীবন, কতরকম বাবুর সংসর্গ, বার বার ভাড়ার বাড়িবদল এইসব বকতে বকতে সে এগিয়ে চলল।

‘আমাদের মতো মেয়েদের আর শান্তি নেই গো দিদি। যৌবন থাকলে একরকম, যৌবন চলে গেলে আরেকরকম।’ কথাটা ভারাক্রান্ত স্বরে বলে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেললো কুসুম, তারপর সামান্য চমকে উঠে বলল, ‘ত্রৈলোক্য দিদি, আমরা কোতায় যাচ্চি বলো তো? এ তো জঙ্গলে চলে এলুম গো কতা কইতে কইতে।’

বাস্তবিকই তাই। শহরের পাকা রাস্তা পেরিয়ে, কাঁচা গলি ধরে এই প্রায় দু-ঘণ্টা ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওরা এখন যেখান দিয়ে যাচ্ছে, সেটা ঘন জঙ্গল। চারপাশ অন্ধকার হয়ে রয়েছে। কেমন একটা বন্য গন্ধ যেন নাকে এসে ঝাপটা মারছে বারবার।

ত্রৈলোক্য সতর্কচোখে বারবার চারপাশ দেখছিল। প্রায় দু-বছর পর আসছে এদিকে, তবু রাস্তা ভুল হওয়ার কথা নয়।

ওই তো, ওই তো আগাছায় ঢেকে যাওয়া সেই বিশাল গেট! এখান দিয়েই ওর এক খদ্দের নিয়ে এসেছিল মনিবের বাগানবাড়িতে ফুর্তি করবে বলে। বহুবছর এই বাড়িতে কেউ থাকে না, পোড়ো ভূতুড়ে বাড়ি বলে বদনামও আছে। ওঁর সেই খদ্দের ছিল এক মস্ত বাবুর কোচোয়ান। সে-ই সবার অলক্ষ্যে ত্রৈলোক্যকে এখানে নিয়ে এসেছিল।

ত্রৈলোক্য চাপা গলায় বলল, ‘এসে গেচি। ওই যে দেকচিস গেট, ওকান দিয়েই ঢুকব আমরা। আয় ইদিকে!’

কুসুম ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসে।

গেট অবশ্য নামেই। অন্তত পঞ্চাশ ষাট বছর এদিকে কারুর পা পড়েনি বোঝা যায়। এককালের বিশাল লোহার গেটটা এখন মোটা মোটা অশ্বত্থ গাছের ঝুড়িতে ঢেকে গেছে, অনেক খুঁজে পেতে সেটা খুলল ত্রৈলোক্য, ‘ভেতরে আয়।’

ভেতরে ঢুকে কুসুম চমকে উঠল।

একটা অতিকায় অট্টালিকা গোটা আকাশকে ঢেকে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মহাকালের মতো।

বাড়িটা এতটাই প্রাচীন আর বিশাল, যে তাকালে ভয়ে কেমন দমবন্ধ হয়ে আসে। দেখলেই মনে হয়, গত কয়েক দশকে কোনো জ্যান্ত মানুষ এখানে বসবাস করেনি।

বাড়িটা এককালে দুধসাদা ছিল, এখন শ্বেতপাথরের ওপর কেমন খয়েরি আস্তরণ পড়ে গেছে, জায়গায় জায়গায় মাথা তুলেছে বট অশ্বত্থের ঝুড়ি। ছাদের ওপর দু-দিক থেকে দুটো কেশর ফোলানো সিংহের মূর্তি এখনো অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। বাড়িটার দরজা জানলা সব বন্ধ। সামনে বিশাল বাগান ছিল এককালে, অপরিচর্যায় তা এখন পরিণত হয়েছে দুর্ভেদ্য অরণ্যে। অন্যপাশের পুকুরটাও কেমন থমথম করছে।

কুসুম ঢোঁক গিলে ত্রৈলোক্যর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে, ‘একানে তোমার গুরুদেব থাকেন কি করে ত্রৈলোক্যদিদি। আ-আমার তো খুউব ভয় করচে!’

‘অত ভয় করলে তবে ফিরে চ’।’ ত্রৈলোক্য সহসা কেমন ক্ষুব্ধ স্বরে বলে ওঠে, ‘দরকারটা তো আমার নয়, তোর। তুই যদি ভয়েই মরে যাস, তবে আর গিয়ে কাজ নেই কো!’

‘না না চল চল।’ কুসুম কাপড়ের আঁচলটা বুকে ভালো করে জড়িয়ে তড়িঘড়ি বলে ওঠে, ‘বাড়িতে ঢুকবে তো?’

‘দাঁড়া।’ ত্রৈলোক্য খনখনে গলায় বলল, ‘চল বললেই তো হল না। এনারা সব হিমালয়ের সাধু। যেমন তেমন করে যাওয়া যায় না। আগে ওই পুকুরে ডুব দিয়ে শুদ্ধ হতে হবে, তারপর ভিজে বসনে গুরুদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে।’

বলতে বলতে ত্রৈলোক্য এগিয়ে যায় ভগ্ন পরিত্যক্ত পুকুরপাড়ে, ‘ইদিকে আয়। এই বাঁধানো জায়গাটায় তোর সব গয়নাগাটি কাপড়চোপড় রাখ, রেকে একটা ডুব দিয়ে আয় মন প্রাণ শুদ্ধ করে।’

কুসুম আড়ষ্টভাবে সব খুলে পাড়ে রাখে, তারপর এক পা এক পা করে নামতে থাকে পুকুরে। হাঁটু অবধি নেমে বলে, ‘তুমি নামবে না ত্রৈলোক্যদিদি?’

‘আ মরণ!’ ত্রৈলোক্য মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে, ‘আমি কি কিচু চাইতে এয়েচি নাকি? তোর দরকার তুই ডুব দে দিকি!’

অগত্যা কুসুম আরো কিছুটা নেমে ডুব দেয়।

ত্রৈলোক্য আড়চোখে চারপাশে তাকায়। বেলা হয়েছে ভালোই, কিন্তু এখানে এসে মনে হচ্ছে বিশ্বচরাচরে কেউ নেই। শুধু দূর থেকে একটা অজানা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে।

ত্রৈলোক্যর আবার হরির সেই ক্রুর মুখটা মনে পড়ে যায়, ‘পাঁচ-শো টাকা না পেলে তোকে খুন করব!’

সতর্ক শিকারি বিড়ালের মতো সে পায়ে পায়ে এগোতে থাকে কুসুমের কাছে।

কোমর পর্যন্ত নেমে একেবারে কাছে গিয়ে বলে, ‘ইশ, তোর পিঠে কি ময়লা রে কুসুম! আয় ডলে দিই।’

‘একা একা হাত পাই নে গো ত্রৈলোক্যদিদি।’ কুসুম আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ততক্ষণে সে একটু বাতাসের জন্য আঁকুপাঁকু করতে শুরু করেছে, তার চোখ জলের মধ্যেই ঠেলে বেরিয়ে আসছে বাইরে, ‘আহ! আহ!’

ত্রৈলোক্যর একটুও চোখের পাতা কাঁপল না, ততক্ষণে কুসুমের কাঁধ ধরে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে সে ডুবিয়ে ফেলেছে পুকুরের জলের মধ্যে, যতই কুসুম ছটফট করুক, সাক্ষাৎ যমদূতের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ত্রৈলোক্য, যতক্ষণ না কুসুমের শরীর একেবারে নিঃসাড় হয়ে যায়।

কিছুক্ষণ পর কুসুমের সমস্ত গয়না কোচড়ে সাবধানে নিয়ে বিড়ালপায়ে ত্রৈলোক্যকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল সেই পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে।

ভেতরের সেই মজে যাওয়া পুকুরের জলে কুসুমের মৃতদেহটা তখন একটা জড়পদার্থের মতোই পড়েছিল আর শেওলার মধ্যে তিরতির করে কাঁপছিল।

১৪

মানুষ যখন প্রথম কোনো পাপ করে, তখন একটা দ্বিধা কাজ করে।

সেই দ্বিধা কেটে গেলে সে একজন দাগি অপরাধীর মতোই পাপবোধ আর অনুশোচনা নামক বস্তুদুটিকে বাতিলের ঝুড়িতে ফেলে দেয়। দিনের পর দিন সে পাপে যত দড় হতে থাকে, তার অনুতাপবোধও ততই অদৃশ্য হতে থাকে।

ত্রৈলোক্যরও সেটাই হয়েছিল। কালীবাবু মারা যাওয়ার পর ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে যে ত্রৈলোক্য গিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল আর কখনো কোনো পাপ না করার, সেই ত্রৈলোক্যই এবার কিছুটা হরির প্রতি ভালোবাসায়, তাকে হারানোর ভয়ে, আর কিছুটা মারের ভয়ে একেবারে মরিয়া হয়ে উঠল।

শুঁড়ির সাক্ষী মাতালের মতো এবার তার সঙ্গিনী হল খুঙ্গী নামক এক অতি হীন চরিত্রের মহিলা। সে এসেছিল ত্রৈলোক্যর বাড়িতে পরিচারিকার কাজে, কিন্তু দিনে দিনে সে-ই তার প্রধান সাকরেদ হয়ে উঠল।

কুসুম মারা যাওয়ার পর চার-পাঁচদিন কিছুই হল না, তারপর কুসুমের ভাড়াবাড়ির অন্য ভাড়াটেরা কৌতূহলী হয়ে উঠল। ত্রৈলোক্যও কুসুমের খোঁজ করার ভান করে উদবিগ্ন মুখে দু-তিনবার ঘুরে এল সে-বাড়ি থেকে। কুসুমের বাড়িওয়ালী বিষণ্ণমুখে তার অনেক মাসের ভাড়া বাকি রয়ে যাওয়ার দুঃখ করছিল, তাকে সান্ত্বনাও দিয়ে এল।

তারপর সবাই ধীরে ধীরে ভুলে গেল কুসুমকে।

ওদিকে প্রায় দিন দশ-বারো পর খবরের কাগজে মানিকতলা থেকে বেশ কিছু দূরে অরণ্যের মাঝে একটি পরিত্যক্ত জমিদারবাড়ি থেকে এক স্ত্রীলোকের গলিত লাশ উদ্ধার হল। তীব্র দুর্গন্ধে কোনো পথচারী কৌতূহলী হয়ে দেখতে গিয়ে মৃতদেহটি আবিষ্কার করেছিল। সবাই অনুমান করল সাংসারিক কোনো দুঃখে স্ত্রীলোকটি আত্মঘাতী হয়েছে।

এরপর হরির চাহিদা যেমন উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল, তেমন ত্রৈলোক্যর সাহসও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগল। খুঙ্গী কুসুমের মতো নির্বোধ স্ত্রীলোকদের গয়না দ্বিগুণ হওয়ার লোভ দেখিয়ে ডেকে নিয়ে আসে।

ত্রৈলোক্য তাকে বোকা বানিয়ে সেই বাগানবাড়িতে নিয়ে গিয়ে ডুবিয়ে মেরে সব গয়না আত্মসাৎ করে। তারপর চুপিচুপি বাড়ি আসে।

এইভাবে পরবর্তী তিন বছরে আরও পাঁচজন হতভাগ্য মহিলার ভবলীলা সাঙ্গ হল। ত্রৈলোক্যরও আর্থিক অবস্থা আবার অনুকূলে এল। হরির চাহিদা পূরণ করার পরেও সে বহুকাল পর আবার বেশ সচ্ছলভাবে জীবন কাটাতে শুরু করল।

আর যতই তার সচ্ছলতা বাড়তে থাকল, ভেতরের গ্লানিবোধও কমতে লাগল।

ওদিকে একই বাগানবাড়ি থেকে পরপর এতগুলো মহিলার লাশ একইভাবে পাওয়া যেতে পুলিশ এবার নড়েচড়ে বসল। প্রত্যেকটা লাশেই ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা গেল, জলে ডুবে শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু।

কালীবাবুর মতোই ত্রৈলোক্যর ক্ষেত্রেও বিধাতার ধৈর্যের সীমা এবার অতিক্রম করতে চলেছিল।

আঙুরবালা নামক এক মধ্যবয়সী দেহপসারিনিকে ত্রৈলোক্য এবার টোপ দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেই বাগানবাড়িতে।

আঙুরবালা ছিল তার ছয় নম্বর শিকার।

শুদ্ধ হওয়ার জন্য স্নানে নামিয়ে পেছন থেকে যখন ত্রৈলোক্য নির্মম হাতে সবেমাত্র তাকে ঠেসে ধরেছে জলের মধ্যে, ঠিক সেইসময় দুজন কৌতূহলী লোক সেই সাংঘাতিক দৃশ্য দেখতে পেয়ে গেল।

লোকমুখে পরপর এত মৃত্যুর কথা শুনে অকুস্থল দেখতেই বোধ হয় তাঁরা এই বাড়ির বাগানের মধ্যে ঘুরতে এসেছিল।

ত্রৈলোক্যর এই ভয়ংকর পাশবিক কাজ দেখে তারা প্রথমে হতবুদ্ধি হয়ে গেল, তারপর ছুটে এসে ধরল তাকে। ত্রৈলোক্য নিজের সাবধানতা অবলম্বন করতে খুঙ্গীকেও নিয়ে আসত না এই জায়গাটা চেনানোর ভয়ে, তাই সে একাই অমানুষিক শক্তিতে প্রতিরোধ করতে লাগল।

ত্রৈলোক্যর হাতের সাঁড়াশিচাপে আরেকটু হলেই আঙুরবালার ভবলীলা সাঙ্গ হচ্ছিল, সে কোনোমতে হাঁপাতে হাঁপাতে পাড়ে গিয়ে চেতনা হারাল।

ত্রৈলোক্য যতই হাত ছাড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করুক, এবার আর শেষরক্ষা হল না। লোকদুটো তাকে ধরাশায়ী তো করলই, হাঁক ডাক করে বাড়ির বাইরে থেকে জড়ো করল আরো দু-চারজনকে।

কিছুজন আঙুরবালার জ্ঞান ফেরাতে উদ্যোগী হল, বাকিরা সবাই মিলে ত্রৈলোক্যকে টানতে টানতে নিয়ে চলল থানায়।

ত্রৈলোক্য প্রথমে খাঁচায় বন্দি হওয়া সিংহের মতো উন্মত্ত হিংস্র আচরণ করছিল, তার বীভৎস চিৎকারে খানখান হয়ে যাচ্ছিল গোটা এলাকা, ‘ভালো হবেনা বলচি। ছাড় আমাকে, ছাড়! আমাকে তো চিনিসনে, আমি হলেম ত্রৈলোক্য রাঁড়, তোদের সক্কলকে একাই কেটে ফেলব আমি। এখনও বলচি, ভালো চাস তো ছেড়ে দে আমায়!’

কিন্তু তারপর যখন সে বুঝল অনর্থক চেঁচিয়ে কোনো লাভ নেই, বরং এতে আরও লোক জড়ো হয়ে তাকে দেখতে পাচ্ছে, সে চুপ করে দাঁতে দাঁত চিপে রইল।

থানায় সেইসময় বড়োবাবু ছিলেন না। শুধুমাত্র একজন বৃদ্ধ কনস্টেবল বসে ছিলেন।

ভদ্রলোকের নাম বিপুল বিহারী দাস, অবসরের বয়স পার হয়ে গেছে বছর দুই আগেই, কিন্তু বয়স কমানো থাকায় তখনো ছড়ি ঘুরিয়ে চলেছেন।

বিপুলবিহারী দাস মহিলাদের সম্পর্কে উদাসীন ছিল এমন অপবাদ তাকে কেউ দিতে পারবে না। বরং এই বয়সেও ইন্দ্রিয়সুখ চরিতার্থে আসক্তি ছিল বেশ চোখে পড়ার মতো। বাড়িতে ভরভরন্ত সংসার থাকলেও তার বাইরের মহিলাদের প্রতি দুর্বলতা ছিল বহু প্রাচীন।

বহুকাল আগে কোনো একসময় সোনাগাজিতে তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ত্রৈলোক্য এখন অনেক পৃথুলা হয়ে গিয়েছে, তার মুখের সেই লাবণ্য, কমনীয়তা অবশিষ্ট তো নেই-ই, বরং গত কয়েক বছরের পাপে তার মুখটি কুটিল আকার ধারণ করেছে।

তবু বিপুলবিহারীর সোনাগাজির একসময়ের প্রসিদ্ধ রূপোপজীবিনী ত্রৈলোক্য রাঁড়কে চিনতে ভুল হল না।

ত্রৈলোক্য রাঁড়ের কাছে একসময় সে গিয়েছিল, সেই রাতের সুখস্মৃতি মনে করে সে মনে মনে কেমন স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ল।

ত্রৈলোক্যকে যারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে সবাইই প্রায় অশিক্ষিত নিম্নবিত্ত মানুষ। তাদের মধ্যে নেতাস্থানীয় একজন বিপুলবিহারীকেই দারোগা ঠাউরে বলল, ‘দারোগাবাবু, এ সেই সিঙ্গিদের বাগানবাড়িতে একটা মেয়েমানুষকে ডুবিয়ে মারচিল। আমরা দেকতে পেয়েই ধরে নিয়ে এলাম।’

‘বটে?’ বিপুলবিহারী চশমার ফাঁক দিয়ে একবার ভালো করে ত্রৈলোক্যকে নিরীক্ষণ করল। নাহ, যৌবন বিদায় নিলেও ত্রৈলোক্যতারিণীর শরীরের গঠন এখনও বেশ আঁটসাঁট, অন্তত তার মতো বিগতযৌবন পুরুষের বুকে হিল্লোল তুলতে ভালোই সক্ষম।

বিপুলবিহারী একখানা খড়কে কাঠি দিয়ে কান খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, ‘কি হয়েচিল বল দিকিনি! কে কাকে চুবোচ্চিল?’

আরেকজন লোক এবার এগিয়ে এসে বলল, ‘ওই যে, যে বাড়িতে একটা একটা করে লাশ পাওয়া যাচ্চিল, সেখেনেই এ আরেকজনকে চুবোচ্চিল। পরপর এ-ই সব ক-টাকে মেরেচে দারোগাবাবু।’

‘বটে?’ বিপুলবিহারীর চোখ কান খোঁচানোর আরামে বন্ধ হয়ে আসছিল, অতিকষ্টে খুলে খিঁচিয়ে উঠল, ‘বাকিগুলোর সময় কি তুই ওকানে ঘাপটি মেরে বসেচিলি নাকি হতভাগা যে বলচিস এ-ই সবাইকে মেরেচে? পুলিশের সঙ্গে ধ্যাস্টামো হচ্চে? দেব সবকটাকে ভেতরে ঢুকিয়ে।’

গরীব মানুষ সব, পুলিশের লোকের এমন উলটো সুরে সবাই হকচকিয়ে গিয়ে এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগল। পরপর খুন হওয়ায় এমনিতেই তাদের ওই এলাকায় উত্তেজনা ছড়াচ্ছিল, আজ ধরতে পেরে তারা উত্তেজনার বশে সবাই হল্লা করতে করতে নিয়ে এসেছে অপরাধীকে। পুলিশ কোথায় তাকে ধরবে তা না, এ যে উলট পুরাণ!

কেউ আর কিছু বলতে সাহস পেলে না। একেই পুলিশে ছুঁলে আঠেরো ঘা, বেশি কথা বলে লাভ কি?

বিপুলবিহারী কোনো পাত্তাই দিল না। বরং ত্রৈলোক্য এখন কোথায় থাকে তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিয়ে কান খোঁচাতে খোঁচাতে মিহিগলায় বলল, ‘ঠিক আচে। আপনি বাড়ি যান। কোনো দরকার হলে আমরা যোগাযোগ করবো।’

তারপর লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠল, ‘অ্যাই, তোরাও বেরো শিগগির!’

লোকগুলো হতভম্ব হয়ে থানা থেকে বেরিয়ে এল।

সাক্ষাৎ বিপদের মুখ থেকে এইভাবে মুক্তি পেয়ে ত্রৈলোক্যের উল্লাসের সীমা-পরিসীমা রইল না। উৎফুল্ল হৃদয়ে সে বাড়ি ফিরে এল।

খুঙ্গী জিজ্ঞেস করল, ‘অ্যাত দেরি হল কেন গা? আমি তো চিন্তা করচিলুম!’

 ত্রৈলোক্য উত্তর না দিয়ে বলল, ‘কয়েকদিনের মধ্যে বাড়িতে একটা চিমসে বুড়ো আসবে, আমি যদি নাও থাকি, তাকে খাতির করে বসাবি যেন। তারপর আমি এসে যা করার করবো।’

কিন্তু ত্রৈলোক্য যতই বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া নিয়ে আনন্দ করুক, বিষয়টা তার অগোচরেই এগোতে লাগল।

আঙুরবালাকে সেদিন ওখানকার লোকেরা বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। সে সুস্থ হয়ে উঠেই আত্মীয়স্বজনকে ত্রৈলোক্যর কাণ্ডকারখানা সম্পর্কে সব খুলে বলল, গেল স্থানীয় থানায়।

ভাগ্যের অমোঘ ঘূর্ণিপাকে এই অপরাধের তদন্তের ভার পড়ল সেই দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের কাঁধে।

প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় সেই কালীবাবুর ফাঁসির সময় থেকেই ত্রৈলোক্যর অপরাধমনস্কতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ ছিলেন। এবারেও তিনি সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন রহস্য উদ্ঘাটনে। মানিকতলার সেই বাগানবাড়িতে তদন্তে যেতেই তিনি সেদিনের থানায় যাওয়া লোকগুলোর খোঁজ পেলেন এবং সব তথ্য সংগ্রহ করে আঙ্গুরবালা দাসীকে হত্যার চেষ্টার অপরাধে ত্রৈলোক্যতারিণীকে গ্রেপ্তার করলেন।

ত্রৈলোক্যকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হল।

সঙ্গে ডাক পড়ল সেই বিপুলবিহারীরও। সেদিন থানায় অভিযোগ লেখার বদলে কেন সে ত্রৈলোক্যকে ছেড়ে দিয়েছিল, তাই নিয়ে প্রশ্ন উঠতে লাগল বারবার।

ইতিমধ্যে বিপুলবিহারী যে বেশ কয়েকবার ত্রৈলোক্যর গৃহে পদার্পণ করেছে, সেই খবরও পুলিশের কাছে চাপা রইল না। তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হল, ও ত্রৈলোক্যর সঙ্গেই তারও বিচার চলতে লাগল।

কিন্তু এতে যার যাই হোক, ত্রৈলোক্যর লাভই হল।

নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য তাকে পয়সা খরচ করে মোকদ্দমায় আত্মপক্ষ সমর্থনের উকিল দায়ের করতে হল না। বিপুলবিহারী নিজের স্বার্থে জলের মতো পয়সা খরচ করে উকিলের খরচ চালাতে লাগল।

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব শীঘ্রই সব প্রমাণ গ্রহণ করে কেসটি পাঠালেন দায়রা আদালতে। সেখানে চলতে লাগল দিনের পর দিন শুনানি।

তারপর সেখান থেকে মামলা গেল আলিপুর সেশান কোর্টে।

বিপুলবিহারী উকিলের খিদেতে প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে পড়তে লাগল। ওদিকে ত্রৈলোক্য যাতে কোনোভাবেই মুক্তি না পায়, সেইজন্য প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় একেবারে অটল অবস্থান নিলেন।

কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, বা দৈবের বিধানই হোক, ব্রিটিশ আইনের প্রচুর ফাঁকের একটির মধ্য দিয়ে বিপুলবিহারীর দুঁদে উকিল তাদের দু-জনকে মুক্ত করে আনলেন। টাকা খাইয়ে সেদিনের সেই লোকগুলোকে সাক্ষ্য দিতে অসম্মত করানো হল।

ফলে না ত্রৈলোক্য, না বিপুলবিহারী কারুর বিরুদ্ধেই কিছু প্রমাণ করা গেল না। আঙুরবালার একার অভিযোগ আদালতে গ্রাহ্য হল না।

প্রিয়নাথ দারোগার সমস্ত প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে ত্রৈলোক্যতারিণী মুক্তি পেল।

মুক্তি পেল আরও খুন করার জন্য।

১৫

সেই মামলা মোকদ্দমার পর ত্রৈলোক্য বিপুলবিহারীর চেষ্টায় নিষ্কৃতি পেল ঠিকই, কিন্তু পুরোনো বাড়িতে আর তার থাকা হল না। গোটা তল্লাটে তার বদনাম এতটাই ছড়িয়ে গিয়েছিল, যে বাড়িওয়ালা দায়িত্ব নিয়ে তাকে উৎখাত করল।

গত কয়েকবছরের ধারাবাহিক হত্যায় যে কাঞ্চন লাভ হয়েছিল, তাতে ত্রৈলোক্যর খুব অসুবিধা কিছু হল না।

সে হরির হাত ধরে এসে উঠল চিতপুরের পাঁচুধোপানির গলির একটি বাড়িতে। সেই বাড়িটি আজও কলকাতা শহরের বুকে একরাশ কলঙ্ক মেখে দাঁড়িয়ে আছে।

হরি অনেকটা শুধরে গিয়েছিল। সম্ভবত বুঝেছিল ত্রৈলোক্যকে দিনরাত প্রহার করে টাকা চাওয়ার থেকে ভালোবেসে আবদার করলে সে পাবে বেশি। তাই নতুন বাড়িতে এসে ত্রৈলোক্যর আর্থিক সংকট থাকলেও মানসিক কষ্ট অনেকটাই দূর হয়েছিল।

পাঁচুধোপানির গলির এই বাড়িটাও বিগতযৌবনা একগাদা বারবনিতা ভাড়াটেতে ভরতি। ত্রৈলোক্য প্রথমে এসে কিছুদিন চুপচাপ রইল, তারপর সংকোচ ঝেড়ে ফেলে অন্যান্য ভাড়াটেদের সঙ্গে মিশতে শুরু করল।

এখানকার ভাড়াটেরা কানাঘুসোয় ত্রৈলোক্যর যে কিছু অপরাধের অতীত আছে শুনলেও সেগুলোর ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশদে কিছু জানত না।

ত্রৈলোক্য থাকত দোতলায়। তার পাশের ঘরেই থাকত প্রিয়বালা নামক আরেকজন মহিলা। তার সঙ্গে ত্রৈলোক্যর অল্পদিনেই বেশ সখ্যতা গড়ে উঠল। এছাড়া সে-বাড়ির বাসিন্দা ছিল কনকচাঁপা, লাবণ্য-এরাও থাকত দোতলাতেই। আর নীচের তলায় থাকত আরও কিছু মহিলা ও পরিচারিকা।

মহিলাদের মধ্যে একজনের নাম ছিল রাজকুমারী দাসী।

রাজকুমারী দাসীও অন্যান্যদের মতোই, কিন্তু তবু অন্যদের চেয়ে সে পৃথক ছিল কারণ একসময় দীর্ঘদিন এক ধনকুবেরের রক্ষিতা থাকার দরুন তার কাছে প্রচুর স্বর্ণালংকার ছিল।

ত্রৈলোক্যর শেষ শিকার এই রাজকুমারী দাসী।

এই গোটা কাহিনি লিখতে গিয়ে কখনো ত্রৈলোক্যতারিণীর চরিত্রের প্রতি ব্যথা অনুভব করেছি, কখনও বা ঘৃণায় রাগে ভরে উঠেছে মন।

তবু সময়ের সঙ্গে তার চরিত্রের মৌলিক পরিবর্তনের পর্যালোচনা করতে গিয়ে এটা উপলব্ধি করি যে, জীবনের প্রথম পর্বে সে অপরাধে যুক্ত হত নেহাত দায়ে পড়ে, কখনও কালীবাবুর উসকানিতে, কখনো বা হরির উৎপীড়নে।

কিন্তু জীবনের সায়াহ্নে এসে অপরাধ বা মনের ক্লেদাক্ত কোণাটিকে উন্মুক্ত করে একের পর নৃশংস হত্যা তার কাছে হয়তো নিছকই শখ বা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।

হয়তো অতিরিক্ত লোভ তাকে সুস্থির থাকতে দিত না।

প্রিয়বালা একদিন ত্রৈলোক্যকে কথায় কথায় বলল, ‘রাজকুমারীর দেমাক দেকেচ? সবসময় ঘরের মদ্যে ঢুকে বসে থাকে, কখনও কারুর সাথে যেচে কথা কয় না। হুহ, এমন হাবভাব করে যেন সত্যি রাজার ঘরের মেয়ে।’

‘হ্যাঁ, আমিও খেয়াল করিচি।” ত্রৈলোক্য প্রিয়র কথায় সায় দিল, ‘ডাকলে ভালো করে সাড়াও দেয়না। খুব কষ্ট করে মুখ বেঁকিয়ে এট্টু হেসেই আবার ঘরে ঢুকে পড়ে। মাগির এত দেমাক কিসের লা? ওই তো রূপের ছিরি, গালে বড়ো বড়ো মায়ের দয়ার দাগ, রংও এমন কিচুই পরিষ্কার নয়।’

‘ওসব না থাক, মাগি ছলাকলা কিচু জানত বটে! একসময় যা একখানা জব্বর বাবু ধরেচিল না।’ প্রিয় ভ্রূ নাচিয়ে বলল, ‘সেই বাবু আহিরিটোলায় তেতলা বাড়িতে রেকেচিল ওকে, গয়না, কাপড়ে এক্কেরে মুড়িয়ে রাখত জানো? তারপর সে বাবু চোক বুজল, বাবুর ছেলেরা এসে রাজকুমারীকে বাপের বাড়ি থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। রাজকুমারী নিজের সব নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এল সে-বাড়ি থেকে। সেই ইস্তক এই পাঁচুধোপানির গলিতেই রয়েচে।’

‘থাম দিকিনি, অমন বাবু আমার অনেক দ্যাকা আচে।’ ত্রৈলোক্য তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘ওরে আমার পেচনে কত রাজাউজির যে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকত, তকন যদি দেকতিস!’

‘জানিগো দিদি জানি।’ প্রিয় খোসামোদের ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি যকন জানবাজারে থাকতুম, তকন থেকেই তোমার নাম শুনতুম। অনেক বাবুরাই এসে বলত, আহা, গান শুনতে চাও তো যেতে হবে ত্রৈলোক্য রাঁড়ের কাচে।’ পরক্ষণেই প্রিয় বলার ভঙ্গি পালটে ফেলে চাপা গলায় বলল, ”কিন্তু রাজকুমারীর কাচে একনও প্রচুর গয়না আচে গো দিদি! বিধু আচে না বিধু, ওই যে কাজ করে গো, সে একদিন নিজের চোকে দেকেছিল, সেই গল্প করেচিল আমায়।’

‘কি দেকেচিল সে?’ ত্রৈলোক্য হঠাৎ থমকে যায়। তার হঠাৎ মনে পড়ে যায় কয়েক বছর আগেও সোনাগাজিতে তার নিজের বাড়িতে কত গয়না ছিল।

ভারী ভারী সীতাহার, থাবায় ধরা যায় না এমন মোটা মোটা বাউটি, কতরকম নকশার টায়রা, টিকলি, বাজুবন্ধ, হাঁসুলি।

কালীবাবুর দরাজ হাতের কল্যাণে সব গিয়েছিল।

আজ এত বছর হয়ে গেল কালীবাবু নেই, এখন পেছন ফিরে তাকালে আফশোসই হয় ত্রৈলোক্যর।

মনে হয় গোটা জীবনটায় সবাই তাকে শুধু ব্যবহার করে গেল।

বিনিময়ে কি পেল সে? অন্যকে খুশী করতে গিয়ে একগাদা পাপ করল, পরকালের বোঝা বাড়ল। আর তো কিছু নয়!

‘রাজকুমারীর ঘরে মেলা গয়না আচে। ওইজন্যই দ্যাকো না, ঘর থেকে মাগি পারতপক্ষে বেরয় না, কাউকে ঘরে ডাকে না? দিনরাত যকের মতো সেসব গয়না আগলে পড়ে থাকে।’

সেদিনের মতো কথা ওখানেই চাপা পড়ে গেল।

যে সময়ের কথা বলছি, সেটা ১৮৮৪ সাল। তার কয়েক মাস আগেই ভাইসরয় লর্ড রিপন প্রস্তাব এনেছেন ইলবার্ট বিল পাশের। আর সেই নিয়ে গোটা শ্বেতাঙ্গ সমাজ তুমুল আন্দোলন শুরু করেছে।

১৮৬১ সালের Civil Service Act এর আগে অবধি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের প্রশাসন ছিল সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশদের করায়ত্ব। ১৮৬১ সালের এই আইনেই ভারতীয় ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের জন্য কিছুটা নিয়ম শিথিল করে ব্রিটিশ রাজ। ক্রমে ১৮৭৯ সালের আইনে সিভিল সার্ভিসকে আরও বেশি করে ভারতীয়দের যোগদানের অনুকূল করে তোলা হয়।

১৮৮০ সালের মধ্যে অনেক ভারতীয় বিশেষ করে শিক্ষিত বাঙালি এইসব পদে নিজ নিজ যোগ্যতায় আসীন হন, কালক্রমে তাঁরা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সেশন জজ এইসব পদেও উন্নীত হন।

কিন্তু তখনও অবধি কোনো ইউরোপীয় অপরাধীর বিচার করার ক্ষমতা ভারতীয় বিচারকের ছিল না। একমাত্র ইউরোপীয় বিচারকরাই ইউরোপীয় অপরাধীদের বিচার করতে পারতেন। সহকর্মী শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় এই ভারতীয় বিচারকদের মাইনে, ক্ষমতা সবই ছিল কম।

এই জাতিভেদমূলক বৈষম্য দূর করার জন্য ভারতদরদী বড়োলাট লর্ড রিপনের আদেশ অনুসারে ভাইসরয়ের কাউন্সিলের আইন সদস্য ইলবার্ট একটি আইনের খসড়া তৈরি করেন, যাতে ভারতীয় বিচারকদের ইউরোপীয় বিচারকদের সমতুল্য মর্যাদা ও ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব আনায় হয় ও বলা হয় ভারতীয় বিচারকেরাও শ্বেতাঙ্গদের বিচার করতে পারবেন।

এই খসড়াটি প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয়রা তুমুল আন্দোলন শুরু করে। নেটিভদের হাতে তাদের বিচার হওয়ার কথা তাদের অহমিকাবোধে ঘা দেয়। বিলটি যাতে কিছুতেই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাশ না হতে পারে, তাই নিয়ে তারা জোরগলায় আন্দোলন শুরু করে।

এমনকী সমকালীন সংবাদপত্র স্পেকটেটরও লেখে, ”জাতিশ্রেষ্ঠ ইউরোপীয়দের বিচার করার যোগ্যতা কি আদৌ ভারতীয়দের আছে? ভারতের বড়োলাটের উচিত এই প্রস্তাব পুনর্বিবেচনা করা।”

উলটোদিকে এই বিলের সমর্থনে গলা তোলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতার স্থানে স্থানে সভা আয়োজিত হতে থাকে।

এইরকম যখন অবস্থা, তখন বলাই বাহুল্য কলকাতার পুলিশকর্তারা খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ও এইসময় চূড়ান্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ফলে সাধারণ ফৌজদারি মামলার তদন্ত থেকে কিছুদিন দূরে ছিলেন তিনি। শহরেও ছিলেন না।

যখন ফিরলেন, তখন শুনলেন ৯ আগস্ট সকালে পাঁচুধোপানির গলির একটা বাড়িতে এক মহিলা খুন হয়েছে। কয়েকদিন হল কিন্তু পুলিশ কোনো কিনারা করতে পারছে না।

প্রিয়নাথ একটু ফাঁকা ছিলেন, তিনি ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে পৌঁছলেন অকুস্থলে। গিয়ে দেখলেন তাঁর বেশ কিছু সহকর্মী ঘোরাফেরা করছেন সেখানে।

‘কি ব্যাপার মশাই আপনার?’ একজন কর্তা ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ‘শহরে এমনধারা একটা খুন হয়ে গেল, আর আপনার কোনো পাত্তাই নেই!’

‘আর বলবেন না।’ প্রিয়নাথ হাসলেন, ‘ডেপুটেশনে গিয়েছিলাম অন্য দপ্তরে। ওই ইলবার্ট বিল। এখানে কদ্দূর কী এগোল দেখতে এলাম। কে খুন হয়েছে?’

‘আরে খুন হয়েছে একজন বয়স্ক প্রস্টিটিউট মশাই।’ সহকর্মীটি গলা নামিয়ে বললেন, ‘রাজকুমারী দাসী। প্রাইমারী লেভেলে সাসপেক্ট করছি, তার গয়নাগাটির লোভেই খুনটা হয়েছে।’

‘কীভাবে খুন করা হয়েছে?’

‘গলা টিপে। পুলিশ সার্জেন ড এস সি ম্যাকেনজি পোস্ট মর্টেম করেচেন। বুকের ওপর বসে কেউ গলা টিপে মেরেচে। বুকের আর পাঁজরের অনেক ছোটো ছোটো হাড় ভাঙাও পাওয়া গেছে।” কথাটা বলে পুলিশটি ঠোঁট বেঁকালেন, ‘কোনো খদ্দেরের সঙ্গে বখরা নিয়ে গোলমাল হতে পারে। সে-ই তারপর গয়না নিয়ে ভেগেচে।’

প্রিয়নাথ তীক্ষ্নচোখে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করছিলেন।

বাড়িটা বেশ অপরিচ্ছন্ন, বোঝাই যায় এই বাড়িতে যে মহিলারা বাস করেন, তাঁরা আর যাই হোক লক্ষ্মী নন। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই সারিসারি ঘর। ওপরেও তাই।

প্রিয়নাথ বললেন, ‘খুনি কি বাইরে থেকে এসেছিল?’

‘সেইটে এখনও ঠাহর করা যাচ্চে না।” পুলিশ সহকর্মী ঘাড় নাড়লেন, ‘বিধু বলে একটা দাসী সকালে দরজা খোলে। সে ঠিক করে কিচুই বলতে পারচে না। একবার বলে ভোরে উঠে দ্যাকে দরজা খোলা, একবার দ্যাকে বন্ধ। যত সব গোমুখ্যুর দল। ধুস!’

‘ইন্টারোগেশনের রিপোর্টটা একবার দিন না, একবার চোখ বুলিয়ে দেখি।’ প্রিয়নাথ হেসে বললেন, ‘আজ আমার অফ। একটু সময়ও কাটবে।’

১৬

‘রাজকুমারী দাসীর মৃতদেহ তার নিজের ঘরেই ১৮৮৪ সালের ৯ আগস্ট সকালে পাওয়া যায়। ঘরের দরজা খোলা ছিল, রাজকুমারী ঘরের মেঝেতে প্রাণহীন অবস্থায় পড়েছিল। মৃতদেহ প্রথম দেখতে পায় বিধু নামে ওই বাড়ির এক পরিচারিকা। দেখামাত্র সে বাড়ির অন্যান্য প্রতিবেশিনীদের খবর দেয়। সকলে মিলে পরামর্শ করে খবর পাঠায় বাড়িওয়ালাকে। বাড়িওয়ালা থাকে পাশের গলিতে অন্য এক বাড়িতে। সে-ই থানায় খবর দেয়।

‘পুলিশ এসে দেখতে পায় রাজকুমারীর ঘরের দরজা ভেজানো রয়েছে এবং ঘরের মধ্যে একটি মাদুরের ওপর তার লাশ পড়ে আছে। লাশের শরীরে তেমন কোনো দ্রষ্টব্য আঘাত না থাকলেও গলার দু-পাশে আঙুলের দাগের সঙ্গে নখের দাগ ছিল। এই ব্যাপারে পরে ম্যাকেনজি সাহেব ময়নাতদন্ত করে রিপোর্ট দিয়েছেন, রাজকুমারীকে চিত করে শুইয়ে তার বুকের ওপর বসে গলা টিপে মারা হয়েছে।

‘ঘরে সাধারণ আসবাব ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বিছানার একপাশে দুটো কাঁসার বাটি পড়ে ছিল। সেই বাটি দুটির গায়ে দই-চিঁড়ে লেগে ছিল। অনুমান এই যে, এই বাটিতে দুজন আগের রাতে খেয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন রাজকুমারী, কারণ পোস্ট মর্টেমে তার পেটের মধ্যে দই-চিঁড়ে পাওয়া গেছে। সন্দেহ করা হচ্ছে, অন্যজনই হত্যাকারী।’

রিপোর্ট পড়তে পড়তে প্রিয়নাথ চিন্তা করলেন, ঘরের দরজা ভেজানো, একসাথে বসে আহার, তার মানে হত্যাকারী রাজকুমারী দাসীর পরিচিত কেউ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তিনি আবার পড়তে শুরু করলেন:

রাজকুমারীর সমস্ত বাক্সপ্যাঁটরা ভাঙা ছিল ও লণ্ডভণ্ড অবস্থায় ছিল। ভেতরে কিছুই মূল্যবান ছিল না। অথচ তার কাছে যে অনেক সোনার গহনা ছিল, তা বাড়ির অনেক মহিলাই জানে। তাদের কাছ থেকে জেরা করে রাজকুমারীর সমস্ত গয়নার একটা তালিকাও করা হয়েছে।

‘খুন হওয়ার আগের দিন অর্থাৎ ৮ আগস্ট রাতে রাজকুমারীর কাছে যে কোনো পুরুষ আদৌ এসেছিল কি না, তা নিশ্চিত হয়ে কেউই বলতে পারেনি। তবে, তার সঙ্গে গল্প করার জন্য সন্ধ্যার পর ওপরতলার দুই ভাড়াটে মহিলা এসেছিল, এ-কথা পরিচারিকা বিধুর জবানবন্দি থেকে জানা গেছে। তারা অবশ্য প্রায়ই আসে, এবং সেদিন কিছুক্ষণ পরেই নিজেদের ঘরে চলে যায়। এ ছাড়া কেউ তেমন আসেনি।

‘সেদিন রাতে বাড়ির সদর দরজা খোলা ছিল না বন্ধ ছিল তা সম্পর্কেও নিশ্চিত কিছু জানা যায় না। রাত বারোটার সময় কামিনী নামে এক পরিচারিকা নিজের হাতে সদর দরজা বন্ধ করে শুয়েছিল। পরেরদিন ভোরে বিধু উঠে দেখেছিল দরজা বন্ধই রয়েছে। তবে বিধুর জবানবন্দি সম্পর্কে সন্দেহ আছে কারণ সে কিছুটা জড়বুদ্ধিসম্পন্ন। তার কথা অনুযায়ী ভাবলে হত্যাকারী কী ভাবে পালাল সে সম্পর্কে প্রশ্ন উঠে যায়।’

প্রিয়নাথ আবার মুখ তুলে সহকর্মীটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এমনও তো হতে পারে, হত্যাকারী বাড়ির মধ্যেই কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল, ভোরবেলা বিধু দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার পর সে সেই সদর দিয়েই পালায়।’

‘না মশাই।’ সহকর্মী বললেন, ‘বিধু ওঠার পর সেই ভোরে রাজকুমারীর সঙ্গে আগের দিন সন্ধ্যায় গল্প করতে আসা দুই মহিলাও উঠোনে উপস্থিত ছিল, তারাও কাউকে বেরোতে দেখতে পায়নি।’

‘কী নাম সেই দু-জন মহিলার?’ প্রিয়নাথ কী চিন্তা করতে করতে উত্তর জিজ্ঞেস করলেন।

সহকর্মী বললেন, ‘প্রিয়বালা এবং ত্রৈলোক্যতারিণী। এরা তদন্তে খুবই সাহায্য করচে, বিশেষত ওই ত্রৈলোক্যতারিণী। এই চারদিনে সে বাড়ি তল্লাশির সময় আমাদের এত সাহায্য করে চলেচে বলার নয়। যে কোনো দরকার, পান সেজে এনে দিচ্চে, জল এনে দিচ্চে, এক্কেরে ছায়ার মতো রয়েছে আমাদের সঙ্গে। এমনকী তার ছেলেকে দিয়ে এটা সেটা আনতে পাঠাচ্চে। চালাকচতুর তো, ওর জবানবন্দিটা তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিধুর মতো হাবা নয়।’

প্রিয়নাথ চমকে উঠে বললেন, ‘কী নাম বললেন?’

‘ত্রৈলোক্যতারিণী দাসী।’ সহকর্মী এক খিলি পান মুখে পুরলেন।

‘তার যে ছেলে বলছেন, তার নাম কি হরি?’ প্রিয়নাথ বিস্ফারিত চোখে বললেন।

সহকর্মী চিবোতে চিবোতে থেমে গেলেন, অবাক হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ। হরি। আপনি চেনেন?’

প্রিয়নাথ বললেন, ‘করেছেন কি আপনি! এতো সেই ত্রৈলোক্য যে বছর কয়েক আগে আলিপুর সেশন কোর্টে খুনের মামলায় দৈবক্রমে ছাড়া পেয়েছে। মানিকতলা পুলের কাছের এক বাড়িতে পাঁচ-পাঁচজনকে খুন করেছিল সে। আপনি কলকাতা পুলিশে থেকে ত্রৈলোক্যর নাম শোনেননি? যার ওপর সবচেয়ে বেশি সন্দেহ করার কথা, তার কাছ থেকে কি না পান খাচ্ছেন?’

সহকর্মীর চিবোনো অনেকক্ষণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ উদ্ভ্রান্তের মতো চেয়ে থেকে বললেন, ‘অ্যাঁ! তাহলে কী হবে? ও-ওকে গ্রেপ্তার করব?’

‘গ্রেপ্তার করে কী হবে?’ প্রিয়নাথ বললেন, ‘আপনি ত্রৈলোক্যকে চেনেন না। ও পারেনা এমন কোনো পাপকাজ ধরাধামে নেই। গ্রেপ্তার করলেও জলজ্যান্ত প্রমাণ না থাকলে ও আবার ছাড়া পেয়ে যাবে। ওভাবে হবে না। অন্য উপায় ভাবতে হবে। আপনি আগে একবার ওকে ডাকুন দিকি, আমি দেখি এ-ই সেই কি না! আমি আড়ালে থাকছি।’

ত্রৈলোক্যকে প্রিয়নাথকে এমনভাবে দেখানো হল যে প্রিয়নাথ ত্রৈলোক্যকে দেখতে পেলেন, কিন্তু ত্রৈলোক্য তাঁকে দেখতে পেল না। সে হাসি হাসি মুখে অন্য কর্তাদের তোষামোদ করে চলল।

ত্রৈলোক্য চলে গেলে প্রিয়নাথ মুখের সামনে থেকে খবরের কাগজ সরিয়ে বললেন, ”এ-ই সেই দাগি ত্রৈলোক্য। আপনারা আর দেরি করবেন না। আমি নিশ্চিত ও-ই খুন করেছে। যে মহিলা নির্জন বাগানবাড়ির পুকুরে গিয়ে মানুষকে ডুবিয়ে মারতে পারে, বাড়িতে সোনার দোকানের কর্মচারী ডেকে এনে গলা টিপে খুন করতে পারে, তার পক্ষে এটা কোনো ব্যাপারই নয়।’

‘কিন্তু …!’ সহকর্মী বললেন, ‘আমরা ভালো করে ত্রৈলোক্য আর তার ছেলের ঘর তল্লাশি করেচি। গয়নাগাটি কিচ্চু পাওয়া যায়নি।’

‘আপনি কি ওকে এতই মূর্খ মনে করেন যে আপনাদের চোখের নাগালে ও গয়না রেখে দেবে?’ প্রিয়নাথ ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ‘ওভাবে হবে না। ওসব করতে গিয়ে আগের মামলাগুলোয় ও ঠিক ফাঁদ কেটে বেরিয়ে গেছে। এবার আমাদের এমন ফাঁদ পাততে হবে যে ও নিজেই অপরাধ স্বীকার করতে বাধ্য হয়।’

তারপর কিছুক্ষণ সকলের মধ্যে শলাপরামর্শ চলল। কৌশলে ত্রৈলোক্যকে গোপন করে ডাকা হল বাড়ির অন্যান্য সদস্যদেরও।

তারপর সেদিন বিকেলে প্রিয়নাথ আবার পাঁচু ধোপানির গলির সেই অকুস্থলে এলেন। এবার আর কোনো গোপনীয়তা নয়, ত্রৈলোক্যকে নিয়ে এসে হাজির করানো হল প্রিয়নাথের সামনে।

একজন পুলিশ বললেন, ‘প্রিয়নাথবাবু, আপনি তো এতক্ষণ অন্যদের জেরা করলেন। এদিকে আমাদের কাচে খবর আচে এই ত্রৈলোক্যর বিরুদ্ধে নাকি আগে অনেকগুলো খুনের অভিযোগ আচে। আপনি কি মনে করেন, রাজকুমারীকেও কি সে-ই মেরেচে?’

প্রিয়নাথ উঠে দাঁড়িয়ে ভালো করে ত্রৈলোক্যর মুখটা যেন প্রথম বার দেখছেন এইভাবে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন।

ত্রৈলোক্যর প্রিয়নাথ দারোগাকে দেখামাত্র মুখ থেকে কে যেন রক্ত শুষে নিয়েছিল, সে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল।

বেশ কিছুক্ষণ ভালো করে দেখার পর প্রিয়নাথ বললেন, ‘দারোগামশাই, আপনি তো এসেই আমাকে দিয়ে বাড়ির সবাইকে জেরা করালেন। সেই জেরাগুলো না করলে হয়ত আমিও ভাবতাম ত্রৈলোক্যই খুন করেচে। ওর পক্ষে কিচুই বিচিত্র নয়। কিন্তু এখন আমি নিশ্চিত, ত্রৈলোক্য সম্পূর্ণ নির্দোষ। আপনাদের আগের জেরার কাগজগুলো আমি ছিঁড়ে ফেলেছি। প্রত্যেকেই এবার অন্য কথা বলেছে। এই খুনে ত্রৈলোক্যর কোনো ভূমিকা নেই, আমি নিশ্চিত।’

ত্রৈলোক্য চমকে প্রিয়নাথের দিকে তাকাল।

তার চোখে মুখে অবিশ্বাস। সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না প্রিয়নাথ মুখুজ্জে তার এত বড়ো উপকার করছে।

‘কেন? আপনি কি করে বুজচেন যে ও নির্দোষ?’ একজন পুলিশ প্রশ্ন করেন।

‘কারণ অপরাধী কে তা আমার কাছে এখন দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট।’ প্রিয়নাথ কথাটা বলে চোখের ইশারায় ইঙ্গিত করেন, ‘ত্রৈলোক্যকে ছেড়ে দিন।’

ত্রৈলোক্য হতবুদ্ধি হয়ে গেল, তারপর সটান এসে প্রিয়নাথের পায়ে পড়ল, ‘কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব দারোগাবাবু! আপনার জন্যই আজ এত বড় বিপদ থেকে আমি উদ্ধার পেলুম!’

‘ঠিক আছে ঠিক আছে।’ প্রিয়নাথ সসংকোচে পা সরিয়ে নিয়ে অন্যান্য পুলিশদের বললেন, ‘বাড়ির বাকি সবাইকে ডাকো। অপরাধী কে তা সবারই জানা দরকার।’

ত্রৈলোক্য নিশ্চিন্ত মনে ঘরের এক কোণে গিয়ে বসলো।

প্রিয়নাথ মুখুজ্জেকে দেখা ইস্তক সে বুঝে গিয়েছিল যে এবার আর কিছুতেই তার নিষ্কৃতি নেই। প্রিয়নাথ সেই পাঁচটা স্ত্রীলোক হত্যার সময়েই ভীষ্মের পণ করেছিলেন, সেই শোধ এবারে তুলবেনই।

কিন্তু এত বড়ো সৌভাগ্য? সে যে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না যে স্বয়ং প্রিয়নাথ তাকে রেহাই দিলেন। কিন্তু কার ঘাড়ে চাপল দোষটা? ত্রৈলোক্য কৌতূহলী চোখে দেখতে লাগল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বিধু, কামিনী, লাবণ্য, প্রিয়বালা থেকে শুরু করে সকলে এসে উপস্থিত হল। ত্রৈলোক্যর ছেলে হরিকেও নিয়ে আসা হল।

প্রথমেই ডাকা হল কামিনীকে।

প্রিয়নাথ তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেরা করতে লাগলেন।

একটু পরেই সে হড়হড় করে বলে দিল, ‘আজ্ঞে বাবু, আমি অনেক রাতে একবার উঠেচিলুম, তকন দেকলুম কি ত্রৈলোক্যদিদির ছেলে হরি পা টিপে টিপে রাজকুমারী দিদির ঘরে যাচ্চে।’

ত্রৈলোক্য কথাটা শুনে চমকে উঠল।

হরিও কথাটা শুনে বিস্মিতচোখে তাকাল।

প্রিয়নাথ বললেন, ‘বটে? তুমি শোরগোল করলে না কেন?’

‘আজ্ঞে শোরগোল করব কেন বাবু? হরি তো পেরায় রাতে যায় রাজকুমারী দিদির ঘরে। দুজনে মিলে মদ খায়, ভোর অবধি ফুর্তি করে যে।’

‘কি বলচিস তুই এসব কামিনী?’ ত্রৈলোক্য আর থাকতে না পেরে চিৎকার করে উঠল, ‘হরি হল গিয়ে রাজকুমারীর ছেলের বয়সি, সে কি না রাতে তার ঘরে যেত? এত বড়ো মিছে কতা তুই কইতে পারচিস?’

প্রিয়নাথের দিকে পরক্ষণে তাকায় সে, ‘হুজুর, ওর কতা একদম বিশ্বেস করবেন না কো! মিছে কতা কইচে কামিনী!’

প্রিয়নাথ হাত তুলে ত্রৈলোক্যকে থামিয়ে দিলেন। আরও কিছু প্রশ্ন করলেন কামিনীকে, সে সব অভিযোগের তিরই ছুঁড়তে লাগল হরির দিকে।

এরপর এল বিধু। সে মাথা চুলকে বলল, ‘আমি তো ভোরবেলা দরজা খুলতেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে হরি বাইরে চলে গেল। রাজকুমারী দিদির ঘর থেকে বেরোতে দেকেচি।’

‘মিছে কতা!’ ত্রৈলোক্য হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে আবার চেঁচায়, ‘নচ্ছার মেয়ে। তোর মুকে পোকা পড়বে রে হারামজাদী। আমার ছেলেটাকে নিয়ে এমন বানিয়ে বলচিস, লজ্জা করে না তোর? নরকেও ঠাঁই হবে না যে!’

এরপর একে একে আসে লাবণ্য, কনকচাঁপা আরও অনেকে। সকলেই একবাক্যে বলতে থাকে যে হরির সঙ্গে রাজকুমারীর গোপন সম্পর্ক ছিল। এমনিতেই হরির বেশ্যালয়গমন ও মদ্যপানের নেশা সুবিদিত। তার ওপর সকলেই বলল, হরি রাতে রাজকুমারীর ঘরে প্রায়ই যেত। আর হত্যার আগের দিন রাতে দুজনের মধ্যে বাদানুবাদও শুনেছে অনেকে।’

প্রিয়নাথ হুকুম করলেন, ‘এই, তোমরা হরিকে গ্রেপ্তার কর এখুনি। ওয়ারেন্ট আনার ব্যবস্থা করছি।’

১৭

ত্রৈলোক্য কথাটা শুনে প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেল, তারপর হাউমাউ করে এসে প্রিয়নাথের পা জড়িয়ে ধরল, ‘হুজুর। আমি শপথ করে বলচি আমার হরি একাজ করেনি। হরি অমন ছেলে নয়। আপনি বিশ্বেস করুন, সবাই ওর নামে মিছে অপবাদ দিচ্চে।’

প্রিয়নাথ গুরুত্ব দিলেন না, তিনি কাগজে খসখস করে জেরার বিশদ লিখতে লাগলেন।

ত্রৈলোক্য এমন চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল, যে পাড়ার কুকুর বিড়ালগুলো পর্যন্ত থেমে গেল।

যে গলা দিয়ে এককালে সুললিত সুর বেরত, সেই গলা দিয়ে বুকফাটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে কেমন যেন বুক হিম করে দিচ্ছিল সবার।

কান্নার দমকে ত্রৈলোক্যর দশাসই শরীর ফুলে ফুলে উঠছিল। হরিকে জড়িয়ে ধরে সে বিলাপ করে চলেছিল, ‘হরি! বাপ আমার! যাস নে তুই আমায় ছেড়ে! তুই যা চাইবি, তাই দেব। লক্ষ্মী বাপ আমার! আমি মরে যাব তোকে ছাড়া।’

হরি চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় তার চোখে জলও আসেনি। কী করে কী হল, সবাই কেন তাকেই একজোট হয়ে মিথ্যেকথা বলে খুনের আসামী বানিয়ে দিল, সে কিছুতেই ভেবে উঠতে পারছিল না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশের গাড়ি চলে এল। হরিকে হাতকড়া পরিয়ে ওঠানো হতে লাগল গাড়িতে, কিন্তু ত্রৈলোক্য কিছুতেই তাকে নিয়ে যেতে দেবে না। সে প্রাণপণে হরিকে চেপে রাখল, ‘না! আমি কিচুতেই ওকে নিয়ে যেতে দেব না। আ-আমার ছেলে কিচ্চু করেনি, কেন ও যাবে? আমি কী নিয়ে থাকব ও গেলে? আমি কিচুতেই ওকে ছাড়ব না!’

প্রিয়নাথের নির্দেশে ত্রৈলোক্যর হাত থেকে বলপূর্বক ছাড়ানো হতে লাগল হরিকে।

প্রিয়নাথ মৃদু হেসে বললেন, ‘তোমার জন্য সত্যিই কষ্ট হচ্ছে ত্রৈলোক্য! কালী বলে তোমার সেই বাবুর ফাঁসি হল, তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে, এখন ছেলের ফাঁসি হবে, সেটাও দেখতে হবে। দুঃখ করো না ত্রৈলোক্য! সবই নিয়তি, বুঝলে!’

ত্রৈলোক্য প্রচণ্ড কান্না থামিয়ে চোখ বড়োবড়ো করে তাকাল প্রিয়নাথের দিকে। কেমন উন্মাদগ্রস্থের মতো বলল, ‘ফাঁসি হবে? হরির ফাঁসি হবে?’

‘তা খুন করেচে, ফাঁসি হবে না তো কি জামাই আদর খাবে?’ পাশ থেকে একটা পুলিশকর্মী সুর করে বলে উঠল।

ত্রৈলোক্য কেমন স্থবির হয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য বরফঠান্ডা হয়ে গেল, তারপর প্রচণ্ড এক কর্কশ চিৎকার করে প্রিয়নাথের পা জড়িয়ে ধরল, ‘দারোগাবাবু, হরি খুন করেনি। আ-আমি খুন করেচি। আপনি বিশ্বেস করুন। আমি মা কালীর নামে শপথ করে বলচি আমি খুন করেচি রাজকুমারীকে।’

‘তা বললে তো হয় না।’ প্রিয়নাথ দ্রুত বললেন, ‘তুমি এখন তোমার ছেলেকে বাঁচানোর জন্য সব দোষ ঘাড়ে নিচ্ছ, সে তো সবাই বুঝছে।’

‘না না না দারোগাবাবু!’ অমানুষিক চিৎকার করে বলে উঠল ত্রৈলোক্য, ‘আমি সত্যি বলচি। আমিই প্রিয়বালাকে নিয়ে রাজকুমারীকে খুন করেচি। ওর গয়নাগাটি সব আমার কাচে আচে।’

এই কথা শোনামাত্র কিছুদূরে দাঁড়ানো প্রিয়বালার মুখ কালো হয়ে গেল। সে উদ্ভ্রান্ত চোখে তাকাতে থাকল চারদিকে।

‘তা কী করে হয়? তোমার ঘর তো আমরা দেকেচি তল্লাশি করে। কোতাও কিচ্চু নেই!’ পাশ থেকে অন্য এক পুলিশ বলল।

‘আচে আচে।’ ত্রৈলোক্য প্রচণ্ড জোরে ফোঁপাচ্ছিল, ‘আমার আলমারির ভেতর একটা চোরাকুঠুরি আচে। সেকানেই সব গয়না আচে। আপনারা চলুন, আমি বের করে দিচ্চি।’

‘বটে?’ প্রিয়নাথ ছদ্ম অবাক হওয়ার ভান করে বললেন, ‘তুমি কী করে মারলে রাজকুমারীকে? কেনই বা মারলে?’

ত্রৈলোক্য ভেজা চোখে বলতে লাগল, ‘রাজকুমারীর গয়নাগুলো চুরি করার জন্য আমি আর প্রিয় ঠিক করেচিলাম ওকে কোনোভাবে অজ্ঞান করে গয়নাগুলো হাতিয়ে নেব। সেইমতো আমি ধুতুরা গাছের কিচু বীজ জোগাড় করে গুঁড়ো করে রেকেচিলাম। ধুতুরার বীজ তো মারাত্মক বিষ, তাই।’

‘কোত্থেকে পেলে?’

‘দূরের এক জঙ্গলে। সেই বীজের গুঁড়ো কিছু সন্দেশে মাখিয়ে রেকে দিয়েচিলুম।’ ত্রৈলোক্য ঠোঁট কামড়ে ধরল, ‘সেদিন সন্ধ্যাবেলা আমি আর প্রিয়বালা ইচ্ছে করেই একরকম জোর করে রাজকুমারীর ঘরে গল্প করতে গেলাম। সে বিশেষ খুশী হচ্চিল না, তবু আমরা যেচে যেচে কথা কইচিলাম। রাত যখন প্রায় সাড়ে এগারোটা, তকন প্রিয় আমায় বলল, চল দিদি, রাজকুমারী তো আমাদের কিচু খেতে দেবে না, বকে বকে সারা হয়ে গেলুম, ওপরে যাই।’

‘তারপর?’ প্রিয়নাথ প্রশ্ন করলেন।

‘তকন রাজকুমারী ইচ্ছে না থাকতেও বলল, না না বোসো, আমি খাবার আনচি। বলে দই চিঁড়ে মেখে নিয়ে এল। আমি খেতে খেতে বললুম, মিষ্টি একদম হয়নি কো! তকন প্রিয়বালা বলল আমার ঘরে মিষ্টি আচে, আমি নিয়ে আসি, রোসো। তারপর গিয়ে সেই বিষ মাখানো মিষ্টি নিয়ে এল। বিষ ছাড়াও কিচু মিষ্টি আনল, সেগুলো আমি আর প্রিয় খেলুম, আর বিষমাখানোগুলো দিলুম রাজকুমারীকে।’

‘কিন্তু সে মিষ্টি খেতে চাইলে না। অনেক জোরাজুরিতে একখানা খেলে, তাতে তার অবসন্ন লাগতে শুরু করল, কিন্তু জ্ঞান হারালে না। তকন আমি প্রিয়কে তামাক সেজে আনতে বলতে আমার শেকানোমতো সে তামাকের বদলে সিদ্ধি নিয়ে এল। কিন্তু সেই সিদ্ধি খাইয়েও রাজকুমারীকে পুরোপুরি অজ্ঞান করতে পারলুম না। এদিকে অনেক রাত হয়ে গ্যাচে। আর দেরি হলে বিপদ।’

‘তখন কী করলে?’

ত্রৈলোক্য একটা নিশ্বাস ফেললো, ”তকন বাধ্য হয়ে আমি প্রিয়কে বললুম ওর পা-দুটো চেপে ধরতে, আমি ওর বুকের ওপর উঠে বসে জোর করে গলা টিপে ধরলুম। রাজকুমারী ছটফট করে বাধা দিতে লাগল। কিন্তু আমার সাথে পেরে উঠল না। দেকতে দেকতে সে স্থির হয়ে গ্যাল। আর উঠল না।’ ত্রৈলোক্য মুখে হাত চাপা দিল।

অনেকক্ষণ পর সে হাত সরিয়ে ভাঙা গলায় বলল, ‘আপনারা আমায় ফাঁসি দিন। কিন্তু আমার হরিকে ছাড়ুন। সে নির্দোষ।’

‘তোমার কথাগুলো সত্যি না বানানো কি করে বুঝব?’ প্রিয়নাথ ছাড়লেন না, ‘কোনো প্রমাণ আছে?’

‘আচে।’ ত্রৈলোক্য বলল, ‘আমার ওই আলমারির কুঠুরির মধ্যে গয়নার পাশেই সেই বিষ মাখানো মিষ্টি পাবেন। হরি খেয়ে ফেলতে পারে সেই ভয়ে ওকানে লুকিয়ে রেকেচিলুম। সিদ্ধির কাগজও আমার ঘরে পাবেন। আর বাকি কতা আপনারা প্রিয়কে জিজ্ঞেস করুন।’

প্রিয়বালা ইতিমধ্যেই কাঁপতে শুরু করেছিল, এবার সে মূর্ছিত হয়ে পড়ল।

অতঃপর সবই হল। ত্রৈলোক্যর ঘরের আলমারির সেই গুপ্ত কুঠুরি থেকে উদ্ধার হল মৃতা রাজকুমারীর গয়না, বিষমাখানো সন্দেশ।

প্রিয়বালাও সব কথা স্বীকার করল।

ত্রৈলোক্যতারিণী গ্রেপ্তার হল।

তবে তাতে তার আর কিছু কষ্ট ছিল না। পুলিশের গাড়িতে ওঠার আগে সে বারবার হরির বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে বলছিল, ‘ভালো থাকিস বাছা! আমার কতা চিন্তা করিস নে। ভালো থাকিস।’

প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় আগের দুটো মামলার সময় ত্রৈলোক্যকে ধরতে না পারলেও একটা ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়েছিলেন যে চারিত্রিক দিক থেকে ত্রৈলোক্য যত নীচেই নামুক না কেন, হরির প্রতি ওর যে মাতৃস্নেহ, তা অকৃত্রিম। তাই হরিকে অপরাধী সাজিয়ে উলটো চাপ দিয়ে ত্রৈলোক্যর কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য কৌশল অবলম্বন করেছিলেন তিনি। ভাড়াটে মহিলাদেরও তেমনই শেখানো হয়েছিল।

চোরের ওপর বাটপাড়ি একেই বলে।

যথাসময়ে Empress VS Troylucko Raur এর চাঞ্চল্যকর মামলাটি কোর্টে উঠল। বিচারক ছিলেন নরিস সাহেব।

সরকারি পক্ষের প্রসিকিউটর হলেন মি ফিলিপস এবং আসামি পক্ষের উকিল হলেন মি জি এল ফাগান।

১৮৮৪ সালের ৯ আগস্ট পাঁচু ধোপানির গলির সেই বাড়িতে ঘটে যাওয়া রাজকুমারী দাসীর হত্যায় অভিযুক্ত কুখ্যাত ত্রৈলোক্যতারিণীকে দেখতে আদালতে লোক প্রায় ভেঙে পড়ল।

প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় এবার আর কোনোদিকে ফাঁক রাখেননি। রাজকুমারীর গলায় সেই নখের দাগ, আঙুলের ছাপের সঙ্গে ত্রৈলোক্যর হাতের ছাপ মিলে গেল। বিষমাখানো সন্দেশ থেকে শুরু করে ত্রৈলোক্যর আলমারিতে পাওয়া সিদ্ধি, রাজকুমারীর অলংকার সব এভিডেন্স হিসাবে জমা দেওয়া হল আদালতে।

পোস্ট মর্টেম যিনি করেছিলেন, সেই ম্যাকেনজি সাহেব থেকে শুরু করে বিধু, কামিনী, কনকচাঁপা সবাইকে সাক্ষ্য দিতে আসতে হল। এমনকী সোনাগাজি থেকে ত্রৈলোক্যর পুরোনো পাড়ার কিছু পরিচিতাকেও ডাকা হল, যারা সবাই একবাক্যে ত্রৈলোক্যর অতীতের অপরাধ প্রবণতার কথা স্বীকার করল। ডাকা হল একটুর জন্য ত্রৈলোক্যর নৃশংসতা থেকে ছাড় পাওয়া সেই আঙুরবালা দাসীকেও।

অবশেষে কয়েকটি ভিড়ে উপচে পড়া শুনানির পর ত্রৈলোক্য ১৮৮৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হল।

ভারতবর্ষের ইতিহাসে সে-ই প্রথম মহিলা যে হত্যার অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল।

দারোগা প্রিয়নাথ শেষ যুদ্ধে জিতলেও কোথাও যেন ত্রৈলোক্যর সমস্ত কিছুর ঊর্ধে উঠে সন্তানের প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসা দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন।

তিনি একদিন গিয়েও ছিলেন জেলে ত্রৈলোক্যর সঙ্গে দেখা করতে।

ত্রৈলোক্য ফাঁসি হওয়ার আগের কয়েকটা দিন কারুর ওপরেই রেগে ছিল না।

শুধু প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়কে সেদিন বলেছিল, ‘দারোগাবাবু, আপনি যে হরির টোপ দিয়ে আমার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করেচিলেন, তা আমি বুজেচি। তা নিয়ে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। কিন্তু আপনার কাচে আমার দুটো প্রার্থনা আচে। মঞ্জুর করবেন?’

মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামিকে আর কী-ই বা বলা যায়?

প্রিয়নাথ বলেছিলেন, ‘বলো কী প্রার্থনা?’

ত্রৈলোক্য ধরা গলায় জেলের খুপরির ফাঁক দিয়ে দূরে তাকিয়ে বলেছিল, ‘জানেন যেদিন পেত্থম এই কলকেতা শহরে পা রেকেচিলুম, খুব সাধ ছিল বিদ্যেসাগর মশাইকে একবার দেখার। ভেবেচিলুম দূর থেকে হলেও পেন্নাম করব। উনিই তো বেধবাদের দুঃখ কষ্ট মুছিয়েচেন। আমি নাহয় জন্মপাপী, তা হলই বা! আমার তেমন কপাল হলে আমিও নিশ্চয়ই বেধবা হয়েও একখানা সংসার পেতুম!’ ত্রৈলোক্য কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকল।

‘একন মেয়েদের যে দুঃখ কষ্ট আস্তে ঘুচচে, সবই তো ওঁরই চেষ্টায় আর আশীর্বাদে। সাধে কি তাঁতিরা শান্তিপুরী তাঁতে লেখা শুরু করেচে, বেঁচে থাকো বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে? সে শাড়ি আমি কিনেওচিলাম একখানা শখ করে, কিন্তু সাহস করে পরতে পারিনি কোনোদিন।’ কথাটা বলে ও প্রিয়নাথের দিকে তাকিয়েছিল, ‘আপনি … আপনি আমার হয়ে ওনাকে একটা পেন্নাম করে আসতে পারেন দারোগাবাবু?’

প্রিয়নাথ অবাক হয়েছিলেন। এমন এক দাগি অপরাধীর মুখে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের নাম শোনা সত্যিই আশ্চর্যের।

তবু কিছু না বলে মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিলেন, ‘বেশ। প্রণাম করে আসব ওঁকে। আর?’

ত্রৈলোক্য এবার একটা বড়ো নিশ্বাস ফেলেছিল। তারপর থেমে থেমে বলেছিল, ‘আপনি পারলে মাঝে মধ্যে হরির এট্টু খোঁজ খবর রাকবেন দারোগাবাবু! আমার ছেলেটা বড্ড অভিমানী, লোকে ভাবে বুজি ও খারাপ, বাজে নেশা করে, খারাপ পাড়ায় যায়। কিন্তু ওর মনটা সত্যিই ভালো।’ বলতে বলতে সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল, ‘আমি না থাকলে ওকে কে দেকবে দারোগাবাবু? আপনার পায়ে পড়ি, আপনি আমায় কতা দিন, আপনি মাঝেমাঝে ওর খবর নেবেন?’

প্রিয়নাথ তখন বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখছিলেন সামনের সেই মহিলাকে যে কিনা অবলীলায় হত্যা করেছে একের-পর-এক মানুষকে।

হয়তো বা খোঁজ পেতে চাইছিলেন নির্মম অপরাধীর ভেতরের মনটার!

সোনাগাজির একসময়ের ডাকসাইটে নাচে গানে পারদর্শী ত্রৈলোক্য রাঁড়কে মানুষ ভুলে গেছে।

ভুলে গেছে ত্রৈলোক্যর কিশোরবেলার সেই অন্ধকারময় জীবন, প্রেমিককে বিশ্বাস করে কলকাতা আসা।

ধীরে ধীরে ভুলে যাবে তার অপরাধগুলোও।

কিন্তু দারোগা প্রিয়নাথ কখনও একজন মায়ের তার সন্তানের প্রতি ভালোবাসাটা ভুলতে পারবেন না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *