রহস্য

রহস্য জাতীয় ব্যাপারগুলিতে আমার তেমন বিশ্বাস নেই। তবু প্রায়ই এ রকম কিছু গল্প-টল্প শুনতে হয়। গত মাসে ঝিকাতলার এক ভদ্রলোক আমাকে এসে বললেন, তার ঘরে একটি তক্ষক আছে – সেটি রোজ রাত ১টা ২৫ মিনিটে তিনবার ডাকে। আমি বহু কষ্টে হাসি থামালাম। এ রকম সময়নিষ্ঠ তক্ষক আছে নাকি এ যুগে? ভদ্রলোক আমার নির্বিকার ভঙ্গি দেখে বললেন, কি ভাই বিশ্বাস করলেন না?
জ্বি না।
এক রাত থাকেন আমার বাসায়। নিজের চোখে দেখেন তক্ষকটা। ঘড়ি ধরে বসে থাকবেন। দেখবেন ঠিক ১টা ২৫ মিনিটে তিনবার ডাকবে।
আরে দুর! কি যে বলেন?

ভদ্রলোক মুখ কালো করে উঠে গেলেন। চারদিন পর তার সঙ্গে আবার দেখা। পৃথিবীটা এরকম, যার সঙ্গে দেখা হবার তার সঙ্গে দেখা হয় না। ভুল মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। আমাকে দেখেই ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে বললেন, আপনি কি দৈনিক বাংলার সালেহ সাহেবকে চেনেন?
হ্যাঁ চিনি।
তাকে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি নিজের কানে শুনেছেন। বলেছেন একটা নিউজ করবেন।
ভালই তো। নিউজ হবার মতই খবর।
আপনি আসেন না ভাই, থাকেন এক রাত।
আমাকে শোনালে কি হবে?
আরে ভাই আপনারা ইউনিভার্সিটির টিচার। আপনাদের কথার একটা আলাদা দাম।
তাই নাকি?
আপনারা একটা কথা বললে কেউ ফেলবে না।
এই জিনিসটা নিয়ে খুব হৈ-চৈ করছেন মনে হচ্ছে?
না, হৈ-চৈ কোথায়? অনেকেই অবশ্যি শুনে গেছেন। বাংলাদেশ টিভির ক্যামেরাম্যান নাজমুল হুদাকে চেনেন?
জ্বি না।
উনিও এসেছিলেন। খুব মাইডিয়ার লোক। আপনি আসুন না।
আচ্ছা ঠিক আছে, একদিন যাওয়া যাবে।

ভদ্রলোকের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি মুখভর্তি করে হাসলেন। টেনে-টেনে বললেন, চলেন চা খাই।
না, চা খাব না।
আরে ভাই আসেন না। প্রফেসর মানুষ, আপনাদের সঙ্গে থাকাটা ভাগ্যের ব্যাপার।
ভদ্রলোক হা হা করে হাসতে লাগলেন। যেতে হল চায়ের দোকানে।
চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবেন? চপ?
না।
আরে ভাই খান না। এই এদিকে দু’টো চা দে তো। এখন ভাই বলেন, কবে যাবেন?
আপনার সঙ্গে তো প্রায়ই দেখা হয়, বলে দেব একদিন।

চা খেতে খেতে ভদ্রলোক দ্বিতীয় একটা রহস্যের কথা শুরু করলেন। নাইনটিন সিক্সটিতে তিনি বরিশালের পিরোজপুরে থাকতেন। তার বাসার কাছে বড় একটা কাঁঠাল গাছ ছিল। অমাবস্যার রাতে নাকি সেই কাঁঠাল গাছ থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসত। আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, সেই কান্নারও কি কোন টাইম ছিল? নির্দিষ্ট সময়ে কাঁদত? আপনার তক্ষকের মত?
ভদ্রলোক আহত স্বরে বললেন, আমার কথা বিশ্বাস করলেন না?
বিশ্বাস করব না কেন?
আমি কান্নার শব্দ গোটাটা টেপ করে রেখেছি। একদিন শোনাব আপনাকে।
ঠিক আছে।

বরিশালের ডিসি সাহেবও শুনেছেন। চেনেন উনাকে? আসগর সাহেব। সি এস পি। খুব খান্দানী ফ্যামিলি।
না, চিনি না।
ডিসি সাহেবের এক ভাই আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকে। বিরাট অফিসার।
তাই বুঝি?
জ্বি। উনার বাসায় একদিন গিয়েছিলাম। খুব খাতির-যত্ন করলেন। গুলশানের বাসা। তিন তলা। উনি থাকেন এক তলায়। ওপরের দুটো তলা ভাড়া দিয়েছেন।
ভদ্রলোক আমার প্রায় এক ঘন্টা সময় নষ্ট করে বিদায় হলেন। আমার মায়াই লাগলো। ইন্ডেন্টিং ফার্মে সামান্য একটা চাকরি করেন। দেখেই বুঝা যায় অভাবে পর্যুদস্ত। চোখের দুষ্টি ভরসাহারা। বয়স এখনো হয়তো ত্রিশ হয়নি কিন্তু বুড়োটে দেখায়। বিচিত্র চরিত্র।

মাস খানেক তার সঙ্গে আমার দেখা হল না। তার প্রধান কারণ, যে সব জায়গায় তার সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা সে সব জায়গা আমি এড়িয়ে চলতে শুরু করেছি। নিউমার্কেটে আড্ডার জায়গাটিতে যাই না। কি দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে? এই লোকটি পিচ্ছিল পদার্থ, সে গায়ের সঙ্গে সেঁটে যাবে। আর ছাড়ানো যাবে না। কিন্তু তবু দেখা হল। একদিন শুনলাম সে ইউনিভার্সিটি ক্লাবে এসে খোঁজ নিচ্ছে। ক্লাবের বেয়ারা বলল, গত কিছুদিন ধরে নাকি সে নিয়মিতই আসছে। কি মুসিবত।

একদিন আর এড়ানো গেল না। ভদ্রলোক বাসায় এসে হাজির।
কি ভাই আপনি তো আর এলেন না?
কাজের ব্যস্ততা …
আজকে আপনাকে নিতে এসেছি।
সে কি?
কবি শামসুল আলম সাহেবও আসবেন।
তাই বুঝি?
জ্বি। চিনেত তো শামসুল আলম সাহেব কে? দু’টো কবিতার বই বেরিয়েছে। পাখির পালক আর অন্ধকার জ্যোত্স্না।
তাই বুঝি?
জ্বি। আমাকে দু’টো বই-ই দিয়েছেন। খুবই বন্ধু মানুষ। বাড়ি হচ্ছে আপনার ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা।
ও।
উনার ছোট ভাইও গল্প টল্প লেখেন। আরিফুল আলম।

গেলাম তার বাসায়। ঝিকাতলার এক গলিতে ঘুপসি মত দু’কামরার বাড়ি। মেজাজ খুবই খারাপ। রাত দেড়টা পর্যন্ত বসে থাকতে হবে সময়নিষ্ঠ তক্ষকের ডাক শোনার জন্য। কত রকম যন্ত্রণা যে আছে পৃথিবীতে!

ভদ্রলোক আমাকে বসার ঘরে বসিয়ে অতি ব্যস্ততার সঙ্গে ভেতরে চলে গেলেন। বসার ঘরটি সুন্দর করে সাজানো। মহিলার হাতের সযত্ন স্পর্শ আছে। ভদ্রলোক বিবাহিত জানতাম না। এ নিয়ে তার সঙ্গে কখনো কথা হয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার স্ত্রী ঘরে এসে ঢুকলেন। খুবই অল্প বয়েসী তরুণী এবং অসম্ভব রূপসী। আমি প্রায় হকচকিয়ে গেলাম।

আমার স্ত্রী লীনা। আর লীনা, উনি হুমায়ূন আহমেদ। এর কথা তো তোমাকে বলেছি।
লীনা হাসি মুখে বললো, জ্বি আপনার কথা প্রায়ই বলে।
লীনা একটু চায়ের ব্যবস্থা কর।

লীনা চলে গেল ভেতরে। ভদ্রলোক নিচু গলায় বললেন, লীনার গল্প-উপন্যাস লেখার শখ আছে। কয়েক দিন আগে সাপ নিয়ে একটা গল্প লিখেছে। মারাত্মক গল্প ভাই। আপনাকে পড়ে শোনাতে বলবো। আমি বললে পড়বে না। আপনিও কাইন্ডলি একটু বলবেন।
আমি বললাম, গুণী মহিলাতো!
ভদ্রলোকের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
তা ভাই, কথাটা অস্বীকার করব না। গানও জানে। নজরুল গীতি। ভালো গায়। বাড়িতে টিচার রেখে শিখেছে।
তাই নাকি?
জ্বি, শোনাবে আপনাকে। একটু প্রেসার দিতে হবে আর কি। আপনি একটু রিকোয়েস্ট করলেই শোনাবে। কাইন্ডলি একটু রিকোয়েস্ট করবেন।
ঠিক আছে, করব।

চা এসে পড়ল। চায়ের সঙ্গে বড়া জাতীয় জিনিস। বেশ খেতে। আমি বললাম, কিসের বড়া এগুলি? ডালের নাকি?
ভদ্রলোক উচ্চস্বরে হাসলেন, নারে ভাই, কুলের বড়া। হা-হা-হা। কত রকম অদ্ভুত রান্না যে জানে! মাঝে মাঝে এত সারপ্রাইজ হই। খেতে কেমন হয়েছে বলেন? চমত্কার না?
ভাল, বেশ ভাল।
আরেক দিন আসবেন, চাইনীজ সুপ খাওয়াবো। চিকেন কর্ন সুপ। চাইনীজ রেস্তোরাঁর চেয়ে যদি ভালো না হয় তাহলে কান কেটে ফেলবেন। হা-হা-হা।

আমি মেয়েটার লেখা একটা ছোট গল্প শুনলাম, দু’টি কবিতা শুনলাম। ভদ্রলোক মুগ্ধ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন। বার বার বললেন, ইস শামসুল আলম সাহেব আসলেন না। দারুণ মিস্ করলেন, কি বলেন ভাই?
রাত এগারোটার দিকে বললাম, তা হলে আজ উঠি?
তক্ষকের ডাক শুনবেন না?
আরেক দিন শুনব।
আচ্ছা, ঠিক আছে। ভুলবেন না যেন ভাই। আসতেই হবে।

ভদ্রলোক আমাকে এগিয়ে দিতে এলেন। রাস্তায় নেমেই বললেন, আমার স্ত্রীকে কেমন দেখলেন ভাই?
ভাল, গুণী মহিলা।
ভদ্রলোকের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ধরা গলায় বললেন, বাঁদরের গলায় মুক্তার মালা। ঠিক না ভাই?
আমি কিছু বললাম না। ভদ্রলোক কাঁপা গলায় বললেন, গরীব মানুষ, স্ত্রীর জন্যে কিছুই করতে পারি না। কিন্তু এই সব নিয়ে লীনা মোটেই মাথা ঘামায় না। বড় ফ্যামিলির মেয়ে তো। ওদের চাল চলনই অন্য রকম।

আমি রিকশায় উঠতে উঠতে বললাম, খুব ভাগ্যবান আপনি।
ভদ্রলোক আমার হাত চেপে ধরলেন। যেন আবেগে কেঁদে ফেলবেন।
ভাই, আরেকদিন কিন্তু আসতে হবে। তক্ষকের ডাক শুনতে হবে। আসবেন তো? প্লীজ।

তক্ষকের ডাকের মত কত রহস্যময় ব্যাপারই না আছে পৃথিবীতে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *