রহস্য রজনীগন্ধার – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়

রহস্য রজনীগন্ধার – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়

ভোরে ওঠা আমার বরাবরের অভ্যাস। কিন্তু ইদানীং রাত সাড়ে তিনটে কি চারটে বাজতে-না-বাজতেই আমার ঘুম ভেঙে যায়। সেই যে ঘুম ভাঙে, হাজার এপাশ-ওপাশ করলেও আর ঘুম আসে না। আমি তখন শয্যাত্যাগ করে কখনও ছাদে যাই, কখনও বা বাগানে পায়চারি করি। এই সময় আমার খুব চা খেতে ইচ্ছে করে। আমার সবরকমের কাজকর্ম করে দেওয়ার জন্য রাখহরি আছে। কিন্তু সে বেচারা তখন এমন অকাতরে ঘুমোয় যে, ওকে ডাকতেও আমার মায়া হয়। ছেলেমানুষ তো! আমি তাই নিজেই এক কাপ চা করে খাই।

আজ ঘুম ভাঙল শেষ রাতে। তিনটেয়। কেন এমন হল? অথচ খুব একটা বেশি রাতেও ঘুমোইনি। যাই হোক, ঘুম থেকে উঠে মুখে-চোখে জল দিয়ে চায়ের একটু ব্যবস্থা করে যখন জানালার ধারে এসে দাঁড়িয়েছি, তখনই বাইরের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই মনে হল, ঘুম যখন ভাঙেই আর উঠতেও যখন হয় তখন এইভাবে বদ্ধ ঘরের মধ্যে আটকে না থেকে একটু মর্নিং-ওয়াক করে নিলে কেমন হয়? মনে হওয়ামাত্রই আমার শরীরচর্চার সঙ্গে আর-একটা নতুন মাত্রা যোগ করে দিলাম।

ডেকে তুললাম রাখহরিকে।

ওকে দরজায় খিল দিতে বলে আমি বাইরে বেরোলাম। এখনও চারদিক অন্ধকারে ঢাকা। চৈত্রের প্রথম। তবুও মনে হচ্ছে, যেন মধ্যরাত। পাখিরা সবে জাগছে। দু’ একজন সাইকেল আরোহী টিং-টিং করে ঘণ্টি বাজিয়ে কোথায় যেন গেল। যে যেখানেই যাক, আমি আমার পথচলা শুরু করলাম।

মৌড়িগ্রাম এখন আর আগের মতো গ্রাম নেই। দ্বিতীয় হুগলি সেতু হয়ে যাওয়ার ফলে নিত্যনতুনভাবে তার চেহারা পালটাচ্ছে। আমি দ্রুত পা চালিয়ে রথতলার দিকে চললাম। হাঁটাটা একটু রপ্ত হয়ে গেলে আরও দূরে খুটির বাজার কিংবা প্রশস্তর দিকে চলে যাব। প্রশস্তর মূর্তি-মহল্লা বিখ্যাত।

মৌড়ি রথতলার কাছাকাছি যখন এসেছি তখন হঠাৎই একটা বাড়ির দিকে আমার নজর পড়ল। দেখলাম গেঞ্জি ও শর্টস পরা এক যুবক একজনের বাড়ির দোতলা থেকে কিছু একটা বেয়ে নীচে লাফিয়েই অন্ধকারে মিশে গেল। যুবকটির গায়ের রং কালো, বেঁটেখাটো চেহারা। ও যে চোর এবং চুরি করতে এসেছিল তা বোঝাই গেল।

আমি ধীরে ধীরে সেই বাড়িটার দিকে গেলাম। কাছে গিয়ে দেখলাম ওপরের ঘরের বারান্দার দিকের দরজাটা খোলা। বোধহয় গরমের জন্য। আর বারান্দার সঙ্গে লোহার হুকে আটকানো একটা নাইলনের ফিতে বাইরের দিকে ঝুলছে। চোর পালাবার সময় এটা না নিয়েই চলে গেছে। বাড়ির দরজায় নেমপ্লেট দেখেই চমকে উঠলাম আমি। আরে, এ যে প্রোফেসর এম. এল. বোসের বাড়ি। ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল না। কিন্তু শুনেছি উনি অত্যন্ত গুণী মানুষ। হাওড়ারই কোনও একটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। ওঁর কোচিং-এরও নামডাক আছে খুব।

একবার ভাবলাম চোরটার পেছনে একটু তাড়া লাগালে হত। যদিও দৌড়ের প্রতিযোগিতায় ওর সঙ্গে আমি পেরে উঠতাম না, তবু একটা শোরগোল ওঠানো যেত। কিন্তু ব্যাপারটা এমনই আচমকা ঘটে গেল যে, তখন আর কিছুই করবার ছিল না আমার।

আমি অনেকক্ষণ সেই জায়গাটায় পায়চারি করে। আকাশ একটু ফরসা হলে প্রোফেসরের বাড়ির দরজায় নক করলাম।

ভেতর থেকে সাড়া এল, “কে?”

তারপর সদ্য ঘুমভাঙা এক মহিলা বেরিয়ে এসে বললেন, “কাকে চাই?”

“প্রোফেসর বোস আছেন?”

“উনি এখন ঘুমোচ্ছেন। এখন তো দেখা হবে না। বেলায় আসবেন।”

“ওঁকে একবার ডাকুন, ডেকে বলুন বাড়িতে চোর এসেছিল।”

মহিলা ভয়েই হোক, বা যে-কোনও কারণেই হোক ‘ও মাগো’ বলে আমার মুখের ওপর সশব্দে বন্ধ করে দিলেন দরজাটা।

আমি আর কী করি, বাধ্য হয়েই বাড়ি ফিরে এলাম।

রাখহরি বলল, “আজ এত ভোরে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন দাদাবাবু?”

“মর্নিং-ওয়াকে। শুধু আজ নয়, এবার থেকে রোজই আমি বেরোব। মর্নিং-ওয়াকটা আমার কাছে এখন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।”

“কিন্তু আপনার মতো লোকের পক্ষে অত ভোরে একা ওইভাবে বেরনোটা কি ঠিক? কে কখন সন্ধান নিয়ে পিছু নেয়, তা কে বলতে পারে?”

“ও-ভয় করলে তো ঘর থেকেই বেরনো যাবে না রে। আজ শুধু হাতে গেছি। কাল থেকে তৈরি হয়েই বেরোব। যাক, তুই এখন বেশ জুতসই করে একটু চা কর দিকিনি।”

রাখহরি ওর কাজে গেল।

আমি ইজিচেয়ারটা বাইরের বাগানে এনে আমার প্রিয় রঙ্গন গাছগুলোর কাছে গিয়ে বসলাম।

একটু পরেই কাগজওয়ালা কাগজ দিয়ে গেল। সেইসঙ্গে একটা দুঃসংবাদ।

কাগজওয়ালা বলল, “জানেন তো চ্যাটার্জিদা, একটা খুব খারাপ খবর আছে আজ। কাগজে নেই অবশ্য খবরটা, তবে কালকের কাগজে নিশ্চয়ই বেরোবে।”

“কীরকম।”

“প্রোফেসর এম.এল.বোস খুন হয়েছেন।”

আমার তো আঁতকে ওঠার পালা। বললাম, “সে কী।”

“হ্যাঁ। শুধু তাই নয়, খুনি খুন করে নীচের দিদিকে জানিয়েও গেছে।”

রাখহরি তখন চা আর টোস্ট নিয়ে এসেছে। আমি কোনওরকমে ওর হাত থেকে সেটা নিয়ে মাটিতে ঘাসের ওপর নামিয়ে রাখলাম।

কাগজওয়ালা বলল, “এই ধরনের অজাতশত্রু মানুষের যদি এই অবস্থা হয়, তা হলে দেশের পরিস্থিতি কীরকম এবার বুঝতে পারছেন তো?” বলে চলে গেল।

আমি কঁপা কাঁপা হাতে টোস্টে কামড় দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। এই মুহূর্তে নিজের ওপর দারুণ রাগ হল আমার। কেন যে ভোরবেলা সেই খুনিটার পেছনে ধাওয়া করলাম না, তা ভেবেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই মুহূর্তে আগাগোড়া ঘটনাটা পুলিশকে জানানো দরকার। তারপর যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতে হবে আততায়ীকে।

থানায় গিয়ে পুলিশকে সব কথা বলতেই ইনস্পেক্টর ত্রিবেদী বললেন, “অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন আপনার এবং আততায়ীর মধ্যে দূরত্ব এতটাই ছিল যে, আপনি উদ্যম নিলেও ধরতে পারতেন না।”

“ঠিক তাই।”

“তবু খুনির চেহারার একটু বর্ণনা দিতে পারেন?”

“বেঁটেখাটো চেহারা। শর্টস আর গেঞ্জি পরে ছিল।”

“মুখে বসন্তের দাগ ছিল কি?”

“দূরত্বের জন্য বোঝা যায়নি।”

মি. ত্রিবেদী একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, “মনে হয় চোর-গণেশ। ছোটখাটো যত চুরিটুরির প্রধান হচ্ছে ও। তবে কিনা এইরকম খুন-জখমের মতো জঘন্য অপরাধের কোনও রেকর্ড ওর নেই। আচ্ছা, লোকটাকে আর একবার দেখলে আপনি চিনতে পারবেন?”

“না পারাই স্বাভাবিক। আমি যখন রথতলার। বাঁকের মুখে এসেছি, ও তখন দড়ি বেয়ে ঝুপ করে নেমে পালাল।”

ত্রিবেদী একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, “ঠিক আছে। চলুন একবার ঘটনাস্থলে যাওয়া যাক।”

আমি বললাম, “যেতে তো হবেই ত্রিবেদীজি। তবে একটা কথা, এই খুনের তদন্তটা কিন্তু আমি করব। আপনারা আমাকে হেলপ করবেন।”

“অন্তত এই একটা ব্যাপারে আপনি আমাদের পরম বন্ধু। আপনার সহযোগিতা আমাদের কাছে অলওয়েজ অ্যাকসেপ্টেবল।”

আমরা একটুও দেরি না করে ঘটনাস্থলে চলে এলাম।

সেই দিদি তো আমাকে দেখেই চমকে উঠলেন। বললেন, “এই তো। এই বাবুই আমাকে খবর দিয়েছিলেন। উনি চলে যাওযার পর ওপরে গিয়েই দেখি এই কাণ্ড। আমি তো ভয়েই মরি। ভাবলাম উনিই বোধহয় বাবুকে খুন করে আমাকে জানিয়ে গেলেন। এখন তো দেখছি উনি পুলিশেরই লোক।”

ইনস্পেক্টর ত্রিবেদী এবং আমি বাইরের লোকজনের ভিড় ঠেলে ওপরে উঠে গেলাম। নীচের কনস্টেবলরা ভিড় কন্ট্রোল করতে লাগল।

আমরা ঘরে ঢুকেই দেখলাম মি. বোস মাথায় আঘাতের চিহ্ন নিয়ে চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর মাথা রেখে এমনভাবে পড়ে আছেন, যাতে মনে হচ্ছে অত্যন্ত ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে নিদ্রা যাচ্ছেন তিনি। টেবিলের ওপরে একটা ফুলদানি আছে। সম্ভবত এই ফুলদানিটা দিয়েই ওঁর মাথার ব্রহ্মতালুতে আঘাত করা হয়। ওঁর হাতের মুঠোয় আছে একগোছা রজনীগন্ধা। টেবিলের ওপর একটা বিদেশি গোয়েন্দা গল্পের বই এবং একটি ‘সুইসাইড নোট’। একটি ফুলস্ক্যাপ কাগজের ওপর লেখা আছে ‘আমিই খুনি’। লেখার নীচে ওঁর সই।

রহস্যময় ব্যাপার। রহস্যময় এই কারণে যে, উনি যদি নিজের মাথায় ফুলদানি দিয়ে আঘাত করে থাকেন, তা হলে সেটা ওইভাবে টেবিলের ওপর থাকতে পারে না। সুইসাইড নোটে কেউ নিজেকে নিজের খুনি বলে লিখে রাখে না। আর তার চেয়েও আশ্চর্যের ব্যাপার যেটা, সেটা হল ওই রজনীগন্ধা ফুলগুলো। এই ফুলগুলো ওঁর হাতের মুঠোয় এল কীভাবে?

এইবার ঘরের অন্যান্য জিনিসপত্রের দিকে নজর দেওয়া হল। সবই ঠিকঠাক আছে শুধু স্টিলের আলমারিটাই যা লন্ডভন্ড। তার মানে খুনি যার লোভে এই কাজ করেছে তা পেয়ে অথবা না পেয়েই করেছে এই কাজ। ওই আলমারিতেই একটি খাতায় লেখা ছিল ওঁর সঞ্চয়ের হিসেবনিকেশ। প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার মতো ইন্দিরা বিকাশ কিনেছিলেন উনি, তার একটিও নেই। জাতীয় সঞ্চয়ের কিছু কাগজ ছেঁড়াখোঁড়া অবস্থায় পড়ে আছে। সেও প্রায় দেড় লাখ টাকার মতো। ব্যাঙ্কে এফ.ডি-র জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা দেওয়ার ফর্ম ফিল আপ করেছিলেন, কিন্তু ফর্ম আছে, অথচ টাকা নেই। অর্থাৎ খুনি এটাকেও হাতিয়েছে। এই টাকাটা সম্ভবত কোনও পলিসি ম্যাচিওর হওয়ার পর জমা পড়তে যাচ্ছিল। খুনি সেটা জানত।

ত্রিবেদী বললেন, “কী বুঝলেন মি. চ্যাটার্জি?”

“রীতিমতো সন্ধানী চোর।”

“কিন্তু ওই সুইসাইড নোটের অর্থ কী?”

“বোঝা যাচ্ছে না। তবে লেখাটা ওঁরই। কেননা ওঁর খাতাপত্র বা অন্য লেখাটেখা দেখে এই লেখার কোনও গরমিল পাচ্ছি না।”

এবার আমরা বারান্দার কাছে এসে একজোড়া পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম। পরে আরও লক্ষ করে ঘরের ভেতর পর্যন্ত একই পায়ের যাওয়া-আসার ছাপ স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমরা। আততায়ী জুতো পরে আসেনি। সে এসেছিল ধুলোমাখা খালি পায়ে। কিন্তু সেই পায়ের ছাপ বোসবাবুর চেয়ারের কাছ পর্যন্ত আছে, তারপর আর নেই। তা হলে স্টিলের আলমারি ভেঙে জিনিসপত্রগুলো চুরি করল কে?

আমি ওঁর সম্পত্তির হিসেব লেখা খাতা ও ডায়েরিটা আদায় করে পুলিশকে বললাম, “আপনারা এবার আপনাদের কাজ করুন। আমি ততক্ষণ দিদির সঙ্গে একটু কথা বলে আসি।”

কাজের দিদি নীচের ঘরে বসে নীরবে চোখের জল মুছছিলেন। আমি গিয়ে বললাম, “আপনাকে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।”

উনি বললেন, “বেশ তো, করুন।”

“আপনি এখানে কতদিন আছেন?”

“তা ধরুন না কেন, বছর পনেরো।”

“আগে কোথায় ছিলেন? আপনার কে কে আছে?”

“আগে দেশে ছিলাম। আমার কেউ নেই। গরিব মানুষ, বিধবা। উনি আমাকে ওঁর চরণে ঠাঁই দেন।”

“বোসবাবুর কে কে আছেন? এখানে অথবা দেশের বাড়িতে?”

“উনি তো আমারই দেশের লোক। দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নেই বহু বছর। কেননা যা যেখানে ছিল সবই বেচেবুচে দিয়ে এইখানে এসে বাড়ি করেছেন। ওঁরও কেউ কোথাও নেই। বিয়ে করেছিলেন, ছেলেপুলে হয়নি। বউদিমণি মারা গেছেন ক্যান্সারে। তারপর উনি আর বিয়েও করেননি। তবে কিছুদিন ধরে বলছিলেন অবসর নেওয়ার পর থেকে তীর্থে তীর্থে ঘুরবেন। তা কোন তীর্থে যে উনি চলে গেলেন বাবা, তা কে জানে?”

“আচ্ছা, সম্প্রতি ওঁর সঙ্গে কি কারও মনোমালিন্য হয়েছিল?”

“না বাবা। সকলে ওঁকে দেবতার মতো ভক্তিশ্রদ্ধা করত।”

“কাল উনি কখন ফিরেছেন? কতক্ষণ কাজ করেছেন? কে কে দেখা করতে এসেছিল ওঁর সঙ্গে?

“উনি তো কাল কলেজে যাননি। কী একটা বই লিখবেন বলে ক’দিনের ছুটি নিয়েছেন। ছাত্র-ছাত্রীও আসেনি কেউ। বাইরের কেউও আসেনি দেখা করতে। শুধু ভোরবেলা আপনিই যা এসেছিলেন।”

কাজের দিদির কথায় একটু আলোর ইশারা পেলাম। অর্থাৎ সুইসাইড নোটের রহস্যটা একটু পরিষ্কার হল। উনি তা হলে বই লিখতে যাচ্ছিলেন। আর সেই বইটার, অথবা সেই বইয়ের কোনও গল্পের নাম নিশ্চয় ‘আমিই খুনি’। হয়তো-বা ওই ইংরেজি বইয়ের কোনও গল্পের অনুবাদ করতে বসেছিলেন। আর ঠিক সেই সময়ে খুনি এসে তার ফায়দাটা লুটেছে। কিন্তু কীভাবে?

আমি আবার ওপরে উঠে এসে বোসবাবুর টেবিলের ওপর রাখা সেই ইংরেজি বইটার পাতা উলটেই এমন একটা গল্প দেখতে পেলাম, যার বাংলা করলে নামটা দাঁড়ায় ‘আমিই খুনি’। বইটা ত্রিবেদীকে দেখাতে তিনিও চমকে উঠলেন। বললেন, “আরে, তাই তো। আমরা তো এতক্ষণ ভুল সিদ্ধান্তে যাচ্ছিলাম।”

আমার মনের মধ্যে তখন একটাই দুশ্চিন্তা তোলপাড় করতে লাগল, খুনি কে? তার পায়ের ছাপ মৃতের কাছ পর্যন্ত গেল কিন্তু আলমারির কাছে নেই কেন? আর মৃতের হাতের মুঠোয় ওই রজনীগন্ধার অর্থ কী?

দুপুরবেলা ঘরে বসে নিজের মনে কত কী চিন্তা করতে লাগলাম। কোন সূত্র ধরে এই তদন্তের কাজে কীভাবে এগোব তা কিছুতেই ভেবে পেলাম না। আততায়ী একমাত্র পদচিহ্ন ছাড়া আর কোনও চিহ্ন রেখে যায়নি। বোসবাবুর সম্পত্তির হিসেব লেখা খাতায় ষাট ভরি সোনার গয়নার উল্লেখ আছে, কিন্তু সেই গয়নাও মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে উধাও। অমন একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত এমন অমূল্য সম্পদ লকারে না রেখে কেন যে ঘরে রেখেছিলেন, তা ভেবে পেলাম না। হয়তোবা এইসবের প্রতি কোনও মোহ ছিল না, তাই।

যাই হোক, আমি যখন বসে বসে এই নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি, ঠিক তখনই টেলিফোনটা সশব্দে বেজে উঠল। ফোন ধরতেই ত্রিবেদীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “মি. চ্যাটার্জি, শিগগির একবার আসুন। বোধহয় আপনার খুনি ধরা পড়েছে।”

বোধহয়? তবুও আমি এক মুহূর্ত দেরি না করে থানায় এলাম। দেখলাম বেঁটেখাটো চেহারার একজন লোককে লকআপে রাখা হয়েছে। এই চোর-গণেশ। লোকটাকে এই এলাকায় বহুবার দেখেছি। তবে নাম জানতাম না। আমাকে দেখেই কেঁদে ফেলল সে। বলল, “আমাকে বাঁচান বাবু। আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। সুযোগ পেলেই ছোটখাটো চুরিচুরি একটু-আধটু করে থাকি বটে, তবে এই সমস্ত খুনখারাপির ব্যাপারে আমি নেই। দরকার হলে আপনার পুলিশ-কুকুর আনান, দেখবেন সে আমার দিকে ফিরেও তাকাবে না। শুধু আমি কেন, ওঁকে খুন করবে এই অঞ্চলে এমন কেউ নেই।”

আমি চোর-গণেশের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললাম, “এ-লোকটাকে ছেড়ে দিতে পারেন। এর পায়ের সঙ্গে ওই ঘরের ভেতরের পায়ের ছাপ মিলছে না। তার এক পায়ে ছ’টা আঙুল ছিল।”

এই কথা শুনেই লাফিয়ে উঠল চোর-গণেশ, “কী বললেন বাবু, ছ’টা আঙুল ছিল? বাঁ পায়ে কি?”

ত্রিবেদী উৎসাহিত হয়ে বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাঁ পায়ে। তুমি চেনো তাকে?”

“চিনি মানে? ওর জামার কলার ধরে এখনই ওকে টেনে আনছি আপনার কাছে। সামান্য ক’টা টাকার লোভে শেষপর্যন্ত এই কাজ করল ও?”

“ও কে?”

“সুবল বাগ। ঘরামির কাজ করে। আমি এখনই টেনে আনছি ওকে। দু’নম্বর বস্তিতে ঘর ছাইতে গেছে ও।”

চোর-গণেশকে ছেড়ে দেওয়া হল। লোকটা বোধহয় ম্যাজিক জানে, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সে মারতে মারতে যাকে নিয়ে এসে হাজির করল তার নাম সুবল বাগ।

সুবল প্রথমেই এসে ত্রিবেদীর পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ল। তারপর আমার পায়ে। বলল, “অপরাধ নেবেন না হুজুর। আমি চোর বটে, তবে খুনি নই।”

ত্রিবেদী বললেন, “তা হলে কি সাধু?”

আমি ইশারায় ত্রিবেদীকে চুপ করতে বললাম।

সুবল বলল, “হুজুর, কাল অনেক রাতে বেগড়ি থেকে একজনের ঘর ছেয়ে খটিরবাজারে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। এমন সময় হঠাৎ দেখি, সুন্দরপানা এক ভদ্রলোক বাবুর বাড়ির দোতলা থেকে কী একটা বেয়ে নামল। তার কাঁধে ছিল একটা ঝোলা-ব্যাগ। পায়ে মোজা। নীচে নেমেই জুতো পরে একটা ভটভটিতে চেপে কোথায় যেন চলে গেল। বাবুর ওপরের ঘরে তখন আলো জ্বলছে। আমি তখন ব্যাপারটা কী হল তা বোঝবার জন্য কাছে গিয়ে দেখি একটা নাইলনের ফিতে ওপর থেকে ঝুলছে। দেখেই কেমন সন্দেহ হল। আমাদের মতো চোরেরা ফিতে ধরে ওঠে না, আবার ভটভটিও চাপে না। তাই কৌতূহলী হয়ে সেই ফিতে ধরে ওপরে উঠেই দেখি এই কাণ্ড। বাবু টেবিলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছেন। দু’চোখ বোজা। আস্তে করে দু’বার ডেকে সাড়া না পেয়ে বুঝলাম বাবুর দেহে প্রাণ নেই। টেবিলের ওপর ফুলদানিটা কাত হয়ে পড়ে ছিল। ঘরের মেঝেয় ফুলদানির জল। সেটাকে ঠিক করে রেখে গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম শরীরে তখনও উত্তাপ আছে যদিও, তবুও উনি মৃত। আমি তখন আলোটা নিভিয়ে দিলাম। কেননা দারুণ ভয়ে হাত-পা কাঁপছে আমার। যদি কেউ নামবার সময় আমাকে দেখে ফেলে তা হলে আমাকেই খুনি ভাববে। তাই কোনওরকমে পালিয়ে বাঁচলাম। কিন্তু বেঁচেও কি রেহাই পেলাম? আমার পায়ের ছাপের জন্য ধরা পড়ে গেলাম। বাবুরা বিশ্বাস করুন আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ।”

আমি বললাম, “তুমি তখন ওই লোকটাকে নামতে দেখে চেঁচালে না কেন?”

“ভয়ে। কেননা ওই জোয়ান লোকটা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে আমি ওর সঙ্গে পেরে উঠতাম না। তা ছাড়া ওইসব লোকের কাছে গোলাগুলিও থাকে।”

“তুমি তখন পুলিশে খবর দিতে পারতে!”

ত্রিবেদী বললেন, “যাক, এসব তো হল। এখন ওই বাবুর ঘর থেকে কী কী জিনিস চুরি করেছিলে তুমি?”

“হুজুর, মা-বাপ। ওই খুন দেখেই আমার সব কিছু তখন মাথায় উঠে গেছে। তা ছাড়া ওই সমস্ত নামীদামি লোকের ঘরে চুরি করবার মতো দুর্মতি আমার হয় না বাবু। আসলে হয় কী, পেটে টান পড়লে তখনই…।”

যাই হোক, সুবলের অকপট স্বীকারোক্তি বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হল। কেননা ও মৃতের কাছ পর্যন্ত যে গিয়েছিল, সে-প্রমাণ আমরাও পেয়েছি। কিন্তু আলমারির কাছে ওর কোনও পদচিহ্ন ছিল না। চতুর খুনি মোজা পরে ঘরে ঢোকার ফলে তারও পায়ের ছাপ কিছু পাওয়া যায়নি। তাই সামান্য জিজ্ঞাসাবাদের পর সুবলকেও ছেড়ে দেওয়া হল।

সন্ধেবেলা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এল। বোসবাবুকে প্রথমে শ্বাসরোধ করে, পরে মাথায় ফুলদানির ঘা দিতেই আঘাতজনিত কারণে মারা যান বোসবাবু। পুলিশ কুকুরও এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে কোনওরকম আলোকপাত করতে পারেনি আমাদের।

পরদিন সকালে আমি আবার বোসবাবুর বাড়ি গেলাম। কাজের দিদি তখন অত্যন্ত কান্নাকাটি করছিলেন। বললেন, “বাবা, তুমি আমার ছেলের মতো। এই অনাথিনীর একটা ব্যবস্থা করে দাও বাবা। আমাকে কোনও একটা আশ্রমে পাঠিয়ে দাও। কেউ কোথাও নেই আমার। এই বাড়িতে একা আমি কী করে থাকব, কী খাব? আর শোনো, বউদিমণির গয়নার বাক্সটা নীচের ঘরে থাকত। তাই ওটা চোরে নিয়ে যেতে পারেনি। ও তুমি থানায় জমা দিয়ে দাও। ও আমি কতদিন আগলে রাখব বাবা? কার জন্য রাখব?”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “বউদিমণির গয়নার বাক্স আপনার কাছে থাকত কেন?”

“ওগুলো নীচের ঘরের আলমারিতে থাকত। তার চাবি আমার কাছে। আমি যে বাবুর মায়ের মতো, দিদির মতো ছিলাম বাবা। উনি যে আমাকে খুবই বিশ্বাস করতেন।”

কাজের দিদির এই কথা শুনে শ্রদ্ধায় মাথাটা নত হয়ে এল আমার। আজকের দিনে এমন নির্লোভ মানুষও হয়? এইজন্যই এই মহিলাকে দেবীর আসনে বসিয়েছিলেন বোসবাবু। আমি বললাম, “আপনার কোনও চিন্তা নেই দিদি। আপনি এই বাড়িতেই থাকবেন। পরে আপনার ব্যাপারে একটা ব্যবস্থা নেব। সেরকম হলে আপনি নীচের তলাটা ভাড়া দিয়ে ওপর তলায় থাকবেন।” তারপর বললাম, “আচ্ছা, একটু মনে করে দেখুন তো, ওঁর এই বিষয়সম্পত্তির দাবি করতে পারে এমন কেউ কি কোথাও নেই?”

“আমার অন্তত জানা নেই বাবা। তবে ওঁর এক দূর সম্পর্কের জ্যাঠতুতো দাদা কাশীতে ছিলেন। শুনেছি তিনিও মারা গেছেন। তাঁর একমাত্র ছেলে খোকনবাবু এবার এখানে এসে এক রাত ছিলেন।”

“কতদিন আগের কথা?”

“এই তো গত মাসে। তা, বাবু ওঁকে কিছু টাকাও দিয়েছেন। বলেছেন আর কখনও যেন এখানে না আসেন।”

“বাবু ওকে এখানে আসতে বারণ করলেন কেন? সে-ব্যাপারে কিছু কি জানেন?”

“না। তবে শুনেছি উনি বাবুকে এখানকার বাড়ি বেচে দিয়ে কাশীতে গঙ্গার ধারে একটা বাড়ি কিনে চলে যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। সেৱকম বাড়িও নাকি ওঁর সন্ধানে আছে। তা বাবু একদমই রাজি হননি।”

“আপনি ওদের কাশীর বাড়ির ঠিকানাটা জানেন?”

“না বাবা, তাও জানি না।”

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “খোকনবাবু যা লোক দেখছি তাতে মনে হয় ওঁকে একটা খবর দেওয়া একান্তই দরকার। কেননা যদি কখনও এই বাড়ির দাবি করে উনি কোর্টে যান তখন কিন্তু আপনি মুশকিলে পড়ে যাবেন।”

দিদি চোখের জল মুছে বললেন, “আমার আর মুশকিল কী বাবা? যাদের যা পাওনা তারা তাই নেবে। আমাকে দয়া করে থাকতে দেয় দেবে, না দেয় তোমরা কোনও একটা আশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ো আমাকে। শেষমেশ ভিক্ষে করব। তাও যদি না জোটে গঙ্গায় জল তো আছেই বাবা।”

আমি তখন দিদিকে বললাম গয়নার বাক্সটা দেখাতে। দিদি আলমারি খুলে বাক্স বের করে দেখালেন। ওই আলমারিতেও অনেক পুরনো কাগজ ও চিঠিপত্র ছিল। হঠাৎ একটি চিঠি দৃষ্টি আকর্ষণ করল আমার। চিঠিটা এসেছিল কাশীর পাঁড়েঘাট থেকে। চিঠিটা লিখেছেন নিশিকান্ত বসু। সম্ভবত ইনিই বোসবাবুর সেই দূর সম্পর্কের জ্যাঠতুতো দাদা। চিঠিটা এই: “বউমার মৃত্যুসংবাদ লোকমুখে শুনে অত্যন্ত দুঃখ পেলাম। আরও দুঃখ পেলাম তুমি দেশের পাট চুকিয়ে হাওড়ায় বাড়ি কিনেছ বলে। তাই আমার অনুরোধ, যদি তুমি কাশীর এই বাড়িটা কিনে রাখো তা হলে এই বৃদ্ধ বয়সে আমি একটু নিশ্চিন্ত হই। তোমার বাড়ি তোমারই থাকবে। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। আর আমি বেঁচে যাই ভাড়া গোনার হাত থেকে। মাত্র পঁচিশ হাজার টাকা হলেই বাড়িটা কিন্তু তোমার হয়ে যায়। ছেলেটাকে মানুষ করতে পারিনি। আমার জীবনের এইটাই চরম ব্যর্থতা।”

আমি চিঠিটা পকেটে রেখে গয়নার বাক্সটা দিদিকে ফেরত দিলাম। বললাম, “এখনই এটা থানায় জমা দেওয়ার কোনও প্রয়োজন দেখছি না। সাবধানে থাকবেন। বাড়ির বাইরে যাবেন না। আর অচেনা কেউ এলে বাড়ির দরজা খুলবেন না।”

দিদি আমার কথায় সায় দিয়ে হ্যাঁ বললেন।

আমি বাড়ি ফিরে এলাম। এসে আবার বোসবাবুর ডায়েরিটা নিয়ে বসলাম। একমাস আগের একদিনের পাতায় লেখা আছে, “পুরনো পরিচয়ের সূত্র ধরে খোকন এসে হাজির। প্রথমে ওকে চিনতেই পারিনি। পরে পরিচয় দিতে চিনলাম। ও কাশীর একটি চার লাখ টাকার বাড়ির দালালি করতে এসেছে। আমাকে ওই বাড়িটা কেনবার জন্য বিশেষভাবে চাপ দিতে লাগল। কিন্তু আমি রাজি হলাম না। শেষমেশ ও আমাকে ওর নানারকম বিপদের কথা বলে দশ হাজার টাকা চাইল। আমি ওকে তাও দিলাম না। বললাম, আমার সব টাকাই এখন ব্যাঙ্ক ও পোস্ট অফিসে ডবল ইনভেস্টমেন্ট-এ আছে। এমনকী, ওর বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য আলমারি থেকে কাগজপত্রগুলোও বের করে দেখালাম। তারপর হাজারখানেক টাকা ওর হাতে দিয়ে বিদায় করলাম ওকে, এবং এও জানালাম, ভবিষ্যতে আর কখনও যেন ও আমাকে এইভাবে বিরক্ত করতে না আসে।”

এই ডায়েরি পড়ে মনে মনে আমি স্থির করলাম যেভাবেই হোক একবার কাশীতেগিয়ে ওই খোকনবাবুর সঙ্গে আমাকে দেখা করতেই হবে। ঠিকানা না থাকলেও পাঁড়েঘাটের ওদের সেই পুরনো বাড়ি থেকেই শুরু হবে আমার অনুসন্ধান। একান্ত খুঁজে না পাই তদন্তের কাজে গিয়ে বারাণসী ভ্রমণ তো হবে। জয় বাবা বিশ্বনাথ।

কিন্তু ভাগ্য আমার এতই ভাল যে, কাশীযাত্রা আর করতে হল না। হঠাৎই সন্ধেবেলা এক অবাঙালি যুবক দেখা করতে এল আমার সঙ্গে, “আপনিই মি. অম্বর চ্যাটার্জি? মানে প্রাইভেট ডিটেকটিভ…।”

“হ্যাঁ আমিই। আপনার পরিচয়?”

“আমার নাম শিবকুমার শর্মা। আমার বাড়ি বারাণসীতে। আমি সালকিয়ায় থাকি।”

“কী ব্যাপার বলুন তো?”

“শুনলাম, আপনি নাকি মি. বোসের খুনের ব্যাপারে তদন্ত করছেন। তা এই ব্যাপারে আমার বন্ধু খোকনবাবু একটু দেখা করতে চান। কেননা মি. বোসের ওই বাড়ি এবং তার অন্যান্য সম্পত্তির ও-ই এখন একমাত্র দাবিদার।”

“আপনার সেই বন্ধুটি কোথায়?”

“বাইরে অপেক্ষা করছে।”

“বাইরে কেন? ভেতরে নিয়ে আসুন।”

“আসলে এই মর্মান্তিক সংবাদে ও খুব ভেঙে পড়েছে। মাসখানেক আগে একবার ও এখানে এসেছিল। সেই শেষ দেখা।”

“ঠিক আছে। ওঁকে আসতে বলুন।”

রহস্যের গন্ধ পেয়ে আমি অস্থির হলাম।।

একটু পরেই শিবকুমার যাকে নিয়ে ভেতরে এল সুবল বাগের বর্ণনার সঙ্গে তার হুবহু মিল। ওরা ঘরে এসে আসন গ্রহণ করলে বললাম, “আপনারই নাম খোকনবাবু?”

“হ্যাঁ, ভাল নাম রজনীকান্ত বোস।”

“কিন্তু আপনি যে সেই লোক তার প্রমাণ কী? আপনাকে চেনে এমন কেউ কি আছে এখানে?”

শিবকুমার বলল, “কেন, আমি আছি।”

“আমি তো আপনাকে চিনি না।” তারপর ওদের দু’জনের আপাদমস্তক আর একবার নিরীক্ষণ করে বললাম, “আচ্ছা ওই বাড়িতে যে কাজের দিদি আছেন তিনি কি চিনবেন আপনাকে?”

খোকনবাবু বললেন, “চিনবেন না মানে? মাত্র একমাস আগে আমি ওই বাড়িতে এসে এক রাত কাটিয়ে গেছি, এত তাড়াতাড়ি ভুল হবে কী করে? আমি এসেছিলাম দাদাভাইকে বুঝিয়েবাঝিয়ে কাশীতে নিয়ে যাব বলে। তা ওই মহিলার চক্রান্তেই সেটা হল না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওই মহিলাই সম্পত্তির লোভে খুন করিয়েছেন আমার দাদামণিকে।”

“কী এমন সম্পত্তি ছিল যে, তার লোভে মহিলা ওই কাজ করতে যাবেন?”

“কী ছিল না? সাড়ে তিন লাখ টাকার ইন্দিরা বিকাশ। দু’লাখ টাকার ‘কিষাণ বিকাশ’, ‘জাতীয় সঞ্চয় সার্টিফিকেট’। ব্যাঙ্কে এফ. ডি.-তে লক্ষাধিক টাকা আর ছিল প্রচুর সোনার গয়না। ওই মহিলা সবকিছুরই সন্ধান জানেন। তা ছাড়া দোতলা ওই বাড়িটার দামও নেহাত কম নয়।”

আমি বিস্মিত হওয়ার ভান করে বললাম, “ওরে বাবা, আপনি মাত্র এক রাত এই বাড়িতে থেকেই সবকিছু জানতে পেরেছেন?”

“আসলে উনি আমাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। তাই বিশ্বাস করে এ-কথা আমাকে বলেছিলেন, এবং এও বলেছিলেন শিগগিরই উনি এই সবই আমার নামে উইল করে দেবেন। এ-কথা জানতে পেরেই ওই মহিলা এই সর্বনাশটি ঘটিয়েছেন।”

“সর্বনাশ যে কে কীভাবে ঘটাল তা ভগবানই জানেন। কিন্তু রজনীবাবু ওরফে খোকনবাবু, ওঁর ডায়েরি যে অন্য কথা বলছে। আপনার কথার সঙ্গে তা তো মিলছে না।”

“কী লিখেছেন উনি ডায়েরিতে?”

“সে-কথা নাই-বা জানলেন?” বলে একটুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বললাম, “জাস্ট এ মিনিট। ছেলেটাকে একটু চা করতে বলে আসি।” বলে উঠে গিয়ে রাখহরিকে যা করতে হবে তা বুঝিয়ে দিলাম।

ও ঘাড় নেড়ে ওর কর্তব্যপালনে চলে গেল।

আমি আবার ঘরে এসে ওদের সামনে বসে বললাম, “বোসবাবুর মৃত্যুসংবাদটা আপনারা কীভাবে পেলেন?”

খোকনবাবু বললেন, “কেন, খবরের কাগজ মারফত পেয়েছি।”

“আপনি এখন থাকেন কোথায়?”

“বেনারসেই থাকি।”

“ওরে বাবা, আজকের কাগজে খবর পেয়ে আজই চলে এলেন?”

“না, না, আমি খবরটা পাই শিবকুমারের মারফত। ও-ই আমাকে ভোরবেলা ফোনে জানায়। আমি তখনই পূর্বা এক্সপ্রেস ধরে চলে আসি।”

“আজকের কাগজ তো ছ’টার পরে বেরিয়েছিল। আর বারাণসীতে পূর্বা এক্সপ্রেস ছাড়ে ভোর পাঁচটা দশে। এটা কী করে সম্ভব হল?”

“আসলে ট্রেনটা আজ এক ঘণ্টা লেট ছিল কিনা?”

“বুঝলাম। কিন্তু আজ বৃহস্পতিবার। আজ তো পূর্বা। এক্সপ্রেস বারাণসী দিয়ে আসে না।”

“তা হলে কি বলতে চান আমি মিথ্যে কথা বলছি?”

“না, না, তা কেন? আমারও ভুল হতে পারে। কিন্তু আমি যে এই ঘটনার তদন্ত করছি এ-কথা আপনাদের কে বলল?”

খোকনবাবু গদগদ হয়ে বললেন, “বাবা, কাল থেকে সবার মুখেই আপনার নাম। সবাই বলছে অম্বর চ্যাটার্জি যখন তদন্ত করছে খুনি তখন ধরা পড়বেই।”

“আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক ভাই। আজকের ভোরে মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সুদূর বারাণসী থেকে এই সবে এখানে এসে পৌঁছলেন আপনি, অথচ কাল সকাল থেকেই এই খুনের তদন্ত আমি করছি বলে আপনি জেনে গেছেন।”

শিবকুমার বলল, “ও-কথা আমিই বলেছি ওকে।”

“আপনিও তো মশাই আজই কাগজ পড়ে জেনেছেন খবরটা। এখানে ‘কাল’ আসে কোত্থেকে?”

শিবকুমার চুপ করে গেল।

আমি খোকনবাবুকে প্রশ্ন করলাম, “আপনি কি ট্রেন থেকে নেমেই সোজা এখানে আসছেন?”

“হ্যাঁ।”

“ওরে বাবা, পূর্বা এক্সপ্রেস দেখছি আজকাল বিমানেরও আগে আসে। যাক, স্টেশন থেকে কীসে এলেন? হেলিকপ্টারে?”

“আপনি কি আমাদের বিদ্রুপ করছেন? আমরা আমাদের স্কুটারে এসেছি।”

“আপনার জিনিসপত্র?”

“কিছুই আনিনি সঙ্গে।”

“বন্ধু নিশ্চয়ই আপনাকে এখানে নিয়ে আসবার জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন?”

“ঠিক তাই।”

এবার একটু যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগল শিবকুমার। বলল, “শুনুন মি. চ্যাটার্জি, আমার বন্ধুটি সবে ট্রেন থেকে নেমেছেন। এখন ওঁর একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। আপনার সঙ্গে পরিচয়পর্বটা সারা হয়ে গেল। আমরা কাল সকালে দেখা করব আপনার সঙ্গে। আজ তা হলে আসি, কেমন?”

“সে কী। আপনাদের জন্য চা করতে বললাম যে।”

“মাফ করবেন। আমরা কেউই চা খাই না।”

“তা হলে আমি যখন চায়ের কথা বললাম তখন আপনারা না করলেন না কেন?”

ওরা দুজনেই তখন যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল।

আমি গলার স্বর কঠিন করে বললাম, “এখন কিন্তু আপনারা যেতে পারবেন না। তার কারণ, যে-রাতে বোসবাবু খুন হন সে রাতে উনি কিছুমাত্র লিখে যেতে না পারলেও ওঁর হাতের মুঠোয় আমরা একগোছা রজনীগন্ধা পেয়েছি। তাতেই বুঝেছি রজনী নামের কারও কথা উনি মরণকালে বলতে চেয়েছিলেন। আর এখন এই ঘরেও একজন রজনী আছেন। তিনি এমন এক রজনী যিনি এক মাস আগে ওঁর সঙ্গে দেখা করে ওঁর নাড়িনক্ষত্র জেনেছেন এবং যাঁকে উনি পছন্দ করেননি। গত রাতে খুনি যখন খুন করে পালায় তখন আমাদেরই পরিচিত একজন লোক খুব কাছ থেকেই তাকে দেখে ফেলে। তারও দেওয়া বিবৃতির সঙ্গে এই রজনীর চেহারার জুতসই একটা মিল আছে। কাল রাতে খুনি পালাবার সময় একটা ভটভটি অর্থাৎ মোটরবাইক কিংবা স্কুটারে চেপে পালায়। আজ আপনারাও একটি স্কুটারে চেপেই এখানে এসেছেন।”

খোকনবাবু ও শিবকুমারের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

খোকনবাবু বললেন, “এর দ্বারা কি প্রমাণ হয় আমিই খুনি?”

“ইয়েস। নাউ ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।” বলতে বলতেই হাতে হাতকড়া নিয়ে ঘরে ঢুকলেন মি. ত্রিবেদী। সঙ্গে আরও পুলিশ। এমনকী সেই সুবল বাগও।

সে রজনীকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল, “এই, এই তো সেই লোক। একেই আমি দেখেছি কাল।”

ত্রিবেদী বললেন, “একজনকে খুনের অপরাধে এবং অন্য জনকে খুনিকে সাহায্য করার অপরাধে গ্রেফতার করা হল।”

রাখহরি তখন দূরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। আমার নির্দেশে সে-ই গিয়ে পুলিশে খবর দিয়েছিল।

আমি তখন খোকনবাবুকে বললাম, “কী রজনীবাবু, এই ব্যাপারে আর কিছু আপনার বলবার আছে?”

ক্লান্ত রজনী মাথা নত করে ঘাড় নাড়লেন।

“তা হলে আপনার অপরাধ আপনি স্বীকার করছেন তো?”

রজনীকান্ত অশ্রুসজল চোখে বলল, “হ্যাঁ। আমিই খুনি।”

শিবকুমারের দু’চোখে তখন আগুন জ্বলছে।

৬ নভেম্বর ১৯১৬

অলংকরণ: সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *