রহস্য যখন সামুদ্রিক
০১.
সেবার মার্চের শেষ সপ্তাহে চন্দনপুর-অন-সি-তে সমুদ্রবিজ্ঞানীদের সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়েছিলুম। পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুধু দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকারই একজন সাংবাদিককে সেখানে ডাকা হয়েছিল। তিনদিনের সম্মেলন। আমন্ত্রণপত্র হাতে পেয়ে খুব খুশি হয়ে আমার ফ্রেন্ড ফিলজফার অ্যান্ড গাইড কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে টেলিফোন করেছিলুম। কিন্তু তার প্রিয় পরিচারক ষষ্ঠীচরণ জানিয়েছিল তার বাবামশাই বাড়িতে নেই। কয়েকদিনের জন্য বাইরে গেছেন।
একটু অবাক অবশ্য হয়েছিলুম। কারণ তার সঙ্গে গত রবিবারেও দেখা হয়েছে। অথচ তিনি বাইরে কোথাও যাবেন এমন কোনো আভাস তাঁর কথায় পাইনি। অবশ্য তার খেয়ালের কথা আমার জানা। কোথাও বিরল প্রজাতির প্রজাপতি বা ক্যাকটাসের খবর পেলে তিনি সেখানে ছুটে যেতে দেরি করেন না।
চন্দনপুর-অন-সি-তে আমি এর আগেও কয়েকবার এসেছি। কিন্তু প্রত্যেকবারই কর্নেলের সঙ্গী হয়ে। সমুদ্রবিজ্ঞানীদের সম্মেলন চলেছে সেখানকার এক বিশাল অডিটোরিয়ামে। বিজ্ঞানীদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কয়েকটি হোটেলে আর সাংবাদিকদের জন্যে বিশেষ করে বরাদ্দ করা হয়েছে হোটেল দ্য শার্ক। এই হোটেলটি সমুদ্রের ধারে একটি সমতল জায়গায় নতুন গড়ে উঠেছে। থাকার জন্য ব্যবস্থাটা খুব মনোরম বলেই মনে হচ্ছিল। আমি উঠেছিলুম দোতলার পশ্চিম দিকের একটা সুইটে। ব্যালকনিতে বসলে ব্যাপকভাবে সমুদ্র। দেখা যায়। তাছাড়া ডানদিকে কিছুটা দূরে পুরোনো আমলের একটা লাইট হাউসও চোখে পড়ে। আমি জানি এ লাইট হাউসটা পোর্তুগিজদের তৈরি এবং বহুকাল ধরে পরিত্যক্ত। কারণ একটি নতুন লাইট হাউস গড়া হয়েছে আরও কিছুটা দূরে সমুদ্রের মধ্যে একটা ছোটো পাথুরে দ্বীপের ওপর।
সম্মেলনের আগের দিন সন্ধ্যার ট্রেনে পৌঁছেছিলুম। সেদিনই নীচের ডাইনিং-এ ভারতের নানা অঞ্চলের সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তাদের মধ্যে মাদ্রাজের দি ইন্টারন্যাশনাল অবজারভার পত্রিকার সাংবাদিক সুভদ্র বর্মন আমার চেনা। বয়সে বড়ো এই ধুরন্ধর সাংবাদিক সর্বত্র দেখেছি অনেকেরই প্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু কলকাতায় তার জন্ম বলে তিনি আমার বেশি অনুরাগী। সম্পর্কটা দাদা-ভাইয়ের মতো। বর্মনদা উঠেছেন দোতলায় মাঝামাঝি একটা সুইটে, যেটা সিঁড়ির পাশে।
সম্মেলনের প্রথম দিন তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং স্থানীয় নেতাদের ভাষণ, শেষে সমুদ্রবিজ্ঞান দপ্তরের এক বড়োকর্তার অসংলগ্ন দীর্ঘ বক্তৃতা, এই সব বিরক্তিকর ব্যাপারেই শেষ হয়েছিল। এক ফাঁকে বর্মনদা চুপিচুপি আমাকে নিয়ে কেটে পড়েছিলেন। কাজেই পুরো সময়ই যে সবাই ছিলুম তা বলা যাবে না। সমুদ্রের ধারে একটা ছোটো কাফেতে দুজনে কফি খেয়ে খাঁড়ির মাথায় একটা পাথরে বসে ছিলুম। কথায় কথায় বর্মনদা জিজ্ঞেস করলেন, আমার একটু অবাক লাগছে জয়ন্ত, এমন একটা সম্মেলনে তোমার বন্ধু ভদ্রলোক কেন আমন্ত্রিত হননি।
আমি তত কিছু না ভেবে বললুম, কর্নেল থাকলে কি আপনি তাকে এখানে কোনো রহস্যের পেছনে লড়িয়ে দিতেন?
বর্মনদা একটু হেসে চাপা স্বরে বললেন, কিছু বলা যায় না। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে সব কিছু ঠিকঠাক চলবে না।
অবাক হয়ে বললুম, তার মানে?
বর্মনদা একটু চুপ করে থাকার পর আস্তে বললেন, এখানে আসার আগে একটা গুজব শুনে এসেছি।
আগ্রহ দেখিয়ে বললুম, কী গুজব, বলতে আপত্তি আছে?
সুভদ্র বর্মন এতক্ষণে একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। আগের মতো চাপা স্বরে বললেন, কোনো এক মহিলা সমুদ্রবিজ্ঞানী নাকি জীববিজ্ঞানেও একটা বিস্ময়কর তথ্য আবিষ্কার করে ফেলেছেন। তিনি সেই বিষয়ে এই সম্মেলনে পেপার পড়বেন। বিষয়টা নাকি এমন গুরুত্বপূর্ণ যে তা সারা বিশ্বে হইচই ফেলে দেবে। তবে থাক, এ নিয়ে আর মুখ না খোলাই ভালো দেওয়ালেরও কান আছে। চলো, কেটে পড়া যাক।
হোটেলে ফেরার পথে বর্মনদা আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন ব্যাপারটা নিয়ে যেন আমি ঘুণাক্ষরেও কারো কাছে না বলি।
এরপর দ্য শার্ক-এ আমার ব্যালকনিতে বসে ডানদিকে পোড়ো লাইট হাউসের পাশ দিয়ে সূর্যাস্ত দেখছিলুম। সুভদ্র বর্মনের গুপ্ত কথা বা গুজব যা-ই হোক আমাকে কেন যেন জ্বালাতন করছিল। সত্যিই যদি এমন কোনো আবিষ্কারের কথা জানা যায় তাহলে কী ঘটতে পারে তা আঁচ করা যায়। সেই মহিলা বিজ্ঞানীর নিরাপত্তার প্রশ্ন এসে যেতে বাধ্য। কারণ আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি এমন সব ক্ষেত্রে বিদেশি চরচক্র সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে বিজ্ঞানীদের দলে মিশে যেতে পারে।
প্রতিটি সুইটের সামনে আলাদা এক টুকরো করে ব্যালকনি। একটু পরে দেখলুম আমার বাঁ পাশের ব্যালকনিতে গাঁট্টাগোট্টা চেহারার একজন তামিল সাংবাদিক একটা বই পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে পোডড়া লাইট হাউসের খাঁড়ির দিকে তাকাচ্ছিল।
তারপর দেখলুম হঠাৎ সে বই বুজিয়ে রেখে ঘরে ঢুকে গেল। আমি যা অনুমান করেছিলুম তা ঠিক। খাড়ির দিকে বড়ো বড়ো পাথর আর ঝোঁপঝাড়ের মধ্য দিয়ে সে হন্তদন্ত হেঁটে যাচ্ছে। ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে। কিন্তু সমুদ্রের ওপর থেকে রক্তিম ছটা মুছে যায়নি। আমি তীক্ষ্ণদৃষ্টে তামিল সাংবাদিককে খুঁজছিলুম। কিন্তু তাকে আর দেখতেই পেলুম না। তখনই ঘরে ঢুকে টেবিলবাতিটা জ্বেলে দিলুম। তারপর সম্মেলনে আমাদের যেসব কাগজপত্র দেওয়া হয়েছিল সেগুলো খুঁজে প্রথমে সাংবাদিকদের লিস্টটা বের করলুম। কিন্তু তামিল সাংবাদিক দুজন। একজন মি, রাঘবন, অন্যজন মি. চন্দ্রশেখর কুট্টি। দুজনেই প্রায় সমবয়সি। আমি কাগজগুলো রেখে আবার ব্যালকনিতে গিয়ে বসলুম। ততক্ষণে সমুদ্রের ধারে সারবদ্ধ আলো জ্বলে উঠছে।
কিছুক্ষণ পরে নিজের গোয়েন্দাগিরির প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে নীচের তলার ক্যান্টিনে গেলুম। ক্যান্টিনের একপাশে বার। সেখানে কয়েকজন উঁচু টুলে বসে মহাসুখে ড্রিঙ্ক করছে। আমি বারে গিয়ে এক জগ বিয়ার নিয়ে জানলার পাশে চেয়ারে বসলুম। তারপরই দেখলুম সেই তামিল সাংবাদিক ক্যান্টিনে ঢুকে উলটোদিকের একটা চেয়ারে বসল। এখন তার একজন সঙ্গী ছিল। সঙ্গীটিকে তামিল মনে হচ্ছিল না। গায়ের রং বেশ ফরসা। রোগা চেহারা। মাথায় একরাশ চুল। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। ক্যান্টিন-বয়কে ডেকে তারা চা আর পকোড়ার অর্ডার দিল।
একটু পরে দেখলুম বর্মনদা ক্যান্টিনে ঢুকছেন। আমাকে দেখতে পেয়েই হাসিমুখে তিনি এগিয়ে এলেন এবং আমার মুখোমুখি বসলেন। বললুম, দাদা, ছোটো ভাইকে বিয়ার খেতে দেখে যেন খাপ্পা হবেন না।
সুভদ্র বর্মন হাত বাড়িয়ে আমার কাঁধে একটু চাপ দিয়ে সহাস্যে বললেন, তুমি যদি বিয়ার খাও তাহলে দাদা হিসেবে আমার কী খাওয়া উচিত?
-হুঁইস্কি। বলে ওয়েটারকে ইশারা করলুম।
বর্মনদা বললেন, সত্যি ভাই জয়ন্ত, এবার আমি এখানে এসে মনে শান্তি পাচ্ছি না।
–আপনার অশান্তির কারণ কি সেই গুজব?
বর্মনদা চোখ টিপে সতর্ক করে দিয়ে আস্তে বললেন, না। একটা অদ্ভুত রকমের ঘটনা লক্ষ করছি। তখন কফি খেয়ে ফিরে আসার পর একটা টেলিফোন পেলুম। সেই মহিলা সমুদ্রবিজ্ঞানী সুভদ্রা ফাটনবিশ আমাকে ডিনারের আমন্ত্রণ করেছেন। তোমাকে আজ রাতের এই গোপন ডিনার খাওয়ার কথা বলে রাখছি, এর একটা কারণ আছে। ঝামেলার গন্ধ পাচ্ছি। তুমি ঠিক রাত দশটায় আমার সুইটে খোঁজ নিয়ে যদি দ্যাখো আমি তখনও ফিরিনি তাহলে তুমি তখনই আমাদের সম্মেলনের নিরাপত্তা দপ্তরের কর্তা আজিজ খানকে খবর দেবে। শুধু বলবে আমি কোথায় গিয়েছিলুম এবং এখনও ফিরছি না দেখে তোমার উদ্বেগ হয়েছে। তিনি যেন একটু খোঁজখবর নেন।
এইসব কথা শোনার পর স্বভাবত আমি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলুম। ততক্ষণে আমার বিয়ার খাওয়া শেষ হয়েছে। বর্মনদাকে জিজ্ঞেস করলুম, আর এক পেগ সেবন করবেন কি না! তিনি শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, নাঃ!
ওয়েটারকে ডেকে বিল মিটিয়ে এবং টিপস দিয়ে দুজনে ওপরে গেলাম। সুভদ্র বর্মন বললেন, একা নিজের ঘরে চুপচাপ বসে থাকবে, তার চেয়ে আমার ঘরে চলো।
তাঁর সুইটে গিয়ে বললুম, আচ্ছা ওই গাঁট্টাগোট্টা চেহারার তামিল সাংবাদিককে আপনি নিশ্চয়ই চেনেন। ক্যান্টিনে সে একজন রোগা ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিল, নিশ্চয়ই লক্ষ করেছিলেন।
বর্মনদা হেসে উঠলেন, তুমি রাঘবনের কথা বলছ? আরে ও কি সাংবাদিক হওয়ার যোগ্য? শ্বশুরের কাগজে ঢু মেরে ঢুকেছে। আমার সঙ্গে কয়েক মাস আগে আলাপ হয়েছিল। সব সময় তিলকে তাল বানিয়ে তোলা ওর অভ্যেস। ওদের কাগজের সব রিপোর্টার আড়ালে ওকে নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করে। কিন্তু হঠাৎ ওর কথা কেন?
এবার আমি সূর্যাস্তের পর যা দেখেছিলুম সবিস্তারে তা ওঁকে শোনালুম। শোনার পর বর্মনদা ভ্রু কুঁচকে কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, রাঘবনের একটা ব্যাপারে খুব বদনাম আছে। লোকটা লম্পট। তুমি তো চন্দনপুর-অন-সি-তে কয়েকবার এসেছিলে বলছিলে। তুমি নিশ্চয় জানো এখানে সন্ধ্যায় আগে থেকেই বারবনিতারা সেজেগুজে খদ্দেরের খোঁজ বেরিয়ে পড়ে। কাজেই তুমি যা দেখেছ তা তেমন কিছু গোপন নয়। বিশেষ করে খাঁড়ির ধারে পোড়ো লাইট হাউস এলাকা ভূতুড়ে বলে খুব বদনাম আছে।
বললুম, হ্যাঁ। তা শুনেছি।
নিশ্চয়ই কর্নেলসাহেবের কাছে?
হ্যাঁ। একবার কর্নেল নাকি একা এসে ভয়ঙ্কর একটা ঝড়ের পাল্লায় পড়েছিলেন। সেই ঝড়টার গড়ন নাকি সাপের মতো লম্বাটে। সমুদ্র থেকে উঠে এসে সেটা লাইট হাউসের মাথা ছুঁড়ে বেরিয়ে যায়।
বর্মনদা বললেন, শুনেছি ওই অদ্ভুত প্রাকৃতিক ঘটনার নাম স্থানীয় ভাষায় কান্ডিলম। অর্থাৎ হাওয়া-সাপ।
বললুম, কিন্তু বর্মনদা, আপনি আমার মাথার ভেতর ইতিমধ্যে একটা কান্ডিলম ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে।
বর্মনদা একটু হেসে বললেন, সমুদ্রবিজ্ঞানী ড. ফাটনবিশেষ ডিনারের আমন্ত্রণে আমি না করে দিলেও পারতাম। কিন্তু জয়ন্ত, তুমি তো জানো আমাদের এই পেশা অর্থাৎ সাংবাদিকতা কোনো কোনো সময় মাথায় জেদ চড়িয়ে দেয়। এখন তুমি সব কথা বুঝতে পারছ না। নিরাপদে ফিরতে পারলে তখন বুঝিয়ে বলব আমি কী ধরনের রিস্ক নিয়েছিলুম।
বললুম, ড. ফাটনবিশ কোন হোটেলে কত নম্বর সুইটে আছেন?
সুভদ্র বর্মন টেবিল থেকে একটা ছোটো প্যাড টেনে নিয়ে লিখে দিলেন।
দেখলুম লেখা আছে : ড. সুভদ্রা ফাটনবিশ হোটেল পূর্বাচল সুইট নং-২৩ দোতলা
পড়ে দেখে বললুম, এই হোটেলটা আমার খুবই চেনা বর্মনদা। রাস্তার উত্তর-পশ্চিম দিকে একটা টিলার মাথায়। এই হোটেলে একবার কর্নেলের সঙ্গে এসে কয়েকদিন কাটিয়েছিলুম।
বর্মনদা হাসলেন–সেবার কর্নেলসাহেব নিশ্চয়ই কোনো অপরাধ রহস্যে নাক গলাতে এসেছিলেন?
বললুম, হ্যাঁ। একটা খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছিল বটে। কর্নেল বলেন তার ভাগ্য বা দুর্ভাগ্য, যেখানেই যান সেখানেই নাকি কোনো এক অদৃশ্য আততায়ী তার সামনে একটা লাশ ছুঁড়ে ফেলে তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে। এবার কর্নেল আমার সঙ্গে নেই। কাজেই বর্মনদা, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, তেমন কিছু ঘটবে না। আমাকে নিরাপত্তা দপ্তরে টেলিফোনও করতে হবে না।
এরপর সমুদ্রবিজ্ঞান সম্মেলনে সেই ড. ফাটনবিশ তার আবিষ্কৃত তথ্যের পেপার পড়ে তাক লাগিয়ে দেবেন এই নিয়ে কিছুক্ষণ কথা হল। তিনি বাঙ্গালোরের সমুদ্র-সংক্রান্ত একটা গবেষণা-সংস্থায় অধ্যাপনা করেন। তার বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ। এখনও বিয়ে করেননি। কথায় কথায় জেনে নিলুম বর্মনদার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে। সেই সূত্রে এই ডিনারের আমন্ত্রণ। এটা অবশ্য স্বাভাবিক। সুভদ্র বর্মনের চেনাজানার পরিধি যে বিশাল তা আমি জানি। ওঁর ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় সকৌতুকে বললুম, একটা আশ্চর্য ব্যাপার, আপনি সুভদ্র আর উনি সুভদ্রা। তফাত শুধু একটা আকারের।
বর্মনদা হাসতে হাসতে বললেন, শুধু আকারের নয় ভাই জয়ন্ত, প্রকারেরও পার্থক্য আছে। তিনি প্রখ্যাত বিজ্ঞানী এবং মোটামুটি সুন্দরী। আর আমি একজন আগুনে পোড়া বুনো আলুর মতো কদর্য পদার্থ।
হঠাৎ আমার মাথায় একটা খেয়াল এল। বললুম, তার সঙ্গে আমার একটু আলাপ করিয়ে দেবেন? কাল মর্নিং সেশনে নিশ্চয় সে-সুযোগ পাওয়া যাবে।
বর্মনদা বললেন, আলাপ করাটা কোনো ব্যাপারই নয়। ইচ্ছে করলে কাল ভোরবেলা সমুদ্রতীরে তুমি তাকে সহজেই আবিষ্কার করতে পারো। পরনে জিনস আর গাঢ় লাল গেঞ্জি পরা মহিলাকে বিচে জগিং করতে দেখলে তুমি জানতে পারবে তিনিই সুভদ্রা। এক্কেবারে মেমসাহেবের মতন চালচলন। তবে সম্মেলনে তিনি সালোয়ার কামিজ পরেই আসবেন। কিন্তু সাবধান, তিনি একটু মুডি মহিলা। কখন কোন মুডে থাকেন, বলা কঠিন।
নিজের ঘরে ফিরে আসার পর আজ সম্মেলনে যেসব কাগজপত্রের ফাইল পেয়েছিলুম সেগুলো খুঁজতেই বিজ্ঞানীদের তালিকা পেয়ে গেলুম। কিন্তু, ড. ফাটনবিশ এবং ব্যাঙ্গালোরের ঠিকানা, সেই সঙ্গে তার পরিচিতি ছাড়া এখানে কোথায় তিনি উঠেছেন তার হদিস মিলল না। সন্দেহ হল, নিরাপত্তার কারণে বিজ্ঞানীর থাকার জায়গা উল্লেখ করা হয়নি।
সাড়ে সাতটা বাজে। আবার গিয়ে ব্যালকনিতে বসলুম। সমুদ্রের দিকে বাঁধের মতো উঠে যাওয়া প্রশস্ত জমির ওপর কেয়াগাছের ঘন জঙ্গল। তারপর একটা বাঁধ। বাঁধের নীচে বিচের ওপর আলো পড়েছিল। বিচ জনহীন নয়। বাঁদিকে যে কাফেতে বর্মনদার সঙ্গে কফি খেয়েছিলুম সেখানে উজ্জ্বল আলো পড়েছে। সন্ধ্যার দিকে ক্রমশ বাতাস বেড়ে গেছে বলে সমুদ্রের গর্জন ভয়ঙ্কর শোনাচ্ছে। যেন। এখনই তীরের সব কিছু গ্রাস করে নেবে তার উত্তাল জলরাশি।
কাফের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ চমকে উঠলুম। মাথায় টুপি এবং পরনে প্যান্ট-শার্ট, তাগড়াই চেহারার এক ভদ্রলোক সবে বেরিয়ে বিচের সমান্তরাল রাস্তায় গিয়ে উঠলেন। তার মুখের একটা পাশ দেখা যাচ্ছিল। মুখে সাদা দাড়ি।
আমি স্বপ্ন দেখছি না তো! ওই চেহারা কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের ছাড়া আর কারও হতে পারে না।
তখনই প্রচণ্ড ঝোঁকে ঘরের দরজা বন্ধ করে নীচে নেমে গেলুম তারপর পিচ রাস্তায় হন্তদন্ত এগিয়ে চললুম। কাফের কাছাকাছি পৌঁছে চারিদিক তন্নতন্ন খুঁজেও তেমন কোনো মানুষকে দেখতে পেলুম না। তাহলে কি আমি ভুল দেখেছি? অন্তত পনেরো-কুড়ি মিনিট দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টে খুঁজছিলুম পিচ রাস্তাটার ডান পাশে কেয়াঝোঁপ, ঘাসবন তারপর বাঁধের নীচে সমুদ্র। বাঁদিকে উঁচু জমির ওপর একটা করে কটেজ, কোথাও বা হোটেল এবং খানিকটা দূরে সেই অডিটোরিয়াম, যেখানে সম্মেলন হচ্ছে।
ফিরে গিয়ে সমুদ্রের দিকে সেই কাফেটার কাছে দাঁড়ালুম। কাঠের দেওয়াল-ঘেরা এবং ওপরে তেরপল চাপানো নেহাতই একটা কফিখানা। যে ভদ্রলোক একটা টেবিলের সামনে বসে কফির দাম নিচ্ছিলেন তাকে জিজ্ঞেস করলুম, কিছু যদি না মনে করেন, একটা কথা জানতে চাই।
ভদ্রলোক মাছের চোখে তাকিয়ে বললেন, বলুন স্যার, আপনার জন্য কী করতে পারি?
বললুম, কিছুক্ষণ আগে মাথায় টুপি এবং প্যান্ট-শার্ট পরা এক ভদ্রলোক–তার মুখে সাদা দাড়িও আছে, তিনি কি আপনার এখানে কফি খাচ্ছিলেন?
ভদ্রলোক তেমনি চোখে তাকিয়ে বললেন, এখানে ওই ধরনের অনেক মানুষই আসেন। বিদেশি পর্যটকরাও আসেন কাজেই আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় আপনার চেনা ওই রকম চেহারার কেউ এসেছিলেন কি না।
একটি কিশোর পরিচারক আমাদের কথা শুনছিল। বলা দরকার আমরা ইংরেজিতেই কথা বলছিলুম। সেই কিশোরটি এগিয়ে এসে বলল, আপনাকে একজনের সঙ্গে আজ বিকেলে এখানে কফি খেতে দেখেছি।
কিশোরটি ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলছিল। সে বলল, আপনি যার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন তিনি আধঘণ্টা আগে এখানে দাঁড়িয়ে কফি খেয়ে চলে গেলেন। তার গলা থেকে একটা ক্যামেরা আর বাইনোকুলার ঝুলছিল। তিনি বিদেশি ট্যুরিস্ট। আমাকে দু-টাকা বকশিশ দিয়ে গেলেন।
তার কথা শোনার পর দ্রুত পিচ রাস্তার দিকে এগিয়ে এলুম। হ্যাঁ, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার সত্যিই এখানে এসেছেন। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছেন। কিন্তু একটা ব্যাপার আশ্চর্যের, সম্মেলনের দিন অডিটোরিয়াম লোকে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু কর্নেলকে আমার চোখে পড়া উচিত ছিল। নাকি তিনি তখন সেখানে ছিলেন না। যাই হোক, হোটেলের দিকে যখন এগোচ্ছি তখন আমি আনন্দে বিহ্বল।
.
০২.
সে রাত্রে দেরি করে ক্যান্টিনে খেতে গিয়েছিলুম। কারণ রাত দশটায় সুভদ্র বর্মনের ফিরে আসার কথা। দশটায় খাওয়া শেষ করার পর বাইরে হোটেলের সামনে ফুলবাগিচার মধ্যে একটা চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে থাকলাম। সাড়ে দশটা বেজে গেল তবু বর্মনদার পাত্তা নেই। এবার উদ্বেগ বেড়ে গেল। উত্তেজিত ভাবে নিজের সুইটে ফিয়ে গেলুম। এই হোটেলের প্রত্যেক সুইটে টেলিফোনের ব্যবস্থা আছে। সেজন্য এই হোটেল সাংবাদিকদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। সম্মেলনের ফাইল খুলে নিরাপত্তা দপ্তরের ফোন নাম্বার দেখে নিলুম। তারপর রিসিভার তুলে জিরো ডায়াল করতেই ডায়াল টোন পাওয়া গেল। ঠিক সেই সময় বাইরের দিকের দরজায় কেউ নক করল। রিসিভার রেখে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখি বর্মনদা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। বললুম, এইমাত্র নিরাপত্তা দপ্তরে টেলিফোন করতে যাচ্ছিলুম। ওফ, আপনি আমাকে কী বিপদেই না ফেলেছিলেন!
বর্মনদা বললেন, আমিও বিপদে পড়তে পারতুম। কিন্তু দৈবাৎ স্থানীয় সমুদ্রবিজ্ঞান অফিসের এক ভদ্রলোকের গাড়ি পেয়ে গিয়েছিলুম। তিনি লিফট দিয়ে চলে গেলেন।
পথে কি আপনার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল?
–সঠিক জানি না। তবে আমি রিস্ক নিতে চাইনি।
–ভেতরে এসে বসবেন তো? ব্যাপারটা বড্ড অস্বস্তিকর। আপনি কথা দিয়েছিলেন নিরাপদে ফিরতে পারলে ব্যাপারটা বিস্তারিত জানাবেন।
বর্মনদা মিটিমিটি হেসে বললেন, চুপকথা অত সহজে ফাঁস করতে নেই। যথাসময়ে তোমাকে নিশ্চয়ই জানাব। প্রায় এগারোটা বাজতে চলল। শুয়ে পড়ো। কাল ভোরে সি বিচে শ্রীমতী সুভদ্রার সঙ্গে তোমার না মিট করার কথা!
কথাটা বলেই বর্মনদা তাঁর সুইটের দিকে চলে গেলেন।
অগত্যা দরজা বন্ধ করে টেলিফোনের কাছে ফিরে এলুম। জিরো ডায়াল করে টেলিফোনটা বাইরের সঙ্গে ডাইরেক্ট করে দিয়েছি। ওটা আবার একবার জিরো ডায়াল না করলে এই হোটেলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বন্ধই থাকবে। এই ভেবে রিসিভারের দিকে হাত বাড়িয়েছি, অমনি টেলিফোনটা বেজে উঠল। এটা বাইরের কল। রিসিভার তুলে সাড়া দিলুম। তারপর আমার চিরপরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল–ডার্লিং, আগে সব না শুনে এই বৃদ্ধের উপর খাপ্পা হয়ো না।
-খাপ্পা হব না মানে? আপনাকে আমি সন্ধ্যায় সমুদ্রতীরের কাফে থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলুম। তারপর
–আগে আমার কথা শোনো। আমি দূর থেকে তোমাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলুম। কিন্তু তখন আমার একটা জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল।
–আমার এই সুইটের টেলিফোন নাম্বার পেলেন কী করে?
যেভাবে হোক পেয়ে গেছি।
–কিন্তু আপনি এখানে কবে এসেছেন?
–গত রাত্রে। সমুদ্রবিজ্ঞান সম্মেলনে সরকার আমাকে আমন্ত্রণ করবেন এটা তোমার কাছে নতুন কিছু নয়।
–কিন্তু আপনাকে আমি আজ সারাদিন কোথাও দেখতে পাইনি কেন?
–সেটা টেলিফোনে বলা যাবে না। মুখোমুখি হলে বলব।
–আপনি উঠেছেন কোথায়?
-তোমার অনুমান করা উচিত ডার্লিং। আমার বন্ধু ক্যাপ্টেন অশোকানন্দ বার্মার এখানে একটা ফার্ম হাউস আছে। সে কারণে তিনি জগন্নাথ টিলার গায়ে একটা সুন্দর বাংলো বাড়ি করেছেন। তোমার মনে পড়া উচিত ক্যাপ্টেন বার্মার ফার্ম হাউসে তোমাকে সেবার নিয়ে গিয়েছিলুম। হ্যাঁ, একটা জরুরি কথা বলি। মন দিয়ে শোনো। তামিল জার্নালিস্ট রাঘবনের কোনো ব্যাপারে যেন ভুলেও নাক গলাবে না।
হাসতে হাসতে বললুম, আপনি দেখছি সত্যিই অন্তর্যামী। আমি রাঘবনের দিকে নজর রেখেছি, আপনি কী করে জানলেন?
–আমি অন্তর্যামী নই। তুমি নিজেই চিন্তা করে দ্যাখো রাঘবনের সন্দেহজনক চলাফেরার কথা নিশ্চয় কাউকে বলেছ।
–কী আশ্চর্য! আপনি তো সুভদ্র বর্মনকে চেনেন। তার সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথাও জানেন। হ্যাঁ, আমি বর্মনদাকে রাঘবন সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করেছিলুম। এখন বোঝা যাচ্ছে ইতিমধ্যে বর্মনদার সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ হয়ে গেছে। আপনি তাকে নিষেধ করেছেন। তিনি যেন আপনার খবর আমাকে না দেন। এই তো?
কর্নেলের হাসির শব্দ ভেসে এল-হা, তোমার সঙ্গে একটু লুকোচুরি খেলেছি। আরও শোনো, তোমার প্রিয় বর্মনদার যেখানে ডিনারের নিমন্ত্রণ ছিল, সেখানে আমারও নিমন্ত্রণ ছিল। ভদ্রলোক একটা ঝুঁকি নিয়েছিলেন। আমি তাকে স্থানীয় অফিসের একটা গাড়িতে হোটেলে পৌঁছোনোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলুম। যাই হোক, কোনো অজানা রহস্যের পেছনে অকারণ ছোটাছুটি করে ঘুম নষ্ট কোরো না। এখনই শুয়ে পড়ো। তোমার সঙ্গে কাল যে কোনো সময় দেখা হয়ে যাবে। উইশ ইউ হ্যাভ এ নাইস স্লিপ। রাখছি।
রিসিভার রেখে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে এক সাংবাদিক বন্ধুর দেওয়া বিদেশি সিগারেটের প্যাকেটটা বের করলুম। এখানে মাঝে মাঝে লোডশেডিং হয়। তাই টেবিলে একটা মোমবাতি আর দেশলাই রাখা আছে। সিগারেট ধরিয়ে ব্যালকনিতে বসলুম। এখন ব্যালকনিতে প্রচণ্ড হাওয়া। ওদিকে সমুদ্রের গর্জনও প্রচণ্ড বেড়ে গেছে।
পরদিন যে খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছিল এবং সমুদ্রের বিচে পৌঁছোতে পেরেছিলুম এর কারণ বর্মনদার সঙ্গে বাজি লড়তে নয়। এখানে কর্নেলের অস্তিত্বই আসলে আমার মনোবল খুব বাড়িয়ে দিয়েছিল। মার্চের ভোর ছটায় তখনও বিচে ঘন কুয়াশা। বাতিগুলিও নেভানো হয়নি।
প্রশস্ত বিচে ততক্ষণে নানাবয়সি পুরুষদের শর্টস পরা ছায়ামূর্তি আর ধুপ ধুপ পায়ের শব্দ একটা ভূতুড়ে আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছিল। কিছু তরুণীকেও দেখছিলুম শর্টস আর গেঞ্জি পরে জগিং করছে। বলা দরকার বাইরে এলে ইদানীং আমিও জগিং-এর চান্স পেলে ছাড়ি না। সেজন্য জগিং-এর উপযোগী পোশাক সঙ্গে রাখি।
এই কুয়াশার মধ্যে ড. সুভদ্রা ফাটনবিশ নামের প্রতিভাধর মহিলাকে খুঁজে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিলুম। তাছাড়া বালির ওপর জগিং করা খুব কষ্টকর। শিগগির ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলুম। সমুদ্রের তীরের দিকে ইতস্তত বড়ো বড়ো পাথর পড়ে আছে। দেখলুম বয়স্করা ততক্ষণে সেইসব পাথর দখল করে নিয়েছেন। পশ্চিমে গিয়ে পোড়া লাইট হাউসের খাঁড়ির কাছাকাছি যেতেই কেউ আমাকে ডাকল, হাই, ম্যান ফ্রম ক্যালকাটা, কাম হিয়ার অ্যান্ড টেক রেস্ট।
কাছে গিয়ে দেখি সেই তামিল সাংবাদিক রাঘবন। তার পরনে শর্টস।
বললুম, মি. রাঘবন, আমার নাম আপনি ভুলে গেছেন। আমি জয়ন্ত চৌধুরী।
রাঘবন অদ্ভুত শব্দে হেসে বলল, সি বিচে জগিং করে আমেরিকানরা। আমাদের ভারতীয়দের পক্ষে ব্যাপারটা কষ্টকর। এ বিষয়ে আপনার কী মত?
বললুম, আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু চন্দনপুর-অন-সি বিচে জগিং করার মধ্যে আনন্দও কম নেই। ওই দেখুন না বিশেষ করে যুবক-যুবতীরা এখানে জগিং-এর থ্রিলটা কেমন উপভোগ করছে।
রাঘবন কী বলতে যাচ্ছিল, বলল না। হঠাৎ সে উঠে দাঁড়িয়ে ধাপবন্দি পাথরের ওপর দিয়ে বাঁধের ওপরে উঠে গেল। তারপর ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হল।
বর্মনদা এই ভদ্রলোক সম্পর্কে কিছু কথা বলেছিলেন। কিন্তু এখন মনে হল রাঘবনের মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা আছে। যাই হোক, তাকে নিয়ে আর মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। আমি আবার উলটোদিকে অর্থাৎ উত্তর-পূর্বে বিচের ওপর দিয়ে জগিং শুরু করলুম। ততক্ষণে কুয়াশা অনেকটা পরিষ্কার হয়েছে। সমুদ্রের শীর্ষে ঈষৎ রক্তিম ছটা দেখা সাচ্ছে। এখন আর সেই ঠান্ডা আবহাওয়াটা নেই। ক্রমশ ঘেমে উঠছি। কিন্তু আমার দৃষ্টি সারাক্ষণ শ্রীমতী সুভদ্রাকে আবিষ্কারের জন্য তৎপর।
মিনিট দশেক পরে বিচে নেমে আসার রাস্তায় পৌঁছে গেলুম। তারপর বাঁধে উঠে সেই কাফেটেরিয়ার সামনে দেখি বর্মনদা কফির জগ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে তিনি বললেন, মর্নিং জয়ন্ত।
–মর্নিং বর্মনদা।
ওফ জয়ন্ত, তুমি একেবারে অন্ধ!
–কেন?
–ওই দ্যাখো, তুমি উঠে আসার পরই আমাদের পিছন দিয়ে শ্রীমতী চলে গেলেন। আমাকে সম্ভাষণ না করেই গেলেন, এতে আমি ক্ষুব্ধ নই। কারণ উনি মুডি মহিলা।
আমি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি দেখে বর্মনদা বললেন, রাস্তার দিকে দ্যাখো। শ্ৰীমতী এখন রাস্তায় জগিং করতে করতে তাঁর হোটেলের দিকে চলেছেন।
দেখলুম হালকা ছিপছিপে গড়নের শর্টস এবং টপ পরা মহিলা প্রায় পঁচিশ-তিরিশ মিটার দূরে পিচ রাস্তা দিয়ে তালে তালে পা ফেলে চলেছেন।
বর্মনদা বললেন, শ্ৰীমতীকে তোমার কাছাকাছি জগিং করে আসতে দেখে আমি ধরেই নিয়েছিলুম তোমার সঙ্গে দু-এক টুকরো কথা বিনিময় হয়েছে। কারণ সাংবাদিকরা অচেনা কারও সঙ্গে আলাপে পটু। যাক গে, কালকের মতো এখানেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কফি খেয়ে নাও। তারপর দুজনে হোটেলে ফিরব। ন-টায় সম্মেলন শুরু। বলে তিনি আমার জন্য কফির অর্ডার দিলেন। তারপর পকেট থেকে একটা চুরুট বের করে লাইটার দিয়ে ধরালেন।
সুভদ্র বর্মনকে আমি চুরুট খেতে দেখেছি। কিন্তু এই চুরুটের গন্ধটা যেন আমার চেনা মনে হল। কফিতে চুমুক দিয়ে একটু হেসে চাপা স্বরে বললুম, বর্মনদা, আমি কিন্তু আমার ফ্রেন্ড-ফিলজফার-গাইড টেকো মাথা এক দাড়িঅলা বৃদ্ধের গন্ধ পাচ্ছি। বর্মনদা, এই চুরুটটা যে আপনি গত রাতে ডিনারের পর কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের কাছে উপহার পেয়েছিলেন তাতে কোনো ভুল নেই।
সুভদ্র বর্মন মিটিমিটি হেসে বললেন, গত রাতে তোমাকে তোমার বৃদ্ধ বন্ধুর কথা বলিনি। ভেবেছিলুম পরে কোনো এক সময়ে তোমাকে তাক লাগিয়ে দোব। কিন্তু ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না।
বললুম, গত রাত্রে কর্নেল আমাকে টেলিফোন করেছিলেন। আমার ধারণা, উনি এখানে একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানী হিসাবে আমন্ত্রিত হয়ে এলেও আড়ালে কোনো উদ্দেশ্য আছে। অর্থাৎ কর্নেলের যা স্বভাব, কোনো রহস্যের টানেই এখানে ছুটে এসেছেন।
কফি খেতে খেতে আমরা সম্মেলন নিয়েও আলোচনা করছিলুম। এই সময় নীচে সমুদ্রের বিচের দিকে লোকজনের ছোটাছুটি দেখতে পেলুম। কিছু লোক কাফের পেছনে বাঁধের উপর দিয়ে হইচই করতে করতে ছুটে গেল।
বর্মনদা এবং আমি দুজনেই চমকে উঠেছিলুম। উনি বললেন, কিছু ঘটেছে মনে হচ্ছে। সবাই পোড় লাইট হাউসের দিকে ছুটছে কেন?
কথাটা বলে তিনি কয়েক পা এগিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে বলতে পারেন?
লোকটি স্থানীয় এবং মৎস্যজীবী বলেই মনে হল। সে বলল, কাল রাত্তিরে অনেক কাল পরে কান্ডিলম উঠেছিল। সেই সময় একটা লোক ওখানে ছিল। কান্ডিলম তাকে লাইট হাউসের ভিতর দিয়ে ঢুকিয়ে মাথার ওপর দিয়ে খাড়িতে ছুঁড়ে ফেলেছে। হাওয়া-সাপের পাল্লায় পড়লে কেউ বাঁচে না।
কথাগুলো শুনেই চমকে উঠেছিলুম। নিশ্চয় এটা কোনো খুনখারাপির ঘটনা। কর্নেলের সামনে সেই অদৃশ্য হত্যাকারী আবার কি তাহলে একটা লাশ ছুঁড়ে ফেলে তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে?
কফি দ্রুত শেষ করে বর্মনদাকে বললুম, যাবেন নাকি দেখতে?
বর্মনদা গম্ভীর মুখে বললেন, নিছক দুর্ঘটনাও হতে পারে। খাঁড়ির মাথায় পাথরগুলো খুব পিচ্ছিল। ওখানে বসে থাকতে থাকতে দৈবাৎ কেউ নীচে পড়ে যেতেও পারে। চলো, পরে সব জানা যাবে। হোটেলে ফেরা যাক। সাড়ে আটটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট করে সম্মেলনে যেতে হবে।
হোটেল দ্য শার্কের দিকে পিচ রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার মাথার ভিতর রাঘবনের ব্যাপারটা মাছির মতো ভনভন করছিল। আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ সে কেনই বা বাঁধে উঠে গেল? আমার ধারণা, রাঘবনই খাঁড়িতে পড়ে মারা গেছে এবং সম্ভবত ওটা দুর্ঘটনা নয়। কারও সঙ্গে তার ওখানে দেখা করার কথা ছিল। সে-ই তাকে নিশ্চয় ধাক্কা মেরে নীচে ফেলে দিয়েছে। মধ্যে প্রচুর পাথরও আছে। প্রায় তিরিশ-চল্লিশ ফুট থেকে কেউ নীচে পড়ে গেলে তার বাঁচার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
এই কথাগুলো বর্মনদাকে বলব কি না ভেবে ঠিক করতে পারছিলুম না। আমাদের হোটেলের সামনে রাস্তার ধারে একটা বিশাল বটগাছ আছে। বটগাছটার গোড়া চারদিক থেকে বাঁধানো। এখন সেখানে কোনো লোক নেই। সেখানে থমকে দাঁড়িয়ে আস্তে বললুম, বর্মনদা, আপনাকে একটা ঘটনার কথা বলা উচিত।
বর্মনদা ভুরু কুঁচকে বললেন, যদি উচিত মনে করো, বলছ না কেন?
তখন আমি বিচের পশ্চিম প্রান্তে রাঘবনের সঙ্গে দেখা এবং তারপর যা ঘটেছিল সবই বললুম। শেষে বললুম–আমার দৃঢ় বিশ্বাস রাঘবনকে কেউ ধাক্কা মেরে নীচের খাড়িতে ফেলে দিয়েছে।
সুভদ্র বর্মন বাঁকা হেসে শুধু বললেন, এমনও হতে পারে রাঘবনই কাউকে ধাক্কা মেরে নীচের খাঁড়িতে ফেলে দিয়েছে। তোমার কী মত?
হাসবার চেষ্টা করে বললুম, হ্যাঁ, তাও হতে পারে। লাশটা শনাক্ত হলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে।
বর্মনদা পা বাড়িয়ে বললেন, কিন্তু জয়ন্ত, তোমার এই গুপ্তকথা আর কাকেও যেন বোলো না।
-কর্নেলকে?
বর্মনদা হেসে উঠলেন, হ্যাঁ, তাকে তো বলতেই হবে।
আমার সুইটে ঢুকে ব্যালকনিতে গিয়ে বসলুম। পশ্চিমে পোড়ো লাইট হাউসের দিকে ঝোঁপজঙ্গল এবং গাছপালার ভেতর ততক্ষণে লোকের ভিড় জমে উঠেছে। একটু পরে পিচ রাস্তার দিক থেকে পুলিশের একটা জিপ এবং অ্যাম্বুল্যান্স দেখা গেল। সেই সময় হোটেলের সামনের রাস্তা দিয়ে ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে দমকলের গাড়ির শব্দ শুনলুম।
আমার বাঁদিকে একটা ব্যালকনির পরে বর্মনদার ব্যালকনি লক্ষ করলুম। বর্মনদাকে দেখতে পেলুম না। তারপরই আমার সুইটের দরজায় কেউ টোকা দিল। দরজা খুলে দেখি আমার পাশের সুইটের পাটনাবাসী সাংবাদিক রমেশ শর্মা। রমেশ আমার চেয়ে বয়েসে কিছু ছোটো। সে উদ্বিগ্ন মুখে বলল, জয়ন্তদা, হোটেল খালি করে সব সাংবাদিক পোড়ো লাইট-হাউসের দিকে হন্তদন্ত ছুটে গেল। আমাদের কি যাওয়া উচিত নয়। কারণ, এটাও তো একটা পাবলিক খাওয়ানো স্টোরি হয়ে উঠবে। কিন্তু ওদিকে ন-টায় সেমিনার শুরু।
বললুম, তাতে কী! তুমি এই বাড়তি স্টোরিটা কুড়িয়ে নাও। এখান থেকে সব কাগজে খবর পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রমেশ মুখে দ্বিধার ভাব ফুটিয়ে বলল, কিন্তু আপনি যাবেন না?
একটু হেসে বললুম, আমি পরের মুখে ঝাল খেতে অভ্যস্ত। যথাসময়ে পুলিশের কাছে খবরটা পেয়ে যাব।
রমেশ হঠাৎ খুব চাপা স্বরে বলল, জয়ন্তদা, আপনাকেই কথাটা বলছি। প্লিজ, কাউকেও যেন বলবেন না।
–তুমি নিশ্চিন্তে বলতে পারে। তোমার কেরিয়ারের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ আমি কিছুতেই করব না।
এবার রমেশ ঘরের ভিতর এসে একটা চেয়ারে বসল। আমি দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিলুম। তারপর বললুম, বলল শুনি।
রমেশ তেমনই চাপা স্বরে বলল, কাল থেকে লক্ষ করছি ওই তামিল ভদ্রলোক, কী যেন নামটা—
–রাঘবন।
–হ্যাঁ, রাঘবনের সঙ্গে একটা রোগাটে গড়নের ভদ্রলোক মাঝে মাঝে এসে চুপি চুপি কী যেন আলোচনা করছে। ভদ্রলোককে আমার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বলে মনে হচ্ছে। তো, আজ ভোরবেলা আমি আমার ঘরের ব্যালকনিতে বসে কালকের ওপেনিং সেরিমনির একটা ড্রাফট তৈরি করছি, হঠাৎ দেখলুম পশ্চিমে পোড় লাইট হাউসের দিকে বাঁধের ওপর সেই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে। তার একটু পরেই রাঘবনকে সমুদ্রের বিচ থেকে ওপরে উঠে আসতে দেখলুম। দুজনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল। তারপর ঝোপের আড়ালে তাদের আর দেখতে পেলুম না। জয়ন্তদা, ওই রাঘবন লোকটাকে আমার পছন্দ হচ্ছে না। যেচে আলাপ করতে গিয়েছিলুম, পাত্তাই দিল না। আর চেহারা দেখলেই কেমন একটা অস্বস্তি জাগে।
হাসতে হাসতে বললুম, ঠিক আছে। যা দেখেছ, চেপে যাও। খাঁড়ির জলে কার ডেডবডি পড়েছে আর কেনই বা পড়েছে–এসব তুমি পুলিশ-সোর্সে পেয়ে যাবে। শুধু একটা কথা শুনে রাখো। যদি দ্যাখো লাশটা রাঘবনের নয় এবং সে দিব্যি বেঁচে আছে, তাহলে সাবধান। কিছুতেই তার ছায়া মাড়াবে না।
রমেশ শর্মা একটু চুপ করে থাকার পর বলল, আপনার কথা আমি মেনে নিলুম। কিন্তু আপনি যাই বলুন, গোপনে আমি লোকটার দিকে নজর রাখব–যদি সে সত্যিই বেঁচে থাকে।
রমেশ চলে যাওয়ার পর পোশাক বদলে নীচের ক্যান্টিনে গেলুম। ক্যান্টিনে খুব ভিড় নেই। ম্যানেজার আমাকে দেখে একটু হেসে বললেন, কি মি. চৌধুরী, আপনার বন্ধুরা তো সবাই খবর আনতে ছুটে গেল।
একটু গম্ভীর হয়ে বললুম, কী খবর বলুন তো?
ম্যানেজার চোখ বড়ো করে বললেন, সে কী, আপনি জানেন না! ভূতুড়ে লাইট হাউসের কাছে খাঁড়ির জলে একটা রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে।
একটা খালি টেবিলের সামনে বসে বললুম, কেউ হয়তো পা স্লিপ করে পড়ে গেছে। এই মার্চে এখানে অনেক পর্যটক আসেন। তাদেরই কেউ হতে পারেন।
ম্যানেজার কেরালার লোক। তার অদ্ভুত নামটা আমার মনে থাকে না। কিন্তু। এই মুহূর্তে মনে পড়ে গেল। বিক্রমন ওটেকাট্টে। ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিয়ে ডানদিকের জানলার পর্দা সরিয়ে পিচ রাস্তার দিকে দৃষ্টি রেখেছিলুম। সেই সময় হঠাৎ মি. ওটেকাট্টে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে চাপা স্বরে বললেন, আমাদের একটা লোক ব্যাপারটা দেখতে গিয়েছিল। সে ফিরে এসে বলল পোশাক দেখে লাশটা তার চেনা মনে হয়েছে।
জিজ্ঞেস করলুম, কার লাশ?
মি. ওটেকাট্টে খুব চাপা স্বরে বললেন, আপনি তাকে এই হোটেলের ক্যান্টিনেও দেখে থাকবেন। লোকটা একজন পোর্তুগিজ। গোয়ায় থাকত। গত বছর থেকে চন্দনপুর-অন-সি-তে একটা কম্পিউটারের কারবার খুলেছে। ওর নাম পিটার গোমস। বেশ পয়সাঅলা লোক। গাড়ি চড়ে বেড়ায়। আমার ধারণা পিটার এখানে আপনাদের এক সাংবাদিককে চেনে। গাঁট্টাগোট্টা চেহারার ওই সাংবাদিক ভদ্রলোকের নামটা আমি জানি, কিন্তু মনে করতে পারছি না। উনি থাকেন তেইশ নম্বর সুইটে।
বললুম, আপনি কি তামিল সাংবাদিক মি. রাঘবনের কথা বলছেন?
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, মি. রাঘবন। জানেন, লোকটাকে আমার কেন যেন পছন্দ হয় না। খুব ভঁটের সঙ্গে কথা বলে। কাল সন্ধ্যায় পিটার গোমসের সঙ্গে ওকে অনেক রাত্রি অব্দি আমাদের বারে দেখেছি। এখন সত্যিই যদি লাশটা পিটারের হয় তাহলে তো-নাঃ। মি. চৌধুরী, প্লিজ আপনি যেন দয়া করে এসব কথা নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করবেন না।
ততক্ষণে টেবিলে ব্রেকফাস্টের খাবার এসে গেছে। আমি খেতে মন দিলুম। সাড়ে আটটা বাজে। ন-টায় সমুদ্রবিজ্ঞান সম্মেলন শুরু হবে।
কিন্তু সুভদ্র বর্মনকে দেখছি না কেন? ভাবুলম খাওয়ার পর দোতলায় উঠে ওঁর খোঁজ নিয়ে যাব।
কিন্তু ওপরে উঠে দেখেছিলুম ওঁর ঘরে উনি নেই। ব্যাপারটা সত্যিই রহস্যময় হয়ে উঠল। গতরাতে কর্নেলের সঙ্গে উনি এক বিজ্ঞানীর ডেরায় ডিনার করেছেন। তাছাড়া নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে কেনই বা তার এত উদ্বেগ ছিল? এদিকে আজ সকালে রাঘবনের সঙ্গে যে ভদ্রলোককে কাল সন্ধ্যায় দেখেছিলুম তার লাশ নাকি খাঁড়ির জলে…। নাঃ। এ নিয়ে ভাবতে গেলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। তার চেয়ে সমুদ্রভবন অডিটোরিয়ামে গিয়ে কর্নেলকে খুঁজে বের করতে হবে।
আমাদের সাংবাদিকদের নিয়ে যাবার জন্য একটা বিশাল বাস এসে দাঁড়িয়ে আছে হোটেলের সামনে। কিন্তু আমি বাসে না উঠে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকলুম। এয়ার কন্ডিশনড বাসে বসে সময় কাটানো বিরক্তিকর। কারণ সাংবাদিকরা কে কখন আসবেন তার ঠিক নেই। সবাই হয়তো লাইট হাউসের ওখানে ভিড় জমিয়েছে। যেতে যেতে মনে হল আমার প্রিয় বর্মনদাও সম্ভবত কৌতূহল চাপতে না পেরে সেখানেই গিয়ে জুটেছেন।
অডিটোরিয়ামে পৌঁছে বিশাল লাউঞ্জের এক কোণে বসে পড়লুম। তার পরই দৃষ্টি গেল জানলার ধারে একটা সুদৃশ্য আসনের দিকে। সেখানে সদ্য আসন গ্রহণ করলেন যিনি, তিনি মাথার টুপি খুলে কোলে রেখে চুরুট ধরালেন। লাউঞ্জের ওদিকটা স্মোকিং জোন। একটু ইতস্তত করে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম। তিনি মুখ তুলে মৃদু হেসে বললেন, মর্নিং জয়ন্ত।
.
০৩.
কর্নেলের পাশের সিটে বসে বললুম, আমার সঙ্গে এই লুকোচুরি খেলাটার অর্থ বুঝতে পারছি না। এটা স্পষ্ট যে কলকাতার দৈনিক সত্যসেবক-এর মতো বড়ো কাগজের কোনো সাংবাদিককে এমন একটা সম্মেলনে ডাকা হবেই আর এ ধরনের সম্মেলনে এর আগেও কর্তৃপক্ষ আমাকেই পাঠিয়েছেন। এদিকে এমন একটা সম্মেলনে বিখ্যাত প্রকৃতিবিজ্ঞানী কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ডাক পাবেন না, এটা হয় না।
কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, কাল ওপেনিং সেশনে আমি তোমাকে প্রেস কর্নারে দেখেছি। কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে পাওনি তার কারণ আমি ছিলাম বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আসা উটকো লোকেদের ভিড়ে। তার চেয়ে বড়ো কথা, তোমার দৃষ্টি ছিল সুন্দরী যুবতী অ্যানাউন্সর মিস চন্দ্রলেখার দিকে।
আমি প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলুম। কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, জয়ন্ত, মিস চন্দ্রলেখা দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার একজন নামকরা হিরোয়িন ছিলেন। এখনও হিরোয়িন রোলে ওঁকে মানিয়ে যায়। কিন্তু গুজব শুনেছি কোনো তীব্র অভিমানে চন্দ্রলেখা নিজেকে সিনেমা থেকে সরিয়ে এনেছেন।
বললুম, সে যাই হোক, আপনি আমাকে লুকিয়ে এখানে এসেছেন। এটা তো জানা কথা, আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যাবে। তাহলে একসঙ্গে দুজনে এলে অসুবিধেটা কী ছিল?
কর্নেল নিঃশব্দে একটু হেসে আস্তে বললেন, আমাকে এখানে আসতে হয়েছে। দু-দিন আগে। হ্যাঁ, এই সম্মেলনের আমন্ত্রণ তো ছিলই, কিন্তু তার আগে আমার বন্ধু ক্যাপ্টেন অশোকানন্দ বার্মা একটা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আমাকে ছুটে আসতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
একটু হেসে বললুম, ওই ডাকটার পেছনে নিশ্চয় কোনো রহস্য ছিল। আপনি কি সেই রহস্যের সমাধান করতে পেরেছেন?
কর্নেল তার সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, নাঃ, কোনো রহস্য নয়। ক্যাপ্টেন বার্মা একজন ডুবুরি। সমুদ্রে ডুব দিয়ে নানা প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী সংগ্রহ করেন। তো
–হ্যাঁ, তার বিশাল অ্যাকোয়ারিয়াম আমি সেবার দেখেছিলুম।
কর্নেল ঘড়ি দেখে নিয়ে বললেন, সম্প্রতি ক্যাপ্টেন বার্মা এখান থেকে দশ কিলোমিটার দূরে সমুদ্রের একটা খাঁড়িতে একটা প্যাকেট উদ্ধার করেছিলেন। ওয়াটার প্রুফ সেই প্যাকেট খুলে তিনি অবাক হয়ে গেছেন। প্রায় পঞ্চাশ শিট কাগজে কী সব বৈজ্ঞানিক রিপোর্ট লেখা আছে।
অবাক হয়ে বললুম, আমার ধারণা, ওটা কোনো জীববিজ্ঞানীর থিসিস!
কর্নেল বললেন, আপাতত যা শুনেছ, এই যথেষ্ট। আমি শুধু দশ মাইল দূরে ওই খাঁড়িতে ক্যাপ্টেন বার্মার সঙ্গে গিয়ে এলাকার জেলেদের কাছে জানতে পেরেছি ওই এলাকায় কিছুদিন আগে একটা জাহাজডুবি হয়েছিল। জাহাজটা বিদেশি, তারা শুধু এটুকুই জানে। আমাদের উপকূলরক্ষী বাহিনীর সঙ্গেও ক্যাপ্টেন বার্মা যোগাযোগ করেছিলেন। তারা এ বিষয়ে মুখ খুলতে চান না।
এই সময় লাউঞ্জে ভিড় বেড়েছে দেখলুম। ন-টা বেজে গেছে। ঘোষণা শোনা গেল- মাননীয় ভদ্রমহোদয় এবং ভদ্রমহোদয়াবৃন্দ, আপনারা অনুগ্রহ করে অডিটোরিয়ামে আসুন। আমাদের সেমিনার এখনই শুরু হবে।
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, জয়ন্ত, আমি এবেলা কালকের মতো উটকো লোকেদের ভিড়েই থাকব। ওই পেপার-টেপার শোনার ধৈর্য আমার তত নেই। তাছাড়া পেপারের কপি তুমি যেমন পেয়ে যাবে, আমিও পাব। তুমি শুধু লক্ষ রাখবে আমি কখন বেরিয়ে যাচ্ছি। তুমি আমাকে ফলো করবে।
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে চাপা স্বরে বললুম, আজ সকালে পোডড়া লাইট হাউসের নীচের খাঁড়িতে–
কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে চাপা স্বরে বললেন, পিটার গোমস।
আমি আরও কিছু বলার আগেই কর্নেল হন্তদন্ত ভিড়ে মিশে গেলেন।
প্রেস ব্লকে প্রতিটি আসনে সাংবাদিকদের নাম লেখা আছে। আমার সৌভাগ্য পাশের আসনেই বর্মনদার আসন। আমি গিয়ে বসার আগেই তাকে বসতে দেখলুম। এই সময় লক্ষ করলুম মি. রাঘবনের আসন খালি।
বর্মনদা বললেন, কি জয়ন্ত? তোমার ফ্রেন্ড-ফিলজফার-গাইডের সঙ্গে দেখা হল?
বললুম, হ্যাঁ। কিন্তু মি. রাঘবনকে দেখছি না।
বর্মনদা খুব আস্তে বললেন, বন্ধুর ডেডবডি ফেলে সম্মেলনে আসতে পারেননি মনে হচ্ছে। হয়তো পুলিশের সঙ্গেই আছেন।
একটু পরেই মিস চন্দ্রলেখা ডায়াসে সুললিত কণ্ঠস্বরে এবং স্মার্ট ইংরেজিতে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে আপ্যায়ন করলেন। তারপর জনৈক সমুদ্রবিজ্ঞানী নবকান্ত সিনহার পেপার পাঠের কথা ঘোষণা করলেন এবং তাকে মঞ্চে আসতে অনুরোধ জানালেন।
মধ্যবয়সি টাই-সুট পরা বেঁটেখাটো এক ভদ্রলোক একগাদা কাগজ হাতে লাউড স্পিকারের দিকে এগিয়ে গেলেন। এদিকে কয়েকজন যুবক-যুবতী সাংবাদিকদের হাতে তার পেপারের কপি বিলি করে চলে গেলেন।
বর্মনদা চোখ বুলিয়ে দেখে বললেন, কিছু বোঝা যায় না ভাই জয়ন্ত। সুযোগমতো কেটে পড়ব।
বললুম, আমিও কেটে পড়ব।
আধঘণ্টা পরে বর্মনদা বাথরুমে যাবার প্যাসেজে এগিয়ে গেলেন। আমার চোখ ছিল কর্নেলের দিকে। আরও মিনিট দশেক পরে কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। অমনি আমিও কেটে পড়লুম। ততক্ষণে বুঝতে পেরেছিলুম, গতরাত্রে প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী ড. সুভদ্রা ফাটনবিশের ডিনারের আয়োজনের পিছনে রীতিমতো রহস্যময় এবং খাঁড়ির জলে পাওয়া সেই থিসিস পর্যালোচনার উদ্দেশ্য ছিল। অতএব কর্নেলের বন্ধু ক্যাপ্টেন বার্মাও যে সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তা তো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে আমার দৃঢ় ধারণা, কর্নেলই সুভদ্র বর্মনের মাধ্যমে ড, ফাটনবিশের সঙ্গে একটা গোপন বৈঠকের ব্যবস্থা করেছিলেন।
কিন্তু মিঃ রাঘবন এবং পিটার গোমসের সঙ্গে কি ক্যাপ্টেন বার্মার উদ্ধার করা সেই থিসিস-পেপারের কোনো যোগাযোগ ছিল? তারা কি কোনো সূত্রে এ কথা জানতে পেরেছিল?
তা যদি হয়, তা হলে রহস্যটা সত্যি জমজমাট হয়ে উঠবে।
রাস্তায় নেমে গিয়ে দেখি কর্নেল একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছেন। দ্রুত গিয়ে তাকে বললাম, বর্মনদাকে বেরিয়ে আসতে দেখেছি। ভেবেছিলুম তিনি আপনার সঙ্গী হবেন।
কর্নেল বললেন, সুভদ্রকে আমি একটা কাজের দায়িত্ব দিয়েছি। তার সঙ্গে আমাদের দেখা হবে ক্যাপ্টেন বার্মার বাংলোয়।
–আজ কি মি. বার্মা সম্মেলনে আসেননি?
–না। উনি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।
রাস্তায় একটা অটো রিকশ যাচ্ছিল, কর্নেল সেটা দাঁড় করিয়ে বললেন, বার্মা সাহেবের বাংলোয় যাব। চেনো তো?
অটোর চালক একগাল হেসে বলল, বার্মার্সবকে কে না চেনে সাহেব?
দুজনে অটো রিকশয় উঠে বসলুম। বুঝতে পারলুম বাংলোটা উনি এখান থেকে বেশ দূরেই কোথাও করেছেন।
মার্চ মাসে সামুদ্রিক পরিবেশে আবহাওয়া বেশ মনোরম। কলকাতার মতো ঝাঁঝালো নয়। তবে বাতাসের প্রচণ্ড উপদ্রব। প্রায় এক কিলোমিটার পূর্বে এগিয়ে ডানদিকে একটা প্রাইভেট রোড চড়াইয়ে উঠেছে। টিলার গায়ে ছবির মতো সুন্দর বাংলো দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল।
গেটের কাছে যেতেই ক্যাপ্টেন বার্মার সহাস্য মূর্তি দেখা গেল। তিনি নিজে এসে গেট খুলে দিলেন। তারপর আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, আপনি এসেছেন তা হলে। জানেন মি. চৌধুরী, কর্নেলসাহেব না বললেও কাল সম্মেলনে গিয়ে প্রেস কর্নারে আপনাকে দেখে আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক, কর্নেলসাহেব আপনার সঙ্গে সম্ভবত লুকোচুরি খেলতে চেয়েছিলেন। আসুন।
বলে তিনি আমার কাধ ধরে বাংলোর বারান্দায় নিয়ে গেলেন। কর্নেল অটো রিকশর ভাড়া মিটিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। তখন দেখলুম একটা তাগড়াই চেহারার লোক গেটটা বন্ধ করে দিল।
বারান্দা থেকে সমুদ্র দেখা যাচ্ছিল। এখানেও নীচের দিকে একটা খাঁড়ি আছে। দেখলুম। বিচ শুরু হয়েছে প্রায় আধ কিলোমিটার দূর থেকে।
ক্যাপ্টেন বার্মা বললেন, এই বারান্দা থেকে আপনাদের আসতে দেখেই কফির ব্যবস্থা করেছি। রামলাল এখনই ট্রে হাতে হাজির হবে। তার আগে কথাটা বলে নিই।
কর্নেল আস্তে বললেন, ড. ফাটনবিশ কি টেলিফোন করেছিলেন?
ক্যাপ্টেন বার্মা গোঁফে তা দিয়ে একটু হেসে বললেন, সুভদ্র বর্মন যা-ই বলুন, এই বিজ্ঞানী মহিলা অত্যন্ত ধুরন্ধর। আমি তাকে সমুদ্রের তল থেকে কুড়িয়ে পাওয়া পেপারগুলোর যে জেরক্স কপি দিয়েছি, তার মতে সেগুলোর মধ্যে যা তথ্য আছে, সবই নাকি বাস্তবে অন্তত এখনও সম্ভব নয়।
কর্নেল বললেন, যে প্রজাতির কীট ফসলের মাঠে বা বাগানে ছেড়ে দিলে মুহূর্তে অ্যামিবার মতো নিজেকে লক্ষ লক্ষ কীটে পরিণত করবে এবং সব খেয়ে শেষ করে ফেলবে এটা ভাবতে গেলে সত্যি আঁতকে উঠতে হয়। এমন কীট তৈরি করে কোনো শত্রু দেশের মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসতে পারলে কী অবস্থা হবে ভাবুন। অবশ্য জয়ন্তদের পক্ষে লেখার মতো খবর হবে তা ঠিক।
অবাক হয়ে বললুম, অ্যাবসার্ড! ওই থিসিস যে লিখেছে তার মাথায় গন্ডগোল আছে।
এই সময় রামলাল ট্রেতে কফি আর স্ন্যাকস নিয়ে এল। তারপর যথারীতি কর্নেলকে সেলাম করে আমার দিকে তাকাল। তারপর বলল, এই ছোটোসাহেবকে আমার চেনা মনে হচ্ছে।
ক্যাপ্টেন বার্মা কপট ধমকের সুরে বললেন, খুব হয়েছে। ছোটোসাহেবকে তুই দু-বছর আগে আমার ফার্মহাউসে দেখেছিস, তা এরই মধ্যে ভুলে গেছিস?
রামলাল আমাকে সেলাম ঠুকে দ্রুত চলে গেল।
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, তাহলে পিটার গোমস অতি লোভে ফাঁদে পা দিয়ে প্রাণ হারাল!
ক্যাপ্টেন বার্মা বললেন, পিটার সম্পর্কে এখানে দুর্নাম ছিল। সে নাকি উপকূলরক্ষী বাহিনীর চোখ এড়িয়ে দূরের সমুদ্রে দাঁড় করানো জাহাজ থেকে বোট বোঝাই করে ইলেকট্রনিক্স গুডস, এমনকী আগ্নেয়াস্ত্রও নিয়ে আসত। এলাকায় দিনে দিনে রাজনীতিওয়ালারা তাদের চ্যালাদের হাতে প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিচ্ছে। এবং সংঘর্ষ বাধছে, এটা কিন্তু একটা প্রত্যক্ষ ঘটনা।
আমি বললুম, এবার পুলিশ নিশ্চয় তার দোকান এবং বাড়ি সার্চ করে দেখবে।
ক্যাপ্টেন বার্মা হাসতে হাসতে বললেন, পুলিশ ওর বাংলো আর দোকান বহুবারই সার্চ করেছে। এই তো গত সপ্তাহে কাস্টমসের লোকেরা এক রাত্রে হানা দিয়েছিল। কিন্তু কোনো বেআইনি জিনিস পায়নি, অস্ত্র তো দূরের কথা।
কর্নেল কফি শেষ করে চুরুট ধরালেন। তারপর চোখে বাইনোকুলার তুলে একটু পরে বললেন, সুভদ্র বর্মন হাঁটতে হাঁটতে আসছেন। তার মতো সাংবাদিকদের পায়ে হেঁটে ঘোরাঘুরিই ভালো। দৈবাৎ অনেক কিছু আবিষ্কৃত হয়ে যায় এবং তা থেকে কাগজের জন্য চমৎকার স্টোরি দাঁড় করানো যায়।
কথাগুলো বলার সময় কর্নেলের একটা চোখ ছিল আমার দিকে। তাই বললুম, বর্মনদা দিল্লিতে ইংরেজি কাগজে কাজ করেন। জাতীয় স্তরের কাগজ। প্রচুর পাতা। আর আমাদের সত্যসেবক পত্রিকার প্রচার যত বেশিই হোক, অত বেশি পাতা খরচ করার সামর্থ্য নেই।
এই সময় ক্যাপ্টেন বার্মা রামলালকে ডাকলেন এবং সে এসে ট্রে নিয়ে গেল।
ক্যাপ্টেন বার্মা এবার মৃদু স্বরে বললেন, সুভদ্র কী খবর আনবে জানি না। তার আগে কর্নেলসাহেব কি আর একবার থানায় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন? কারণ, এতক্ষণে বোধহয় অফিসার-ইন-চার্জ মাধবনসাহেব ফিরে এসেছেন।
কর্নেল বললেন, ঠিক বলেছেন। মাধবনসাহেবের সঙ্গে আমার তো গতকালই আলাপ হয়ে গেছে। চলুন।
বলে তিনি ক্যাপ্টেন বার্মার সঙ্গে ঘরের ভেতরে ঢুকলেন। আমি মুখ ফিরিয়ে বর্মনদাকে খুঁজছিলুম। কিছুক্ষণ পরে দেখলুম বর্মনদা বিচের মাথায় বাঁধের পথে। হেঁটে আসছেন। এখানে পৌঁছোতে হলে তাকে একটা বিস্তীর্ণ কেয়াবন পেরিয়ে আসতে হবে। কারণ, বাঁধটা ওখানেই শেষ হয়ে গেছে। তারপর শুধু বড়ো বড়ো পাথর।
একটু পরেই তিনি কেয়াবনে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
এদিকে কর্নেল টেলিফোন করে বেরিয়ে এলেন। ক্যাপ্টেন বার্মাকে তার সঙ্গে দেখলুম না।
বললুম, আশা করি এরপর আর আমার সঙ্গে লুকোচুরি করবেন না।
কর্নেল তার প্রশস্ত টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, নাঃ!
–তাহলে বলুন পুলিশের অফিসার-ইন-চার্জ মাধবনসাহেবের কাছে কী খবর নিয়ে এলেন?
কর্নেল হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, পুলিশের ধারণা পিটার গোমস পা পিছলে দৈবাৎ খাঁড়িতে পড়ে মারা গেছে। কয়েকজন জেলে নাকি বলেছে ক-দিন থেকে ভোরবেলায় গোমসসাহেব নাকি ওখানে এসে বসে থাকত। আর সিগারেট টানত। কথাটা যে সত্যি, পুলিশ তার প্রমাণ পেয়েছে। ওখানে প্রচুর ফিলটার টিপস পড়ে আছে। মি. মাধবনের ধারণা ইদানীং গোমসসাহেবের। ব্যবসায়ে মন্দা চলছিল। কারণ তার আসল ব্যবসাই তো জাহাজ থেকে বিদেশি জিনিস, বিশেষ করে অস্ত্রশস্ত্র চোরাচালান। পুলিশ এবং কাস্টমসের চাপে ইদানীং সে কারবার বন্ধ ছিল। মি. মাধববনের ধারণা, মানসিক অবসাদের ফলেও পিটার গোমস আত্মহত্যা করতে পারে।
বললুম, কিন্তু কর্নেল, আমি আপনাকে বলেছি ভোরবেলায় সি বিচের পশ্চিম প্রান্তে খাঁড়ির কাছাকাছি জায়গায় আমি তামিল সাংবাদিক রাঘবনকে বসে থাকতে দেখেছি। তারপর হঠাৎ সে পাথরের চাঙড়ের ওপর দিয়ে দ্রুত পা ফেলে ওপরের বাঁধে উঠে গিয়েছিল। বাঁধের দু-ধারে ঝোঁপঝাড়, গাছপালা। বাঁধের দু-ধারে ঝোঁপঝাড়, গাছপালা। ঘন জঙ্গল। তাই তাকে আর দেখতে পাইনি। এ থেকে আমার সন্দেহ দুজনের ওখানে দেখা হওয়ার কথা ছিল। তারপর যে কোনো কারণেই হোক রাঘবন পিটারকে আচমকা ধাক্কা মেরে নীচের খাড়ির জলে ফেলে দেয়।
কর্নেল হাসলেন–জয়ন্ত, তোমাকে আমি বরাবর অবভাস তত্ত্বের কথা বলি। ইংরেজিতে বলতে গেলে হোয়াট অ্যাপিয়ারস ইজ নট রিয়াল। বাংলায় একটা কথা। আছে। কাক এসে একটা তালে বসল আর তালটা পড়ে গেল। এই দেখে কেউ যদি ভাবে কাকের শরীরের চাপেই তালটা খসে পড়ল, সে ভুল করবে।
সায় দিয়ে বললুম, হ্যাঁ, আপনি কাকতালীয় যোগের কথা বলছেন।
কর্নেল হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে বললেন, কী সর্বনাশ! তোমার বর্মনদা দেখছি ওই কেয়াবনের ভেতর দিয়ে আসছে। সর্বনাশ! ওখানে নাকি প্রায় সামুদ্রিক অজগর সাপ এসে ডিম পাড়বার জন্য ডেরা পাতে।
কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। বর্মনদা কেয়াবন ঘুরে কয়েকটা পাথরের চাঙড়ের ওপর দিয়ে এগিয়ে এলেন। তারপর গেটের কাছে এসে বললেন, আমি কিন্তু ফিরে আসতে দেরি করিনি কর্নেলসাহেব।
সেই তাগড়াই চেহারার লোকটা বর্মনদাকে সেলাম করে গেট খুলে দিল। বর্মনদা এসে বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসলেন। তারপর হাঁক দিলেন, রামলাল! চা-কফি যা হোক কিছু একটা শিগগির নিয়ে এসো। হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।
ক্যাপ্টেন বার্মা ঘর থেকে বেরিয়ে হাত বাড়িয়ে বললেন, হ্যাল্লো…হ্যাল্লো বর্মন। তুমি এক্কেবারে কথামতো ঠিক সময়ে এসে পড়েছ। তবে কোনো তাড়াহুড়ো নয়। আগে রামলালের সেবা নাও, তারপর কথা হবে।
রামলালের স্বভাব কতকটা ষষ্ঠীচরণের মতো। সে তখনই এক পেয়ালা কফি রেখে গেল।
বর্মনদা কফিতে চুমুক দিয়ে হঠাৎ ফিক করে হেসে বললেন, ভুলেই গিয়েছিলুম আজ ক্যাপ্টেন সাহেবের বাংলোয় আমাদের লাঞ্চের নেমন্তন্ন।
ক্যাপ্টেন বার্মা আস্তে বললেন, তুমি সাকসেসফুল তো?
বর্মনদা বললেন, হ্যাঁ। তবে টের পেয়েছি ড. ফাটনবিশের এখানে কোনো গার্জেন আছেন। তিনি চলছেন তাঁরই হুকুমে।
.
০৪.
কফি পানের পর বর্মনদা যা বললেন তা সংক্ষেপে এই :
পিটার গোমসের এক কর্মচারী ওড়িয়া। তার নাম নবকুমার পণ্ডা। আজ ওই সাংঘাতিক ঘটনার জন্য পিটার গোমসের দোকান বন্ধ ছিল। কিন্তু মি. পণ্ডা পিছনের বাংলোয় ছিল। গোমসসাহেবের সঙ্গে কম্পিউটার কেনার মিথ্যা কাহিনি বানিয়ে এবং বর্মনদার অচেনা লোকদের সঙ্গে ভাব করার কুশলতা তো অতুলনীয়, তিনি ভদ্রলোককে করায়ত্ত করে ফেলেছিলেন। তারপর একথা-ওকথা বলার ফাঁকে জানিয়েছিলেন বাঙ্গালোর থেকে এখানে একজন মহিলা বিজ্ঞানীর আসার কথা। তিনি বর্মনদার পরিচিত। তিনি বলেছিলেন গোমসসাহেবের কাছে এক ধরনের জাপানি কম্পিউটার পাওয়া যায়। তাতে বিজ্ঞানের সব দুরূহ অঙ্ক নিমেষে কষে ফেলা যায়। সেই মহিলা বিজ্ঞানী নিশ্চয়ই গোমসসাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। মি. পণ্ডা বর্মনদাকে বলেছে এক মহিলা কাল তাকে ফোন করেছিলেন। তিনি বাঙ্গালোরে থাকেন। তখন সাহেব বাইরে কোথাও গিয়েছিল। তাঁকে সন্ধ্যার পর ফোন করতে বলেছিল। সন্ধ্যায় গোমসসাহেব দোকানের অফিস ঘরে ছিল। সেই সময় টেলিফোন এসেছিল। কথাবার্তা শুনে মি. পণ্ডা বুঝতে পেরেছিল বাঙ্গালোরের সেই মহিলা বিজ্ঞানী কথা বলছেন। তারপর গোমসসাহেব অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। ওদিকে আগেই বর্মনদা হোটেল পূর্বাচলের ক্যান্টিনের একজন কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে এসেছেন। কর্মচারীটি তাকে বলেছেন, তেইশ নম্বর সুইটে ভদ্রমহিলার সঙ্গে গোমসসাহেব দেখা করতে এসেছিল। তাহলে দেখা যাচ্ছে ক্যাপ্টেন বার্মা, কর্নেল এবং বর্মনদা যে সুইটে রাত নটায় ডিনার খেয়েছেন সেই সুইটেই তার কিছুক্ষণ আগে পিটার গোমস গিয়েছিল।
বর্মনদার কথা শেষ হওয়ার পর ক্যাপ্টেন বার্মা উত্তেজিতভাবে বললেন, তাহলে দেখুন কর্নেল, আমার কথায় কোনো ভুল ছিল না। আমি ড. ফাটনবিশের টেবিলে কাগজপত্রের তলা থেকে যে নেমকার্ডটা দেখতে পেয়েছিলুম, সেটা সত্যিই পিটার গোমসের কার্ড। তখনই বুঝেছিলুম এই ধুরন্ধর মহিলা আমার কুড়িয়ে পাওয়া এক জার্মান বিজ্ঞানীর থিসিসের জেরক্স কপি হাতিয়ে গোমসকেই বেচে দিয়েছেন। আমার ভুল হয়েছিল ওঁকে জেরক্স কপি দেওয়া। কর্নেলসাহেব, এবার বুঝুন আপনার সায় না পেলে আমি কখনোই মহিলাকে জেরক্স কপি দিতুম না।
কর্নেল বললেন, ড. ফাটনবিশ এখনও এখানে আছেন কি না সেটা জানাই জরুরি।
বর্মনদা বললেন, নিশ্চয় আছেন। এভাবে হঠাৎ সম্মেলন ছেড়ে চলে গেলে তার প্রতি অনেকের সন্দেহ জাগতে পারে। কারণ তিনি নাকি একটা যুগান্তকারী জীববিজ্ঞানের তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন যা সম্মেলনে তার পড়ার কথা।
ক্যপ্টেন বার্মা বললেন, আমরা গাড়ি বের করে এখনই সমুদ্রভবন অডিটোরিয়ামে যেতে পারি।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। আমাদের এখনই গিয়ে দেখা দরকার পিটার গোমস মারা পড়েছেন শুনে ড. ফাটনবিশ কোনো অছিলায় এখান থেকে কেটে পড়েছেন কি না।
ক্যাপ্টেন বার্মার গাড়িতে মিনিট দশেকের মধ্যেই আমরা সমুদ্রভবন অডিটোরিয়ামের সামনে পৌঁছেলুম। পার্কিং জোনে গাড়ি রেখে কর্নেল এবং ক্যাপ্টেন বার্মা বললেন, আমরা শ্রোতাদের ভিড়ে জায়গা করে নেব। আপনারা দুজনে সাংবাদিক, আপনারা প্রেস কর্নারে গিয়ে বসবেন। তবে আমাদের দিকে। একটু লক্ষ রাখবেন।
প্রেস কর্নারে দুজনে দু-দিক থেকে গিয়ে নিজেদের সিটে বসলুম। তখন অন্য এক বিজ্ঞানী সবে তাঁর পেপার পড়তে শুরু করেছেন। প্রেস কর্নারে কিন্তু রাঘবনকে দেখলুম না। তাকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেনি তো?
বর্মনদার চোখে চোখ পড়তেই তিনি চোখের ইশারায় রাঘবনের শূন্য সিটটি দেখিয়ে দিলেন।
সাংবাদিকরা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বিজ্ঞানীর ভাষণে চোখ বুলোচ্ছিলেন। বলা দরকার আমার সিটেও যথারীতি এক কপি প্রতিলিপি সযত্নে রাখা ছিল। সেটা আমার হাতে কিন্তু আমার দৃষ্টি বিজ্ঞানীদের আসনের দিকে। সেখানে ড. ফাটনবিশকে আবিষ্কার করতে দেরি হল না। কারণ মহিলা বিজ্ঞানীর সংখ্যা মাত্র পাঁচ।
তারপরই লক্ষ করলুম ড. ফাটনবিশ বর্মনদার দিকে তাকিয়ে একবার হাত নাড়লেন। বর্মনদাও যথারীতি হাত নাড়লেন। হাতের ভাষায় দুজনের মধ্যে কী কথা হল কে জানে, তবে ড. ফাটনবিশের মুখে হাসি ছিল।
তখন প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। জলদগম্ভীর স্বরে পেপার পড়া শেষ করতে বিজ্ঞানী ভদ্রলোকের প্রায় এক ঘণ্টা লাগল। সময় কাটছিল না। দুর্বোধ্য সব বিষয়ে এইসব ভাষণ শোনা আমার পক্ষে খুব কষ্টকর। কিন্তু এরপর ঘোষিকা মিস চন্দ্রলেখা ঘোষণা করলেন, এবার জীববিজ্ঞানের জিনোম প্রকল্প বিষয়ে পেপার পড়বেন প্রথিতযশা জিনোম ও সমুদ্রবিজ্ঞানী ড. সুভদ্রা ফাটনবিশ। তাঁর ভাষণের পরই আমাদের মর্নিং সেশন শেষ হবে। লাঞ্চের পর দ্বিতীয় সেশন শুরু হবে বেলা চারটেয়। আমি ড. ফাটনবিশকে মঞ্চে আসতে অনুরোধ জানাচ্ছি।
সুভদ্রা ফাটনবিশ আসন ছেড়ে এগিয়ে গেলেন। তারপর যখন মঞ্চে উঠলেন, দেখলুম তাঁর পরনে বাঙালি মেয়েদের মতো পরা শাড়ি। মঞ্চে তাকে সুন্দর এবং সপ্রতিভ দেখাচ্ছিল। ফাইল খুলে তিনি তার পেপার বের করলেন।
ইতিমধ্যে আমাদের কাছে তার পেপারের কপি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তাঁর পেপারের শীর্ষনাম : এ নিউ হরাইজন ইন দি ফিল্ড অফ জিনোম প্রজেক্ট।
তার কণ্ঠস্বর তীব্র। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলুম উনি কী বলতে চাইছেন। আণবিক জীববিজ্ঞানের পটভূমিতে দীর্ঘকাল গবেষণার পর ড. ওয়াটসন নামে এক বিজ্ঞানী জীবকোষে ক্রোমোজমের মধ্যে মালার মতো গাঁথা জিনের ভিতরে ডি এন এ-র স্ট্রাকচার বা গঠন আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি ডি এন এ চর্চার জন্য যে প্রকল্প হাতে নেন তার নাম জিনোম প্রকল্প। ড. সুভদ্রা ফাটনবিশ এই প্রকল্পে কয়েক বছর গবেষণা করার পর একটা নতুন তথ্য আবিষ্কার করেছেন। পিঁপড়ে জাতীয় কীটের মতো প্রাণীদের ডি এন এ-কে এমন ভাবে বদলে দেওয়া যায় যা হাইড্রোজেন বোমার চেয়ে সাংঘাতিক মারণাস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। তার তত্ত্ব অনুসারে কোনো কীটের ডি এন এ-তে পরিবর্তন ঘটিয়ে এমন অবস্থায় আনা যায় যা প্রতি সেকেন্ডে ক্রমাগত বংশবৃদ্ধি করবে এবং উদ্ভিদজগৎকে খেয়ে নিঃশেষ করে ফেলবে। কোনো দেশ যদি হাতে এই অস্ত্র পায় তাহলে সে পৃথিবীকে ধ্বংস করে দিতে পারবে।
বিজ্ঞানীদের বসার জায়গা থেকে গুঞ্জন শোনা গেল। তারপরই দেখলুম ক্যাপ্টেন বার্মা উঠে দাঁড়িয়ে ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন, ড. ফাটনবিশ, আপনি আমার দেওয়া জার্মান বিজ্ঞানী ফ্রেডারিক স্টাইনগাসের পেপার থেকে তথ্য নিয়েছেন। একটা অত্যন্ত অন্যায়।
সম্মেলনে জোরালো গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। বর্মনদা আমাকে চুপিচুপি বললেন, ভুলটা আমারই। ক্যাপ্টেন বার্মা যে এমন বোকামি করে বসবেন ভাবতে পারিনি।
বর্মনদা কথাগুলো আমাকে বাংলাতেই বললেন। আমাদের আশেপাশে কোনো সাংবাদিক বাংলা জানেন বলে মনে হল না। যাই হোক, সুভদ্রা ফাটনবিশ পালটা ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন, ওই জার্মান বিজ্ঞানীর তত্ত্ব আমি আগেই জেনেছি।
ক্যাপ্টেন বার্মাকে কর্নেল নিরস্ত করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তিনি আরও ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, আপনি অসত্য কথা বলছেন। জার্মান বিজ্ঞানীর একটি গোপন ডকুমেন্টের জেরক্স কপি আপনাকে দেওয়া সাক্ষী এখানেই উপস্থিত আছেন।
তারপর দেখলুম কর্নেল ক্যাপ্টেন বার্মাকে প্রায় জোর করে বাইরে নিয়ে গেলেন। উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে টাইসুট-পরা জাঁদরেল এক ভদ্রলোক গম্ভীর কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন, আমি আপনাদের চুপ করতে অনুরোধ জানাচ্ছি। ওই ক্যাপ্টেন বার্মা যে একজন বদ্ধ পাগল তা এখানকার সবাই জানে। আমরা চাই। সম্মেলনের শিষ্টতা যেন বজায় থাকে। ড. ফাটনবিশ, আপনি আপনার পেপার পড়ুন।
গুঞ্জন থেমে গেল। সুভদ্রা ফাটনবিশ ততক্ষণে আকস্মিক আক্রমণ সামলে নিয়েছেন। তিনি আবার পেপার পড়া শুরু করলেন।
বর্মনদা চুপিচুপি ডাকছিলেন, জয়ন্ত, উঠে পড়ো।
তখনই দুজনে বেরিয়ে এসে দেখলুম কর্নেল এবং ক্যাপ্টেন বার্মা তাঁর গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে উত্তেজিতভাবে কথা বলছেন। আমরা কাছে যেতেই ক্যাপ্টেন বার্মা বললেন, সুভদ্র, আমার ইচ্ছে করছে ওই মহিলাকে তুলে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিই। মহিলা কী চালাক লক্ষ করেছ। কিন্তু এই কাণ্ডটা তুমিই বাধালে।
বর্মনদা বললেন, আমি কল্পনাও করিনি ভদ্রমহিলা অন্যের থিসিসকে নিজের বলে চালাবেন।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, আমার মতে ক্যাপ্টেনসাহেবের রাগের কোনো কারণ ছিল না।
ক্যাপ্টেন বার্মা বললেন, কেন? আমি কি মিথ্যা বলছি? আপনিও তো জার্মান বিজ্ঞানীর পেপার পুরোটা পড়েছেন।
কর্নেল বললেন, কিন্তু ক্যাপ্টেনসাহেব, আপনি ভুলে যাচ্ছেন জার্মান বিজ্ঞানীর পেপারের দ্বিতীয় অংশই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওই অংশেই তার এই প্রজেক্টের ফরমুলা সবিস্তারে দেখানো হয়েছে। সেই জন্যই আমি আপনাকে দ্বিতীয় অংশটার জেরক্স কপি দিতে নিষেধ করেছিলুম।
ক্যাপ্টেন বার্মা এতক্ষণে শান্ত হলেন। বললেন, ভাগ্যিস আমি ওই ভাইটাল সেকেন্ড পার্টটা ওঁর হাতে তুলে দিইনি! যাই হোক, চলুন, বাংলোয় ফেরা যাক। সুভদ্র, উঠে পড়ো।
বর্মনদা গাড়িতে উঠে বললেন, যাই বলুন ক্যাপ্টেনসাহেব, আমি কিন্তু জেনেশুনেই এই খেলাটা খেলেছিলুম। সুভদ্রা ফাটনবিশ আমার অনেক দিনের চেনা মহিলা। দিল্লিতে বায়োলজিক্যাল রিসার্চ ইন্সটিটিউটে থাকার সময় উনি এক বিদেশি চরের পাল্লায় পড়েছিলেন। সময়মতো আমি সুভদ্রাকে সাবধান করে দিই।
বাংলোয় পৌঁছে এবার আমরা ড্রয়িংরুমে বসলুম। বললুম, আমরা যা-ই ভাবি না কেন, এই ঘটনা কিন্তু সবিস্তারে দেশের সব কাগজে বেরুবে। ড. ফাটনবিশের ভাবমূর্তি এতে ক্ষুণ্ণ হতে পারে, কী বলেন বর্মনদা?
বর্মনদা বললেন, সে যা হবার হবে, কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে এবার ক্যাপ্টেনসাহেবের কাছে গপ্পোটা আদায় করার জন্য সাংবাদিকরা এসে ভিড় বাড়াবে।
কর্নেল বললেন, তুমি ঠিক ধরেছ সুভদ্র। ক্যাপ্টেনসাহেব, একটার মধ্যে লাঞ্চ সেরে নিয়ে আপনি বরং আপনার ফার্মহাউসে গিয়ে গা ঢাকা দিন।
ক্যাপ্টেন বার্মা গম্ভীর মুখে বললেন, রঘুনাথ ওদের গেট থেকেই ভাগিয়ে দেবে। ইস! কী যে ভুল করেছি। আমার অ্যালসেশিয়ান ডনিকে সঙ্গে নিয়ে এলে ভালো করতুম। ফার্ম-হাউস পাহারার কাজে ওকে রেখে আসাই ভুল হয়েছে।
উনি ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। কর্নেল হাত বাড়িয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। তারপর সাড়া পেয়ে বললেন, আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।… ওসিসাহেব এখন নেই…ঠিক আছে, উনি ফিরে এলে বলবেন আমি রিং করেছিলুম।
রিসিভার রেখে উনি সেন্টার টেবিল থেকে একটা ইংরেজি পত্রিকা টেনে নিলেন। বুঝতে পারলুম আমার বৃদ্ধ বন্ধু পত্রিকার ছাপানো অক্ষরে চোখ রেখে মনের ভিতরে পিটার গোমসের হত্যার রহস্য নিয়েই খেলা শুরু করেছেন।
এই সময় আমি পকেট থেকে সেই বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট বার করে বর্মনদার সামনে ধরলুম। বর্মনদা অবাক হয়ে বললেন, আরে এ মাল তুমি পেলে কোথায়? তাছাড়া তুমি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলে বলছিলে।
বলে বর্মনদা একটা সিগারেট টেনে নিলেন। আমিও একটা নিলুম। বর্মনদা লাইটার বের করে সিগারেট ধরালেন। কর্নেল বললেন, আমারও চুরুট খেতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু খাব না। যত শীঘ্র রামলাল লাঞ্চের আয়োজন করতে পারে ততই ভালো। বর্মন, তোমাকে কাল রাত্রে যে চুরুটটা দিয়েছিলুম তার সদ্ব্যবহার করেছ তো?
করেছি।
-বাজে বোলো না। অত কড়া চুরুট তুমি নিশ্চয় এখনও পুরোটা শেষ করতে পারোনি।
বর্মনদা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, আপনার শিষ্য জয়ন্ত সাক্ষী।
বললুম, হা কর্নেল। বর্মনদা আজ ভোরবেলায় কাফেটেরিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে একটা চুরুট টানছিলেন। গন্ধ শুঁকেই আমি কিন্তু বুঝতে পেরেছিলুম ওটা আপনারই উপহার।
সাড়ে বারোটার মধ্যে লাঞ্চ সেরে ক্যাপ্টেন বার্মার গাড়িতে উঠেছিলুম। কর্নেল বলেছিলেন, আপাতত আমার ফার্মে যাওয়ার ইচ্ছা নেই। কারণ পুলিশের সঙ্গে আমার যোগাযোগ রাখা দরকার। তাছাড়া বর্মন এবং জয়ন্তকেও আমার দরকার আছে। তাই আমাদের আপনি রাস্তায় কোথাও নামিয়ে দেবেন। আমি টেলিফোনে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখব। আর একটা কথা, এরপর আপনি কিন্তু সাবধানে থাকবেন না। সাংবাদিকদের উপদ্রবের জন্য বলছি না। আমার সন্দেহ হচ্ছে শ্ৰীমতী ফাটনবিশকে প্রকাশ্যে অপমান করায় তো বটেই, তাছাড়া জার্মান বিজ্ঞানীর পেপারের সেকেন্ড পার্টের লোভে আপনি আক্রান্ত হতে পারেন।
ক্যাপ্টেন বার্মা গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বাঁকা হেসে বলেছিলেন, আপনি তো দেখেছেন আমার রাইফেল আছে। তাছাড়া সঙ্গেও আমি ফায়ার-আর্মস রাখি। আমার ফার্মে পৌঁছোতে পারলে আমি সম্পূর্ণ নিরাপদ।
সমুদ্রভবন-এর কিছুটা আগে আমাদের নামিয়ে দিয়ে ক্যাপ্টেন বার্মা তার গাড়ি একটা পিচ রাস্তার চড়াইয়ের দিকে ঘোরালেন। ওদিকটা টিলা পাহাড় আর ঘন জঙ্গল।
একটু পরেই একটা প্রাইভেট ট্যাক্সি বাজারের দিক থেকে আসতে আসতে আমাদের কাছে এসে গতি কমাল। চন্দনপুর-অন-সি-তে অনেক দেখবার মতো জায়গা আছে। তাই এখানে ট্যাক্সিও পাওয়া যায়। সেই ট্যাক্সিতে চেপে আমরা হোটেল দ্য শার্ক-এ পৌঁছোলুম।
লাউঞ্জে এখন কেউ নেই। কিন্তু ক্যান্টিনের এক প্রান্তে জানলার ধারে একটা টেবিলের সামনে বসে আছে তামিল সাংবাদিক রাঘবন। তার দৃষ্টি সমুদ্রের দিকে।
কর্নেলকে দেখে ম্যানেজার মি. ওটেকাট্টে সবিনয়ে বললেন, কর্নেলসাহেব, আমাকে কি মনে আছে আপনার? আগে কিন্তু আমি হোটেল পূর্বাচলেই ছিলুম। আপনাকে দেখা মাত্রই চিনতে পেরেছি।
কর্নেল হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বললেন, আমার সৌভাগ্য মি. ওটেকাট্টে। আপনি যে এই হোটলে আছেন তা আমি শুনেছি। কিন্তু আপনি আমার এই তরুণ বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরীকে চিনতে পারছেন না দেখে
মি. ওটেকাট্টে দ্রুত বললেন, ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছে তবে এতক্ষণে আমার মনে পড়ল পূর্বাচলে মি. চৌধুরী আপনার সঙ্গেই ছিলেন।
কথাবার্তা শুনে রাঘবন একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দেখল তারপর আবার জানলার দিকে ঘুরে সিগারেট টানতে থাকল।
আমি কর্নেলকে সঙ্গে নিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালুম। বর্মনদা খুব চাপা স্বরে বললেন, ওই তামিল ভদ্রলোকের সঙ্গে একটু আড্ডা দিয়ে আসি।
বললুম, কিন্তু সাবধান। ওর মনমেজাজ দেখছি বোধহয় ভালো নয়।
বর্মনদা একটু হেসে বললেন, জয়ন্ত, এই সুভদ্র বর্মন সারা দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে বন্ধুতা করতে বেশি সময় নেয় না। কাজেই তোমার চিন্তার কারণ নেই।
দোতলায় আমার ঘরে গিয়ে জানলা খুলে দিয়ে জোরে ফ্যান চালিয়ে দিলুম। ব্যালকনির দিকে দরজা খুলে দিলুম। কর্নেল ব্যালকনিতে গিয়ে একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর বললেন, কী সর্বনাশ! তুমি ওই অভিশপ্ত পোডড়া বাতিঘরের এত কাছে আছো? তোমার মনে আছে নিশুতি রাত্রে ভয়ঙ্কর সেই হাওয়া-সাপ, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে কান্ডিলম, আমাকে ভীষণ জব্দ করেছিল।
বললুম, হ্যাঁ, মনে আছে। কিন্তু আপনি বাতিঘরটা কাছে বলছেন কেন? ওটা এখান থেকে প্রায় হাফ কিলোমিটার দূরে। অবশ্য আপনার বাইনোকুলারে ওটার কোনো দূরত্ব নেই।
কর্নেল এবার বাইনোকুলারে চোখ রেখে বললেন, ওদিকটা এখন একেবারে নির্জন। এখন কিছুদিন পিটার গোমসের আত্মার ভয়ে একাদোকা কেউ ওখানে পা বাড়াবে না।
বলে কর্নেল বাইনোকুলার ঘুরিয়ে সমুদ্রে কী দেখতে থাকলেন।
জিজ্ঞেস করলুম, কিছু দেখতে পাচ্ছেন নাকি?
–পাচ্ছি।
ব্যস্ত হয়ে বললুম, কী, কী দেখতে পাচ্ছেন?
-সমুদ্রে যা দেখা যায়।
বলে তিনি বাইনোকুলার নামিয়ে রেখে ঘরে ঢুকলেন। চেয়ার টেনে বসে বললেন, বলো তো সমুদ্রে কী দেখা যায়?
একটু ভেবে বললুম, আপনার বাইনোকুলারের বিচারে বলা যায় জাহাজ।
কর্নেল হাসলেন, বাঃ! দিনে দিনে তোমার বুদ্ধি খুলে গেছে। জাহাজটা অবশ্য অনেক দূরেই আছে। মনে হল বিদেশি জাহাজ। কিন্তু জাহাজটা ওখানে নোঙর বেঁধে আছে। আমাদের কোস্টগার্ডরা সম্ভবত ওটা চেক করে ফিরে এসেছে।
আমি বিছানায় বসে বললুম, আমার ভাতঘুম নষ্ট করার জন্য আপনার প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নাই। কিন্তু এখনও একটা বিষয়ে আপনি আমাকে অন্ধকারে রেখেছেন।
কর্নেল তার বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা টেবিলে রেখে পা দুটো ছড়িয়ে দিলেন। তারপর বললেন, তুমি আমাকে প্রশ্ন করতে পারো কী ব্যাপারে তোমাকে অন্ধকারে রেখেছি।
বললুম, সমুদ্রে জাহাজডুবিতে দৈবাৎ একটা ওয়াটারপ্রুফ প্যাকেট কোনো খাঁড়ির দিকে ভেসে আসতেই পারে। কিন্তু প্যাকেটটা নিশ্চয় কারও কাছে পাঠানো হয়েছিল অথবা স্বয়ং সেই জার্মান বিজ্ঞানী সঙ্গে নিয়ে মাদ্রাজ বা বোম্বাই যাচ্ছিলেন। এইসব খোঁজখবর আপনি নিশ্চয় এই কয়েকদিনে প্রতিরক্ষা বাহিনীর কিংবা কোস্টগার্ডদের কর্তৃপক্ষের কাছে জেনে নিয়েছেন বলেই আমার ধারণা।
কর্নেল চোখ বুজে মুখ একটু উঁচুতে তুলে যেন ঝিমোচ্ছিলেন। আমার কথার কোনো জবাব দিলেন না।
তখন আবার আমি বললুম, আপনি কিন্তু আমাকে পাত্তা দিচ্ছেন না।
এবার কর্নেল ওই অবস্থায় থেকেই বললেন, এখানে এসে তোমার বুদ্ধি অনেকটা খুলে গেছে। হ্যাঁ, তোমার প্রশ্নটা নিয়ে আমি যথারীতি অনন্তপুরমের কোস্টগার্ড অফিসে এবং মাদ্রাজে প্রতিরক্ষা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ। করেছিলুম। তবে ওই প্যাকেটের কথা তাদের জানাইনি। শুধু জানতে চেয়েছিলুম জার্মানি থেকে কেউ ওই জাহাজের যাত্রী ছিলেন কিনা কিংবা কেউ কোনো জিনিস পাঠিয়ে থাকলে তার কোনো লিস্ট উদ্ধার করা হয়েছিল কি না। দুটি সোসেই আমি জানতে পেরেছিলুম জাহাজটি ছিল ছোটো একটি কারগো ভেসেল। ইঞ্জিন বিগড়ে গিয়ে সমুদ্রের উপকূলের দিকে ডুবো পাথরে ধাক্কা লেগে তলা চিড় খেয়েছিল। কোস্টগার্ডরা নৌবাহিনীকে খবর দিয়েছিল। নৌবাহিনী অনেক জিনিস উদ্ধার করেছে। জাহাজটিতে ক্যাপ্টেন এবং যে কজন নাবিক ছিল তারা সবাই প্রাণে বেঁচে যায়।
এই সময় দরজায় টোকার শব্দ হল। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখি বর্মনদা। তিনি ভিতরে এসে অন্য একটা চেয়ারে বসে একটু হেসে বললেন, রাঘবন গভীর জলের মাছ। তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলুম এখানে এসেই পিটার গোমসের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। পরিচয়ের পর দুজনের মধ্যে বন্ধুতাও হয়। তাই পিটারের আকস্মিক মৃত্যুতে রাঘবনের মনের অবস্থা খারাপ। আমি কৌশলে তার কাছ থেকে জানবার চেষ্টা করছিলুম ডঃ ফাটনবিশকে সে ব্যক্তিগতভাবে চেনে কি না। রাঘবন বলল, মহিলার সঙ্গে তার পরিচয় নেই, তবে সে শুনেছে ডঃ ফাটনবিশ খুব দাম্ভিক প্রকৃতির।
কর্নেল সোজা হয়ে বসে টেলিফোনের রিসিভার তুলে জিরো ডায়াল করার পর তারপর সাড়া পেয়ে বললেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। ক্যাপ্টেন বার্মা, আপনার ফার্মে কোনো সাংবাদিক গিয়ে ঝামেলা করেনি তো? …হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন, কিন্তু তখন অত তাড়াতাড়ি আপনি চলে গেলেন, আমার একটা কথা বলা হয়নি। আপনি আজ রাত্রে ফার্ম হাউস থেকে বেরোবেন না। আমি অবশ্য আপনার বাংলোতে যেমন ছিলাম তেমন থাকবো…কেন তা কাল মর্নিং-এ আপনাকে গিয়ে মুখোমুখি বলব। অনুগ্রহ করে আপনি নটার মধ্যেই আপনার গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। হ্যাঁ, আর একটা কথা-সম্মেলন কালও চলবে, কিন্তু বিকেলের সেশনে আমি সম্মেলনে থাকব…সব কথা কাল মুখোমুখি হবে। তাছাড়া দৈবাৎ আপনার ফার্মে রাত্রে কিছু ঘটলে–না, জাস্ট কথার কথা বলছি, কিছু বলা যায় না। ডঃ ফাটনবিশের লোকাল গার্জেন আপনার প্রতি খুব খাপ্পা। আচ্ছা, রাখছি।
কর্নেল আবার জিরো ডায়াল করে রিসিভার রেখে দিলেন। বর্মনদা কান খাড়া করে শুনছিলেন। তাঁর মুখে উদ্বেগ লক্ষ করলুম। তিনি বললেন, কর্নেল সাহেব, ডঃ ফাটনবিশের লোকাল গার্জেন আছে একথা শুনে আমার খুব অবাক লাগছে। আপনি যদি এই ব্যাপারটা একটু খুলে বলেন আমার সুবিধা হয়।
কর্নেল ঠোঁটের কোণে হেসে বললেন, গত রাতে ডিনারের একটু আগে ডঃ ফাটনবিশের সুইটে টেলিফোন এসেছিল। তুমি টেলিফোনের দিকে কান পাতলে জানতে পারতে মহিলা বারবার আঙ্কল বলে অন্য পক্ষকে সম্ভাষণ করছিলেন।
বর্মনদা বললেন, হ্যাঁ, কথাটা আমার মনে আছে। মহিলা খুব চঞ্চল এবং হাসিখুশি হয়ে কাকে আঙ্কল বলছিলেন।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ, লোকটির কথা তোমার এবং জয়ন্তের জানা দরকার। কারণ চন্দনপুর-অন-সি-তে এই ভদ্রলোকের অসাধারণ দাপট আছে। তিনি রাজনীতি করেন এবং এলাকার দুবৃত্তদের একজন গুরু।
বর্মনদা চাপা স্বরে বললেন, মনে হচ্ছে তার কথা আমি জানি। আপনি কি এরিয়ার প্রাক্তন এম.পি বিনায়ক সেনাপতির কথা বলছেন?
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক ধরেছো। সত্যি বলতে কি এখানে এবারকার সম্মেলনের পিছনে বিনায়কবাবুরই উদ্যোগ ছিল। ডঃ ফাটনবিশের অ্যাসিস্টান্ট মিস সুমনার মামা হলেন বিনায়কবাবু। এই সূত্রে ওদের ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে।
.
০৫.
বিকেলে কর্নেল ক্যাপ্টেন বার্মার বাংলোয় চলে যাওয়ার পর বর্মনদার সঙ্গে শার্ক হোটেলের পূর্বে বাঁধের পথে পোড়া বাতিঘরের নীচের খাঁড়ি দেখতে গিয়েছিলুম।
আমাদের বাঁদিকে পাথরের চাঙড় এবং তার ফাঁকে ঝোঁপঝাড়, গাছপালার নীচে সি বিচ হঠাৎ শেষ হয়েছে একটা পাথরের প্রকাণ্ড দেওয়ালের কাছে। বর্মনদা বললেন, দ্যাখো তো জয়ন্ত, ঠিক কোথায় মি. রাঘবন বসে ছিল তারপর হঠাৎ কোনখান দিয়ে এই বাঁধে উঠে এসেছিল, চিনতে পারছ কিনা।
জায়গাটা ভালো করে দেখে নিয়ে বললুম, বাঁদিকে নীচের বিচের প্রান্তে যে পাথরটা দেখছেন সেখানেই রাঘবন বসেছিলেন। তারপর হঠাৎ ওখান থেকেই সোজাসুজি বাঁধে এসে ওঠেন।
বর্মনদা জায়গাটা খুঁটিয়ে দেখার পর বললেন, লক্ষ করো জয়ন্ত, ওখানে কেউ যদি বসে থাকে সে আমাদের দেখতে পাবে না। তবে যদি আমরা তাকে লক্ষ করে এক টুকরো ঢিল ছুঁড়ে ফেলি তাহলেই সে আমাদের টের পাবে।
বললুম, আমি কিন্তু কোনো ঢিল পড়তে দেখিনি।
বর্মনদা হাসলেন–প্রচণ্ড সামুদ্রিক বাতাস আর জলের তর্জন-গর্জনের মধ্যে ঢিল পড়ার শব্দ তোমার কানে না যেতেও পারে। যাই হোক, চলো এগিয়ে যাই।
কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখলুম ক্রমশ ঢালু হয়ে একটা প্রশস্ত পাথরের চত্বর কিছুটা নীচে গিয়ে শেষ হয়েছে। যেন ওপর থেকে পাথরটা ঝুলে আছে। নীচের খাঁড়ির গভীরতা অন্তত তিরিশ থেকে চল্লিশ ফুট বলেই মনে হল। খাঁড়িটা কতকটা অর্ধবৃত্তাকার এবং বেশ চওড়া। আমাদের সোজাসুজি পশ্চিমে খাঁড়ির ওপারে জঙ্গলের ভিতর দাঁড়িয়ে আছে পোর্তুগিজ আমলের সেই পোড়ো বাতিঘর।
বর্মনদা বললেন, এই ঢালু পাথরটাতে ঝুঁকি নিয়ে অনেক বসে থাকে। কিন্তু লক্ষ করো পাথরটার নীচের দিকে বারবার খাড়ির জল ছিটকে এসে পড়ছে। ধরো দুজনে এখানে বসে আছি। তারপর একসময় তোমাকে যদি আচমকা ধাক্কা মারি, কী হবে বুঝতে পারছ?
আঁতকে উঠে বললুম, সর্বনাশ! আপনি আমাকে ধাক্কা মারার মতলবে আছেন নাকি?
বর্মনদা হাসতে হাসতে বাঁপাশে পাথরটা যেখানে শুরু হয়েছে সেখানে ঝোঁপ আর ঘাসের গোড়া থেকে সিগারেটের কয়েকটা ফিলটার টিপ কুড়িয়ে নিলেন। সেগুলো পরীক্ষা করে দেখার পর বললেন, এগুলো বিদেশি সিগারেট মনে হচ্ছে। চন্দনপুর-অন-সি-তে বিদেশি জিনিসের ছড়াছড়ি। পিটার গোমস মারা গেল কিন্তু আবার তার জায়গা কেউ দখল করে নেবে।
আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। বললুম, চলুন বর্মনদা। এখানে থাকার কোনো মানে হয় না।
ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল সি বিচে লোকজন বেড়াতে বেরিয়েছে।
বর্মনদা আমার কথা শুনে হাসতে হাসতে বললেন, একটা আনক্যানি ফিলিংস আমারও হচ্ছে। চলল।
কথাটা বলেই তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে বাঁদিকে অর্থাৎ বিচের উলটোদিকে কেয়াঝোপের ভেতর কিছু দেখতে থাকলেন।
বললুম, কী ব্যাপার? সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েছে নাকি বর্মনদা?
সুভদ্র বর্মন আমাকে অবাক করে কেয়াবনের ভেতরে ঢুকে গেলেন। তারপর কী একটা কুড়িয়ে নিয়ে আমাকে ইশারায় ডাকলেন। তাঁর কাছে গিয়ে দেখি তার হাতে এক পাটি লেডিস স্যান্ডেল। তিনি গুঁড়ি মেরে বসে ঝোপের মধ্যে এদিক-ওদিক দেখছিলেন। একটু পরে আর এক পাটি একই স্যান্ডেল কুড়িয়ে নিয়ে। চাপা স্বরে বললেন, এখানে একজোড়া লেডিস স্যান্ডেল পড়ে থাকাটা সহজ ব্যাপার নয় জয়ন্ত। আবার আমার মনে সেই আনক্যানি ফিলিংসটা জেগে উঠেছে।
বলে তিনি গুঁড়ি মেরে আরও কিছুটা এগিয়ে গেলেন। কেয়াবনটা আমাদের মাথা ছাড়িয়ে উঁচুতে উঠেছে, তাই আমাদের দেখতে পাওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
বর্মনদার শ্বাসক্লিষ্ট কণ্ঠস্বর ভেসে এল–জয়ন্ত, আমার সন্দেহ হচ্ছে এখানে। বালির মধ্যে কিছু পোঁতা আছে। চলো আমরা পিচ রাস্তায় গিয়ে ব্যাপারটা ভেবে দেখি।
ঘন কেয়াবন পেরিয়ে পিচ রাস্তায় পৌঁছে বর্মনদা বললেন, একটু ভুল করে ফেলেছি। স্যান্ডেল দুটো যেখানে ছিল সেখানেই রেখে আসি। আমার হাতের ছাপ মুছে ফেলাও দরকার। তুমি একটু অপেক্ষা করো। আমি আসছি।
বলে তিনি আবার কেয়াবনের ভেতরে ঢুকে গেলেন। রাস্তা দিয়ে গাড়ি, অটো রিকশ এবং সাইকেল রিকশতে লোকজনের চলাচল আছে। কিন্তু কেউ আমাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কৌতূহলী নয়।
একটু পরেই বর্মনদা ফিরে এলেন। তারপর বললেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওখানে। বালির মধ্যে কোনো মেয়েকে খুন করে পুঁতে রাখা হয়েছে। খুনিরা তার স্যান্ডেল দুটোর দিকে লক্ষ রাখেনি। চলো। এ ব্যাপারে কী করা দরকার তা কর্নেলসাহেবের কাছেই জানতে হবে।
কোনো খালি যানবাহন পাওয়া গেল না। আমরা হাঁটতে থাকলুম।
কর্নেলের দেখা পাওয়ার আশা এখনও আছে। কারণ উনি ক্যাপ্টেন বার্মার ফার্মে আজ রাতে যাবেন না।
আমাদের সৌভাগ্য সমুদ্রতীরের সেই কাফেটেরিয়ার সামনে দূর থেকে কর্নেলকে কফির পেয়ালা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলুম।
বর্মনদা বললেন, আর তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই। চলো আস্তে-সুস্থে যাওয়া যাক। তারপর কফি খেতে খেতে কর্নেল সাহেবকে ব্যাপারটা জানাতে হবে।
কর্নেল আমাদের দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি হাত নাড়লেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁর কাছে পৌঁছে আমি ঘটনাটা বলার আগেই বর্মনদা বলে উঠলেন, জয়ন্ত, আগে কফি খাওয়া যাক। কর্নেলসাহেব বলেন কফি নার্ভকে চাঙ্গা করে।
কর্নেল আস্তে বললেন, হ্যাঁ। তোমাদের দুজনেরই নার্ভ যে সাংঘাতিক কোনো কিছু দেখে ঝিমিয়ে পড়েছে তা বোঝা যাচ্ছে।
একটু পরেই দু-পেয়ালা কফি এসে গেল। আমরা চুপচাপ কফিপানে মন দিলুম। কর্নেল কফি শেষ করে পেয়ালা রেখে চুরুট ধরালেন।
সি বিচ থেকে উঠে আসার পথে এই কাফেটেরিয়া। তাই ক্রমশ জায়গাটা ভিড়ে ভরে গেল। আমরা কফি শেষ করার পর দেখলুম কর্নেল আমাদের কফিও দাম মিটিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, চলো। রাস্তায় যেতে যেতে কথা হবে।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বর্মনদা উত্তেজিতভাবে ঘটনাটা বললেন।
কর্নেল বললেন, ওখানে সত্যিই একটা লাশ পোঁতা আছে এটা কেন তোমার মনে হয়েছে?
বর্মনদা বললেন, অনেকটা জায়গা জুড়ে কেয়াগাছের নীচের বালি হাত দিয়ে যেন সমান করা হয়েছে। আর স্যান্ডেল দুটো বেশ দামি। কোনোটাই ছেঁড়া নয়।
কর্নেল একস্থানে দাঁড়িয়ে চুরুটের একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, তোমরা যা দেখেছ তা সত্যিই সন্দেহজনক। কিন্তু এখনই পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ ছুটে যাবে। স্যান্ডেল দুটো তারা পাবে। কিন্তু বালির তলায় যদি কোনো বড়ি না পাওয়া যায় তাহলে পুলিশ খাপ্পা হবে। এখানকার পুলিশের স্বভাবচরিত্র একটু অন্যরকম। তারা সবসময় যেন দাঁত-মুখ খিঁচিয়েই আছে। বিশেষ করে ওসি ভদ্রলোক আমার সবিশেষ পরিচয় জানেন। অথচ আমার সঙ্গে দেখা করতেও তাঁর অনিচ্ছা। আমাকেই তাঁর কাছে যেতে হবে এমন তার মনোভাব। কাজেই আমার মতে ব্যাপারটা চাপা থাক। এখানকার বা বাইরের কোনো মেয়ে হঠাৎ নিপাত্তা হয়ে গেলে তার গার্জেন অবশ্যই পুলিশের কাছে যাবে। কাজেই অপেক্ষা করে দেখা যাক।
বর্মনদা বললেন, কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওখানে একটা লাশ পোঁতা আছে।
কর্নেল হাসলেন–তাহলে এক কাজ করতে পারো। তুমি যেহেতু একজন সাংবাদিক এবং খুব বড়ো কাগজেরই সাংবাদিক, অতএব টেলিফোন করে তুমিই পুলিশকে খবর দাও।
বর্মনদা বললেন, খুনি বা খুনিদের কেউ যদি তখন আড়াল থেকে আমাদের দেখে থাকে, তারা রাত্রে মধ্যেই লাশটা সরিয়ে ফেলতে পারে। কাজেই যা আছে বরাতে, আমি আমাদের হোটেলে ফিরে গিয়ে সেখান থেকেই পুলিশকে ফোন করব।
বলে বর্মনদা আমার দিকে তাকালেন–কী জয়ন্ত, তোমার কথা কি পুলিশের কাছে চেপে যাব?
একটু ইতস্তত করে বললুম, কর্নেল কী বলেন?
কর্নেল বললেন, কী আশ্চর্য! তুমিও তো কলকাতা বড়ো কাগজের সাংবাদিক। সুভদ্রের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে যা দেখেছ বলবে। লাশ পাওয়া না গেলে তোমাদের সন্দেহ হওয়া যে স্বাভাবিক সে কথা পুলিশকে বুঝিয়ে বললেই হবে।
কথাটা শুনেই বর্মনদা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন, কর্নেলসাহেব, আপনাকেও আমাদের সঙ্গে পেতে চাই। আপনি একজন প্রখ্যাত রহস্যভেদী। কাজেই আপনার নিজের দিক থেকেই ঘটনাটা দেখার দায়িত্ব আছে।
কর্নেল তাঁর বিখ্যাত অট্টহাসি হাসলেন। তারপর বললেন, তাহলে চলো তোমাদের হোটেলেই যাওয়া যাক। আমি আর জয়ন্ত কিন্তু ক্যান্টিনে বসে আরও এক কাপ কফি খাব। তুমি তোমার ঘর থেকে সোজা থানায় ফোন করে পুলিশকে। তোমাদের হোটেলের সামনে আসতে বলবে। এখন পাঁচটা বাজে। পুলিশ তাড়াতাড়ি এলে দিনে বেলায় জায়গাটা খুঁজে বের করার সুবিধা হবে।
এরপর আমরা উলটো দিকে ঘুরে হোটেল দ্য শার্ক-এ দিকে হাঁটতে থাকলুম।
ক্যান্টিনে ঢুকে দেখলুম তত ভিড় নেই। সাংবাদিকরা সম্ভবত সি বিচে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ম্যানেজার কর্নেলকে দেখে নমস্কার করে বললেন, আপনি আমার হোটেলে চলে আসুন। আপনার জন্য একটা সুইটের অভাব হবে না।
কর্নেল তার দিকে হাত নেড়ে বললেন, ধন্যবাদ। দরকার হলে জানাব। আপাতত আমাদের দুজনকে কফি খাইয়ে দিন।
আমরা রাস্তার দিকে একটা জানলার ধারে বসলুম। শিগগির কফি এসে গেল। কর্নেলের মতো ঘন ঘন কফি খাওয়ার অভ্যেস আমার নেই। কিন্তু কী ঘটতে চলেছে সেই দুর্ভাবনার উপশম ঘটাল কফি। মিনিট দশেক পরে বর্মনদা এসে ধপাস করে একটা চেয়ারে বসে বললেন, হোপলেস। থানার ডিউটি অফিসারকে কিছুতেই ব্যাপারটা বোঝাতে পারলাম না। তার মতে কোনো মেয়ে হনিমুনে এসে। রাগ করে পায়ের স্নিপার জঙ্গলে ছুঁড়ে ফেলেছে। দেখবেন এতক্ষণে সেই স্লিপারজোড়া তার স্বামী খুঁজে এনে দিয়েছে। কোথায় কোন জঙ্গলে লাশের বদলে জুতো পড়ে আছে, সেই জুতো কুড়োনোর কাজ পুলিশের নয়।
কর্নেল হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, তুমিও আমাদের মতো এক কাপ কফি খেয়ে নাও, নার্ভ আরও চাঙ্গা হবে।
একটু পরে কফি এল। বর্মনদা কফি খেতে খেতে বললেন, কর্নেল, আমার মনে হয় আপনাকে নিয়ে এখনই ওখানে যাওয়া দরকার। আপনার অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়ে যাবে প্রকৃতপক্ষে কিছু ঘটেছে কি না।
কর্নেল বললেন, আমাদের ওখানে পৌঁছোতে দিনের আলো ফুরিয়ে যাবে তাছাড়া বিশেষ করে আমাদের তিনজনকে কেয়াঝোপে ঢুকতে দেখলে নির্ঘাত রাস্তায় ভিড় জমে যাবে। তার চেয়ে বলি, আমি জয়ন্তের ঘর থেকে বাইনোকুলারে কিছুক্ষণ ওই জায়গাটায় লক্ষ রাখব। যদি সত্যিই ওখানে মারাত্মক কিছু ঘটে থাকে, টের পেতে দেরি হবে না।
বর্মনদা বললেন, টের পাবেন কী ভাবে?
কর্নেল কফি শেষ করার পর চুরুট বের করে বললেন, উত্তরটা সহজ। যদি সত্যি ওখানে কেউ বা কারা কোনো লাশ পুঁজে রেখে থাকে, তাহলে তাদের কেউ না কেউ আড়াল থেকে লক্ষ রাখতে বাধ্য। বিশেষ করে তুমি আর জয়ন্ত সেখানে ঢুকেছ এবং দু-পাটি স্যান্ডেল আবিষ্কার করেছ। এটা তার চোখে পড়ে থাকলে সে পুলিশ আসার আগেই লাশটা তুলে খাঁড়ির জলে ফেলে দেওয়ার কথাই ভাববে।
দোতলায় আমার ঘরে গিয়ে ব্যালকনিতে তিনটে চেয়ার পেতে প্রায় ঠাসাঠাসি হয়ে আমরা বসলুম। প্রাক সন্ধ্যার কুয়াশা ক্রমশ ঘনিয়ে উঠেছে। কর্নেল বাইনোকুলার তুলে মাঝে মাঝে দেখছিলেন আর চুরুটে টান দিচ্ছিলেন। বর্মনদার হাবভাব দেখে বুঝতে পারছিলুম তাঁর মধ্যে প্রচণ্ড উত্তেজনা জেগে উঠেছে। ক্রমশ সমুদ্রতীরের উজ্জ্বল বাতিগুলো জ্বলে উঠল। তার ফলে সেই কেয়াবনটা অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল।
বেশ কিছুক্ষণ পরে সেই কেয়াবনে টর্চের আলোর ঝলক দেখতে পেলুম। অমনি বর্মনদা বলে উঠলেন, কর্নেল, টর্চের আলো দেখতে পেলেন তো? আমার ধারণা খুনিরা এবার লাশটা তুলে খাড়ির জলে ফেলতে এসেছে।
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এতক্ষণে মনে হচ্ছে কাছাকাছি গিয়ে ঘটনাটা বুঝে দেখা উচিত।
বর্মনদা বললেন, তাহলে এখনই চলুন।
আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা লক করে নীচে গেলুম। তারপর পিচ রাস্তায় উঠে পশ্চিমদিকে হাঁটতে থাকলুম। রাস্তায় যানবাহন চলাচল এখন একটু কম। কেয়াবনের কাছাকাছি যেতেই লক্ষ করলুম টর্চের আলোটা আবার জ্বলে উঠে নিভে গেল। তাড়াতাড়িতে আমি টর্চ নিতে ভুলে গিয়েছিলুম। কিন্তু কর্নেলের প্যান্টের পকেটে তার শক্তিশালী ছোটো সার্চলাইটটা যথারীতি রাখা ছিল। তিনি কেয়াবনের ওপর এক ঝলক আলো ফেলতেই দেখলুম কেয়াবনের ডগাগুলো খুব নড়ছে।
কর্নেল পকেট থেকে তার ফায়ার আর্মস বের করে আস্তে বললেন, জয়ন্ত, তোমার ফায়ার আর্মসটা সঙ্গে আনননি?
বললুম, না। আমি কি জানতুম যে সন্ধেবেলা এখানে ওটার দরকার হবে?
কর্নেল তার আলো জ্বেলে রেখে পাথরের চাঙড়ের ওপর দিয়ে সাবধানে জঙ্গলে নেমে গেলেন। আমরা তাকে অনুসরণ করলুম।
কর্নেলের পিছন থেকে বর্মনদা ফিশফিশ করে বললেন, আমাদের একটু ডানদিকে কোনাকুনি এগিয়ে যেতে হবে।
কেয়াবনে ঢোকার পর কর্নেলের টর্চের আলোয় কয়েক সেকেন্ডের জন্য কী একটা ছাইরঙা জিনিস দেখতে পেলাম। তারপরই কর্নেলের গর্জন কানে এল–একটু নড়লেই তোমার খুলি উড়ে যাবে। আমার হাতে এটা কী লক্ষ করেছ তো?
বলে কর্নেল বাঘের মতো সামনের দিকে প্রায় ঝাঁপ দেওয়ার মতো এগিয়ে গেলেন। তারপর দেখলুম প্যান্টশার্ট পরা যুবক উঠে দাঁড়িয়ে কান্না-জড়ানো গলায় বলল, আমি স্যার এখানে আমার বউ-এর জুতো খুঁজতে এসেছিলুম। বিকেলে বউ। আমার বোনের সঙ্গে ঝগড়া করে নিজের পায়ের স্যান্ডেল দুটো এই জঙ্গলে ছুঁড়ে ফেলেছিল। অনেক খুঁজে এই দেখুন এক পাটি স্যান্ডেল পেয়েছি।
কর্নেল বললেন, কী নাম তোমার, কোথায় থাকো?
সে কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, আপনাদের মতো আমিও বাঙালি স্যার। মেদিনীপুরের কঁথি থেকে আমার বউ আর বোনকে সঙ্গে নিয়ে এখানে বেড়াতে এসেছি।
বর্মনদা হো হো করে হেসে ফেললেন।
এই সময় হঠাৎ যুবকটি টর্চ জ্বেলে আরেক পাটি স্যান্ডেল দেখতে পেল এবং তখনই সেটা কুড়িয়ে নিয়ে বলল, তাহলে আমি যাই স্যার?
সেই সময় কর্নেল বাঁদিকে ঘুরে একটা কেয়াগাছের গোড়ার দিকে আলো ফেলেছিলেন। তিনি সেদিকে ঝুঁকে গেলেন। জিজ্ঞেস করলুম, কী ব্যাপার?
ওদিকে সেই যুবকটি স্যান্ডেল জোড়া হাতে নিয়ে আচমকা কেন কে জানে শেয়ালের মতো জঙ্গলের ভেতর দিয়ে উধাও হয়ে গেল। কর্নেল হাঁটু মুড়ে বসে একস্থানের বালি সরাতে শুরু করলেন। তারপর বললেন, তোমরাও হাত লাগাও। আমার মনে হচ্ছে এখানে কিছু যেন পোঁতা আছে।
তিনজনে নরম বালি সরাতে তত কষ্ট হচ্ছিল না। কর্নেল শুধু মাঝে মাঝে। টর্চের আলো দেখাচ্ছিলেন। প্রায় দেড় ফুট নীচে একটা কালো রঙের জিনিস দেখা গেল।
বর্মনদা বললেন, মাথার চুল নয় তো?
কর্নেল সেটাকে এক হাতে অনেক টানাটানি করে তোলার চেষ্টা করছিলেন। বললেন, চুল নয়। একটা ছোটো সুটকেস জাতীয় জিনিস মনে হচ্ছে।
একটু পরেই বেরিয়ে এল প্রায় এক ফুট লম্বা, ইঞ্চি আট-দশ চওড়া এবং ইঞ্চি ছয়েক উঁচু একটা শক্ত ব্যাগ। ব্যাগের হ্যাঁন্ডেল আছে। কিন্তু চাবি ঢোকানোর কোনো ছিদ্র নেই।
কর্নেল ভালো করে হাত ঝেড়ে রুমালে মুছে তারপর ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, কিছু বোঝা যাচ্ছে না। এখানে বউয়ের স্যান্ডেল খুঁজতে আসা বাঙালি যুবকের হঠাৎ অন্তর্ধান তারপর এই আজগুবি বাক্স উদ্ধার। যাই হোক, চলো ফেরা যাক। তবে সাবধান। আমার হাতে কায়ার আর্মস রেডি থাকা দরকার। কাজেই জয়ন্ত তুমি আমার টর্চটা নাও।
আমরা তিনজনে কেয়াবন থেকে বেরিয়ে এবার ঘন ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পিচ রাস্তায় পৌঁছলুম।
পিচ রাস্তায় দূরে দূরে একটা করে ল্যাম্পপোস্ট আছে। দেখে সাহস পেলুম কেউ একা বা দল বেঁধে আমাদের ওপর হামলা করার কোথাও দাঁড়িয়ে নেই।
.
০৬.
রাস্তায় দুটো সাইকেল রিকশ পেয়ে গিয়েছিলুম। কর্নেলের কথায় তার সঙ্গে আমাদের ক্যাপ্টেন বার্মার বাংলোয় যেতে হল।
রামলাল বলল, ক্যাপ্টেনসাহেব ফোন করেছিলেন। আপনার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। উনি বলেছেন বাংলোয় ফিরেই আপনি তাকে যেন টেলিফোন করেন।
আমরা বারান্দায় বসলুম। কর্নেল অদ্ভুত ব্যাগটা তার উরুর ওপর রেখে বললেন, রামলাল, খিদে পেয়ে গেছে। আমাদের বরং পকৌড়া খাওয়ানোর ব্যবস্থা করো।
বর্মনদা বললেন, ঘরে গিয়ে বসলে ভালো হত। ওই বস্তুটি কী, খুলে দেখার জন্য আমার মন ছটফট করছে।
আমি বললুম, আমারও।
তখন কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে হাঁক দিলেন, কেতুচরণ, আমার ঘরটা খুলে দাও। আর রামলালকে বলো পকৌড়া, কফি আমার ঘরেই পাঠিয়ে দেয় যেন।
ড্রয়িং রুমে ঢুকে কর্নেল বললেন, এক মিনিট। তারপর রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। সাড়া পেয়ে তিনি বললেন, ক্যাপ্টেন বার্মা, আমার মনে হচ্ছে এ রাত্রে সাংবাদিকরা আপনার ওপর হামলা করতে আসবে না…শুনুন, আপনাকে আসতে বলছি তার কারণ আছে। একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে…না, টেলিফোনে বলা যাবে। না। আপনি বরং সঙ্গে একজন নিরাপত্তা রক্ষী নিয়ে চলে আসুন…হ্যাঁ, রহস্য অন্য দিকে গড়িয়েছে। কাজেই প্লিজ, চলে আসুন। আমার সঙ্গে জয়ন্ত আর সুভদ্র, দুজনেই আছে।
রিসিভার রেখে ড্রয়িং রুমের অন্য একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে সমুদ্রের দিকের বারান্দায় এলুম। সেখানে দেখলুম হাফপ্যান্ট এবং স্পোর্টিং গেঞ্জি পরা এক কিশোর দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ের রং কুচকুচে কালো। বলিষ্ঠ গড়ন। সে সাদা দাঁত দেখিয়ে বলল, ঘর খুলে দিয়েছি স্যার।
বলা দরকার কর্নেল রামলাল এবং এই ছেলেটির সঙ্গে হিন্দিতেই কথা বলছিলেন। তারাও হিন্দিতে বলছিল। যদিও আমি জানি এদের মাতৃভাষা-কারও তেলুগু, কারও তামিল।
কর্নেলের জন্য যে ঘরটা ক্যাপ্টেন বার্মা ব্যবহার করতে দিয়েছেন সেটা বেশ চওড়া এবং সুন্দর করে সাজানো। এক পাশে সোফা সেট, অন্য পাশে একটা ডিভান। ঘরের দেওয়ালে বহু সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও প্রাণীর শিল্প-নিদর্শন আটকানো আছে।
আমি এবং বর্মনদা সোফায় বসলুম। কর্নেল বসলেন একটা ইজিচেয়ারে। বাকশোটা আপাতত তিনি পাশের টেবিলের তলায় রেখে দিলেন। আমরা দুজন। ক্লান্ত এবং মনে মনে উত্তেজিত। কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে দাড়িতে হাত বোলাচ্ছিলেন। টুপিটা ইতিমধ্যেই টেবিলে রেখে দিয়েছেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে রামলাল ট্রেতে কফি আর তিন প্লেট পকৌড়া রেখে গেল। আমরা চুপচাপ পকৌড়া শেষ করে কফিতে চুমুক দিলাম। এতক্ষণে প্রকৃতি কফির স্বাদ পাওয়া গেল।
একসময় কর্নেল আস্তে বললেন, দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দাও জয়ন্ত। ওদিকের দুটো জানলারই পর্দা টেনে দাও।
একটু পরে তিনি সেই ছোটো ব্যাগটা টেবিলের ওপর রাখলেন। তারপর হাত বাড়িয়ে তার কিটব্যাগটা টেনে নিলেন। কিটব্যাগের ভেতর থেকে একটা মোটা সূঁচ আর স্ক্রু-ড্রাইভার বের করে নিয়ে এবার তিনি ব্যাগটা খোলার চেষ্টা করতে থাকলেন। ব্যাগটা খোলা সহজ নয়।
কর্নেল কিটব্যাগ থেকে আরও কয়েকটা স্ক্র-ড্রাইভার বা ওই জাতীয় জিনিস বের করে একটি ছোটো হাতুড়ির সাহায্যে ঘা দিতে থাকলেন। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর ব্যাগটার অনেকটা অংশ খুলে গেল। কর্নেল বাকি অংশ ছাড়িয়ে ফেলার পর বললেন, কী আশ্চর্য! এটা তো দেখছি একটা যন্ত্র। কী যন্ত্র এটা?
এরপর তিনি আতশ কাচ বের করে খুঁটিয়ে দেখার পর বললেন, বর্মন, সব ধন্যবাদ তোমারই প্রাপ্য।
বর্মনদা বললেন, কেন বলুন তো?
কর্নেল বললেন, এর গায়ে জার্মান ভাষায় লেখা আছে–ড. ফ্রেডারিক স্টাইনগাস। বার্লিন। পার্ট থ্রি। দা বায়োকেমিক্যাল মেশিন।
আমি কিছু বলার আগেই বর্মনদা উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন, একটা ধারণা আমার মাথায় এসেছে। ওই জার্মান জীববিজ্ঞানীর থিসিস এবং এই যন্ত্রটা ব্যবহারের ফরমুলা কেউ তার ঘর থেকে চুরি করে পাচার করেছিল। অনন্তপুরমের কাছে জাহাজডুবিতে দুটো প্যাকেটই সমুদ্রে তলিয়ে যায়। তারপর দৈবাৎ একটা উদ্ধার করতে পারেন ক্যাপ্টেন বার্মা এবং অন্যটা–এই প্যাকেটটা সম্ভবত তার আগেই অন্য কেউ উদ্ধার করে পিটার গোমসের কাছে দেখাতে নিয়ে এসেছিল। কারণ পিটার এসব জিনিস কেনে। পিটারই এটা ওখানে পুঁতে রেখেছিল।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, এটা কে উদ্ধার করে লুকিয়ে রেখেছিল, খুঁজতে হবে।
আমি ব্যস্তভাবে বললুম, কেন, সেই বাঙালি যুবকটি কি সত্যি কথা বলছিল?
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, হ্যাঁ। ও বেচারা সত্যিই তার বউয়ের জুতো খুঁজতে এসেছিল। এতে কোনো ভুল নেই।
বললুম, তাহলে সে হঠাৎ অমন করে পালিয়ে গেল কেন?
বর্মনদা বললেন, কর্নেলসাহেবের হাতে রিভলবার দেখে তার ভয় পাবারই কথা।
কর্নেল বললেন, জয়ন্ত, এও একটা কাকতালীয় যোগ।
হাসি চেপে বললুম, হ্যাঁ। অবভাস তত্ত্ব। হুইচ অ্যাপিয়ারস ইজ নট রিয়েল।
ক্যাপ্টেন বার্মা পৌঁছলেন রাত আটটা নাগাদ। কর্নেলের ঘরে ঢুকেই তিনি বললেন, আপনার কথামতো সঙ্গে দেহরক্ষী নিয়ে বেরোইনি। বেরুলে একটা নরহত্যা হয়ে যেত।
কথাটা শুনে আমরা সবাই চমকে উঠেছিলুম। আমি বললুম, সেকী! পথে কি কেউ আপনার উপর হামলা করেছিল?
ক্যাপ্টেন বার্মা বললেন, হামলাও বলতে পারেন। একটা লোক আমার গাড়ির টায়ার লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিল। গুলিটা ফসকে যায়। আমার হাতে স্টিয়ারিং, ফায়ার আর্মসটা অবশ্য পাশেই রাখা ছিল। কিন্তু রিস্ক না নিয়ে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।
কর্নেল বললেন, তাহলে আমার ইনটিউশনের কথা আপনাকে মানতে হবে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল ড. ফাটনবিশকে প্রকাশ্য সভায় অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা তার গার্জেন অর্থাৎ বিনায়ক সেনাপতি করতেই পারে।
ক্যাপ্টেন বার্মা মুখে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি ফুটিয়ে বললেন, লোকটাকে আমি একটা ইঁদুর ছাড়া কিছু ভাবি না। যাকগে, আপনার খবর বলুন।
কর্নেল সেই ছোট্ট ব্যাগটা খুলে ভিতরটা দেখিয়ে বললেন, এটা একটা বায়োকেমিক যন্ত্র। এর তলায় পঞ্চাশ শিট টাইপ করা নোট আছে। অর্থাৎ এবার আপনি ইচ্ছা করলে সেই ভয়ঙ্কর সর্বভুক পিঁপড়ে তৈরি করতে পারবেন। অবশ্য তার আগে আপনাকে বায়োকেমিস্ট্রিতে দক্ষ হতে হবে।
বিস্মিত ক্যাপ্টেন বার্মা সবটা খুঁটিয়ে দেখে বললেন, এটা আপনি কোথায় পেলেন?
কৃতিত্বটা আমার একার নয়। কৃতিত্বের প্রায় সবটাই সুভদ্র বর্মনের প্রাপ্য। সুভদ্র, তুমিই বরং ঘটনাটা খুলে বলো।
বর্মনদা পুরো ঘটনা সবিস্তারে শোনালেন। তারপর বললেন, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে জার্মান বিজ্ঞানীর থিসিসের প্রথম দুটো অংশ আপনি অনন্তপুরমের। খাঁড়ি থেকে উদ্ধার করেছিলেন। কিন্তু সম্ভবত তার আগে যেভাবেই হোক ওই খাড়ি থেকে অন্য কেউ এই অংশটা অর্থাৎ এই প্যাকেটটা দৈবাৎ উদ্ধার করেছিল। আমরা জানি পিটার গোমস জাহাজের চোরাই মাল কেনে। কাজেই এটা তার হাতে চলে আসার কথা।
ক্যাপ্টেন বার্মা বললেন, ঠিক বলেছ। কিন্তু পিটার কেন এটা নিজের বাড়ির কোনো গুপ্ত স্থানে না রেখে ওই কেয়াবনে পুঁতে রেখেছিল, এই প্রশ্নটা কিন্তু ভাইটাল।
কর্নেল বললেন, এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। আমি জানতে চাইছি আসার পথে আক্রান্ত হওয়ার পর আপনি কি থানার ওসি মিঃ মাধবনকে কথাটা জানিয়ে এসেছেন?
হ্যাঁ। আসার পথে থানায় গিয়ে ওসি মি. মাধবনকে পেয়ে গেলুম। মাই গুডনেস, বলে তিনি হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, কথাটা বলতে ভুলে গেছি। মি. মাধবনের কাছে শুনলুম ডিউটি অফিসারকে সন্ধ্যার দিকে এক সাংবাদিক টেলিফোন করে জানিয়েছিল পোড়ো বাতিঘরের কাছে জঙ্গলে নাকি দু-পাটি মেয়েদের জুতো সে দেখতে পেয়েছে। তাই ধারণা সেখানে কোনো মেয়ের লাশ পোঁতা আছে।
বর্মনদা তার কথার ওপর বললেন, ভাগ্যিস ওই পুলিশ ভদ্রলোক আমাকে পাত্তা দেননি। তাহলে এই অত্যাশ্চর্য ব্যাগটা আমাদের হাতে আসত না।
কর্নেল বললেন, ওসি মি. মাধবন কি তার ডিউটি অফিসারের কথা সিরিয়াসলি নিয়েছেন? কী মনে হল আপনার?
ক্যাপ্টেন বার্মা বললেন, না। উনি ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না।
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, পিটার গোমস বা যে-ই হোক, যে এই জিনিসটা ওখানে পুঁতে রেখেছিল সে ভেবেছিল ওটার পাত্তা কারও পাওয়া সম্ভব নয়। তাই ওখানে লক্ষ রাখেনি। লক্ষ রাখলে আমাদের টর্চের আলো তার চোখে পড়ত এবং সে তখনই মরিয়া হয়ে হামলা করত।
ক্যাপ্টেন বার্মা সায় দিয়ে বললেন, এ রাতেও জয়ন্তবাবু আর বর্মন আমাদের সঙ্গে খাবেন। রামলালকে আমি বলে দিই।
বর্মনদা হাত নেড়ে ব্যস্তভাবে বললেন, না, না। জয়ন্ত কী করবে জানি না, আমাকে হোটেলে ফিরতেই হবে।
কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, তোমার তামিল বন্ধু রাঘবনের পিছনে গোয়েন্দাগিরি করতে চাও। তাই না?
বর্মনদা হাসলেন–গোয়েন্দাগিরি নয় তবে আফটার অল সে আমার পরিচিত এবং একই পেশার লোক। পিটার গোমসের সঙ্গে তার বন্ধুতা ছিল। বন্ধুর আকস্মিক মৃত্যুতে তার মনের অবস্থা খারাপ হতেই পারে। কাজেই তার সঙ্গে দু-চারটে কথাবার্তা বলা আমার কর্তব্য।
বলে মুচকি হেসে বর্মনদা উঠে দাঁড়ালেন। আমিও উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, আমি বড্ড টায়ার্ড। সকাল সকাল খেয়ে নিয়ে ঘুমোতে চাই। ক্যাপ্টেন বার্মা, কর্নেল, গুড নাইট। টা-টা।
ওঁরা দুজনে হেসে উঠলেন। বর্মনদা আমার হাত ধরে টেনে বললেন, চলো জয়ন্ত। আশা করি ক্যাপ্টেনসাহেবের মতো আমাদের ওপর কেউ হামলা করবে না।
আমরা বারান্দায় বেরুতেই ক্যাপ্টেন বার্মা বলে উঠলেন, না বর্মন, চলো তোমাদের আমি গাড়িতে করে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসি। আজকাল চন্দনপুর-অন-সির অবস্থা আগের মতো নিরুপদ্রব নয়।
ক্যাপ্টেন বার্মা আমাদের তার গাড়িতে তুলে হোটেল দ্য শার্ক-এ পৌঁছে দিলেন। তারপর তিনি সবেগে গাড়ি চালিয়ে চলে গেলেন।
লাউঞ্জে এখন সাংবাদিকদের ভিড়। কেউ কেউ বর্মনদাকে হাত তুলে সম্ভাষণ করল–হাই!
বর্মনদা হাত নেড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেন। তারপর দোতলার করিডরে দাঁড়িয়ে বললেন, ভাই জয়ন্ত, তুমি যখন ক্যান্টিনে খেতে যাবে, আমাকে টেলিফোন করবে। দুজনে একসঙ্গেই যাব। আর একটা কথা, দরজায় কেউ নক করলে আই-হোল দিয়ে দেখে নেবে এবং যেই হোক, দরজা খুলবে না। সোজা বলে দেবে আমি ব্যস্ত।
কথাটা বলে তিনি নিজের সুইটের দিকে চলে গেলেন।
পোশাক বদল করে বাথরুমে মুখ ধুয়ে এবং ঘাড়ে জল ছিটিয়ে অনেকটা চাঙ্গা হওয়া গেল। ব্যালকনিতে গিয়ে বসলুম। দক্ষিণের পোড়ো বাতিঘর অন্ধকারে অদৃশ্য। কিন্তু সি বিচে উজ্জ্বল আলোয় কিছু লোকের চলাফেরা চোখে পড়ল। ঘড়ি দেখলুম। আটটা পঁয়তাল্লিশ।
সমুদ্রের নোনা বাতাসের উপদ্রবে এখন বেশ কিছুটা হিমেল আক্রমণ আছে।
ন-টায় বর্মনদাকে টেলিফোন করে জানিয়েছিলুম আমি ক্যান্টিনে যাচ্ছি।
দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে দেখি তামিল সাংবাদিক মি. রাঘবন এইমাত্র করিডরে উঠল। আমি তাকে মার্কিন রীতিতে সম্ভাষণ করলাম–হাই!
মি. রাঘবন ঘুরে দাঁড়িয়ে নিষ্পলক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, আপনি আর সুভদ্র বর্মনকে প্রায় লক্ষ করছি যেন দুজনে কিছু দাঁও মারার তালে আছেন।
আমি একটু উষ্ণ হয়ে বললুম, দাঁও মানে? কী বলতে চাইছেন?
মি. রাঘবন তেমনই চোখে বলল, সাংবাদিকদের কাছে দাও কথাটার একটাই অর্থ আছে। কোনো সেনসেশেনাল নিউজ বিশেষ করে এখানকার একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী পিটার গোমসের ক্ষতবিক্ষত লাশ যখন খাঁড়ির জলে পাওয়া গেছে তখন অনেক সাংবাদিকই অন্তর্তদন্তের জন্য লড়ে যাবে। তার মানে আমি বলতে চাইছি। আপনারা দুজনে কি সেই লড়াই লড়ে যাচ্ছেন?
মাথাটা ঠান্ডা রেখে মুখে হাসি এনে বললুম, আপনিও কি লড়ে যাচ্ছেন না?
মি. রাঘবন কিছু বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছিল। বর্মনদা এসে গেলেন। তিনি বললেন, হাই রাঘবন, কলকাতার তরুণ বাঙালি সাংবাদিককে একলা পেয়ে কোনো বিষয়ে প্ররোচনা দিচ্ছ নাকি?
মি. রাঘবন বলল, বর্মন, তুমি তো তর্কবিদ্যাবিশারদ। তোমার অনেক অন্তর্তদন্তের খবর সারা দেশে হইচই বাধিয়েছে। কিন্তু আমার ধারণা পিটার গোমসের ব্যাপারে নাক গলানোয় রিস্ক আছে।
বর্মনদা ঠোঁটের কোণে বাঁকা হেসে বললেন, এটা কি তোমার হুমকি?
-না। অনেক ব্যাপারে আমাদের সাংবাদিকদের বেশি নাক না গলানোই উচিত।
কথাটা বলে মি. রাঘবন নিজের সুইটের দিকে চলে গেল।
সিঁড়িতে নামতে নামতে আমি বর্মনদাকে জানিয়ে দিলুম মি. রাঘবন আমাকে কী বলছিল।
বর্মনদা চাপা স্বরে বললেন, লোকটা সাংবাদিক হওয়ার যোগ্য নয়। অথচ মাদ্রাজে ওর নামডাক আছে। বড়ো বড়ো রাজনীতিকরা ওকে পাত্তা দেন। কেন দেন সেটা আমার মাথায় আসে না।
ক্যান্টিনে গিয়ে আমরা দুজনেই রুটি তরকারি আর একটা পানীয় অর্ডার দিয়ে ডিনার সেরে নিলুম। তারপর আমার পকেট থেকে সেই বিদেশি সিগারেট বের করে বর্মনদাকে একটা দিলুম। বর্মনদা লাইটার দিয়ে আমার সিগারেটটা ধরিয়ে দিলেন। তারপর নিজেরটা ধরিয়ে নিয়ে বললেন, রাঘবন একটা কিছু আঁচ করেছে। তার বন্ধু পিটার গোমসের ব্যাপারে যে আমরা আগ্রহী তা সে বুঝতে পেরেছে। কিন্তু আমার ধারণা আমাদের এই আগ্রহ যে নিছক সাংবাদিকসুলভ নয়, এর পেছনে অন্য কিছু আছে বলে সে সন্দেহ করেছে।
বললুম, বর্মনদা, অত কিছু নাও হতে পারে। হয়তো একটা ঘটনার অন্তর্তদন্ত নিয়ে মি. রাঘবনের এটা নিছক সাংবাদিকসুলভ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব।
বর্মনদা আস্তে বললেন, তুমি ওকে ভোরবেলায় হঠাৎ সমুদ্রের বাঁধে উঠে যেতে দেখেছিলে। সেখানে থেকে নীচের কেয়াবনে যে জিনিসটা আমরা উদ্ধার করেছি তার দুরত্ব বড়জোর ১৫/২০ মিটারের মধ্যে।
বলেই তিনি চুপ করে গেলেন। লক্ষ করলুম মি. রাঘবন ক্যান্টিনে ঢুকছে। সোজা এগিয়ে গিয়ে সে যে টেবিলের সামনে বসল সেখানে একজন ভদ্রলোক বসেছিলেন। তাকে আমি সাংবাদিকদের দলে দেখিনি। তাই চাপা স্বরে বললুম, মি. রাঘবনের গেস্টকে চিনতে পারছেন বর্মনদা?
চেনা মনে হচ্ছে কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে করতে পারছি না। ভদ্রলোক যে সাংবাদিক নন সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। যাই হোক, চলো নিজের নিজের ডেরায় গিয়ে শুয়ে পড়া যাক। খুব ধকল গেছে।
দোতলার করিডরে গিয়ে বর্মনদা আবার আমাকে সাবধান করে দিলেন কেউ দরজায় নক করলে কিছুতেই আমি যেন দরজা না খুলি। প্রয়োজনে তার ঘরে টেলিফোনে ঘুম ভাঙালেও তিনি রাগ করবেন না।
সে রাতে কেউ অবশ্য আমার দরজায় নক করেনি। করলেও আমি বেঘোরে এমন ঘুমিয়ে ছিলুম যে টের পাইনি।
এদিন ঘুম ভাঙতে সাতটা বেজে গিয়েছিল। আজ আর সি বিচে জগিং করতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। বাথরুম সেরে পোশাক বদলে নীচে গেলুম। আমি জানি বর্মনদা খুব ভোরে ওঠেন। তাকে না খুঁজে সোজা চলে গেলুম সমুদ্রতীরের সেই কাফেটেরিয়ায়। বাইরে দাঁড়িয়ে এক পেয়ালা কফি নিলুম তারপর সি বিচের দিকে। লক্ষ রাখলুম।
বর্মনদাকে সি বিচের ভিড়ে খুঁজছিলুম। কফি শেষ করার পর সি বিচে না নেমে পিচ রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে হোটেল দ্য শার্ক পেরিয়ে যেন কী এক নেশার ঘোরে পোড়ো বাতিঘরের দিকে এগিয়ে গেলুম।
সেই সময় বাঁদিকের সেই কেয়াবনটা দেখার ইচ্ছা হল। থমকে দাঁড়ালুম। বিস্তীর্ণ কেয়াবনটা যেন কোনো মত্ত হাতি রাতারাতি ভাঙচুর করেছে।
অবাক হয়ে ভাবছি এই জঙ্গলটার এমন দুর্দশা হল কেন? সেই সময় আমাকে অবাক করে পশ্চিমে খাঁড়ির উঁচু পাড় থেকে কর্নেল এবং বর্মনদা নেমে এলেন। ওঁরা তখন আমার কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরে।
আমি হন্তদন্ত তাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলুম। কর্নেল দূর থেকে হাত তুলে আমাকে অপেক্ষা করতে ইশারা করলেন।
কিছুক্ষণ পরে কর্নেল এসে সম্ভাষণ করলেন, মর্নিং জয়ন্ত। তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি বেঘোরে ঘুমিয়েছ।
কিন্তু তুমি কি দৈবাৎ আমাদের দেখতে পেয়েছিলে তোমার ব্যালকনি থেকে?
বললুম, না। আমি আপনার প্রিয় কাফেটেরিয়ায় কফি খেয়ে নিছক মর্নিংওয়াক করছিলুম। এখানে এসে হঠাৎ কেয়াবনটার অবস্থা দেখে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলুম। এই এলাকায় হাতি নেই। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে এই জঙ্গলে মত্ত হাতি খুব দাপাদাপি করেছে।
বর্মনদা একটু হেসে বললেন, চন্দনপুর-অন-সিতে পুলিশকে তুমি মত্ত হাতির সঙ্গে তুলনা করতে পারো। এ কীর্তি তাদেরই।
বললুম, সে কী! পুলিশ কেন এই জঙ্গলটার অবস্থা এমন করেছে?
বর্মনদা বললেন, কর্নেলসাহেব, আপনার এই তরুণ বন্ধুটিকে খবরটা দিন।
কর্নেল বললেন, খবরের লোককে খবর দেওয়া নিশ্চয় উচিত। কিন্তু খবর তো তুমিই দিয়ে ফেললে। রাতদুপুরে এখানে পুলিশ হানা দিয়েছিল। তারা একজন লোককে ধরতে পেরেছে। অন্য জন পালিয়ে গেছে। চলো! আমাদের প্রিয় কাফেটেরিয়ায় কফি খেতে খেতে বাকি খবরটুকু দেব।…
.
০৭.
সি বিচে নামার পথে এই কাফেটেরিয়ায় পৌঁছে কফি পানের সঙ্গে কর্নেল যা জানালেন তা এই :
থানার ওসি মি. মাধবনকে কেউ উড়ো ফোনে জানিয়েছিল পোভড়া বাতিঘরের কাছে চোরাকারবারীদের একটা লেনদেন ঘটবে। পুলিশ যেন আগে থেকেই গোপনে সেখানে ওত পাতে। ওসি এর আগেও ডিউটি অফিসারের কাছে বর্মনদার ফোনের কথা শুনেছিলেন। তাছাড়া ক্যাপ্টেন বার্মাও তাকে আভাসে জানিয়ে রেখেছিলেন পিটার গোমস মারা গেলেও তার আত্মা ঠিকই কারবার চালিয়ে যাবে।
রাত এগারোটায় ওসি মি. মাধবন কর্নেলকে টেলিফোনে জানিয়েছিলেন এই অভিযানে তিনি সঙ্গী হতে চান কিনা। কর্নেল তার প্রস্তাব এড়িয়ে গিয়েছিলেন। কারণ সত্যি যদি মৃত পিটার গোমসের লোকজন জার্মান বিজ্ঞানীর দ্বিতীয় ব্যাগটা ওখানেই পুঁতে রেখে থাকে, তাহলে তারা সেটা উদ্ধারের জন্য অস্ত্রশস্ত্রে সেজেই অবতীর্ণ হবে। কাজেই রাতের অন্ধকারে কোনো দুবৃত্তের হাতে হতাহত হতে কর্নেলের ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু ক্যাপ্টেন বর্মা এবং তিনি দুজনেই বাংলোয় জেগে বসে ছিলেন। পুলিশ গোপনে অন্য পথে গিয়ে সেখানে ওত পেতে ছিল। কিন্তু ততকিছু জমজমাট লড়াই বাধেনি। সি বিচের দিক থেকে আলো-ছায়ার ভেতর দিয়ে দুটো লোক কেয়াবনে ঢুকে পড়া মাত্র পুলিশ চার্জ করে। লোক দুটো নেহাত গোবেচারা। কিন্তু তাদের পাকড়াও করতে পুলিশ বাহিনী সত্যিই মত্ত হাতির মতো পুরো জঙ্গলটা দাপিয়ে তাদের খুঁজে বেড়ায়। অবশেষে একটা লোককে তারা ধরে ফেলে তার হাতে একটা শাবল ছিল। দ্বিতীয় লোকটা কীভাবে একেবারে নিপাত্তা হয়ে যায়। এদিকে আসামীর হাতে শাবল দেখে ওসি মি. মাধবনের বিশ্বাস হয়েছিল। ওরা এই জঙ্গলের ভিতরেই কোথাও দামি চোরাইমাল পুঁতে রেখেছে। তাই তিনি তন্নতন্ন জঙ্গল খুঁজে এবং সেই সঙ্গে কনস্টেবলদের খোঁজার কাজে লাগিয়ে অবশেষে ব্যর্থ হন। বাকি রাত চারদিক ঘিরে পুলিশ পাহারা রেখে ওসি ফিরে যান। রাত একটা নাগাদ কর্নেল থানায় টেলিফোন করে ব্যর্থ অভিযানের কাহিনি শোনেন। তারপর কর্নেলই বলেন যে লোকটা ধরা পড়েছে তাকে জেরা করলেই তো জানা যাবে জঙ্গলে কী পোতা ছিল। কাজেই অনর্থক ওখানে কনস্টেবল বেচারাদের রাত জাগিয়ে লাভ নেই। অন্তত এ রাতে আর ওখানে কারও পা বাড়ানোর সাহস হবে না।
গত রাতে পুলিশ অভিযানের এই কাহিনি শুনে আমার হাসি পাচ্ছিল। বললুম, তাহলে অভিযান ব্যর্থ হয়নি। অন্তত একজন ধরা পড়েছে। লোকটা কে তা কি আপনারা জানতে পেরেছেন?
বর্মনদা বললেন, শুনলে তুমি তত অবাক হবে না। পিটার গোমসের ম্যানেজার নবকুমার পণ্ডা হাফপ্যান্ট-গেঞ্জি পরে একটা শাবল হাতে নিয়ে মৃত মালিকের গুপ্তধন খুঁড়ে বের করতে গিয়েছিল। সে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে তার। মালিকের হুকুমেই সে একটা ছোটো ব্যাগ ওখানে পুঁতে রেখেছিল। কিন্তু ব্যাগে কী আছে সে এখনও জানে না।
কর্নেল বললেন, আশ্চর্য ব্যাপার, ভোর ছটা অবধি জেরা করেও সঙ্গীর নাম পুলিশ বের করতে পারেনি।
বর্মনদা বললেন, মি. মাধবন যেরকম কড়া ধাতের মানুষ, তার, জেরা আর ব্যাটনের মারাত্মক ঘা পণ্ডামশাইকে শেষ পর্যন্ত নামটা বলিয়ে তবে ছাড়বে। যাই হোক, আজকে তো বেলা ন-টা থেকে বারোটা অবধি লাস্ট সেশন চলবে। তুমি কি সেই সেশনে উপস্থিত থাকতে চাও?
বললুম, আর ওখানে নয়। আমি এবার কর্নেলের সঙ্গ ধরব। কারণ এই অদ্ভুত রহস্যের জটটা কর্নেলই খুলবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কারণ এই রহস্যের টানেই কর্নেল আগেই কলকাতা থেকে চন্দনপুর-অন-সিতে এসে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, রহস্যের জট তো পুলিশের হাতে। তাছাড়া এ ব্যাপারে সুভদ্র বর্মনই প্রকৃতপক্ষে সব রহস্যের জটগুলো অনেকটা ছাড়িয়ে ফেলেছে। কাজেই কৃতিত্ব যদি দিতে হয় তাহলে তা তারই প্রাপ্য।
বর্মনদা মুচকি হেসে বললেন, আমাকে মনে হচ্ছে কর্নেল আবার একদফা লড়িয়ে দিতে চান।
কর্নেল তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, কেন?
বর্মনদা বললেন, খুব সোজা অঙ্ক। গত রাতের ঘটনার খবর পেয়ে ড. ফাটনবিশের প্রতিক্রিয়া জানতে আপনি উদগ্রীব, তাই না?
কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, ওই মহিলা বিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলার পক্ষে তুমি একমাত্র মিডিয়া। আগের রাতে ডিনার খেতে গিয়ে দেখেছি সুভদ্রা ফাটনবিশ সুভদ্র বর্মনকে যেন বেশি যত্নআত্তি করছিলেন।
বর্মনদা হাসি চেপে বললেন, কর্নেলসাহেব, আপনি গুরুজন, তবু আপনার সামনে কথাটা বলা যায়। শুনেছি, ওই মহিলাকে অনেক জ্ঞানীগুণী লোক বিয়ের জন্য প্রপোজ করে প্রচণ্ড অপমানিত হয়েছেন। শুধু একজনকে শ্ৰীমতীর নাকি বেজায় পছন্দ।
আমি বলে উঠলুম, সর্বনাশ! সে ভদ্রলোক তামিল সাংবাদিক মি. রাঘবন নয় তো??
বর্মনদা বললেন, তা এখন বলব না। যথাসময়ে তোমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেব।
কর্নেল বললেন, এবার ক্যাপ্টেন বার্মার বাংলোয় ফেরা যাক। ভদ্রলোক সারা রাত ঘুমোননি। আমিও ঘুমোইনি। কাজেই ব্রেকফাস্ট করে অন্তত ঘণ্টা দুই-তিন বিছানায় লম্বা হব।
বর্মনদা আমার হাত ধরে বললেন, জয়ন্ত কর্নেল সাহেবের সঙ্গী হতে চাইছিল। উনি বিছানায় লম্বা হবেন আর জয়ন্ত চেয়ারে বাঁকা হয়ে বসে অকারণ সময় কাটাবে–এটা হয় না। চলো জয়ন্ত, আমরা এখানে সরকারের আতিথ্যে কাটাচ্ছি; কাজেই আজ সমুদ্রভবনে সেমিনারের লাস্ট সেশনে উপস্থিত থাকা উচিত। তাছাড়া আমাদের যাতায়াতের ভাড়া দেবার দিন আজ। ওই অডিটোরিয়ামের পাশের ঘরেই ক্যাশিয়ার নগদ নোটের বান্ডিল নিয়ে বসে থাকবেন আর আমরা লাইন দিয়ে দাঁড়াব। ওফ, কী লোভনীয় দৃশ্য! ভাই জয়ন্ত, টাকা, টাকার চেয়ে। মূল্যবান জিনিস সত্যিই এই জগতে নেই।
তাঁর কথা বলার ভঙ্গিতে হেসে উঠলুম। কর্নেল পিচ রাস্তা অবধি আমাদের সঙ্গে এসে বললেন, জয়ন্ত, সুভদ্রের মতো স্ট্রাগল করে তুমি খ্যাতি অর্জন করোনি।
বর্মনদা হাসতে হাসতে কর্নেলকে বিদায় দিয়ে আমার কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটতে থাকলেন।
হোটেল দ্য শার্ক-এ পৌঁছোনের পর বর্মনদা বললেন, শুধু পোশাক বদলে রেডি হয়ে ক্যান্টিনে এসো। তোমার জন্য জায়গা রেখে দেব। দেরি কোরো না।
সাড়ে আটটা বাজে। সুইটে গিয়ে দ্রুত দাড়ি কেটে এবং পোশাক বদলে তৈরি হলুম। সম্মেলনে যাওয়ার ফাইলটি হাতে নিতে হল। তারপর কেন যেন মনে হল এই ঘরে আমার লাইসেন্সড ফায়ার আর্মসটা সুটকেসে ফেলে রেখে যাওয়া ঠিক নয়। পয়েন্ট বাইশ ক্যালিবারের রিভলবারটা সিক্স রাউন্ডার। তাতে ছটা বুলেট লোড করে নিয়ে সাবধানে রুমালে জড়িয়ে প্যান্টের বাঁ পকেটে রেখে দিলুম। তারপর বেরিয়ে গিয়ে দরজা লক করলুম।
ক্যান্টিনে ভিড় ছিল। বর্মনদা আমার জন্য একটা চেয়ার আটকে রেখে অপেক্ষা করছিলেন। আমি যাওয়ার পর তিনি বললেন, বাঃ! দাড়ি কেটে একেবারে ফিলমের হিরো হয়ে উঠেছ।
বললুম, আপনার মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি সত্ত্বেও আপনাকেই হিরো দেখাচ্ছে।
এই টেবিলে আরও কয়েকজন সাংবাদিক ব্রেকফাস্ট করছিলেন। তারা চলে যাওয়ার পর চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলুম, মি. রাঘবনকে দেখেছেন?
বর্মনদা টোস্টে কামড় দেওয়ার পর বললেন, ভদ্রলোককে দেখিনি। এমন হতে পারে ড. ফাটনবিশের সুইটে সে ব্রেকফাস্টের জন্য আমন্ত্রিত।
দ্রুত ব্রেকফাস্টের পর বর্মনদার দেখাদেখি মিষ্টি লিকার চা পান করলুম। সিগারেট টানার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বর্মনদা বললেন, বাসে না গেলে পায়ে হাঁটতে হবে। আজ এই ভোরবেলা কর্নেলসাহেবের ফোন পেয়ে নীচে অপেক্ষা করছিলুম। উনি হাঁটতে হাঁটতে এসেছিলেন। দুজনে পোড়ো লাইট হাউসের দিকে গিয়েছিলুম। কাজেই প্রচুর হাঁটাহাঁটি করেছি। উঠে পড়ো। সমুদ্রভবনে গিয়ে বাথরুমে সিগারেট খাওয়া যাবে।
বাইরে আমাদের নিয়ে যাবার জন্য লম্বা-চওড়া সুদৃশ্য বাস দাঁড়িয়ে ছিল। সেই বাসে চেপে কয়েক মিনিটের মধ্যেই সমুদ্রভবনের লনে পৌঁছে গেলুম।
বাস থেকে নেমে বর্মনদা বললেন, আমাদের দেশে ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে কোনো কাজ হয় না। সেশন শুরু হতে দেরি আছে মনে হচ্ছে। চলো, বাথরুমে নয়, সামনের করিডরে দাঁড়িয়ে তোমার বিদেশি সিগারেট টানা যাবে।
এই করিডরে দাঁড়ালে বাঁদিকের জানলা দিয়ে সুদৃশ্য ফুলবাগিচা আর বেঁটে চওড়া পাতাওয়ালা অদ্ভুত কী গাছের নীচে বসার বেদি চোখে পড়ে।
সিগারেট টানতে টানতে হঠাৎ আমার চোখে পড়ল মি. রাঘবন আর ড. ফাটনবিশ পাশাপাশি বসে গম্ভীর মুখে কথা বলছেন। বর্মনদাকে দৃশ্যটা দেখিয়ে দিলুম। বর্মনদা ঠোঁটের কোণে হেসে চাপা স্বরে বললেন, দেখলে তো আমার হিসেবে কোনো ভুল হয় না।
বললুম, বর্মনদা, তাহলে তার একটা কথা জিজ্ঞেস করি। কাফেটেরিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে আপনি এক ভদ্রলোকের কথা বলছিলেন যাকে নাকি ড. ফাটনবিশ খুব পাত্তা দেন। সে-ই কি মি. রাঘবন?
বর্মনদা মিটিমিটি হেসে বললেন, চেপে যাও।
এই সময় অডিটোরিয়ামে মিস চন্দ্রলেখা ঘোষণা করছিলেন–মাননীয় বিজ্ঞানীবৃন্দ, সাংবাদিক বন্ধুগণ এবং আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের আসন গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছি। আমাদের শেষ অধিবেশন এখনই শুরু হবে।
একটু পরে লক্ষ করলুম মি. রাঘবন এসে নিজের আসনে বসল। তার মুখে স্পষ্ট তিক্ততার আভাস। তার দিক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে মঞ্চের দিকে রাখলুম।
মিস চন্দ্রলেখা এবার ঘোষণা করলেন, ভদ্রমহোদয়া এবং ভদ্রমহোদয়, গত দু-দিনে এই সম্মেলনে যেসব বিষয় আলোচনা হয়েছে তার সংক্ষিপ্তসার শুনিয়ে প্রখ্যাত সমুদ্রবিজ্ঞানী ড. মনোহর সুন্দরম তার মূল্যবান মতামত জানাবেন। আশা করি আপনাদের হাতে এতক্ষণে এই লাস্ট সেশনের প্রোগ্রাম পৌঁছে গেছে।
টাইপ করা এক পাতা প্রোগ্রাম আমাদের টেবিলে রাখা ছিল। চোখ বুলিয়ে দেখলুম ড. সুন্দরমের পর স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবেন। তাহলে বোঝা যাচ্ছে ড. সুন্দরমের ভাষণ খুব লম্বাচওড়াই হবে।
মুখ ঘুরিয়ে বর্মনদার দিকে তাকালুম। তিনি চোখের ইশারায় কী যেন বললেন কিন্তু বুঝতে পারলুম না। অগত্যা একটুকরো কাগজে লিখলুম–কথাটা খুলে জানিয়ে দিন। তারপর হাত বাড়িয়ে দুটো সিটের পরে তার হাতে কাগজটা খুঁজে দিলুম। একটু পরে তিনি ওই কাগজের উলটো পিঠে কিছু লিখে হাত বাড়িয়ে আমাকে দিলেন। পড়ে দেখি তাতে লেখা আছে–অন্তত এক ঘণ্টা কষ্ট করে থাকার পর আমি করিডরে যাব। তুমি মিনিট পাঁচেক পরে আমাকে অনুসরণ করবে।
এই একটা ঘণ্টার মধ্যে মাঝে মাঝে মঞ্চের সামনে বসা বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করছিলেন। বিষয়টা আমার মাথায় ঢুকছিল না। অবশেষে বুঝতে পারলুম সমুদ্রবিজ্ঞানী ড. সুভদ্রা ফাটনবিশ কীটজাতীয় প্রাণীর ডি এন এ-তে পরিবর্তন ঘটিয়ে যে সাংঘাতিক সর্বভুক কীট সৃষ্টির সম্ভাবনা নিয়ে বক্তৃতা করেছেন, সবার প্রশ্নের লক্ষ্য সেই তত্ত্ব।
এভাবে এক ঘণ্টা কেটে গেল। তারপর কথামতো বেরিয়ে গিয়ে দেখি করিডরে বর্মনদা নিজের ব্র্যান্ড সিগারেট টানছেন।
কাছে গেলে বললেন, কর্নেলসাহেব আর ক্যাপ্টেন বার্মাকে আমন্ত্রিতদের মধ্যে খুঁজে পেলাম না। তার মানে ওঁরা দুজনেই পুলিশ স্টেশনে যেতে পারেন। যাই হোক আমরা ততক্ষণে একটা কাজ সেরে নিই। অফিসে গিয়ে যাতায়াতের খরচের ফর্ম চেয়ে নিই। তারপর ফর্ম ভর্তি করে দেখা যাক ক্যাশিয়ার ভদ্রলোককে জয় করা যায় নাকি।
বর্মনদাকে চুপচাপ অনুসরণ করলুম।
সমুদ্রভবনের কর্মচারীরা যেন আপদ বিদায়ের তালেই ছিলেন। যত শিগগির ঝামেলা শেষ করা যায় তত ভালো। কারণ তিনদিন ধরে নিয়মমতো অফিস আসা আর হরেক রকম ফাইল তৈরি বা জেরক্স করা এইসব রুটিন জবে ব্যতিব্যস্ত থাকতে কারই বা ভালো লাগে।
ক্যাশিয়ারের কাউন্টারে যাতায়াত খরচের ফর্ম জমা দিয়ে টাকা পেতে দেরি হল না। বর্মনদা বললেন, এবার চলো জয়ন্ত, কর্নেলসাহেব কোথায় কী করছেন খোঁজ। করা যাক।
করিডর দিয়ে এগিয়ে লনে নেমে বললুম, ওই গেটে গাছটার ছায়ায় বসে মি. রাঘবন আর ড. ফাটনবিশকে ঘনিষ্ঠভাবে বাক্যালাপ করতে দেখেছি। ব্যাপারটা আমার এখনও অদ্ভুত লাগছে।
বর্মনদা বললেন, ওফ! জয়ন্ত, তখন তোমাকে বলেছিলুম না ব্যাপারটা চেপে যাও।
বর্মনদার সঙ্গে পিচ রাস্তায় পৌঁছে বললুম, কর্নেলকে সম্মেলনে খুঁজে পাইনি। সম্ভবত ক্যাপ্টেন বার্মার বাংলোতেও খুঁজে পাওয়ার চান্স নেই।
বর্মনদা বললেন, ঠিকই বলেছ। কর্নেলসাহেব নিশ্চয় কোনো জরুরি সূত্র ধরে কোথাও ওত পাততে গেছেন। বরং চলো, হোটেল দ্য শার্ক-এ ফিরে গিয়ে তাকে টেলিফোন করে খোঁজ নেওয়া যাবে।
আমরা সবে পা বাড়িয়েছি, সমুদ্রভবনের গেট থেকে পাটনার সেই তরুণ সাংবাদিক রমেশ শর্মা ডাকল, জয়ন্তদা, জয়ন্তদা।
আমরা দাঁড়িয়ে গেলুম। বর্মনদা চাপা স্বরে বললেন, এই কচি মালটি ভবিষ্যতে নাম কামাবে।
-আপনার সঙ্গে আলাপ আছে?
–আছে মানে, এখানে আলাপ হয়েছে। এই প্রথম।
রমেশ কাছে এসে মৃদু হেসে বললল, আমি আপনাদের দিকে লক্ষ রেখেছিলুম। তাই যাতায়াতের ভাড়া আদায় করে বেরিয়ে এলুম। একঘেয়ে বুকনি শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে।
বললুম, তুমি কি হোটেলে ফিরবে?
রমেশ বলল, ফিরব। কিন্তু আমি আপনাদের ফলো করেছি কেন জানেন? মর্নিং সেশন শুরু হওয়ার একটু আগে লনের ফুলবাগানে একটা মজার দৃশ্য দেখেছি।
বর্মনদা বললেন, দৃশ্যটা মজার কেন বলো তো?
রমেশ হেসে অস্থির হয়ে বলল, ব্যাকগ্রাউন্ডটা যেন ফিলমের। তার মধ্যে ড. সুভদ্রার মতো সুন্দরী মহিলার সঙ্গে একটা গাঁট্টাগোট্টা কালো রঙের গুঁফো ভদ্রলোক–নাঃ। আপনারা আমার গুরুজনের তুল্য। আপনাদের সঙ্গে এসব কথা বলা উচিত নয়।
বর্মনদা তার পাশে গিয়ে তার কাঁধে একটা হাত রেখে চাপ দিলেন। তারপর বললেন, রমেশ, তুমি ওই রাঘবনের চেয়ে বেশি ধুরন্ধর। আমি লক্ষ করেছি তুমি রাঘবনকে প্রায় ফলো করে বেড়াও। ব্যাপারটা কী?
রমেশ চাপা স্বরে বলল, পিটার গোমসের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথা জয়ন্তদাকে বলেছিলুম। তারপর পিটার গোমস বেমক্কা মারা পড়ল। এখন আমার ভয় হচ্ছে মি. রাঘবনের পাল্লায় পড়ে ওই মহিলা বিজ্ঞানীর না কোনো বিপদ হয়।
বর্মনদা একটু হেসে বললেন, পিটার গোমস ছিল বিদেশি জিনিসের চোরাকারবারী। রাঘবনের সঙ্গে তার কেন বন্ধুতা গড়ে উঠেছিল আমরা জানি না। তুমি জানো?
রমেশ চাপা স্বরে বলল, আমার কেন যেন সন্দেহ হয় রাঘবন সত্যি কি সাংবাদিক?
চমকে উঠে বললুম, কেন? কেন?
রমেশ বলল, তার সঙ্গে মেলামেশার চেষ্টা করে দেখেছি তার কথাবার্তা সাংবাদিকদের মতো নয়। অবশ্য আমার ভুল হতেও পারে। কেন যেন সন্দেহ হয় পিটার গোমসের কোনো মাদ্রাজবাসী সহযোগী কোনো গোপন কারণে এই ভদ্রলোককে সাংবাদিক সাজিয়ে এখানে পাঠিয়েছে।
বর্মনদা এবার তার পিঠ চাপড়ে বললেন, বাঃ! তোমার মাথায় নানারকম অঙ্ক আসে। ভবিষ্যতে তুমি নাম করবে।
রমেশ কাঁচুমাচু মুখে বলল, প্লিজ বর্মনদা, আমাকে ভড়কে দেবেন না।
বর্মনদা হঠাৎ ঘুরে আমাকে বললেন, জয়ন্ত, সেই বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট তোমাকে নিশ্চয় এই শ্রীমান উপহার দিয়েছিল।
বললুম, হ্যাঁ।
রমেশ বলল, মাঝে মাঝে আমার সিগারেট খেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সিগারেট ছাড়ার প্রতিজ্ঞা রাখতে পারি না। বিশেষ করে অ্যামেরিকান সিগারেট মার্লবরোর প্যাকেট কোনো দোকানে দেখলে ভীষণ লোভ হয়। এখানে এসেই একটা দোকানে দেখতে পেয়ে দু-প্যাকেট কিনে ফেলেছিলুম।
বর্মনদা বললেন, ওরে বাবা! তার মানে তুমি এই বয়সেই ইয়াংকির সঙ্গ করে এসেছ।
রমেশ বলল, গত অক্টোবরে সরকারি আমন্ত্রণে ওয়াশিংটন গিয়েছিলুম।
ততক্ষণে আমরা হোটেল দ্য শার্ক-এর সামনে পৌঁছে গেছি। বর্মনদা বললেন, মোটে দশটা বাজে। চলো ক্যান্টিনে ঢুকে চায়ের লিকার পান করা যাক।
আমরা সবে ঘুরেছি এমন সময় পশ্চিম দিক থেকে একটা গাড়ি এসে আমাদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে গেল। তারপর দেখি গাড়ি ড্রাইভ করছেন ক্যাপ্টেন বার্মা এবং তাঁর বাঁ-পাশে বসে আছেন স্বনামধন্য কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
বর্মনদা বললেন, কী ব্যাপার ক্যাপ্টেনসাহেব?
ক্যাপ্টেন বললেন, কর্নেলসাহেবকে অনন্তপুরমে নৌবাহিনীর ঘাঁটিতে নিয়ে গিয়েছিলুম।
কর্নেল তার পাশ থেকে বললেন, সম্মেলন কি শেষ হয়ে গেল?
বর্মনদা বললেন, না। ওই বিরক্তিকর ভাষণ বরদাস্ত হল না। তাই যাতায়াতের টাকাকড়ি মিটিয়ে নিয়ে আমরা তিনজনে কেটে পড়লুম।
কর্নেল বললেন, অনেক দূর থেকে বাইনোকুলারে তোমাদের তিনজনকে খুব হাসিখুশি অবস্থায় আসতে দেখছিলুম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তোমাদের আলোচ্য ছিল কোনো মজার ঘটনা, যা সমুদ্রভবনের লাস্ট সেশনে তোমরা উপভোগ করেছ।
বর্মনদা বললেন, ঠিক ধরেছেন। কিন্তু আসলে আমরা মনে মনে আপনাকেই খুঁজছিলুম। ক্যান্টিনে চা খেয়ে ক্যাপ্টেনসাহেবের বাংলোয় ফোন করতুম।
আমি বললুম, ক্যাপ্টেন বার্মা আর কর্নেল যদি আমাদের সঙ্গে ক্যান্টিনে কিছুক্ষণ কাটিয়ে যান, সেই ঘটনাটা শুনতে পাবেন।
ক্যাপ্টেন বার্মা ঘড়ি দেখে বললেন, নাঃ! আমাদের সমুদ্রভবনে লাস্ট সেশনে একবার উপস্থিত থাকতেই হবে।
কর্নেল তার পাশ থেকে বললেন, ঘটনাটা এক লাইনে শুনতে পেলে ভালো হয়। আমার কাজে লাগতে পারে।
তখন আমি গাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে কর্নেলের কাছে গেলুম। তারপর সমুদ্রভবনের লনের ফুলবাগিচায় ড. সুভদ্রা ফাটনবিশ এবং সাংবাদিক মি. রাঘবনের অন্তরঙ্গ আলাপের কথাটা জানিয়ে দিলুম।
আমার কথা শুনেই কি জানি কেন কর্নেল বলে উঠলেন, ক্যাপ্টেন বার্মা, আর দেরি করা ঠিক নয়। সমুদ্রভবনে পৌঁছোনো দরকার।
ক্যাপ্টেন বার্মার গাড়ি জোরে বেরিয়ে গেল। আমি অবাক হয়ে বললুম, বর্মনদা, আমরা সমুদ্রভবন থেকে চলে এসে বোধহয় ভুল করেছি। কর্নেলের কথা শুনে মনে হল নিশ্চয়ই সেখানে কিছু একটা ঘটতে চলেছে।
রমেশ সায় দিয়ে বলল, জয়ন্তদা ঠিক বলেছেন।
বর্মনদা বললেন, যা ঘটার তা ঘটবে। যত শিগগির ঘটে তাই ভালো। চলো আমরা চায়ের লিকার পান করি আর রমেশ, তুমি কি তোমার মার্লবরোর প্যাকেট শেষ করে ফেলেছ?
-হ্যাঁ বর্মনদা।
আমি বললুম, আমার প্যাকেটে এখনও কয়েকটা আছে।
লাউঞ্জে ঢুকে দেখি একেবারে ফাঁকা হয়ে আছে। তারপর চোখে পড়ল শেষ। প্রান্তে দুজন তাগড়াই সন্দেহজনক চেহারার লোক বসে আছে।
ক্যান্টিনে ঢুকে কথাটা বর্মনদাকে বলতেই তিনি আস্তে বললেন, তোমরা নাবালক। বুঝতে পারছ না পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোক এই হোটেলে মোতায়েন করা হয়েছে। বিশেষ করে এসবি সম্মেলনে নানা দেশের গুপ্তচররা এসে জুটে যায়।
জানলার ধারে বসে তিনকাপ মিষ্টি চায়ের লিকারের অর্ডার দিলেন বর্মনদা। কিছুক্ষণ পরে চা খেতে খেতে বললুম, বোঝা যাচ্ছে কর্নেল অনন্তপুরমের খাঁড়ির কাছে সেই বিদেশি জাহাজডুবির ব্যাপারে নতুন কোনো তথ্যের খোঁজে গেছিলেন।
বর্মনদা বললেন, হ্যাঁ। জাহাজটা কোন দেশের এবং জাহাজে যারা ছিল তাদের খোঁজখবর না জানলে পিটার গোমস এবং ক্যাপ্টেন বার্মার হস্তগত জিনিস দুটির রহস্য বোঝা যাবে না।
রমেশ বলল, গত রাতে পুলিশ পোড়ো বাতিঘরের ওখানে কোথায় হানা দিয়েছিল শুনেছি।
বর্মনদা চোখ পাকিয়ে বললেন, কী আশ্চর্য! তুমি শুধু কানে শুনেছ, দেখতে যাওনি? এমন একটা সাংঘাতিক খবর তোমার কাগজ মিস করলে তো কেলেঙ্কারি। আশ্চর্য! আমি ভাবছি তুমি–
কথাটা অসমাপ্ত রেখেই বর্মনদা বললেন, নাঃ! রমেশ এখনও কচি খোকা থেকে গেছে। জয়ন্ত, ওর সিগারেট বের করো। এমনভাবে সিগারেট টানব যেন রমেশকেই পুড়িয়ে খাচ্ছি।
আমি পকেট থেকে মার্লবরোর প্যাকেট বার করে দেখলুম এখনও চারটে সিগারেট আছে। তিনজনে তিনটে সিগারেট ধরালাম। তারপর রমেশ চাপা স্বরে বলল, বর্মনদা, আমি ওই জঙ্গলে যাইনি বটে কিন্তু ভোরবেলা সি বিচে একজন জেলের কাছে সব খবর জেনে নিয়েছি। পিটার গেমসের ম্যানেজার ধরা পড়েছে। কিন্তু তার সঙ্গী পালিয়ে গেছে। এই সঙ্গীর খোঁজে পুলিশ এখনও নাকি সবখানে খোঁজাখুঁজি করে বেড়াচ্ছিল।
জানলা দিয়ে পিচ রাস্তার দিকে তাকিয়ে বর্মনদা সিগারেট টানছিলেন। বললেন, তুমি তাকে প্রশ্ন করলেই পারতে। পালিয়ে যাওয়া লোকটা কে হতে পারে বলে তার সন্দেহ হয়।
রমেশ হাসল–নিশ্চয় জিজ্ঞেস করেছিলুম। লোকটি অনেক খবর রাখে। সে বলল পিটারসাহেবের সঙ্গে ভোটের বাবু সেনাপতিমশাইয়ের খুব ভাব ছিল। পিটারের কারবার তো তার জোরেই চলত। পুলিশকে মুখ বুজে থাকতে হত। জেলে লোকটির মতে গতরাতে যে পালিয়ে গেছে সে সেনাপতিমশায়েরই কোনো লোক। এখানকার সব দুৰ্বত্ত নাকি ভোটের বাবুর চ্যালা।
এই সময় বর্মনদা হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, সমুদ্রভবনের দিকে কী যেন গন্ডগোল বেধেছে। চলো জয়ন্ত, দেখে আসি। রমেশ রেডি হও। নিশ্চয় জব্বর কিছু খবর পেয়ে যাবে।
বর্মনদা চায়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে হন্তদন্ত বেরুলেন। আমরা তাকে অনুসরণ করলুম।
গেট পেরিয়ে গিয়ে দেখি সমুদ্রভবনের সামনে রাস্তা অবধি বেশ ভিড় জমে গেছে। পুলিশের কয়েকটা গাড়িও দেখা গেল।
আমরা হন্তদন্ত এগিয়ে গেলুম।
সমুদ্রভবনের সামনে পৌঁছে দেখলুম একটা প্রিজন ভ্যান তখনই চলে গেল। তারপর পুলিশের একটা জিপ ভ্যানটাকে অনুসরণ করল।
এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলুম, কী ব্যাপার বলনু তো?
ভদ্রলোক বললেন, কি জানি কী ব্যাপার বোঝা গেল না।
ওদিকে বর্মনদা তখন ভিড়ের ভিতর হারিয়ে গেছেন। রমেশকেও খুঁজে পেলুম না।
.
০৮.
ব্যস্ত হয়ে ভিড়ের ভিতরে যাকেই জিজ্ঞেস করছিলুম তিনিই বলছিলেন কী ঘটেছে জানেন না। এরা সবাই স্থানীয় লোক এবং পুলিশের হামলার কথা শুনে এখানে এসে ভিড় জমিয়েছে, তা বুঝতে দেরি হল না। সমুদ্রভবনের গেটে কয়েকজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে এবং ভিতর থেকে বিজ্ঞানীদের দু-এক কথা জিজ্ঞেস করে বেরিয়ে আসতে দিচ্ছে। এক বিজ্ঞানী ভদ্রলোক বেরিয়ে আসা মাত্র তাকে জিজ্ঞেস করলুম, এখানে কি কোনো গন্ডগোল হয়েছে, স্যার?
ভদ্রলোক গোমড়া মুখে বললেন, আমি কিছু জানি না। পুলিশ অডিটোরিয়ামের পিছনে কার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছিল শুনলুম।
কথাটা বলে তিনি ভিড় ঠেলে চলে গেলেন।
অগত্যা আমি আমার আইডেন্টিটি কার্ড পুলিশকে দেখিয়ে ভিতরে যেতে চাইলুম। পুলিশ আপত্তি করল না।
লাউঞ্জে গিয়ে দেখি বর্মনদা কর্নেলের মুখোমুখি বসে কথা বলছেন। রমেশকে দেখতে পেলুম না। লাউঞ্জে তখনও ইতস্তত কিছু ভদ্রলোক বসে আছেন। অনেকের হাতে পেপার-কাপে চা কিংবা কফি।
কর্নেল আমাকে দেখে বললেন, এতক্ষণ তুমি কোথায় ছিলে?
রুষ্টমুখে বললুম, বর্মনদার সঙ্গে কোথাও যাওয়া দেখছি নিরাপদ নয়। দিব্যি আমাকে ফেলে রেখে কখন ভিতরে ঢুকে পড়েছে।
বর্মনদা হাসতে হাসতে বললেন, নাটকটা স্বচক্ষে দেখতে পেলুম না। কিন্তু বোকার মতো নিজের কার্ড দেখিয়ে এখানে ঢুকে পড়েছি। আর আমার সৌভাগ্য এখানে ঢুকেই কর্নেলসাহেবকে পেয়ে গেছি।
ওঁদের পাশে একটা আসন টেনে নিয়ে বসে বললুম, কিন্তু পুলিশ এখনও এলাকা ঘিরে রেখেছে কেন? গেটেও দেখলুম খুব কড়াকড়ি।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। কড়াকড়ি তো থাকবেই। মূল আসামীকে অনেক কষ্টে প্রায় তাড়া করে নিয়ে গিয়ে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। এখনও আর একজন সন্দেহভাজন লোককে পুলিশ খুঁজছে।
জিজ্ঞেস করলুম, মূল আসামী কে?
কর্নেল বর্মনদার দিকে তাকালেন। বর্মনদা মুচকি হেসে বললেন, এখনও তুমি টের পাচ্ছ না সে কে হতে পারে!
চমকে উঠে বললুম, মি. রাঘবন নয় তো?
–আবার কে! বলে বর্মনদা হঠাৎ থেমে গেলেন।
লক্ষ করলুম তিনি কোণের দিক থেকে সদ্য উঠে আসা এক ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে আছেন।
কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, ভদ্রলোককে কোথায় যেন দেখেছি।
বর্মনদা বললেন, আমিও দেখেছি কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছি না।
ভদ্রলোকের পরনে সাফারি স্যুট, হাতে একটা ব্রিফকেস। তিনি সোজা বেরিয়ে গেলেন।
এদিকে ততক্ষণে কর্নেল পকেট থেকে একটা ছবি বের করে দেখছিলেন। হঠাৎ তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বর্মনদা বললেন, ব্যাপার কী কর্নেলসাহেব?
কর্নেল ব্যস্তভাবে বললেন, আজ অনন্তপুরমে নৌবাহিনীর রেকর্ড থেকে এই ছবিটা পেয়েছি। এটা গ্রুপ ছবি। ডুবে যাওয়া ইটালিয়ান জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং অন্যান্য যাদের কোস্টগার্ডরা উদ্ধার করেছিল তাদের ছবির একটা কপি। তোমরা এসো। নাটকটা স্বচক্ষেই দেখবে।
লাউঞ্জের বাইরে একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে ছিলেন। কর্নেল হন্তদন্ত এগিয়ে গিয়ে তাঁকে ছবিটা দেখিয়ে কিছু বললেন।
আমরা এগিয়ে গিয়ে দেখি সেই পুলিশ অফিসার এবং আরও জনা তিন-চার সাদা পোশাকের পুলিশ সেই ভদ্রলোককে ঘিরে ধরেছেন। ভদ্রলোক খাপ্পা হয়ে তর্জনগর্জন করছেন। কিন্তু শেষাবধি সাদা পোশাকের পুলিশেরা তাঁর হাত থেকে ব্রিফকেসটা নিয়ে তার দুটো হাত পিছনে এনে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে দিল। তারপর তাঁরা তাঁকে নিয়ে গিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা অ্যামবাসাডর গাড়িতে ঢোকাল।
কর্নেল পুলিশ অফিসারটির সঙ্গে যাচ্ছিলেন। তিনি সহাস্যে গাড়ির সামনে উঠে হাত নেড়ে কর্নেলকে বিদায় জানালেন। আমরা দুজনে হতবাক।
আবার আইডেন্টিটি কার্ড দেখিয়ে গেট পেরিয়ে কর্নেলের কাছে গেলুম। বললুম, এই তিন নম্বর আসামীটি কে?
কর্নেল বললেন, এখানে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে কোনো কথা নয়। ওই দেখ ক্যাপ্টেন বার্মা তার গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছেন। আমরা তার কাছে যাই।
ক্যাপ্টেন বার্মার গাড়ির কাছে যেতেই তিনি হাসতে হাসতে বললেন, তাহলে সত্যিই চন্দ্রস্বামী আইয়ার এখনও ভিতরে ছিল?
কর্নেল বললেন, বেরুবার সুযোগ খুঁজছিলেন কিন্তু আইয়ারসাহেব ভাবতে পারেননি আমি তার জন্য লাউঞ্জে ওত পেতে বসে আছি।
ক্যাপ্টেন বার্মার গাড়িতে চেপে আমরা তার বাংলোয় পৌঁছেলুম। তারপর তার গেস্টরুমে কর্নেলের সঙ্গে গিয়ে ঢুকলুম।
ক্যাপ্টেন বললেন, আমি পোশাক বদলে আসছি। এত বেলায় সুভদ্র কি কফি খাবে?
বর্মনদা বললেন, না। হোটেলে ফিরে লাঞ্চ খাব।
-জয়ন্ত?
আমি বললুম, নাঃ। এই যাত্রায় আমি বর্মনদার সঙ্গী। কাজেই তিনি যা করবেন, আমিও তা করব।
কর্নেল বললেন, তাহলে তোমরা আমাদের দুই বৃদ্ধের কফি পান দেখবে?
বললুম, না। আপনার মুখে রহস্যের জট খোলার বিবরণ শুনব।
বর্মনদা বললেন, হ্যাঁ। আমার মাথার ভিতরে এখন অনেক প্রশ্ন মাছির মতো ভনভন করছে।
কর্নেল বললেন, একটু অপেক্ষা করো। ক্যাপ্টেন বার্মার সঙ্গে আশা করি রামলালের তৈরি কফিও এসে যাবে।
বর্মনদা ভ্রু কুঁচকে কী ভাবছিলেন। তারপর বললেন, মাই গুডনেস! দ্বিতীয় মূল আসামী তামিল সাংবাদিক মি. রাঘবন, তাই না?
কর্নেল বললেন, ভদ্রলোক পুলিশ দেখে হঠাৎ যদি চুপিচুপি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করত এবং পিছনের অফিসে ঢুকে বসে থাকত, তাকে পুলিশের খুঁজে বের করতে সময় লাগত।
বললুম, তাহলে আমার সন্দেহটাই ঠিক প্রমাণিত হল। গতকাল ভোরে হঠাৎ সি বিচ থেকে উঠে রাঘবন তাহলে পিটার গোমসকেই বধ করতে গিয়েছিল।
বর্মনদা বললেন, ঠিক তাই। দুজনের মধ্যে ওই সময় গোপনে খাড়ির ধারে বসে লুকিয়ে রাখা জিনিসটা নিয়ে দর কষাকষির প্রোগ্রাম ছিল। কী বলেন কর্নেলসাহেব?
এই সময় ক্যাপ্টেন বার্মা এবং তার সঙ্গে রামলাল এসে ট্রেতে কফি রেখে গেল।
ক্যাপ্টেন বার্মা কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, সূভদ্রের কথাটা আমার কানে এসেছে। ব্যাপারটা ঠিক তাই। রাঘবন পিটার গোমসের ম্যানেজার নবকুমার পণ্ডার সঙ্গে গোপনে ভাব করে জিনিসটার হদিস পেয়েছিল। পণ্ডা জানত ওটা কোথায় পোঁতা আছে। কাজেই পণ্ডা এবং রাঘবন দুজনেই পিটারকে কৌশলে খুন করার ষড়যন্ত্র করেছিল।
বললুম, এটা কি আপনার এবং কর্নেল সাহেবের নিছক থিয়োরি?
কর্নেল বললেন, প্রথম দিকে থিয়োরিটা ক্যাপ্টেনসাহেবের মাথায় এসেছিল। নবকুমার পণ্ডাকে অ্যারেস্ট করার পর জেরার চোটে একসময় সে ভেঙে পড়ে। তারপর চক্রান্তটা স্বীকার করে। আমি অবশ্য পুলিশ সোর্স থেকে টেলিফোনে কথাটা জেনেছিলুম। ওদিকে অনন্তপুরমে নৌবাহিনীর ঘাঁটিতে এখানে আসার পরই ক্যাপ্টেনসাহেবের সঙ্গে গিয়ে তাদের বলেছিলুম ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে যাদের উদ্ধার করা হয়েছিল তাদের নিশ্চয়ই ফোটো রাখা আছে? আমি সেই ফোটোর একটা কপি পাওয়ার জন্য ওদের অনুরোধ করেছিলুম। আজ থানায় ফোন করার পর অনন্তপুরমে ফোন করেছিলুম। ওঁরা বললেন ফোটোর কপি আমরা গেলেই পেয়ে যাব।
বর্মনদা বললেন, কিন্তু এই চন্দ্রস্বামী আইয়ারের ভূমিকাটা কী?
কর্নেল বললেন, সে এক লম্বাচওড়া কাহিনি। কলকাতায় ক্যাপ্টেনসাহেবের টেলিফোন পাওয়ার পর আমি আমার নিউজ পেপার কাটিং-এর ফাইল খুঁজে জার্মানির জীববিজ্ঞানী ড. ফ্রেডারিক স্টাইনগাসের হঠাৎ রহস্যময় মৃত্যু এবং তার ল্যাব থেকে মূল্যবান নথি চুরি যাওয়ার যে খবর বেরিয়েছিল সেটা বের করি। ওই কাটিংটা নেহাত খেয়ালবশে রেখেছিলুম। অবশ্য জয়ন্ত জানে এই ধরনের নিউজ কাটিং সংগ্রহ করা আমার বাতিক। কখন কোনটা কাজে লেগে যায়।
বর্মনদা বললেন, আপনার এখানে ছুটে আসার কারণটা বোঝা গেল। কিন্তু খবরে কি অনন্তপুরমের কাছে ইটালিয়ান জাহাজডুবির কোনো উল্লেখ ছিল?
কর্নেল বললেন, না। এই খবরটা তার এক মাস পরে বেরিয়েছিল। জার্মান সরকারের পুলিশ দপ্তর একটা সূত্র পেয়েছিল। ড. স্টাইনগাসের হত্যাকাণ্ডের আগে একজন ভারতীয় জীববিজ্ঞানী তার সহকারী নিযুক্ত হয়েছিলেন। ঘটনার পর পুলিশ জানতে পারে সেই ভদ্রলোক অর্থাৎ চন্দ্রস্বামী আইয়ার ইটালির ভিসা নিয়ে। রোমে গেছেন। ইটালির পুলিশ তাকে খুঁজে বের করার আগেই ভদ্রলোক একটা কারগো ভেসেল বা ছোটো মালবাহী জাহাজে চাকরি নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন। তার চাকরি পাওয়ার কারণ কারগো ভেসেলটা ভারতের মাদ্রাজ এবং বোম্বাই বন্দরে কিছু মাল খালাস করার কথা ছিল। বোঝা যায়, এর মধ্যে চোরাই মাল ছিল। প্রায় উপকূল ঘেঁষে জাহাজটা যাচ্ছিল। ডুবো পাথরে ধাক্কা লেগে তলা ফেটে যায় এবং জাহাজটা ডুবে যায়। আইয়ার ভারতীয় হওয়ার জন্য উদ্ধারকারীদের মনে সন্দেহ জাগেনি।
বললুম, এই আইয়ার ভদ্রলোক কি এখানে বিজ্ঞানী হিসেবে এসেছিলেন?
কর্নেল বললেন, আগেই তো বলেছি আইয়ার একজন জীববিজ্ঞানী। কাজেই তার এই সম্মেলনে আসার আমন্ত্রণপত্র জোগাড় করতে কষ্ট হয়নি।
হাসতে হাসতে বললুম, জার্মান জীববিজ্ঞানীর পুরো নথি এবং পরীক্ষানিরীক্ষার যন্ত্রপাতি এখন ক্যাপ্টেন বার্মার করতলগত। ইচ্ছে করলে ওটা কোনো দেশকে বেচে আপনি–
ক্যাপ্টেন বার্মা হোহো করে হেসে উঠলেন–আমি উন্মাদ নাকি! ওইসব নথিপত্র আর ওই খুদে বায়োকেমিক্যাল মেশিন আমার ফার্মহাউসে পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলব। তোমরা দুজনে যদি তা দেখতে চাও তাহলে আসতে পারো। বিকেল চারটেয় আমি কর্নেলসাহেবকে নিয়ে ফার্মহাউসে যাব।
বর্মনদা বললেন, অবশ্যই যাব। কিন্তু একটা শর্ত। এই চাঞ্চল্যকর খবরের কপিরাইট কিন্তু আমাদের দুজনের।
কর্নেল বললেন, আমরা না বললেও তোমরা এই রহস্যময় ঘটনার খবর সবিস্তারে লিখবে, তা আমরা জানি। যাই হোক, সব জিনিসপত্র গুছিয়ে তৈরি থেকো। আমরা গিয়ে হোটেল দ্য শার্ক থেকে তোমাদের পিক-আপ করব।
বাংলো থেকে বেরিয়ে পিচ রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বললুম, জীবনে এই প্রথম একটি রহস্যের উন্মোচনের সঙ্গে আমি কর্নেলের সারাক্ষণের সঙ্গী হতে পারলুম না।
বর্মনদা হাসতে হাসতে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ওঁর সঙ্গী হলে পিটার। গোমসের মৃত্যুরহস্যের সূত্র.তুমি পেতে বলে মনে হয় না। তুমিই তো রাঘবনকে হঠাৎ সি বিচ থেকে ওপরে উঠে যেতে দেখেছিলে। আর তার পরেই পিটারের রক্তাক্ত লাশ খাঁড়ির জলে দেখতে পাওয়া যায়। তাছাড়া তুমি এই সূত্রটা আমাকে না জানালে আমিও ওই কেয়াবনের কাটায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে দু-পাটি লেডিস স্যান্ডেল খুঁজে পেতুম না এবং সেখানে একটা কিছু পোঁতা আছে বলে সন্দেহ করতুম না। অতএব জয়ন্ত, চন্দনপুর-অন-সিতে এবারকার রহস্য কাহিনির সূত্র আবিষ্কার আমরা দুজনেই করেছি। কী বলো?
সহাস্যে বললুম, আজ রাতে ক্যাপ্টেন বার্মার খামারে এই কৃতিত্বের কথা আপনি কিন্তু সগৌরবে জানিয়ে দেবেন।
আমরা হোটেল দ্য শার্ক-এর দিকে এগিয়ে চললুম। কাছাকাছি গিয়ে সুভদ্র বর্মন হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে ফিক করে হাসলেন। তারপর বললেন, ওই যাঃ। ড. সুভদ্রা ফাটনবিশের অবস্থাটা জানা গেল না। আমার ধারণা চোরাই মালটার ক্রেতা ছিলেন। তিনিই। তাছাড়া মি. আইয়ারের সঙ্গে আগেই তার বোঝাঁপড়া হয়েছিল, এতে সন্দেহ নেই। জয়ন্ত, বড় ইচ্ছে করছে একবার ভদ্রমহিলাকে দর্শন করতে কিন্তু থাক–
বর্মনদা হঠাৎ থেমে গিয়ে চাপা শ্বাস ছাড়লেন।