রহস্য যখন গভীরে – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
সাহিত্যিক অরিন্দম বসু বললে কারও পক্ষেই চেনা সম্ভব নয়, কিন্তু যে ছদ্মনামে তিনি লেখেন সেই ‘বাজপাখি’র কথা যদি বলি, একবাক্যে সবাই লাফিয়ে উঠবে ওরেব্বাস, দারুণ লেখক।
বাজপাখির নাম এখন ঘরে ঘরে। প্রায় দেড়শোর ওপর তিনি বই লিখেছেন। প্রতিটি বইই তাঁর সাড়া জাগানো। এর মধ্যে রক্তচোষা নিশাচরের তো জবাব নেই, রেকর্ড বিক্রি। বইটি বেরুবার এক মাসের মধ্যেই পাঁচ-পাঁচটি এডিশন খতম, ভাবা যায়! সন্দেহ নেই, বইটি একবার পড়তে শুরু করলে নাওয়া-খাওয়া সব মাথায় ওঠে। বইটির পাতায় পাতায় ভয়ংকর সব উত্তেজনা আর ভয়। যত সাহসীই হও না বাপু, ভয়ে বুক ঢিবঢিব করবেই। একবার নাকি এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল বইটি পড়তে পড়তে। অরিন্দমবাবু তাই পরবর্তী এডিশনের সময় আলাদা একটা ফ্ল্যাপে সাবধান বাণী জুড়ে দিয়েছিলেন বইটির সঙ্গে — সাবধান! সাবধান!! এই বই কখনও রাত্রে পড়িবার চেষ্টা করিবেন না। যদি করেন এবং তার জন্য যদি কোথাও বিপদ ঘটে, লেখককে কোনও ভাবেই দায়ী করা চলিবে না।
অরিন্দমবাবুর কেবল রক্তচোষা নিশাচরই নয়, কালের করাল ছায়া, ভয়ংকরের ডাক, মৃত্যুর হাতছানি ইত্যাদি বইগুলোও যে বাংলা সাহিত্যে দারুণ আলোড়ন তুলেছে সেকথা আর নতুন করে না বললেও চলে। ও সব নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নানারকম আলোচনাও হয়। যোগ্য লেখকের যোগ্য বিচার হওয়াটাই স্বাভাবিক। তা হোক, আমরা সে-সব প্রসঙ্গে যাব না, আমরা আজ ওঁর জীবনের যে ঘটনার কথা বলতে যাচ্ছি, সেটাও কম ভয়ংকর নয়।
তবে আসল ঘটনায় আসার আগে অরিন্দমবাবু ওরফে বাজপাখি লোকটা ব্যক্তিগত জীবনে কেমন তা একটু জেনে নেওয়া দরকার। প্রথমেই বলি অরিন্দমবাবু বাজপাখি ছদ্মনামের আড়ালে যত দুর্ধর্ষ গল্পই লিখুন না কেন, লোকটা কিন্তু এরকম দুর্ধর্ষ নন, বরং বলা যায় ভোলেভালা, অমায়িক সজ্জন। বেশভূষাতেও অতি সাধারণ। এত বড়ো সাহিত্যিক অথচ অহংকারবোধ যদি বল, একদম নেই। কোনও কিছু নিয়ে হইচই একদম পছন্দ করেন না। আলতু-ফালতু দশজনের সঙ্গে মেলামেশার ব্যাপারটাও তিনি সব সময় এড়িয়ে চলতেই ভালোবাসেন। আর সব সময় চেষ্টা করেন একা থাকতে। কিন্তু একা থাকব বললেই তো থাকা যায় না, লেখকদের পেছনে ভক্তের উৎপাত সব সময়ই লেগে থাকে। তাছাড়া মাঝে মধ্যে এদিক-ওদিক সাহিত্যসভা করতেও যেতে হয়। অবশ্য সভায়-টভায় যাওয়ার কথা উঠলে তিনি না না বলে এড়িয়ে যাওয়ারই চেষ্টা করেন, কিন্তু নাছোড়বান্দাদের পাল্লায় পড়লে আর উপায় কী!
তা, একবার এরকমই একটা সাহিত্যসভায় তাঁর ডাক পড়ল। ডাক পড়ল মানে সেএক অদ্ভুত ব্যাপার। পোস্টকার্ডে একটা চিঠি এল। চিঠিটা এরকম :
প্রিয় বাজপাখি,
আগামী শনিবার কুসুমপুর রেল ক্রসিং-এর সংলগ্ন মাঠে একটা সাহিত্যসভার আয়োজন করা হয়েছে। উক্ত সভায় আপনাকে আমরা সভাপতি হিসেবে পেতে চাই। আশা করি আমাদের মনোবাসনা আপনি পূর্ণ করবেন। ইতি
আপনার এক গুণমুগ্ধ ভক্ত।
ভক্তের অবশ্য নাম নেই। তবে চিঠির ওপরে ঠিকানা আর পথ-নির্দেশিকা রয়েছে। গ্রাম ও পোস্টঅফিস কুসুমপুর, বর্ধমান। জি টি রোড ধরে গোপীগঞ্জের বাঁদিকের রাস্তায় এক কিলোমিটারের মতো পথ। চিঠিটার দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন অরিন্দমবাবু। নিশ্চয়ই এ কোনও পাগলের চিঠি। পাগল না হলে বাজপাখির মতো বিশিষ্ট কোনও লেখককে এভাবে কেউ সাহিত্যসভায় যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারে! আশ্চর্য!
ভাবলেন, চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে দেন। কিন্তু পরক্ষণেই আবার কী খেয়াল হল, চিঠিটা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রেখে দিলেন। তারপর এপাশ-ওপাশ খানিকক্ষণ পায়চারি করে আবার গিয়ে লেখার টেবিলে বসলেন। টেবিলের ওপর তাঁর লেখা পান্ডুলিপিগুলি পেপার-ওয়েটে চাপা দেওয়া রয়েছে। নতুন একটা উপন্যাসে সবে উনি হাত দিয়েছেন। কয়েকটা পাতা মাত্র লেখা হয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই তিনি বইটার নামকরণও করে ফেলেছেন, ‘রহস্য যখন গভীরে’। ঘটনাটা যেভাবে উনি সাজাতে চাইছেন, তাতে নামটা যে বেশ জুতসই হবে সন্দেহ নেই। অবশ্য লিখতে লিখতে এ নাম যদি পালটেও যায়, বলার কিছু নেই। লেখকদের লেখার ব্যাপারে এরকম প্রায়ই ঘটে। কেবল নাম কেন, অনেক সময় মূল কাহিনিটাই তো অন্যরকম হয়ে যেতে পারে। ড্রয়ার থেকে আবার চিঠিটা বার করলেন। আবার পড়লেন। তারপর কেমন যেন গোলোকধাঁধায় পড়ে গেলেন।
মনে হল, নির্ঘাত কেউ ওঁর লেখা পান্ডুলিপিটা পড়ে বদমায়েশি করে এই চিঠি লিখেছে। উপন্যাসে উনি পটভূমি হিসেবে কোনও এক কুসুমপুরের কথাই লিখেছেন। এটা কী করে সম্ভব হল! আবার মনে হল, তাই বা কী করে সম্ভব! ওঁর এই লেখার টেবিলে তো কারুর হাত দেওয়ার কথা নয়। কে পড়ল তাহলে!
অরিন্দমবাবু একটু উত্তেজিত হয়ে ভোলাকে ডাকলেন, ভোলা, এই ভোলা, এদিকে আয় তো।
ভোলা তখন রান্নাঘরে। অরিন্দমের জন্য বিকেলের টিফিন তৈরি করছিল।
হারামজাদা তোর চাকরি যদি আমি না খেয়েছি তো কী বললাম!
ভোলা হাত মুছতে মুছতে ঘরে ঢোকে, কেন বাবু?
কেন বাবু মানে, আমার লেখার টেবিলে কে হাত দিয়েছিল?
আজ্ঞে কেউ না তো বাবু। আপনি যখন ঘরে থাকেন না, এ ঘর তো তখন বন্ধ করেই রাখা হয়।
তাহলে এ চিঠি এল কী করে?
চিঠিটা ভোলার সামনে এগিয়ে ধরেন অরিন্দমবাবু। কিন্তু ধরলে কী হবে, ভোলা ক-অক্ষর গোমাংস। লেখাপড়াই যদি শিখবে, তাহলে কী আর এ কাজ করে!
ভোলা করুণ চোখে তাকাল, বিশ্বাস করুন বাবু, এ ঘরে বাইরের লোক কেউ ঢোকেনি। আপনি একবার বারণ করে দিয়েছেন, তারপর থেকে আপনি না থাকলে এ ঘরে আমি কাউকে ঢুকতে দেই না।
অরিন্দমবাবু আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ভোলার দিকে। অনেক দিনকার পুরোনো চাকর। আর তেমনি বিশ্বস্তও। ও যে মিথ্যা কথা বলবে তা-ও মনে হয় না।
গলার স্বর নরম করে বললেন, তার মানে আমার কাগজপত্র কেউ ঘাঁটাঘাঁটি করেনি বলছিস?
ভোলা আবার জোর দিয়ে বলল, বলছি তো বাবু, কেউ ঢোকেনি।
অরিন্দমবাবু বললেন, ঠিক আছে। তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, তুই কুসুমপুর চিনিস?
ভোলা এবার বোকার মতো তাকায়, কোন কুসুমপুর বাবু?
কোন কুসুমপুর মানে, দশটা কুসুমপুর আছে নাকি?
আজ্ঞে হাবড়া ছাড়িয়ে একটা কুসুমপুর আছে। সেখানে আমার শ্বশুরবাড়ি ছিল। বউটাও মরে গেল, ও-বাড়ির পাটও উঠে গেল।
না না, ও কুসুমপুর না। বর্ধমান জেলার ভেতর কোথাও হবে। চিনিস?
ভোলা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল, আজ্ঞে না বাবু। ওখানেও কুসুমপুর আছে নাকি!
না থাকলে তোকে এমনি এমনি জিজ্ঞেস করছি! যা পালা, তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। ভালো কথা, জলখাবার কী করছিস শুনি?
আজ্ঞে নুচি ভাজছি। ফুলকো নুচি আর আলুর দম। তাছাড়া জলভরা সন্দেশও আনিয়ে রেখেছি।
ঠিক আছে, যা তাহলে, তাড়াতাড়ি কর। ভোলা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই আবার পান্ডুলিপির দিকে নজর দিলেন অরিন্দমবাবু। সবেমাত্র কয়েক পাতা লেখা হয়েছে। যা লেখা হয়নি, তা সব মনের মধ্যেই রয়েছে। ঘটনাটাকে ছমছম আধিভৌতিক করে তুলতে হবে। আর তা যদি করতে হয়, তাহলে একটা অপঘাতে মৃত্যুর প্রয়োজন। আর সেটা ভেবেই অরিন্দমবাবু একটা লেভেল ক্রসিং-এর কথা ভেবেছেন। লেভেল ক্রসিং-এ একটা লোক ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যাবে। তাই নিয়ে সাংঘাতিক উত্তেজনা। এরপর শুরু হবে লোকটার প্রেতাত্মার দৌরাত্ম্য। লিখতে লিখতেই সে-সব ব্যাপার এসে যাবে। আর এই বইটাও যে পাঠকমহলে দারুণ সাড়া ফেলবে, সন্দেহ নেই।
মনে মনে বেশ উত্তেজিতই হচ্ছিলেন অরিন্দমবাবু। আর সেইসঙ্গে নিজের সম্পর্কে কেমন যেন স্বপ্ন দেখতেও শুরু করলেন, বাংলা সাহিত্যে তাঁর অমরত্ব এবার কে ঠেকায়!
খানিকক্ষণ ওইভাবেই কেটে গেল। তারপর ডিশে ফুলকো লুচি সাজিয়ে ভোলা এসে ঘরে ঢুকল।
বাবু, চটপট এবার খেয়ে নিন দেখি।
রাখ। অরিন্দমবাবু ফুটবলের মতো একটা লুচি হাতে তুলে নিয়েই আবার উহ উহ করে ডিশে নামিয়ে রাখলেন, কী গরম রে!
ভোলা হাসে, হবে না, এই তো ঘিয়ের কড়াই থেকে নাবালাম। একটু জুড়োক, আলুর দম দিয়ে খান।
তা তো খাব, কিন্তু বুঝলি ভোলা, চিঠি নিয়ে খুব ভাবনায় পড়েছি রে। চিঠিতে কুসুমপুর আর সেই লেভেল ক্রসিং-এর কথা যদি না থাকত, তাহলে কিছু বলার ছিল না।
বাবুর দুশ্চিন্তা লক্ষ করে ভোলার মুখেও দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, কী লিখেছে বাবু চিঠিতে?
তেমন কিছু না। আগামী শনিবার একটা সাহিত্যসভা হবে কুসুমপুরে লেভেল ক্রসিং-এর মাঠে। সেখানে আমাকে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পাঠিয়েছে আর কী!
কে লিখেছে বাবু? নাম কী?
নামই তো নেই। নীচে ইতি দিয়ে লিখেছে আপনার এক গুণমুগ্ধ ভক্ত। আচ্ছা, তুই-ই বল, আমার ভক্তের কী শেষ আছে! মাঝে মাঝে ভক্তের দল এসে অটোগ্রাফের জন্য কেমন ছেঁকে ধরে দেখিস না!
ভোলা কী করে বলবে, চুপ করে থাকে।
আলুর দমে লুচি জড়িয়ে মুখে দেন অরিন্দমবাবু। তারপর একটু ঠাণ্ডা জল গিলে নিয়ে বললেন, মাঝে মাঝে কী মনে হচ্ছে জানিস, যাই না একবার ঘুরে দেখেই আসি, কে আমার ভক্ত আর কী এমন সাহিত্যসভা।
ভোলা একটু অবাক না হয়ে পারে না, সাহিত্যসভায় আপনাকে না নিতে এলে কি আপনার যাওয়া উচিত? আপনার মতো এমন নামজাদা লোক কি হুট করে ওখানে গিয়ে উপস্থিত হতে পারে!
তা যা বলেছিস। নাহ একা একা খুঁজতে খুঁজতে কুসুমপুর যাওয়াটা ঠিক হবে না। ঠিক আছে, যাব না। প্রয়োজন হয় ওরা গাড়ি পাঠাক, তারপর দেখা যাবে। তুই এবার একটু জম্পেশ করে কফি বানা দেখি, খাই।
ভোলা কফি বানাতে চলে গেল। অরিন্দমবাবুও চিঠির কথাটা মাথা থেকে তাড়াবার জন্য আবার তাঁর লেখার কাগজ টেনে নিয়ে বসলেন।
অনেক রাত অবধি জেগে সেদিন প্রায় আরও পনেরো-ষোলো পাতার মতো লিখে ফেললেন। তারপর কাগজপত্র সব টেবিলের ওপর চাপা দিয়ে বিছানায় এসে গড়িয়ে পড়লেন অরিন্দমবাবু। ঘুমিয়েও পড়লেন।
আর ঘুমের মধ্যে গা ছমছম করা একটা স্বপ্ন দেখে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসলেন।
স্বপ্নটা ভারি অদ্ভুত। অরিন্দমবাবু দেখলেন, একটা যেন ফাঁকা মাঠের ভিতর দিয়ে তিনি হাঁটছেন। হাঁটতে হাঁটতে একটা ছোট্ট গ্রাম মতো। বেশ কিছু গাছাপালা। কিছু খড়ের চালঅলা বাড়ি-ঘর, উঠোন। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, পুরো গ্রামটাই কেমন ফাঁকা। কোনও লোকজন তো দূরের কথা, একটা পশুপাখিও চোখে পড়ল না।
হঠাৎ মনে হল যেন রেলগাড়ির শব্দ। কোনও একটা ট্রেন আসছে বোধহয়। শব্দ লক্ষ্য করে গ্রাম ছেড়ে ছুটতে ছুটতে তিনি এগিয়ে চললেন। এগোতে এগোতে ছোট্ট একটা ফাঁকা মাঠ। মাঠ ছাড়াতেই একটা লেভেল ক্রসিং। এমন সময় কার যেন একটা গলা শুনতে পেলেন পিছন থেকে, স্যার, শুনছেন?
কে! চমকে উঠেছিলেন অরিন্দমবাবু। পিছনে তাকিয়ে দেখলেন, রোগা হিলহিলে চেহারার একটা ছোকরা। হ্যাঁ স্যার, আমি। কাজল। কাজল সামন্ত।
অরিন্দমবাবু চিনতে পারলেন না ছেলেটাকে। জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? কী চাই?
আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখবেন স্যার? আমার স্যার খুব ইচ্ছে, আপনার উপন্যাসে আমি একটা চরিত্র হয়ে বেঁচে থাকি।
হেসে উঠলেন অরিন্দমবাবু। তুমি কী তালেবর হে ছোকরা যে তোমাকে নিয়ে লিখতে হবে!
আজ্ঞে স্যার, আমার জীবনের কথা যদি একটু শুনতেন —
বটে, এইটুকু তো বয়স তোমার, কী এমন কথা থাকতে পারে তোমার জীবনের?
আপনি বিশ্বাস করবেন না স্যার, দারুণ একটা ট্র্যাজেডি রয়েছে আমার জীবনে।
অরিন্দমবাবু কেমন হাঁ-করে তাকিয়ে থাকেন ছোকরাটার দিকে।
সত্যি বিশ্বাস করুন স্যার, দারুণ ট্র্যাজেডি। দেখবেন?
ট্রেনটা ততক্ষণে দারুণভাবে শব্দ করতে করতে এগিয়ে এসেছিল। একেবারে লেভেল ক্রসিং-এর কাছে আসতেই কাজল একটা কান্ড করে বসল। ছুটে গিয়েই ট্রেনের তলায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ওর ধড় আর মাথা আলাদা। বীভৎস দৃশ্য, ভাবাই যায় না।
ভয়ে চোখ বুজে ফেললেন অরিন্দমবাবু। এ দৃশ্য দেখাই যায় না। খানিকক্ষণের মধ্যেই লেভেল ক্রসিং ছাড়িয়ে ট্রেনটা বেরিয়ে গেল। অরিন্দমবাবুও চোখ খুললেন। খুলতেই দেখলেন দু-টুকরো হওয়া কাজল কোথায়! রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে অক্ষত কাজলই। মুখে অল্প অল্প হাসি। তারপর হাসতে হাসতেই এগিয়ে আসতে শুরু করল। এ তো এক অকল্পনীয় দৃশ্য! কাজলকে ওভাবে এগিয়ে আসতে দেখেই ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন অরিন্দমবাবু। আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ঘুমও ভেঙে গেল।
ঘুম ভাঙলেও বুকের ভেতর ধড়ফড়ানি চলতেই লাগল। বাকি রাতটা আর ঘুমুতে পারলেন না। বিছানায় বসেই কাটিয়ে দিলেন।
তারপর ভোর হতে না হতেই ভোলাকে ডাকলেন, ভোলা, এই ভোলা। উঠবি না? ওঠ।
ভোলা বেচারা চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানা ছাড়ে, কী হয়েছে বাবু?
কী হয়েছে মানে? কত বেলা অবধি ঘুমুবি শুনি? আজ কী বার মনে আছে?
আজ্ঞে, আজ তো শনিবার।
তাহলে?
কী তাহলে? ভোলা ঠিক বুঝতে পারে না। বোকার মতো তাকিয়ে থাকে।
আজ সেই সাহিত্যসভা না? কুসুমপুরে সাহিত্যসভা হবে বলে চিঠি এসেছে তোকে বললাম না? আচ্ছা ভুলো মন তো তোর।
ভোলা বলল, সেতো বলেছিলেন বাবু। কিন্তু ওখানে আপনি যাবেন নাকি?
হ্যাঁ রে, ব্যাপারটা একটু দেখে আসতে বড়ো ইচ্ছে করছে। যাই না, দেখেই আসি।
আপনি একা যাবেন বাবু? ভোলা যেন অবাক না হয়ে পারে না।
একা ছাড়া আবার দোকা পাব কোথায়! তুই হারাধনকে বলে রাখিস, ও যেন গাড়িটা নিয়ে চারটের মধ্যেই এখানে চলে আসে।
ভোলা অরিন্দমবাবুর আপাদমস্তক একবার চোখ বুলিয়ে নেয়, এ রকম একা একা যে বাবু সাহিত্যসভায় যাবেন, ভোলা যেন তা ভাবতেই পারছে না।
অরিন্দমবাবু তাড়া লাগালেন, হাঁ করে দেখছিস কী! যা, আগে চা-টা কর, তারপর হারাধনকে খবরটা দিয়ে আয়। বলবি, দেরি যেন না করে। অনেক দূর যেতে হবে, একটু খোঁজাখুঁজিরও দরকার আছে। বুঝলি?
ভোলা তাড়া খেয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকে পড়ল। কী জানি, বাবুর রকমসকম ওর কিছুই মাথায় ঢোকে না যেন।
জি টি রোড ধরে গোপীগঞ্জে পৌঁছতে অসুবিধা হল না। হারাধন চৌকস ড্রাইভার, তাছাড়া হাইওয়েতে প্রায়ই ওকে গাড়ি নিয়ে বেরুতে হয়। গোপীগঞ্জের মোড়ে এসে হারাধন বলল, বাবু, এবার কি বাঁদিকে যাব?
একটু জিজ্ঞেস করে নাও না, কুসুমপুরটা মনে হচ্ছে এই রাস্তাতেই হবে।
হারাধন এক চায়ের দোকানিকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে বাঁদিকেই গাড়ির বাঁক নিল।
এগোতে এগোতে শেষ পর্যন্ত চোখে পড়ল একটা লেভেল ক্রসিং। হ্যাঁ এই ক্রসিংটাই হবে।
গাড়ি দাঁড় করালেন অরিন্দমবাবু। ঘড়ি দেখলেন, প্রায় সাতটা বাজে। গাড়ি থেকে নামলেন, তুমি এখানেই একটু দাঁড়াও হারাধন, আমি ক্রসিংটা পেরিয়ে ওপারে এগিয়ে একটু দেখে আসি। তারপর ধীরে ধীরে এগোতে লাগলেন অরিন্দমবাবু। লেভেল ক্রসিংটা পেরুতেই মাইকের শব্দ শুনতে পেলেন। দেখলেন বেশ খানিকটা দূরে একেবারে গ্রামের গায়-গায় একটা সভারই কাজ চলছে।
উত্তেজনায় দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে গেলেন। কে যেন একজন গুরুগম্ভীর গলায় বক্তৃতা ঝাড়ছে। আরও একটু এগিয়ে ডায়াসের দিকে তাকিয়ে অবাক। এটা কি সাহিত্যসভা না শোকসভা! ডায়াসে টেবিলের ওপর ফুলটুল দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে একটা ছবি। এই কি তবে ওর স্বপ্নে দেখা কাজল নাকি!
অরিন্দমবাবু পাশের এক ভদ্রলোককে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছিল দাদা?
ভদ্রলোক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। তাকিয়েই যেন অবাক, আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?
আমাকে! না না, আমাকে আবার কোথায় দেখবেন।
না মশাই, দেখেছি। আচ্ছা আপনিই কি বাজপাখি?
অরিন্দমবাবু বুঝলেন তিনি ধরা পড়ে গেছেন। মৃদু একটু হাসলেন শুধু। ভদ্রলোককে তখন আর পায় কে! স্বয়ং বাজপাখিকে এখানে পাওয়া যাবে, ভাবা যায়! বললেন, একেই বলে ভক্তের টান। ছেলেটা আপনার দারুণ ফ্যান ছিল মশাই। এমনই কপাল ওই লেভেল ক্রসিং-এ পার হতে গিয়ে রেলে কাটা পড়ে জীবনটাই দিয়ে বসল।
ছেলেটার নাম কি কাজল?
হ্যাঁ কাজল। কাজল সামন্ত। আপনি চেনেন ওকে?
না, ঠিক চিনি না। তবে —
ততক্ষণে আরও কয়েকজন এগিয়ে এসেছে। ভদ্রলোক বললেন, আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন, এটা শোভা পায় না। আসুন, আমার সঙ্গে আসুন। অরিন্দমবাবুকে একরকম প্রায় টেনেই ডায়াসে তুলে দিলেন ভদ্রলোক। চারপাশে সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল, বাজপাখি এসেছেন, বাজপাখি। অরিন্দমবাবুকে বক্তৃতাও দিতে হল মঞ্চে। লেখক মানেই বক্তৃতা দেওয়ার ব্যাপারে ওস্তাদ। কাজল সম্পর্কে কিছু না জেনেও তিনি টানা এক ঘণ্টা বক্তৃতা দিলেন। বললেন, তিনি এখন যে উপন্যাস লিখতে শুরু করেছেন, তার নাম ‘রহস্য যখন গভীরে’। এই উপন্যাসের যে প্রধান চরিত্র তাকে সন্ধান করতেই তিনি বেরিয়েছিলেন। খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত তাকে তিনি পেয়েও গেছেন। আচ্ছা আপনাদের কাছেই প্রশ্ন রাখছি, বলুন তো সেকে?
দর্শকদের দিকেই প্রশ্নটা তিনি ছুঁড়ে দিলেন।
কিন্তু দর্শকদের ভেতর থেকে কোনওরকম উত্তর না আসায়, তিনিই উত্তরটা দিয়ে দিলেন। সেহচ্ছে আপনাদের এই কুসুমপুর গ্রামের কাজল।
সঙ্গে সঙ্গে হাততালিতে সরগরম হয়ে উঠল আসর।
অরিন্দমবাবু মাইক ছেড়ে একগুচ্ছ ফুল নিয়ে ছড়িয়ে দিলেন কাজলের ছবির ওপর।
কুসুমপুরের মানুষ দু-চোখ ভরে তাকিয়ে রইলেন বিশ্বজয়ী এক লেখকের দিকে। ধন্য হয়ে গেলেন সবাই।