2 of 2

রহস্য-গল্প প্রতিযোগিতার জন্যে – মীরা বালসুব্রমনিয়ন

রহস্য-গল্প প্রতিযোগিতার জন্যে – মীরা বালসুব্রমনিয়ন

মাননীয় সম্পাদকমশাই, খবরের কাগজে আপনাদের বিজ্ঞাপনটা দেখা অবধি একটা দ্বিধার মধ্যে পড়েছি আমি : এই প্রতিযোগিতায় যোগ দেব কি দেব না? একদিক থেকে দেখতে গেলে, এসব প্রতিযোগিতায় যোগ না দেওয়াই ভালো। যোগ দিলেই হার-জিতের প্রশ্ন আছে। জিততে, এবং তার আনুষঙ্গিক ব্যাপারগুলো—অর্থাৎ, পুরস্কার পাওয়া, খবরের কাগজে ছবি ছাপা হওয়া ইত্যাদি কার না ভালো লাগে এবং আমি যখন একজন মানুষ, তখন আমারও ভালো লাগবে। কিন্তু যদি না জিতি? ধরুন, আপনাদের রহস্য-গল্প প্রতিযোগিতায় যোগ দিলাম এবং ফলাফলের আশায় ধৈর্য ধরে পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যা কিনে গেলাম। তারপর যে-সংখ্যায় ফল বেরোল, তার প্রতিটি পাতা তন্নতন্ন করে খুঁজেও আমার নাম পেলাম না, বরঞ্চ পেলাম রাম-শ্যাম-যদু, এই তিনজন পুরস্কার-প্রাপ্তের নাম। ধরুন, সেই যদু আমার পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে। তাহলে? তখন কি ইচ্ছে হবে না, স্টলের সবগুলো পত্রিকাই উনুনে দিতে? কিংবা সেই যদুকে গিয়ে চ্যালেঞ্জ করতে ‘আপনি তো বেশ, মশাই—আমারই মুখে গল্পটা শুনে, প্লটটা একটু এদিক-ওদিক করে দিব্যি পুরস্কার মেরে দিলেন!’

অবশ্য এমন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। যদুকে আমি কোনও গল্পই বলিনি।

আসলে যদু বলেই কেউ নেই আমার পাশের ফ্ল্যাটে। আর আমার ঝুলিতে যে-গল্পটা আছে, সেটা বার করলে আপনি পুরস্কার না দিয়ে যেতে পারেন না। রহস্য-গল্পের রহস্যটা বেশ জোরদার হলে তবেই না গল্পটা পুরস্কার পাবে! সহজেই সমাধান বাতলে দিতে পারলে, সেটা আর রহস্য থাকে না। গল্পগুলোকে তখন বড্ড পানসে মনে হয়। কিন্তু আমার ঝুলির গল্পটার পানসে হয়ে যাওয়ার ভয় নেই। কারণ, সহজে কেন—আজ পর্যন্ত সে-রহস্যের কোনওই সমাধান হয়নি। বিশ্বাস না হয়, পুলিশ কমিশনারকে জিগ্যেস করে দেখুন।

আজকালকার খবরের কাগজ খুললেই এত খুনখারাপি, বোমাবাজি, গণহত্যা এসবের খবর থাকে যে, সত্যিকারের কোর্টকাছারির খবর খুব কমই নজরে পড়ে। তবুও যাঁরা একটু খুঁটিয়ে কাগজ পড়েন, তাঁরা নিশ্চয় লক্ষ করেছেন, গত এক বছরের মধ্যে কলকাতায় বেশ তিন-চারটে খুন হয়ে গেছে যেগুলোর হত্যাকারীকে আজও ধরা যায়নি। আপনারা হয়তো বলতে পারেন, এই সবগুলো খুনই যে একজন লোকের কাজ, সেটা আমায় কে বলল। ঠিক কথা, এই তিন-চারটে খুনের মধ্যে কোনও যোগসূত্র পুলিশ আবিষ্কার করতে পারেনি। এমনকী, এগুলো যে একজন লোকের কাজ, এমন সন্দেহও লালবাজারের ফাইলে কোথাও উল্লেখ করা নেই। আমাদের পাড়ায় একজন রিটায়ার্ড পুলিশ-ইনস্পেক্টর থাকেন। তাঁর বাড়িতে সন্ধেবেলা দাবার আসর বসে—সেই আসরে যাই আমি। সেই ভদ্রলোকই প্রথমে আমায় বলেছিলেন, ‘মনে হচ্ছে, এগুলো সব একটা লোকের কীর্তি। দেখছেন, চার-চারটে খুনের সবগুলোতেই পুলিশকে কেমন বাঁদর-নাচ নাচানো হচ্ছে, যেন পুলিশকে বোকা বানানোর জন্যেই একের-পর-এক খুন করে যাচ্ছে লোকটা!’

আপনারা যাঁরা রহস্য গল্প-উপন্যাস পড়তে ভালোবাসেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এটা লক্ষ করেছেন যে, সব গল্প-উপন্যাসেই খুনি বেচারি যত ভেবেচিন্তেই খুনটা করুক না কেন, শেষপর্যন্ত পুলিশের হাতে ধরা পড়বেই পড়বে। রহস্য-সাহিত্য নিয়ে নাড়াচাড়া আমি সবসময়ই করি। আমার একমাত্র হবিই হচ্ছে ওটা। আমি তো এটা বিশেষভাবেই লক্ষ করেছি। আপনাদের কী হয় জানি না, আমার কিন্তু প্রায়ই মনে হত, এটা এক ধরনের সামাজিক অবিচার। অন্তত দু-একটা উদাহরণও কেন পাওয়া যাবে না যাতে খুনিরা জিতবে—পুলিশেরা নয়? অবশ্য ভুল বুঝবেন না, খুনিদের পক্ষ নিয়ে আমি কিছু বলছি না। তবে আমার কথা হচ্ছে, পুলিশেরা সবসময় খুনিদের চেয়ে বেশি চালাক হবে, এটা এক ধরনের একদেশদর্শিতা নয় কি?

আসলে অবিচার আমি মোটে সহ্য করতে পারি না। কিন্তু তাই বলে সভা-সমিতি করা আমার ধাতে নেই—’ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বা ‘চলছে চলবে’ করতে গেলে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। আমার মা বলতেন, ছোটবেলা থেকেই নাকি আমি মুখচোরা! দাদারা অবশ্য বলত, আমি মিটমিটে শয়তান—আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়াতে ভালোবাসি। আসলে আমি ওসব কিচ্ছু না, আমিও আপনাদের মতোই চাকরি করি। তফাত এই যে, আপনি হয়তো বিয়ে করে ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার ফেঁদেছেন—আমার ওসব বালাই নেই। জনতা স্টোভে প্রেশার কুকার চাপিয়ে রান্না করে খাচ্ছি। দাদারা অবশ্য চুটিয়ে সংসার করছে। ওদের সঙ্গে ছিলামও কিছুদিন, কিন্তু বউদিদের দাপটে টিকতে পারিনি। আসলে দাদারা বেশ হোমরা-চোমরা হয়েছে জীবনে, আর আমি এক ব্যবসাদারের খাতা লেখার কাজ করছি, এটা বউদিদের প্রেস্টিজে লাগছিল। তা একদিক থেকে ভালোই হয়েছে, বেশ ঝাড়া হাত-পা হয়ে স্বাধীনভাবে আছি—কখন যাই, কখন আসি এসবের জন্যে কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। তবে এটাও ঠিক যে, আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি দাদারা গেলে যেমন সাজ-সাজ রব পড়ে যায়, যেমন খাতির-যত্ন পায় ওরা, আমি তার সিকির সিকিও পাই না। বরঞ্চ আমাকে দেখলেই সবার ভ্রূ কুঁচকে আসে, যেন আমি কোনও কিছু ধার করতে গেছি। বন্ধুরাও কথায়-কথায় আমাকে নস্যাৎ করে ফেলে, যেন, যেহেতু আমি একটা কেউকেটা নই, সেহেতু আমার কথার কোনও মূল্য নেই। হয়তো ওদের কাছে আমারই কোনও মূল্য নেই।

আসলে বন্ধুই আমার বিশেষ নেই। বড়বাজারে যে-ব্যবসাদারের খাতা লিখি, তার ম্যানেজার হচ্ছেন শান্তশীল দাস। ওই শান্তশীলবাবুর সঙ্গেই দু-চারটে সুখ-দুঃখের কথা হয় আমার—রিটায়ার্ড পুলিশ ইনস্পেক্টরটির দাবার আসরের কথা বাদ দিলে। শান্তশীলবাবুও আমার মতো ডিটেকটিভ বই পড়তে ভালোবাসেন। নানা রহস্য-বই নিয়ে আলোচনা করি আমরা। উনি ব্যাচেলার না হলেও সংসারের ঝামেলা নেই বেশি—দুটো মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, এখন শুধু স্বামী-স্ত্রী। নামে ম্যানেজার হলেও ওঁর মাইনেটা এমন কিছু আহামরি নয়। তাই অবসর সময়টুকু লাইব্রেরির বই পড়েই কাটিয়ে দেন, সিনেমা-থিয়েটার বা অন্য কোনও নেশার পাট নেই—টিভিও কেনেননি। এই শান্তশীলবাবুই একদিন কথায়-কথায় বলেছিলেন যে, পুলিশেরা যে অত চট করে খুনিদের ধরে ফেলে, তার কারণ খুনের উদ্দেশ্য—রহস্য গল্পে যাকে মোটিভ বলা হয়, সেটা সবসময়ই বড্ড স্পষ্ট। মোটিভ না জানা গেলে খুনি ধরা পুলিশের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হত।

তারপর থেকে আমার মনে হয়েছে, আচ্ছা, যদি এমন একটা খুন হয়, যার কোনও মোটিভ নেই—না, ভুল বললাম, যার একমাত্র মোটিভ হচ্ছে পুলিশকে ধোঁকা দেওয়া, তাহলে কেমন হয়? মনে হল, খুঁজলে কোর্টকাছারির বিবরণে এমন একটা খুনের দেখা নিশ্চয়ই পাব। কিন্তু না, তা পাইনি। তারপর আমি সেই রিটায়ার্ড পুলিশ ইনস্পেক্টরকে নিয়ে পড়েছিলাম, যদি ওঁর ঝুলিতে অমন কোনও খুনের গল্প থাকে। কিন্তু উনি বলেছিলেন, ‘তা কী করে হয়, মশাই! কোনও মোটিভ না থাকলে শুধু-শুধু একটা লোক খুন করতে যাবে কেন, নেহাত পাগল-ছাগল না হলে?’

আশ্চর্য, পুলিশকে ধোঁকা দেওয়াটাকে উনি একটা মোটিভের মধ্যেই গণ্য করেন না। অর্থাৎ, উনিও সেই দলে, যারা চিরকাল বিশ্বাস করে এসেছে যে, খুনির কাজ হচ্ছে খুন করা, আর পুলিশের কাজ তাকে ধরা—এবং পুলিশ তাকে ধরবেই ধরবে। এই ধরনের একগুঁয়ে ধারণা দেখলে, আমার বড্ড রাগ হয়। ইচ্ছে হয়, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিই মোটিভবিহীন খুন করা যায় কি না এবং এ ধরনের খুনের কথা যারা বলে তারা সবাই পাগল-ছাগল নয়।

কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, মোটিভবিহীন খুনের মতো শক্ত কাজ আর কিছু নেই। প্রথমত, এমন একজনকে ঠিক করতে হবে, যার সঙ্গে তোমার কোনও পরিচয় নেই, কোনও যোগসূত্র নেই, যার মৃত্যুতে তুমি বিন্দুমাত্র লাভবান হবে না। এমন একজনকে খুঁজে পেতে আমার খুব বেগ পেতে হয়েছিল। আর তেমন লোককে খালি খুঁজে পেলেই তো হবে না, খুনের সুযোগটিও তো করে নিতে হবে। অনেকদিন অপেক্ষার পর আমি তেমন লোক আর সুযোগ পেয়েছিলাম। ভোরে লেকে বেড়াতে আসতেন বেচারি বুড়ো ভদ্রলোক—সুইমিং ক্লাবের ওদিকটায় একটা বেঞ্চিতে বসে কী একটা বই পড়তেন। ময়লা ধুতি-পাঞ্জাবি, ক্যানভাসের জুতো আর রোগা-রোগা হাত-পা দেখে বেশ বোঝা গেল, ভদ্রলোক স্বচ্ছলতার মধ্যে নেই। একটু বেলায় ওঁর এক বন্ধু আসতেন। তখন দুই বন্ধুতে বসে সুখ-দুঃখের গল্প করতেন। একটু দূরে ঘাসের ওপর বসে কান-খাড়া করে সেসব শুনতাম আমি। ভদ্রলোক সরকারি চাকরি করতেন না—পেনশন নেই—তাই ছেলেদের সংসারে সমাদর নেই—ছেলের বউয়েরা ভ্রূকুটি করেই আছে। সামান্য আফিমের নেশা আছে, কিন্তু দুধের ছিটে-ফোঁটা পাওয়ার জো নেই। ভদ্রলোক প্রায় বলতেন, ‘যমেও দ্যাখে না আমায়—।’ এক-একবার ইচ্ছে হত উঠে গিয়ে বলি, ‘এবার আপনার ইচ্ছা পূর্ণ হবে—।’

কিন্তু মজা এই যে, সে-কথা শুনলে ভদ্রলোক হয়তো আঁকুপাঁকু করে বলে উঠতেন, ‘ওটা কথার কথা।’ ছেলেবেলায় একটা গান শুনেছিলাম, ‘আমার কিন্তু মোটেই মরতে ইচ্ছে নেইকো ভাই—।’ ওই বুড়ো ভদ্রলোকের মনোভাবও ঠিক তাই হত সন্দেহ নেই।

কাজেই একদিন ভোরে লেকে বেড়াতে এসে যখন ভদ্রলোকের ইচ্ছেটা হঠাৎ পূর্ণ হয়ে গেল, তখন বেচারি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলেন সন্দেহ নেই। খবরের কাগজে খুনের যে-বিবরণ বেরিয়েছে, সেটা পড়েছেন কি না জানি না। যদি পড়ে থাকেন তো জানবেন, ভদ্রলোকের পকেটে আধছেঁড়া মানিব্যাগের খুচরা পয়সাগুলো যেমনকার তেমনি ছিল, একটু এদিক-ওদিক হয়নি। খুনের অস্ত্র—ধারালো ছোরাখানা—কাছেই পড়ে ছিল, কিন্তু তার বাঁটখানা রুমালে মুছে পরিষ্কার করা। কোনও আঙুলের ছাপ নেই তাতে। আর ছোরাখানাও এমন সাধারণ যে, সব দোকানেই অমন ডজনখানেক ছোরা পাওয়া যাবে। কোন দোকানি কাকে অমন ছোরা বিক্রি করল, সেটা বার করা প্রায় অসাধ্য।

অর্থাৎ, অকুস্থলে যেসব সূত্র পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলি থেকে খুনিকে বার করা অসম্ভব। পুলিশ সবচেয়ে ধাক্কা খেয়েছিল মোটিভের বেলায়। কেন ভদ্রলোক খুন হলেন? ওঁকে খুন করায় কার স্বার্থসিদ্ধি হল? এসব প্রশ্নের উত্তর পুলিশ খুঁজে পেল না। বুড়োর ছেলে-বউয়েরা ওকে বোঝা মনে করত হয়তো, কিন্তু বোঝা নামাবার জন্যে ওরা অদ্দূর যাবে, এটা কেউ বিশ্বাস করতে রাজি হলেন না। তা ছাড়া সাক্ষীদের জিগ্যেস করে এটা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হল যে, খুনের সময়টায় বুড়োর ছেলে-বউয়েরা সবাই বাড়িতেই ছিল। শেষপর্যন্ত খুনটার কোনওই হদিশ করতে পারল না পুলিশ। অবশ্য আপনারাও নিশ্চয় এতক্ষণে সেটা বুঝতে পেরেছেন। সেই রিটায়ার্ড পুলিশ ইনস্পেক্টরকে এই খুনটার উদাহরণ দেওয়াতে উনি আমায় এককথায় নস্যাৎ করে দিয়ে বললেন, ‘আরে, মোটিভ ছাড়া খুন হবে কেন? আর পুলিশ আজ খুনি ধরতে পারল না বলে কোনওদিন পারবে না, এমন কোনও কথা আছে নাকি! দেখবেন, পুলিশ ঠিক খুনিকে ধরে ফেলবে।’

মাসখানেকের মধ্যেও যখন খুনি ধরা পড়ল না, তখন আমি কথাটা আবার মিস্টার চন্দের (সেই রিটায়ার্ড পুলিশ ইনস্পেক্টরের) কাছে তুলেছিলাম। উনি কিন্তু কথাটা শেষ করতেই দিলেন না আমাকে : ‘আরে রাখুন, মশাই। এতবড় শহরে কোথায় একটা খুন হয়েছে, তার খুনি একমাস পর ধরা পড়ল—এটা একটা খবর হল নাকি যে, কাগজে বেরোবে?’

‘কিন্তু এটাও তো হতে পারে যে, খুনি ধরা পড়েনি?’

‘কী করে জানলেন আপনি? লালবাজারে খোঁজ করেছেন কি?’ নাকে একটিপ নস্যি গুঁজে মিস্টার চন্দ দাবার বোর্ডটা নামিয়ে বললেন, ‘ছাড়ুন ওসব আজেবাজে চিন্তা। আসুন, একহাত খেলে নিই—।’

মিস্টার চন্দকে অবশ্য বলতে পারতাম যে, খুনি যে ধরা পড়েনি, এটা আমার চেয়ে কেউ ভালো জানে না। কিন্তু চুপ করে গেলাম, কেননা, আমার মতো সাধারণ লোকের মতামতকে কেয়ার করবার লোক মিস্টার চন্দ নন। মনে হল, আরও দু-একটা উদাহরণ না দেখলে সত্যকে স্বীকার করবেন না উনি।

এর পরের খুনটা হয়েছিল—না, দক্ষিণে নয়—উত্তর কলকাতায়। কলেজ স্ট্রিট, হ্যারিসন রোডের মোড়টা দেখেছেন তো? ওইখানেই ছোট্ট একটা বইয়ের দোকান আছে। স্কুলের বই, আর কিছু বটতলা মার্কা গল্প-উপন্যাস। এ ছাড়া ছিল খাতা, পেনসিল, রবার—আজকালকার বাচ্চারা যাকে ইরেজার বলে থাকে। দোকানে থাকত বেশ বুড়ো একজন লোক। আশপাশের দোকানে জিগ্যেস করে জেনেছিলাম, দোকানটা ওর ভাগ্নের। দু-চারদিন সেই দোকানে এসে কিছু খাতা-পেনসিল ও গোটা দুই উপন্যাস কিনেছিলাম। লক্ষ করেছিলাম যে, বুড়োর সাহায্যকারী কেউ নেই। বুড়োর শরীরটাও ভালো মনে হচ্ছিল না। যখনই দেখেছি, খকখক করে কাশছে। তা ছাড়া মুখখানাও ছিল আমসি। দেখেই বোঝা যেত অম্বলের ব্যারামও আছে।

এহেন বুড়ো যে বেঁচে থেকে কারও কোনই উপকারে আসছিল না, এটা বলাই বাহুল্য। অবশ্য বলতে পারেন যে, বেঁচে থেকে ও নিজের উপকারে তো আসছিল! যদিও কবি বলে গেছেন, ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’ আসলে প্রত্যেকে আমরা নিজের তরে বই তো নয়! সেদিক থেকে দেখতে গেলে বুড়োর মৃত্যুটা ওর নিজের কাছে অপূরণীয় ক্ষতি নিশ্চয়ই। আবার দেখুন, কবি তো এ-ও বলে গেছেন, ‘জন্মিলে মরিতে হবে—অমর কে কোথা কবে?’ মরতে তো বুড়োটাকে হতই। আজ নয় তো কাল। সেই মরতেই যখন হবে, তখন দু-দিন আগে মরে গিয়ে যদি একটা সামাজিক অবিচারের মুখোশ খুলে দিতে পারা যায়, তাহলে ক্ষতি কী? আপশোস এই যে, বুড়োটা জেনে গেল না যে, ও আসলে মারা গেল না—শহিদ হল। ভবিষ্যতে ইতিহাসে ওর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

অবশ্য এই বুড়োর মৃত্যুটাকে স্রেফ ভবিতব্যও বলতে পারেন—নয়তো সেদিনই লোডশেডিংয়ে সারা পাড়াটা অন্ধকার হয়ে থাকবে কেন, আর ঘণ্টাখানেক পর আশেপাশের দোকানগুলোই বা ঝাঁপ ফেলে দেবে কেন? অথচ বুড়োটাই বা একপাশের দরজাটা বন্ধ করেও খদ্দেরের আশায় অন্য দরজাটা খুলে মোম জ্বালিয়ে অপেক্ষা করবে কেন? আর খদ্দেররূপী শমন এলে বই দেখাবার জন্যে তাকে নিয়েই বা বন্ধ দরজাটার ওদিকে ঢুকবে কেন?

আসলে যার ভাগ্যে যা আছে তা হবেই। আপনি-আমি কেউ তাকে ঠেকাতে পারব না। সে যাক—আশা করেছিলাম এই খুনটার বিস্তারিত বিবরণ কাগজে বেরোবে, তাহলে মিস্টার চন্দের সঙ্গে আলোচনা করা যাবে। কিন্তু খবরের কাগজে ব্যাপারটা খুব সংক্ষিপ্ত আকারেই বেরোল। সেদিন সন্ধেবেলা যখন মিস্টার চন্দের ওখানে গেলাম, তখন আশা করেছিলাম, উনিই খুনের প্রসঙ্গটা তুলবেন। কিন্তু উনি খেলাতেই মত্ত রইলেন, খুনের প্রসঙ্গের ধার দিয়েও গেলেন না। অগত্যা কিছুক্ষণ উসখুস করে আমাকেই বলতে হল, ‘আজকের খবরের কাগজটা দেখেছেন?’

‘হুঁ!’

‘কলেজ স্ট্রিটের কাছে আর-একজন খুন হয়েছে। ভেরি স্যাড। আচ্ছা, মোটিভটা কী বলে আপনার মনে হয়?’

মিস্টার চন্দ ভুরু কুঁচকে দু-এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘খুনটা যখন আমি করিনি, বা খুনি ধরার দায়িত্বটাও যখন আমার নয়, তখন মোটিভ নিয়ে আমি মাথা ঘামাব কেন?’

‘না, এই একটু আলোচনা করা যেত আর কী—।’

‘লাভ কী? আর আপনার এসব ব্যাপারে এত ইন্টারেস্ট কেন?’

মিস্টার চন্দ কি পুলিশি জেরা শুরু করবেন নাকি? বললাম, ‘লাভালাভের প্রশ্ন তুলছেন কেন? নেহাত সময় কাটানোর জন্যেই জিগ্যেস করা। ধরুন, এই খুনিটাও যদি ধরা না পড়ে—।’

‘পড়বে—পড়বে—’ নিশ্চিন্ত সুরে বললেন মিস্টার চন্দ, ‘খুনিরা কখনও ধরা না পড়ে যায়!’

অর্থাৎ, উনি তখনও ‘পুলিশেরা জিতবেই’, এই মনোভাব ছাড়তে রাজি নন।

এরপর ওই খুনের ব্যাপারটা নিয়ে শান্তশীলবাবুর সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম যে, গল্পের খুনখারাপিতে ওঁর যতই ইন্টারেস্ট থাকুক, বাস্তবের খুনখারাপিতে একদম নেই।

‘সত্যিকারের খুন-টুনগুলোতে একদম রহস্য নেই, বুঝলেন?’ বলেন উনি।

ভেবেছিলাম দু-দুটো কিনারা-না-হওয়া খুনের মামলা নিয়ে পুলিশ বেশ নাজেহাল হবে…খবরের কাগজের সম্পাদকীয়তে পুলিশ বিভাগের অকর্মণ্যতার বিষয় নিয়ে জোরদার লেখা বেরোবে…ট্রামে-বাসে আলোচনা হবে খুনগুলো নিয়ে। আর সেইসব আলোচনা শুনে সবার অলক্ষ্যেই আমার বুকটা ফুলে উঠবে—কারণ, নিজের কৃতিত্বের কথা শুনতে কার না ভালো লাগে!

কিন্তু আশ্চর্য হলাম এই দেখে যে, ট্রাম-বাসে আলোচনা তো দূরের কথা, খবরের কাগজেও খুনদুটো নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য হল না। এই যে দু-দুটো মানুষ মারা গেল, হোক বুড়ো তাতে কী, এতে কারওরই যেন কিছু যায়-আসে না। অর্থাৎ, জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকলেও মানুষের দাম অনেক সস্তা হয়ে গেছে। দু-একজন এদিক-ওদিক হলে কারওরই মাথা-ব্যথা নেই।

কিন্তু সামাজিক অবিচার বন্ধ করার জন্যে শহিদ হওয়া তো নিরর্থক হবে—যদি আত্মত্যাগটা লোকের নজরেই না পড়ে। আর সেই নজরে পড়ার আশায়ই যদি আরও দুটো খুন হয়ে যায়, তাহলে কি আপনি খুনিকে খুব একটা দোষ দিতে পারেন? লেকের ধার আর কলেজ স্ট্রিটের পর যদি খিদিরপুর ব্রিজের পাশে বসে ভিক্ষে করা এক-পা কাটা বুড়ো ভিখিরিটা খুন হয়, আর এ-ক্ষেত্রেও যদি বাঁটটা পরিষ্কার করে মোছা ধারালো ছোরাখানা পাশে পাওয়া যায়, অথচ পুলিশ খুনের মোটিভ বার করতে হিমশিম খেয়ে যায়, তবে কি খুব অবাক হবেন? এবং তারপর যদি খোদ ভবানীপুরের এক এঁদো গলিতে এক শীতের রাতে রিকশায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা এক রিকশাওলা খুন হয়ে যায়, তাহলেও কি আপনার মনে হবে না, এ ছাড়া কী-ই বা করতে পারত বেচারি খুনি?

যদিও খবরের কাগজে এবারও কোনও হইচই হয় না খুনগুলি নিয়ে, তবু এবার যেন মিস্টার চন্দের টনক নড়ে। তখনই উনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে, এগুলো একটা লোকেরই কীর্তি। দেখছেন, চার-চারটে খুনের সবগুলোতেই পুলিশকে কেমন বাঁদর-নাচ নাচানো হচ্ছে! যেন পুলিশকে বোকা বানাবার জন্যেই একের পর এক খুন করে যাচ্ছে লোকটা।’

একটু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বলি, ‘আমি তো আগেই বলেছিলাম সে-কথা…আপনি তো আমার কথাকে পাত্তাই দিতে চাইলেন না। মনে আছে, সেই প্রথম খুনটার বেলায়ই—।’

‘বলেছিলেন নাকি?’ মিঃ চন্দ একটু ভালো করে আমার দিকে তাকালেন এবার : ‘আপনার দূরদৃষ্টি আছে বলতে হবে। অবশ্য মোটিভটা যে কী এখনও তা ঠিক বুঝতে

পারছি না—।’

‘সেকি, এক্ষুনিই তো বললেন যে, পুলিশকে ধোঁকা দেওয়ার জন্যেই—।’

‘আরে, সেটা তো একটা কথার কথা। শুধু পুলিশকে বোকা বানাবার জন্যে খুন করে নাকি কেউ, নেহাত পাগল-ছাগল না হলে?’

আমার রাগ চড়ে গেল। যেন মিস্টার চন্দের সঙ্গে যাদের মত মিলবে না, তারা সবাই পাগল-ছাগল। বললাম, ‘বেশ তো, আপনিই বার করুন না মোটিভটা—।’

দাবার ছকটা পেড়ে টেবিলে রাখলেন মিস্টার চন্দ। তারপর বললেন, ‘আমার কী দায় পড়েছে—।’

কিন্তু আমার জেদ চেপে গিয়েছিল। বললাম, ‘কথাটা যখন উঠেছে, তখন ফয়সালা হয়ে যাওয়া ভালো। এই যে চার-চারজন লোক খুন হল, এদের কি এমন কোনও শত্রু আছে যে এদের খুন করতে চাইবে?’

‘খবরের কাগজে যা পড়েছি আর সাধারণ বুদ্ধিতে যা মনে হয়, তাতে নিশ্চয়ই বলব, না—।’

‘তাহলেই দেখুন, ব্যক্তিগত শত্রুতার মোটিভটা খাটছে না। তা ছাড়া চারটে খুনই যদি একজন লোকই করে থাকে, তাহলে তার চার-চারজন পরম শত্রু কলকাতার চার কোণে ছড়ানো থাকবে—এটাও কি বিশ্বাস করতে বলেন?’

‘নিশ্চয়ই না—।’

‘তাহলে বাকি থাকল টাকা-পয়সার ব্যাপারটা। লেকের ধারের সেই বুড়োর টাকা-পয়সা খোওয়া যায়নি—কলেজ স্ট্রিটের দোকানের ক্যাশও একটুও এদিক-ওদিক হয়নি। ভিখিরিটার কাছে তো বোধহয় ছিলই মাত্র কয়েকটা পয়সা। আর রিকশাওলাটার কোমরে বাঁধা পুঁটুলিটায় যে ন’টাকা পঞ্চাশ পয়সা ছিল, তাও তো খোয়া যায়নি। যদি বলেন যে, খুনির হয়তো ইচ্ছে ছিল ন’টাকা পঞ্চাশ পয়সা নিয়েই যাবে, কিন্তু হয়তো কোনও বাধা পড়ায় ওটা না নিয়েই পালিয়েছে, তাহলে বলব যে, ন’টাকা পঞ্চাশ পয়সার জন্যে কি কেউ—?’

হঠাৎ লক্ষ করলাম, মিস্টার চন্দ আমার দিকে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমায় থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ন’টাকা পঞ্চাশ পয়সার কথা আপনি জানলেন কী করে? ওটা তো কাগজে ওঠেনি?’

এতক্ষণে হুঁশ হল, বলতে-বলতে অনেক কিছুই বলে ফেলেছি। এবার মুখে কুলুপ আঁটতে হবে। আমতা-আমতা করে বললাম, ‘না, ঠিক জানি না, শুনেছিলাম কার কাছে যেন। অবশ্য ওটা স্রেফ অনুমানও হতে পারে।’

‘না, ওটা অনুমান নয়—’ বললেন মিস্টার চন্দ, ‘রিকশাওলাটার কাছে ন’ টাকা পঞ্চাশ পয়সাই ছিল। আর ছিলও গামছার পুঁটুলিতে কোমরে বাঁধা। ভবানীপুর থানার ও. সি.-র সঙ্গে বাজারে দেখা হয়েছিল। ওঁর কাছেই শুনেছি। উনি তো বলেছিলেন কথাটা গোপন আছে। আপনি যে কী করে জানলেন—।’

একটা চেষ্টাকৃত হাই তুলে বললাম, ‘যাকগে ওসব কথা। আসুন, খেলা শুরু করা যাক—।’

কিন্তু সেদিন খেলাটা ঠিক জমল না। মিস্টার চন্দ বারেবারেই কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতে লাগলেন। চলে আসব, এমন সময় উনি জিগ্যেস করলেন, ‘গত সোমবার আপনি আমার এখানে এসেছিলেন, না?’

একটা বিপদসূচক ঘণ্টা শুনতে পেলাম যেন মাথার মধ্যে। গত সোমবারই ভবানীপুরের রিকশাওলাটা খুন হয়েছিল। ভাবলাম বলি, ‘এসেছিলামই তো। বসে দু-দুটো গেম খেললাম, মনে নেই?’—তারপর ভাবলাম, অতটা করার দরকার নেই। কে জানে, সেদিন মিস্টার চন্দের ওখানে অন্য কেউ এসেছিল কি না, যে বলতে পারবে, ‘কই, আপনি তো আসেননি সেদিন!’

তবে মিস্টার চন্দের প্রশ্নে ঘাবড়াবারও কিছু নেই। গলাটা যদ্দূর সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললাম, ‘না, সেদিন আসিনি তো! শান্তশীলবাবুর ওখানে গিয়েছিলাম বোধহয়। নাকি দাদাদের ওখানে? ঠিক মনে পড়ছে না।’

এরপর কয়েক দিন মিস্টার চন্দের ওখানে গেলাম না। ওঁর ভেতরের যে-পুলিশি সত্তাটা জেগে উঠছিল সেটাকে ঘুমোতে দেওয়া দরকার। তবে সন্ধেবেলা একা বাড়ি বসে থাকতেও ভালো লাগছিল না। তাই একদিন গেলাম শান্তশীলবাবুর ওখানে। শুনলাম, এর মধ্যে মিস্টার চন্দ এসেছিলেন ওখানে। সেই সোমবার আমি শান্তশীলবাবুর কাছে গিয়েছিলাম কি না সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।

‘কী ব্যাপার বলুন তো?’ শান্তশীলবাবু জিগ্যেস করলেন।

‘কী করে জানব বলুন, কার মনে কী আছে। তা আপনি কী বললেন?’

‘কী আর বলব! আপনি তো সেদিন আসেননি এখানে। সে-কথাটাই বলেছি। কেন, এ-কথা বলে অন্যায় করেছি নাকি?’

‘না, না, অন্যায় করবেন কেন? সত্যি কথা বলায় দোষটা কী!’

খানিকটা ইতস্তত করে এর পরদিন দাদাদের ওখানে গেলাম। যা ভেবেছিলাম তাই। মিস্টার চন্দ সেখানেও খোঁজ করতে গিয়েছিলেন। বড়দা বিরক্ত মুখে বললেন, ‘পুলিশ অফিসার-টফিসার তোমার খোঁজে আসে কেন? অফিসে কোনও গন্ডগোল করেছ নাকি?’

মনে হল, বড়দার ধারণা আমি হয়তো অফিসের ক্যাশ ভেঙেছি। গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘মিস্টার চন্দ তো রিটায়ার করেছেন। আর এটা একটা প্রাইভেট ব্যাপার। একটা বাজি ধরেছিলাম—সেই সূত্রেই এসেছিলেন উনি।’

বড়দা সন্তুষ্ট হলেন কি না বুঝতে পারলাম না, তবে আমার চিন্তাটা যে বাড়ল, তাতে সন্দেহ নেই। কারণ মিস্টার চন্দ সন্তুষ্ট হয়েছেন কি না জানতে হবে। তাই এর পরদিন ফের গেলাম ওঁর ওখানে। উনি মুখে কিছু বললেন না। যথারীতি দাবার বোর্ডটা নামালেন এবং বাড়ির ভেতর থেকে যথারীতি দু-পেয়ালা চা-ও এল। তবু খেলার চালের ফাঁকে-ফাঁকে উনি কেমন যেন অদ্ভুতভাবে তাকালেন বারকয়েক। তারপর বললেন, ‘শান্তশীলবাবু আর আপনার দাদার কাছে গিয়েছিলাম। যে সোমবার রিকশাওলাটা খুন হয়, সেদিন আপনি দু-জায়গার কোথাও যাননি।’

একটা হাই তোলার চেষ্টা করে বললাম, ‘বলেইছি তো, ঠিক মনে পড়ছে না। হয়তো অন্য কোথাও গিয়ে থাকব।’

মিস্টার চন্দ আর কিছু বললেন না। কিন্তু খেলার শেষে বাড়ি আসব, তখন হঠাৎ বলে বসলেন, ‘কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানের খুনটা ঠিক কবে হয়েছিল, মনে আছে আপনার?’

‘জানিই না তারিখটা। মনে রাখার প্রশ্ন ওঠে কী করে—।’

‘থানার ও. সি.-র কাছে গেলে অবশ্য জানা যাবে—।’

ওঁকে আর বেশি কিছু বলার অবসর না দিয়ে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু বুঝতে পারলাম, মিস্টার চন্দ অতি সহজেই তারিখটা জেনে ফেলবেন এবং তারপরই জেরা শুরু করবেন, ‘অমুক তারিখে এতটার সময় আপনি আমার এখানে এসেছিলেন কি? আসেননি? তবে কোথায় গিয়েছিলেন?’

মনে হল, পুলিশ অফিসারদের পুলিশি সত্তা রিটায়ার করলেও মরে না, বরঞ্চ সুযোগ পেলেই মাথা-চাড়া দিয়ে ওঠে। মিস্টার চন্দেরও তাই হয়েছে। যে-খুনের কিনারা করতে রেগুলার পুলিশি ডিপার্টমেন্ট হিমশিম খাচ্ছে, সেই খুনের রহস্য ভেদ করার প্রলোভন ত্যাগ করতে পারা রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসারের পক্ষে খুব সহজ নয়।

একটা অস্বস্তি নিয়ে শুতে গেলাম সে-রাত্রে। আর হয়তো সেজন্যেই মাঝরাতে স্বপ্ন দেখলাম একটা। যেন একটা মাকড়সার জালে আটকে পড়েছি আমি—বেরোবার চেষ্টা যতই করছি, ততই আরও আটকে যাচ্ছি। জালের একধারে মাকড়সাটা একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে আছে। আস্তে-আস্তে মাকড়সার মুখটা যেন মিস্টার চন্দের মতো হয়ে গেল। ঘুম ভেঙে গেলে বুঝলাম, ওটা স্বপ্ন—সত্যি নয়—তবু অস্বস্তিটা গেল না। চোখ বুজলেই মাকড়সারূপী মিস্টার চন্দের মুখটা আমায় তাড়া করে বেড়াতে লাগল।

ভোর হয়ে গেলে দিনের আলো দেখে মনের আত্মবিশ্বাস অনেকটা ফিরে পেলাম। যেখানে রেগুলার পুলিশই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে, সেখানে মিস্টার চন্দ আর কতটুকু করতে পারেন! আর যাই করুন না কেন, প্রমাণই বা কোথায়? তবু সাবধানের মার নেই। মনে হল, কিছুদিনের জন্যে এখানকার পাততাড়ি গোটানোই ভালো। অবশ্য আমার পাততাড়ি গোটাতে তো আর খুব একটা ঝামেলা নেই! বাক্সখানা গুছিয়ে নিয়ে ঘরে একটা তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়লেই হল। যেখানে চাকরি করি, সেখানে একটা খবর দিতে হবে অবশ্যই। বললেই হবে, স্বপ্নে হঠাৎ প্রত্যাদেশ পেয়ে তীর্থভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছি। তারপর কে কার পাত্তা রাখে।

কিন্তু তা যদি করি, তাহলে তো আমার এতদিনের পরিশ্রম মাঠে মারা যায়। খুনিদের প্রতি সামাজিক অবিচারেরও কোনও প্রতিকার হয় না। কী করি ভাবছিলাম, এমনসময়েই কাগজে আপনাদের রহস্য-গল্প প্রতিযোগিতার বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ল। তাই ভাবছি, এই রহস্য গল্পটা যদি আপনাদের প্রতিযোগিতার জন্যে পাঠিয়ে দিই, তাহলে এক ঢিলে দু-পাখি মারা হয়ে যায়। খুনিদের প্রতি সামাজিক অবিচারের কথাটাও সবাই জানতে পারে, অথচ আমি ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকি। মিস্টার চন্দ হাজারটা প্রশ্ন করলেও উত্তর দিতে পারি, ‘কী যে বলেন মশাই, গল্প আবার কখনও সত্যি হয় নাকি!’

তাই ভাবছি, প্লটটা একটু এদিক-ওদিক করে, পাত্রপাত্রীদের নাম-ধাম বদলে পাঠিয়ে দেব আপনাদের অফিসে। তারপর ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ব তীর্থভ্রমণে। গল্পটাকে আপনারা পুরস্কার দেবেন কি না, সেটা তখন আপনারাই বিবেচনা করবেন।

মাসিক রোমাঞ্চ

জানুয়ারি, ১৯৮৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *