রহস্যময় বাড়ি
কুচবিহার ও ভুটানের মাঝখানে জয়ন্তী পাহাড়। খবর পেলুম তারই কাছাকাছি অরণ্য প্রদেশে বেড়াতে এসেছেন হিমালয়ের পারাবতরা। এ হচ্ছে একরকম বড়ো জাতের পায়রা, পাখি শিকারিদের কাছে বিশেষ লোভনীয়।
পাখি মারা বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম, বিপিনের সঙ্গে। বিপিন বন্দুক ছুড়তে জানে না, কিন্তু শিকারের উত্তেজনা উপভোগ করতে ভালোবাসে। তাকেও দিলুম একটি রাইফেল বহন করবার ভার, কারণ যেখানে যাচ্ছি, সে জায়গাটা নিরাপদ নয়। দৈবগতিকে যদি কোনো বড়ো জাতের বদমেজাজি চতুষ্পদ জীবের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তাহলে পাখি মারা ছররার বদলে দরকার হবে বাঘ মারা বুলেট।
ছোটো-বড়ো মাঠ, ছোটো-বড়ো গাছ, ছোটো-বড়ো বন। দূরে যেন নীলাকাশের সঙ্গে মৌন ভাষায় আলাপ করছে জয়ন্তী শৈলশিখর। পরিপূর্ণ সূর্যকর ঝলমল ঝলমল করছে সবুজে ছাওয়া নিসর্গ। মানুষের চিৎকার নেই, আছে কেবল গীতকারী পাখিদের সাড়া। আর শোনো যায় থেকে থেকে একটি ছোটো নদীর মৃদু কলধ্বনি। তার স্থানীয় নাম কি জানি না, কিন্তু এ মুল্লুকের সীমানা ছাড়িয়ে বৃহত্তর হয়ে সে নাম পেয়েছে লসকাস নদী!
দুপুর গেল, বৈকালও যায় যায়, বনে বনে ঘুরে ক্রমেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। ঘুঘু দেখেছি, বক দেখেছি, শকুন-চিল দেখেছি, কিন্তু একটিমাত্রও হিমালয়ের পরাবত দৃষ্টিগোচর হল না।
বিপিন বললে, ‘বোধ হয় আমাদের দেখে তারা আবার হিমালয়ের পথে মহাপ্রস্থান করেছে।’
‘না বিপিন, বোধ হয় আমরাই ভুল খবর পেয়েছি তারা এখানে বেড়াতে আসেনি।’
‘বিধি যখন বাম তখন আজকের ডিনারটা ব্যর্থ না হয়ে যায় না। ফিরে চল।’
‘উঁহু, এখনও আমি হাল ছাড়িনি।’
আরও খানিকক্ষণ ধরে চলল ঘোরাঘুরি।
তারপর সূর্যকিরণ যখন মাটি ছেড়ে বনস্পতির মাথায় মাথায় উড়িয়ে দিয়েছে আলোকপতাকা, তখন দেখা গেল এক গাছের ডালে বসে রয়েছে একটা ময়ূর। আমি বন্দুক তুললুম।
বিপিন ব্যস্ত হয়ে আমার হাত ধরে বলল, ‘আরে, আরে, করো কী! ময়ূর দেখে লোকে কবিতা লেখে, ওকে বধ করা মহাপাপ।’
‘জানো না তো বন্ধু, ময়ূরের মাংসে ভালো কাটলেট হয়।’
বিপিন তৎক্ষণাৎ আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘তাহলে চুলোয় যাক কবিতা আর চুলোয় যাক মহাপাপ, চিরনীরব করে দাও ওই কেকাগীতির গায়ককে!’
ততক্ষণে ময়ূরটা বুঝে ফেলেছে, আমাদের অভিসন্ধি সন্দেহজনক। ডাল ছেড়ে হুস করে উড়ে সে পাশের বনের ভিতর গিয়ে ঢুকল।
বিপিন হতাশভাবে বলল, ‘ওই যাঃ, কাটলেটও হল পলাতক।’
ময়ূরের সন্ধানে আমিও ছুটতে ছুটতে বনের ভিতরে গিয়ে ঢুকলাম। বন ঘন হলেও বড়ো নয়। একটা ছোটো পথ ধরে খানিকদূর এগিয়েই দেখলুম, বনের পরেই রয়েছে ছোটো একটা মাঠ।
সেই মাঠের উপরে গিয়ে দাঁড়িয়ে ময়ূরটাকে আর দেখতে পেলুম না বটে কিন্তু অন্য একটা অভাবিত দৃশ্য দেখে একেবারেই অবাক হয়ে গেলুম।
সেই ব্যাঘ্র, চিতা ও বন্য বরাহের মুল্লুকে, নির্জন ও নিভৃত অরণ্যের বুকের ভিতর একখানি দোতলা বাড়ি।
বাড়িখানা বড়োও নয়, ছোটোও নয়, নতুন নয়, পুরাতনও নয়। দোতলার বারান্দার ওপাশে দেখা যাচ্ছে সারি সারি খড়খড়িওয়ালা বারোটা দরজা। প্রত্যেক দরজাই খোলা। একতলাতেও রয়েছে অনেকগুলো খোলা জানালা। বাড়ির চারিদিকে রেলিং দিয়ে ঘেরা, মাঝখানে ফটক, তাও বন্ধ নয়।
বিপিন বললে, ‘ময়ূরটা এই বাড়িতেই এসে ঢুকেছে।’
‘এমন সন্দেহের কারণ?’
‘নিশ্চয়ই এ কোনো মাথা পাগলা কবির বাড়ি আর ময়ূরটা হচ্ছে তারই পোষা।’
‘বাড়ির মালিক কবি কিনা জানি না, তবে তাঁর মাথায় যে বিলক্ষণ ছিট আছে এতে আর কোনোই সন্দেহ নেই। ফটকের ভিতরে ঢুকে একবার সাড়া দেব নাকি?’
‘যে মানুষ লোকালয়ে বাস করতে নারাজ, আমাদের সাড়া পেলে সে কি খুশি হবে? কী ওজর দেখিয়ে আমরা গায়ে পড়ে আলাপ করব?’
‘বলব, বনে বনে ঘুরে তৃষ্ণার্ত হয়েছি, জলপান করতে চাই।’
‘বেশ, চল। কিন্তু সত্যিকথা বলতে কী ভাই, কৌতূহলের সঙ্গে সঙ্গে আমার কেমন ভয়ও হচ্ছে।
গুটিগুটি ফটকের ভিতরে গিয়ে ঢুকলুম। বাড়ির মালিক কবি হতে পারে, কিন্তু ফটক ও বাড়ির মাঝখানকার বিস্তৃত জমির উপরে কবিত্বের কোনো লক্ষণই খুঁজে পাওয়া গেল না। সেখানে আছে কেবল বুনো আগাছার ঘন জঙ্গল, নেই একটিমাত্র ফুলের চারা।
বাহির থেকে আগে একতলার ঘরের খোলা জানালাগুলো দিয়ে ভিতরে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলুম। জনপ্রাণীকে দেখতে পেলুম না বটে, কিন্তু কোনো ঘরেই আসবাব বা তৈজসপত্রের অভাব নেই।
ধুলো-জঞ্জালহীন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা দেখে বেশ বোঝা যায়, প্রত্যেক ঘরই ব্যবহৃত হয় প্রত্যহ।
বিপিন বললে, ‘কে জানে, কোন নিরালা কোণে বসে কবি তাঁর কাব্যলক্ষ্মীর ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে আছেন।’
আমি বললুম, ‘কিন্তু কবির সাঙ্গোপাঙ্গরা কোথায়? একটাও চাকর বামুনের টিকি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না যে।’
‘চল সদর দরজায় গিয়ে ডাকাডাকি করে দেখা যাক, কবির ধ্যানভঙ্গ হয় কি না।’
যথেষ্ট ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি করা হল। চারিদিক ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল আমাদের উচ্চ চিৎকারে, কিন্তু সমস্তই হল অরণ্যের রোদন। বাড়ির ভিতর থেকে এল না একটিমাত্র টুঁ শব্দ।
আমি বিস্মিত হয়ে বললুম, ‘পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, আসবাবে পরিপূর্ণ, জনশূন্য অরক্ষিত বাড়ি। এ কী রহস্য।’
‘এ রহস্য ভেদ করতে হলে আমাদের বাড়ির ভিতরে অনধিকার প্রবেশ করতে হয়।’
‘যদিও সেটা হবে বেআইনি কাজ, তবু তা না করলে আমাদের কৌতূহল শান্ত হতে পারে না। আর আমরা তো চোরের মতো ঢুকব না, দস্তুরমতো সাড়া দিতে দিতে ভিতরে যাব।’
* * *
ঢুকে পড়লুম বাড়ির ভিতরে। তারপর ‘বাড়িতে কে আছেন’, বলে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে একেবারে গিয়ে দাঁড়ালুম মাঝারি আকারের এক উঠানের ধারে। উঠানের চারিদিকে ঘিরে দরদালান, মেঝে এমন তকতকে যে মনে হয় সদ্য সদ্য ধুয়ে ফেলা হয়েছে।
দালান ধরে এগিয়ে এক কোণে পেলুম দোতলায় ওঠবার সোপানশ্রেণি। সজোরে পা ফেলে ও চেঁচিয়ে বাড়ি কাঁপিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলুম।
দোতলার দালান পেরিয়ে প্রথম ঘরে গিয়ে ঢুকলুম, সেখানা বেশ বড়োসড়ো, নিশ্চয় বৈঠকখানারূপে ব্যবহৃত হয়। কক্ষতলে পাটাতনের উপরে সাজানো সারি সারি তাকিয়া। দেওয়ালে দেওয়ালে ছবি ও বড়ো আয়না। ছাদ থেকে ঝুলছে দুটো মস্ত আলোর ঝাড়। ঘরের এক কোণে রয়েছে একটা মটকা জড়ানো, বড়ো আলবোলা এবং দুটো রুপোর বাঁধানো হুঁকো! একাধিক মানুষের জন্যে আসর প্রস্তুত, কিন্তু মানুষ নেই এক জনও।
বৈঠকখানার এক পাশের একটা দরজা দিয়ে ঢুকলুম গিয়ে আর একটা ঘরে। মাঝারি ঘর। কার শয়নগৃহ। মূল্যবান পালঙ্কে পুরু গদির উপরে পাতা শঙ্খধবল আস্তরণ। এখানে-ওখানে রয়েছে মাথার বালিশ, গালবালিশ, পাশপালিশ। একদিকে একটা প্রকাণ্ড আলমারি, দরজায় তার আয়না বসানো। তার পাশে একটি গোল মার্বেলের টেবিল ও দু-খানা গদিমোড়া চেয়ার। আর একদিকে একটা মস্ত লোহার সিন্দুক এবং একটা দেরাজ-আলনা। আলনায় ঝুলছে খানকয় ধোপদস্তুর শৌখিন ধুতি এবং দুটো চুড়িদার পাঞ্জাবি। কিন্তু কে এই বিছানায় শোয়, এইসব জামাকাপড় পরে, ওই গদিমোড়া চেয়ারে বসে?
এই ঘরের ভিতর দিয়ে পেলুম আর একখানা ঘর। কিন্তু সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে-না- দাঁড়াতেই আচম্বিতে কেমন একটা ঠান্ডা কনকনে দমকা হাওয়া আমাদের গা ছুঁয়ে সাঁ করে দালানের দিকে খোলা দরজাটায় ধাক্কা মেরে বাইরে বেরিয়ে গেল এবং তারপরই দালানের উপর শুনলুম কার দ্রুত ও লঘু চরণের চুটকির সুমধুর মিশ্রণ!
এ কি আমার কানের ভ্রম? সেই মুহূর্তেই ঘরের ভিতরটাও ভরে উঠল ভুরভুরে বেলফুলের সুগন্ধে।
সবিস্ময়ে বললুম, ‘বিপিন শুনেছ?’
‘দালানে কার পায়ের চুটকির আওয়াজ তো? শুনেছি!’
‘ঘরের ভিতরেও কোনো গন্ধ পাচ্ছ না?’
‘পাচ্ছি বইকী। বেলফুলের।’
‘কিন্তু ভরা শীতকালে কখনো কি বেলফুল ফোটে?’
‘আমিও তাই ভাবছি।’
ঘরের ভিতরটা দেখলেই বুঝতে বিলম্ব হয় না যে, এখানে বাস করেন কোনো তরুণী মহিলা। একটা ড্রেসিং টেবিলের উপর সাজানো রয়েছে হরেকরকম প্রসাধন সামগ্রী। রুজ সিঁদুর পাউডারের কৌটা, এসেন্স, তরল আলতা ও সুবাসিত তৈলের শিশি প্রভৃতি। আলনাতেও ঝুলছে রঙিন শাড়ি, সেমিজ, শায়া ও ব্লাউজ প্রভৃতি।
তন্ময় হয়ে এইসব দেখতে দেখতে হঠাৎ খেয়াল হল আমার চোখ ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে, একটু তফাতে আর ভালো করে নজর চলছে না। চমকে মুখ তুলে জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি, সূর্য অস্তগত এবং সন্ধ্যা প্রায় সমাগত। বন থেকে ভেসে আসছে পাখিদের বেলাশেষের কাকলি এবং আকাশপথ দিয়ে বাসার দিকে যাত্রা করেছে দলে দলে হংস বলাকারা। বিপিন বলে উঠল, ‘সর্বনাশ! এখনি চারিদিক অন্ধকার হয়ে যাবে। বনের ভিতরে শেষটা হারিয়ে বেঘোরে মারা পড়ব নাকি?’
ঘরের মধ্যবর্তী দরজাগুলো দিয়ে দুটো ঘর পেরিয়ে দু-জনেই দ্রুতপদে এসে পড়লুম আবার সেই বৈঠকখানায়।
সেখানে আর এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য!
পাটাতনের বিছানার উপরে বসানো আছে বৃহৎ আলবোলাটা এবং তার সটকার রুপোর বাঁধানো নলের মুখটা পড়ে রয়েছে একটা তাকিয়ার উপরে!
আমি একেবারে ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম কয়েক মুহূর্ত।
বিপিন বললে, ‘আমি দিব্যি গেলে বলতে পারি, খানিক আগেই আলবোলাটা নামানো ছিল মেঝের উপরে ওই কোণে।’
আমি বললুম, ‘ঠিক তাই। কিন্তু এখন আর ও নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। আগে বেরিয়ে পড়ি চল।’
একরকম দৌড়েই সিঁড়ি দিয়ে নেমে দালান পার হয়ে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ালুম এবং ঠিক সেই সময়েই শুনলুম, বাড়ির উপর থেকে কারা পুরুষ ও নারী কণ্ঠে হা হা হা হা করে হেসে উঠল।
ছুটতে ছুটতে আঙিনা, ফটক ও মাঠ পেরিয়ে বনের কাছে এসে আর এক বার ফিরে দাঁড়ালুম।
সেই সৃষ্টিছাড়া বাড়ির জানালাগুলো দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে, আলোকে-আলোকে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে প্রত্যেক ঘরখানা।
বললুম, ‘বিপিন কারা আমাদের সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল জোক করবার চেষ্টা করছে। বাড়ির সব ঘর তল্লাশ করতে পারলেই রহস্যের হদিশ পাওয়া যেত। আচ্ছা, কাল দুপুরে আবার সদলবলে এসে দেখতে হবে, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।’
পরের দিন ফের না-এসে ছাড়িনি। এবং এসেছিলুম সদলবলে। বলা বাহুল্য, দলের কোনো লোকই আমাদের দু-জনের কথা সত্য বলে গ্রহণ করেনি।
বনের যথাস্থানে এসে শুধোলুম, ‘বিপিন, ময়ূরটা কাল ওই গাছের ডালে বসেছিল তো?’
‘হ্যাঁ’
‘এসো সবাই আমাদের সঙ্গে।’
পথ ধরে বনের ভিতর ঢুকলুম বটে, কিন্তু মিনিট তিনেক পদচালনার পরেই পথ হয়ে গেল একেবারে বন্ধ। সামনে দাঁড়িয়ে আছে ঘন কণ্টকতরুলতাসমাচ্ছন্ন দুর্ভেদ্য অরণ্যের প্রাচীর, আর এক পদও অগ্রসর হওয়ার উপায় নেই!
বিস্মিত হয়ে বেরিয়ে এসে, আমরা অন্য কোনো পথ খুঁজতে লাগলুম। আর কোনো পথই নেই। আগেই বলেছি, বনটা বড়ো নয়। তার চারিদিকে বেষ্টন করে ঘুরে আসতেও বেশি সময়ের দরকার হল না। কিন্তু কোনোদিক দিয়েই ভিতরে প্রবেশ করবার পথ পাওয়া গেল না। বনের ভিতরেই থেকে গেল বনের রহস্য।
আজ যারা সঙ্গে এসেছিল তারা একবাক্যে স্বীকার করলে, গাঁজার ধোঁয়াতে যে গল্প শুরু হয়, তা শেষ হয় গাঁজার ধোঁয়াতেই। আচ্ছা ধাপ্পা ঝেড়েছ বাবা, আমাদেরও মিছে কাদা ঘেঁটে মরতে হল।
আমাদের জবাব দেওয়ার মুখ নেই।