রহস্যময় পাখিরা

রহস্যময় পাখিরা

তৈরি হয়ে অফিসে বেরোচ্ছিলাম, রাকেশ ডাকল, ‘বাবা, দশ মিনিট সময় দিতে হবে।’ আমি ঘুরে তাকালাম। আমার বাঁ-কাঁধের পেশির নীচে ঘড়িক্যাপসুল বসানো আছে। তার কোনও শব্দ নেই। বাইরে থেকে দেখাও যায় না। কিন্তু মগজের ভেতরে প্রতিটি মুহূর্তে সঠিক সময়টা পৌঁছে দেয়। চোখ দিয়ে ঘড়ি দেখে সময় জানার বিরক্তিকর পদ্ধতি সেকেলে হয়ে গেছে। সুতরাং স্পষ্ট টের পেলাম, এখন সময় আটটা তিপ্পান্ন। ন’টায় অফিস। অফিস কমপ্লেক্স এই বাড়িরই সাতচল্লিশ তলা নীচে। সেখানে পৌঁছে দিতে সুপার-এলিভেটর দেড় মিনিট সময় নেয়। সুতরাং হিসেব কষে রাকেশকে বললাম, ‘দশ মিনিট হবে না, সাড়ে পাঁচ মিনিট সময় দিতে পারি। কী বলবে চটপট বলো।’

রাকেশ জানে, এখন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার যুগ। তাই একটুও মন খারাপ না করে হাসিমুখে বলল, ‘বাবা, তুমি না সেদিন বলছিলে, বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর সমস্ত সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে

আমি বললাম, ‘উঁহু, তা বলিনি। বলেছি, বেশিরভাগ সমস্যার। কিন্তু তাতে হয়েছে কী?’

রাকেশ চোখ বড়-বড় করে বলল, ‘কাল টিভিতে পৃথিবীর নানান রহস্য নিয়ে একটা পুরোনো প্রোগ্রাম দেখাচ্ছিল। তাতে বলল, বারমুডা ত্রিভুজ, পিরামিড রহস্য, ঈস্টার দ্বীপ, এরকম সব রহস্যের সমাধান হয়ে গেলেও জাটিঙ্গার পাখিরহস্যের সমাধান এখনও হয়নি। প্রায় দেড়শো বছর ধরে চেষ্টা করেও বিজ্ঞানীরা কোনও উত্তর খুঁজে পায়নি। কেন, বাবা?’

আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। ওর প্রশ্নের কারণ বুঝতে পারছি। আজ সকালেই ওকে নতুন একটা খেলনা দিয়েছি, ইলেকট্রনিক পাখি। পাখিটা একটানা দশ সেকেন্ড উড়তে পারে, সুরেলা শিস দিয়ে ডাকতেও পারে। সারা সকাল রাকেশ ওটা নিয়ে খেলা করছিল। আর বিজ্ঞানী হিসেবে আমার পরিচয়টা যে নেহাত ছোটখাটো নয় সেটাও ও জানে। তাই বিজ্ঞানী এবং পাখি, দুটো মিলিয়েই হয়তো গতকালের টিভি প্রোগ্রামটার কথা ওর এই মুহূর্তে মনে পড়েছে।

রাকেশ আগ্রহ নিয়ে আমাকে দেখছিল। কোনও উত্তর আশা করছিল অবশ্যই। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে জাটিঙ্গার পাখি-রহস্যের কথা ভাবছিলাম।

ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ছোট্ট এক চিলতে পাহাড়ি গ্রাম জাটিঙ্গা। সেখানে ঘন কুয়াশার রাতে, বাতাস থাকলে আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি হলে, আলোর টানে উড়ে আসে পাখিরা। ঠিক শ্যামাপোকার মতো। জাটিঙ্গায় খাসিয়া উপজাতির বাস। আবহাওয়া ঠিকমতো শর্ত পূরণ করলে তারা হ্যাজাক লন্ঠন কিংবা সার্চলাইট জ্বেলে বসে থাকে পাহাড়ের ঢালে, রাস্তায়, বাড়ির উঠোনে। তাদের হাতে থাকে লিকলিকে বাঁশের লাঠি। আলোর টানে ছুটে আসা পাখিদের আঘাত করে তারা পেড়ে ফেলে মাটিতে। কোনও কোনও পাখি আবার নিজে থেকেই ধরা দেয়, যেন আচ্ছন্ন, সম্মোহিত।

রাতের গাঢ় অন্ধকারে দিশেহারা অন্ধ পাখিরা কেন যে আলোর টানে উড়ে আসে তা কেউই জানে না। আরও আশ্চর্য, জাটিঙ্গা গ্রাম ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও এমনটি দেখা যায়নি। গত দেড়শো বছর ধরে মাথা ঘামিয়েও বিজ্ঞানীরা এর কোনও উত্তর খুঁজে পায়নি। রহস্য রহস্যই রয়ে গেছে।

একটু হেসে রাকেশের মাথার চুল ঘেঁটে দিয়ে বললাম, ‘পাখিদের এই রহস্যের উত্তর বোধহয় খুব সহজ নয়।’

রাকেশ এতক্ষণ পিছনে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎই ইলেকট্রনিক পাখিসমেত একটা হাত সামনে নিয়ে এল। বোতাম টিপে দিতেই পাখিটা ডানা নাড়তে লাগল। শিস দিতে লাগল সুর করে।

রাকেশ পাখিটার পা-জোড়া ধরে রেখেছিল হাতে। ওটার নড়াচড়া দেখতেদেখতে বলল, ‘মানুষের কাছে যে-প্রশ্নের উত্তর খুব কঠিন, পাখিদের কাছে সেটা হয়তো খুবই সহজ!

ওর কথায় চমকে উঠলাম। সত্যিই তো! মানুষের মস্তিষ্ক প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে জটিল, তাই কোনও কিছু সহজভাবে আমরা ভাবতে পারি না। রাকেশের বুদ্ধি খুব বেশি নয়। ওর আই কিউ মাত্র পঁচানব্বই।

এখনকার নিয়ম অনুসারে ছেলেমেয়েদের বারো বছর বয়স হলেই সরকারি সংস্থায় গিয়ে আই কিউ সার্টিফিকেট নিয়ে আসতে হয়। তারপর আই কিউ’র ফল অনুযায়ী তাদের ভবিষ্যৎ পড়াশোনা ও পেশা ঠিক করে দেওয়া হয় সরকার থেকে। রাকেশের বেশি পড়াশোনা করার অধিকার নেই। ট্রাফিক কনট্রোল ডিপার্টমেন্টে ওকে সহজ-সাদামাটা কাজ নিতে হবে। ওকে নিয়ে আমার চিন্তা হয়। ছোটবেলায় ছেলেটা মা’কে হারিয়েছে, ফলে মাতৃস্নেহ পায়নি। কে জানে, সেইজন্যেই হয়তো ওর বুদ্ধির বিকাশ কিছুটা বাধা পেয়েছে। এ-বিষয়ে বিজ্ঞানীরা এখনও গবেষণা করছে।

রাকেশের জন্যে আমার দুশ্চিন্তা যেমন, তেমনি দুঃখও কম নয়। এই মুহূর্তে ওকে ভীষণ ভালো লাগল। কাছে টেনে নিয়ে ওর গালে একটু চুমু খেলাম। বললাম, ‘তুমি ঠিকই বলেছ। বুদ্ধি বেশি হলে সহজভাবে কিছু ভাবা যায় না। তাই মাঝেমাঝে তোমাকে আমার হিংসে হয়।’

ন’টা বাজতে আর পনেরো সেকেন্ড বাকি। সুতরাং ওকে বললাম, ‘সময় হয়ে গেছে, এখন যাই—।’

রাকেশের হাতে পাখিটা থেমে গিয়েছিল। ও আবার বোতাম টিপে দিল। আমার পিছনে ফ্ল্যাটের অটোমেটিক ইলেকট্রনিক দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। শোনা যাচ্ছিল, পাখিটার শিসের শব্দ। তারই মধ্যে রাকেশের শেষ কথাটা আমার কানে এসে বিঁধল, ‘পাখিদের কাছে তোমরা হেরে গেলে, বাবা!

সুপার-এলিভেটর পুরোপুরি স্বচ্ছ প্লাস্টিকের একটি খাঁচা! তার চেহারা অনেকটা দু-মুখ কাটা পেনসিলের মতো। চৌম্বকক্ষেত্রের কারিকুরিতে ওটা কোনওরকম অবলম্বন স্পর্শ না করেই দ্রুত ওঠানামা করতে পারে, অনেকটা পুরোনো দিনের ম্যাগলেভ ট্রেনের মতো।

একশো পঁচিশ তলা বাড়ির গা বেয়ে সুপার এলিভেটর চলাচল করে। ফলে এখন বাইরের দুনিয়া দেখা যাচ্ছিল। আকাশ কালচে, ঘোলাটে। সেখানে কোনও পাখি নেই। যেদিকে চোখ যায়, শুধু আকাশছোঁয়া লিকলিকে বাড়ি। কোনওটা একশো, কোনওটা দুশো, কোনওটা বা তিনশো তলা উঁচু। জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বসবাস-সমস্যা মেটানোর জন্যেই এই আধুনিক ব্যবস্থা। তা ছাড়া সময়ের অপচয় বাঁচাতে প্রতিটি মানুষের অফিস ও বাড়ি একই বিল্ডিংয়ে। এর ওপরে বাধ্যতামূলক ঘড়ি-ক্যাপসুল তো আছেই। আঠারো বছর বয়সের পর সকলকেই ঘড়ি-ক্যাপসুল লাগিয়ে নিতে হয়।

অফিসে ঢুকলাম। আমি ‘রোবোটিক্স ইনকরপোরেটেড’ কোম্পানির টেকনিক্যাল ম্যানেজার। ইলেকট্রনিক খেলনা থেকে শুরু করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট, সবকিছুই তৈরি করি আমরা। সারা পৃথিবী জুড়েই আমাদের কোম্পানির খুব নাম-ডাক। আমার ঘরে ঢুকেই দেখি, একজন অতিথি আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। জাপানের ‘সুমিটোমো ইলেকট্রিক’ কোম্পানির চিফ ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার টাকাহাসি। কতকগুলো নতুন প্রজেক্টের ব্যাপারে কথা বলতে টাকাহাসি এসেছে জাপান থেকে। ওর সঙ্গে গত তিনদিন ধরেই আমাদের মিটিং চলছে। মিটিংয়ের ফলাফল বেশ ভালো।

সুমিটোমো ইলেকট্রিক বেশ বিখ্যাত কোম্পানি। প্রায় দুশো বছর ধরে ওরা পৃথিবীতে রাজত্ব করছে। সেই কোন ১৯০৮-তেই ওরা ইলেকট্রনিক রোবট তৈরি করেছিল, যার চেহারা ছিল অনেকটা মানুষের মতো। রোবটটা অরগান বাজাতে পারত, পা দিয়ে অরগানের ফুটপেডাল ব্যবহার করতে পারত। মেমোরি কন্ট্রোল থেকে বা নোটেশান শিট দেখে সুরেলা বাজনা বাজাত রোবটটা। তার শরীরে পঞ্চাশটা জয়েন্ট ছিল। সতেরোটা সিক্সটিন বিট মাইক্রোপ্রসেসর তাকে কন্ট্রোল করত। ওই সময়ে এরকম উন্নত একটা যন্ত্রের কথা ভাবতেই রোমাঞ্চ হয়। আমরাও অনেক এগিয়েছি, তবে সুমিটোমো এখনও সবার সেরা।

রাকেশের কথাটা আমার মাথায় ঘুরছিল। পাখিদের কাছে আমরা হেরে গেলাম? আচ্ছা, পাখি দিয়েই রহস্যের সমাধান করার চেষ্টা করলে কেমন হয়? তাই টাকাহাসির মুখোমুখি বসেই ওকে প্রস্তাবটা দিলাম। বললাম, ‘তোমাদের সব প্রস্তাব আমরা মেনে নিতে চেষ্টা করব, কিন্তু তার বদলে তোমাকে একটা উপকার করতে হবে।’

টাকাহাসির মুখে সর্বদাই একটা হাসি-হাসি ভাব। ও বলল, ‘বলো, কী করতে হবে?

আমি বললাম, ‘আমার একটা খেলনা-পাখি চাই। যে-পাখি চেহারায় আর গঠনে হবে হুবহু আসল পাখির মতো। তার পালক থাকবে, অন্য পাখিদের সঙ্গে ঝাঁক বেঁধে থাকলে নকল বলে যেন বোঝা না যায়!’ টাকাহাসি বলল, ‘ইজি, ভেরি ইজি।’

আমি ওকে বাধা দিয়ে বললাম, ‘শুধু ওতেই হবে না, আরও আছে, পাখিটার টানা একমাস ওড়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। সে চোখ দিয়ে যা দেখবে, কান দিয়ে যা শুনবে তার ভিডিও রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে, অন্তত একমাসের মতো। আর ওই মিনিয়েচার ভিডিও ক্যাসেটটা এমন একটা ক্যাপসুলের মধ্যে রাখতে হবে, যাতে কোনও দুর্যোগেই সেটা নষ্ট না হয়। আর সেটাকে সহজে খুঁজে পাওয়ার কোনও ব্যবস্থা যেন থাকে, মানে—।’

এবারে টাকাহাসি আমাকে বাধা দিল, বলল, ‘বুঝেছি, হারকিউলিস ক্যাপসুল। না তো, পাখিটা দিনের পাখি না রাতের পাখি?’ কিন্তু আমি বললাম, ‘দিনের পাখি।’

‘আচ্ছা, ওটার চোখ আর কানের স্ট্রাকচার কীরকম হবে? কোন পাখির মতো?’

আমি বললাম, ‘শুধু চোখ আর কান নয়, তার সবটাই হবে থ্রি টোড কিংফিশারের মতো।’

টাকাহাসিকে এই বিশেষ পাখিটার কথা বললাম, কারণ জাটিঙ্গায় কুয়াশার রাতে আলোর টানে থ্রি টোড কিংফিশার বা তিন আঙুলে মাছরাঙা প্রচুর আসে। শহরে এ-পাখি জোগাড় করা যাবে না। শুধু এ-পাখি কেন? শহরে এখন কোনও বাড়তি গাছপালা নেই, পশু নেই, পাখি নেই, পোকামাকড়ও নেই। সবই রাখা আছে দেশের বিশেষ-বিশেষ নির্দিষ্ট জায়গায়, তাদের নিজস্ব পালনকেন্দ্রে। সেখান থেকেই একটা জ্যান্ত পাখি আনিয়ে টাকাহাসিকে দিয়ে দেব।

ভেতরে-ভেতরে টাকাহাসির বোধহয় কৌতূহল হচ্ছিল। ভাবছিল, এরকম গুণধর একটা খেলনা-পাখি আমার কেন দরকার। ও অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘এত সব কাজ খুব একটা তাড়াতাড়ি সারা যাবে না। আমাকে অন্তত তিরিশ দিন সময় দেবে তো?’

আমি বললাম, ‘তা না হয় দিলাম। কিন্তু খরচ কীরকম পড়বে?’

টাকাহাসি হাসল, বলল, ‘আমাদের কোম্পানির তরফ থেকে পাখিটা তোমাকে আমরা উপহার দেব। পাখিটার শুধু একটাই গলদ থাকবে, ওর শরীরে কোনও হজমের ব্যবস্থা থাকবে না। থ্রি টোড কিংফিশাররা যেমন খায়, সেরকম ওটাও খাবে ঠিকই, কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পরে-পরে সেই খাওয়াগুলোই ওর শরীর থেকে আবার বেরিয়ে যাবে। আর তোমার জন্যে উপহার বলেই তার মধ্যে অন্তত পাঁচশো জয়েন্ট আর একশোটা ব্রেন ফাংশান রাখার চেষ্টা করব। তা ছাড়া সুমিটোমোর সুনামটাও তো রাখতে হবে! এখন তুমি আমাকে একটা আসল পাখি জোগাড় করে দাও দেখি।’

আমি টেবিলে রাখা ট্রান্সিভারে কয়েকটা কথা বললাম। তারপর টাকাহাসিকে বললাম, ‘পরশু তুমি দেশে রওনা হচ্ছ, তার আগেই পাখি তোমার হাতে পৌঁছে যাবে।’

টাকাহাসি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আমরা করমর্দন করলাম। ওকে সব কথা খুলে বলতে পারলাম না বলে খারাপ লাগছিল। কিন্তু উপায় কী! যাই হোক, জাটিঙ্গার পাখি-রহস্যের এতদিনে হয়তো একটা সমাধান হবে।

কাজের শেষে সুপার-এলিভেটরে করে ঘরে ফেরার সময়ে একই কথা মাথায় ঘুরছিল : রাকেশ, টাকাহাসির পাখি, জাটিঙ্গার রহস্য।

দেশের সমস্ত অঞ্চল এখন এমন হিসেব করে ভাগ করা হয়ে গেছে যে, নির্দিষ্ট জিনিস নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া পাওয়া যায় না। সবই বৈজ্ঞানিক চাহিদা অনুযায়ী সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরোনো দিনের স্মৃতি হিসেবে যে-কয়েকটা জায়গা আগের মতোই রেখে দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে জাটিঙ্গা উল্লেখযোগ্য। পাখিরহস্যের গবেষণার সুবিধের জন্যেই সেখানকার পরিবেশকে আধুনিক করে তোলা হয়নি। গাছপালা, পশু-পাখি, মানুষজন, সব দেড়শো বছর আগে যেমন ছিল তেমনই আছে।

ঠিক করলাম, টাকাহাসির পাঠানো পাখিটা পেলেই বিজ্ঞানীদের একটা ছোট দল নিয়ে চলে যাব জাটিঙ্গায়। কুয়াশার রাতে সেখানে ছেড়ে দেব পাখিটাকে। তারপর তার শরীরে ভিডিও ক্যাসেটটা প্লে-ব্যাক করে দেখার অপেক্ষা। কিন্তু টাকাহাসি পাখিটা ঠিকমতো তৈরি করতে পারবে তো?

ফ্ল্যাটের দরজার কাছে পৌঁছোতেই ইলেকট্রনিক চোখ আমার মুখের ছবি পরীক্ষা করে মিলিয়ে দরজা খুলে দিল। আমি ঢুকতেই দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল।

রাকেশ ভিডিও ক্যাসেট চালিয়ে নানারকম পাখির ছবি দেখছিল। আধুনিক শহুরে জীবনে পাখি চোখেই পড়ে না। সুতরাং আমাদের মনের বা চোখের চাহিদা মেটাতে ভিডিয়ো ক্যাসেটই সম্বল। এ-ধরনের বহু ভিডিও ক্যাসেট সরকার থেকে বাজারে ছাড়া হয়েছে। যেখানে যেটা দুষ্প্রাপ্য সেখানে সেই জিনিস দেখতে ইচ্ছে করলে সরকারি ক্যাসেটই একমাত্র মুশকিল আসান। রাকেশের সংগ্রহে প্রকৃতি আর বন্য প্রাণীর বিষয়েই বেশি ক্যাসেট রয়েছে। তা ছাড়া, আর একটা ক্যাসেট ওর খুব প্রিয়, তাতে রয়েছে ওর মায়ের ছবি, আমিই একসময় তুলেছিলাম। মাঝেমাঝেই ওর মা’কে ও ছবিতে দেখে, তখন আমিও দেখি। কষ্ট হয়। অথচ গোপন রাখতে হয়। কষ্ট প্রকাশ করা এক ধরনের দুর্বলতা।

রাকেশকে বললাম টাকাহাসির পাখির কথা। শুনে ও খুশিতে একেবারে ডগমগ হয়ে উঠল। বলল, ‘জাটিঙ্গায় আমাকে নিয়ে যাবে, বাবা?’ আমি একটু চিন্তা করে বললাম, ‘দেখি।’

এমনিতেই আমি অফিসে গেলে ছেলেটা প্রায় সারাদিন একা একা থাকে। হয় কম্পিউটার টিচারের সামনে বসে পড়াশোনা করে, না হয় খেলা করে, নয়তো টিভি বা ভিডিও দেখে। আমি চার-পাঁচদিনের জন্যে ওকে ছেড়ে গেলে ও কি একা-একা থাকতে পারবে? ঠিক করলাম, টাকাহাসির পাখিটা আগে হাতে পাই, তারপর রাকেশকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আমাদের কোম্পানির চেয়ারম্যানের কাছে বিশেষ অনুমতি চাইব। উনি নিশ্চয়ই অনুমতি দেবেন। কারণ, আমার এক্সপেরিমেন্ট যদি সফল হয় তাহলে ‘রোবোটিক্স ইনকরপোরেটেড’-এর নাম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। অবশ্য সুমিটোমো ইলেকট্রিকও সেই সুনামের ভাগ পাবে। তখন টাকাহাসি একেবারে অবাক হয়ে যাবে।

আমি ভীষণ অধীর হয়ে পড়ছিলাম। রাকেশের ইলেকট্রনিক পাখিটা হাতে নিয়ে বোতাম টিপে দিলাম। ওটা ডানা নেড়ে শিস দিয়ে উঠল। আমার চোখের সামনে একটা কুয়াশার রাত ভেসে উঠছিল। সেখানে হ্যাজাকের আলোর চারপাশে একটা ছোট্ট মাছরাঙা পাখি উড়ে বেড়াচ্ছিল। আর কতকগুলো লিকলিকে বাঁশের লাঠি শাঁই-শাঁই শব্দে ওটাকে আঘাত করার চেষ্টা করছিল।

টাকাহাসির পাখি চল্লিশ দিন পরে হাতে পেলাম। চার-পাঁচ ইঞ্চি লম্বা ছোট্ট পাখি। লাল ঠোঁট। গায়ে বেগুনি, নীল, লাল, কালো, অনেকরকম রং। পায়ে তিনটে করে আঙুল। ও পাখিটার নাম দিয়েছে ‘অরনিথো মার্ক ওয়ান’ বা সংক্ষেপে ও. এম. ওয়ান। আমি যেমন চেয়েছিলাম তারচেয়েও অন্তত দশগুণ উন্নত পাখি তৈরি করে পাঠিয়েছে টাকাহাসি। আসল-নকলে তফাত বোঝার কোনও উপায় নেই। আমার কথামতো হারকিউলিস ক্যাপসুলও বসিয়ে দিয়েছে ও। সেই ক্যাপসুল থেকে প্রতি মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে একটা বিশেষ বেতার-তরঙ্গ। ক্যাপসুলটা যেখানেই হারিয়ে যাক না কেন, ওই বেতার-তরঙ্গের সূত্র ধরে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবেই। অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে টাকাহাসিকে একটা ভিডিও টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিলাম। এবং পরদিনই সুপার-ক্র্যাফটে চড়ে আমরা চারজন বিজ্ঞানী রওনা হয়ে গেলাম জাটিঙ্গার উদ্দেশে। বিশেষ অনুমতি পেয়ে যাওয়ায় রাকেশকেও সঙ্গে নিতে কোনও অসুবিধে হল না।

জাটিঙ্গায় পৌঁছে একটা বার্ড ওয়াচিং টাওয়ারে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল। যন্ত্রপাতি গোছগাছের পর ওএম ওয়ানকে আমরা ছেড়ে দিলাম। পাখিটা দিব্যি উড়ে গিয়ে জঙ্গলে হারিয়ে গেল। রাকেশ মুগ্ধ হয়ে জঙ্গল-পাহাড়-গাছপালা দেখছিল। বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছিল। হঠাৎই বলল, ‘বাবা, জায়গাটা কী সুন্দর! আমাদের ঘরবাড়ি যদি এখানে হত!’

অন্য বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে রাকেশের দিকে তাকাল। আমি তাড়াতাড়ি বলে

উঠলাম, ‘কিছু মনে করবেন না, ওর বুদ্ধি কম, তাই এরকম উদ্ভট কথা বলে।’ তারপর রাকেশকে কাছে টেনে নিয়ে ওর পিঠে হাত রাখলাম। দূরে পাহাড়ের কোলে সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। ও মুগ্ধ হয়ে সেদিকে দেখছে। ধীরে-ধীরে ভেসে আসছে ভিজে কুয়াশা, ক্রমশ ঢেকে ফেলছে জাটিঙ্গা গ্রামকে। আজ রাতে আলোর টানে হয়তো পাখিরা আসবে।

কিন্তু না। ঘটনা ঘটল চারদিন পর। আবহাওয়ার শর্ত ঠিক-ঠিক পূরণ হল সেদিন। ফলে রাত বারোটা নাগাদ সত্যিই পাখিরা এল। অন্ধকার কুয়াশায় তারা ঝাঁকে-ঝাঁকে উড়তে লাগল। এর মধ্যে ওএম ওয়ান আছে কি না কে জানে!

অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে সুপার-ক্র্যাফটে চড়ে আমরা আকাশে ভেসে পড়লাম। আধুনিক এই যন্ত্রযান একেবারে নিঃশব্দে উড়ে চলে। ফলে নির্বিঘ্নে পরিদর্শনের কাজ সেরে ফেলা গেল। তবে মাঝে-মাঝে আমাদের অবলোহিত রশ্মি ও উপযুক্ত চশমা ব্যবহার করতে হল।

আমি আগে অনেকবার জাটিঙ্গায় এসেছি। আর রাকেশ এসেছে এই প্রথম। তাই অবাক চোখে ও নীচের গ্রামটার দিকে তাকিয়ে ছিল। ছোট্ট পাহাড়ি ঢিবির ওপরে বহু জায়গাতেই হ্যাজাক লণ্ঠন জ্বলছে। সেখানে পাখিরা উড়ছে। লাঠি চালানোর শব্দ হচ্ছে বাতাসে।

যখন আমরা পর্যবেক্ষণ শেষ করে নেমে আসছি ঠিক তখনই আমাদের যন্ত্রে ধরা পড়ল, ওএম ওয়ানকে কেউ আঘাত করেছে! তাহলে নিশ্চয়ই টাকাহাসির পাখিটা হ্যাজাকের আলোর টানে গ্রামে গিয়ে পড়েছে! সুতরাং তড়িঘড়ি সুপারক্র্যাফট ল্যান্ড করানোর নির্দেশ দিলাম।

তাড়াহুড়ো করে সুপার-ক্র্যাফট থেকে আমরা নেমে এলাম। তারপর রাকেশকে টাওয়ারে অপেক্ষা করতে বলে আমরা চারজনই সাজসরঞ্জাম নিয়ে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়লাম। যে করে হোক, হারকিউলিস ক্যাপসুল আমাদের খুঁজে পেতেই হবে। কিন্তু সে-রাতে সমস্ত খোঁজাখুঁজিই ব্যর্থ হল।

ক্যাপসুলটা খুঁজে পেলাম পরদিন সকালে। পাহাড়ি ঢালের ওপরে একটা ঝোপের পাশে পড়ে ছিল টাকাহাসির পাখির ধ্বংসাবশেষ। রঙিন পালকগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে চারপাশে। শরীরের ভেতরের যন্ত্রপাতি ছত্রখান। পাশেই দুটো খাটো পাথরের মাঝে পোড়া কাঠকুটো, ছাই, আর অন্য কয়েকটা পাখির পালক চোখে পড়ছে।

একটু খুঁজতেই কালো ক্যাপসুলটা পাওয়া গেল। সেটা কুড়িয়ে নিয়ে আমরা টাওয়ারে ফিরে চললাম। উত্তেজনায় বুক ঢিপঢিপ করছে। এই ছোট্ট ক্যাপসুলটার মধ্যেই হয়তো রয়েছে দেড়শো বছরের পুরোনো প্রশ্নের উত্তর। এক্ষুনি হেডঅফিসে ফিরতে হবে আমাদের। তারপর…।

কোম্পানির অন্ধকার প্রোজেকশান রুমে বসে আছি আমরা ছ’জন মানুষ। আমাদের একাগ্র চোখ সামনের ছোট পরদায়। হারকিউলিস ক্যাপসুলের ভেতর থেকে পাওয়া ভিডিও ক্যাসেটের শব্দ ও ছবি ফুটে উঠছে সেখানে। এক দুর্লভ চলচ্চিত্র হাতে পেয়েছি আমরা। পাখির চোখ দিয়ে দেখা রহস্যের ছবি, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে গোপন চাবিকাঠি।

ঘরে আমরা চারজন ছাড়া আর যে-দুজন রয়েছেন, তাঁরা হলেন রোবোটিক্স ইনকরপোরেটেড কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ন্যাশন্যাল টেকনিক্যাল কমিটির ডিরেক্টর। জাটিঙ্গার পাখি-রহস্য নিয়ে ওঁদের আগ্রহও নিতান্ত কম নয়।

প্রথমে প্রকৃতির নানা ছবি ভেসে উঠল পরদায়। গাছপালা, আকাশ, পাহাড়, সবকিছুই আমাদের চোখে চেনা, তবে তাদের রংগুলো যেন অন্যরকম। কিছু রং চেনা, কিছু রং অচেনা। আবার একাধিক রঙের বিচিত্র মিশ্রণও চোখে পড়ল।

আমাদের দলের কালার টেকনোলজিস্ট ভদ্রলোক বললেন, আমরা যে-সাতটা রং দেখি, পাখিরা কেউ-কেউ তার কম দেখে, কেউ বা তার বেশি দেখে। থ্রি টোড কিংফিশারের ব্যাপারটা আমাদের ঠিক জানা নেই, তবে মনে হচ্ছে ওই কারণেই রঙের চেহারাগুলো অন্যরকম লাগছে।

এরপর পরদা অন্ধকার হয়ে গেল। রাত নেমেছে নিশ্চয়ই। আর তার অনেকক্ষণ পরে দেখা গেল এক আশ্চর্য ছবি।

জ্যামিতির গঠনের অসংখ্য ত্রিমাত্রিক ফুলের ছবি ফুটে উঠল পরদায়। ঠিক ক্যালিডোস্কোপের নকশার মতো। অদ্ভুত তাদের বর্ণ, অদ্ভুত তাদের সুষম আকার। ছোট-বড় নানান আলোর ফুল ভেসে বেড়াচ্ছে পরদায়। এরকম রং আমরা কখনও দেখিনি, এরকম ফুলও নয়। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলাম।

চেয়ারম্যান জিগ্যেস করলেন, ‘এ কী! এরকম আশ্চর্য ফুল এল কোথা থেকে?’

অন্ধকারে আমার পিছন থেকে কে যেন জবাব দিল, ‘জানি না। তবে হ্যাজাক লন্ঠনের আলো কুয়াশার কণার মধ্যে দিয়ে পাখিদের চোখে যখন আসে তখনই হয়তো এরকম বিচিত্র ফুলের বর্ণালি তৈরি হয়। জাটিঙ্গার কুয়াশায় হয়তো এমন কিছু আছে যাতে…।’

আমি বললাম, ‘ওখানকার চৌম্বকক্ষেত্রের খাপছাড়া ধরনটা আগেই বিজ্ঞানীরা টের পেয়েছিল। তা ছাড়া ওই অঞ্চলে অনেকবার ভূমিকম্প হয়েছে, অল্প তেজস্ক্রিয়তারও সন্ধান পাওয়া গেছে। তার ওপরে মহাজাগতিক কণার অস্বাভাবিক স্রোত ধরা পড়েছে ওখানকার আবহাওয়ায়। এইসব মিলেমিশে যদি জাটিঙ্গার কুয়াশা অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।’

আমাদের চোখের সামনে তখনও অসংখ্য বিচিত্র ফুলের ফুলঝুরি ফুটছিল। এই অদ্ভুত জিনিস দেখেই তাহলে অন্ধকার ভেদ করে আলোর কাছে ছুটে যায় রহস্যময় পাখিরা? এত সহজ, এত সরল ওদের আকর্ষণ!

সুন্দরের প্রতি আমাদের টান দিন-দিন কত কমে গেছে। কিন্তু পাখিরা? গত দেড়শো বছর ধরেও ওদের সেই টান এতটুকু কমেনি। আজও সুন্দরের টানে ছুটে গিয়ে প্রাণ দিতে ওরা ভয় পায় না।

অন্ধকার ঘরে বসে পরদার বিচিত্র রঙের ত্রিমাত্রিক ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আমরা ছ’জন বুদ্ধিমান মানুষ হয়তো একই কথা ভাবছিলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে রাকেশের কথাটা ভেসে এল আমার কানে : ‘পাখিদের কাছে তোমরা হেরে গেলে, বাবা?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *