রহস্যভেদ – আশালতা সিংহ
রেল লাইনের ধারে খানিকটা পোড়ো জমি। একটা সরু রাস্তা এঁকে বেঁকে চলে গেছে ঝোপ ঝাড় জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। সেই রাস্তা দিয়ে সামান্য কিছুদূর গেলেই শৈলেন চৌধুরীর ছোট বাড়িখানি ছবির মত। সামনে একটুকরো বাগান। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সুদৃশ্য বাড়ি। লোকে বাড়িখানা দেখলেই বলবে, একজন শিক্ষিত সুকুমার রুচি ভদ্রলোকের বাড়ি।এর বেশি আর কিছু তার মনে হবে না। কিন্তু শৈলেন চৌধুরীর ইতিহাস বড় ভয়ঙ্কর। তার এই সুন্দর বাড়ি এবং মনোরম বাগানের পিছনে যে কত নরহত্যা কত রাহাজানি, খুন এবং ডাকাতির কাহিনী জড়িত হয়ে আছে তার ইয়ত্তা হয় না। কিন্তু শৈলেন সাবধানী এবং হিসেবী ও অত্যন্ত বুদ্ধিমান। এ পর্যন্ত ওই সব উপায়ে যত টাকা সঞ্চয় করেছে, সে টাকাগুলো লাভজনক ব্যবসায়ে খাটিয়ে তার বেশ আয় হয়। আর এ পর্যন্ত পুলিশ হাজার চেষ্টা করেও তাকে ধরতে পারেনি। এমনকি শৈলেন চৌধুরীই যে নানা ছদ্মবেশে নানাস্থানে কত অপকীর্তি করে বেড়িয়েছে সে খবর পুলিশ জানে না। শৈলেন ভদ্রসমাজে মেলামেশা করে, মাঝে মাঝে কলকাতায় যেয়ে সিনেমা থিয়েটার দেখে আসে। কেউ জানে না যে ওই সুবেশ ভদ্রলোকটি কী করেছে! কত লোকের ধন অপহরণ করেছে, কত লোককে প্রাণে মেরেছে। কিন্তু মধ্যে মধ্যে কলকাতায় যেয়ে আমোদ প্রমোদ করে এলেও, থাকে সে কলকাতা থেকে কয়েক স্টেশন দূরে ছোট একটি মফঃস্বল শহরে। আর তার বাড়িটাও একেবারে ফাঁকায়—জনবিরল স্থানে। খানিকটা পতিত জমি পার হয়ে। তার বাড়ির আশেপাশে চারিদিকে কোথাও মনুষ্যের বসতি নাই।
আমরা যেদিনের কথা বলছি সেদিন আকাশে মেঘ করেছে। মেঘলা রাত্রি, চাঁদ নেই। চারিদিকে সূচিভেদ্য অন্ধকার। থেকে থেকে ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে। শৈলেন রাত আটটার ট্রেনে কলকাতা যাবে। আজকের এই ঠাণ্ডা দুর্যোগের রাতে সে হয়তো বাড়ি ছেড়ে বার হতো না। কিন্তু বিশেষ দরকারে আজই তাকে যেতে হবে। দিনকতক আগে সে কতকগুলো জিনিস চুরি করেছিল। চোরাই সেই দামী মালগুলো সম্বন্ধে একটা যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে। ট্রেনের তখনও দেরি ছিল, সবেমাত্র সাতটা বেজেছে, আর স্টেশন তো মাত্র তার বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেক রাস্তা। যাত্রার আয়োজন প্রস্তুত। বাইরে বসবার ঘরে তার বিছানা এবং বাক্স বাঁধা হয়ে রয়েচে। শৈলেনের একমাত্র চাকর রঘুবীর শহরে গেছে হাট করতে। হাটবারে সে হাটে যায় এবং একেবারে সপ্তাহের মত জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসে। রঘুবীর ছাড়া শৈলেনের সংসারে আর দ্বিতীয় প্রাণী নেই। রঘুবীরই তার চাকরের কাজ, খানসামার কাজ, রাঁধুনির কাজ সমস্তই করে। মাইনেটা কিছু বেশি লাগে বটে কিন্তু এতেই শৈলেনের সুবিধে। কারণ তার যা পেশা তাতে যতদূর সম্ভব একাকী ও নির্জনে থাকা চাই। মোটের উপর যে সন্ধ্যেতে আমাদের গল্পের শুরু সেদিন শৈলেনের বাড়ি একেবারে নির্জন। রঘুবীর সম্ভবত এ দুর্যোগের রাত্রিতে আর ফিরবে না। কাল সকালে আসবে। যদি বা ফেরে প্রায় তিন মাইল রাস্তা অতিক্রম করে হাটবাজার সেরে তার আসতে কোন্ না রাত দশটা এগারটা হবে। শৈলেন ট্রেনের অপেক্ষায় বাগানের গেটের সামনে পায়চারি করছিল। বৃষ্টি তখনও শুরু হয়নি। উদ্দাম ঝোড়ো হাওয়ার মাঝে ঘুরে বেড়াতে তার খুব ভাল লাগছিল। এমন সময় কে একটি পথিক গেটের সামনে এসে তাকে জিজ্ঞেস করলে, মশায়, স্টেশনে যাবার রাস্তাটা কোনদিকে বলে দিতে পারেন?
পথিকের চোখে চশমা। হাতে একটা ছাতা এবং চামড়ার ব্যাগ। লোকটি বাংলা ভাষাতেই কথা বললে বটে কিন্তু তার পরনে আগাগোড়া নিখুঁত সাহেবি পোশাক পরিচ্ছদ। মুখে পাইপ।
শৈলেন তার টর্চটা জ্বাললে। টর্চের আলোতে লোকটার চেহারা আগাগোড়া দেখেই চিনতে পারল। প্রায় মাস খানেক আগে কলকাতার এক বিখ্যাত জুয়েলারির দোকানে সে ছদ্মবেশে ডাকাতি করতে যায়, কিন্তু নানা কারণে বিশেষ কিছুই নিতে পারেনি, এ লোকটি সেই দোকানেরই ম্যানেজার। এবং সম্ভবত ওই চামড়ার সুবিপুল ব্যাগটির ভিতর এমন সব জিনিস ঠাসা আছে যার দাম হয়তো লক্ষ টাকারও অধিক। লোভে শৈলেনের চোখ দুটো জ্বলে উঠল। কিন্তু মুখে সে নিস্পৃহ সুরে বললে, আপনি স্টেশনে যাবেন? তা এই পোড়ো মাঠটা পেরিয়ে বাঁদিকে একটা রাস্তা গেছে, সেইটে ধরে বরাবর ডান হাতি গেলেই—
পথিক ত্যক্ত সুরে বললে, আর মশায় ঘণ্টা তিন চার ধরে ক্রমাগত ঘুরে ঘুরে হয়রান হয়ে গেছি। কতলোকে যে কত রকম রাস্তা বলছে! আমি প্রায় মারা যাবার যোগাড়। তার উপর সঙ্গের এই ভারী ব্যাগটি। আমি ওষুধের এজেন্ট কিনা, ব্যাগে ভর্তি নানা রকম ওষুধের নমুনা।
শৈলেন মনে মনে বললে, ওষুধের ভারে তোমার ব্যাগ ভর্তি না মাথা! বুঝেছি ব্যাপার। বিদেশ বিভূঁয়ে এসেছ, সঙ্গে যে বিশেষ মূল্যবান হীরা জহরত আছে তা কাউকে জানতে দিতে চাও না। বিশেষ করে এই মাসখানেক আগেই আমারই কল্যাণে যে ব্যাপারটি ঘটেছিল তোমাদের জুয়েলারির দোকানে!
কিন্তু মুখে সে অত্যন্ত বিনয় দেখিয়ে বললে,তাই তো, আপনি দেখছি বিদেশী লোক, এ অঞ্চলের পথ ঘাট মুখে বলে দিলেও চিনবেন না। আচ্ছা, আমাদের এ পাড়াগ্রাম অঞ্চলে হঠাৎ কি প্রয়োজনে আপনার আসা?
পথিক বললে, এখানকার জমিদার রামকান্ত বাবুকে তাঁর আদেশক্রমে আমি কয়েকটি ওষুধের নমুনা দেখাতে এনেছিলাম। কাজ হয়ে গেছে, তাই ফিরে যাচ্ছি। তাঁরা গরুর গাড়িতে আসতে বলেছিলেন, আমি সম্মতি হইনি। সঙ্গে লোক দিতে চাইছিলেন তাও ফিরিয়ে দিয়েছি। এখন দেখছি, ভাল কাজ করিনি।
শৈলেন মনে মনে বললে, আর ন্যাকা সাজতে হবে না। বুঝেছি সব ব্যাপারটা স্পষ্টই। জমিদার রামকান্তের দুই ছেলের এক সঙ্গে বিয়ে এই মাসে। বুড়ো নিজে দেশ ছেড়ে এক পা নড়তে পারে না, তাই তোমাদের ফরমাশ করেছিল দামী দামী গয়না নিয়ে এসে দেখাতে। ওই ব্যাগটাতে আছে সেই সব বস্তু।
মুখে সে বললে, আপনি কোন ট্রেনে কলকাতা যাবেন? আটটার ট্রেনে? তা এক কাজ করুন না কেন, আমার এই বসবার ঘরে হাত পা ছড়িয়ে খানিকক্ষণ আরাম করুন। আমিও আজ ওই আটটার ট্রেনে কলকাতা যাচ্ছি। বেশ দুজনে এক সঙ্গে স্টেশনে যাওয়া যাবে’খন। ট্রেনের এখনও ঘণ্টাখানেক দেরি রয়েছে। সে সময়টা ওয়েটিংরুমে অপেক্ষা করার চেয়ে আমার বাড়িতেই বসুন। অবশ্য যদি না আপনার আপত্তি থাকে। তাছাড়া স্টেশনের রাস্তা এই অন্ধকার ঝড়ের রাত্রিতে মুখে বলে দিলেও আপনি যখন চিনে নিতে পারবেন না।
একটুখানি অপেক্ষা করে পথিক রাজী হয়ে গেল। বস্তুত সে খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল এবং এই অন্ধকার রাতে ব্যাগটা হাতে করে অনির্দিষ্টভাবে ভুল রাস্তায় ঘোরাঘুরি করা সমীচীন বলে বোধ করলে না।
দুজনে মিলে বসবার ঘরে এসে বসল। শৈলেন মিষ্টস্বরে জিজ্ঞেস করলে, ততক্ষণ আপনি এক পেয়ালা চা আর খানকতক বিস্কুট খাবেন কি? নিশ্চয়ই পথে বিপথে ঘুরে ঘুরে আপনি হয়রান হয়ে গেছেন।
পথিক অস্ফুট স্বরে দু’একবার বিনীত আপত্তি করল, কিন্তু স্পষ্টই বোঝা গেল, ক্লান্তির পরে চা ও বিস্কুট পেলে সে আরাম করেই খায়। তার কোনই আপত্তি নেই এই চমৎকার আতিথ্যের প্রস্তাবে। শৈলেন স্টোভ ধরিয়ে চা তৈরি করে এক পেয়ালা চা অতিথির সামনে ধরলে এবং আলমারি খুলে একটা ক্রীম্ক্রেকার বিস্কুটের টিন থেকে গোটাকতক বিস্কুট বার করে প্লেটে সাজিয়ে সামনে আগিয়ে দিল। এবং তারপর এক পেয়ালা চা নিজেও ঢেলে নিলে। কিন্তু বাইরে তার মুখে হাসি, কথাতে বিনয় এবং ব্যবহারে সৌজন্য ফেটে বার হলেও মনের ভিতর তার ভয়ানক একটা দ্বন্দ্ব চলছিল। উত্তেজনায় সমস্ত মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছিল। ঠিক সেই সময় একটা মালগাড়ি স্টেশনে এসে লাগল। সেই শব্দে শৈলেন নিজের সঙ্কল্প স্থির করে নিলে। এই তো চমৎকার সুযোগ। বাড়িতে দ্বিতীয় প্রাণী নেই। রঘুবীরটা পর্যন্ত আজ হাট করতে শহরে গেছে। কাছাকাছি এক মাইলের মধ্যে কোন প্রতিবেশীর বাড়ি নেই। এখনই যদি সে ওই লোকটিকে খুন করে ফেলে, কেউ জানবে না। এক ভাবনা ছিল মেরে ফেলার পর মৃতদেহটাকে নিয়ে কি করবে। সঙ্গে সঙ্গে পুঁতে ফেলা তার একার চেষ্টাতে হওয়া অসম্ভব। আর এসব কাজে আজ পর্যন্ত সে কখনো সাথী ডাকেনি। যা কিছু করেছে, একাই করেছে। তাই আজও কেউ তার সন্ধান জানে না, তাই আজও সে ধরা পড়েনি। কিন্তু সে সমস্যার সমাধানও মিটে গেল ওই মালগাড়িটার শব্দে। এ লাইনে কখন কোন গাড়ি যায় সমস্তই শৈলেনের নখদর্পণে। আরও পনের মিনিট পরে আর একটা মালগাড়ি যাবে। তারপরে আসবে তাদের কলকাতা যাওয়ার ট্রেন। শৈলেন স্থির করলে লোকটাকে খুন করে লাইনের ওপর এমন জায়গায় ফেলে দিয়ে আসবে যে, কিছুক্ষণ পরেই যে দ্বিতীয় মালগাড়িটা আসবে সেটা যেন ওর মৃতদেহের উপর দিয়ে চলে যায়! লোকে ভাববে, লোকটা লাইন পার হতে যেয়ে অসাবধানে কাটা পড়েছে।
মনে মনে সে এই সমস্ত ভয়াবহ সঙ্কল্প করছিল কিন্তু মুখে তখন হাসি টেনে এনে পথিককে বলছে, আজ রাত্রির মত এমন ঠাণ্ডা অনেক দিন পড়েনি। হাড়ের ভিতর শুদ্ধ যেন কাঁপিয়ে দিচ্ছে। আপনি আর এক পেয়ালা গরম চা নিন। ঠাণ্ডায় চা’টা লাগবে ভাল।
জুয়েলারির দোকানের ম্যানেজার তার সৌজন্যে প্রায় অভিভূত হয়ে উঠেছেন। এমন সময়ে শৈলেন উঠে দাঁড়িয়ে বললে, যদি কিছু মনে না করেন, মিস্টার রায়, তবে আমি আর একটা ওভার-কোট আমার শোবার ঘরের ড্রেসিং আলমারি খুলে বার করে নিয়ে আসি। এই একটা মাত্র পাতলা কোটে শীত যেন যাচ্ছে না।
ম্যানেজার মিঃ রায় বললেন, বিলক্ষণ, আমি কী মনে করব, আপনি স্বচ্ছন্দে যান, ওভারকোট পরে আসুন।
শৈলেনের কাছে পথিক তার নাম বলেছিল, বিনয় রায়। গায়ের কাপড়টা ভাল করে মুড়ি দিয়ে মিঃ রায় পকেট থেকে তামাকের কৌটো ও একরকম পাতলা কাগজ বার করে সিগারেট তৈরি করতে শুরু করলেন। তিনি কেনা সিগারেট খান না। এক রকম বড় বড় সিগারেট এইভাবেই নিজেই তৈরি করে নেন। শৈলেন ওভারকোট পরবার অছিলা করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। কিন্তু বেরিয়ে এসে সে মোটেই ওভারকোট পরবার চেষ্টা করলে না। সোজা রান্নাঘরে এসে এক কোণে ঠেসানো একটা লোহার শাবল হাতে করে তুলে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। শাবলটা আকারে ছোট এবং ধারাল। এই দিয়ে একটা চোট মারতে পারলেই বিনয় রায় ফর্সা! এই সব চিন্তার সঙ্গে এরই পাশাপাশি আরও একটা চিন্তার ধারা তার মনে বয়ে যাচ্ছিল। কে যেন তার কানে কানে বলছিল, অমন করো না। একজন নিরপরাধ অতিথি, যে বিশ্বাস করে তোমার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে তাকে অমন করে হত্যা করো না। এমন তো জীবনে অনেকই দুষ্কার্য করেছ, আর নাই বা করলে। এক এক সময় তার ইচ্ছা। হতে লাগল ছুটে এ বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। তাহলে হয়তো খুনের এ নেশা থেকে পরিত্রাণ পায়! পায়ের জুতো জোড়া খুলে রেখে সে পা টিপে টিপে নিঃশব্দে বসবার ঘরের দুয়ারের কাছে এসে দাঁড়াল। তার দিকে পিছন করে বসে মিঃ রায় নিশ্চিন্ত মনে সিগারেট টানছেন। সারাদিন ঘোরাঘুরি ও হয়রানির পর এখানে নিশ্চিন্ত মনে বিশ্রাম করতে পেয়ে আরামে তাঁর সর্বাঙ্গ শিথিল হয়ে এসেছে। শৈলেন আরও নিঃশব্দে চুপি চুপি একেবারে তাঁর পিছনে এসে দাঁড়াল। রুদ্ধ নিশ্বাসে সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, তার চোখগুলো জ্বলতে লাগল ধক্ ধক্ করে, হাতের আঙুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এল। নাক দিয়ে নিশ্বাস নিলে পাছে নিশ্বাস পতনের মৃদু শব্দও কর্ণগোচর হয়, সেই ভয়ে সে মুখ দিয়ে শ্বাস ফেলছিল। এই অবস্থায় তাকে দেখলে জীবন্ত হত্যাকারীর বিভীষিকা পথিকের চোখের সুমুখে জ্বল জ্বল করে উঠত।
মিঃ রায় কিছুই টের পেলেন না। নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগে যেমন সিগারেট টানছিলেন তেমনই টানতে লাগলেন। শৈলেন একাজে এত সিদ্ধহস্ত এবং সে এত নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছিল যে কোন লেশতম শব্দ টের পাওয়াও সম্ভব নয়। আবার শৈলেন ধীরে ধীরে ফিরে গেল। এবারে সেই ছোট শাবলটা হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে পিছনে এসে দাঁড়াল। হাতের রিস্টওয়াচটার দিকে চেয়ে দেখলে আর বেশি দেরি করলে চলবে না। ট্রেনের সময় প্রায় হয়ে এসেছে। মালগাড়িটা পেরিয়ে যেতে আর বড় বেশি দেরি নেই।
মিঃ রায়ের মাথা লক্ষ্য করে শাবলটা ছুঁড়ল। ছুঁড়বার সময় ঈষৎ শব্দ হল। সেই শব্দে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে মিঃ রায় আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন এবং ছুটে এসে শৈলেনের একটা হাত চেপে ধরলেন। তিনি মাথা সরিয়ে নেওয়াতে লোহার শাবলটা লক্ষ্যচ্যুত হল। কেবল মাত্র মিঃ রায়ের মাথার একদিকটা খানিকটা কেটে সেটা সশব্দে যেয়ে মেঝের উপর পড়ল। তারপরে শৈলেনের আর ম্যানেজারে ধস্তাধস্তি আরম্ভ হল। দুজনে দুজনকে জাপটিয়ে ধরে ঘরের মেঝেতে একবার এদিক একবার ওদিক গড়াগড়ি যেতে লাগল। ম্যানেজার আবার সেই রকম আতঙ্কে মর্মভেদী আর্তনাদ করে উঠল। শৈলেনের মাথায় তখন খুন চেপেছে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তার খুনের নেশায় টলমল করছে। তবুও একবার তার ভয় হল, যদি মিঃ রায়ের ওই মর্মন্তুদ আর্তনাদ কোন পথিকের কানে যেয়ে থাকে। তাহলে! তাদের ধস্তাধস্তির ফলে একটা চেয়ার উল্টে গেল, মিঃ রায়ের চোখের চশমা ভেঙে খান খান হয়ে গেল, একটা কাচের গ্লাসে খাবার জল ছিল, টেবিলের উপর সেটাও পড়ে যেয়ে চশমার ভাঙা কাচের টুকরোর সঙ্গে ভেঙে খান খান হয়ে মিশিয়ে গেল। মিঃ রায় রোগা ভদ্রলোক, পক্ষান্তরে শৈলেনের ব্যায়ামপটু দেহে অসুরের শক্তি। সে কিছুক্ষণ পরেই রায়কে মাটিতে ফেলে তাকে কাবু করে ফেলল এবং টেবিলের উপরে পাতা রঙিন টেবিল ক্লথটা টেনে নিয়ে তার মুখে ডেলা পাকিয়ে জোরে গুঁজে দিল।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মিঃ রায়ের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। চোখ দুটো হিংস্র অদ্ভুত যন্ত্রণায় নিস্পন্দভাবে যেন শৈলেনের দিকে ঠিকরে চেয়ে রইল। শৈলেনও প্রায় মিনিট খানেক সেই মরণাহত চোখের তারার দিকে চেয়ে নিশ্চল পাষাণের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল। তারপর যখন নিশ্চয় করে বুঝতে পারলে লোকটা মরে গেছে, তখন জোর করে সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে অস্ফুট স্বরে বললে, এখন আর ভাবা মিছে, যা হবার তা তো হয়ে গেল। দেখা যাক এর পর কি কি আর করবার আছে। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলে সমস্ত ব্যাপারটা ঘটতে মাত্র পাঁচ মিনিট সময় লেগেছে। এই ট্রেনের প্রায় আধ ঘণ্টা দেরি। মৃত ম্যানেজারের পকেট থেকে চাবি বার করে ব্যাগটা খুলে দেখলে, যা ভেবেছিল তাই। নানারকম মূল্যবান হীরা, চুণি, পান্না এবং জহরতের অলঙ্কারে ব্যাগটি পূর্ণ।
সেগুলি দেখামাত্র তার কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা অন্তর্হিত হল। এতগুলো বহুমূল্য জিনিস এখন তারই। সম্পূর্ণ তার। কি রকম উপায়ে ওইগুলো গলিয়ে ভেঙেচুরে সে বিক্রি করবে, যাতে চোরাই মাল বলে ধরা না যায়, সে প্ল্যানও সে সঙ্গে সঙ্গে ভেবে ঠিক করে নিলে।
এতক্ষণে শৈলেন আবার সহজ মানুষের মত প্রকৃতিস্থ হয়ে ক্ষিপ্রহস্তে তার যা করবার চটপট করতে আরম্ভ করে দিলে। প্রথমে ব্যাগ থেকে অলঙ্কারগুলি বার করে নিয়ে নিজের কোটের বুক পকেটে রাখলে। এ কোটের পকেট সে বিশেষ ভাবে তৈরি করিয়েছিল। তারপরে ব্যাগে যথারীতি পূর্বের মত চাবি বন্ধ করে চাবি আবার মিঃ রায়ের কোটের পকেটে রেখে দিল। তারপরে মিঃ রায়ের মুখ থেকে টেবিল ক্লথটা টেনে বার করে ফেলল। পরীক্ষা করে দেখলে সেই টেবিল ঢাকায় কয়েক ফোঁটা রক্ত লেগেছে। যে শাবলটা দিয়ে প্রথমে রায়ের মাথায় আঘাত করেছিল সেটার মুখেও কয়েক ফোঁটা রক্ত লেগেছে। এবং শাবলটা মাথার ধার ঘিঁষে যাওয়ার সময়ে মাথার একাংশ কেটে যেয়ে যে আহতস্থানের সৃষ্টি হয়েছিল, সেখান থেকেও কয়েক ফোঁটা রক্তমোক্ষণ হয়ে মেঝের কার্পেটের উপর রক্তের দাগ লেগেছে। খুনের এ সমস্ত চিহ্ন অবিলম্বে মুছে ফেলা দরকার। শৈলেন তৎক্ষণাৎ রান্নাঘর থেকে এক-বালতি জল একটা শুকনো তোয়ালে এবং দাঁত মাজবার একটা ব্রাশ নিয়ে এল। ব্রাশটা জলে ভিজিয়ে রক্তের দাগগুলো ঘষে ঘষে মুছে ফেললে এবং শুকনো তোয়ালে দিয়ে ভিজে জায়গাটা মুছে দিলে। তারপর টেবিলক্লথটা আবার টেবিলের উপর সোজা করে পেতে দিলে, যে চেয়ারটা উল্টে গিয়েছিল সেটা উঠিয়ে রাখলে। খানিকটা পুরোন খবরের কাগজ ভাঁজ করে মাথার যেখান দিয়ে রক্ত ঝরছিল সামান্য, তারই তলায় পেতে দিলে, যাতে আর কার্পেটে রক্তের দাগ না লাগে। ম্যানেজারের চশমা এবং কাচের একটা গ্লাস যে টুক্রো টুক্রো হয়ে ভেঙে মেঝেতে পড়েছিল, সেই কাচের টুকরোগুলো কুড়িয়ে নিয়ে একটা কাগজে মুড়লে। তার থেকে বেছে বেছে যেগুলো গ্লাস ভাঙা বড় টুকরো সেগুলো বাড়ির পিছনের আবর্জনা স্তূপে ফেলে দিল। আর যেগুলো চশমা ভাঙা কাচ সেগুলো এবং চশমার তোবড়ানো ফ্রেমটা কাগজে মুড়ে নিজের পকেটে রাখলে। তবুও বাছবার সময় তাড়াতাড়ি দু’রকম কাচ একসঙ্গে মিশে গেল। খানিকটা বাছা হল, খানিকটা দু’রকম কাচ একসঙ্গে মেশানোই রইল। শৈলেন ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলে মালগাড়িটা, যে গাড়ির চাকার তলায় সে এই মৃতদেহটাকে ফেলবে, তা আসার আর বড় দেরি নেই। খুব শিগগির সারতে হবে। অস্ফুট স্বরে সে বললে, থাক আর কাচ বাছতে পারিনে। কেই বা অত লক্ষ্য করে দেখতে যাচ্ছে, এমনই থাক। মৃতদেহটা লাইনের উপর ফেলে দিয়ে তার পাশে এই তোবড়ানো চশমার ফ্রেম আর ভাঙা কাচের টুকরোগুলো ছড়িয়ে দেব। লোক মনে করবে গাড়ি চাপা পড়বার সময় লোকটার চশমাটাও ভেঙে খান খান হয়ে গেছে।
কিন্তু হায়! শৈলেন তখনও বুঝতে পারেনি এই সামান্য অসাবধানতাটুকুই তাকে হত্যাকারী বলে চিনিয়ে দেবে।
এরপরে সে তার আলমারি খুলে একটা দড়ির বান্ডিল থেকে খানিকটা দড়ি বার করে সেই দড়ি দিয়ে ম্যানেজারের ব্যাগ এবং ছাতাটা একসঙ্গে বেঁধে সেটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিলে এবং ম্যানেজারের মৃতদেহটাও কাঁধে ঝুলিয়ে নিলে। বাইরে অন্ধকার রাত্রি, টিপি টিপি বৃষ্টি পড়ছে, রাস্তায় কাদা। স্টেশনের লাইন তার বাড়ি থেকে মাত্র তিনশো সাড়ে তিনশো গজ। তিন চার মিনিটের রাস্তা, তবু ছাতা ও ব্যাগের বান্ডিল এবং মৃতদেহটা কাঁধে নিয়ে সেই ঘোর অন্ধকারেও ভীতভাবে সতর্ক দৃষ্টিতে চারিদিকে চাইতে চাইতে যেতে শৈলেনের খানিকটা সময় লাগল। তারের বেড়া পার হয়ে লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে যেখানে লাইনটা বেঁকে গেছে সেখানে মৃতদেহটাকে উপুড় করে শুইয়ে দিলে, গলাটা ঠিক লাইনের উপরেই রাখলে। পকেট থেকে ভাঙা কাচের টুক্রো এবং চশমার তোবড়ানো ফ্রেমটা বার করে চারদিকে ছড়িয়ে দিলে। তারপরে যে দড়িতে ম্যানেজারের ছাতা ও ব্যাগ একসঙ্গে বাঁধা ছিল সেই দড়িটা ছুরি দিয়ে কেটে ছাতা ও ব্যাগটাও পাশে রেখে দিলে। দড়িটা নিজের পকেটজাত করল। কেবল একটুকরো দড়ি কাটবার সময় সেখানে মাটিতে পড়ে গেল, সেটা অন্ধকারে অত ঠাহর করতে পারল না।
দূরে একটা ইঞ্জিনের আলো ও গর্জন শোনা গেল। ইঞ্জিনের আলোয় পাছে কেউ তাকেই দেখে ফেলে বলে শৈলেন তাড়াতাড়ি নিজের বাড়ির দিকে অগ্রসর হয়ে গেল। যখন সে তার বাড়ির পিছনের দিককার দরজায় পৌঁছেছে, সেই সময়ে ইঞ্জিনের একটা দীর্ঘ আর্তনাদ ও সুদীর্ঘতর বাঁশির শব্দ শোনা যেতে লাগল। হঠাৎ ব্রেক কষে কেউ যেন গাড়িটাকে থামাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। শৈলেন বুঝতে পারলে, নিশ্চয়ই মৃতদেহটা ওভাবে লাইনের উপর পড়ে থাকতে কেউ দেখেছে এবং সেজন্যই হঠাৎ গাড়ি থামানো হয়েছে। ভয়ে তার নিশ্বাস রুদ্ধ হয়ে এল। তাড়াতাড়ি সে বাগানের পেছন দিককার গেট দিয়ে বাড়িতে ঢুকে গেটটা বন্ধ করে দিলে। বাড়িতে ঢুকে প্রতি মুহূর্তে তার ভয় হতে লাগল হয়তো এতক্ষণ ধরা পড়ে গেছে। হয়তো এখনই তাকে ধরবার জন্যে কেউ এ বাড়িতে এসে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। রুদ্ধ নিশ্বাসে সে অনেকক্ষণ কান পেতে শুনলে দরজায় সত্যি কোন ধাক্কার শব্দ শোনা যাচ্ছে কিনা। তারপর ধীরে ধীরে বসবার ঘরে, যেখানে সে ম্যানেজারকে খুন করেছিল সেখানে এল। ঘরের সমস্তটা সুসজ্জিত, সুবিন্যস্ত। খুনের বা ধস্তাধস্তির কোন চিহ্নই আর কোনখানে নেই। যে লোহার শাবলটা দিয়ে সে প্রথমে ম্যানেজারের মাথায় আঘাত করেছিল, সেইটা দেয়ালের কাছ দিয়ে পড়ে রয়েছে। সেটা হাতে তুলে নিয়ে শৈলেন পরীক্ষা করে দেখলে তাতে আর রক্তের চিহ্নমাত্র নাই। কেবল মাথার দুয়েক গাছ চুল সেটাতে জড়িয়ে রয়েছে। অন্যমনস্ক ভাবে সে টেবিলক্লথটা তুলে নিয়ে শাবলের মুখটা মুছল। তারপর টেবিল ক্লথটা আবার ভালো করে পেতে দিয়ে শাবলটা হাতে করে বাগানে এল এবং বাগানের পাঁচিল টপকিয়ে সেটা ছুড়ে বাইরের ঝোপের মধ্যে ফেলে দিল। নিজের ছোট চামড়ার সুটকেশ এবং পাতলা বিছানার বান্ডিলটা তুলে নিয়ে সে এবার নিজের যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হল। যাবার আগে বসবার ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিতে এসে সে আর একবার ঘরখানার উপর চোখ বুলিয়ে নিল। বিশেষ উল্লেখযোগ্য কিছু নজরে তার পড়ল না। টেবিলের উপরে দুটো চায়ের পেয়ালা এবং ক্রীম্ক্রেকার বিস্কুটের টিনটা রয়েছে। থাকলেও কোন ক্ষতি নেই, থাক। আলোটা নিভিয়ে দিতে সে যেই হাত উঠিয়েছে এমন সময় তার সহসা নজরে পড়ল, ঘরের এককোণে টিপয়ের উপর ম্যানেজারের হ্যাট্টা রাখা রয়েছে। ম্যানেজার ঘরে ঢুকেই মাথার টুপিটা খুলে ওইখানে রেখেছিল। সর্বনাশ! আর একটু হলেই তো টুপিটা অমনই অবস্থায় ফেলে রেখে সে চলে যাচ্ছিল। একটুর জন্যে ভগবান খুব বাঁচিয়ে দিয়েছেন। টুপিটা হাতে তুলে নিয়ে দেখে ভিতরের দিকে ইংরেজিতে নাম লেখা রয়েছে, ‘বিনয়কুমার রায়।’ ভয়ে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দাঁড়িয়ে গেল এই শীতের রাত্তিরেও। এতবড় একটা প্রমাণ তারই বাড়িতে ফেলে রেখে আর একটু হলেই সে আলো নিভিয়ে চলে যাচ্ছিল স্বচ্ছন্দে! সমস্ত শরীরটা তার একবার কেঁপে উঠল এখনই কী ঘটতে পারত তা মনশ্চক্ষে কল্পনা করে। যাক, নষ্ট করবার মত আর সময় নেই। রান্নাঘরে উনুনে তখনও আগুন জ্বলছিল, হ্যাটটাকে দুমড়িয়ে ভেঙে সেই আগুনে নিক্ষেপ করে সে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল। সদর দরজায় কুলুপ বন্ধ করে কলকাতা যাবার এক্সপ্রেস ধরবার জন্যে সে স্টেশন অভিমুখে যাত্রা করলে। রঘুবীর যদি রাত এগারোটার ট্রেনেও হাট বাজার করে ফিরে আসে, তার কাছে সদরের কুলুপের দ্বিতীয় চাবি আছে। সে অনায়াসে খুলে বাড়ি ঢুকতে পারবে। কোন অসুবিধা হবে না। উনুনে ভাঙা হ্যাট্টা ততক্ষণ পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
স্টেশনে এসে পৌঁছে শৈলেন দেখে টিকিটের প্রথম ঘণ্টা পড়েছে। তাড়াতাড়ি টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে আসতেই সে দেখলে সেখানে ভয়ানক একটা চাঞ্চল্য এবং উত্তেজনা চলছে। সমস্ত যাত্রীদের মুখে কৌতূহল, উৎকণ্ঠা ও একটা আতঙ্ক। সবাই বলাবলি করছে, ‘মালগাড়িতে একটা লোক কাটা পড়েছে। আহা!’ একটা ট্রলিতে সাদা চাদর ঢেকে মৃতদেহটাকে দুজন কুলি ঠেলে ঠেলে স্টেশনের গুদাম ঘরের দিকে নিয়ে গেল, সেইদিকে চেয়ে শৈলেনের হৃৎপিণ্ড ধ্বক্ করে উঠল। স্টেশনের ল্যাম্পের আলোর তলায় তার মুখ মৃতের মত রক্তলেশহীন বিবর্ণ মনে হল। তার হাতের তলা ঠাণ্ডা হয়ে এল। জোর করে সে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলে।
রাধানগরের জমিদার রামকান্তবাবুর বড়ছেলে বাণীকান্ত সেই ট্রেনেই রাধানগর আসছিলেন। যে কামরায় তিনি আসছিলেন সেই সেকেণ্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্টে তাঁর ডাক্তার বন্ধু বিমানবিহারী এবং ডাক্তারের প্রাইভেট সেক্রেটারি রমাপ্রসাদ বসেছিল। বিমানকে দেখে বাণীকান্ত বড় খুশি হলেন। বিমানের সঙ্গে তাঁর ছেলেবেলা থেকে বন্ধুত্ব। বললেন, এতটা পথ তোমার সঙ্গে গল্প করতে পারব মনে করতেই আমার খুব ভালো লাগছে। আচ্ছা, তোমার সঙ্গের ওই অদ্ভুত সবুজ বাক্সটি কি?
উত্তরে বিমান একটু হাসলেন। এখানে বলে রাখা ভালো বিমানবিহারী প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসাবে কলকাতা শহরে অসম্ভব খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। যদিও তাঁর পেশা ডাক্তারি, কিন্তু পুলিশে একাধিকবার তাঁরই সাহায্য নিয়ে অনেক জটিল খুনী এবং ডাকাতি মামলার রহস্যভেদ করতে সমর্থ হয়েছিল।
বিমান বাণীকান্তের প্রশ্নের উত্তরে বললেন, তুমি তো জানোই ওই ছোট এবং অদ্ভুত বাক্সটি ছাড়া আমি এক পা কোথাও বার হইনে। এর ভিতর কি আছে দেখবে?—বাক্সটি খুলে দেখালেন, তার ভিতরে ছোট আকারের মাইক্রোস্কোপ, লেন্স টেস্টটিউব, শ্লাইড, ছোট স্পিরিটল্যাম্প এবং নানা আকারের ছোট ছোট শিশিতে অনেকপ্রকার রাসায়নিক আরক রয়েছে।
বাণীকান্ত বললেন, বুঝেছি। তোমার এই বাক্সটির সাহায্যে তুমি জটিল রহস্যভেদে অনেক সাহায্য পাও। কাগজে তোমার যে দুয়েকটা ডিটেকটিভগিরির কথা পড়েছি, তা পড়ে বিস্ময়ে কূল কিনারা খুঁজে পাইনি। সামান্য একটুখানি সূত্র অবলম্বন করে কেমন করে তুমি সমস্ত ব্যাপারটা আঁচ করে নাও, আশ্চর্য! আচ্ছা, এই যে এত ছোট আকারের মাইক্রোস্কোপ, এত ছোট লেন্স, এ দিয়ে সত্যি কি তোমার কোন উপকার হয়?
বিমান সবুজ বাক্সটি খুলে অত্যন্ত মমতার সহিত যন্ত্রপাতিগুলি নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, হয় না আবার! খুবই হয়। যদিও বড় মাইক্রোস্কোপ পেলে হয়তো আরও সুবিধে হতে পারত নানা বিষয়ে। কিন্তু এত বড় জিনিস সর্বদা বহন করা যায় না, তাই এই ছোটতেই আমি কাজ চালিয়ে নিই।
বাণীকান্ত জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছ, নতুন কোন তদন্তে নাকি?
বাণীকান্তের প্রশ্নের উত্তরে বিমান বললেন, না, তদন্তে নয়। আমি আর্য ইনসিওরেন্স কোম্পানির তরফ থেকে কতকগুলো ইনসিওর কেস করতে রাধানগরে তোমাদের জমিদারিতেই যাচ্ছি। আমি যেখানে যে উদ্দেশ্যেই যাই এ সবুজ বাক্সটি কখনো হাতছাড়া করিনে। বলা তো যায় না হঠাৎ কখন কি দরকার হয়ে পড়ে।
বিমান এবং বাণীকান্ত যখন এমনই নানা গল্পালাপ করতে করতে আসছেন সে সময়ে ট্রেনটা রাধানগরে এসে দাঁড়াল। দুজনেই এখানে নামবেন, জিনিসপত্র গুছিয়ে গাছিয়ে নিলেন। কিন্তু প্লাটফর্মে নেমে দেখেন স্টেশনে মহাচাঞ্চল্য। সবাই দলে দলে স্টেশনের গুদাম ঘরটার দিকে ছুটছে। সবারই মুখে এক কথা: আহা! আহা! মালগাড়িতে একটা লোক কাটা পড়েছে! মুণ্ডটা ধড় থেকে একেবারে আলাদা হয়ে গেছে। আহা-বেচারি!
স্টেশনমাস্টার একটা আলো হাতে এই দিকে ছুটে আসছিলেন, তিনি বাণীকান্তকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, বড়বাবু, যে লোকটা কাটা পড়েছে তাকে একবার দেখবেন? হয়তো আপনারা লোকটাকে চিনলেও চিনতে পারেন। কলকাতার লোক। তার সঙ্গে যে ব্যাগটা পাওয়া গেছে তার ভিতর সোনার জলে কলকাতার একটা বড় জুয়েলারির দোকানের নাম লেখা রয়েছে। পান্নালাল অ্যাণ্ড মণিলাল অ্যান্ড কোং।
বাণীকান্ত উৎসুক হয়ে বললেন, কী বলছেন, পান্নালাল অ্যান্ড মণিলাল! ওই দোকানেরই একজন ম্যানেজার, তাঁর নাম বিনয় রায়, তাঁর যে আজ আমাদের বাড়িতে কতকগুলো গয়নার নমুনা দেখিয়ে কলকাতা ফিরে যাবার কথা ছিল। পরশুদিন সে ভদ্রলোককে আমিই তাঁদের দোকানে গিয়ে অর্ডার দিয়ে রাধানগরে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিই। সেই লোকটাই কাটা পড়েনি তো?
স্টেশনমাস্টার বললেন, খুব সম্ভব সেই লোকটাই। আসুন না, গুদাম ঘরে দেখবেন আসুন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে ব্যাগটায় খানকতক ক্যাটলগ একটা সুট এবং অন্যান্য দু একটা জিনিস ছাড়া গয়নাগাটির তো লেশও ছিল না।
বাণীকান্ত বিমানবিহারী এবং তাঁর সেক্রেটারি রমাপ্রসাদ তিনজনেই মৃতদেহটাকে দেখবার জন্য স্টেশনের গুদামঘর অভিমুখে অগ্রসর হলেন।
একটা ত্রিপলের উপর একটা কালো চাদর ঢাকা মৃতদেহটা ছিল। ঢাকা খুলতেই সেই শোচনীয় করুণ দৃশ্য সবারই চোখের সামনে উদঘাটিত হল। মাথাটা ধড় থেকে একেবারে আলাদা হয়ে গেছে। সেই ভীষণ আকৃতির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বাণীকান্ত দুঃখিতস্বরে বললেন, হ্যাঁ, এ সেই জুয়েলারির ম্যানেজার বিনয় রায়ই বটে। আমি চিনতে পেরেছি। লোকটি কি অসাবধানতাবশত কাটা পড়েছেন? না, তাই বা কি করে হবে? তাহলে তাঁর ব্যাগের ভিতরে যে সমস্ত দামী গয়না থাকবার কথা সেগুলি কি হল? নাঃ, ব্যাপারটা দস্তুর মত জটিল ঠেকছে।
তিনি বিমানবিহারীর দিকে চেয়ে অনুনয়ের সুরে বললেন, ভাই, তোমার অসাধারণ ক্ষমতা যদি এই ব্যাপারে একটুখানি খাটাও, তাহলে আসল ব্যাপারটা জানবার একটুখানি সুরাহা হয়। এতে কি তোমার ইনসিওরেন্সের কাজের কোন ক্ষতি হবে? আমার নিজেরও এতে একটা দায়িত্ব আছে। বিনয়বাবু অনেক অলঙ্কারপত্র নিয়ে রাধানগর জমিদার বাড়িতে এসেছিলেন। এখন তিনি যদি নির্বিঘ্নে কলকাতায় ফিরে যেতে না পেরে রাধানগরে ট্রেনে কাটা পড়েন এবং তাঁর সঙ্গের অলঙ্কারগুলিও উধাও হয়, তাহলে আমাদের বাড়ির একটা দুর্নাম হতে পারে।
বিমানবিহারী বন্ধুর অনুরোধে স্বীকৃত হয়ে বললেন, বেশ। আমি যথাসাধ্য সত্য নিরূপণ করতে চেষ্টা করব। এতে আমার ইনসিওরেন্সের কাজের কোনই অসুবিধা হবে না। তুমি আমার উপর নির্ভর করতে পার। এখানকার কাজ শেষ হয়ে গেলেই আমি তোমাদের বাড়িতে যেয়ে তোমাকে খবর দেব।
বাণীকান্ত বন্ধুকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একটু দুঃখিত এবং চিন্তিতভাবে নিজের বাড়ি চলে গেলেন।
স্টেশনমাস্টার নিজেও বিমানবিহারীর নাম জানতেন। কিন্তু তিনি বললেন, আমি পুলিশকে খবর দিয়েছি। হয়তো অল্পক্ষণের মধ্যেই পুলিশ ইন্সপেক্টর এসে পড়বেন। তিনি এলে তাঁর অনুমতি নিয়ে আপনি অবশ্যই এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারেন। কিন্তু তিনি যতক্ষণ না আসছেন ততক্ষণ—
বিমান সহাস্যে বললেন, ততক্ষণ আমি স্বচ্ছন্দে অপেক্ষা করব। আপনি কিছু ভাববেন না।
ইন্সপেক্টারের অপেক্ষায় বাইরের প্লাটফর্মে তিনি ও তাঁর সেক্রেটারি রমাপ্রসাদ পায়চারি করতে লাগলেন। এমন সময় দেখা গেল স্টেশনের জমাদার রুদ্ধনিশ্বাসে সেইদিকে ছুটে আসছে। সেক্রেটারি রমাপ্রসাদ বলল, আচ্ছা, ততক্ষণ জমাদারকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখলে হয় না? ব্যাপারটা সম্বন্ধে সে যদি কোন খবর দিতে পারে।
—তুমি মন্দ বলনি। এই বলে বিমান হস্তের ইঙ্গিতে জমাদারকে ডাকলেন। সে নিকটে এলে বললেন, ওহে, ব্যাপারটা কি ঘটেছে বলতে পার? লোকটা কাটা পড়ল কিভাবে?
জমাদার উৎসাহিত হয়ে হাত পা নেড়ে বলতে শুরু করলে, ব্যাপারটা কি হয়েছিল শুনুন তাহলে। মালগাড়ির লাইনটা যেখানে বেঁকেছে, সেই বাঁকের মুখে যখন গাড়িটা এসেছে তখন ড্রাইভার হঠাৎ লক্ষ্য করলে সামনেই লাইনের উপর কে একটা লোক উপুড় হয়ে রয়েছে। ইঞ্জিনের হেডলাইট লোকটার উপর পড়েছিল, কাজেই ড্রাইভারের দেখতে কোন অসুবিধা হয় নাই। ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষলে। কিন্তু আপনি তা জানেনই একটা চলন্ত মালগাড়ি থামাতে একটু সময় লাগে। গাড়িটা থামতে থামতে ইঞ্জিন ও প্রায় ছ’টা বগি মানুষটার উপর দিয়ে চলে গেল। আহা বেচারা!
বিমান জমাদারকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা কাটা পড়বার আগে লোকটা লাইনের উপর কিভাবে ছিল জানো? ইঞ্জিনের ডাইভার কি তা দেখেছিল?
জমাদার বলল, হ্যাঁ, মশাই, গাড়ির হেডলাইটের সমস্ত আলো তখন লোকটার মুখের উপর গিয়ে পড়েছিল, লোকটি সে জায়গায় উপুড় হয়ে শুয়েছিল। তার মাথাটা লাইনের ঠিক উপরেই দিয়ে। এ কখনই অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে না। ইচ্ছা করে লোকটা আত্মহত্যা করেছে। বিশেষত যেখানটায় সে কাটা পড়েছিল সেখানে কোন লেভেল্ক্রসিং কোন রাস্তা বা কোন কিছু ছিল না।
বিমান বললেন, বটে। তা তুমি এসব জানলে কেমন করে?
—জানি, আমি মশাই জানি। ইঞ্জিনের ড্রাইভার স্টেশনমাস্টারকে সবিস্তারে সব বলছিল, আমি শুনেছি। তাছাড়া আপনারা তো এখনই সেখানে যাবেন, সমস্ত খোঁজখবর নেবেন। দেখবেন আমি যা বলেছি, বর্ণে বর্ণে সত্য। আহা, লোকটা গাড়ির তলায় পড়ে আত্মহত্যা করলে। এই বলে জমাদার ব্যস্তসমস্ত হয়ে আপন কাজে চলে গেল।
পুলিশের অপেক্ষায় স্টেশনে পায়চারি করতে করতে বিমান তাঁর সেক্রেটারিকে বললেন, লোকটা যা বলেছে তা ঠিক। ওই জুয়েলারির ম্যানেজার হয় আত্মহত্যা করেছে, নয় তাকে আগেই কেউ খুন করে কিংবা অজ্ঞান করে রেল লাইনের উপর ফেলে দিয়ে গেছে। হঠাৎ কাটা পড়া নয়। তা যদি হত, তাহলে ওই রকম অবস্থায় উপুড় হয়ে গলাটা রেলের লাইনের উপর বাড়িয়ে থাকত না দেহটা।
এমন সময় দেখা গেল পুলিশ ইন্সপেক্টর এইদিকে আসছেন।
বিমান নিজের নাম লেখা কার্ড তাঁর হাতে দিয়ে বললেন, আমার বিশেষ বন্ধু এই রাধানগরের জমিদার রামকান্তবাবুর বড় ছেলে বাণীকান্ত আমাকে অনুরোধ করে গেছেন আমি যেন সাধ্যমত এ বিষয়ে তদন্তের সাহায্য করি। কারণ যে লোকটা কাটা পড়েছে, বাণীকান্ত তাকে সনাক্ত করেছেন, সে মণিলাল পান্নালাল জুয়েলারি ওয়ার্কসের ম্যানেজার, রাধানগরের জমিদার বাড়িতে বহুমূল্য অলঙ্কার সঙ্গে করে সে এসেছিল। এ অবস্থায় যথার্থ ঘটনা তদন্ত করে বার না হলে আমার বন্ধুর সুনামের পক্ষে সেটা হানিকর হবে।
বিমানবিহারীর নাম, তাঁর অদ্ভুত ক্ষমতা এবং খ্যাতির কথা ইন্সপেক্টর অনেক শুনেছিলাম। তিনি সম্মতি দিয়ে বললেন, আপনার সাহায্য যে আমরা পাব, এ তো সুখের কথা। চলুন, দেখা যাক।
মৃতদেহের আচ্ছাদন খোলার পূর্বে তার ব্যাগ, ছাতা এবং তোবড়ানো চশমার ফ্রেমটার দিকে চেয়ে বিমান স্টেশনমাস্টারকে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, এই চশমাটা মৃতদেহের কোনখানে পড়েছিল?
স্টেশনমাস্টার বললেন, ওই রকম মোচড়ানো অবস্থায় মাথার কাছে পড়েছিল এবং কাচগুলো চারদিকে ছড়ান ছিল।
মৃতের আচ্ছাদন সরানো হলে ইন্সপেক্টর লণ্ঠনের তীব্র আলো দেহটার উপর ফেললেন এবং বিমান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে লাগলেন। কিছুকাল পর মুখ তুলে বললেন, লোকটি যে আত্মহত্যা করেনি বা দৈবাৎ চাপা পড়েনি সে সম্বন্ধে আমি নিঃসন্দেহ। একে কেউ আগেই খুন বা অজ্ঞান করে লাইনের উপর ফেলে দিয়েছে।
এই বলে পকেট থেকে নোটবুক বার করে কি সব লিখতে লাগলেন। ইন্সপেক্টর প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, আপনিও দেহটা দেখলেন, আমিও দেখলুম। কিন্তু আপনি এমন কী দেখলেন যাতে এমন করে নিঃসংশয়ে বলছেন, লোকটি লাইনে কাটা পড়বার আগেই খুন হয়েছে কিংবা আহত হয়ে অজ্ঞান হয়েছে?
বিমান বললেন, কি করে বুঝলুম জানেন, ব্যাপারটা সামান্যই, কিন্তু প্রমাণের দিক থেকে ভয়ানক গুরুত্বপূর্ণ। এই যে মৃতের মাথার বাঁদিকে একটা ক্ষতস্থান রয়েছে দেখতে পাচ্ছেন, এটা থেকে দুটো ধারায় রক্তক্ষরণ হয়েছে। এবং সে দু জায়গাতেই রক্ত জমাট বেঁধে গেছে আর শুকিয়ে গেছে। কিন্তু লোকটির মাথা তার দেহ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে এবং যদি ইঞ্জিনের আঘাতেই ওই ক্ষতস্থানটি সৃষ্টি হয়েছে স্বীকার করতে হয়, তাহলে মানতেই হবে যে আগে তার মাথাটা কাটা পড়েছে, তারপর মাথায় ওই ক্ষতস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ ওই দিকটা ইঞ্জিনের থেকে একটু দূরে ছিল। আপনারা যেমনভাবে বর্ণনা দিয়েছেন, যেমন করে ইঞ্জিনের ড্রাইভার হেড লাইটের আলোতে দেহটাকে লাইনের উপর পড়ে থাকতে দেখেছিল, সে অবস্থান বিবেচনা করলে মানতেই হবে যে, আগে মাথাটা দেহচ্যুত হয়েছে তারপরে মাথার ওই বাঁ দিকটায় হয়তো ইঞ্জিনের ঘষা লেগে আহত হয়েছে।
ইন্সপেক্টর বললেন, হওয়া খুবই সম্ভব। তা-ই তো মনে হয়। ইঞ্জিনের ধাক্কাতেই ওই জায়গাটা কেটেছে। হয়তো বা আপনার কথাই সত্যি, হয়তো কেন নিশ্চয়ই, আগে মাথা কেটে দেহ থেকে আলাদা হয়েছে, তারপরে ওই আঘাতটা লেগে কাটার মত হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে আপনি কি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ খুঁজে পেলেন?
বিমান মৃদু হেসে শান্তস্বরে বললেন, তাই যদি মেনে নিতে হয়, তাহলে রক্তগুলো এল কেমন করে। দেহচ্যুত মস্তক থেকে রক্ত মোক্ষণ হয় না এ-কথাটা তো পাঁচ বছরের ছেলেও জানে। এটা আপনার চোখে পড়েনি? ও আঘাতটা ইঞ্জিনের দ্বারা হয়নি। লাইনের তলায় ফেলে রেখে যাবার আগেই কোন দুর্বৃত্ত তার মাথায় ওই আঘাত করেছে। এর থেকে এ-ই প্রমাণ হয়। তারপর দেখুন, শুধু যে ওই ক্ষত জায়গাটা থেকে রক্তমোক্ষণ হয়েছে তাই নয়, রক্তের ধারাটা বয়ে গেছে দুভাবে। একটা ধারা বয়ে গেছে মুখের বাঁ পাশ দিয়ে এবং জামার কলারের উপর পড়েছে, আর একটা ধারা—দ্বিতীয় ধারাটা ক্ষতস্থান থেকে মাথার পিছন দিকে গড়িয়ে গেছে। মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম সর্বত্রই এক। এর থেকে এই বোঝা যাচ্ছে যে লোকটার মাথায় যখন প্রথম আঘাত করা হয় তখন সে বসেছিল কিংবা দাঁড়িয়েছিল। তারপর অনেকক্ষণের জন্যে নিশ্চয় তাকে মুখ উপর দিকে রেখে চিৎ করে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। রক্তের ওই দুটো ধারা থেকে দেহের ওই অবস্থানই প্রমাণ হয়। কিন্তু চাপা দেবার ঠিক আগেই ড্রাইভার দেখেছিল লোকটা লাইনে গলা বাড়িয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে। এ অবস্থায় তাকে আর কেউ শুইয়ে রেখে গেছে। এবং ও অবস্থায় ফেলে যাবার আগেই মাথার ক্ষতস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং তার থেকে রক্তও গড়িয়ে পড়েছে। এর থেকে এই কথাই প্রমাণ হয়। এবং সে প্রমাণের যথেষ্ট ভিত্তি আছে।
ইন্সপেক্টর মুগ্ধ এবং সপ্রশংস দৃষ্টিতে বিমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার বুদ্ধি এত তীক্ষ্ণ! দৃষ্টি এত পরিষ্কার। সামান্য একটুখানি ব্যাপার যা আমাদের চোখেও পড়েনি, তার থেকে আপনি কত কথাই না প্রমাণ করলেন।
বিমান তাঁর কথার কোন জবাব না দিয়ে তখন একমনে লেন্স দিয়ে মৃতদেহের মুখের ভিতর কি পরীক্ষা করে দেখছিলেন। তাঁর সহকারী রমাপ্রসাদকে ডেকে তিনি বললেন, ওহে, আমাকে একটা স্লাইড্, ফরসেপস্ ও ছোট মাইক্রোস্কোপটা সবুজ বাক্স থেকে বার করে দাও তো।
বিমানের নির্দেশমতো রমাপ্রসাদ জিনিসগুলি বার করে দিলেন। বিমান ফর্সেপস্ দ্বারা একটি সূক্ষ্ম সুতোর মত বস্তু মৃতের দাঁতের ফাঁক থেকে বার করলেন এবং শ্লাইডে সযত্নে সেটুকুকে রাখলেন। তারপর মাইক্রোস্কোপ দিয়ে সেই সুতোটিকে গভীর অভিনিবেশ সহকারে পরীক্ষা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর আবার মাইক্রোস্কোপটি নিয়ে মৃতের পায়ের জুতোর তলা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলেন। কোটের উপরে সাদা গুঁড়ি গুঁড়ি কি লেগেছিল, সেখানটাও বিশেষভাবে মাইক্রোস্কোপ দ্বারা দেখলেন।
ইন্সপেক্টর জিজ্ঞেস করলেন, কী এত আপনি দেখছেন? জুতোর তলায় এবং জামার কোটে কী এত আপনার দেখবার আছে? মুখই বা অত শুঁকছেন কেন? যাই হোক, খাওয়ার দোষে নিশ্চয় লোকটা মরেনি!
বিমান বললেন, এসব কাজে কিছুই অত নিশ্চয় করে বলা যায় না। যে লোকটা মরেছে, সে মরবার আগে একটা সিগারেট খেয়ে শেষটা হয়তো মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। বিস্কুট হয়তো চায়ের সঙ্গে খেয়েছিল এবং যে ঘরে সে খুন হয়েছে সে ঘরে বেশ একটা দামী কার্পেট পাতা আছে। টেবিলের উপর ময়ূরকণ্ঠি রংয়ের কিংবা সাত রংয়ের মেশানো একটা টেবিল ক্লথ পাতা আছে। মুখে একটা কিছু গুঁজে দিয়ে দমবন্ধ করেই শেষ অবধি লোকটাকে মারা হয়েছে।
ইন্সপেক্টর হাঁ করে বিমানের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি মনশ্চক্ষে সমস্ত ঘটনাটা দেখতে পাচ্ছেন? না এ আপনার নিছক কল্পনা!
বিমান তৎক্ষণাৎ বললেন, না, কল্পনা নয়। আমি সমস্তই মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছি। কেমন করে দেখতে পাচ্ছি শুনুন। প্রথমে আমি মৃতের মুখের ভিতরটা লেন্স ও মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুব ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলুম মুখের ভিতরটা ফোলা। মাড়ি ও ঠোঁটের কিয়দংশও স্ফীত, রক্ত যেন জমাট হয়ে গেছে। কেউ যেন বহুক্ষণ মুখে কোন বস্তু জোর করে গুঁজে রেখেছিল। তারপর দাঁতের ফাঁকে একটি সুতো পেলুম। সে সুতোটিকে পরীক্ষা করে দেখা গেল ; লাল হলুদ নীল নানা রঙের সমন্বয়ে সে সুতোটি প্রস্তুত। এবং মৃত যে পরিচ্ছদ পরে আছেন তার সঙ্গে কোনই মিল নেই সে সুতোটির। অর্থাৎ সুতোটি তাঁর পরিচ্ছদের অংশ নয়। তখন নিঃসংশয়েই বোঝা গেল যে, যে কাপড়ের টুকরো মুখের ভিতর খুঁজে দম বন্ধ করা হয়েছিল সেটি তারই একটি সুতো।
ইন্সপেক্টর জিজ্ঞেস করলেন, মৃতের মুখে যে কাপড় গুঁজে দেওয়া হয়েছিল তার প্রমাণ কি?
বিমান বললেন, প্রমাণ খুব স্পষ্ট। আপনি যদি ডাক্তার হতেন, তাহলে অনায়াসে মৃতের মুখ পরীক্ষা করে দেখলেই বুঝতে পারতেন যে, কোন একটা জিনিস তার মুখে গুঁজে দম বন্ধ করা হয়েছে। আর ওই দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা রঙিন সুতোটি বলে দিচ্ছে, সে জিনিসটি একটি টেবিল ক্লথ! টেবিল ক্লথ মানে সেখানে টেবিল আছে। আর টেবিল মানে সেখানে মানুষের বসতি আছে। যেখানে লোকটা খুন হয়েছে সেটি একটি টেবিল চেয়ারে সুসজ্জিত কক্ষ।
ইন্সপেক্টর বললেন, রঙিন সুতো টেবিল ক্লথেরই যে হবে তার মানে কি? স্ত্রীলোকের রঙিন শাড়ির সুতোও তো হওয়া সম্ভব।
বিমান বললেন, অসম্ভব নয়। কিন্তু সুতোটি বিশেষভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি, সেটি এত মোটা যে খুব সম্ভব ওটি জানালার পর্দা বা টেবিল ঢাকার সুতো হওয়াই সম্ভব। যাক, তারপর মৃতের জুতোর তলাটি আমি বহুক্ষণ পরীক্ষা করে দেখলুম, এত যে ঝড় জল হয়ে রাস্তাতে কাদা হয়েছে সেই কাদার চিহ্নও জুতোর তলায় নেই, রয়েছে বিস্কুটের গুড়ো, কেউ যেন একটু বিস্কুট পায়ের তলায় মাড়িয়ে দিয়েছে। এবং একটা আধপোড়া সিগারেটও যেন মাড়িয়ে দিয়েছে, এ চিহ্নও রয়েছে জুতোর তলায়। এর থেকে বোঝা যায় লোকটা খুন হবার আগে চা বিস্কুট খেয়েছে। সম্ভবত বিস্কুটের টিনটা বা প্লেটে কয়েকখানা বিস্কুট টেবিলের উপর ছিল, আততায়ীর সঙ্গে ধস্তাধস্তির সময়ে বিস্কুটটা মাটিতে পড়ে যায় ও পা লেগে গুঁড়ো হয়। একটা সিগারেটও খাওয়ার পরে সে মাটিতে ছুঁড়ে দেয়, দুজনের পরস্পরকে আক্রমণের সময় সেটাও পায়ের তলায় গুঁড়ো হয়ে যায়। আচ্ছা, লোকটার চশমার ফ্রেমটা দেখছি তুবড়ে পড়ে রয়েছে, কাচটা গেল কোথা?
স্টেশনমাস্টার বললেন, কাচগুলো সম্ভবত রেল লাইনের আশেপাশেই ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। অতটা লক্ষ্য করে দেখা হয়নি।
বিমান ইন্সপেক্টারের দিকে তাকিয়ে বললেন, চলুন না একবার লাইনের ধারে যাওয়া যাক। সে জায়গাটাও একবার ভালো করে দেখা দরকার। হয়তো আরও কোন সূত্র পাওয়া যেতে পারে।
ইন্সপেক্টর বিমান এবং তাঁর সহকারী রমাপ্রসাদ তিনজনে রেল লাইনের উদ্দেশে যেখানে লোকটা কাটা পড়েছে, চললেন। ইন্সপেক্টর হাতে একটা তীব্র হেডলাইটের আলো নিয়ে চললেন। যেখানে লোকটি কাটা পড়েছিল ঠিক সেই স্থানে গিয়ে তাঁরা দাঁড়ালেন। লাইনের আশেপাশে কাচের কয়েকটি টুকরো ছড়ানো ছিল, বিমান সেগুলি একত্রিত করে লেন্স, এবং মাইক্রোস্কোপ দিয়ে গভীর মনোযোগের সহিত পরীক্ষা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর মুখ তুলে বললেন, দু’ রকম কাচ রয়েছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এইগুলি চশমার কাচ, এবং এই পাতলা কাচগুলি কোন গ্লাস ভাঙা কাচ। এই যে গ্লাস ভাঙা কাচের মধ্যে আবার রঙিন ফুলের নক্সাও আছে। ভাঙা টুকরোর ভিতরেও তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আপনাকে পূর্বেই বলেছি ইন্সপেক্টরবাবু, লোকটি খুন হবার আগে বিস্কুট খেয়েছে, সিগারেট খেয়েছে। সম্ভবত কাচের গ্লাসে তাকে জলও দেওয়া হয়েছিল। ধস্তাধস্তির সময় কাচের গ্লাসটিও ভেঙে যায় আর মৃতের চশমাটিও ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। মৃতের চশমাটি যে রেলে কাটা পড়বার আগেই ভেঙেছে, তার আর একটা প্রমাণ যদি ট্রেনের চাকার তলায় ওর কাচ ভাঙতো, তাহলে কাচগুলি এমন বড় বড় টুকরো না হয়ে ভারী লোহার চাকার তলায় একেবারে গুঁড়িয়ে যেত।
কথা বলতে বলতে লণ্ঠনের তীব্র আলোয় এক টুকরো সবুজ দড়ির টুকরো বিমান দেখতে পেলেন। এ সেই দড়ি যে দড়ি দিয়ে শৈলেন মৃতের ব্যাগ ও ছাতাটি বেঁধে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে এসেছিল।
দড়ির টুকরোটুকু পকেটজাত করে বিমান উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কেমন ভাবে লোকটা খুন হয়েছে সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। একটা বাড়িতে একখানা সুসজ্জিত কক্ষে বিস্কুট সিগারেট খাওয়ার পর অতর্কিত লোকটা আক্রান্ত হয়েছে। খুনী যথেষ্ট সাবধানতা সত্ত্বেও এমন দু একটা ভুল করে ফেলেছে যার ফলে আমি ব্যাপারটার অনেকখানি আঁচ করে নিয়েছি! কিন্তু যে বাড়িতে লোকটা খুন হয়েছে, সে বাড়িতে আমি না ঢুকলে তো এ খুনের কিনারা হবে না। অথচ বাড়ি বাড়ি ঢুকে তো আর পরীক্ষা করে দেখা চলে না যে কোথায় লোকটা খুন হয়েছে। তাইতো! —বিমান চিন্তিতমুখে বললেন, আচ্ছা, লোকটার পরনে নিখুঁত সাহেবি পোশাক দেখলুম, কিন্তু হ্যাট কোথায় গেল?
ইন্সপেক্টর বললেন, মৃতের জিনিসপত্রের মধ্যে ব্যাগ, ছাতা, সিগারেটের কৌটো এই সবই দেখছি, হ্যাট তো কই নেই। বোধ হয় রাস্তায় পড়ে থাকবে। খোঁজ করে দেখা যাক।
চলুন।—বিমান উঠে দাঁড়ালেন।
আচ্ছা,এদিকে কোন বসতি নেই?
ইন্সপেক্টর বললেন,না, এই পোড়ো জমিটার পরেই যে দেয়াল দেখা যাচ্ছে ওইটে শৈলেন চৌধুরীর বাড়ি। সেখানা ছাড়া এখানে এক মাইলের মধ্যে আর বসতি নেই।
তাঁরা তিনজনে মৃতের হ্যাটের সন্ধানে পোড়ো জমিটা দিয়ে ঝোপ অতিক্রম করে চললেন। ইন্সপেক্টর ঝোপের ভিতর সজোরে পদাঘাত করতে করতে চললেন। যদি হ্যাট্টা ঝোপে পড়ে থাকে তাঁর পায়ে ঠেকবে।
শৈলেনের বাড়ির প্রাচীরের নিচে ঘন ঝোপের মাঝে তিনি উঃ বলে চিৎকার করে উঠলেন। দেখা গেল একটা ধারালো ছোট শাবলে তাঁর পায়ে হোঁচট লেগেছে।
এটা এখানে কে মরতে রেখেছে! বলে তিনি বিরক্তির সহিত সেটা তুলে ধরলেন।
কই দেখি দেখি! —বিমান সেটা তাঁর হাত থেকে নিয়ে পকেট থেকে মাইক্রোস্কোপ বার করে পরীক্ষা করতে লাগলেন।
ইন্সপেক্টরের পায়ে বিলক্ষণ আঘাত লেগেছিল, তিনি কিছু বিরক্ত হয়ে বললেন, যা দেখবেন তাই আপনার পরীক্ষা করা চাই। ওটায় কী আছে কি? হ্যাট্ খুঁজতে বেরিয়েছি আমরা মনে রাখবেন।
বিমান তাঁর কথায় কর্ণপাত না করে হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, এই দেখুন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে মৃতের দাঁতের ফাঁকে যে রকম সাতরঙে মেশানো মোটা সুতো পাওয়া গিয়েছিল ঠিক সেইরকমই দু তিনটি সুতো এই লোহার শাবলটার মুখেও জড়িয়ে রয়েছে। খুব সম্ভব যে পর্দা বা টেবিল ক্লথ চাপা দিয়ে মৃতের মুখ চেপে দমবন্ধ করা হয়েছিল সেইটে দিয়েই এই শাবলটা কেউ মুছেছে। নাঃ, এ বাড়িটায় আমাদের একবার ঢোকা দরকার। খুব সম্ভব এই বাড়িতেই লোকটা খুন হয়েছে।
গেটের কাছে এসে বিমান একটা পরিত্যক্ত সিগারেট তুলে নিয়ে ইন্সপেক্টরকে বললেন, মৃতের পকেটে সিগারেটের যে কৌটো পাওয়া গিয়েছিল তা বার করুন দেখি। বার করতে বলছি এইজন্যে যে, আমি প্রথমে লক্ষ্য করে দেখেছি মৃতের পকেট থেকে যে সিগারেটের কৌটো পাওয়া গিয়েছিল তা সাধারণ প্রচলিত বাজারের সিগারেট নয়। এই পরিত্যক্ত টুকরোটার সঙ্গে তার যেন মিল রয়েছে। মৃতের সিগারেটের কৌটো আপনার পকেটে আছে তো?
আছে।—ইন্সপেক্টর পকেট থেকে কৌটা বার করলেন। মিলিয়ে দেখা গেল দুটোই একরকম।
ক্রমশ সমস্তই মিলে আসছে—কিন্তু বিমান চিন্তিতমুখে বললেন, জনপ্রাণীর সাড়া নেই। আমরা বাড়িতে ঢুকব কেমন করে? আচ্ছা, ততক্ষণ এই ডাস্টবিন্টা পরীক্ষা করে আপনাকে দেখিয়ে দিই যে এটা খুনের বাড়ি সে সম্বন্ধে লেশমাত্র সন্দেহ নেই। তখন হয়তো জোর করে বাড়িতে ঢুকতেও আপনার আপত্তি থাকবে না। ইন্সপেক্টর হাতের তীব্র আলো বাড়ির পিছনের ডাস্টবিনের উপর ফেললেন, সেই আলোতে কতকগুলো কাচের টুকরো ঝকমক করে উঠল।
সেগুলি সযত্নে সংগ্রহ করে তার থেকে চশমার পুরু কাচগুলি বেছে নিয়ে পকেট থেকে তোবড়ানো ফ্রেম এবং রেল লাইনের পাশে কুড়িয়ে পাওয়া চশমার কাচের খণ্ডগুলি যোগ দিয়ে একটা কাগজে পুরোপুরি সাজিয়ে দিয়ে বিমান ইন্সপেক্টরকে বললেন, এই দেখুন, যে লোকটা খুন হয়েছে তার চশমার অর্ধেকটা প্রায় এই বাড়ির রাবিশ স্তূপের মধ্যে পাওয়া গেল। এর থেকে কী প্রমাণ হয়? এ বাড়ির ভেতর ঢোকা আমাদের চাই-ই। যে কোন উপায়েই হোক।
ইন্সপেক্টর বললেন, তাহলে দরজাটা ভাঙতে হয়। কিন্তু সে ভারি বিরক্তিকর! কোন দরকার নেই।
বিমান পকেট থেকে একটা প্রকাণ্ড চাবির গোছা বার করে অনায়াসে দরজার তালা খুলে ফেললেন। বাড়ির ভিতর ঢুকে বসবার ঘরে তাঁরা দেখলেন, টেবিলে একটা বিস্কুটের টিন, গোটা দুই ভুক্তাবশেষ সমেত চায়ের পেয়ালা। মেজেতে একটা অর্ধদগ্ধ মাড়ানো সিগারেট। সমস্তই বিমানের বর্ণনার সঙ্গে মিলে গেল। একটুকরো সবুজ দড়ি পড়ে রয়েছে, সেটাও বিমানের পকেটের দড়ির সঙ্গে মিলে গেল। এমন সময় একটা বিশ্রী গন্ধ তাদের নাকে এল। সেই গন্ধ অনুসরণ করে রান্না ঘরে ঢুকে তাঁরা দেখলেন, একটা স্ট্র হ্যাট্ আগুনে দেওয়া হয়েছিল যার সবটা পোড়েনি, তারই দুর্গন্ধ। সেই হ্যাট্টা যে মৃতের সে সম্বন্ধেও আর কোন সন্দেহের অবকাশ রইল না। তাঁরা বাইরের ঘরে এসে দাঁড়িয়েছেন, এমন সময় হাট বাজার করে এগারোটার ট্রেনে শহর থেকে রঘুবীর এসে হাজির। সে তার মনিবের ঘরে এত লোক সমাগম দেখে ভীত এবং বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, আপনারা কে?
তোমার মনিব কোথায় গেছেন?—ইন্সপেক্টর কঠোর ভাষায় প্রশ্ন করলেন।
—আমার মনিব কলকাতা গেছেন। আজ রাত আটটার ট্রেনে তাঁর যাবার কথা ছিল। নিশ্চয় তাই গেছেন। পরশু ফিরবেন।—রঘুবীর ব্যাপার কি বুঝতে না পেরে বলল।
বিমান ইন্সপেক্টরকে বললেন, এই বাড়িটার উপর কড়া নজর রাখুন, যেন একটি জিনিসও স্থানচ্যুত হয় না! রঘুবীরকেও আপনাদের কড়া নজরে রাখুন। পরশু দিন শৈলেন চৌধুরী যেই এই গ্রামের স্টেশনে পা দেবেন, তাঁকে গ্রেপ্তার করবেন।
বিমানবিহারীর অদ্ভুত বুদ্ধি-কৌশলে খুনী শৈলেন চৌধুরী একদিন পরে ধরা পড়ল। বিমানের সাহায্য না পেলে একা পুলিশের ক্ষমতাও ছিল না তাকে ধরে।