রহস্যভেদ

রহস্যভেদ

গন্ধ তো নয় মন্দ

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার নারায়ণপুর মৌজার মণিমোহনতলা এককালে নিতান্তই একটি সাধারণ গ্রাম ছিল। কলকাতার দশ-পনেরো কিলোমিটারের মধ্যে এই গ্রামের বাসিন্দাদের বেশিরভাগই ছিলেন দরিদ্র চাষি নয়তো কুমোর। একটাই পাকা বাড়ি ছিল। প্রায় দু-বিঘে জমির ওপরে নীচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা সাধারণ দোতলা ইমারত। তার সামনে একটি বড়োসড়ো বাগান, পিছনে তরিতরকারির খেত। এ বাড়ির মালিক, সিংহ পরিবার। একসময় তাঁরাই ছিলেন গ্রামের জমিদার।

আজ মণিমোহনতলার চেহারাই আলাদা। কলকাতা শহর বাড়তে বাড়তে তাকে ছাড়িয়ে আরও দক্ষিণে চলে গেছে। ঝকঝকে নতুন বাড়িগুলো দেখলে তার অতীতের চেহারাটা কেউ কল্পনাই করতে পারবে না। কুঁড়েঘরগুলোর আর কোনো চিহ্নই নেই।

এতসব প্রাচুর্যের মধ্যে অতীতের একমাত্র সাক্ষী হয়ে সসংকোচে দাঁড়িয়ে রয়েছে সিংহদের বাড়িটা। ছিয়াত্তর বছরের বৃদ্ধ কনকলতা সিংহ আর তাঁর বড়ো ছেলে ইন্দ্রকুমার ছাড়া ওই পরিবারের কেউ-ই এখন আর সবসময়ের জন্য ও বাড়িতে থাকেন না। ইন্দ্রকুমার ওয়েস্টার্ন রেলের চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট ছিলেন, সম্প্রতি রিটায়ার করে ফিরে এসেছেন পশ্চিমবাংলায়। কনকলতার নাতিনাতনিরা বছরে একবার পুজোয় সময় আসে। বছরের বাকি দিনগুলো যেন তাদের আশাতেই কাটিয়ে দেন তিনি।

আর একটি পরিবার ওই বাড়িতে থাকে। বিদ্যাধর পাত্র আর তার স্ত্রী মনোরমা। বিদ্যাধর প্রায় চল্লিশ বছর আগে মেদিনীপুর থেকে এ বাড়িতে এসেছিল চোদ্দো বছর বয়সে। সেই থেকে এখানেই রয়ে গেছে। কনকতলার সকল কাজের কাজি সে। তিনি তাঁর সব কাজের ভার ওর ওপরে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে আছেন। বাড়ির আর বাগানের দেখাশুনো থেকে শুরু করে টাকাপয়সার হিসাব— সবই তার দায়িত্বে।

মনোরমা কিঞ্চিৎ ছিটগ্রস্ত। তার জীবনের একমাত্র নেশা হল কাপড় কাচা, সেসব শুকোতে দেওয়া আর ইস্তিরি করা। আগে যখন বাড়িতে অনেক লোকজন থাকত, তখন তাকে অনেক কাপড় কাচতে হত, আজ তা হয় না— এটাই বোধ হয় তার জীবনের একমাত্র দুঃখ। তবে, এর ফলে বাড়ির সব কটা ঘরের বিছানার চাদর, পর্দা ইত্যাদি সবসময় একেবারে ফিটফাট থাকে।

কনকলতার মেজোছেলে নন্দকুমার সিংহ সাগরের স্কুলের হেডমাস্টার। বছর পঞ্চাশেক বয়েস, দশাসই চেহারা আর প্রচণ্ড বদরাগী। এই রাগের জন্যেই নাকি তাঁর মাথাজোড়া টাক। শুঁয়োপোকার মতো তাঁর একজোড়া ভুরু সবসময়ই কুঁচকে আছে। বলাই বাহুল্য যে তাঁকে সবাই প্রচণ্ড ভয় করে। এন. কে. সিংহকে ছাত্ররা চিরকাল নরখাদক সিংহ বলেই জেনে এসেছে।

এইসব কারণে সাগরের যখন হেডমাস্টারমশায়ের ঘরে ডাক পড়ল, তখন কেবল সে নয়, ক্লাসসুদ্ধু ছেলেমেয়ে ভয়ানক চিন্তিত হয়ে পড়ল। তখন বাংলা ক্লাস চলছিল, ক্লাস নিচ্ছিলেন রমেনবাবু। তিনিও খুব আশ্চর্য হয়ে গেলেন। বললেন— কী করছিস রে, সাগর? কী গণ্ডগোল পাকালি আবার? যা, শিগগির যা।

সাগরের বন্ধুরা ফিসফিস করে কেউ বলল— জুতো মুছে ঢুকবি। কেউ বলল— চুল আঁচড়ে নে। কেউ বলল— প্যান্টের ভেতরে ভূগোল বইটা ঢুকিয়ে নিয়ে যা, বেত মারলে লাগবে না।

সাগর কাঁপতে কাঁপতে হেডমাস্টারমশায়ের ঘরে ঢুকল। উনি তখন চকচকে টাকমাথা নীচু করে কীসব কাগজপত্র দেখছিলেন। সাগরকে ঢুকতে দেখে মুখ তুলে হাসলেন। তাই দেখে সাগর আরও নার্ভাস হয়ে পড়ল। তার মনে হল ভয়ংকর কিছু একটা নিশ্চয়ই ঘটেছে, নইলে নরখাদক তাকে দেখে হাসবে কেন? কেউ যাঁকে কোনোদিন হাসতে দেখেনি, তাঁকে হাসতে দেখলে ভয় পাওয়ারই কথা।

হেডমাস্টারমশাই বললেন— বসো, সাগর। তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

সাগর বলল— বসব স্যার? আমি বরং দাঁড়িয়েই থাকি। আপনি বলুন কী বলবেন।

—ঠিক আছে, আচ্ছা, আমি শুনেছি যে তুমি নাকি শখের ডিটেকটিভ। কথাটা কী সত্যি?

সাগর বিড়বিড় করে বলল— না, স্যার, তেমন কিছু নয়। মাঝে মাঝে দু-একবার মাথা খাটাবার সুযোগ পেয়েছি, এইমাত্র।

—বেশ, বেশ। দ্যাখো, আমার একটা প্রবলেম আছে। সে ব্যাপারে মাথা খাটাতে রাজি আছ?

—নিশ্চয়ই, স্যার। আপনি বললে অবশ্যই রাজি আছি।

—বেশ। এবার তাহলে বসো। আমি তোমাকে আমার প্রবলেমটা বিস্তারিতভাবে বলি।

হেডমাস্টারমশাই তাঁর মণিমোহনতলায় পরিবার আর তার পুরোনো ইতিহাসের কথা বলেন। লর্ড কার্জনের আমলে জমিদারির পত্তন হয়। আদায়পত্র এমন কিছু গেয়ে বেড়াবার মতো কোনো কালেই ছিল না। কাজেই গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য পরিবারের সকলকেই লেখাপড়ার দিকে যেতে হয়েছে। তার ফলে, পরিবারে প্রায় সকলকেই কলকাতা বা ভারতবর্ষের অন্যান্য শহরে চলে যেতে হয়েছে। তবে যে যেখানেই যান না-কেন, তাঁদের শেকড়টা কিন্তু রয়ে গেছে মণিমোহনতলাতেই।

একমাত্র ব্যতিক্রম হেডমাস্টারমশায়ের বাবা বিষ্ণুপদ সিংহ। তিনি ছিলেন আদর্শবাদী ডাক্তার। পাশ করে গ্রামে ফিরে আসেন এবং চিকিৎসা শুরু করেন। তাঁর খ্যাতি অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। কলকাতা, পাটনা এমনকী লক্ষ্নৌ থেকেও তাঁর ডাক আসত। কাজেই, তাঁকে কোনোদিন অর্থাভাবে ভুগতে হয়নি বা তাঁর গ্রামের গরিব মানুষদের বিনে পয়সায় চিকিৎসা করতেও কোনো অসুবিধে হয়নি।

বিষ্ণুপদর তিন ছেলে, এক মেয়ে। ছেলেরা হলেন ইন্দ্রকুমার, নন্দকুমার আর নবকুমার। মেয়ের নাম ইরা, তাঁর বিয়ে হয়ে গেছে, থাকেন চেন্নাইতে। ইন্দ্রকুমার বিপত্নীক। তাঁর ছেলেমেয়েরা মুম্বাই, পুনা আর বরোদায় থাকে। নন্দকুমারের দুই ছেলে। বড়োজন আর্কিটেক্ট, তাঁর হেয়ার স্ট্রিটে নিজস্ব অফিস আর ছোটোজন তার জ্যাঠামশায়ের মতো চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, থাকেন কানপুরে। নবকুমার অবিবাহিত। তিনি আমেরিকায় থাকেন, তবে মাঝে মাঝে দেশে আসেন। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ান আর বাঙালি ছেলেমেয়েদের রবীন্দ্রসংগীত শেখান।

যে সমস্যা নিয়ে হেডমাস্টারমশাই সাগরকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, সেটা শুরু হয় ইন্দ্রকুমার আর মণিমোহনতলায় পাকাপাকিভাবে চলে আসবার তিন-চারমাস পর থেকে, হঠাৎই সারা বাড়িতে একটা অদ্ভুত গন্ধ পেতে শুরু করে সবাই। গন্ধটা অম্বুরি তামাকের। হেডমাস্টারমশায়ের ছোটো ঠাকুরদা এই তামাক খেতেন। তাঁর বাবাও শেষবয়সে এই তামাক ধরেছিলেন। কেবল বাতাসে নয়, বিছানার চাদরে, পর্দায়, এমনকী তোয়ালেতেও এই গন্ধ পাওয়া যেতে লাগল। মনোরমা তটস্থ হয়ে উঠেছে আর অনবরত কাপড় কেচে যাচ্ছে। অথচ, সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও কোনো অম্বুরি তামাকের সন্ধান পায়নি কেউ।

এখানেই শেষ নয়। শেষরাত্রের দিকে মাঝে মধ্যে একটা আতরের গন্ধও ভেসে আসে। এটা সাধারণ আতর নয়। ডা. বিষ্ণুপদ সিংহের লক্ষ্নৌ-এর এক রুগি তাঁকে এই বিশেষ আতরটি কখনো কখনো পাঠাতেন।

এই ঘটনার ফলে সিংহ পরিবারের সকলে আতঙ্কিত না হলেও, বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। কারুর যে-কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তা তাঁরা মনে করছেন না। কিন্তু এমন ঘটনা ঘটবে কেন?

একটা কারণ থাকবে তো ঘটনার পিছনে। আজ না হয় গন্ধের ওপর দিয়ে যাচ্ছে, কাল যে আরও বিপজ্জনক কিছু ঘটবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়?

হেডমাস্টারমশাই বললেন— এই কারণটা খুঁজে বের করবার জন্য অনুরোধ জানাতেই তোমাকে ডেকে এনেছি। দেখবে নাকি একটু মাথা খাটিয়ে?

সাগর বলল— স্যার, দেখব তো বটেই। তবে, তার আগে কি আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি?

—নিশ্চয়ই পারো। বলো কী জানতে চাও?

—আপনি একজন প্রতিষ্ঠিত ডিটেকটিভকে না-ডেকে আমাকে ডাকলেন কেন?

হেডমাস্টারমশাই ম্লান হেসে বললেন— তার কারণ, একজন প্রতিষ্ঠিত ডিটেকটিভ ডাকলে ব্যাপারটা আমাদের পরিবারের বাইরের লোকদের মধ্যে জানাজানি হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তা যদি হয়, তাহলে অনেকেই হাসাহাসি করবে আর বলবে, দেখেছ, সিংহ বাড়ির লোকেরা ভূতের ভয় পাচ্ছে। ঘটনাটা যে তা নয়, সেটা তাদের বোঝানো যাবে না।

—সে তো স্যার, আমিও কথাটা পাঁচজনকে বলে বেড়াতে পারি।

—না, তা পারো না। কারণ, তুমি ভালো করেই জানো যে তা করলে নরখাদক সিংহ তোমাকে জ্যান্তো চিবিয়ে খাবে।

অনেক কষ্টে হাসি চেপে গম্ভীর মুখে সাগর বলল— এবার স্যার দ্বিতীয় প্রশ্ন। গন্ধটা কী বাড়িতে যখন অনেক লোকজন থাকে তখনও পাওয়া যায়, না কেবল মোটামুটি খালি বাড়িতেই পাওয়া যায়?

হেডমাস্টারমশাই বললেন— খালি বাড়িতেই বেশি পাওয়া যায়। তবে লোকজন থাকলেও যে পাওয়া যায় না, তা নয়।

—আপনাদের ওখানে তো জমির অনেক দাম। প্রোমোটাররা আসে না আপনাদের বাড়িটা কিনে নেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে?

—আসে না আবার? অনবরত আসছে। টাকার থলি নিয়ে বসে রয়েছে সবাই। কেউ দেখাচ্ছে লোভ, কেউ দেখাচ্ছে ভয়। বেশ কিছুদিন আগে একজন তো আমার মা আর দাদাকে বলে গেল, ইয়ে কোঠি আপকো ছোড়না পড়েগা। তারপরে একটু উৎপাতও শুরু করেছিল। দাদা তো বেশ ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলেন। তখন সদ্য এসেছেন ওখানে, ভয় পাওয়ারই কথা। পরে সেই প্রোমোটার যখন জানতে পারল যে ডিসি সাউথ সঞ্জয় বোস আমার ছাত্র, তখন সে গা ঢাকা দিল।

—আপনার বাবা বা ঠাকুরদাদার মুখে অতীতে এই ধরনের কোনো উপদ্রবের কথা কি শুনছেন কখনো?

—না। কখনো না।

—আপনার দাদা কি তামাক বা সিগারেট খান বা কখনো খেতেন?

—না, আমাদের ভাইয়েদের ওই নেশা কস্মিনকালেও ছিল না। দাদা তো সিগারেটের গন্ধ একেবারেই সহ্য করতে পারে না।

—আমি কি একবার আপনাদের বাড়িতে যেতে পারি, আর ওখানে যাঁরা থাকেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে পারি?

—অবশ্যই পারো। আমি আগামী শনিবার গাড়ি নিয়ে তোমার বাড়িতে যাব বেলা দুটো নাগাদ। তোমার বাবা-মাকে জানিয়ে রেখো, আমি তাঁদের সঙ্গে কথা বলে নেব। সন্ধে ছ-টার মধ্যেই ফিরে আসতে পারব আমরা।

—আর একটা কথা স্যার। আমার বোন শ্রীলতাও আমার সঙ্গে যাবে। সে এই স্কুলেই ক্লাস টেনে পড়ে। ও আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। আমি না বললে মুখ খুলবে না। কোনো অসুবিধে হবে না তো?

—ক্লাস টেনের শ্রীলতা, মানে আমাদের ব্যাডমিন্টন টিমের শ্রীলতা চৌধুরি? না, না, কোনো অসুবিধে হবে না।

.

সাগর যখন ক্লাসে ফিরল, তখন বাংলা ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। অঙ্ক স্যার নিরঞ্জনবাবু তখনও এসে পৌঁছননি। ও ঢোকামাত্র সবাই ঘিরে ধরল। অজস্র প্রশ্ন— নরখাদক কেন ডেকেছিল, কী করেছিস তুই, খুব মেরেছে না কি ওঠ-বোস করিয়ে ছেড়ে দিয়েছে, স্কুলে নাম কেটে দেয়নি তো, ইত্যাদি ইত্যাদি।

সাগর প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বলল— না, না, ওসব কিছু নয়। আমাকে শুধু বললেন, এ বছরটা খেলাধুলো বন্ধ রেখে পড়াশুনোয় বেশি করে মন দিতে। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতেই হবে।

ফার্স্টবয় সুপ্রতীক বলল— আর কাউকে না-ডেকে শুধু তোকে ডাকল কেন? আমাকেও তো ডাকতে পারত।

মনীষা বলল— বোকার মতো কথা বলিস না তো। ওকে ডেকেছিল খেলতে বারণ করবার জন্য। সেজন্য তোকে ডাকবে কেন? তুই কোনোদিন ফুটবলে পা লাগিয়েছিস?

বেশ একটা ঝগড়া বেঁধে গেল। ভালোই হল। সাগর আর বলবার কোনো সুযোগই পেল না যে নরখাদক সিংহের বাইরেটা যতই ভয়ংকর হোক না-কেন, তার ভেতরে একটা রসিক মানুষ লুকিয়ে আছে। অবশ্য বললেও কেউ বিশ্বাস করত না।

.

হেডমাস্টারমশাই-এর পিছনে পিছনে তাঁদের বাড়িতে ঢোকামাত্র গন্ধটা পেল সাগর আর শ্রীলতা। একটা মিষ্টি-মিষ্টি অথচ সোঁদা-সোঁদা গন্ধ।

হেডমাস্টারমশাই বললেন— একটা গন্ধ পাচ্ছ তোমরা? এটা অম্বুরি তামাকের গন্ধ।

শ্রীলতা ফিসফিস করে বলল— আমার কেমন ভয় করছে রে, দাদা।

সাগরও ফিসফিস করে বলল— দূর, দিনদুপুরে আবার ভয়ের কী আছে? গন্ধ তো নয় মন্দ।

সাগরের শেষ কথাটা হেডমাস্টারমশাই-এর কানে গেল। মৃদু হেসে বললেন— যা বলেছ। এসো, এবার তোমাদের বাড়ির সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। চা-এর সময় হয়েছে, সকলকেই এখন বসবার ঘরে পাওয়া যাবে।

বসবার ঘরটা একতলায়। আয়তনে বেশ বড়ো, মেঝে জুড়ে কার্পেট আর দেওয়ালে অজস্র ছোটো-বড়ো ফোটোগ্রাফ আর অয়েলপেন্টিং। সেখানে কয়েকটি প্রাচীন অতিকায় সোফার ওপরে তিনজন বসে ছিলেন। একজন বৃদ্ধ মহিলা আর অন্য দু-জন সুদর্শন ভদ্রলোক। তাঁদের একজন প্রৌঢ় আর অন্যজন মনে হল যৌবনের প্রান্তে এসে পৌঁছেছেন। স্পষ্টতই, প্রথম জন ইন্দ্রকুমার আর অপরজন নবকুমার। তাঁদের মা বৃদ্ধা হলেও অত্যন্ত শক্তপোক্ত আর প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। তাঁর মেজোছেলে যে তাঁর কাছ থেকে চরিত্রটি পেয়েছেন, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। অথচ, ইন্দ্রকুমারকে মনে হল নিতান্ত নার্ভাস প্রকৃতির মানুষ। অনবরত নখ খেয়ে যাচ্ছেন। নবকুমার আবার অন্যরকম। তিনি রসিক মানুষ, মুখে সবসময় একটি রহস্যপূর্ণ ব্যঙ্গাত্মক হাসি লেগে আছে।

নবাগতরা ঘরে ঢোকামাত্র নবকুমার প্রশ্ন করলেন— এই তোমার বাচ্চা শার্লক হোমস, ছোড়দা? আর ইনি? বাচ্চি ওয়াটসন? এঁরাই রহস্যভেদ করবেন বুঝি?

প্রশ্নের প্রচ্ছন্ন খোঁচাটা এড়িয়ে গেলেন হেডমাস্টারমশাই। বললেন— বুড়ো শার্লক হোমস যখন পাচ্ছি না, তখন বাচ্চা শার্লক হোমস ছাড়া উপায় কী বল? বলে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

নবকুমার বললেন— পরিচয় তো হল, এবার কী-কী প্রশ্ন আমাকে করবার আছে সেগুলো করে ফেলুন মি. হোমস।

মৃদু হেসে সাগর বলল— আপনাকে নয়, আগে ওঁকে প্রশ্ন করব। বলে, ইন্দ্রকুমারকে জিজ্ঞাসা করল— আপনি তো রেলওয়ের চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট ছিলেন। আপনি ভালো বলতে পারেন। এই বাড়িটা বিক্রি করলে এখন কীরকম দাম পাওয়া যাবে?

প্রবল বেগে নখ খেতে খেতে ইন্দ্রকুমার বললেন— তা প্রায় এক কোটি কুড়ি লক্ষ টাকা হবে খোলা বাজারে। আর যদি প্রেমোটারকে দেওয়া হয় তাহলে আমরা ভাইবোনেরা আর মা প্রত্যেকে একটা করে ফ্ল্যাট আর চোদ্দো লক্ষ করে টাকা পাব।

—তার মানে, সকলের একটি আধুনিক ফ্ল্যাট থাকবে আর বাকি জীবনটা স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে দেবার মতো সুযোগ পাওয়া যাবে, তাই তো?

কিঞ্চিত উত্তেজিতভাবে ইন্দ্রকুমার হাত নেড়ে বললেন— ঠিক তাই। আমি তো সে কথাই সবাইকে বোঝাবার চেষ্টা করছি কিন্তু বুঝতে চাইছে না। আর এখন তো সে প্রশ্ন আর ওঠেই না। আমরা সবাই যখন বাবার উপস্থিতি সর্বদাই অনুভব করছি তখন এ বাড়ি কি বিক্রি করা সম্ভব?

ইন্দ্রকুমার হয়তো আরও কিছু বলতেন কিন্তু তাঁর মা-র চোখে চোখ পড়ায় চুপ করে গিয়ে পুনরায় প্রবল বেগে নখ খেতে শুরু করে দিলেন।

কিছুটা যেন তাঁর দাদাকে চুপ করানোর জন্য নবকুমার তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন— এবার কী আমার পালা?

সাগর বলল— আমি একটু বাড়িটা ঘুরে দেখব তারপরে হয়তো আপনার পালা আসবে। তবে, তার আগে আপনাদের সবাইকে একটা প্রশ্ন করতে চাই। রোজ আপনাদের মধ্যে সকলের আগে ঘুম থেকে কে ওঠেন?

প্রশ্নটা শুনে শ্রোতারা সকলেই একটু আশ্চর্য হলেন। কনকলতা বললেন— আমি। সূর্য ওঠার আগে স্নান করি তারপর পুজোয় বসি।

—ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গেসঙ্গে কি চা খান?

বেশ বিরক্তভাবে কনকলতা বললেন— হ্যাঁ, খাই। তবে আমি চা খাই কী না-খাই তার সঙ্গে গন্ধের কী সম্পর্ক?

—সেটা পরে বলব। চা কি আপনি নিজে করেন?

—না। মনোরমা করে এনে দেয়। কনকলতাকে আরও বিরক্ত মনে হল।

অবিচলিত সাগর হেডমাস্টারমশাই-এর দিকে তাকিয়ে বলল— স্যার, এই বাড়িতে ঢোকার সময় দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটা একতলা দু-কামরার ছোটো বাড়ি দেখলুম। ওটা কী?

হেডমাস্টারমশাই বললেন— ওটা বিদ্যাধরের কোয়ার্টার্স বলতে পারো। একটা ঘরে ও আর মনোরমা থাকে, অন্যটা ওদের পুজোর ঘর।

—আমি ওই বাড়িটা একবার দেখব স্যার। আপনি শ্রীলতাকে এই বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিন, আর বিদ্যাধরকে বলুন ঘরটা খুলে দিতে।

শ্রীলতা শঙ্কিত মুখে বলল— আমি স্যারের সঙ্গে যাব?

—হ্যাঁ, তুই যা। দুটো তলারই সব কটা ঘর দেখবি। কোন-কোন ঘরে গন্ধের তীব্রতাটা বেশি সেটা নোট করে নিবি।

ঘর থেকে বেরুনোর সময় ঘাড় ঘুরিয়ে সাগর দেখল নবকুমার ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন, তাঁর মুখের ব্যঙ্গাত্মক হাসিটি অনুপস্থিত। হেডমাস্টারমশাই-এর মুখেও আষাঢ়ের মেঘ। বিদ্যাধরের বাড়িটা সাগরের একা দেখতে যাওয়াটা তিনি পছন্দ করছেন না বলে মনে হল।

.

পরিদর্শন সেরে সকলে প্রায় একইসঙ্গে বসবার ঘরে ফিরে এল। সাগর শ্রীলতাকে জিগ্যেস করল— সব ঘর দেখলি?

শ্রীলতা বলল— হ্যাঁ, দেখেছি। বাড়ির ওই কোণায় দোতলায় ওঠার সিঁড়ির বাঁ-পাশের ঘরেই গন্ধটা সবচেয়ে বেশি। দোতলার দুটো ঘরেও আছে তবে অতটা বেশি নয়।

কনকলতা ব্যাজার মুখে বললেন— সিঁড়ির বাঁ-পাশের ঘরটা আমার। দোতলার যে ঘরদুটোর কথা মেয়েটি বলছে, তার একটা আমার মেয়ে ইরার আর অন্যটা নন্দর। এ ব্যাপারটা আমি অনেকদিনই লক্ষ করেছি।

সাগর অভিব্যক্তিহীন মুখে কথাটা শুনল, কোনো মতামত প্রকাশ করল না। তারপর কিছুক্ষণ চিন্তা করে মুখ তুলে ঘাড় নেড়ে বলল— না! আমি পারলুম না স্যার। এ রহস্য ভেদ করা আমার সাধ্য নয়।

গাম্ভারি হেসে নবকুমার বললেন— পারলে না তো মি. হোমস? আমি জানতুম পারবে না। আমি যেখানে পারিনি, তুমি তো সেখানে শিশু।

সাগর সহাস্যে কথাটায় সায় দিল।

.

গাড়িতে উঠে হেডমাস্টারমশাই বললেন— তুমি কি সত্যিই রহস্যটা সমাধান করতে পারোনি?

সাগর বলল— পেরেছি, স্যার।

—তবে তুমি মিথ্যে কথা বললে কেন?

—তার কারণ, যে জন্য রহস্যটা তৈরি করা হয়েছ সেটা একটা ভালো উদ্দেশ্যে, কোনো অসদুদ্দেশ্যে নয়। এ ব্যাপারটা প্রকাশ করলে শুধু যে সেই উদ্দেশ্যটা অসফল হতে পারত তাই নয়, আপনারও অসম্মান হতে পারত।

—আমার অসম্মান? আমি আবার এর মধ্যে কোত্থেকে এলুম? কী তুমি বুঝেছ বলো তো?

—স্যার, আমি যা বুঝেছি তা হল, আপনাদের বাড়িটা বিক্রি হওয়া বন্ধ করবার জন্যই এই রহস্যটা তৈরি করা হয়েছে। আপনার দাদার, ন্যায় বা অন্যায় যেকোনো কারণেই হোক, এখন অনেক টাকার দরকার। বাড়িটা বিক্রি হলে সেই টাকাটার একটা ব্যবস্থা হয়ে যেতে পারত। সম্ভবত, তার পরিমাণটা এতই বেশি যে আপনারা দুই ভাই মিলে যে তাঁকে টাকাটা দেবেন, সেটা হয়ে উঠছে না। অথচ, বাড়িটা বিক্রি হোক, তাও আপনারা বা আপনাদের মা মনেপ্রাণে চাইছেন না। সে কথাটা আবার মুখ ফুটে বলতেও পারছেন না পাছে আপনাদের দাদার মনে আঘাত লাগে। কাজেই এমন একটা রহস্য সৃষ্টি করা হল যাতে যতই প্রয়োজন থাকুক না-কেন আপনাদের দাদা এ ব্যাপারে অগ্রসর হতে না পারেন।

হেডমাস্টারমশাই চিন্তিত মুখে সাগরের কথা শুনছিলেন। বললেন— আশ্চর্য! তুমি ঠিকই ধরেছ। আমরাও বুঝতে পারছি যে দাদার এখন অনেক টাকার দরকার। কিন্তু, কত টাকা বা কীসের জন্য দরকার সেটা কিছুতেই বলছেন না। আমরাও জিগ্যেস করতে পারছি না। এদিকে এখানে এসেই বাড়ি বিক্রির জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। কয়েক জনকে কথা পর্যন্ত দিয়ে ফেলে ভয়ানক গোলমাল পাকিয়ে তুলেছিলেন। এখন অবশ্য সেসব বন্ধ হয়েছে।… তবে রহস্যটা আমারই তৈরি, সে কথাটা তোমার মনে হল কেন।

—লক্ষ্নৌ-এর আতর থেকে স্যার।

—খুলে বলো।

—আপনি ভেবেছিলেন যে আমি রহস্যটা ভেদ করতে পারব না এবং ঘটনাটা যে অতীন্দ্রিয় সেটা মোটামুটি প্রমাণ হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা যদি অলৌকিক কাণ্ড, প্রেতাত্মা কাণ্ড, প্রেতাত্মা, ভূত ইত্যাদি বাদ দিই, তাহলে স্যার ধরে নিতে হয় যে, কোনো মানুষই এই গন্ধ ছড়াচ্ছে। সে কে হতে পারে? আপনার মা যেরকম রাশভারি মহিলা, তাতে এ ধরনের ব্যাপার থেকে তাঁকে বাদ দিতেই হয়। আপনি বা আপনার ছোটোভাই ওখানে সবসময় থাকেন না। আর, আপনার দাদাকে দেখে বোঝাই যায় যে তিনিও হতে পারেন না। তাহলে বাকি থাকে বিদ্যাধর বা মনোরমা।

—আমি কিন্তু বাদ পড়ে গেছি।

—না, স্যার, যাননি। বিদ্যাধর আর মনোরমার ঘটে এত বুদ্ধি নেই যে তারা এমন চমৎকার একটি প্ল্যান ফেঁদে ফেলবে। তাদের দিয়ে এই কাজ কেউ করাচ্ছেন। এখন প্রশ্ন হল এটা তারা করেছে কীভাবে? ধোঁয়ার মাধ্যমে এটা হয়তো করা যেত কিন্তু তা করলে তৎক্ষণাৎ তারা ধরা পড়ে যেত। তাহলে দ্বিতীয় সম্ভাবনাটাই মেনে নিতে হয়, আর তা হল বিছানায় চাদর বা পর্দার সাহায্যে এটা করা হচ্ছে। তার মানে, মনোরমা কাচার সময় এই গন্ধ এগুলোতে লাগিয়ে দিচ্ছে এবং সেটা অম্বুরি তামাকের গন্ধ।

—আতর নয় কেন?

—তার কারণ, আতর দামি জিনিস। সারা বাড়িতে তার গন্ধ ছড়াতে গেলে সেটা অনেক খরচের ব্যাপার হয়ে যায়। কাজেই, কোনো কোনো ঘরে সে একফোঁটা দু-ফোঁটা করে মাঝে মাঝে দিয়ে আসে। ভোর বেলায় যখন সবাই ঘুমোন আর আপনার মা থাকেন পুজোর ঘরে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, ধরা পড়ার ঝুঁকি নিয়েও সে এ কাজ করছেই বা কেন? এখানে স্যার, আপনি ওর কাপড় কাচার পাগলামিটা কাজে লাগিয়েছেন। সে বুঝেছে যে এ বাড়ি বিক্রি করে সবাই যদি ছোটো ফ্ল্যাটে উঠে যায়, তাহলে তার কাপড় কাচা প্রায় বন্ধই হয়ে যাবে। এ ব্যাপারটা তার পক্ষে সহ্য করা প্রায় অসম্ভব।

হেডমাস্টারমশাই হাসতে হাসতে বললেন— সেটা অত্যন্ত সত্যি কথা। কিন্তু এটা যে আমিই তাকে বুঝিয়েছি, একথা তোমার মনে হল কেন?

—স্যার, এটা তো ঠিক যে তামাক বা আতর তাকে কেউ এনে দেয়। তামাকটা জোগাড় করা কঠিন নয়, সেটা হয়তো বিদ্যাধরই করতে পারত। শুধু যদি তামাকের গন্ধই পাওয়া যেত, তাহলে আপনি এবং আপনার ছোটোভাই, দু-জনকেই সন্দেহ করতুম। কিন্তু ব্যাপারটা জোরদার করবার জন্য আতরটা এনেই আপনি ধরা পড়ে গেলেন। লক্ষ্নৌ থেকে ওই আতরটি এনে এখানে ব্যবহার করা আপনার ছোটোভাই-এর পক্ষে অসম্ভব না হলেও অত্যন্ত কঠিন। অন্যদিকে, আপনার ছোটো ছেলে যে কানপুরে থাকে, তার কাছে এই আতর জোগাড় করে আপনাকে পাঠিয়ে দেওয়া সহজ ব্যাপার।

হেডমাস্টারমশাই সপ্রশংস গলায় বললেন— চমৎকার! অমন অ্যানাটিক্যাল বুদ্ধি তোমার অথচ অঙ্কে সত্তরের ওপরে পাওনা কখনো। কেন? এমন করলে কখনো ফাইনালে স্ট্যান্ড করতে পারব না। শোনো সাগর, কাল থেকে তুমি স্কুলের পরে রোজ একঘণ্টা আমার কাছে অঙ্ক শিখবে, বুঝেছ?

 মিস অনুরাধা পলের হত্যারহস্য

সন্ধে হয়ে এসেছে। সাগর সবে বসেছিল পড়ার টেবিলে। ঠিক তখনই দরজায় বেল বাজল। একটু পরে শ্রীলতা ঘরে ঢুকে বলল— দাদা, গুরুদাসবাবু এসেছেন। বাবা তোকে বসবার ঘরে ডাকছে।

তৎক্ষণাৎ তড়াক করে উঠে পড়ল সাগর। বসবার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শুনল সি আই ডি-র বড়োকর্তা গুরুদাসবাবু বলছেন— আমি একেবারেই বেশি সময় নেব না, মিসেস রায়চৌধুরি। আমি কী জানি না যে সাগরের ফাইনাল পরীক্ষার আর দেরি নেই? কিন্তু, কী করব, বলুন? একজন নিরীহ, নির্বিরোধ, পরোপকারী মধ্যবয়স্কা মহিলা নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। কে খুন করেছে বা কেন, তা আমরা এখনও বের করতে পারিনি। আমাদের সরকারি পদ্ধতিতে এই রহস্যের সমাধান হতে দেরি হবেই আর সেই সময়ের মধ্যে যারা অপরাধী, তারা আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। সেটা কি আপনি চাইবেন? আমার দৃঢ় ধারণা আপনার ছেলে অন্যান্য বারের মতোই খুব কম সময়ের মধ্যেই অপরাধীদের মুখোশ খুলে দিতে পারবে।

অতসী হাঁড়িপানা মুখ করে বললেন— কোথায় ঘটেছে এই ব্যাপারটা?

আরামবাগের কাছে শিবনাথপুর বলে একটা গ্রাম আছে। নামেই গ্রাম, এখন রীতিমতো শহর। আরামবাগ মিউনিসিপ্যালিটির মধ্যেই।

—ও বাবা, সে যে অনেক দূর!

—দূর বেশি নয়, তবে আমি সাগরকে কখনোই ওখানে যেতে বলব না। ও যদি এখানে বসে সব কথা শুনে রহস্যভেদ করতে পারে, ভালো। নইলে, কোতুলপুর থানার ওসি আর আমি মিলে যা পারি তাই করব।

অতসীর গভীর ভ্রূকুটি একটু নরম হল। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন— এখানে বসেই করবে? তবে তাই করুক। তবে দেখবেন যেন বেশি সময় নষ্ট না করে।

—আপনার কোনো চিন্তা নেই। আমি সমস্ত ডিটেলস নিয়ে এসেছি। ফটোগ্রাফও আছে। আশা করি এতেই হয়ে যাবে। আর, যদি না-হয়, তাহলে আর কিছু করবার নেই।

এই কথার মধ্যে সাগর ঘরে ঢুকল।

.

গুরুদাসবাবু বলতে শুরু করলেন— যে ভদ্রমহিলা খুন হয়েছেন, তাঁর নাম মিস মেরী অনুরাধা পল। বয়েস পঞ্চাশের কাছাকাছি। শিবনাথপুর গার্লস হাই স্কুলের অঙ্কের টিচার। স্কুলটা বিরাট আর তার খুব সুনাম। ওই তল্লাটের এক নম্বর স্কুল বলা যায়। প্রায় পঁচিশ বছর আগে এমএ পাশ করে এই স্কুলে ঢুকেছিলেন মিস পল। সেই থেকে এখানেই থেকে গেছেন। সিনিয়ার মোস্ট টিচার ছিলেন, প্রিন্সিপাল মিসেস বন্দনা ঘোষাল ছুটি নিলে উনিই ইনচার্জের কাজ করতেন।

সাগর বলল— এই স্কুলে আসবার আগে কোথায় ছিলেন? মানে বাড়ি কোথায় ছিল?

—সেটা আজ আর কারোর মনে নেই। তবে, স্কুলের জিয়োগ্রাফির টিচার অর্পিতা ভট্টাচার্য বললেন যে, সম্ভবত উনি বাঁকুড়া থেকে এসেছিলেন। ওঁর কথায় সেরকম একটা টান ছিল। স্কুলের রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ওঁর পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস দেওয়া ছিল কেয়ার অফ ডাক্তার জন বার্তোস, আরামবাগের একটা ঠিকানায়। সেখানে খোঁজ করে দেখা গেছে ডা. বার্তোস ১৯৯৯ সালের মার্চ মাসে মারা যান। তখন তাঁর বয়েস হয়েছিল একাশি বছর। তারপর থেকে মিস পলের ঠিকানা রঘুনাথপুরের নেতাজি কলোনির একটি একতলা বাংলো।

—আরামবাগের এঁদের প্রতিবেশীরা কী বললেন এঁদের সম্পর্কে?

—ডা. বার্তোস ছিলেন মিতভাষী গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। তবে, রোগীর সেবায় কোনো ত্রুটি রাখতেন না। সকলেই তাঁকে ভালোবাসত কিন্তু কেউই তাঁর ঘনিষ্ঠ হতে পারেনি। অনুরাধা খুব সম্ভবত তাঁর ভাগনি। উনিও মামার মতোই গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন। স্কুল থেকে ফিরে মামার ক্লিনিকে নার্সের কাজ করতেন আর অন্যান্য ব্যাপারে সাহায্য করতেন। মামা মারা যাওয়ার পর, অনুরাধা শিবনাথপুরে নেতাজি বাসস্ট্যান্ডের কাছে বাংলোটা ভাড়া নিয়ে একাই থাকতেন। সকালে বাগান করতেন, রাত্রে পড়াশুনো। প্রত্যেক রোববার বাসে করে আরামবাগের সেন্ট ক্রিস্টোফার চার্চে যেতেন। শান্ত নির্বিরোধ নিয়মানুবর্তী জীবনযাত্রা। তবে প্রতিবেশী বা সহকর্মীদের কারোর কোনো বিপদ হলে যথাসাধ্য সাহায্য করতেন। রাত জেগে সেবা করতেন। কিন্তু গায়ে পড়ে কারোর উপকার করতে যেতেন না।

—বুঝতে পেরেছি। উনি কি আর কিছু করতেন বলে জানা আছে?

—আছে। ভদ্রমহিলা মাঝে মাঝেই ইংরেজি কাগজে বা ম্যাগাজিনে অঙ্কশাস্ত্রের ওপরে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ লিখতেন। শুনেছি, উনি বর্ধমান ইউনিভার্সিটি থেকে বিএ পরীক্ষায় প্রথম আর এমএ-তে তৃতীয় হয়েছিলেন।

—ওঁর টাকা পয়সা কীরকম ছিল? একা মানুষ, মাইনে অবশ্যই ভালোই পেতেন। বিলাসিতাও বিশেষ কিছু ছিল না মনে হয়। কাজেই, জমানো টাকা বেশ ভালোই থাকার কথা।

—তা ঠিক, কিন্তু তা ছিল না। ওঁর মাইনের একটা মোটা অংশ যেত আরামবাগের চার্চ পরিচালিত একটি হাসপাতালে। বাকিটার অনেকটাই খরচ হত শিবনাথপুরে স্থানীয় জনসেবায়। জামানো টাকা বলতে ছিল ওঁর স্কুলের পাশে একটা ব্যাঙ্কে হাজার পাঁচেক টাকা।

—বাড়িতে ক্যাশ কিছু ছিল?

—ছিল কিছু, কিন্তু যথাস্থানেই ছিল। তুমি ভাবছ যে টাকা পয়সার জন্যে কেউ ওঁকে খুন করেছে, তা বোধ হয় না। যদিও কোতলপুর থানার ওসি অরূপ কুণ্ডুর এইরকম ধারণা। আমার কিন্তু তা মনে হয় না। আমি কেন অন্যরকম ভাবছি সেটা মিস পল কীভাবে খুন হয়েছিলেন তা শুনলে বুঝতে পারবে।

—কীভাবে?

গুরুদাসবাবু একটা ফোটোগ্রাফ টেবিলের ওপর রেখে বললেন— এটা মিস পলের বাংলো। পেছনে যে উঁচু পাঁচিলটা দেখা যাচ্ছে তার ওপাশে নেতাজি বাসস্ট্যান্ড। বাংলোর সামনে বাগান তার আগে রাস্তা। তিন দিকে বাউন্ডারি ওয়াল বলতে একটা ফুট তিনেক উঁচু বাঁশের বেড়া। বাংলোর দু-পাশে ফাঁকা জমি। অনুরাধা নিহত হন গত পরশুর আগের দিন, ২৩ জানুয়ারি, মঙ্গলবার, সকাল ন-টায়। তখন নেতাজি বাসস্ট্যান্ড আর অন্য জায়গায় নেতাজির জন্মদিন পালন করা হচ্ছিল। চারদিকে মাইকে নানারকম দেশাত্মবোধক গান বাজছিল, বক্তৃতা হচ্ছিল। অনুরাধা তখন বাগানে ঘুরে ঘুরে ফুল গাছগুলো দেখাশুনো করছিলেন। সেইসময় তাঁকে গুলি করা হয়।

—কোথা থেকে গুলি করা হয় বোঝা গেছে?

—হ্যাঁ, রাস্তা থেকে। রাস্তায় তখন অনেক লোক যাতায়াত করছিল। কেউ যাচ্ছিল বাসস্ট্যান্ডে, কেউ বাজারে। অনেকে আবার বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে অনুরাধার সঙ্গে দুটো কথা বলে নিচ্ছিল। হঠাৎ তাঁকে পড়ে যেতে দেখে তাদের দু-চারজন গেট খুলে ভেতরে ঢুকে ব্যাপারটা দেখতে পায়। গুলি লেগেছিল গলায়। সঙ্গেসঙ্গে মৃত্যু হয়েছিল।

—দু-পাশের ফাঁকা জমিতে কেউ ছিল না?

—না।

—না থাকারই কথা। থাকলে তার ওপরে লোকের নজর পড়ত। কেউ গুলির শব্দ শুনেছিল?

—না। মাইকের শব্দে সেই শব্দ বোধ হয় চাপা পড়ে গিয়েছিল। তবুও বলব, বেড়ার এপাশ থেকে যদি গুলি করা হয়ে থাকে তাহলে সে শব্দ কারোর না-কারোর শোনবার কথা। আর একটা কথা। যে গুলিটা অনুরাধার শরীরে পাওয়া গেছে সেটা একটা বিদেশি পিস্তল থেকে ছোড়া হয়েছিল, দিশি ওয়ান-শটার নয়। তার মানে, অবশ্যই কোনো সাইলেন্সার লাগানো রিভলভার ব্যবহার করা হয়েছিল। সেটা একটা বেশ বড়ো লম্বাটে জিনিস। শীতকালে বলে তখন পথচারীদের অনেকের গায়েই আলোয়ান। তার মধ্যে সেটা লুকিয়ে রাখা হয়তো কঠিন নয়, কিন্তু অতগুলো লোকের মধ্যে দাঁড়িয়ে সেটা কাউকে না দেখতে দিয়ে ঠান্ডা মাথায় গুলি চালানো তা-ও এমনভাবে যে এক গুলিতেই কাজ শেষ, সেটা কিন্তু সহজ ব্যাপার নয়।

—মানে, এক্সপার্ট প্রফেশনাল ভাড়াটে খুনির কাজ। ডাকাতির ব্যাপার নয়।

গুরুদাসবাবু মাথা নেড়ে বললেন— ঠিক তাই। কিন্তু কেন? মিস পলের মতো একজন নিতান্ত সাধারণ মাঝবয়সি শিক্ষিকাকে একগাদা টাকা খরচা করে ভাড়াটে খুনি লাগিয়ে মারবার দরকার পড়ল কার, বা কেন?

সাগর অন্যমনস্কভাবে থেমে থেমে বলল— আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি?

—অবশ্যই।

—এক নম্বর প্রশ্ন। মিস পলের কি কোনো বন্ধুবান্ধব ছিলেন যাঁদের বাড়িতে উনি যাতায়াত করতেন বা তাঁদের কেউ কেউ ওঁর বাড়িতে আসতেন?

—না, ওঁর কোনো বন্ধুবান্ধব বা ইয়ারদোস্ত কেউই ছিল না, থাকবার কথাও নয়।

—স্কুলের শিক্ষিকাদের কেউ?

—কেউ না। তাঁরা অনুরাধাকে অপছন্দ কখনোই করতেন না, কিন্তু ঘনিষ্ঠতাও করতে পারতেন না।

—কেউ আসত না এই বাড়িতে?

—আসত। তিনজন। প্রথম, নাসিমা খাতুন, রান্না করত। দুপর বেলা টিফিন ক্যারিয়ারে স্কুলে লাঞ্চ নিয়ে যেত। দ্বিতীয়, তার হাসব্যান্ড আইনুল হক। তার কাজ ছিল ঘরদোর পরিষ্কার করা, দুধ আনা, ট্যাক্স জমা দেওয়া আর অন্যান্য বাইরের কাজ করা। তৃতীয়, সুবিমল সরকার, স্কুলের অ্যাকাউন্টেন্ট। ইনি মাসের প্রথমে মিস পলের মাইনেটা ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে তাঁর পাসবইটা আপডেট করে বাড়িতে পৌঁছে দিতেন।

সাগর বেশ চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করল— এদের সম্পর্কে কিছু বলুন।

গুরুদাস বললেন— নাসিমা বাংলাদেশের মেয়ে। বয়েস তিরিশের বেশি নয়। সাদামাটা ভালো মানুষ। আইনুলের বয়েস পঁয়তাল্লিশ, আদি বাড়ি বিহারের ছাপরায়। তিন-চার পুরুষ আছে আরামবাগের কাছে মাঝডাঙা গ্রামে। পুলিশের খাতায় আইনুলের নাম আছে। বছর কুড়ি আগেও সে আরামবাগ, কোতুলপুর, শিবনাথপুর অঞ্চলে ডাকাতি করে বেড়াত। কয়েক বার জেলও খেটেছে। কিন্তু, নাসিমা আর অনুরাধা মিলে ওকে সৎপথে ফিরিয়ে আনে। অনুরাধা তাকে বর্ধমানে একটা ইনস্টিটিউটে ভরতি করে দরজির কাজ শেখান। এখন অনেক বছর হল সে আর নাসিমা দিনে অনুরাধার বাড়িতে কাজ করে আর সন্ধে বেলা বাড়ি ফিরে রাতে দরজির কাজ করে।

—আইনুল বোধ হয় এখন হাজতে।

—ঠিক। অরূপের দৃঢ় বিশ্বাস যে একবার অপরাধ জগতে ঢোকে সে আর বেরোতে পারে না। তার থিয়োরি হল যে আইনুল তার পুরোনো বন্ধুদের দিয়ে সে আর নাসিমা ওখানে ঢোকবার আগেই মিস পলকে খুন করিয়েছে। উদ্দেশ্য, যাতে তাদের ওপরে কারোর কোনো সন্দেহ না পড়ে আর গোলমাল মিটে গেলে এই বাংলোটা অবলীলাক্রমে দখল করা যায়। আমার মনে হয় এই থিয়োরিটা আদালতে ধোপে টিকবে না। বাংলোটা যে ভাড়া বাড়ি ছিল, এই তথ্যটা অরূপ পাত্তা দিতে চাইছে না।

—আপনি কিন্তু একজনের কথা এখনও বলেননি।

—কে, অ্যাকাউন্টেন্ট সুবিমল সরকার? তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলবার নেই। ষাটের কাছাকাছি বয়েস, চোখে মোটা কাচের চশমা, রোগা কোলকুঁজো ডিসপেপটিক চেহারা। অত্যন্ত নার্ভাস প্রকৃতির লোক। অল্পেই বেশি বিচলিত হয়ে পড়েন। ঘটনার দিন সকাল বেলা একটা পোর্টফোলিও ব্যাগ নিয়ে অনুরাধার বাংলোয় এসেছিলেন হত্যাকাণ্ডটা ঘটে যাবার মিনিট কুড়ি বাদে। এসে এত লোকজন, পুলিশ, ডাক্তার, অ্যাম্বুলেন্স আর রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখে কাঁপতে কাঁপতে বারান্দার ওপর শুয়েই পড়লেন। তখন আবার তার মাথায় জল-টল দিয়ে একটু সুস্থ করে রিকশা করে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

সাগর মুখ তুলে বলল— ২৩ তারিখে সকাল বেলা পোর্টফোলিও ব্যাগ নিয়ে তিনি মিস পলের বাড়িতে গিয়েছিলেন কেন, সে কথা জিজ্ঞাসা করেননি মি. কুণ্ডু?

—না। ও অঞ্চলে সকলেই সরকারবাবুকে চেনে। নিতান্ত নিরীহ মানুষ, বিশাল পরিবার নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। তাঁর পক্ষে কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটানো আর এভারেস্টের ডগায় ওঠা একই ব্যাপার। আর ব্যাগটা? একজন অ্যাকাউন্ট্যান্টের বগলে পোর্টফোলিওব্যাগ থাকবে, সেটা কারোর অস্বাভাবিক বলে মনে হয়নি।

একটু চুপ করে থেকে সাগর বলল— আপনি যে মিস পলের নিয়মানুবর্তী জীবনযাত্রার কথা বললেন, তাতে কি সম্প্রতি কোনো পরিবর্তন ঘটেছিল?

গুরুদাসবাবু হাত নেড়ে বললেন— এটা আমার জানা নেই। কুণ্ডুকে বলছি নাসিমা আর আইনুলকে জেরা করে জেনে নিতে। কাল তোমাকে জানাব।

—সেইসঙ্গে আরও কয়েকটা বিষয় জেনে নিতে বলবেন। এক, মিস পল স্কুলে কোনো টাকাপয়সা সংক্রান্ত গোলমালে জড়িয়ে পড়েছিলেন কি না। দুই, ওঁর স্বভাবে কোনো দুর্বলতা ছিল কি না। যেমন— মিষ্টি খাওয়ার প্রতি অতিরিক্ত লোভ বা অল্পেই রেগে যাওয়া বা এই ধরনের কিছু। তিন, ব্রেকফাস্ট কি উনি নিজেই বানিয়ে নিতেন না নাসিমা এসে বানাত? সকালে কখন আসত নাসিমা আর কখন যেত? চার, স্কুল শুরু হয় ক-টার সময় আর শেষ হয় কখন।

—তোমার শেষ দুটো প্রশ্নের উত্তর আমি জানি। নাসিমা আর আইনুল আসত সাড়ে ন-টা থেকে পৌনে দশটার মধ্যে। ঘটনার দিনও দু-জনে পৌনে দশটা নাগাদ এসেছিল। তবে মিস পল ব্রেকফাস্ট মনে হয় নিজেই বানাতেন। কারণ, নাসিমারা এলে তাদের হাতে বাড়ির চাবি দিয়ে স্কুলে চলে যেতেন। কাছেই রিকশস্ট্যান্ড, সেখান থেকে দশ মিনিটের মধ্যে স্কুলে পৌঁছে যেতেন। স্কুলের সময় দশটা থেকে চারটে, শনি আর রবিবার স্কুল বন্ধ। অনুরাধা রোজ সাড়ে চারটের ভেতরে বাড়ি পৌঁছতেন আর সাতটা নাগাদ নাসিমা বাড়ি যেত। আইনুল তার আগেই চলে যেত। আর তোমার দু-নম্বর প্রশ্ন, মানে স্কুলে টাকাপয়সার কোনো গণ্ডগোলের ব্যাপারে বলতে পারি, মিস পল এত সৎ ছিলেন যে তাঁর পক্ষে, বিশেষত সুবিমল সরকারের মতো একজন ভীরুপ্রকৃতির লোকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে, এই ধরনের কোনো স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে পড়া একেবারেই অসম্ভব।

বলে উঠে দাঁড়িয়ে জোরগলায় বললেন— দেখুন মিসেস রায়চৌধুরি, আমি মোটেই বেশি সময় নিইনি। তবে, সাগরের কতগুলো প্রশ্নের জবাব পেলে কাল আমি সারাদিনে কোনো একসময়ে আসব।

তারপর গলা নামিয়ে বললেন— আজ রাত্রেই কুণ্ডুর সঙ্গে যোগাযোগ করছি। মনে হয়, কাল সকালেই উত্তর পেয়ে যাব।

.

গুরুদাসবাবু চলে গেলে, দীপঙ্কর বললেন— কিছু বুঝতে পারলি?

সাগর মাথা নাড়ল। বলল— না, পারিনি। তবে, একটা খুব আবছা ছবি দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে, খুনটা যে করেছে সে যে ভাড়াটে খুনি তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু যে খুন করিয়েছে, সে একটি ভয়ংকর ক্রিমিন্যাল। হেন দুষ্কর্ম নেই যা সে করতে পারে না।

.

শনিবার সাগর বসবার ঘরেই বসেছিল। গুরুদাসবাবু এগারোটার মধ্যে এসে গেলেন। একটু চিন্তিত মুখে কোনোরকম ভনিতা না-করে বললেন— তোমার প্রশ্নের উত্তরগুলো এনেছি। ব্যাপারটা যে একটু গোলমেলে হয়ে গেল।

সাগর হেসে উঠে বলল— কী জানলেন বলুন, গুরুদাসকাকা।

—এক নম্বর উত্তর। নাসিমা জানিয়েছে যে গত মাস তিনেক হল, মিস পলের নিয়ম-বাঁধা জীবনযাত্রায় একটা পরিবর্তন হয়েছিল। এই সময়ে মাঝে মাঝেই সন্ধে ছ-টা সাড়ে ছ-টা নাগাদ সুবিমল সরকার পোর্টফোলিয়ও ব্যাগে ভরে কিছু ফাইল তাঁকে দিতে আসতেন আর দিয়েই চলে যেতেন। অনুরাধা অনেক রাত অবধি সেই ফাইলগুলো পড়তেন আর খাতায় কী সব লিখতেন। দু-চারদিন পরে সেই ফাইলগুলো একটা বাজারের থলেতে ভরে নিয়ে স্কুলে যেতেন।

সাগর ভুরু কুঁচকে বলল— অনেক রাত অবধি ফাইল দেখতেন, সেটা নাসিমা জানল কী করে?

—এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে নাসিমার একটি কথায়। মিস পল নাকি সুবিমল সরকারের ফাইল যে ক-দিন কাছে রাখতেন, সে ক-দিন বিকেল বেলা ঘুমুতেন। অন্যান্য দিন নয়।

—যে খাতায় মিস পল কাজ করতেন সেই খাতাগুলো আপনারা পেয়েছেন?

—পেয়েছি তা জোর করে বলি কী করে? ভদ্রমহিলার পড়বার ঘরে অসংখ্য খাতা আর তাদের সব কটাতেই নানা রকমের ভয়ানক জটিল অঙ্ক কষা। সেসব অঙ্কে দাঁত ফোটানো ক্ষমতা আমাদের নেই। কাজেই সেসব কার অঙ্ক, কীসের অঙ্ক তা বোঝা আমাদের সাধ্যাতীত। তবে তিনি ইদানীং কোনো একটা গোলমালে জড়িয়ে পড়ছিলেন ঠিকই। কিন্তু সেটা স্কুলে না অন্যত্র তা বোঝা যাচ্ছে না।

—কী কী বোঝা যাচ্ছে?

—নাসিমা বলেছে যে গত কয়েক মাস যাবৎ তার মনিব খুব চিন্তিত হয়ে থাকতেন। ফাইল দেখতে দেখতে চেয়ার থেকে উঠে ঘরের ভেতর পায়চারি করতেন। কখনো একটা ইজিচেয়ারে বসে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। সেসময় তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলে বিরক্ত হতেন। উনি আগে এরকম ছিলেন না। আর তোমার তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর হল যে মিস পল ভীষণ একরোখা মানুষ ছিলেন। এটা একরকম দোষই বলতে পারো। নিজে যা ভালো মনে করতেন সেটা করে ছাড়তেন।

—তার মানে বোঝা যাচ্ছে যে ওই ফাইলগুলোয় এমন কিছু ছিল যা মিস পলকে বিচলিত করেছিল এবং খুব সম্ভবত সেই জন্যেই এই ঘটনাটা ঘটে গেল। সুবিমল সরকারকে আপনারা এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন?

—হ্যাঁ, করেছি। কাল রাত্রেই। সুবিমল বলছেন যে কিছুদিন যাবৎ তিনি স্কুলকে না-জানিয়ে সন্ধ্যে বেলা ভুবনেশ্বরী কোল্ডস্টোরেজে একটা পার্টটাইম কাজ নিয়েছেন। কিন্তু আলুর হিমঘরের হিসাবপত্রের ব্যাপারটা তিনি কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। অনুরাধা মিস খুব ভালো অঙ্ক জানে। তাই তাঁর কাছে ব্যাপারটা বুঝে নিতে যেতেন সুবিমল। বিরাট সংসার, শুধু স্কুলের মাইনেতে চলে না। তাই এই কাজটা তাঁর বিশেষ প্রয়োজন। এই জন্যেই তিনি অনুরাধা মিসের সাহায্য চেয়েছিলেন। তিনিও খুশি হয়ে রাজি হয়েছিলেন।

—এর মানে হল এই হিসাবপত্রের মধ্যে এমন একটা গরমিল মিস পল দেখতে পেয়েছিলেন যা তাঁকে বিচলিত করে তুলেছিল। এখন কথা হল একটা কোল্ডস্টোরেজের হিসাবের গণ্ডগোল থাকলে মিস পল কি এতটা উত্তেজিত হয়ে পড়বেন আর এমন কাজ করে বসবেন যাতে তাঁর প্রাণটা চলে যায়?

—ঠিক বলেছ। তার মানে, সুবিমল সত্যি কথা বলছেন না। তাহলে এখন আমাদের কর্তব্য কী? সুবিমলকে গ্রেপ্তার করব? তাতে কিন্তু আমার মন থেকে সমর্থন পাচ্ছি না।

সাগর বলল— আজ শনিবার, কালও স্কুল ছুটি। আমার মনে হয় এই সুযোগে স্কুলের সমস্ত কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করে সোমবার থেকে একটি স্বতন্ত্র অডিটর বা হিসাবরক্ষক সংস্থাকে দিয়ে সেগুলো আপনারা পরীক্ষা করান। আমি নিশ্চিত যে তাহলেই সব রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে। এই কাজটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করা দরকার; নইলে সব কাগজপত্র হয় আগুন লেগে পুড়ে যাবে নয়তো চুরি হয়ে যাবে। অরূপবাবু আইনুলকে হাজতে ঢুকিয়ে একটা ভালো কাজ করছেন। পুলিশ ভুলপথে যাচ্ছে দেখে বোধ হয় আসল অপরাধী হুড়োতাড়া করে হিসাবের খাতাগুলো লোপাট করেনি। আর সামনেই যে রিকশাস্ট্যান্ড আছে সেখানে খোঁজ নিন যে গত রবিবার, ২১ তারিখে, মিস পল চার্চ থেকে ফিরে কোথাও গিয়েছিলেন কি না।

গুরুদাসবাবু উঠে দাঁড়ালেন। বললেন— বুঝেছি। আমি এখনি ব্যবস্থা নিচ্ছি। আর এর ফলশ্রুতি কী দাঁড়াল, সেটাও দু-এক দিনের মধ্যেই তোমাকে জানিয়ে যাব। তোমার কি মনে হয় যে সুবিমল সরকার এর মধ্যে আছেন?

—থাকতে পারেন। তবে আমার এখনও পর্যন্ত ধারণা যে উনি এর মধ্যে নেই। থাকলে কোল্ডস্টোরেজে পার্টটাইম কাজ নিতেন না। মনে হয়, সুবিমলবাবু নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছেন।

বুধবার স্কুল থেকে ব্যাডমিন্টন খেলে বাড়ি ফিরে সাগর দেখল বসবার ঘরে গুরুদাসবাবু আর অন্য একজন কমবয়সি পুলিশ অফিসার বসে রয়েছেন।

গুরুদাসবাবু সহাস্যে বললেন— এসো সাগর, আমরা তোমার জন্যেই বসে রয়েছি। আর এই যে ইনি তোমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন, ইনি হলেন…

সাগর একটা চেয়ারে বসে বলল— জানি, অরূপবাবু, কোতুলপুর থানার ওসি। বলুন, রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে?

গুরুদাসবাবু বললেন— শোনো, বলছি। রবিবার সকালে আমরা স্কুলে গিয়ে সমস্ত হিসাবের খাতাপত্র বাজেয়াপ্ত করি। সঙ্গেসঙ্গে হুলুস্থুল পড়ে গেল। স্কুলের গভর্নিং বডির প্রেসিডেন্ট গৌরহরি সাহা আর সেক্রেটারি বিজন সামন্ত থানায় এসে হাজির। গৌরহরি সাহা ধর্মপ্রাণ সৎ লোক বলে ওই অঞ্চলে পরিচিত। শিবনাথপুর গার্লস আর বয়েজ হাই স্কুল দুটোই দাঁড়িয়ে আছে তাঁর বাবা কৃষ্ণহরি সাহার দান করা জমির ওপরে। গৌরহরি কম বয়সে দুটো স্কুলেই পড়াতেন। স্কুলের সব ফাংশনেই তিনি হাজির থাকেন। সেক্রেটারি বিজন সামন্ত স্থানীয় লোক কিন্তু নামকাটা সেপাই। অল্প বয়েসে নানারকম বেআইনি আর অসমাজিক কাজকর্ম করে অনেক টাকা করেন। তারপরে পলিটিক্স। তখন তাঁর রমরমা দেখে কে? কামারপুর আর শিবনাথপুরে দুটো কোল্ডস্টোরেজ, আরামবাগে একটা শপিং সেন্টার। তারপরে এম এল এ। এখন জনপ্রতিনিধি হয়ে স্কুলের সেক্রেটারি হয়ে বসেছেন, কেউ আটকাতে পারেনি। একজন রিকশাওয়ালার কাছে জানা গেল যে রবিবার বিকেলে এই বিজন সামন্তর কাছেই গিয়েছিলেন অনুরাধা।

—বাঃ। উনিই তো তাহলে নাটের গুরু। উনিই স্কুলের অ্যাকাউন্টস-এ কারচুপি করে হাজার হাজার টাকা সরিয়েছেন আর একরোখা মিস পল যে সেটা ধরে ফেলেছেন সেটা রবিবার জানতে পেরে মঙ্গলবারেই তাঁকে খুন করিয়েছেন। তাঁর বোধ হয় আরও ভয় ছিল যে মিস পল খবরের কাগজে লেখেন যখন, তখন সেখানে ব্যাপারটা প্রকাশ করে দিতে পারেন। ঠিক বলেছি?

—একদম। শুধু তোমার অনুমানে একটু ভুল আছে। বিজন সামন্ত হাজার হাজার নয়, লক্ষ লক্ষ টাকা সরিয়েছেন। আমাদের জেরায় সুবিমল সে কথা স্বীকার করেছেন। কোথাও যে একটা বিরাট গোলমাল আছে সেটা সুবিমল আন্দাজ করতে পারেন মাস চারেক আগে। সেটা কনফার্ম করবার জন্যে মিস পলের কাছে গিয়েছিলেন। উনি স্কুলটাকে এত ভালোবাসতেন যে সুবিমলের কথা শুনে হিসাব পরীক্ষা করতে রাজি হন। সুবিমল ভাবতেই পারেননি যে স্কুলের টাকা নয়-ছয় হচ্ছে দেখে অনুরাধা এত রেগে যাবেন যে একেবারে খোদ বিজন সামন্তর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে ধমকে দিয়ে আসবেন। সুবিমলের সে সাহস ছিল না। না থাকারই কথা। এই তল্লাটে সবাই সামন্তকে যমের মতো ভয় পায়। সুবিমল ফেঁসে যাবার আগেই সময় বুঝে পালাবার পথ হিসেবেই কোল্ডস্টোরেজের চাকরিটা নিয়েছিলেন।

—গৌরহরি সাহা এর মধ্যে ছিলেন না?

—না, উনিই মিস পলের খুনের খবর পেয়ে সঙ্গেসঙ্গে মন্ত্রী শক্তিপদ নস্করকে কেসটা সি আই ডি-র কাছে পাঠাতে বলেন। শক্তিপদবাবু গৌরহরিবাবুকে অত্যন্ত শ্রদ্ধ করেন, তাঁর প্রিয় ছাত্র ছিলেন, শিবনাথপুর স্কুল থেকেই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছেন। তিনি তৎক্ষণাৎ আমাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাঁর অনুমতি নিয়েই আমরা বিজন সামন্তকে গ্রেপ্তার করেছি।

সাগর বলল, কিন্তু খুনটা করল কে?

গুরুদাসবাবু সহাস্যে বললেন, চিন্তা কোরো না। মাথাটা যখন ধরেছি, তখন কানটা ধরতে বেশি দেরি হবে না।

 মহারাজার গুপ্তধন

পর্যটকরা বাস থেকে নামতেই তাঁদের অভ্যর্থনা করবার জন্য টুরিস্ট অফিসার এগিয়ে এলেন। লম্বা-চওড়া-টাকমাথা-মাঝবয়েসি ভদ্রলোক, পরনে রংচঙে বুশশার্ট আর সাদা ট্রাউজার্স, মুখে ভুবনমোহন হাসি। কেতাদুরস্তভাবে হাত নেড়ে বললেন— টুরিস্ট ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে আপনাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি হরিসিং রাঠোর, আপনাদের টুরিস্ট অফিসার। আপনাদের এই বাঘেলাগড় দুর্গ দেখাবার দায়িত্ব আমার।

বলে খুব বিনীতভাবে সবাইকে নিয়ে অফিসে ঢুকলেন।

নিজের টেবিলে বসে হরিসিং বললেন— আপনারা ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে এসেছেন, কাজেই আপনাদের সবকিছু বেশ বিস্তারিতভাবে দেখাতে হবে। ফাঁকি দিলে চলবে না। এই দুর্গের শুধু দ্রষ্টব্যগুলো দেখালেই তো হবে না, তার রাজবংশের ইতিহাস, স্থাপত্য ও শিল্পকলার ইতিহাস, এসবও তো জানাতে হবে। তা, এই ব্যাপারে যিনি সবচেয়ে অভিজ্ঞ, তাঁকেই আপনাদের গাইড হিসেবে দিচ্ছি। এর পরিবার বংশানুক্রমে এই দুর্গেই বাস করে আসছেন। কাজেই, এই দুর্গের সবকিছু তাঁর নখদর্পণে। ওই যে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, উনিই আপনাদের গাইড হবেন— শ্রীবিজয়কুমার মীনা।

বিজয়কুমার ছোটোখাটো, রোগাটে মানুষ, পরনে ধুতি আর ছাইরঙের হাঁটু পর্যন্ত লম্বা একটি অতি প্রাচীন শেরওয়ানি। তবে, তাঁর গালভাঙা মুখে একজোড়া প্রকাণ্ড গোঁফ তাঁর অতীত আভিজাত্যের সাক্ষ্য দিচ্ছে।

হরিসিং-এর প্রশংসাবাক্যে বিজয়কুমার কিছুমাত্র পুলকিত হয়েছেন বলে মনে হল না। গম্ভীর মুখে বললেন— আপনারা আমার সঙ্গে আসুন।

দুর্গটা যেন কেমনধারা। অনেকটা গোলকধাঁধার মতো। ঘরের ভেতর দিয়ে ঘর, এখানে-ওখানে সরু সরু অন্ধকার সিঁড়ি কোনোটা ওপরে কোনোটা নীচে চলে গেছে, বারান্দা বা করিডরগুলো একটু গিয়েই এদিক-ওদিক বাঁক নিয়েছে। বিজয়কুমার বললেন যে এসবই করা হয়েছিল রাজপরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে। ফলে, সারা দুর্গটাতেই একটা গা-ছমছম করা ভাব। মনে হয় যেন সব ঘরেই ষড়যন্ত্রীরা ফিসফিস করে কথা বলছে নয়তো ওঁত পেতে বসে আছে।

সমস্ত দুর্গটা ঘুরিয়ে বিজয়কুমার তাঁর টুরিস্টদের দল নিয়ে প্রশস্ত একটা বারান্দা পেরিয়ে অন্দরমহলের একতলায় একটা ঘরে এসে ঢুকলেন। বাইরে তখন বিকেল হয়ে এসেছে। কাজেই ঘরের ভেতরে কিছুটা অন্ধকার। ঘরটা চৌকোনা আর বেশ বড়ো। তার নিরেট দেওয়ালে জানলা-টানলা নেই, তবে সমকোণে দুটো দরজা— একটা অবশ্যই বারান্দার দিকে, অন্যটায় মোটা কাঠের কারুকার্য করা পাল্লা বন্ধ করা ছিল। বারান্দার দিকের দরজাটা দিয়েই ঘরের ভেতরে যা আলো আসবার আসছে।

বিজয়কুমার বললেন— এটা মহারানি নন্দাবাই-এর সংগীতকক্ষ। মহারানি কেবল অসাধারণ গানই করতেন না, সংগীত রচনাও করতেন। তাঁর রচিত বহু গান শুধু এই রাজ্যেই নয়, সারাদেশে আজও অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাঁর স্বামী মহারাজ দয়ানাথ সিং তাঁর প্রতিভার সমঝদার ছিলেন। তিনি তাঁর রানির গান এই বাঘেলাগড় দুর্গের বাইরে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই রাজবংশ ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল। তাই পর্দানশীন রানির পক্ষে সবার সামনে বসে গান গাওয়া সম্ভব ছিল না। সেইজন্যে, মহারাজ এই দুর্গের ভেতরে এমন ব্যবস্থা করেছিলেন যে অন্দরমহলের এই ঘরে বসে মহারানি গান গাইতেন আর রাজসভায় বসে সবাই সেই গান শুনত।

টুরিস্টদের ভেতর থেকে লেকটাউনের মিসেস গৌরী মিত্র বললেন— সে কী কথা? রাজসভা তো আমরা দেখে এলুম। সে তো এখান থেকে বেশ অনেকটা দূরে। অতদূরে গলা পৌঁছুত কী করে? সে যুগে কি মাইক-টাইক ছিল?

বাঁশদ্রোণী কলেজের ছাত্র সমীর ব্যানার্জি বলল— পৌঁছবে না কেন? সে যুগের মহিলাদের বাজখাঁই গলা হত, বুঝলেন? আপনাদের মতো মিনমিনে ছিল না। তাঁরা অমায়িক হয়ে গান গাইতেন, রাজ্যসুদ্ধু লোক শুনতে পেত।

বিজয়কুমার সমীরকে পাত্তা না-দিয়ে মৃদু হেসে বললেন— মাইক তখন কোথায়? ইলেকট্রিসিটিই কী ছিল নাকি? কিন্তু আমাদের দেশে সেই সময়ে যাঁরা বাস্তুকার ছিলেন, মানে আজ যাঁদের আপনারা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বলেন, তাঁদের ছিল অসম্ভব কে সম্ভব করার অদ্ভুত ক্ষমতা। ওই যে বন্ধ দরজাটা দেখছেন, ওর পেছনে একটা করিডর রয়েছে। ওখান দিয়ে রাজসভায় যাওয়া যায়। করিডরটা এমনভাবে তৈরি যে এই ঘরে কারও হাতের কাচের চুড়ির টুংটাং শব্দও রাজসভায় পরিষ্কার শোনা যায়। গান আর তার সূক্ষ্ম গলার কাজ যে শোনা যাবে তাতে আর আশ্চর্য কী? অথচ, রাজসভার কোনো কথাই এ-ঘরে শোনা যায় না।

সমীর বলল— বলেন কী? তার মানে, রাজামশাই এ-ঘরে তাঁর রানিকে কোনো গোপন কথা বলতেন, সেটা সভাসদরা সবাই শুনতে পেত?

বিজয়কুমার দরজাটা খুলে দিতে দিতে বললেন— না। এই দরজাটা পুরো খুলে না-দিলে ওপাশে কিচ্ছু শোনা যাবে না। এবার আপনাদের মধ্যে যিনি গান করতে পারেন, তিনি এখানে থাকুন আর বাকি সবাই এই পথে রাজসভায় চলে যান। আমি এখানেই আছি। ব্যাপারটা কী ঘটত, এবার আপনারা দেখতে পাবেন বা শুনতে পাবেন।

কে গান গাইতে পারেন এবং কে থাকবেন, তাই নিয়ে আলোচনা শুরু হল। শেষপর্যন্ত শ্রীলতাকেই সবার পছন্দ হল। গাইড বললেন— না। পুরুষদের মধ্যে একজন থাকুন।

শ্রীলতার বাবা সাংবাদিক দীপঙ্কর চৌধুরি বললেন— কেন? অসুবিধে আছে?

—হ্যাঁ, আছে। আপনারা শুনেছেন কি না জানি না, এই বাঘেলাগড় দুর্গের একটা বদনাম আছে। এই ঘরেই মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধে গুরুতর আহত মহারাজ দয়া সিং মারা যান আর সতী নন্দাবাই আত্মহত্যা করেন। তারপর থেকে— সে যাকগে, নানা লোকে নানা কথা বলে।

দীপঙ্কর বললেন— ভূত? আমি ভূতে বিশ্বাস করি না।

মা-মেয়ে অতসী আর শ্রীলতা সমস্বরে বলল— আমি করি। আমি করি।

বিজয়কুমার সহাস্যে বললেন— দেখলেন তো? তাহলে, আর একজনকে ঠিক করুন। কিছুই হবে না, কোনোদিন হয়নি। তবে, সাবধানের মার নেই।

এবার গানের জন্য নির্বাচিত হলেন যাদবপুর গৌরীশঙ্কর স্মৃতি হাই স্কুলের মাস্টারমশাই কল্যাণময় গুহ। অত্যন্ত নিরীহ আর শান্তপ্রকৃতির এই অকৃতদার মাঝবয়েসি ভদ্রলোক লজ্জিতভাবে রাজি হলেন।

রাজসভার দিকে যেতে যেতে সমীর বলল— ভালো করে গাইবেন, মাস্টারমশাই। ভুলভাল হলে নন্দাবাই-এর ইয়ে কিন্তু আপনার ঘাড়ে চড়ে বসতে পারে।

.

চারদিক ঢাকা টানেলের মতো করিডর দিয়ে সকলে রাজসভায় চলে এলেন। একটু বাদেই করিডরের ভেতর থেকে পরিষ্কার বিজয়কুমারের গলা শোনা গেল— এবার সবাই শুনুন, গান শুরু হচ্ছে।

একটা গলা খ্যাকারি শোনা গেল। তারপরেই একটা ভয়ংকর আর্তনাদ।

আর্তনাদটা শুনেই সাগর বলল— শ্রী, আমার সঙ্গে আয়। আর, আপনাদের মধ্যে কেউ এক্ষুনি গিয়ে টুরিস্ট অফিসারকে খবর দিন। বলে দু-জন করিডর দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট লাগাল। পিছনে পিছনে গেল সমীর।

.

রানির ঘরে ঢুকে দেখা গেল মাস্টারমশাই একপাশে মেঝের ওপর অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে রয়েছেন, বিজয়কুমারের চিহ্নমাত্র নেই। সাগর বলল— শ্রী, তুই ওই দরজাটা দিয়ে বাইরের বারান্দায় যা। এখানে আসার সময় দেখেছি বাঁ-দিকে একটা ছোটো বাথরুম আছে। ওখান থেকে তোর টুপিটা ভিজিয়ে নিয়ে আয়। মাস্টারমশাই-এর মুখে জলের ছিটে দিতে হবে। শিগগির যা।

শ্রীলতা একটু ইতস্তত করে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। সাগর সমীরকে বলল— আপনি মাস্টারমশাই-এর পাশে থাকুন, সমীরদা। আমি এদিকটা দেখছি।

সমীর একটু আশ্চর্য হয়ে বলল— এদিকটা মানে? কোন দিকটা?

সাগর উত্তর দেবার আগেই ওদের দলের সবাই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে এসে ঢুকল। সাগর বেশ জোরের সঙ্গে বলল— সবাই ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ান, কেউ দেওয়ালের কাছে যাবেন না।

সাগরের কথায় কাজ হল। সকলে হুড়মুড় করে ঘরের মাঝখানে চলে এলেন। তারপর শুরু হল প্রশ্নের বন্যা— মাস্টারমশাই বেঁচে আছেন কি না, গাইডসাহেব কোথায় গেলেন, নিশ্চয়ই কেটে পড়েছেন, টুরিস্ট-অফিসারের পাত্তা নেই কেন, দেওয়ালের কাছে গেলে কী হবে, ওই বাচ্চা ছেলেটি এসব কথা বলবার কে, ইত্যাদি, ইত্যাদি। সবাই তারস্বরে কথা বলছেন, সে এক মহা গণ্ডগোল।

সাগর এই প্রশ্নমালার উত্তর দেবার চেষ্টাই করল না। বলল— বাবা, তোমার টর্চটা দাও তো।

দীপঙ্কর তাঁর কাঁধ-ঝোলার ভেতর থেকে ছোটো টর্চ বের করে সাগরের হাতে দিলেন। সঙ্গেসঙ্গে নতুন প্রশ্নের ঝড় উঠল— টর্চ দিয়ে কী হবে, ছেলেটা কী ডিটেকটিভ না কি, যতসব চালিয়াতি বাজে কায়দা দেখাবার আর জায়গা ছিল না ইত্যাদি।

এরমধ্যে শ্রীলতা তার টুপি ভিজিয়ে নিয়ে এসেছে। সমীর সেটা নিংড়ে মাস্টারমশাই-এর চোখে-মুখে কিছুক্ষণ জলের ছিটে দেওয়ার পর তাঁর জ্ঞান ফিরল। চোখ খুলেই মাস্টারমশাই খাবি খেতে খেতে বললেন— ভূত… ভূত।

সমীর ব্যথিত গলায় বলল— আমি ভূত নই, মাস্টারমশাই। জলজ্যান্ত মানুষ।

মাস্টারমশাই বললেন— আহা, তুমি ভূত হতে যাবে কেন। ঘরের ভেতরে সত্যিকারের ভূত এসেছিল। বিজয়কুমারের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়েছিল।

দুর্গাপুরের মিসেস সুগতা গাঙ্গুলি মাস্টারমশাই-এর মতোই কম্পিতকণ্ঠে বললেন— ওরে বাবারে! কীরকম দেখতে ছিল ভূতটা, মাস্টারমশাই?

—আমি কী আর ভালো করে দেখেছি? তবে, কোনো রাজা-টাজার ভূত হবে। বিশাল চেহারা, মাথায় পাগড়ি, পরনে সলমা-চুমকি বসানো রাজার মতো পোশাক।

—ও মা গো! ওই বারান্দা দিয়ে ভূতটা এল?

সাগর টর্চটা জ্বেলে দেওয়ালের কাছে মেঝেটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল। বলল— না। ভূতটা দেওয়ালে ফুটো করে বেরিয়ে এসেছিল, তাই-না মাস্টারমশাই?

মাস্টারমশাই বললেন— ঠিক তাই। আমি আর বিজয়কুমার ঘরের মধ্যিখানে করিডরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিলুম। কাজেই ওপাশের বারান্দা দিয়ে যা কিছুই আসুক না-কেন, আমরা দেখতে পেতুম। ভূতটা এসেছিল আমাদের পেছন থেকে। তার মানে দেওয়ালে ফুটো করেই বটে। তা, সে কথাটা তুমি কী করে জানলে?

ঢাকুরিয়ার সবজান্তা উকিল কান্তিভূষণ কুণ্ডু বললেন— এতে আবার না জানার কী আছে? বারান্দা দিয়ে এলে শুধু আপনি কেন, বাইরে দুর্গের যেসব লোকজন ঘোরাঘুরি করছে, তারাও দেখতে পেত। আমার তো মনে হয়, ভূত-টূত কিছু নয়। একটা লোক এই ঘরের মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে ছিল।

কান্তিভূষণের স্ত্রী গীতা বললেন— বাজে কথা বোলো না তো। এই ঘরে লুকোবার মতো কোনো জায়গা আছে? যা এসেছিল, সেটা ভূতই, মানুষ হতে পারে না। মাস্টারমশাই খুব জোর বেঁচে গেছেন। ভূতটা গাইডসাহেবকে তুলে নিয়ে ওই দেওয়াল ভেদ করেই বেরিয়ে গেছে। দ্যাখো গিয়ে, এতক্ষণে তাঁকে বোধ হয় কড়মড় করে…

মিসেস গাঙ্গুলি তাঁর স্বামী ডি. এস. পি.-র ইঞ্জিনিয়ার প্রবালকে বললেন— আমি এখানে আর একমুহূর্তও থাকব না। আমি এক্ষুনি বাড়ি যাব।

বারান্দায় কতগুলো ভারী জুতোর শব্দ পাওয়া গেল। সঙ্গেসঙ্গে সকলের কথা বন্ধ হয়ে গেল। ঘরে ঢুকলেন টুরিস্ট-অফিসার রাঠোর, একজন রোগা, লম্বা পুলিশের দারোগা আর দু-জন মোটাসোটা কনস্টেবল।

ঘরে ঢুকেই রাঠোর বললেন— এ কী! বিজয়কুমার কোথায় গেল? তার এখান থেকে চলে যাওয়া ঠিক হয়নি।

মিসেস গাঙ্গুলি বললেন— ইচ্ছে করে কী আর গেছেন? তাঁকে তুলে নিয়ে গেছে।

তারপর সবাই একসঙ্গে ঘটনাটা রাঠোরকে বোঝানোর চেষ্টা করতে আরম্ভ করে দিলেন। কেউ শুরু করলেন রাজসভা থেকে গান শুনতে পাওয়ার কাহিনি থেকে। কেউ সকাল বেলা টুরিস্ট বাংলো থেকে রওনা হওয়া থেকে। আবার কেউ-বা একেবারে হাওড়া স্টেশনে মাস্টারমশাই-এর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হওয়া থেকে। সবাই একসঙ্গে কথা বলে যাচ্ছেন, কে যে কার কথা শুনেছেন তা বোঝে কার সাধ্যি।

অনেক কষ্টে ব্যাপারটা বুঝে রাঠোর বললেন— আপনারা ভয় পাবেন না। এ কথাটা ঠিকই যে এখানে নানা রকমের অতিপ্রাকৃত গল্প প্রচলিত আছে, কিন্তু সেগুলো গল্পই। এখানে আজ যা ঘটেছে বলে আপনারা মনে করছেন, সেটা ঠিক নয়। আমার তো মনে হচ্ছে যে বিজয়কুমার মাস্টারমশাইকে ভয় দেখিয়ে অজ্ঞান করে তাঁর টাকাপয়সা হাতিয়ে নেবার ধান্দায় ছিল। মাস্টারমশাই চিৎকার করে ওঠায় সে পালিয়েছে। রাজার সাজে যাকে উনি দেখেছেন, হয় সেটা তাঁর চোখের ভুল নয়তো বিজয়কুমারের কোনো সাগরেদের কাণ্ড। আপনারা নিশ্চিন্ত মনে বাংলোয় ফিরে যান। বিজয়কুমার এই দুর্গেই এদিক-ওদিক কোথাও আছে। বাইরে কোথাও যায়নি। ওকে ধরা কঠিন হবে না। কি বলেন দারোগাসাহেব?

দারোগাসাহেব মাথা নেড়ে বললেন— সহি বাত।

সাগর বলল— বিজয়কুমার এদিক-ওদিক কোথাও নেই আর এক্ষুনি ব্যবস্থা না-নিলে ওঁকে ধরা সত্যিই কঠিন হবে। মাস্টারমশাই যা দেখেছেন, সেটা তাঁর চোখের ভুল নয়।

সস্নেহ হাসি হেসে রাঠোর বললেন— বাঃ, তুমি তো সব জেনে গেছ দেখছি। বিজয়কুমার কোথায় আছে বা সে সেখানে গেল কী করে, সেটাও কি জানতে পেরেছ? তবে তো দারোগাসাহেবের কাজ খুব-ই সহজ হয়ে গেল। না কি বলেন দারোগাসাহেব?

দারোগাসাহেব মাথা নেড়ে বললেন— সহি বাত।

সাগর বলল— বিজয়কুমার কোথায় আছেন তা আমি সঠিক না জানলেও আন্দাজ করতে পারি আর তাঁকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এই দেওয়াল ভেদ করে।

রাঠোর এবার গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন— ওই নিরেট পাথরের দেওয়াল ফুটো করে একটা মানুষকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এটা কিন্তু বুদ্ধিমানের মতো কথা হল না। আমি বলি কী, আপনারা এবার বাড়ি যান। পুলিশ এবার তার কাজ শুরু করবে। তাই তো, দারোগাবাবু?

দারোগাসাহেব মাথা নেড়ে বললেন— সহি বাত।

সাগর বলল— শুনুন মি. রাঠোর, আমাদের কিন্তু দেরি করা চলবে না। তাহলে হয়তো বিজয়কুমারকে আর জীবিত অবস্থায় পাওয়া যাবে না।

রাঠোরের গলায় এবার বিদ্রূপের সুর। বললেন— একেবারে খুন? কী করে বুঝলে?

—দেওয়ালের ধারে এই বৃত্তচাপের মতো বাঁকা দাগটায় আর ন্যাফথালিনের গন্ধে।

—এসব কী আজেবাজে কথা বলছে এই ছেলেটি? বেশি ডিটেকটিভ গল্প পড়ার এই ফলই হয়। চলুন সবাই, আপনাদের বাংলোয় ফেরার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। বিজয়কুমারকে নিয়ে পুলিশকে মাথা ঘামাতে দিন।

সমীর এতক্ষণ গভীর মনোযোগের সঙ্গে এই কথোপকথন শুনছিল। রাঠোরকে বাধা দিয়ে বলল— একটু দাঁড়ান। সাগর, তুমি কী বলতে চাইছ, বলো তো?

সাগর বলল— আমি যা বলতে চাইছি সেটা জানতে হলে আগে এইখানে আসুন। বাবা, তুমিও এসো।

—তা না-হয় যাব। তারপর কী করতে হবে?

—আমরা তিনজনে মিলে দেওয়ালের এই জায়গাটা ঠেলব।

রাঠোর ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললেন— না, এসব এখানে চলবে না। বিজয়কুমার একজন অত্যন্ত শয়তান লোক। অনেকদিন ধরেই আমি সেটা জানি। কাজেই, কোনো বাচ্চা ছেলে নয়, পুলিশই তার খোঁজ করবে।

দারোগাসাহেব মাথা নেড়ে বললেন— সহি বাত।

টুরিস্টদের মধ্যেও অনেকেই তাঁকে সমর্থন করলেন।

সমীর বলল— পুলিশ তার কাজ করুক-না। ছেলেটি তো শুধু চাইছে দেওয়ালের একটা জায়গায় ধাক্কা দিতে। তাতে যে কী মহাভারত অশুদ্ধ হচ্ছে, তাই তো আমি বুঝতে পারছি না। এতে কী পুলিশের কাজে কোনোরকম বাধা দেওয়া হচ্ছে? তা যদি না-হয়, তাহলে তো পুলিশের তরফ থেকে কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। তাই না দারোগাসাহেব?

দারোগাসাহেব মাথা নেড়ে বললেন— সহি বাত।

এই কথার মধ্যে সমীর সাগরের কাছে চলে এসেছে এবং দু-জনে দেওয়াল ঠেলতে শুরু করে দিয়েছে। দীপঙ্করের দরকার হল না, দু-জনের ঠেলাতেই একটা স্ল্যাব বেশ মসৃণভাবে ঘুরে গেল। দেখা গেল, সেটা আসলে একটা গোপন দরজা আর তার পেছনে একটা অন্ধকার সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে।

দরজাটা বেরোনোমাত্র রাঠোর হাউমাউ করে চিৎকার করে উঠলেন— আর্কিয়োলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টের অনুমতি ছাড়া ওখান দিয়ে কেউ যাবে না।

কে কার কথা শোনে। সাগর সমীরকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামতে নামতে চেঁচিয়ে বলল— বাবা, রাঠোরকে আটকে রাখো। দারোগাসাহেব, আপনি আমাদের সঙ্গে আসুন।

এইবার দারোগাসাহেবের মধ্যে কিছু ব্যস্ততা দেখা গেল। তাড়াতাড়ি দৌড়লেন সিঁড়িটার দিকে। বাকি সবাই রাঠোরের চারদিকে ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন।

.

হরিসিং রাঠোর ভাঙেন কিন্তু মচকান না। টুরিস্ট অফিসে নিজের চেয়ারে বসে বাঁকা হেসে বললেন— আমিই যে বিজয়কুমারকে তুলে নিয়ে গিয়ে মাটির নীচে চোরকুঠুরিতে মুখ-হাত-পা বেঁধে আটকে রেখেছিলুম, তার কোনো প্রমাণ আছে?

সাগর বলল— বিজয়কুমার পুলিশকে যা বলেছে সেটাই কি যথেষ্ট নয়?

—না, বিজয়কুমার যা বলছে তার একটি শব্দও বিশ্বাসযোগ্য নয়। সে একটা মহা পাজি লোক। অনর্গল মিথ্যেকথা বলে থাকে। অন্য কোনো প্রমাণ থাকে তো বলো।

—অন্য প্রমাণও আছে। সেটা আপনার গায়ে তীব্র ন্যাফথালিনের গন্ধ। আপনি পরে রয়েছেন কটন বুশশার্ট। ও জিনিস কেউ ন্যাপথালিন দিয়ে রাখে না। আর, বিজয়কুমারের পাশে যে সলমা-চুমকি বসানো প্রিন্সকোর্টটি পাওয়া গেছে তারমধ্যেও এই একই গন্ধ। সারকামস্ট্যান্সিয়াল এভিডেন্স হিসেবে এই ব্যাপারটা কিন্তু খুব জোরালো। তা ছাড়া, এই কোটের পকেটে যে থিয়েটারের পোশাক ভাড়া দেবার দোকানের রসিদটি পাওয়া গেছে সেখান থেকে ওটা কে ভাড়া নিয়েছিল সেটা বের করতে পুলিশের বেশি সময় লাগবে না।

সাগরের কথা শুনে রাঠোর গুম হয়ে চুপ করে রইলেন। কিছুক্ষণ বাদে সাগর প্রশ্ন করল— এই কাজ আপনি করতে গেলেন কেন, মি. রাঠোর?

রাঠোর দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন— এত কথা জেনে বসে আছ আর একথাটা জানো না?

—বিজয়কুমার গুপ্তধন সম্পর্কে কী যেন বলছিলেন বটে। তা, সেটা কি এমন একটা কাণ্ড করবার জন্য খুব জরুরি ছিল?

—নিশ্চয়ই। যে গুপ্তধনের কথা ও বলছিল সেটা আমার পরিবারের সম্পত্তি। রাজা দয়ানাথ সিং আর রানি নন্দাবাই নিঃসন্তান ছিলেন। দয়ানাথের মৃত্যুর পর তাঁর শ্যালক সিংহাসন দখল করে রাজা হয়েছিলেন। তিনিই আমার পূর্বপুরুষ। ওই বিজয়কুমারের বংশ ছিল এখানকার রাজপরিবারের দেহরক্ষী। আলমগীর যখন এই দুর্গ আক্রমণ করেছিলেন, তখন দয়ানাথের আদেশে তাঁর প্রধান দেহরক্ষক সমস্ত রাজকীয় ধনরত্ন লুকিয়ে ফেলেছিল। যুদ্ধে দয়ানাথ মারা যান, ফলে এই বিশাল সম্পদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। নতুন রাজা প্রধান দেহরক্ষকের ওপর অনেক অত্যাচার করেছিলেন কিন্তু তার পেট থেকে কথা বের করতে পারেননি।

—বেশ, ব্যাপারটা এইবার স্পষ্ট বোঝা গেল। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। আপনার বিশ্বাস, বিজয়কুমারের পরিবারে প্রচলিত কাহিনির মাধ্যমে সেই সম্পদ কোথায় থাকতে পারে সে সম্পর্কে তাঁর একটা ধারণা ছিল। দুর্গের ভেতরে দর্শকদের ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে তিনি তাঁর খোঁজ পেয়ে গেছেন আর সেটা আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছেন, যদিও আপনার মতে সেটা আপনার হক্কের ধন। অতএব, আপনি বিজয়কুমারকে জোর করে গোপন কুঠুরিতে তুলে নিয়ে গিয়ে তাঁর গলা টিপে তার পেটের খবর বের করে নেবার জন্য এত কাণ্ড করলেন। অথচ এটা ভেবে দেখলেন না যে ওই গুপ্তধন যদি থাকেও, তবে আজ সেটা জাতীয় সম্পত্তি, তাতে কারুর ব্যক্তিগত অধিকার নেই। আর, যদি মনে করেন যে ওসব আইনের অর্থহীন কথা তাহলেও আপনি সেটা হজম করতে পারতেন না। কারণ, তা করতে গেলে যে পরিমাণ এলেম থাকা দরকার তা আপনার নেই। যদি থাকত তাহলে এমন নির্বোধের মতো একটা প্ল্যান করতেন না আর পত্রপাঠ ধরাও পড়ে যেতেন না।

.

টুরিস্ট বাংলোর বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে সমীর বলল— হরিসিং রাঠোরের এলেম থাক বা না-থাক, তোমার তো বেশ আছে বলেই মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা তুমি ধরলে কীভাবে একটু বুঝিয়ে বলো তো।

কান্তিভূষণ কুণ্ডু বললেন— এতে আবার বোঝাবার কী আছে? খুবই সহজ ব্যাপার। আমি তো প্রথমেই বলেছিলুম যে ভূত-টূত নয়, একটা লোকই ঘরের ভেতরে লুকিয়ে ছিল। অবশ্য পাথরের দেওয়ালে চোরা দরজার কথাটা তখন মাথায় আসেনি। আর, ন্যাফথালিনের গন্ধটা পেলে তো রাঠোরকে সঙ্গেসঙ্গে ধরে ফেলতুম। কিন্তু পাবো কোত্থেকে? আমি একটু বেশি সিগারেট খাই কিনা, তাই এসব গন্ধ-টন্ধ আমার নাকে বড়ো একটা আসে না।

শ্রীলতা জনান্তিকে বলল— আমারও ছিল মনে, কেমনে ব্যাটা পেরেছে সেটা জানতে।

সাগর বলল— যে দুর্গে এত চোরা পথ, সেখানে রানিমহলে তা থাকবে না সেটা ভাবাই যায় না। তাহলে সেটা পাথরের দেওয়ালেই কোথাও-না-কোথাও হবে। সেখান দিয়ে কেউ এলে তার কোনো একটা চিহ্ন দেওয়ালের খুব কাছেই থাকার সম্ভাবনা। সেইজন্যেই আমি কাউকে দেওয়ালের কাছে আসতে বারণ করেছিলুম। ধুলোর ওপরে বৃত্তচাপের মতো একটা হালকা দাগ দেখে বুঝতে পারলুম যে কোন পাথরের স্ল্যাবটা আসলে একটা চোরা দরজা আর তার কোন দিকটা ঠেললে সেটা খুলে যাবে। হরিসিং এখানকার ভূতের ভয়ের কথা জানতেন। ভেবেছিলেন যে ঘরে যখন মাত্র দু-জন লোক থাকবে তখন রাজার পোশাক পরে পেছন থেকে ঘাড়ে লাফিয়ে পড়লে তারা অজ্ঞান হয়ে যাবে আর তিনি বিজয়কুমারকে নিয়ে চোরাকুঠুরিতে বিনা বাধায় চলে যেতে পারবেন। এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল তবে মাস্টারমশাই যে ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠবেন আর আমরা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ও ঘরে পৌঁছে যাব সেটা ভাবতে পারেননি।

—তোমার কি মনে হয় যে বিজয়কুমার গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছেন?

—আমার তো মনে হয় না। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে রাঠোরের উষ্ণ মস্তিষ্কের কল্পনা। এই দুর্গের গলিঘুঁজির সব খবর রাঠোরই রাখেন, বিজয়কুমার নয়। আজকের ঘটনাটা সেই ইঙ্গিতই করে। সম্ভবত, অনেক দিন ধরেই মহারাজার গুপ্তধন খুঁজে বেড়াচ্ছেন রাঠোর। না-পেয়ে হতাশার রাগটা গিয়ে পড়েছে বেচারা বিজয়কুমারের ওপরে। তবে, বিজয়কুমার গুপ্তধনের সন্ধান যদি পেয়েও থাকেন তাহলেও উনি সেটা প্রকাশ করবেন না কারণ, ওই যে বললুম, সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে।

 চন্দ্রশেখর হত্যারহস্য

শশীশেখর লাহিড়ি ভুরু কুঁচকে তাঁর চশমার মোটা কাচের ভেতর দিয়ে সাগরকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করে বললেন— তুমি রহস্যভেদ করে থাকো? এই বয়েসে?

সাগর হেসে বলল— চেষ্টা করি। সবসময় যে পেরে উঠি, তা নয়।

—বটে? আমার ছেলে অর্ণব কিন্তু বলছিল যে তোমার নাকি বেশ ভালোই ক্ষমতা আছে। ও-ই তো তোমাকে ডেকে এনেছে।

—অর্ণব আমার বহুদিনের বন্ধু। সেই ক্লাস ওয়ান থেকে একসঙ্গে পড়ছি। ও আমাকে খুব ভালোবাসে। আমার প্রতি ওর পক্ষপাতিত্ব থাকাই স্বাভাবিক।

—তা বটে। যাই হোক, এসেছ যখন, তখন আজকের মিটিং-এ থেকেই যাও। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর গুরুদাস হাজরা এখুনি এসে পড়বেন। তাঁর আগে ব্যাপারটা তোমাকে বলি।

—সেই ভালো।

শশীশেখর যা বললেন সেটা এইরকম—

উত্তর কলকাতার বসাকপাড়ায় শশীশেখরের পৈত্রিক বাড়ি। গঙ্গার ধারে দোতলা; প্রায় দেড়শো বছরের পুরোনো ইমারত। শশীশেখরের পূর্বপুরুষ হেমশঙ্কর লাহিড়ি বগুড়া থেকে কলকাতায় এসে কাগজের ব্যাবসা শুরু করেছিলেন। টাকাপয়সা হয়েছিল অনেক। তাই দিয়েই বাড়িটা বানানো। তারপর পরিবার যত বড়ো হয়েছে, ততই ও বাড়িতে থাকবার জায়গা কমে এসেছে। শেষপর্যন্ত, শশীশেখরের বাবা ডাক্তার বিধুশেখর লাহিড়ি দক্ষিণ কলকাতার চারুচন্দ্র স্ট্রিটের বর্তমান বাড়িটা বানিয়ে সেখানে উঠে আসেন। বসাকপাড়ায় তাঁর ছোটোকাকার পরিবার এখনও থাকেন। তাঁদের কপালে একটা ঘর আর একটা বারান্দা জুটেছে।

মাসছয়েক আগে, শশীশেখরের স্ত্রী গৌরী দেবী তাঁর খুড়শ্বশুড়ের ছোটোছেলে চন্দ্রশেখরের কাছ থেকে একটা টেলিফোন পান। চন্দ্রশেখর তাঁকে বলে যে তাঁর সামনে ভয়ংকর বিপদ আসছে, অতএব তিনি যেন সাবধানে থাকেন, আর এই ফোনের কথা যেন কাউকে না জানানো হয়। তিনি অবশ্য কথাটা তৎক্ষণাৎ শশীশেখরকে বলেন। পরের দিনই শশীশেখর বসাকপাড়ায় গিয়ে চন্দ্রশেখরের সঙ্গে দেখা করেন। সে ফোনের কথাটা অস্বীকার তো করেই আর যেন অত্যন্ত আশ্চর্য হয়েছে, এরকম একটা ভাব করে।

এর দু-দিন পরে আবার ফোন আসে। এবার শশীশেখরকে কথাটা বলে দেওয়ার জন্য গৌরী দেবীকে রীতিমতো শাসানো হয়। আর বলা হয় যে তাঁদের দু-জনের গোপন কুকীর্তির কথা এবার ফাঁস করে দেওয়ার সময় হয়েছে। সেটা যদি আটকাতে চান, তাহলে তিনি যেন দশহাজার টাকা জোগাড় করে রাখেন। এই কথা শুনে শশীশেখর অবিলম্বে লোকাল থানায় গিয়ে একটা ডায়েরি করে আসেন।

তদন্ত করে পুলিশ তাঁকে যে খবর দেয় তাতে তাঁরা খুব চিন্তায় পড়ে যান। চন্দ্রশেখর নাকি একজন মারাত্মক লোক। সে ভালোমানুষির মুখোশ পরে নানা অসামাজিক কাজকর্ম করে থাকে। হেন দুষ্কর্ম নেই যা সে করতে পারে না। মানে, যাকে বলে, সে একটা হার্ডকোর ক্রিমিনাল। পুলিশ অনেকবারই ও-বাড়িতে হানা দিয়েছে, যদিও কিছুই ধরতে পারেনি।

এই ঘটনার দিনতিনেক বাদে হঠাৎ খবর আসে যে চন্দ্রশেখর আত্মহত্যা করেছে। তাঁর মৃত্যুর ঘটনাও অদ্ভুত। তখন বাড়িতে কেউ ছিল না। ঘরের দরজা বন্ধ করে সে খাটে বসে টাকা গুনছিল। সেই অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। দরজা ভেঙে পুলিশ যখন ভেতরে ঢোকে, তখনও তাঁর হাতে পাঁচ-শো টাকার কুড়িটা নোট।

স্বভাবতই, পুলিশ প্রথমে ধরে নিয়েছিল যে চন্দ্রশেখর হার্টফেল করে মারা গেছে। কিন্তু পোস্টমর্টেমের পর দেখা গেল যে তাঁর মৃত্যুর কারণ পটাশিয়াম সায়ানাইডের বিষক্রিয়া। তাঁর মানে এটা আত্মহত্যা। কিন্তু, সেখানে কয়েকটা প্রশ্ন উঠল।

প্রথমত, টাকা গুনতে-গুনতে সে আত্মহত্যা করতে গেল কেন? দ্বিতীয়ত, তাঁর ঘরে যে পটাশিয়াম সায়ানাইডের শিশিটি পাওয়া গেছে, সেটা ছিল তাঁর টেবিলের ড্রয়ারে। পটাশিয়াম সায়ানাইড খেলে তাঁর তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হওয়ার কথা। তাহলে, শিশিটি ওখানে গেল কী করে? তৃতীয়ত, সে যদি কোনো চামচে সেটা মুখে ঢেলে দিয়ে থাকে, তাহলে সেই চামচটা বা গেল কোথায়?

এইখানে পুলিশের সন্দেহ এসে পড়ল শশীশেখরের ওপরে। চন্দ্রশেখর শশীশেখরের কাছে দশহাজার টাকা দাবি করেছিল। তাঁর হাতেও ছিল দশহাজার টাকা। এটা হতে পারে যে শশীশেখর একটা নোটের ওপরে পটাশিয়াম সায়ানাইডের গুঁড়ো ছড়িয়ে রেখে তাকে টাকা দিয়েছিলেন। জিভ দিয়ে আঙুল ভিজিয়ে টাকা গুনতে গিয়ে সেই বিষ তাঁর মুখে চলে যায়, আর তার মৃত্যু হয়। এই সন্দেহের ওপরে পুলিশ হয়তো তাঁকে গ্রেপ্তার করত। করেনি, কারণ তাঁর হাতে যে টাকাগুলো ছিল, তাঁর কোনোটাতেই কোনো বিষের সন্ধান পাওয়া যায়নি। সেই রহস্যের সমাধান করতেই লালবাজার থেকে মি. হাজরা আসছেন শশীশেখরকে জেরা করবার জন্য।

সবকথা শুনে সাগর বললেন— আমি কি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি?

শশীশেখর বললেন— করো।

—আপনি বললেন যে, চন্দ্রশেখর আপনার ছোটোকাকার ছোটো ছেলে। ওঁর আর ক-টি ভাইবোন? তাঁরা কে কী করেন?

—ছোটোকাকার দুই ছেলে এক মেয়ে। বড়ো ছেলে হিমাদ্রিশেখর। সে আত্মভোলা মানুষ, গানবাজনা নিয়ে আছে। শ্যামবাজারে তাঁর একটা গানের স্কুল আছে। স্কুলটা বেশ ভালোই চলে। তারপরে মেয়ে প্রতিমা। সে এমএসসি পাশ করে বরানগরে একটা ওষুধের ফ্যাক্টরিতে চাকরি করত। সম্প্রতি সেই কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়িতে বসে আছে আর চাকরি খুঁজছে।

—আপনার কাকা আর কাকিমা কি বেঁচে আছেন?

—কাকা বেঁচে নেই। কাকিমা বেঁচে আছেন বটে, কিন্তু তিনি অত্যন্ত অসুস্থ। ঘটনার সময় তাঁকে নিয়ে প্রতিমা ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল আর হিমাদ্রি ছিল গানের স্কুলে।

—ওই পরিবারের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কীরকম?

—সম্পর্ক নেই বললেই চলে। বসাকপাড়ার বাড়িতে বিয়ে বা ওই ধরনের কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান হলে দেখা হয়, এই পর্যন্ত।

—তখন চন্দ্রশেখর বা তাঁর ভাইবোনেরা আপনাদের সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করেন?

—বলবার মতো কিছু নয়। চন্দ্রশেখরকে তো প্রায় কখনোই দেখি না। হিমাদ্রি বা প্রতিমা হেসে কথা বলে, এই আর কী।

—আপনি তো মহারাজা স্বর্ণকুমার কলেজে ইকনমিক্স পড়ান। মাসিমা ঘরসংসার নিয়েই আছেন। এখন, আপনার বা মাসিমার কী এমন কোনো অতীত ইতিহাস আছে যা কোনোমতেই প্রকাশ হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়? আমি ইতিহাসটা জানতে চাই না, শুধু জানতে চাই যে সেরকম কিছু আছে কিনা।

—কখনোই নয়। আমি বা আমরা কখনো কোনো বেআইনি কাজ করিনি।

—বেশ। তাহলে দেখুন, চন্দ্রশেখরবাবু যদি আত্মহত্যা করে না-থাকেন, তাহলে তাঁর মৃত্যু ঘটানোর জন্যে চারজনের ওপরে সন্দেহ হওয়ার কথা। এক নম্বর, আপনি। টেলিফোনে খবরটা পেয়েই আপনি বসাকপাড়ায় গিয়েছিলেন। হয়তো, টাকা দিতে। টাকায় সামান্য বিষের গুঁড়ো মেশানো ছিল যেটা আপনি আপনার কলেজের ল্যাবরেটরি থেকে জোগাড় করেছিলেন। সেটা হাওয়ায় উড়ে গেছে। বিছানার চাদরটা পরীক্ষা করলে সেটা জানা যাবে। দু-নম্বর, হিমাদ্রিশেখর। একটা ঘরের মধ্যে চারজনে মিলে থাকেন। তাঁর ওপরে অসুস্থ মা। খুবই অসুবিধে হওয়ার কথা। আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়া, পুলিশের ঝামেলা। ছোটোভাইয়ের যা সুনাম, তাতে বোনের বিয়ে দেওয়াও কঠিন। কাজেই, চন্দ্রশেখর সরে গেলে সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। তিন নম্বর, প্রতিমা। তাঁরও একই সমস্যা। তা ছাড়া, তিনি ওষুধের কারখানায় কাজ করতেন। হয়তো সেখান থেকে পটাশিয়াম সায়ানাইড গোপনে সরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। চার নম্বর, অন্য কেউ।

সাগরের কথা শেষ হওয়ামাত্র দরজার পরদা সরিয়ে ঘরে ঢুকলেন একজন মধ্যবয়স্ক বেঁটেখাটো ভদ্রলোক। তাঁর পরনে নীলরঙের শার্ট আর কালো ট্রাউজার্স।

ভদ্রলোক বললেন— আমার নাম গুরুদাস হাজরা। আমি লালবাজার থেকে আসছি।

প্রাথমিক অভ্যর্থনা আর পরিচয়পর্ব শেষ হলে হাজরা বললেন— আমি আপনাদের অনুমতি ছাড়াই দরজার বাইরে থেকে এই ছেলেটির কথা শুনছিলুম। আপনার ছেলে ঠিক কথাই বলেছে, প্রফেসর লাহিড়ি। স্বীকার করতেই হবে যে রহস্যভেদে এর একটি স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে।… এবার তাহলে বলো তো সাগরবাবু, আমাদের এখন কী কর্তব্য?

সাগর অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে বলল— আমি কখনো আপনাকে তা বলতে পারি?

—খুব পারো। তুমি তো এখন আমাদের সঙ্গে আছ। তাহলে বলো তো, যে চারজনের কথা বললে, তাদের ব্যাপারে কীভাবে এগোনো যেতে পারে?

—মেসোমশায়ের ব্যাপারে বলতে পারি যে তাঁর অতীত জীবনের ওপরে একটা বিশদ তদন্ত হওয়া দরকার। সেইসঙ্গে মাসিমারও। কোনো একজন তাঁদের ব্ল্যাকমেল করতে উদ্যত হয়েছিল। কেন? সেটা কি কোনো কারণ ছাড়াই করা হয়েছিল? আর ফোনগুলো কে করেছিল? চন্দ্রশেখর না অন্য কেউ।

—তাহলে তোমাকে বলি, চন্দ্রশেখরের মোবাইল ফোন থেকে জানা গেছে যে ফোনগুলো সেই করেছিল।

—ভালো কথা। বাকি তিনজনের ব্যাপারে কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারব না। কারণ, আমি তাদের চিনিও না, তাদের সঙ্গে কথাও বলিনি।

—তুমি কি তাদের সঙ্গে আলাদা-আলাদা কথা বলতে চাও?

—তাহলে তো খুব ভালোই হয়। তবে আমি আপনার সামনেই কথা বলতে চাই।

—সে ক্ষেত্রে, বসাকপাড়ার বাড়িতে কথা বলা যাবে না। একটাই ঘর। সেখানে হিমাদ্রিশেখরের মা রয়েছেন। তিনি একে সুস্থ নন, তাঁর ওপরে পুত্রশোকে পাগলের মতো হয়ে খুব চ্যাঁচামেচি করছেন। ওই পরিবেশে শান্তভাবে কোনো আলোচনা চালানো একেবারেই অসম্ভব। আমি তাহলে হিমাদ্রিশেখর আর প্রতিমাকে লালবাজারে আসতে বলি। আমার ঘরে বসেই কথা বলা যাবে। আজ থেকে দিনপনেরো-বাদে কুড়ি তারিখে তুমি আর শশীশেখরবাবু এগারোটার মধ্যে ওখানে পৌঁছে যাবে। সেইসময় তোমার কি স্কুল আছে?

—না, এখন তো গরমের ছুটি।

—বেশ, তাহলে তো কোনো অসুবিধে নেই। তোমার বাড়ি থেকে কোনো আপত্তি উঠবে না তো?

—বাবা কোনো আপত্তি করবেন না, তবে মা করবেন। উনি আমার এইসব কাজ একেবারেই পছন্দ করেন না।

—সেটা তুমি ম্যানেজ করে নিও।

—তা নেব। তবে আমি ঠিক কোন অধিকারে ওখানে উপস্থিত থাকব? যাঁদের আপনি জেরা করবেন, তাঁরা তো আপত্তি করতে পারেন।

—সেটা আমি ম্যানেজ করব। তবে, তোমার যদি অস্বস্তি হয়, তুমি তোমার প্রশ্নগুলো আমাকে একটা চিরকুটে লিখে দেবে, আমি সেগুলো ওদের জিগ্যেস করব।

—সেটা ভালো কথা। আমি মূল প্রশ্নগুলো খাতায় লিখে আপনাকে দিয়ে দেব। আর তার ওপরেও যদি কোনো জিজ্ঞাস্য থাকে সেগুলো আলাদা করে আপনাকে লিখে দেব।

—তাই হবে। আর ইতিমধ্যে শশীশেখরবাবু আর তাঁর স্ত্রীর ব্যাকগ্রাউন্ডটা চেক করা হয়ে যাবে।

শশীশেখর হাত নেড়ে বললেন— ভালো রে ভালো। সাগরকে ডেকে এনে দেখছি মহা উপকারই করল আমার পুত্র। কোথাও কিছু নেই, মাঝখান থেকে পুলিশ আমারই পেছনে পড়ে গেল। তাও আবার খুনের দায়ে। আচ্ছা গুরুদাসবাবু, সাগরকে যে আপনি এতটা পাত্তা দিচ্ছেন, সেটা কী খুব আইনসংগত হচ্ছে? আপনার ওপরওয়ালারা কি এটা ভালো চোখে দেখবেন?

—আমার ওপরওয়ালারা জানতেই পারবেন না। আসলে কী জানেন, সাগরের বিশ্লেষণী ক্ষমতা দেখে আমার খুব কৌতূহল হচ্ছে। আমি দেখতে চাই ও কতদূর যেতে পারে। তা ছাড়া, এটা একটা খুনের ব্যাপার। এখানে আমার প্রিন্সিপল হল, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পেলেও পাইতে পারো অমূল্যরতন। আমার মনে হচ্ছে, এই ছেলেটি একটি অমূল্যরতন।

অমূল্যরতন সহাস্যে বলল— ছাই আবার কোথায় দেখলেন, স্যার?

.

কুড়ি তারিখে আলোচনা শেষ হল প্রায় একটার সময়।

গুরুদাস বললেন— কিছু বুঝলে, সাগর?

সাগর বলল— ছাড়া-ছাড়াভাবে বুঝেছি। সবটা সাজাতে দিনদুয়েক ভাবতে হবে। তারপরে আপনার সঙ্গে বসব।

—সেই ভালো। আমিও কিছুটা বুঝেছি। দেখি, তোমার সঙ্গে মেলে কি না।

.

তিনদিন পরে শশীশেখরবাবুর বাড়ির বসবার ঘরে কথাবার্তা শুরু হল। শশীশেখর, গুরুদাস আর সাগর ছাড়া সেখানে উপস্থিত ছিলেন শশীশেখরবাবুর স্ত্রী অনুরাধা আর অর্ণব।

গুরুদাস বললেন— শশীশেখরবাবু আর মিসেস লাহিড়ির ব্যাপারে যেটুকু জানতে পারা গেছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে ছাত্রজীবনে দু-জনেই বেশ ভালোভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শশীশেখরবাবু আন্দোলন করতে গিয়ে একাধিকবার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন আর বারদুয়েক হাজতবাসও করেছেন। তবে মিসেস লাহিড়ির সেরকম কোনো রেকর্ড অবশ্য পাওয়া যায়নি। এটা এমন কোনো ঘটনা নয় যাতে তাঁকে কেউ ব্ল্যাকমেল করতে পারে। এরপর, হিমাদ্রিশেখর। রগচটা বলে তাঁর ছাত্রমহলে বদনাম থাকলেও, তাঁর কোনো ক্রিমিনাল ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। প্রতিমাও তথৈবচ। ইনিও তাঁর দাদার মতো রগচটা। তবে, উনি যে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে ছিলেন, তাঁরা কখনোই পটাশিয়াম সায়ানাইড ব্যবহার করে না। বলা যেতে পারে যে নরহত্যা করবার মতো মানসিকতার ইতিহাস এঁদের নেই। তবে, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘আন্ডার এক্সট্রিম প্রোভেকেশন’ তাঁরা যে এরকম কিছু করতে পারেন না, সে কথা জোর করে বলা যায় না।

অনুরাধা বললেন— আর চন্দ্রশেখর?

—সে একটা নামকাটা সেপাই। হেন ক্রাইম নেই যা সে করেনি বা করতে পারে না। পুলিশ তাকে ধরবার অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি। প্রত্যেকবারই সে পাঁকাল মাছের মতো পিছলে বেরিয়ে গেছে। এইবার, সাগর, তুমি বলো যে কুড়ি তারিখের আলোচনায় ওরা যা-যা বলেছেন তাতে কোন ব্যাপারটা তোমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে।

সাগর বলল— একটা তো নয়, অনেকগুলো ব্যাপারই আমার কাছে অত্যন্ত দরকারি বলে মনে হয়েছে।

—যথা?

—প্রথমত, চন্দ্রশেখরের ব্যাবসায় ইদানীং অত্যন্ত মন্দা যাচ্ছিল। পুলিশের উপদ্রব এবং অন্যান্য কারণে তার চিত্তে সুখ ছিল না। ফলে, আগে তিনি বাড়িতে যদিও সবসময়ে খুব হাসিখুশি থাকতেন, কিন্তু কিছুদিন যাবৎ খুব গম্ভীর আর চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। হয়তো এই জন্যেই তাঁর বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ না-হলেও কমে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, ঘটনার দিন আটটা নাগাদ তিনি ব্রেকফাস্ট খেয়েছিলেন আর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী তাঁর মৃত্যু ন-টার সময়। তৃতীয়ত, সেদিন সকাল থেকেই প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। চতুর্থত, ব্রেকফাস্ট খাওয়ার সময়, তাঁর কাছে ঘন্টু নামের একটি লোক এসেছিল। লোকটি তাঁর বিজনেস পার্টনার মধুকর মণ্ডলের সাগরেদ, মাঝে-মাঝেই সে তাঁর কাছে আসত। তাঁদের রান্না আর খাওয়ার জায়গা বরান্দার একটি ঘেরা অংশে। উনি সেখান থেকে ঘন্টুকে নিয়ে শোওয়ার ঘরে চলে যান। মিনিটদুয়েক বাদে বেরিয়ে আসেন হাসতে হাসতে। এসে বলেন, ‘যাক বাবা,বাঁচা গেল। এবার দেখব, ব্যাটা আর কতদিন রোয়াবি দেখাতে পারে।’ আর সব শেষে, চন্দ্রশেখর আজকাল একটা অদ্ভুত পেটের যন্ত্রণায় ভুগছিলেন, কোনো ডাক্তারই সেটা সারাতে পারছিলেন না।

ভয়ানক গম্ভীর হয়ে গুরুদাস বললেন— সেদিন যে খুব গরম পড়েছিল, এটাও তোমার মতে একটা খুব প্রয়োজনীয় তথ্য? তুমি কি বলতে চাও, সেদিন গরম না পড়লে চন্দ্রশেখর খুন হতেন না।

—না, আমি তা বলতে চাই না। সেদিন গরম না পড়লে, রহস্যটা এতটা জটিল হত না।

—বটে? যাহোক, তুমি একের-পর-এক তোমার পয়েন্টগুলো ব্যাখ্যা করে বলো।

—বেশ। প্রথমে ধরা যাক চন্দ্রশেখরবাবুর ব্যাবসার কথা। তাঁর কাজ ছিল, প্রথমত লোক ঠকিয়ে টাকা রোজগার করা। পুলিশ তাঁকে ধরতে পারেনি, তাঁর গতিবিধিও বন্ধ হয়নি। তাহলে তাঁর রোজগারপাতি কমে গিয়েছিল কেন? এর জন্যে কী পুলিশের ঝামেলা দায়ি, না অন্য কোনো কারণ?

গুরুদাস বললেন— একটা কারণ হতে পারে তাঁর দলের মধ্যে গণ্ডগোল। দলের যে মদত তাঁর পাওয়ার কথা, তা সে পাচ্ছিল না।

—ঠিক তাই। এরপর দেখুন, ব্রেকফাস্ট খাওয়ার সময়, ঘন্টু নামক একটা লোক এসেছিল। খাওয়া বন্ধ করে তাকে নিয়ে চন্দ্রশেখরবাবু ঘরে চলে যান। সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন হাসতে হাসতে। তার মানে, ঘন্টু তাঁকে এমন কিছু দিয়েছিল যা তাঁকে খুশি করেছিল। সেটা, ধরে নেওয়া যেতে পারে, দশহাজার টাকা যা গুনবার সময় তাঁর মৃত্যু হয়। তখন তাঁর টাকার টানাটানি চলছে। বাড়িতে আগে থেকে গুনে না-রাখা দশহাজার টাকা না-থাকাই স্বাভাবিক। ঘন্টুই যে সেই টাকাটা এনে দিয়েছিল, তাতে সন্দেহ থাকে না। কোত্থেকে এল সেই টাকা?

—তুমি কি সেটাও ধরতে পেরেছ?

—ঠিক ধরতে পেরেছি কি না জানি না, তবে অনুমান করতে পারি।

—কী করে অনুমান করলে?

—চন্দ্রশেখরবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে যে মন্তব্য করেন, তার থেকে। উনি বলেছিলেন, ‘যাক বাবা, বাঁচা গেল। এবার দেখব, ব্যাটা আর কতদিন রোয়াবি দেখাতে পারে।’ ‘যাক বাবা, বাঁচা গেল’ থেকে বোঝা যায় যে ঘন্টু তাঁকে যে টাকা দিয়ে গেছে সেটা তাঁর খুব দরকার ছিল। আর ‘এবার দেখব, ব্যাটা আর কতদিন রোয়াবি দেখাতে পারে’ থেকে অনুমান করা যায় টাকাটা যে ব্যাটার কাছ থেকে এসেছে তাঁর রোয়াবি চন্দ্রশেখরবাবুর একেবারেই পছন্দ নয়। এই ব্যাটা যে মেসোমশাই সেটা ধরে নেওয়া যেতে পারে। চন্দ্রশেখরবাবু মেসোমশাই-এর কাছে দশহাজার টাকাই দাবি করেছিলেন আর মেসোমশাই-এর স্বচ্ছলতা যে বসাকপাড়ার পরিবার ভালো চোখে দেখে না সেটা আমরা জানি।

—তোমার এই অনুমান কিন্তু কিছু প্রশ্ন ওঠে।

—আমি জানি। আর একটু বিশদভাবে বলি। ‘এবার দেখব’ কথাটা থেকে দুটো জিনিস বোঝা যায়। প্রথমত, চন্দ্রশেখরবাবু খুব একটা নিশ্চিন্ত ছিলেন না যে টাকাটা আদায় করা যাবে কি না। আর আদায় যখন হল, তখন তিনি বুঝতে পেরে গেলেন যে এবার মেসোমশাইকে দোহন করা যাবে বেশ ভালোভাবে এবং কিছু দিনের মধ্যেই তাঁকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া যাবে।

গুরুদাস উত্তেজিতভাবে সোফার ওপরে সোজা হয়ে বললেন— কী বলতে চাইছ তুমি?

—আমি বলতে চাইছি যে চন্দ্রশেখরবাবু যখন মাসিমাকে ফোন করেছিলেন তখন তিনি স্থির নিশ্চিত ছিলেন না যে মেসোমশাইয়ের সত্যিই প্রকাশ করার অযোগ্য কোনো অতীত ইতিহাস আছে কি না। টাকাটা পাওয়া যেতে সে ব্যাপারে তাঁর আর কোনো সন্দেহ রইল না। অর্থাৎ কেউ তাঁকে উপদেশ বা পরামর্শ দিয়েছিল মাসিমাকে ফোন করবার জন্য। সে কে হতে পারে?

গুরুদাস দাঁতে দাঁত চেপে বললেন— মধুকর মণ্ডল। সেই ঘন্টুর হাত দিয়ে টাকাটা পাঠায়। সে জানত যে তাঁর পরামর্শটা ভিত্তিহীন, কাজেই সেটা তাঁর নিজের টাকা। আর ঘন্টুই বিষটা চন্দ্রশেখরের হাতে তুলে দেয় আর কোনোভাবে সায়ানাইডের শিশিটা তাঁর টেবিলের ড্রয়ারের মধ্যে রেখে দেয়।

সাগর হেসে বলল— ঠিক তাই। তবে আমার ধারণা, শিশিটা ড্রয়ারের ভেতরে রাখাটা বোধ হয় ওরিজিনাল প্ল্যানের মধ্যে ছিল না। ঘন্টু নার্ভাস হয়ে ওই ভয়ানক বিষ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের পকেট থেকে বের করে দেওয়ার জন্যই কর্মটি করে।

—নোটগুলোর ওপরে সায়ানাইড ছিল না কেন? মধুকর বোধ হয় জানত না যে চন্দ্রশেখরের জিভ দিয়ে আঙুল ভিজিয়ে টাকা গোনার অভ্যাস আছে কি না, তাই না?

—হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। মধুকরই গোপনে চন্দ্রশেখরবাবুর পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে নিচ্ছিল। তাকে মাঝেমধ্যেই গণ্ডগোলে ফেলছিল যাতে সে ব্যাবসাটা কুক্ষিগত করতে পারে। কিন্তু তাতে দেরি হচ্ছিল বলেই সে অনেক আঁটঘাঁট বেঁধে, নিজের পকেট থেকে টাকাটা পাঠিয়ে, তাঁর বন্ধুকে খুন করে। আমার ধারণা, আপনি খোঁজ নিলে দেখবেন যে সে-ই পুলিশকে খবর দিয়ে ঝামেলাগুলো করাত। পুলিশ কিছু করতে পারেনি তার কারণ তাঁরা সঠিক বা পুরো খবর পেত না। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ তা পেলে তো মধুকরও ফেঁসে যেতে পারত। সে শুধু চন্দ্রশেখরবাবুকে দুর্বল করে দিচ্ছিল যাতে তাঁর আত্মহত্যাটা পুলিশ মেনে নেয়।

—বিষটা সে চন্দ্রশেখরকে খাওয়াল কী করে?

—দেখুন, সকাল আটটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট শেষ করে সবাই হাসপাতালে চলে গেল। তখন, চন্দ্রশেখরবাবু ঘরের দরজা বন্ধ করে টাকা গুনতে বসলেন। ন-টা নাগাদ তাঁর মৃত্যু হল। ঠিক এক ঘণ্টা বাদে। কেন?

শশীশেখর রুদ্ধনিশ্বাসে বললেন— কেন?

—সেটা বোঝা তো কঠিন নয়। মনে রাখতে হবে যে চন্দ্রশেখরবাবু আজকাল এমন একটা অদ্ভুত পেটের যন্ত্রণায় ভুগছিলেন যেটা কোনো ডাক্তারই সারাতে পারছিলেন না। এমন অবস্থায় আমরা কী করি? হোমিয়োপ্যাথিক ওষুধ ট্রাই করি। এই হোমিয়োপ্যাথিক ওষুধ কোনোকিছু খাওয়ার এক ঘণ্টা বাদে খেতে হয়। এটা পাওয়া যায় ছোটো শিশিতে গ্লোবিউলে নয়তো কাগজের পুরিয়ায় সাদা পাউডার হিসেবে। এই পাউডারের সঙ্গে সায়ানাইড মিশিয়ে দেওয়া অত্যন্ত সহজ কাজ। তাই করা হয়েছিল। চন্দ্রশেখরবাবু মধুকরকে সন্দেহ করতেন কি না জানি না। কিন্তু তাঁর দেওয়া মেসোমশাই সংক্রান্ত খবরটা যখন ঠিক প্রমাণিত হল আর তাঁর লোক টাকাটাও এনে দিল, তখন তাঁর পাঠানো ওষুধটা খেতে আর তো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।

গুরুদাস বললেন— আচ্ছা, তাই তুমি গরমের কথা বললে? ঘরে জোরে ফ্যান চলছিল। চন্দ্রশেখর মারা যেতে পুরিয়ার কাগজটা তাঁর হাত থেকে পড়ে যায় আর ফ্যানের হাওয়ায় উড়ে চলে যায় খাট বা আলমারির নীচে। ঘর সার্চ করলেও সেটা কারুর নজরেই পড়ত না। বাঃ, বাঃ, চমৎকার। অসাধারণ। আমি ভাবতেই পারিনি… সে যাক। এবার তাহলে আমরা ঘন্টুকে অ্যারেস্ট করার ব্যবস্থা করি?

সাগর হাসল। বলল— তাকে বোধ হয় পাবেন না। সে হয় গা ঢাকা দিয়েছে নয়তো আর ইহজগতে নেই।

—আর মধুকর?

—তাকে হয়তো পাবেন। সে থাকে কোথায়?

—বসাকপাড়াতেই থাকে। গঙ্গার দিকে।

—তাহলে, পাড়ার কোনো হোমিয়ো ওষুধের দোকানে খোঁজ নিলেই জানা যাবে যে ঘন্টু সম্প্রতি সেখান থেকে কোনো ওষুধ কিনেছিল কি না। এর ভিত্তিতে, দেখুন, তাঁর পেটের থেকে কথা বের করতে পারেন কিনা।

গুরুদাস হাজরা হেসে উঠে বললেন— ও তুমি ভেব না। পেটের কথা টেনে বের করাই তো আমাদের কাজ। তাঁর অনেক রাস্তা আছে। সেটা আমি ম্যানেজ করব।

 চিন্ময় গুহর মৃত্যুরহস্য

উত্তরাঞ্চল প্রদেশের ভোগরাই গ্রামের নাম এখনও সর্বত্র খুব পরিচিত নয় তবে ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। হিমালয়ের এই অঞ্চলে যারা ট্রেকিং করে, তারা এর নাম জানে। আগে এখানে হেঁটে যেতে হত, এখন বাস চলাচলের উপযোগী রাস্তা হয়ে গেছে।

গ্রামটি একটি প্রশস্ত উপত্যকার ওপরে। তার চারপাশে গাঢ় সবুজ জঙ্গলে ঢাকা আকাশছোঁয়া পাহাড়গুলো মনে হয় যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। তাদের ফাঁকে ফাঁকে দেবতাত্মা হিমালয়ের অনেকগুলো শুভ্র তুষারমণ্ডিত চুড়ো উঁকি দিয়ে গ্রামটির সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে দেখে। গ্রামটির কাছেই একটি বেশ উঁচু ঝরনা আছে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে মিনিট পনেরো লাগে। তার পাশেই রয়েছে মহাকাল শিবের একটি অতি প্রাচীন মন্দির।

সরকারি তৎপরতায় গ্রামটিকে একটি পর্যটনকেন্দ্র করে গড়ে তোলার কাজ চলছে কয়েক বছর ধরে। একটা ইউথ হস্টেল আগে থেকেই ছিল, তার ওপরে আরও কয়েকটা হোটেল তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে। বছর দুয়েক হল, কলকাতার প্রতিষ্ঠান ওরিয়েন্টাল ইন এখানে রিট্রিট নামে একটি সুদৃশ্য চারতারা হোটেল বানিয়েছে। তবে লোকজন আশানুরূপ আসছে না। সেজন্য তারা সপরিবারে সাংবাদিক দীপঙ্কর চৌধুরিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল যাতে তিনি কলকাতায় ফিরে কাগজে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মতো রিট্রিট সম্পর্কে কিছু লেখেন। পুজোর ছুটি চলছিল। কাজেই অতসীর সঙ্গে সাগর আর শ্রীলতাও দীপঙ্করের সঙ্গী হয়ে গেল।

রিট্রিট ভোগরাই গ্রামের থেকে একটু দূরে জঙ্গলের ভেতরে। হোটেলের চৌহদ্দি বেশ উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ভেতরে একটা বাড়ি নয়, অনেকগুলো কটেজ গাছপালার মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কটেজগুলোর মধ্যে যাতায়াতের জন্যে রয়েছে পাথরে বাঁধানো সরু পায়ে চলার পথ। প্রত্যেকটি কটেজের সামনে ফুলের বাগান আর ভেতরে আরামপ্রদ থাকবার ব্যবস্থা। এ ছাড়াও রয়েছে সুইমিং পুল, জিমনেশিয়াম, লাইব্রেরি, বই-এর দোকান, কিউরিও শপ ইত্যাদি।

কাঠগুদাম থেকে জিপে ভোগরাই পৌঁছুতে রাত হয়ে গেল। রাত্রের খাওয়া সেরে বিছানায় শোওয়ামাত্র সকলে ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন ঘুম ভাঙল। না, পাখির ডাকে নয়, লোকজনের চ্যাঁচামেচিতে। ব্যাপারটা কী জানবার জন্য দরজা খুলে বাইরে এলেন দীপঙ্কর, সঙ্গে সাগর। দেখা গেল হোটেলের কিছু উত্তেজিত কর্মচারী কলরব করতে করতে তাঁদের কটেজের সামনে দিয়ে চলেছে, আর তাদের পেছনে পেছনে আসছেন ওই সাতসকালেই স্যুটেড-বুটেড হোটেলের ম্যানেজার ভবানীপ্রসাদ রায়, একজন ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ ইন্সপেক্টর আর জনা চারেক বন্দুকধারী কনস্টেবল।

আগেরদিন রাত্রে ভবানীপ্রসাদের সঙ্গে দীপঙ্করের পরিচয় হয়েছিল। তাঁকে ডেকে দীপঙ্কর জিগ্যেস করলেন— কী হয়েছে মি. রায়? এতসব পুলিশ-টুলিশ এসেছে কেন?

ভবানীপ্রসাদ টাকমাথা মোটাসোটা মানুষ। দীপঙ্করের প্রশ্ন শুনে টাই-এর নট ঠিক করতে করতে বললেন— আর বলবেন না মশাই। যতসব বিচ্ছিরি ঝামেলা। এসব একটু মিটে যাক। আপনারা ব্রেকফাস্ট করে আমার অফিসে আসুন, তখন সব বলব।

ব্রেকফাস্টের পর, কিচ্ছু কিনবেন না বলতে বলতে অতসী কিউরিও শপে চলে গেলেন। সাগর আর শ্রীলতাকে নিয়ে দীপঙ্কর গেলেন রিসেপশন কাউন্টারের পেছনে ভবানীপ্রসাদের অফিসে। রায়সাহেব তখন গম্ভীরভাবে কতগুলো কাগজপত্র দেখছিলেন। অতিথিদের ঢুকতে দেখে সেসব সরিয়ে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে অভ্যর্থনা জানালেন।

দীপঙ্করের প্রশ্নের উত্তরে রায়সাহেব জানালেন যে তাঁর একজন গেস্ট অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে মারা গেছেন। না, হোটেলে নয়, বাইরে জঙ্গলে। গেস্টটির নাম ড. চিন্ময় গুহ, বাড়ি শ্যামবাজারের মুনীন্দ্র মিত্র লেনে। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক। ড. গুহ এর আগেও কয়েক বার এই হোটেলে এসেছেন। অত্যন্ত নিরীহ, নির্বিরোধ মানুষ। সারাদিন পাহাড়ে, জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। কেবল রাত্রে ঘরে শুতে আসতেন। মাঝে মাঝে দু-তিনদিন তাও আসতেন না। গতকাল দুপুরে যথারীতি উনি হোটেল থেকে বেরিয়ে যান। রাত্রে ফিরে না-আসায় কেউ উদবিগ্ন হয়নি। তাঁর যে-কোনো বিপদ হয়েছে তা কারোরই মনে হয়নি।

আজ ভোর না-হতে ভোগরাই থানার ওসি সুলেমান কুরেশি সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে এসে হাজির। কাল রাত্রে একজন কনট্রাক্টরের লোক একটা রক্তমাখা ছিন্নভিন্ন শার্ট আর ড. গুহর একটা ব্যাগ থানায় জমা দেয়। এখান থেকে মাইল দুয়েক দূরে একটা বড়ো লেবার কলোনি আছে। তার পেছনে জঙ্গলের ভেতরে সে ওগুলো কুড়িয়ে পায়। কুরেশি ড. গুহর ঘর সার্চ করে সেটা সিল করে দিয়ে গেছেন। ব্যাপার দেখে মনে হচ্ছে যে ড. গুহ কোনো হিংস্র বন্যজন্তুর আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন।

সাগর জিজ্ঞাসা করল— এ অঞ্চলে বন্যজন্তুর আক্রমণের ঘটনা কি আগে কখনো ঘটেছে?

ভবানীপ্রসাদ বললেন— আমি কখনো শুনিনি। তবে চারদিকে এত ঘন জঙ্গল। ওপর থেকে ভালুক বা নীচ থেকে বাঘ এখানে চলে আসতেই পারে।

—আপনি যে লেবার কলোনিটার কথা বললেন সেটা ঠিক কোথায়?

—ওটা এখানে আসার বাস-রাস্তার ধারে একটা টিলার ধারে। চারদিকে যত কন্সট্রাকশনের কাজ চলছে, তার ওয়ার্কাররা ওখানে থাকে।

—ওখানে যারা থাকে তারা কি কখনো বাঘ-ভাল্লুকের উপস্থিতি টের পেয়েছে?

—মনে হয় না। সেরকম কিছু হলে খবর পেতুম।

—ইতিহাসের অধ্যাপক পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন কেন?

—এখানে নাকি কোনো এককালে একটা বৌদ্ধবিহার না কী যেন ছিল? সেটারই সন্ধান করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল।

.

ভবানীপ্রসাদের অফিস থেকে বেরিয়ে সুইমিং পুলের কাছে এসে দেখা গেল তার ধারে হোটেলের বাসিন্দাদের একটি উত্তেজিত জটলা। সকলেই অবাঙালি, সবাই সমস্বরে ড. গুহর মারা যাওয়া নিয়ে কথা বলছেন। কার কথা কে শুনছেন বোঝা দুষ্কর।

এই জটলার থেকে একটু দূরে একটা টেবিলে দু-জন মাঝবয়সি ভদ্রলোক অত্যন্ত চিন্তিতমুখে চুপচাপ বসে ছিলেন। একজন কিঞ্চিৎ স্থূলকায়, চোখে রিমলেস সোনার ফ্রেমের চশমা আর পরনে পাজামা-পাঞ্জাবির ওপরে মহার্ঘ কাশ্মীরি শাল। অন্যজনের দোহারা চেহারা, পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি-জহরকোট আর শাল। তাঁরা কেন যে অন্যান্যদের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দেননি, সেটা বোঝা গেল না।

এই দু-জনের পাশে একটা খালি টেবিলে দীপঙ্কর ছেলেমেয়েকে নিয়ে বসে পড়লেন। সাগরকে প্রশ্ন করলেন— ভবানীপ্রসাদের সঙ্গে আলোচনায় কিছু বুঝলি?

সাগর গলাটা একটু উঁচু করে বলল— কিছুই না। কেবল, কতগুলো জায়গায় খটকা লেগেছে।

—যথা?

—এক নম্বর, পুলিশ অত সকালে এল কেন? এরকম তো সাধারণত হয় না। দু-নম্বর, দু-মাইল দূরে জঙ্গলের মধ্যে কোনো বন্যজন্তুর শিকার; একজনের ঘর সার্চ করতে চারটে রাইফেলধারী সেপাই আনবার দরকার পড়ল কেন? দারোগা কি আশঙ্কা করছিলেন যে বন্যজন্তুটা ওই ঘরের মধ্যে বসে আছে? তিন নম্বর, ড. গুহ যে বৌদ্ধবিহার খুঁজছিলেন, সেটা কার কাজ? নিজের না বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের? বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের যদি হত, তাহলে তারা তাঁকে নিশ্চয়ই চারতারা হোটেলে রাখত না। তাহলে, ধরে নেওয়া যেতে পারে যে এটা নিজের জন্যই। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে যে এত খরচ করে কোনো সহকারী ছাড়াই তিনি এই কাজটি করছিলেন কেন? চার নম্বর, ড. গুহ যে মৃত তার প্রমাণ হিসেবে যা দেখানো হয়েছে সেটা তাঁর একটা রক্তমাখা শার্ট। কেন? বাকি জামাকাপড় কোথায় গেল? সেগুলো কি ভালুকবাবাজি তাঁর ছেলেকে দেওয়ার জন্য নিয়ে গিয়েছেন?

সাগর তার বক্তব্য শেষ করা মাত্র পাশের টেবিলের ভদ্রলোক দু-জন হাততালি দিয়ে উঠলেন। রিমলেস চশমা বললেন— সাবাস! তুমি তো বড়ো হলে মস্ত ডিটেকটিভ হবে হে। এ তো রীতিমতো প্রতিভা।

বলতে বলতে দু-জনে তাঁদের চেয়ার টেনে এনে দীপঙ্করের টেবিলে বসে পড়লেন। পরিচয়পর্ব শেষ হলে জানা গেল যে রিমলেস চশমার নাম প্রফেসর জয়নারায়ণ বসাক, মৌলানা আব্দুল মজিদ কলেজে ইতিহাস পড়ান আর অন্যজনের নাম ড. রমারঞ্জন সিংহ। ওঁরা দীর্ঘদিনের বন্ধু, সবসময় একসঙ্গে বেড়াতে বের হন।

প্রফেসর বসাক বললেন— তুমি যে রহস্যের লিস্ট দিলে তাতে আমরা আরও গোটা দুয়েক আইটেম যোগ করতে চাই। হয়তো তাতে তোমার অ্যানালিসিস-এ সুবিধে হবে।

সাগর সহাস্যে বলল— কী আইটেম?

—তুমি তো চার নম্বরে শেষ করেছিলে, এবার পাঁচ নম্বর। হোটেলের খাতায় চিন্ময় গুহর যে ঠিকানা দেওয়া আছে, সেটা ভুয়ো। আমি খাস শ্যামবাজারের লোক, আমাদের ওখানে বন কেটে বসত বলতে পারো। শ্যামবাজার-বাগবাজারের প্রতিটি গলিঘুঁচি আমার নখদর্পণে। আমি হলফ করে বলতে পারি যে শ্যামবাজারে মুনীন্দ্র মিত্র লেন বলে কোনো রাস্তা নেই, কস্মিনকালেও ছিল না। তারপর ছ-নম্বর। আমার এই বন্ধুটি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে গত চার বছর যাবৎ অর্থনীতি পড়াচ্ছে। ও বলছে যে ওখানে চিন্ময় গুহ নামের কোনো অধ্যাপক নেই। চারবছর আগে যদি থেকে থাকেন তো সেটা আলাদা কথা। সেক্ষেত্রে জানা দরকার যে, এতবছর বাদে সেই পরিচয় জাহির করবার কারণটা কী?

সাগর জিগ্যেস করল— আপনারা কবে এখানে এসেছেন? ওই লোকটির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল কি?

—আমরা পরশু রাত্রে এসেছি, সস্ত্রীক। কাল ব্রেকফাস্ট করবার জন্য ডাইনিং রুমে যখন যাই, তখন লোকটা আমাদের পাশের টেবিলেই বসেছিল। লম্বা-চওড়া স্বাস্থ্যবান লোক, তামাটে গায়ের রং, উশকো-খুশকো কাঁচা-পাকা চুল, পরনে জিনস আর গলাবন্ধ রংচঙে সোয়েটার। বয়েস তিরিশ থেকে পঁয়তিরিশের মধ্যে। দেখে বাঙালি বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু যেচে আলাপ করতে যাইনি। আমার গিন্নির আবার কৌতূহল বড্ড বেশি। তিনি নাকি দেখেছেন যে লোকটা খেতে খেতে একটা ম্যাপ দেখছিল। তারপরে আর তাঁকে দেখিনি।

—আচ্ছা, আপনি তো ইতিহাস পড়ান। আপনার কি মনে হয় যে এখানে কোনো প্রাচীন বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসস্তূপ থাকা সম্ভব?

—হ্যাঁ, সেটা খুব সম্ভব। চীন থেকে ফা-হিয়েন বা হিউ-এন-সাঙের মতো যেসব পরিব্রাজক অতীতে ভারতবর্ষে আসতেন বৌদ্ধ তীর্থক্ষেত্রগুলো দর্শন করতে, তাঁদের একাধিক পথের মধ্যে একটির ওপরে এই ভোগরাই গ্রামটি পড়ে। যাঁরা আফগানিস্তান বা গান্ধার থেকে খাইবার পাস পেরিয়ে পুরুষপুর বা পেশোয়ার হয়ে কুশীনগর, বুদ্ধগয়া ইত্যাদি দেখে গৌড় বা কর্ণসুবর্ণ হয়ে তাম্রলিপ্তে গিয়ে দেশের জাহাজ ধরতেন, তাঁরা চাইলে এখানে বিশ্রাম নিতে পারতেন। এ-অঞ্চলের আদিবাসীদের প্রাচীন ভাষায় ভোগরাই শব্দের মানে— খুব ভালো সরাইখানা। অবশ্য সেই রাস্তাটা আজ আর খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সে-ব্যাপারে সন্দেহ আছে।

অধ্যাপক বসাকের কথা শুনতে শুনতে সাগর অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়ল। সেটা অধ্যাপক লক্ষ করলেন। বললেন— কী হল? আমার কথায় চিন্তার খোরাক পেলে বলে মনে হচ্ছে যেন?

—না, না, ও কিছু নয়। আপনাদেরও তো দেখে খুব চিন্তিত বলে মনে হচ্ছিল। সেটা কি ঠিক?

—হ্যাঁ, আজ সকালে সব খবর শুনে আমরা চিন্তা করছিলুম যে পুলিশের কাছে গিয়ে সবকথা বলা আমাদের উচিত হবে কি না। আবার এও ভাবছিলুম যে কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে এসে গায়ে পড়ে পুলিশ ছুঁয়ে যদি ছত্রিশ-ঘা হয়, তখন এই বিদেশ-বিভুঁয়ে সেটা সামলাতে পারব তো?

দীপঙ্কর বললেন— না, না, আপনারা কেন যাবেন? আপনারা যা বললেন, সে তো পুলিশ তদন্ত শুরু করলেই বেরিয়ে আসবে। খামোকা ওদের পরিশ্রম লাঘব করতে যাবেন কোন দুঃখে? তা ছাড়া সত্যিই তো, এর মধ্যে জড়িয়ে পড়লে আপনাদের হাঁড়ির হাল হয়ে যেতে পারে। আর লোকটা যখন বাঘের পেটেই গেছে তখন সে পাজিই হোক বা জালই হোক, পুলিশ আর তা নিয়ে মাথা খামাবে বলে তো মনে হয় না।

কথাটা শুনে দুই বন্ধু নিশ্চিন্ত হলেন বলে মনে হল। ড. সিংহ বললেন— আপনি সাংবাদিক, এসব ব্যাপার আপনিই ভালো জানবেন। এবার আমরা তাহলে উঠি? আমাদের গৃহিনীরা গেছেন মাউন্ট ভিউ হোটেলে শাড়ির একজিবিশন দেখতে। এখন সেখান থেকে তাঁদের উপড়ে বের করে আনা বিশেষ প্রয়োজন।

অধ্যাপকদের প্রস্থানের পর দীপঙ্কর বললেন— তুই বুঝেছিলি যে ওঁরা বাঙালি, আর এ-ব্যাপারে ওঁদের কিছু বক্তব্য থাকতে পারে, তাই জোরে জোরে কথা বলছিলি, তাই না?

সাগর বলল— ঠিক ধরেছ।

—আমি যেটা বুঝতে পারছি না, তা হল যে ওই লোকটা যদি বর্ধমান ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যুক্ত নাই হয় তাহলে সে ড. সিংহকে চিনল কী করে আর কেটে পড়তেই বা গেল কেন?

—সেটা দু-ভাবে হতে পারে। এক, লোকটা এখানে কোনো একজন আসতে পারে জেনে রোজ হোটেলের রেজিস্টার চেক করতে গিয়ে ড. সিংহের পরিচয় পায় অথবা দুই, রিসেপশনিস্ট তাঁকে ডেকে বলে যে বর্ধমান ইউনিভার্সিটি থেকে আর একজন অধ্যাপক এখানে এসেছেন। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটাই আমার ঠিক বলে মনে হয়।

শ্রীলতা বলল— আহা রে, পালাতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ দিল লোকটা।

সাগর বলল— তোর দুঃখিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমার ধারণা যে লোকটা মরেনি, এখানেই কোথাও গা ঢাকা দিয়ে আছে।

—তা কী করে হয়, দাদা? ওর ছেঁড়াখোঁড়া শার্টটাই কি প্রমাণ করে না যে, লোকটা আর বেঁচে নেই?

—না, বরং তার উলটোটাই প্রমাণ করে।

.

অতসী বললেন— কতবার বারণ করেছি যে ছেলেটাকে এইসব খুনখারাবির মধ্যে যেতে দিও না, তা শুনবে কী কেউ আমার কথা? সুপ্ত প্রতিভা জাগাতে গিয়ে যে লেখাপড়া লুপ্ত হতে বসেছে সে-কথা কী কেউ ভাবে? সামনে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা, সেটা কি কারুর মনে আছে?

দীপঙ্কর হাসতে হাসতে বললেন— আবার কী হল? ছুটিতে বেড়াতে এসে লেখাপড়ার কথা উঠছে কেন? পরীক্ষা-টরীক্ষা কলকাতায় ফিরে। এখন একটু রিল্যাক্স করুক না।

—রিল্যাক্স? এই রিল্যাক্স করার ছিরি? সকাল থেকে চোখ কপালে তুলে বসে আছে ছেলেটা, কথা বললে সাড়া দেয় না। হাঁ করে বসে রহস্যভেদ করছেন। দেখলে গা-পিত্তি জ্বলে যায়।

শ্রীলতা বলল— আঃ, মা। দেখছ দাদা চিন্তা করছে। এইসময় চ্যাঁচামেচি করো না তো।

—তুই আর পোঁ ধরিসনি বাপু। দাদা চিন্তা করছে, তাতো দেখতেই পাচ্ছি। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে তাড়িয়ে হন্যে হয়ে গেল।

দীপঙ্কর বললেন— ঠিক, ঠিক। তা হ্যাঁরে, সাগর, অনেক তো চিন্তা করলি। আর কত করবি?

সাগর বলল— দ্যাখো বাবা, সকাল বেলায় প্রফেসর বসাক আমাদের একটা মোক্ষম ক্লু দিয়েছেন, কিন্তু সেটা যে কী তা কিছুতেই ধরতে পারছি না।

শ্রীলতা একটা চকোলেটের বার এগিয়ে দিয়ে বলল— এটা খা। খেতে-খেতেই দেখবি বুদ্ধিটা ফট করে খুলে যাবে।

সাগর চকোলেট নিয়ে খেতে শুরু করল। একটু বাদেই লাফ দিয়ে বিছানার ওপর উঠে দাঁড়াল। চেঁচিয়ে উঠল— পুরুষপুর! পেয়ে গেছি। বুঝতে পারছিলুম যে পুরুষপুরটা খুব ইম্পর্টান্ট, কিন্তু কীভাবে সেটা ধরতে পারছিলুম না।

শ্রীলতা একচক্কর নেচে নিয়ে বলল— এখন ধরতে পেরেছিস তো? পারতেই হবে। বলেছিলুম না যে চকোলেট খেলেই বুদ্ধিটা ফট করে খুলে যাবে?

অতসী বললেন— তোদের এই পাগলামি বন্ধ করবি? এত আদিখ্যেতা আর সহ্য হচ্ছে না।

সাগর বলল— বাবা, মনে হচ্ছে ব্যাপারটা আমি বুঝতে পেরেছি। কয়েকটা জায়গায় একটু ফাঁক রয়ে গেছে। সেগুলো ভরাট না-করা পর্যন্ত কিছু বলা বোধ হয় উচিত হবে না।

দীপঙ্কর বলল— ফাঁকগুলো ভরাট করার জন্য কী করা দরকার?

—চিন্ময় গুহের শার্টটা একবার দেখা দরকার।

—বেশ তো, চল এখন একবার থানায় গিয়ে কুরেশির সঙ্গে কথা বলে দেখি। আমার পরিচয় পেলে দেখতে দিলেও দিতে পারে।

অতসী আর্তনাদ করে উঠলেন— এই ভর সন্ধে বেলায় তোমরা থানায় যাবে?

দীপঙ্কর মাথা চুলকিয়ে বললেন— যাই-না। কাছেই তো, হাঁটাপথ। যাব আর আসব।

.

ওসি সুলেমান কুরেশি থানায় ছিলেন না, তাঁকে কোয়ার্টাস থেকে ডেকে আনা হল। বেশ খাতির করেই দীপঙ্কর আর তাঁর ছেলেমেয়েদের বসালেন। দীপঙ্করের কথা শুনে অত্যন্ত পুলকিত হয়ে বললেন— এই ছেলেটি সখের ডিটেকটিভ? খুব ক্রাইমের ওপরে বই পড়ে বুঝি? আমি ওকে নিশ্চয়ই সাহায্য করব। কিন্তু এই কেসে রহস্য তো তেমন কিছু নেই। ওই চিন্ময় গুহ নামের লোকটা একটা ফ্রড। এখানে সে যে কী করছিল তা আমি জানি না। তার কাগজপত্র পরীক্ষা করে যে সেটা জানব তারও উপায় নেই, কারণ তার ঘর সার্চ করে কিছুই পাওয়া যায়নি। তবে, চেনা লোকের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে পালাতে গিয়ে মারা পড়েছে, সেটা জানতে পেরেছি। ভালোই হয়েছে, আপদ চুকেছে।

দীপঙ্কর কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। সাগর বাধা দিয়ে বলল— সে তো বটেই। তবে আপনি যদি আমার দু-একটা প্রশ্নের উত্তর দেন তো খুব ভালো হয়।

—নিশ্চয়ই দেব। বলো, কী জানতে চাও?

—আপনি কী করে জানলেন যে লোকটা ফ্রড? আর ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে সে পালিয়েছে?

—আজ দুপুরে কলকাতায় মেসেজ পাঠাই চিন্ময় গুহর বাড়িতে তার মৃত্যুসংবাদ দেওয়ার জন্য। একটু পরেই খবর পাই যে ঠিকানাটা ভুল। তখন বর্ধমান ইউনিভার্সিটিতে ফোন করি। সেখান থেকে জানা গেল যে ওই নামে কোনো অধ্যাপক ওখানে নেই। তখন হোটেলে ফোন করে জানতে পারি যে ওখানে ওই ইউনিভার্সিটিরই একজন অধ্যাপক আছেন আর রিসেপশনিস্ট মহিলা গুহকে সেই খবরটা দেয়। এরপর দুয়ে-দুয়ে চার।

—মি. রায়ের কাছে জানা গেল যে বাসরাস্তার ধারে লেবার-কলোনির পিছনে জঙ্গলের ভেতরে চিন্ময় গুহর রক্তমাখা শার্ট আর ব্যাগ পাওয়া গেছে। আপনি যদি অনুমতি করেন তো সেগুলো আমি একবার দেখতুম।

—সেগুলো তো এখানে নেই। এই কিছুক্ষণ আগে আমার লোক সেগুলো নিয়ে দিল্লি চলে গেল ফোরেনসিক পরীক্ষা করানোর জন্য। ফোরেন্সিক পরীক্ষা কাকে বলে জানো তো?

সাগর সহাস্যে বলল— হ্যাঁ, জানি। আচ্ছা, কোনো হিংস্র জন্তু গুহসাহেবকে আক্রমণ করেছিল বলে আপনার মনে হয়? ভালুকদের তো এখন ঘুমোনোর সময়। আর, হতে পারে বাঘ। এখানে যে বাস-রাস্তা দিয়ে সারারাত বড়ো বড়ো মালবোঝাই ট্রাক, ট্র্যাক্টর, ক্রেন বা অন্যান্য কন্সট্রাকশনের মেশিনপত্র প্রচণ্ড শব্দ করে চলাচল করছে, তার ত্রিসীমানায় কোনো বাঘ কি আসতে পারে কখনো?

কুরেশি ব্যাজার হয়ে বললেন— তা আমি কী করে বলব? বাঘ-ভাল্লুক তো আর আমার সঙ্গে পরামর্শ করে জঙ্গলে ঘুরতে বেরোয় না। তুমি কী জানতে চাইছ সেটা পরিষ্কার করে জিগ্যেস করো তো।

—তাই করব। তবে, তার যে উত্তর আপনি দেবেন সেটা শুধু আমাদের এই ক-জনের মধ্যেই থাকবে। আমার বাবা সাংবাদিক হলেও তিনি তা প্রকাশ করবেন না কারণ তা করলে আমাদেরই দেশের ক্ষতি হবে। আর, কেবলমাত্র আমার কৌতূহল মেটানোর জন্য যদি আপনি জবাব না দেন, তাহলেও কোনো অসুবিধে নেই। আমরা তো আর কয়েক দিনের মধ্যেই জানতে পারব যে আমার সন্দেহটা ঠিক না ভুল।

দীপঙ্কর ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে বললেন— ব্যাপারটা কী বল তো? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

কুরেশি দীপঙ্করকে পাত্তা না-দিয়ে একটু রূঢ়ভাবেই সাগরকে বললেন— বক্তৃতা না-দিয়ে আসল কথাটা কী তা বলবে?

—হ্যাঁ। আমার ধারণা গুহসাহেব বর্ধমান থেকে আসেননি, এসেছেন দিল্লি থেকে। তিনি এখন খুব সম্ভবত আপনার বাড়িতেই আছেন। আপনারা দিল্লি থেকে ফোর্স আসবার অপেক্ষা করছেন। এলেই, রেড শুরু করবেন। আমার অনুমানটা কি সঠিক?

সাগরের কথা শুনতে শুনতে কুরেশি এমন মুখব্যাদান করলেন যে তাঁর চোয়ালটা প্রায় টেবিলে ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থা হল। কোনোরকমে সামলে নিয়ে কাষ্ঠ হেসে বললেন— তোমার এহেন অনুমানের কারণটা জানতে পারি?

—কারণ অনেকগুলো। তারা এইরকম। প্রথম, একজন প্রফেসর, তাঁর যতই ব্যক্তিগত টাকাপয়সা থাক না-কেন, তাঁর রিসার্চের জন্য একটা দামি ফোরস্টার হোটেলে এসে বার বার উঠবেন না। তিনি যা দিয়ে রিসার্চ করছেন বলে বলেছেন, সেটার থেকে যদি প্রচুর অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকত, তাহলে হয়তো এটা মেনে নেওয়া যেতে পারত। একটা বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার সেরকম কোনো ব্যাপার নয়।

—তা কেন? ওই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে কোনো গুপ্তধন তো থাকতে পারে, তাই না?

—হয়তো পারে। তবে, সেটা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের থাকবার জায়গা না-হয়ে কোনো রাজপ্রাসাদ-টাসাদ হলে সেই সম্ভাবনাটা প্রবলতর হত। এখানে সেরকম কোনো রাজপ্রাসাদ কস্মিনকালেও ছিল বলে ইতিহাসে লেখে না। এর থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে যে বৌদ্ধবিহার বাজে কথা, গুহসাহেব এখানকার জঙ্গলে অন্য কিছু খুঁজছিলেন আর থাকবার জন্য এই হোটেলটা বেছে নিয়েছিলেন। তার অন্যতম কারণ এখানে যাঁরা এসে ওঠেন তাঁরা কেউ অন্য কারুর ব্যাপারে নাক গলান না। এমনকী বাঙালিরাও, এই যে দাদা আপনিও বাঙালি আমিও বাঙালি, বলে এ ওর ঘাড়ে পড়েন না। আর এটা হতে পারে যে, এই হোটেলটাও তাঁর নজরদারির লিস্টের মধ্যে ছিল। কেন সেটা পরে বলছি। এবার দ্বিতীয় কারণ। ভদ্রলোক তো এখানে ধরা পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পালালেন। কিন্তু, বন্যজন্তুর হাতে মারা যেতে গেলেন কেন?

—এটা কী একটা কথা হল, ডিটেকটিভ সাহেব? উনি কি বন্যজন্তু ডেকে এনে মারা গেছেন?

—অনেকটা তাই। ছেঁড়া শার্টের গল্পটা একটু কাঁচা হয়ে গেছে। এই শীতে উনি কি শার্ট গায়ে জঙ্গলে ঘুরছিলেন? প্রফেসর বসাকের কথায় জানা গেল সে-সকালে তাঁর পরনে ছিল মোটা রংচঙে সোয়েটার। জঙ্গলে রাত্রি বেলা তার ওপরে নিশ্চয়ই কোট, ওভারকোট ইত্যাদি ছিল। সেগুলো গেল কোথায়? পাওয়া গেল শুধু শার্টটা? তার মানে বোঝা যাচ্ছে যে ভদ্রলোক হোটেল থেকে পালালেন বটে কিন্তু ভোগরাইতেই থেকে গেলেন এবং, সেটা পুলিশের মদতে আর পুলিশকে মদত দেওয়ার জন্য।

—পুলিশকে মদত দেওয়ার জন্য? তা কী করে হয়?

—আপনারা গুহসাহেবের শার্ট আর ব্যাগ পেয়েছেন রাত্রি বেলা আর আজকেই ভোর না-হতে হোটেলের বাসিন্দারা কোথাও বেরিয়ে যাওয়া আগেই একগাদা লোকজন সঙ্গে নিয়ে হইচই করতে করতে হোটেলে গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। এই অস্বাভাবিক ঘটনা থেকে প্রমাণ হয় যে আপনার বা পুলিশের উদ্দেশ্য ছিল হোটেলের সবাইকে জানানো যে গুহসাহেবের মৃত্যু হয়েছে এবং সে-ব্যাপারে আপনারা নিশ্চিত। কিন্তু একথাটা খেয়াল করেননি যে, গুহসাহেব যে আপনাদেরই লোক সেটাও এর থেকে বোঝা যেতে পারে। আরও একটা কথা। যে লোকটির ওপরে গুহসাহেব নজর রাখছিলেন, তাকেও আপনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে কোনো একজন বিশেষ লোককে আপনারা সন্দেহ করছেন না। করলে, হোটেলসুদ্ধু লোকের ঘুম ভাঙিয়ে হইচই করার দরকার পড়ত না।

—লোকটি কে তাও তুমি বুঝতে পেরেছ না কি?

—বোধ হয় পেরেছি। গুহসাহেবের বার বার এই হোটেলে ওঠা থেকে মনে হয় তিনি ম্যানেজার ভবানীপ্রসাদ রায়। তিনিই একমাত্র কন্সট্যান্ট ফ্যাক্টর।

বিচলিত গলায় কুরেশি বললেন— এসব একদম বাজে কথা। বাইরের কোনো লোকের সঙ্গে এসব কথা আলোচনা করবে না। আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি।

মৃদু হেসে সাগর বলল— আপনার সাবধান করে দেওয়ার কোনো দরকার নেই। আমি তো প্রথমেই বলেছি যে আমাদের আলোচনার কথা আর কেউ জানতে পারবে না, আমার বাবা সাংবাদিক হলেও নয়। সে যাকগে। তাহলে একটা কথা স্পষ্ট হল যে গুহসাহেব আপনাদেরই লোক। আর জাল ড. গুহের লুকিয়ে থাকার শ্রেষ্ঠ জায়গা পুলিশের কোয়ার্টাস ছাড়া আর কী হতে পারে?

গভীর ভ্রূকুটি করে কুরেশি বললেন— চিন্ময় গুহ কি খুঁজছিলেন জানো?

—খুব সম্ভবত, একটা রাস্তা, যেটা বহু শতাব্দী আগে লুপ্ত হয়ে গেছে বলে সকলের ধারণা। রাস্তাটা আফগানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে হিমালয়ের ভেতর দিয়ে ভোগরাই ছুঁয়ে জঙ্গলের আড়ালে আড়ালে চলে গেছে নেপালে। প্রফেসর বসাক পুরুষপুর বা পেশোয়ারের নাম না করলে সেটা হয়তো আমার পক্ষে ধরাটা শক্ত হত। মনে হয়, স্মাগলাররা এই পথের সন্ধান জানতে পেরেছে আর অতীতের মতোই এই ভোগরাইকে তাদের একটি স্টেশনে পরিণত করেছে। আমার ধারণা এটা ড্রাগ পাচারের রাস্তা, কারণ এর একদিকে আফগানিস্তান, পাকিস্তান আর অন্যদিকে নেপাল, বিহার, বাংলাদেশ, বর্মা, থাইল্যান্ড ইত্যাদি। আর রাস্তাটা ছাড়া গুহসাহেব খুঁজছিলেন এই চোরাচালান চক্রের পাণ্ডাদের।

—তারা কারা তাও জানো না কি?

—না, সেটা জানি না। তবে গুহসাহেব জানেন। আর, তাদের ধরবার জন্যই উনি বাঘ-ভাল্লুকের গল্প বানিয়ে এখানে থেকে গেছেন। নইলে, সোজা দিল্লি ফিরে যেতেন।

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলেন— আদৌ গল্পটা বানাবার দরকার কী ছিল? স্রেফ গা-ঢাকা দিলেই তো পারতেন।

—আমার ধারণা, এই চক্রের পাণ্ডারা সন্দেহ করছে যে তাদের ওপরে কেউ নজর রাখছে। গুহসাহেবের জঙ্গলে ঘোরাঘুরি যে তাদের সন্দেহ বাড়াচ্ছে সেটা ধরে নেওয়া যেতেই পারে। গুহসাহেবের মৃত্যুসংবাদের গল্পটা তাদের রিল্যাক্স করতে সাহায্য করবে।

কুরেশির ঘরের একপাশে একটা দরজার পরদা সরিয়ে ভেতরে এলেন একজন মধ্যবয়স্ক, উশকো-খুশকো চুল, স্বাস্থ্যবান ভদ্রলোক। বললেন— আমি ওপাশ থেকে সব শুনেছি। তোমার সব অনুমানই ঠিক, কেবল একটি ছাড়া। আমি দিল্লি থেকে আসিনি।

.

ছেলেমেয়েকে নিয়ে প্রবলবেগে চকোলেট খেতে খেতে বিজয়গর্বে ঘরে ঢুকলেন দীপঙ্কর। অতসীকে একটা চকোলেট দিয়ে বললেন— তোমার ছেলে একেবারে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়নি। তার কিছু প্রাপ্তিযোগও ঘটেছে। কী পেয়েছে দ্যাখো। একটা নোটবই আর একটা দামি কলম। দুটোর ওপরেই ছোটো ছোটো করে লেখা ‘ইন্টারপোল’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *