রস ও ব্যক্তিত্ব
[ওসিআর ভার্সন, প্রুফ্ররিড করা হয়নি]
ব্যাপক অর্থে মানুষের সমস্ত লিপিবদ্ধ চিন্তাভাবনাকে সাহিত্য বলা যায়। কিন্তু সাধারণত আমরা বিজ্ঞানকে সাহিত্যের অন্তর্গত করে দেখি না। দর্শন ও ইতিহাসকে যদিও সাহিত্য থেকে পৃথক করা খুব বেশি কঠিন তবু এসবও সাধারণত আমরা সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত জ্ঞান করি না।
বাংলায় এই সংকীর্ণ অর্থে সাহিত্যের প্রচলিত নাম রস-সাহিত্য। নামটি এক হিসাবে বেশ ভাল কেননা এই সংকীর্ণ অর্থে সত্যকার সাহিত্য তাই যা রসোত্তীর্ণ। এর অর্থ অবশ্য এ নয় যে বৈজ্ঞানিক অথবা দার্শনিক অনুসন্ধান ও বিচার অথবা ঐতিহাসিক তথ্য সাহিত্যে অবাঞ্ছিত অথবা অপ্রয়োজনীয়; তবে, প্রকৃত সাহিত্যে এসব অতিক্রম করে থাকা চাই রস অর্থাৎ মানুষের মনের বিশেষ ও গভীর অনুভূতির পরিচয়।।
আমাদের দেশের প্রাচীন সাহিত্যে এই রস বা অনুভূতিকে মোটামুটি কয়েক ভাগে ভাগ করে দেখা হয়েছে, যথা, হাস্য রৌদ্র বীভৎস করুণ ইত্যাদি। আমাদের প্রাচীন আলঙ্কারিকদের সেই রসের নয় বিভাগ যে একালে আমাদের খুশী করতে অক্ষম তা বলাইবাহুল্য, কেননা, মানুষের মন যে অত্যন্ত জটিল, সুতরাং তার অনুভূতিও বহু বিচিত্র, এ বিষয়ে এযুগে আমরা অতিশয় সচেতন। তবে রস, অর্থাৎ অনুভূতির বিশেষ পরিচয়, যে সাহিত্যের এক অতি বড় ব্যাপার সে-সম্বন্ধে প্রাচীনদের নির্দেশ শিরোধার্য। ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম’ তাঁদের দেওয়া সাহিত্যের এই সংজ্ঞা বাস্তবিকই মূল্যবান নির্দেশ।
কিন্তু একালে আমাদের সাহিত্যিক চিন্তাভাবনা যেমন মূল্যবান রস তেমনি মূল্যবান অন্য একটি ব্যাপার-তার নাম সাহিত্যিকের ব্যক্তিত্ব। নানা দেশের নানা কালের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমরা বুঝেছি সাহিত্যে সাহিত্যস্রষ্টার এই ব্যক্তিত্বের মর্যাদা। বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম, আর সাহিত্য ব্যক্তিত্বের বাণীরূপ– সাহিত্যের এই দুই সংজ্ঞাই আজ আমাদের জন্য মহামূল্য।
কিন্তু এ দুটিকে স্বতন্ত্রভাবে বোঝ আমাদের পক্ষে যত সহজ এ দুয়ের পরস্পরের যোগাযোগের তত্ত্বটি বোঝা সেই পরিমাণে দুরূহ, কত দুরূহ তা বোঝ যাবে এই থেকে যে এ-দুয়ের পূর্ণ উপলব্ধির সন্ধান আমরা পাই জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের মধ্যেই, কিন্তু মানুষের দীর্ঘ ইতিহাসে তাঁদের সংখ্যা অতিশয় পরিমিত। সাধারণত কবি সাহিত্যিক নামে যারা পরিচিত তারা মোটের উপর সাহিত্যে রসের অর্থাৎ মাধুর্যের ও কলাকৌশলের কথা কিছু কিছু বোঝেন, কিন্তু ব্যক্তিত্বের কথা খুব কমই বোঝেন। এর দৃষ্টান্ত রয়েছে সংস্কৃত সাহিত্যে। মনোরম পদ ও শ্লোকের রচয়িতা সে-সাহিত্যে প্রচুর সংখ্যায় মেলে, প্রকাশের মার্জিত্ত্বের গুণে অশ্লীল কবিতাও তাতে সাধারণত সুপাঠ্য, কিন্তু সাহিত্যের বাণীতে যেমন চাই মনোহারিতা তেমনি চাই মহাপ্রাণতা, কিন্তু সেটি সম্ভব হয় রচয়িতা নিজে যখন মহাপ্রাণ রচয়িতার নিজের সেই মহাপ্রাণতা ভিন্ন পাণ্ডিত্য কলাকৌশল কিছুই তাঁর বাণীতে সেই মহাপ্রাণতার সঞ্চার করতে পারে না–এ বিষয়ে প্রাচীন আলঙ্কারিকরা যেন উদাসীন। এই ব্যাপারে গ্যেটের মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে মন্তব্যটি তিনি করেছিলেন বিখ্যাত সমালোচক শ্লেগেল সম্পর্কে :
স্বীকার করতে হবে যে, শ্লেগেলের জানাশোনা ঢের, তাঁর অসাধারণ গুণপনা ও পড়াশোনা দেখে ভীত হতে হয়। কিন্তু তা-ই যথেষ্ট নয়। জগৎজোড়া পাণ্ডিত্য থাকলেও বিচারক্ষমতা না থাকতে পারে। শেগেলের সমালোচনা সম্পূর্ণ একদেশদর্শী, তার কারণ, নাটকে তিনি দেখেন শুধু প্লট ও সাজাবার কৌশল আর পরবর্তীদের সঙ্গে (আলোচ্য) লেখকের ছোটখাটো মিল। সেই লেখক জীবনের মাধুর্য ও মহৎ চিত্তের প্রভাব কতখানি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন সেদিকে তার দৃষ্টি নেই। কিন্তু প্রতিভার সমস্ত কলানৈপুণ্যের কি মূল্য যদি নাটকে আমরা না পাই লেখকের মধুর অথবা মহৎ ব্যক্তিত্ব জনসাধারণের চিত্তের উৎকর্ষ ঘটে এরই গুণে। শেগেলের ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্ব মহৎদের প্রকৃতি বুঝবার ও সমাদর করবার আযোগ্য। [কবিগুরু গ্যেটে, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯১]
মহৎ ব্যক্তিত্ব দুর্লভ ব্যাপার বলেই সব দেশের সাহিত্যেই, বিশেষ করে চলতি সাহিত্যে, কলাকৌশলের বিন্যাস কবি ও সাহিত্যিকদের এক বড় কাজ। এমন চেষ্টার একটা ব্যবহারিক মূল্য অবশ্যই আছে, কেননা, অনেকের জন্য সাহিত্য কালহরণের বহু উপায়ের মধ্যে একটি উপায়; শিল্পেরও এমনি প্রয়োজনীয় অপব্যবহারের দৃষ্টান্ত বিজ্ঞাপনে শিল্পের ব্যবহার। এমন নিকৃষ্ট কলা-কৌশলের সাহিত্য ও শিল্প যে বহুজনের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে পারে, তাদের চিত্তবিনোদনও কিছু পরিমাণে করতে পারে, এতেই প্রমাণিত হয় যে শিল্পে ও সাহিত্যে কলাকৌশল খুব বড় ব্যাপার শিল্পের ও সাহিত্যের বিশেষত্ব এই থেকে। কিন্তু যারা দৃষ্টিমান তাঁদের বুঝতে দেরী হয় না যে এই কলাকৌশলের প্রয়োগও তাদের দ্বারা বেশি সার্থক হয় যারা শুধু কলাকুশলী নন, সেই সঙ্গে সহজভাবে মহৎ।
শিল্পী ও সাহিত্যিকদের এই মহত্ত্বের কথা কিন্তু একটু বিশেষভাবে বুঝবার আছে। সাধারণত দেখা যায় যাকে মহত্ত্বে সুপ্রতিষ্ঠিত বলা যায় তেমন চরিত্র শিল্পী-সাহিত্যিকদের নয়। তাঁদের শ্রেষ্ঠদের প্রতিনিধিস্থানীয় বরং ভর্তৃহরি যিনি শনার বৈরাগ্য অবলম্বন করেছিলেন আর বহুবার কামনার জীবনে ফিরে এসেছিলেন– খেয়ালের বশে নয়, অন্তরপ্রকৃতির সত্যকার তাগিদে। শিল্পী সাহিত্যিকদের মধ্যে সবলতা ও দুর্বলতা যে এমন একই সঙ্গে থাকে বোধ হয় এই জন্য ভাল আর মন্দ দুয়েরই আকর্ষণের মনোহারিতা তারা নিজেরা এমন গভীর করে উপলব্ধি করেন আর সুন্দর করে তা ব্যক্ত করতে পারেন। চিত্তের এমন সহজ প্রসার, বিচিত্র অনুভূতির এমন তীক্ষ্ণতা, যখন শিল্পী-সাহিত্যিকদের জন্য দুর্লভ হয়ে কোনো বিশেষ idea ধারণার চাপে তখন ঘটে তাঁর পতন। তখনো দক্ষতাগুণে লোভনীয় অথবা রোমাঞ্চকর চিত্র তিনি অঙ্কিত করতে পারেন কিন্তু মানুষের চিত্ত গভীরভাবে আশ্লিষ্ট হতে পারে তার রচনা আর তেমন রচনা থাকে না। এমন ত্রুটিপূর্ণ শিল্প সম্পর্কে ম্যাক্সিম গোর্কির টলস্টয়–চরিতের এই বিচার শণীয়-বিচার করেছেন রবীন্দ্রনাথ :
ম্যাক্সিম গোর্কি টলস্টয়ের একটি জীবনচরিত লিখেছেন। বর্তমান কালের প্রখরবুদ্ধি পাঠকেরা বাহবা দিয়ে বলেছেন, এ লেখাটা আর্টিষ্টের মোগ্য লেখা বটে। অর্থাৎ টলস্টয় দোষে গুণে ঠিক যেমনটি সেই ছবিতে তীক্ষ্ণ রেখায় তেমনটি আঁকা হয়েছে; এর মধ্যে দয়ামায়া ভক্তিশ্রদ্ধার কোনো কুয়াশা নেই। পড়লে মনে হয়, টলস্টয় যে সর্বসাধারণের চেয়ে বিশেষ কিছু বড় তা নয়, এমন কি, অনেক বিষয়ে হেয়।…….টলস্টয়ের কিছুই মন্দ ছিলনা এ কথা বলাই চলে না; খুঁটিনাটি বিচার করলে তিনি যে নানা বিষয়ে সাধারণ মানুষের মতোই এবং অনেক বিষয়ে তাদের চেয়েও দুর্বল, এ কথা স্বীকার করা যেতে পারে। কিন্তু যে-সত্যের গুণে টলস্টয় বহু লোকের এবং বহুকালের, তার ক্ষণিকমূর্তি যদি সেই সত্যকে আমাদের কাছ থেকে আচ্ছন্ন করে থাকে তাহলে এই আর্টিষ্টের আশ্চর্য ছবি নিয়ে আমার লাভ হবে কী। প্রথম যখন আমি দার্জিলিং দেখতে গিয়েছিলুম দিনের পর দিন কেবলই দেখেছিলুম মেঘ আর কুয়াশা। কিন্তু জানা ছিল, এগুলো সাময়িক এবং যদিও হিমালয়কে আচ্ছন্ন করবার এদের শক্তি আছে তবুও এরা কালো বাষ্প মাত্র, কাঞ্চনজর ধ্রুব শুভ্র মহত্ত্বকে এর অতিক্রম করতে পারে না। আর যাই হোক, হিমালয়কে এই কুয়াশার দ্বারা তিরকৃত দেখে ফিরে যাওয়া আমার পক্ষে মূঢ়তা হতো। ক্ষণকালের মায়ার দ্বারা চিরকালের স্বরূপকে আচ্ছন্ন করে দেখাই আর্টিষ্টের দেখা, একথা মানতে পারি নে। তা ছাড়া গোর্কির আর্টিষ্ট চিত্ততা বৈজ্ঞানিক হিসেবে নির্বিকার নয়। তাঁর চিত্তে টলস্টয়ের যে- ছায়া পড়েছে সেটা একটা ছবি হতে পারে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক হিসাবেও সেটা যে- সত্য তা কেমন করে বলব! গোর্কর টলস্টয়ই কি টলস্টয়। বহুকালের ও বহুলোকের চিত্তকে যদি গোর্কি নিজের চিত্তের মধ্যে সংযত করতে পারতেন তাহলেই তাঁর দ্বারা বহুকালের বহুলোকের টলস্টয়ের ছবি আঁকা সম্ভবপর হত। তার মধ্যে অনেক ভোলবার সামগ্রী ভুলে যাওয়া হত, আর তবেই যা না ভোলবার তার বড় হয়ে, সম্পূর্ণ হয়ে দেখা দিত। [রবীন্দ্র রচনাবলী, ১৯শ খণ্ড, পৃঃ ৩৮২]
রবীন্দ্রনাথের সমালোচনার শেষ ক’টি ছত্রে যে বলা হয়েছে : শিল্পীর কাজ শুধু অঙ্কনকুশল হওয়া নয়, শিল্পীর কাজ তার বর্ণনার বিষয় সম্পর্কে প্রধান ও অপ্রধানের বিচার করা, সাহিত্য ও শিল্প সম্পর্কে এ এক বড় ব্যাপার। বলা বহুল্য এরও যোগ কবির ব্যক্তিত্বের সঙ্গেই, নিজে এক মহৎ ব্যক্তিত্বের অধিকারী না হলে। জীবনের ব্যাপারে এমন প্রধান অপ্রধানের বিচার সম্ভবপর নয়; কিন্তু জীবনে প্রধান অপ্রধানের ভাল-মন্দের এই ভেদ সাহিত্যিক ও শিল্পী যে করেন সেটি কিন্তু ঠিক নীতিবিদের ভঙ্গিতে নয়। নীতিবিদ কোনো বিশেষ আদর্শকে তাঁর অথবা তার ও জগতের জন্য শ্ৰেয় জ্ঞান করেছেন, আর যথাশক্তি অনুসরণ করে চলেছেন সেই আদর্শই, অন্যদিকে দৃষ্টি তার প্রায় নেই, কিন্তু শিল্পী–অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ শিল্পী– জীবনের এক বিশেষ আদর্শ সম্বন্ধে যেমন সচেতন তেমনি সচেতন মানবচিত্তের বিচিত্র প্রবণতা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে, তবে এই বিচিত্র প্রভাবে ও আকর্ষণে শ্রেষ্ঠ শিল্পী আকুল ও দিশাহারা নন, চমকিত ও আন্দোলিত কিন্তু স্থিরলক্ষ্যও–যেমন স্থিরলক্ষ্য বর্ষার দুরন্ত পদ্মায় যারা পাড়ি জমায় সেই মহাবিচক্ষণ ও মহালাঞ্ছিত মাঝিরা। শিল্পে ও সাহিত্যে এমন বিচক্ষণতা অবশ্য উচ্চাঙ্গের প্রতিভার পক্ষেও দীর্ঘদিনের লভ্য, কাজেই আলোচনার বিষয় তেমন নয়। শিল্পে ও সাহিত্যে এই ধরনের ব্যাপার লক্ষ্য করেই বলা হয়েছে– শিল্পের অতি অল্প অংশই শেখানো যায় কিন্তু শিল্পীকে জানতে হয় সবটা।
সাহিত্যের সংজ্ঞা সম্পর্কে এই যে দুটি কথার অবতারণা আমরা করেছি আর ব্যক্তিত্ব– অর্থাৎ রচনাকে রসময় করা আর তাতে ব্যক্তিত্বের স্পর্শ দান করা, যাতে রচনাটি হয়ে ওঠে শুধু মধুর নয়, বিশিষ্ট, এই দুটি ব্যাপারই কি সমান মর্যাদার? অথবা এ-দুয়ের মধ্যে এমন সম্পর্ক আছে যার গুণে এর বিশেষ একটির সাধনাই অন্যটি লাভেরও প্রশস্ত উপায় বলে গণ্য হতে পারে?
ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা বুঝি, রসই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের প্রধান নির্ভরের ব্যাপার হয়েছে; তাতে প্রাচীন সাহিত্য সহজেই হয়েছে সুখপাঠ্য আর অনেকের আকর্ষণস্থল। কিন্তু রস যত মনোহর হোক একালে আমাদের মন বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছে সাহিত্যে ও শিল্পে ব্যক্তিত্বের দ্বারা, এমন কি, সাহিত্য ও শিল্পের সমস্ত মাধুর্যের সমস্ত কলা কৌশলে ব্যক্তিত্বের স্পর্শটুকু আবিষ্কার করতে না পারলে আমাদের শিল্প ও সাহিত্য উপভোগ আজ আর পূর্ণাঙ্গ হয় না। কিন্তু এই ব্যক্তিত্ব বাস্তবিকই অতি গভীর ব্যাপার। গজে গজে যেমন মৌক্তিক হয় না তেমনি এই ব্যক্তিত্বও সাহিত্যে দুর্লভ রয়ে যাবে হয়ত চিরকাল–তা পাণ্ডিত্য ও কলাকৌশলের পথে যতই আমরা অগ্রসর হই। এটি সজাগ সাধনারও ব্যাপার তেমন মনে হয় না, বরং কতকটা জন্মগত সহজ অধিকারের ব্যাপার অথচ অশ্রান্ত বিকাশেরও ব্যাপার। তবে, একালে সাহিত্যে ও শিল্পে এই ব্যক্তিত্বের মর্যাদা সম্বন্ধে অবহিত হয়ে একালের সমালোচনা সাহিত্য এক নূতন মর্যাদা লাভ করেছে। [অল ইন্ডিয়া রেডিওর সৌজন্যে]
জুন, ১৯৪৬