রসের গল্প

রসের গল্প

পৃথিবীর সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ঘটনা— তা সে প্রেমের ব্যাপারই বলুন, কি চুরি-ডাকাতিই বলুন— চাঁদের আবছা আলোয় ঘটতে পরে, কিন্তু রসের ব্যাপারের বেশিরভাগই যে দিনের আলোয় প্রত্যক্ষভাবে পথে-ঘাটে ঘটে থাকে, তাতে কোনও সন্দেহই নেই। বিশেষ করে ট্রামে, বাসে, রেলগাড়িতে। সেখানে এতটুকু রসের ব্যাপার ঘটলে দশজন উপভোগ করে বলে দশগুণ জমে।

একবার আমার মণিদা (সত্যজিতের কাকা সুবিনয়) রাতের ট্রেনে জব্বলপুর যাচ্ছেন। বউদি তাঁর সঙ্গে টিফিনকারি ভরতি ভালমন্দ খাবার দিয়েছেন, যেমন তাঁর অভ্যেস ট্রেন ছাড়লে, পায়ের কাছে মেঝের ওপর টিফিনকারিটি রেখে, নীচের বার্থে পা মেলে শুয়ে, মণিদা একটা রহস্যের বই পড়ছেন আর একটু পরে ক্যায়সা ভোজ হবে ভাবছেন।

মাথার ওপরের বার্থে আরেক ভদ্রলোকও নীচে টিফিনকারি রেখে, খচমচ করে ওপরে উঠে শুয়েছেন। তাঁর সঙ্গে বই-টই ছিল না, কিংবা পড়ার শখ ছিল না। সে যাই হোক, কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে ভদ্রলোক বললেন, ‘নাঃ! কাঁহাতক শুয়ে থাকা যায়, খেয়েই নিই।’

এই বলে ওপর থেকে নেমে এসে, মণিদার পায়ের কাছে একটু জায়গা ছিল, সেখানে বসে, টিফিনকারি খুলেই আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন, ‘অ্যাঁ! ই কী! গিন্নির যে হাত খুলেছে! লুচি! চপ! কিমার ডালনা! ছানার জিলিপি! ওয়া! ওয়া! একেই বলে কপাল-খোলা!’ এইসব বলছেন আর গপাগপ্‌ গিলছেন।

রহস্যের উপন্যাসের গভীর সমুদ্রের তলা থেকেও কথাগুলো মণিদার কানে গেল। কানে যেতেই কেমন খট্‌কা লাগল। মণিদা উঠে পড়ে বললেন, ‘ও কী মশাই! আপনি যে আমার টিফিনকারি খুলে খাবার খাচ্ছেন। এর মানে কী!’

ভদ্রলোক বললেন, ‘অ্যাঁ! তাই নাকি! এই রে! রাতে চোখে ভাল দেখি না কিনা, তাই দুটোকে অবিকল একইরকম দেখতে লাগছিল। দেখুন তো কাণ্ড, মশাই, অবিশ্যি সেরকম ক্ষতি হয়নি, মশাই। আপনি আমারটা খেয়ে ফেলুন। ফেয়ার এক্সচেঞ্জ!’

তারপর মণিদা যখন সেই ভদ্রলোকের টিফিনকারি খুলে গোটা ছয় হাতের রুটি, বেগুন পোড়া, মুলোর ঘণ্ট, দুটো চাঁপাকলা বের করলেন তখন ভদ্রলোক এক গাল হেসে বললেন, ‘দেখলেন তো মশাই! সাধে বলে স্বভাব যায় না মলেও!’

তাই শুনে গাড়িসুদ্ধ সবাই এমনি ভীষণ হাসতে লাগল যে মণিদা পর্যন্ত না হেসে পারলেন না।

আরেকবার আমার ছোট জ্যাঠামশাই কুলদারঞ্জন রায় বাসে করে যাচ্ছেন। একটুও জায়গা নেই, ছাদের রড ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। এমন সময় এক মাতাল উঠে, হাসি-হাসি মুখ করে ওঁর পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে হিক্কা তুলতে লাগল।

চারদিকে একটা মৃদু মোদো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। তখন গাড়িসুদ্ধ যাত্রীরা কন্ডাক্টরকে বলতে লাগল, ‘হয় ওকে নামিয়ে দাও, নয়তো আমরা সবাই নেমে যাব।’

একথা শুনে মাতাল মুচকি হেসে বলল, ‘কেন ওয়া-ওয়া? আমি তো কিচ্ছু কচ্ছি টচ্ছি না। নামাবে কেন?’ তাতে যাত্রীরা আরও গরম হয়ে ওঠাতে, শেষ পর্যন্ত কন্ডাক্টর তাকে বলল, ‘না, মশাই, আপনি বরং নেমেই যান।’

সে বলল, ‘যাচ্ছি, বাপু, যাচ্ছি। আগে আমার পহা ফেরত দাও, তাপ্পর আমি নামব।’ কন্ডাক্টর চটে গেল, ‘কী বাজে বকছেন! আপনি পয়সা-টয়সা দেননি।’

সে তবু বলল, ‘দিইচি, বাবু, নিচ্চয় দিইচি। আমি পহা দিইচি তা আমি জানব না, তুমি জানবে?’

কন্ডাক্টর বেকুব বনে বলল, ‘আমাকে পয়সা দিয়েছেন বলছেন?’ সে জিব কেটে বলল, ‘ছি ছি তা বলব কেন? তোমাকে দেবই বা কেন? তুমি তো ঢের পাচ্চ। আমি ওই ব্যাটাকে দিইচি।’ এই বলে জ্যাঠামশাইকে দেখিয়ে দিল।

তিনি তো চটে কাঁই! ‘ফের মিছে কথা! তুমি কখন আমার হাতে পয়সা দিলে?’ সে মাথা দুলিয়ে বলল, ‘হাতে দোব কেন? ভদ্দরলোকের হাতে পহা দিতে হয়? পকেটে দিইচি।’ জ্যাঠামশাই রেগেমেগে কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ নিজের বুকপকেটের দিকে চোখ পড়ল। দেখেন ভাঁজ করা রুমালের ওপর পাঁচটা তামার পয়সা রয়েছে!

তখন বাসসুদ্ধ লোক কী হাসিটাই হেসেছিল সহজেই অনুমান করা যায়। ততক্ষণে হাসতে হাসতে মাতালও তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে, টুপ করে নেমে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল। জ্যাঠামশাইও হাসিমুখে পয়সাগুলো কন্ডাক্টরকে দিয়ে, তাঁর স্টপে নামলেন।

আমাদের বন্ধু, ‘রামধনু’র সম্পাদক অধ্যাপক ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য একটা ভাল গল্প বলেছিলেন। তাঁর দুই আত্মীয়া বাসে করে যাচ্ছেন। বেজায় ভিড়। বসবার জায়গা তো নেই-ই, মধ্যিখানের প্যাসেজটাও মানুষে ঠাসা। সবাই কোনওমতে আঁকড়ে-পাকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকের সিটে আত্মীয়ারা দু’জন, ওদিকের সিটে জানলার কাছে এক ভদ্রলোক, তাঁর পাশে তাঁর স্ত্রী।

এমন সময় বাসের যেমন অভ্যাস, দারুণ এক ঝাঁকি দিয়ে সে বেগ বাড়াল। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়ানো ভদ্রলোকদের একজনের হাত ফসকে গিয়ে, তিনি ওই ভদ্রলোকের স্ত্রীর কোলে ঝুপ করে পড়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে প্রভূত ক্ষমা চাইতে লাগলেন। কিন্তু ভদ্রলোকের রাগ দেখে কে! ‘মশাই, আপনি কোন অধিকারে আমার স্ত্রীর কোলে বসলেন?’

বেচারি যতই বলেন, ‘পড়ে গেছি ভাই, ইচ্ছে করে কখনও বসতে পারি?’ ভদ্রলোক ততই গরম হন, ‘বাজে কথা রাখুন! চালাকি করবার জায়গা পাননি, না?’ বাসসুদ্ধ সবাই বোঝাতে চেষ্টা করল যে ব্যাপারটা নিতান্ত আকস্মিক, একেবারেই ইচ্ছাকৃত নয়, তা কে কার কথা শোনে!

শেষ পর্যন্ত অপরাধী ভদ্রলোক তাঁর মনিব্যাগ খুলে একটা কার্ড বের করে, রাগী ভদ্রলোকের হাতে দিয়ে বললেন, ‘ধরুন, এতে আমার নাম, পেশা, ঠিকানা, সব দেওয়া আছে। আপনি যখন খুশি আমার বাড়িতে গিয়ে, যতক্ষণ ইচ্ছা আমার স্ত্রীর কোলে বসে থাকতে পারেন। আমরা কেউ কিছু মনে করব না।’

একথা শুনে বাসের লোকরা কী করল সেটা নিশ্চয় বলে দিতে হবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *