রসিকতা

রসিকতা

হাসতে হয়, না-হেসে উপায় নেই। এমনকি যারা হাতুড়ি আর কান্তের নিচে বসে আছে, তারাও হাসে। তবে প্রাণ খুলে নয়, কিংবা পাবে বসে বেপরোয়া গালগল্প গুল-গ্যাস ছাড়বার মাঝে মাঝে নয়। সন্তর্পণে টাপেটাপে। এই কিছুদিন পূর্বেই লৌহ-যবনিকার অন্তরালে একটি রসের গল্প মুখে-মুখে ফিরতে ফিরতে এই হেথা বাঙলা দেশে পৌঁছেছে–অবশ্য একে বাঁচিয়ে, ওকে এড়িয়ে।

এক কম্যুনিস্ট আরেক কমুনিস্টকে সোল্লাসে খবর দিল, জানিস ভাই প্রাভদা কাগজ সবচেয়ে সেরা পলিটিক্যাল রসিকতার জন্য একটা প্রাইজ দেবে কাগজে ঘোষণা করেছে।

দ্বিতীয় কম্যুনিস্ট : (অধিকতর সোল্লাসে) পয়লা প্রাইজ কত কমরেড?

প্রথম কম্যুনিস্ট : কুড়ি বচ্ছর সাইবেরিয়া নির্বাসন।

নির্বাসন না উইন্টার স্পোটর্স অ্যান্ড হলিডে আমার সঠিক মনে নেই। তবে নিখরচায় সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

এর থেকে অবশ্য পাঠক মনে করতে পারেন, রুশ-চীনে বুঝি মানুষ মুখ বন্ধ করে আছে। যেমন, হিটলার আমলে জর্মনিতে একটি রসিকতা বেশ প্রসার লাভ করেছিল। এক জর্মন আরেক জনকে শুধাল, তুই নাকি ভাই, ডেনট্রিট্রি পড়া ছেড়ে দিয়েছিস? কেন?

কী আর হবে? দাঁতের চিকিৎসা করব কী করে? কেউ যে মুখ খুলতে আদৌ রাজি হয় না।

তা নয়। লোকে মুখ খোলে। কারণ যেসব কর্তাব্যক্তিরা রুশ-চীনের ফুটন্ত জলের কেতলির উপর বসে আছেন তারাও জানেন, মাঝে মাঝে ঢাকনাটা একটু ফাঁক না করে দিলে তাদেরও উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তবে এঁরা মোটামুটি ঠিক করে নিয়েছেন, কোন্ ধরনের রসিকতা একটুখানি বরদাস্ত করে নিতে হয়, আর কোন্ ধরনের রসিকতা হারাম বিধান দিয়ে সাইবেরিয়া ব্যবস্থা করতে হয়– চীন দেশে, শুনেছি, নেফা অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, গুলি খেয়ে মরবে, নয় শীতে জমে গিয়ে।

সবচেয়ে বরদাস্ত করা হয়, বাসস্থানের অভাব, আহারাদির অনটন, বাধ্য হয়ে অর্ধ-দিগম্বর বেশ ধারণ সম্বন্ধে। কারণ চোখের সামনে এগুলো এমনই জাজ্বল্যমান, সবাই এগুলো সম্বন্ধে হাড়ে হাড়ে এমনই সচেতন যে এ নিয়ে মস্করা করে তাই সবাই কিছুটা মনের ভার নামাক– একটা নতুন অক্টোবর রেভলুশন অদ্যকার কর্তাব্যক্তিদের পক্ষে আরামদায়ক অভিজ্ঞতা না-ও হতে পারে। এবং বাসস্থান-আহারাদির অনটন সম্বন্ধে পোল্যান্ড-রুমানিয়ার কারসিকেরা বলে, সোশ্যালিস্ট রাজ্যের বর্তমান ক্ষণস্থায়ী অভাব-অনটন ভবিষ্যতের চিরস্থায়ী অভাব-অনটনের পথে পথে বিজয়স্তম্ভ।

ভবিষ্যতে কীরকম হবে তাই নিয়ে বলা হয়, আরও তিনটি ফাইভ ইয়ার প্ল্যান চিন্ময় থেকে মৃন্ময় রূপ ধারণ করার পর এমনই সুদিন আসবে যে, সক্কলের আপন আপন সলুন মোটরগাড়ি, এমনকি আপন আপন হেলিকপ্টার থাকবে। সেই সময় মস্কোর উপরে শূন্যমার্গে আপন হেলিকপ্টারে দুই কমরেডের দেখা। একজন আরেকজনকে শুধাল, কোথায় চললি কমরেড?

তুই যদি আমার পিছু না নিস তবে বলছি। অতি গোপনীয় সূত্রে খবর পেয়েছি, কৃষ্ণসাগরের পারে ওডেসার রেশন-শপে আড়াই আউন্স মাখন পাওয়া যেতে পারে। সেখানে যাচ্ছি।

এ তো ভবিষ্যতের কথা। আর বর্তমান দিনে?

হঠাৎ বাড়ি ফিরে কমরেড দেখেন তাঁর স্ত্রী উপপতির সঙ্গে রসকেলিতে মত্ত। হুঙ্কার দিয়ে স্বামী বলল, এই বুঝি প্রেম করার সময়! ওদিকে যে রেশন-শপে এক ঘণ্টা ধরে নেবু বিক্রি হচ্ছে।

সত্যই তো। প্রেম তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না, কিন্তু নেবু কিছু আর নিত্যি-নিত্যি মেলে না।

এই মর্মে আরেকটি চুটকিলা আছে।

গৃহবন্টন বিভাগের কর্তা বললেন, কী বললেন কমরেড, আপনার স্ত্রীর ফ্ল্যাটখানা পছন্দ হচ্ছে না? তা আর এমন কী? আমার উপদেশ নিন। স্ত্রী বদল করুন। ঢের কম হাঙ্গামায় পাবেন। ফ্ল্যাট পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা!

কিংবা বাড়ি বাবদে :

ক্লাসটিচার শুধালেন, লেনিনের যে ছবিখানা দিলুম সেটি কোথায় টাঙিয়েছ?

আজ্ঞে কোথাও না।

 কেন?

আজ্ঞে চার দেয়াল ঘেঁষে চারটি পরিবার বাস করে। আমরা থাকি মধ্যিখানে। আমাদের তো দেয়াল নেই।

কিংবা ধরুন– এটা নাকি চীনদেশের মন্ত্রীমশায় বেতারে বক্তৃতা দিচ্ছেন, ১৯৬০-এ আমরা আগের চেয়ে ১১০ গুণ বিজলি বাড়াতে পেরেছি। ১৯৬১-তে ৬০ গুণ। এ বছরে দু-শো গুণ– দাঁড়ান, কী হল? আমি যে কিছুই দেখতে পাচ্ছিনে, কমরেড স্টুডিয়ো অ্যাসিসটেন্ট, একটি মোমবাতি নিয়ে আসো দিকিনি।

তবে কোনও কোনও বাবদে বর্তমানে যে অবস্থা অনেকখানি ভালো সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এ গল্পটাও হলদে, না লাল জানিনে। এক কমরেড রিপোর্ট লিখছেন, পূর্বের চেয়ে এখন অবস্থা অনেক ভালো। আগে গৃহিণী যখন জামা-কাপড় কাঁচতেন, আমাকে তখন সাহায্য করতে হত। এখন সে দুর্দিন গেছে। এখন স্ত্রী বলেন, তোমার পাতলুন আর শার্টটা দাও তো। আর তুমি বিছানায় গিয়ে চাদরটাকা দাও।

[এই স্ত্রীকে সাহায্য করার ব্যাপার নিয়ে মার্কিন মুলুকে অন্য পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। গত যুদ্ধে বহু মার্কিন কাপড় কাঁচা, বাসন মাজা, রান্না করা, আরও পাঁচটা কাজ শিখে এসে বাড়িতে যখন দেখে স্ত্রী আনাড়ির মতো কাজ করছে তখন তারা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে বাতলে দেয় কীভাবে কর্মগুলো সুষ্ঠুরূপে করতে হয়। ফলে বউরা তাদের খাঁটিয়ে মারতে শুরু করে। সেটা পরের পুরুষেও সংক্রামিত হয়। হালে যখন মার্কিন দেশে প্রস্তাব পাড়া হয়, ওভার প্রোডাকশন হচ্ছে বলে সক্কলকে হপ্তায় দুদিন করে ছুটি দেওয়া হবে, তখন বিস্তর মার্কিন তারস্বরে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, বউরা খাঁটিয়ে মারবে। তার চেয়ে আপিসের কলমফ পেষা ঢের ভালো। এরা বলে, নিগ্রো-দাসত্ব উঠে যাওয়ার পর এটা নাকি এক নতুন ধবল-দাসত্ব।]

কম্যুনিস্ট দেশে নাকি রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতারি হয় অতি ভোরবেলা– এদেশে যে-রকম ১৯৪৭-এর আগে হত, আর হিটলারি জর্মনিতে তো নিজে দেখেছি। এ ব্যাপার নিয়ে নাকি ঠাট্টা-মস্করা খুব বেশি বরদাস্ত করা হয় না।

ভোর পাঁচটার সময় বাড়িওলা ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে ঘন্টা বাজিয়ে মৃদুকণ্ঠে বলছে, কমরেড, অযথা ভয় পাবেন না। আমি শুধু বলতে এসেছি, বাড়িতে আগুন লেগেছে মাত্র। কিংবা, কী বললে? ইভান ইভানোভিচ মারা গিয়েছে? কই, আমি তো তার গ্রেফতার হওয়ার খবরটা পর্যন্ত পাইনি। কিংবা খবরের কাগজে শোকসংবাদ কলামে পিতামাতা প্রকাশ করলেন, আমাদের স্বর্গস্থ সৃষ্টিকর্তা তার অসীম করুণায় আমাদের কন্যাকে কল্যাণতর লোকে নিয়ে গিয়েছেন। আপন সোশ্যালিস্ট দেশকে অপমান করার জন্য দুজনাই পরের দিন গ্রেফতার হন।

সবচেয়ে বিপজ্জনক হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক রসিকতাই সবচেয়ে বেশি আদর পায়। পূর্বেই প্রাভদা প্রসঙ্গে তার একটি নিবেদন করেছি। এগুলো সচরাচর তৈরি হয় কতকগুলো বিশেষ বিষয়বস্তু নিয়ে পার্টির দুর্নীতি, বড়কর্তাদের বিলাসব্যসন (হালে চীনও খ্রশ্চফকে গালাগাল দিয়েছে এই বলে যে, তাঁর দুখানা আপন মোটরগাড়ি আছে), ধর্মবিশ্বাসে অসহিষ্ণুতা, স্বাধীন-চিন্তার নিপীড়ন, চাষাদের বেগার খাটানো, উপরাষ্ট্র-ধর্ষণ ইত্যাদি। যারা কম্যুনিজমে বিশ্বাস করে না কিংবা কম্যুনিস্টদের কার্যকলাপে দুর্নীতি সহ্য করতে পারে না তাদের আত্মাভিমান রক্ষা করার একমাত্র উপায় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শরণ-নেওয়া।

এক কয়েদি আরেক কয়েদিকে, তোর কি মাথা খারাপ? আদালতে কেন স্বীকার করলি, কালোবাজারে চিনি কিনেছিস?

দ্বিতীয় কয়েদি, কী করি বল। সরকারপক্ষের উকিলই যে আমাকে চিনি বেচেছিল। কিংবা শিক্ষামন্ত্রীকে পাগল বলার অপরাধে একজনের কুড়ি বছরের জেল হয়। পাঁচ বছর হয় সরকারি কর্মচারীকে অপমান করার জন্য, বাকি পনেরো বছর রাষ্ট্রের গোপন খবর প্রকাশ করে দেবার জন্য। কিংবা,

রুশ কর্মী কথায় কথায় বলল, আমি সবচেয়ে ভালোবাসি কম্যুনিস্ট পার্টির মেম্বারদের জন্য কাজ করতে। সরকারি কর্মচারী প্রশংসা করে বললেন, বড় আনন্দের কথা। তা, আপনি কী কাজ করেন? আজ্ঞে আমি গোর খুঁড়ি।

কিংবা,

চেকোশ্লোভাকিয়া থেকে প্রাপ্ত :

খবরের কাগজের হকাররা রাস্তায় চেঁচাচ্ছে, রুশেরা চাঁদে পৌঁছে গেছে, রুশেরা চাঁদে পৌঁছে গেছে। রাস্তায় একাধিক উল্লসিত কণ্ঠস্বর, সবাই? সবাই?

কিংবা,

ট্রামগাড়ির কন্ডাক্টর : এগিয়ে চলুন, মশাইরা, এগিয়ে চলুন।

আমরা মশাইরা নই, আমরা কমরেড।

মস্করা ছাড়ুন। কমরেডরা ট্রামগাড়ি চড়েন না, তাঁরা চড়েন আপন আপন মোটরগাড়ি।

কিন্তু পূর্বেই বলেছি, এসব রসিকতা করতে হয় টাপেটোপে নিতান্ত আপনজনের মাঝখানে। নইলে —

তিন বৃদ্ধ পার্কের বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে। তার মধ্যে দুজন ওয়াক্ থুঃ ওয়াক্ থুঃ বলে থুথু ফেলছে। তৃতীয়জন বলল, দয়া করে কোনওপ্রকারের রাজনৈতিক আলোচনা আরম্ভ করবেন না। নইলে আমাকে গোয়েন্দা বিভাগে খবর দিতে হবে।

ইংরেজিতে বলে, নীরবতা হিরন্ময়।

ইহুদিরা আসলে প্রাচ্যদেশীয় বলে বহুশত বছর ইয়োরোপে থাকার পরও তাদের রসিকতায় বিদ্রূপ ও তিক্ততা থাকে অনেক বেশি। ওদিকে হিটলার যে-রকম একদা ইহুদিদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছিলেন, তার দশভাগের একভাগ না হলেও কমুনিস্ট দেশে ইহুদি-নির্যাতন আরম্ভ হয়ে গিয়েছে অনেক দিন। ইহুদিরাও বাধ্য হয়ে বাইরের দিক দিয়ে যতদূর সম্ভব গা বাঁচিয়ে চলে ও অন্তরে অন্তরে অন্তরীণ হয়ে থাকে।

চতুর পোলিশ ইহুদি মূর্খ পোলিশ ইহুদির সঙ্গে কীভাবে আলাপ করে?

 নিউইয়র্ক থেকে, টেলিফোনযোগে। কিংবা,

সরকারি কর্মচারী ইহুদিকে বললেন, কমরেড লেভি, আপনি ফর্মে লিখেছেন, আপনার কোনও আত্মীয় বিদেশে বসবাস করে না। ওদিকে আমরা খবর পেয়েছি, আপনার আপন ভাই ইসরায়েলে বাস করে।

তা তো করেই। সে আছে আপন দেশে, আমিই তো আছি বিদেশে।

সবচেয়ে কম শুনতে পাওয়া যায় বড় পাণ্ডাদের নিয়ে রসিকতা। তার কারণ উৎপীড়িত জনেরাও অতি অল্পদিনের অভিজ্ঞতায় বুঝে যায়, যাকে নিয়ে রসিকতা করা হয়, গৌণভাবে তারই বিজ্ঞাপন করা হয় মাত্র। একথাটা উভয়পক্ষই বিলক্ষণ জানে বলে হিটলারের দক্ষিণহস্তস্বরূপ গ্যোরিঙ তাঁর সম্বন্ধে বাজারে রসিকতা চালু হওয়া মাত্রই সেটি সংগ্রহ করে রাখতেন এবং এ ধরনের রসিকতা নিজেই যে শুধু বলে বেড়াতেন তাই নয়, অন্য সকলকেও নয়া নয়া রসিকতা বানাবার জন্য টুইয়ে দিতে কসুর করতেন না।

রুশ দেশও ব্যত্যয় নয়। তাই খ্রশ্চ ইত্যাদিকে নিয়ে রসিকতার বাড়াবাড়ি নেই, তবু দু-একটি যা শুনতে পাওয়া যায় সেগুলো উপাদেয়। তারই একটি দিয়ে শেষ করি।

শীর্ষ সম্মেলন শেষ করে নিকিতা খ্রুশ্চফ ও পুলিশকর্তা (আসলে গোয়েন্দা বিভাগের সর্বাধ্যক্ষ) সাখার একসঙ্গে উড়োজাহাজে করে দেশে ফিরছেন। সাখার বললেন, কেনেডির অলঙ্কারগুলো লক্ষ করেছিলি? একদম সাচ্চা।

নিকিতা বললেন, না, কই, দে তো।* [*ভেল্টভখের (সুরিষ) ১৪৫২ সংখ্যার সাহায্যে লেখা।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *