রসাতলের রহস্য – ৯

নয়

তখন সমুদ্র শান্ত। আকাশ পরিষ্কার। যদিও কিছু টুকরো মেঘ আটার মতো লেগে আছে এখানে-সেখানে। কিন্তু রাত শেষ হয়ে আসায় চারধারে দৃষ্টি যাচ্ছে। হাঁকাহাকি করে, বন্দুকের বাঁট দিয়ে আঘাত করে বন্দিদের লাইন সোজা করল পাইরেটরা। ইতিমধ্যেই দুজন এমন অসুস্থ হয়ে পড়েছে যে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না। প্রথমে তাদের নিজস্ব ভাষায় খুব ধমকাল দুজন পাইরেট। চুলের মুঠো ধরে সোজা দাঁড় করাতে চেষ্টা করল। কিন্তু লোকটার অবস্থা তখন শোচনীয়। তাদের প্যান্ট ভিজে গেছে নিজেদের প্রস্রাবে। চেষ্টা করেও সোজা হতে না পারায় ধপাস করে বসে পড়ল মেঝের ওপর। এবার বন্দুকের বাঁট দিয়ে তাদের আঘাত করল পাইরেটরা। লোকদুটো ওঠার ভঙ্গি করল, কিন্তু তাদের হাটু কাজ করল না। পাশ ফিরে পড়ে গেল।

একজন পাইরেট চিৎকার করে কাউকে কিছু বলল। বলে যেন আদেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল। খানিক বাদে একজন মোটা দীর্ঘদেহী পাইরেট সেখানে এসে লোকদুটোকে দেখল। তারপর জোরে জোরে দুজনের পশ্চাৎদেশে লাথি মারল। ওরা একটু নড়ে উঠল মাত্র, ওঠার শক্তি ওদের ছিল না। এবার দীর্ঘদেহী হাতের ইশারা করল। সঙ্গে সঙ্গে আগের পাইরেট দুটো ওদের টানতে টানতে জাহাজের কিনারে নিয়ে গিয়ে এত জোরে লাথি মারল যে শরীর দুটো রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে জলে পড়ে গেল।

ওরা বোবা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শরীরের অক্ষমতার জন্যে দুজন মানুষকে ওরা জীবন্ত অবস্থায় মেরে ফেলল। অত ওপর থেকে জলে পড়লে বেঁচে থাকার কোনও সম্ভাবনা সুস্থ অবস্থাতেই কম থাকে। কারণ শরীরগুলো একক্ষণে জাহাজের নীচে চলে গেছে। বন্দিরা কথা বলার সাহস হারিয়ে ফেলেছিল। নীল দেখল তার সামনে দাঁড়ানো মেনন মাথা ঝুঁকিয়ে রয়েছে।

চটপট আবার ওদের হাত বেঁধে ফেলা হল। দড়ির শেকলে আটকে দেওয়া হল সবাইকে। ভোর হচ্ছে। বাঁ-দিকে তাকাতেই দূরে মাটি দেখতে পেল নীল। জাহাজ সেদিকেই এগোচ্ছে। কিন্তু ওই মাটির ওপর কোনও বাড়িঘর চোখে পড়ল না। ঘন জঙ্গলে ঢাকা ওই জায়গার নাম কী? মেনন ফিসফিস করে বলল, ‘নিশ্চয়ই সোমালিয়া।’

জাহাজের কম্পিউটারে কাজ করতে করতে একদিন গুগল সার্চ করে সোমালিয়া সম্পর্কে কিছু কথা জেনেছিল নীল। আসল নাম ফেডেরাল রিপাবলিক অফ সোমালিয়া। আফ্রিকার উপকূলে এই দেশের পশ্চিমে থিওপিয়া, উত্তর-পশ্চিমে জিবউতি, উত্তরে গাল্ফ অফ অ্যাডেন, পূর্ব দিকে ভারত মহাসাগর। কেনিয়া আছে দক্ষিণ-পশ্চিমে। সোমালিয়ায় মানুষের সংখ্যা দশ মিলিয়ন। তাদের বেশির ভাগই সুন্নি সম্প্রদায়ের মুসলমান। ওদের মূল ভাষা হল সোমালি। কেউ কেউ আরবিও বলেন।

তীর থেকে অনেকটা দূরে থেমে গেল জাহাজ। এখানে কোনও বন্দর নেই। জাহাজ নিয়মিত যে আসে না, তা দেখলেই বোঝা যায়। দ্রুত জলের ওপর পাটাতন নামিয়ে দেওয়া হল। কয়েকজন পাইরেট তার ওপর দিয়ে হেঁটে যেখানে জলে নামল, সেখানে হাঁটুর একটু ওপর পর্যন্ত জলের ঢেউ। এবার চিৎকার করে বন্দিদের চলতে বলা হল। কোনও রেলিং নেই, পায়ের তলায় পাটাতন কাঁপছে, সেই অবস্থায় হাত বাঁধা, কোমর বাঁধা অবস্থায় হেঁটে যাওয়া খুব সমস্যার। একজন বেকায়দায় পা ফেললে অনেককেই সমুদ্রের ভেতর তলিয়ে যেতে হবে। মেননের আগের লোকটা টলমল করছিল। ভয়ে চিৎকার করে উঠল। তাই শুনে পাইরেটরা খ্যাক খ্যাক করে শিয়ালের মতো হাসতে লাগল। মেনন তাকে ধমকাল, ‘মরতে যদি না চাও তাহলে সামলে পা ফেলো।’

শেষ পর্যন্ত ওরা বালির চরে পৌঁছোতে পারল। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ভার্জিন বিচ। নীলের মনে হল এটা সেইরকম। এই বিচে আগে কেউ হেঁটেছে বলে দেখে মনে হচ্ছে না। টুরিস্টরা যেসব বিচে বেড়াতে যান, সেসব বিচের লাল কাঁকড়াগুলো পায়ের আওয়াজ পেলেই দৌড়ে গর্তে ঢুকে যায়। এখানে যেসব কাঁকড়া রয়েছে, তারা বোধহয় আগে কখনও মানুষ দ্যাখেনি। তাই ভয় পাচ্ছে অনেক পরে।

সেই দীর্ঘদেহী পাইরেটের আদেশে ওদের বালির চর থেকে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হল। মাথার ওপর আকাশ ঢাকা গাছ, তলায় বুনো ঝোপ। একটা ন্যাড়া জায়গায় তাদের বসিয়ে দুজন পাহারায় থাকল, বাকিরা জাহাজের দিকে চলে গেল।

হাঁটু মুড়ে বসেছিল মেনন। নীলের পাশে। নীচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘আমাদের নিয়ে ওরা কী করবে তার কিছু আন্দাজ করতে পারছ?’

‘না।’ নীল ঠোঁট নাড়ল।

‘এটা যদি সোমালিয়া হয়, তাহলে আমাদের কোনও আশা নেই।’ মেনন বলল।

‘কেন?’ নীল কিছু বলতে হয়, তাই জিজ্ঞাসা করল।

‘সোমালিয়া খুব ভয়ংকর। কিডন্যাপ করে কোটি কোটি ডলার মুক্তিপণ আদায় না করে ছাড়ে না। খবরের কাগজে পড়োনি? অদ্ভুত লোক এরা। চাষের সময় চাষ করে, চাষ না থাকলে পাইরেসি। এখানকার গভর্নমেন্ট এদের ঘাটাতে সাহস পায় না।’ মেনন বলল।

‘এত টাকা নিয়ে ওরা কী করে?’

‘আমি কি ওদের সঙ্গে থেকেছি যে সব কথা জানব? মুখ বিকৃত করল মেনন, ‘আচ্ছা জ্বালা। সবাই ভেবে নেয় আমি কত কী জেনে বসে আছি।’

নীল হাসল, ‘কথাটা তো ভুল নয়। তুমি অনেক কিছু জানো।’

মেনন হাসল। বোঝা গেল সে খুশি হয়েছে।

সমুদ্রের ধার থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসছিল। বোঝা যাচ্ছিল, ওখানে ওরা খুব উত্তেজিত হয়ে রয়েছে। তার পরেই দুমদুম গুলির শব্দ হল। তারপর আচমকা চুপচাপ। একটু পরে দলটা ফিরে এল। নীল গুনে দেখল বারো জন পাইরেট, প্রত্যেকের হাতে এ কে ফিফটি সেভেন। সাধারণ বন্দুক নয়। ওদের নেতৃত্বে সেই দীর্ঘদেহ, স্বাস্থ্যবান পাইরেট। কাছে এসেই লোকটা চিৎকার করল ‘মুভ মুভ।’ তার মানে ওই লোকটা কিন্তু ইংরেজি শব্দ জানে।

সবাইকে সোজা দাঁড় করাতে সময় লাগল। যে দুর্বলতা দেখাচ্ছিল, তাকে বেধড়ক মারছিল পাইরেটরা। নেতা এবং তিনজন সামনে গেল, বাকি পাইরেটরা পেছনে। ওরা হাঁটা শুরু করতেই জাহাজের শব্দ কানে এল নীলের। জাহাজ তাদের ডাঙায় নামিয়ে আবার সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছে।

চাপা গলায় নীল মেননকে বলল, ‘জাহাজটা চলে যাচ্ছে কেন?’

‘আমাদের জাহাজের সমস্ত মাল এখন ওর পেটে খালাস করতে হবে না? তাই ওদের পছন্দমতো বন্দরে চলে যাচ্ছে।’ মেনন নীচু গলায় বলল।

‘ক্যাপ্টেনকে একবারও দেখলাম না।’ নীল কথা চালাল।

‘একটু আগে গুলির শব্দ যেটা হল, সেটা হয়তো ক্যাপ্টেনের জন্যে।’

‘কিন্তু ওরা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?’

‘সাইলেন্ট, সাইলেন্ট।’ সামনে থেকে হুঙ্কার ভেসে এল।

ক্রমশ জঙ্গল ঘন হচ্ছে। পায়ের তলায় লতা ছড়িয়ে। পা ফেললেই তাতে জড়িয়ে হোঁচট খেতে হচ্ছে। গাছগুলোর গায়ে আদিমকালের শ্যাওলা; ঝুড়ি নেমেছে কারও কারও। বন্দিরা কেউ স্বচ্ছন্দে হাঁটতে পারছিল না। একজন আছাড় খেলে তার কোমরে বাঁধা দড়ির টানে আরও একজন পড়ছিল। অদ্ভুত মুখের বাঁদর কিচমিচ করছে গাছগুলোতে। নীল বুঝতে পারছিল, ওরা একটু একটু করে ওপরের দিকে উঠছে। ডান বা বাঁ-দিকের কিছুই দেখা যাচ্ছে না, গাছগুলো যেন দেওয়াল হয়ে আড়াল তৈরি করছে।

ঘণ্টা দুয়েক যাওয়ার পরে সামনে থেকে চিৎকার ভেসে এল, ‘হল্ট।’

মানুষের মাথার মাঝখানে যেমন টাক গজায়, তেমনি ঘনজঙ্গলের কোথাও কোথাও গাছ লতাশূন্য হয়ে থাকে। সেরকম একটা জায়গায় তাদের বসতে বলা হল। ইশারায় বুঝিয়ে গোল করে বসাল ওরা বন্দিদের। তারপর দীর্ঘদেহ স্বাস্থ্যবান নেতা বৃত্তের মাঝখানে এসে বক্তৃতা দিতে লাগল। সেই সোমালি ভাষায় বক্তৃতা। আর একজন অনুবাদ করে শোনাচ্ছিল যে ভাষায়, তা কারও বোধগম্য হচ্ছিল না। নীল অনুমান করল, এটা আরবি ভাষা। কানের পর্দায় শব্দগুলো শুধু আঘাত করে চলেছে, বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পরছে না, তবু নীল তার মাথা নাড়তে লাগল। কথা বুঝতে পারলে এবং তা ভালো লাগলে মানুষ এইভাবে মাথা নাড়ে।

দীর্ঘদেহ সেটা লক্ষ করে হঠাৎ চিৎকার করল নীলের দিকে তাকিয়ে। যে শব্দ উচ্চারণ করল এবং তা করার সময় মুখের চেহারা যা হল, তা ক্ষিপ্ত হয়ে গালাগালি দেওয়ার সময় মানুষের হয়! নীল সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝোঁকাতে লাগল, যার অর্থ ভুল হয়ে গেছে।

সেটা দেখে শান্ত হল লোকটা, এবার তার ঠোঁটে হাসি ফুটল। হাত তুলল তথাস্তু বলার ভঙ্গি নিয়ে। তারপর আবার মিনিটখানেক বক্তৃতা দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জুতোয় শব্দ তুলল। সঙ্গে সঙ্গে অন্য পাইরেটরা একইভাবে জুতোয় আওয়াজ করল।

ঘাসের ওপর বসার পরেই একজন পাইরেট চেঁচিয়ে কিছু বলতেই অন্যরা যেদিকে তাকাল, সেদিকে নজর গেল নীলের। একটা বড় গাছ থেকে মোটা এবং বেশ লম্বা সাপ নেমে আসছে। নীলের প্রথমে মনে হয়েছিল ওটা আনাকোন্ডা। কিন্তু মেনন বলল, ‘পাইথন। বেশ বড় সাইজের। একটা হরিণ খেয়ে নিতে পারে।’

যেদিক থেকে পাইথন নামছিল, সেদিকে বসে থাকা বন্দিরা প্রাণের ভয়ে চিৎকার করতে করতে একসঙ্গে বৃত্তের এদিকে আসতে চাইলে পাইরেটরা লাথি মরতে লাগল তাদের। আবার আগের জায়গায় বসিয়ে দিল জোর করে। লোকগুলোর মুখে মৃত্যুভয় স্পষ্ট। পাইথন অনেকটা নীচে নেমে এসেছে। লম্বা জিবটা একবার বের করছে, আর- একবার ঢোকাচ্ছে। দীর্ঘদেহ এগিয়ে গেল পাইথনটার দিকে। তারপর কোমরে ঝোলা খাপ থেকে লম্বা ছুরি বের করে দক্ষ হাতে ছুড়ল পাইথনের দিকে। পাইথনটা ততক্ষণে গাছের গুড়ি বেয়ে নীচে নামতে চেষ্টা করছিল। ছুরিটা উড়ে গিয়ে তার গলার মাঝখানে ঢুকে গাছে বিঁধে গেল। পাঁচ সেকেন্ড সময় লাগল। পাইথনের বিশাল শরীরটা পড়ে গেল গাছ থেকে। মাথাটা ছাড়াবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে পাইথন, কিন্তু এমন জায়গায় ছুরি আটকেছে যে সে কিছুতেই মুভ করতে পারছিল না। দীর্ঘদেহ কিছু বলতেই দুজন পাইরেট এগিয়ে গিয়ে তাদের ছুরি বের করে পাইথনের মাথাটা কেটে শরীর থেকে বাদ দিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে অন্য পাইরেটরা আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল।

বৃত্তের মাঝখানে আগুন জ্বালা হয়েছে। তারপর গাছের ডাল কেটে খাঁচা করে পাইথনটাকে সেঁকা হচ্ছে। অন্তত ষোলো ফুট লম্বা সাপটার শরীরের অন্য কোথাও ছুরি বিঁধলে, গুলি না করে তাকে মারা যেত না। পোড়া পাইথনের শরীর থেকে ধোঁয়া এবং পোড়া গন্ধ বের হচ্ছে। মেনন ফিসফিস করে বলল, ‘শালারা সাপ পুড়িয়ে খাবে।’

নীল বলল, ‘চাইনিজরাও সাপ খায়। এক একটা সাপের এক এক রকম স্বাদ।’

‘একেই খালি পেট, তার ওপর এসব দেখে মনে হচ্ছে বমি হয়ে যাবে।’

‘উহুঁ। নিজেকে ঠিক রাখো মেনন।’

সাপটাকে সম্পূর্ণ পোড়ানো হয়ে গেলে ওরা পোড়া ছাল টেনে তুলে দিল। এখন ওর চেহারা কাবাবের মতো দেখাচ্ছে। একটা লোক উঠে দাঁড়িয়ে মাথা গুনল। তারপর বসে সাপটাকে টুকরো করতে লাগল। প্রথম টুকরোটা, যেটা বেশ বড়, দীর্ঘদেহকে দিল লোকটা। একগাল হেসে পরম তৃপ্তিতে দীর্ঘদেহ তাতে কামড় বসাল।

প্রথমে নিজেদের জন্যে অনেকটা রেখে একটা করে টুকরো বন্দিদের হাতে গুঁজে দিয়ে গেল ওরা। দীর্ঘদেহ মাংস চিবোতে চিবোতে চেঁচাল, ‘ইট, ইট।’

মেনন জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি ওটা খাবে?’

‘কখনও তো খাইনি।’

‘আমার একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না।’ মেনন বলল।

‘কিন্তু পেটে তো কিছু নেই। এটা না খেলে সারাদিন কিছু খেতে পারব না বলে মনে হচ্ছে। না খেলে হাঁটতেও পারব না। তাই খেতে বাধ্য হচ্ছি।’ নীল বলল।

সে মাংসের টুকরোটায় কামড় দিল। বেশ তুলতুলে মাংস। চর্বি আছে। সিরাজের কাবাব খাচ্ছে বলে মনে হল। যদি একটু লবন মেশানো যেত। খিদে যে পেয়েছিল তা এখন খেতে খেতে আরও ভালো বুঝতে পারল নীল।

দু-দুবার মুখের কাছে নিয়ে গিয়েও খেতে পারল না মেনন। দীর্ঘদেহী সেটা লক্ষ করছিল। হঠাৎ সে চেঁচিয়ে উঠল। আগ্নেয়াস্ত্র তুলে মেননের দিকে তাক করে চেঁচিয়ে কিছু বলতেই নীল বলল, ‘খেয়ে নাও, না খেলে তোমাকে গুলি করে মারবে।’

মৃত্যুভয়ে কোনও মানুষকে কখনও খেতে দ্যাখেনি নীল। মেনন যেরকম গোগ্রাসে মাংসগুলো গলা দিয়ে নামাচ্ছিল তাতে মনে হচ্ছিল যেকোনও সময় তার দমবন্ধ হয়ে যাবে। দীর্ঘদেহ ওর খাওয়া দেখে হাসল। খাওয়া শেষ করে মেনন কোনওমতে বলল, ‘জল, একটু জল।’

‘এখন কেউ জল দেবে না। দেখছ না, কারও কাছে জলের পাত্র নেই।’ নীল বলল।

আবার হাঁটা শুরু হল। একটা খরগোশ অবাক চোখে তাদের দেখে বিপুল বেগে ছুটে পালাল। নীল বুঝতে পারছিল মাংসের টুকরো পেটে না গেলে হাঁটা প্রায় অসম্ভব ছিল। বাঁদরগুলো জোর শোরগোল তুলছে গাছগুলোতে। একজন পাইরেট মাটি থেকে একটা পাথর তুলে তাদের দিকে ছুড়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ওরা উধাও হয়ে গেল সামনে থেকে। প্রায় ঘণ্টা তিনেক হাঁটার পরে জলের শব্দ কানে এল। দীর্ঘদেহী চিৎকার করল, ‘হল্ট।’

এখানে বসার জন্য ন্যাড়া জায়গা নেই। নীল কান পেতে জলের শব্দ শুনল। বৃষ্টি হচ্ছে না, অথচ প্রবল শব্দে জল পড়ছে কাছাকাছি কোথাও। তাদের সামনে একটা ছোট পাহাড়। পাহাড়টার চুড়োয় পাথর, বাকিটা জঙ্গলে ঢাকা।

‘হল্ট’ চিৎকারটা করা হয়েছে তাদের থামার জন্যে, বসার জন্যে নয়। বসার কোনও জায়গাও নেই। খোঁচা খোঁচা গুল্ম ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র। এবার চিৎকার ভেসে এল, ‘ডাউন, ডাউন।’

অর্থাৎ নীচের দিকে এগোও। অনেকেই সেটা বুঝতে না পারলেও ফিসফিসিয়ে মেনন জিজ্ঞাসা করল, ‘কী মতলব বলো তো? আমাদের মারতে চাইছে?’

‘মারতে হলে এতদূরে নিয়ে আসবে কেন? সমুদ্রেই তো ডুবিয়ে মারতে পারত।’

‘তা ঠিক। দ্যাখো, আমরা যেমন কষ্ট করছি, ওরাও তেমনি করছে। শুধু ওদের হাত-পা বাঁধা নেই। চলো, নীচে চলো।’

দুপাশে পাহারা দিয়ে ওদের নীচে নামানো হলে নীল অবাক হয়ে গেল। জলপ্রপাতটা বেশ বড়, ভয়ংকর জলের ধারা অনেক ওপর থেকে আছড়ে পড়ছে নীচে। তার আওয়াজে কানে তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। সেই জল তীব্র স্রোতে নেমে যাচ্ছে নীচের দিকে। নিশ্চয়ই সমুদ্রে গিয়ে শেষ হচ্ছে।

কিন্তু এবার আর একটা দৃশ্য আবছা দেখা যাচ্ছে। আবছা কারণ তা আড়াল করে জলের বিশাল ধারা আছড়ে পড়ছে। প্রহরীরা চিৎকার করছিল জলের ধার ধরে এগিয়ে যেতে। কিছুটা যেতেই মেনন শিরশিরে গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘দেখেছ?’

হ্যাঁ, নীল মাথা নাড়ল। জলপ্রপাতের পেছনে অনেকটা লম্বা একটা অস্থায়ী বাঁশের আস্তানা। সেই আস্তানার মুখেও বন্দুকধারী পাহারাদার দাঁড়িয়ে ওদের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে হাসছে, যেন অনেক কাল পরে আফ্রিকার ক্যানিবালরা মানুষের দেখা পেয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *