রসাতলের রহস্য – ৮

আট

ঝড়ের আওয়াজ, জলের শব্দ ছাপিয়ে অনেক মানুষ একসঙ্গে আর্তনাদ করে উঠল, যদিও প্রবল ধাক্কায় জাহাজটা কাত হতে হতে সামলে নিতে পেরেছিল। নীল অবাক হয়ে দেখছিল তাদের জাহাজের গা-ঘেঁষে বেশ কয়েকটা রক্তচোখ জ্বলছে। ওগুলো যে আর একটি জাহাজের আলো তা বুঝতে সময় লাগল। তারপর হুঙ্কার, চিৎকার এবং কান্নার শব্দ কানে এল। ব্যাপারটা কী বোঝার জন্যে রেলিং-এর ধার দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে গিয়েও থেমে গেল নীল। জাহাজ এখনও ঝড়ের দাপটে শান্ত হয়নি। সোজা হয়ে হাঁটা দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার মনে হল ভয়ংকর কিছু একটা ঘটছে জাহাজে। এই যে হুঙ্কার এবং কান্না স্বাভাবিক অবস্থায় তো শোনা যায় না। ওপাশের দেওয়াল-ঘেঁষা বড় জলের পাইপের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল সে। দাঁড়াবার মিনিট খানেকের মধ্যে ঝড় থেমে গেল, জাহাজ সোজা হল। আরে কী আশ্চর্য, যাওয়ার সময় মেঘ বোধ হয় মেঘগুলোকে ওপরের আকাশ থেকে ঝেঁটিয়ে নিয়ে গেল। ফলে তিরতিরে আলোয় সমুদ্র অস্পষ্ট হলেও দেখা যেতে লাগল। নীল মুখ ঘুরিয়ে পাশের জাহাজটাকে দেখল। এই অল্পসময়ের সমুদ্রযাত্রায় সে জেনেছে যে কখনোই দুটো জাহাজ মাঝসমুদ্রে গায়ে গায়ে দাঁড়াবে না। এটা আইনবিরুদ্ধ। পাশের জাহাজটা আকৃতিতে অনেক ছোট।

এই সময় গুলির আওয়াজ কানে এল। ওপর থেকে গুলি ছুড়ছে। নীল একটু কেঁপে উঠল। তার পরই নীচ থেকে টানা গুলির আওয়াজ হতে লাগল। সেইসঙ্গে আর্তনাদ। বোঝা যাচ্ছে নীচ থেকে যারা গুলি ছুড়ছে তাদের অস্ত্র অনেক আধুনিক। এবার জাহাজ কাঁপিয়ে ওপরের তলায় শব্দ হল, আলো ছিটকে সমুদ্রটাকে এক ঝলকের জন্যে দৃশ্যমান করেই নিভে গেল। নীচ থেকে হাতবোমা ছোড়া হচ্ছে। নীল বুঝতে পারল এই জাহাজ আক্রান্ত। নিশ্চয়ই জলদস্যুদের কবলে পড়েছে তারা।

মিনিট তিনেক সব চুপচাপ। তারপরে জাহাজের সাউন্ডসিস্টেমে গলা ভেসে এল। ভাষা বুঝতে পারল না নীল। শুধু শেষদুটো শব্দ ইংরেজিতে বলল লোকটা, ‘ক্যাপ্টেন, টক।’

এখন ক্যাপ্টেনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। চিনতে ভুল হল না। ক্যাপ্টেন বললেন, ‘জাহাজের প্রতিটি কর্মী এবং অফিসারকে আমি দু:খের সঙ্গে জানাতে বাধ্য হচ্ছি এই জাহাজ এখন পাইরেটসদের দখলে। জাহাজের রেডিয়ো এবং কম্পিউটার রুম ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আমি প্রতিটি কর্মী এবং অফিসারকে ডেকের ওপর লাইন দিয়ে দাঁড়াতে অনুরোধ করছি। আমাদের অনেকেই হতাহত হয়েছে। তাই অনুরোধ এই সংখ্যাটা আর বাড়াবেন না।’

একটা বড় সার্চ লাইটের আলো ঘুরতে ঘুরতে এদিকে আসছিল। নীল বুঝল জলের পাইপের আড়ালে দাঁড়িয়েও সে নিজেকে সম্পূর্ণ লুকোতে পারবে না। ধীরে ধীরে সে কয়েক পা এগোতেই সার্চ লাইটের আলো তার ওপর এসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসের চিৎকার। একটা শক্ত কিছু ছুটে এসে তার থাইতে তীব্র আঘাত করলে সে আর্তনাদ করে মেঝের ওপর পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা শক্ত হাত তাকে হ্যাঁচকা টানে তুলে ধরে মুখ বিকৃত করে কথা বলতে লাগল। লোকটার গায়ের রং মিশকালো, তার পর তাকে ধাক্কা দিতে দিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল ডেকের দিকে।

প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছিল ডান পায়ে। যেটা ছোড়া হয়েছিল সেটা যদি দুই ইঞ্চি নীচে এসে লাগত তাহলে হাঁটু চুরমার হয়ে যেত। যে লোকটা তাকে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার শরীর সাড়ে-ছয় ফুট এবং তার চেয়ে অনেক শক্তিশালী। পা জখম না হলেও ওর সঙ্গে শক্তিতে পারা সম্ভব হত না।

ডেকে গিয়ে নীল দেখল ইতিমধ্যেই অনেকে লাইনে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ভয়ে সিটিয়ে গিয়েছে বেশির ভাগ কর্মী। সামনে আধুনিক রাইফেল নিয়ে আট জন পাইরেট সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে। একজন এগিয়ে এসে রাইফেলের নল দিয়ে প্রথম লোকটিকে আঘাত করতেই সে আর্তনাদ করে উঠল। তাকে কাঁধ ধরে বসিয়ে দিল পাইরেট। তার পর দ্বিতীয় জনের দিকে এগোতেই সে আঘাত এড়াতে বসে পড়ল। নীল দেখল লাইনের সবাই এক এক করে বসে গেল। অতএব তাকেও বসতে হল। এবার ওপর থেকে গরু তাড়াবার মতো কয়েকজনকে নামিয়ে আনল অন্য পাইরেটরা। তাদের বসিয়ে দেওয়ার পর নীল লক্ষ করল অনেকের পোশাকে রক্তের ছাপ, মুখ ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে। এই সময় ওপর থেকে পরপর চারবার গুলির আওয়াজ ভেসে এল। তার পর বিশাল চেহারার একটা লোক নীচে নেমে এল, পেছনে কয়েকজন বাডিগার্ড, যাদের হাতে অস্ত্র। লোকটাকে এদের নেতা না ভাবার কোনও কারণ নেই। নীচে নেমে বসে থাকা কর্মচারীদের দেখে গুনতে লাগল আঙুল তুলে। তারপর অজানা ভাষায় হুকুম দিল। সঙ্গে সঙ্গে পাইরেটরা কর্মচারীদের পেছনে মুড়ে বেঁধে ফেলল। তারপর প্রত্যেককে কোমরে দড়ি বেঁধে একজনের সঙ্গে আর একজনকে জুড়ে দিল। নেতা চিৎকার করে হুকুম করতেই দড়ির প্রথমে যে ছিল তাকে আদেশ করল একজন পাইরেট। কথার অর্থ বুঝতে না পারায় লোকটা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। রাইফেলের নল দিয়ে তাকে আঘাত করে এগিয়ে যেতে ইশারা করল পাইরেট। লোকটা এগোতেই পেছনের লোকগুলো অনুমান করতে বাধ্য হল। পায়ে ভয়ংকর যন্ত্রণা সত্বেও খুঁড়িয়ে হাঁটতে বাধ্য হল নীল।

দুটো জাহাজের মাঝখানে একটা চওড়া কাঠের পাটাতন ফেলে আসা-যাওয়ার পথ বানিয়েছে পাইরেটরা। নীলদের জাহাজের রেলিংটার এই জায়গাটা যে খোলা যায় তা পাইরেটদের জানা থাকায় কাজটা সহজ হয়েছে। বন্দিদের ওই পথ দিয়ে পাইরেটদের জাহাজে নিয়ে আসা হল। তার পর একটু এগিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামানোর পর একটা দরজা খুলে তার ভেতরে সবাইকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। এই কাজটা করতে প্রচুর চিৎকার করল ওরা, হাত চালাল বারংবার। ওই ঘর থেকে আরও নীচে নামতে হল। স্যাঁতসেতে, অন্ধকার ঘরের দেওয়ালে একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে। নিজেদের ভূতের মতো মনে হচ্ছিল। ওদের ওখানে নামিয়ে দিয়ে পাইরেটরা দরজা বন্ধ করে ওপরে চলে গেল। কেউ কেউ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, কেউ চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল। নীলের পাশে দাঁড়ানো লোকটা, মুখ আবছা, বলল, ‘সব শেষ হয়ে গেল।’

ওপাশের লোকটা বলল, ‘আমাদের বন্দি করে নিয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই বিক্রি করবে।’

নীল দেখল কথাগুলো মুখে মুখে ছড়িয়ে যেতে আবার কান্না আর আর্তনাদ শুরু হল। কিন্তু মানুষের এসব করার শক্তি বেশিক্ষণ থাকে না বলে একসময় সবাই চুপ মেরে গেল। নীল পা বাড়িয়ে বাড়িয়ে বুঝতে পারল দেওয়ালের গায়ে বেঞ্চির মতো কিছু রয়েছে। সে বসার চেষ্টা করলে পাশের লোকের কোমরে টান পড়ল, ‘কী করছ?’

মুখ ঘুরিয়ে নীল বলল, ‘আর দাঁড়াতে পারছি না। আপনিও বসুন না!’

‘এখানে বসার জায়গা আছে!’ লোকটা অবাক হল। তার পর চেষ্টা করল বসতে। তার দেখাদেখি অনেকেই বসে পড়ল। বাকিদের জায়গা হল না।

নীলের পাশে যে বসেছিল তার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না সে। যাদের সঙ্গে ওপরের অফিসে কাজ করত তারা কেউ এখানে ছিল না। এমনকী গলার স্বর শোনার পর থেকে ক্যাপ্টেনের হদিশ পাওয়া যায়নি, এরা কি ওপরে যখন গুলি চালিয়েছিল তখন সবাইকে মেরে ফেলেছে?

এবার পাইরেটদের এই জাহাজ নড়তে লাগল। মাঝে মাঝেই বেশ কেঁপে উঠছে। পাশের লোকটা ফিসফিস করে বলল, ‘লোডিং হচ্ছে।’

‘কী?’ নীল জিজ্ঞাসা করল।

‘আমাদের জাহাজে যত মাল যাচ্ছিল সব এই জাহাজে ঢুকিয়ে ফেলছে। আচ্ছা, ক্যাপ্টেন কী করছেন? এরা ওঁকে মেরে ফেলল নাকি?’

নীল উত্তর দিল না। উত্তরটা তার জানা নেই।

ঘণ্টাদুয়েক বাদে পাইরেটরা জাহাজ ছাড়ল। পাশের লোকটা বলল, ‘এখানে দিনরাত কিছুই বোঝা যাবে না। এই ঘরটা নিশ্চয় জলের নীচে। তোমার নাম কী?’

—’নীল।’

—’ও:, তোমাকে তো অনেকবার দেখেছি। ফারুক সাহেবের বন্ধু?’

—’তুমি ফারুক সাহেবের সঙ্গে পরিচিত?’

‘আরে দোস্ত, জাহাজের সবাই ওঁকে চিনত। যখন শুনলাম মানুষটা বন্দরে নেমে হারিয়ে গিয়েছে, কেউ বলল মারা গিয়েছে, খুব খারাপ লেগেছিল। শেষ পর্যন্ত জানলাম একটা পাইরেট জাহাজে ওকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তখন মনে হল তাহলে তো বেঁচে যাওয়ার চান্স আছে। আচ্ছা, ওরকম ভালো মানুষকে পাইরেটরা বন্দি করে নিয়ে গেল কেন?’ লোকটা জিজ্ঞাসা করল।

‘তোমার নাম কী?’ নীল জিজ্ঞাসা করল।

—’মেনন।’

‘মেনন, আমাদের অনেকেই তো খুব সাধারণ মানুষ। তাহলে আমাদের ওরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে কেন? ব্যাপারটা একই।’ নীল হাসল।

‘আরে! এই অবস্থাতেও তুমি হাসছ!’ মেনন অবাক হল।

‘দ্যাখো, লোকে ভবিষ্যতে কী হবে তা জানে না। আমরা তো বর্তমানে কী হচ্ছে তাও জানি না। ধরো, আমার এখন বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হল, কোথায় কীভাবে যাব জানি না।’ নীল বলল, ‘তাই হাসি এসে গেল।’

‘হুম। একটু পরে জায়গাটা নরক হয়ে যাবে।’ মেনন হতাশ গলায় বলল।

জাহাজ এবার কিছুটা গতি বাড়িয়েছে। ওপরে কী হচ্ছে তা নীচে বসে কেউ টের পাচ্ছে না। মেনন বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে এরা সোমালিয়ার পাইরেট।’

—’কেন মনে হচ্ছে?’

—’আমাদের ওখানে চাষিরা চাষের সময় খেতে কাজ করে। যখন চাষ থাকে না তখন শহরে গিয়ে রিকশা চালায়। এরাও শুনেছি অবসর পেলেই পাইরেসি করে। এদের মনে কোনও দয়ামায়া নেই। এই যে আমাদের এখানে ফেলে রেখেছে, দেখবে খাবার দেবে না, জলও দেবে না।

নীল বলল, ‘তাহলে তো সবাই মরে যাবে, বিক্রি করবে কাকে?’

মেনন কোনও কথা বলল না। সম্ভবত তার মাথায় কিছু ঢুকছিল না।

সোমালিয়া। কাগজে সোমালিয়ার জলদস্যুর সম্পর্কে যা পড়েছে তাতেই মনে হয়েছে ওরা মানুষ নয়, ভয়ংকর দানব। তার নমুনা তো ইতিমধ্যেই দেখা গিয়েছে। এদের হাত থেকে কী করে নিষ্কৃতি পাবে তা বুঝতে পারছিল না নীল। একবার যদি ওরা বিক্রি করে দিতে পারে তাহলে বাকি জীবনটা ক্রীতদাস হয়ে থাকতে হবে। এই দুই হাজার চোদ্দো সালেও যে পৃথিবীতে ক্রীতদাস প্রথা চালু আছে তা সভ্যজগতে ক’জন মানুষ জানেন?

এই ঘর জলের তলায়। এর ওপর আরও দুটো তলা আছে। স্বাভাবিকভাবেই এই ঘরে জানলা থাকতে পারে না। কোনও ফাঁক তৈরি করে যদি এখানে জল ঢোকে তাহলে চুপচাপ মরে যেতে হবে। চিৎকার করলেও বাইরের কেউ শুনতে পাবে না। এখানে দিন এবং রাতের পার্থক্য বোঝার কোনও উপায় নেই। হঠাৎ ওপাশের কেউ চিৎকার করে উঠল। তার পায়ে কিছু কামড়েছে। আর্তনাদ করতে লাগল লোকটা। আর তখনই নীলের পায়ের ওপর দিয়ে দ্রুত কিছু চলে গেল। মেনন চেঁচিয়ে উঠল, ‘ইঁদুর, ইঁদুর। খুব বড় সাইজের ইঁদুর। যাকে কামড়েছে তাকে এখনই ইঞ্জেকশন দেওয়া দরকার।’

নীল হেসে ফেলল, ‘ইঞ্জেকশন না দিলে কী হবে?’

মেনন উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘মরে যাবে লোকটা।’

‘এমনিতেই তো মরে যাবে। আমরা কেউ কি বেঁচে থাকব?’

এই সময় ওপরে শব্দ হল। ঘটঘটাং করে খুলে গেল লোহার ঢাকনা। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল পাঁচজন লোক। একজনের হাতে বড় ড্রাম। বাকিরা প্লাস্টিকের বাটি সেই ড্রামে চুবিয়ে একের পর এক বন্দির হাতে তুলে দিতে এসে থেমে গেল। তার পর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পেছনে বেঁধে রাখা হাত খুলে দিল। তার পর প্লাস্টিকের বাটি প্রত্যেকের হাতে তুলে দিয়ে ফিরে গেল ওপরে। ঢাকনা আবার বন্ধ হয়ে গেল।

টিমটিম আলোয় বোঝা গেল বাটির মধ্যে ঘোলজাতীয় তরল পদার্থের মধ্যে কিছু ভাসছে। তার আগেই মেনন চুমুক দিল। ছ্যা ছ্যা বলে মুখ বিকৃত করল। নীল জিজ্ঞাসা করল, ‘কী এটা?’

‘আমার চোদ্দো পুরুষ এর নাম বলতে পারবে না। ঠান্ডা ঝোল, কোনও স্বাদ নেই, তার মধ্যে মাংসের মিনি টুকরো।’ মেনন বলল।

‘খেয়ে নিন। না খেলে শরীর দুর্বল হয়ে যাবে।’ নীল বলল।

‘দুর্বল হলেও মরব, এমনিতেও মারা যাব।’ মেনন বিড়বিড় করল।

নীল চুমুক দিল। এটা ঝোল নয়। সম্ভবত স্যুপ। কিন্তু এরকম বিস্বাদ স্যুপ বানাতেও দক্ষতা লাগে। মাংসের ছোট্ট টুকরোটা দুবার চিবোতেই মিলিয়ে গেল। মেনন জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা কীসের মাংস মনে হয়? চিকেন তো নয়ই।’

‘মাটন খুব দামি। আমাদের খাওয়াবে না। হয় গরু নয় শুয়োর।’ নীল বলল।

মেননের ওপাশে যে স্যুপ শেষ করে কথা শুনছিল সে চিৎকার করে উঠল। ‘হায় আল্লা, এটা যেন গরুর মাংস হয়, আমাকে নিষিদ্ধ মাংস খাওয়ার পাপ থেকে উদ্ধার করোক।’

মেনন রেগে গেল, ‘তুমি তো অদ্ভুত লোক। তোমার শুয়োরের মাংস খাওয়া যদি পাপ হয় তাহলে আমার তো গরুর মাংস খেলেও পাপ হবে। তুমি গরুর মাংস চাইছ কেন?’

নীল বলল, ‘বা:, আমরা সবাই এখন যে অবস্থায় আছি সেই অবস্থাতেও ধর্ম যদি চলে যায় সেই ভয়ে চেঁচামেচি করছি। চমৎকার!’

হাত খুলে দেওয়ায় মানুষগুলো সাহসী হল। কোমরের দড়ি খুলে ফেলল ওরা। একটু পরেই শব্দ কানে এল। নীল দেখল এক এক করে কয়েকজন ঘরের একদম কোনায় গিয়ে জলবিয়োগ করে আসছে। সেটা বাইরে বেরিয়ে যেতে পারবে না। একটু পরেই সমস্ত ঘরের মেঝেতে প্রস্রাব ছড়িয়ে পড়বে। দুর্গন্ধে ভরে যাবে, শ্বাস নিতে কষ্ট হবে।

একটু পরে একজন হিন্দিতে চিৎকার করল, ‘জল খাব। খুব তেষ্ঠা পেয়েছে।’

কেউ বলল, ‘এখানে জল পাওয়া যাবে না।’

—’পাওয়া যাবে না বললেই হল! জল না খেলে মরে যাব।’

—’তাহলে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ধাক্কা দাও, খুললে জল চেয়ে নাও।’

তৃষ্ণা যার প্রবল হয়ে উঠেছিল সে সিঁড়ির শেষ ধাপে উঠে লোহার ঢাকনায় সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ খুলে গেল ঢাকনা। মুখ বাড়িয়ে একজন পাইরেট যেভাবে কথা বলল তা মানুষ রেগে না গেলে বলে না।

লোকটা হকচকিয়ে গিয়েছিল। তার পর সাহস করে বলল, ওয়াটার, থার্স্টি, গিভ মি ওয়াটার।’ সেই সঙ্গে গলায় গ্লাস থেকে জল ঢালার মুদ্রা করল।

এবার পাইরেট হো হো করে হেসে উঠল। উঠে আড়ালে থাকা তার সঙ্গীকে নিজের ভাষায় কিছু বলল। সঙ্গে সঙ্গে লোকটাকে সরিয়ে সঙ্গী পাইরেট গর্তের মুখে চলে এসে প্যান্টের জিপার টেনে সরিয়ে লোকটার মুখের ওপর প্রস্রাব করতে করতে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগল।

ধড়মড়িয়ে নীচে নেমে এল লোকটা। ওপরের ঢাকনা বন্ধ হয়ে গেল।

কতক্ষণ চলে গেল নীল বুঝতে পারেনি, কিন্তু জাহাজটা যে গতি কমিয়ে আনছে তা টের পেল। তার পর ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। অর্থাৎ ওরা বন্দরে চলে এসেছে। সভ্যজগতের নিয়ম মানলে এখন বন্দরের কাস্টমস অফিসারদের জাহাজে উঠে আসার কথা। কিন্তু নীল নি:সন্দেহ এদের ক্ষেত্রে সেটা হবে না।

এই ঘর এতক্ষণে নরক হয়ে গেছে। প্রস্রাবের সঙ্গে বমিও করছে কেউ কেউ। হঠাৎ ফারুক সাহেবের কথা মনে এল নীলের। পিরানহা জাহাজে কিডন্যাপ করে ওঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওই জাহাজেও কি ওঁকে এমন নরকযন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে?

মেনন নীচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কী করে এদের হাত থেকে পালানো যায় ভাবো তো। আমি এতক্ষণ ভেবেও কূল পাচ্ছি না।’

ঠিক তখনই ওপরে শব্দ হল। লোহার ঢাকনা খুলে একজন পাইরেট মুখ বারিয়ে চিৎকার করল, ‘আপ, আপ, লাইন, লাইন, কুইক।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *