রসাতলের রহস্য – ৭

ক্যাপ্টেনের ঘরের এককোণে চুপচাপ বসেছিল নীল। পিরানহা জাহাজটাকে দেখার পরেই সে সোজা ক্যাপ্টেনের ঘরে কোনও অনুমতি ছাড়াই চলে এসেছিল উত্তেজিত হয়ে, যা রীতি বিরুদ্ধ। বিয়ার বারে যা শুনেছিল তা বিশদে বলে জানিয়েছিল এইমাত্র তিনটে গাড়ি গিয়ে থেমেছে ওই জাহাজের সামনে। মহিলার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে ফারুক সাহেবকে উদ্ধার সম্ভব হবে।

ক্যাপ্টেন গম্ভীরমুখে সব শুনে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘যদি মহিলার কথা সত্যি না হয়, অথবা সত্যি হলেও ওই গাড়িগুলোতে যদি ফারুক না থাকে তাহলে আমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে। তুমি ওখানে বসো। আমি আসছি।’

ক্যাপ্টেন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে নীল ঘরের এককোণে জানলার পাশের চেয়ারে গিয়ে বসেছিল। তার মনে হচ্ছিল ওরা নিশ্চয়ই ফারুক সাহেবকে জাহাজে তুলে ফেলেছে। ওরকম কাচ ঢাকা গাড়িদের পাইলট কার এসকর্ট করে কেন ওই জাহাজে নিয়ে যাবে? নিশ্চয়ই ওই জাহাজের ক্যাপ্টেন বা অন্য কেউ এত খাতির পাবে না। সে জানলার বাইরে তাকাল। সমুদ্রে সন্ধ্যা নামছে। একটু পরেই অন্ধকার ঘন হয়ে গেলে তাদের জাহাজ যেমন এই বন্দর ছেড়ে যাবে তেমনি পিরানহা তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। ফারুক সাহেবকে যদি সত্যি ওরা নিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে আর কোনওদিন ওঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এতবড় সমুদ্রে দুটো জাহাজের দূরত্ব ক্রমশ বেড়ে যাবে।

দরজায় শব্দ হল। ডিসিলভা ভেতরে এলেন। নীলকে দেখে হেসে বললেন, ‘তুমি খুব ভাগ্যবান। খবর পেলাম পুলিশ নাকি বন্দর এলাকায় তল্লাশি চালাচ্ছে। রাস্তায় লোক চলাচল নিষিদ্ধ। তুমি ঠিক সময়ে জাহাজে ফিরে এসেছ, না হলে—!’

পুলিশ অফিসারের কথা মনে পড়ল নীলের। লোকটা তাড়াতাড়ি তাকে জাহাজে ফিরে যেতে বলেছিল। এখন লোকটাকে আর খারাপ মনে হল না। এই সময় ক্যাপ্টেন ঘরে এলেন। নিজের চেয়ারে বসে বললেন, ‘আমি হেড অফিসের সঙ্গে কথা বললাম। ওরা আমাকে কোনওরকম ঝুঁকি নিতে নিষেধ করলেন। এই বন্দর থেকে একটু পরেই বেরিয়ে যাব আমরা, ততক্ষণ চুপচাপ থাকতে উপদেশ দিলেন। এক্ষেত্রে আমার কিছুই করণীয় নেই।’

ডিসিলভা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নীল কোনও খবর এনেছে?’

‘হ্যাঁ। ওর মনে হচ্ছে ফারুককে কিডন্যাপ করে একটা জাহাজে তোলা হয়েছে। পুলিশকে বলে সেই জাহাজে খোঁজ করলে ওকে উদ্ধার করা যেতে পারে। কোনও প্রমাণ নেই, শুধু মনে হওয়ার ওপর নির্ভর করে আমরা অভিযোগ জানাতে পারি না।’ ক্যাপ্টেন বললেন।

‘আশ্চর্য! ফারুক সেইলার। বছরের বেশিরভাগ সময় সে স্বেচ্ছায় জাহাজে থাকে। তাকে কেন কিডন্যাপ করা হবে। উদ্দেশ্য কী?’ ডিসিলভা নীলের দিকে তাকালেন। ‘কিডন্যাপের কথা তোমার মনে এল কেন?’

‘বিয়ার বারের যিনি মালকিন তিনিই কথাটা বলেছেন।’ নীল বলল।

‘বাট হোয়াই? ওকে কিডন্যাপ করে ওরা কী পাবে?’

‘জানি না।’ নীল মুখ নীচু করল।

ক্যাপ্টেন বললেন, ‘আর একটা খবর আছে। যে জাহাজের কথা নীল বলছে সেই পিরানহা আসলে মায়ানমারের এক কোম্পানির। তাদের অতীতের কাজকর্ম ভালো নয় বলে লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। ওরা এখন চিনের এক কোম্পানির ব্যানারে জাহাজ চালাচ্ছে।’

‘মায়ানমার?’ নামটা শুনে নীল সোজা হয়ে বসল।

ডিসিলভা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কিছু বলবে?’

নিজেকে সামলাল নীল। বলল, ‘না।’

ক্যাপ্টেন বললেন, ‘ওয়েল। আমাদের এখন তৈরি হতে হবে।’

নীল বেরিয়ে এল।

রাত ন’টায় ওদের জাহাজ বন্দর ছেড়ে যাবে বলে তৈরি ছিল কিন্তু পোর্ট অথরিটি ক্লিয়ারেন্স দিতে দেড় ঘণ্টা দেরি করল। নীল ডেকে দাঁড়িয়ে বন্দরের দিকে তাকিয়েছিল। ডাইনির চোখের মতো বন্দরের আলোগুলোকে রহস্যময় মনে হচ্ছিল। এই বন্দরে দুটো মানুষ চিরকালের জন্যে হারিয়ে গেল ভাবতেই শরীরে কাঁটা ফুটল। স্যাম তো আত্মহত্যা করেছে। ওই ডাইনির কাছে যাওয়ার কোনও দরকার ছিল না ওর। কিন্তু ফারুক সাহেব তো নির্দোষ মানুষ। কারও সাতে পাঁচে থাকতেন না। তাহলে তিনি কেন হারিয়ে যাবেন? ক্যাপ্টেন বললেন পিরানহা জাহাজটা আসলে মায়ানমারের জাহাজ। এই মায়ানমার নামটা শুনেই নীলের মনে হচ্ছে একটা গভীর চক্রান্তের শিকার হয়েছেন ফারুক সাহেব। তাঁর বন্ধু ইয়াসিন তো জলদস্যুদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল মায়ানমারে। ইয়াসিনের কাছে যে দামি দামি হিরে ছিল তা জলদস্যুরা জেনে গিয়েছিল বলেই সে ফারুক মাস্টারকে বিশ্বাস করে রাখতে দিয়েছিল। ইয়াসিন খুন হয়ে যায়। এই খুন নিশ্চয়ই মায়ানমারের জলদস্যুরাই করেছিল। ফারুক সাহেব যে ওই হিরের হদিশ জানেন এই খবর কি ওরা পেয়ে গেছে? কীভাবে পেল? জাহাজ ছাড়ছে। নীল দ্রুত ডেকের শেষ প্রান্তে চলে এল। অন্ধকার হলেও বন্দরের এদিকে যে কোনও জাহাজ নেই তা বুঝতে অসুবিধে হল না। পিরানহা বন্দর ছেড়ে চলে গিয়েছে। নীলের কেবলই মনে হচ্ছিল, ক্যাপ্টেন যদি তার কথায় আস্থা রেখে পিরানহা জাহাজটাকে পুলিশ দিয়ে সার্চ করাত তাহলে ফারুক সাহেবকে অবশ্যই উদ্ধার করা যেত। তার পরেই মনে হল, পুলিশ কিছুতেই সার্চ করতে রাজি হত না। গড়িমসি করে সময়টা কাটিয়ে দিত। যারা পাহারা দিয়ে অপরাধীদের সাহায্য করে তারা একটা বাহানা খুঁজে বের করবেই।

জাহাজ চলছে। বন্দরের একটি ছোট্ট জাহাজ পথ দেখিয়ে দিয়ে ফিরে গেল। আজ আকাশে তারাদের দেখা যাচ্ছে না। ছেঁড়া ছেঁড়া কালো মেঘগুলো পরস্পরকে আঁকড়ে ধরায় সমুদ্র আর আকাশের মধ্যে আড়াল তৈরি হয়ে গিয়েছে। ক্যান্টিনে বসে ডিনার করছিল নীল। বেশিরভাগ নাবিক যে যার কাজে লেগে গেছে। জনা সাতেক মানুষ খাবার খাচ্ছিল। তার পাশে বসা বয়স্ক নাবিকটি প্রশ্ন করল, ‘তুমি আজ প্রায় দৌড়ে ফিরে এসেছ জাহাজে। ভাগ্যিস ফিরেছ।’

‘আপনি দেখেছেন?’ নীল জিজ্ঞাসা করল।

‘দেখলাম তো, তার পরই তো ধরপাকড় শুরু হয়ে গেল। এই সব আদিম আইনের বন্দরগুলোতে কখন কী হবে তা আগাম বলা মুশকিল। মাঝখান থেকে আমাদের দুজন মানুষ আর ফিরে আসবে না।’ লোকটি কথা বলছিল এমন গলায় যে মনে হচ্ছিল সে নিজের সঙ্গেই কথা বলছে।

একটু পরে লোকটা নীলের দিকে তাকাল, ‘আকাশটা দেখেছ?’

‘হ্যাঁ। মেঘ জমেছে।’

‘আকাশ ছাড়া মেঘ আর কোথায় জমবে। কিন্তু ভালো করে দেখলে বুঝবে এই মেঘ সচরাচর জমে না। এ হল অমঙ্গলের মেঘ।’ লোকটি বলল।

‘আপনার কথা বুঝতে পারলাম না।’ নীল তাকাল।

‘আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না। অনুভব করতে পারি। এরকম থম ধরা মেঘ ঝড়কে ডেকে আনে। একবার ওই ঝড়ের মধ্যে পড়েছিলাম। কপাল ভালো ছিল, বেঁচে গিয়েছিলাম। আমার হাত ভেঙে গিয়েছিল। তখন ওই ফারুক আমাকে রক্ষা করেছিল। আজ ফারুক নেই কিন্তু মনে হচ্ছে ঝড়টা ঠিক আসবে।’ বিড়বিড় করে বলল লোকটা।

‘আপনি আপনার আশঙ্কার কথা ক্যাপ্টেনকে বলছেন না কেন?’

কাঁধ নাচিয়ে হাসল লোকটা। ‘আমার কথা শুনবে কেন? এখন জাহাজ চলে যন্ত্রের সাহায্যে। কম্পিউটার আগাম যে খবর দেবে তা-ই ক্যাপ্টেন মেনে নেবে। এখন বলতে গেলে ভাববে আমি পাগলামি করছি। কিন্তু তোমাকে বললাম। তোমার সঙ্গে ফারুকের ভালো সম্পর্ক ছিল। লোকটা খারাপ মানুষের সঙ্গে মিশত না। মনে হল তুমি খারাপ নও। তাই বলছি, সতর্ক থেকো।’

‘কীভাবে সতর্ক থাকব?’

‘কেবিন থেকে বেরিও না। আজ কেবিনে যাওয়ার আগে লাইফ জ্যাকেট হাতের কাছে রেখো। সঙ্গে টর্চ রাখবে। আর যতটা পারো শুকনো খাবার কোনও ওয়াটার প্যাকেটে ভরে নেবে। অন্তত তিন বোতল জল নেবে। যদি জাহাজ ডুবে যায় এগুলো তোমাকে খুব সাহায্য করবে।’ কথাগুলো বলে লোকটা চুপচাপ চলে গেল।

এই লোকটিকে আগেও দেখেছে নীল। নিজের কাজটুকু ঠিকঠাক করে কেবিনে চলে যায়। কারও সঙ্গে কথা বলে না অপ্রয়োজনে। ফারুক সাহেব মুখোমুখি হলে সেলাম জানাতে দেখেছে নীল। আজ যখন চলে গেল তখন লোকটাকে ভূতুড়ে বলে মনে হচ্ছিল। লোকটা যেন সামনে মৃত্যু দেখতে পেয়ে গেছে। মৃত্যুর মোকাবিলা কীভাবে করতে হবে তার পরামর্শ দিয়ে খুশি হল। এরকম মানুষের সান্নিধ্য এড়িয়ে যাওয়াই উচিত।

ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে একটা চাতালে এসে দাঁড়াল নীল। চাতালের ওপর কোনও ছাদ না থাকায় আকাশটাকে খোলাখুলি দেখা যায়। সে আকাশের দিকে তাকাল। ঘন মেঘ যেন পৃথিবীর ছাদের চেহারা নিয়েছে। ফলে সাগরের জল একদম দেখা যাচ্ছে না। লোকটা যা বলে গেল তা কি সত্যি হবে। ঝড় আসছে এমন পূর্বাভাস কি জাহাজের র‌্যাডারে ধরা পড়বে না? সেটা জানতে পারলে ক্যাপ্টেন নিশ্চয়ই সবাইকে সতর্ক করে দেবেন! হঠাৎ আকাশের এককোণে নজর আটকে গেল নীলের। সেখানকার মেঘ যেন একটু একটু করে পাতলা হয়ে আসছে। পাতলা যে হচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে এই কারণে যে ওই জায়গায় খুব নিস্তেজ আলো ফুটছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নীলের মনে হচ্ছিল আলোর তেজ বাড়ছে। যেন মেঘের ওপাশে কেউ আলো জ্বেলে দিয়েছে। তার একটু পরেই চকিতে একফালি চাঁদ দেখা দিতেই নীচের মেঘ তাকে আড়ালে ফেলে দিল। হঠাৎ সেই লাইনটা মনে পড়ে গেল নীলের। ওদের স্কুলের টিচার মাঝে মাঝে লাইনটা বলতেন। সেটাকে একটু ঘুরিয়ে ভাবল সে, ‘মেঘ দেখে তুই করিস না ভয়, আড়ালে তার চাঁদ হাসে।’

অফিসস্টাফ ছাড়া সমস্ত কর্মীদের আজ রাত্রে চার ঘণ্টার শিফটে কাজ করার আদেশ দিয়েছেন ক্যাপ্টেন। তাঁর জুনিয়াররা জাহাজের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। নিজের বিছানায় শুতে গিয়ে লোকটার কথা আবার মনে পড়ল। যে সব জিনিস জোগাড় করে কাছে রাখতে বলেছিল লোকটা সেগুলো নিয়ে আসা খুব কঠিন কাজ নয়। কিন্তু ব্যাপারটা জানাজানি হলে তাকে নিয়ে সবাই মজা করবে। ধরা যাক, আজ রাত্রের ঝড়ে জাহাজ ডুবে গেল সমুদ্রে, লাইফ জ্যাকেট, জলের বোতল, শুকনো খাবার আর টর্চ নিয়ে এই গভীর সমুদ্রে সে কতক্ষণ ভেসে থাকতে পারবে? তাদের উদ্ধার করতে যদি কোনও জাহাজ চলে আসে ততক্ষণে তো সে ঢেউ-এর ধাক্কায় অনেক দূরে চলে যাবে। ঠান্ডা জলে শরীর অসাড় হবে। ওই জলের বোতলটাকেই খুব ভারী মনে হবে তখন। হয়তো তাকে উদ্ধার করা হবে তখন যখন শরীরে প্রাণ থাকবে না। নীল ধুত্তেরিকা বলে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল।

সকালে ঘুম ভাঙার পর চারপাশে তাকিয়ে খুশি হল নীল। না, সে সমুদ্রে ভাসছে না। লোকটার কথা শুনলে এখন বেইজ্জত হতে হত। কিছু কিছু মানুষ আতঙ্ক তৈরি করতে ভালোবাসে। নিজেই একটা জগৎ তৈরি করে তার মধ্যে থেকে যেতে চায় তারা।

স্নান করে ব্রেকফাস্ট সেরে অফিসে চলে এল নীল। আসার সময় ডেকের ওপর একটু দাঁড়িয়ে দেখেছিল আজ সূর্য ওঠেনি। মেঘ আরও ঘন হয়েছে। সমুদ্রের ওপর মরা আলো ছড়ানো। এরকম আলো দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়।

অফিস ঘরে ঢুকে নিজের টেবিলে বসার আগে সে লক্ষ করল সিনিয়াররা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। সে গুডমর্নিং বললে ওঁরা ঘাড় নাড়লেন। যেহেতু ওরা অফিসস্টাফ তাই ওদের থাকার ব্যবস্থা আলাদা। ক্যান্টিনও সেখানে আছে। নীলকে যেহেতু জাহাজকর্মী থেকে অফিসের কাজে নিয়ে আসা হয়েছে তাই সে আগের জায়গাতেই থেকে গিয়েছে। তখন বললে নিশ্চয়ই তার থাকার জায়গা বদলে যেত কিন্তু ফারুক সাহেবের সঙ্গ পাবে বলে সে আবেদন করেনি।

কম্পিউটারে ডেটা এন্ট্রি শুরু করল নীল। আধঘণ্টা পরে ডিসিলভা ঘরে ঢুকলেন গম্ভীর মুখে। নীল তাঁকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘গুডমর্নিং স্যার।’

চিন্তিত ডিসিলভা মাথা নাড়লেন, ‘ইয়েস। কিন্তু আজকের সকালটা শুভ খবর দিচ্ছে না হে। খুব খারাপ খবর বলতে পারো।’

সবাই ডিসিলভার দিকে উদ্বিগ্ন হয়ে তাকাল। নিজের চেয়ারে বসে ডিসিলভা বললেন, ‘হেডঅফিসের সঙ্গে কথা বলে ক্যাপ্টেন জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। কারণ সামনে ভয়ঙ্কর ঝড় এগিয়ে আসছে। ওই ঝড়ের মধ্যে পড়ার আগেই যদি আমরা বেরিয়ে যেতে পারি তাহলে অনেক দূরে চলে যাব বটে কিন্তু দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাব।’

নীল জিজ্ঞাসা করল, ‘আমরা যদি সোজা যেতাম তাহলে কতক্ষণে ঝড়ের মধ্যে পড়তাম স্যার।’ ঘড়ি দেখলেন ডিসিলভা, ‘নাইনটি মিনিটস।’ আবার উঠে পড়লেন ভদ্রলোক, ‘ক্যাপ্টেন এই ব্যাপারটা এখনই অ্যানাউন্স করতে চাইছেন না। তাতে সবাই আতঙ্কিত হবে, প্রাণ হারাবার ভয় পাবে। যদি জাহাজ দিক পরিবর্তন করে ঝড়টাকে এড়িয়ে যেতে পারে তাহলে কী ঘটতে যাচ্ছিল তা কেউ বুঝতে পারবে না। কোথাও খবরটা কাউকে জানিও না।’

পেছন থেকে একজন প্রশ্ন করল, ‘যদি এড়াতে না পারে—?’

‘আধঘণ্টা আগেই সেটা জানা যাবে। তখন পরিস্থিতি অনুযারী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে ওই সময়টা যথেষ্ঠ। তোমরা এই একঘণ্টা কাজ করতে পারো। তারপর অ্যানাউন্সমেন্টের জন্যে অপেক্ষা করো।’ ডিসিলভা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

সঙ্গে সঙ্গে ওপাশের ভদ্রলোক ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। তাঁকে তাঁর সহকর্মী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আরে! কাঁদছেন কেন? কিছুই তো এখনও হয়নি।’

কান্না গিলতে গিলতে ভদ্রলোক বললেন, ‘হবে। আমি এখন নিশ্চিত ঝড় এই জাহাজকে ডুবিয়ে দেবে। কিন্তু আমি আমার জন্যে ভাবছি না। আমার একমাত্র মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। দেশে ফিরে গিয়ে তার বিয়ে দেব। কিন্তু সেটা আর হবে না। আমি মরে গেলে মেয়ের বিয়েটা ভেঙে যাবে।’

সহকর্মী বললেন, ‘মরলে তো আপনি একা মরবেন না। আমরাও মরব। শুনলেন তো, ঝড়টাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আপনি এখন থেকেই মড়াকান্না কাঁদতে আরম্ভ করলেন। আরে ভাই, যেদিন জাহাজের চাকরিতে ঢুকেছি সেদিনই জেনেছি জলে ডুবে মৃত্যু হতে পারে।’

যিনি ভেঙে পড়েছিলেন তিনি মুখ বন্ধ করলেও ঘরের আবহাওয়া আর স্বাভাবিক থাকল না। সবাই বারংবার ঘড়ির দিকে তাকাতে লাগল।

ঠিক একঘণ্টা বাদে সাইরেনের বিপদ সংকেত বাজল। এইভাবে সাইরেন কদাচিৎ বেজে থাকে। নীল বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল মানুষজন ছুটোছুটি করছে। ক্যাপ্টেনের সহকারীরা চিৎকার করে তাদের শান্ত থাকতে বলছেন। প্রাথমিক ধাক্কা কেটে গেলে বিভিন্ন জায়গায় জড়ো হওয়া মানুষদের বললেন, ‘এত ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। একটা ভয়ঙ্কর ঝড় এগিয়ে আসছিল, কিন্তু আমরা সেটাকে প্রায় এড়িয়ে যেতে পেরেছি। কিন্তু তা সত্বেও উত্তাল ঢেউ-এ কিছুক্ষণ জাহাজ থাকবে। তখন আপনারা যাতে সতর্ক থাকেন তাই সাইরেন বাজানো হয়েছে।’

এই সব কথায় কিছুটা কাজ হল। কিন্তু মানুষগুলো যে আগের মতো সহজ হয়ে গেল না সেটা বোঝা গেল।

জাহাজের রেলিং-এ দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে অবাক হল নীল। জলের রং কালচে। সেটা মেঘের জন্যেও হতে পারে। কিন্তু বেশ জোরে হাওয়া ছুটে আসায় জলে ক্রমাগত ঢেউ তৈরি হচ্ছে। দিনের আলো আরও কমে গিয়েছে, জাহাজ গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন আফ্রিকার যেদিকে যাওয়ার কথা ঠিক তার উলটোদিকে ছুটছে জাহাজ। চারধারে একটা অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি হয়ে গিয়েছে। জাহাজের গতিবৃদ্ধির জন্যে স্বাভাবিকভাবে হাঁটা যাচ্ছে না। নীল বুঝতে পারল ক্যাপ্টেন প্রাণপণ চেষ্টা করছেন যাতে ঝড়ের কবলে না পড়তে হয়।

টলতে টলতে নিজের কেবিনের দিকে এগোচ্ছিল নীল। বাঁক ঘুরতেই লোকটাকে দেখতে পেল। চোখ বন্ধ করে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এত দুলুনিতেও লোকটা সোজা হয়ে থাকতে পেরেছে। নীলের মুখ থেকে প্রশ্ন বেরিয়ে এল, ‘আপনি এইভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? পড়ে যাবেন যে!’

লোকটা চোখ খুলল। তারপর নীচুস্বরে বলল, ‘বলেছিলাম। এইটা হবে। এখন বিশ্বাস হল তো! আসছে, ঢেউ আসছে। আ:।’

লোকটার গলার স্বর শুনে গায়ে কাঁটা ফুটল নীলের। ওকে এখন মানুষ বলে মনে হচ্ছিল না। সে দ্রুত, যতটা সম্ভব দ্রুত হেঁটে কেবিনে ঢুকল। তার কেবিনসঙ্গীরা তখন যে যার জায়গায় বাঙ্ক আঁকড়ে বসে আছে। একজন জিজ্ঞাসা করল, ‘জাহাজ ডুবে গেলে কেবিনে থাকা ঠিক নয়, না?’

‘না। তখন কেবিন থেকে বের হতে পারবেন না।’ নীল বলল।

‘তাহলে আমরা ওপরে চলে যাই। লাইফজ্যাকেট পরে থাকলে কিছুক্ষণ তো জলে ভাসতে পারব। এই জাহাজ যে বিপদে পড়েছে সেই খবর নিশ্চয়ই উদ্ধারকারী জাহাজগুলো পেয়ে গেছে। অবশ্য যদি ওরা কাছাকাছি থাকে।

এই চল, ওপরের ডেকে চলে যাই।’ লোকটা উঠে দাঁড়াতেই তার সঙ্গ নিল অন্যজন।

বাঙ্কে বসে নীল বুঝতে পারল জাহাজ স্থির হয়ে ছুটছে না। ঢেউ-এর নাচন লেগেছে জাহাজের তলায়, গায়ে। ওই লোকটার কথা কি তাহলে সত্যি হয়ে যাবে। হুড়মুড় করে ভয় ঢুকে গেল মনে। নীলের মনে হল লোকটার উপদেশ মেনে তৈরি হয়ে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সঙ্গে জল আর খাবার থাকলে লাইফজ্যাকেট তাকে অন্তত চব্বিশ ঘণ্টা বাঁচিয়ে রাখতে পারে। অবশ্য তার আগেই যদি হাঙরের পেটে চলে যেতে হয় তাহলে অন্য কথা! কিন্তু সেই ভয়ংকর ঢেউ-এর কাছাকাছিও হাঙরের থাকার কথা নয়। ওদেরও প্রাণের ভয় আছে। নীল উঠে দাঁড়াল।

এখন জাহাজে নিয়মশৃঙ্খলা একটু শিথিল। তাই জিনিসগুলো সংগ্রহ করতে খুব বেগ পেতে হল না। শক্ত দড়িতে সেগুলোকে বেঁধে রাখল নীল। একবার ভাবল দড়ির অন্যপ্রান্ত কোমরে বেঁধে রাখবে কিনা। জাহাজের সবাই এখন লাইফজ্যাকেট পরে নিয়েছে। বেশিরভাগই উঠে গিয়েছে জাহাজের ওপরের ডেকে। সহকারী ক্যাপ্টেন এবং অফিসিয়ালরা তাদের নামাতে পারছেন না। বোতল এবং খাওয়ার নিয়ে ওপরে উঠে গেলে সবাই তাকে দেখবে। কাজে লাগবে বুঝে ওরা এইসব সংগ্রহ করতে ছুটবে। নীল ওপরে উঠল না।

ক্রমশ হাওয়ার জোর বাড়তে লাগল। ছোট ঢেউগুলো ফণা তুলল এবং একসময় বিশাল হাতির চেহারা নিয়ে জাহাজের ওপর আছড়ে পড়তে লাগল। জাহাজ দুলছে ভয়ঙ্করভাবে। আচমকা একটা বড় ঢেউ-এর ধাক্কায় জাহাজের মুখ খানিকটা ঘুরে যেতেই চিৎকার এবং কান্না শরু হয়ে গেল। সাইরেন বেজে যাচ্ছিল একটানা। একটা সময় মনে হচ্ছিল সমুদ্রের ঢেউ-এর কাছে জাহাজটা যেন খেলনা হয়ে গিয়েছে। এই ঝড় এবং ঢেউ মূল ঝড়ের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। মুল ঝড়ের মুখে পড়লে জাহাজ সমুদ্রের গভীর তলে পৌঁছে যেত এতক্ষণে। হঠাৎ বমি করে ফেলল নীল। পেটে মোচড় দিচ্ছে। ডেকে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। হিংস্র সাপের মতো ঢেউ উঠে আসছে ওপরে। জল বাইরে বের করার জন্যে পাম্প চালু করা হয়েছে।

নীল কেবিনের দরজা ধরে দাঁড়াল। আচমকা ঢেউ যদি তাকে টেনে নিয়ে যায় তাহলে যেমন কিছু করার থাকবে না, তেমনি কেবিনের ভেতরে থাকলে জলের তলায় দম বন্ধ হয়ে মরতে হবে। সে এইবার দড়ির প্রান্ত কোমরে বেঁধে নিল।

একটু একটু করে ঢেউ-এর দাপট কমছিল। হাওয়ার দোলাও আগের মতো তীব্র ছিল না। কিন্তু জাহাজ স্থির চলতে পারছিল না তখনও। আর সেই সময় ওপরের মানুষগুলো চিৎকার করতে লাগল, ‘জাহাজ, জাহাজ, জাহাজ।’

দুর্যোগ কমে এলেও এই পথে আর একটা জাহাজ কী করে এল? নীলের মনে পড়ল, ঝড় থেকে বাঁচার জন্যে ক্যাপ্টেন এই জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে এসেছেন। এদিকে যেসব জাহাজের চলার কথা তারাই তো তাদের আগন্তুক ভাবছে। কিন্তু আর একটা জাহাজ মানে আরও মানুষ, আরও প্রাণের সাহচার্য।

নীল কোমরের দড়ি খুলতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *