জাহাজে উঠে সোজা অফিসে চলে গেলেন ক্যাপ্টেন। ডিসিলভা নীলকে বললেন, ‘তুমি তখন কিছু বলতে চাইছিলে। ক্যাপ্টেনকে বলবে না?’
‘হ্যাঁ স্যার। আমাকে আজ ভয়ংকর মিথ্যেকে মেনে নিতে বাধ্য করা হয়েছে।’ নীল বলল।
‘এসো আমার সঙ্গে।’ ডিসিলভার পেছন পেছন নীল চলে এল ক্যাপ্টেনের অফিসে। ক্যাপ্টেন ততক্ষণে কম্পিউটারের সামনে বসে মেল টাইপ করছেন। ডিসিলভা নীচু গলায় বললেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই হেড অফিসে মেল করছেন?’
‘কাল থেকে তো সমানে মেল করে যাচ্ছি আর এজেন্ট বলছে ধৈর্য ধরতে। কিন্তু আজ কীভাবে ধৈর্য ধরব বলুন তো। ফারুক এই জাহাজের খুব কাছের নাবিক ছিল। দীর্ঘদিন ধরে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছে। বেচারার শরীর প্রাণহীন অবস্থায় এই মধ্যযুগীয় বন্দরের মর্গে পড়ে আছে, এটা ভাবা যায়? আমি হেড অফিসকে অনুরোধ করছি ওঁর মৃত্যুর তদন্ত করার জন্যে দাবি জানাতে। জাহাজের ক্যাপ্টেনের এই অধিকার না থাকলেও কোম্পানির তো আছে। আপনারা বসুন।’ ক্যাপ্টেন আবার ঘুরে বসলেন।
নীল বলল, ‘স্যার, তখন গাড়িতে আপনাকে একটা কথা বলতে
যাচ্ছিলাম—।’
‘খুব জরুরি না হলে পরে শোনা যাবে।’ ক্যাপ্টেন টাইপ শুরু করলেন।
‘হ্যাঁ স্যার। খুব জরুরি।’
আবার ঘুরে বসলেন ক্যাপ্টেন, ‘ওয়েল, হ্যাঁ, ড্রাইভারের সামনে তুমি খুব উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে চাইছিলে। হ্যাঁ, মনে পড়ছে। কী ব্যাপার?’
‘স্যার, ফারুক সাহেব মারা যাননি। অন্তত মর্গে যার ডেডবডি দেখেছি সেটা ফারুক সাহেবের নয়।’ নীল বলল।
সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন এবং ডিসিলভার মুখ থেকে প্রায় একসঙ্গে বিস্ময়সূচক আওয়াজ বের হল। নীল বলল, ‘আমাকে পুলিশ জোর করে অন্যায় কাজ করিয়েছে। যে ডেডবডিকে ওরা ফারুক সাহেবের বলে দাবি করছে সেটা তাঁর নয়।’
‘সে কি!’ ক্যাপ্টেন উঠে দাঁড়ালেন, ‘তুমি তখনই প্রতিবাদ করলে না কেন?’
‘করলে ওরা আমাকে সারাজীবন এখানকার জেলে রেখে দিত।’
‘থ্যাঙ্ক গড। মিস্টার ফারুক বেঁচে আছেন।’ ডিসিলভা বললেন।
‘স্যার, ফারুক সাহেব বেঁচে আছেন কি না জানি না, কিন্তু ওরা স্যামের ডেডবডি আমাকে দেখিয়ে ফারুক সাহেব বলে লিখিয়ে নিয়েছে।’ নীল বলল।
‘কী বললে? স্যামের ডেডবডি? স্যাম মারা গিয়েছে?’ ক্যাপ্টেন অবাক।
‘আপনাকে বলেছিলাম, স্যাম পাহাড়ের গুহায় থাকা এক ডাইনির সঙ্গে দেখা করবে বলেছিল। বোধহয় সেখানেই ওকে মেরে ফেলা হয়েছে। কাল যখন অফিসারদের বলেছিলাম তখন ওঁরা যদি পাহাড়ে খোঁজ করতে যেত তাহলে হয়তো স্যাম বেঁচে যেত।’
‘ঠিক কথা। কিন্তু স্যাম তো নিজের মৃত্যু নিজেই ডেকে এনেছে। অনেক কিছু পাওয়ার লোভে সে ডাইনির কৃপা পেতে গিয়েছিল। ওর চালচলন আমার পছন্দ হত না। এমন ভাব দেখাত যে মনে হত সে সব জানে। তুমি নিশ্চিত যে স্যামের ডেডবডি দেখেছ?’
‘হ্যাঁ স্যার।’ নীল জবাব দিল।
‘খুব ভালো সময়ে আমাকে খবরটা জানিয়েছ তোমরা। নইলে ফারুকের মৃত্যুর খবর হেড অফিসকে জানিয়ে বোকা হয়ে যেতাম।’
‘না হতেন না।’ ডিসিলভা বললেন, ‘লোক্যাল পুলিশ আপনাকে ফারুকের মৃত্যুই কনফার্ম করেছে। কিন্তু আমি ভাবছি, ফারুক কোথায় যেতে পারেন? কোথায় আছেন এখন?’
ক্যাপ্টেন নীলের দিকে তাকালেন, ‘তুমি ভালো করে ভাবো। ফারুকের সঙ্গে তুমিই শেষপর্যন্ত ছিলে, এমন কিছু কি ফারুক বলেছিল যা থেকে সে কোথায় যেতে পারে তা আন্দাজ করা যায়?’
চোখ বন্ধ করল নীল। না, তেমন কিছু মনে পড়ছে না তার। সে মাথা নেড়ে ‘না’ বলল।
ডিসিলভা তখন ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমাদের তো আজ সন্ধ্যাবেলায় এই বন্দর ছেড়ে যাওয়ার কথা। তার মধ্যে যদি মিস্টার ফারুক ফিরে না আসেন তাহলে তো তিনি কোনওদিন এখান থেকে বের হতে পারবেন না।’
‘আমার হাত বাঁধা। ফারুককে পাওয়া যাচ্ছে না বলে পুলিশের কাছে কমপ্লেন করেছিলাম। তারা জানিয়েছে ফারুক মৃত। নীলকে দিয়ে জোর করে লিখিয়ে নিয়েছে। এখন আমি যদি বলি মৃতদেহ ফারুকের নয়, তাহলে মিথ্যে আইডেন্টিফাই করার অভিযোগে নীলকে জেলে পুরবে ওরা। ফারুককে খোঁজার জন্যে এখানকার কোনও এজেন্সির সাহায্য পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না, কোনও এজেন্সিকে এখানকার পুলিশ কাজ করতে অ্যালাও করবে না। আমার কিছুই করার নেই। প্রার্থনা করো যাতে জাহাজ ছাড়ার আগে ফারুক ফিরে আসে।’ ক্যাপ্টেন মেল টাইপ করতে শুরু করলেন।
নীল বলল, ‘স্যার, একটা কথা বলব?’
‘ইয়েস।’ টাইপ করতে করতেই মাথা নাড়লেন ক্যাপ্টেন।
‘স্যামের ডেডবডি কি আমরা জাহাজে নিয়ে আসতে পারি না? পুলিশ বলেছে, পোস্টমর্টেম করতে দেরি হবে, এখানে ডাক্তার নেই। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট পেলে স্যামের তো কোনও উপকার হবে না। আমরা তখন বন্দর ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাব। সেই রিপোর্ট এখানকার পুলিশ আমাদের পাঠাবে না বলে আমার ধারণা।’
ডিসিলভা বললেন, ‘এরকম ধারণা কেন হচ্ছে!’
‘স্যার, ওদের আচরণে আমি নিশ্চিত, ডেডবডিটা যে ফারুক সাহেবের নয় তা ওরা জানে। ফারুক সাহেব মিসিং বলে অভিযোগ করা হয়েছিল। সেটা চাপা দিতেই স্যামের ডেডবডি ফারুক সাহেবের বলে চালিয়ে দিয়েছে। আমি আপত্তি করায় ওরা আমাকে শাসিয়েছে। দেখবেন স্যার, ওরা পোস্টমর্টেম করাবেই না।’ নীল বলল।
ক্যাপ্টেন মাথা নাড়লেন, ‘সম্ভব। খুবই সম্ভব। কিন্তু ডেডবডি চাইলে ওরা ওই কারণেই দেবে না। আইন দেখাবে। অ্যাকসিডেন্টাল ডেথ হলে পোস্টমর্টেম ছাড়া বডি ছাড়া আইনবিরুদ্ধ। তা ছাড়া স্যামের ডেডবডি জাহাজে নিয়ে এলে সবাই বলবে ওটা স্যামের, ফারুকের নয়। ওরা সেটা কিছুতেই চাইবে না।’
ডিসিলভা বললেন, ‘খুব স্যাড। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অসহায় লাগে।’
ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে নীল দাঁড়াল। তারপর অত্যন্ত বিনীত গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যার, আমাকে দু-ঘণ্টার জন্যে বন্দরে যাওয়ার অনুমতি দেবেন।’
‘কেন? এই অবস্থায় জাহাজের বাইরে কেন যেতে চাইছ?’
‘আমি একবার ঘুরে দেখি কোনও ক্লু পাই কি না।’ নীল বলল।
‘জাহাজের দুজন লোক কমে গিয়েছে। তৃতীয় জনকে যদি হারাতে হয় তাহলে আমাকে খুব অসুবিধার মধ্যে পড়তে হবে।’ ক্যাপ্টেন বললেন।
‘স্যার, আমাকে একটা সুযোগ দিন। বিপদ বুঝলেই আমি ফিরে আসব।’
ক্যাপ্টেন ডিসিলভার দিকে তাকালেন। ডিসিলভা নীলকে বললেন, ‘তুমি কি বুঝতে পারছ না কীরকম ঝুঁকি নিতে চাইছ?’
‘হ্যাঁ স্যার। ফারুক সাহেব মারা গিয়েছেন বলে ওরা আমাকে দিয়ে জোর করে স্বীকার করিয়েছে। সারা জীবন আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। একবারও যদি চেষ্টা না করি তাহলে কীভাবে নিজেকে সান্ত্বনা দেব?’ নীল বলল।
ক্যাপ্টেন বললেন, ‘ঠিক আছে। দু-ঘণ্টার জন্যে যেতে পারো। কিন্তু মনে রেখো, সন্ধে ছ’টার আগে ফিরে না এলে আমরা বন্দর ছেড়ে যেতে বাধ্য হব। বন্দরে থাকার জন্যে এখানকার সরকারকে হেড অফিস যে টাকা দিয়েছে তার সময়সীমা সন্ধে ছ’টায় শেষ হয়ে যাবে।’
ডিসিলভা বললেন, ‘নীলের সঙ্গে আর কাউকে পাঠালে ভালো হত না?’
‘হত। কিন্তু ওরা না ফিরলে আমরা মোট চারজনকে হারাব। আই কান্ট অ্যাফোর্ড।’
লাঞ্চ করে অফিস থেকে অনুমতিপত্র নিয়ে সিকিউরিটিকে দেখিয়ে জাহাজ থেকে বন্দরে নামল নীল। আজ আকাশে হালকা মেঘ জমে থাকায় রোদ্দুর নেই। এই দুপুরে বন্দর এলাকায় মানুষজন কম। তাকে একা দেখে তিনজন স্থানীয় দালালগোছের লোক ছুটে এল। একজন জিজ্ঞাসা করল, ডলার আছে কি না। থাকলে দামি মুক্তো খুব সস্তায় কিনিয়ে দিতে পারে। আর একজন বলল, ‘চিতা বা সিংহের চামড়া অর্ধেক দামে কিনতে পারবেন আমার সঙ্গে গেলে।’ তৃতীয়জন বলল, ‘আমি এক্সপার্ট গাইড। চলুন, আপনাকে মরুভূমির র্যাটেল স্নেক দেখিয়ে দিচ্ছি। কোনও ভয় নেই।’
হাসল নীল, ‘তোমরা মিছিমিছি সময় নষ্ট করছ। আমার কাছে ডলার দূরের কথা, তোমাদের শিলিং পর্যন্ত নেই। আমি একটু হাঁটতে বেরিয়েছি।’
কয়েকবার বোঝাবার পর লোক তিনটে সঙ্গ ছাড়ল। হাঁটতে হাঁটতে নীল সেই জায়গায় পৌঁছোল যেখানে শেষবার ফারুক সাহবকে দেখেছিল। যে টয়লেটে সে গিয়েছিল সেদিকে দু-পা হেঁটেও থেমে গেল সে। কাল যে পুলিশ অফিসার এখানে টহল দিচ্ছিল আজও তার ডিউটি এখানেই। লোকটা তাকে দেখতে পেয়েছে। নীল জাহাজ থেকে নামবার আগে ক্যান্টিন থেকে দু-প্যাকেট ট্রিপল ফাইভ সিগারেট কিনে এনেছিল। সে অফিসারের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘গুড আফটারনুন স্যার।’
‘সাহস বেড়ে গেছে দেখছি। আবার এখানে কী মনে করে এসেছ?’ খুব বিরক্ত মুখে জিজ্ঞাসা করল অফিসার।
‘কাল আপনার সঙ্গে কথা বলে আমার খুব ভালো লেগেছে। তাই আজ একটা ছোট্ট গিফট আপনাকে দিয়ে ধন্য হতে চাই। যদি দয়া করে নেন—!’
‘গিফট?’ লোকটার মুখে হাসি ফুটল, ‘কী গিফট?’
এক প্যাকেট সিগারেট পকেট থেকে বের করে অফিসারের হাতে দিল নীল।
‘ব্রিটিশ সিগারেট! গুড। তোমাদের জাহাজে স্কচ হুইস্কি পাওয়া যায় না?’
‘অবশ্যই যায়। আপনার পছন্দ?’
প্যাকেটটা পকেটে ঢুকিয়ে অফিসার বলল, ‘আমি খেলে স্কচই খাই। তবে এই দিনের আলোয় আনবে না। কত চোখ যে আমাকে এখানে গিলছে। হিংসুকের দল। ঠিক কমপ্লেন করে দেবে। সন্ধের পরে এনো। আমার ডিউটি শেষ হবে রাত ন’টায়।’
‘স্যার সন্ধের পরে বিদেশি দেখলে যদি কেউ—!’
‘আমার নাম বলবে। বলবে সার্জেন্ট মোমসার লোক তুমি। সঙ্গে সঙ্গে ওরা হাওয়া হয়ে যাবে। আই উইল ওয়েট। কোথায় যাবে এখন?’ অফিসার জিগ্যেস করল।
‘এই বিয়ার পাবে। আপনি একটু বিয়ার খাবেন স্যার।’
‘থ্যাঙ্কু। নো। আমি এখন ডিউটিতে আছি। তোমাকে আমার ভালো লাগছে বলে একটু সতর্ক করে দিচ্ছি। বিয়ার পাবের কাউন্টারে যে মেয়েমানুষটা থাকে তার কথায় বিশ্বাস কোরো না। ডেঞ্জারাস মহিলা।’ ছড়ি নাচাতে নাচাতে সার্জেন্ট হাঁটতে শুরু করল।
এক প্যাকেট বিলিতি সিগারেট কী সুন্দর কাজ করল! নীল হাসল। ব্যাটা নিশ্চয় সন্ধ্যার পর স্কচ হুইস্কির জন্যে হাঁ করে অপেক্ষা করবে। ততক্ষণে জাহাজ গভীর সমুদ্রে।
বিয়ার পাবে এখন ভিড় নেই। কাউন্টারের সামনে গিয়ে নীল দেখল আজ অন্য একটি মেয়ে কাজ করছে। এর বয়স কম, ছিপছিপে শরীর। তাকে দেখে হেসে এগিয়ে এল মেয়েটি, ‘আমার নাম জুলিয়া। তোমাকে আগে তো দেখিনি। কী দেব বলো?’
‘বিয়ার।’ নীল বলল।
‘স্ট্রং না লাইট? লাইটই দিই। তাহলে অনেকক্ষণ থাকতে পারবে।’ কয়েক পা পিছিয়ে কল টিপে জাগে বিয়ার ঢেলে ওটা এগিয়ে দিল জুলিয়া। বলল, ‘পঞ্চাশ শিলিং।’
বিয়ারের দাম এক-একদিন এক-একরকম হয় নাকি? মুখে কিছু না বলে সে দাম দিয়ে দিল। জুলিয়া বলল, ‘তুমি পাকিস্তানি?’
‘না। ইন্ডিয়ান।’
জিভে আফশোশের আওয়াজ করল জুলিয়া, ‘খুব খারাপ খবর শুনলাম। একজন ইন্ডিয়ানকে পাহাড়ের রাস্তায় পাওয়া গিয়েছে কাল। শরীরে প্রাণ ছিল না। বোধহয় ওই ডাইনির কাছে গিয়েছিল। তুমি যেন ভুল করেও যেও না।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ। এই পাব তোমার?’
‘না, না। আমার এত টাকা কোথায়? এর মালিক হল আমার দিদির বয়ফ্রেন্ড। দিদিই চালায়। আজ দিদি রেস্ট নিচ্ছে বলে আমি হেল্প করছি।’
‘তোমার দিদি কি একটু স্বাস্থ্যবতী?’
খিলখিল করে হেসে উঠল জুলিয়া। হাসি থামিয়ে বলল, ‘শুনলে দিদি খুব খুশি হবে। একটা অসুখের পর থেকে দিদি ওরকম মোটা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তুমি দিদিকে চিনলে কী করে? এখানে আগে এসেছ?’
‘হ্যাঁ। গতকাল এসেছিলাম। তিনি কোথায়? তার জন্যে একটা উপহার এনেছিলাম।’ নীল বিয়ারে চুমুক দিল।
‘বা:! খুব ভালো কথা। আমাকে দাও, আমি দিদিকে দিয়ে দেব।’ জুলিয়া বলল।
নীল হাসল, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমি যদি ওঁকে নিজের হাতে দিতে পারি তাহলে অনেক বেশি খুশি হব। এটুকু সাহায্য করবেন না?’
কাউন্টারের নীচে রাখা ফোনের রিসিভার তুলল জুলিয়া, ‘তুমি ক্যামেরা কাউন্টারের দিকে মুখ করো।’ বলে নীলের দিকে তাকিয়ে হাসল, ‘দেখতে পাচ্ছ? গুড। আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে তার নাম, কী যেন নামটা?’
‘নীল।’ নীল বলল।
‘হ্যাঁ নীল। ও ইন্ডিয়ান। ওকে কি তুমি আগে দেখেছ?’
খসখসে গলা শোনা গেল, ‘হ্যাঁ।’
‘নীল তোমার হাতে একটা গিফট দিতে চাইছে। আমাকে দিলে তোমায় দিয়ে দেব বলেছিলাম। কিন্তু ও তাতে খুশি নয়। কী করব?’
‘ওকে সার্চ করে দ্যাখো। সঙ্গে অস্ত্র না থাকলে পাঠিয়ে দাও।’
রিসিভার রেখে জুলিয়া বলল, ‘আমার দিদি আজ কার মুখ দেখে উঠেছিল কে জানে! ওপাশ দিয়ে ভেতরে এসো।’
নীল ভেতরে যাওয়ামাত্র জুলিয়া বেশ অভ্যস্ত হাতে তার শার্ট-প্যান্টের পকেট সার্চ করল, ‘এটা কী?’
‘সিগারেটের প্যাকেট।’
‘বের করে দেখান।’
ট্রিপল ফাইভ সিগারেটের প্যাকেট বের করল নীল।
জুলিয়া বলল, ‘আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড। আপনি বাঁ-দিকের দরজা ঠেলে ভেতরে গেলে একটা সিঁড়ি দেখতে পাবেন। দোতলায় উঠে ডানদিকের কোণের ঘরে দিদিকে দেখতে পাবেন। ঠিক আছে?’
নীলের মনে হচ্ছিল এই মহিলার কাছে ফারুক সাহেবের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে কোনও ক্লু পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কিন্তু মহিলা বোনকে বললেন তাকে সার্চ করে পাঠাতে। অর্থাৎ তিনি নিজেকে নিরাপদ বলে মনে করছেন না। কেন? এই কারণে কি আজ কাউন্টারে না থেকে ওপরের ঘরে বসে আছেন? এই বারের সিসিটিভিতে নজর রাখছেন।
প্যাসেজটায় আলো কম। সিঁড়িতেও একইরকম। দোতলায় উঠে ডানদিকে বন্ধ দরজায় শব্দ করল নীল। খট করে আওয়াজ হল। তারপর খসখসে গলাটা কানে এল, ‘কাম ইন।’
ভেতরে ঢুকে নীল দেখল ঘরে স্বাভাবিক আলো। মনিটারে বারের ঢোকার দরজা এবং অনেকটাই দেখা যাচ্ছে। রিমোট বিছানায় রেখে মহিলা উঠে বসলেন, ‘কী ব্যাপার? একদিনের আলাপে গিফট কেউ দেয় না। বাহানা করে আসার কারণ কী?’
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে মহিলার সামনের বিছানায় রাখল নীল। খপ করে সেটা তুলে নিলেন মহিলা। তাঁর মুখ খুশিতে ভরে গেল। ‘ব্রিটিশ সিগারেট। এখানে পাওয়া যায় না। থ্যাঙ্কস। বলো।’
নীল বসল। দ্রুত প্যাকেট খুলে একটা বের করে লাইটারের আগুনে ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল মহিলা। ‘গুড। ভেরি গুড। কেন এসেছ?’
‘আপনার সাহায্য চাই। দয়া করে না বলবেন না!’ নীল করুণস্বরে বলল।
‘আমি কে? কী আমার ক্ষমতা যে তোমার মতো বিদেশি জাহাজিকে সাহায্য করব?’ হেসে উঠল মহিলা, ‘মাই ব্রাদার, তুমি ভুল জায়গায় এসেছ।’
‘আপনি যখন আমাকে ভাই বললেন, তখন এটুকুও আশা করতে পারি না?’
প্রশ্ন শুনে চোখ বন্ধ করে ধোঁয়া টানলেন মহিলা। তারপর ঠোঁট ছুঁচলো করে রিং বানালেন, ‘কী সাহায্য চাইছ?’
‘আপনি জানেন কাল আমার সঙ্গে যে বয়স্ক ভদ্রলোক বারে এসেছিলেন তাঁকে এখান থেকে বের হওয়ার পরে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি টয়লেট থেকে বেরিয়ে এসে আর ওঁকে দেখতে পাইনি।’ নীল বলল।
‘পুলিশের কাছে নিশ্চয়ই গিয়েছিলে?’
‘হ্যাঁ। পুলিশ বলল ফারুক সাহেব মারা গিয়েছেন। কিন্তু অন্য একজনের মৃতদেহ দেখিয়ে বলেছে ওটাই ফারুক সাহেবের মৃতদেহ।’
হাসলেন ভদ্রমহিলা। তারপর বললেন, ‘পুলিশ যখন সত্যি কথা বলছে না, তখন বুঝতে হবে তাদের দিয়ে মিথ্যে বলানো হচ্ছে। যারা বলাচ্ছে তারা খুব শক্তিশালী। আমি কী করে তাদের খবর জানব?’
‘আপনার মনে আছে, কাল কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে স্যুট এবং টুপি পরা একজন আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইছিল?’ আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল নীল।
মহিলা তাকালেন। সিগারেটের বাট অ্যাশট্রেতে চেপে আগুন নেভালেন। তারপর বললেন, ‘মনে আছে। এখানে ফারুককে খুঁজে কোনও লাভ হবে না। আজ রাত্রে একটা জাহাজে তাকে অজ্ঞান করে নিয়ে যাওয়া হবে। জাহাজটার নাম পিরানহা।’
‘পিরানহা? ওটা তো একটা ভয়ংকর হিংস্র মাছের নাম!’
‘হ্যাঁ। খোঁজ নিয়ে দ্যাখো ওই জাহাজ এখান থেকে কোথায় কোন দেশে যাবে! ব্যস। অনেক খবর পেয়ে গেছ।’ হাত নাড়লেন মহিলা।
‘কিছু মনে করবেন না, আপনি কী করে খবরটা জানতে পারলেন?’
হাসলেন মহিলা, ‘পুলিশের বড়কর্তাদের কেউ কেউ আমাকে পছন্দ করেন আর সেটাই আমার ভয়। এবার যেতে পারো।’ রিমোট হাতে তুলে নিলেন মহিলা।
নীচে নেমে এল নীল। জুলিয়া তাকে দেখে হাসল কিন্তু কথা বলল না। বাইরে বেরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল সে। দু-ঘণ্টা শেষ হতে বেশি দেরি নেই।
হাঁটতে শুরু করতেই মোড়ের মাথায় অফিসারকে দেখতে পেল। ভেবেছিল এড়িয়ে যেতে পারবে কিন্তু তার আগেই অফিসার ইশারায় থামতে বলল।
নীল দাঁড়াতেই অফিসার কাছে এসে নীচু গলায় বলল, ‘যত তাড়াতাড়ি পারো জাহাজে ফিরে যাও।’ কথা শেষ করেই অন্যদিকে চলে গেল লোকটা।
কোনওরকমে জাহাজের ডেকে ওঠার পর নীল সাইরেনের আওয়াজ শুনতে পেল। তিনটে পুরো ঢাকা গাড়িকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটা মোটর সাইকেল। তাদের জাহাজকে বাঁদিকে রেখে এগিয়ে গেল ওরা।
কোথায় যাচ্ছে কৌতূহলী হয়ে দ্রুত দোতলার ডেকের প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াতেই সিকিউরিটি আপত্তি জানিয়ে চলে যেতে বলল।
কিন্তু ততক্ষণে নীল দেখে ফেলেছে গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে গিয়েছে যে জাহাজটার সামনে, তার গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে, ‘পিরানহা।’