রসাতলের রহস্য – ৫

নীল একটু অপেক্ষা করল। ফারুক সাহেবও তো টয়লেটে যেতে পারেন। কিন্তু প্রায় মিনিট ছয়েক অপেক্ষা করার পরেও ফারুক সাহেবকে দেখতে না পেয়ে মনে ভয় এল। মানুষটার কিছু হল না তো? কী হতে পারে? এই বন্দরে উনি এর আগে কখনও আসেননি যে পুরোনো শত্রুতার জেরে কেউ ওঁর ক্ষতি করবে। তা ছাড়া এখানে এখনও অনেক মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফারুক সাহেবের কোনও বিপদ হলে কি এই জায়গা এমন শান্ত থাকত? কী করবে বুঝতে পারছিল না নীল। হঠাৎ মনে হল ফারুক সাহেব ওই বিয়ারবারে ফিরে যাননি তো? হয়তো কিছু ফেলে এসেছিলেন তা খুঁজতে গিয়েছিলেন।

নীল সোজা চলে গেল সেই বিয়ারপাবে, যেখানে একটু আগে ওরা ছিল। বার কাউন্টারের ওপাশে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সেই বিশাল চেহারার কালো মহিলা। জিনস, জ্যাকেট এবং টুপি মাথার লোকটি এখন সেখানে নেই। চারপাশে তাকিয়ে নীল ফারুক সাহেবকে দেখতে না পেয়ে মহিলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, ‘আমার সঙ্গে যে ভদ্রলোক ছিলেন তিনি কি আবার এখানে এসেছিলেন?’

মহিলা এমনভাবে হাত নাড়লেন যার মানে তিনি কিছুই জানেন না। তার পরই গলার স্বর নামিয়ে বললেন, ‘তুমি এখনই জাহাজে ফিরে যাও, জাহাজই তোমার কাছে নিরাপদ জায়গা।’ বলেই এমন ভঙ্গিতে পেছনে চলে গেলেন যে নীলেরই মনে হল, উনি তাকেই কথাগুলো বললেন তো!

বাইরে বেরিয়ে নীল একজন পুলিশ অফিসারকে দেখতে পেল। নীল পোশাক, নীল টুপি, কোমরে রিভলভার, হাতে ছড়ি। ওকে দেখেই পথচারীরা সরে গিয়ে জায়গা করে দিচ্ছে। নীল দ্রুত লোকটার সামনে গিয়ে বলল, ‘স্যার, আপনার সাহায্য চাই।’

লোকটার মাথা বিরাট, মুখ ফোলা ফোলা। নীলের থেকে অন্তত ইঞ্চি চারেক লম্বা। যে-ভাষা ওর মুখ থেকে বের হল তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারল না নীল।

নীল বলল, ‘স্যার, আই নো ইংলিশ।’

‘ইংলিশ?’ হা হা হা করে হাসলেন অফিসার, ‘ইউ? হু?’

‘আই ওয়ার্ক ইন দি শিপ।’

অফিসার হাত বাড়ালেন, ‘পেপার!’

জাহাজ থেকে দেওয়া কাগজ পকেট থেকে বের করে এগিয়ে ধরল নীল। ছোঁ মেরে সেটা নিয়ে চোখের সামনে ধরলেন অফিসার। এই আধা-অন্ধকারে তিনি কী পড়লেন তা তিনিই জানেন। তারপর কাগজটা ফেরত দিয়ে বললেন, ‘গো টু দি শিপ। গো।’ বলে হাতের ছড়িটা সজোরে শূন্যে ঘোরালেন।

নীল বুঝতে পারল এই পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে কোনও সাহায্যই পাওয়া যাবে না। তার উচিত এখনই জাহাজে ফিরে গিয়ে ক্যাপ্টেনকে ব্যাপারটা জানানো। ক্যাপ্টেনের নিশ্চয়ই বিশেষ ক্ষমতা আছে।

সে আর দাঁড়াল না। যে পথ দিয়ে সে জাহাজ থেকে এসেছিল, সেই পথে আসতে আসতে থমকে দাঁড়াল। দুটো লোক তাদের নিজস্ব ভাষায় ঝগড়া করছে। একজন আর একজনকে ঘুসি মারতেই আহত লোকটি রিভলভার বের করে গুলি চালাল। রাস্তায় গড়িয়ে পড়ল মৃত লোকটা। যে গুলি করেছিল সে খুব শান্তভঙ্গিতে চলে গেলে যারা দৃশ্যটি দেখছিল তারা আবার স্বাভাবিক আচরণ করতে লাগল। মৃতদেহের দিকে কেউ তাকাল না।

নীল দ্রুত হাঁটতে লাগল। চোখের সামনে খুন হতে দেখেও এখানকার মানুষ যখন কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাল না তখন ফারুক সাহেবের বিপদ হলে বিচলিত হবে কেন? তাই টয়লেট থেকে বেরিয়ে সে রাস্তার পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখেছে।

কাগজ দেখিয়ে জাহাজে ওঠার অনুমতি পেয়ে সে গার্ডকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ফারুক সাহেবকে কি জাহাজে ফিরে আসতে দেখেছেন?’

‘না।’

নীল প্রথমে ডিসিলভা সাহেবের কাছে গেল। তিনি তখন কম্পিউটারের সামনে বসেছিলেন। দেখে অবাক হলেন, ‘এ কী। তুমি বাইরে যাওনি?’

‘গিয়েছিলাম। মিস্টার ফারুক আমার সঙ্গে ছিলেন।’ নীল যা যা ঘটেছে তা ডিসিলভাকে জানাল।

‘মাইগড!’ ডিসিলভা উঠে দাঁড়ালেন, ‘তুমি কি নিশ্চিত যে ফারুক স্বেচ্ছায় কোথাও যায়নি? তুমি টয়লেটে গিয়েছিলে আর তার মধ্যেই ওকে কেউ কী করে কিডন্যাপ করবে? আমার মনে হয় ওর জন্যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা উচিত।’

‘স্যার, এখানে সব হয়। চোখের সামনে কাউকে খুন হতে দেখলে এদের মধ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া হয় না।’ নীল বলল, ‘আপনারা যদি পুলিশের সাহায্য নেন তাহলে ফারুক সাহেবকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে।’

‘আমার সঙ্গে এসো।’ ডিসিলভা ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেলেন। নীল তাড়াতাড়ি তাঁকে অনুসরণ করল। সিঁড়ি ভেঙে ক্যাপ্টেনের ঘরের দরজায় পৌঁছে তার সঙ্গে আসার ইশারা করে ভেতরে ঢুকলেন।

ক্যাপ্টেন অবাক চোখে তাকালেন। ডিসিলভা নীলকে দেখিয়ে উত্তেজিত গলায় ব্যাপারটা জানালেন। ক্যাপ্টেন চমকে উঠলেন, ‘সে কী! কতক্ষণ টয়লেটে ছিলে তুমি?’

‘বড়জোর মিনিট তিনেক।’ নীল বলল।

‘তার মধ্যেই ফারুক উধাও হয়ে গেল?’

‘হ্যাঁ স্যার।’

‘এনি ক্লু? এর আগে কিছু ঘটেছিল? ফারুককে কেউ কিছু বলেছিল?’

লোকটার কথা মনে পড়ল। তার কথা বলল নীল।

ক্যাপ্টেন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের পাকিস্তানি বলে ভেবেছিল?’

‘হ্যাঁ স্যার। লোকটা কক্সবাজারে যেতে চাইছে বলেছিল।’

‘কেন?’

‘তা বলেনি। আমি বলেছিলাম ফারুক সাহেবের বন্ধু ইয়াসিনভাই কক্সবাজারে থাকতেন। তিনি খুন হয়ে গিয়েছেন। ফারুক সাহেব বিরক্ত হয়েছিলেন এই কথা বলার জন্যে। লোকটা জিজ্ঞাসা করেছিল ইয়াসিনভাই নাবিক ছিলেন কিনা। উত্তরটা দিতে চাননি ফারুক সাহেব। ওই লোকটা কক্সবাজার সম্পর্কে খুব উৎসাহী তা বুঝতে পেরেছিলাম যা ফারুক সাহেব পছন্দ করেননি।’ নীল বলল।

‘ফারুক কেন পছন্দ করেনি? তোমাকে কিছু বলেছিল?’

মাথা নেড়ে না বলল নীল। ফারুক সাহেব বিশ্বাস করে হিরের কথা তাকে বলেছিলেন। ওই লোকটা কি জানে হিরেগুলো কক্সবাজারেই আছে? কিন্তু ক্যাপ্টেনকে নারকোল গাছের নীচের বালিতে হিরে গুঁজে রাখার কথা বলা মানে ফারুক সাহেবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা। সুস্থ অবস্থায় ফিরে এসে তিনি যখন শুনবেন তখন তাকে কী চোখে দেখবেন?

ডিসিলভা ক্যাপ্টেনকে বললেন, ‘আফ্রিকার এই বন্দরগুলো ক্রিমিন্যালে ভরতি। এখনই পুলিশের কাছে কমপ্লেন করা দরকার।’

ক্যাপ্টেন রিসিভার তুলে অপারেটারকে বললেন, ‘শহরের পুলিশ কমিশনারকে ফোনে ধরো। আরজেন্ট।’

রিসিভার নামিয়ে রেখে বললেন, ‘মিস্টার ডিসিলভা, গোমেজও ছুটি নিয়ে শহরে গিয়েছে। আপনি এখনই জাহাজের অ্যালার্ট সাইরেন বাজাতে বলুন। ওটা শুনতে পেলে সবাই জাহাজে ফিরে আসবে। আমি আর ঝুঁকি নিতে চাই না।’

ডিসিলভা নীলকে ইশারা করলেন বেরিয়ে যেতে। দোতলার ডেকে এসে দাঁড়াল সে। এখন রাত ঘন হচ্ছে। সমুদ্রের জলের রং বোঝা যাচ্ছে না। ওপাশে বন্দরের রাস্তায়, বাড়িতে আলো জ্বলছে। ফারুক সাহেব কোথায় গেলেন! যেখানেই গিয়ে থাকুন তিনি নিজের ইচ্ছায় যাননি। কেন ওঁর ক্ষতি করতে চাইবে এখানকার কিছু লোক? হঠাৎ মনে হল বিয়ারপাবের সেই টুপি পরা লোকটা নিশ্চয়ই হিরের খবর জানে। ইয়াসিন সেই হিরে নিয়ে কক্সবাজারে গিয়েছিল এই খবর নিশ্চয়ই লোকটার কাছে ছিল। কিন্তু লোকটা জানত না ফারুক সাহেব, যিনি ইয়াসিনকে চেনেন, তিনি ওই বিয়ারপাবে যাবেন অথবা হিরের খবর রাখেন। কিন্তু লোকটা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছিল সে ইয়াসিনের প্রসঙ্গ তুলতেই ফারুক সাহেব বিরক্ত হয়ে প্রসঙ্গ পালটাতে চাইছিলেন। তাতে কি লোকটার মনে সন্দেহ এল? আর যদি সন্দেহ আসেই তাহলে ওই অত অল্প সময়ের মধ্যেই ফারুক সাহেবকে কিডন্যাপ করল কী করে।

সাইরেন বাজছে। এখনকার আওয়াজ একটু অন্যরকম। জাহাজে বিপদ ঘটলে বোধহয় এইরকম আওয়াজে সাইরেন বাজানো হয়। একটু পরে হইহই করে জাহাজের নাবিকরা ফিরে আসতে লাগল। ওপর থেকে তাদের দেখতে পাচ্ছিল নীল। অসময়ে চলে আসার জন্যে তারা বেশ বিরক্ত। সে লক্ষ রাখছিল, ওই ভিড়ে ফারুক সাহেব আছেন কি না! না দেখতে পেয়ে চোখ বন্ধ করল সে। ওই ভালো মানুষটার যদি কিছু খারাপ হয় তাহলে তার জন্যে নিজেকে দায়ী করবে সে। ভদ্রলোক তো যেতেই চাইছিলেন না, সে জোর করে ওঁকে সঙ্গী হতে বাধ্য করেছিল।

ঘণ্টাখানেক পরে ক্যাপ্টেনের ঘরে ডাক পড়ল নীলের। ভেজানো দরজায় শব্দ করতেই ক্যাপ্টেনের গলা শুনল, ‘কাম ইন।’

ভেতরে ঢুকে দেখল ক্যাপ্টেনের সামনে দুজন বিশাল চেহারার আফ্রিকান বসে আছেন। পরনে ইউনিফর্ম না থাকা সত্বেও ওঁরা পুলিশের বড়কর্তা তা বুঝতে পারল নীল। ক্যাপ্টেন বললেন, ‘ঘটনাটা এই ছেলেটি রিপোর্ট করেছে। মিস্টার ফারুকের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ে ওরা একটা বিয়ারপাবে গিয়েছিল। সেখানে একটি লোক গায়ে পড়ে কথা বলে ওদের সঙ্গে। তারপর রাস্তায় নেমে ও টয়লেটে যায়। ফিরে এসে দ্যাখে মিস্টার ফারুক নেই। খোঁজাখুঁজি করেও তাঁকে পায়নি। জাহাজের প্রায় সব কর্মচারী সাইরেন শুনে ফিরে এসেছে। শুধু দুজন ফেরেনি। তার একজন হল মিস্টার ফারুক। আমরা ভয় পাচ্ছি, ওঁর কোনও ক্ষতি হতে পারে!’

অফিসার দুজনের একজনের সামনে টেবিলের ওপর একটা ফটোগ্রাফ পড়ে ছিল। সেটা তুলে তিনি আর একবার দেখলেন। তারপর নীলের দিকে তাকিয়ে খুব নীচু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কি মারপিট করেছিলে?’

‘না স্যার।’ দ্রুত মাথা নাড়ল নীল।

‘আজ একটু আগে একটা লোককে মার্ডার করা হয়েছে। যে গুলি করেছে সে আফ্রিকান নয়। এটা পাবলিকের মুখ থেকে জানা গেছে। যে লোকটাকে ক্যাপ্টেন খুঁজে পেতে চাইছেন সেই লোকটাই যদি গুলি ছুড়ে থাকে তাহলে সে ধরা পড়বেই। তুমি কিছু জানো?’ লোকটা পকেট থেকে একটা টুথপিক বের করে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে জিজ্ঞাসা করল।

‘না স্যার। ফারুক সাহেব কখনওই খুন করতে পারেন না। উনি অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ মানুষ। তা ছাড়া ওঁর সঙ্গে গুলি করার জন্যে কোনও অস্ত্র ছিল না।’ নীল প্রতিবাদ করল।

‘শোনো। তুমি যদি এরকম কথা আর একবার বলো তাহলে ভুল তথ্য দিয়ে পুলিশকে বিভ্রান্ত করার অভিযোগে তোমাকে গ্রেপ্তার করব।’ কথাগুলো শেষ করে হেসে তিনি ক্যাপ্টেনকে বললেন, ‘আপনি তো জানেন ক্যাপ্টেন, নাবিকরা কোনও বন্দরে নামলে নানান অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। দিনের পর দিন জলে থাকতে থাকতে ওরা এমন একঘেঁয়েমিতে আক্রান্ত হয় যে মাটি ছেড়ে যেতে চায় না। এই মিস্টার ফারুক বোধহয় ওই শ্রেণির একজন। চিন্তা করবেন না, আমরা দেখছি।’

ক্যাপ্টেন বললেন, ‘অফিসার, কাল সন্ধ্যার পরে আমাদের এই বন্দর ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা—!’

‘লেটস সি।’ প্রথম অফিসার উঠে দাঁড়ালেন।

দ্বিতীয় অফিসার উঠলেন না। তিনি নীলের দিকে তাকালেন, ‘আর একজন কোথায়?’

‘আর একজন!’ প্রশ্নটা বুঝতে পারল না নীল।

‘ক্যাপ্টেন বলছেন দুজন জাহাজে ফিরে আসেনি। একজন যদি মিস্টার ফারুক হন, দ্বিতীয় লোকটি কে? কোথায় আছে সে?’

নীল অবাক হয়ে ক্যাপ্টেনের দিকে তাকাল। ক্যাপ্টেন বললেন, ‘ওর নাম হল স্যামুয়েল। স্যাম নামেই পরিচিত। সেও ফিরে আসেনি।’

দ্বিতীয় অফিসার উঠে দাঁড়ালেন, ‘ক্যাপ্টেন, আমার মনে হচ্ছে ওই দুজন প্ল্যান করে উধাও হয়ে গেছে। কেউ ওদের কিডন্যাপ করেনি। কাল সকালেই ওরা জাহাজে ফিরে আসবে। না ফিরলে খবর দেবেন।’

হঠাৎ মনে পড়ে গেল নীলের। স্যাম তাকে এক ডাইনির কাহিনি বলেছিল। শহরের কাছাকাছি পাহাড়ের গুহাতে থাকে। মেজাজ ভালো থাকলে ডাইনি মানুষের উপকার করে। স্যাম তার কাছে যেতে চেয়েছিল। স্যাম কি সেখানেই গিয়েছে?

নীল ক্যাপ্টেনকে স্যামের ইচ্ছের কথা জানাল।

প্রথম অফিসার মাথা চাপড়ালেন, ‘মাই গড! তাহলে ধরে নিন আপনার ওই দ্বিতীয় লোকটাও আর ফিরে আসছে না। ভয়ংকর ডাইনির মন সবসময় খারাপ থাকে।’

‘একবার ওখানে গিয়ে খোঁজ করলে ভালো হত অফিসার।’ ক্যাপ্টেন বললেন।

‘না। এই রাত্রে কখনোই না। কাল সকাল হলে দেখা যাবে।’ ওঁরা পা বাড়ালেন।

ওরা ঘর থেকে চলে গেলে নীল ক্যাপ্টেনের দিকে এক পা এগিয়ে গেল, ‘স্যার, আমি নিশ্চিত স্যামকে ওই পাহাড়ে গেলে পাওয়া যাবে। ওখানে নিশ্চয়ই জাহাজের সাইরেনের আওয়াজ পৌঁছোয়নি। ওর কিছু হওয়ার আগে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।’

‘পাগল হয়েছ? জাহাজের কোনও নাবিকের অধিকার নেই বন্দরের বাইরে যাওয়ার। স্যাম যদি গিয়ে থাকে তাহলে সে অবৈধ কাজ করেছে।’ ক্যাপ্টেন বললেন, ‘এরা যা বলল তাতে আমারও এখন মনে হচ্ছে স্যাম ফারুককে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে।’

‘না স্যার। ফারুক সাহেব আল্লার দোয়া চান, আর কাউকে তিনি মানেন না। ডাইনিকে যে তিনি অপছন্দ করেন তা আমাকে বলেছেন।’ নীল বলল।

‘শোনো নীল। আমরা একটা বিদেশি রাষ্ট্রের বন্দরে এখন আছি। এখানকার নিয়মকানুন মেনে চলা আমাদের কর্তব্য। নিজেরা উদ্যোগী হয়ে কিছু করতে চাইলে এখানকার পুলিশ মিথ্যে অভিযোগে আমাদের এমন ফাঁসিয়ে দিতে পারে যে আর বের হতে পারব না। অতএব, অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।’ ক্যাপ্টেন উঠে পাশের ঘরে চলে গেলেন। খুব হতাশ হল নীল। তার তো কিছুই করার নেই।

মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে গেল নীলের। সে ধড়মড়িয়ে উঠে চারপাশে তাকাল। না, ফারুক সাহেব তার পাশে এসে দাঁড়াননি। অথচ সে একটু আগে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল। ব্যাপারটা যে স্বপ্ন তা বুঝতে পেরে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। সে যেন দেখল ফারুক সাহেব তাকে বলছেন, ‘ভাই নীল, ওই হিরের সঙ্গে অভিশাপ জড়িয়ে আছে। ইয়াসিন, নিজের জন্যে রাখবে ভেবেছিল, তাই খুন হয়ে গিয়েছিল। আমি কখনওই তা ভাবিনি। কিন্তু ভেবেছিলাম যদি টাকা পাই তাহলে আমার গ্রামের উন্নতির জন্যে খরচ করব! এটাও যে খুব স্বার্থপর ভাবনা তা ভাবিনি। হয়তো এই কারণেই আমাকে শাস্তি পেতে হল। আল্লার কাছে প্রার্থনা করো যেন তিনি আমাকে কৃপা করেন।’

হ্যাঁ, ফারুক সাহেব তো তাকে প্রায় একই কথা বলেছিলেন। ওই হিরের সঙ্গে অভিশাপ জড়িয়ে আছে। এই একুশ শতাব্দীতে অভিশাপের কথা কেউ বললে তাকে অন্ধসংস্কারে আবদ্ধ বলেই মনে হয়। প্রথমবার শোনার পর এটা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায়নি নীল। স্বপ্নটা দেখার পর অস্বস্তি শুরু হল।

সকালে ক্যাপ্টেন, ডিসিলভার সঙ্গে গাড়িতে উঠল সে। পুলিশ একটু আগে জানিয়েছে তাদের থানায় যেতে। আরও বলেছে, নীলকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। ক্যাপ্টেন তাকে বারংবার বলেছেন, কোনও অবস্থাতেই কোনও কথা না বলতে। অপছন্দের কথা শুনলেও প্রতিবাদ না করতে। একটা পাইলট মোটরবাইক তাঁদের গাড়িকে একটা থানায় নিয়ে এল। জুনিয়ার অফিসারের সঙ্গে গতরাতের জাহাজে আসা দুই কর্তার একজন দাঁড়িয়েছিলেন। গাড়ি থেকে নামতেই সেই কর্তা এগিয়ে এসে বললেন, ‘আপনাদের এখানে ডেকে আনতে বাধ্য হলাম। একটা প্রথা মানতেই ডেকেছি। আমার বিশ্বাস আপনারা সহযোগিতা করবেন।’

‘কী করতে হবে বলুন।’ ক্যাপ্টেন জিজ্ঞাসা করলেন।

‘একটি মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। তাকে আইডেন্টিফাই করতে হবে।’ তিনি একজন অফিসারকে ডেকে বললেন, ‘এই ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে ডেডবডির মুখ দেখাও।’

দুজন অফিসার নীলকে নিয়ে থানার পেছন দিকে চলে এলেন। সেখানে একটি দরজা বন্ধ ঘরের সামনে এসে অফিসারদের একজন চেঁচিয়ে কাউকে ডাকলেন। একটা লোক ছুটতে ছুটতে এলে তাকে আদেশ করলেন তিনি। ভাষা বুঝতে পারছিল না নীল। দরজা খুলে দিলে একজন অফিসার নীলকে বললেন, ‘গো ইনসাইড। আইডেন্টিফাই দ্য ডেডবডি।’

নীল পা বাড়াল। বিশ্রী পচা গন্ধ বাতাসে ভাসছে। যে দরজা খুলেছিল সে আগে আগে গিয়ে মাটিতে শোওয়া একটি শরীর থেকে কাপড় সরাল। তারপর আলো জ্বেলে দিল। মুখে রুমাল চেপে নীল একটু কাছে গিয়ে দেখল। মুখ দেখে চমকে উঠল সে। একটা ধেড়ে ইঁদুর মৃতদেহর গলা থেকে নেমে একটু ইতস্তত করে ঘরের কোণে চলে গেল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না নীল। এখানে এসে সে স্যামের মৃতদেহ দেখতে পাবে তা কল্পনাও করেনি। এখনও মৃতদেহে পচন ধরেনি, দেখে মনে হচ্ছে সে ঘুমোচ্ছে।

ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই অফিসারদের একজন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি নিশ্চয়ই আইডেন্টিফাই করতে পেরেছ?’

শরীর গোলাচ্ছিল, মাথা ঘুরছিল। কোনওমতে সে মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ।’

‘গুড।’ বলে অফিসার লোকটিকে আদেশ করলেন। সে সঙ্গে সঙ্গে একটা লম্বা খাতা নিয়ে এল। অফিসার তার একটি পাতায় কিছু লিখে বললেন, ‘সই করো।’

নীল লেখাটা পড়ল। ‘ডেডবডি অফ মিস্টার ফারুক, এ সেইলার, ইজ আইডেন্টিফাইড বাই মি।’ অফিসার আঙুল দিয়ে কোথায় সই করতে হবে দেখিয়ে দিলেন।

নীল দ্রুত মাথা নাড়ল, ‘নো, নো।’

‘কী? তুমি আইডেন্টিফাই করেও সই করবে না? এর জন্যে তোমাকে কি শাস্তি পেতে হবে তা জানো?’

নীলের মনে পড়ল, ক্যাপ্টেন বলেছে অপছন্দের কথা শুনেও সে যেন প্রতিবাদ না করে। এই লোকগুলো যদি তাকে জেলে ঢুকিয়ে দেয়, তাহলে সেখানেই পচে মরতে হবে। ক্যাপ্টেনের পক্ষে তার মুক্তির ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। সে কলম নিয়ে ধীরে ধীরে সই করল।

ওঁরা তাকে ক্যাপ্টেনের কাছে নিয়ে এল। অফিসারদের একজন হেসে বললেন, ‘ডেডবডি অফ মিস্টার ফারুককে এখন পোস্টমর্টেম করতে পাঠাতে হবে।’

ক্যাপ্টেন নীলের দিকে একবার তাকালেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমরা কি আজ সন্ধ্যার মধ্যে ওঁর ডেডবডি পেতে পারি?’

‘না ক্যাপ্টেন। এখানে ডক্টর নেই। পোস্টমর্টেম করতে তিনদিন লাগবে। আপনি চিন্তা করবেন না। ওর পারলৌকিক কাজ আমরাই করে দেব।’

গাড়িতে উঠল ওরা। থানা ছাড়াতেই নীল উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘স্যার—!’ সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত চেপে ধরলেন ক্যাপ্টেন। ইশারায় ড্রাইভারকে দেখিয়ে দিলেন। ড্রাইভার স্থানীয় মানুষ।

গাড়ি চলছিল জাহাজের দিকে। নীলের মনে হল, তাহলে কি ফারুক সাহেব এখনও বেঁচে আছেন? বেচারা স্যাম! ঠোঁট কামড়াল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *