রসাতলের রহস্য – ৪

নীলের কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘হিরেগুলোর কী হল?’

‘জানি না। নারকোল গাছের গায়ে বালির মধ্যে কৌটোটাকে পুঁতে এসেছিলাম। জানা না থাকলে কেউ খুঁজে পাবে না। তবে সমুদ্র যদি উত্তাল হয়ে পাড়ের জমি খেয়ে নেয়, তাহলে ওই কৌটো তার তলায় হারিয়ে গিয়েছে। ইয়াসিনের ইচ্ছে ছিল, যদি হিরে বিক্রি করতে পারে তাহলে তার অর্ধেকটা টাকা দু-ভাগ করে সোমালিয়া আর বাংলাদেশের অনাথ ছেলেমেয়েদের জন্যে ব্যয় করবে। মানুষের তো কত ইচ্ছে থাকে, পূর্ণ হয় কোথায়!’ ফারুক সাহেব বললেন।

‘আপনি আর কখনও কক্সবাজারে গিয়ে হিরের সন্ধান করেননি?’ নীল জিজ্ঞাসা করল।

‘না। প্রাণের ভয়ে যাইনি। তারপর থেকে জাহাজে জাহাজে ভেসেছি।’

‘কিন্তু এত লোক থাকতে আপনি আমাকে এই গোপন কথাটা জানালেন কেন?’ নীল তাকাল।

‘ধরো, হিরেগুলো যেখানে রেখেছিলাম সেখানেই থেকে গেছে। ইয়াসিন নেই আর আমিও চোখ বুঁজলাম। তাহলে হিরেগুলো তো কখনোই কারও কাজে লাগবে না। আর তোমাকে কেন বললাম? একটা সময় আসে যখন কিছু কথা কাউকে না কাউকে জানিয়ে যেতে হয়। কাকে জানাব? না, যাকে দেখে মনে বিশ্বাস আসে, আস্থা তৈরি হয়। তুমি মদ খাও না, সিগারেটের নেশা নেই, সত্যি বলতে কী, তোমাকে নাবিক বলে মনেই হয় না। তাই ভাবলাম—! ক’দিন থেকে কেবলই মনে হচ্ছে আর বেশি সময় হাতে নেই। তাই—!’ ফারুক সাহেব হাসলেন।

‘আপনার এমন কিছু বয়স হয়নি যে এসব ভাববেন। আচ্ছা, আপনি আমাকে তথ্য দিলেন যা কেউ জানে না। আমি তো হিরেগুলো পেলে আত্মসাৎ করে ফেলতে পারি। অত হিরে বিক্রি করলে সারাজীবন কোনও কাজ না করে পায়ের ওপর পা তুলে কাটাতে পারব। তাই না?’ নীল জিজ্ঞাসা করল।

‘পারবে না।’ মাথা নাড়লেন ফারুকসাহেব।

‘কেন?’

‘ওই হিরে বিক্রি করে আত্মসাৎ করলে তা তুমি ভোগ করতে পারবে না।’

‘একথা কেন বলছেন?’

‘ইয়াসিন বলেছিল, ওই হিরের ওপর অভিশাপ আছে। জলদস্যুদের খপ্পর থেকে পালাবার সময় এক বন্দি তাকে হিরেগুলো দিয়ে বলেছিল এগুলো নিয়ে যাও। এসব অভিশাপের হিরে। তবে মানুষের মঙ্গল করলে তোমার ক্ষতি হবে না। ইয়াসিন তাই অনাথ শিশুদের উপকার করতে চেয়েছিল। কিন্তু বিক্রির টাকার অর্ধেকটা দিয়ে। বাকি অর্ধেক সে দুভাগ করে একভাগ নিজে রেখে অন্য ভাগ আমাকে দেবে বলেছিল। অর্থাৎ পুরোপুরি নি:স্বার্থ হয়নি, তাই বোধহয় তাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। আশা করি তুমি ওই ভুল করবে না।’ ফারুক সাহেব উঠে দাঁড়ালেন, ‘অবশ্য এসব বলা এখন অবান্তর। আমরা এখন মাঝসমুদ্রে, কোথায় কক্সবাজার। সেখানে সমুদ্র হিরের কৌটো গিলে ফেলেছে কি না তাও জানি না। অনেক রাত হয়েছে। চলো ফেরা যাক।’ ফারুক সাহেব দাঁড়ালেন না। একটু ঝুঁকে নেমে গেলেন ওপরের ডেক থেকে।

নীল সমুদ্র দেখল। আকাশের তারাদের আলো এখন আরও উজ্জ্বল। সমুদ্রের নীল জলে মাঝে মাঝে সাদা ফেনা ছিটকে উঠছে ঢেউ-এর ধাক্কায়। এখানে জলের গভীরতা অন্তত দুই কিলোমিটার। ডুবে গেলে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে হবে। কিছুদিন আগে যাত্রীসমেত একটি প্লেন এয়ারপোর্টে না নেমে একেবারেই হারিয়ে গিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, প্লেন সমুদ্রের নীচে তলিয়ে গিয়েছে। দু-মাইল জলের তলায় চলে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব, যদি না তার টুকরোগুলো ভেসে ওঠে।

আফ্রিকার একটি অখ্যাত বন্দরে জাহাজ ভেড়ালেন ক্যাপ্টেন। ঝড়ের কারণে জাহাজের অনেক ক্ষতি হয়েছিল, সেগুলো সারিয়ে নেওয়ার কারণে দিন তিনেক থাকতে হবে। নীল শুনল, ওই ক্ষতিগুলো নিয়ে জাহাজ স্বচ্ছন্দে ভেসে যেতে পারত, কিন্তু ক্যাপ্টেন সন্তুষ্ট ছিলেন না। জাহাজ তাঁর কাছে সন্তানের মতো, সবসময় তাকে নিখুঁত রাখতে চান।

যে ক’দিন জাহাজ সারাই-এর কাজ চলছে সেই কয়েকদিন নাবিকদের ছুটি। অফিসের ক্লার্করাও অর্ধেক দিন ছুটি পাবে। কিন্তু ডিসিলভা সাহেব কম্পিউটারের স্টাফদের ছুটি দেবেন না। ফলে নীলও ছুটি পায়নি। প্রতিমুহূর্তে মেইল আসছে, নানান ডাটা দিয়ে তথ্য পাঠাচ্ছে হেড অফিস। নীলের ওপরে দায়িত্ব দিয়েছেন তাদের প্রিন্টআউট সঙ্গে সঙ্গে বের করে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার, ফলে জাহাজের জানলা থেকে সে বন্দরের মাটি দেখতে পায়। কখনও ওপরের ডেকে উঠে দ্যাখে।

এই শহরের ভেতরে কী আছে তা জাহাজে দাঁড়িয়ে দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু বন্দরে যারা কাজ করছে তাদের গায়ের রং খুব কালো। এরা যে আফ্রিকান তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। যে মেকানিকরা জাহাজ সারাই-এর কাজে জাহাজে উঠে এসেছে, তাদের নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুনেছিল নীল, বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারেনি।

কিন্তু জাহাজের অনেকেই লাঞ্চের পর বেরিয়ে যাচ্ছে। রাত এগারোটায় কেউ কেউ টলতে টলতে ফিরছে, কেউ স্বাভাবিক পায়ে কিন্তু গম্ভীর হয়ে। তারপর ঘুমাচ্ছে পরের দিন সকাল শেষ হওয়া পর্যন্ত। স্যাম তাকে বলল, ‘বেশ ছিলে, ডেক পরিষ্কার করতে, একটু পরিশ্রম করতে হত, কিন্তু এই তিনদিন ছুটি পেয়ে চুটিয়ে উপভোগ করতে পারতে। বোকার মতো ডিসিলভার পাল্লায় পড়লে।’

শহরটাকে দেখার ইচ্ছে হচ্ছিল খুব, তাই স্যামের কথার প্রতিবাদ করল না নীল।

সে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি এই বন্দরে আগে এসেছ?’

মাথা নড়ল স্যাম, ‘না। এখানে সব জাহাজ আসে না। বন্দরের টেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্ট তাই খুব দুর্বল। আমাদের জাহাজের মেরামতি বড় বন্দরে হলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে হয়ে যেত। এখানে তিনদিন লাগছে, বুঝতেই পারছ। আর যেহেতু বন্দরে বেশি জাহাজ আসে না তাই শহরে ঢুকলে খাতির পাওয়া যায়। লোকাল জিনিসপত্র তো বেশ সস্তা। তবে সাবস্ট্যান্ডার্ড। কিন্তু ওসব নিয়ে মাথা ঘামালে আনন্দফুর্তি করা হবে না।’ অদ্ভুত গলায় হাসল স্যাম।

‘কী কী দেখলে এখানে?’ নীল জিজ্ঞাসা করল।

‘দেখার কিছু নেই। তবে শুনেছি।’ স্যাম সমুদ্র দেখতে দেখতে এতক্ষণ কথা বলছিল। এবার নীলের দিকে ঘুরে দাঁড়াল, ‘খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। বিয়ারপাবে গিয়ে শুনলাম।’

‘এখানে একজন বুড়ি ডাইনি আছে। শহর থেকে আধঘণ্টা দূরে পাহাড়ের গুহায় সেই বুড়ি থাকে। তার মন ভালো থাকলে সে এমনসব কথা বলবে যে তুমি চমকে যাবে।’

‘বুড়ি ডাইনি?’

‘ইয়েস ব্রাদার। আমি একটা পাবে শুনলাম। ডাইনি বলে অনেকেই ভয়ে কাছে যায় না। কারণ তার মেজাজ খারাপ থাকলে সে নাকি মানুষকে ভেড়া বানিয়ে দিতে পারে। কেউ কি ভেড়া হতে চায়, বলো?’ স্যাম তাকাল।

‘সর্বনাশ। এসব এই একুশ শতকে কেউ বিশ্বাস করে?’

‘আরে, প্রমাণ না পেলে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করবে কেন? ঘটনা ঘটেছে বলেই লোক ভয় পায় ওর কাছে যেতে। কিন্তু আর তো মাত্র একটা দিন হাতে আছে, ভাবছি কাল আমি একটা ট্রাই নেব।’ স্যাম ঘড়ি দেখল।

‘কিন্তু তুমি রিস্ক নেবে? তখন যদি বুড়ি ডাইনির মেজাজ খারাপ থাকে।’

‘সিম্পল অ্যানসার। ওর কাছে যাব না।’

‘সেটা বুঝবে কী করে?’

‘শুনলাম মেজাজ যখন খারাপ হয় তখন বুড়ি গুহার ভেতর থেকে বের হয় না, গুহায় আলো জ্বালে না, অন্ধকারে শুয়ে থাকে। মেজাজ ভালো হলে গুহা থেকে বেরিয়ে আসে, মানুষের দেওয়া ফলের ঝুড়ি থেকে ফল তুলে নেয়। বুড়ি পোড়া মাংস খেতে খুব ভালোবাসে। সেইসময় কেউ যদি পোড়া মাংস নিয়ে ওর সামনে যায়, তাহলে আর কথা নেই। বুড়ি তখন যা বলবে তা শুনে চললে জীবন বদলে যাবে। একজন নাবিককে নাকি মন ভালো থাকা অবস্থায় বুড়ি বলেছিল, ”খবরদার, যে জাহাজ এখানে এসেছিল সেই জাহাজে ফিরে যাস না। প্রাণে মারা যাবি।” সেই নাবিক ভয় পেয়ে আর তার জাহাজে ফিরে যায়নি। তাকে ছাড়াই জাহাজ চলে যায়। পরে জানা গেল, পাইরেটরা মারপিট করে জাহাজটাকে ডুবিয়ে দিয়েছে। কেউ বাঁচেনি।’ স্যাম হাসল, ‘দেখি, আমার কপালে কী আছে!’

স্যাম চলে গেলে নীল ফারুক সাহেবের ঘরে এল, সেখানে ফারুক সাহেবের সঙ্গে আরও তিনজন থাকেন। ফারুক সাহেব তখন নিজের জামা সেলাই করছিলেন। তাঁর রুমমেটরা ঘরে নেই। নীল জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি জামা সেলাই করছেন?’

‘এতে অবাক হচ্ছ কেন?’ মুখ তুললেন ফারুক সাহেব।

‘অনেকটা ছিঁড়েছে, আপনার নিশ্চয়ই আরও অনেক জামা আছে, এটাকে বাতিল করলে তো অসুবিধে হত না।’ নীল বলল।

‘একটু ঠিকঠাক সেলাই করে নিলে যদি ব্যবহার করা যায়, তাহলে বাতিল করব কেন? আমাদের বাপদাদারা যখন বৃদ্ধ হয়ে অকর্মণ্য হন তখন তাঁদের কি আমরা বাতিল করি, না ওষুধ দিয়ে সুস্থ করতে চাই?’ ফারুক সাহেব আবার সেলাই-এ মন দিলেন। তারপর কাজটা স্থগিত রেখে বললেন, ‘আমার দাদার একটা কালো গাই ছিল। খুব দুধ দিত। তারপর বয়স হলে যখন বাচ্চা হত না, তখন দুধ দেওয়া বন্ধ করেছিল। দাদাকে আমার বড় চাচা বললেন, ”আবু, গাইটাকে হাটে নিয়ে গিয়ে কসাই-এর কাছে বিক্রি করে দিয়ে আসি, ভালো টাকা পাওয়া যাবে।” দাদা তার সেজোছেলের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ”এই যে এত বছর ধরে ও দুধ দিল, যা খেয়ে তোরা খুশি ছিলি, তখন তো বলিসনি ওকে কসাই-এর কাছে বিক্রি করে দিই। এখন যখন সেই ইচ্ছে হয়েছে তখন এতকাল যত দুধ খেয়েছিস তার দাম মসজিদে দিয়ে আয়, তারপর বিক্রি করবি। ওরে হতভাগা, আমি যেদিন সংসারের কোনও কাজে লাগব না সেদিন কী বলবি, এই বুড়োটা বসে বসে খাচ্ছে, একে বিদায় কর।” দাদা চোখ বন্ধ করেছিলেন কথাগুলো বলতে বলতে। সেইসময় কালী গরুর হাম্বা ডাক ভেসে এল। দাদা চোখ খুলে বললেন, ”আহা, ডাকটা আমার প্রাণ জুড়িয়ে দিল। এতবছর ধরে শুনছি, খিদে পেলে ও এইরকম ডাকে। যাই খাবার দিয়ে আসি।” হাসলেন ফারুকসাহেব, ‘কিছু মনে কোরো না ভাই, বুড়ো হয়েছি তো, তাই মুখ খুললে বেশি কথা বেরিয়ে আসে।’

মুগ্ধ হয়ে গল্পটা শুনছিল নীল। বলল, ‘ভাগ্যিস আপনি এখন সেলাই করছিলেন, নইলে এত চমৎকার গল্প আমি শুনতে পেতাম না। একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?’

ফারুক সাহেব তাকালেন।

নীল জিজ্ঞাসা করল, ‘তিনদিন ছুটি পাওয়া সত্বেও আপনি বন্দরের মাটিতে এখনও পা দেননি। কেন?’

‘কী করব ওখানে? খাওয়ার জিনিস তো জাহাজেই পাওয়া যায়। এরকম জায়গায় দেখার কী আছে?’ ফারুক সাহেব বললেন, ‘যাদের বয়স কম তারা কিছু না কিছু সন্ধান করে। আমার এই বয়সে একটাই চাওয়া, সেটা হল আল্লার দোয়া।’

‘আপনি কি জানেন, এই শহর থেকে আধঘণ্টা দূরে পাহাড়ের গুহার মধ্যে একজন বুড়ি ডাইনি থাকে। তাকে সবাই ভয় পায় কারণ মেজাজ খারাপ থাকলে সে খুব ক্ষতি করে। কিন্তু মেজাজ ভালো থাকলে এমন কথা বলে যে খুব উপকার হয়।’ নীল বলল।

‘তুমি এই কথা জানলে কী করে?’

‘স্যাম বলছিল। সে এখানকার মানুষের মুখে শুনেছে।’

‘এরকম কেউ কেউ সব দেশে থাকে বলে শুনেছি।’

‘স্যাম যাচ্ছে তার কাছে। আমারও খুব কৌতূহল হচ্ছে। আপনি যাবেন?’

‘গেলে তোমার তো ক্ষতিও হতে পারে!’

‘বুড়ি যখন বাইরে বেরিয়ে আসে তখন ক্ষতি করে না। আমি তো ছুটি পাব না, আপনি ইচ্ছে করলে যেতে পারেন।’

‘দ্যাখো নীল, আল্লা আমার ভবিষ্যৎ জানেন। আর কারও তো জানার কথা নয়। যদি কেউ কিছু বলে আর তা ভবিষ্যতে সত্যি মিলে যায়, তাহলে বুঝতে হবে সেই মানুষ অসৎপথে ক্ষমতা পেয়েছে। বুড়ি যদি সৎ হত তাহলে তাকে কেউ ডাইনি বলত না। শ্রদ্ধাভক্তি করত। আচ্ছা, অনেক কথা বলেছি, আমাকে সেলাইটা শেষ করতে দাও।’ ফারুক সাহেব আবার জামা টেনে নিলেন।

হঠাৎ মন বদলে গেল ডিসিলভা সাহেবের। দ্বিতীয় দিনের বিকেলে বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমরা এখন সেজেগুজে বন্দরে যেতে পারো। সবাই যাচ্ছে, তোমরাই বঞ্চিত হবে কেন? কিন্তু মনে রেখো, নতুন জায়গা, তাই রাত দশটার মধ্যে জাহাজে ফিরে আসবে। কাল সকাল থেকে আবার কাজ। এনজয় দিস ইভনিং।’

কেবিনে এসে তৈরি হয়ে নিল নীল। তারপরেই মনে হল এই বন্দরশহরে কিছু কিনতে হলে কোন টাকা দরকার হবে তার জানা নেই। সে শুনেছে, বন্দরে নামার আগে নাবিকরা জাহাজের ক্যাশ কাউন্টার থেকে টাকা এক্সচেঞ্জ করে নিয়ে যায়। যদিও তার পরিমাণ বেশি নয়। নীল ফারুক সাহেবের কাছে এল। তখন তিনি নামাজ শেষ করে উঠেছেন। নীল তাকে বলল, ‘আমাদেরও আজ বিকেলে ছুটি দেওয়া হয়েছে। আপনি আমার সঙ্গে চলুন, শহরটাকে দেখে আসি।’

ফারুক সাহেব কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন, নীলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বেশ, চলো। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে নিচ্ছি।’

দুজনেই সামান্য টাকা বদলে নিয়েছিল। মাটিতে পা দিয়ে বন্দরের অফিসগুলো পার হতেই কিছু লোক ওদের সঙ্গ নিতে শুরু করল। তারা বারংবার বলতে লাগল, খুব সস্তায় রেস্টুরেন্টে দারুণ খাবার খাওয়া যাবে। কেউ বলল, আমার সিঙ্গিং বারে গেলে মিষ্টি গান শুনতে শুনতে পৃথিবীর সেরা মদ পান করতে পারবেন।

ফারুক সাহেব বললেন, ‘এদের কথায় কান দিও না। হাঁটো।’ লোকগুলো তবু সঙ্গ ছাড়ছে না দেখে ফারুক সাহেব ঘুরে দাঁড়িয়ে খুব করে এমনসব শব্দ উচ্চারণ করতে লাগলেন যার বিন্দুমাত্র বুঝতে পারল না নীল। লোকগুলো থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। নীল দেখল ওদের চোখ বিস্ফারিত। বকা বন্ধ করে ফারুক সাহেব আবার শান্ত হয়ে হাঁটতে শুরু করলে নীল জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কোন ভাষায় ওদের সঙ্গে কথা বললেন।’

‘আমি তো ওদের সঙ্গে কথা বলিনি। আমি কোরাণ আবৃত্তি করছিলাম।’ নির্লিপ্ত মুখে বললেন ফারুক সাহেব। লোকগুলো আর পিছু নিল না।

ছোট্ট শহর। ওরা ঘুরে ঘুরে একটা চত্বরে এল যেখানে মেলা বসেছে। মেয়ে পুরুষ শিশু সেজেগুজে জিনিসপত্র কিনছে। সবই শখের জিনিস। পাশে রয়েছে খাবারের দোকান। নীল দেখল বিচিত্ররকমের মাছভাজা বিক্রি হচ্ছে। এদের অনেককেই সে কখনও দ্যাখেনি। ফারুক সাহেব বললেন, ‘নীল, এগুলো কি খেতে ইচ্ছে করছে?’

‘আপনি মাছগুলোকে চেনেন?’

‘কয়েকটাকে চিনি। বাংলাদেশে লইট্যা শুঁটকি যাকে বলা হয়, এই শুঁটকি মাছ তাদেরই ভাইবোন ছিল। তুমি কি কখনও শুঁটকি মাছ খেয়েছ?’

‘না।’ জোর মাথা নাড়ল নীল।

হেসে ফেললেন ফারুক সাহেব। ‘টিন ফিশ?’

‘হ্যাঁ।’ মাথা নড়ল নীল।

‘টিন ফিশ যেভাবে কৌটোয় রাখা হয় সেইভাবে শুঁটকিকে রেখে দিলে তুমি আর নাক সিঁটকাবে না। চলো।’

খানিকটা হাঁটতেই একটা বিয়ারপাব চোখে পড়ল। স্যাম যে বিয়ারপাবের কথা শুনেছিল সেটা কি এটাই? ওকে দাঁড়াতে দেখে ফারুক সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার কি এক গ্লাস বিয়ার পান করার ইচ্ছে হচ্ছে? হলে যেতে পারো।’

‘আপনি?’

‘না হে। আমি প্রয়োজনের বাইরে কোনও খাবার খাই না। তাই বলে তোমার সঙ্গে ভেতরে গিয়ে বসতে আপত্তি নেই। চলো।’

দরজা টেনে ভেতরে ঢুকতেই বিশ্রী গন্ধ নাকে এল। পোড়া তামাকের সঙ্গে অ্যালকোহলের কটু গন্ধ মিশে রয়েছে ঘরের ভেতরে। টেবিলের অর্ধেকটাই খালি। বার কাউন্টারে একজন লোক দাঁড়িয়ে পান করছে।

ফারুক সাহেব বললেন, ‘বসার দরকার নেই। বার কাউন্টারে চলো, ওখানে দাঁড়িয়েই এক গ্লাস পান করে নেবে।’

ওরা কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াতেই একটি বিশাল চেহারার কালো মহিলা ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে উলটোদিকে এগিয়ে এলেন। নীল বলল, ‘বিয়ার!’

‘স্ট্রং অর পোলাইট?’

কোনও বিয়ার পোলাইট হয় তা নীলের জানা ছিল না। ফারুক সাহেব বললেন, ‘পোলাইট। অনলি ফর হিম!’

‘ইউ?’

‘নো।’

মহিলা তার বিশাল কাঁধ নাচালেন। একটা ছোট বিয়ারের বোতল সামনে এগিয়ে দিয়ে পেছনে ঝোলানো দামের চার্ট দেখিয়ে দিলেন। নীল দেখল তাতে অনেক মদের লিস্টের শেষে লেখা আছে বিগ বিয়ার টেন, স্মল বিয়ার সেভেন। সে পকেট থেকে নোট বের করে জিজ্ঞাসা করল, ‘সেভেন শিলিং অর ফাইভ শিলিং? ইফ ফুল ইজ টেন দেন—!’

‘নো-নো। উই ফলো দ্য চার্ট। এনি স্ন্যাকস?’ দশ সিলিং-এর নোট টেনে নিয়ে ড্রয়ার টেনে বলল, ‘নো চেঞ্জ।’ ছোট বোতল ফিরিয়ে নিয়ে একটা বড় বোতল এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওকে!’

ফারুক সাহেব নীচু গলায় বললেন, ‘ধীরে ধীরে খাও। এক বোতল বিয়ার খেলে তোমার নেশা হবে না। মহিলা কায়দা করে চাপিয়ে দিলেন।’

‘স্ন্যাকস?’

নীল মাথা নাড়ল, ‘নো।’

‘নিউ সেইলার?’

‘ইয়েস।’

‘আন্ডারস্ট্যান্ড।’

পাশে দাঁড়ানো লোকটা এবার তাদের দিকে তাকাল। বছর চল্লিশেক বয়স এবং লোকটা কালো নয়। জিনস, জ্যাকেট এবং মাথায় টুপি।

হঠাৎ লোকটা জিজ্ঞাসা করল, ‘ইউ আর ফ্রম ডিফারেন্ট কান্ট্রি?’

নীল মুখ খোলার আগে ফারুক সাহেব বললেন, ‘ইয়েস।’

‘আর ইউ পাকিস্তানি?’ লোকটা ফারুক সাহেবের দিকে তাকাল।

‘নট দ্যাট অল। আই অ্যাম ফ্রম বাংলাদেশ।’

‘আই সি। বাংলাদেশ। ইটস নিয়ার মায়নামার।’

‘মায়নামার ইজ নিয়ার বাংলাদেশ। হ্যাভ ইউ বিন দেয়ার?’

‘নো। আই ওয়ান্ট টু গো বাংলাদেশ। দেয়ার ইজ এ সি-টাউন।’

‘কক্সবাজার?’ ফারুক সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন।

‘ইয়া ইয়া। ইউ নো কক্সবাজার?’

নীল ইংরেজিতে বলল, ‘কক্সবাজারে ওর বন্ধু থাকত। উনি অনেকবার গিয়েছেন।’

‘বন্ধু এখন নেই?’

‘না। তাকে খুন করা হয়েছে।’

ফারুক সাহেব বিরক্ত হলেন, ‘ইয়াসিনের কথা বলার কী দরকার!’

‘ইয়াসিন, উনিও কি নাবিক ছিলেন?’

‘তার কথা জেনে আপনি কী করবেন!’

‘সরি, মাই ফ্রেন্ডস!’ লোকটা আবার উলটোদিকে ঘুরল।

বিয়ার শেষ করে ওরা যখন বাইরে এল তখন বেলা শেষ হয়ে গেছে। রাত নেমেছে। কিছুটা হাঁটতে নীল একটি প্রস্রাবখানার বোর্ড দেখতে পেয়ে বলল, ‘আমাকে একটু মাইনাস করতে হবে।’ ফারুক সাহেব হাসলেন, ‘বিয়ার খাওয়ার প্রতিক্রিয়া, যাও।’

মিনিট তিনেকের মধ্যে বাইরে বেরিয়ে এসে নীল ফারুক সাহেবকে দেখতে পেল না। মিটিমিটি আলো জ্বলছে লাইটপোস্টের ওপর। ফারুক সাহেবকে দেখা যাচ্ছে না। সে চিৎকার করে ডাকল, ‘ফারুকসাহেব। ফারুকসাহেব।’ কোনও সাড়া এল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *