মাথা ঘুরছে; শরীরের ভেতরে তীব্র যন্ত্রণা, ঘনঘন বমি হচ্ছে, মেঝেতে শুয়েও নিজেকে স্থির রাখতে পারছিল না নীল। কিন্তু দু-হাতের মুঠোতে রডটাকে ধরে রাখছিল সে। জাহাজ যেভাবে নাচছে, এপাশ-ওপাশ করছে, তাতে রড ছাড়লেই শরীর আছড়ে পড়বে দেওয়ালে।
আজ বিকেলে আকাশ দেখে মনে হয়নি এরকম ভয়ংকর ঝড় সমুদ্রকে উথালপাথাল করবে। এত দ্রুত প্রকৃতির চরিত্র বদলে গেল! তাও সে কেবিনের মধ্যে আছে, ডেকে থাকলে নির্ঘাত সমুদ্রে ডুবে যেত এতক্ষণে।
‘আল্লাকে ডাকো। একমাত্র তিনিই আমাদের রক্ষা করতে পারবেন!’ পাশ থেকে ফারুক সাহেব নীচু গলায় বললেন। নীল হাসল। তারপর মনে মনে যিশুর মুখ কল্পনা করতে চাইল। কিন্তু তখনই মনে হল যিশু তো ঈশ্বরের বরপুত্র। ফারুক সাহেব যে আল্লা অথবা ঈশ্বরকে স্মরণ করতে বলছেন। মায়ের সঙ্গে গির্জায় যেতে হয়েছে তাকে। তখন যিশুকেই স্মরণ করেছে নির্দেশ মেনে। সে নীচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, ঈশ্বর কীরকম দেখতে?’
ওইরকম উথালপাথালের মধ্যেও ফারুক সাহেব হো হো শব্দে হেসে ফেললেন। তারপর চুপ করে গেলেন। এই প্রশ্ন সে ছেলেবেলায় মাকেও জিজ্ঞাসা করেছিল। মা বলেছেন, ‘এই পৃথিবীর জলে-স্থলে-আকাশে-বাতাসে ঈশ্বর বাস করেন।’ সে বুঝেছিল ঈশ্বর আছেন কিন্তু তাঁকে দেখা যায় না।
আচমকা জাহাজ স্থির হয়ে গেল। ফারুক সাহেব ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, ‘উ:, হাঁটু আর কনুই বোধহয় ভেঙে গেছে। ওঠো ভাই; ঝড় থেমে গেছে।’
তখনই সাইরেন বেজে উঠল। ধীরে ধীরে দাঁড়াল নীল। হাতে পায়ে ভয়ংকর ব্যথা, শরীর খুব কাহিল। ফারুক সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ঠিক আছ তো?’
‘হুঁ!’ মাথা নাড়ল নীল। এখন কেউ তাকে টোকা মারলেই মেঝের ওপর পড়ে যাবে।’
‘চলো, সাইরেন বাজছে।’ ফারুক সাহেব দরজার দিকে এগোলেন।
‘সাইরেন বাজছে কেন?’
‘জাহাজের সমস্ত কর্মচারীকে ওপরের ডেকে জড়ো হওয়ার জন্যে সাইরেন বাজানো হয়।’
প্রচুর মানুষ আহত হয়েছেন। তাঁদের ফাস্ট এইড দিচ্ছেন ডাক্তার এবং তাঁর সহকারীরা। বেশ কয়েকজন সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতেই পারেনি। ডিসিলভার মাথায় বড় ব্যান্ডেজ বাঁধা হয়ে গিয়েছে। নীলকে দেখে বললেন, ‘আমার চশমা টুকরো হয়ে গিয়েছে। এই জন্যেই আমি সবসময় দুটো অতিরিক্ত চশমা সঙ্গে রাখি। তোমাকে সবসময় বিপদের জন্যে তৈরি থাকতে হবে। তুমি দেখছি ঠিকই আছ, রক্তপাত হয়নি।’
ক্যাপ্টেন ভাষণ দিলেন, ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমরা তাঁর করুণায় আবার একজায়গায় একত্রিত হয়েছি। এই জাহাজ বেশ শক্তিশালী, সুগঠিত। তবু একসময় মনে হচ্ছিল ঝড় আর ঢেউ-এর মিলিত আক্রমণ সহ্য করতে পারবে না। যে-কোনও মুহূর্তেই জাহাজ ডুবে যাবে। সত্যি কথা বলতে লজ্জা নেই, একটা সময় মনে হয়েছিল বিপদ সংকেত জানিয়ে আপনাদের বলব বেরিয়ে এসে লাইফজ্যাকেট পরে তৈরি থাকতে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে। কিন্তু আমি ধৈর্য্য ধরেছিলাম। একথা ঠিক আমরা যদি ষাট সালের জাহাজে আজ থাকতাম তাহলে এই মুহূর্তে ওটাকে খুঁজে পাওয়া যেত না।’ গলায় খাঁকারি দিয়ে শ্বাস নিলেন ক্যাপ্টেন। ‘যাঁরা আহত হয়েছেন তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আগামী বারো ঘণ্টার মধ্যে দ্বিতীয়বারের ঝড় আসবে না। কিন্তু এই একটি ঝড়ে জাহাজের যে ক্ষতি হয়েছে তার মেরামতি করা দরকার। এটাকে ইমার্জেন্সি হিসেবে ভেবে নিন। কিছুক্ষণের মধ্যে অফিসাররা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে আপনাদের নিয়ে কাজ শুরু করে দেবেন।’
আকাশে হালকা মেঘ ছিল, সমুদ্র অন্ধকার। নীল যে গ্রুপে কাজ করছিল তা শেষ হল সূর্য ওঠার কিছুটা আগে। ডেকের রেলিং-এ দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল নীল। মেঘের চেহারা একটু একটু করে রঙিন হয়ে উঠেছে। সূর্য দেখা যাচ্ছে না কিন্তু তার আসার আয়োজন জলে এবং আকাশে তৈরি হচ্ছে। সমুদ্র এখন পোষা বেড়ালের মতো শান্ত। এক ঝাঁক উড়ুক্কু মাছ জল ছেড়ে খানিকটা উড়ে আবার জলে মিশে গেল। একটু একটু করে চারধার পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল। তারপর সূর্যর একাংশ জল থেকে মুখ তুলল। সঙ্গে সঙ্গে সর্বাঙ্গে কাঁটা ফুটল নীলের। যা বলেছিল, এই পৃথিবীর সর্বত্র ঈশ্বর আছেন। এই মুহূর্তে তার মনে হল সে ঈশ্বরকে দর্শন করছে।
‘কী দেখছ?’ স্যাম এসে দাঁড়াল পাশে। তার বাঁ-হাতে ব্যান্ডেজ।
‘সূর্য উঠছে।’ নীল বলল।
হাসল স্যাম। ‘এত খুশি হওয়ার কোনও কারণ নেই।’
‘মানে?’
‘সমুদ্রে একবার বিপদ এলে সেখানেই শেষ হয়ে যায় না। পরের পর আসতে থাকে। একটা ঝড় আমার হাত মচকে দিল কিন্তু আর একটা ঝড় এসে হাতটা ভেঙে দেবে না, তা কে বলতে পারে!’
নীল হাসল, ‘তুমি বোধহয় একটু ভয় পেয়ে গেছ। তাকিয়ে দ্যাখো, সমুদ্র কী শান্ত, সূর্য ওঠার পর আকাশ কী দারুণ ঝকঝকে।’
‘তোমার কোনও অভিজ্ঞতা নেই নীল, সমুদ্রে বিপদ কখনও একা আসে না। হয়তো ঝড় আসবে না বারো ঘণ্টার মধ্যে কিন্তু আমাদের এই জাহাজটা আচমকা ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারে!’
‘অ্যাঁ?’ অবাক হল নীল। ‘সেটা কী করে সম্ভব?’
‘বারমুডা ট্র্যাঙ্গেলের কথা শুনেছ?’
‘হ্যাঁ। সেটা তো আফ্রিকায়—।’
হাত তুলে নীলকে থামাল স্যাম। ‘হ্যাঁ বারবাডোজের কাছে। জাহাজগুলো ওখানে পৌঁছে বেমালুম গায়েব হয়ে গিয়েছে। কেউ তাদের খোঁজ পায়নি। বারমুডা ট্র্যাঙ্গেলের কথা বেশ প্রচলিত কিন্তু ভারত-প্রশান্ত বা আটলান্টিক সমুদ্রে ওরকম জায়গা যে নেই তা কেউ জোর গলায় বলতে পারবে না। সেরকম হলে আমরা কেউ বুঝতে পারব না কী হয়েছে।’
অবাক হয়ে গেল নীল।
‘তাছাড়া পাইরেটদের খপ্পরে এই জাহাজ পড়তে পারে।’ মাথা নাড়ল স্যাম।
‘আমাদের জাহাজেও তো সিকিউরিটি গার্ডস আছে।’
‘পাইরেটদের তুমি চেনো না। ওদের মতো ভয়ংকর নিষ্ঠুর অমানুষদের সঙ্গে কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ড কিছুই করে উঠতে পারবে না। ও:, এই ঝড়টাকে নিয়ে আমি আর ভাবছি না। আশঙ্কা হচ্ছে আগামীকাল কী হবে।’ স্যাম চলে গেল।
নীল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। মা বলত, বিপদ কখনও একা আসে না। হয়তো কথাটা সত্যি। কিন্তু স্যাম বোধহয় বেশি ভয় পেয়েছে। ওর মতো স্মার্ট ছেলে কীরকম নেতিয়ে গেছে। সে কেবিনের দিকে হাঁটতে লাগল। রাত্রে কাজ করলেও ঠিক সময়ে না পৌঁছোলে ডিসিলভা সাহেব খেপে যাবেন। এখনই স্নান করে কিছু খেয়ে ছুটতে হবে।
স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট খেয়ে অফিসঘরে ঢুকে নীল দেখল ডিসিলভা সাহেব রাগী সিংহের মতো ঘরের এদিক থেকে ওদিকে হাঁটছেন। দুটো হাত পিছনে। সেই তিনজন কর্মচারী তাঁদের চেয়ারে বসে আছেন চুপচাপ। নীল ভয় পেয়ে দেওয়ালের ঘড়িতে চোখ রাখল। তার মাত্র দু-মিনিট দেরি হয়েছে। তাই দেখে ডিসিলভা দুটো হাত সামনে এসে খিঁচিয়ে উঠলেন, ‘এখন কি আমি সারাদিন ধরে তোমার মুখদর্শন করে কাটাব?’
‘আমি খুব দু:খিত স্যার। কাল সারারাত কাজ করে এখানে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল।’
‘দেরি হয়ে গেল! দু-মিনিট আগে এলে কী উদ্ধার করতে?’
কথাটার অর্থ বুঝতে পারল না নীল। লোকটা এত খেপে গেল কেন?
ডিসিলভা কাছে এসে দাঁড়ালেন। ‘এই মেশিনটাকে চালু করতে পারবে?’
‘আমি? কখনও—।’
‘শেখোনি, তাই তো? যে জানে সে কাল রাতে বমি করে করে এখন নেতিয়ে পড়ে আছে। স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। কখন তিনি সুস্থ হবেন তা তিনিই জানেন।’ ডিসিলভা বললেন।
‘কী হয়েছে?’
‘কাল রাত্রে সবক’টা কম্পিউটার ডাউন হয়ে গিয়েছে। অতএব এখন তোমাদের মুখ দেখতে আমার একটুও ইচ্ছে করছে না। যে যার কেবিনে চলে যাও। এরা চালু হলে খবর পাবে। যাও।’
কেবিনে ফিরে এল নীল। ডিসিলভা লোকটা যতই রাগারাগি করুক, ওঁকে খারাপ লাগে না। নিছক কাজপাগল মানুষ। কিন্তু কম্পিউটারগুলোকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। এখন মনে হচ্ছে বিছানায় শোওয়ার সুযোগ পাওয়ায় সে বেঁচে গেল। গতকালের বীভৎস অভিজ্ঞতার পর কাজ করতে হয়েছে ভোর পর্যন্ত, শরীর আর নিতে পারছিল না। বিছানায় শরীর ফেলে দিতেই ঘুম এসে গেল।
ফারুক সাহেব যখন ঘুম ভাঙালেন তখন ভরদুপুর। ধড়মরিয়ে উঠে বসতেই তিনি বললেন, ‘এখন কেমন লাগছে?’
‘ভালো।’
‘যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। তোমার লাঞ্চ আমি নিয়ে এসেছি।’
‘সে কী!’ অবাক হল নীল।
‘এখন ক’টা বাজে তা তোমার খেয়ালে নেই। লাঞ্চ আওয়ার শেষ হয়ে গেছে, গেলে পেতে না।’
‘আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব—!’
‘ওই প্টেটা খালি করলেই সেটা জানানো হয়ে যাবে।’
ফ্রেশ হয়ে এসে খাবারে হাত দিল নীল। তার যে খুব খিদে পেয়েছে তা এতক্ষণ টের পায়নি, প্রথম কামড়ের পর সেটা মালুম হল। খেতে খেতে গত রাতের কথা মনে পড়ল তার। কিন্তু সরাসরি ওই প্রসঙ্গে না গিয়ে বলল, ‘স্যাম বলছিল, সমুদ্রে একবার বিপদ এলে পরের পর আসতে থাকে। ঠিক?’
‘দ্যাখো, নাবিকদের মনে যে কুসংস্কার জন্ম নেয় তার পেছনে কারণ থাকে। একবার কিছু ঘটে যাওয়া মানে সবসময় যে তাই ঘটবে এটা অনেকেই বুঝতে পারে না। এসব নিয়ে তুমি ভেবো না। এইসব জাহাজ অতি ভয়ংকর ঝড় না এলে তলিয়ে যাবে না।’ ফারুক সাহেব বললেন, ‘তোমার ডিউটি তিনটে থেকে।’
‘মানে? আপনি জানলেন কী করে?’
‘ওপর থেকে খবর দিয়ে গিয়েছে।’
খাওয়া শেষ হলে নীল বলল, ‘কাল রাত্রে আপনি আমাকে কিছু বলবেন বলে ভেবেছিলেন।’
ফারুক সাহেব হাসলেন, ‘ও-কথা থাক।’
‘তাহলে কাল বলতে চাইলেন কেন?’
‘মৃত্যুভয়। কাল যেভাবে জাহাজটা ঝড়ে নাচছিল, শরীর যুতে রাখতে পারছিলাম না, তখন মনে হয়েছিল মৃত্যু আসন্ন। তাই—।’
‘এখন মনে হচ্ছে বলার দরকার নেই?’
‘না।’
‘নাকি আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।’
ফারুক সাহেব একটু চুপ করে থাকলেন। ‘তোমাকে একটা ঘটনা বলি। তিরিশ হাজার ফুট উচুঁতে একটি বিমান উড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ পাইলট আবিষ্কার করেন যে বিমানের ট্যাঙ্কের নীচে ফুটো হওয়ায় তেল বেরিয়ে যাচ্ছে। প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর উড়ে চলা সেই প্লেনের নিকটবর্তী এয়ারপোর্টে নামতে হলে অন্তত একটি ঘণ্টা সময় দরকার। কিন্তু ততক্ষণ প্লেন উড়তে পারবে না, তেল শেষ হয়ে যাবে। বাধ্য হয়ে তিনি যাত্রীদের ব্যাপারটা জানালেন। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুভয়ে তারা কান্নাকাটি শুরু করল। সমুদ্রে প্লেন নামলে নির্ঘাত ডুবে মরতে হবে। আছড়ে পড়লেও একই অবস্থা। ওই প্লেনে একজন ধর্মযাজক ছিলেন। হঠাৎ একজন যাত্রী তাঁর সামনে গিয়ে বললেন, ‘ফাদার, মৃত্যু যখন অবশ্যম্ভাবী তখন মরার আগে আমি আমার পাপ কনফেস করে যেতে চাই।’ খ্রিস্টানদের ধারণা আছে, চার্চে গিয়ে ফাদারের কাছে পাপ স্বীকার করলে মৃত্যুর পরে খানিকটা মার্জনা পাওয়া যায়। লোকটা তার পাপের কথা বলল। বন্ধুকে ঠকিয়ে কীভাবে সে তার সব সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছে, তা স্বীকার করল। তাকে স্বীকারোক্তি করতে দেখে একে একে অন্য যাত্রীরাও একই কাজ করল। শেষ পর্যন্ত ধর্মযাজক বললেন, ‘তোমরা তোমাদের সব পাপ স্বীকার করেছ। এবার আমার পালা। আমিও অন্যায় করেছি। আমার সহযাজককে খাবারে বিষ মিশিয়ে মেরেছি কারণ সে আমার পথের কাঁটা ছিল।’ সবাই চুপচাপ। একঘণ্টা শেষ হয়ে আসছে। যে-কোনও মুহূর্তে বিস্ফোরণ হবে। একজন চেঁচিয়ে বলল, ‘ঈশ্বর আমাকে আশ্রয় দাও।’ তখনই ঘর্ষণের শব্দ হল। বালির ওপর দিয়ে চাকা গড়িয়ে চলল দ্রুত। পাইলট তাঁর দক্ষতা দেখিয়ে সমুদ্রের তটে নামিয়ে এনেছেন জাহাজটাকে। অনেকটা চলার পর বিমান থেমে গেলে পাইলট বেরিয়ে এসে চিৎকার করলেন, ‘থ্যাঙ্ক গড। আমরা বেঁচে গেছি। আর কোনও বিপদ নেই।’
কিন্তু যাত্রীদের কেউ একটি কথাও বলতে পারছিল না। কেউ কারও দিকে তাকাতে পারছিল না। গতরাতে যদি আমি তোমাকে কথাগুলো বলতাম তাহলে আজ আমারও ওই অবস্থা হত।’
নীল মাথা নাড়ল, ‘সরি। আমি আপনাকে আর অনুরোধ করব না।’
‘তোমার দু:খিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। আমার শরীরের অবস্থা খুব ভালো নয়। ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছি। হয়তো এটাই আমার শেষ সমুদ্রযাত্রা। কিন্তু তার মধ্যেই তো শেষ দিনটা এসে যেতে পারে। একজন মানুষকে তাই কথাগুলো বলা দরকার। কিন্তু এখন নয়। রাত নামুক। তখন তোমাকে সব কথা বলব। আচ্ছা, চলি।’ ফারুক সাহেব চলে গেলেন।
ঘড়িতে তিনটে বাজতে বেশি দেরি নেই। নীল তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে ওপরের অফিসে পৌঁছে যেতেই ডিসিলভাসাহেব একমুখ হাসি নিয়ে বললেন, ‘ওয়েলকাম, তুমি তিনমিনিট আগে পৌঁছে গেছ।’
রাত নেমেছে সমুদ্রে। আকাশে লক্ষ-লক্ষ হিরে জ্বলছে। কোথাও এক ফোঁটা কালো মেঘ নেই। জাহাজ চলেছে রাজার মতো। ফারুক সাহেবকে খুঁজতে খুঁজতে নীল একেবারে ওপরের ডেকের মুখে পৌঁছে দেখেন তিনি নামাজ পড়ছেন। সাধারণত এখানে তিনি নামাজ পড়তে উঠে আসেন না। আর এত রাতে মুসলমানরা নামাজ পড়েন কি না তা তার জানা নেই।
ফারুক সাহেবের নামাজ পড়া শেষ হয়ে গেলে বাবু হয়ে বসলেন, ‘তুমি!’
‘আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে চলে এলাম। আপনি এইসময়ে নামাজ পড়ছেন?’
ফারুক সাহেব হাসলেন, ‘মাথার ওপর আল্লার সৃষ্টি, নীচে তাকালেও তাই।’ সব শান্ত, সব সুন্দর। এখনকার নামাজকে তাহাজুক বলে। দিনের পাঁচ নামাজের চেয়েও এই নামাজ মূল্যবান। তা আমাকে খুঁজছিলে কেন?’
‘কোনও কারণ নেই।’ হাওয়া বইছিল। বেশ শীতল হাওয়া। নীল খানিকটা কাছে এসে বসল।
‘ভালোই হল। আচ্ছা নীল, তুমি কখনও বাংলাদেশে গিয়েছ?’
‘না।’
‘চট্টগ্রামের চার ঘণ্টা দূরে কক্সবাজারের সমুদ্রতটকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা বিচ। ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গেও সমুদ্রতীর অনেকটা লম্বা হতে পারত যদি মন্দারমণি থেকে জুনপুট হয়ে দীঘা পেরিয়ে উদয়পুর অবধি একটা টানা বিচ তৈরি হত। সমুদ্রে ভেসে ভেসে বিচ দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।’
‘আপনি হঠাৎ বিচের কথা বলছেন কেন?’
‘আমার এক সহনাবিকের নাম ছিল ইয়াসিন। সে যে জাহাজে কাজ করত তা পেট্রল বহন করত। একবার জাহাজটা পর্তুগিজ জলদস্যুদের হাতে পড়ে। অনেকের মতো ইয়াসিনকে ধরে নিয়ে যায় তারা। তেল খালি করে জাহাজটাকে ডুবিয়ে দেয়। ইয়াসিন প্রায় মাসখানেক বন্দি হয়ে থাকে। তারপর একটা সুযোগ পেয়ে পালিয়ে আসে। সে কী করে কক্সবাজারে পৌঁছোল তার বর্ণনা শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে। সেটা বলছি না এখন।’
‘তারপর?’
‘কক্সবাজারে মাসখানেক ছিল ইয়াসিন। তখন আমি ঢাকায়। ফোন করে আমাকে ডেকে নিল সে। তারপর কারণটা জানাল। জলদস্যুদের কাছ থেকে পালাবার সময় সে এক ব্যাগ হিরে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু সেগুলো সে বিক্রি করতে পারছে না। পুলিশের ভয়, মানুষের ভয়। সে আমাকে সাহায্য করতে বলে। কারণ তার মনে হচ্ছিল কয়েকজন কেবলই তাকে অনুসরণ করে চলেছে। আমি তাকে সাহায্য কীভাবে করব? তখন স্থির হয় হিরেগুলো কিছুদিন কোথাও লুকিয়ে রাখতে হবে। যখন সব শান্ত হয়ে যাবে তখন একটা একটা করে বিক্রি করে দিলেই হবে। ইয়াসিন স্থির করল অন্তত একটা বছর সে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে সাধারণ নাগরিকের জীবনযাপন করবে। কিন্তু কোথায় লুকোবে হিরেগুলো। দেখলাম গোটা আটেক বেশ বড় হিরে। কোটি টাকার ওপর দাম হবে নিশ্চয়ই। শেষে মতলব এল। কক্সবাজারের সমুদ্রতটের একটা জায়গা আছে সেখানে দাঁড়ালে মনে হবে সমুদ্র পায়ের নীচে ডুবে যাচ্ছে। সেই জায়গায় তীরের মধ্যে কয়েকটা নারকোল গাছ বহুকাল থেকে দাঁড়িয়ে। সেই গাছগুলোর মধ্যে দু-হাত বালি খুঁড়ে একটা টিনের কৌটায় হিরেগুলো লুকিয়ে রাখা হবে। মতলব মতো এক গভীর রাতে আমরা কাজটা করে এলাম। ভোরের বাস ধরে আমি চলে এলাম ঢাকায়। কিন্তু দুদিন পরে খবর পেলাম ইয়াসিন খুন হয়ে গিয়েছে। ভয়ে আমি আর কক্সবাজারে যেতে পারিনি।’
ফারুক সাহেব শ্বাস ফেলল।