দুই
ঠিক পাঁচটা বাজতে পাঁচ মিনিট আগে ভিউগল বেজে উঠল। জাহাজের সর্বত্র সেই আওয়াজ ছড়িয়ে পড়তেই নীল মুখ তুলে তাকাল। সারাদিনে অনেকটা কাজ সে শেষ করলেও এখনও ঘণ্টা দুয়েক খাটতে হবে। নীল মুখ ফিরিয়ে দেখল ঘরের অন্যদিকে যে তিনজন গম্ভীর মুখে কাজ করে যাচ্ছিলেন, তাঁরা এখন তার দিকে তাকিয়ে আছেন। এইসময় ডিসিলভা ঘরে ঢুকে ব্যস্ত হয়ে টেবিল থেকে চশমা তুলে চোখে আঁটতে আঁটতে বললেন, ‘ক্যাপ্টেন চাইছেন আমি ওখানে যেন উপস্থিত থাকি। সমস্যা হল আমাকে নিয়ে। জন গাব্রিয়েল লোকটা ছিল খুব অলস। প্রায়ই বকাঝকা করতাম। বহুদিন জাহাজে কাজ করছে বলে ক্যাপ্টেন ওকে স্যাক করেননি। সেই লোকটা আমার আগে মরে যেতে একটু অবাক এবং অনেক ধাক্কা খেয়েছিলাম। তার আজ জলসমাধি হবে, দৃশ্যটি দেখতে আমার ভালো লাগবে না। কিন্তু যেতেই হবে। ওয়েল, তোমাদের মধ্যে কে যাবে?’
নীল বলল, ‘আমাকে যেতে বলা হয়েছে।’
‘গুড। জাহাজে নতুন ঢুকেছ, সব ব্যাপারে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করো। যাও, আমি আসছি।’ ডিসিলভা টয়লেটে ঢুকে গেলেন।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ফারুক সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, মাথায় সাদা টুপি পরে ভদ্রলোক পাশে এসে দাঁড়ালেন, ‘চলো।’
নীচের ডেকে তখন বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়ে গেছেন। ফারুক সাহেবের সঙ্গে তাঁদের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল নীল। ক্যাপ্টেন এবং তাঁর অফিসাররা একদিকে সরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন। এবার ডিসিলভা তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন।
এতক্ষণ সূর্য বেশ কড়া রোদ ছড়াচ্ছিল, এবার তার তেজ নরম হল। নীল দেখল আদিগন্ত ছোট ছোট ঢেউ-এর ওপর রোদ পড়ায় সেগুলো চকচক করছে। মাথার ওপর কোনও পাখি নেই। হঠাৎ একটা গুঞ্জন উঠল। ফারুক সাহেব চাপা গলায় বললেন, ‘শার্ক, বুঝতে পারছ?’
নীল ঢেউগুলো ভালোভাবে লক্ষ করতেই জলের ওপর মাঝে মাঝে উঠে আসা হাঙরের পিঠের উঁচু অংশগুলো দেখতে পেল। একটা নয়, গোটা চার-পাঁচ।
ফারুক সাহেব বললেন, ‘বেশ বড় শার্ক। সাধারণত ওরা সমুদ্রের এত ভেতরে আসে না। কে জানে, হয়তো জাহাজের পেছন পেছন চলে এসেছে।’
জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে শার্কগুলোকে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। হঠাৎ নীলের মনে হল, হরিণ, গরু বা জেব্রার সঙ্গে মানুষের এক জায়গায় মিল আছে। জঙ্গলে বাঘ, সিংহ অথবা হায়েনার সামনে কোনও মানুষ দাঁড়াতে পারে না ওদের মতো। জলে কুমির অথবা হাঙরের মোকাবিলা করার ক্ষমতা মানুষের নেই। এসব সত্বেও ওই অবলা প্রাণীদের মতো মানুষের সংখ্যা প্রতিদিন বেড়ে যাচ্ছে আর ভয়ংকর প্রাণীগুলোর সংখ্যা কমে যাচ্ছে দ্রুত।
এবার ক্যাপ্টেন সামনে এসে দাঁড়ালেন, ‘আমরা খুবই দু:খিত। আমাদের প্রিয় সহকর্মী জন গ্যাব্রিয়েল যে মহাশক্তির পথে চলে গেছেন তা আপনারা জানেন। আমরা তাঁর মরদেহ আজ সমুদ্রের জলে সমর্পণ করব বলে ঠিক করেছি। আবহাওয়ার রিপোর্ট বলছে আজ সন্ধের পরে দুর্যোগ আসতে পারে। তার প্রভাব পড়বে সমুদ্রে। তাই এখন, এই শান্ত সময়ে সূর্যাস্তের কালে জন গাব্রিয়েলের মরদেহের কফিন জলে নামিয়ে দিতে চাইছি। কিন্তু—।’ ক্যাপ্টেন একটু থামলেন, ‘কিন্তু সমস্যা তৈরি করেছে কয়েকটি বিশাল হাঙর। আপনারা দেখছেন ওরা জলে পাক খাচ্ছে। কফিন নামিয়ে দেওয়ামাত্র ওরা ঝাঁপিয়ে পড়বে, ভেঙে ফেলবে কাঠ। জন গ্যাব্রিয়েলের মৃত শরীর হাঙরের পেটে যাক তা আমরা চাই না। আপনারা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন।’
তারপরে দৃশ্যটি দেখল নীল। দুটো রাইফেলের মতো দেখতে অস্ত্র এনে ক্যাপ্টেন এবং সহকারীর হাতে দিল দুজন নাবিক। রেলিং-এর ধারে গিয়ে জলের ওপর নজর রেখে ট্রিগার টিপতে লাগলেন ওঁরা। ভয়ংকর শব্দে জলে আলোড়ন শুরু হল। একটা হাঙর অবশেষে পেট উলটে ভেসে উঠতেই অন্য দুটো তাকে টেনে নীচে নামিয়ে নিয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ ধরে আক্রমণ করার পর ওঁরা থামলে দেখা গেল জল শান্ত, আর কোনও হাঙরের অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে না।
অস্ত্রগুলো ফিরিয়ে দিয়ে ক্যাপ্টেন ইশারা করলেন। চারজন নাবিক কফিন বয়ে নিয়ে সামনে রাখল। একজন অফিসার বাইবেল খুলে কফিনের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েক লাইন পড়লেন। ক্যাপ্টেন ঘোষণা করলেন, ‘এবার আপনারা শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারেন।’
সবাই লাইন দিয়ে কফিনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মাথা নীচু করল, কেউ কেউ নমস্কার। নীলের আগে ছিলেন ফারুক সাহেব। তিনি টুপি খুলে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে নীরবে প্রার্থনা করলেন এক মিনিট। তাঁর পরে নীল চোখ বন্ধ করে মাথা নীচু করে থেকে সরে এল। এবার ক্যাপ্টেন তাঁর পকেট থেকে একটা ছোট লাল গোলাপ ফুল বের করে কফিনের অংশটায় গুঁজে দিলেন। নীল চাপা গলায় ফারুক সাহেবকে জিগ্যেস করল, ‘জাহাজে ফুল পাওয়া যায়?’
‘না। তবে ক্যাপ্টেনের বসার ঘরে কয়েকটা ফুলের টব দেখেছি। তাতেই ফুটেছে ফুল।’ ফারুক সাহেব বললেন, ‘জন গাব্রিয়েলের সৌভাগ্য যে তার মরদেহ শেষ সময়ে একটা ফুল পেল। অবশ্য তাতে তার কিছু এসে যাচ্ছে না। সে তো অনেক আগেই এসবের ঊর্ধ্বে চলে গেছে।’
এইসময় বিউগল বেজে উঠল। নাবিকরা পাঁচজন শূন্যে গুলি ছুড়লেন, তারপর দড়িতে বাঁধা কফিন ধীরে ধীরে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হল। দড়ি কাটতেই সেটা টুক করে ডুবে গেল অতলে। নীল জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, ওই কফিনের ভেতরে কি জল ঢুকবে?’
‘ছিদ্র থাকলে ঢুকবে। না থাকলে কাঠ যখন হোক একসময় পচে যাবে। জল ঢুকতে অসুবিধে হবে না। অবশ্য তার আগেই ওরা কফিন ভেঙে ফেলতে পারে।’ ফারুক সাহেব বললেন।
‘ওরা মানে? শার্কগুলো তো পালিয়ে গেছে।’ নীল বলল।
‘দ্যাখো ভাই, পৃথিবীর মাটির ওপর যত প্রাণী আছে তার কয়েকগুণ বেশি আছে জলের তলায়। মানুষ পৃথিবীর সব কোণ আবিষ্কার করে ফেলেছে, কিন্তু সেটা মাটির ওপরের পৃথিবীর, সমুদ্রের নীচটা এখনও মানুষের কাছে রহস্যময়। তুমি তো জানো এই পৃথিবীর মাত্র এক ভাগ মাটি, তিনভাগ জল। ওই জলে হাঙর ছাড়াও কত প্রাণী বাস করে তার ইয়ত্তা নেই। সবাই প্রতি মুহূর্তে খাবার খুঁজছে। কফিনের ভেতরের মানুষের গন্ধ ওরা ঠিক পেয়ে যাবে।’ ফারুক সাহেব বললেন, ‘চলো, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। সূর্যাস্ত দেখতে হলে ওপরের ডেকে যেতে হবে।’
‘না। আমার কাজ এখনও বাকি আছে।’ নীল বলল।
হাসলেন ফারুক সাহেব, ‘জাহাজের নিয়ম হল সমাধি দেওয়ার পর সমস্ত কাজ, যা না করলেই নয়, বন্ধ রাখতে হবে। মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার জন্য।’
দোতলার ডেক থেকে সমুদ্রের অনেকটা দেখা যায়। সূর্য ডুবছে। রোদ আর নেই। যে আলোটা এখনও আকাশে এবং জলে, তার রং ফ্যাকাসে। নীল নীচের দিকে তাকাল। জন গ্যাব্রিয়েলকে সে দ্যাখেনি। তার জন্যে শোক তার মনে আসা স্বাভাবিক নয়। কিন্তু আত্মীয়-স্বজন বিহীন মানুষটার শরীর ওই অতল জলের নীচে একটা কফিনে শুয়ে আছে ভাবলেই কীরকম লাগে।
ধীরে ধীরে সূর্যের অর্ধেক শরীর জলের নীচে চলে গেল। বাকিটা ঢেউ-এর কারণে একবার উঠছে। একবার ডুবছে। আকাশে কী দারুণ রঙের খেলা। মুগ্ধ হয়ে দেখছিল নীল। ক্রমশ জলের চেহারা বদলে যাচ্ছে। ছায়া যত ঘন হচ্ছে তত কালচে হয়ে যাচ্ছে তার রং। শেষ পর্যন্ত সূর্যকে দেখা না গেলেও সমুদ্রের ওপর ছায়া ঘন অন্ধকারে পরিণত হয়নি। ঠিক তখনই দুটো কাঠকে ভেসে উঠতে দেখল নীল। ঢেউ-এর তালে ভাসতে ভাসতে জাহাজের পাশাপাশি যাচ্ছিল কাঠগুলো। সমুদ্রের এত গভীরে কাঠ কী করে ভেসে আসবে? সোজা হয়ে দাঁড়াল নীল। জন গ্যাব্রিয়েলের কফিনের কাঠ নয় তো? ভালো দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু হঠাৎ শুঁড়ের মতো কিছু কাঠদুটোকে টেনে নিয়ে গেল জলের ভিতরে। আর দেখা গেল না। সমুদ্রে অন্ধকার নামল।
ফারুক সাহেব নামাজ পড়ছিলেন। এই যে বারংবার উঠে দাঁড়ানো, প্রার্থনা করা, আবার হাঁটুমুড়ে প্রণামের ভঙ্গিতে মাথা নামানোর মধ্যে একটা ডিসিপ্লিন আছে বলে মনে হচ্ছিল নীলের। এই বয়স্ক মানুষটি যে সাবলীলভাবে প্রার্থনা করছেন তাতে তাঁর মন এবং শরীর এক হয়ে আছে। নামাজ শেষ করে ফারুক সাহেব তাঁর আসন ভাঁজ করে উঠে দাঁড়ালেন। নীলকে দেখে বললেন, ‘কখন এসেছ?’
‘খানিকক্ষণ আগে। আচ্ছা, দিনে পাঁচবার নামাজ পড়ে আপনি খুব আনন্দ পান, না?’
‘অবশ্যই। আল্লার দোয়া না পেলে আমার জীবন তো মরুভূমি হয়ে যাবে। তুমি তো খ্রিস্টান?’
‘হ্যাঁ। মায়ের সঙ্গে আগে প্রতি রবিবার চার্চে যেতাম। কয়েকবছর হল শুধু খ্রিস্টমাস ইভে যাচ্ছি। কেন জানি না, এই ব্যাপারটা আমাকে টানে না। মা খুব বকত।’ নীল বলল।
ফারুক সাহেব হাসলেন, ‘দ্যাখো, যে যেভাবে ভালো থাকে তার তা-ই করা উচিত। কোনও কাজ করে যদি পরে আপশোস হয় তাহলে বুঝতে হবে খারাপ কাজ করা হয়েছে। তখন তার প্রায়শ্চিত্তের জন্য ভালো কাজ করা দরকার। এই ভালো কাজ তো অনেকরকমের। আল্লার কাছে নিজেকে সমর্পণ করা আবার অতি অসহায় মানুষের সেবা, যে যেমন করতে পারে। চলো।’
ঠিক সময়ে ক্যান্টিনে টিফিন এবং চা দেওয়া হয়। ফারুক সাহেবের সঙ্গে সেখানে চলে এল নীল। আজকের টিফিন ফিশফ্রাই। দুজনে তাই নিয়ে মুখোমুখি বসলে নীল জিজ্ঞাসা করল, ‘সমুদ্রে কোন কোন প্রাণীর লম্বা শুঁড় থাকতে পারে?’
ফারুক সাহেব বললেন, ‘প্রথমেই মনে পড়বে অক্টোপাসের কথা। তবে অনেক নীচে কিছু কিছু প্রাণী আছে যাদের মাছ বলা যায় না, তাদেরও শুঁড় আছে। জাহাজের লাইব্রেরিতে গেলে এসবের ছবি বইতে দেখতে পাবে। তবে ওইসব প্রাণী ভুলেও জলের ওপরে উঠে আসে না।’
‘তাহলে আমি অক্টোপাসের শুঁড় দেখতে পেয়েছি।’ নীল বলল।’
‘কীরকম?’
কাঠের টুকরোর ব্যাপারটা ফারুক সাহেবকে বলল নীল।
মুখ নীচু করলেন ফারুক সাহেব। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ থেকে বললেন, ‘ক্যাপ্টেন চেয়েছিলেন মৃতদেহটা হাঙরের পেটে না যাক। কিন্তু ভুলে গিয়েছিলেন হাঙর ছাড়াও অনেক হিংস্র প্রাণী বাস করে। আমি নিশ্চিত, ওই কাঠের টুকরোগুলো কফিনের ভাঙা অংশ। জন গ্যাব্রিয়েলের শরীরের কোনও কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। তুমি হয়তো কোনও কৌতূহলী অক্টোপাসের শুঁড় দেখেছ। হয়তো আমারও এই পরিণতি হবে।’ শ্বাস ফেললেন ভদ্রলোক।
‘একথা কেন বলছেন? আপনি নিশ্চয়ই একসময় অবসর নিয়ে ডাঙায়ে ফিরে যাবেন। সেখানে শান্তিতে থাকবেন।’ নীল বলল।
‘জনের সঙ্গে আমার অনেকটা মিল আছে। একজন ছাড়া পৃথিবীতে কেউ আমার কথা ভাবে কি না সন্দেহ। কিন্তু তাকে বিরক্ত করতে আমি চাই না বলে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছি। জাহাজ ছেড়ে মাটিতে যেতে ইচ্ছে করে না। প্রতিটি মানুষ, যাঁরা জাহাজে কাজ করে তাঁরা কেউ চার মাস বা ছ’মাস জলে থেকে মাটিতে ফিরে যায়। আমি দুই মাসের মধ্যে জাহাজে ফিরে আসি। এখন তো সবাই আমাকে চেনে, তাই যে-কোনও জাহাজেই কাজ পেয়ে যাই।’
‘যাঁর কথা বলছেন তিনি কে?’
ফারুক সাহেব তাকালেন, ‘ওকথা থাক।’
তারপর প্রসঙ্গ বদলাতেই বললেন, ‘কাল বা পরশু আমাদের এই জাহাজ আফ্রিকার তীর ধরে যাবে। এই জায়গায় যখনই জাহাজ আসে তখনই আমি ভয়ে ভয়ে থাকি। স্বস্তি পাই না।’
‘কেন?’ নীল জানতে চাইল।
‘পাইরেটসদের জন্যে। বিশেষ করে সোমালিয়ার পাইরেটস। অত্যন্ত ভয়ংকর, দয়ামায়ার ধার ধারে না। তুমি ওদের কথা শোনোনি?’
‘আবছা, আবছা। পরিষ্কার ধারণা নেই। একটু বলুন, প্লিজ।’
‘সোমালিয়ার পাইরেটসরা দু-হাজার বারো সাল পর্যন্ত ভয়ংকর লুঠপাট করত। আন্তর্জাতিক স্তরে চেষ্টা করে এদের বিভিন্ন জাহাজ দখল করে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আদায় করার খেলা বন্ধ করা হয়েছিল বলে সবাই ভেবেছিল। কিন্তু বেশি দিন দেরি হয়নি, পাইরেটস আবার সক্রিয় হয়ে কেনিয়ার কোস্টে ট্যুরিজম শিল্পকে বিধ্বস্ত করেছিল। রিসর্ট থেকে ট্যুরিস্টদের ধরে নিয়ে গিয়ে মোটা ডলার আদায় করে ছাড়ছিল। একসময় মাছ ধরাই যাদের জীবিকা ছিল তারা আবার দু-হাজার তোরো সাল থেকে বন্দুক হাতে তুলে নিল। বিবিসির রিপোর্ট অনুযায়ী দু-হাজার দশ সালে পাইরেটসরা এক হাজার একশো একাশিজনকে বন্দি করে মিলিয়ন ডলার রোজগার করেছিল। দু-হাজার এগারো সালের গ্রীষ্মের সময় ওরা তিনশো মানুষকে ইলোপ করে। আন্তর্জাতিক ম্যারিটাইম ব্যুরো যাকে সংক্ষেপে আইএমবি বলে, ঘোষণা করে সোমালিয়ার সমুদ্রকূল হল পৃথিবীর সব চেয়ে কুখ্যাত অঞ্চল। একটা সময় পাইরেটদের কবলে একডজন জাহাজ চলে গিয়েছিল যাদের মধ্যে তেলের ট্যাঙ্কারও ছিল। এদের বিনিময়ে ওরা পঁচিশ মিলিয়ন ডলার দাবি করে।’ ফারুক সাহেব বললেন।
‘ওরা কীভাবে অ্যাটাক করে?’
‘ধরো আটজন পাইরেট আধুনিক অস্ত্র নিয়ে কোনও জাহাজকে আক্রমণ করে। জাহাজটা গতি বাড়িয়ে ২২.৮ নট গতিতে পালাবার চেষ্টা করে কিন্তু পাইরেটরা তাদের বোটের ২৩.৫ নটে গিয়ে অনুসরণ করে। কাছাকাছি পৌঁছে তারা গুলি বর্ষণ শুরু করে। খুব কমক্ষেত্রে ওরা অসফল হয়ে ফিরে যায়।’
‘কেন? কেন ওরা পাইরেসি করে?’
‘দ্যাখো সোমালিয়া সমুদ্রতীরভূমি বিশাল। আফ্রিকার অনেকটা ওদের দখলে। দু-হাজার আট সাল পর্যন্ত পাইরেটরা দি গাল্ফ অফ অ্যাভেনের সরু খালে অপারেশন করত। তাতে সফল হয়ে লোভ বেড়ে গেল ওদের। বেশ কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে ওরা দ্রুতগামী স্পিডবোট সংগ্রহ করে কাজ শুরু করল। জাহাজ দখল করার সময়ে যদি বাধা পায় তাহলে নিমেষে খুন করতে দ্বিধা করে না। এই কারণে আফ্রিকার তীরে জাহাজ গেলে আমি ভয় পাই।’
একটু একটু করে মেঘ জমছে আকাশে। অন্যরাতে আকাশ পরিষ্কার থাকলে লক্ষ লক্ষ তারা চেয়ে থাকে সমুদ্রের দিকে। তাদের আলোয় অন্ধকার জমাট বাঁধতে পারে না। চারধার চমৎকার মায়াবী হয়ে যায়। কিন্তু আজ দৃষ্টি বেশিদূর যাচ্ছে না। নীল নিজেদের কেবিনে যেতে দেখল স্যাম ল্যাপটপের সামনে মগ্ন হয়ে বসে আছে। কৌতূহল হল।
তাকে দেখে স্যাম হাসল, ‘কাল দুপুরে আমরা আফ্রিকার কোস্টে পৌঁছে যাব।’
‘সর্বনাশ!’
‘কেন? সর্বনাশ কেন?’
‘শুনেছি ওখানে পাইরেটরা খুব অত্যাচার করে।’
‘করে! তবে ওরা সাধারণত অয়েলট্যাঙ্কার হাইজ্যাক করে। আমাদের জাহাজ যা নিয়ে যাচ্ছে তা ওদের আকর্ষণ করবে না।’ স্যাম বলল।
‘এই জাহজে কী আছে তা ওরা জানবে কী করে?’
শব্দ করে হাসল স্যাম, ‘তুমি ওদের কী ভাবো? ওই কোস্টে যেসব জাহাজ যেতে বাধ্য হয় তার পেটে কী কী জিনিস আছে তা ওদের নখদর্পণে থাকে। কোন জাহাজে কত মানুষ, কী কী আর্মস আছে তাও ওদের জানা। চমৎকার নেটওয়ার্ক করে রেখেছে। এই দ্যাখো, আমরা এখন সমুদ্রের এখানে। যেতে হলে এদিকে এগোতে হবে,’ ল্যাপটপের মাউস ঘোরাল স্যাম, ‘ওই দ্যাখো আফ্রিকার কোস্ট।’
‘তুমি আগে ওইদিক দিয়ে জাহাজে গিয়েছ?’
‘হ্যাঁ। কোনও বিপদে পড়িনি।’
‘সোমালিয়া দেশটা কীরকম?’
‘খুব খারাপ। গরিব মানুষ ওরা। অনাহারে মারা যায় অনেকেই।’
‘তাহলে ওরা পাইরেট হল কী করে?’
‘মরিয়া হয়ে। যারা একসময় মাছ ধরত, সমুদ্রের খবর জানত, তারা দেখল পরিশ্রম করে কিছু হচ্ছে না। আরও রোজগারের ধান্দায় ওরা জাহাজগুলোয় হামলা করতে শুরু করল। বুঝতেই পারছ, ওখানকার সমস্ত মানুষ পাইরেট নয়। যারা হত তাদের অবস্থা ভালো হয়ে গেল। বাকিরা যেমন গরিব ছিল তেমনই রইল। তবে সংঘর্ষে কত পাইরেট যে মারা গিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।’ স্যাম গম্ভীর হল।
‘ওরা নিশ্চয়ই খুব শক্তিশালী।’
‘আফ্রিকানদের চেহারা যেমন হয়। লম্বা, পেটাই চেহারা। ওদের প্রধান ভাষা দুটো। এক সোমালি, দুই আরবিক। দাঁড়াও।’ ল্যাপটপে ঝুঁকে পড়ল স্যাম, তারপর বলল, ‘এই মুহূর্তে সোমালিয়ার মানুষরা চোদ্দোরকম ভাষায় কথা বলে থাকে। অর্থাৎ চোদ্দোটি ভাষাই বেঁচে আছে। কিন্তু অন্যভাষাভাষীর সঙ্গে কথা বলতে ওরা সোমালি বা আরবিক ব্যবহার করে। তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আরে আমরা জলের ওপর কাজ করার ঝুঁকি নিয়েছি। অর্থাৎ আমরা যেচে বিপদের মধ্যে চলে এসেছি। এখন আর বিপদের ভয় করে কী হবে!’
স্যাম আবার ল্যাপটপের ওপর ঝুঁকে পড়ল।
জাহাজ যখন মাঝসমুদ্রে চলে তখন তার একটা বিশেষ ছন্দ থাকে। কেবিনে শুয়েও তাতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু আজ রাতে খাওয়ার পরে বিছানায় শুতেই মনে হল সেই ছন্দটা আর নেই। জাহাজের দুলুনিটা একটু বেড়ে গেছে। তার কেবিনমেটরা নি:শব্দে শুয়ে আছে। ঘুমিয়েও পড়েছে কেউ। নীল বিছানা ছেড়ে কেবিনের বাইরে বেরিয়ে এসেই ফারুক সাহেবকে দেখতে পেল। জাহাজ বেশ দুলতে দুলতে চলেছে।
তাকে দেখে ফারুক সাহেব বললেন, ‘ওয়েদার খারাপ হয়ে যাচ্ছে। খুব শিগগির ঝড় আসবে। তোমার এটা প্রথমবার, তাড়াতাড়ি বমির ওষুধ খেয়ে নাও।’
‘কেন?’
‘জাহাজ যখন লাফাবে তখন তোমার পেটের ভেতরটা শান্ত থাকবে না।’
‘এতবড় জাহাজ লাফাবে?’
‘হ্যাঁ।’ ফারুক সাহেব বললেন। ‘একটা বড় পুকুরে দেশলাইবাক্স যা এই সমুদ্রে জাহাজটাও তেমনি। সঙ্গে নিশ্চয়ই নেই?’
‘না।’
ফারুক সাহেব তাঁর কেবিন থেকে একটা জলের বোতল আর ট্যাবলেট এনে দিলেন। সেটা গলায় ঢালা মাত্র সাইরেন বেজে উঠল। পরপর দুবার।
‘ওটা কেন বাজছে?’ নীল জিজ্ঞাসা করল।
‘অ্যালার্ট করার জন্যে।’ এখন কেউ আর শুয়ে বা ঘুমিয়ে থাকতে পারবে না। প্রত্যেককেই অ্যালার্ট হয়ে থাকতে হবে।’
‘কী বলছেন আপনি? এখনও ঝড়ে জাহাজ ডুবে যায়?’
‘না। বেশিরভাগ জাহাজই এখন মোকাবিলা করতে পারে। কিন্তু ঘটনাটা যে ঘটে না তাও বলা যায় না। ভাঙচুর তো হতেই পারে।’
ফারুক সাহেবের কথা শেষ হতেই সোঁ সোঁ আওয়াজ শুরু হল। যেন ভয়ংকর দৈত্যরা সমুদ্রের পূর্বদিক থেকে তেড়ে আসছে জাহাজের দিকে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চাবুক ঝাঁপিয়ে পড়ছে সমুদ্রের জলে। বিশাল বিশাল ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে জাহাজটা। এক-একবার প্রায় তিরিশফুট নীচে নেমে যাচ্ছে সামনের দিকটা, পরক্ষণেই উঠে আসছে। সেইসঙ্গে শুরু হল বৃষ্টি।
হঠাৎ ফারুক সাহেব বললেন, ‘নীল, তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। আমি যদি তোমাকে কিছু বলি তাহলে নিশ্চয়ই তুমি তার মর্যাদা রাখবে?’
‘নিশ্চয়ই।’
‘আমার জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে যা কাউকে বলিনি। যদি দ্যাখো আমার কিছু হয়ে গেল, জন গ্যাব্রিয়েলের মতো আমাকেও সলিলসমাধি দেওয়া হল, তাহলে আশা করব তোমাকে যা বলে যাব তুমি সেই কাজটা করবে।’
ফারুক সাহেবের কথার মাঝখানেই জাহাজ এমনভাবে লাফিয়ে উঠল যে ছিটকে পড়ে গলে নীল। সঙ্গে সঙ্গে তার পেটের ভেতরটা মোচড়াতে লাগল। হাঁটু এবং কনুইতে লাগলেও মনে হল পেটের সব কিছু বেরিয়ে যাবে।
সে মেঝেতে শুয়ে একটা রড আঁকড়ে ধরে স্থির হয়ে গেল।