কানফাটা শব্দ নীচে থেকে উঠে আসছে। ওটা যে জলপ্রপাতের কারণে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু নীল যেখানে পৌঁছে গেল সেখান থেকে সামনে এগোনোর কোনও উপায় নেই। অনেক নীচে আদিগন্ত সমুদ্র, স্পষ্ট। এমনকী তার ছোট-বড় ঢেউগুলোও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। যেখানে সে দাঁড়িয়ে আছে সেই জায়গাটা এতটাই খাড়াই যে পাহাড় বেয়ে নীচে নামার কোনও সুযোগই নেই। নীল শ্বাস ফেলল। ভেতরে চিৎকার শুরু হয়েছে। অর্থাৎ তার খোঁজে লোকে ছোটাছুটি করছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে মৃত্যু অনিবার্য। এখন দেখামাত্রই ওরা তাকে গুলি করবে। নীল ঈষৎ নীচের দিকে ঝুঁকতেই পাথরটাকে দেখতে পেল। পাহাড়ের ভেতর থেকে বড়জোর ফুট তিনেকের একটা চাঁই বেরিয়ে আছে। তার তলায় কী আছে তা বোঝা যাচ্ছে না, কারণ দৃষ্টি পৌঁছোচ্ছে না তার নীচে। কিন্তু ওই পাথরের ওপর পৌঁছাতে হলে অন্তত বারো ফুট লাফ দিয়ে নীচে নামতে হবে। ঠিক তখনই গুলির শব্দ হল। গুলিটা কাছাকাছি পাথরে ছিটকে চলে যেতে নীল আর দ্বিধা করল না। পাহাড়ের গা ঘেঁষে শরীরটাকে নীচে ছেড়ে দিল।
পায়ের নীচে পাথরটা চলে আসতেই সে দু-হাতে পাহাড়টাকে আঁকড়ে ধরল। অনেক নীচে সমুদ্রের ঢেউ, ওপরে আকাশ। কিন্তু পাথরটা যার ওপর সে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যেন একটু নড়ে উঠল। ওটা যে বেশিক্ষণ তাকে বহন করতে পারবে না বুঝতে পেরে চারপাশে তাকাল নীল। কোথাও কোনও ধরার জায়গা নেই। এইভাবে তিন ফুট পাথরের ওপর অনন্তকাল দাঁড়িয়ে থাকাও সম্ভব নয়। হঠাৎ চিৎকার কানে আসতেই নীল ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখল একটা মুখে কুৎসিত আনন্দের অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে তাকে দেখতে পেয়ে; তার পরেই লোকটার দুটো হাত আর রাইফেল দেখতে পেল সে। এবার সরাসরি গুলি করবে তাকে। বারো ফুট দূরত্বের কাউকে গুলি করতে এবার নিশ্চয়ই লোকটা ভুল করবে না।
নীল আর ভাবতে পারল না। মরতে হবেই যখন এত কাছ থেকে গুলি খেয়ে কেন মরবে! সে ঝাঁপ দিল শূন্যে। তার মধ্যেই কানে গুলির শব্দ ভেসে এল। না তার শরীরের কোথাও আঘাত লাগছে না। কিন্তু তার মাথা ঘুরতে লাগল। সাঁই সাঁই করে শরীরটা নীচের দিকে ছুটে যাচ্ছে। আছাড় খাওয়ামাত্র চৌচির হয়ে যাবে সে। নীচের দিকে তাকাতেই শরীরটা ঘুরে গেল। এবার মাথা নীচে, দুটো পা ওপরে। অর্থাৎ মাথাটা আগে গুড়িয়ে যাবে। নীল চোখ বন্ধ করল। তার শরীর বেঁকে যাচ্ছে। সোজা থাকার বদলে তেরচা হয়ে যাচ্ছে। তারপর আর কিছু মনে নেই।
সমস্ত শরীরে ব্যথা, বিশেষ করে শরীরের বাঁ-দিকটায়, নীলের যখন চৈতন্য এল তখন তার শরীরের বেশিরভাগ অংশ ঢেউ-এ দোল খাচ্ছে, মাথা দুটো পাথরের খাঁজে আটকানো। সে শরীর নাড়তেই তীব্র যন্ত্রণায় আক্রান্ত হল। কিন্তু সেই সঙ্গে বুঝতে পারল সে বেঁচে আছে। মরে গেলে শরীরে যন্ত্রণা তৈরি হয় না।
অনেক চেষ্টার পর ধীরে ধীরে সে পা ছড়িয়ে বসতে পারল। সমুদ্রের জল অনেকটা ওপরে উঠে এসেছিল, এখন খানিকটা নেমে গিয়েছে। সে কী করে বেঁচে থাকল? অত ওপর থেকে জলে পড়লে কি বেঁচে থাকা যায়? প্রথমে কিছুই ঢুকছিল না মাথায়? তারপরে খেয়াল হল। জলে পড়ার সময় তার শরীর তেরচা ভঙ্গিতে থাকায় সোজা নীচে চলে গিয়ে বালি বা পাথরে ধাক্কা লেগে চৌচির হয়নি। তেরচা শরীর আড়ে আড়ে জলের ভেতর দিয়ে অনেকটা চলে যাওয়ার পরে হয়তো কিনারায় চলে এসেছিল। তখন তার গতি কমে এসেছিল নিশ্চয়ই, তবু সেসময় এই পাথর, বালির সঙ্গে যেটুকু ধাক্কা লেগেছে তাতেই সে কাহিল।
অর্ধেক শরীর জলের তলায়, নির্জীব নীল কাত হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ পায়ে তীব্র যন্ত্রণা বোধ করতেই সে ধড়মড়িয়ে উঠে বসতে চাইল। সর্বাঙ্গে ব্যথা অনুভব করেও সে পায়ের দিকে তাকাতেই আরও ভয় পেল। বিশাল চেহারার একটা কাঁকড়া তার বাঁ-পায়ের গোড়ালি কামড়ে ধরে আছে। রক্ত ঝরছে ক্ষত স্থান দিয়ে। এত বড় কাঁকড়া সে কখনও দ্যাখেনি। হাতের কাছে যে পাথরটা পেল তাই তুলে ছুড়ে মারতে চাইল কাঁকড়াটাকে। আর একটু হলে সে নিজের পা-কেই আঘাত করত কিন্তু কাঁকড়াটা একটু সরে আসতেই তার শরীরে পাথরটা আছড়ে পড়ল। শব্দ হল। কাঁকড়ার শরীর চুপসে গিয়ে জল বের হল কিন্তু তার দাঁড়া নীলের শরীর থেকে মুক্ত হল না। কোনওরকম পা ওপরে তুলে দু-হাত দিয়ে কাঁকড়াটাকে ছাড়াল সে। বেচারা মরে গিয়েছে কিন্তু ওর দাঁড়া তার কাজ করে চলেছে। কাঁকড়াটাকে পেছনে ছুড়ে ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করল নীল। শরীর টলছে। সে জল ছেড়ে পাহাড়ের দিকে কয়েক পা হেঁটে এল। ওপরের বালি ভিজে। অর্থাৎ একটু আগে জোয়ারের জল ছিল। এখন অন্তত বেশ কয়েকঘণ্টা জায়গাটা শুকনো থাকবে।
পায়ের ক্ষত দেখল সে। খুব বেশি গর্ত হয়নি। আর একটু সময় পেলে বোধহয় মাংস ছিঁড়ে খেত কাঁকড়াটা। সে বিরক্ত হয়ে দূরে পড়ে থাকা কাঁকড়াটাকে দেখল। তখনই তার মনে হল ওটার শরীরে যথেষ্ট মাংস আছে। পেট ভরে খেলেও শেষ করতে পারবে না। কিন্তু কাঁচা মাংস খাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।
এখান থেকে কীভাবে বাইরে বের হওয়া যায়? চারপাশে তাকাল নীল। বাঁ, ডান এবং সামনে শুধু সমুদ্র। আর পেছনে খাড়া পাহাড়। শুকনো পাথরের ওপর কিছুক্ষণ বসে থাকল সে। তারপর পাহাড়ের গা ঘেঁষে হাঁটতে লাগল। একটা খাড়ির মতো জায়গা, সেখানে জোয়ারের জল ঢুকে রয়েছে। তার দুপাশে প্রচুর বুনো ঝোপ, গুল্ম ছড়িয়ে আছে। সেখানে পৌঁছে একটা শক্ত ডাল কোনওমতে ভেঙে নিয়ে নীল ভাবল চেষ্টা করেই দেখা যাক। অনেকদিন আগে অ্যানিমেল ওয়ার্ল্ড টিভি চ্যানেলে দৃশ্যটা দেখেছিল সে। শক্ত লতার ফাঁসে ডালটাকে জড়িয়ে তার এক প্রান্ত পাথরের ওপর রেখে লতাটাকে ঘোরাতে লাগল অবিরত। হঠাৎ যেন মনে হল পাথরটা তেতে উঠেছে। পাশ থেকে শুকনো ঘাস ছিঁড়ে সেই পাথরের ওপর রেখে একইভাবে লাঠি ঘষতেই হঠাৎ ধোঁয়া বের হল। উত্তেজিত হয়ে নীল শুকনো ঘাসে ফুঁ দিতেই দপ করে আগুন জ্বলে উঠল। তৎক্ষণাৎ আরও কিছু শুকনো ঘাস, পাতা তার ওপর ছড়িয়ে সে মরা ঝোপের ডাল সংগ্রহ করে নিয়ে এল। আগুন নিভবে না নিশ্চিত হওয়ার পরে নীল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে এল যেখানে সে কাঁকড়াটাকে ফেলেছিল। এসে দেখল দশ-বারোটা বড় বড় পিঁপড়ে অত বড় কাঁকড়াটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ওগুলো তাড়াতে কসরত করতে হল। তারপর সে কাঁকড়াটাকে নিয়ে এল খাড়ির কাছে। একটা কাঠিতে ওটাকে বেঁধে আগুনের ওপর ঝুলিয়ে সেঁকতে লাগল।
মাংস আধকাঁচা, তবু সুস্বাদু। অর্ধেক খেয়েই পেট ভরে গেল নীলের। এখানে পরে খাব বলে কিছু রাখা যাবে না। পড়ে থাকা মাত্র পিঁপড়ে আসবে দখল নিতে। একটানে কাঁকড়ার অভুক্ত অংশ সমুদ্রের জলে ছুড়ে দিয়ে সে আরও ডাল এবং পাতা সংগ্রহ করে রাখল।
সূর্য ডুবে গিয়েছে। অন্ধকার নামবে যে-কোনও মুহূর্তেই। সে চারপাশে তাকাল। এই বুনো ঝোপের জঙ্গলে কোনও হিংস্র প্রাণী লুকিয়ে আছে কি না বোঝা মুশকিল। সে পাহাড়ের খাঁজে রাত কাটাবে বলে ঠিক করল। আগুনটাকে সরিয়ে নিয়ে গেল তার মুখে। হিংস্র জন্তু যদি থাকে তাহলে তারা নিশ্চয়ই আগে আগুন দ্যাখেনি। কৌতূহলী হয়ে কাছে এলে তাপ পেয়ে সরে যাবেই।
গায়ের পোশাক গায়েই শুকিয়েছিল। কাঁকড়াটা যেখানে কামড়েছিল সেই গোড়ালিটা এখন দপদপ করছে। এখান থেকে কী করে মানুষের সমাজে ফিরে যাওয়া যায় বুঝতে পারছিল না সে। তার কেবলই মনে হচ্ছিল সে ফিরে যাবেই। নইলে অত উঁচু পাহাড় থেকে সমুদ্রে পড়ে গিয়েও সে মরল না কেন? মাথা নীচের দিকে সোজা হয়ে থাকলে তো ওটা চুরমার হয়ে যেত। সেরকম ঘটনা যখন ঘটেনি তখন এই পাহাড়ে কাঁকড়ার মাংস পুড়িয়ে খেয়ে বাকি জীবনটা নিশ্চয়ই কাটিয়ে দিতে হবে না।
আগুনটা যাতে সারারাত জ্বলে তার ব্যবস্থা করে নীল পাথরে মাথা রেখে পাহাড়ের খাঁজে শুয়ে পড়ল। মাঝে একবার ঘুম ভেঙেছিল, আগুনের তাপ অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু ওটা তার অসহ্য হলেও জীবজন্তুর হাত থেকে বাঁচাচ্ছে।
তিন-তিনটে দিন এবং রাত একইভাবে কেটে গেল। দ্বিতীয় দিনে তাকে অভুক্ত থাকতে হয়েছিল। কারণ চাইলেই সামুদ্রিক কাঁকড়া ধরা দেয় না। তৃতীয় দিন সকালে সে আবিষ্কার করল জোয়ারের জল নেমে গেলে যেটুকু পড়ে থাকে সেখানে সমুদ্রের কিছু মাছ আটকে থাকে। তৃতীয়দিন তাকে আর অভুক্ত থাকতে হল না।
তৃতীয় রাতে ঘটনাটা ঘটল। আজ একটা বড় মরা গুঁড়ি পেয়ে তাতেই আগুন জ্বেলেছিল নীল। দাউদাউ করে জ্বলছিল সেটা। নীল ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ একটা ইঞ্জিনের আওয়াজ এবং মানুষের গলা জড়িয়ে মিশিয়ে কানে যেতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। সে কিছু বোঝার আগেই দুটো বিশাল চেহারার লোক ওর দুই কনুই ধরে তুলে ধরল। বাকি দুজন আশেপাশে পরীক্ষা করে কিছু না পেয়ে নিজেদের ভাষায় কিছু বলাবলি করল। তারপর নীলকে টানতে টানতে একটা মোটরবোটে তুলল। ইঞ্জিনের শব্দ ওই মোটরবোট থেকেই হচ্ছিল। নীল এবার দেখতে পেল। অন্ধকারে সমুদ্রের মধ্যে যে আলোর মালা দুলছে সেটা অবশ্যই কোনও জাহাজের। মোটরবোট এগিয়ে যেতে সে এবার জাহাজটাকে দেখতে পেল। জাহাজের গায়ে ঝুলে থাকা সিঁড়ি বেয়ে ওকে ওপরে নিয়ে যাওয়া হল।
জাহাজের ডেকে দুজন লোক দাঁড়িয়েছিল যাদের অফিসার বলে মনে হল নীলের। একজনের হাতে দূরবিন। লোকটা যেদিকে দূরবিন দিয়ে দেখছিল সেখানে নীলের জ্বালা আগুন টিমটিম করছে। তাকে লোকদুটোর সামনে হাজির করলে অফিসারদের একজন ওদের ভাষায় কিছু বললে নীলের শরীর থেকে হাত সরিয়ে নেওয়া হল।
দ্বিতীয় লোকটা, যাকে বয়স্ক মনে হচ্ছিল, জিজ্ঞাসা করল কিছু যার অর্থ নীল বুঝতে পারল না। সে বলল, ‘আই নো ইংলিশ, হিন্দি অ্যান্ড বেঙ্গলি।’
‘ইন্ডিয়া অর পাকিস্তানি?’ বয়স্ক লোকটি জিজ্ঞাসা করল।
‘স্যার, আই অ্যাম ইন্ডিয়ান।’
‘হু আর ইউ?’
‘আই অ্যাম এ সেইলার। পাইরেটস রবড আওয়ার শিপ!’
প্রায় আধঘণ্টা ধরে তাকে জেরা করে সন্দেহমুক্ত হলেন এই জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং তাঁর সহকারী। একটা ইন্ডিয়ান জাহাজ যে পাইরেটরা দখল করে ডুবিয়ে দিয়েছে সেই খবর এঁরা রাখেন। নীলের কাছে যখন জানলেন সেই পাইরেটদের ডেরা ওই পাহাড়ের ওপরে, তখন দ্রুত জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে উপকূল ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল। বয়স্ক অফিসার তাকে ওপরের অফিসে নিয়ে গেলেন। সেখানে জাহাজের প্রবীণ ক্যাপ্টেন দুজনকে নির্দেশ দিয়ে ওদের দিকে তাকালে অফিসার সমস্ত বৃন্তান্ত তাঁকে জানালেন। শোনার পর ক্যাপ্টেন ইংরেজিতে বললেন, ‘তোমার কথা সত্যি হতে পারে আবার নাও হতে পারে। উঁচু পাহাড় থেকে সমুদ্রে লাফিয়ে পড়ে মরে যাওয়া দূরের কথা, হাত-পা ভাঙেনি, একথা মানতে পারছি না। আবার তুমি আফ্রিকান নও, ওই পাহাড়ের নীচে তোমার থাকার কথাও নয়। যা-হোক, তোমাকে খাবার দেওয়া হবে কিন্তু ঘরের বাইরে যেতে পারবে না। ঘরের ভেতর টয়লেট আছে। সেখানেই থাকবে যতদিন না আমরা পরের বন্দরে পৌঁছোই। পাইরেটরা নানান ধরনের ফন্দি করে জাহাজ দখল করে, তোমাকে যে তারা ব্যবহার করছে না তা কী করে বুঝব! নিয়ে যাও ওকে।’
খুব ছোট ঘর, একটা চিলতে পাটাতন রয়েছে শোওয়ার জন্যে। টয়লেটটা অপরিষ্কার নয়, কলে জল আছে। এটা যদি ঘর হয় তাহলে এখানে কোনও জানলা নেই। টয়লেটের ওপর ঘুলঘুলি আছে যা দিয়ে বাতাস এবং আলো ঢোকে। নীল চিন্তা করল। ওই পাহাড়ের নীচে চব্বিশ ঘণ্টা আগুন বাঁচিয়ে রেখে সে কতদিন বাঁচতে পারত? রোজ যে মাছ, কাঁকড়া অথবা অন্য কোনও প্রাণী শিকার হিসেবে পাওয়া যেত তার কোনও গ্যারান্টি নেই। খুব অল্পদিনের মধ্যে শুকিয়ে মরতে হত অথবা অন্য পশুর খাদ্য হতে হত। সে আগুন জ্বেলেছিল বলে এই জাহাজ থেকে লোক পাঠানো হয়েছিল দ্যাখার জন্যে। আগুনটা যদি পাইরেটদের চোখে পড়ত তাহলে তার মৃতদেহ সমুদ্রে ভাসত। তার চেয়ে এই ঘর ছোট হলেও অনেক নিরাপদ। পরের বন্দরে ওরা যদি তাকে নামিয়ে দেয় তাহলে সেখানে নিশ্চয়ই প্রশ্ন করা হবে। তার সঙ্গে কোনও কাগজপত্র নেই। পাসপোর্ট দেখাতে পারবে না। কীভাবে ওদের বিশ্বাস করাবে সে কোন জাহাজে কাজ করত, তার দেশ কোথায় ছিল! শেষ পর্যন্ত যা হওয়ার তা হবে বলে নীল শুয়ে পড়ল।
দু-বেলা তাকে খাবার দেওয়া হয়েছে। দরজা খুলে টেবিলের ওপর পাত্র রেখে পুরোনোটা নিয়ে গিয়েছে দুজন লোক। ষোলোটা খাবার খাওয়ার পর একদিন মনে হল জাহাজ অনেকক্ষণ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। তারপর দরজা খুলে গেল। দুজন লোক সেখানে দাঁড়িয়ে। একজন ইশারা করল ওদের অনুসরণ করতে।
আটদিন ঘরবন্দি থাকার পর বাইরের আলোয় চোখ অস্বস্তিতে পড়েছিল। তাকে যখন ক্যাপ্টেনের সামনে নিয়ে যাওয়া হল তখনও স্বস্তিটা ফিরে আসেনি।
ক্যাপ্টেন ওকে বসতে বললেন, ইংরেজিতে। তারপর বললেন, ‘আমরা বন্দর থেকে সামান্য দূরে আছি। কিন্তু ওরা কোনও পরিচিতিবিহীন মানুষের দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছে না। তখন বাধ্য হয়ে আমি সেই কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করি যাদের জাহাজ পাইরেটরা কয়েকদিন আগে লুঠ করে ডুবিয়ে দিয়েছে। ওরা অবাক হয়েছে। কারণ ওদের ধারণা হয়েছিল জাহাজের কোনও নাবিক বেঁচে নেই। তুমি এই কাগজে তোমার নাম, ঠিকানা, জাহাজের নাম লিখে দাও। ওগুলো পড়ে যদি তোমার কোম্পানি আইডেন্টিফাই করতে পারে তাহলে ভাগ্য তোমাকে সাহায্য করবে।’
নীল লিখে দিলে ক্যাপ্টেন কম্পিউটারের কাজে ব্যস্ত একজনকে ডেকে সেটা দিয়ে নিজেদের ভাষায় কী করতে হবে জানিয়ে দিলেন।
নীলকে আবার তার চিলতে ঘরে নিয়ে আসা হল। কোম্পানি কীরকম রিঅ্যাক্ট করে তার ওপর তার ভাগ্য নির্ভর করছে। সে আর ভাবতে পারছিল না।
বিকেলবেলায় আবার তাকে ক্যাপ্টেনের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘তোমার কোম্পানি ভাবতেই পারছে না যে তুমি বেঁচে আছ।’
‘ওরা আমাকে রিকগনাইজ করেছে?’
‘নিশ্চয়ই। পাইরেটদের ডুবিয়ে দেওয়া জাহাজের একজন নাবিক জীবিত, এই খবর সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু ওরা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।’
কম্পিউটারের মাধ্যমে কথা বলা হল। ওরা নীলের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হল। সে জানাল মিস্টার ফারুককে নিজের চোখে মরে যেতে দেখেছে। আর কে কে মারা গিয়েছে তা জানে না। তবে মেনন নামের একজন নাবিক বন্দিদের মধ্যে রয়ে গেছে। ওরা ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলতে চাইল।
নীলের জাহাজ কোম্পানির অনুরোধ এই জাহাজের ক্যাপ্টেন রাখলেন। সমুদ্রে বিপদ হলে এই অনুরোধ রাখাকে শিষ্টাচারের অঙ্গ বলা হয়ে থাকে। স্থানীয় পুলিশের সাহায্য নিয়ে নীলকে সবচেয়ে কাছের বিমানবন্দরে পৌঁছে দেওয়া হবে। তার বিমানের টিকিটের দাম কোম্পানি বহন করবে। দেখা গেল, সবচেয়ে কাছের বিমানবন্দর মোগাধিমুতে। নাম আদেন আদ্দে ইন্টারন্যাশন্যাল এয়ারপোর্ট। সেখান থেকে ঢাকার বিমান পাওয়া যাবে। ঢাকা থেকে বিমান বদলে নীল কলকাতায় পৌঁছোতে পারবে। ক্যাপ্টেন তার পরিচয়পত্র যা ওঁর পক্ষে দেওয়া সম্ভব লিখে দিলেন। নীলের উদ্ধার পাওয়ার খবর স্থানীয় পুলিশ জেনে গিয়েছিল বলে নিয়মকানুনের কড়াকড়ি না করে তাকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিল তারা।
আদেন আদ্দে বিমানবন্দরে গিয়ে নীল জানতে পারল ভাগ্যক্রমে সেইদিনই ঢাকার ফ্লাইট আছে। তাতে একটা আসন তার জন্যে জাহাজ কোম্পানির অনুরোধে রাখা হয়েছে। ক্যাপ্টেন ইন্টারনেট থেকে টিকিটের কপি বের করে তাকে দিয়েছিলেন বলে বোর্ডিং কার্ড পেতে সমস্যা হল না। ভদ্রলোক তাকে কুড়িটা আমেরিকান ডলার দিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা পথে লাগতে পারে। শোধ করতে চাইলে তুমি তোমার শহরের যেকোনও চার্চে দিয়ে দিও। আমি খুশি হব।’
বোর্ডিং কার্ড নিয়ে এয়ারপোর্টের রেস্টুরেন্টে ঢুকে ভাত দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল নীলের। বাসমতী চালের ভাত। এখানকার সব মাংস ছাগল। পর্ক একেবারে নিষিদ্ধ। অ্যালকোহল পরিবেশিত হয় না। যে মাছ বা প্রাণী নিজে নিজেই মারা যায় তা খাওয়া হয় না। সব দেখে শুনে নীলের চোখে পড়ল হালুয়ার মতো দেখতে একটা খাবার। ভুট্টার দানা, দুধ, চিনি, আর ঘি দিয়ে তৈরি সেই খাবার এক পাত্র সে কিনল পাঁচ ডলারে। খেয়ে শরীর জুড়িয়ে গেল।
প্লেনের বেশির ভাগই বাংলাদেশের চট্টগ্রাম-সিলেটের মানুষ। কাজকর্মে এঁরা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এসে থাকেন। তবে এঁরা নিজেদের মধ্যে কথা যখন বলছিলেন তখন বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারছিল না নীল।
ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। দীর্ঘ সময় ধরে একটানা উড়ছে প্লেন। পাশের যাত্রী ঘড়ি দেখলেন, ‘এসে গেছে। আর বড় জোর আধঘণ্টা।’
শ্বাস ফেলল নীল। ঢাকা থেকে কলকাতায় যেতে আধঘণ্টা লাগে প্লেনে। তার মানে ঢাকায় পৌঁছোবার পর কলকাতা হাতের মুঠোয়।
হঠাৎ প্লেনটা প্রচণ্ড নড়ে উঠল। তারপর লাফাল। বেল্ট বাঁধার সাইন জ্বলে উঠল। ক্যাপ্টেনের গলা শোনা গেল সাউন্ড সিস্টেমের মাধ্যমে, ‘আমরা আচমকা ঝড়ের মধ্যে পড়েছি। এই ঝড় এড়াতে আমাদের প্লেনের মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।’
বাইরে ছুটন্ত মেঘ। প্লেন নেমে গিয়েছিল অনেকটা, এখন দ্রুত ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে। পাশের যাত্রী বললেন, ‘যাচ্চলে। আমরা তো ঢাকা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।’
বেশ কিছুক্ষণ পরে ঘোষণা শোনা গেল, ‘খারাপ আবহাওয়ার জন্যে আমরা এখন ঢাকা বিমানবন্দরে নামতে পারছি না। তার বদলে এখন চট্টগ্রাম বন্দরে নামতে বাধ্য হচ্ছি। যাত্রীদের অনুরোধ করা হচ্ছে সহযোগিতা করার জন্যে।’
প্লেন চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে নামল। এখন দুপুর।
যাত্রীদের জানানো হল ঝড়ে প্লেনের সামান্য ক্ষতি হয়েছে। সেটা মেরামত করে আগামীকাল আটটায় প্লেন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। ততক্ষণ সমস্ত যাত্রীদের হোটেলে নিয়ে গিয়ে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
এয়ারপোর্টের কাছাকাছি হোটেলে একটা ঘর পেল নীল। কোথায় সে ভেবেছিল আজ বিকেলের মধ্যে কলকাতায় পৌঁছোতে পারবে, কোথায় চট্টগ্রামের হোটেলে পড়ে থাকা। কলকাতায় তার কেউ নেই, তবু কলকাতা তাকে টানছে!
হঠাৎ মাথার মধ্যে যেন বিদ্যুৎ বয়ে গেল। সে এখন চট্টগ্রামে। এখান থেকে কক্সবাজার নিশ্চয়ই বেশি দূর নয়। লোকে তো চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত দেখতে যায়। ঘর থেকে বেরিয়ে খোঁজ নিয়ে নীল জানতে পারল কক্সবাজারে যেতে বাসে সাড়ে তিনঘণ্টা লাগে। সারা দিন এবং রাত বাস চলে। এখন গিয়ে স্বচ্ছন্দে ফিরে এসে সকালের প্লেন ধরা সম্ভব হবে।
পকেটে পনেরো ডলার ছিল। দশ ডলার ভাঙিয়ে সাতশো বাংলাদেশি টাকা পেয়ে গেল। এই টাকায় কক্সবাজারে যাওয়া-আসার বাসভাড়া হয়ে যাবে।
প্রবল উত্তেজিত হয়ে বিকেল চারটের বাস ধরল নীল। হোটেল থেকে বলা হয়েছিল যেহেতু তারা ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার তাই কখনোই বেশি দূরে যেন না যায়। কিন্তু এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না নীল।
বাসে বসে বারংবার মনে পড়ছিল ফারুক সাহেবের কথা। মানুষটার শেষ ইচ্ছে ছিল যেন নীল কক্সবাজারে যায়। এই কক্সবাজারের জন্যে ফারুক সাহেবের বন্ধু নিহত হন, ফারুক সাহেবকেও প্রাণ হারাতে হয়।
যে বন্দি ফারুক সাহেবের বন্ধু ইয়াসিনভাইকে হিরেগুলো দিয়েছিলেন তিনি খালি বলেছিলেন ও হিরেতে অভিশাপ আছে। মঙ্গলজনক কোনও কাজে ব্যবহার না করলে হিরে ক্ষতি করতে পারে। ফারুকসাহেবের ধারণা ছিল যে ইয়াসিনভাই সম্পূর্ণ নি:স্বার্থ ছিলেন না বলে খুন হয়েছেন। কিন্তু ফারুকসাহেবের ক্ষেত্রে তো কথাটা খাটে না।
যদি হিরেগুলো পাওয়া যায় তাহলে সে কী করবে? সঙ্গে সঙ্গে তাকে উদ্ধার করা জাহাজের ক্যাপ্টেনের মুখ মনে পড়ল। ভদ্রলোক বলেছিলেন চার্চের দানবাক্সে কুড়ি ডলার দিয়ে দিতে। সে ঠিক করল, হিরেগুলো পাওয়া গেলে সবটাই চার্চে দিয়ে দেবে যাতে ওগুলো বিক্রি করে চার্চ জনহিতকর কাজ করতে পারে। ব্যাপারটা সে কাউকে জানাবে না। দান করে নাম কেনাটাও তো স্বার্থসিদ্ধির উপায় হতে পারে। সেটা সে কখনোই করবে না।
কক্সবাজারের বাসটার্মিনাস একটা ঘিঞ্জি এলাকায়। অবশ্য খানিকটা হাঁটলেই সেই বিখ্যাত সমুদ্রের ধার। নীল যখন সমুদ্রের গায়ে এল তখন রাত সাড়ে সাতটা। আজ পূর্ণিমার পরের রাত। আকাশে জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে ইয়া বড় চাঁদ। নীল খুশি হল। তাকে অন্ধকারে বেশি খোঁজাখুজি করতে হবে না।
ইয়াসিনভাই যে গল্প ফারুক সাহেবকে শুনিয়েছিলেন সেই মতো নীল সমুদ্রের ধার দিয়ে হাঁটতে লাগল। নারকোল গাছগুলোর নীচে বালি খুঁড়ে হিরে পুঁতে রেখ গেছেন ইয়াসিনভাই। জ্যোৎস্নায় প্রায় আধ কিলোমিটার হেঁটে এসেও কোনও নারকেল গাছ চোখে পড়ল না। বিশাল লম্বা বিচ। আরও কিছুটা হাঁটতেই মনে হল সমুদ্রের জল যেন দিগন্তে বেঁকে নীচু হয়ে মিলিয়ে গেছে। এর কাছাকাছি নারকোল গাছের নীচে হিরেগুলোর থাকার কথা।
নীল দেখল একজন প্রৌঢ় সাইকেল চালিয়ে পাশের রাস্তা দিয়ে আসছে। সে হাত তুলে তাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, এদিকে নারকোল গাছ কোথায় আছে বলতে পারেন?’
‘নারকোল খাবেন? এখানে পাবেন না। বাজারে যেতে হবে।’
‘না খাব না। আমি গাছের খোঁজ করছি। কয়েকবছর আগে দেখে গিয়েছিলাম।’
‘ও:। সেসব গাছ, ওপাশের কিছু ঘরবাড়ি পানির তলায়। সমুদ্র সব খেয়ে গিয়েছে। অবিরত ভেঙে চলছে ঢেউগুলো।’ লোকটা আবার সাইকেল চালিয়ে চলে গেল।
নীল হতভম্ব। আরও কিছুক্ষণ সে নারকোল গাছ খুঁজল। এই বিশাল বালির ভেতরে যদি হিরে থেকেও থাকে তাহলে তা কোনও মানুষের পক্ষে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। কিংবা সমুদ্রের ঢেউ হয়তো নিজের বুকে নিয়ে নিয়েছে ওগুলো। অভিশাপের হিরে আর কখনোই দিনের আলো দেখবে না।
সেই সাইকেলে চাপা প্রৌঢ় ফিরছিল। তাকে দেখে বলল, ‘আপনি কি এখনও নারকোল গাছ খুঁজছেন?’
নীল মাথা নেড়ে ‘না’ বললে প্রৌঢ় খুশি হলেন, ‘যাক। এখানে একটা পাগল ছিল। সে-ও নারকোল গাছ খুঁজত। মাসখানেক হল সমুদ্রে ডুবে মারা গিয়েছে। তাই ভয় পাচ্ছিলাম—আচ্ছা!’ প্রৌঢ় চলে গেল।
চট্টগ্রাম ফিরে যাওয়ার বাস ধরল নীল।