জলপ্রপাতের গর্জনে একটা আতঙ্কের আবহাওয়া তৈরি হয়েই ছিল, তার ওপর থেকে পাথরে পা রেখে রেখে নীচে আসার সময় পিছলে পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না। লাইন দিয়ে নামার সময় নীচের দিকে তাকালেই মাথা ঘুরে যাচ্ছিল অনেকের, চিৎকার শুরু হয়ে গেল। এবং তখনই পা হড়কে একজন নীচে ঝুলে পড়ল। তার দড়ির সঙ্গে আটকে থাকা অন্য দুজন পাথর আঁকড়ে ধরে পরিত্রাহী চিৎকার করে চলেছে। ওদের পক্ষে আর নিজেদের পতন থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে না বলে বুঝে গেছে। এই সময় একজন পাইরেট এগিয়ে এসে দোল খাওয়া লোকটার শরীরের সঙ্গে বাঁধা দড়িতে কোপ মারল। দুবারের চেষ্টা সফল হল। শরীরটা পাক খেতে খেতে নীচের ঝরনায় পৌঁছে গেল, আর দেখা গেল না।
নীলের শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ঝুলন্ত লোকটাকে বাঁচানো মুশকিল ছিল। কিন্তু চেষ্টা করা যেত। তা না করে নির্দয় হাতে ওকে খুন করা হল? বন্দিদের একজন কমে গেলে এদের যে কিছু এসে যায় না তা স্পষ্টই বুঝিয়ে দিল। লোকটা নীচে পড়ে যাওয়ায় পড়ন্ত অন্য লোকদুটো এ যাত্রায় বেঁচে গেল। ভগবানকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিল তারা।
মাঝে মাঝে জলের ছিটে লাগছিল শরীরে। খুব ধীরে নামছিল ওরা। ওপর থেকে জলের ধারার যেটুকু নীচে আছড়ে পড়েও ওপরের দিকে ছিটকে উঠছিল তাতেই ভিজে যাচ্ছিল শরীরের নিম্নাংশ। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, ‘বুক ফেটে যাচ্ছে, জল খাব।’
চিৎকারটা মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল। দীর্ঘসময় জলপান না করে, সাপের মাংস খেয়ে লোকগুলোর অবস্থা খুবই কাহিল হয়েছিল। চিৎকার এবং হাতের মুদ্রায় তারা জল খেতে চাইল। কিন্তু ভবি ভুলবার নয়। ছিটকে আসা জলে তেষ্টা মেটানো যায় না। জল খেতে হলে নীচে নামতে হবে, জলের কাছে যেতে হবে। সেটা হতে দিল না পাইরেটরা। চাবুক মারতেই সামনের লোকগুলো চলতে শুরু করল। মেনন নীচু গলায় বলল, ‘আমরা পেছন দিকে আছি বলে মার খাওয়া থেকে বেঁচে গেলাম।’
ক্রমশ ওরা নীচে নেমে এল। চারদিকে বাঁশের খাঁচা, তার দুপাশে অনেকগুলো ঘর। সামনে জলপ্রপাতের আড়াল। দুটো খাঁচায় তাদের ঢুকিয়ে দেওয়া হল। দীর্ঘদেহী সোজা হয়ে দাঁড়াতেই প্রহরীরা তার সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়াল। দীর্ঘদেহী তার ভাষায় যে বক্তৃতা দিল তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারল না নীল। বক্তৃতা শেষ করে দীর্ঘদেহী এগিয়ে এল খাঁচার সামনে। তারপর হাত নেড়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘গুড? ওকে! ব্যাড?’ পাশের পাইরেটের বন্দুক হাতে তুলে তাক করল সে, মুখে আওয়াজ করল, ‘ব্যাঙ, ব্যাঙ, ব্যাঙ। অল ডেড।’ বলে বন্দুক ফিরিয়ে দিয়ে হাসল। ওপাশের খাঁচার কেউ বলল, ‘ওয়াটার প্লিজ।’
দীর্ঘদেহী ঘুরে তার সঙ্গীদের যেভাবে আদেশ দিল তাতে নীলের মনে হল এবার জল পাওয়া যাবে। দীর্ঘদেহী চোখের আড়ালে চলে গেলে দুটো লোক জলপ্রপাতের ভেতর থেকে পাইপ এনে পাম্প চালিয়ে বিপুলবেগে দুটো খাঁচায় জল ফেলতে লাগল। সেই ধারার সামনে দাঁড়িয়ে থাকাই মুশকিল, সর্বাঙ্গ ভিজে গেল। শেষে পেছন ফিরল। কিন্তু কেউ কেউ সেই জল আজলায় ভরে গিলতে লাগল। মেননের দেখাদেখি নীলও তেষ্টা মেটাল পাশ ফিরে, আজলায় জল ধরে।
বিধ্বস্ত করে ওরা যখন চলে গেল তখন ভেজা জামা খুলে নীল খাঁচার কোণে চলে এল। সে বুঝতে পারছিল এই পাইরেটগুলো তাদের সঙ্গে সামান্য ভালো ব্যবহার করবে না। মেনন এসে বসল তার পাশে। বলল, ‘কী মতলব ওদের বুঝতে পারছি না। আমাদের এমন জায়গায় আটকে রাখল যে এখান থেকে পালাবার কোনও পথ পাব না।’
নীল হাসল, ‘সোজা একটা পথ আছে। খাঁচার দরজা খুলে দৌড়ে ওই জলপ্রপাতে ঝাঁপিয়ে পড়লে কেউ আর তোমাকে খুঁজে পাবে না।’
‘নীচে পড়ার আগেই প্রাণ বেরিয়ে যাবে।’ মেনন বিড়বিড় করল। ‘কিন্তু আমাদের আটকে ওরা কী লাভ করবে? খামোকা আটকেছে কেন?’
উত্তরটা জানা গেল কিছু পরে। তিনজন পাইরেট খাঁচার ভেতর ঢুকল। দুজন দুপাশে অস্ত্র উঁচিয়ে ধরল। মাঝখানের জনের হাতে একটা পিজবোর্ডের ওপর কাগজ লাগানো। সেটা একজন বন্দির সামনে ধরে কলম এগিয়ে বুকে খোঁচা দিয়ে ইশারা করল কাগজে লিখতে। কয়েকবার সেটা করার পরে বোঝাতে পারল লোকটা। নাম লিখতে হবে। এক দুই তিন করে বন্দিরা নাম লিখতে লাগল। তালিকা তৈরি করে ওরা চলে গেলে মেনন মাথা নাড়ল, ‘এখন বুঝতে পারলাম।’
‘কী সেটা?’ নীল জিজ্ঞাসা করল।
‘আমরা কে কে ওদের হাতে বন্দি হয়ে আছি তার লিস্ট তৈরি করে হেডঅফিসের কাছে টাকা চাইবে। হেডঅফিস টাকা না দিলে আমাদের মেরে ফেলবে। নিশ্চয়ই গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাবে খবরটা।’ মেনন বলল, ‘তাই তো?’
মাথা নাড়ল নীল। ‘অনুমান করা ছাড়া আমাদের কোনও পথ নেই।’
সন্ধে নামলে এক বাটি করে স্যুপ দিয়ে গেল পাইরেটরা। তাও খাঁচার দরজা খুলে না ঢুকে বাঁশের ফাঁক গলিয়ে দিয়ে গেল। একটা চুমুক দিয়ে নীল বলল, ‘পিওর ভেজেটিরিয়ান।’
মেনন খুশি হয়ে বড় চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করল। ঠান্ডা, স্বাদহীন এবং বিটকেল গন্ধ।
নীল বলল, ‘বাইরের জঙ্গলের পাতা ছিঁড়ে সেদ্ধ করে দিয়েছে। পয়সা খরচ করতে হয়নি। ইচ্ছে হলে আমারটা খেয়ে নিতে পারো।’
গাছ কেটে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে চার জায়গায়। তাতেই আলোকিত হয়ে আছে এলাকাটা। জলপ্রপাতের একটানা গর্জনে কান অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে বন্দিদের। সেই অভ্যস্ততা এতখানি, সবাই যে কানে কম শুনছে তাও টের পাচ্ছে না। নীল ঘুমাবার চেষ্টা করল। বন্দিরা সবাই পড়ে আছে যে যার জায়গায়।
কিন্তু ঘণ্টাখানেক বাদে দুটো লোক খাঁচার সামনে এসে চেঁচাতে লাগল। তাদের একজনের হাতে একটা কাগজ ধরা। সেই কাগজ বন্দিদের দিকে ধরে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে মেনন নীলকে ডাকতে লাগল, ‘এই, এই দ্যাখো তো, মনে হচ্ছে তোমার নাম!’
নীল ধড়মড়িয়ে উঠল। লোকদুটোকে দেখল। তারপর এগিয়ে গিয়ে বাঁশের বেড়ার এ পাশে দাঁড়িয়ে কাগজটায় যা লেখা রয়েছে তা পড়ার চেষ্টা করল। অত্যন্ত অপটু হাতে ইংরেজি অক্ষর লেখার যে চেষ্টা হয়েছে তা উচ্চারণ করলে নিজের নামটা শোনা যাবে। নীল হাত তুলল। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ইশারা করা হল দরজার কাছে যেতে। নীল বন্দিদের দিকে তাকাল। মড়ার মতো চেয়ে আছে সবাই। সে এগিয়ে যেতেই দেখল এই প্রহরীরা সামনে আছে বটে, কিন্তু পেছনে অস্ত্র হাতে নজর রাখছে পাহারাদাররা।
লোকটা, যার হাতে কাগজটা ছিল, ইশারায় লেখাটা দেখিয়ে জানতে চাইল, ওটা সে কি না? নীল মাথা নাড়তে তালা খুলে তাকে বের করা হল। সঙ্গে সঙ্গে তার হাত আবার বেঁধে ওরা টানতে টানতে নিয়ে চলে এল বাঁ-দিকে। সেখানে বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে নীলকে ওদের সঙ্গে ওপরে উঠতে হল। সামনেই গুহা। গুহার দরজায় পাহারাদার। তার হাতে ওরা নীলকে জমা দিতেই লোকটা ধাক্কা মারল। হুমড়ি খেয়ে পড়ল নীল। সেই অবস্থায় তাকে টানতে টানতে দরজার কাছে নিয়ে ফেলে রেখে লোকটা ভেতরে ঢুকে গেল। একটু পরে ফিরে এসে মেঝে থেকে নীলকে তুলে লোকটা ভেতরে নিয়ে গেল।
মশালজাতীয় আলো জ্বলছে একটা ঘরে। গুহাকে কেটে ঘর করা হয়েছে। নীল চারপাশে তাকাল। এই সময় দীর্ঘদেহী এগিয়ে এল তার সামনে।
‘হাই! নেইল?’ নীলের উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট তবু লোকটা মাথা নীচু করে তাকাল।
‘নেইল?’ নীল মানে বুঝতে পারল না।
বাঁ-হাতের তর্জনী নীলের বুকে ছুঁইয়ে দীর্ঘদেহী জিজ্ঞাসা করল, ‘নেইল? ইউ?’
মাথা নাড়ল নীল, ‘ইয়েস। আই অ্যাম নীল।’
ইশারায় তাকে অনুসরণ করতে বলে লোকটা ভেতরে চলে গেল। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিল না নীল। সে ভেতরের দিকে এগিয়ে দেখল একটা টেবিলের দুপাশে দুটো চেয়ার পাতা আছে। লোকটা তাকে ইশারায় বসতে বলে হাসল।
নীল ঢোঁক গিলল। দরজার বাইরে প্রহরী তার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে আর ঘরের ভেতর তাদের নেতা যা করছে তার দুটোর মধ্যে যা পার্থক্য তাতে মাথা ঘুরে যাওয়াই স্বাভাবিক। সে বেশ জড়সড় হয়ে একটা চেয়ারে বসল। দীর্ঘদেহী হে হে শব্দ করে হাসল। তারপর বুক পকেট থেকে একটা চুরুট বের করে লাইটারের আগুনে ধরিয়ে এগিয়ে দিল নীলের দিকে, ‘টেক, টেক।’
মাথা নাড়ল নীল, ‘আই ডোন্ট স্মোক।’
চোখ বড় করে ‘অ’ বলল লোকটা। তারপর চুরুটে টান দিয়ে ধোঁয়া বের করে এগিয়ে গেল একটা আলমারির দিকে। তার পেছনটা দেখা যাচ্ছিল না। নীল বুঝতে পারছিল না দীর্ঘদেহী তাকে এত খাতির করছে কেন। একজন বন্দির দড়ি কেটে যারা ওপর থেকে জলে ফেলে মারতে পারে তারা তাকে দামি চুরুট খেতে দেবে কেন? একথা ঠিক ওরা তার কাছ থেকে কিছু আশা করছে। কী সেটা? এমন কোনও গোপন তথ্য তার জানা নেই যার জন্যে দীর্ঘদেহী তাকে চুরুট খাওয়াবে।
দীর্ঘদেহী ফিরে এল দুটো গ্লাস হাতে নিয়ে। গ্লাসের নীচের দিকে খানিকটা সোনালি তরল পদার্থ রয়েছে। একটা গ্লাস নীলের সামনের টেবিলে রেখে দীর্ঘদেহী হাসল, ‘টেক। স্কচ। ফ্রম লন্ডন।’ বলেই অন্য গ্লাসটা দুই ঠোঁটের গহ্বরে উপুড় করে দিল। গলা দিয়ে সেটা নীচে নামতেই লোকটা উল্লাসে বলল, ‘আ:!’
নীল গ্লাসের দিকে তাকাল। তারপর বলল, ‘আই ডোন্ট ড্রিঙ্ক!’
‘আঁ? মাই গড!’ লোকটা বিশাল থাবায় গ্লাস তুলে তরল পদার্থ মুখের ভেতর চালান করে বলল, ‘ইউ হেল্প মি। আই হেল্প ইউ!’
যেন অনেকটা ইংরেজি বলে ফেলেছে এমন গর্বে মাথা নাড়ল দীর্ঘদেহী।
‘ও কে!’ নীল তাকাল। যদিও কী সাহায্য চাইছে লোকটা তা তার জানা নেই।
‘কাম।’ হাত নাড়ল লোকটা। নীল অনুসরণ করলে লোকটা কয়েক পা হেঁটে পাশের দরজাটা লাথি মেরে খুলল। ঘরটা অন্ধকার। পকেট থেকে হুইসল বের করে বাজাল লোকটা। সঙ্গে সঙ্গে দুজন বন্দুকধারী গোপন জায়গা থেকে ছুটে সামনে চলে এল। লোকটা তাদের আদেশ করলে একজন ভেতরে ঢুকে বড় হ্যারিকেন জ্বেলে দিয়ে দরজার বাইরে চলে গেল। দীর্ঘদেহী ইশারা করল নীলকে ভেতরে ঢুকতে।
ঘরের এককোণে লম্বা খাটিয়ায় যে-কোনও মানুষ উপুড় হয়ে শুয়ে আছে তা প্রথমে বুঝতে পারেনি নীল। দীর্ঘদেহী এগিয়ে গিয়ে শায়িত লোকটার পায়ের কাছে লাথি মারতেই লোকটা নড়ে উঠল। দীর্ঘদেহী নীলকে জিজ্ঞাসা করল, ‘নো হিম?’
নীল কাছে গেল। দাড়িওয়ালা লোকটার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। দীর্ঘদেহী পা দিয়ে মানুষটাকে চিৎ করে দিতেই নীলের মুখ থেকে ছিটকে বেরুল শব্দ দুটো, ‘ফারুকসাহেব?’
‘হ হ হ!’ জোরে জোরে হাসলে দীর্ঘদেহী, ‘গুড, গুড।’
নীল ততক্ষণে ফারুক সাহেবের মাথার পাশে বসে পড়েছে। ‘ফারুক সাহেব আপনার কী হয়েছে? কথা বলছেন না কেন? ফারুক সাহেব?’
কিন্তু কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। ভদ্রলোক সংজ্ঞাহীন।
দীর্ঘদেহী নীলের কাঁধে হাত রাখল, ‘ইউ স্পিক হিম! দেন ইউ ফ্রি!’
কথাগুলো বলে দরজা বন্ধ করে দীর্ঘদেহী বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
নীল অবাক হয়ে ফারুক সাহেবকে দেখছিল। এরা ওঁকে এখানে কখন কীভাবে নিয়ে এল? ফারুক সাহেব অজ্ঞান হয়ে আছেন কেন? হঠাৎ কেঁদে ফেলল নীল। কান্নাটা বুকে তৈরি হয়ে ছড়িয়ে পড়ল শরীরে সর্বত্র। মাথা ঝুঁকে গেল নীলের। সেই কান্নার শব্দে অথবা চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জলের স্পর্শে চোখ খুললেন ফারুক সাহেব। রুগ্ন গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘কী হল?’
গলার স্বর এত নীচু যে প্রথমে ঠাওর করেনি নীল। পরে দেখতে পেল ফারুকসাহেব তাকিয়ে আছেন। চোখ হলুদ। সে ওঁর মাথায় কপালে হাত রেখে বুঝতে পারল মানুষটার শরীর জ্বরে পুড়ছে।
‘ফারুক সাহেব, আমি নীল।’
‘হুঁ।’
‘ওরা আপনার কাছে কী চাইছে?’ নীল কানের কাছে মুখ নিয়ে গেল।
‘হিরে। কক্সবাজারের—!’ আবার সংজ্ঞা হারালেন ফারুক সাহেব।
নীল খেপে গেল। দ্রুত দরজায় গিয়ে দেখল সেটা বন্ধ বাইরে থেকে। দু-হাতে দরজায় ধাক্কা মারতে লাগল সে। একটু পরে হাট করে দরজা খুলে দাঁড়াল দীর্ঘদেহী। নীল চিৎকার করল, ‘ডাক্তার, কল ডাক্তার!’
‘ডাক্তার?’ হো হো করে হাসল লোকটা, ‘নো ডাক্তার। ইউ স্পিক?’
‘হি ইজ সেন্সলেস।’
দীর্ঘদেহী হুইসল বাজালে দুটো লোক দরজায় এল। তাদের নিজের ভাষায় নির্দেশ দিলে একটা বালতিতে জল আর মগ নিয়ে এল তারা। তারপর সেই জল ফারুক সাহেবের মাথায় ঢালা হল। চারবার ঢালতেই ফারুক সাহেব আ: আ: করে উঠল। দীর্ঘদেহী নীলকে ঠেলে ফারুক সাহেবের কাছে পাঠিয়ে বলল, ‘স্পিক!’
কিন্তু ততক্ষণে হেঁচকি উঠেছে ফারুক সাহেবের। কয়েকবার হেঁচকি তুলে ক্রমশ স্থির হয়ে গেল তাঁর শরীর। বিস্ফারিত চোখে মৃত্যুদর্শন করল নীল। ধীরে ধীরে ফারুক সাহেবের পাশে বসে পড়ল সে মাথা নীচু করে। দীর্ঘদেহী হাত বাড়িয়ে ফারুক সাহেবের গলা স্পর্শ করে চিৎকার করলেন নিজের ভাষায়। সঙ্গে সঙ্গে লোকদুটো তাঁকে চ্যাংদোলা করে ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেল। দীর্ঘদেহী নীলকে জুতোর ধাক্কা দিলে সে চোখ তুলল। দীর্ঘদেহী হাতের মুদ্রায় বোঝাল ওরা ডেডবডি এখন জলপ্রপাতে ফেলে দেবে। তাতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। কাল সে নীলের সঙ্গে কথা বলবে। এই কথাগুলো দীর্ঘদেহীর ইশারার ভাষা দেখে বুঝতে চাইল নীল এভাবেই।
দীর্ঘদেহী বেরিয়ে গেল তাড়াতাড়ি করে। কী ভেবে নীল দ্রুত লোকটাকে নি:শব্দে অনুসরণ করল। কোনও একটা দুশ্চিন্তা মাথায় আসায় কোনওদিকে না তাকিয়ে লোকটা সোজা এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। নীল ডান এবং বাঁ-দিকে তাকাল। যেদিকে দীর্ঘদেহীর আলমারি ছিল সেখানে যেতেই একটা বেডরুম চোখে পড়ল তার। নীল দ্রুত সেই ঘরে ঢুকে খোলা জানলা দেখতে পেল।