কুয়াশা এখন ঘন হয়নি, তাই সিগালগুলোকে ফিরে যেতে দেখতে পেল নীল। বন্দর ছাড়ার পরেই ওরা জাহাজের ওপর পাক খেতে থাকে। নির্দিষ্ট সীমায় পৌঁছে ফিরে যায় ডাঙায়। যেখানে ওরা যেতে পারবে না সেখানে একটা জাহাজ যাচ্ছে, সেই খুশিতে একটু সঙ্গী হওয়া, না যেতে নিষেধ করার জন্যে সঙ্গে উড়ে আসা। কিন্তু ওরা ফিরে যাওয়ার পর মন উদাস হল।
এই জাহাজের পেটে রয়েছে এক কোটি ডলারের দামি ইলেকট্রনিক্স বাক্স। এগুলো পৌঁছে দিতে হবে আফ্রিকার ডারবান বন্দরে।
ইলিয়ট রোড আর সার্কুলার রোডের মোড়ে ট্রাম আর বাসের সংঘর্ষে যে চারজন মানুষ মারা যান তাদের মধ্যে নীলের মা ছিলেন। সেই সময় নীল নিউমার্কেটে ঘুরছিল একটা আমেরিকান টুরিস্টের সঙ্গে। লোকটার ইংরেজি উচ্চারণ কেউ বুঝতে না পারায় নীল দোভাষীর কাজ করছিল। বেকার জীবনে ওটাই তার একমাত্র রোজগারের রাস্তা ছিল। ছ’শো টাকা হাতে পেয়ে নিউমার্কেট থেকে ভালো হ্যাম আর পাউরুটি কিনে সে যখন বাড়িতে পৌঁছল তখন প্রতিবেশীরা খবরটা দিল।
হাসপাতাল থেকে মাকে তুলে কবরখানায় নিয়ে গিয়ে কফিনে শুইয়ে দেওয়ার পর নীল বুঝল এই পৃথিবীতে সে একা। তার কোনও আত্মীয়স্বজন নেই, তা ঠিক নয়। যারা আছে তারা চিরকাল দূরেই থেকে গেছে। ইলিয়ট রোডে ওরা থাকত দেড় কামরার বাসায়। মা যখন ছিল তখন তিনিই সব কিছু সামলে নিতেন, নীলের গায়ে আঁচ পড়ত না। এখন প্রতিটি মুহূর্তে ঠোকর খেতে লাগল সে। তাদের পাশের ফ্ল্যাটের আন্টি, যাঁকে সবাই মিসেস রডরিগস বলে, ডেকে বললেন, ‘এবার নিজে রান্না করতে শেখো। প্রথম দিকে না পারলে বলো, শিখিয়ে দেব।’
লোকটা তাকে দেখল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘আট ঘণ্টা পরিশ্রম করতে পারবে?’
নীল মাথা নাড়ল, ‘নিশ্চয়ই পারব।’
‘ছয়-আট মাস সমুদ্রের জলে ভেসে বেড়াতে হবে। এখানকার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক থাকবে না। জাহাজ একবার বন্দর ছেড়ে গেলে ফিরে না আসা পর্যন্ত কান্নাকাটি করেও কোনও লাভ হবে না।’
‘আমি পারব।’
‘বেশ। আমি কথা দিচ্ছি না। কারণ কথা দেওয়ার মালিক অন্য লোক। আমি যে জাহাজ কোম্পানিতে চাকরি করি তার হেড অফিস সিঙ্গাপুরে। কিন্তু চেন্নাইতে একটা শাখা অফিস আছে। সেখানকার বস-কে তোমার জন্যে অনুরোধ করতে পারি। হলে ভালো, না হলে চেন্নাই থেকে ফিরে আসতে হবে। চান্স যদি নিতে চাও তো তাহলে ট্রেনের টিকিট কাটো।’ লোকটা বলল।
কথা শেষ হওয়ামাত্রই মহিলা বললেন, ‘নেবে না মানে? নিশ্চয়ই নেবে। এরকম সুযোগ জীবনে ক’বার আসে? নীল, তুমি চিন্তা কোরো না, তোমার ট্রেনের টিকিট আমি করে দেব।’
‘আপনি করে দেবেন?’ নীল অবাক হয়েছিল।
‘আরে তুমি তো আমার ছেলের মতো। তোমার মা থাকলে যা করতেন তাই আমি করছি। কিন্তু নীল, এই ব্যাপারটা কাউকে বলবে না। এই ইলিয়ট রোডের মানুষগুলোকে বিশ্বাস করি না। কেউ হয়তো তোমার বিরুদ্ধে কিছু জানিয়ে দেবে জাহাজ কোম্পানির কানে। তা ছাড়া ছয়-সাত মাস তোমাদের ঘর তালাবন্দি থাকলে তো বাড়িওয়ালা নিশ্চয়ই দখল নিয়ে নেবে।’ মহিলা চিন্তিত।
নীল বলল, ‘আমি চলে যাওয়ার পর দরজায় তালা দেখে তো বুঝতে পারবে।’
‘কিছুই বুঝবে না। তার জন্যে আমি আছি না? দরজায় তালা ঝোলাবই না। আমার এক বোন তার মেয়ের সঙ্গে তোমাদের ঘরে মাস ছয়েক থাকবে। কেউ কিছুই বুঝতে পারবে না। তুমি ফিরে এলেই ওরা চলে যাবে। ওরা এখন পিকনিক গার্ডেনে থাকে। ওখান থেকে যাতায়াত করতে মেয়েটার খুব অসুবিধে হচ্ছে।’ মহিলা বললেন।
‘কী করে মেয়েটি?’ মহিলার ভাই জিজ্ঞাসা করল।
‘বারসিঙ্গার। খুব ভালো গান গায়।’ মহিলা খুশি খুশি গলায় বলেছিলেন।
‘হাই নীল।’ পেছন থেকে গলা ভেসে আসতে ঘুরে দাঁড়াল নীল। প্যাসেজ থেকে বেরিয়ে এগিয়ে আসছে স্যাম। তার থেকে বছর পাঁচেকের বড় ছেলেটা। এরমধ্যে তিনবার সমুদ্র ঘুরে এসেছে। রেলিং-এর পাশে এসে দাঁড়িয়ে স্যাম জিজ্ঞাসা করল, ‘কী দেখছ?’
‘কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।’ নীল জবাব দিল।
স্যাম হাসল, ‘ঘণ্টা দেড়েক পরে এই কুয়াশাটাকে মিস করবে।’ স্যাম বলল।
‘কেন?’
‘কারণ তখন জাহাজ খোলা সমুদ্রে ঢুকে যাবে। চারধারে শুধু জল আর জল। পূর্ণিমার বেশি দেরি নেই বলে মাঝরাতের পর ফিকে জ্যোৎস্না দেখতে পাবে।’ স্যাম হাসল।
‘তুমি তো তিনবার জাহাজে ভেসেছ। তোমার কাছে সবচেয়ে সুখের অভিজ্ঞতা কোনটা?’
‘যখন বন্দরে জাহাজ পৌঁছে যায়, যখন পায়ের তলায় মাটি পাই তখন মনে মনে বলি, ঈশ্বর তোমায় ধন্যবাদ। ওই সময় মনে যে আনন্দ হয় তার তুলনা নেই।’
‘তার মানে জলে যে-কোনও মুহূর্তে বিপদ হতে পারে তা আমি জানি। কিন্তু এখনকার জাহাজ এত উন্নত যে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই হয়। তাহলে এই জাহাজে চাকরি করেও ডাঙায় নেমে কেন খুশি হও? জাহাজটাও তো নিরাপদ জায়গা।’ নীল বলল।
‘তুমি নেট খুলে দ্যাখো, গত এক বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন সমুদ্রে পাঁচটা জাহাজ তলিয়ে গিয়েছে। কখন কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটে যাবে তা কেউ আগাম বলতে পারে না। ছেড়ে দাও এসব কথা, বাড়ির জন্যে মন কেমন করছে তো?’
‘না। বাড়িতে আমার কেউ নেই যে তার জন্যে মন কেমন করবে।’
‘হঠাৎ জাহাজের কাজে এলে কেন?’
‘আর কোনও চাকরি পাইনি, তাই।’
সেই মহিলার ভাই-এর দৌলতে নীল ক্যাপ্টেনের কাছে গিয়েছিল। চেন্নাইতে পৌঁছে নীল প্রথমে খুব হতাশ হয়েছিল। মহিলার ভাইকে সে আঙ্কল বলে ডাকতে শুরু করেছিল। আঙ্কল বলেছিল, তার জাহাজে কোনও চাকরি খালি নেই। তবে এর আগে আঙ্কল যে জাহাজে চাকরি করত সেটা এখন চেন্নাই বন্দরে আছে। তার ক্যাপ্টেনের কাছে নীলকে নিয়ে যাবে আঙ্কল।
বেশ কিছুক্ষণ পরীক্ষা করার পর ক্যাপ্টেন বললেন, এই যাত্রায় জাহাজ ধোওয়ামোছার চাকরিতে তিনি নীলকে নিতে পারেন। আরও পাঁচটি লোক এই কাজে আছে। ঠিকঠাক করলে পরের ট্রিপে অন্য কাজ দেওয়া হতে পারে। মাইনেপত্র যা ঠিক হল, তা নিয়ে একটিও কথা বলেনি নীল। আঙ্কলের কাছে সে কৃতজ্ঞ এই সুযোগ করে দেওয়ার জন্যে।
প্রথম কয়েকটা দিন ছিল ভয়ংকর। জাহাজ চলছে কিন্তু সে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। সামান্য ওঠা-নামা করলেই পেট মুচড়ে উঠছিল, বমি হচ্ছিল অবিরাম। ওদের ছয়জনের দলের নেতা হলেন ফারুক সাহেব। বাঙালি। তিনি কয়েকটা টোটকা খাইয়েও কাজ না হওয়াতে জাহাজের মেডিক্যাল অফিসারের কাছে নিয়ে গেলেন। তাঁর দেওয়া ইনজেকশনে এবং চব্বিশ ঘণ্টা ঘুমিয়ে থাকার পর শরীর স্থির হল। আরও একদিন বিশ্রাম দিলেন ফারুক সাহেব। তারপর ভোর না হতেই কাজ শুরু। হাত না দিয়ে যন্ত্রের সাহায্যে পুরো জাহাজটাকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করতে হয়। কিন্তু কাজ শেষ করার পর সামান্য ত্রুটি দেখলেই অফিসাররা খাওয়া বন্ধের আদেশ দেন। তাই ফাঁকি দেওয়ার কথা মাথায় থাকে না কারও। ফারুক সাহেব সবসময় পেছনে লেগে থাকেন খুঁত ধরতে। পরিশ্রম হয় প্রচুর। কিন্তু বিকেলে যখন কোনও কাজ নেই, তখন আরামটাকে উপভোগ করতে পারে ওরা।
জাহাজে তাদের জন্যে এখন বিনোদনের ব্যবস্থা আছে। ফারুক সাহেব গল্প করেন, আগে যখন যন্ত্রের সাহায্য পাওয়া যেত না তখন কাজ শেষ করতে বিকেল হয়ে যেত। শরীরে শক্তি থাকত না এক ফোঁটাও। আর বিছানায় শরীর এলিয়ে পড়ে থাকা ছাড়া অন্য কোনও চিন্তা মাথায় আসত না। এখন টিভি এসেছে ঘরে। সবই যে ইংরেজি চ্যানেল তা নয়। স্প্যানিশ তো আছেই, ফরাসি-ইতালিয়ান থেকে শুরু করে আফ্রিকার বিভিন্ন ভাষার অনুষ্ঠান-সিনেমা সেখানে দেখানো হয়। ভাষা না বুঝেও অনেকে ছবি দ্যাখে বুঁদ হয়ে। তখন নীল বেরিয়ে আসে ডেকে, জাহাজের ওপরের প্যাসেজে। সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখতে তার খুব ভালো লাগে।
এই যে বন্দরে জাহাজ থেমেছিল, সমুদ্রযাত্রায় এটিই নীলের প্রথম বন্দর। সঙ্গীরা একদিনের ছুটি পেয়ে প্রবল উৎসাহিত হয়ে নেমেছিল। বন্দরের জীবন নাকি আলাদা। পকেটে টাকা থাকলে অনেকরকম মজা নাকি উপভোগ করা যায়। নীল নামেনি। সঙ্গীরা অনেক অনুরোধ করেছিল, জাহাজে চাকরি করে বন্দরের মজা নেবে না, এটা হয় নাকি?
নীল রাজি হয়নি। সে সদ্য চাকরিতে ঢুকেছে। পকেটে রয়েছে সামান্য টাকা। তা অকারণে খরচ করতে উৎসাহ পায়নি। ওরা চলে গেলে সে ডেকের ওপর ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পেল ফারুক সাহেবকে। একমনে নামাজ পড়ছেন। নীল লক্ষ করছিল মানুষটাকে। উঠছেন, বসছেন, প্রার্থনা করছেন। নামাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে অপেক্ষা করল। শেষ হওয়ার পর ফারুক সাহেব মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখতে পেয়ে হাসলেন, ‘এ কী! তুমি ওদের সঙ্গে গেলে না?’
‘না:।’ নীল বলল, ‘আপনিও তো যাননি।’
‘আমার কি মজা করতে যাওয়ার বয়স আছে ভাই! এখন শুধু আল্লাকে ডাকি আর বলি, যে-ক’টাদিন বাঁচব ততদিন যেন তোমার দয়া পাই।’
‘ক’টাদিন বাঁচার কথা ভাবছেন কেন? আপনি এখনও অনেকদিন থাকবেন।’
‘প্রায় তিনকুড়ি বছর পার করতে চলেছি। তুমি আমার জন্যে দোয়া করো যেন চলে যাওয়ার পরে আল্লার আশ্রয় পাই।’ কাছে এলেন ফারুক ভাই।
‘আপনার বাড়িতে কে কে আছেন?’
‘কেউ নেই, কেউ নেই।’ ফারুক সাহেব মাথা নাড়লেন। তারপর আচমকা উলটোদিকে চলে গেলেন। নীলের মনে হল, মানুষটা তাঁর ব্যক্তিগত কথা বলতে চাইলেন না।
মধ্যরাতে নীলের ঘুম ভাঙল চেঁচামেচি কানে ঢোকায়। সে দেখল তার সঙ্গীরা ফিরে এসেছে কিন্তু ওদের একজন মাতাল হয়ে চিৎকার করছে। বাকিরা থামাবার চেষ্টা করেও পারছে না। বিছানায় উঠে বসে লোকটাকে সে দেখল। ইলিয়ট রোডে থাকত বলে সে অনেক মাতাল দেখেছে।
হঠাৎ তার মেজাজ বিগড়ে গেল। বিছানা থেকে নেমে সজোরে একটা চড় কষিয়ে দিল মাতাল লোকটার গালে। প্রচণ্ড অবাক হয়ে মাতালটা নিজের গাল চেপে ধরল, তার সঙ্গীরাও হতবাক। মাতাল লোকটার চোখে এখন ভয় স্পষ্ট। সে জামাপ্যান্ট পরা অবস্থাতেই বিছানায় শুয়ে পড়ল চুপচাপ। সঙ্গীরাও কোনও কথা না বলে যে যার বিছানায় যাওয়ার আগে পোশাক বদলাতে লাগল। এইসময় ফারুক সাহেবের গলা ভেসে এল, ‘থ্যাঙ্কু নীল’। নীল তাকাতেই তিনি দরজা থেকে সরে গেলেন।
পরের দিন সকালে উঠে নীল ভেবেছিল ওই চড় মারা নিয়ে মাতাল লোকটা নিশ্চয়ই খুব ঝামেলা করবে। কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখল, লোকটা বলছে, ‘নীল, আই অ্যাম গ্রেটফুল টু ইউ। তুমি কাল আমাকে সেন্সে ফিরিয়ে দিয়েছিলে বলে তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
‘এমন মদ খেয়েছিলে কেন যা তুমি সহ্য করতে পারো না?’ নীল স্বস্তিতে বলেছিল।
‘বাধ্য হয়ে খেয়েছিলাম। ওই স্যাম ব্যাটা আমাকে প্রভোক করেছিল।’
‘স্যাম তোমাদের সঙ্গে গিয়েছিল?’
‘না। আলাদা দলে গিয়েছিল।’
‘ও। কিন্তু কেউ তোমাকে প্রভোক করলেই তুমি মাতাল হবে?’
কিছু বলতে গিয়েই চুপ করে গিয়েছিল লোকটা।
পরে স্যামের সঙ্গে যখন দেখা হয়েছিল তখন ওকে খুব স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। একবারও গতরাতের ঘটনার কথা উচ্চারণ করেনি।
গতকাল বিকেলে সমুদ্রে দৃশ্যটা দেখতে পেয়েছিল নীল। সে ঘরে ছিল, স্যামই ছুটে এসে তাদের ডেকে আসার জন্যে অনুরোধ করেছিল। ওরা ফিরে ডেকে উঠে দেখল দৃশ্যটা। মাঝে-মাঝেই জল থেকে ওপরে উঠে কিছুটা উড়ে গিয়ে জলে নামছে মাছগুলো। শেষ সূর্যের মায়ায় তাদের শরীর থেকে রুপোলি আলো যেন ছিটকে বের হচ্ছিল। ফারুক সাহেব বললেন, ‘এগুলোকে বলা হয় উড়ুক্কু মাছ। জানি না কপালে কী আছে।’
‘তার মানে?’ নীল গল্পের গন্ধ পেল।
‘তোমরা হাসবে। কিন্তু মানুষের মনে একটা কুসংস্কারের পুতুল থাকে। কখনও কখনও মানুষ তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে সেই পুতুলটাকে গুরুত্ব দেয়। এই আর কী!’
‘আপনি সরাসরি বলুন না!’ স্যাম নীলের পাশে এসে দাঁড়াল। নীল অবাক হল, কাল রাতে যার সঙ্গে স্যামের ঝামেলা হয়েছিল সেই মাতাল লোকটা এখন বন্ধুর মতো স্যামের পাশে দাঁড়িয়ে ফারুক সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে।
ফারুক সাহেব বললেন, ‘বেশ। গল্পটা শোনো। কিন্তু বিশ্বাস কোরো না। প্রথম জীবনে আমি মিলিটারিতে ছিলাম। সাধারণ সোলজারের চাকরি। হঠাৎ আমাকে বদলি করা হল যে রেজিমেন্টে তারা চিন-ভারত সীমান্তে থাকে। চারধারে বরফ, প্রচণ্ড শীত। খুব কাহিল হয়ে পড়লেও চাকরি ছেড়ে আসতে পারিনি। আমার পাঠানো টাকায় সংসার চলত। মাঝে-মাঝেই প্র্যাকটিস সেশন চলত। একটা পাহাড় থেকে কাছাকাছি আর একটা পাহাড়ের টার্গেটে গুলি ছুড়তে হত। কিন্তু গুলি টার্গেটে লাগছে কি না, লাগলে কোথায় লাগছে তা দেখার জন্যে ওই টার্গেটের নীচে একজন সোলজারকে পোস্টিং করা হত। সে একটা পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে বিচার করে আমাদের পয়েন্ট লাগিতে দিত কিন্তু তার শরীরে গুলি লাগত না। ওই পাথরের আড়াল ওকে রক্ষা করত। সেদিন সকাল থেকে প্র্যাকটিস। শুরু হয়েছিল। যে সোলজারকে সেদিন বিচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তার সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল। ঘণ্টা তিনেক কাজ করার পর সাময়িক বিরতি। সোলজারের একটা বদঅভ্যেস ছিল। সে খুব ঘন ঘন বিড়ি খেত। সেদিন বিড়ি ফুরিয়ে যাওয়ায় তার অস্বস্তি শুরু হয়েছিল। নিজের ঘড়ি দেখে সে বুঝল দ্বিতীয় সেশন শুরু হতে কুড়ি মিনিট দেরি আছে। এই সময়ের মধ্যে সে আট মিনিট দূরে থাকা অন্য জোয়ানের কাছ থেকে বিড়ি নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু বেচারার ঘড়ি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সে লক্ষ করেনি। সে আড়াল থেকে বেরিয়ে আসার মিনিট খানেক পরেই আবার প্র্যাকটিস শুরু হয়ে গেল। সেই গুলিতে তার শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। তারপর তার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানানোর জন্যে সেখানে একটা শহিদবেদি তৈরি করা হয়। মজার কথা হল, সোলজাররা সেই বেদিকেই মন্দির বানিয়ে নিল। ক্রমশ তারা বিশ্বাস করতে লাগল ওই মন্দিরে পুজো না দিয়ে ওই এলাকায় থাকলে মৃত্যু অনিবার্য। মৃত্যুকে সবাই ভয় পায়। হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমান খ্রিস্টান সোলজাররাও সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় পুজো দিয়ে যেত। আর পুজোতে নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হত বিড়ি। মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল ওই মন্দির হল বিড়িবাবার মন্দির।’ ফারুক সাহেব হাসলেন, ‘মানুষ কত কিছু উদ্ভট কাজ করে।’ তারপর অন্যদিকে পা বাড়ালেন।
স্যাম বুঝদারের ভঙ্গি করে বলল, ‘এরকম হয়, আমি শুনেছি।’
নীল বলল, ‘হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এই গল্পের সঙ্গে উড়ুক্কু মাছের কী সম্পর্ক? ফারুক সাহেব ওই কথাটাই বললেন না।’
স্যাম হাসল, ‘ওর বলার কিছু ছিল না। তাই একটা গ্যাজাখুরি গপ্পো শুনিয়ে গেল। বুড়ো লোকদের যা স্বভাব।’
এই জাহাজের ক্যাপ্টেন একেবারে অধস্তন কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলেন যখন শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন হয়। তাঁর নীচে যাঁরা আছেন তাঁরাও দরকার পড়লে গ্রুপ লিডারদের ডেকে কথা বলেন। কিন্তু রোজ দুবার ক্যাপ্টেন পুরো জাহাজটাকে ঘুরে দ্যাখেন। এদিন দুপুরে যখন নীল ডেক পরিষ্কার করছে তখন ক্যাপ্টেনকে আসতে দেখে মুখ নীচু করে কাজ করতে লাগল। কিন্তু পাশ দিয়ে চলে না গিয়ে ক্যাপ্টেন তার সামনে এসে দাঁড়ালেন, ‘তোমার নাম তো নীল? নিউ রিক্রুট?’
‘ইয়েস স্যার।’
‘কাল তুমি একটা মাতালকে চড় মেরে থামিয়েছিলে?’ ক্যাপ্টেন জিজ্ঞাসা করলেন।
মাথা নীচু করে দাঁড়াল নীল। চড় মারা কাজটা অবশ্যই ভালো নয় এবং একারণে ক্যাপ্টেন নিশ্চয়ই তাকে শাস্তি দেবেন। ক্যাপ্টেন বেশ কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন মেরেছ?’
মাথা নীচু করেই নীল জবাব দিল, ‘মাতাল হয়ে এমন চিৎকার করছিল যে আমি সহ্য করতে পারিনি।’
‘হুম।’ ক্যাপ্টেন বললেন, ‘আজ বিকেল পাঁচটায় আমার অফিসে আসবে।’ বলে তিনি চলে গেলেন।
দূরে দাঁড়িয়ে তদারকি করছিলেন ফারুক সাহেব। নীল দ্রুত তাঁর কাছে গিয়ে ব্যাপারটা জানিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার কী হবে?’
‘কী আর হবে! তোমাকে তো ওই সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার হুকুম দিতে পারবে না। যতদিন নেক্সট পোর্টে জাহাজ না যাবে ততদিন নীচের সেলারে বন্দি থাকবে। পোর্ট এলে সেখানে তোমাকে নামিয়ে দেওয়া হতে পারে। সেখান থেকে কী করে দেশে ফিরবে তা তোমার চিন্তা।’ ফারুক সাহেব বললেন, ‘এখন যা করছিলে সেটা করো।’
বিকেল পাঁচটায় দোতলায় ক্যাপ্টেনের ঘরের সামনে পৌঁছোল নীল। এই এলাকায় কাজ ছাড়া তারা আসতে পারে না। ক্যাপ্টেনের খাস বেয়ারা তাকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘এই, তুমি এখানে কেন? যাও, নীচে যাও।’
নীল বলল, ‘সাহেব আমাকে আসতে বলেছেন, আমার নাম নীল।’
লোকটা থতমত খেয়েও নিজেকে সামলে নিল, ‘অ। সাহেবকে জিজ্ঞাসা করে আসি।’
লোকটা ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে চলে গেল। নীল চারপাশে তাকাল। এদিকের সবকিছু দামি জিনিস দিয়ে সাজানো। ফারুক সাহেব তাদের দিয়ে জাহাজের প্রায় সবখানেই ধোওয়ামোছার কাজ করান, এদিকটা বাদে। এখানে সাহেবের নিজস্ব কর্মচারীরা কাজ করে। সে দূরে তাকাল। সমুদ্র শান্ত, আকাশে কোনও পাখি নেই। বহু দূরে একটা জাহাজ আবছা দেখা যাচ্ছে। একটা সমুদ্রে কত জল থাকে কে জানে। এই জাহাজের কত নীচে গেলে বালি বা মাটি পাওয়া যাবে তাও জানা নেই। এরই মধ্যে পুরোনো নাবিকরা গল্প শুনিয়েছে, আগে প্রায়ই জাহাজ ডুবে যেত। ঝড়বৃষ্টিতে ঢেউ প্রবল হয়ে জাহাজ ডুবিয়ে দিত। সেইসব জাহাজে ঘুমন্ত অবস্থায় যারা মারা যেত তাদের আত্মার মুক্তি হত না। জাহাজ যেখানে ডুবে ছিল সেখানেই সেই সব আত্মা অন্য জাহাজের জন্যে অপেক্ষা করে। জাহাজিরা জেনে গেছে তাই ওই অঞ্চলে যখন জাহাজ যায় তখন কেউ ডেকে দূরের কথা, প্যাসেজে পা রাখে না। সবাই বন্ধ ঘরে প্রেয়ার করে। নামাজ পড়ে, ধূপ জ্বালিয়ে পুজো দেয়। গল্পটা শুনে হাসি পেয়েছিল নীলের। কিন্তু সিনিয়ারদের একজন তাকে বলেছিল, ‘অনেক ঘটনা ঘটে যায় ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। যতক্ষণ না কোনও কিছুকে মিথ্যে প্রমাণ করতে পারো ততক্ষণ তাকে অবিশ্বাস করা উচিত নয়।’
‘এসো।’ সেই বেয়ারাটা বিরক্তমুখে তাকে ডাকল।
কী মনে হল, নীল একটু তেল মারল, ‘স্যার, উনি কি একা আছেন?’
স্যার শুনে বোধহয় লোকটার মুখে হাসি ফুটল। কাঁধ নাচিয়ে বলল, ‘একাই আছেন।’
প্যাসেজ পেরিয়ে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সোজা হল নীল। তারপর দরজায় টোকা মারল। একবার শব্দটা হতেই ভেতর থেকে আওয়াজ ভেসে এল, ‘কাম ইন।’
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে নীল দেখল একটা বিশাল টেবিলের ওপাশে বসে ক্যাপ্টেন সাহেব ল্যাপটপে কাজ করে যাচ্ছেন। হাতের কাজ শেষ করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি ডেটা এন্ট্রি করতে পারবে?’
পড়াশুনায় তেমন মন কখনওই ছিল না। কিন্তু হায়ার সেকেন্ডারির পরে মা তাকে জোর করে রিপন স্ট্রিটের একটা কম্প্যুটার ট্রেনিং সেন্টারে ভরতি করে দিয়েছিল। একবছরের কোর্স করেছিল সে। কিন্তু পরে কাজে লাগায়নি। শাস্তির বদলে এই প্রস্তাব পেয়ে মাথা নাড়ল নীল, ‘পারব।’
‘গুড। তুমি কাল আমার অফিসের ডিসিলভার সঙ্গে দেখা করবে। সে তোমাকে কী কী করতে হবে বুঝিয়ে দেবে। কিন্তু একটা কথা, ডিসিলভা জেগে থাকলেই ড্রিঙ্ক করে থাকে। দয়া করে তার গালে চড় বসিয়ে দিও না। যাও।’ ক্যাপ্টেন সাহেব আবার কাজে মন দিলেন।
বাইরে বেরিয়ে নীল বেয়ারাটাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ডিসিলভা সাহেব কে?’
‘জাহাজে কাজ করো আর ডিসিলভা সাহেবের নাম শোনোনি?’ বেয়ারা খিঁচিয়ে উঠল।
‘না স্যার। এটা আমারই অন্যায়।’ নীল বলল।
‘ঠিক আছে। তুমি নিশ্চয়ই নতুন?’
‘হ্যাঁ স্যার।’
‘ওই যে অফিস ঘর দেখছ, ওখান থেকেই জাহাজের সমস্ত অফিসিয়াল কাজকর্ম করা হয়। ডিসিলভা সাহেব ওই অফিসের চার্জে আছেন। কাজ পাগলা মানুষ বোঝো? উনি ঠিক তাই। অফিসেই খান, অফিসেই ঘুমোন। কাজ ছাড়া কিছু বোঝেন না।’ বেয়ারা বলল।
‘কেন ওঁর নিজের কেউ নেই?’
‘থাকবে না কেন? সেখানে যাওয়ার উনি সময় পান না।’
নীল বুঝল আগামীকাল ওখানেই তাকে আসতে হবে। ধন্যবাদ জানিয়ে সে চলে আসছিল। বেয়ারা তাকে পিছু ডাকল, ‘শোনো, আমাকে তুমি স্যার বলছ, ঠিক আছে। কিন্তু অন্য কেউ সামনে থাকলে এটা বোলো না। জাহাজে যারা কাজ করে তারা একটু হিংসুটে হয়। বুঝতে পারলে?’
মাথা নেড়ে চলে এসেছিল নীল।
জাহাজের জীবনটা বদলে গেল নীলের। সকাল আটটায় তাকে হাজির হতে হয় অফিসে। ডিলিসভা তাকে গাদা গাদা কাগজ দেন, এন্ট্রি করতে। জড়তা ভাঙতে কয়েক ঘণ্টা লেগেছিল। প্রথম দিন সেই কয়েক ঘণ্টায় নিজের চুল ছিঁড়তে বাকি রেখেছিলেন ডিসিলভা। বারংবার চিৎকার করেছিলেন, ‘গাধা দিয়ে ঘোড়ার কাজ হয় না। আমার কাছে যাচাই করতে না পাঠিয়ে একেবারে পোস্টিং দিয়ে দিল ক্যাপ্টেন। আজ ওর হবে! এসপার কি ওসপার করব আমি!’
রোগা, পাকা চুলে ঢাকা মাথা, চশমা নাকের ডগায়, গ্যালিস-দেওয়া প্যান্ট পরা লোকটি চিৎকার শেষ করে পকেট থেকে একটা নিব বের করে গলায় ঢাললেন দুবার। তারপর ফোন তুলে ক্যাপ্টেনকে চাইলেন। ওপাশ থেকে তাঁকে জানানো হল এইমুহূর্তে ক্যাপ্টেন খুব ব্যস্ত আছেন। তিনি আধঘণ্টা পরে ডিসিলভাকে ফোন করবেন। রিসিভার রেখে ডিসিলভা ছুটলেন অন্য টেবিলে। সেখানে যিনি কাজ করছিলেন তাঁকে বোঝাতে লাগলেন কিছু। শেষ পর্যন্ত অনভ্যাসের জড়তা কাটাতে পারল নীল। একেবারে পাকা হাতের নয়, কিন্তু থেমে থাকল না। কাজ শুরু করে দিল সে মনোযোগের সঙ্গে। পঁচিশ মিনিটের মাথায় ডিসিলভা দ্রুত কাছে এলেন, ‘বলো। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।’
নীল কুঁকড়ে গিয়ে বলল, ‘স্যার, একবার দেখুন—!’
হঠাৎ ঝুঁকে কাজটা দেখে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক, ‘এতক্ষণ কি ন্যাকামি করছিলে?’
‘না স্যার!’
‘তার মানে অনেকদিন এই কাজ করোনি। পড়ে থাকা লরি স্টার্ট নিতে দেরি করে। তা কথাটা আমাকে বললেই পারতে। যত্তসব।’ পকেট থেকে নিপ বের করে তরল পদার্থ গলায় ঢেলে টেলিফোনের কাছে গিয়ে রিসিভার তুলে বললেন, ‘ক্যাপ্টেনকে বলুন, আমার জন্যে তিনি যেন অপেক্ষা না করেন। আই অ্যাম অলরাইট।’
লাঞ্চের সময় কাজ অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল। অফিসের সবাই যখন ব্রেক নিয়েছে তখন ডিসিলভা সাহেব এখানে কাজ করে চলেছেন। ভদ্রলোক উঠছেন না দেখে শেষ পর্যন্ত নীল ভয়ে ভয়ে কাছে গিয়ে বলল, ‘স্যার, আমি কি লাঞ্চে যেতে পারি?’
তার দিকে না তাকিয়ে ডিসিলভা বললেন, ‘আমাকে জিজ্ঞাসা করছ কেন?’
‘আপনি যাচ্ছেন না দেখে—।’
‘আমি তো অভুক্ত নই।’ সকাল থেকে মাঝে-মাঝেই পেটে খাবার পাঠাচ্ছি। আর-একটা বার্গার এখনই আমার টেবিলে এসে যাবে।’ ডিসিলভা জানালেন।
‘স্যার, কেউ যদি আমার লাঞ্চটা টেবিলে দিয়ে যায় তাহলে একই কাজটা কন্টিনিউ করতে পারি। সময় নষ্ট হয় না।’ নীল বলল।
আচমকা ঘুরে বসলেন ডিসিলভা, ‘প্রথম দিন এসে তুমি আমাকে কাজ দেখিয়ে ইমপ্রেস করবে ভেবেছ? আই অ্যাম সিওর, তুমি এতক্ষণ যা করেছ তাতে থার্টি পার্সেন্ট ভুল হয়েছে।’ বলেই উঠে এলেন। সোজা নীচের চেয়ারে বসে পরীক্ষা করতে লাগলেন।
শেষতক দেখার পর চশমা খুলে রুমালে কাচ মুছে বললেন, ‘একজন সেলর ড্রাঙ্ক হয়ে চেঁচামেচি করেছিল বলে তুমি তাকে চড় মেরেছিলে?’
মুখ নীচু করল নীল। ব্যাপারটা ডিলিসভা সাহেবও জানেন!
‘ঠিক করেছ। যারা ড্রিঙ্ক করে চেঁচায়, রাউডি হয় তাদের গালে চড় মারাই উচিত। গত কুড়ি বছর ধরে আমি ড্রিঙ্ক করে যাচ্ছি কিন্তু কোনওদিন মাতাল হইনি। তুমি ড্রিঙ্ক করো?’
‘না স্যার!’
‘আজ থেকে শুরু করো। যদি মাতাল হও তাহলে সমুদ্রে ফেলে দেব।’ ডিসিলভা সাহেব হাত নাড়লেন, ‘যাও লাঞ্চ খেয়ে এসো।’ তারপর হাসলেন, ‘সবাই সব কিছু পারে না। আমি একটু মজা করছিলাম। কোনওদিন যেন মুখে মদের গন্ধ না পাই। যাও।’
অফিসঘরে আরও তিনজন কাজ করেন। কিন্তু তাঁদের দেখে রোবট বলে মনে হয় নীলের। কেউ কাজের বাইরে কথা বলেন না। হাসেন না। এদিন লাঞ্চের সময় খাবারের থালা নিয়ে ওঁদের পাশে বসল নীল। তিনজনেই তার দিকে একবার তাকিয়ে চুপচাপ খেতে লাগল।
নীল খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করল, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনাদের খুব গম্ভীর লাগে। কেন?’
পাশে যিনি বসেছিলেন, তিনি প্রৌঢ়, বললেন, ‘আমাদের মন খুব খারাপ ভাই।’
‘কেন? কী হয়েছে?’
‘আমাদের এক সহকর্মীর কোনও আত্মীয়স্বজন নেই। তার মৃতদেহ দেশে নিয়ে যাওয়া হবে কি না জানতে চাওয়া হয়েছিল। কেউ সাড়া দেয়নি। খুব হাসিখুশি ছিল লোকটা। টুপ করে মরে গেল।’
‘ও হো!’ মাথা নাড়ল নীল, ‘কী কাজ করতেন তিনি?’
‘আমাদের সঙ্গেই, আমাদের ঘরে। তুমি যে চেয়ারে বসছ সেই চেয়ারেই বসত সে।’
আচমকা মেরুদণ্ডে কাঁপুনি ছাড়ল। যে মানুষটি ওই চেয়ারে বসে কাজ করত তার মৃত্যুর পরে তাকে একই জায়গায় বসে কাজ করতে হচ্ছে! ঢোঁক গিলে সে জিজ্ঞাসা করল ‘তার মৃতদেহ এখন কোথায়?’
‘জাহাজের হিমঘরে। আজ সূর্যাস্তের সময় ওকে জলসমাধি দেওয়া হবে। তুমি জিজ্ঞাসা করলে বলে এত কথা বললাম। আমাদের কথা বলতে একটুও ইচ্ছে করছে না।’ কথা শেষ করে আবার চুপচাপ খেতে লাগলেন লোকটি।
খাওয়া শেষ করে রেলিং-এর পাশে দাঁড়িয়ে নীল সমুদ্র দেখছিল নীল। জাহাজ ছুটে চলেছে জল ভেঙে। আর এই জাহাজের কোনও হিমঘরে পড়ে আছে যার মৃতদেহ সে নিশ্চয়ই বহুবছর একই কাজ করে গেছে জলের ওপরে জাহাজে বসে। ছয়-সাত মাস ধরে লোকটার বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ থাকার কথা নয়। কিন্তু তার পরে যখন বাড়িতে যেত তখন কি সেখানে কেউ থাকত না? থাকলে তার মৃতদেহ ঠিকঠাক সৎকারের জন্যে নিয়ে যেতে অনুরোধ করত। হঠাৎ নিজের কথা মনে এল। মা চলে যাওয়ার পরে তারও তো কেউ নেই। খুব বিচ্ছিরি হয়ে গেল মনটা। এই সময় জাহাজের সাউন্ড সিস্টেমে ক্যাপ্টেনের গলা শোনা গেল, ‘আজ বিকেল পাঁচটার সময় প্রতিটি বিভাগের একজন কর্মচারী পরলোকগত সহকর্মী জন গাব্রিয়েলকে চিরবিদায় দিতে সামনের ডেকে উপস্থিত থাকবেন।’
হঠাৎ পেছন থেকে গলা ভেসে এল, ‘তোমার নাম তো নীল?’
ঘুরে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ল সে, ‘হ্যাঁ।’
যে লোকটি তার পাশে বসে খেতে খেতে মৃত্যুসংবাদ দিয়েছিলেন, তিনি বললেন, ‘আমরা ওঁর বিদায়দৃশ্য দেখতে চাই না। ভাই, আমাদের বিভাগ থেকে তুমি বিকেলে, সামনের ডেকে যাবে। ঠিক আছে?’
নীরবে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল নীল।