রসাতল

রসাতল

মহেশ ঘোষ খানিকটা আগে আগেই বাড়ি ফিরলেন। মন ভার, মুখ ভার। নিজের ঘরে এসে দেখলেন, স্ত্রী নবতারা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুঠো মুঠো পাউডার ছড়াচ্ছেন গায়ে। মাথার চুল ঝুঁটি করে বাঁধা, চুড়োর মতন। ঘাড়ে গলায় চাপ চাপ পাউডার ; সারা মুখ সাদা। হাতে বুকেও অজস্র পাউডার ; পায়ের তলায় মেঝেতেও পাউডারের গুঁড়ো ছড়িয়ে আছে।

মহেশ কয়েক পলক আলমারির আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আলমারিটা তাঁর বাবার আমলের। পয়লা নম্বর বর্মি টিক দিয়ে তৈরি, ইংলিশ ডিজাইন। আলমারির একটা পাল্লায় আসল বেলজিয়াম গ্লাস। পুরোটাই। আয়নায় স্ত্রীকে আপাদমস্তক দেখা যাচ্ছিল, শাড়ির আঁচল ভূলুণ্ঠিত, গায়ের জামাটা ঢোল্লা নিমা ধরনের।

আলমারির মতন তাঁর এই স্ত্রীটিও বাবার আমলের। বাবাই এনে ঘরে ঢুকিয়েছিলেন। উনিও বর্মি। তবে আসল নয়। রেঙ্গুনে জন্ম, দিল্লিতে বালিকা জীবন, কলকাতায় যৌবন-সমাগম, তার পর দুর্গাপুরে এসে বিবাহযোগ্যা কন্যা। বাবার কৃপায় তখন থেকেই উনি মহেশের সহধর্মিণী। নবতারা নামটি থেকে ‘নব’-টি কবে খসে গেছে। এখন উনি ‘তারা’। অবশ্য মাঝে মাঝে মহেশ সোহাগ করে স্ত্রীকে তারাসুন্দরী বলে ডাকেন।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, গায়ের আঁচল মাটিতে লুটিয়ে মহেশের তারাসুন্দরী পাউডার মাখছেন, ঘরের দু’কোণের দুটো পাখাই ঝড়ের বেগে ঘুরছে, পাউডার উড়ছে বাতাসে, লেবু-লেবু গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে, বাতি অবশ্য একটাই জ্বলছিল। এমন একটি দৃশ্য অন্য দিন দেখলে মহেশ হয়ত গান গেয়ে উঠতেন, আহা কী শোভা দেখ রে, মাচা তলে রাধা সাজে বাহা রে। আজ আর গান এল না গলায়, অন্য কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন—তার আগেই নবতারা কথা বললেন। “আজ এত তাড়াতাড়ি?”

গায়ের জামা আলগা করতে করতে মহেশ বললেন, “চলে এলাম।”

“চলে এলে! তাসপাশা জমল না?” বলতে বলতে নবতারা মুখের ওপর জমা পুরু-পাউডার আলতো করে মুছে নিলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন দেওয়াল-ঘড়িটা। হিসেব তাঁর ভুল হয়নি। এখন মাত্র সোয়া আট। ঘোষবাবু রাত সাড়ে নয় কি দশের আগে বড় একটা বাড়ি ফেরেন না। আজ আগে আগেই ফিরেছেন।

মহেশ গায়ের জামা খুলে জায়গা মতন রাখতে রাখতে বললেন, “এ-মাসে ক’কৌটো হল? ছয় না সাত?”

কথাটা শুনেছিলেন নবতারা। জামার তলায় আরও খানিকটা পাউডার ছড়িয়ে বললেন, “কেন? হিসেব চাইছ?”

‘না। হিসেব চাইছি না। হিসেবের দিন ফুরিয়ে গেছে। এবার নিকেশ।.. আহা, কী চেহারাই হয়েছে এ-সংসারের। বাড়িতে ঢুকলাম, নীচে তোমার ছোট ছেলে আর মেয়ে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডা জমিয়েছে। গান শুনছে—ইংরিজি গান। আই লাভ ইউ বেবি। স্টিরিও ফেটে যাবার জোগাড়। ও তো গান নয়, কামান। …আর ওপরে এসে দেখি—তুমি বন বন করে দুটো পাখা চালিয়ে বাঘের মতন থাবা করে পাউডার মাখছ। বাঃ, বেশ!”

লুটোনো শাড়ির আঁচল তুলে নিতে নিতে নবতারা বললেন, “তাতে হয়েছে কী? দুটো পাখা চললে আর দু’কৌটো পাউডার খরচ হলে তুমি কি ফতুর হয়ে যাচ্ছ! নিজে যখন দু’বোতল গিলে আস—তখন হিসেবটা মনে থাকে না।”

“বাজে কথা বোলো না। বোতল আমি গিলি না।” “না, তুমি গেলো না বোতল তোমায় গেলায়। ’’

“আবার বাজে কথা। মাসকাবারি বাজারে দু’চারটে বাড়তি জিনিস তোমার সংসারে আসে না? আমাদেরও ওই রকম মাসকাবারি হিসেব। তুলসীরই যা রোজকার বাজার।”

“আমারই বা নিত্যি দিনের নাকি! গরমে মরছি, বুকপিঠ ঘাড়গলা জ্বলে যাচ্ছে ঘামাচিতে, দু’কৌটো পাউডার যদি মেখেই থাকি—তোমার এত খোঁটা দেবার কী আছে! না হয় তোমার পয়সায় মাখব না আর, ছেলের পয়সায় মাখব।”

“থাক, তোমার ছেলেদের বহর বোঝা গেছে। বড়টি তো টু-ইন-ওয়ান হয়ে আছেন। তাঁরা দুটো মানুষ থাকেন—তাতেই বাবু-বিবির চলে না, যখন-তখন ভরতুকি পাঠাতে হয়।”

“আমার ছেলে…”

“তিন হাজারি। তিনে এখন কিছু হয় না। বাইরে থাকেন তো! ছেলে, ছেলের বউয়েরও কুলোয় না ওতে। বাপের ভরতুকিটা হল ওদের ঠেকো। যাক গে, তুমি মাখো। গরমে ঘামাচি, শীতে পা-ফাটার ক্রিম…”

“তার মানে! ঘামাচিতে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে না বলছ?”

“তা বলিনি। বলছি ঘামাচি আর বেঙাচি একই ক্লাসের। ও যায় না।”

“কিসে যায়?”

“নিজেই যাবে। এই তো বর্ষা পড়ে গেল। এবার যাবে।”

“ও! খুব টেরা টেরা কথা বলছ যে আজ—!” নবতারা আলমারির কাছ থেকে সরে এলেন। স্বামীকে দেখতে লাগলেন খুঁটিয়ে। নেশার কোনও চিহ্ন নেই। বরং অন্য অন্য দিন মুখের যেমন স্বাভাবিক ভাব থাকে, আজ তা নেই। খানিকটা গম্ভীর মুখ। কপালটাও কোঁচকানো সামান্য। আড্ডা-ফেরত স্বামীকে বেশিরভাগ সময়েই হাসিখুশি মজাদার লাগে, যেন আড্ডার রেশ নিয়েই বাড়ি ফেরেন। আজ ঘোষবাবুর মুখের এ-চেহারা কেন! নবতারা বললেন, “কী হয়েছে? ঝগড়াঝাটি?”

“ঝগড়াঝাটি! বন্ধুদের সঙ্গে আমি ঝগড়া করব?”

“তাস খেলতে খেলতে তো করো। “

“সে খেলার ঝগড়া।’’

“তা হলে হয়েছে কী? আসর ভেঙে চলে এলে?”

মহেশ ততক্ষণে কলঘরে যাবার জন্যে তৈরি। হাতমুখ ধুয়ে এসে বসবেন আরাম করে ; কাপড় বদলানো হয়ে গিয়েছে।

“তা হলে?” আবার বললেন নবতারা।

জবাব দেবার আগে মহেশ ডান হাতটা পায়ের দিকে ঝুলিয়ে আঙুল দিয়ে মাটি দেখালেন। বললেন, “শেষ।… আমার এখন রসাতল অবস্থা। রসাতল গমন।”

নবতারা কিছুই বুঝলেন না। অবাক হয়ে বললেন, “কী গমন?” “রসাতল। মানে মরণদশা। সাত-আট নয়—ব্যাস…”

নবতারার মাথাটি বেশ গোলগাল। তা যত গোলই হোক, দেহের অন্যান্য অঙ্গ ও অংশ যে-পরিমাণ গোলাকার তার তুলনায় কিছুই নয়। পাকা, আধপাকা চুল ও গোল মাথা নিয়েও নবতারা কথাটার অর্থ ধরতে পারলেন না। বললেন, “কী বলছ রসাতল ফসাতল! কিসের মরণদশা?”

“আমি বলেছি নাকি! যা বলেছে তাই বলছি। বলেছে, রসাতল অবস্থা। মরণদশা। সাত আট নয়…ব্যাস। শেষ।” বলতে বলতে পায়ে চটি গলিয়ে মহেশ এগিয়ে যাচ্ছিলেন দরজার দিকে।

নবতারা স্বামীর হাত ধরে ফেললেন। “কে বলেছে?”

“চু চে চোল। মানে তিব্বতি বাবা!”

“সে আবার কে? তিব্বতি বাবাটা পেলে কোথায়?”

“নন্দর বাড়িতে। নন্দর কেমন ভাই হয়। পাঁচ বছর তিব্বতে আর তিন বছর ভুটানে ছিল। ওদিককার তন্ত্রসিদ্ধ পুরুষ। বড় বড় জটা, মানে ওই ক্লাসের চুল, ইয়া দাড়ি-গোঁফ, চোখ দুটো একেবারে ছুরির মতন। না, চোখ দুটো বড় বড় গোল গোল—কিন্তু দৃষ্টিটা ছুরির মতন।”

নবতারা বললেন, “তুমি আমায় ভয় দেখাচ্ছ?”

“আমি তোমায় ভয় দেখাব! আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা। নিজেই আমি ভয় পেয়ে গেছি। রসাতল অবস্থাটা বুঝছ না? কী ভয়াবহ দশা!”

“বুঝছি। বেশ বুঝছি,” নবতারা বলেন, “তোমার সঙ্গে চল্লিশ বছর ঘর করে রসাতল বুঝব না!”

“কী কপাল আমার! তা আর একটা ঘর যদি আগে হত—, ইস! আমার কাউন্ট হত চার-পাঁচ-ছয়। ফোর ফাইভ সিক্স। তখন থাকত চ্যারিয়ট—রথারোহণ অবস্থা। তাতে ধনলাভ পুত্রলাভ।”

নবতারা স্বামীকে দেখলেন, নাকমুখ কুঁচকে বললেন, “ধনলাভ পুত্রলাভ। চৌষট্টি বছরের বুড়োর এখনও শখ কত! পুত্রলাভ! তোমার লজ্জা করে না! এ জন্মে আর রথে চড়তে হবে না, পরের জন্মে চড়ো।” হাত ছেড়ে দিলেন নবতারা।

মহেশ বললেন, “পরের জন্মের কথা বলতে পারছি না। এ-জন্ম শেষ হয়ে এল গো, সাত আট নয়—মানে আর টেনেটুনে সাত আর আটে পনেরো প্লাস নয়—মানে চব্বিশ। মাত্তর চব্বিশ মাস ; দু’বছর। তারপরই ফট।” বলতে বলতে তিনি বাইরে চলে গেলেন।

নবতারা যেমন ধাঁধায় পড়ে কিছুই বুঝতে পারছিলেন না—সেইভাবেই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন।

তাঁর স্বামীর বয়েস চৌষট্টি। মানে পঁয়ষট্টিতে সবেই পড়েছেন। শরীর স্বাস্থ্যে কোনও গোলমাল নেই। এই বয়েসে ছোটখাটো যেসব গোলমাল থাকা স্বাভাবিক—তার ছ’আনাও নয়। বেশ মজবুত রয়েছেন ঘোষবাবু। এখনও হপ্তায় দু’দিন মাংস খান, আধ সেরের কাছাকাছি দুধ খান রাত্রে, খাওয়ায় অরুচি নেই, নিজে হাটবাজার করেন, বাগান নিয়ে বসেন প্রায়ই, চারবেলা খবর শোনেন রেডিয়োয়, তাসপাশা খেলেন বন্ধুদের সঙ্গে, বই টইও পড়েন রোজ দু-পাঁচ পাতা। স্ত্রীর সঙ্গে গলাবাজি গলা জড়াজড়ি দুইই হয়, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ফক্কুড়ি করতেও আটকায় না। এই মানুষটির এমন কিছুই হয়নি যে, মরণদশা ঘনিয়ে আসবে! তাও কিনা দু’বছরের মধ্যে। কিসের রসাতল? কে এই তিব্বতি বাবা? লোকটা তো অদ্ভুত! সুস্থ সমর্থ, প্রাণবন্ত একটা বয়স্ক মানুষকে রসাতল দেখিয়ে দিল!

নন্দবাবুকে বিলক্ষণ চেনেন নবতারা। স্বামীর বন্ধু। শিবতলার দিকে বাড়ি। এখানকার পুরনো লোক, মহেশবাবুর মতনই। নন্দবাবুর স্ত্রী নেই। বছর চারেক হল মারা গেছেন মহিলা। নবতারার সঙ্গে ভাল রকম মাখামাখি ছিল। পারিবারিক বন্ধুত্ব ছিল দুই পরিবারের। স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকেই নবাবুর খানিকটা অন্য রকম মতি হয়েছে। সাধু সন্ন্যাসী, বাবাজি, হাত দেখা, কপাল গোনা থেকে শুরু করে প্ল্যানচেট আত্মা নামানো পর্যন্ত। স্বামীর কাছেই সব খবর পান নবতারা। ঘোষবাবু নিজেই বলেন, ‘নন্দটার মাথাটা গেছে একেবারে। যত রাজ্যের সাধু-সন্ন্যাসী, আখড়া আশ্রম, তান্ত্রিক, ধুনোবাজি! ওই পিডি-ই মাথাটা খেয়েছে ওর।’ পিডি মানে প্রফুল্ল দত্ত, যাকে মহেশরা ঠাট্টা করে বলেন, পিণ্ডি দত্ত। প্রফুল্ল দত্তর ও-সব আছে, আধ্যাত্মিক আধিভৌতিক ব্যাপার-স্যাপারে টান আছে। লাইনটা জানে।

স্বামী সম্পর্কে সামান্য উৎকণ্ঠা বোধ করলেন নবতারা। ঘোষবাবুর কোনও কালেই এসব ছিল না। হঠাৎ এত ঘাবড়ে গেলেন? উৎকণ্ঠার বেশি কৌতুহলই হচ্ছিল নবতারার।

বিছানায় বসেছিলেন স্বামী-স্ত্রী। মাথার দিকে মহেশ, পায়ের দিকে নবতারা। মহেশের পরনে হাই কোয়ালিটি লুঙ্গি, গায়ে বোতামঅলা সাবেকি গেঞ্জি। হাতে সিগারেট। নবতারার মুখে ছাঁচি পান। ভাগ্নে এসেছিল কাল, মাসিকে শ’খানেক পান দিয়ে গেছে। বেনারসি ছাঁচি পান। নবতারা ছাঁচি পান আর জরদা মুখে বসেছিলেন।

পান চিবোত চিবোতে নবতারা এক সময় বললেন, “এবার বলল, শুনি। নন্দবাবুর বাড়িতে কে কে ছিলে তোমরা?”

মহেশ অল্পক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বললেন, “কে কে ছিলাম! ছিলাম সবাই—যেমন থাকি। নন্দ, তুলসী, কেষ্ট…। ভবেন ছিল না।”

“তাসপাশা খেলনি?”

“খেলতে বসার আগেই নন্দ তার ভাইকে ভেতর থেকে ধরে আনল আলাপ করিয়ে দিতে।”

“কেমন ভাই?”

“নিজের নয় ; জ্ঞাতি সম্পর্কে ভাই।’’

“তবে তো বাঙালি!”

“বাঙালি ছাড়া আবার কী! তবে পাঁচ বছর তিব্বত আর দু-তিন বছর ভুটানে থাকতে থাকতে চেহারাটা কেমন লামা-টাইপের হয়ে গেছে।”

“নাম কী?”

“বাঙালি নাম চুনি। ডাক নাম। নন্দ তো চুনি বলেই ডাকছিল। ইয়ের নাম চু চে চোল না কী যেন।”

“ইয়ের নাম মানে?”

“সিদ্ধির নাম। তিব্বতে টাইটেল পাওয়া। মানে চুনি যখন তিব্বতে ওদের মতন করে তন্ত্রসাধনা করে সিদ্ধিলাভ করল তখন থেকে নাম হল চু চে চোল।”

“তিব্বতি গণৎকার?”

“না, ও হল—ইন্দো তিব্বত অ্যাসট্রলজার। আমরা ছেলেবেলায় কলকাতায় মামার বাড়িতে গেলে ইন্দো-বর্মা রেস্টুরেন্টে ঠোস, কাটলিস, চ্চা খেতাম; ভেরি ফাইন। সেই রকম ও ইন্দো-তিব্বতি জ্যোতিষী এবং তান্ত্রিক। দু’রকম মতটত মিলিয়ে এখন তিব্বতি বাবা।”

“বাংলাতেই কথা বলল তো?”

“আবার কিসে বলবে! পেটে বাংলা। মাঝে মাঝে দু’চারটে তিব্বতি ঝাড়ছিল।”

“বয়েস কত?”

“ব-য়েস! বয়েস আর কত, আমাদের চেয়ে ছোট, নন্দর ছোট ভাই না। নন্দ আমার চেয়ে চার বছরের ছোট, ওই ভাই আরও খানিকটা হবে। ধরো, ছাপান্ন, সাতান্ন। কিন্তু চেহারা দেখলে মনে হয় পঞ্চাশটঞ্চাশ। বেটার মুখটা ছুঁচলো, রুইতনের মতন, লম্বা নাক, ধকধক করছে চোখ, লালচে রং। গায়ে একটা চিত্র বিচিত্র আলখাল্লা। ইয়া লম্বা লম্বা চুল মাথায়, দাড়ি গোঁফের জঙ্গল।” মহেশ সিগারেটের টুকরোটা ছাইদানে ফেলে দিলেন।

নবতারার কান খুব সজাগ। তবু তিনি খানিকটা সরে এলেন স্বামীর কাছে। বললেন, “তা হঠাৎ তোমার কুষ্টি নিয়ে পড়ল কেন?”

“কোষ্ঠী নয়। এ আমাদের বারো ঘর স্টাইলের কোষ্ঠী নয়। অন্য ক্যালকুলেশান। নন্দ বলল, আমার সম্বন্ধে কিছু ফোরকাস্ট করবে। লোকটা তখন আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকল ; তারপর কাগজ পেনসিল চেয়ে নিয়ে ফটাফট কী দাগটাগ মারল কাগজে। লিখল এটা সেটা। ক্যালকুলেশান করল। করে বলল, আমার রসাতল অবস্থা চলছে। মানে মরণদশা। সাত আট নয়ের হিসেব করলে আর মাত্র চব্বিশ মাস, মানে মাত্তর দুটি বছর। তার পরেই ফট।”

“ফট! বললেই হল! কেন ফট!”

“তা তো জানি না। তবে আমি বেটার কথায় হেসে উঠতেই, ও আসছি বলে ভেতরে চলে গেল। ফিরে এল একটা বেতের চৌকো ঝুড়ি নিয়ে। চামড়ার স্ট্র্যাপ-বাঁধা ঝুড়ি। ওপরে রং। মস্ত এক সাপের মুখ আঁকা।”

নবতারা আরও দু হাত সরে এলেন স্বামীর দিকে। “ঝুড়ি কী হবে?”

“ঝুড়ির মধ্যেই ছিল জিনিসটা।… ঝুড়ি ঘেঁটে ওই বেটা গোটা কয়েক আয়না বার করল।”

“আয়না!” নবতারা অবাক হয়ে গালে হাত তুললেন। “আয়না কেন?”

“কেন—তা কি আমি আগে বুঝেছি ছাই। আয়নাগুলো ছোট ছোট, ইঞ্চি তিনেক লম্বা হবে। চওড়ায় দু ইঞ্চির মতন। রাস্তার নাপতেদের মতন। অবশ্য গালার ফ্রেম দিয়ে বাঁধানেনা। একটা আয়না আমায় দিল লোকটা। বলল, দেখুন।”

“তুমি দেখলে?”

“দেখার আগে কী হল শোনো। আগে আমার দু চোখে সুর্মা মতন কী লাগিয়ে দিল। চোখ জ্বলে যায় আমার। গন্ধও নাকে লাগছিল। জল এসে গেল চোখে। তারপর আয়নাটা দেখলাম। ঝাপসা ভুসোওঠা কাচ। এবড়ো খেবড়ো। কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না প্রথমে, তারপর দেখলাম আয়নার তলা থেকে একটা চিতার ছবি ফুটে উঠল। লকলক করে আগুন জ্বলছে। সবই ঝাপসা, তবু দেখলাম। যত ভাল করে দেখার চেষ্টা করি ততই চিতাটা জ্বলজ্বলিয়ে ওঠে।’’

নবতারা ঘামাচির জ্বালা ভুলে গেলেন। আগে মাঝে মাঝে গলা ঘাড় বুক চুকোচ্ছিলেন, এখন আর হাত নড়ল না।

মহেশ বললেন, “ওই তিব্বতি বেটা বলল, ওটাই আমার ভবিষ্যৎ। রসাতলের শেষ অবস্থা। সাত আট নয়-এর শেষ কাউন্ট।”

নবতারা বার দুই ঢোঁক গিলে হঠাৎ বললেন, “চিতা জ্বলছিল জ্বলুক, তুমি তো আর নিজেকে দেখোনি। তবে?”

মহেশ বললেন, “মনে করতে পারছি না। যা চোখ জ্বলছিল।”

নবতারা অনেকক্ষণ কথা বললেন না। শেষে আরও খানিকটা এগিয়ে এসে শাড়ির আঁচল দিয়ে মহেশের কপাল মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন, “রাস্তার লোকের কথায় তুমি এত ঘাবড়ে গেলে। কে না কে ওই তিব্বতি বাবা, বুজরুকি করল, আর তুমিও নেতিয়ে পড়লে!… দাঁড়াও আমি দেখছি নন্দবাবুকে। বাড়িতে ডেকে এনে যা করব—বুঝিয়ে দেব, আমি কে। ওসব তিব্বতি বুজরুকি আমার কাছে চলবে না। রসাতল দশা। দেখাচ্ছি রসাতল। কার রসাতল তখন বুঝবে!”

“নন্দর কী দোষ!”

“নন্দর ভাইটাকেও ছাড়ব নাকি! দেখো কী করি। যত্ত সব বুজরুক। বুড়ো হচ্ছে যত ততই ভীমরতি বাড়ছে।… নাও চলো, দশটা বেজে গেল, খেতে চলো।” বলে স্বামীর হাত ধরে টানলেন নবতারা।

দুই

দিন দুই পরে নন্দ এলেন। সন্ধেবেলায়। বসার ঘরে বসে বসে মহেশের সঙ্গে কথা বলছেন, চা আর হিঙের কচুরি এল। নবতারা নিজেই হাতে করে নিয়ে এসেছেন। বাইরে বৃষ্টিও নামল। বর্ষার শুরু তো, এক আধ পশলা রোজই হচ্ছে।

নন্দ বললেন, “আসুন বউদি।… আপনি শুনলাম ডেকে পাঠিয়েছেন।”

নবতারা হাসিমুখ করে বললেন, “তা কী করব বলুন! আপনারা তো আর আসেনই না। পথ ভুলে গেছেন। ডেকে না পাঠালে কী আস্‌তেন! নিন—আগে চাটুকু খেয়ে নিন।”

একসময়ে নন্দলালের খাদ্যরসিক বলে খ্যাতি ছিল। পুরুষ মানুষ হয়েও তাঁর শখ আর নেশা ছিল রান্নাবান্নার। নিজের হাতে নানারকম আমিষ রান্না রাঁধতে পারতেন। খাওয়াতেন বন্ধুবান্ধবকে ডেকে। স্ত্রী মারা যাবার পর তাঁর শখ ঘুচে গিয়েছে, অরুচি এসেছে খাওয়া-দাওয়ায়। জিবের স্বাদ নিয়ে আর মাথা ঘামান না, পেটে দুটো পড়লেই হল।

কচুরি খেতে খেতে নন্দ বললেন, “নিজে করেছেন? বেশ হয়েছে…! আপনার হাতের সেই ছানার তরকারি আর পায়েস ভুলতে পারি না।”

মহেশ বললেন, “তুমি মাঝেমাঝে এসে বললেই, তোমার বউদি পায়েসটা, ছানাটা খাওয়াতে পারে। “ বলতে বলতে আরও আধখানা কচুরি মুখে পুরে দিলেন।

নবতারা বললেন, “তা পারি। কিন্তু উনি আসেন কোথায়?”

“কেন। আসি তো! অবশ্য কমই।… আসলে কি জানেন বউদি, দাদার কাছ থেকে রোজই আপনাদের সব খবর পাই, বিনুর সঙ্গেও দেখা হয়ে যায়। কাজেই আর—” বিনু মানে বিনতা, মহেশদের মেয়ে।

নন্দর কথা শেষ হবার মুখেই নবতারা বললেন—”আপনার দাদার তো খাওয়া-দাওয়া ঘুম গেল।”

“কেন কেন?”

“সে তো আপনিই ভাল জানেন! আপনার কোন ভাই, তিব্বতি বাবা নাকি বলেছে, ওঁর এখন রসাতল অবস্থা। মানে ইয়ের দশায় পেয়েছে…” বলে স্বামীর দিকে তাকালেন নবতারা।

“মরণদশা,” মহেশ বললেন, “সাত আট নয়। মাত্র আর দু বছর।”

নন্দ মাথা নাড়লেন। “হ্যাঁ, দশাটা খুব খারাপ। চুনি তাই বলল।”

“আপনার চুনি কি জ্যোতিষী?”

“জ্যোতিষী! ওরে বাব্বা, সে তো এখন ত্রিতন্ত্রসিদ্ধ পুরুষ। অর্ডিনারি জ্যোতিষী ওর কাছে লাগে না। তিন ধাপ ওপরে। চুনির ভীষণ পাওয়ার। দৈব-ক্ষমতা পেয়েছে। মুখ থেকে যা খসে, তাই হয়।”

নবতারা বললেন, “কী দেখে আপনার ভাই বুঝল ওঁর এমন একটা অবস্থা হয়েছে! কুষ্টি তো দেখেনি যে বলবে—!”

হাত নেড়ে নন্দ বলল, “কোষ্ঠীর দরকার করে না। এ অন্য হিসেব।”

“কী হিসেব?”

“আমি তা জানি না, বউদি। তবে কোষ্ঠীর রকমফের আছে। এক এক দেশে এক এক রকম। যস্মিন দেশে যদাচার— গোছের আর কী! কোথাও সূর্য কোথাও চন্দ্র, কোথাও সাপ, কোথাও খরগোশ, কোথাও চিল—কত রকম পশুপাখি দিয়ে হিসেব হয়। যে যার নিজের রেওয়াজ মতন ভূত-ভবিষ্যৎ বিচার করে। চুনি তো দাদার মুখ দেখেই একটা হিসেব করে নিল। তারপর…”

“হিসেবটা ভুলও হতে পারে।”

“পারে! ভগবানেরও হিসেব ভুল হয়। তবে চুনি ফেলনা নয় বউদি, ওর পাওয়ার আছে।’’

নবতারা একবার স্বামীর দিকে তাকিয়ে কী দেখলেন তারপর নন্দর দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ‘‘আপনার কী মনে হয়?”

নন্দ চায়ের কাপ তুলে নিয়েছিলেন। বললেন, “বউদি, মানুষ তার ভাগ্য জানে না। আমিই কী জানতাম। যে মানুষ সারাদিন সংসারের কাজকর্ম করল, সন্ধেবেলায় সেজেগুজে গিয়ে সিনেমা দেখে এল, সেই মানুষ খেয়েদেয়ে শুতে এসে বিছানায় বসল, কী চলে গেল! বলুন এর কোনও কারণ আছে! মানে পাবেন! তবু বলি ভুল সকলেরই হয়। চুনিরও হতে পারে। মহেশদাকে আমি সে কথা বলেছি। বলেছি—এটা মাথায় তোলা থাক। আপনি ও নিয়ে বেশি ভাববেন না। জন্মিলে মরিতে হবে—অমর কে কোথা কবে! বরং কী হবে সেটা ভুলে গিয়ে এই বেলায় বাকি কাজগুলো সেরে ফেলুন। হাতে এখনও সময় আছে।”

মহেশ বড় করে নিশ্বাস ফেললেন। বললেন, “নন্দ, বাকি কাজ তো ভাই অনেক ছিল, সব তো মেটাতে পারব না। সময় হবে না। অন্তত মেয়েটার বিয়েটা যদি চুকিয়ে দিতে পারতাম।”

“দিন না, আর দেরি করছেন কেন! বিনুমা আমাদের কী সুন্দর দেখতে। অমন গড়ন বাঙালি ঘরে ক’টা থাকে। ছিপছিপে লম্বা, মিষ্টি মুখ। গায়ের রংও ফেলনা নয়। ভীষণ ঝরঝরে, লেখাপড়াও শিখেছে। বয়েস কত হল—?”

“বাইশে পড়েছে।’’

“তবে আর কী! রাইট টাইম।”

মহেশ বললেন, “তা ঠিক। আমাদের সময়ে তো আঠারো কুড়িতেই হয়ে যেত।”

নবতারা বললেন, “চেষ্টা তো করছি ঠাকুরপো! ভাল ছেলে পাচ্ছি কোথায়? আপনাকেও তো কতবার বলেছি। ভাইঝির জন্যে একটা ভাল ছেলে জোগাড় করে দিন।”

“তা বলেছেন,” নন্দ সায় জানালেন। তারপর কী ভেবে বললেন, “দু একজনকে তো আপনারা দেখেছেন শুনেছি।”

“খোঁজ খবর করেছি, চোখে দেখেছি দু একজনকে,” নবতারা বললেন, “সেগুলো ছেলে নয়, ছাগল।’’

মহেশ চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে সিগারেট খুঁজতে লাগলেন পকেটে। নন্দর সঙ্গে একবার চোখ চাওয়া-চাওয়ি হয়ে গেল।

নন্দ চা খেতে খেতে কপাল চুলকে নিয়ে শেষে বললেন, “বউদি। একটা কথা বলি, কিছু মনে করবেন না। দাদা একশো বছর বাঁচুন, চুনির কথা মিথ্যে হোক। তবু কথাটা আপনাকে না বলে পারছি না। সাতটা দাদার কেটে যাবে, আট থেকে দাদার বড় একটা ভাল থাকার কথা নয়। স্ট্রোকট্রোক হতে পারে। চিনুর ফোরকাস্ট। ওই সময় বাকিটা—মানে বাকি ক’মাস—ক্রাইসিস পিরিয়ড…। সবই ভাগ্যের ব্যাপার বউদি। হয়তো কিছুই হল না, আবার হতেও পারে। আমার মনে হয় অত দেরি না করে খানিকটা আগে ভাগে যদি বিনুর বিয়েটা সেরে রাখতে পারেন—মেয়ের চিন্তাটা দূর হবে মহেশদার। তা ছাড়া বিয়ে তো দিতেই হবে। না কি মহেশদা?”

মহেশ বড় করে নিশ্বাস ফেললেন আবার। “আমার তো তাই ইচ্ছে। তবে মনের ইচ্ছে কি সব সময় মেটে হে! মেয়ের বিয়ে আর ছোট ছেলেটার চাকরি পাকা হয়ে গেলে ইচ্ছে ছিল তোমার বউদিকে নিয়ে দু একমাস হরিদ্বার দেরাদুন দিল্লি কাটিয়ে কাশি হয়ে ফিরব।”

নবতারা হঠাৎ নন্দকে বললেন, “আপনার ভাইকে একদিন এখানে আনুন না। আমাদের দেখে একবার বলুক না কী হবে! বিনুকে দেখে বলুক—বিয়েটিয়ে কবে আছে কপালে?”

নন্দ তাকালেন নবতারার দিকে। পরে বললেন, “চুনি দিন দুই চার পরে ফিরবে। ও আজ সকালে এক জায়গায় গেল। ফিরলে নিয়ে আসব।”

“আনুন। বেলাবেলি আনবেন। না হয় এখানেই খাওয়া-দাওয়া করবে একটা বেলা।”

“ও কিন্তু দিনের বেলা বেরুতে চায় না। সন্ধে করেই আনব।”

“তাই আনুন।”

নবতারা আর বসলেন না, উঠে পড়লেন।

মহেশ আর নন্দ সিগারেট শেষ করলেন, আর-একটা করে। বৃষ্টি থেমে আসার মতন হচ্ছিল।

ছাতা ছিল নন্দর কাছে। বললেন, “ওঠা যাক মহেশদা!”

“হ্যাঁ, চলো।”

নন্দকে নিয়ে মহেশ সদর পর্যন্ত আসতেই দরজার কাছে বিনুর সঙ্গে দেখা।

“নন্দকাকা! তুমি কখন এসেছ!”

“অনেকক্ষণ। কোথায় ছিলি তুই?”

“বাড়ি ছিলাম না। এই মাত্র ফিরলাম। … দেখো না, রিকশা থেকে নামতে গিয়ে শাড়ি ফাঁসল, বাঁ পাটাও গোড়ালির কাছে মচকে গেল। আমাদের গলির এখানটায় যা পেছল হয়।”

নন্দ হেসে বললেন, “তাই দেখছি।…আজ তা হলে বউদির কাছে—।।” “মা! ওরে বাব্বা। জানতে পারলে রক্ষে রাখবে না।”

“পালা তা হলে।”

বাইরে এসে মহেশ বললেন, “নন্দ, যে নদীতে কুমির থাকে—সেই জলে ঝাঁপ দিচ্ছি আমরা। এরপর—’’

নন্দ বলল, “ভেবে লাভ নেই দাদা। হয় মক্কা, না হয় ফক্কা।”

রাত্রে শুতে এসে নবতারা বললেন, “শুনছ তো!”

মহেশ জেগে ছিলেন। খোলা জানলা দিয়ে বর্ষার জলো বাতাস আসছিল। গুমোট গরম নেই। পাখাও চলছে। তবু ঘুমিয়ে পড়তে পারেননি। না পারার কারণ নবতারা। স্ত্রী বলে রেখেছিলেন, বিছানায় পড়লাম আর ঘুমোলাম না হয়, কথা আছে। তা ছাড়া মহেশ নিজেই খানিকটা চিন্তায় ছিলেন।

মহেশ সামান্য দেরি করে সাড়া দিলেন। “বলো।”

নবতারা তখনও বিছানায় শোননি, শাড়ি জামা আলগা করে মাথার খোঁপা সরিয়ে নিচ্ছিলেন ঘাড়ের কাছ থেকে। বললেন, “মেয়ের বিয়ে নিয়ে তোমার বড় চিন্তা।”

মহেশ ব্যাপারটা ধরতে পারলেন। সন্ধেবেলার কথার জের। বললেন, “কার না হয়। সব মা বাপেরই হয়ে থাকে।’’

“তা হলে ব্যবস্থা দেখো।”

“কী ব্যবস্থা দেখব।”

“ছেলে খোঁজো।”

“তুমিই খোঁজো না।”

“কেন! তুমি বাপ না! বাড়ির কর্তা, পুরুষ মানুষ। চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছ। কত চেনা শোনা।”

“আমায় আর খুঁজতে বোলো না। যে ক’টা খুঁজে বার করেছি—সব কটাকে তোমরা অপছন্দ করেছ।”

নবতারা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন স্বামীকে। বললেন, “ওকে খোঁজা বলে না। ছেলে কি মাঠে-চরা গোরু ছাগল যে গলায় দড়ি বেঁধে একটা ধরে আনলে আর হয়ে গেল। আমার বাবাকে দেখেছি..”

“তোমার বাবা কী জিনিস ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন তা তুমিই জান। তবে আমি যাদের খোঁজ দিয়েছিলাম—’’

“অখাদ্য। ওরা আবার ছেলে! আমার পছন্দ হয়নি, তোমারও বা হয়েছিল কোথায়! মেয়েরও নয়।”

“মেয়ের কথা তুমি জানলে কেমন করে?”

“আমি মা হয়ে জানব না, তুমি বাবা হয়ে জানবে! তোমার মতন বাপের কোনও মান-মর্যাদা আছে। ছেলেমেয়ের সঙ্গে হাসি ফক্কুড়ি করছ। বাপ না ইয়ার বোঝা যায় না। মেয়ে তো সবসময় বাপের সঙ্গে হ্যা হ্যা হিহি করছে। আমরা বাপু বাপকে যত ভালবাসতাম, তত ভয় পেতাম। তোমায় তো ওরা গ্রাহই করে না, ভাবে প্রাণের ইয়ার। দেখলে আমার গা জ্বলে যায়।”

মহেশ বললেন, “তোমার বাবার সঙ্গে আমাকে মেলাতে যেও না। তিনি তিনি, আমি আমি। …তুমি বলছ, আগে যাদের খোঁজ এনেছি মেয়েরও তাদের পছন্দ হয়নি।”

“হ্যাঁ।”

“আমি যদি বলি, একটা ছেলেকে পছন্দ ছিল।”

সঙ্গে সঙ্গে নবতারা একেবারে ঘুরে বসলেন? “কে? কাকে পছন্দ ওই নাচিয়ে ছেলেটাকে?”

“নাচিয়ে মানে! ও…”

“ও-টো রাখো। ওকে আমি দেখিনি নাকি! ভটভটি করে ঘুরে বেড়ায় এপাড়া ওপাড়া, মেয়েদের মতন লম্বা চুল মাথায়, চোখে ঠুলি, পোশাক আশাকের কী বাহার, যেন সং; সারা জামা প্যান্টে তাপ্পাতুল্পি, রং। ওটাকে আমি নাচতে দেখেছি। গত বচ্ছর এখানে যে ফাংশান হল তাতে পিঠ কোমর ভেঙে মাটিতে শুয়ে বসে কী নাচ। সেই সঙ্গে ঝমঝমা বাজনা। নাচ আর থামে না। হিন্দি সিনেমা। অখাদ্য। ছিছি, দামড়া একটা ছেলের ওই ঢং দেখে পিত্তি জ্বলে গেল! ওই হারামজাদা আবার ছেলে হল নাকি? ওকে তুমি নিজের মেয়ের পাত্র হিসেবে ভাবতে পারলে। রাম রাম।”

মহেশ সবই জানেন। বললেন, “তুমি শুধু নাচ দেখছ।”

“আবার কী দেখব! আমি ওকে নাচতে দেখেছি।”

“ইয়ে, মানে ওকে বলে ব্রেক ড্যান্স। আমি তো তাই শুনেছি। ব্রেক ড্যান্সের এখন খুব কদর। মডার্ন ক্রেজ। ওই নাচ ওই রকমই। শরীর ভেঙে ভেঙে নাচতে হয়। তা নাচটা ও জানে, শিখেছে। নাচে বলেই ছেলে খারাপ হবে। ও কম্পুটার এনজিনিয়ার, ভাল কাজকর্ম করে, বাপের ঘরবাড়ি আছে, বাবা রেলের বড় অফিসার ছিলেন। ভাল ফ্যামিলি।… আমাদের নন্দর সঙ্গে একটা রিলেশান আছে।’’

নবতারা ধমকে উঠে বললেন, “চুলোয় যাক তোমার ভাল ফ্যামিলি। বোম্বাইঅলাদের মতন দেখতে, —সাজ পোশাক, কুচ্ছিত নাচ, ভটভটি চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সারাদিন, গুণ্ডা বদমাশের মতন—, ওর সঙ্গে ভদ্রলোক মেয়ের বিয়ে দেয়। একটা মাত্র মেয়ে আমাদের, আমি দেখেশুনে একটা বাঁদরকে জামাই করব! ছি, তোমার লজ্জা করল না বলতে।”

মহেশ চুপ। মাস কয়েক আগেও এক দফা তাঁকে এসব শুনতে হয়েছে।

হঠাৎ নবতারা বললেন, “কী বলছিলে তুমি? ওই বাঁদরকে বিনুর পছন্দ?”

মহেশ বিপদে পড়ে গেলেন। ঢোঁক গিলে কোনও রকমে বললেন “না—মানে, মনে হল অপছন্দ নয়।”

‘মনে হওয়াচ্ছি। দেখি তার কেমন পছন্দ।”

মহেশ তাড়াতাড়ি বললেন, “একটা কথা বললুম আর তোমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। দাঁড়াও না। মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাও দু-দিন পরেই বলবে।”

নবতারা আর কথা বললেন না।

তিন

দিন চারেক পর নন্দলাল এলেন। ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নেমেছিল বিকেলে, সন্ধের গোড়ায় থামল।

সন্ধেবেলায় গায়ে বর্ষাতি, মাথায় ছাতা নন্দলাল এলেন তাঁর ভাই চুনিকে নিয়ে। কথা ছিল আসার।

বসার ঘরে ঢোকার আগেই নন্দলাল উচু গলায় হাঁক মেরে বললেন, “বউদি, আজই আসতে হল বৃষ্টি বাদলার মধ্যে। চুনি কাল সকালেই দিল্লি মেলে চলে যাচ্ছে। আবার কবে আসবে ঠিক নেই। নিয়ে এলাম আজই।”

মহেশ কেমন চোরের মতন বললেন, “এসো। এসো।” বলেই নন্দকে চোখ টিপলেন। নিচু গলায় বললেন, “দিল্লি মেল রাত্রে পাস করে। মুখ্যু।”

নন্দ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “ডাউন ট্রেন ভীষণ লেট যাচ্ছে ক’দিন।”

“এসো।”

বসার ঘরে বসলেন নন্দরা।

নন্দর ভাই চুনি—মানে তিব্বতি বাবার পোশাক খানিকটা পাল্টেছে যেন। একরঙা আলখাল্লা। টকটকে লাল। মাথায় কানঢাকা টুপি। ঘাড়ের পাশে চুল ঝুলছে। দাড়ি গোঁফ যথারীতি। চোখে রঙিন কাচের চশমা। পাতলা কাচ, রংটাও ফিকে। হাতে একটা ঝোলা।

মহেশ বার কয়েক নন্দকে কী বলব কী বলব করে শেষে বললেন, “ডাকি তা হলে!”

“হ্যাঁ, ডাকুন।…বিনুকেও তো আসতে হবে একবার। তা ও খানিকটা পরে এলেও হবে। বউদিকেই ডাকুন আগে।”

“বিনুটার ভীষণ সর্দি জ্বর। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধিয়েছে। পায়েও ব্যথা। তবে আসবে। আজ জ্বর কমেছে।”

নন্দ বললেন, “চুনিরও গলা ভেঙে গেছে। কাল যে-গাড়িটা করে ফিরছিল সেটা রাস্তা থেকে হড়কে গিয়ে ডোবায় পড়ে গিয়েছিল। জলে কিছুক্ষণ হাবুডুবু খেয়েছে বেচারি।”

মহেশ বললেন, “জোর বেঁচে গেছে বলো। জলে হাবুডুবু বড় খারাপ। বসো, গিন্নিকে ডেকে আনি।”

খানিকটা পরে নবতারা এলেন।

মহেশ আগেই ফিরে এসেছিলেন, কথা বলছিলেন নন্দদের সঙ্গে।

নবতারা ঘরে আসতেই নন্দ পরিচয় করিয়ে দিলেন, “বউদি আজই আসতে হল। বৃষ্টি বাদলা মাথায় নিয়ে। চুনি কাল সকালেই চলে যাচ্ছে। মহেশদাকে আমি গতকালই বলে রেখেছিলাম—আজ আসার চেষ্টা করব।”

নবতারা চুনিকে দেখছিলেন।

চোখ বুজে, সামান্য জিব বার করে মাথাটা নুইয়ে ছিল চুনি। দু কানে হাত রাখল কয়েক পলক। অভিবাদন জানাল বোধ হয়।

নবতারা নন্দকে বললেন, “এসে ভাল করেছেন। না এলে আর ওঁকে দেখতে পেতুন না। তা কাল উনি কোথায় যাচ্ছেন?”

“কলকাতা হয়ে শিলিগুড়ি দার্জিলিং।”

“এখানেই থাকেন।”

“এখন বছর খানেক।”

“ঘরবাড়ি কি এদিকেই কোথাও?”

“হ্যাঁ ; এই তো বীরভূমে। চুনি বরাবরই বাড়ি-ছাড়া। ঘুরে বেড়াত এদিক ওদিক। কাজকর্ম করত। ভাল লাগত না। ছেড়ে দিয়ে পালাত অন্য কোথাও। ওই করতে করতে তিব্বত চলে গেল। ওর বরাবরই খানিকটা সাধু সন্ন্যাসীর সঙ্গে মেলামেশা ছিল। ওই থেকে যা হয়—মন চলে গেল সাধনা টাধনার দিকে।”

নবতারা শুনলেন। তারপর বললেন, “তা উনি আপনার দাদার ব্যাপারে যা বলেছেন, তা কি ঠিক?”

এবার চুনি বলল, ভাঙা গলায়, “যা দেখেছি তাই বলেছি।’’

“কী দেখেছেন? কুষ্টি তো দেখেন নি।”

“আপনাদের এই হরস্কোপ আমি দেখি না। আমরা মুখ দেখি। মুখ দেখে বলি। মুখের হিসেব আছে। তারপর অঙ্ক। অঙ্কের গোলমাল হতে পারে।”

“এক থেকে দশের পর আরও আছে?”

“আঠারো পর্যন্ত আছে।”

“ওনার হিসেব..”

“বিলকুল ঠিক। হিসেব ভুল হবে না। তবে ওপরঅলা যা করবেন।”

নবতারা নিজের মুখটা দেখালেন। “আমার মুখ দেখে কিছু বলুন।’’

চুনি একটু চুপ করে থেকে বলল, “আমি একটা মুখই দেখব। আপনার মুখ দেখলে আপনারই দেখব। মেয়ের মুখ দেখব না।’’।

নন্দ তাড়াতাড়ি বললেন, “বউদি আমি চুনিকে বলেছি, বিনুর মুখ দেখে দু চারটে কথা বলতে হবে।”

নবতারা বললেন, “দুটো মুখ দেখা যায় না।”

চুনি বলল, “আমি দেখি না। কাগজ পেনসিল দিন আপনারটাই হিসেব করি।”

মহেশ তাড়াতাড়ি বললেন, “তুমি কেন। বিনুকেই দেখুক না।”

নবতারা যেন কানই করলেন না, বললেন, “আমারটাই হোক। তোমার তো মন্দ শুনলাম। কতটা মন্দ আমাকে দিয়েই বোঝা যাবে। আমার ভাগ্যেও যদি খারাপ থাকে—!”

সাদামাটা যুক্তি। স্বামীর ভাগ্যের অন্তত খানিকটা স্ত্রীর ভাগ্যেও বর্তাবে।

মহেশকে বাধ্য হয়ে কাগজ কলম জুগিয়ে দিতে হল।

চুনি তার হালকা রঙিন কাচের চশমার আড়াল থেকে নবতারাকে দেখল বার বার, তারপর কাগজ কলম নিয়ে হিসেবে বসল। লাইন টানল নানা রকম, ছোট বড়, কাটাকুটি করল, চৌকো গোল নানান ছাঁদের চেহারা এল এখানে সেখানে। শেষে অঙ্ক। যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ—হয়ত জ্যামিতির অঙ্কও হল।

অতক্ষণ ধৈর্য ধরে বসে থাকা মুশকিল। মহেশ একবার বাইরে গেলেন, ফিরে এলেন খানিকটা পরে। নন্দ হাই তুলতে লাগলেন। দু চারটে কথাও হল মহেশের সঙ্গে নিচু গলায়। বাইরে মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি আবার আসতেও পারে।

নবতারা কিন্তু একই ভাবে বসে বসে চুনিকে দেখছিলেন। দু চার বার চোখ সরে যাচ্ছিল স্বামীর দিকে।

শেষ পর্যন্ত নন্দ বললেন ভাইকে, “কিরে? হল?”

চুনি মাথা হেলাল। বড়সড় নিশ্বাস ফেলে বলল, “হয়েছে।” “কী হল?”

“অবিন্ধন দশা।”

“মানে?”

‘তেরো চোদ্দ পনেরোর কাউন্ট। অহি হল সাপ। স্নেক। সাপের বন্ধন। মানে সংসারের দড়াদড়ি দুশ্চিন্তা ভাবনায় একেবারে জড়িয়ে পড়বেন। না, ওদিকে কোনও ভয় নেই, দেহহানি ঘটবে না। তবে মন আর এখনকার মতন থাকবে না। সুখশাস্তি যা পাবার, পাওয়া হয়ে গিয়েছে। আবার খানিকটা পাবেন পনেরোর ঘরে। তা, সে পেতে পেতে বছর দশ। ওটাই শেষ।”

নবতারা বললেন, “এতকাল তবে সুখশান্তি পেয়েছি।”

“আমার হিসেব বলছে।”

“বললেই আমায় মানতে হবে। সুখ যে কত পেয়েছি আর শান্তিতে কেমন আছি—আমিই জানি। তা যাক গে সেকথা। আমার ভাগ্যেও তা হলে ওঁর কোনও আপদ কাটল না।”

“না, তেমন কিছু দেখছি না।”

এমন সময় বিনু এল। বিনুর সঙ্গে এ-বাড়ির কাজের মেয়েটা, ফুলু। ট্রে সাজিয়ে চা খাবারটাবার এনেছে। বিনু সামান্য খোঁড়াচ্ছিল। একটা পায়ের গোড়ালিতে ক্রেপ ব্যান্ডেজ জড়াননা। মচকানো পা।

বিনু মেয়েটি দেখতে বেশ। ছিপছিপে গড়ন, মিষ্টি মুখশ্রী, চোখ দুটি হাসভিরা, থুতনির মাঝখানে ছোট্ট মতন গর্ত। চমৎকার ঝরঝরে মেয়ে।

বিনু নিচু হয়ে চা খাবার এগিয়ে দিচ্ছিল নন্দদের।

নন্দ চুনিকে বললেন, “চুনি, এ আমাদের বিনুমা।” বলে হাসিমুখেই বিনুকে বললেন, “কিগো সেই পায়ের চোট। এখনও খোঁড়াচ্ছ।”

“মচকে গিয়েছে। যা ব্যথা!”

“ভাঙেনি তো?”

“ভাঙলে দাঁড়াতে পারতাম নাকি?”

মাথা নাড়লেন নন্দ। “তা ঠিক।” বলতে বলতে চুনির দিকে তাকালেন আবার, “চুনি—একবার না হয় তোমার নিয়মটা ভাঙলে। বিনুমায়ের এটা যদি একবার দেখতে।”

চুনি কিছুই বলল না। বিনুকে দেখতে লাগল।

নবতারা বললেন, “না, না, জোরাজুরি করে লাভ নেই। ওঁর যখন নিয়ম নেই তখন আর কেন…”

নবতারার কথা শেষ হল না, চুনি বলল, “ওকে বসতে হবে না। আমার দেখা হয়ে গেছে। তুমি যেতে পারো। তোমার পুরো নামটা কী?”

“বিনতা।”

“বি-ন-তা! ঠিক আছে তুমি যাও।”

বিনু চলে গেল।

চা খাবার খেতে খেতে নন্দ বললেন, “মেয়েটাকে একটু ভাল করে দেখলে না চুনি।’’

“দেখেছি।”

“দেখেছ। ওই দেখাতেই হবে! তা একবার…”

“কোনও দরকার নেই নন্দদা। মেয়েটির অনেক সুলক্ষণ আছে। বয়েস কত। “কুড়ি পেরিয়েছে?”

“বাইশ,” মহেশ বললেন।

“তা হলে তো বেশ ভাল! কুড়ির পর থেকেই শঙ্খ।”

‘‘শঙ্খ।’’

“দরং টংলা। কুমুদহি গজাধী শঃ। ওসব আপনাদের বোঝার কথা নয়। এ মেয়ে পরম ভাগ্যবতী। বাপমায়ের সংসারের অনেক ভাল করেছে।”

মহেশ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “তা ঠিক। বিনুর জন্মের পর থেকেই আমার উন্নতি।” বলে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। “আমাদের অনেক ঝঞ্জাট কেটে গিয়েছে—তাই না।”

নবতারা কিছুই বললেন না।

চুনি বলল, “ও হল চার পাঁচ ছয়ের কাউন্ট। বিষ্ণু শঙ্খ। স্বর্ণ শ্বেতাভ। সুখ। আনন্দ সম্পদ বৃদ্ধি করে। ভাগ্যবতী।”

নন্দ বললেন, “বিয়ের কোনও যোগটোগ নেই?”

“যোগ হয়ে গেছে নন্দদা! বিয়ে সামনেই।”

“যোগ হয়ে গেছে! পাত্র! পাত্রের কথা কিছু বলতে পার?”

চুনি মাছের চপ খেতে খেতে বলল, “সাউথ ইস্ট!”।

“সাউথ ইস্ট মানে? সে তো রেলওয়ে—সাউথ ইস্টার্ন!”

“রেল নয়। সাউথ ইস্ট ডিরেকশন থেকে পাত্র আসবে।”

“সাউথ ইস্ট! সে তো গোটা…”

“না না, খুব দূর হবার কথা নয়। কাছাকাছি থেকেই।”

“ছেলে কেমন হবে? কী করবে টরবে?”

“ছেলে ভালই হবে। হেলদি, লেখাপড়া জানা। চোখ হয়তো একটু কটা হবে। দেখবেন—মিশুকে হবে খুব!”

“কাজকর্ম?” মহেশ বললেন।

“ভাবতে হবে না। কালে নাকালে লক্ষ…”

“লক্ষপতি?”

“না না কালে কালে অনেক করবে।”

নবতারা এবার কথা বললেন। “মেয়ের ভাগ্যে তার বাবার ওই মন্দটা কেটে যেতে পরে না?”

চুনি কী ভাবল। চোখ বন্ধ করে হয়তো হিসেব করল কিছু। তারপর বলল, “ঠিক। কাটতে পারে। আপনি ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন বউদি। মেয়ে আপনার পারে। তবে ওর ভাগ্যটা আরও একটু পোক্ত করিয়ে দেবেন।”

“কেমন করে?”

“বিয়েটা দিয়ে দেবেন আগে। বিয়ে হলে যুগ্ম হয়।”

“ইচ্ছে তো খুবই—”

“ইচ্ছে বলবতী হলে সবই হয়। আপনারা অনর্থক সময় নষ্ট করবেন না। শুভ কাজ যত তাড়াতাড়ি পারা যায় সেরে ফেলা ভাল। তা ছাড়া মহেশদার সময়টা মনে রাখবেন।”

নবতারা মাথা হেলিয়ে জানালেন, তাঁর মনে থাকবে।

চার

মহেশের ঘুম এসে গিয়েছিল, গা-নাড়া খেয়ে ঘুম কাটল। চোখ খুলে তাকালেন। দেখলেন নবতার পাশে বসে আছেন। আতঙ্কিত হলেন।

“কী হল?” মহেশ বললেন।

“ওঠো। উঠে বসো।”

“কেন! উঠে বসার কী হল?”

“দরকার আছে!”

মহেশ বললেন, “শুয়ে শুয়ে হয় না?”

“ওঠো।”

মহেশ উঠে বসলেন।

নবতারা বললেন, “তুমি এত বড় জোচ্চোর, আমি জানতাম না।”

“ঠগ! জোচ্চোর! কী বলছ?”

“ন্যাকামি কোরো না। আমি কচি খুকি নয়, হাঁদাবোকা মুখও নয়। তুমি আমার সঙ্গে চিটিংবাজি করলে?”

মহেশ রীতিমতন ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। বললেন, “আমি আবার কী করলুম।”

“যা করেছ তুমি জান! ন্যাকা সাজতে এসো না।.. তুমি মেয়ের হয়ে গল্প ফেঁদে আমায় বোকা বানাবার চেষ্টা করলে!… ওই চুনিটা কে? মিথ্যে বলবে না। আমি সব জানি। ছেলেকে দিয়ে বলিয়ে নিয়েছি।”

মহেশ বুঝতে পারলেন, জলের কুমির তাঁকে ধরেছে। পালাবার পথ নেই। নন্দ তাঁকে কুমিরের মুখেই ঠেলে দিল।

মহেশ বললেন—“চুনি—মানে চুনি হল নন্দর মামাতো ভাই।”

“আর ওই নাচিয়ে ছেলেটা?”

“চুনির মাসতুতো দাদা।”

“বাঃ! মামাতো মাসতুতো! দড়ি বাঁধাবাঁধি।

“এসব বুদ্ধি কে দিয়েছিল?”

“নন্দ আর চুনি। নন্দই আসল।”

“ওরা পরামর্শ দিল, আর তুমি নিলে?”

মহেশ একটু চুপ করে থেকে বললেন, “কী করব! মেয়েটা যে ওই বাচ্চু ছেলেটাকেই পছন্দ করে। লাভ করে। প্রেম।”।

“তোমায় বলেছে।”

“বাঃ, বলবে না!”

“তোমারই তো মেয়ে! আর ওই নাচিয়েটা?”

“আরে বাবা, সে তো আমাদের মাথা খেয়ে ফেলল।”

নবতারা একটু চুপ করে থেকে বললেন, “তা হলে আর কী! এবার মেয়েকে বলো একটা পাঁজি আনতে। বাপেতে-মেয়েতে মিলে দিন ঠিক করে নাও।”

মহেশ বড় অস্বস্তিতে পড়লেন। কী যে বলেন। শেষে বললেন, “পাঁজি তো তুমি দেখবে!”

“না !”

“না কেন?”

“পছন্দ তোমাদের, ভালবাসা তোমাদের, আহ্লাদ তোমাদের—তোমরাই যা করার করবে। এই বিয়েতে আমি নেই। বিয়ের সময় আমি থাকবও না এখানে। বেনারসে দিদির কাছে চলে যাব।”

মহেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, “তুমি বড় জেদ করছ! তুমি বুঝতে পারছ না, আজকালকার ছেলেমেয়েদের ধাত আলাদা। তারা তাদের মতন পছন্দ করে, ভাবে, নিজেদের ভালমন্দ নিজেরাই ঠিক করে নেয়। বিনু ওই বাচ্চু ছেলেটাকে সত্যিই ভালবাসে। আমি তোমার ছোট ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল, বাবা, গো অ্যাহেড! আমরা সব জানি। দারুণ হবে।”

“হোক দারুণ। আমায় বাদ দিয়ে দারুণ হোক।”

মহেশ বললেন, “তোমাকে বাদ দিয়ে আমরা! বলছ কী?”

“ঠিক বলছি। মেয়ের ভালবাসা দেখে তোমার প্রাণ হু হু করে উঠল—তার হয়ে নাচতে নামলে, আর আমি যে চল্লিশটি বছর তোমার সব কিছু আগলে রাখলুম—আমার মান-মর্যাদাটুকু রাখলে না। এই রকমই হয়! আমাকে তোমরা তুচ্ছ করলে। ঠিক আছে। তোমাদের পাঁঠা তোমরা যেখানে খুশি কাটো।”

মহেশ হঠাৎ স্ত্রীর কোলের ওপর মুখ থুবড়ে পড়লেন। পড়েই বললেন, “আমি তো তোমারই পাঁঠা। তুমি রাখলে আছি, নয়ত’ নেই। ঠিক আছে, মেয়েকে বলে দেব, বাচ্ছু হবে না।”

নবতারা স্বামীর মাথা কোল থেকে সরিয়ে দিলেন। বললেন, “আমি বলে দিয়েছি আজই।”

“সর্বনাশ! কী বলেছ?”

“বলেছি, যা তুই ওই ছোঁড়াটাকে বিয়ে করগে যা! তোর বাপ যখন বলছে, ছেলে ভাল তখন ভাল। আমি আর কিছু জানি না।”

মহেশ মহানন্দে স্ত্রীর গালে গাল ঘষে বললেন, “এই না হলে তুমি আমার তারাসুন্দরী। আহা, এমন মা ক’টা ছেলেমেয়েই বা পায়।”

নবতারা বললেন, “আদিখ্যেতা কোরো না। রসাতল কাকে বলে এবার তুমি দেখবে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *