রসলক্ষ্মীর সাধনা
কে এক আধুনিক কবি যেন লিখেছিলেন, কপালের চুল ছিঁড়ে ইটের দেয়ালে মাথা ঠুকে কবিতা লেখার কোনও মানে হয় না। তা, কাব্যলক্ষ্মী তো বহুদিন আমাকে পরিত্যাগ করেছেন, আজকাল আমার রসলক্ষ্মীর সাধনা।
কিন্তু প্রবঞ্চনায় রসলক্ষ্মী কিছু কম যান না, সেদিন সন্ধ্যা থেকে অনেক চেষ্টা করলাম, লক্ষ্মীর কৃপা হল না। এক পঙ্ক্তিও লিখতে পারলাম না।
এমন সময় গঙ্গারাম এসে হাজির। তার হাতে একটা বোতল তোয়ালে দিয়ে জড়ানো। দেখে আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল। মদ আমার দু’চক্ষের বিষ। গঙ্গারাম সেটা জানে, সে কী করে এত সাহস পেল।
আমার মনোভাব গঙ্গারাম হয়তো মুখ দেখে টের পেয়েছিল। সে বলল, ‘দাদা আপনি যা ভাবছেন তা নয়।’ আমি বললাম, ‘কী ভাবছি? কী নয়?’ গঙ্গারাম বলল, ‘আপনি ভাবছেন আপনার জন্যে মদের বোতল নিয়ে এসেছি নিউ ইয়ারের ভেট হিসেবে। তা কিন্তু নয়।’
আমার খেয়াল হল দিনটা, দোসরা জানুয়ারি গতকালই ইংরেজি নতুন বছর শুরু হয়েছে। তোয়ালে ঢাকা জিনিসটার দিকে তাকিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা হলে তোয়ালে দিয়ে ঢাকা জিনিসটা কী?’ গঙ্গারাম বলল, ‘এটা পৌষ কালীর প্রসাদ।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘পৌষ কালী?’ গঙ্গারাম বলল, ‘জানেন না, পৌষ মাসের অমাবস্যায় পৌষ কালীর পুজো হয়। সেদিন লোকেরা সারাদিন চড়ুইভাতি করে, বিকেলে প্রসাদ পায়। এই এক বোতল টাটকা প্রসাদ আপনার জন্য নিয়ে এলাম। দু’-এক চামচ খেয়ে দেখুন, মাথা সাফ হয়ে যাবে। কলমের মুখ দিয়ে সরস সব গল্প বেরুবে।’ এই বন্ধ্যা সন্ধ্যায় গঙ্গারামের কথা শুনে একটু ভরসা পেলাম। তবু আমার মনের খটকা যায় না। আমি বললাম, ‘কোথায় পেলে এ মহামূল্য প্রসাদ?’ গঙ্গারাম বলল, ‘বনহুগলির ধাঙড়পাড়ায়।’ আর বিস্তৃত জানতে চাইলাম না। গঙ্গারাম পকেটে করে দুটো চা খাওয়ার খুরি নিয়ে এসেছিল, এঁটো কি না কে জানে। গঙ্গারাম ভিতরের বারান্দায় গিয়ে খুরি দুটো জল দিয়ে ধুয়ে নিয়ে এল, তারপর সেই বোতল থেকে টকটকে লাল রঙের কী একটা ঘন পানীয় ভাঁড় দুটোয় ভরল। তারপর একটা আমাকে এগিয়ে দিল। আমি ভয়ে ভয়ে পানীয়টির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা লেহ্য, না পেয়? মানে এটা চেটে খেতে হবে, না চুমুক দিয়ে খেতে হবে?’ গঙ্গারাম বলল ‘ভয় পাবেন না, খাঁটি শাস্ত্র মেনে তৈরি। পরশুরাম তাঁর গল্পে যে চাঙ্গায়ণী সুধার কথা বলেছিলেন, এ তার চেয়ে অনেক বেশি কড়া, স্বর্ণভস্ম থেকে স্কচ, মোদকানন্দ মোদক থেকে আফিং, সব মিলিয়ে এটা তৈরি৷’ভয়ে ভয়ে এক চুমুক ঠোঁটে ঠেকালাম। ছোট শিশু হাঁটতে শিখলে লোকে যেমন বলে আর একটু আর একটু, গঙ্গারাম তাই করতে লাগল। কিন্তু আমার পক্ষে আর একটু সম্ভব হল না। ততক্ষণে গঙ্গারাম এক খুরি শেষ করে পরের খুরি ঢেলেছে। সে খাতার উপর ফেলে রাখা কলমটা আমার হাতে ধরিয়ে বলল, ‘এবার লিখে যা দেখি, আমি বলছি।’
গঙ্গারামের সাহস দেখে আমার রাগ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু একটু নেশা হয়তো হয়ে গিয়েছিল, রাগ সামলে নিয়ে বললাম, ‘ঠিক আছে, কী গল্প বলবে বলো।’ গঙ্গারাম বলল, ‘আমাদের পাড়ায় শিবনাথ বিয়ে করেছে। বিয়ে করে বাড়িতে বউ নিয়ে এসেছে। বাড়িতে থাকার মধ্যে শিবনাথের প্রৌঢ়া বিধবা মা। তিনি নতুন বউ দেখে একদম হকচকিয়ে গেলেন। বললেন, ‘শিবু এ কী করেছিস? চোখ দুটো ট্যারা, দাঁতগুলো পোকায় কাটা, কালো, গায়ের রংও কালো। মাথায় চুল প্রায় নেই। এ কী বউ নিয়ে এলি?’ নববধূ যাতে শুনতে না পায় শিবুর মা নববধূকে আশীর্বাদ করতে করতে ফিস ফিস করে এইসব কথা শিবুকে বলছিলেন। মায়ের কথা শুনে শিবনাথ মাকে বলল, ‘মা, বউ কানে একদম কালা। তোমাকে ফিসফিস করে কথা বলতে হবে না।’
সব শুনে আমি বললাম, ‘এ তো বাজে গল্প।’ গঙ্গারাম আহত হয়ে বলল, ‘তা হলে আপনার বউমার একটা গল্প বলি। কাল একচোট খুব ঝগড়া করল। আমি বাধ্য হয়ে বললাম, তুমি এ রকম করলে বাড়িতে শান্তি থাকবে না।’ আমার কথা শুনে আপনার বউমা আমাকে তেড়ে এল। বলল, ‘আমি বাপের বাড়ি যাচ্ছি, তুমি থাক তোমার শান্তিকে নিয়ে।’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘শান্তি? শান্তি আবার কে?’ উদ্যত ঝাঁটা হাতে বউ বলল, ‘ন্যাকামি করো না, এ বাড়িতে শান্তি আসবে না, এ বাড়িতে শান্তি থাকবে না—আমি কিছু বুঝি না বুঝি!’