রসগোল্লা

রসগোল্লা

মিষ্টির মান খুব খারাপ। মুখে তোলা যায় না। অনেক সময় পচাও থাকে। পাড়ার সকলে সে কথা জানে। তবু খুব ভিড় হয়।

দোকানের নাম মহামায়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। আজকাল মিষ্টির দোকানগুলোর মাথায় থাকে গ্লো সাইনবোর্ড। দূর থেকে মনে হয় বিউটি পার্লার। মহামায়ার মাথায় গ্লো সাইনবোর্ড তো দূরের কথা, টিনের সাইনবোর্ডও নেই। একটা ছিল, অক্টোবরের ঝড়ে উড়ে গেছে। তারপর আর লাগানো হয়নি। দরকারই বা কী? সাইনবোর্ড ছাড়াই সকালে বিকালে প্রচণ্ড ভিড়। ঠাসাঠাসি ভিড় যাকে বলে। লাইন দিয়ে চাল, গম বা কেরোসিন কেনার নিয়ম, কিন্তু সন্দেশ বা চমচম কেনার জন্য লাইন দেওয়ার কোনও নিয়ম এখনও চালু হয়নি। চালু হলে এখানকার লাইন রোজই বড় রাস্তা পর্যন্ত চলে যেত।

যারা এই দোকানে আসে তারা কিন্তু কেউই মিষ্টি কিনতে আসে না। জেনেশুনে খারাপ জিনিস কে কিনবে? তবে তারা কী জন্য আসে?

আসে কচুরি কিনতে।

মহামায়ার কচুরি শুধু এই পাড়ায় নয়, গোটা শহরেই খুব নামকরা। সে কচুরি একবার খাওয়া যায় না। মোট তিন বার খেতে হয়। প্রথম বার মুখে দেওয়ার পর বিশ্বাস হয় না যে এটা কচুরি। মনে হয় কচুরির নামে অন্য কিছু খেলাম। মনের মধ্যে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। সেই বিভ্রান্তি কাটানোর জন্য আবার খেতে হয়। তখন জটিলতা কাটে এবং তার বদলে একটা বিস্ময় ভাব জাগে। তৃতীয় বার আরও দুটো না নিয়ে তখন আর কোনও উপায় থাকে না। এই জন্যই মহামায়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে একই লোককে অনেক সময় দিনে তিন বার পর্যন্ত দেখা যায়। যদিও কোনও বারই তারা মিষ্টি কেনে না।

তবে সব কিছুরই ব্যতিক্রম আছে।

মহামায়ার ব্যতিক্রম হলেন গোপীনাথবাবু। গোপীনাথ হালদার। এই যে মোড়টায় হলুদ রঙের একটা দোতলা বাড়ি দেখা যাচ্ছে না? ওই যে দোতলার বারান্দায় গামছা ঝুলছে? হ্যাঁ, ওখানেই গোপীনাথবাবু থাকেন। গামছাটা ওঁরই। গোপীনাথ হালদারের বয়স সামনের মাসের চার অথবা পাঁচ তারিখে সাতষট্টি পূর্ণ করবে। তারিখ নিয়ে একটা সংশয় আছে। তবে একদিন বলে সেটা নিয়ে খুব একটা গ্রাহ্য হয় না। তা ছাড়া তাঁর তো আর ধূমধাড়াক্কা করে জন্মদিন হচ্ছে না। সুতরাং চারও যা পাঁচও তাই।

রোজ সকাল সাতটা দশ থেকে পনেরোর মধ্যে গোপীনাথবাবু মহামায়ায় আসেন। এক টাকা পিসের মোট চারটে রসগোল্লা কেনেন। ভাঁড়ে যখন রসগোল্লা তোলা হয় গোপীনাথবাবু বলেন, ‘বেশি করে রস দিয়ো হে কালাচাঁদ। বুঝলে না রসটাই আসল।’ কালাচাঁদ গদগদ মুখে বলে, ‘দিয়েছি দাদা বেশি করেই দিয়েছি। একেবারে নাকডোবা রস দিয়েছি আজ।’ ভাঁড় হাতে নিশ্চিন্ত মনে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন গোপীনাথবাবু।

আজ কিন্তু তাঁর মন নিশ্চিন্ত নয়। আজ দেরি হয়ে গেছে। ছোট নাতনি এতক্ষণে স্কুলে বেরিয়ে গেল কিনা কে জানে। বেরিয়ে গেলে তার টিফিনে আর রসগোল্লা দেওয়া গেল না। বড় নাতনিটা কলেজে পড়ে। তারও তো ভাত খাওয়ার সময় চলে এল। ভাতের আগে কি আর রসগোল্লা খাবে? মনে হয় না। ভাতের পাতে দিয়ে একবার চেষ্টা করা যেতে পারে। বউমাকে বলতে হবে। বড় নাতনিটার খাওয়া নিয়ে ভারী ছরকট। ‘খাবি?’ জিজ্ঞেস করলে সে কিছুতেই মুখে দেবে না। যেন তাকে উচ্ছে খেতে বলা হচ্ছে। ঝপ করে পাতে ফেলে দিতে হবে। অন্যমনস্ক হয়ে যদি খেয়ে নেয়। বাকি রইল দুটো। একটা বউমার, একটা খোকার। ওরা অবশ্য এখন খায় না। যখন ইচ্ছে টপ করে মুখে ফেলে দেয়। জিনিসটা ঠিক করে না। অন্যায় করে। মানুষের খাওয়াদাওয়ার একটা নিজস্ব সময় আছে। পশুদের নেই। পশুরা যখন যা পাবে খেয়ে নেবে। মানুষ তা করবে না। সে ভাত খাবে ভাতের সময়। কেউ কি সন্ধে ছ’টার সময় ভাত খায়? খায় না। তেমনই রসগোল্লারও একটা নিজস্ব সময় আছে। তাকে সেই সময়েই খেতে হবে। বউমা আর খোকা সেটা বোঝে না। কেন বোঝে না? বড়দের নিয়ে এই একটা ঝামেলা, তারা অনেক কিছু বুঝতে চায় না। গোপীনাথবাবু অনেক চেষ্টা করেছেন। কাজ হয়নি। বউমা বলে, ‘ঠিক আছে বাবা, আপনি দিন, আমরা ঠিক একটা সময় খেয়ে নেব। হাতে এখন অনেক কাজ। রসগোল্লা তো আর ট্যাবলেট নয় যে কাজের মধ্যেই খেতে হবে।’ এটা কোনও কথা হল? রসগোল্লা যেমন ট্যাবলেট নয়, তেমনই আবার চারা মাছও নয়। আধ ঘণ্টা কাঁটা বেছে খেতে হয় না। খোকাটাও একই রকম। রসগোল্লার প্রসঙ্গ তুলতেই যত সব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলবে।

‘বাবা, তুমি কত টাকা পেনশন পাও?’

‘আটশো বাইশ টাকা।’

‘দিনে তুমি কত টাকার রসগোল্লা কেনো?’

‘মোটে চার টাকার। টাকায় একটা। আজকাল কি আর এক টাকায় কিছু পাওয়া যায়? কিচ্ছু পাওয়া যায় না। একটা টাকা তুই রাস্তায় ফেলে দে, দেখবি কেউ ফিরেও তাকায় না। এত ছোট জিনিস কে পাত্তা দেবে? কেউ নয় নেহাত কালাচাঁদ মানুষটা ভীষণ ভাল। সে এখনও এক টাকাকে দাম দেয়। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা ছোট জিনিসকেও মূল্য দেয়। ও সে রকমই একটা মানুষ।’

‘রোজ চার টাকার রসগোল্লা কিনলে তুমি মাসে কিনছ মোট একশো কুড়ি টাকার। বছরে কত হচ্ছে? সোজা হিসাব। এক হাজার চারশো চল্লিশ টাকা। লাস্ট ফাইভ ইয়ারস ধরে তুমি এই কাণ্ড চালাচ্ছ। ফাইভ ইনটু এক হাজার চারশো চল্লিশ। অর্থাৎ খরচ হয়ে গেছে সাত হাজার দুশো কুড়ি। এই অ্যামাউন্টটা যদি তুমি কিষাণ বিকাশে রাখতে সাড়ে পাঁচ বছরে কত রির্টান পেতে সেটা একবার ভেবেছ? ভাবোনি তো? একবার ভেবো। ঠিক আছে তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। আমিই বলে দিচ্ছি। প্রায় সাড়ে চোদ্দো হাজার টাকা। বোনাস টোনাস নিয়ে হয়তো পনেরো হলেও হতে পারে। এর পর আবার যখন তুমি রসগোল্লা কিনবে প্লিজ এটা একবার মনে করবে। মনে করবে আমি পনেরো হাজার টাকা জলে দিচ্ছি। সরি, জলে নয়, রসে দিচ্ছ বাবা।’

এটা কোনও কথা হল? গোপীনাথবাবু ভেবে দেখেছেন এটা কোনও কথা হল না। পৃথিবীর সব কিছুরই কি হিসাব করা যায় নাকি? এই যে কালাচাঁদ তাকে প্রতিদিন ভাঁড়ে একটু বেশি করে রস ঢেলে দেয় তার কি কোনও হিসাব রাখে? তার জন্য কি দুটো পয়সা বেশি চায়? মোটেই না, কখনওই চায় না।

তার ওপর রসগোল্লার খাদ্যগুণ? সেটা হিসাবের মধ্যে আসবে না? খোকাটা ছেলেবেলার মতো এখনও অঙ্কে কাঁচা।

তবু ছেলের কথা শোনার পর গোপীনাথবাবু কিছুটা মুষড়ে পড়ে। এই যে তিনি প্রতিদিন রসগোল্লার পিছনে ছোটাছুটি করছেন, দুই নাতনি, ছেলে এবং ছেলের বউকে খাওয়াচ্ছেন এর মূল্য কত? এর পরেই তিনি ঠিক করেন এ সম্পর্কে কিছু পড়াশুনা করবেন। কিন্তু পড়াশুনা করব বললেই তা করা যায় না। আজকাল অনেকের বাড়িতেই মাইক্রোচিপস বা সাইবারনেটিক্স সম্পর্কে বই থাকে। ক্লাস ফোর ফাইভের ছেলেদের স্কুলের ব্যাগ ঘাঁটলে টিনটিনের সঙ্গে সফ্‌টওয়ারের রঙিন পত্রপত্রিকা বেরিয়ে পড়বে। কিন্তু রসগোল্লার ওপর কিছু জানতে হলে গভীর জলে পড়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। শুধু তাই নয়, এমন বইয়ের খোঁজ করলেও বিপদ। লোকে পাগল ভাববে।

আশ্চর্য ভাবে গোপীনাথবাবু পাড়ার লাইব্রেরি থেকে মিষ্টান্ন বিষয়ক কিছু তথ্য পেয়ে গেলেন। একটা বই তো তাঁকে খুবই সাহায্য করল। ‘দ্য ফুড ভ্যালু অব সুইট অ্যান্ড সাওয়ার!’ মূলত এটি পুষ্টি বিষয়ক বই! তা হোক। এতেই অনেক কাজ হল।

বইটি পড়ে বৃদ্ধ গোপীনাথবাবু জানলে— সুষম খাদ্যই হল বেঁচে থাকার আসল মন্ত্র। সুষম খাদ্য ছাড়া শরীর-যন্ত্র অচল। তেলহীন গাড়ির মতো মুখ থুবড়ে পড়বে সে। সুষম খান্যের মধ্যে শর্করা হল এক নম্বর। ভাত, রুটিতে যেমন শর্করা আছে তেমনই আছে মিষ্টিতেও। তবে পুষ্টি বিজ্ঞানের মতে ভাত রুটির হল জটিল শর্করা। চিনি হল সরল শর্করা। শরীরে ঢুকে কাজ করে দ্রুত। সব থেকে বড় এবং আসল কথা হল মানুষের শরীরের মূল এনার্জিট আসে মিষ্টি থেকে। বাংলায় যাকে বলে শক্তি। খুব তাড়াতাড়ি যদি এনার্জি পেতে চাও তা হলে টপ করে একটা মিষ্টি মুখে ফেলে নাও। এর নাকি কোনও বিকল্প নেই। এই পর্যন্ত জেনে গোপীনাথবাবু খুবই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলেন। এত দিনে খোকার মুখের মতো একটা জবাব পাওয়া গেছে। শর্করা সম্বন্ধে আরও রোমাঞ্চকর ব্যাপারও আছে। গোপীনাথবাবু ধীরে ধীরে জানতে পারলেন— বড় বড় চিকিৎসকেরা অনেকেই মনে করেন, ছোটদের পক্ষে শর্করার মতো জরুরি জিনিস খুব কমই আছে। অর্থাৎ খুব জরুরি হল মিষ্টি। এতে নাকি শরীর সুগঠিত হয়, হয় মজবুত। কিন্তু রসগোল্লা কেন? গোপীনাথবাবু এই প্রশ্নের উওরও খুঁজে পেলেন। রসগোল্লা হল ছানার। আর মহামায়ার ছানা নিশ্চয় বাসি ছানা নয়। টাটকা ছানা। এতে ফ্যাটের পরিমাণ কম। সুতরাং রসগোল্লা জিন্দাবাদ। গোপীনাথবাবু এতেই থেমে গেলেন না। তিনি বই ঘেঁটে রসগোল্লার খাদ্যগুণ ঠিক কত তার একটা হিসেবও তৈরি করে ফেললেন। একটু খাটাখাটুনি করতে হয়েছে বটে কিন্তু কাজটা করে খুবই তৃপ্তি পেলেন। ঠিক সেই হিসাবে দেখা যাচ্ছে এক কেজি ছানা আর আড়াই কেজি চিনি থেকে প্রায় বিরানব্বইটির মতো প্রমাণ সাইজের রসগোল্লা তৈরি করা যায়। এরকম একটা রসগোল্লায় প্রোটিন থাকে দু’ গ্রামের কাছাকাছি। ফ্যাট থাকে আড়াই গ্রামের একটু কম। এনার্জি পাওয়া যায় প্রায় সত্তর কিলো ক্যালরির মতো।

পকেটে হিসেবের চিরকুট ঢুকিয়ে গোপীনাথবাবু ভাবলেন আগে একবার কালাচাঁদকে দেখিয়ে নিয়ে গেলে কেমন হয়? মানুষটা এত দিন মিষ্টির মধ্যে আছে। ভুলচুক হলে শুধরে দেবে। তার থেকে বড় কথা হল রসগোল্লার রসে যে এত রহস্য লুকিয়ে আছে সেটা ওকে একবার না জানালে মনটা কেমন খচখচ করবে।

মিষ্টির দোকানের মালিকরা মোটাসোটা হয়। তাদের গা থেকে ঘিয়ের গন্ধ বেরোয়। কালাচাঁদ কিন্তু একেবারে উলটো। রোগাভোগা শরীর, চিমসেপানা। তার ওপরে মুখটা তার সর্বদাই কাঁচুমাচু। কেমন যেন লাজুক টাইপের। আসলে সত্যি সত্যি কিন্তু কালাচাঁদ খুবই লজ্জার মধ্যে থাকে। এত সুন্দর একটা চালু দোকান নিয়ে তার কীসের লজ্জা? দোকান না চললে না হয় একটা লজ্জার ব্যাপার ছিল।

আজ গোপীনাথবাবু কথাটা জিজ্ঞেস করে ফেললেন।

‘কালাচাঁদ, তুমি মুখটা অমন করে থাকো কেন? তুমি থাকবে হাসিখুশি। খদ্দেরদের দাপট দেখাবে।’

কালাচাঁদ এই কথায় আরও কুঁকড়ে যায়, ‘কী যে বলেন কর্তা? দোকান দিলাম মিষ্টির। নাম হল নোনতার। লজ্জার। খুবই লজ্জার।’

‘তা হোক। তোমার তো বিক্রিবাট্টা হওয়া নিয়ে কথা। লাভ হলেই হল।’

‘ছি ছি ও কথা বলবেন না কর্তা। সব কি আর লাভ লোকসান নিয়ে বিচার চলে? শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর গড়ে ফেললে কি আর ভাল লাগে? আপনিই বলুন কর্তা। এই ক’বছরে কত যে হালুইকর বদলালাম তার ঠিক নেই। কিন্তু অবস্থা যে কে সেই। মিষ্টি আপনি মুখে তুলতে পারবেন না।’

গোপীনাথবাবু ভেবে দেখলেন কথাটা খুব ভুল বলেনি কালাচাঁদ। দুঃখ হওয়ারই কথা। এক ভেবে সারাটা জীবন কাজ করার পর লোকে যদি অন্য জিনিসের মূল্য দেয় তা হলে মনে শান্তি আসে না। আসার কথা নয়। কিন্তু কী করা যাবে? মেনে নেওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।

‘কালাচাঁদ, তুমি একটা কাজ করো। মিষ্টির বদলে দোকানটা তুমি পুরোপুরি নোনতা করে দাও না কেন? মহামায়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের বদলে মহামায়া নোনতা ভাণ্ডার। একটু কেমন কেমন লাগছে বটে, তবে ও শুনতে শুনতে ঠিক হয়ে যাবে।’

‘কী যে বলেন কর্তা। এ-কথা শোনাও পাপ। মিষ্টি তৈরি একেবারে বন্ধ করে দেব? তা কখনও হয় নাকি! আপনি যাবেন কোথায়? এই যে সকালে আপনি আসেন, চাড্ডি রসগোল্লা নিয়ে ভাঁড় হাতে ফিরে যান, দেখলে মনটা একেবারে ভরে যায়। যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ আপনার দিকে তাকিয়ে থাকি। কর্মচারীরা আড়ালে হাসাহাসি করে। সে করুক। কতা, রসগোল্লা সন্দেশ বড় কথা নয়। বড় কথা হল, একজন অন্তত যা করতে চেয়েছিলাম তার মূল্য দেয়। এই কথাটা ছাড়ি কী করে কর্তা? ছাড়তে পারি না।’

খাদ্যগুণে হিসেব নিকেশ করে মনটা ভাল হয়ে গিয়েছিল। এখন আবার খারাপ হয়ে গেল। বাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে গোপীনাথবাবু ভাবলেন, না কালাচাঁদ লোকটা বোকাই আছে। বোকা না হলে সামান্য মিষ্টির দোকান চালিয়ে এমন ফিলজফিকাল কথা বলে? আসলে কিছু কিছু বোকা লোক পৃথিবীতে আছে যাদের জন্য এই বুড়ো বয়সে মন খারাপ হয়ে যায়। সেই মন খারাপ সহজে কাটতে চায় না।

রোজ বিকেলে দুই নাতনি অপলা আর সুপলা ছাদে ওঠে। আজও উঠেছে। গোপীনাথবাবু ছাদে এসে দেখলেন সুপলা ছাদের ওপর খড়ি দিয়ে এক্কা দোক্কার ছক কাটছে। অপলা এক কোণে বসে আছে। তার হাতে একটা কাগজ। মনে হচ্ছে চিঠি জাতীয় একটা কিছু হবে। মুখ গম্ভীর, খুবই গম্ভীর।

গোপীনাথবাবুকে দেখে ছোট নাতনি সুপলা ঠোঁটে হাত দিল, ‘শ্‌ শ্‌ দাদু। একদম আস্তে।’ তারপর দিদির দিকে চোখ তুলে ইশারা করল।

গোপীনাথবাবু গলা নামিয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে? মনে হচ্ছে ব্যাপার সিরিয়াস?’

‘খুবই। দিদি এখন একেবারে খেপচুরিয়াস। কিছু বলতে গেলে মারতে আসছে।’

অল্পবয়সি মেয়েরা যখন ছাদের কোণে চিঠি পড়ে তখন সবসময়ই তাদের মুখ গম্ভীর থাকে। সে চিঠি আনন্দের বা দুঃখের যাই হোক না কেন। এই সময় তারা রেগেও থাকে। তাই অপলার রাগের ঘটনায় খুব একটা গুরুত্ব দিতে চাইলেন না গোপীনাথবাবু।

‘তোদের আজ একটা মজার জিনিস বলব বলে এখন ছাদে এলাম। মজার, আবার একসঙ্গে জানারও। এতদিন অনেক খেটেখুটে জিনিসটা তৈরি করেছি।’

‘পড়াশুনার কিছু হলে আমি কিন্তু শুনব না দাদু। গল্প বলার নাম করে যারা জ্ঞান দেয় তাদের আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না। এই দোষটা ইদানীং তোমার মধ্যে ডেভেলপ করেছে।’

‘না, সে রকম কিছু নয়, শোন না, শুনলে তোরও খুব মজা পাবি।’

সুপলা দাদুর দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আর তুমি মজা পাবে না?’

‘না। আমি মজা পাব তোর বাবা যখন শুনবে।’

গোপীনাথবাবু কথাটা বলে একচোট হাসলেন। সেই শব্দে চিঠি থেকে মুখ তুলে অপলা বিরক্ত মুখে তাকাল। সুপলারও কৌতূহল হল।

‘দাদু কী ব্যাপার বলো তো। আমার তো সন্দেহ হচ্ছে। তোমার রসগোল্লার কিছু নয় তো?’

ছোট নাতনির বুদ্ধি দেখে গোপীনাথবাবু খুশি হলেন।

‘ঠিক বলেছিস। ভেরি গুড।’

‘ও বাবা, তাই বলো। আবার তোমার সেই রসগোল্লা! উফ্‌ দাদু, ইট ইজ ডিসগাসটিং। ঠিক আছে দাদু, আগে আমি তোমাকে একটা গোপন খবর দিয়ে দিই। তারপর ভেবে দ্যাখো তোমারটা তুমি বলবে কিনা। আমার মনে হয় না আমার খবর শোনার পর তুমি আর তোমার মিস্টার রসগোল্লাকে নিয়ে কোনও কথা বলবে।’

গোপীনাথবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কী ব্যাপার বল তো।’

সুপলা চারপাশটা ভাল করে দেখে ফিসফিস করে বলল, ‘জানো দাদু, আমরা কিন্তু তোমার আনা রসগোল্লা কোনও দিন খাই না। রোজই তোমাকে লুকিয়ে আমরা ওগুলো ফেলে দিই।’

‘কেন? ফেলে দিস কেন?’ গোপীনাথবাবু অবাক হলেন।

‘কেন আবার? অমন হতকুচ্ছিৎ জিনিস মুখে দেওয়া যায় নাকি? আমি একদিন টিফিনে ভুল করে নিয়ে গিয়েছিলাম। তপতী খেল। তপতীকে চেনো তো? শি ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। সেই রসগোল্লায় কামড় দিয়ে তপতীর কী বমি গো! তারপর আরও কেলেঙ্কারি আছে। শুনবে? মা একদিন রতনের মাকে দিয়েছিল। বাবা রাতে শুনে রেগে একবারে কাঁই। বলল, ডাক্তারের খরচ কে দেবে? তুমি? বাবার ছাইপাঁশ তুমি ওকে খাওয়ালে? বলেছি না ফেলে দেবে? উফ্‌। রিটায়ারমেন্টের পর বাবার মাথাটা একদম গেছে।’

ছোট নাতনির মুখ থেকে এমন গোপন খবর জানার পর গোপীনাথবাবুর ভেঙে পড়ার কথা। তিনি ভেঙে পড়লেন। ছাদে সন্ধে নামছে। সূর্য ডোবার কমলা আলোয় একদিনের আকাশটা কেমন মনমরা। কীসের জন্য মনমরা? হয়তো দিন চলে যাওয়ার জন্য। কে জানে। গোপীনাথবাবু পাঁচিলে কনুই রেখে দাঁড়ালেন। পকেটের খাদ্যগুণের কথা লেখা চিলতে কাগজ বের করে উড়িয়ে দিলেন। কী হবে রেখে। আশ্চর্য! এত কষ্ট করে আনা সামান্য জিনিসটা এরা কোনও দিন মুখেও তোলে না! অবাক কাণ্ড। অবাক ভাবটা কেটে গিয়ে ধীরে ধীরে গোপীনাথবাবুর রাগ হতে থাকল। অন্ধকার নামার পর তিনি একটা বড় সিদ্ধান্ত নিলেন। যা হবার হয়ে গেছে। আর নয়। আর কোনও দিন নয়। কোনও দিন তিনি আর রসগোল্লা আনবেন না। মহামায়ার দিকে পা-ই বাড়াবেন না।

সিদ্ধান্ত বড় হলেও বুড়ো মানুষটা কেন জানি সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পারলেন না। বয়স হয়ে যাওয়ার মুশকিল। ইচ্ছে থাকলেও অনেক কিছুই করা হয়ে ওঠে না।

পরদিন সকালে ঠিক সময়ে আবার মহামায়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে গোপীনাথ হালদারকে দেখা গেল।

কচুরি-ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে তিনি দুইবার কাশলেন। রোজই কাশেন। রসগোল্লার সিগন্যাল।

কাশির শব্দে কালাচাঁদ তাকাল। একগাল হেসে বলল, ‘আসুন কর্তা।’ গোপীনাথবাবু গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘একটু বেশি করে রস দিয়ে কালাচাঁদ। বৃদ্ধ মানুষটার মনে হল, রসগোল্লা হবে টইটম্বুর। খাওয়ার সময় সেই রস ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়বে। খোকা, বউমা, নাতনিরা সেই রস হাত দিয়ে মুছবে। মুছতে গিয়ে হাত চটচট করবে। সহজে সেই চটচটে ভাব কমবে না। অনেকক্ষণ লেগে থাকবে। অনেকক্ষণ।

গোপীনাথবাবু নিজের মনেই হাসলেন। সামান্য হাসি।

ওই যে বুড়ো মানুষটা হলুদ বাড়ির দিকে যাচ্ছেন। একটু তাড়াতাড়ি যাচ্ছেন। ছোট নাতনিটার স্কুলে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হয়ে গেল। বড় নাতনিটা ভাত খেতে বসবে। খোকা, বউমাও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রস-ভরা ছোট ভাঁড়টা হাতে শক্ত করে ধরা। মন ভরা তৃপ্তি। এই তৃপ্তির দাম যে আকাশছোঁয়া। ফ্যাট, ক্যালরি, এনার্জি আর কিষাণ বিকাশের লম্বা চওড়া হিসাব তাকে ছোঁবে কী করে?

গোপীনাথবাবু জোরে পা চালালেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *