2 of 2

রসগোল্লার গাছ – শ্যামলকান্তি দাশ

রসগোল্লার গাছ – শ্যামলকান্তি দাশ

পুরো আটচল্লিশ ঘণ্টাও হয়নি এখনও। এরই মধ্যে নানা কাণ্ড। অদ্ভুত। বিদঘুটে। দেখতে দেখতে শিবনাথবাবুর চোখের পলক পড়ছে না। যত দেখছেন ততই অবাক হয়ে যাচ্ছেন। বিস্ময়ে তাঁর মুখ দিয়ে কোনো কথা ফুটছে না। এটা ঠিক কোন জায়গা তা এখনও ভালোভাবে জানেন না শিবনাথবাবু। জায়গাটাও কেমন যেন। ল্যাজা—মুড়ো কিচ্ছু নেই। আর এখানে আসার কারণটাই বা কী! গুরুতর কিছু? তাও স্পষ্টভাবে মনে পড়ছে না। চোখ কচলে, গলা ঝেড়ে, নেচেকুঁদে, পেশি ফুলিয়ে, দুটো মৃদু লাফ দিয়ে মনে করবার চেষ্টা করলেন। একবার নয়, অনেকবার। কিন্তু নাহ, কিছুই মনে পড়ল না। আর কেন যে এমন সব গোলমেলে কাণ্ড ঘটছে তা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না তিনি।

মস্ত একটা ফুলপাতা আঁকা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিলেন শিবনাথবাবু। মাঝে মাঝে চোখ পাকিয়ে, ভুরু নাচিয়ে, নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে নিজেকে ভেংচি কাটছিলেন। এটা শিবনাথবাবুর বহু বছরের পুরোনো অভ্যেস। নিজেকে নিয়ে মজা করতে বেশ লাগে। মনটা তরতাজা হয়ে যায়। কেমন যেন মিহি ফুরফুরে একটা ভাব জেগে ওঠে। নিজেকে কেমন যেন ছেলেমানুষ ছেলেমানুষ মনে হয়। ভারি আমোদ লাগে তখন।

এই ভাব জেগে ওঠার জন্য কিনা জানি না, খুব পরিপাটি করে চুল আঁচড়াতে গেলেন শিবনাথ। কিন্তু এ কী! মাথার চুলগুলো কোথায় গেল! টেরি ঠিক করতে গিয়ে ঠক করে চিরুনি পড়ে গেল হাত থেকে। মাথাভরতি কোঁকড়ানো চুলগুলো যেন নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল। এ কী গণপতি চক্রবর্তীর ম্যাজিক নাকি! মাথা আছে, কিন্তু মাথার ওপর যারা দিনভর দাপিয়ে বেড়ায় তারা ভ্যানিশ! একে ভোজভেলকি ছাড়া আর কী বলা যায়! মাথার এই দুরবস্থা দেখে ভয়ে তিন হাত পিছিয়ে গেলেন শিবনাথ। আর হ্যাঁ, তাঁর মাথাটাই বা কই? কাঠির মতো গর্দানের ওপর যেন একটা ঝুনো নারকেল বসানো। একটু টোকা দিলেই খসে পড়বে।

প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা কাবার হয়ে গেল। এখনও কিছু খাননি শিবনাথ। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। নাড়িভুঁড়ি তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু খাবেনই বা কী? দেবেই বা কে? কাকেই বা তিনি জানাবেন যে, তাঁর খুব খিদে পেয়েছে। এখন আর কিছু নয়, চাট্টি গরম ডালভাত আর আলুপোস্ত চাই তাঁর, আর সঙ্গে এক টুকরো গন্ধলেবু। আহা হা, এর তুল্য খাবার হয়? ভাবতে ভাবতে তাঁর জিভে জল এসে গেল। কিন্তু কাকে বলবেন এসব কথা! এ তো তাঁর সেই রাজনগর নয় যে যেমনটি চাই মুহূর্তের মধ্যে তেমনটিই পেয়ে যাবেন। বাড়িতে চাল ডাল নেই তাতে কী, হাওয়া খাও। মুহূর্তে পেট টইটম্বুর হয়ে যাবে। অমন নির্মল স্নিগ্ধ হাওয়া কি আছে এখানে!

রাজা নেই, রাজবাড়ি নেই কিন্তু গ্রামের নাম রাজনগর। রাজনগরের কথা মনে পড়তেই প্রাণটা আকুলি—বিকুলি করে উঠল। ছবির মতো গ্রাম। চারপাশে অজস্র গাছপালা, সবুজ। গাছে গাছে কত ফুল, রঙের কত বাহার, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। রাজনগরের মতো অত পাখি আর কোন গ্রামে আছে। ডাহুক, ঘুঘু, শালিক, বেনেবউ, চড়ুই, দুর্গাটুনটুনি। প্রতিটি পাখির ডাক চিনতেন শিবনাথ। বনের পাখি হলে কী হবে, প্রতিটি পাখির সঙ্গে তাঁর গলায় গলায় ভাব।

গ্রামের একপাশে ছোট্ট একটা নদী। আর নদীর নামটাও কবিতার মতো ভারি চমৎকার। কঙ্কাবতী। শান্ত আর নিরিবিলি। কাচের মতো ঝকঝক করছে জল। সন্ধেবেলা সেই নদীর ধারে বসে জলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঢেউয়ের গায়ে হাত রাখতেন। এই নদীর কাছেই গল্পের রসদ পেতেন শিবনাথ। এই নদীটা ছিল বলেই তো তিনি অতগুলো বই লিখতে পেরেছেন। আর এই রাজনগর গ্রামটা ছিল বলেই তো লোকজন তাঁকে অত খাতির করত। সভাসমিতিতে যেতেন, গলায় ফুলের মালা পরতেন, হাততালি পেতেন। এই গ্রামটা ছিল বলেই লেখক হতে পেরেছিলেন শিবনাথ।

আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে তো গল্পই লিখছিলেন শিবনাথ। একটা জমকালো ভূতের গল্প। সবে যখন একটু একটু করে গা—ছমছমে পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, গল্পের পাত্র—মিত্ররা এসে হাজির হচ্ছে, হঠাৎ শিবনাথবাবুর বুকে ব্যথা। প্রবল শ্বাসকষ্ট। একটু দূরে বসে খবরের কাগজ দেখতে দেখতে চা খাচ্ছিলেন অভিন্ন—হৃদয় বন্ধু হরিসত্য বসু। তাঁকে কিছু বলবার আগেই কুয়াশার মতো সব কেমন যেন ঝাপসা নিথর হয়ে গেল। রাজনগর, কঙ্কাবতী নদী, নদীর ধারে কুমোরপাড়া, লাল টালি ছাওয়া ইস্কুলবাড়ি, সবুজ ঘাসে ঢাকা মস্ত খেলার মাঠ, লেখার কাগজ, বন্ধু হরিসত্য সব যেন স্বপ্নের মতো। ছায়া—ছায়া। তারপর আর কিছুই মনে নেই শিবনাথের।

আবছা ভাবে এই ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই শিবনাথ আচার্যর বুকটা হু—হু করে উঠল। মনে হল চারদিকে কোথাও কোনো জনপ্রাণী নেই। যতদূর চোখ যায় কেবল ফাঁকা আর শূন্য। চারপাশে জাঁকিয়ে বসেছে একটা নিরেট, নিশ্ছিদ্র অন্ধকার।

আস্তে আস্তে আয়নার সামনে থেকে সরে এলেন শিবনাথ। এখন আর কোনোভাবেই তিনি শিবনাথ আচার্য নন, ভূতনাথ ভট্টশালী। তাঁর পিতৃদত্ত অমন সুন্দর, ভাবগম্ভীর নামটা এভাবে হারিয়ে যাবে তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। শিবনাথের বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।

শিবনাথ।

শিবনাথ।

ও শিবনাথ…।

মনে হল কেউ যেন হেঁড়ে গলায় পেছন থেকে ডাকছে। চেনা গলা, অথচ ঠিক চেনা যাচ্ছে না।

কেউ যেন বারতিনেক শিবনাথ বলে ডেকেই চুকচুক করল। ‘এই যাঃ, ভুলে গেছি তো। তুই তো আবার এখন শিবনাথ নোস। তোর কী যেন নতুন নাম হয়েছে না?’

কথাগুলো কেমন যেন ব্যঙ্গের মতো শোনাল। সেই সঙ্গে অদ্ভুত একটা হাসি। খিক খিক। খিক খিক।

কিন্তু কোথাও কোনো উত্তর নেই। চারদিকে চুপচাপ। অনেক দূরে একটা ধুলোর ঘূর্ণি দেখা গেল। মনে হল গাছপাতা নড়ছে। হঠাৎ আবার সেই গলা, ‘ওহ, তুই তো এখন ভূতো, মানে ভূতনাথ…’

এরকম একটা অচেনা—অজানা জায়গায় কে এমন ভাবে ডাকছে! আর এ তো নিছক ডাকা নয়, রীতিমতো তুই—তোকারি। তা ছাড়া তাঁর সুন্দর নামাটাকেও স্লেটের লেখার মতো জল দিয়ে যেন মুছে দিয়েছে।

লোকটা কে? হাতি—ঘোড়া, বাঘ—ভালুক, পণ্ডিত—গোমস্তা যেই হোক, আদপে লোকটা একটা বেয়াদপ। যাকে বলে ষোলো আনা বেল্লিক। ভব্যতার ধার ধারে না। সেই সঙ্গে বুকের পাটাও আছে বলতে হবে। তা না হলে এরকম একটা বয়সি লোককে কেউ কখনো তুই—তোকারি করে!

রাগে ফুঁসছেন ভূতনাথ। লোকটা কে? কোত্থেকে কথা বলছে? চারপাশে ন্যাড়া মাঠ। একটা ধান—গমের গাছ নেই। একটা কাঠফড়িং কিংবা বাহারি প্রজাপতি উড়লেও পরিষ্কার দেখা যাবে। এইতো তাঁর পায়ের সামনে দিয়ে একসার গুঁড়ি পিঁপড়ে যাচ্ছে। তাঁর বুড়ো আঙুলে কুট কুট করে কামড়াচ্ছে। তিনি দেখতে পাচ্ছেন। অথচ লোকটাকে দেখতে পাচ্ছেন না কেন? কেউ কি ফিচলেমি করছে তাঁর সঙ্গে? নাকি অদৃশ্য থেকে ভূত কথা বলছে? নাকি দৈববাণী হচ্ছে? এ তো মহা জ্বালা! তা হলে কি…চিন্তিত হয়ে পড়লেন ভূতনাথ। দেখা হলে লোকটাকে উচিত শিক্ষা দেবেন।

এরকম মনোরম বিকেলবেলায় মনে কোনো রাগ থাকে না, মনের কোথাও কোনো দুঃখ জমতে পারে না। নিজেকে বেশ হালকা, ভারহীন মনে হয়। মাথার ওপর নীল আকাশ। পালকের মতো টুকরো টুকরো সাদা মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে—ওখানে। সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। সূর্যটা কি ডুবে গেল? কে জানে। একটুও রোদ নেই। মিষ্টি হাওয়া লাগছে গায়ে। দূরে দূরে বুনো গাছের ঝোপ। অদ্ভুত রঙে বিচিত্র সব ফুল ফুটে আছে। ঝিলমিলে, চোখ ধাঁদানো তাদের বাহার। মাথার ওপর দিয়ে ক্যাঁক ক্যাঁক শব্দ করে কয়েকটা পাখি উড়ে গেল।

এরকম পরিবেশে যে—কোনো লোকেরই মাথায় ভাব এসে যায়। ভূতনাথেরও এল। প্রথমেই দুটো দুর্দান্ত লাইন। মন ভালো হয়ে যায়। তারপরের লাইনটা তেমন জমল না। একটু জোলো হয়ে গেল। পানসে আমের মতো। চতুর্থ লাইনটা বেশ ওজনদার হওয়া চাই—তবেই না কবিতাটা দাঁড়াবে!

হাঁটতে হাঁটতে এই চতুর্থ লাইনটা ভাবছিলেন ভূতনাথ। একটা দুর্দান্ত লাইন চকিতে এসেও গিয়েছিল মাথায়—’খোলা আকাশের তলে ক্রীড়া করে বৈকালের ফুলগাছ’। কিন্তু ‘ক্রীড়া’ আর ‘বৈকাল’ শব্দ দুটো এখনকার দিনে একেবারেই অচল। পছন্দ হচ্ছিল না ভূতনাথের। ‘বৈকাল’ শব্দটা কেটে ‘মধ্যাহ্ন’ লিখবেন কিনা ভাবছিলেন, হঠাৎ আবার কে যেন খিকখিক করে হেসে একটা ছড়া কেটে উঠল:

খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে,

মরল তাঁতি হেলে গোরু কিনে।

মানে?

মানে কী এসব কথার? কে তাঁকে এইসব হাসিঠাট্টা করছে? অনর্থক তাঁর কবিতায় বাধা দিচ্ছে কোন বজ্জাত? রাগে আকাশের দিকে ঘুষি পাকালেন ভূতনাথ।

‘দূর, দূর, ওটা কি কোনো পদ্য হল রে!’

‘পদ্য নয়! এটা তাহলে কী?’

‘ওটা তোর মাথা আর আমার মুণ্ডু। ওটা একটা ছাই।’

‘ছাই! তার মানে?’

‘ছাই মানে ছাই। মানে পাঁশ। মানে ধুলো। মানে ফক্কা।’ হেসে উঠল অদৃশ্যকণ্ঠ।

ভূতনাথের মুখ রাগে লাল হয়ে উঠল। বেল্লিকটাকে নাগালের মধ্যে পেলে কান ধরে ওঠবোস করাতেন। নাকে খত দেওয়াতেন। কাব্য ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটানো যে রীতিমতো অপরাধ তা ভালোমতো বুঝিয়ে দিতেন।

‘ছাই মানে বোঝো না? গবেট কোথাকার! যার ল্যাজাও নেই মুড়োও নেই তাকে ছাই ছাড়া আর কী বলব? দূর দূর, ওসব ছাতামাথা লিখিস না। কেউ পড়বে না।’

‘বেশ করব লিখব। আলবাত লিখব। একশোবার লিখব। হাজারবার লিখব।’ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন ভূতনাথ।

‘না লিখবি না।’

ভূতনাথ কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, ধমকে উঠল অদৃশ্যকণ্ঠ। ‘এটা তোর রাজনগর নয় যে যা—খুশি করবি। এখানে এসব চলে না। আর একটা লাইন লিখেছিস কি মটাত করে ঘাড় মটকে দেব।’

ক্রোধে প্রায় জ্বলে উঠলেন ভূতনাথ, ‘দেখা যাবে কে কার ঘাড় মটকায়। এতক্ষণ কিছু লিখিনি, শুধুই ভাবছিলাম, এবার সত্যি সত্যি লিখব।’ তারপর নিজের মনেই বিড়বিড় করে বললেন, ‘বলে কিনা লিখবি না! তুমি বলার কে হে! চেনা নেই শুনো নেই, উপদেশ দিতে এসেছে। এতদিন গপ্পো লিখেছি, এবার পদ্য লিখব। দেদার পদ্য। লিখব আর হাওয়ায় ওড়াব। চৈত্রমাসের আকাশে উড়বে শিমুল তুলোর মতো। ফুরফুর। ফুরফুর। আহা হা, এই মজার কোনো তুলনা হয়?’

হঠাৎ শিবনাথকে কেউ যেন একটা চিমটি কাটল আড়াল থেকে। কাউকেই ধারেকাছে দেখা গেল না।

যন্ত্রণায় মুখ বেঁকিয়ে কিছু একটা বলতে গেলেন ভূতনাথ। সঙ্গে সঙ্গে মুখে একটা আলতো চাপড় এসে পড়ল, ‘উহুঁ, কথাটি নয়, কথাটি নয়। কথা বললেই বিপদ।’

ভূতনাথ একটু নীরব থেকে রহস্যটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন।

আবার সেই বিদ্রূপ মেশানো খিকখিক হাসি, ‘বলি, লিখছিস লেখ। কত লোকই তো লেখে, তুইও লিখবি, এতে আপত্তির কী! কিন্তু বাপধন, ছন্দ—টন্দ ঠিক করে লিখতে হবে তো। ভাষা পরিষ্কার হওয়া চাই। ভাব সাফ—সুতরো হওয়া দরকার। মগজ তালগোল পাকানো হলে চলবে না, খোলামেলা পদ্য পড়বে কে শুনি?’

বলতে বলতে টকাং করে একটা গাঁট্টা পড়ল শিবনাথের মাথায়। শিবনাথের চোখে জল এসে গেল। এইসব অপমান আর খুচরো প্রহার তাঁকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। ‘মাইকেলের কথা ভাব তো একবার। কী লেখা লিখেছিল লোকটা। পারবি অমন লিখতে—

হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন—তা সবে, (অবোধ আমি)। অবহেলা করি, পর—ধন লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি… লিখতে হলে এইরকম লিখতে হয়রে ব্যাটা। রবিঠাকুর রবিঠাকুর করে খুব তো গলা ফাটাস। পঁচিশে বৈশাখ এলেই তোদের আহ্লাদের সীমা থাকে না। পারবি ওই বুড়োর মতো একটা লাইন লিখতে? ওই যে রে, একটা পদ্য আছে না—

ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল।

ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল।

লেখ না এরকম পদ্য। বুঝব হাড়ে জোর আছে। পদ্য নিয়ে তোর কোনো পরিষ্কার ধারণাই নেই। তোর ভাবনা অস্পষ্ট। ভাষায় ছানি পড়েছে। কথাগুলোয় মনে হয় কফ জমেছে।’

ভাষায় ছানি পড়েছে! বলে কী মূর্খটা! খোলা আকাশের তলে ক্রীড়া করে বৈকালের ফুলগাছ—ক—জন ভাবতে পারে এরকম! ক—জনের মগজে আসে এরকম ভাবনা!

এবার হাসির শব্দ তুমুল হয়ে উঠল, ‘তোকে আগেই তো বললাম, ওটা পদ্য নয়, ছাই। ভস্ম। যে লাইনটায় তুই গলদঘর্ম হচ্ছিস, সেটা এইভাবেই তো ভাবতে পারিস—’আকাশের নীচে সাদা হয়ে আছে রসগোল্লার গাছ’। ব্যস, ‘বৈকাল’ও রইল না, আর ‘ক্রীড়া’ও রইল না। ল্যাটা চুকে গেল।’

‘তা না হয় হল,’ আপন মনে আবার বলে উঠলেন ভূতনাথ, ‘কিন্তু পরের লাইনটা আবার কীভাবে আসবে? সে তো মহা সমস্যার ব্যাপার রে বাপ।’

”আরে বোকা, বেকুবরাম, সমস্যা মনে করলেই সমস্যা। সমস্যা বলে সংসারে কিছু আছেরে পাগলা? সমস্যা ছাড়াই তো চাঁদ—সুয্যি উঠছে, ফুল ফুটছে, পাখি ডাকছে, বিয়েবাড়িতে লোক পাতপেড়ে কবজি ডুবিয়ে খাচ্ছে, এঁদো গাঁয়ের নাম হয়ে যাচ্ছে রাজনগর—আরে ব্যাটা, সংসারে সমস্যা বলতে কিচ্ছুটি নেই। ওসব তোদের মনের ভুল। যাকে বলে বিভ্রম। হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ।’ হেসে উঠল অদৃশ্য কণ্ঠ।

এসব কথা মানে কী! এ তো কথা নয়, দার্শনিকের উক্তি। সাধুসন্তের মুখনিঃসৃত বাণী। এমন উদ্ভট, সৃষ্টিছাড়া কথা তো আগে কখনো ভূতনাথ শোনেননি। সমস্যার ঠেলায় মানুষ চোখে সর্ষে ফুল দেখছে, গলা পর্যন্ত ডুবে আছে, আর এই হাড়—বদমাশটা বলছে কিনা সমস্যা নেই। বাণী বিলোতে এসে ব্যাটা। দাঁত কিড়মিড় করতে লাগলেন ভূতনাথ। তাঁর সারা গায়ে জ্বলুনি। হাঁ করে তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে অদৃশ্যকণ্ঠকে খুঁজতে লাগলেন।

খোলা হাঁয়ের ওপর হঠাৎ কেউ যেন একটা মৃদু থাবড়া মেরে বলল, ‘আবার বলছি সমস্যা বলে কিছু নেই। গাছের সঙ্গে মাছের মিল দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়। এই ধর—’ অদৃশ্যকণ্ঠ একটু খুক খুক করে কেশে নিল। তারপর বলল, ‘দৃশ্যটা দেখে হাঁ হয়ে গেল পুঁটি মৌরলা মাছ।’

বাঃ বাঃ।

‘দৃশ্যটা দেখে হাঁ হয়ে গেল পুঁটি মোরলা মাছ’। ভাবা যায় না। অপূর্ব, অপূর্ব! এ লোকটা নির্ঘাত কবি। সত্যেন দত্তের চেয়েও ভালো পদ্য লেখে। অহঙ্কারে আকাশের চাঁদ ভাবছে নিজেকে। ধরা দিচ্ছে না।

কবিতার লাইনটা আরেকবার বিড়বিড় করে আওড়ালেন ভূতনাথ। সত্যিই অসাধারণ। কোনো সাধারণ লোকের পক্ষে এরকম অসাধারণ লাইন লেখা কোনোমতেই সম্ভব নয়। আহ্লাদে আঠারোখানা হয়ে গেলেন ভূতনাথ। মেহনত ছাড়াই কবিতা। তাও আবার উড়ে আসছে আকাশ থেকে। কবিতা লেখার সত্যিই আর কোনো সমস্যা নেই। ঠিকই বলেছে লোকটা। জাত কবি, তাই ওরকম বলতে পেরেছে। আনন্দে আত্মহারা ভূতনাথ গগন বিদীর্ণ করে চেঁচিয়ে উঠলেন:

আকাশের নীচে সাদা হয়ে আছে

রসগোল্লার গাছ,

দৃশ্যটা দেখে হাঁ হয়ে গেল

পুঁটি মৌরলা মাছ!

ব্যস এবার একটার পর একটা লাইন একটু জুত করে বসিয়ে দিতে পারলেই হল। পুরো ব্যাপারটা জমে দই হয়ে যাবে। দুটো লাইন যখন হাওয়ায় উড়ে এসেছে, বাকি লাইনগুলো আর আসতে কতক্ষণ!

কবিতায় যেন ডুবে গেছেন ভূতনাথ। এত ছন্দ আর মিল আগে আর কখনো দেখেননি। জীবনে তো কম কবিতা পড়েননি তিনি, কিন্তু ভাবে ভাষায় সমৃদ্ধ, রসে পূর্ণ এরকম সহজ সুন্দর কবিতা তাঁর চোখে পড়েনি।

ভূতনাথ তন্ময় হয়ে ভাবলেন, এবার তিনি রসগোল্লার গাছে বোঁদে আর জিলিপির অগুন্তি ফুল ফোটাবেন। পদ্য কাকে বলে বাংলা বিহার ওড়িশার ডাকসাইটে কবিদের তিনি দেখিয়ে ছাড়বেন। আর এক লাইনও গদ্য নয়, এখন থেকে তিনি বাজারে শুধু পদ্যই ছাড়তে থাকবেন। অঢেল পদ্য। শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে পদ্য।

এইসব সাতসতেরো ভাবতে ভাবতে বাড়িমুখো হচ্ছিলেন ভূতনাথ ভট্টশালী। সবে দু—চার পা এগিয়েছেন তিনি, চারদিকে একটা গরম হাওয়া বয়ে গেল। বহু লোক যেন হাসি—কান্না মেশানো গলায় নানারকম কথা বলছে, গান গাইছে, ভাষণ দিচ্ছে, আবৃত্তি করছে, আকাশের গায়ে দমাদ্দম ঘুষি মারছে। ব্যাপারটা ঠিক কী, বুঝে ওঠবার আগেই কেউ যেন একটা বাঁকানো লাঠি দিয়ে ভূতনাথের গলাটা টেনে ধরল। তারপর ভূতনাথের পেটে একটা পেনসিলের খোঁচা দিয়ে বলল, ‘খবরদার, গাছপালা নিয়ে বেশি মশকরা করতে যেয়ো না। রসগোল্লার গাছে পান্তুয়ার ফুল ফোটাতে পারো। বোঁদে—জিলিপির মতো বাজে ফালতু আকাট ফুল ফুটিয়ো না বাপধন। ঠকবে, খুব ঠকবে।’

মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল ভূতনাথবাবুর। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। গলায় কথা আটকে গেল।

‘ও কী! ও কী! খেতে খেতে ওরকম পাগলের মতো হাসছ কেন?’ গিরিবালা আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘বিষম খাবে যে।’

মন্মথর হাসি তবু থামে না। উৎকট হাসি। হেসেই চলেছেন। হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল, মুখ থেকে খাবার ছিটকে গেল, মন্মথর সেদিকে দৃকপাত নেই।

‘তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি? বয়স হয়েছে, খেয়াল আছে? এক্ষুনি একটা অঘটন ঘটবে।’

‘নতুন করে আর কী অঘটন ঘটবে!’ মন্মথ আগের মতোই হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন, ‘এইমাত্র তো একটা অঘটন ঘটিয়ে এলাম।’

‘অঘটন!’ গিরিবালা চোখ কপালে তুললেন।

‘অঘটন কথার মানে বোঝো না?’ খেঁকিয়ে উঠলেন মন্মথ। ‘ডিকশনারি দেখে নাও।’

‘কী অঘটন ঘটিয়ে এলে তুমি! কোথায় ঘটিয়ে এলে? বুড়ো বয়সে কী যে সব হেঁয়ালি করো, বুঝি না বাপু।’ গিরিবালা যেন একটু উদবিগ্ন হয়ে উঠলেন। তারপর স্বামীর পাতে ঠক করে মস্ত একটা মাছের মুড়ো ফেলে দিয়ে বললেন, ‘একটু ঝেড়ে কাশো তো এবার। তোমার কথার ল্যাজা—মুড়ো কিছুই তো ধরতে পারছি না।”

মন্মথ প্রকাণ্ড হাঁ করে মাছের মুড়োটা মুখে ঢুকিয়ে নিলেন। তারপর বেশ আয়েস করে মুড়ো চিবোতে চিবোতে বললেন, ‘নাড়াজোলের কথা মনে আছে তোমার?’

‘হঠাৎ এই রাতদুপুরে নাড়াজোলের কথা কেন?’ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন গিরিবালা।

‘আহা রাগ করছ কেন! বলি মনে আছে কিনা বলো না।’ মন্মথ নরম গলায় বললেন।

‘থাকবে না কেন? বাপের বাড়ির কথা লোকে ভুলে যায় নাকি?’ গিরিবালার ছানিপড়া ঝাপসা চোখে যেন আলো ঠিকরে উঠল, ‘রামনবমীর রথের মেলায় কম জিলিপি আর পাঁপড় খেয়েছি? হ্যাঁগো, রাজবাড়িটা আছে তো এখনও?’

মন্মথ হেসে ফেললেন, ‘থাকবে না কেন? সব আছে। একটু এদিক—ওদিক হয়েছে—এই যা।’

শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন গিরিবালা। আনন্দের অশ্রু ঝরছে তাঁর চোখে। ‘কালসাফার মাঠটার কথা ভাবলেই বুক ঢিবঢিব করে। মাঠের মাঝখানে তালপুকুর। পুকুরের চারপাশে অগুন্তি তালগাছ। কালসাফার মাঠ পেরিয়ে আমরা ভাইবোনেরা গোরুর গাড়ি করে কেশপুর আমডুবি যেতাম। উঃ মাঠ বলে মাঠ! জনমানুষ নেই। সন্ধে হলেই ভূত—প্রেত ডাকত। জ্যোৎস্না রাত্রে আর এক দৃশ্য। ডাইনি চরে বেড়াচ্ছে মাঠে। অমাবস্যার অন্ধকারে মশাল জ্বলত। অর্জুন ডাকাতের গলা নয়, যেন বাজ পড়ার শব্দ।’

মন্মথর হাত থেকে ঠক করে জলের গেলাসটা থালায় পড়ে গেল। হুঙ্কার ছাড়লেন মন্মথ, ‘অত ফিরিস্তি তোমার কাছে কে চেয়েছে গিরি? জানতে চাইলাম নাড়াজোলের কথা মনে আছে কিনা, ব্যস শুরু হয়ে গেল অষ্টাদশ পর্ব মহাভারত। আমি অত বৃত্তান্ত শুনতে চাইনি।’

গিরিবালা স্বামীর ধমক খেয়ে চুপ করে গেলেন। নাড়াজোল বললেই অনেক কথা মনে পড়ে যায় যে। কী করবেন গিরিবালা? বাড়ির পেছন দিকে ছোটো পুকুরের কাছে ন্যাড়া বেলগাছটার কথা বেশি করে মনে পড়ছিল। বেলগাছটাকে সাপের মতো পাক দিয়ে উঠেছিল একটা রোগা অশ্বত্থ গাছ। রাত বারোটার পর বেলগাছ আর বেলগাছে নেই। দুধের মতো ধপধপে একটা কাপড় সাঁই সাঁই করে উড়ে যেত অনেক উঁচু দিয়ে, প্রায় আকাশের গা ঘেঁষে। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভেঙে পড়েছে আকাশ। আর সেই কাপড় ধরার জন্য কত রকম মূর্তি যে ভিড় জমাত বেলতলায় তার হিসেব নেই।

ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে যাচ্ছিলেন গিরিবালা। হঠাৎ সংবিত ফিলে পেলেন মন্মথর ডাকে। ‘নাড়াজোলের পাশের গ্রামটাই তো রাজনগর?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাতে হয়েছে কী?’ গিরিবালার গলার স্বর একটু রুষ্ট শোনাল, ‘তখন থেকে হেঁয়ালিই করে চলেছ। বুড়ো বয়সে এই সব আদেখলাপনা ভালো লাগে না বাপু।’

‘রাজনগরের শিবনাথকে মনে আছে তোমার? শিবনাথ গো শিবনাথ, যে এখন নাম পালটে ভূতনাথ হয়েছে।’

‘শিবনাথ!’ যেন আকাশ থেকে পড়লেন গিরিবালা, ‘কে শিবনাথ?’

‘আরে সেই যে গল্পটল্প লিখত! আমার ‘মশগুল’ পত্রিকায় কম গল্প লিখেছে নাকি! একবার পুজোর সময় ছেলেবউকে নিয়ে আমাদের বাড়ি থেকে গেল তিনদিন। ও অবশ্য এখন আর শিবনাথ নয়, ভূতনাথ ভট্টশালী। মনে পড়ছে না তোমার?’

গিরিবালার মুখ হাসিতে ভরে গেল, ‘ও, তুমি শিবনাথ আচার্যের কথা বলছ? খেতে ভালোবাসতেন খুব। শাকপাতা যা দিয়েছি রান্না করে, সোনামুখ করে সব খেয়েছেন ভদ্রলোক। খাওয়া নিয়ে তোমার মতো খিটিমিটি করতে কাউকে দেখিনি।’

‘আবার উলটোপালটা কথা। বলছি শিবনাথের লেখার কথা আর তুমি চলে গেলে তার খাওয়া—দাওয়ায়। তার লেখালিখিটা গৌণ হয়ে গেল। সত্যিই তুমি একটা অদ্ভুত।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভারী ভালো লিখতেন ভদ্রলোক।’ মন্মথর রাগে জল ঢেলে দিয়ে গিরিবালা বললেন, ‘ওঁর ‘কবন্ধের বন্ধ ঘরে’ বইটার কথা কোনোদিন ভুলতে পারব না। কতবার যে পড়েছি বইটা।’

মন্মথ এবার বেশ গর্বভরে বললেন, ‘ওটা কিন্তু আমিই বার করেছিলাম। শিবনাথ রাইটার, নিশিকান্ত প্রিন্টার, মন্মথ পাবলিশার—যাকে বলে থ্রি মাস্কেটিয়ার্স। হাঃ হাঃ।’

মন্মথর সেই গর্বের কথায় কান না দিয়ে গিরিবালা বললেন, ‘আর ‘আঁতিপাতি কত হাতি’ বইটার কথা ভাবো। অতটুকু পুঁচকে একটা হাতি বনবাদাড় পেরিয়ে ঢুকে পড়ল লোকালয়ে। অনিল মুদির রসগোল্লার কড়াইয়ে পা ডুবিয়ে কী অনাসৃষ্টিই না করল।’

‘অ্যাই, এতক্ষণে ঠিক ধরেছ। ওই রসগোল্লা নিয়েই তো যত বিভ্রাট। ব্যাটা শিবনাথের মগজে এমন রসগোল্লার প্যাঁচ চরিয়ে দিয়েছি যে এবার বুঝবে ঠ্যালা।’ ঘরের ছাদ ফাটিয়ে হো হা করে হেসে উঠলেন মন্মথ। মুহূর্তেই সেই হাসি থেমে গেল। গম্ভীর হয়ে গেলেন মন্মথ।

গিরিবালা বললেন, ‘কী হল তোমার? চুপ করে গেলে কেন?’

মন্মথ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘ব্যাটা শয়তান, আগাম টাকা নিয়েছিল আমার কাছে।’

‘টাকা!’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, টাকা।’ মন্মথ দাঁত খিঁচিয়ে উঠলেন, ‘করকরে পাঁচ—পাঁচশো টাকা। কী, না, পুজো সংখ্যায় উপন্যাস দেবে। তাগাদা দিতে দিতে আমার জিভ বেরিয়ে গেল। শিবনাথের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। উপন্যাসের ‘উ’—ও পাইনি, টাকাটাও ফেরত দেয়নি। মাথার ঘাম পায়ে ফেলা অতগুলো টাকা জলে গেল আমার।’

গিরিবালা কপালে মৃদু করাঘাত করে বললেন, ‘সর্বনাশের মাথায় বাড়ি। কই, আগে তো কখনো বলোনি এসব?’

‘লাভ কী ওসব পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে?’ নিজের গালে একটা থাবড়া মেরে মন্মথ বললেন, ‘তা ছাড়া তোমাকে বললে লাভই বা কী হত? উপন্যাসটা পেয়ে যেতাম? টাকাগুলো উড়ে আসত আমার কাছে?’ হঠাৎ মুহূর্তে গম্ভীর ভাবটা উধাও হয়ে গেল। উদ্ভাসিত মুখে মন্মথ বললেন, ‘উপন্যাস না দিক, শিবনাথ উপন্যাসের নামটা কিন্তু দিয়েছিল ফাটাফাটি।’

‘কী নাম দিয়েছিল শুনি?’ ব্যগ্র হয়ে উঠলেন গিরিবালা।

‘বললাম তো নামটা ব্যাটা দিয়েছিল একেবারে যাকে বলে ফাটাফাটি। রসগোল্লার গাছ। সত্যি, এ নামের কোনো তুলনা নেই। আরে বাবা, এরকম নাম দেওয়া যার—তার কম্ম নয়। এরজন্য আলাদা প্রতিভা চাই। শিবনাথের এই প্রতিভাটা কিন্তু ছিল—চোখে—মুখে আলাদা একটা বিভা খেলা করত। সেই বিভা যখন বিকীর্ণ হত, তখন শিবনাথ দুমদাম করে লিখে ফেলত দুর্দান্ত সব গপ্প—উপন্যাস।’

গিরিবালা মুচকি হেসে বললেন, ‘কী বললে যেন নামটা? রসগোল্লার গাছ? হয় নাকি এরকম? রসগোল্লা কি গাছে ফলে?’

মন্মথ শূন্য ভাতের থালায় একটা ঘুষি মেরে বললেন, ‘হয় হয়, বিদর্ভে হয়, উজ্জয়িনীতে হয়, প্রাগজ্যোতিষপুরে হয়, গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে হয়। ওসব জায়গায় তোমার বিশেষ ঘোরাটোরা নেই। জানবে কী করে? তা আজ ব্যাটাকে বাগে পেয়ে এই নামটাই ওর ঘিলুতে ঢুকিয়ে দিয়েছি। এবার বোঝো কত ধানে কত চাল। রসগোল্লার গাছ খুঁজতে আবার রাজনগর পালাবে।’

গিরিবালা স্বামীর এইসব আবোল—তাবোল কথার কোনো মানে খুঁজে পেলেন না। অতি সরল মনের আলাভোলা মানুষ শিবনাথবাবু। কারও কোনো সাতে—পাঁচে থাকেন না। তাঁকে অযথা ওইরকম একটা প্যাঁচে ফেলার কোনো মানে হয়? কাজটা মোটেই ভালো করেননি মন্মথ। গিরিবালার মুখটা কেমন যেন পালটে গেল। ভেতরে ভেতরে তিনি বেশ অস্বস্তি বোধ করছেন। মন্মথকে আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করতেও সাহস হল না তাঁর।

রাত হয়েছে। অন্ধকারেই চারদিকে ঘুটঘুট করছে। চারপাশে কিলবিল করছে অজস্র জোনাকি। একেকটা যেন চাঁদের ভাঙা টুকরো। দপদপ করে জ্বলছে আর নিভছে। মেঘের একটা প্রকাণ্ড চাঁই ভাসতে ভাসতে ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতর। মন্মথ উঠে গিয়ে ধাঁ করে মেঘটাকে ধরে ফেললেন। তারপর মেঘটাকে নিয়ে প্রথমে খানিকক্ষণ লোফালুফি করলেন। তারপর সেটাকে টুক করে বগলদাবা করে ফেললেন।

এতক্ষণ গিরিবালা মন্মথর বকবকানি শুনছিলেন। পাগলামি দেখছিলেন। এখন তাঁর মাথা ঝিমঝিম করছে। চোখ দুটোয় মনে হয় কাঁকর পড়েছে—বেশ কটকট করছে। জানলা দিয়ে ফস করে রোগা, লম্বা, সুঁটকো একটা হাত বাড়িয়ে গাজরের মতো বড়ো বড়ো কুড়িটা কাঁচালঙ্কা তুলে আনলেন, আর ফুটবলের মতো একটা গন্ধলেবু। লম্ফের শিখা একটু উসকে দিলেন। মশালের মতো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। খুব খিদে পেয়েছে। এবার খেতে বসবেন গিরিবালা।

বাপস, এ তো মাঠ নয়, রূপকথার গল্পে পড়া তেপান্তর। যতদূর চোখ যায় ধু ধু করছে চারদিক। কোথাও কোনো বাড়িঘর নেই। হাঁটতে হাঁটতে পা ফুলে কলাগাছ হয়ে গেল। তা হোক। এত বড়ো একটা মাঠে একা একা বেড়াবার মজাই আলাদা। বেশ অ্যাডভেঞ্চার—অ্যাডভেঞ্চার গন্ধ পাওয়া যায়।

ভূতের গল্প লিখে নাম করলে কী হবে, ভূতনাথ আসলে ভিতু মানুষ। অচেনা জায়গায় কখনো একা একা যাননি। নির্জন জায়গার কথা শুনলেই সিঁটিয়ে যান। এ নিয়ে কি লোকে তাঁকে কম ঠাট্টা করে?

অন্ধকারে, নির্জন রাস্তায় টর্চের আলো ছাড়া চলতেই পারতেন না। ভূতের ভয় যেমন আছে, তেমনই আছে তাঁর চোরের ভয়ও। সাপকে যেমন ভয় পেতেন ভূতনাথ, তেমনই ভয় পেতেন বিছে, গিরগিটি কিংবা মাকড়সাকে। কিন্তু এখন এই প্রকাণ্ড মাঠটায় একা একা তাঁর ঘুরে বেড়াতে একটুও ভয় করছে না। এখানে চোর—ছ্যাঁচ্চোড় আসবে কোত্থেকে। সাপ—খোপ থাকলেও তারা বড্ড কমজোরি, বেশি ট্যাঁ—ফোঁ করে না। আসলে আছে গায়ে ছ্যাঁকা লাগানো গরম হাওয়া আর দমকা বাতাস। আর আছে কুজঝটিকা। কিন্তু তাদের ভয় কী! তারা তো অট্টালিকার মাথায় গ্যাঁট হয়ে বসে থাকে। নাগালের মধ্যে যাদের পায় তাদের সহজে ছাড়ে না। ঘোল খাইয়ে দেয়।

এসব ভেবেই মাঠের একদিকে নির্ভয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিলেন ভূতনাথ। এই সময় ঘোরাঘুরি করাটা শরীর—স্বাস্থ্যের পক্ষেও ভালো। ঘুরতে ঘুরতে মনটাও বেশ তাজা আর ঝরঝরে হয়ে যায়। অন্য কোনো বিষয়ের কথা খেয়াল থাকে না।

হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই তিন ছায়ামূর্তির আবির্ভাব। গুটি গুটি পায়ে তারা এগিয়ে এল ভূতনাথের দিকে।

ভূতনাথ সাহস করে কিছু বলবার আগেই যেন চারদিকে ঝনঝন করে একটা কাঁসি বেজে উঠল, ‘নতুন দেঁশে বেঁড়াতে এঁয়েচ বুঝি? তাঁ বেঁশ। ভাঁলো কঁরে ঘুঁরে ফিঁরে দ্যাঁখো। কঁত যে দেঁখবাঁর আঁছে এঁখানে।’

আরেকজন চিঁচিঁ করে বলল, ‘আমি তোঁর মাঁসি হঁই রেঁ বাঁপ। বঁয়স হঁয়েছে তোঁ! তাঁই বোঁধহয় চিঁনতে পাঁরছিস না। দ্যাঁখ দিঁকি, চিঁনতে পাঁরিস কিঁ না?’

অন্যজন খ্যাসখ্যাসে গলায় ফোড়ন কাটল, ‘চিঁনবে কী কঁরে? তুঁই যঁখন এখাঁনে এঁলি, সে কী আঁজকের কঁথা? তোঁর বোঁনপোঁ তঁখন কঁত ছোঁটো। ওঁর কী আঁর ওঁসব মঁনে আঁছে রেঁ?’

কথা বলতে বলতে তিন ছায়ামূর্তি ভূতনাথকে ঘিরে ফেলল। ভূতনাথের গলা জড়িয়ে এল। অসহায়ভাবে আমতা আমতা করতে লাগলেন, ‘না, মানে, আমি তো আপনাদের কাউকেই চিনতে পারছি না। আগে কখনো দেখেছি বলেও মনে পড়ে না। আপনারা থাকেন কোথায়?’

তিন ছায়ামূর্তি সমস্বরে হেসে উঠল। একজন আরেকজনকে বলল, ‘দ্যাঁখ বেঁকুবটার কাঁণ্ড। আঁমাদের নিবাঁস জাঁনতে চাঁইছে।’

‘নিবাঁস? বেঁশিদূর নঁয় বাঁপ, এঁই কাঁছেই। ধ্যাঁদ্ধেড়েঁ গোঁবিন্দপুর। যেঁতে খঁরচ পঁড়ে সাঁকুল্যে সঁতেরো টাঁকা সাঁইতিরিশ পঁয়সা।’

আরেক ছায়ামূর্তি বিশ্রী খনখনে গলায় যেন আর্তনাদ করে উঠল, ‘মাঁয়ের বোঁন মাঁসিকে চিনতে পাঁরছিস না হঁতচ্ছাড়া? বঁলি তোঁর চোঁখে কি চাঁলসে পঁড়েছে? তোঁর মাঁ মঁরার পঁর তোঁকে কোঁলেপিঁঠে কঁরে আঁমিই তোঁ মাঁনুষ কঁরেছি। এঁকটুও কি মঁনে পঁড়ে না রেঁ হঁতভাগা?’ ছায়ামূর্তি যেন আর্তনাদ করে উঠল—’তোঁরা এঁত অ্যাঁকৃতজ্ঞ রেঁ শিঁবু! নিঁজের লোঁককে ভুঁলে যাঁস? মাঁয়ের বোঁন মাঁসিকে চিঁনতে পাঁরিস নাঁ, নঁরাধম?’

মাসি! বিদেশ—বিভুঁইয়েও তা হলে আত্মীয়স্বজন থাকে মানুষের! এইজন্যেই কি কবি লিখেছেন ‘দেশে দেশে মোর ঘর আছে…’। আবেগ এসে গেল ভূতনাথের। চোখের এক কোণে আনন্দের অশ্রু ফুটে উঠল। ভূতনাথ মাথা নিচু করে মাসিকে প্রণাম করার জন্য হাত বাড়ালেন, ‘কিছু মনে কোরো না মাসি। কবে ছোটোবেলায় তোমাকে দেখেছি, সে কথা কি আর মনে আছে! দু—দিন আগের কথাই মানুষে মনে রাখতে পারে না। ক্ষমা—ঘেন্না করে দাও মাসি।’

কিন্তু এ কী! তাজ্জব কাণ্ড!

মাসির পা কই!

এ তো তিনটে কাঁটা কুলের গাছ। ভূতনাথের হাতের বুড়ো আঙুলে প্যাট করে একটা কাঁটা ফুটে গেল। চোখের নিমেষে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল তিন ছায়ামূর্তি। মাসি বলে এতক্ষণ যে নিজের পরিচয় দিচ্ছিল, সে কি সত্যি মাসি? নাকি প্রহেলিকা? মনের ভুল?

বুকটা ঢিপঢিপ করে উঠল শিবনাথের। কিন্তু সামলে নিলেন নিজেকে। না, না, বিদেশ—বিভুঁইয়ে অত দুর্বল হলে চলে না। ভয় আরও চেপে ধরে। বাবা বলতেন, ভয় করলেই ভয়, নইলে কিছুই নয়।

মাঠের মাঝ—বরাবর আবার হাঁটতে লাগলেন ভূতনাথ। একটু এগোতেই একটা ছোটো জটলা। চার—পাঁচজন বেশ উত্তেজিতভাবে কথা বলছে। কী হল এখানে! মারদাঙ্গা হচ্ছে নাকি? একজন তারস্বরে বলছে, ‘দেখে নেব। দেখে নেব।’

কী দেখে নেবে রে বাবা! একটু ভড়কে গেলেন ভূতনাথ। এইসব মাথাগরম লোকজনের মধ্যে না ঢোকাই ভালো। হিতে বিপরীত হয়ে যাবে।

কান খাড়া করে ভূতনাথ জটলার কথাগুলো ধরবার চেষ্টা করলেন। একজন ঢ্যাঙা মতন লোক গলা ফুলিয়ে বলে উঠল, ‘মন্মথ সমাদ্দারকে মাসের পর মাস কাগজ সাপ্লাই দিয়েছি। কখনো না বলিনি। কভারের কাগজ দিয়েছি। একটা কানাকড়িও পাইনি। কুড়ি রিম কাগজের দাম পাব। কত টাকা পাব ভেবে দেখেছ একবার?’

ঢ্যাঙা লোকটির সঙ্গে মুশকো মতন একটি লোক গলা মেলাল, ‘চারশো একত্রিশ টাকা পঁচাত্তর পয়সা বাকি। বলে বলে মুখ ব্যথা হয়ে গেছে। মন্মথ সমাদ্দার একটি পয়সাও দেয়নি। বিনি পয়সায় মাসের পর মাস পত্রিকা বাঁধাই করে দিয়েছি। ওকে ছেড়ে দেব ভেবেছ?’

মিনমিন করে কথা বলছিল তাগড়াই চেহারার একটা লোক। সে প্রায় লাফিয়ে উঠল, ‘পাগল! ছেড়ে দেবে! এগারোটা কভারের দাম দেয়নি মন্মথ সমাদ্দার।’

একজন চোখ কপালে তুলল, ‘এ—গা—রো—টা! বলো কী?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। বুকের রক্ত জল করে এক একটা কভার আঁকতাম। কী ডেঞ্জারাস লোকরে বাবা! একটা পয়সাও পেলাম না। ব্যাটা নচ্ছার।’

হঠাৎ ঝাঁকড়া—চুলো, দানবের মতো দেখতে একটা লোক কোত্থেকে যেন উদয় হল। গগন বিদীর্ণ করে সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে, সকলেই তো পাবে, কিন্তু দেবে কোত্থেকে লোকটা? বইয়ের ব্যবসা তো লাটে উঠেছে। আমার কাছ থেকেই কয়েক হাজার টাকা ধার নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল। আসল পয়সা দূর অস্ত, একটা পয়সা সুদও পাইনি।’

‘তা হলে উপায়?’ সমস্বরে সকলে বলে উঠল।

‘উপায় একটা আছে বইকি।’

‘কী উপায়? কী উপায়?’

ঝাঁকড়া—চুলো, দৈত্য—সদৃশ লোকটি বলল, ‘মন্মথ সমাদ্দারের পুরো বাগান—বাড়িটাই আমি দখল করে রেখেছি।’

‘অ্যাঁ!’ সকলে হাততালি দিয়ে উঠল।

‘হ্যাঁ। পুরো বাগানবাড়ি। যতদিন না সমস্ত টাকা ফেরত পাচ্ছি, ও বাগান, আমি হাতছাড়া করছি না। আম, জাম আর সবেদার গাছে বাগান ভরতি। টক খেতে চাও? তাও আছে। টোপাকুল আর তেঁতুলের গাছেরও কমতি নেই। তেতো দরকার। ঘোড়ানিম, মহানিম আর চুটকি নিমের গাছে চারদিক থিক থিক করছে। সারাদিন বাগানে ঢুঁড়ে বেড়াও, পেট ভরে ফলপাকুড় খাও, ছেঁড়ো, ফেল, ছড়াও, পুঁটলি ভরে বাড়ি নিয়ে যাও—খবরদারি করার কেউ নেই। আতা গাছে আতাও আছে। খুঁজলে তোতাও পাবে। হেঁ হেঁ হেঁ।’

পালাবে কোথায় বাছাধন! এতগুলো লোককে তুমি দিনের পর দিন ফাঁকি দিয়েছ। এবার সম্পাদক বলে কেউ তোমাকে ছেড়ে কথা বলবে না। ভূতনাথ মনে মনে বললেন, তুমি অকারণ আমার পেছনে লেগেছ। কত গল্প তুমি ‘মশগুল’ পত্রিকায় ছেপেছ। একটা পয়সাও দাওনি। বই ছেপেছ অতগুলো। কী বিক্রি সেসব বইয়ের। তিনদিনে এডিশন শেষ। শুধু একবারই বিপাকে পড়ে তোমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলাম। লেখাটা সময়মতো দিতে পারিনি বলে এত কাণ্ড। এখানে এসেও শান্তি নেই। পেছনে টিকটিকি লেলিয়ে দিয়েছ। ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছ। ব্যাটা হাড়বজ্জাত। আমিও কম যাই না। তুমি চলো ডালে ডালে, আমি চলি পাতায় পাতায়। তুমি করবে আমাকে জব্দ! হুঁঃ। এবার দ্যাখো মজা কাকে বলে।

ভাবতে ভাবতে বাড়িমুখো হলেন ভূতনাথ ভট্টশালী। আজ আর তাড়াতাড়ি ঘুমোনো নয়। ‘রসগোল্লার গাছ’ উপন্যাসটা শেষ করে ফেলতে হবে। হাটবাজার নেই, পরীক্ষার খাতা দেখা নেই, ছাত্র পড়ানো নেই, সংসারের ফাইফরমাশ, বউয়ের মুখঝামটা নেই। নেই নেই আর নেই। চমৎকার একটা নেই—রাজ্য। এমন নিশ্চিন্ত অবকাশ অন্য কোথাও বড় একটা মেলে না।

আকাশের মাঝখানে, না, ঠিক মাঝখানে নয়, এক কোণে বারকোশের মতো একটা গোল চাঁদ। সবুজ রঙে ঝলমল করছে। বেগনি, নীল আর হলুদ জ্যোৎস্নায় চারদিক ফটফটে। ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছে। ধারে—কাছে নদী নেই, নদী থাকবার কথাও নয়। কিন্তু কোথাও যেন নৌকোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। ছপ ছপ। অনেকটা দূরে একটা ফুলের বাগান। মস্ত মস্ত সাদা ফুলে আলো হয়ে আছে চারদিক। ভারি মিষ্টি গন্ধ। এরকম জ্যোৎস্না রাত্রে কেউ বাড়ি থাকে না, সকলে বনে চলে যায়। কিন্তু এখানে না আছে লোকজন, আর না আছে লোকালয়।

কী ভালোই না লাগছে ভূতনাথের। এরকম জ্যোৎস্না মাখানো মায়াময় রাত্রি বড়ো একটা চোখে পড়ে না। গানের গলা থাকলে এখন প্রাণ খুলে তারস্বরে গান গাইতেন। তন্ময় হয়ে কত কী যে ভাবছিলেন। পাখির কথা, আকাশের কথা, মাটির কথা, পৃথিবীর কথা। ভাবতে ভাবতে তাঁর চোখ যেন আলাদা একটা স্বপ্নের আঠায় জড়িয়ে আসছিল। তিনি বিভোর হয়ে উঠছিলেন।

কিন্তু এই ঘোর কাটতে বেশি সময় লাগল না।

উপন্যাসের কথা মনে পড়তেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন ভূতনাথ। এখন যেভাবেই হোক উপন্যাসটা শেষ করে ফেলতেই হবে। আর ফেলে রাখা যায় না। এই উপন্যাসটাই তাঁকে ঝুড়ি ঝুড়ি খ্যাতি এনে দেবে। লেখা কাকে বলে তিনি দেশের লেখক সমাজকে দেখিয়ে ছাড়বেন।

লিখবেন তো বটে, কিন্তু কাগজ কই! এখন কয়েকখানা কাগজ চাই। যেমন—তেমন কাগজ হলে চলবে না। দুধের মতো ধবধবে সাদা, মসৃণ কাগজ চাই। রুলটানা কাগজে একদম লিখতে পারেন না ভূতনাথ। আর চাই একটা ফাউন্টেন পেন, যাকে বলে ঝরনা কলম। এখনকার বিতিকিচ্ছিরি বল পেন, যাতে কিনা ছেলেছোকরারা পরীক্ষা দেয়, চিঠি লেখে, পদ্য রচনা করে—দু—চক্ষে দেখতে পারেন না ভূতনাথ। একবার এই বল পেনে লিখতে গিয়ে কী ঝামেলাটাই না হল! গল্প প্রায় মাঝপথে এসে গেছে, এমন সময় বিভ্রাট। রিফিল ভরতি—কিন্তু কালি সরছে না। কলম ঘষতে ঘষতে হাত ব্যথা হয়ে গেল ভূতনাথের, মুখ ভোঁতা হয়ে গেল কলমের—কিন্তু কিছুতেই কালি বেরোল না। মেজাজ খিঁচড়ে গেল। উঠে পড়লেন ভূতনাথ। গল্পেরও ইতি এখানেই। তারপর থেকেই ভূতনাথ বল পেন দেখলেই তিরিক্ষি হয়ে ওঠেন। ঝরনা কলমে এসব ঝক্কি নেই। কালি ভরতি থাকলে আর চিন্তা কী! তরতর করে লেখা এগিয়ে যায়। কিন্তু এখন ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরে কোথায় পাওয়া যাবে ঝরনা কলম আর রয়াল ব্লু কালি? কোথায়ই বা মিলবে বাঘমার্কা দুধসাদা কাগজ? অথচ এখন মাথায় ভাবনা গিজগিজ করছে। কত কিছু যে লেখার আছে! অল্প সময়ের মধ্যে এই নতুন জায়গায় অভিজ্ঞতা কি কম হল?

হঠাৎ দেওয়াল—আলমারিটার দিকে নজর যেতেই চমকে উঠলেন ভূতনাথ।

এ কী! ভূত দেখছেন না তো! ভালো করে দু—বার রগড়ে নিলেন।

থরে থরে সব কলম সাজানো।

লাল। কালো। সবুজ। সাদা। হলুদ। বেগনি। বিচিত্র গড়নের সব কলম। দুটো কালির দোয়াত। একটা চিনেমাটির, একটা পেতলের। দুটো দোয়াতের মধ্যেই মস্ত দুটো খাগের কলম ডোবানো। কলমের গা থেকে যেন জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সেই জ্যোতির গায়ে হাত দিলেই যেন হাত ঝলসে যাবে।

একটা তাকে ডাঁই হয়ে আছে দিস্তা দিস্তা কাগজ। দুধের মতো সাদা। একেই বোধহয় দুগ্ধফেননিভ বলে। এ যে মেঘ না চাইতেই জল। ভারি তাজ্জব কাণ্ড। আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেলেন ভূতনাথ। সংসারে এতসব আনন্দের জিনিস। আর কী চাই তাঁর!

দেওয়াল—আলমারির আংটায় ছোট্ট একটা তালা ঝুলছে। হাত দেওয়া মাত্রই ঘচাং করে খুলে গেল। আত্মহারা ভূতনাথ ‘লিখিও যতনে’ নামে একটি কলমে হাত ছোঁয়ানো মাত্র যেন একটা ছ্যাঁকা খেলেন। চমকে এক হাত পিছিয়ে আসতেই কেউ যেন গম্ভীর গলায় বিশুদ্ধ সাধুভাষায় বলে উঠল, ‘এই স্থান অতি পবিত্র; নির্মল এবং রৌদ্রকরোজ্জ্বল। সেই হেতু জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী এই স্থানে অবস্থান করেন। বিনয় এবং ভক্তিপূর্বক নতমস্তকে তাঁহাকে প্রণিপাত কর।’

কাউকে দেখতে পেলেন না ভূতনাথ। কিন্তু কথাগুলি আদেশের মতো। অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। ভূতনাথ কোনো দ্বিরুক্তি করলেন না। লক্ষ্মী ছেলের মতো হাতজোড় করে মাথা নীচু করলেন।

ছেলেবেলায় বাবা তাঁকে একটা মন্ত্র শিখিয়েছিলেন। সরস্বতীর মন্ত্র। মন্ত্রটার সবটুকু আজ আর মনে নেই। কোনো কোনো শব্দ খুব আবছা ভাবে মনে পড়ছে তাঁর। সকালে পড়তে বসবার আগে মন্ত্রটা তিনবার আওড়াতেন ভূতনাথ। পাছে ভুল হয়ে যায়, তাই এখন আর মন্ত্রটা আওড়ালেন না। মনের মধ্যে কেবল একটা কথাই খচ খচ করছে। কারা করছে এইসব পাঁয়তারা? করে কী লাভ? কেনই বা তাঁকে এরকম ভয় দেখাচ্ছে? যারাই করুক, নিশ্চয়ই একটা ফন্দি আঁটছে তারা। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন ভূতনাথ। তাঁর চোখ জ্বালা করছে। মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। কানটা দু—বার ঝাড়া দিলেন ভূতনাথ। কোনো লাভ হল না। দেয়ালে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে দিলেন। মাথাব্যথাটা একটু কমুক। তারপর আবার নতুন উদ্যমে লেগে পড়তে হবে। যেই বাগড়া দিক ভূতনাথ দমে যাবেন না। তিনি একজন ডাকসাইটে লেখক। কত পাঠক তাঁর। কত লোক তাঁকে ভালোবাসে। বই বেরনো মাত্র বিক্রি হয়ে যায়। তিনি ভয় পাবেন কেন? তুচ্ছ ভয়কে জয় করে উপন্যাসটা শেষ করা চাই—ই চাই।

কুরুক্কু কুরুক্কু।

কুর কুর কুরুক্কু।

কুরুক্ক…উ…উ…

অদ্ভুত এবং একটানা শব্দ করে একটা পাখি ডেকেই চলেছে। ভারি ঝলমলে রং সেই পাখির, দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। একটা ফলভরতি গাছের ডালে সরু চিকন অন্তত দেড় হাত লম্বা লেজ ঝুলিয়ে দোল খাচ্ছে পাখিটা। কেউ যেন ফিসফিস করে বলল, ‘এই পাখিটার নাম লোচনদাস। স্বর্গের বাগান থেকে হাওয়া খেতে এসেছে। একে একটু খাতির—যত্ন কোরো। ভারি পয়া এই পাখিটা।’

লোচনদাস!

চোখ কচলে ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন ভূতনাথ। লোচনদাস এখানে এল কোত্থেকে! খুব ছেলেবেলার একটা পাখির কথা মনে পড়ল তাঁর। দাদু এনেছিলেন হিমালয় থেকে। ঠাকুরমার প্রাণ ছিল সেই পাখিটা। ঠাকুমাই তার নাম রেখেছিলেন লোচনদাস। খাঁচার দরজা সারাদিন খোলা থাকত। সে যখন খুশি এখানে—ওখানে উড়ে যেত। আবার সন্ধেবেলা ফিরে আসত খাঁচায়। ভোরবেলা ‘লোচনদাস’ ‘লোচনদাস’ ‘লোচনদাস’ বলে খুব চ্যাঁচাত সেই পাখি। বাড়িসুদ্ধ সকলের ঘুম ভেঙে যেত। একদিন ভোরবেলায় কোনো শব্দ নেই। খাঁচার মধ্যে পড়ে আছে নিথর, নিস্পন্দ লোচনদাস।

এই দৃশ্য দেখে ঠাকুমার সে কী পাগলের মতো হাউ হাউ করে কান্না! দাদু যে লোচনদাসের শোকে পাথর হয়ে গেছেন। মুখে একটি কথা নেই। ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে আছেন। সেই হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলার স্বপ্নের পাখি এখানে আসবে কোত্থেকে! না না, এ তাঁর কানের ভুল। শোনায় কোনো বিভ্রম হয়েছে।

আরেকবার চোখ কচলে ‘কুরুক্কু’—ডাকা পাখিটাকে দেখার চেষ্টা করলেন ভূতনাথ। না, পাখিটা নেই। মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া। কোথায় গেল পাখিটা? একেই কি পাখির ফাঁকি বলে নাকি?

জানলা দিয়ে আকাশে মুখ বাড়ালেন ভূতনাথ। ভোর হয়ে গেল কি? না, এখনও রাত্রি আছে। তারায় তারায় বিশাল আকাশটা ভরতি হয়ে আছে। বারকোশের মতো গোল চাঁদটা সরসর করে একবার নীচে নেমে আসছে, আবার হুস করে ওপরে উঠে যাচ্ছে। সেঁটে বসে যাচ্ছে আকাশের মাঝখানে। আকাশের একটা দিক একটু ছায়া—ছায়া তো। সেখানে সাতটা লোক যেন জড়াজড়ি করে ধ্যানে বসেছে। মুখভরতি লম্বা দাড়ি। হাতের সামনে খড়ম, চিমটে আর কমণ্ডলু। তাদের চোখে—মুখে বেশ সন্ন্যাসী—সন্ন্যাসী ভাব। গোল হয়ে বসে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে শলাপরামর্শ করছে। এতদূর থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তাদের।

জীবনে অনেক সাধু—সন্ন্যাসী দেখেছেন ভূতনাথ। কিন্তু এরকম বিচিত্র সাধু—সন্ন্যাসী আগে কখনো দেখেননি। চোখের পলক পড়ছিল না। তন্ময় হয়ে তাদের দেখছিলেন। হঠাৎ একটা গমগমে গলা শুনে তন্ময়তা ভেঙে গেল, ‘উপসংহারটুকু লিখে ফেললেই তোমার ছুটি।’

উপসংহার! এ আবার কী! কোনো সাংকেতিক শব্দ নাকি? নাকি কোনো গোয়েন্দা গল্পের সূত্র? কার কাছে গেলে এইসব কথার মানে জানা যাবে? ধারে—কাছে তো একজনও চেনামুখ নেই, কাকে জিজ্ঞেস করবেন এইসব কথার মানে? কিংবা কাউকে একটা ডিকশনারি দিতে বলবেন কয়েক ঘণ্টার জন্য!

এইরকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই একটা শব্দ।

ধুপ।

কোনো উঁচু জায়গা থেকে বেড়াল লাফিয়ে পড়ল নাকি ঘরের ভেতর? হ্যাঁ, বেড়ালের মতোই মোটাসোটা, হৃষ্টপুষ্ট দুধসাদা কাগজের একটা বান্ডিল। উড়তে উড়তে এসে পড়ল মেঝের ওপর। একেবারে তাঁর পায়ের কাছে।

শশব্যস্ত হয়ে ভূতনাথ খুলে ফেললেন বান্ডিলের লাল সুতো।

কিন্তু এ কী!

অভূতপূর্ব!

অদৃষ্টপূর্ব!

অশ্রুতপূর্ব!

মুক্তো মতো হাতের লেখায় পাতার পর পাতা নানা বিচিত্র কাহিনি। রাজনগর, নাড়াজোল, মন্মথ সমাদ্দার, মাখনদাদু, ধীরেন ভৌমিক, ভন্টুলাল, অর্জুন সেনের মুদির দোকান, গোবিন্দ ময়রার মুগের জিলিপি, গোপাল দণ্ডপাটের ডাক্তারখানা—কী নেই সেখানে! তিরিতিরি করে বয়ে চলেছে কঙ্কাবতী। এই জায়গাটা পড়তে পড়তে বিহ্বল হয়ে উঠলেন ভূতনাথ। ছোটো ছোটো ঢেউ এসে যেন গায়ে আছড়ে পড়ছে। নদীর বুকে ভেসে চলেছে ডিঙি নৌকো। লগি ঠেলে ঠেলে একটা সাইকেল আর কয়েক ঝুড়ি মাটির হাঁড়ি পার করছে নিরাপদ মাঝি। টিমটিম করে লণ্ঠন জ্বলছে। নদী যেন আশ্চর্য আর মোহময়।

ভূতনাথ পড়তে পড়তে বিভোর হয়ে গেলেন। মস্ত লেখক। দারুণ লেখা। কী ভাষা! বলার কী চমৎকার ভঙ্গি! বর্ণনা যে কঙ্কাবতী নদীর মতো। উচ্ছল। অবাধ। ইস, আমি যদি পারতাম এরকম লিখতে! চুক চুক শব্দ করলেন ভূতনাথ। কে তাঁকে লিখে দিলেন এরকম লেখা! তাঁর অসমাপ্ত কাজ কে এভাবে শেষ করে দিয়ে তাঁকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচালেন! এরকম বন্ধু কি চট করে মানুষ পায়? ইনি তো কেবল বন্ধু নন, হিতৈষীও।

একা পরিচ্ছদে এসে স্থির হয়ে গেল ভূনাথের চোখ। তিনি যেন বড়ো ধাক্কা খেলেন। সেই ছেলেবেলার লোচনদাস পাখির কথা সুন্দরভাবে অদৃশ্য—লেখক লিখেছেন। পাখিটার বর্ণনা বড়ো জীবন্ত। ভোরবেলায় তার ঘুমভাঙানিয়া ডাকটার কথাও নিখুঁতভাবে বলা হয়েছে। এও কি সম্ভব? ঠাকুমা পাখিটাকে যেভাবে খাওয়াতেন, আদরযত্ন করতেন, গায়ে হাত বোলাতেন—সব, সব লেখায় ছবি হয়ে ফুটে উঠেছে।

ভূতনাথ হাতে যেন স্বর্গ পেলেন। আর তাঁকে কষ্ট করতে হবে না। পরিশ্রম করতে হবে না। বিনা আয়াসেই হাতের মুঠোয় সম্পূর্ণ উপন্যাস ‘রসগোল্লার গাছ’। এবার বাজারে রীতিমতো হইচই ফেলতে হবে। আগে বইটা বেরোক।

হাতে যেন একটা সব পেয়েছির দেশ পেয়েছেন ভূতনাথ। এখন তাঁকে খুব নিশ্চিন্ত মনে হচ্ছে। তাঁর ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির অপূর্ব হাসি। আনন্দে তাঁর চোখ বুজে এল।

রেডিয়ো খুলে দিয়ে চুপচাপ রয়েছিলেন সুলোচনা। সুন্দর, মিষ্টি সুরের গান বাজছে। বোধহয় পুরোনো দিনের। গানের কথাগুলোও ভারি চমৎকার। শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে গিয়েছিলেন। এদিকে হাঁড়িতে ভাত ফুটতে ফুটতে কখন যে গলে পাঁক হয়ে গেছে সে খেয়ালই নেই তাঁর। ভাতের ফ্যান পড়ে কাঠের উনুনও নিবে গেছে অনেকক্ষণ। যাঃ, আজ দুপুরের খাওয়াটাই মাটি হয়ে গেল। রেডিয়ো বন্ধ করে ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়লেন সুলোচনা।

কারা যেন দাঁড়িয়ে ছিল রান্নাঘরের জানলার কাছে। সুলোচনাকে দেখেই ঝট করে সরে গেল। চোর—টোর নাকি! দিনের বেলা কেউ চুরি করতে আসে নাকি! কয়েকটা পুরোনো হাতা—খুন্তি, বাটি—গেলাস, কয়েকটা ভাঙা পুরোনো কাঁসার থালা আর শিল—নোড়া ছাড়া রান্নাঘরে আর আছেটা কী। নাকি কোনো ভিখারি—টিকারি সুযোগ খুঁজছিল! যে—ই আসুক সাহ তো কম নয়। জানলার সামনেই ছিল ঠোঙাভরতি ভেলিগুড় আর গুঁড়ো দুধের শিশি। সেগুলো তাড়াতাড়ি সরিয়ে ফেললেন সুলোচনা। জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালেন। কাউকে দেখতে পেলেন না। শুকনো পাতার উপর একটা কুকুর শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে এদিক—ওদিক করছে। তারই খড়খড় শব্দ।

চোর, ভিখিরি, মতলববাজ—যেই হোক না কেন, অত সহজে কাউকে ভয় পান না সুলোচনা। ‘ভয় করলেই ভয়, নইলে কিছুই নয়’—অন্তত হাজারবার শোনা পদ্যটা এই মুহূর্তে মনে পড়ে গেল তাঁর। পাশেই কুঞ্জ সিদ্ধান্তের বাড়ি, ওদিকে ধীরেন লাহার মুদি দোকান, একটু দূরেই আঢ্যদের পুকুরে জাল ফেলছে লক্ষ্মণ জেলে, এপাশে সামন্তদের ধানজমি।—কত লোক কাজ করছে। একটা ডাক দিলেই রে রে করে সবাই দৌড়ে আসবে। শিবনাথ ওরফে ভূতনাথ একটা কথা সর্বদা বলতেন, ভয় পেয়েছ কি মরেছ। সাহস করে এগিয়ে যাবে, তারপর যা থাকে কপালে।

শিবনাথের কথা মনে পড়তেই রান্নাঘরের দরজার ছিটকিনি খুলে ফেললেন সুলোচনা। কিছু বলবার আগেই গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এল চারটে ছেলে। একটি ছেলে এসে ঢিপ করে প্রণাম করে ফেলল। হাসি—হাসি মুখে বলল, ‘মাসিমা, আমরা।’

সুলোচনা হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘থাক বাবা থাক, প্রণাম করতে হবে না। কিন্তু তোমাদের তো ঠিক চিনলাম না?’

‘আমরা আনন্দগড়ে থাকি।’

‘আনন্দগড়! সে তো অনেকদূর!’ সুলোচনার চোখে—মুখে বিস্ময়।

‘না না, দূর কোথায় মাসিমা! এই তো এখান থেকেই দেখা যায়।’ একটি ছেলে আঙুল দিয়ে দূরের ঝাপসা গাছপালা দেখিয়ে বলল, ‘ওই যে জঙ্গল—মতো দেখছেন, উঁচু উঁচু তালগাছ, ওগুলোর সামনে গিয়ে যাকে বলবেন সেই দেখিয়ে দেবে আনন্দগড় যাওয়ার রাস্তা।’

‘তা ভালো কথা, কী মনে করে এসেছ বাবা তোমরা?’ সুলোচনার গলায় স্নেহ ঝরে পড়ল, ‘ভেতরে এসে বোসো।’

একটি ছেলে ভারি ফচকে। তার মুখচোখ, ভাব—ভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায়। সে একগাল হেসে বলল, ‘মাসিমা, ভেতরে গেলেই মহা বিপদ। নাড়ু খাওয়াতে হবে।’

যে ছেলেটি প্রথমে প্রণাম করেছিল সে বলল, ‘হ্যাঁ মাসিমা, নাড়ু। নাড়ু খেতে খুব ভালোবাসি আমরা।’

আরেকটি ছেলে ফুট কাটল, ‘কয়েকটা নাড়ু দিয়ে দেবেন মাসিমা। রাস্তায় যেতে যেতে খাব। একটু বেশি করে দেবেন।’

ছেলেগুলো ভারি পাজি তো? সুলোচনা যে একটু বিরক্ত হয়েছেন সেটা বুঝতে না দিয়ে ছেলেগুলোকে বললেন, ‘নাড়ু এখন কোথায় পাব বাবা এই অসময়ে? তা, তোমরা আসবে জানা থাকলে না হয় বানিয়ে রাখতাম।’

চারটে ছেলে একসঙ্গে হি হি করে হেসে উঠল, ‘নাড়ু খাব মাসিমা, নাড়ু খাব।’

‘পাগল ছেলে সব। দুপুরবেলা এসেছে নাড়ু খেতে।’ মৃদু ধমক দিয়ে সুলোচনা বললেন,”যাও, গাছে ওঠো, নারকেল পাড়ো, নাড়ু বানিয়ে দিচ্ছি, খাও।’

ফচকে মতো ছেলেটি মুচকি হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, মাসিমা। নাড়ু খেয়ে কাজ নেই। আরেকদিন হবে’খন।’

সুলোচনা বললেন, ‘তোমরা কেন এসেছ বললে না তো?’

একটি ছেলে বেশ ভারিক্কি গলায় বলল, ‘আমি নাট্যরূপ দিয়েছি।’

ফাজিল ছেলেটি বলল, ‘আমি নাট্য—নির্দেশক।’

আরেকটি ছেলে বলল, ‘আমি প্রম্পটার।’

সবচেয়ে নিরীহ ছেলেটি হাতে একটা প্রবল তালি দিয়ে বলল, ‘দেখবেন জমে যাবে আমাদের নাটক।’ ফচকে ছেলেটি কান চুলকে বলল, ‘দেখবেন আমাদের নিউ ব্যায়াম সমিতি কালের বুকে একটা স্বাক্ষর রেখে যাবে।’

ছেলেগুলো কি পাগল নাকি? কী সব আবোল—তাবোল বলছে তখন থেকে। নাটক, নাট্যরূপ, নাট্য—নির্দেশক—এসব কথার মানে কী! মাথামুণ্ডু কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। সুলোচনা একটু ধন্দে পড়ে গেলেন। ছেলেগুলো কি তাহলে বখাটে, বিচ্ছু? তাঁকে একা পেয়ে ভয় দেখাতে এসেছে? এবার একটু একটু মাথা ধরছে সুলোচনার। তিনি যে ছেলেগুলোকে ভাগিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেবেন, সে ক্ষমতাও তাঁর নেই। যে ছেলেটা তাঁকে প্রণাম করেছিল, তার মুখটা খুব কচি কচি, মায়াময়। দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। আর ছেলেগুলোর বয়সও খুব কম। ইস্কুল—টিস্কুলে পড়ে বোধহয়। সুযোগ পেয়ে একটু দুষ্টুমি করতে এসেছে।

ধমকের সুরে সুলোচনা বললেন, ‘আমি কিন্তু এবার রাগ করব। তখন থেকে কী বকবক করছ তোমরা!’

‘রাগ করবেন না মাসিমা, রাগ করবেন না।’ ফচকে ছেলেটি এসে খপ করে সুলোচনার হাত ধরে ফেলল।

অন্য একটি ছেলে তার কথায় তাল দিল, ‘দেখে বুঝতে পারবেন না, আমরা কিন্তু খুব ভালো ছেলে।’

এবারে আর হাসি চাপতে পারলেন না সুলোচনা। ‘তোমরা যে ভালো ছেলে তা আমি জানি। কিন্তু কেন আমার কাছে এসেছ, কী চাই তোমাদের, কিছুই তো খোলসা করে বলছ না।’

ফচকে ছেলেটি মজার মুখ করে বলল, ‘অনুমতি চাই। ‘রসগোল্লার গাছ’ নাটক করব আমরা।’

‘ওঃ নাটকটা যা হবে না, দেখবেন একবার! হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবে।’

‘রসগোল্লার গাছ’। চমকে উঠলেন সুলোচনা। নামটা শোনা শোনা মনে হচ্ছে। একটু ভাবতেই অনেক কথা মনে পড়ে গেল তাঁর।

রসগোল্লা খেতে খুব ভালোবাসতেন শিবনাথ। রাত্রে খাওয়ার শেষে তাঁর দুটো রসগোল্লা চাই—ই চাই। রসগোল্লা না পেলেই মুখ বেজার করে থাকতেন। যখন—তখন লুকিয়ে অনিল ময়রার দোকান থেকে রসগোল্লা খেয়ে আসতেন। সুলোচনা রাগারাগি করলেই বলতেন, ‘আলুপোস্ত খেয়ে খেয়ে তোমার মাথাটাও পোস্ত হয়ে গেছে। রসগোল্লার মহিমা তুমি বুঝবে না।’ তাঁর গল্প—কবিতায় একটাই মিষ্টি—রসগোল্লা। আর রসগোল্লার কত রকম নাম দিয়েছিলেন তিনি—রসরঞ্জন, রসরাজ, রসসুধা, রসসুন্দর, রসলহরী, রসচিত্ত, রসবিভঙ্গ, রসরঙ্গ, রসরইরই। এইসব নাম নিয়ে সুলোচনা কি কম হাসাহাসি করেছেন? এরকম রসগোল্লারসিক মানুষ সচরাচর দেখা যায় না। এই রসগোল্লা নিয়েই একটা বড়ো লেখার স্বপ্ন ছিল শিবনাথের। শিবনাথ বলতেন, ‘এই লেখাটা দেখবে কালজয়ী হবে। বাংলার ছেলেমেয়েরা কাড়াকাড়ি করে বই পড়বে। এই বইটা লিখতে পারলে আর কোনো লেখার দরকার হবে না। তারপর আমি রসগোল্লা খাওয়াও ছেড়ে দেব। এই লেখার জন্য হয়তো একদিন আমার নাম সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে যাবে।’

তবে কি…

সুলোচনা চুপ করে আছেন দেখে ছেলেগুলো বিকট চিৎকার করে উঠল, ‘অনুমতি চাই মাসিমা, অনুমতি।’

সবচেয়ে নিরীহ ছেলেটি কাতর ভাবে বলল, ‘রসগোল্লার মঞ্চ সাদা হয়ে আছে। স্টেজে বন্যার মতো বইছে রসগোল্লার রস। দর্শকদের মুখ রসগোল্লায় ভরতি। পাত্রমিত্র সব রসগোল্লা। রসগোল্লার মায়াবী আলোয় ডুবে গেছে নিউ ব্যায়াম সমিতির খেলার মাঠ। বাঙালি অনেকদিন এরকম রসগোল্লা দেখেনি।’

ফচকে ছেলেটি এতক্ষণ ফিকফিক করে হাসছিল। সে এবার দন্ত বিকশিত করে বলল, ‘রসগোল্লার গাছ অক্ষয় বটের মতো। মরবে না কোনোদিনই।’

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এইসব ফিচলেমি আর সহ্য করতে পারলেন না সুলোচনা। তাঁর মাথা ঘুরছে। চোখ জ্বালা করছে। পা কাঁপছে থরথর করে। ছেলেগুলোকে আর একটা কথা বলারও সুযোগ দিলেন না। তাদের মুখের উপরেই দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন সুলোচনা।

বাইরে গগন বিদীর্ণ করে শব্দ উঠল, ”রসগোল্লা অমর রহে। ‘রসগোল্লার গাছ’ অমর রহে।’

ঢ্যাম কুড় কুড়।

ঢ্যাম কুড় কুড়।

ঢাকে কাঠি পড়েছে। তারই শব্দ। অনেক দূর থেকে হাওয়ায় ভেসে আসছে। আকাশে টুকরো টুকরো সাদা মেঘ। কেউ যেন খেলাচ্ছলে রাশি রাশি পেঁজা তুলো ছড়িয়ে দিয়েছে। সেই তুলোগুলোই বোধ হয় এখন ফুরফুরে আনন্দে ভেসে বেড়াচ্ছে।

গাছে পাতায় রোদের অদ্ভুতে আঁকিবুকি। সব যেন কেমন অচেনা লাগছে। মাটির রং সোনার মতো। পুকুরের জল সোনার মতো। চারদিকে ঝলমলে বাহারি দৃশ্য।

আকাশে চক্কর দিচ্ছে কয়েকটা শঙ্খচিল। মাঝে মাঝে ডাকছে করুণ সুরে। পানা পুকুর থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাচ্ছে পুঁটি, খলসে। ঢাকের শব্দ যেন আরও কাছে এগিয়ে আসছে, ঢ্যাম কুড় কুড়, ঢ্যাম কুড় কুড়।

বাণী বলল, ‘এই শুভ্রাদি!’

‘উঁ।’

‘পুজো এসে গেল, না রে?’

শুভ্রা মুখ নীচু করে বসেছিল। তার চোখের কোণে কালি। মুখে আনন্দের ছিটেফোঁটাও নেই। কোনো রকমে ঢোক গিলে বলল, ‘হ্যাঁ।’

বাণী বলল, ‘এবারেও কিন্তু আমরা অষ্টমীর দিন বেরোব। ভুলিস না শুভ্রাদি।’

‘আমরা এবার পুজো—টুজোয় বেরোনো হবে নারে বাণী। তুই বরং অন্য কারও সঙ্গে বেরোস। দেখছিস তো বাবার অবস্থা।’ শুভ্রা চোখ মুছল।

বাণী ফ্যাল ফ্যাল করে শুভ্রার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না।

হরিসত্য রোজই এই সময় এ—বাড়িতে আসেন। গল্প করেন শিবনাথের সঙ্গে। দু—কাপ চা খান। শিবনাথও তাঁর প্রাণের বন্ধুর সঙ্গে লেখালেখি নিয়ে কথা বলেন। নতুন কিছু লিখলেই পড়ে শোনান। শিবনাথের লেখালিখির ব্যাপারে হরিসত্যর কথাই শেষ কথা। তিনি যদি বলেন, হয়েছে, তা হলে সত্যি—সত্যিই লেখাটা উৎরেছে। আজও তিনি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। ঢুকেই হাঁকডাক ফেলে দিলেন, ‘জানলাটা খুলে দে শুভ্রা,’ কই সুলোচনা, চা বসাও,’ ”কী রে বাণী, ঘরটা এত নোংরা কেন, ঝাঁট দিসনি?’

ঘরের এক কোণে চায়ে চুমুক দিতে দিতে শিবনাথের একটা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিলেন ডাঃ সরকার। হরিসত্যকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন, ‘বসুন, কাকাবাবু।’

হরিসত্য নীচু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আজ কেমন দেখছ?’

‘বিপদ কেটে গেছে। আর কোনো ভয় নেই।’

শুভ্রার মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটল। ‘ডাক্তারবাবু, বাবা এখন আগের মতো লেখালেখি করতে পারবে তো?’

‘নিশ্চয়ই পারবেন। কিন্তু এখনই লেখালেখির কথা ভাবছ কেন? দুটো দিন বিশ্রাম নিন, তারপর ওসব ভেবো।’

সুলোচনা বললেন, ‘না, মানে, তুমি তো জানো সুবিনয়, লেখাই ওঁর প্রাণ। না লিখে এক মুহূর্ত থাকতে পারেন না।’

‘সব হবে কাকিমা, আগে মানুষটাকে একটু উঠে বসতে দিন। তারপর। এখন আরেকটু চা খাওয়ান তো, আমি কেটে পড়ি।’

সুলোচনা ব্যস্ত—সমস্ত হয়ে চলে যেতেই ডা. সরকার হরিসত্যকে বললেন, ‘কাকাবাবু, আপনার বন্ধুটিকে এবার একটু বকাঝকা করবেন। বয়স হচ্ছে। অত পরিশ্রম ভালো নয়। লেখালিখির চেয়ে জীবনটা অনেক দামি।’

শুভ্রা বলল, ‘আমিও তো তাই বলি ডাক্তারবাবু। কিন্তু বাবা কি বারণ শোনার পাত্র?’

ডা. সরকার হাসতে হাসতে বললেন, ‘আসলে কী জানো, বয়স হচ্ছে তো। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ পালটাতে থাকে। তাকে ছেলেমানুষি চেপে ধরে।’

হরিসত্য বললেন, ‘আমি কিন্তু ওকে অনেকবার বলেছি সুবিনয়। সত্যিই ও কথা শোনার লোক নয়।’

ডা. সরকার বললেন, ‘শুভ্রা, বাবাকে বোলো, এবার যেন নিজেকে নিয়ে একটা গল্প লেখেন। বেশ জমাটি গল্প।’

চা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন সুলোচনা, ‘সে তোমাকে বলতে হবে না সুবিনয়। সবসময় বলে, নিজেকে নিয়ে অনেক কিছু বলার আছে। বলতে হবে সব।’

খোলা জানলা দিয়ে রোদ ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঘরের মধ্যে। সোনার মতো রোদেসারাঘর ঝলমল করছে। জানলার কাছে একটা কলকে গাছ। ফিকে হলদে রঙের অজস্র ফুল ফুটে আছে। অনেকগুলো পাখি কিচিরমিচির করছে কলকে ফুলের গাছে।

হরিসত্য জিজ্ঞেস করলেন, ‘সুবিনয় এবার বলো তো, শিবনাথের ঠিক কী হয়েছিল?’

ডা. সরকার বললেন, ‘না, তেমন মারাত্মক কিছু নয়। ওঁর মস্তিষ্কের একটা অংশ অল্প সময়ের জন্য অসাড় হয়ে গিয়েছিল।’

হরিসত্য বললেন, ‘তার মানে সাময়িক সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস?’

‘ঠিক ধরেছেন কাকাবাবু।’

‘থ্র—ম্বো—সি—স!’ চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করল শুভ্রা।

‘বলছি তো আর ভয়ের কিছু নেই।’

শিবনাথের গায়ে মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে ডা. সরকার বললেন, ‘কাকাবাবু এখন বিপদমুক্ত। ভালো আছেন।’

সুলোচনা দেওয়ালে টাঙানো তাঁর গুরুদেবের ফোটোর দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করলেন। তারপর ডা. সরকারকে বললেন, ‘সবই তোমার হাত—যশ সুবিনয়। তুমি না থাকলে যে কী হত, ভেবেই আতঙ্ক হচ্ছে।’

শুভ্রার মুখে হাসির রেখা। ‘সত্যিই আপনি ভগবান ডাক্তারবাবু।’

ডা. সরকার লজ্জায় জিভ বের করে ফেললেন। শুভ্রাকে বললেন, ‘কাকাবাবুকে এখন আর কোনো ওষুধ খাওয়ানোর দরকার নেই। আমি আবার বিকেলে এসে নতুন ওষুধ লিখে দেব।’

আস্তে আস্তে চোখ খুলছেন শিবনাথ। হাত নেড়ে শুভ্রাকে ডাকলেন। খুব নীচু গলায় কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন। সুলোচনা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললেন, ‘না, একদম কথা নয়।’

কিন্তু বারণ শোনার পাত্র নন শিবনাথ। হরিসত্যকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোথায় ছিলাম রে এতক্ষণ?’

‘সে তুই—ই জানিস। বেশি কথা বলিস না এখন। আগে ভালো হয়ে ওঠ। তারপর অনেক গল্প হবে।’

ওঠার চেষ্টা করলেন শিবনাথ। শুভ্রা আর বাণী এসে তাঁকে শুইয়ে দিল।

শিবনাথ চুকচুক শব্দ করলেন। তারপর ফিস ফিস করে বললেন, ‘ইস, সব মাটি হয়ে গেল।’

‘কী মাটি হয়ে গেল?’ হরিসত্য ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করলেন।

‘সে তোরা বুঝবি না। ‘রসগোল্লার গাছ’।’

মুখ চাওয়া—চাওয়ি করলেন সুলোচনা আর শুভ্রা।

‘আশ্চর্য দেশ…আশ্চর্য মানুষ…আশ্চর্য অভিজ্ঞতা…জীবনে একবারই দেখা যায়। বারবার হয় না।’

শুভ্রা মৃদু ধমক দিল, ‘বাবা, তোমাকে না কথা বলতে বারণ করেছি? কেন তুমি এত কথা বলছ?’

শিবনাথের চোখের কোণে জল। বাইরে সমানে ঢাক বেজে চলেছে ঢ্যাম কুড় কুড়, ঢ্যাম কুড় কুড় কুড়। চারদিকে পুজো পুজো গন্ধ। শিউলির সুবাস আসছে। উতলা হয়ে উঠছে মন। সুলোচনা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন।

শিবনাথ হাত বাড়ালেন হরিসত্যর দিকে। ‘হরি,’ শিশুর মতো গলায় বললেন, ‘কয়েকটা কাগজ আর কলম দিবি? এক্ষুনি না লিখলে সব ভুলে যাব রে।’

হরিসত্য বললেন, ‘কী ভুলে যাবি?’

‘অভিজ্ঞতা রে, আশ্চর্য একটা অভিজ্ঞতা। লিখে ফেলতেই হবে। গাছে যখন—তখন রসগোল্লা ফলে না রে হরি একবারই ফলে।’

কারও মুখে কোনো কথা নেই। হরিসত্য বললেন, ‘শুভ্রা, বাবাকে আর একদম বিরক্ত করিস না। কথা বললেই ও এখন বকবক করবে। ওকে বরং একটু ঘুমোতে দে।’

সুলোচনা বললেন, ‘সুবিনয়কে কী একবার ডেকে পাঠাব?’

হরিসত্য বললেন, ‘না না, তার কোনো দরকার নেই। বোঝাই যাচ্ছে শিবনাথ এখনও একটা ঘোরের মধ্যে আছে। এই ঘোর কাটতে একটু সময় লাগবে।’

শিবনাথ শুয়ে আছেন। তাঁর মুখের ওপর রোদের একটা ছোট্ট টুকরো খেলা করছে। ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসি। আস্তে আস্তে বললেন, ‘ঠিক বলেছিস হরি। এই ঘোরের মধ্যে কতক্ষণ আছি জানি না। কিন্তু ছিলাম বলেই তো একটা ‘রসগোল্লার গাছ’ পেলাম রে পাগল। এত আনন্দ কী সহজে পাওয়া যায়?’

খোলা জানলার সামনে অনেকগুলো পাখি। পালকে তাদের কতরকম রং। উড়ুৎ ফুড়ুৎ করে গাছের ডালে উড়ে বেড়াচ্ছে। একসঙ্গে এত পাখি কখনো দেখেননি শিবনাথ। এমন স্বাধীন, বাধাবন্ধহীন জীবনও তাঁর চোখে পড়েনি কখনো। অদ্ভুত একটা আনন্দ আর ভালো লাগায় তাঁর মন ভরে গেল। জানলার বাইরে চমৎকার একটা নীল আকাশ, দুধের ফেনার মতো সাদা সাদা মেঘ, পাতা—লতায় শরতের সোনা ঝরছে, দূরে কাঁকি নদীর জলে ভেসে বেড়াচ্ছে নৌকো। আর কী চাই? ‘রসগোল্লার গাছ’ লিখে ফেলার এই তো প্রকৃত সময়।

আস্তে আস্তে উঠে বসলেন শিবনাথ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *