দ্বিতীয় দৃশ্য
[ভৈরব আচার্যের বহির্বাটী। দৌহিত্রের অন্নপ্রাশন-উপলক্ষে দ্বারে মঙ্গলঘট স্থাপিত হইয়াছে। আম্রপল্লবের মালা গাঁথিয়া সম্মুখে ঝুলাইয়া দেওয়া হইয়াছে। প্রাঙ্গণের একপ্রান্তে রোশনচৌকি বাদ্যকরের দল উপবিষ্ট। সম্মুখের বারান্দায় বসিয়া গোবিন্দ গাঙ্গুলী, বেণী ঘোষাল প্রভৃতি ভদ্রলোক। কেহ হাসিতেছে, কেহ ধূমপান করিতেছে। একজন বৈষ্ণব ও তাহার বৈষ্ণবী কীর্তন গাহিতেছিল, এবং তাহাই সকলে পরমানন্দে শ্রবণ করিতেছে। গান শেষ হইলে দীনু ভট্টাচার্য হুঁকা রাখিয়া বাহিরে যাইতেছিল, এমনি সময়ে রমেশ আসিয়া প্রবেশ করিল। দেখিলেই বুঝা যায় সে অতিশয় উত্তেজিত হইয়া আসিয়াছে। তাহার অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবে উপস্থিত সকলেই চঞ্চল হইয়া উঠিল]
গান
শ্রীমতী করিছে বেশ।
ভুলাতে নাগর
শ্যাম নটবর
নানা ছাঁদে বাঁধে কেশ।
(আহা) শ্রীমতী করিছে বেশ।
হেরিয়া মুকুরে
চাঁচর চিকুরে
বিনায়ে বিনায়ে বিনোদ গোখুরে
রাধা বাঁধিল কবরী কত
কেহ হল নাক মনোমত (হায় রে),
ফণি–গঞ্জিত বেণী বিনোদিনী
দুলাইয়া দিল শেষ
(আহা) শ্রীমতী করিছে বেশ।
বেণী গেল ছুটি
লঙ্ঘিয়া কটি
পরশি মেখলা নিতম্বে লুটি
চুম্বিলা পাদদেশ।
উজ্জ্বল দু’টি নয়নপ্রান্তে কজ্জল দিল টানি
ফুলধনু জিনি ভ্রূযুগ মাঝে দীপসম টিপখানি।
ভরিয়া দু’ করে স্বর্ণবিন্দু
মার্জিল ধনী বদন ইন্দু
নন্দিতে শ্যামসুন্দর-হৃদি—বন্দিতে কমলেশ।
রমেশ। আচায্যিমশাই কৈ?
দীনু। (কাছে আসিয়া) চল, বাবা চল, বাড়ি ফিরে চল। তুমি যে উপকার আচায্যির করেচো সে ওর বাবা করতো না। কিন্তু উপায় ত নেই। কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে সকলকেই ঘর করতে হয়, তোমাকে নেমন্তন্ন করতে গেলে,—বুঝলে না বাবা,—ভৈরবকে নেহাত দোষ দেওয়াও যায় না। তোমরা সব আজকালকার শহরের ছেলে, জাত-টাত ত তেমন মানো না—তাতেই বুঝলে না বাবা,—দু’দিন পরে ওর ছোট মেয়েটা বছর বারোর হলো ত,—পার করতেও ত হবে,—আমাদের সমাজের ব্যাপার বুঝলে না বাবা—
রমেশ। আজ্ঞে হাঁ বুঝেচি। তিনি কৈ?
দীনু। আছে আছে, বাড়িতেই আছে। কিন্তু বামুনকেই বা দোষ দিই কি করে? (সকলের দিকে চাহিয়া) আমাদের বুড়োমানুষের পরকালের ভয়ও ত একটা—
রমেশ। সে ত ঠিক কথা। কিন্তু ভৈরব কোথায়?
[ভৈরবের প্রবেশ]
ভৈরব। (সবিস্ময়ে বেণীবাবুর উদ্দেশ্যে) দেখুন বড়বাবু, আপনার পাছে কষ্ট হয়—
[অকস্মাৎ সম্মুখে রমেশকে দেখিয়া সে বজ্রাহতের ন্যায় স্তব্ধ হইয়া গেল]
রমেশ। (দ্রুতপদে অগ্রসর হইয়া তাহার একটা হাত সবলে চাপিয়া ধরিয়া) কেন এমন করলেন? আজ আমি—
ভৈরব। বড়বাবু—গোবিন্দ গাঙ্গুলীমশাই—দেখুন না একবার—
রমেশ। (ভৈরবকে সজোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়া) বড়বাবু, গোবিন্দ—আজি আমি সবাইকে দেখাবো! বলুন কেন এ কাজ করলেন?
[বেণী প্রভৃতি সকলের দ্রুতবেগে পলায়ন]
ভৈরব। (কাঁদিয়া উঠিয়া) লক্ষ্মী রে, পুলিশে খবর দে রে! মেরে ফেললে রে—
রমেশ। চুপ! বলুন, কিসের জন্যে এ কাজ করলেন?
ভৈরব। মেরে ফেললে রে! বাবা রে!
রমেশ। মেরেই ফেলবো। আজ তোমাকে খুন করে তবে বাড়ি যাবো।
[এই বলিয়া সে পুনঃ পুনঃ ঝাঁকুনি দিতে লাগিল। লক্ষ্মী আসিয়া পড়িয়া আর্তনাদ করিতে লাগিল। ইতিমধ্যে বহু লোক সমবেত হইয়া চারিদিক হইতে উঁকিঝুঁকি মারিতে লাগিল]
[দ্রুতবেগে রমার প্রবেশ]
রমা। (রমেশের হাত চাপিয়া ধরিয়া) হয়েচে,—এবার ছেড়ে দাও।
রমেশ। কেন শুনি?
রমা। এই লোকটার গায়ে তুমি হাত দেবে?
রমেশ। একে আমি কিছুতেই ছাড়বো না।
রমা। (জোর করিয়া হাত ছাড়াইয়া দিয়া) এত লোকের মাঝখানে এই লোকটার গায়ে হাত দিতে তোমার লজ্জা করচে না, কিন্তু আমি যে লজ্জায় মরে যাই রমেশদা! বাড়ি যাও।
রমেশ। মুহূর্তকাল বিহ্বল-চক্ষে তাহার প্রতি চাহিয়া থাকিয়া) আচ্ছা। বাড়িই চললাম।
[রমেশ ধীরে ধীরে প্রস্থান করিতে বেণী, গোবিন্দ প্রভৃতি সকলে ভিড় করিয়া আসিয়া পড়িল। ভৈরব বসিয়া পড়িয়া দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজিয়া কাঁদিতে লাগিল]
গোবিন্দ। বাড়ি চড়াও হয়ে যে আধমরা করে গেল, এর কি করবে এখন সেই পরামর্শ করো।
বেণী। আমিও ত তাই বলি।
রমা। কিন্তু এ পক্ষের দোষও ত কম নয় বড়দা? তা ছাড়া হয়েচেই বা কি যে এই নিয়ে হৈচৈ করতে হবে?
বেণী। বল কি রমা, এ কি সোজা ব্যাপার হোলো? আমরা সবাই না থাকলে ত সে খুন করে যেতো।
রমা। করলেও তোমরা আটকাতে পারতে না বড়দা। পালালে কেন?
বেণী। পালালাম?
গোবিন্দ। পালাবো আমরা? আমরা শুধু আড়াল থেকে দেখছিলাম ওর দৌড় কত?
লক্ষ্মী। তুমি ত ওর হয়ে বলবেই রমাদিদি। তোমার বাপকে কেউ ঘরে ঢুকে মেরে গেলে কি করতে বল ত?
রমা। আমার বাপ ও তোমার বাপে অনেক তফাত লক্ষ্মী, তুমি সে তুলনা কোরো না। কিন্তু আমি কারও হয়েই কথা বলিনি, ভালোর জন্যই বলেচি।
লক্ষ্মী। বটে! ওর হয়ে কোঁদল করতে তোমার লজ্জা করে না? বড়লোকের মেয়ে বলে কেউ ভয়ে কথা বলে না, নইলে কে না শুনেচে? তুমি বলে তাই মুখ দেখাও, আর কেউ হলে গলায় দড়ি দিতো।
বেণী। (লক্ষ্মীকে তাড়া দিয়া) তুই থাম না লক্ষ্মী—কাজ কি ও-সব কথায়?
লক্ষ্মী। কাজ নেই কেন? যার জন্যে বাবাকে এত দুঃখ পেতে হোলো তার হয়েই উনি কোঁদল করবেন? বাবা যদি আজ মারা যেতেন?
রমা। (লক্ষ্মীর প্রতি) লক্ষ্মী, ওঁর মত লোকের হাতে মরতে পাওয়া ভাগ্যের কথা। আজ মারা পড়লে তোমার বাবা স্বর্গে যেতে পারতো।
লক্ষ্মী। তাতেই বুঝি তুমি মরেচো রমাদিদি?
রমা। (ক্ষণকাল নীরবে তাহার প্রতি চাহিয়া থাকিয়া মুখ ফিরাইয়া লইল) কিন্তু কথাটা কি তুমিই বল ত বড়দা?
বেণী। কি করে জানবো বোন! লোকে কত কথা বলে—তাতে কান দিলে ত চলে না।
রমা। লোকে কি বলে?
বেণী। বললেই বা রমা। লোকের কথাতে ত গায়ে ফোস্কা পড়ে না। বলুক না।
রমা। তোমার গায়ে হয়ত কিছুতেই ফোস্কা পড়ে না, কিন্তু সকলের গায়ে ত গণ্ডারের চামড়া নেই? কিন্তু লোককে এ কথা বলাচ্চে কে? তুমি?
বেণী। আমি?
রমা। তুমি ছাড়া আর কেউ নয়। পৃথিবীতে কোন দুষ্কর্মই ত তোমার বাকি নেই,—জাল, জোচ্চুরি, চুরি, ঘরে আগুন দেওয়া সবই হয়ে গেছে, এটাই বা বাকী থাকে কেন? মেয়েমানুষের এতবড় সর্বনাশ যে আর নেই সে বোঝবার তোমার শক্তি নেই। কিন্তু জিজ্ঞেসা করি কিসের জন্য এ শত্রুতা তুমি করে বেড়াচ্চো? এ কলঙ্ক রটিয়ে তোমার লাভ কি?
বেণী। আমার লাভ কি হবে? লোকে যদি তোমাকে রাত্রে রমেশের বাড়ি থেকে বার হতে দেখে,—আমি করব কি?
রমা। এত লোকের সামনে আর সব কথা আমি বলতে চাইনে, কিন্তু তুমি মনে করো না বড়দা, তোমার মনের ভাব আমি টের পাইনি। কিন্তু তুমি নিশ্চয় জেনো,—আমি রমা। যদি মরি, তোমাকেও জ্যান্ত রেখে যাবো না।
[দ্রুতবেগে প্রস্থান]
গোবিন্দ। অ্যাঁ? এ হোলো কি বড়বাবু? তোমাকেও চোখ রাঙ্গিয়ে যায়,—মেয়েমানুষ হয়ে? আমি বেঁচে থেকে এও চোখে দেখতে হবে?
বেণী। (নিজের ললাট স্পর্শ করিয়া) কারও দোষ নয় খুড়ো, দোষ এর। কলিকাল,—এরই নাম কাল-মাহাত্ম্য। ভালো ছাড়া কখনো কারো মন্দ করিনে, মন্দ করার কথা ভাবতে পারিনে। জগতে আমার এমন হবে না ত হবে কার? বিদ্যেসাগরের কি হয়েছিল? গল্প শুনেচো ত!
গোবিন্দ। তা আর শুনিনি!
বেণী। তবে তাই! দোষ দেবো আর কাকে? (ভৈরবকে দেখাইয়া) এঁকে রক্ষে করতে না যেতাম ত কোন কথাই হতো না! কিন্তু সে ত আর আমি প্রাণ থাকতে পারিনে!