রমা – ২.৩

তৃতীয় দৃশ্য

[গ্রাম্য পথ। সময় অপরাহ্ণপ্রায়। তিন দিন অত্যধিক ও অবিশ্রাম বারিপাতে পুষ্করিণী-খাল-বিল-নালা সমস্তই জলে পরিপূর্ণ হইয়া গেছে। পথ অতিশয় কর্দমাক্ত। ক্ষণকাল মাত্র বৃষ্টির বিরাম পড়িয়াছে। লাঠি ও ছাতি হাতে বেণী ও গোবিন্দ প্রবেশ করিল। দুর্গম পথে চলার চিহ্ন তাহাদের সর্বাঙ্গে বিদ্যমান]

গোবিন্দ। (অন্তরাল হইতেই উচ্চকণ্ঠে) বলি, কিসের এত খাতির হে! কুটুমের দল এয়েচেন আবদার নিয়ে বাঁধ কাটিয়ে জল নিকেশ করে দাও, মাঠ হেজে যাবে! গেল, গেলই! ছোটলোক ব্যাটাদের আস্পর্ধার কথা শুনে হাসব কি কাঁদব ভেবে পাইনে বড়বাবু!

বেণী। বল ত খুড়ো! চাষা ব্যাটাদের একশো বিঘের মাঠ হেজে যাবে, জল বার করে দাও। সুমুখের বিলটার যে বছর সালিয়ানা দুশো টাকার জলকর বিলি হয়। একটা মাছও কি তা হলে থাকবে?

গোবিন্দ। তাও কি কখনো থাকে? ছোটলোক ব্যাটারা, দুটো টাকার মুখ কখনো একসঙ্গে দেখিস নে তোরা,—জানিস, দু-দুশো টাকার লোকসান কাকে বলে? বলি, লোক-জন সব মোতায়েন রেখেছ ত? লুকিয়ে-চুরিয়ে ব্যাটারা কোথাও কেটেকুটে দেবে না ত? বলা যায় না বড়বাবু! প্রাণের দায়ে শালারা সব পারে।

বেণী। দরোয়ান আর গোপাল লস্করকে পাঠিয়েচি পাহারা দিতে। আর খবর পাঠিয়েচি রমার পীরপুরের প্রজা আকবর লেঠেল আর তার দুই ব্যাটাকে। একশো জনের মোয়াড়া আটকাতে পারে তারা।

গোবিন্দ। ঠিক করেচ বাবা। কলকেটি সেজে ফুঁ দিচ্চি, আর তোমার চাকর গিয়ে হাজির। বলি, ভিজতে ভিজতে কেন রে হরি? বলে, বড়বাবু তোমাকে ডাকচে। মিথ্যে বলব না বাবা, হাতের হুঁকো হাতে রইল, একবার টানবার সময় হল না। ছাতি আর ছড়িটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তোমার খুড়ী বললে এ দুর্যোগে যাও কোথা? বললুম, থাম্‌ মাগী, আবার পিছু ডাকে! দেখচিস বড়বাবু ডাকতে পাঠিয়েচে না? তার আবার সুযোগ-দুর্যোগ কি?

বেণী। জান ত খুড়ো তোমার পরামর্শ ছাড়া আমি এক-পা কোথাও চলিনে। আমার কাছে কান্নাকাটি কোরে যখন হোল না, তখন ব্যাটারা গেল ছোটবাবুর কাছে দরবার করতে। হোঁৎকা-গোঁয়ার, ওর কি! হয়ত বলে বসবে, হোকগে লোকসান আমাদের, দে তোরা বাঁধ কেটে।

গোবিন্দ। পারে, ও হারামজাদা সব পারে বড়বাবু। (গলা ছোট করিয়া) বলি রমাকে একটা খবর দিয়ে রেখেচ ত? সে ছুঁড়ীরও সব সময়ে মেজাজের ঠিক থাকে না। গরীব-দুঃখীর কান্না দেখলে হয়ত বা সায় দিয়েই বসবে।

বেণী। নাঃ—সে ভয় নেই খুড়ো, তাকে আমি সকালবেলাতেই টিপে দিয়ে রেখেচি। কাল রাত্তির থেকেই একটা কানাঘুষো শুনচি কিনা! ঐ যে আবার ক’ ব্যাটা এই দিকেই আসছে।

[কয়েকজন কৃষকের প্রবেশ। তাহাদের সর্বাঙ্গ
জলে ও কাদায় একাকার হইয়া গেছে]

কৃষকেরা। (সমস্বরে) দোহাই বড়বাবু, গরীবদের বাঁচান। এ আবাদ পচে গেলে আমরা ছেলেপুলে নিয়ে অনাহারে মরব।

গোবিন্দ। কেন হে সনাতন, মুরুব্বিরা ছুটে গেলেন যে ছোটবাবুর কাছে! এখন বাঁচান না তিনি!

সনাতন। যে গেছে সে গেছে গাঙ্গুলীমশাই, আমরা এই পা-দুটিই জানি, এই পা ধরেই পড়ে থাকব। (বেণীর পদতলে পড়িয়া ক্রন্দন)

২য় কৃষক। (বেণীর পদতলে পড়িয়া) আমাদের রাখতে হয় রাখুন, মারতে হয় মারুন,—পা আমরা ছাড়ব না।

বেণী। (জোর করিয়া পা ছাড়াইয়া লইয়া) যা—যা—আমি দু’-দুশো টাকার জলকর নষ্ট করতে পারব না। চল খুড়ো আমারা যাই, আমাদের আরও কাজ আছে।

[বেণী ও গোবিন্দ যাইতে উদ্যত হইল]

কৃষকেরা। বড়বাবু, গাঙ্গুলীমশাই, তবে কি সত্যি সত্যিই আমরা মারা যাব?

গোবিন্দ। (ফিরিয়া দাঁড়াইয়া মুখ বিকৃত করিয়া) মারা যাবি কি যাবিনে তার আমরা কি জানি?

[উভয়ের প্রস্থান]

কৃষকেরা। হা ভগবান! দুঃখীদের কি তবে সত্যিই মারবে? ওপরে বসে সব দেখচ, তবু কোন উপায় করে দেবে না?

[সকলের দ্রুতবেগে প্রস্থান]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *