রমলা টু
অবাক করা বা সন্দেহজনক টেলিফোন এলে বিশেষ এক ধরনের আচরণ করতে হয়। কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পর ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে হয় টেলিফোনের দিকে। ভাবটা এমন, যেন এই সন্দেহজনক কাজের জন্য টেলিফোন যন্ত্রটাই দায়ী। টেলিফোনের ভুরু নেই। থাকলে হয়তো সেও পালটা ভুরু কোঁচকাত। বলত, ‘এই যে, ওভাবে তাকাচ্ছেন কেন? আমার কী দোষ?’
এক্ষুনি রমলার কাছে ভীষণ ‘অবাক করা’ একটা টেলিফোন এসেছিল। তবে রিসিভার নামিয়ে রমলা ভুরু, চোখ, নাক কিছুই কোঁচকাল না, কড়া চোখে টেলিফোনের দিকে তাকালও না। উলটে হাসল। সেই হাসির মধ্যে দারুণ একটা তৃপ্তির ভাব আছে।
হাসি নিয়েই সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল রমলা। টেবিলের ওপর রাখা ফুলদানির ফুলদুটো সামান্য এদিক ওদিক করল। বছর পাঁচেক আগে হো চি মিন সরণিতে পুষ্পসজ্জার ওপর একটা শর্ট কোর্স করেছিল সে। প্রথমদিনই তারা বলেছিল, ফুল সাজানোর আসল রহস্য ফুলে নয়। রহস্য ফুলের পজিশনে। একই ফুল নড়িয়ে চড়িয়ে রাখলে এক-এক সময় এক-এক রকম দেখায়।
ফুল ছেড়ে রমলা শোকেসের সামনে এসে দাঁড়াল। ভারী সুন্দর জিনিসটা। দেয়ালে ঝুলছে একটা কাচের বাক্স। কোথাও এক টুকরো কাঠ নেই। মনে হয়, পেরেক নাট বল্টুগুলোও সব কাচ দিয়ে তৈরি। কাচের হাতুড়ি, কাচের করাত দিয়ে জিনিসটা তৈরি হয়েছে। গঁত্যিয়ের ক্যাটালগ ঘেঁটে এই জিনিস যখন রমলার পছন্দ হয়েছিল, তখন এক সমস্যা হল। বানাবার লোক পাওয়া যায় না। মনে আছে, অনেক হ্যাপা হয়েছিল। তবে জিনিস একটা হয়েছে বটে, চোখ ফেরানো যায় না। ভেতরের কিউরিগুলোও তেমনি। এদেশের একটাও নয়। সুনন্দ যখনই কাজে বাইরে যায়, তখনই সে তিনজনের জন্য কিছু-না-কিছু আনবে। এই তিনজন হল স্ত্রী, পুত্র আর শোকেস। গতবছর হংকংয়ের চিমসাচই মার্কেট থেকে অদ্ভুত একটা পুতুল এনেছে সুনন্দ। দু’ইঞ্চির একটা প্যান্ট-কোট পরা বুড়ো সাহেব। সাহেবের মাথায় টুপি। জাপানিদের মতো খুদে খুদে চোখ। মজা হল, দিনের আলোর সঙ্গে সঙ্গে বুড়ো সাহেবের উচ্চতা বদলাতে থাকে। সকালে বেঁটে দেখায়। বেলা যত বাড়তে থাকে বুড়ো লম্বা হয়ে যায়! রাতে মনে হয়, মনে হয় এই বুঝি শোকেস ভেঙে মাথা তুলে দাঁড়াবে! আসলে সবটাই চোখের ভুল। আলোর প্রতিফলন প্রতিসরণের তত্ত্ব মেপে এই পুতুল তৈরি হয়েছে।
রমলা শাড়ির আঁচল শোকেসের ওপর দিয়ে ঝুলিয়ে নিল। তকতকে কাচে তার মুখের ছায়া পড়ল। সে এখনও হাসছে।
আসলে রমলা খুব তৃপ্তি বোধ করছে। গত উনিশ বছর ধরে রমলা এই টেলিফোনের জন্য অপেক্ষা করে ছিল। দীর্ঘ উনিশ বছর। স্বামীর রমরমা ব্যাবসা সল্ট লেকে ডুপলেক্স ফ্ল্যাট, গ্যারাজে কমলা রঙের পালিও, ছেলের দার্জিলিং কনভেন্ট, ক্যামাক স্ট্রিটে নিজের ফুলের বুটিক, মধ্যমগ্রামে নার্সারির পরও কোথাও যেন একটা অস্বস্তি ছিল। কাঁটা বেঁধার মতো অস্বস্তি। সবসময় নয়, মাঝেমধ্যে, হঠাৎ হঠাৎ সেই কাঁটা খচখচ করে উঠত।
উনিশ বছরে মানুষের সবকিছু বদলে যায়। তবু টেলিফোন ধরেই রমলা ওপাশের গলা চিনতে পারল। সেই চেনা গলা বলল, ‘হ্যালো, হ্যালো রমলা আছে? ও রমলাই বলছিস? চিনতে পারছিস? পারছিস না? আমি রমলা। আমি তোদের সেই রমলা টু রে। সেই যে ক্লাস এইটে ভরতি হলাম। মনে পড়েছে? বাবাঃ মনে পড়েছে তা হলে। বাঁচালি ভাই, আমি তো ভেবেছিলুম…। রমলা, খুব বিপদে পড়েছি ভাই, ভীষণ বিপদে। তুই যদি সাহায্য না করিস দুই মেয়ে নিয়ে সুইসাইড করতে হবে। বিষ কেনার মতো পয়সাও এই মুহূর্তে আমার হাতে নেই। অনেক কষ্টে তোর টেলিফোন নম্বর জোগাড় করেছি। তুই আমার শেষ ভরসা। আমি জানি, তুই একমাত্র আমায় বিশ্বাস করবি। কিছু টাকা তোকে ধার দিতে হবে ভাই। আজই দিতে হবে। আমায় বাঁচা তুই।’
স্কুলজীবনে এরকম হামেশাই ঘটে। এক ক্লাসে একই নামে অনেকগুলো ছেলেমেয়ে। তিনখানা সুমন, দু’জন অঞ্জনা, চারটে দেবাশিস। রমলার জীবনেও ঘটল। তখন ক্লাস এইট। একদিন ভূগোলের পিরিয়ড চলছে। হঠাৎ বড়দি ক্লাসে ঢুকলেন। পেছন পেছন একটা মেয়ে। মিষ্টি দেখতে। গায়ের রং খুব ফরসা আর চোখগুলো বড় বড়। বড়দি বললেন, ‘গালর্স, আজ থেকে এই মেয়েটি তোমাদের ক্লাসে পড়বে। এর বাবার বদলির চাকরি, দিল্লি থেকে হঠাৎ ট্রান্সফার হয়ে এসেছেন। তোমরা সবাই মিলে দেখবে এই মেয়ের যেন কোনও অসুবিধে না হয়।’
বড়দি বেরিয়ে যেতেই মেয়েরা মুখ নামিয়ে হাসল। গা টেপাটেপি করল। ফিসফিস করে নন্দিতা বলল, ‘হাঁদা’। তপতী এল, ‘সাদা হাঁদা’। রমলা বলল, ‘সাদা হাঁদা গাধা’।
টিফিনের আগেই নতুন মেয়েটি সম্পর্কে দুটি ভয়ংকর ঘটনা জানা গেল। আর তিন নম্বর ভয়ংকর ঘটনা জানা গেল টিফিনের সময়। প্রথম ঘটনা যেটা জানা গেল তা হল, নতুন মেয়েটি দারুণ বুদ্ধিমতী। অঙ্ক ক্লাসে সবার আগে খাতা জমা দিল এবং সব অঙ্ক ঠিক করল। দ্বিতীয় ভয়ংকর ঘটনা হল, এই মেয়েটির নামও রমলা। আর তিন নম্বর যা জানা গেল, তা হল, এ-মেয়ে দারুণ ঝগড়া করতে পারে। এ-ব্যাপারে ছোট বড় কোনও ইস্যু সে ছাড়তে রাজি নয়। বেঞ্চে বসা থেকে উত্তর মেরুর তাপমাত্রা— সব ব্যাপারেই সে ঝগড়া করতে পারে।
প্রথমদিনই কী করে যেন নতুন রমলার নাম হয়ে গেছে, ‘রমলা টু’। দু’নম্বর রমলা।
রমলা টু ভুরু কুঁচকে বলল, ‘টু কেন?’
অনিন্দিতা আমতা আমতা করে বলল, ‘তুমি পরে এসেছ তাই টু। এরপরে রমলা নামে যারা আসবে তারা হবে থ্রি, ফোর, ফাইভ।’
‘তোমাদের ক্লাসে কি আরও রমলা আসবে বলে মনে হয়?’
চন্দনা সাবধানে বলল, ‘কে জানে আসতেও তো পারে। ক্লাস এইটে তো চারজন ছন্দা আছে। বেঁকা ছন্দা, সোজা ছন্দা, হাসি ছন্দা আর কান্না ছন্দা।’
রমলা টু ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ‘তোমাদের স্কুলের মেয়েরা তো খুব অসভ্য দেখছি। বিচ্ছিরি নাম দাও।’
মনীষা সাহস করে বলল, ‘সেদিক থেকে তোমার নাম তো ভালই হয়েছে। ওয়ান, টু, থ্রি তো বিচ্ছিরি কিছু নয়।’
রমলা টু তার মাথা-ভরতি চুল ঝাঁকিয়ে বলল, ‘বিচ্ছিরি নয়। তবে অপমানজনক। আমি সেকেন্ড পছন্দ করি না। আগের স্কুলে কোনও কিছুতে কখনও আমি সেকেন্ড হইনি। লেখাপড়া, খেলাধুলা, গানবাজনা, সবকিছুতেই আমি ফার্স্ট হতাম। একবার অ্যানুয়াল ফাংশনে ড্রেস কম্পিটিশন হয়েছিল। আমি খুব সিম্পল সেজেও ফার্স্ট হয়েছিলাম। মাথায় শুধু একটা লাল রিবন লাগিয়েছিলাম, ব্যস। চিন্তা কোরো না, এখানেও সবকিছুতে ফার্স্ট হব। সেই কারণেই নামের পেছনে টু আমি মেনে নিতে পারছি না। তা ছাড়া সমস্যা হল, বাবা শুনলে রাগ করতে পারে। বাবা রাগ করে এমন কোনও কাজ আমি কখনও করি না।’
রমলা অবাক হয়ে বলল, ‘এর মধ্যে ফার্স্ট সেকেন্ডের কী আছে? এ তো আর পরীক্ষার রেজাল্ট নয়। আমাদের দু’জনকে আলাদা করার জন্যে একটা ব্যবস্থা। কেউ যদি শুধু রমলা বলে তা হলে হয়তো অনেকেই বুঝতে পারবে না। ভাববে আমার কথা বলছে। তাই রমলা টু।’
রমলা টু কঠিন চোখে রমলার দিকে তাকাল। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘জীবনে কখনও কোনও কিছুতে ফার্স্ট হয়েছ? মনে হচ্ছে না হয়েছ। হলে আর এ কথাটা বলতে না।’
অপমানে রমলার চোখ মুখ লাল হয়ে গেল। জ্বালা জ্বালা করতে লাগল। সে বলল, ‘ঠিক আছে। তুমি যেমন রমলা আছ তেমন থাকো।’
‘কেন? তুমি কি দয়া দেখাচ্ছ? দুঃখিত, আমি কারও দয়া নিই না ভাই। যাক, তোমাদের সঙ্গে এই বিষয়ে তর্ক করা বৃথা। আমি তোমাদের দেওয়া নাম মেনে নিলাম কিন্তু একটা শর্ত আছে।’
এষা বলল, ‘শর্ত! শর্ত আবার কী?’
রমলা টু ঠোঁটের ফাঁকে বিদ্রূপের হাসি এনে বলল, ‘ফাইনাল পরীক্ষায় আমি যখন ফার্স্ট হব তখন কিন্তু আমার নামের সঙ্গে আর টু বলা যাবে না। তখন তোমাদের পুরনো রমলাকেই টু বলে ডাকতে হবে। আর আমি হব শুধু রমলা। তখন যদি কেউ আমাকে টু বলে ডাকো আমি কমপ্লেইন করব, বাবার চিঠি নিয়ে আসব।’
স্কুলে কান্না সামলালেও বাড়িতে এসে দরজা আটকে রমলা খুব খানিকটা কাঁদল। ঠিক কারণেই কাঁদল। এতদিন সে-ই ছিল ক্লাস এইটের একমাত্র রমলা। এবার তার থেকে অনেক সুন্দরী, পড়াশোনায় অনেক ভাল, একটা মেয়ে কোথা থেকে উড়ে এসে সেই নাম কেড়ে নিল! তাকে সবার সামনে অপমান করতেও ছাড়ল না।
অপমানের এখানেই শেষ নয়। বলা যেতে পারে শুরু। যত দিন যেতে লাগল সেই অপমানের পরিমাণ বাড়তে লাগল। এক মাসের মধ্যে রমলা টু রমলাকে অনেক পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল। ক্লাসের মেয়েরা পর্যন্ত তার ভক্ত। আর কথাটা মিথ্যে নয়, মেয়েটা শুধু দেখতে সুন্দর নয়, সবকিছুতেই চৌখস। গান, বাজনা, পড়াশোনাতেও তো বটেই, স্পোটর্সের সময় একশো মিটার দৌড়েও সে সবাইকে হারিয়ে দিল! দিদিমণিরা রমলা টু বলতে অজ্ঞান। নিজেরা বলাবলি করেন, ‘এই মেয়ে মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করতে পারে। এর ওপর বিশেষ নজর দেওয়া দরকার।’
অনিন্দিতা একদিন রমলাকে ফিসফিস করে বলল, ‘অ্যাই জানিস, রমলা টুয়ের নাকি এর মধ্যেই বর ঠিক হয়ে আছে। ছেলে সিডনিতে পড়াশোনা করে।’
রমলা নামের একটা মেয়ে চোখের সামনে এভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে রমলা কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। শুধু নামটা এক, বাকি সবটাই আলাদা, অনেক আলাদা। রমলা অনেক কিছু ভেবেছে। কখনও ভেবেছে, নিজের নামটা বদলে ফেলবে। রমলা এমন কিছু নাম নয় যে আঁকড়ে বসে থাকতে হবে। একবার মনে হল, আজ থেকে ঠেসে অঙ্ক করবে। সবাইকে দেখিয়ে দেবে, এই রমলাও কম যায় না। সেও বুদ্ধিমতী। সেও অঙ্ক পারে। কিন্তু হল না। এক মাসের মাথায় ক্লাস টেস্টে পঁচিশে ছাব্বিশ পেয়ে রমলা টু সবাইকে চমকে দিল! সব অঙ্ক পারার জন্য পুরো নম্বর আর পরিচ্ছন্নতায় মুগ্ধ হয়ে অতিরিক্ত এক নম্বর। সেখানে রমলার তিনটে ভুল। টিফিনের সময় পেট ব্যথা করছে বলে বাকি সময়টা বেঞ্চে মাথা নামিয়ে বসে রইল রমলা।
এরপর আরও এক অদ্ভুত কাণ্ড শুরু করল রমলা। সকাল বিকেল স্নানের সময় ঘষে ঘষে সাবান মাখতে লাগল। সাবান কোনও কাজ দিল না। গায়ের রং সেই একইরকম রয়ে গেল। চাপা আর শ্যামলা। উলটে বেশি সাবানে কনুইয়ের কাছে অ্যালার্জির র্যাশ বেরোল।
পরিস্থিতি ভয়ংকর হল, ক্লাসের বন্ধুরা তখন রমলার এই অবস্থার কথা জেনে ফেলল। শুধু নিজের ক্লাসে নয়, ঘটনা ছড়িয়ে পড়ল গোটা স্কুলে। দিদিমণিরা পর্যন্ত জেনে গেল। রমলার একসময় মনে হতে লাগল, সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। আলোচনা করছে। সায়েন্স টিচার একদিন টিচারস রুমে ডেকে পাঠালেন। পিঠে হাত দিয়ে বললেন, ‘রমলা, কম্পিটিশন ভাল। কিন্তু জেলাসি ভাল নয়। তোমার সমস্যাটা যে আমরা বুঝতে পারছি না তা নয়। কিন্তু আইনস্টাইন বলেছিলেন…।’
একটা সময় রমলার মনে হতে লাগল, সে বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছে। নিজের নাম শুনলে চমকে উঠত। সারাদিন ভেতরে একটা ছটফট ভাব। রাতে ভাল করে ঘুম হয় না। ঘুম হলেও মাঝরাতে ভেঙে যায়। চোখের কোনায় কালি। স্কুল যাওয়া তার কাছে বিষের মতো মনে হচ্ছে। বেঁচে থাকাটাই যেন একটা দুঃস্বপ্ন।
মা বলল, ‘কী হয়েছে তোর? অ্যাঁ কী হয়েছে?’
রমলা চুপ করে থাকে। কী বলবে সে? আমি রমলা টু’র মতো হতে চাই মা। ওর মতো সুন্দর, ওর মতো লেখাপড়ায় সেরা, ওর মতো দৌড়ে প্রথম। আমি চাই, আমার হবু বর টোকিও বা নিউইয়র্কে বড় হোক। মা, আমি রমলা টু হতে চাই।
দার্জিলিঙে একবার ফোন করলে কেমন হয়? রনির সঙ্গে কাল রাতেই কথা হয়েছে। হোক কথা। ছেলের সঙ্গে কথা বলতে গেলে মেপে কথা বলতে হয় নাকি? তা ছাড়া ওদের এখন এক্সাম লিভ চলছে।
একেবারেই হস্টেলে ফোন পাওয়া গেল।
‘কী হল মা, এনিথিং প্রবলেম?’
‘না না, এমনি ফোন করলাম।’
‘এমনি করলে মানে? কাল রাতেই তো কথা হল।’
‘তাতে কী হয়েছে? কাল রাতে করেছি বলে কি আজ সকালে করতে পারি না?’
‘উফ, ডোন্ট টক সিলি মা। বাবা কোথায়? বাবাকে বলবে, কতগুলো রেফারেন্স লাগবে। আমি কাল ই-মেলে লিস্ট পাঠিয়ে দেব।’
‘সে হবেখন। জানিস রনি, আজ একটা মজার কাণ্ড হয়েছে।’
‘ওরে বাবা, মজার কাণ্ড শোনাতে তুমি এই সময় ফোন করলে? আমি এখন হিস্ট্রি পড়ছি। ক্লাস নাইনের হিস্ট্রি যে কী হরিবল জিনিস। এর মধ্যে মজার কাণ্ড শোনাবে?’
‘আহা শোন না। আজ আমার এক স্কুলের বন্ধু আমাকে ফোন করেছিল।’
‘এটাই তোমার মজার কাণ্ড! এর মধ্যে মজা কোথায়!’
‘মজা হল, সেই বন্ধুটার নামও রমলা। সবাই বলত রমলা টু। রমলা টু আমাকে সবকিছুতে হারিয়ে দিত। সবকিছুতে। হ্যালো, হ্যালো রনি…হ্যালো, হ্যালো।’ ফোন কেটে গেছে।
রমলা এবার সুনন্দর মোবাইলের নম্বর টিপল।
ভয়ংকর একটা মানসিক ঝড়ের মধ্যে ক্লাস এইটের অ্যানুয়েল পরীক্ষা শেষ হয়েছিল। খুব খারাপ পরীক্ষা দিল রমলা। শেষ দিন ছিল ভূগোল। পরীক্ষা দিতেই দিতেই বাথরুমে গিয়ে একবার বমি করে এল। সে নিশ্চিত, রমলা টু এবার ফার্স্ট হবে। শুধু সে কেন, সবাই জানে। তারপর? তারপরটা সে আর ভাবতেও পারছে না। ক’টা মাস নিজেকে রমলা টুয়ের মতো করে গড়ে তোলবার জন্য কতরকম চেষ্টাই না করছে। একটা কিছুতে তাকে ফার্স্ট হতে হবে। যে-কোনও একটা কিছুতে। সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। সে রমলা টু হয়ে যাচ্ছে। জিতে থাকা রমলা টু নয়, হেরে যাওয়া রমলা টু। কী হবে? সে কি আত্মহত্যা করবে?
সুনন্দর মোবাইলে চোস্ত ইংরেজিতে ভয়েস রেকর্ডার বেজে বলল— ‘নমস্কার, আমি সুনন্দ চ্যাটার্জি বলছি। আমি এখন ব্যস্ত। আপনি দয়া করে আপনার মেসেজ জানিয়ে রাখুন। কিছু পরেই আমি আপনাকে ফোন করছি।’
রমলা ফিসফিস করে ‘মেসেজ’ জানাতে লাগল। দীর্ঘ ‘মেসেজ’।
‘জানো সুনন্দ, আজ আমাকে আমার এক ছেলেবেলার বন্ধু ফোন করেছিল। অনেক ছেলেবেলার। সেই স্কুলের। তার নাম শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে। তার নামও ছিল রমলা। রমলা টু। কেউ রমলা বলে ডাকলে যাতে আমার সঙ্গে গুলিয়ে না যায় সেই জন্য রমলা টু। উনিশ বছর আগে এই রমলার কাছে এই রমলা সব বাপারে হেরে ভূত হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় নিজেকে রমলা টুয়ের মতো করে বানাবার জন্য কত পাগলামিই না করেছি। সবসময় ভাবতাম ওকে হারাতে হবে। একটা না একটা কিছুতে ওকে হারাতেই হবে। জানো সুনন্দ, লজ্জায়, অপমানে আমি একসময় সুইসাইডের কথাও ভেবেছিলাম। আর আজ কী মজা দ্যাখো, রমলা টু আজ আমার কাছে সাহায্য চাইছে। বলছে, রমলা আমায় বাঁচা। প্লিজ আমাকে বাঁচা। তুই না বাঁচালে দুই মেয়ে নিয়ে পথে ভিক্ষে করতে হবে। আমি সুইসাইড করব। মজার না? আমার তো খুব মজা লাগছে। যে-রমলার জন্য একদিন আমি সুইসাইড করতে যাচ্ছিলাম তাকে আজ আমিই বাঁচাব! ওকে আজই আসতে বলেছি। বিকেল চারটেতে আসবে। তাকে আমি সাহায্য করব। এতদিন পর আজ আমি তাকে হারিয়ে দেব। কী, দেব না?’
অ্যানুয়্যাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর আগে রমলার জ্বর এল। ধুম জ্বর। জ্বরের সঙ্গে তীব্র ডিলিরিয়াম। বিড়বিড় করে ভুল বকা— ‘না না, আমি রমলা, আমি রমলা টু, না না আমি রমলা টু নই, আমি রমলা টু, আমি রমলা…।’
আবছা মনে পড়ে, অনেক রাতে ডাক্তার ঘোষ এসে ইঞ্জেকশন দিলেন। বাবাকে গলা নামিয়ে বলে গেলেন, ‘আপনারা একজন সাইক্রিয়াটিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’
ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠতে গিয়ে রমলা টু ফার্স্ট হল। শুধু ফার্স্ট নয়, অন্তত তিনটে সাবজেক্টে রেকর্ড নম্বর পেল সে। ক্লাসে হইচই পড়ে গেল। কিন্তু রমলা টু স্কুলে এল না। সে আর কোনওদিনই এল না। খবর এল, তার বাবার আবার বদলি হয়েছে। এবার নাকি আরও দূরের কোন শহরে।
ক্লাসে আবার একজনই রমলা।
রমলা প্রথমে ভেবেছিল বিউটি পার্লারে যাবে, ফেশিয়াল করিয়ে আসবে। তারপর মনে পড়ে গেল, গত সোমবারই ফেশিয়াল করিয়েছে। তাই নিজেই ড্রেসিং টেবিলের সামনে সাজতে বসল। মেকআপের পর অনেক বাছাই করে একটা টিয়াপাখি রঙের ব্যোমকাই সিঙ্ক বের করে পরল। এই শাড়ি কেউ বাড়িতে পারে না। রমলা পরল। কুকিজারে ফোন করে কেক, পেস্ট্রি, প্যাটিসের অর্ডার দিল। প্রথমে তিন রকমের অর্ডার দিয়েছিল। আবার ফোন করে দুটো আইটেম বাড়িয়ে নিল। চিকেন অ্যাসপারাগস্ আর প্রন কাটলেট। তিনটের সময় রতনের মাকে ডেকে বলল, ‘ড্রইং রুমের দুটো এসিই চালিয়ে রাখো। আর শোনো রতনের মা, চারটের সময় আমার যে গেস্ট আসবে তাকে বলবে, আপনাকে বসতে হবে। বউদি ঘুমোচ্ছেন। উনি উঠলে খবর দেব।’
রমলা ঘুমোতে গেল না। সাজ শেষ করে সে ড্রয়ার হাতড়ে গাদাগুচ্ছের পুরনো ডায়েরি নোটবুক বের করল। উনিশ বছর পরেও স্কুলের বন্ধুদের ফোন নম্বর কোথাও লেখা থাকবে ভাবাটা অদ্ভুত। রমলা সেই অদ্ভুত কাজটাই করছে। অনিন্দিতা, এষা, মণীষা কারও নম্বর নেই তপতী পাণ্ডে বলে একজনের নাম পাওয়া গেল। কে তপতী পাণ্ডে? রমলার মনে পড়ছে না। তবু সে ডায়াল করল। কর্কশ গলায় একজন বলে উঠল, ‘বলুন, শিয়ালদা নর্থ পুলিশ স্টেশন বলছি।’
রতনের মা ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়াল। মানুষটা করে কী ? ভরদুপুরে মুখে রংচং মেখে মেঝের ওপর উপুড় হয়ে বসে আছে! ঘরময় ছেঁড়া খাতাবই, ধুলো, আর ঝুল। রতনের মা চোখ সরু করে তাকাল। বলল, ‘বউদি, সাজগোজা করে নোংরা ঘাঁটেন ক্যান?’
বসার ঘরে পা দিয়েই রমলা চমকে উঠল। এ কে? কে এ? একজন রোগা ফ্যাকাশে মহিলা বসে আছে। গায়ে একটা নীল শাড়ি। সবুজও হতে পারে। রং উঠে যাওয়ায় ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। শাড়ি টেনে ভাল করে গায়ে জড়ানো। চোখে চশমা! ফ্রেম বারবার ঝুলে পড়ছে। মাথা নামিয়ে বসে আছে সে। এসির ঠান্ডায় অল্প অল্প কাঁপছে কি? মহিলার দু’পাশে দুটি মেয়ে। সোফার কোনায় বসে আছে গুটিসুটি মেরে। তবে তারা মায়ের মতো মাথা নামিয়ে বসে নেই। দু’জনের চোখেই ভয়ভয় একটা ভাব। সস্তার ফ্রক পরেছে। বুকের কাছে জরি বসানো। ছোট জন ঠান্ডার চোটে হাঁটু মুড়ে প্রায় সোফার তলায় ঢুকিয়ে ফেলেছে। বড় মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে, ভয়ে সে ঠান্ডা গরমও আলাদা করতে পারছে না।
পায়ের শব্দে ফ্যাকাশে মহিলা ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অ্যাই, তোরা হাঁ করে দেখছিস কী? অ্যাঁ, দেখছিস কী? ওঠ, উঠে মাসিকে প্রণাম কর। ওঠ, ওঠ। বলছি না, এই মাসিটার নামও তোদের মায়ের মতো রমলা। হা হা। কেমন মজা, না?’
দুই রুগ্ণ মেয়ে যন্ত্রের মতো উঠে দাঁড়াল। রমলা বিড়বিড় করে বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে।’ এ কোন রমলা টু? কোথায় সেই টানাটানা চোখ? একমাথা চুল ? চোয়াল বসে গেছে। গায়ের রং রোদে পোড়া কালো।
রমলা অনেক কিছু ভেবে রেখেছিল। পরপর অনেককিছু। ঠিক করেছিল, প্রথমে রমলা টু’কে নিজের সুখের কথা সব গুছিয়ে বলবে। বরের ইনকাম ট্যাক্স, ছেলের টেনিস খেলা, তার ফুলের বুটিক— সব। তারপর তার দুঃখের কাহিনী শুনবে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করবে, বর কেন ফেলে পালাল, এখন চলে কী করে, একলা পেয়ে কেউ খারাপ ইঙ্গিত টিঙ্গিত করে কিনা— এইসব। সেই কাহিনী শুনতে শুনতেই গোটা ফ্ল্যাট ঘুরিয়ে দেখানো হবে। এমনকী, বাথরুম রান্নাঘর পর্যন্ত। খেতে দেওয়ার পর রতনের মা অ্যালবাম নিয়ে আসবে। রমলার বিদেশ ভ্রমণের ছবি দেখবে রমলা টু। হংকং ভ্রমণ দেখা হবে টিভিতে হ্যান্ড ক্যামেরার তার লাগিয়ে। সবশেষে সাহায্য পর্ব। টাকার খাম তুলে দেওয়ার সময় রমলা কী বলবে তাও রিহার্সাল দেওয়া আছে। বলবে, ‘দরকার হলে আবার ফোন করিস। লজ্জা পাস না একদম।’ টাকা ভরে খাম রেডি করা আছে।
রমলা এসব কিছুই করতে পারল না। সে ভাল করে কথাই বলতে পারছে না। শুধু হুঁ হাঁ করছে।
খাবারের প্লেট আসার পর মেয়েদের ওপর তাদের মা একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বলল, ‘অ্যাই, একদম নষ্ট করবি না। একদম না, নো ওয়েসটেজ। জিনিস নষ্ট করা কিন্তু তোমাদের রমলা মাসি একদম পছন্দ করে না। তাই না রমলা? ঠিক আছে যতটুকু পারবে খাও, বাকিটা তুলে রাখো। এঁটো করবে না। ঠিক আছে, রমলা মাসিকে বল একটা কৌটো দিতে। কাল তোদের স্কুলের টিফিন দিয়ে দেব। রমলা, ইস তুই কী যে করিস না। এত কিছু কেন আনালি রমলা? দ্যাখ, আমার স্কুলের বন্ধু আমাকে কত ভালবাসে দ্যাখ একবার। রমলা, আমি কিন্তু শুধু এই সন্দেশটা খাচ্ছি, বাকিটা নিয়ে যাব। তোর মনে আছে রমলা, অনিন্দিতাটা কী পেটুক ছিল। টিফিন বাক্স খুললেই ঝাঁপিয়ে পড়ত। মনে আছে তোর? একটা কৌটো দিতে বল না ভাই। ভাবিস না, আমি তোর কৌটো ফেরত দিয়ে যাব।’
ও এতবার রমলা রমলা করছে কেন? রমলার ভাল লাগছে না। অথচ কথা ছিল, তার ভাল লাগবে, খুব ভাল লাগবে।
অনেকক্ষণ হল ওরা চলে গেছে। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে রমলা। টেলিফোনটা বাজছে। বেজেই চলেছে। রমলা ধরছে না। তার মনে হচ্ছে, রিসিভার কানে নিলেই কেউ ওপাশ থেকে বলে উঠবে, ‘হ্যালো, হ্যালো, রমলা টু বলছেন? রমলা টু?’
রমলার ভয় করছে। খুব ভয় করছে। বারবার সে দরজার দিকে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এখুনি দরজা ঠেলে দুটো রোগা রুগ্ণ মেয়ে ঘরে ঢুকে পড়বে। অন্ধকারে তাদের মুখ ভাল করে দেখা যাবে না। শুধু ফ্রকের জরিগুলো জ্বলজ্বল করবে।