রমণীর মন
কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথি। দুপুর রাত্রে গাঁয়ের জমিদার বাড়িতে ডাকাত পড়ল। পঁচিশজন ঘোড়সওয়ার ডাকাত মশাল জ্বালিয়ে বাড়ি ঘেরাও করল।
জমিদার অবনীধর রায় নিজের শয়নকক্ষে সস্ত্রীক ঘুমোচ্ছিলেন, বাইরে গণ্ডগোল শুনে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি কড়া মেজাজের মানুষ, ভৃত্য পরিজনের বেয়াদপি সহ্য করেন না; ভাবলেন চাকর এবং দারোয়ানেরা মদ খেয়ে বাইরে হুল্লোড় করছে। তিনি ঘুমচোখে ঘরের দোর খুলে সদর বারান্দায় বেরিয়ে এলেন।
ডাকাতের সর্দার এবং তার কয়েকজন সঙ্গী ওত পেতে ছিল, তারা একসঙ্গে তাঁর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল। অবনীধর ধরাশায়ী হলেন। ডাকাতেরা তাঁকে টেনে তুলে দালানের একটা থামে দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধিল। জমিদারবাবু চিৎকার করে চাকরদের নাম ধরে ডাকতে লাগলেন কিন্তু কেউ এল না। ডাকাতের সর্দার অট্টহাসি হেসে বলল—‘কাকে ডাকছ? কেউ নেই, সব পালিয়েছে।’ তারপর নিজের দলের লোকদের বলল—‘লুট আরম্ভ কর। টাকাকড়ি সোনাদানা সব নেবে, বাজে মাল নেবে না। যাও।’
লুটপাট শুরু হয়ে গেল। ডাকাতের সর্দার জমিদারের শয়নকক্ষে প্রবেশ করল।
শ’খানেক বছর আগেকার ঘটনা। সিপাহী যুদ্ধের আগুন নিভেছে কিন্তু ছাই ঠাণ্ডা হয়নি। যেসব সিপাহী ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়েছিল তাদের মধ্যে অনেকেই শ্যাম-কুল দু’ই হারিয়েছে। বেশীর ভাগই যুদ্ধবৃত্তি ছেড়ে নিজের গাঁয়ে গিয়ে লুকিয়ে আছে, অল্পসংখ্যক সিপাহী ছোট ছোট দল তৈরি করে ডাকাতি করে বেড়াচ্ছে। তাদের মতলব লুটপাট করে কিছু অর্থ সংগ্রহ করবে, তারপর নতুন জায়গায় গিয়ে ভালমানুষ সেজে সংসার পেতে বসবে।
পশ্চিম বাংলার রাইনগর গ্রামে এইরকম একদল ডাকাত হানা দিয়েছিল।
রাইনগরের রায়েরা চার পুরুষে জমিদার। তাঁরা অপব্যয়ী ছিলেন না, চার পুরুষ ধরে অনেক ধনসঞ্চয় করেছিলেন; গ্রামে পাকা বাড়ি বাগান পুকুর দেবমন্দির করেছিলেন। অবনীধর রায় এই বংশের চতুর্থ পুরুষ; বয়স বেশী নয়, অনুমান পঁয়ত্রিশ বছর; যেমন তেজস্বী আকৃতি, তেমনি গম্ভীর রাশভারী প্রকৃতি। বাল্যকালে তাঁর একবার বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু কৈশোর অতিক্রম করবার আগেই সে-স্ত্রী মারা যায়; তারপর অনেকদিন বিয়ে করেননি। বছর পাঁচেক আগে দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করেছেন। নতুন স্ত্রী সরযূর বয়স এখন কুড়ি-একুশ। সন্তানাদি হয়নি। বেশ সুখে শান্তিতে দিন কাটছিল, হঠাৎ দুপুর রাত্রে ডাকাতদের আক্রমণ। যেন বিনা মেঘে বজ্রাঘাত। মুহূর্তমধ্যে সব তচনচ হয়ে গেল।
সরযূর ঘুম একটু দেরিতে ভেঙেছিল। সে আঁচল-খসা গায়ে বিছানায় উঠে বসে ব্যাকুল চোখে এদিক ওদিক চাইছিল। ঘরের কোণে ঘৃত-প্রদীপ জ্বলছিল; তারি মৃদুস্নিগ্ধ আলোয় সরযূকে দেখা যায়। গায়ের রঙ একটু চাপা, কিন্তু মুখ ও দেহের গড়ন অতুলনীয়। রজনীগন্ধার ছড়ের মতো কৃশাঙ্গী, কিন্তু সর্বাঙ্গে ভরা যৌবনের প্রাচুর্য। কাঁধে পিঠে চুলের ঢাল এলিয়ে পড়েছে।
বাঁ হাতে মশাল, ডান হাতে প্রকাণ্ড কাটারি নিয়ে একটা দৈত্যের মতো লোক ঘরে ঢুকছে দেখে সরযূ ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল—‘কে! কে তুমি! কি চাও?’
ডাকাতের সর্দার উত্তর দিল না, রক্তাভ চোখ মেলে খাটের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। সরযূ গলার মধ্যে অব্যক্ত শব্দ করে আঁচলে মুখ ঢাকল। এই ভীষণাকৃতি লোকটার দিকে তাকাতেও ভয় করে।
লোকটা খাটের পাশে এসে দাঁড়াল, কিছুক্ষণ সরযূর স্খলিত-বসন অর্ধনগ্ন দেহের পানে চেয়ে থেকে কর্কশ স্বরে বলল—‘মুখ খোলো, নইলে কাপড়ে আগুন লাগিয়ে দেব।’
কাঁপতে কাঁপতে সরযূ মুখ খুলল, কিন্তু চোখ বুজে রইল। লোকটা মশাল তার মুখের কাছে এনে ভাল করে মুখখানা দেখল, তারপর আগের মতোই কঠিন স্বরে বলল—‘এস আমার সঙ্গে। আমরা লুট করতে এসেছি, তোমাকেও লুটে নিয়ে যাব। আজ থেকে তুমি আমার।’
সরযূ বিভীষিকাপূর্ণ চোখ খুলে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ডাকাত সর্দার অমনি কাটারি উঁচিয়ে তাকে মারবার উপক্রম করল। সরযূ আর সহ্য করতে পারল না, অজ্ঞান হয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়ল।
ডাকাত সর্দার কাটারি কোমরে গুঁজে সরযূকে এক হাতে জড়িয়ে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে কাঁধে ফেলল, যেন তার দেহটা শিশুর দেহ। তারপর মশাল তুলে ধরে ঘরের বাইরে চলল।
বাড়ির অন্য ঘরগুলাতে নানারকম শব্দ হচ্ছে, খটাখট ঝনঝন। তার সঙ্গে ডাকাতদের কর্কশ চিৎকার। তারা বাক্স-পেটরা সিন্দুক ভেঙে লুট করছে।
এক ঘণ্টা পরে ডাকাতেরা পোঁটলা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল। তখন কৃষ্ণাষ্টমীর চাঁদ গাছের মাথা ছাড়িয়ে উঁচুতে উঠেছে। জমিদারবাবু থামে বাঁধা ছিলেন, সর্দার সরযূর সংজ্ঞাহীন দেহ কাঁধে নিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াল, অট্টহাসি হেসে বলল—‘আমরা চললাম জমিদারবাবু। তোমার বৌকেও নিয়ে চললাম। তুমি আবার বিয়ে কোরো।’
তারপর ডাকাতেরা মশাল নিভিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসল, চাঁদের আলোয় ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।
গ্রামের উত্তর দিকে ক্রোশখানেক দূরে বন আরম্ভ হয়েছে। দশ ক্রোশ জুড়ে ঘন শাল-পিয়ালের বন। ডাকাতেরা বনের মধ্যে প্রবেশ করল।
বনের মাঝখানে একটুখানি খোলা জায়গা। প্রকাণ্ড গাছগুলো যেন চারিদিক থেকে এগিয়ে আসতে আসতে মন্ত্রপূত গণ্ডীর বাইরে থেমে গেছে। ডাকাতেরা এইখানে এসে ঘোড়া থেকে নামল। চাঁদের আলো এখন বেশ উজ্জ্বল হয়েছে, মুখ চেনা যায়। ডাকাত সর্দার সরযূর অচৈতন্য দেহ এক পাশে ঘাসের উপর শুইয়ে দিয়ে অন্য ডাকাতদের বলল—‘ভাই সব, আজ আমাদের শেষ ডাকাতি। আজ আমরা যা লুট করেছি তাতে অনেকদিন চলবে। এস, লুটের মাল ভাগ করে নিই। তারপর যার যেদিকে ইচ্ছে চলে যাব, আর আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ হবে না।’
সকলে সায় দিল। তারপর লুটের সোনা রুপো গয়না টাকা মোহর সমান ভাগ করে যে-যার পুঁটলিতে বাঁধল, ঘোড়ায় চড়ে একে একে দু’য়ে দু’য়ে ভিন্ন ভিন্ন দিকে চলে গেল। রয়ে গেল কেবল সর্দার।
সকলে অন্তর্হিত হবার পর সর্দার সরযূর পাশে ঘাসের ওপর গিয়ে বসল। সরযূর দেহ শিথিল, মুখে গভীর নিদ্রার ভাবহীনতা; এখনো তার জ্ঞান হয়নি। সর্দার তার মুখের কাছে মুখ ঝুঁকিয়ে দেখল, বুকের মাঝখানে হাত রেখে বুকের ধুকধুকুনি অনুভব করল। তারপর তার দেহের ঊর্ধ্বভাগ সবলে টেনে নিয়ে নিজের বুকে চেপে ধরল।
এই সময় সরযূর জ্ঞান হলো। তার শরীরের স্নায়ুপেশী শক্ত হলো, সে চোখ খুলে চাইল, তারপর শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করল। তার শরীর আবার শিথিল হয়ে এলিয়ে পড়ল।
সর্দার সেই অবস্থাতেই সরযূকে পাঁজাকোলা করে তুলে উঠে দাঁড়াল, একবার চারদিকে ঘাড় ফেরাল। কেউ কোথাও নেই, কেবল ঘোড়াটা চাঁদের আলায় কিছু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সর্দার তখন সরযূকে বুকের কাছে নিয়ে একটা গাছের অন্ধকার ছায়ার দিকে চলল।…
রাত্রি শেষ হয়ে আসছে, চাঁদ পশ্চিম দিকে একটু ঢলেছে। বনের মধ্যে পাখিরা থেকে থেকে ডেকে উঠছে। সর্দার সরযূকে কাঁধে ফেলে গাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে এল। ঘোড়ার কাছে এসে এক লাফে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসল, তারপর উত্তর দিক লক্ষ্য করে ঘোড়া চালাল।
জমিদার অবনীধর রায় সারা রাত্রি থামে বাঁধা রইলেন। তাঁর চাকর-বাকর ডাকাতদের সাড়া পেয়ে পালিয়েছিল, তারা আর ফিরে এল না। ডাকাতের হাতে যদি বা প্রাণ বেঁচেছে, ফিরে এলে মালিকের হাতে প্রাণ যাবে। তারা দেশান্তরী হলো।
রাত্রে গ্রামবাসীরা সবাই জানতে পেরেছিল যে, জমিদারের বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, কিন্তু কেউ দোর খোলেনি। সুর্যোদয়ের পর যখন তারা নিঃসংশয়ে বুঝল যে, ডাকাতেরা চলে গেছে তখন গুটি গুটি এসে জমিদারের বাড়িতে উপস্থিত হলো। ডাকাত পড়েছিল শুনে তারা ঘোর বিস্ময় প্রকাশ করল, তারপর জমিদারবাবুর বন্ধন খুলে দিল। অবনীধর রায় গুরুতর আহত হননি বটে, কিন্তু তাঁর দেহ অক্ষত ছিল না। উপরন্তু তাঁর দেহের চেয়ে মনের ক্ষতই বেশী হয়েছিল। গ্রামবাসীরা যখন শুনল যে, ডাকাতেরা তাঁর স্ত্রীকে ধরে নিয়ে গেছে তখন তাদের বিস্ময় ও হাহুতাশ চতুর্গুণ বেড়ে গেল।
একজন মাতব্বর লোক বলল—‘কালে কালে এসব হচ্ছে কি! আগেও ডাকাত পড়ত কিন্তু তারা মেয়েমানুষের গায়ে হাত দিত না। এরা নিশ্চয় বাংলা দেশের ডাকাত নয়, চাষাড়ে খোট্টা ডাকাত, তাই এত আস্পর্ধা।’
জমিদারবাবু বললেন—‘ডাকাতের সর্দারকে আমি চিনতে পেরেছি।’
‘অ্যাঁ! চিনতে পেরেছেন! কে? কে?’
‘খগেশ্বর নন্দী।’
‘অ্যাঁ? খগা! খগা নন্দী! তার এই কাজ!’
দশ বছর আগে খগা ওই গ্রামেরই ছেলে ছিল। জন্মাবধি দূরন্ত এবং দুঃশীল, যতই তার বয়স বাড়তে লাগল ততই সে অসহ্য রকম দুরাচার হয়ে উঠল। তারপর একদিন সে এমন একটা অকথ্য দুষ্কার্য করল যে, জমিদার অবনীধরবাবু তাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিলেন। গ্রামে এক বুড়ি পিসী ছাড়া খগার কেউ ছিল না; সে গ্রাম ছেড়ে চেলে গেল, শহরে গিয়ে ইংরেজের সিপাহী দলে ভর্তি হলো। সেই থেকে গ্রামের লোক তার কোনও খবর রাখত না, এতদিন পরে আবার তার আবির্ভাব।
হপ্তাখানেকের মধ্যে জমিদারবাবু সুস্থ হয়ে উঠলেন। কিন্তু তাঁর মনের মধ্যে আগুন জ্বলছে। চার পুরুষের সঞ্চিত টাকাকড়ি সোনাদানা গিয়েছে যাক; জমিদারী আছে, টাকা আবার হবে। কিন্তু ডাকাত তাঁর স্ত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে এই মর্মদাহ নিরন্তর তাঁকে দগ্ধ করছে। সতীসাধ্বী সরযূ অবশ্য আত্মহত্যা করেছে; কিন্তু খগা যতদিন বেঁচে আছে ততদিন তাঁর বুকের আগুন নিভবে না।
অবনীধর রায় চারিদিকে গুপ্তচর পাঠালেন। অল্প দিনের মধ্যেই দু’তিন জন গুপ্তচর ফিরে এসে খবর দিল যে, ডাকাতের দল ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে, যার যেদিকে খুশি চলে গেছে। অনেক টাকা পেয়েছে, তারা আর ডাকাতি করবে না।
কিন্তু খগা নন্দী কোথায় গেছে কেউ খবর দিতে পারল না। জমিদার এক হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করলেন, তবু খগা নন্দীর পাত্তা পাওয়া গেল না।
জমিদার স্থিরবুদ্ধি লোক। তিনি বাছা বাছা চারজন ভোজপুরী জোয়ান জোগাড় করলেন; তারা এমন লোক যে খুন-জখমে পিছপাও হবে না। তাদের কর্তব্যকর্ম বুঝিয়ে দিয়ে তাদের হাতে একখানি করে কাটারি দিলেন, নিজের কোমরে তলোয়ার বাঁধলেন; তারপর পাঁচজনে ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে পড়লেন। ঘরে বসে খগা নন্দীকে ধরা যাবে না, গ্রামে গ্রামে, শহরে শহরে তাকে খুঁজে বেড়াতে হবে।
মাস তিনেক জমিদারের বাড়ি বন্ধ রইল, তারপর তিনি সঙ্গীদের নিয়ে ফিরে এলেন। খগেশ্বরকে পাওয়া যায়নি। বাড়ি ফিরে এসে তিনি মাসখানেক বিশ্রাম করলেন, তারপর আবার বেরুলেন। এইভাবে চলতে লাগল। মাসের পর মাস কাটল, বছরের পর বছর ঘুরে গেল, কিন্তু খগার সন্ধান মিলল না।
দেখতে দেখতে তিন বছর কেটে গেল।
রাইনগর থেকে আন্দাজ চল্লিশ ক্রোশ উত্তরে গঙ্গার কূলে একটি গ্রাম। গ্রাম না বলে পল্লী বললেই ভাল হয়। কুড়ি পঁচিশটি মাটির কুটির ঘিরে ক্ষেত খামার। পিছনে জঙ্গল, সামনে গঙ্গা। এই পল্লীর পূর্বদিকে ক্রোশ দুই দূরে গঙ্গার ধারে একটি ছোট নগর আছে।
পল্লীর অধিবাসীরা অর্ধসভ্য আদিম জাতির মানুষ। তারা চাষবাস করে, আবার তীরধনুক নিয়ে বনে শিকারও করে। কদাচিৎ গঙ্গায় তগি ফলে মাছ ধরে খায়; তাদের নৌকো নেই। কখনো বনের কাঠ কেটে নগরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে। এইভাবে তাদের বৈচিত্র্যহীন সংকীর্ণ জীবনযাত্রা নির্বাহ হয়।
খগেশ্বর কয়েক জায়গা ঘুরে শেষে সরযূকে নিয়ে এইখানে বাসা বেঁধেছিল। ঘন সন্নিবিষ্ট পল্লী থেকে একটু দূরে গঙ্গার পাড়ের ওপর কুটির তৈরি করেছিল। কুটির ঘিরে গঙ্গামাটির আল হাঁটু পর্যন্ত উঁচু, তার মধ্যে ছোট্ট একটুখানি শাকসজির বাগান।
পল্লীবাসীরা প্রথমে তাদের দেখে বেশ কৌতুহলী হয়েছিল; খগেশ্বর ছদ্মনামে নিজের পরিচয় দিয়ে তাদের সঙ্গে ভাব জমিয়েছিল; গাঁয়ের লোককে বলেছিল—সরযূ তার বৌ, কোনও দুষ্ট জমিদার সরযূর প্রতি কুদৃষ্টি দিয়েছিল, তাই সে বৌ নিয়ে পালিয়ে এসেছে। সরল পল্লীবাসীরা তাই বুঝেছিল এবং সহৃদয়তার সঙ্গে তাদের আশ্রয় দিয়েছিল।
জমিদারবাবুর অনুমান সত্য নয়, সরযূ আত্মহত্যা করেনি, বেঁচে আছে। কিন্তু তাকে দেখে মনে হয় সে অন্য মানুষ। আগে তার দেহ ছিল কোমল সুকুমার, এখন কঠিন হয়েছে; মুখে হাসি লেগে থাকত, এখন হাসি নেই, জীবনের কঠোর অভিজ্ঞতা মুখে ছাপ মেরে দিয়েছে। সে কোনোকালেই বেশী কথা বলত না, এখন একেবারেই কথা বলে না। তাকে দেখে মনে হয় কাঁচা মাটির পুতুলকে পুড়িয়ে শক্ত করা হয়েছে।
দুর্দান্ত স্বভাবের খগেশ্বর যখন সরযূকে হরণ করে নিয়ে যায় তখন তার মনে ছিল প্রতিহিংসা আর নারীলিপ্সা; সরযূকে চিরজীবন আঁকড়ে থাকার সংকল্প তার ছিল না; ভেবেছিল দু’চার দিন পরে তাকে কোথাও ফেলে রেখে চলে যাবে। কিন্তু কিছুকাল একসঙ্গে থাকার পর তার মনের ভাব আস্তে আস্তে বদলাতে লাগল। সরযূর রূপ-যৌবনের মোহ তার কাটল না, সে প্রচণ্ড আগ্রহে প্রাণপণে সরযূকে আঁকড়ে রইল; অন্য স্ত্রীলোক সম্বন্ধে তার মন নির্বিকার হয়ে গেল।
তাদের জীবনযাত্রা বড় বিচিত্র। এক পক্ষে দুর্মদ প্রমত্ততা, অন্য পক্ষে বাক্যহীন হাস্যহীন সমর্পণ। সরযূর যেন স্বাধীন ইচ্ছা নেই; খগেশ্বর যা বলে সে সজীব যন্ত্রের মতো তাই করে। খগেশ্বর তার দেহ দুই বাহুর মধ্যে নিয়ে নিষ্পেষিত করে, কিন্তু তার মনের মধ্যে কী হচ্ছে জানতে পারে না।—রমণীর মন।
কিছুদিন গঙ্গাতীরের কুটিরে কাটাবার পর একদিন খগেশ্বর সরযূকে বলল—‘একটা মতলব ঠাউরেছি। আমি নগরে যাচ্ছি, ফিরতে বেলা গড়িয়ে যাবে। তুমি রেঁধে বেড়ে রেখো, এসে খাব।’
সরযূ কোনও প্রশ্ন করল না, কেবল ঘাড় নাড়ল। খগেশ্বর টাকার গেঁজে কোমরে বাঁধল, কাঁধে চাদর ফেলে গঙ্গার ধার বেয়ে ভাটির মুখে চলল। এর আগে খগেশ্বর কখনো সরযূকে ছেড়ে বেশী দূর যায়নি। এখন সে বুঝেছে সরযূ তাকে ছেড়ে পালাতে পারবে না। কোথায় পালাবে?
দুপুর পেরিয়ে যাবার পর সরযূ ঘরের কাজ সেরে গঙ্গার ধারে গিয়ে বসল। সূর্যের তাপ বেশী নয়, গঙ্গার জলছোঁয়া ঝিরি ঝিরি বাতাস বেশ ঠাণ্ডা। সরযূ দূরের দিকে চেয়ে বসে রইল। চুলে একটু জট পড়েছে, প্রসাধনের কোনও চেষ্টা নেই; তবু তাকে দেখতে ভাল লাগে।
অনেকক্ষণ বসে থাকার পর সে দেখতে পেল, দূরে ভাটির দিকে গঙ্গার ধারা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেইখানে একটি জেলে ডিঙি দেখা দিয়েছে। ডিঙিতে কেবল একটি মানুষ, সে দাঁড় টানছে; সরযূর দিক থেকে তার পিঠ দেখা যাচ্ছে, মুখ দেখা যাচ্ছে না। ডিঙি আরো কাছে এলে সরযূ চিনতে পারল, মানুষটা খগেশ্বর, তার ঘামে-ভেজা গায়ে সূর্যের আলো চকচক করছে, দুই বলিষ্ঠ বাহুতে দু’টি দাঁড় ধরে সে উজান বেয়ে এগিয়ে এসেছে। সরযূর কপালে বিস্ময়ের রেখা পড়ল; সে সেইদিকে চেয়ে রইল।
প্রায় আধঘণ্টা পরে সরযূ যেখানে বসে ছিল সেইখানে খগেশ্বরের ডিঙি এসে লাগল। খগেশ্বর সরযূর দিকে ঘাড় ফিরিয়ে হা হা করে হেসে উঠল, তারপর বলল—‘এস এস, দাঁড়টা ধর।’ ডিঙির গলুই-এ বাঁধা একটা দড়ির প্রান্ত সরযূর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সে ডিঙি থেকে এক হাঁটু জলে নেমে পড়ল, তারপর ডাঙায় উঠে সরযূর হাত থেকে দড়ি নিয়ে ডিঙিটাকে টেনে বালির ওপর তুলল। সারাক্ষণ সে কথা বলে চলেছে—‘সাত টাকা দিয়ে ডিঙি কিনেছি। কেমন, সুন্দর নয়? ছোট বটে, কিন্তু নতুন; সোলার মতো হালকা, কিন্তু ভারি মজবুত। এই ডিঙিতে চড়ে গঙ্গায় মাছ ধরব। খেপলা জাল কিনেছি। মাছ ধরে নিজেরা খাব, গাঁয়ের লোকদের দেব; বেশী মাছ ধরলে নগরে বিক্রি করব। খুব ক্ষিদে পেয়েছে। নগরে একটা দোকানে জিলিপি আর কাঁচাগোল্লা খেয়েছিলাম, কিন্তু এতখানি দাঁড় টেনে সব হজম হয়ে গেছে। হা হা হা! তোমার জন্যেও মিষ্টি এনেছি, শাড়ি এনেছি, গামছা, আরো কত কী এনেছি—’
এর পর থেকে ওদের জীবনযাত্রায় একটা নূতনত্ব এল। দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া সেরে ওরা ডিঙিতে ওঠে, মাঝ গঙ্গায় গিয়ে মন্থর স্রোতের মুখে ডিঙি ভাসিয়ে দেয়। সরযূ ডিঙির গলুই-এ চুপ করে বসে থাকে, খগেশ্বর জাল হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। খেপলা জাল ফেলার কায়দা সে জানে; হাত ঘুরিয়ে জাল ছুঁড়ে দেয়, জাল চক্রাকার হয়ে জলে পড়ে। খগেশ্বর দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, জাল ডুবে গেলে আস্তে আস্তে দড়ি টেনে ডিঙির পাশে আনে।
জালে কখনো ছোট মাছ ওঠে : বাটা চেলা মৌরালা; কখনো বড় মাছ : রুই কাৎলা মৃগেল। বড় মাছ উঠলে খগেশ্বর আহ্লাদে আটখানা হয়ে যায়; সরযূর সাহায্যে মাছ জাল থেকে বের করে ডিঙির খোলের মধ্যে রেখে আবার জাল ফেলে।
এইভাবে জাল ফেলতে ফেলতে তাদের ডিঙি বাঁকের দিকে ভেসে চলে। যেদিন খগেশ্বর বড় মাছ পায় সেদিন নগরের ঘাটে গিয়ে ডিঙি বাঁধে। সরযূ ডিঙিতেই মুখে ঘোমটা টেনে বসে থাকে, খগেশ্বর মাছ বিক্রি করে। নিজেদের জন্যে একটা মাছ রেখে বাকি মাছ বিক্রি করে। ঘাটেই সব মাছ বিক্রি হয়ে যায়। খগেশ্বর বিক্রির পয়সা সিকি আধুলি যা পায় তাই দিয়ে বাজারে সওদা করে, হাসতে হাসতে ডিঙিতে ফিরে আসে, দাঁড় টেনে ঘরে ফিরে যায়।
যেদিন জালে চুনো মাছ ছাড়া আর কিছু ওঠে না সেদিন খগেশ্বর বাঁকের মুখ থেকেই ঘরে ফিরে আসে। নিজেদের জন্যে কিছু মাছ রেখে বাকি মাছ সরযূকে দিয়ে বলে, ‘যাও, গাঁয়ে বিলিয়ে এস।’
সরযূ গামছায় মাছ বেঁধে গাঁয়ে যায়, সেখানে ঘরে ঘরে মাছ বিলোয়। গাঁয়ের মেয়েরা কলকলিয়ে তার সঙ্গে গল্প করে, তাকে কলাটা মূলোটা দেয়; তাই নিয়ে সরযূ ফিরে আসে।
রাত্রির খাওয়া শেষ হলে সরযূ নদীতে গিয়ে বাসন মেজে আনে। তারপর তার রাত্রি কাটে খগেশ্বরের বাহুবন্ধনের মধ্যে।
এইভাবে একটি একটি করে বছর কাটতে থাকে। খগেশ্বর মাছ ধরে, সরযূ গৃহকর্ম করে। যে মেয়ে আগে কখনো নিজের হাতে জল গড়িয়ে খায়নি, সে রাঁধে, ঘর ঝাঁট দেয়, কাপড় কাচে, বাসন মাজে। আগেকার কথা তার মনে পড়ে কিনা কে জানে।
তিন বছর কেটে গেল।
আষাঢ় মাস আরম্ভ হয়েছে। আকাশে নতুন মেঘ, বিলেকবেলার দিকে বৃষ্টি নামে। গঙ্গায় ইলিশ মাছ দেখা দিয়েছে।
এইদিন ভোরবেলা খগেশ্বর সরযূকে নিয়ে মাছ ধরতে বেরুল। আকাশ মেঘে ঢাকা, ইলশে-গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। ইলিশ মাছ ধরার এই সময়।
চার-পাঁচ বার জাল ফেলতেই গোটা পঁচিশ ইলিশ জালে উঠল। খগেশ্বর অট্টহাসি হেসে বলল—‘আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম। চল ঘরে ফিরি। নগরে যাব না; গাঁয়ের লোকেরা আমাদের অনেক দেয় থোয়, আজ ওদের পেট ভরে ইলিশ মাছ খাওয়াব।’
ঘরে ফিরে সরযূ একটা মাছ কুটে রাঁধতে বসল। রান্না হলে খগেশ্বর ইলিশ মাছের রাই-ঝাল খেয়ে বিছানায় লম্বা হলো। সরযূ নিজে খেয়ে নদীতে বাসন মাজল। ততক্ষণ বেলা প্রায় তিন প্রহর। সরযূ তখন একটা চুবড়িতে ইলিশ মাছগুলি নিয়ে চুবড়ি কাঁখে গাঁয়ে গেল।
সরযূকে দেখে গাঁয়ের মেয়ের কলকোলাহল করে যে-যার ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ইলিশ মাছ পেয়ে সবাই আনন্দে দিশেহারা। মাছ ভাগ করে নিয়ে তারা বকুল গাছের তলায় সরযূকে ঘিরে গল্প করতে বসল। হাসি-গল্পে ঘণ্টাখানেক কেটে গেল।
কয়েকটি বালিকা গাঁয়ের দক্ষিণ প্রান্তের মাঠে খেলা করছিল। তারা হঠাৎ ছুটতে ছুটতে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল—‘ঘোড়ায় চড়ে পাঁচজন লোক আসছে।’
পাঁচজন ঘোড়সওয়ার! এমন অভাবনীয় ব্যাপার গাঁয়ে কখনো ঘটেনি। মেয়েরা বাঁধভাঙা জলের মতো সেইদিকে ছুটল। কেবল সরযূ একা বকুলতলায় বসে রইল।
‘ঘোড়সওয়ার’ শুনেই সরযূর মনে খটকা লেগেছিল। সে আস্তে আস্তে উঠে একটি কুটিরের পিছনে লুকিয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পরেই মেয়েদের কলকলানির সঙ্গে ঘোড়ার আওয়াজ শোনা গেল। সরযূ আড়াল থেকে কান পেতে শুনতে লাগল। তারপরই শুনতে পেলে একজন পুরুষের গম্ভীর গলা—‘এ গাঁয়ে খগেশ্বর নন্দী নামে কেউ থাকে?’
অত্যন্ত পরিচিত গলা। সরযূ আর দাঁড়াল না, সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে নিজের কুটিরের দিকে ছুটল।
খগেশ্বর তখনো চিত হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছিল, সরযূ ছুটে এসে তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল, তার বুকের ওপর হাত রেখে ব্যগ্র চাপা গলায় বলল—‘শুনছ? ওঠো ওঠো, ওরা আমাদের ধরতে এসেছে।’
খগেশ্বর তড়াক করে একেবারে উঠে দাঁড়াল। ঘুম-রাঙা চোখে চেয়ে বলল—‘কারা ধরতে এসেছে?’
সরযূও উঠে দাঁড়াল, পাংশু মুখে বলল—‘ওরা রাইনগর থেকে।’
‘জমিদার!’ দেয়ালের গায়ে খাঁড়ার মতো কাটারিটা ঝুলছিল, খগেশ্বর এক লাফে গিয়ে সেটা হাতে নিল। সরযূ ভয়ার্ত স্বরে বলল—‘না না, ওরা পাঁচজন ঘোড়ায় চড়ে এসেছে। ওদের সঙ্গে তুমি একলা পারবে না। চল আমরা পালিয়ে যাই।’ সরযূ খগেশ্বরের খুব কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
খগেশ্বর বলল—‘পালিয়ে যাব! কোথায় যাব?’
সরযূ বলল—‘চল ডিঙিতে করে গঙ্গার ওপারে চলে যাই।’
খগেশ্বরের মুখে আস্তে আস্তে একটা প্রকাণ্ড নিঃশব্দ হাসি ফুটে উঠল। সে এক খাবলায় সরযূকে শূন্যে তুলে নিয়ে নিজের বুকে চেপে ধরল, তারপর নামিয়ে দিয়ে বলল—‘চল পালাই।’
টাকার গেঁজে কোমরে বেঁধে নিয়ে, এক হাতে কাটারি অন্য হাতে সরযূর হাত ধরে সে গঙ্গার ধারে গেল; ডিঙি জলে ঠেলে দিয়ে ডিঙিতে দু’জনে উঠে বসল। খগেশ্বর দু’ হাতে দাঁড় নিয়ে জলে ডোবাল; ডিঙি তীরের মতো পরপারের দিকে ছুটে চলল। দুস্তর গঙ্গা, এপার থেকে ওপার দেখা যায় না।
জমিদার অবনীধর রায় গাঁয়ে খোঁজখবর নিয়ে খোলা তলোয়ার হাতে যখন গঙ্গার তীরে এলেন তখন ডিঙি অনেক দূর চলে গেছে। তার ওপর ছিপছিপ করে বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। আবছা আলোয় ধূসর জলের ওপর কেবল একটি কালো বিন্দু দেখা যায়।
২২ জুন ১৯৬৭