রবীন্দ্র রসের ফিল্মরূপ

রবীন্দ্র রসের ফিল্মরূপ

অনেকেই হয়তো মনে করতে পারেন মুনিঋষিদের মত পরিবর্তন হয় না; আজীবন একই বাণী প্রচার করে যান। আমি এ মত পোষণ করিনে। আমরা বিশ্বাস করি তাঁদেরও পরিবর্তন হয়, তবে আমার আরেকটি অন্ধবিশ্বাস, মত পরিবর্তন সত্ত্বেও তাঁদের একটি মূল সুর বরাবরই বজায় থাকে।

রবীন্দ্রনাথ যখন শান্তিনিকেতনে প্রথম বিদ্যালয় স্থাপন করেন তখন এটাকে ব্রহ্মচর্যাশ্রম বা ব্রহ্মবিদ্যালয় বলা হত। ছেলেরা জুতো পরত না, নিরামিষ খেত, ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণেতরের জন্য পৃথক পৃথক পঙক্তি ছিল; এমনকি প্রশ্ন উঠেছিল ব্রাহ্মণ ছাত্র কায়স্থ গুরুর পদধূলি নেবে কি না!

সেই শান্তিনিকেতনেই, রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায়ই পৃথক পৃথক পঙক্তি উঠে গেল, আমিষ প্রচলিত হল, গ্রামোফোন বাজল, ফিল্ম দেখানো হল। রবীন্দ্রনাথের তিরোধানের পূর্বেই শান্তিনিকেতন সত্যার্থে বিশ্বভারতী বা ইন্টারন্যাশনাল য়ুনিভার্সিটিরূপে পরিচিত হল। বস্তৃত এরকম উদার সর্বজনীন বাসস্থল পৃথিবীতে আর কোথাও নেই।

***

একদিকে তিনি যেমন চাইতেন আমাদের চাষবাসে ট্রটর এবং অন্যান্য কলকজা প্রচলিত হয়ে আমাদের ফসলোৎপাদন বৃদ্ধি করুক, অন্যদিকে ঠিক তেমনি ইয়োরোপের মানুষ কীভাবে অত্যধিক যন্ত্রপাতির নিপীড়নে তার মনুষ্যত্ব হারাচ্ছে সে সম্বন্ধে তার তীব্র মন্তব্য বিশ্বজনকে জানিয়ে গিয়েছেন। এ বিষয়ে তাঁর জীবনদর্শন কী ছিল তার আলোচনা কঠিন এবং দীর্ঘ; আমাদের সামনে প্রশ্ন– আজ যে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প, উপন্যাস, নাট্য, নৃত্যনাট্য ফিল্মে আত্মপ্রকাশ করছে সেটা কীভাবে করলে তিনি আনন্দিত হতেন?

এ-কথা সত্য, প্রথম যৌবনে তিনি গ্রামোফোনের প্রতি বিরূপ ছিলেন এবং পরবর্তীকালে তিনি তার জন্য গেয়েছেন। পিয়ানোযোগে তার একাধিক নাট্য মঞ্চস্থ হয়েছে অথচ তিনি হারমোনিয়াম পছন্দ করতেন না। ফিল্মের প্রতি তাঁর অবজ্ঞা ছিল না; এমনকি শুনেছি তার প্রাণ চায় চক্ষু না চায় গানটিতে তিনি যে সুর দিয়েছেন তাতে কিছুটা ফিলের রস দেবার চেষ্টা করেছিলেন। এবং আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী জাতীয় একাধিক গানে যে বিলিতি সুর আছে সে তো জানা কথা।

প্রথম দিন রেডিয়োর কথা।

আমার বিস্ময় বোধ হয়, কোন সাহসে রেডিও-নাট্যের প্রডুসার রবীন্দ্রনাটকের কাটছাঁট করেন।

গান, কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস প্রত্যেক রসবস্তুরই একটা নির্দিষ্ট আয়তন আছে এবং সেটি ধরা পড়ে রসবস্তুটি সর্বাঙ্গে সম্পূর্ণ হয়ে আত্মপ্রকাশ করার পর। আগুনের পরশমণিকে তিন ঘণ্টা ধরে পালা কীর্তনের মতো করে গাইলে তার রস বাড়ে না, আবার কোনও মার্কিন কোটিপতির আদেশে তাজমহলকে কাটছাট করে তার জাহাজে করে নিয়ে যাবার মতো সাইজ-সই করে দেবার চেষ্টাও বাতুলতা।

এই কিছুদিন পূর্বে বেতারে রবীন্দ্রনাথের একটি নাটক শুনছিলাম। এক ঘণ্টাতে সেটাকে ফিট করার জন্য তার ওপর যে কী নির্মম কাঁচি চালানো হয়েছিল সেটা সর্বকঠিন প্রতিবাদেরও বাইরে চলে যায়। শব্দে শব্দে ছত্রে ছত্রে, প্রশ্ন উত্তরে, ঘটনা ঘটনায় যতখানি সময় নিয়ে রবীন্দ্রনাথ একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি তুলে ধরলেন তাতে কাটছাঁট করলে যে কী রসভঙ্গ হয় সে শুধু ওইসব দাম্ভিকেরা বোঝে না। আমার মনে হয় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও যদি অতি অনিচ্ছায় কোনও কারণে রাজি হতেন ওটাকে ছোট করতে, তবে তাঁকেও বিষম বিপাকে পড়তে হত। স্থাপত্যের বেলা জিনিসটা আরও সহজে হৃদয়ঙ্গম হয়। আজ যদি পুরাতত্ত্ব বিভাগ তদারকির খরচ কমাবার জন্য তাজমহলটাকে আকারে ক্ষুদ্রতর করার চেষ্টা করেন তবে কী অবস্থা হয় চিন্তা করুন তো। কিংবা ফিল্মেরই উদাহরণ নিন। বছর পাঁচেক পূর্বে আমি একটা নামকরা বিদেশি ফিল্ম দেখে অবাক হয়ে বললুম, প্রত্যেক অংশই সুন্দর কিন্তু তবু রস জমল না। তখন খবর নিয়ে জানা গেল ফিলা বোর্ড এর ওপর এমনই নির্মম কাঁচি চালিয়েছেন যে, তার একটা বিপুল ভাগ কাটা পড়েছে। যেন মনে করুন তাজের গম্বুজ এবং দুটি মিনারিকা কেটে নেওয়া হলে পর তার যেরকম চেহারা দাঁড়াবে।

আমার প্রশ্ন, কী দরকার? দুনিয়ায় এত শত জিনিস যখন রয়েছে যেগুলো বেতারের সময় অনুযায়ী পরিবেশন করা যায় তখন কী প্রয়োজন সর্বাঙ্গসুন্দর জিনিস বিকলাঙ্গ করার। হনুমান হনুমানই সই, কিন্তু শিব কেটে ঠুটো জগন্নাথ করার কী প্রয়োজন?

দুই নম্বর : রবীন্দ্রনাথের নাট্যের শব্দ পরিবর্তন। কিছুদিন পূর্বে একটি নাট্যে এরকম পরিবর্তন শুনে কান যখন ঝালাপালা- বস্তুত কিছুক্ষণ শোনার পরই আমাদের মনে হল, এ ভাষা রবীন্দ্রনাথের হতেই পারে না এবং তাই বইখানি চোখের সামনে খুলে ধরে নাট্যটি শুনছিলুম–তখন এক জায়গায় দেখি ছাপাতে আছে কে তুমি এবং নাট্যে বলা হল তুমি কে?

এ দুটোর তফাত তো ইস্কুল-বয়ও জানে।

 নাট্যমঞ্চে হলে তবুও না হয় ভাবতুম, হয়তো নোট ভালো করে মুখস্থ করেননি, কিন্তু এ তো বেতারের ব্যাপার– ছাপা বই তো সামনে রয়েছে।

পুনরায় প্রশ্ন করি, কী প্রয়োজন, কী প্রয়োজন? জানি পনেরো আনা শ্রোতা ভাষা সম্বন্ধে অত সচেতন নয়, কিন্তু যেখানে কোনও প্রয়োজন নেই সেখানে এক আনা লোককেই-বা কেন। পীড়া দেওয়া?

তিন নম্বর– এবং সেইটেই সবচেয়ে মারাত্মক!

রবীন্দ্রনাথের একটি গল্পকে নাটক করা হয়েছে। গল্পটি গত শতকের শেষের কিংবা এই শতকের গোড়ার পটভূমিতে আঁকা এবং নিম্ন মধ্যবর্তী শ্রেণি নিয়ে লেখা। বাপ-মায়েতে ঠিক হয়েছে অমুকের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে দেওয়া হবে। তখন বাপ তাঁর স্ত্রীকে শুধোচ্ছেন, তোমার মেয়ে কী বলে? মা যে কী ন্যাকরার সুরে বললে সে অবর্ণনীয়– ওকে জিগ্যেস করবে কী? সে তো সকাল-বিকাল ওরই ঘরে ঘুর ঘুর করছে। সক্কলের পয়লা কথা, সে যুগে মেয়েকে বিয়ের পূর্বে ওরকম জিগ্যেস করা হত না, সে কাকে বিয়ে করতে চায়, দ্বিতীয়ত, মেয়ের প্রেমে পড়া নিয়ে সে যুগে বাপে-মায়ে এরকম ন্যাকরা করে কথা বলা হত না।

আমার কাছে এমনি বেখাপ্পা লাগল যে, আমি কিছুতেই বুঝতে পারলুম না রবীন্দ্রনাথের পক্ষে এ জিনিস কী প্রকারে সম্ভব। তখন উঠে বই খুলে পড়ে দেখি, মেয়ের মতামত জানবার জন্য বাপ-মায়েতে এই কথোপকথন গল্পটিতে আদৌ নেই।

সস্তা, কুরুচিপূর্ণ, ন্যক্কারজনক বাজে নাটক শুনে শুনে আমাদের রুচি এমনই বিগড়ে গিয়েছে যে, প্রসার মনে করেন যে প্রচুর পরিমাণে ন্যাকামোর লঙ্কা-ফোড়ন না দিলে আমরা আর কোনও জিনিসই সুস্বাদু বলে গ্রহণ করতে পারব না। দোষ শুধু প্রডুসারের নয়, আমাদেরও।

তবে প্রশ্ন উঠতে পারে : স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই অনেক কিছু করেছেন।

যেমন মনে করুন শ্যামা নাট্য তাঁর পরিশোধ কবিতার ওপর গড়া। আবার পরিশোধের প্লটটি জাতক থেকে নেওয়া। তাতেও আবার রবীন্দ্রনাথ মূল প্লটকে শেষের দিকে খানিকটা বদলে দিয়েছেন। এ স্থলে বক্তব্য, জাতকের গল্পেতে থাকে শুধু প্লটই। সেখানে অন্য কোনও রসের পরিবেশ থাকে না বলে সেই প্লট নিয়ে কৃতকর্মা রনির্মাতা গল্প উপন্যাস নাট্য নির্মাণ করতে পারেন। অর্থাৎ দেবীর কাঠামোর উপর মাটি-কাদা-রঙ লাগিয়ে প্রতিমা নির্মাণ করা এক কথা– সেটা সহজও, যে-যার খুশিমতো করে তাকে সুন্দর করতে পারলেই হল–কিন্তু প্রস্তুত প্রতিমার উপর আরও মাটি লাগিয়ে হাত দুটিকে আরও লম্বা করা, কিংবা দশ হাতের উপর আরও দুটি চড়িয়ে দেওয়া, সে সম্পূর্ণ অন্য কথা। দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রনাথ তাঁর পরিশোধকে শ্যামাতে পরিবর্তিত করতে পারেন, তার সে শক্তি আছে। সেরকম শক্তিমান আমাদের ভিতর কই? এবং আমার মনে হয় সেরকম শক্তিমান ফিল্ম ডিরেক্টর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে টানা-হাচড়া না করেও এমন প্লট অন্যত্র পাবে সেখানে সে তার জিনিয়াস, তার সৃজনীশক্তি আরও সহজে, আরও সুন্দর করে দেখাতে পারবে।

জাতক পড়ুন, জাতক পড়ুন, জাতক পড়ন। ওর মতো ভাণ্ডার কোনও ভাষাতেই নেই। এবং রবীন্দ্রনাথ কীভাবে জাতকের প্লট নিয়ে কবিতা এবং নাট্য করতেন সেই টেকনিকটি রপ্ত করে নিন।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *