রবীন্দ্র রচনাবলি

রবীন্দ্র রচনাবলি

রবীন্দ্র রচনাবলি/জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণ। বিশ্বভারতীর সৌজন্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষে শিক্ষাসচিব শ্রীধীরেন্দ্রমোহন সেন কর্তৃক প্রকাশিত/২৫ বৈশাখ ১৩৬৮ বিশ্বভারতীর কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে গ্রন্থ সম্পাদনের সহায়তা করেছেন শ্রীপ্রবোধচন্দ্র সেন, শ্রীপ্রমথনাথ বিশী, শ্রীবিজনবিহারী ভট্টাচার্য, শ্রীহীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও শ্রীঅমিয়কুমার সেন।

রবীন্দ্র রচনাবলি সদ্য প্রকাশিত দুই খণ্ড যে আমার এবং আমার মতো রবীন্দ্রানুরাগী বহু সহস্র পাঠকের মনে কী গভীর পরিতৃপ্তি : সৃষ্টি করেছে সেটি এই অবকাশেই প্রকাশ না করলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তথা বাঙালি জনমতের প্রতি বিলক্ষণ অবিচার করা হবে। উভয়েরই কৃতিতু সমান। রবীন্দ্ৰশতাব্দী উপলক্ষে সুলভ রবীন্দ্র রচনাবলি প্রকাশিত হোক, এই ঐকান্তিক ও ঐক্যবদ্ধ কামনা দেশের কাগজে কাগজে প্রকাশিত হয়েছে; আমরা, যাদের কথার কোনও মূল্যই নেই, যতদূর সম্ভব অনুনয়-বিনয় করেছি কর্তৃপক্ষের কাছে, উৎসাহ দিয়েছি যারা বাঙালির হয়ে তাঁদের কামনাটি বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে জানিয়েছেন। অবশ্য বলে রাখা উচিত, এই উভয় কর্তৃপক্ষের ভিতর বিস্তর রবীন্দ্রানুরাগীও আছেন যারা এই সুলভ রচনাবলি প্রকাশের জন্য জনমত তৈরি হওয়ার পূর্বেই এ ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন। বলা বাহুল্য, এঁদের সকলেই বিস্তর বিরুদ্ধাচরণ অতিক্রম করে আজ সাফল্যের দ্বারে এসে পৌঁছেছেন। বলা আরও বাহুল্য বিরুদ্ধাচারীগণ যে রবীন্দ্রভক্ত নন একথা বললে অন্যায় বলা হবে। কী কারণে তারা এ প্রস্তাব অনুমোদন করেননি সে প্রসঙ্গ এস্থলে নিষ্প্রয়োজন।

এই দুই খণ্ড যে ছাপা, বাঁধাই, কাগজ, ছবি, কবির হস্তলিপি ইত্যাদি নিয়ে অনবদ্য সে-বিষয়ে কোনও তর্কের অবকাশ নেই।

কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, প্রথম আড়াই বা তিন খণ্ডেই আমরা কবির তাবৎ কবিতা ও প্রচুর গান একসঙ্গে পেয়ে যাচ্ছি। যারা প্রাচীন রচনাবলি নিয়ে কাজ করতেন তারাই জানেন রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা বের করতে আমাদের কী বেগই না পেতে হত। কোনও বিশেষ ছোটগল্প, নাট্য, বা প্রবন্ধ নিয়ে প্রায় ওই একই অসুবিধায় পড়তে হত। এই দ্বিতীয় অসুবিধাটিও বর্তমান রচনাবলি দূর করে দেবে– কারণ এতে প্রাচীন রচনাবলির মতো চার রকমের জিনিসের (১. কবিতা ও গান, ২. নাটক ও প্রহসন, ৩. উপন্যাস ও গল্প, ৪. প্রবন্ধ) পঁচমেশালি থাকবে না।

আমি রবীন্দ্রসৃষ্টির বিশেষজ্ঞ নই, কিন্তু আরও বহু বঙ্গসন্তানের মতো রবীন্দ্রনাথের কোনও বিশেষ কবিতা পাঠ করে ভাবোদয় হলে সেটা তাদেরই মতো প্রকাশ করতে চেয়েছি। এ যাবৎ সেটাও করতে পারিনি তার কারণ ওই ছাব্বিশ খণ্ড নিয়ে রেফেরেন্স খুঁজে বেড়ানো আমাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। আমার শোক– নবীন রচনাবলিখানা কুড়ি বৎসর পূর্বে পেলে হয়তো এই নিয়ে কোনও বৃহৎ কাজে হাত দিতে পারতুম। বক্তব্য একটু ব্যক্তিগত হয়ে গেল, কিন্তু আমার একাধিক অনুরাগী পাঠক এই নিয়ে ফরিয়াদ করেছেন বলেই এই সাফাইটি গাইতে হল। আমি কিন্তু প্রাচীন রচনাবলির নিন্দা করার উদ্দেশ্য নিয়ে এ প্রবন্ধিকা লিখতে বসিনি– যারা চার রকমের লেখা পাঁচমেশালি করেছিলেন তাঁদের উদ্দেশ্য শুভই ছিল, সে বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই।

এখন প্রশ্ন, নবীন রচনাবলির সম্পাদনা কীরকমের হয়েছে। আমি বলব উত্তম, অতি উত্তম। কিন্তু সর্বাঙ্গসুন্দর সম্পাদনা হতে এখনও একশো কিংবা দুশো বছর লাগবে। কারণ এ কাজ দশজন পণ্ডিতকে দশ বছর খাঁটিয়ে নিলেই হয় না।

প্রথমত, কবির তাবৎ প্রকাশিত রচনাবলির প্রথম প্রকাশের ফোটোস্টাট, তাঁর জীবিতাবস্থায় তিনি যেসব পরিবর্তন করেছিলেন সেসব এবং তার পাণ্ডুলিপি (এগুলো সংগ্রহ করতে কতদিন লাগবে, কেউ বলতে পারে না) যেমন যেমন পাওয়া যাবে তারও ফোটোস্টটি (অন্য একটা নতুন সস্তা পদ্ধতিও হালে বেরিয়েছে) বের করতে হবে। তাদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে কবির দেহত্যাগের পর যেসব পুনর্মুদ্রণ এবং নতুন সংস্করণ বেরিয়েছে তাতে যেসব পরিবর্তন করা হয়েছে সেগুলো পাণ্ডুলিপি-সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত হয়েছে কি না। এখন এ কাজ সম্ভব নয়। ত্রিশ বৎসর পর যখন এসব পুস্তকের ওপর কারও কোনও কপিরাইট থাকবে না, তখনই উৎসাহী, অগ্রণী নানা প্রকারের প্রকাশক নানারকম জিনিস প্রকাশ করে পণ্ডিতদের সামনে তুলে ধরবেন। তারা বাঙলার ভিতরে-বাইরে বসে বসে যেসব গবেষণা প্রকাশ করবেন সে সমস্ত যাচাই-বাছাই করে ধীরে ধীরে তৈরি হবে প্রামাণিক সংস্করণ। একটি তুলনা দিই; জর্মন কবি হাইনরিশ হাইনের মৃত্যু শতাব্দী উদযাপিত হয়েছে বছর পাঁচেক পূর্বে (আমরা রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী করছি এখন) এবং আজও তাঁর চিঠিপত্র মুদ্রিতাকারে প্রকাশিত হচ্ছে। কবে শেষ হবে, অনুমান করা কঠিন।

নবীন রচনাবলির সম্পাদকগণ এ ধরনের কাজে হাত না দিয়ে যে প্রাচীন রচনাবলি যেভাবে ছাপা হয়েছিল মোটামুটি সেভাবেই ছেপেছেন সেইটেই করেছেন ভালো। মোটামুটি কথাটা বোঝাবার জন্য একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ দিই; প্রাচীন রচনাবলির একাদশ খণ্ডে, গীতাঞ্জলি পুস্তকে আছে

কত অজানারে জানাইলে তুমি,
কত ঘরে দিলে ঠাঁই
দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু,
পরকে করিলে ভাই।

গীতবিতানেও তাই কিন্তু ব্রহ্ম-সঙ্গীতে নিকটর পর কমা নেই অর্থাৎ নিকট-বন্ধুরূপে পড়া যেতে পারে। আমরাও ছেলেবেলায় ওই অর্থে পড়েছি- বন্ধুকে ভকেটিভ কেসে নিইনি। জন্ম শতবার্ষিক সংস্করণের (২য় খণ্ড, ২১৬ পৃষ্ঠায়) পাচ্ছি নিকট বন্ধু, মাঝখানে কমা নেই। অর্থাৎ ব্রহ্মসঙ্গীতেও আমরা ছেলেবেলায় যেটি শুনেছি সেই পাঠ কবিতাটির পাণ্ডুলিপি রবীন্দ্র সদনে নেই। ওদিকে ওই সদনের জনৈক দায়িত্বশীল কর্মচারী আমাকে বলেছেন, তিনি রবীন্দ্রনাথের আপন হাতে অটোগ্রাফ বইয়ে লেখা এই কবিতাটিতে নিকট ও বন্ধুর মাঝখানে কমা পেয়েছেন।

নবীন সংস্করণের সম্পাদকগণ কমা না দিয়ে ভালো করেছেন না ভুল করেছেন সেটা পরবর্তীকালে হয়তো স্থির হবে। উপস্থিত এই পাঠটি দেওয়াতে, আমাদের ভিতর যে আলোচনা হত সেটি সজীব রইল, এবং আরও পাঁচজনের সামনে প্রকাশ পেল।

প্রাচীন সংস্করণ কপি করাতে নবীন সংস্করণে আরও কিছু কিছু অসম্পূর্ণতা থেকে যাবে সন্দেহ নেই, কিন্তু পূর্বেই বলেছি গত্যন্তর ছিল না। যেমন প্রাচীন রচনাবলি পূরবী পুস্তকের দুঃখ-সম্পদ কবিতাটি শেষ হয়েছে, তখন বুঝিতে পারি আপনার মাঝে। আপন অমরাবতী চিরদিন গোপনে বিরাজে। কিন্তু রবীন্দ্র সদনে সুরক্ষিত ওই পুস্তকের পাণ্ডুলিপিতে এরপর আরও ছয়টি ছত্র আছে–

যখনি কুঁড়ির বক্ষ, বিদীর্ণ করিয়া দেয় তাপে,
তখনি ত জানি, ফুল চিরদিন ছিল ভাপে।
 দুঃখ চেয়ে আরো বড় না থাকিত কিছু
জীবনের প্রতিদিন হত মাথা নীচু
তবে জীবনের অবসান
মৃত্যুর বিদ্রূপ হাস্যে আনিত চরম অসম্মান।

দু একটি শব্দের তফাত নয় বলে এ কয়টি লাইনের বিশেষ মূল্য আছে ও প্রাচীন রচনাবলির গ্রন্থ পরিচয় দেওয়া আছে। যদিও বাজারে প্রচলিত ভাদ্র ১৩৬৩ পুনর্মুদ্রণের পূরবীতে নেই।

ঠিক সেইরকম বানান, সমাসবদ্ধ শব্দ লেখার পদ্ধতি নিয়েও নানা কথা উঠবে, নানা আলোচনা হবে। কিন্তু বর্তমান সম্পাদকগণ সেদিকে না গিয়ে ভালোই করেছেন। প্রাচীন রচনাবলি নানা প্রতিকূল অবস্থার মাঝখানে সম্পাদিত ও মুদ্রিত হয়েছিল। তাতে অনেক বিষয়ে অনেকের মতান্তর থাকবে। আমরা চেয়েছিলুম, সেই প্রাচীন সংস্করণেরই একটি সুলভ, কবিতা গল্প ইত্যাদি আলাদা আলাদা করা হ্যাঁন্ডি সংস্করণ। তাই পেয়েছি।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *