রবীন্দ্র প্রসঙ্গে
রবীন্দ্রসাহিত্য আমাদের সংস্কৃতি-বিধ্বংসী বলে যে কথা উঠেছে, যে আশঙ্কা আমাদের জাতি-প্রাণ বুদ্ধিজীবীদের মনে জেগেছে, তা নিরসনের জন্যে রবীন্দ্রসাহিত্যানুরাগী আর একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। তাঁদের সদিচ্ছা নিশ্চয় শ্রদ্ধেয়। তাদের কল্যাণকামী হৃদয়ের অকৃত্রিম আকুলতা সহানুভূতিও জাগায়। কিন্তু তাদের সদিচ্ছা সৎসাহসপুষ্ট নয়–এবং সদিচ্ছার সঙ্গে সৎসাহসের যোগ না হলে সাফল্য থাকে অসম্পূর্ণ; এমনকি স্থান-কাল বিশেষে সাফল্য অর্জন হয় অসম্ভব।
রবীন্দ্রসাহিত্য যে আমাদের অকল্যাণের নয় বরং আমাদের মনুষ্যত্ব ও মানবতাবোধ বিকাশের সহায়ক–এই কথা বুঝিয়ে বলবার জন্যে তারা যে-সব যুক্তির অবতারণা করেন আর যে-সব তথ্য ও তত্ত্ব উপস্থিত করেন, তাতে তাঁরা তাঁদের অজ্ঞাতেই রবীন্দ্রনাথকে করেন অপমানিত আর নিজেরা বরণ করেন কৃপাজীবীর লজ্জা।
তারা প্রতিবাদের দ্বারা প্রতিরোধ করতে চান না, তারা অনুগ্রহকামীর মন-বুদ্ধি নিয়ে হুজুরের দরবারে তদবিরে নিরত। বিরোধীদের ক্ষমা ও প্রশ্রয়বাঞ্ছায় তারা পেশ করেন আবেদন-নিবেদন, যাঞা করেন কৃপাদৃষ্টি। তাই তারা সভায় ও লেখায় বলে চলেছেন; রবীন্দ্রনাথের পিতা ছিলেন হাফিজের কাব্যের অনুরাগী, রবীন্দ্রনাথে বর্তেছে সে-প্রভাব, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম, আর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সূফীকবি, মুসলিম বিদ্বেষ তাঁর ছিল না, নিন্দাও করেননি কোথাও। তিনি টুপি ইজার আলখাল্লা পরতেন, আর সযত্নে লালন করতেন দাড়ি। মোঘলাই পরিবেশ ছিল ঠাকুর পরিবারে। অতএব রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রায় তৌহিদবাদী ও আধা মুসলমান। কাজেই হুজরান দয়া করে আমাদের শুনতে দিন রবীন্দ্রসঙ্গীত, পড়তে দিন রবীন্দ্রসাহিত্য। এখন মহামহিমদের সুমর্জি, ক্ষমাসুন্দর হুকুম ও সদয়প্রশ্রয়ের অপেক্ষায় রয়েছেন তারা আসামীর দুরু দুরু বুকের কাপুনি ও আশা নিয়ে। নির্দোষ বলে প্রমাণ করার জন্যে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ভীরুহৃদয়ের এই সদিচ্ছা রবীন্দ্রনাথকে অপমানিত করতে বাকি রাখল কি? বরং রবীন্দ্র-বিরোধীরাই তাঁকে যথার্থ সম্মান দেন। কেননা, তাঁর অমিত শক্তি ও সর্বগ্রাসী প্রভাব স্বীকার করেন বলেই তারা ভীত। তারা সূর্যের প্রচণ্ড তাপ স্বীকার করেন বলেই অন্ধকারের প্রাণীর মতো তারা আত্মরক্ষার ভাবনায় বিচলিত।
মহত্মনের স্পর্শকামী এইসব মানবতাবাদী যদি রবীন্দ্রসাহিত্য বিরোধিতা প্রতিরোধ প্রয়াসে সৎসাহসের সঙ্গে প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসতেন, তাহলে তাদের মুখে শোনা যেত অন্য যুক্তি। তারা বলতে পারতেন–আমাদের কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান থেকে ইসলামী শাস্ত্র অবধি সব বিদ্যাই দান করা হয় বিদেশী, বিজাতি ও বিধর্মী য়ুরোপীয় বিদ্বানদের গ্রন্থ পড়িয়ে। চীন-রাশিয়ার নাস্তিক্য সাহিত্যই আজ পাকিস্তানে জনপ্রিয় পাঠ্য। আমেরিকার যৌন-গোয়েন্দা সাহিত্যে আজ বাজার ভর্তি। বিদেশীর, বিজাতির ও বিধর্মীর সাহিত্য অনুবাদের জন্যে দেশে গড়ে উঠেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান। খ্রীস্টান য়ুরোপের আদর্শে জীবন রচনার সাধনায় আজ সারাদেশ উন্মুখ। য়ুরোপীয় আদলে জীবনযাপন করে অসংখ্য লোক কৃতাৰ্থমন্য। য়ুরোপ আজ কামনার স্বর্গলোক। তাছাড়া ইমরুল কএস থেকে হাতেমতাই, এবং দারান-ওশেরোয়া থেকে রুস্তম অবধি সব আরব-ইরানী কাফেরই আমাদের শ্রদ্ধেয়। এতসব উপসর্গ বেষ্টিত হয়েও আমাদের ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতি বিলোপের আশঙ্কা করিনে। কেবল দেশী কাফের রাম থেকে রবীন্দ্রনাথকেই আমাদের ভয়। অথচ এই রাম রবীন্দ্রনাথের দেশেই তাঁদের জ্ঞাতিরাই বরণ করেছে ইসলাম। এঁদের দেখে-শুনে-জেনেও বিচলিত হয়নি মুমিনের ইমান। পাশে থেকেও প্রভাবে যে পড়েনি তার প্রমাণ আজকের মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। তাহলে হাজার বছরের পুরোনো মুসলমান সন্তানদের ধর্ম-সংস্কৃতি হারানোর এই ভয় কেন?
অতএব, রবীন্দ্রবিরোধিতার মূলে সংস্কৃতিধ্বংসের আশঙ্কা নয়, রয়েছে অন্য কিছু। তা যদি রাজনৈতিক স্বার্থ কিংবা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিষয়ক হয়, তা হলে আমাদের বুঝিয়ে বলেন না কেন তারা? আমাদের স্বাজাত্যবোধ দেশপ্রেম কিংবা রাষ্ট্রানুগত্য কি কারো চেয়ে কম যে তাঁরা আমাদের প্রতি সন্দিহান হয়ে আমাদের অপমানিত করবার অধিকার নেবেন! আমরা যদি উপলব্ধি করতে পারি কিংবা তারা যদি আমাদের বুঝিয়ে দেন যে রবীন্দ্রসাহিত্য আমাদের রাজনীতি ও রাষ্ট্রের পক্ষে ক্ষতিকর, তা হলে আমরা নিশ্চয়ই বর্জন করব রবীন্দ্রসাহিত্য। দেশের স্বার্থে এমনকি প্রয়োজন হলে নিজের সন্তানকেও বর্জন করতে রাজি। কিন্তু এ তো হুকুমে হবার কাজ নয়–জানা-বুঝার ব্যাপার। তারা এগিয়ে আসুন, আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিন। আমরা কি এতই পাপাত্মা যে দেশের স্বার্থ বুঝব না! –এমনি সব তথ্য, তত্ত্ব ও যুক্তির অবতারণা করতে পারতেন তারা। আর যদি শ্রেণীস্বার্থের কারণেই ঘটে রবীন্দ্রবিরোধিতার উদ্ভব, তাহলে আমাদের স্বার্থেই প্রতিকার প্রয়োজন। সে-প্রতিকারের পথে যদি আঘাত নেমেই আসে, তবে ধৈর্য, দৃঢ়তা ও সাহসের সঙ্গে সইতে হবে সে আঘাত। কেননা, ছলনা দিয়ে ছলনার প্রতিকার হয় না। পরস্বাপহারীর হৃদয় গলে না অনুনয়ে। কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে রাখলেই শুকায় না দুষ্টক্ষত কিংবা বন্ধ হয় না। মিথ্যার প্রলেপে ঢাকা যায় না মিথ্যাকে। বেদনা সয়েই ব্যবস্থা করতে হয় বেদনা উপশমের। সমস্যা এড়িয়ে চললে সমস্যা বাড়েই–সমাধান হয় না। অস্ত্রোপচারে যন্ত্রণা বাড়িয়ে যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হতে হয় কোনো কোনো রোগে। এরূপ ক্ষেত্রে কল্যাণবুদ্ধি ও মমতাই যোগায় নির্মম হবার প্রেরণা। আপাত নিষ্ঠুরতা অনেকক্ষেত্রেই গভীর করুণার পরিচায়ক।
রবীন্দ্রনাথ মানবতার প্রমূর্ত প্রতিনিধি। মানবকল্যাণের দিশারী। আমাদের গরজেই আমরা রবীন্দ্রসাহিত্যের পাঠক। সে-গরজ যদি হয় গুরুতর, তা হলে আমাদের প্রতিকার-প্রয়াসও হবে তীব্র। এভাবে সখের প্রেরণায় সৌখিন ক্ষোভ ও বেদনা প্রকাশ করে রবীন্দ্রনাথকে অপমানিত করবার অধিকার নেই আমাদের।