রবীন্দ্রসাহিত্যে সংস্কৃত প্রভাব

রবীন্দ্রসাহিত্যে সংস্কৃত প্রভাব

এক

রবীন্দ্রনাথ তিনটি সূত্র থেকে সংস্কৃতের প্রভাব আত্মস্থ করেছিলেন: ক) বাল্যকালের গৃহশিক্ষার কাল, যখন তিনি কঠিন অধ্যাবসায় নিয়ে ব্যাকরণ ও অভিধানের সহায়তায় ভাষা রপ্ত করেন; খ) এক সংস্কৃতিবান পরিবারে সংস্কৃত চর্চার পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা, যা তাঁর সাংস্কৃতিক মননের বিকাশের প্রক্রিয়ায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে ওঠে; এবং গ) পরবর্তী কালে কখনও বিক্ষিপ্ত, কখনও বা সুশৃঙ্খল সংস্কৃত ভাষাচর্চা ও পণ্ডিতদের সঙ্গে আলোচনার প্রভাব। ছেলেবেলা কিংবা জীবনস্মৃতি-র মতো আত্মজীবনীমূলক রচনা, চিঠিপত্রাদি এবং অন্যান্য রবীন্দ্রজীবনী গ্রন্থ এ সবের সাক্ষ্য বহন করে।

প্রথম বয়সের শিক্ষা তাঁর ভাষাজ্ঞানকে শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ফলত সামান্য কঠিন, গঠনগত ভাবে ব্যতিক্রমী অনুচ্ছেদের অর্থ তিনি বুঝে নিতে পারতেন, কিছু শব্দের সঠিক অর্থ অধরা থাকলেও অপরিচিত শব্দাবলী বা বাক্য গঠন পদ্ধতিজনিত শূন্যস্থান কবি কল্পনার রসদের ভাণ্ডার দিয়ে পূর্ণ হত।

ঊনবিংশ শতকের বাংলায় যখন সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্কগুলি ভেঙে পড়ছিল এবং নতুন মুৎসুদ্দি সংস্কৃতি রূপ পরিগ্রহ করছিল তখন এক শ্রেণির ভূস্বামীরা কে কত দ্রুত পশ্চিমী জীবনচর্যা আয়ত্ত করতে পারেন সেই প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছিলেন। কিন্তু ঠাকুর পরিবার ছিল ব্যতিক্রম। তাঁরা আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের যা কিছু মহৎ তার পুনরাবিষ্কার ও রক্ষার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে তাকে যুগোপযোগী করে তোলার ব্রত গ্রহণ করেছিলেন। সমাজের শিক্ষিত শ্রেণি যখন পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রেমে মাতোয়ারা, তখন কবির পিতা ও তাঁর সহোদরদের এবং অন্য কয়েকজন জমিদারের এ বিষয়ে কৃতিত্ব প্রাপ্য যে, তাঁরা প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন এবং আধুনিক প্রজন্মের মানবিক প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে সেই ঐতিহ্য কোনও অবদান রাখতে পারে কিনা তার অন্বেষণে নিযুক্ত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই বিনীত, শ্রদ্ধালু অনুসন্ধানের পরিবেশে বড় হয়েছিলেন এবং উপেক্ষা, বিস্মৃতি তথা বিনাশের হাত থেকে কিছু মূল্যবান সম্পদকে রক্ষা করেছিলেন। যা কিছু তিনি পেয়েছিলেন তাকে অনুসরণ করে, তার আদলে তিনি তাঁর নিজস্ব সৃষ্টির সৌধ নির্মাণ করেছেন।

সংস্কৃত তাঁকে নানা ভাবে প্রভাবিত করেছিল— শব্দভাণ্ডার, ছন্দশাস্ত্র, অলঙ্কার শাস্ত্র এবং বিষয়বস্তুর মতো তুলনামূলক ভাবে বেশি প্রত্যক্ষ দিকগুলি ছাড়াও ধারণা এবং মূল্যবোধের মতো সূক্ষ্ম ও জটিলতর বিষয়গুলি দ্বারাও তিনি প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। সংস্কৃত সাহিত্য থেকে তিনি যা আহরণ করেছিলেন তা বিভিন্ন স্তরে ও সময়ে তাঁকে প্রভাবিত করেছে এবং সেটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কেননা, তাঁর মনোজগৎ ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ ছিল না। কিন্তু তাঁর মনের প্রসারতা, সজাগতা, সজীবতা এবং সে মনের বিকাশ ও পরিবর্তনশীলতা সত্ত্বেও কিছু জিনিস ছিল যা তাঁর মনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলেছিল। সময়ের বিচিত্র স্রোতের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষায় এগুলি তাঁর নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের স্থল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই মূল্যবোধ ও মনোভঙ্গিই সম্ভবত সংস্কৃত সাহিত্যের প্রভাবের দীর্ঘস্থায়ী ফসল। অবশ্য তাঁর কবি প্রতিভার উন্মেষ তথা বিকাশের আলোচনায় পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবের কথা বলতেই হয়। সতেরো বছর বয়সে প্রথম ইংলন্ড ভ্রমণের (১৮৭৯-৮০) আগে লেখা বনফুল, কবিকাহিনী এবং শৈশব সঙ্গীত-এর অপরিপক্ক কাব্যিক অভিজ্ঞতা ও আবেগকে ঠিক তাঁর পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ লেখা সন্ধ্যাসঙ্গীত ও প্রভাত সঙ্গীত এর সঙ্গে তুলনা করলেই এ কথা স্পষ্ট হবে। শুরুর দিককার কবিতা ও কাব্য নাটকগুলিতে তাঁর অনুভূতির প্রকাশ অস্পষ্ট, আবছা এবং সেগুলিতে কবির অভিজ্ঞতা প্রকাশের ভাষায় প্রাঞ্জলতার অভাব থেকে যায়। শেষ দুটি উল্লিখিত কাব্যগ্রন্থে কবির প্রকাশভঙ্গি অনেক বেশি পরিশীলিত এবং সেখানে অভিজ্ঞতার সুষ্ঠুতর প্রতিফলন ঘটেছে। পরবর্তী কালে তিনি সন্ধ্যা সঙ্গীত-এর জন্য লেখা একটি ভূমিকায় বলেন:

সেই কপিবুক-যুগের চৌকাঠ পেরিয়েই প্রথম দেখা দিল সন্ধ্যাসংগীত। তাকে আমের বোলের সঙ্গে তুলনা করব না, করব কচি আমের গুটির সঙ্গে, অর্থাৎ তাতে তার আপন চেহারাটা সবে দেখা দিয়েছে শ্যামল রঙে। রস ধরেনি, তাই তার দাম কম। কিন্তু সেই কবিতাই প্রথম স্বকীয় রূপ দেখিয়ে আমাকে আনন্দ দিয়েছিল। অতএব, সন্ধ্যাসংগীতেই আমার কাব্যের প্রথম পরিচয়। সে উৎকৃষ্ট নয়, কিন্তু আমারই বটে। সে সময়কার অন্য সমস্ত কবিতা থেকে আপন ছন্দের বিশেষ সাজ পরে এসেছিল। সে সাজ বাজারে চলিত ছিল না।

কয়েক দশকের ব্যবধানে কবি কিছুটা ব্যক্তি-নিরপেক্ষ, বস্তু-নিষ্ঠ দৃষ্টিতে পিছন ফিরে তাকাতে পেরেছিলেন এবং বুঝেছিলেন যে, তাঁর এই কবিতাগুলিই প্রথম নিজস্বতা মণ্ডিত হয়ে উঠতে পেরেছিল। উল্লেখযোগ্য, ইংলন্ড থেকে ফিরে আসার পরে পরেই এগুলি লেখা হয়েছিল। কিছু তাজা অপরিচিত উত্তেজক তাঁর তরুণ মনকে উদ্দীপ্ত করেছিল; কবিতা হয়ে উঠেছিল আরও প্রাণবন্ত, ঐশ্বর্য্যশালী এবং সূক্ষ্ম রুচিময়; মুক্তি পেয়েছিল কিছু আধো উচ্চারিত অনির্দিষ্ট আবেগের কুয়াশাচ্ছন্নতা থেকে। সন্ধ্যা— দিশাহীন আবেগ সম্পর্কিত অতৃপ্তির প্রকাশ, কবি অস্থির হয়ে পড়েন, তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসে। সার্থক নামা প্ৰভাত সঙ্গীত এই দম আটকানো আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো একান্ত ব্যক্তিগত আবেগ-মুক্তির প্রকাশ। বিখ্যাত কবিতা ‘নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ’-তে দেখি গুহাভাণ্ডের বদ্ধ জলাশয়ে হঠাৎই আছড়ে পড়ে সূর্যের কিরণ; বাইরের পৃথিবীর পাখিদের গান ভেসে আসে, আর গুহার অন্ধকার নিশ্চলতা থেকে শত কলতানে উৎসারিত হয় ঝরনা, ধেয়ে চলে এক বৃহত্তর আলোকজ্জ্বল পৃথিবীর দিকে। এই রূপ প্রতিমা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ, তা প্রতীকি এবং নিজস্ব আবেগের জগতের বাইরের জীবন সম্পর্কে কবির এক আকস্মিক উপলব্ধির প্রকাশে ভাস্বর। পরবর্তী কবিতা ‘প্রভাত উৎসব’ও এই বিপুল এবং অর্থবহ পৃথিবীতে পা রাখার আনন্দ উদযাপন।

১৮৯১ সালে তিরিশ বছর বয়সে কবি দ্বিতীয়বার ইউরোপ পরিভ্রমণে যান এবং ১৮৯৩ সালে দেশে ফিরে আসেন। সোনার তরী এর পরের কাব্য সংগ্রহ— সে অর্থে প্রথম কাব্যোৎকর্ষে পরিণত কাব্যগ্রন্থ। অন্তঃস্থ ‘রোমান্টিসিজিম্’-এর সঙ্গে মিলেমিশে থাকা উপহাস, পরিহাস ও সন্দিগ্ধতার সুর মানসী-র অন্তর্গত শেষ কয়েকটি কবিতাতেই ইতিমধ্যে শোনা গেছে। কিন্তু সোনার তরী-তে পরিণত দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রকাশভঙ্গি আরও স্পষ্ট। এই কাব্যগ্রন্থে রোমান্টিক কবি কাব্যিক ঐশ্বর্য্যের এমন এক চূড়া ছুঁতে পেরেছেন যা তাঁর আগেকার কবিতায় অনুপস্থিত। এই সমস্ত কবিতা এক বা একাধিক দ্বন্দ্বের ফসল। পাশ্চাত্য প্রভাব পড়েছিল কয়েক শতাব্দীর সাহিত্যে সমৃদ্ধ মননে। পাশ্চাত্যের কবি সাহিত্যিকদের তৈরি করা মাপকাঠিতে সংস্কৃত সাহিত্যের মূল্যায়নের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা বাসা বেঁধেছিল কবির অবচেতন মনে, আর তা থেকে সৃষ্টি হয়েছিল উৎকৃষ্ট সব কবিতা। সোনার তরী-তেই প্রথম তা লক্ষ্য করা যায়, যেখানে সর্বপ্রথম তিনি তাঁর বিশিষ্ট কাব্যিক ভাষা আবিষ্কার করেন।

দুই

প্রথমে কবির উপর সংস্কৃত সাহিত্যের সব থেকে দৃষ্টিগোচর প্রভাবগুলি নিয়ে আলোচনা করা যাক— শব্দভাণ্ডার এবং ছন্দশাস্ত্র। প্রথম বয়সে কবি যখন কবিতা লেখা শুরু করেন, তখন রামায়ণ, মহাভারত-এর ভাষান্তর, মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব কবিদের কবিতা এবং মধুসূদন দত্ত, বিহালীলাল চক্রবর্তী প্রমুখের কবিতার মধ্যেই সীমায়িত ছিল আমাদের সাহিত্যের (বিশেষত কাব্যের) ঐতিহ্য। এ সবই ছিল ভীষণ ভাবে সংস্কৃত গাথা-কাহিনি নির্ভর। তাঁর সময়কার শিক্ষিত বাঙালি সমাজের কাব্যিক শব্দের ভাণ্ডার পরিপূর্ণ ছিল এই সব সংস্কৃত শব্দে। অতএব, একার্থে সংস্কৃত ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভের আগেই সংস্কৃত ঐতিহ্যের বীজ রোপিত হয়েছিল রবি-কবির মনে। কালীপ্রসন্ন সিংহ অনুদিত মহাভারত অগুন্তি কঠিন, অপরিচিত সংস্কৃত শব্দের সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় ঘটিয়েছিল; শিক্ষিত বাঙালির কাছে অবশ্য তা কোনও সমস্যার কারণ ছিল না, কেননা শিক্ষাব্যবস্থা ছিল সংস্কৃত ভাষাভিত্তিক। অতএব, তামাদি হয়ে যাওয়া শব্দরাজির উচ্চারণ বার বার শুনতে শুনতে এই কিশোর অসচেতনেই পরিচিত হয়ে যায় সেই সব শব্দের সঙ্গে, কেননা, কাব্যিক পরিপ্রেক্ষিতে সে খুঁজে পেয়েছিল শব্দের অর্থ। এর পর সংস্কৃতর সঙ্গে পরিচয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তিনি এমন বেশ কিছু শব্দ আবিষ্কার করেন, পূর্ববর্তী সাহিত্যিকরা যেগুলির কাব্যিক সম্ভাবনাকে ব্যবহার করার কাজে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এই ব্যর্থতার মূলে ছিল অগ্রজ সাহিত্যিকদের প্রয়োজনের ভিন্নতা, অর্থাৎ সংস্কৃত শব্দে অনুকরণের অভ্যাস। অন্য দিকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজস্ব কাব্যিক প্রয়োজন মেটাতে শব্দগুলির রূপে পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন। এটা স্বাভাবিক, কেননা, তাঁর কবিতার প্রাণসত্তা ছিল ভিন্ন। যেখানে তাঁর পূর্ববর্তী প্রায় সব উল্লেখযোগ্য কবি কোনও না কোনও মহাকাব্যভিত্তিক সৃষ্টির কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন, সেখানে রবীন্দ্রনাথই প্রথম লিরিকের আশ্রয় নেন। তিনি বুঝেছিলেন লিরিকই তাঁর সৃষ্টির মুখ্য বাহন। তাঁর রোমান্টিক মন এমন কিছু শব্দ খুঁজে বেড়াচ্ছিল যার প্রয়োজন মধ্যযুগীয় মানসিকতা সম্পন্ন ভারতচন্দ্র বা ধ্রুপদী মধুসূদন কখনওই অনুভব করেননি।

রবীন্দ্রনাথের রচনা অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, সংস্কৃত শব্দের রূপান্তর ঘটিয়ে নতুন শব্দ তৈরির কাজে তিনি রামায়ণ এবং কালিদাস ও বাণভট্টের রচনাবলির মুখাপেক্ষী হয়েছিলেন। এই সন্ধানে ১৯৬৪ সালে আমি বিশ্বভারতীর গ্রন্থাগারের কর্মীদের অনুরোধ করি কবির ব্যবহৃত এই গ্রন্থগুলির প্রতিলিপি আমাকে দেওয়ার জন্য এবং আমার অনুমানের বাস্তব সত্যতার সাক্ষ্য পেয়ে আমি আনন্দে শিহরিত হয়ে উঠি। সে সবের মার্জিনে অজস্র নোট থেকে সংস্কৃত থেকে শব্দ গঠনের প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তর নজরে পড়ে। এই শব্দগুলি সরাসরি ধার করা বা নব্য প্রয়োগ নয়। বরং সেগুলি পরম আবেগময় ভাবের প্রয়োজনে সংস্কৃত শব্দের অভিযোজন ও পরিমার্জনা। কালিদাসের মেঘদূতে আমরা পড়ি, ‘রেবাম দ্রক্ষ্যস্যুপলাভিস বিন্ধ্যপাদে বিশীর্ণম’ (‘বিন্ধ্যপর্বতশ্রেণীর নুড়ি বিছানো পাদদেশে তুমি শীর্ণ স্রোতা রেবা নদী অবলোকন করবে’)।

রবীন্দ্রনাথের মেঘদূতে আমরা পাই, ‘বিমল বিশীর্ণা রেবা বিন্ধ্য পাদমূলে উপলব্যথিত গতি।’

আনুভূতিক অতিস্বর একান্তই তাঁর নিজস্ব। বান-এর লেখায় আমরা পাই, ‘বিষাদাচ্ছন্ন পারাবতের অবিশ্রাম কূজনে আচ্ছন্ন পৃথিবীতে।’

রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘কুলায়ে কাঁদিছে কাতর কপোত।’ ঋণ সুপ্রতিভাত, কিন্তু স্মৃতি জাগানিয়া সৌন্দর্য্য তাঁর নিজস্ব অবদান। ময়ূরের ‘সূর্যসরক’ এর কথা মনে আসে, ‘সূৰ্য্য দেবতার রথের নৃশংস চাকার তলায় ছিন্নভিন্ন হয় নক্ষত্র সকল, কিন্তু নক্ষত্রের আর্তনাদে ভ্রুক্ষেপহীন রথ এগিয়ে চলে।’ ‘শেষের কবিতা’-য় কবি বলছেন:

কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?
তারি রথ নিত্যই উধাও
জাগিছে অন্তরীক্ষে হৃদয় স্পন্দন
চক্র পিষ্ট আঁধারের বক্ষফাটা তারার ক্রন্দন।

প্রতিমা নির্মাণী শব্দ ‘চক্র পিষ্ট’ দুটি কবিতাতেই উপস্থিত, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রগাঢ় সাংবেদনিক আবেদন নিশ্চিত ভাবে আমাদের অনেক বেশি স্পর্শ করে— আপাত উদাসীন অন্ধকার রাত্রির বুক থেকে উঠে আসে নক্ষত্রের আকুল কান্না। সংস্কৃত কবি শুধুমাত্র এক মহাজাগতিক রূপ প্রতিমা সৃষ্টি করেন: লিরিক কবির লেখনীতে তা ভগ্ন হৃদয়ের যন্ত্রণার অনুরণন হয়ে ওঠে। যে সব শব্দ আবেগের অনুষঙ্গে হাজির হয় এবং গভীরতর গূঢ়ার্থ বহন করে তা নেহাৎই ব্যঞ্জনার্থক শব্দের তুলনায় লিরিক কবিতার পক্ষে অনেক বেশি উপযোগী।

পরবর্তী জীবনে কবি যখন ইস্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় চালিয়েছেন তখন তিনি সর্বসাধারণের জন্য বিজ্ঞানবিষয়ক বইও লিখেছেন। এবং একান্তই বৈজ্ঞানিক কথা নির্দেশক শব্দের খোঁজে তিনি সমগোত্রীয় সংস্কৃত রচনার কাছে ফিরে গিয়েছিলেন। আর তার হাত ধরে আমরা পেয়ে গেছি অতি উপযোগী অনেক উদ্ভাবনী শব্দ।

তিন

রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃত ছন্দশাস্ত্র থেকে বেশি কিছু সরাসরি ধার করেননি, কিন্তু অনেক সংস্কৃত ছন্দের রদবদল করেছেন। এটা তাঁকে করতে হয়েছিল জয়দেব প্রমুখের ব্যবহৃত অপভ্রংশ ছন্দের নানা ধরনে অভ্যস্ত বাঙালির কানের পরিতৃপ্তির জন্য। রবীন্দ্রনাথের এই দিকটি নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞই আলোচনা করেছেন, অতএব আমি আমার বিশ্লেষণ কয়েকটি বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখব। জয়দেব লিখছেন :

বরষি যদি বিঞ্চিদপি দন্তরুচি কৌমুদী
হরতি ডরতিমিরমতিঘোরম্

মূল সংস্কৃত থেকে কবি দুটি ছান্দস এককের অবস্থান বদল করে দিলেন। অথবা, ‘মদন ভষ্মের পূর্বে’কবিতাতে রূপের দিক দিয়ে তা প্রায় একই রকমই থাকল, কিন্তু বাঙালি পাঠকের কর্ণে তা কিছুটা বেসুরো কেননা চূড়ান্ত স্বর দৈর্ঘ্যটির কবিতা পংক্তির আশানুরূপ দৈর্ঘ্যে প্রসারিত হওয়াটাতে সেই কাজ অনভ্যস্ত: ‘একদা তুমি অঙ্গ ধরি ফিরিতে নব ভুবনে মরি মরি অনঙ্গ দেবতা’।

পরবর্তী কবিতা ‘মদনভষ্মের পরে’ তে সমস্যা লাঘব করার জন্য আরও কতগুলি ‘সিলেবল’ বা ছান্দিস একক যোগ করা হয় এবং আমরা এক শ্রবণ সুখদ ছন্দের আস্বাদ পেয়ে যাই:

পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ একি
সন্ন্যাসী, বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে।

এমনকী ‘শেষের কবিতা’-র মতো পরিণত রচনাতেও তিনি ছন্দ নিয়ে উল্লেখযোগ্য পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন,

সুন্দরী তুমি, শুকতারা দূর শৈল-শিখরান্তে
শর্বরী যবে হবে সারা
দর্শন দিও দিক্‌ভ্রান্তে।

এখানে নিয়মিত চরণগুলি অন্তিম স্বরবর্ণকে সামান্য প্রলম্বিত করে, কিন্তু অনিয়মিত চরণে তা অনেক বেশি দীর্ঘায়িত। এই কৌশলের ব্যবহারের ফলে প্রায় সংগীতের মুর্ছনা সংযোজিত হয়, যেখানে পরিমাণগত অপূর্ণতা আকুল অনুরণনে পূর্ণতা পায়। ছান্দিক আবহ তৈরির এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব যিনি প্রতিটি ছন্দোবদ্ধ অবয়বের যথার্থ কাব্যিক মূল্য অনুধাবনে সক্ষম এবং বিষয়বস্তুর আনুভূতিক চাহিদা মেটাতে তার উপযুক্ত রদবদল ঘটাতে পারেন। অতএব, ছন্দ ভাব প্রকাশের আরও এক মাধ্যম হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়, যা সামগ্রিক কাব্যিক অনুভবে অতিরিক্ত মাত্রা যোগ করে। বাংলায় সংস্কৃত ছন্দ অনুকরণের ক্ষেত্রে অন্য একটি বাধা ছিল। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ধ্রুপদী সংস্কৃত কাব্যে অন্ত্যমিলের কোনও জায়গা ছিল না, কিন্তু বাঙালি পাঠক-পাঠিকার প্রত্যাশা তথা রুচি গড়ে উঠেছিল জয়দেবের লেখনী নিঃসৃত অপভ্রংশ অন্ত্যমিলের ঐতিহ্যে। রবীন্দ্রনাথ অতি বিচক্ষণতার সঙ্গে সেই ঐতিহ্যকে ব্যবহার করেছেন। কখনও কখনও ছন্দের ব্যবহারে আপাত অবশ্যম্ভাবী স্থূলতার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য তিনি অন্বয়ী ছান্দস একক ব্যবহার করেছেন:

যেদিন হিমাদ্রিশৃঙ্গে নামি আসে আসন্ন আষাঢ়
মহানদ ব্রহ্মপুত্র অকস্মাৎ দুর্দম দুর্বার
দুঃসহ অন্তরাবেগে তীরতরু করিয়া উন্মুল
মাতিয়া খুঁজিয়া ফিরে আপনার কূল-উপকূল

ভাষা ও ছন্দ

অন্যত্র আবার ছন্দোবদ্ধ পংক্তিগুলিকে দীর্ঘায়িত বা পরিবর্তিত করেছেন যাতে পংক্তিগুলির মধ্যেকার দূরত্ব বজায় থাকে :

দুঃখ পেয়েছি দৈন্য ফিরেছে অশ্লীল দিনেরাতে
দেখেছি কুশ্রীতারে;
মানুষের প্রাণে বিষ মিশায়েছে মানুষ আপন হাতে
ঘটেছে তা বারেবারে

‘পত্রোত্তর’, সেঁজুতি

তিনি অসম দৈর্ঘ্যের ছন্দোবদ্ধ পংক্তির আশ্রয়ও নিয়েছিলেন যাতে ছান্দিক অভিঘাত এক সূক্ষ্ম ও জটিল স্বর কাঠামোর বশে থাকে :

ঘুম ভাঙ্গানিয়া জোছনা
কোথা থেকে যেন আকাশে কে বলে
এতটুকু কাছে বোসোনা

‘অস্পষ্ট’, নবজাতক

জয়দেব বা তাঁর যে কোনও পূর্বসূরীর তুলনায় রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা ছিল অনেক বড় মাপের। তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে জয়দেব এবং বন্দনা সঙ্গীত থেকে ধার করেছেন সেই বন্দনাগীতি যা ছন্দকে মন্ত্রোচ্চারণের স্তরে উন্নীত করে। তিনি গ্রহণ করেছেন ছন্দ প্রকরণ নিরপেক্ষ সুললিত ধ্রুপদী কাঠামো থেকেও, যেখানে ছন্দসৃষ্টির উৎস নিহিত থাকে ধ্বনির সুচিন্তিত বিন্যাসের মধ্যে। শেষের দিকে তিনি ঋক্ বেদের নির্মেদ ছন্দ-অনাশ্রিত শ্লোকের কাছে ফিরে যান। কবিতাকে বাহ্যিক অলংকারে সাজানোর প্রচেষ্টা প্রায় সম্পূর্ণতই তিনি বর্জন করেন। অন্তরতম অনুভব তাঁর কাব্যে সাধনার মুখ্য অভিব্যক্তি হয়ে ওঠে এবং পূরবী-র পরবর্তীতে আমরা পোক্ত রত্নের মতো কবিতার কাঠামোর সন্ধান পাই। কবির শব্দচয়ন, ললিত গীতির আমেজ তৈরির উদ্দেশ্যে ধ্বনি সামঞ্জস্য, অন্তঃস্থ ছান্দিক কাঠামো এবং ধ্বনি সাদৃশ্যের ব্যবহারে সংস্কৃত কবিতার যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কিছু কিছু অনুচ্ছেদ পড়তে প্রায় সংস্কৃতেরই মতো, কারণ, সংস্কৃত কাঠামো ব্যবহার বা ছন্দের পুনরাবৃত্তি না করেই কবি দুয়েরই সুপটু ও কার্যকরী প্রয়োগ করেছেন। কখনও কখনও অনুচ্ছেদের পর অনুচ্ছেদে সদৃশ সংস্কৃত অনুচ্ছেদের অনুরণন শোনা যায়। আবার অন্যত্র তা সংস্কৃত রীতির এত কাছাকাছি যে, মনে হয় বুঝি বা সংস্কৃত কাব্যে কোথাও তাদের দেখা মিলবে। উদাহরণস্বরূপ:

স্নিগ্ধ সজল মেঘ কজ্জল দিবসে
বিবশ প্রহর অচল অলস আবেশে
শশীতারাহীনা অন্ধতামসী যামিনী
কোথা তোরা পুরকামিনী?
কোথা তোরা অয়ি তরুণী পথিক ললনা,
জনপদবধূ তড়িৎচকিত নয়না
মালতী মালীনি কোথা প্রিয় পরিচারিকা,
কোথা তোরা অভিসারিকা!
ঘনবনতলে এস ঘননীলবসনা,
ললিত নৃত্যে বাজুক স্বর্ণ রসনা।

‘বর্ষা মঙ্গল’, কল্পনা

অথবা,

অয়ি ভুবনমন মোহিনী
অয়ি নির্মল সূর্যকরোজ্জ্বল ধরণী
জনক জননী জননী
সুনীলসিন্ধুজলধৌত চরণতল
অনিল কম্পিত শ্যামল অঞ্চল
অমল চুম্বিত ভাল হিমাচল শুভ্ৰ
তুষার কিরিটীনি…..

সংস্কৃত কাব্যশাস্ত্রে অনুপ্রাস অলংকারকেই সর্বোত্তম বলা হয়েছে। অনুপ্রাসময় ব্যঞ্জন বর্ণের নিকটতর সন্নিধি আমরা রবীন্দ্রনাথেও পাই, কিন্তু তাঁর শিল্পী সত্তার শ্রেষ্ঠতা তাঁকে অবক্ষয়ী সংস্কৃত কাব্যের রুচি বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করে। উদাহরণস্বরূপ:

ঘোর ঘন নীলগঠন তব
চল চপলার চকিত চমকে করিছ চরণ বিবরণ
কোথা চম্পক আভরণ
ফাল্গুনে আমি ফুলবনে বসে গেঁথেছিনু যত ফুলহার।

‘আবির্ভাব’, ক্ষণিকা

অথবা,

বাতায়নে বসি বিহ্বলবীণা বিজনে বাজাই বসিয়া।

‘অন্তরঙ্গ’, ক্ষণিকা

মোটামুটি ভাবে পাঁচ বা ছয় ছান্দস এককে বিধৃত ছন্দের প্রতি তাঁর পক্ষপাতের অনেকটাই নানা সংস্কৃত-ছন্দে প্রভাবিত।

চার

অলংকার বিষয়ে সংস্কৃত আদর্শকে আঁকড়ে ধরে না থেকে তা থেকে সরে আসাই রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে বেশি লক্ষণীয়। যদিও, অলংকারের মূল ভাণ্ডার (উপমা, রূপক, অনুপ্রাস, পরোক্ষ উল্লেখ, জড়বস্তুতে মানবোচিত গুণারোপ) সব সাহিত্যের ক্ষেত্রেই এক, রবীন্দ্রনাথ এগুলিকে স্বাধীন ভাবে ব্যবহার করেছেন। বেশি জটিল এবং কৃত্রিম আলংকারিক প্রয়োগ তিনি মোটামুটি বর্জন করেছেন। আমরা দেখি যে, ফাল্গুনী নাটকে ভণ্ড পণ্ডিত শ্রুতিভূষণ রাজাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, ‘আমার পত্নীর ইচ্ছা এই যে মহারাজের খ্যাতি তাঁর সমগ্র দেহ জুড়ে প্রবাহিত হোক।’ (অর্থাৎ, স্ত্রী-র ইচ্ছা রাজা তার প্রতিটি অঙ্গের জন্য গয়না গড়িয়ে দিন)। এই কৃত্রিম রূপ প্রতিমাটি সরাসরি অবক্ষয়ী সংস্কৃত সাহিত্যে ব্যবহৃত অতিশয়োক্তি থেকে গ্রহণ করা হয়েছে এবং ইচ্ছাকৃত ভাবে তাকে অতি মামুলি ভাবে পরিবেশন করা হয়েছে। রোমান্টিক কবি হিসাবে প্রায়শ কালিদাস উত্তর সংস্কৃত সাহিত্যে ব্যবহৃত ‘বারোক’ মার্কা অলংকারের বাহুল্যের প্রতি তাঁর সহজাত সুস্থ বিতৃষ্ণা ছিল— বিষয়বস্তু ও রূপের প্রয়োজনীয় স্বাভাবিক ভারসাম্য বজায় রাখা এবং শিল্পীর রুচিবোধের ব্যাপারে কালিদাসই ছিলেন তাঁর আদর্শ। তাঁর পক্ষপাত ছিল আতিশয্য মুক্ত সরল-সুন্দর বাক্যালংকারের প্রতি; অলংকার ব্যবহারে অবক্ষয়ী উচ্ছাসের প্রতি অনীহা তাঁর সহজাত সুরুচি বোধকেই প্রমাণ করে। যে কবির বিচরণ ভূমি ছিল ঊনবিংশ শতকের ইংরাজি রোমান্টিক কবিতা, অত্যধিক ভারী এবং জটিল অলংকারের প্রতি তাঁর বিরূপতা স্বাভাবিক। তাঁর বিরাট অবদান হল ঐতিহ্যের অবস্থানে পরিবর্তন ঘটানো এবং বিষয়বস্তু ও রূপের ভারসাম্যের বোধ গড়ে তোলা— যা কালিদাস উত্তর সংস্কৃত কবিতায় একান্তই অনুপস্থিত।

কবির অন্য একটি অবদান হল রূপ-প্রতিমা নির্মাণের ক্ষেত্রটিকে বিস্তৃত করা। ধ্রুপদী সংস্কৃত কবিরা উপমা ও রূপক নির্মাণের ক্ষেত্রকে ক্রমাগত সংকুচিত করছিলেন, কেননা, কৃত্রিম কাব্য রীতির সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটছিল। অপরপক্ষে সত্যকার অনুপ্রাণিত কবিতা দশম শতাব্দীর পর কথ্যভাষার দিকে ঝুঁকছিল। এ ছাড়াও কাব্যশাস্ত্র ধীর কিন্তু নিশ্চিত ভাবে কবিতার কণ্ঠস্বর রোধ করার কাজে উঠে পড়ে লেগেছিল। ফলত সংস্কৃত কবিতা দ্রুত ব্যাকরণ ও আলংকারিক কসরতের শিকার হয়ে পড়ছিল, যা শুধু নিস্পৃহ অভিজাত শ্রেণি তথা রাজসভা ও ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মনোরঞ্জনের মাধ্যম হয়ে উঠছিল। এই পর্বের বিশাল, বিপুল সাহিত্য উষরভূমিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। আর এই অনুপ্রেরণার অভাব ঢাকতে কবিরা ভাষার মারপ্যাচ এবং ক্লান্তিকর বহু ব্যবহৃত রূপ প্রতিমার ভারে কবিতাকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছিলেন। বন্ধ্যা আলংকারিক কবিতার দীর্ঘ পর্বের অবসানের পর রবীন্দ্রনাথের রূপ-প্রতিমার সজীবতার পিছনে অনেকগুলি নির্মাণের ক্ষেত্র বিস্তৃত এবং তা মূলত ইউরোপীয় রোমান্টিকতার প্রভাব সঞ্জাত।

পাঁচ

রূপ-প্রতিমার আলোচনায় আমাদের রবীন্দ্রনাথের পুরাণ কাহিনির ব্যবহার বিষয়ে কিছু কথা বলতে হবে। এ বিষয়টিকে মোটামুটি ভাবে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়: ক) সরল পরোক্ষোক্তি; খ) রূপ-প্রতিমা নির্মাণে সেগুলির ব্যবহার; এবং গ) নব্য-পুরাণের কল্পকাহিনিতে প্রতীকি ব্যাখ্যা ও তার বিস্তার। রবীন্দ্রনাথের পূর্ববর্তী তথা পরবর্তী কবিরা অনেকেই পুরা কাহিনির এই বিপুল সম্ভারকে কাজে লাগিয়েছেন। এবং, রূপ-কল্প নির্মাণেও কল্পকাহিনির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে, যেখানে দেবতাদের পৌরাণিক আচরণকে পাত্র-পাত্রীদের চরিত্র চিত্রণে ব্যবহার করা হয়। আবার কল্পকাহিনিগুলির প্রতীকি ব্যাখ্যাও করা হয়। কিন্তু কল্পকাহিনির সর্বোৎকৃষ্ট ও সব থেকে সৃজনশীল ব্যবহার হয়েছে যেখানে দেব-দেবীদের আচরণ তাঁদের চরিত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এবং যেখানে তাঁরা কবির কোনও বক্তব্যকে পরিপুষ্ট অথবা প্রতিষ্ঠিত করেন। উদাহরণস্বরূপ, তাসের দেশ নাটকটির কথা ভাবা যাক: কথিত আছে যে ব্রহ্মা সারা দিনের সৃষ্টিকর্ম শেষে ক্লান্ত হয়ে যে হাই তুলেছিলেন তা থেকে নিরানন্দ, নির্জীব তাস জাতি সৃষ্ট হয়েছিল। এখানে বৃদ্ধ ব্রহ্মার অবিরাম সৃষ্টিকর্মের ছবিটি পুরাণ থেকে নেওয়া, যদিও অন্তর্জগতে সারশূন্য, প্রাণহীন তাসেদের তীব্র হাই থেকে উৎপন্ন হওয়ার কল্পনাটি তাঁর নিজের। এবং তা বহু-ব্রাহ্মণ্য ও পুরাণ কাহিনির সঙ্গে যথেষ্ট সংগতিপূর্ণ। সে সব কাহিনিতে দেখা যায় সৃষ্ট জীবের চরিত্র সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির সময়কার মেজাজ ও অবস্থার উপর নির্ভর করে। এই সব অনুচ্ছেদের মধ্য দিয়েই প্রাচীন পুরাকাহিনির সঙ্গে কবির গভীর ও পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিচয় সম্পর্কে আমরা সহসা অবহিত হই। রবীন্দ্রনাথের রূপকল্পে প্রায়শই এক হারিয়ে যাওয়া গৌরবময় অতীতের প্রতিফলন ঘটে। হয়তো এই অতীতের কোনও ঐতিহাসিক অস্তিত্ব কোনও দিনই ছিল না, কিন্তু সংস্কৃত কবিরা তাকে বাস্তবের থেকেও বড় অতিবাস্তব হিসাবে পাঠকদের কাছে হাজির করেছেন।

কবি তাঁর রূপকল্প নির্মাণ করেন এক কল্পিত জগতের আধারে। এমন এক জগৎ যেখানে রাজকুমার এবং রাজকুমারীরা পরস্পরের স্বপ্নে বিভোর থাকে আর আকুলি বিকুলি করে, সেখানে গভীর নিশীথে নারী চুপিসারে প্রেমিকের গান শোনে বা বীণায় সহজ সুর তোলে এবং কাছে না থাকা প্রেমিকের জন্য ফুলের মালা গাঁথতে গাঁথতে শুধু নীরব চোখের জলে ভাসে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এ পৃথিবী পদ্ম ফুলের, বীণার, চন্দনকাঠের, মহার্ঘ অলংকারের আর জমকালো সাজপোশাকের। এ পৃথিবী কুঞ্জবনের, সংগীতের, চন্দ্রালোকের প্রেমের। এই ফেলে আসা স্বপ্নিল জগৎ থেকে তিনি প্রধানত তাঁর রূপকল্প আহরণ করেন যা তাঁর কবিতাকে এতটা ঐশ্বর্য্যশালী করে। সাধারণ পরিশীলিত সংবেদনের অধিকারী এক কবির নির্মাণ করা এই ইন্দ্রিয়ঘন রূপকল্পগুলি এতটাই আবেশময় যে প্রায়শই তারা যেন জীবন্ত শরীরে আমাদের সামনে উপস্থিত মনে হয়। এটা ঘটে, কারণ, তা কোনও এক যুগের অনুরণন যা কবি-কল্পনায় একান্ত বাস্তব এবং সে সম্পর্কে কবি স্মৃতি মেদুরতায় আচ্ছন্ন হন।

রবীন্দ্র সাহিত্যের অনেক বিষয়বস্তুই সংস্কৃত সাহিত্য থেকে আহরণ করা হয়েছে। উপনিষদ, মহাকাব্য, বৌদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্য এবং পুরাণ। ‘কাহিনী’-তে আমরা দেখি সংস্কৃত সাহিত্যের আখ্যানকে কবি নিজ ব্যাখ্যায় ঐশ্বৰ্য্যশালী করে তার কাব্য রূপ দিয়েছেন। চিত্রা-র অন্তর্গত ‘প্রেমের অভিষেক’ কবিতাটিতে আমরা এক বার্তার সন্ধান পাই যা, রোমান্টিক যুগের এক উজ্জ্বল পুননির্মাণ, কিন্তু একই সঙ্গে তা একান্তই নিজস্ব সৃষ্টি, কেননা তিনি তা গড়ে তোলেন বিভিন্ন যুগের বহু সংস্কৃত কবির নানা বর্ণময় সৃষ্টির অংশকে একত্র করে। এখানে দময়ন্তী, শকুন্তলা, মহাশ্বেতা, সুভদ্রা এবং পার্বতীর বর্ণনা পাওয়া যায়— যে চরিত্রগুলিকে সহজেই রোমান্টিক কবিতার নায়িকা চরিত্রে রূপান্তরিত করা সম্ভব। প্রতিটি চরিত্রকে ঘিরে কবি রঙের চমৎকার এক সূক্ষ্ম মনোহারী অস্পষ্ট কুয়াশার জাল বোনেন এবং সেখানেই নিবৃত্ত হন। বর্ণনা অন্তে ব্যঞ্জনা সে স্থান পূরণ করে এবং এক অবিনশ্বর ছবি মনে গেঁথে যায়।

এই পৃথিবীর কোনও ঐতিহাসিক বাস্তবতা কখনওই ছিল না। এটি মূলত একটি নতুন মিথ বা কল্পকাহিনি যা অতীত সম্পর্কিত আতিশয্যময় বর্ণনা থেকে কবি গড়ে তুলেছেন- সেই কবি যিনি কম বয়সেই উনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি রোমান্টিক কবিতার প্রভাব আত্মস্থ করেছেন এবং যিনি ইউরোপীয় সঙ্গীত, শিল্প ও সাহিত্যের পরিমণ্ডলে যথেষ্ট স্বচ্ছন্দবোধ করতেন।

মাত্র সতেরো বছর বয়সে কবি ইংলন্ড পরিভ্রমণে যান এবং প্রত্যক্ষ ভাবে ইউরোপীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর ধ্যান ধারণা গড়ে ওঠে। সহজাত পরিশীলিত মনের অধিকারী কবির প্রতিক্রিয়া হয় শিল্পীসুলভ; এটা পরিষ্কার বোঝা যায় ইংলন্ড যাত্রার আগে ও পরে রচিত কবিতাগুলিকে তুলনা করলে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি তাঁর কাছে এক জীবন্ত বাস্তব, এক ইতিবাচক এবং নিজেকে গড়ে তোলার শক্তি, যা তাঁর জীবন সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিতে ছাপ ফেলে, বদল ঘটায়। তাঁর মহৎ সৃষ্টির অনেকটাই নিজস্ব প্রাচীন ঐতিহ্যের গ্রহণ বর্জনের প্রক্রিয়ায় তীব্র দ্বন্দ্বের ফল। মাত্র সতেরো বছর বয়সেই ইউরোপীয় জীবনচর্যার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে ঐতিহ্যের আংশিক প্রত্যাখানের চিন্তা তাঁর মনে বাসা বাঁধে এবং তিনি প্রথাগত ভারতীয় মূল্যবোধের পুনর্মূল্যায়নের প্রয়াসে ইংলন্ড থেকে ভারতী পত্রিকার জন্য নিবন্ধ লেখা শুরু করেন। পরে তিনি আবার ইউরোপ পরিভ্রমণে যান। এ বার ইউরোপীয় সভ্যতা সম্পর্কিত পড়াশোনা এবং ইউরোপীয় বন্ধু-বান্ধবদের সাহচর্যে পাশ্চাত্য সভ্যতার আরও নিবিড় সংস্পর্শে আসেন। তিনি পাশ্চাত্য সাহিত্য, বিশেষত উনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি সাহিত্য আত্মস্থ করেন এবং মধ্যযুগের ভারতচন্দ্র অথবা ধ্রুপদী মধুসূদনের তুলনায় ভারতীয় ঐতিহ্য তাঁর কাছে প্রায় সম্পূর্ণ অন্য চেহারায় উপস্থিত হয়। প্রতীকি এবং ব্যঞ্জনাত্মক নাটকগুলি তার প্রমাণস্বরূপ, যেমন তাসের দেশ, অচলায়তন, মুক্তধারা, কালের যাত্রা, রথের রশি এবং অন্যান্য অনেক রচনা। ভারতীয় বাস্তবতার অনেকটাই যে অনড়, মৃতপ্রায় সে কথা তিনি উপলব্ধি করেন। তিনি কখনও প্রচ্ছন্ন ভাবে কখনও বা প্রত্যক্ষ ভাবে তাকে পরিহাস করেন এবং কী করে ও কেন সামাজিক জীবন গতিশীলতা হারিয়েছে তা নির্দেশ করেন। নিরপেক্ষ বিচারক হিসাবে তিনি শিল্প বিপ্লবের যুগে ভয়ঙ্কর যান্ত্রিক অস্তিত্বে অমঙ্গল ও আতিশয্যের বিষয়টি থেকেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নেননি। এবং রক্তকরবী ও মুক্তধারা নাটকে তার প্রতি তীব্র বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করতে কসুর করেননি। বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হল দুই ধরনের মৃত্যু থেকেই তিনি মুক্তির পথ খুঁজেছেন তারুণ্যের জয়গান গেয়ে।

নির্জীব ও ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের প্রত্যাখ্যানও তাঁর কবিতার রূপকল্প হিসাবে এসেছে। শীত এই শুষ্কতা, নির্জীবতার প্রতীক এবং বসন্ত প্রেম, আনন্দ, তারুণ্য জীবন উদযাপন করে।

চিত্রা-র উর্বশীর বিষয়বস্তু আহরণ করা হয়েছে ভারতীয় মহাকাব্য থেকে— এক অপ্সরার পৌরাণিক বর্ণনা থেকে। কিন্তু তাঁর উপস্থাপনায় শেলীর ‘হাইম টু ইন্টালেকচুয়াল বিউটি’র ছাপ স্পষ্ট। ‘বিজয়িনী’ (চিত্রা) কবিতার বিষয়বস্তু কাদম্বরী-র মহাশ্বেতা-আখ্যানভিত্তিক, কিন্তু এখানেও তিনি বিষয়টিকে অন্য ভাবে পরিবেশন করেছেন। মহাশ্বেতার কষ্ট যা শাশ্বত প্রেমের প্রণয়োপচার, সেই কষ্টকে তিনি সর্বজনীনতা দিয়েছেন। এটি একান্তই রোমান্টিক কবি-মনের ফসল।

পাস্পরিক অতীতের সঙ্গে আরও সরাসরি ভাবে যুক্ত চৈতালী-র কিছু সংখ্যক কবিতা। এগুলি, এ-দিক ও-দিক কিছু টুকরো অংশ বাদ দিলে, কবিতা হিসাবে নিম্নমানের। এ সব কবিতায় তিনি অতীত যেমন ভাবে তাঁর কাছে উপস্থিত হয়েছে তেমন ভাবেই তার উপস্থাপনা করেছেন এবং প্রথাগত ভাবে বিষয়বস্তুর যে সুর সেই সুরেই স্মৃতি বিধুরতা নিয়ে কবিতা শেষ হয়েছে। হয়তো দু-একটা পরিবর্তন কোথাও কোথাও লক্ষ্য করা যায়। ক্ষণিকা-র কবিতা আমরা ব্যাঙ্গত্মক সুর শুনতে পাই, অতীতের মৃতপ্রায় ছবির প্রতি তাঁর যেন কিছুটা বিরাগ। এ সব কবিতায় তিনি পরিহাস ছলে রোমান্টিক অতীতের স্বরূপ উদ্ঘাটিত করেছেন। কিছু কবিতায় অতীত সম্পর্কিত এই স্বপ্নিল দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে অতীতের উপর বর্তমানের বিজয় ঘোষণা করা হয়েছে। এবং কবি বর্তমানের প্রবক্তা হিসাবে বর্তমান বাস্তবতাকে গৌরবান্বিত করেছেন। আবার বর্তমান নিয়েও তিনি সন্তুষ্ট বটে। ‘সেকাল’-এ তিনি বলেন সুপ্রাচীন যুগের মানুষ কালিদাস বর্তমানের মহিমা ও রোমান্স থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাঁর গর্ব হয় এই ভেবে যে অতীতের উত্তরাধিকারী তো তিনি বটেই, একই সঙ্গে বর্তমানের স্বাদোপভোগের আশীর্বাদও তাঁর উপর বর্ষিত হয়েছে। আমরা সকলেই জানি যে ক্ষণিকা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কবিতাগুলি রচিত হয়েছিল একাধিক রাজনৈতিক তথা সামাজিক উদ্যোগের ব্যর্থতার তিক্ত অভিজ্ঞতার পর। মানসিক পুনরুজ্জীবনের উপায় হিসাবে তিনি আত্মবিদ্রুপের আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই তাজা মনোমুগ্ধকর কবিতাগুলি রচনাকালেও ব্যাঙ্গাত্মক হাসির রেশ মিলিয়ে যায়নি। রোমান্টিকতা বিরোধী প্রলেপটি নেহাৎই অগভীর, কিন্তু তা বিষয়বস্তু ও তার উপস্থাপনায় সৌন্দর্য্যের নতুন মাত্রা যোগ করে।

আরও পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথের কবিতা কালিদাসের ঋতু সংহার ও অন্যান্য বিখাত প্রকৃতি বিষয়ক কাব্য দ্বারা অনুপ্রাণিত। একঘেয়ে ‘শেফার্ড’স্ ক্যালেন্ডার’ (রাখালের ষড় ঋতু)-র মতো দীর্ঘ কবিতার পরিবর্তে কবির মনোযোগ নিবদ্ধ হয় বসন্ত বা বর্ষার আগমন ও বিদায়ে। ‘নটরাজ’ও ‘ঋতুরঙ্গশালা’ ষড়ঋতুর ব্যাখ্যামূলক কাব্যরূপ এবং সে ব্যাখ্যা একান্তই কবির নিজস্ব। রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি বিষয়ক কবিতাগুলি প্রায়শই প্রতীকি। আমরা আগেই শীত ও বসন্তের প্রতীকি তাৎপর্য্যের উপস্থিটি টের পাই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের হাতে কুমার সম্ভব-এর মিথ পরিবর্দ্ধিত হয়। এর তৃতীয় সর্গে বিনাশকারী শক্তির জয় হয় এবং পঞ্চম সর্গে প্রেম ও জীবন বিজয় লাভ করে। কবি ‘তপোভঙ্গ’ কবিতায় প্রতীক ব্যবহারের রহস্য ফাঁস করে দেন। তা হয়ে ওঠে এক সম্প্রসারিত রূপালঙ্কার: শীতল হিমালয় পর্বতে শিব অনুশোচনায় রত অথবা ভিখারীর বেশে তাঁর পার্বতীর কাছে উপস্থিত হওয়া শীতের প্রতীক। ছদ্মবেশের এই নাটক বিফলে যায়, পার্বতী তাঁর দৈহিক সৌন্দর্য্য প্রদর্শন করেন এবং নিথর পরিবেশ ও কঠোর তপোশ্চর্যার দৃশ্যে অকাল বসন্তের আবির্ভাব ঘটে। এই হতাশাই একমাত্র আনুগত্যহীন সদা চঞ্চলা প্রেমের ভবিতব্য; শিব পার্বতীর প্রেম প্রত্যাখ্যান করেন, তাঁর তৃতীয়-নেত্র-উদ্গারিত আগুনে মদন ভস্মীভূত হয়, বসন্ত পলায়ন করে এবং নাটকের বিয়োগান্তক পরিসমাপ্তি ঘটে। পরে চতুর্থ সর্গে রতি মৃত মদনের জন্য বিলাপ করে— অনেকটা ওসিরিসের জন্য আইরিসের শোকের মতন— যখন পশ্চাদপটে পার্বতী অনুশোচনার মধ্য দিয়ে প্রেমকে পরিশুদ্ধ করেন। তার পর পঞ্চম সর্গে শিব ঋষি বেশে পার্বতীর কাছে উপস্থিত হন এবং তাকে তাঁর প্রেমিকের বিরুদ্ধে উস্কানি দেন। পার্বতী তাঁর একাগ্র প্রেমের অঙ্গীকারে স্থির থাকেন, তিনি তাঁর পরিচয় উদ্ঘাটন করেন এবং শিব-পার্বতীর মিলন ঘটে।

রবীন্দ্রনাথের মানসে এই ছদ্ম মোটিফ শাশ্বত প্রাকৃতিক লীলার প্রতীক। বসন্তের আসন্ন আগমনকে আড়াল করার জন্য শীত প্রকৃতির সাময়িক ছদ্মবেশ। এই বিষয়বস্তু বার বার ফিরে আসে। ফাল্গুনী নাটকেরও একই বিষয়বস্তু। নানা কবিতা, গান, উপন্যাস, প্রবন্ধ, চিঠিপত্র এবং নাটকে এই ধারণার পুনরাবৃত্তি ঘটে। একই ভাবে অনুশোচনার মাধ্যমে চঞ্চলা দৈহিক প্রেমের পরিশুদ্ধির বিষয়টি তাঁর অনেক রচনার উপজীব্য এবং তা কালিদাসের কাব্য থেকে সরাসরি গ্রহণ করা হয়েছে। কালিদাসের কুমারসম্ভব, ঋতুসংহার এবং মেঘদূত নাটক তিনটিকে ত্রয়ী হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে এবং সেগুলি এই বিষয়বস্তুর তিনটি বিষয় নিয়ে গড়ে উঠেছে। ছদ্ম মোটিফ কবির কাছে একটি জরুরি বিষয়, যার চারপাশে ঋতুচক্র আবর্তিত হয়। তাঁর গ্রীষ্মের ধারণা (তুলনায়, ‘বৈশাখ’ এবং বহু কবিতা ও গান) এক দীন ভিখারির (প্রথম সর্গের শিব); বর্ষাকাল বিচ্ছেদের (চতুর্থ সর্গ) তথা পরিপূর্ণতার (ষষ্ঠ সর্গ) প্রতীক। শরৎ আসে বধূ বেশে। কালিদাসের কাব্যে নব বধু-ই শরৎ, শরৎই নববধূ (ঋতুসংহার, শরৎ, তৃতীয় সর্গ)। হেমন্ত পরিতুষ্ট সধবা, শীত ছদ্মবেশী প্রেমিক এবং বসন্ত আসে বর বেশে। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত কবিতায় শোনা যায় কুমারসম্ভব ও ঋতুসংহার এর অনুরণন।

ছয়

সংস্কৃত সাহিত্য সমালোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কেবলমাত্র সাহিত্যের উত্তরাধিকারের ব্যাখ্যাই দিয়েছেন। অতীতের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মে তিনি শুধু খুঁজে পান একটি ধারণাগত অন্তঃস্থ কাঠামো। শকুন্তলা, রামায়ণ ও কাদম্বরী প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে তিনি লক্ষ্য করেছেন ওই সব কাব্যে অন্বিত ধ্যানধারণা এবং তাঁর স্বকীয় ধ্যানধারণার ভিতর অভিন্ন যোগসূত্র। অন্য ভাবে বলা যায়— এবং তা বলা নিরাপদ যে, উভয় ক্ষেত্রে ধ্যানধারণাগুলি একই ঐতিহ্য দ্বারা পুষ্ট এবং রবীন্দ্রনাথ শুধু তাঁর পূর্বতন শিল্পীদের নান্দনিক গুণান্বিত রচনাগুলির পুনর্ব্যখ্যার দায়ই নিজের উপর ন্যস্ত করেছেন। এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি যে সব মানদণ্ডের দ্বারস্থ হয়েছেন তা নেহাৎই সাদামাটা, গভীর চিন্তার প্রসাদ গুণ তাতে অনুপস্থিত। তাঁর মতে সমালোচনা একটি সৃষ্টিকর্মে রসগ্রহীতার নামান্তর, যা অন্য পাঠকদের সৃষ্টিকর্মের মনোযোগী পাঠে আকৃষ্ট করবে। এ ক্ষেত্রেও সংস্কৃত সাহিত্যে সমালোচনার ঐতিহ্যের মাপকাঠিগুলিতে তিনি পুনরুদ্ধার করেন। এই প্রসঙ্গে দুটো নির্ণায়কের উল্লেখ জরুরি। এক, কাব্যিক মানদণ্ডগুলির সঙ্গে একটি সৃষ্টিকর্মের সঙ্গতির বিচার। সঙ্গতি থাকলে স্রষ্টা উত্তম, নচেৎ তিনি মন্দ। নির্ণায়কটি আদতে নিষ্ফলা, সৃজনশীলতার প্রশ্নটি এতে অনুপস্থিত। দুই, রস অর্থাৎ কাব্যিক অনুভূতি বা ভাব দ্বারা সাহিত্যকর্মের বিচার, যা সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থের সর্বোৎকৃষ্ট নির্ণায়ক। রবীন্দ্রনাথও এই সূত্রের অনুসারী। তিনি কালোত্তীর্ণ সৃষ্টিকর্মগুলি বিচার করে দেখিয়েছেন কী ভাবে এবং কোথায় তারা রস-সঞ্চারে সফল হয়েছে।

সাত

রবীন্দ্রনাথের ভাবনার জগতে প্রাচীন অতীত তার সর্বাধিক সূক্ষ্ম, পরিব্যাপ্ত এবং তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। গ্রহণ এবং বর্জনের আকাঙ্ক্ষাজনিত টানাপোড়েন থেকে উৎসারিত হয়েছে তাঁর বহু মহৎ সৃষ্টি। গোরা উপন্যাস এদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট। উপন্যাসটিতে সংলাপের মারফৎ সরাসরি ভাবে এবং প্রতীকি ঘটনার মাধ্যমে পরোক্ষ ভাবে সমস্যাটিকে উপস্থাপিত করা হয়েছে। প্রাচীন অতীতের প্রতি কবির স্মৃতি-বিধুরতা একটি প্রাণদায়ী শক্তি, আবার একই সঙ্গে তা ভারবিশেষ। তিনি প্রায়শই বলেছেন, একটি জাতির চিরন্তন মূল্যবোধ তার অতীতকে সরাসরি বর্জন করতে পারে না। অতএব মূল প্রশ্নটি গ্রহণ ও বর্জনের মানদণ্ড নির্দিষ্ট করা, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে অতীত কতটা চালিত করবে তা নিরুপণ করা। দেশপ্রেম তাঁকে তৎপর করেছে সমালোচনার দৃষ্টিতে অতীতকে গ্রহণ ও বর্জনের মারফৎ উত্তরাধিকারকে নব কলেবর দিতে। সুতরাং, ভাবনার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে গ্রহণ ও বর্জন পালা করে এসেছে। ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর প্রবন্ধগুলিতে দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। প্রথমদিককার প্রবন্ধগুলিতে তিনি ভারতের অতীতকে আদর্শায়িত করেছেন এবং সম্পূর্ণ ভাবে অনুসরণযোগ্য হিসেবে তাঁর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের পুনর্ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তী প্রবন্ধগুলিতে তিনি অনেক সাবধানী, সমালোচনা-মনস্ক এবং ভাল-মন্দ বিচারে অন্বিষ্ট। নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতা বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, চারপাশের ঘটনাবলিতে তিনি হতাশ। তাঁর বিশ্বাস, আধুনিক ভারতে দুর্দশা এবং অশুভ শক্তির প্রাদুর্ভাবের জন্য অনেকটাই দায়ী প্রাচীন ভারতের মূল্যবোধ থেকে আমাদের সরে যাওয়া। বলা বাহুল্য, তাঁর সিদ্ধান্তগুলি সমালোচনাবর্জিত এবং অনৈতিহাসিক, কারণ ব্যক্তি হিসাবে ভবিষ্যৎদ্রষ্টারা যে মূল্যবোধগুলিকে স্বতঃসিদ্ধ হিসাবে ধরে নিয়েছিলেন সেগুলি আবশ্যিক ভাবে তদানীন্তন সমাজের বাস্তব রূপ দর্শায় না, বরং সেগুলি ছিল আদর্শ মাত্র। অগ্নি, বায়ু, জল ও বৃক্ষ সমূহের ভিতর একটি সত্তা বিরাজমান— প্রাচীন আর্যদের এই মহৎ উপলব্ধি মনুষ্য-জগৎ সম্বন্ধে আমাদের কিছুই বলে না এবং বিশ্ব-সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে আবদ্ধ ছিল, রবীন্দ্রনাথের এই ধারণা নেহাতই রোমান্টিক। সুতরাং মহৎ আদর্শ থেকে সরে আসা নিয়ে তাঁর বিলাপ ঐতিহাসিক ভাবে যুক্তিসিদ্ধ নয়। আবার তিনি যখন বলেন, এই সরে আসার কারণেই বিংশ শতাব্দীর ভারত দীন অবস্থায় পতিত হয়েছে, তখনও তিনি একই দোষে দুষ্ট হন। তিনি অতীতের সঙ্গে বর্তমানের তুলনা করে বলেন:

আমরা কোথায় আছি, কোথায় সুদূরে
দীপহীন জীর্ণভিত্তি অবসাদ পুরে…

তারপর ঋকবেদের সুবিদিত স্তবক থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন :

রে মৃত ভারত
শুধু সেই এক আছে নাহি অন্য পথ।

তাঁর দৃষ্টিতে বর্তমান নীরস এবং নিরানন্দ, যেহেতু আমরা ঋক্‌বেদ কথিত আনন্দের বাণী বিস্মৃত হয়েছি। অতএব অতীতের পুনরুত্থান সাধনেই আমাদের মুক্তি। ১৯০০ সালে, শতাব্দীর শুরুতেই তিনি প্রাচীন আর্যদের ‘বাণী’ নিয়ে বার বার বলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এই পুনরুত্থানবাদ তাঁর চিরস্থায়ী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। তিনি কয়েকবার তাঁর অবস্থান পালটেছেন এবং এই পালটানোর মারফৎ গড়ে উঠেছেন। এই অন্তঃস্থ গতিশীলতাই গুরুত্বপূর্ণ, একমাত্র বিচার্য।

কবিতায় প্রাচীন মূল্যবোধের পুনর্মূল্যায়নের একটা সরাসরি প্রচেষ্টায় তিনি ব্রতী হন। অতীতের প্রতি তাঁর নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে সুস্থ দোষদর্শিতার উপাদানটি লক্ষণীয়। তাঁর সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য লেখা গোরা উপন্যাসে তিনি টেবিলে তাঁর সব তাস রেখেছেন, এবং দীর্ঘ চুলচেরা আলোচনার মারফৎ পশ্চিমী ভাবাপন্ন সমাজের মানুষজনের মূল্যবোধের পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের বিচার করেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও গোরার মূল্যবোধ পুরোপুরি ঐতিহ্যাশ্রয়ী নয়, কারণ গোরার ভিতরকার ঐতিহ্য পশ্চিমী সংস্কৃতির সঙ্গে বিবাদ-বিতর্কে লিপ্ত হয়েছে। এই সংঘর্ষের ফল হিসাবে আমরা পাই একটি পরিবর্তিত, পরিশীলিত ও মেধার দ্যুতিতে ভাস্বর ঐতিহ্য, যা একান্ত ভাবেই গোরার বিচরণভূমি। উপন্যাসটিতে আমরা পাই কবির আধ্যাত্মিক আত্মজীবনীর একটি পর্যায় এবং ভারতের অতীতে তাঁর যাত্রা ও সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন ও অপরিবর্তিত রূপে ঊনবিংশ শতাব্দীর শিক্ষিতজনের ধ্যানধারণার বিবরণ। চিন্তক কবি চরম ঐতিহ্যগত ধ্যানধারণা ও চরম আধুনিক ধ্যানধারণার মধ্যবর্তী বিপুল দুরত্ব ভ্রমণ করেছেন এবং ধারণাগত ভাবে যতদূর অবধি যাওয়া সম্ভব তত দূর অবধি তিনি গেছেন। প্রায় প্রতিটি চরিত্রই একটি বিশেষ ধারণাগত অবস্থানের আধার। প্রতিটি আধারকে তিনি খতিয়ে দেখেন এবং যুগের আধ্যাত্মিক চাহিদার উপযোগী কিছু মূল্যবোধ গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন। তবে একটা সহজাত আদর্শবাদ তাঁর সব ধারণাকে রঞ্জিত করে।

যোগাযোগ, চার অধ্যায়, ঘরে বাইরে এবং চতুরঙ্গ-তে একই যন্ত্রণাদগ্ধ যাত্রার পুনরাবৃত্তি ঘটে। প্রকৃত কবি হিসাবে তিনি একটি অন্তিম অবস্থান নিতে পারেন না। তাঁর সংবেদী এবং চিরপরিবর্তনশীল মন বিভিন্ন অবস্থানের মধ্যে দোদুল্যমান হয় এবং এই সৃজনশীল টানাপোড়েন থেকে উৎসারিত হয় বহু প্রকৃত সৃষ্টি।

আধুনিক জীবনের নিরিখে কী ভাবে তিনি প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য বাস্তবায়িত করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন তার একটা উদাহরণ দেওয়া যায়: ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ তিনি প্রাচীন পৃথিবীর তপোবনের আদলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। শান্তিনিকেতনের ইতিহাস অনুধাবন করলে প্রাচ্য ও প্রতীচ্য, অতীত ও বর্তমানের মধ্যে একটা দোদুল্যমান পেন্ডুলামের মতো কবির অশান্ত মনের হদিশ আমরা পেয়ে যাই। এটা সত্য যে, কতকগুলি মূল্যবোধ থেকে কখনওই তিনি সরে যাননি, কিন্তু প্রতিদিনকার প্রয়োগে এই ধারণাগুলিকে বাস্তবায়িত করার প্রক্রিয়া ও ধরনগুলি অতীতের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে পালটেছে। তপোবন মডেলটি বিভিন্ন সাহিত্যকর্মের উল্লেখ থেকে পুনর্নির্মিত হয়েছে। শান্তিনিকেতন শীর্ষক তাঁর প্রবন্ধগুলি, তাঁর আধ্যাত্মিক আত্মজীবনী আত্মপরিচয়, তাঁর গভীর বিশ্বাস সঞ্জাত ‘মানুষের ধর্ম’ শীর্ষক প্রবন্ধ এবং তাঁর শেষ ইচ্ছাজাত ‘সভ্যতার ইতিহাস’ তাঁর দ্বিধাগ্রস্ত মনের আন্দোলন এবং একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ কাল-বিভাজনের ধারণা দেয়। কখনও তিনি পশ্চিমের দিকে ঝুঁকছেন, আবার কখনও তিনি প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্যের ওপর দৃষ্টিপাত করেছেন।তবে তাঁর গোটা আধ্যাত্মিক জীবন জুড়ে কিছু বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ অন্তিম ভরসা হিসাবে কাজ করেছে। বৈদিক, মহাকাব্যিক, ঔপনিষদিক ও বৌদ্ধ সাহিত্য তাঁকে দিয়েছে চিরন্তন মূল্যের কিছু রত্ন এবং তাঁর চিন্তা, কর্ম ও শিল্পে ফেলে গেছে অবিনশ্বর প্রভাব। এগুলির মধ্যে উপনিষদের অবদানই সর্বাধিক স্পষ্ট। এই অবদান নিয়ে অতি দক্ষ বহু পণ্ডিত পুঙ্খানুপুঙ্খ কাজ করেছেন, যদিও একটা কাঁচা মনের উপর উপনিষদের সজীব, বর্ণময় এবং মর্মস্পর্শী রূপ-প্রতিমার প্রভাব নিয়ে যথাযথ অনুসন্ধান হয়নি। সংস্কৃত ভাষায় লেখা বৌদ্ধ রচনা থেকে তিনি অসংখ্য বিষয় এবং একটি সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছেন, যার কার্যকরী প্রকাশ ঘটেছে রাজর্ষি, মুকুট এবং অন্যান্য বহু কবিতা ও গল্পে।

আট

ঋক্‌বেদই রবীন্দ্রনাথের উপর সর্বাধিক প্রভাব ফেলেছে মনে হয়। একটু ব্যাখ্যায় যেতে হবে। বহু শতাব্দী ধরে আমাদের ঐতিহ্যে বৈরাগ্য সাধনই চরম মোক্ষ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথও এই ঐতিহ্যেরই উত্তরাধিকারী। ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীবমাত্রই ব্রহ্ম, শঙ্করাচার্যের উপনিষৎ সম্পর্কিত ভাষ্য এবং বেদান্ত দর্শনের মতবাদ দ্বারা এই ধারণা পুষ্ট হয়েছে। যা দেখি তা সবই মায়া। অতএব জীবই ব্রহ্ম— এই উপলব্ধি মুক্তির একমাত্র উপায়। জীবন অন্তঃসারশূন্য মায়ামাত্র, তা মানুষকে বুঝতে হবে। মায়ার প্রভাবে মানুষ যে-সব কার্যকলাপে লিপ্ত হয় তা থেকে তাকে মুক্ত হতেই হবে। রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবের পূর্বে হাজার বছরের অধিক কাল ধরে এই দৃষ্টিভঙ্গি বা বিশ্ববীক্ষা সাহিত্যকে রঞ্জিত করেছে এবং তা ছিল সব কবি ও দার্শনিকের চিন্তার মূল ভিত্তি। এই দৃষ্টিভঙ্গি জন্ম দেয় জীবন সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণার, কারণ তা ঐহিক জীবনের সব আনন্দকে অশুভ বলে চিহ্নিত করে। নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থের তিরিশ নম্বর কবিতায় সুস্পষ্ট ভাবে একটি ভিন্ন সুর ধ্বনিত হয়। কবিতাটিতে উচ্চারিত হয় ভাষার দ্ব্যর্থহীন প্রকাশে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যয়:

বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়
অসংখ্য বন্ধন-মাঝে মহানন্দময় লভিব মুক্তির স্বাদ;

হাজার বছর ধরে চলে আসা আত্মবিলোপ, কৃচ্ছসাধন এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আনন্দকে হীন প্রতিপন্ন করার দর্শনের বিরুদ্ধে দ্ব্যর্থহীন প্রকাশ ঘটেছে এই কবিতাটিতে। আত্মবঞ্চনার প্রচারকরা যে বন্ধ্যা অস্তিত্বের সমর্থনে কথা বলেছেন তার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবি-সত্তা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। শতাধিক কবিতায় সুস্পষ্ট ভাবে তিনি তাঁর অবস্থান ব্যক্ত করেন; মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্য দিয়ে অসংখ্য রূপে ব্যক্ত জীবনই তাঁর প্রিয়। মানুষ এবং প্রকৃতির কোনও কিছুই তাঁর কাছে ব্রাত্য নয়। এই পৃথিবীতে জন্ম নিতে পেরে তিনি গর্বিত, যেখানে তুচ্ছতম খুঁটিনাটিও তাঁর কাছে তাৎপর্য নিয়ে আসে। পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তির জন্য জীবন সব আয়োজন ছড়িয়ে রেখেছে। জীবনের এই আনন্দোৎসব থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখা অন্যায়; তা প্রকৃতি বিরুদ্ধ। আকাশ, চাঁদ, সূর্য, নক্ষত্র, আলো-অন্ধকার, বৃক্ষ ও নদী, পাখি ও প্রাণী, আনন্দ ও দুঃখ, আশা, স্বপ্ন এবং হতাশা এই সব নিয়েই জীবনের ব্যাপ্তি। একবারই আসে এই সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার সুযোগ। একে প্রত্যাখ্যান করা অন্যায়।

রবীন্দ্রনাথের পূর্বসূরীরা বহু শতাব্দী ধরে বেদান্ত এবং মায়ার দর্শনে নিমজ্জিত ছিলেন। যে-কবি জীবনের বাস্তবকে সমৃদ্ধ এবং তাৎপর্যময় বলে মেনেছেন তাঁর কাছে এই মতবাদ সম্পূর্ণ ভাবে অযৌক্তিক। জগৎ মায়ামাত্র, অতএব অশুভ, এই প্ররোচনায় মানুষ অন্তহীন দুর্দশায় পতিত হয়, বেদান্ত ও মায়া দর্শনের এই মনোভঙ্গির বিপরীতে রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ নতুন করে সুর আনেন: আপন প্রয়োজনেই জীবন গৌরবময়; পৃথিবীতে মানব জীবন আশীর্বাদ স্বরূপ, মানব জীবন ক্ষণস্থায়ী এ কথা মনে রেখে কৃতজ্ঞতা ও গর্বের সঙ্গে তা উপভোগ করা উচিত। প্রকৃতির দীপ্তি এবং মানুষের আবেগ ও মানুষে মানুষে সম্পর্ক দ্বারা জীবন মহিমান্বিত। মানব অস্তিত্বের এই গৌরব ও বিষ্ময়বোধ ঋক্‌বেদেও ধ্বনিত হয়। ঋক্‌বেদে জীবনের আনন্দের উল্লেখ আমরা প্রায়শই পাই। দীর্ঘজীবনের আকাঙ্ক্ষায় প্রার্থনা সাধারণ ঘটনা। এই পৃথিবীতে জীবন কাম্য। স্তোত্র-৫৮:১০-র ধুয়া: আমরা এখানে অর্থাৎ এই পৃথিবীতে বাঁচতে এবং বাস করতে চাই। যতদিন সম্ভব ততদিন অবধি মৃত্যুকে প্রতিহত করো, এই জীবন ছেড়ে অনন্ত আধ্যাত্মিক সুখে নিমজ্জিত হতে মানুষ আগ্রহী নয়। কারণ তার কাছে সুখ এখানেই এবং এখনই। সোম এবং অন্যান্য দেবতাদের কাছে কৃতাঞ্জলিপুটে প্রার্থনা, ভক্তরা যেন অনেক বছর ধরে উদীয়মান সূর্যকে দেখতে পায়। ওই প্রাচীন আর্যদের কাছে উদীয়মান সূর্য একটি প্রতীক, তা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ তাঁদের কাছে মূল্যবান, কারণ তা জীবনের প্রতীক। মৃত্যু নয়, বরং জীবনই কাম্য। সোমের কাছে অমরত্ব-আকাঙ্ক্ষী বিখ্যাত প্রার্থনাটি ঋকবেদের বহু প্রার্থনার মূল সুর: ‘যেখানে দীপ্তি আছে, যেখানে সূর্য বিরাজমান, যেখানে মৃত্যু বা ক্ষয় নেই, বিবস্বত পুত্র যেখানে রাজা, যেখানে মানুষ সূর্যে প্রবেশ করে এবং প্রশস্ত নদী সমূহ যেখানে প্রবহমান, সেখানে আমাকে অধিষ্ঠিত করে আমাকে অমর করো।’ ঐহিক আনন্দ এবং সুখের জন্য অনন্ত বাসনা পূরণের আকাঙ্ক্ষা ওই স্তোত্রটিতে অসাধারণ রূপ পেয়েছে। ঋক্‌বেদ বলছে, জীবনের আনন্দ উপভোগ করো, পরিপূর্ণ ভাবে বাঁচো, ছোটখাটো আনন্দকে অবহেলা করো না, পঞ্চেন্দ্রিয় পরিতৃপ্তি চায়, এই শরীরেই দীর্ঘ জীবন উপভোগ করা প্রয়োজন। প্রথম গ্রন্থের বিখ্যাত স্তোত্রটিতে এই দর্শন পুনঃপুনঃ ব্যক্ত হয়েছে। সময়ের আগে কেউই জীবনের পরিসমাপ্তি চায় না। বৈদিক আর্যদের কাছে মানুষের স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল একশো বছর। ঋক্‌বেদ ছাড়া আর কোথাও বেঁচে থাকার জন্য এমন আকুলতা দেখা যায় না: শত বৎসর বাঁচো, দেখো, সুখে থাকো। যে সাধারণ উপকরণ নিয়ে জীবন আবর্তিত, বিখ্যাত মধুসূত্রটি তারই প্রশাস্তিতে একটি স্তোত্র: বায়ু, জল, বাতাস, বৃক্ষ, নদী, গাভী, দিবা ও রাত্রির ওপর তার আশীর্বাদ ঝরে পড়ে। এটা জীবনের প্রতি একটি বিশেষ অনুরাগকে নির্দেশিত করে। স্তোত্রটি জীবন এবং বেঁচে থাকার আনন্দকে মহিমান্বিত করে।

এ দুই সহস্রাব্দের পর ভারতের মাটিতে এই সুর আবার ধ্বনিত হয়। এই দীর্ঘ সময় ধরে অশিক্ষিতরা এবং অধিবিদ্যা-চর্চাকারীরা জীবনকে যথাক্রমে অপরিহার্য এবং অমঙ্গল ও মায়া হিসাবে দেখেছে। রবীন্দ্রনাথ এই ধারণাকে উল্টে দেন। তিনি বলেন :

মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।

সারা জীবন ধরে তিনি এই শুষ্ক, বন্ধ্যা এবং নেতিবাচক দর্শনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তিনি বৈরাগ্যকে বিদ্রুপ এবং মায়াবাদকে জেরা করেছেন: ‘বিশ্ব যদি স্বপ্ন দেখে সে স্বপন কাহার স্বপন।’ কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থে এই কবিতার ধুয়া বৈদান্তিক অবস্থানের সারসংক্ষেপ বিশেষ। যা-কিছু জীবনকে অর্থপূর্ণ করে বেদান্ত দর্শন তাকে মায়া বলে খারিজ করে। শ্যামলী কাব্যগ্রন্থে বিখ্যাত ‘আমি’ কবিতায় তিনি এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে অযৌক্তিক বলে বর্জন করেন, কারণ তা বিশ্ব-সৃষ্টি এবং স্বয়ং অস্তিত্বেরই পরিপন্থী।

গীতবিতান এর ৭৭ সংখ্যক গানে কবি বলেছেন, অনেক যুগ আগে নক্ষত্রের উজ্জ্বল স্বর্গীয় জগৎ থেকে তাঁর কাছে নিমন্ত্রণ এসেছিল; কিন্তু তা তাঁকে পরিতৃপ্তি করতে পারেনি, তিনি এই পৃথিবীতে ফিরে এসেছিলেন। অসংখ্য গানে এই পৃথিবীর প্রতি তাঁর গভীর মমত্ববোধ এবং পার্থিব জীবনের নব নব আনন্দের প্রকাশ ঘটেছে। পরকালে স্বর্গীয় কোনও আনন্দময় জীবনের সম্ভাবনা অথবা পরমপুরুষের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাঁকে প্রলোভিত করেনি। তিনি জীবন সম্পর্কে বীতস্পৃহ নন কখনওই, কেননা জীবনের অজস্র সংঘাতের অভিজ্ঞতা তাঁর কাছে আশীর্বাদস্বরূপ, বেঁচে থাকাই চরম প্রাধিকার। রূপকার্থ ব্যতীত রবীন্দ্রনাথ দেহান্তরিত আত্মা বা মৃত্যুর পর জীবনের অস্তিত্বের কথা উচ্চারণ করেননি। এখানেও ঋকবেদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। শেষ খণ্ডের কয়েকটি স্তোত্র ছাড়া মৃত্যু, স্বর্গ বা নরক নিয়ে ঋক্‌বেদের কোনও উৎসাহ দেখা যায় না। জীবনকে ঘিরে তরতাজা সজীব উচ্ছ্বাস আর বহুবর্ণময় সৃষ্টির উদযাপনই সেখানে মুখ্য।

‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ–’ ‘সভ্যতার সংকট’-এ উচ্চারিত এই বাণীই তাঁর অন্তিম উপলব্ধি। যখন তিনি সব থেকে বেশি সৃষ্টিশীল, তাঁর সাহিত্য জীবনের সেই মধ্য পর্বে তিনি বেশি বেশি করে উপনিষৎ, বৈষ্ণব কবিতা এবং মধ্যযুগের ভক্তি রসাশ্রয়ী কবিতার দিকে ঝুঁকেছিলেন; কিন্তু পাছে তাতে এক বন্ধ্যা আত্ম-অস্বীকৃতির শিকার হতে হয়, এই আশংকায় ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছিলেন। যখন সত্যসত্যই তাঁর বিশ্ববীক্ষা প্রবীণ ও পরিণত হয়ে ওঠে, তিনি জীবনকে ধন্যবাদের সঙ্গে গ্রহণ এবং জীবনের স্তুতি স্তবের ঋকবেদীয় মনোভাবের কাছাকাছি সরে আসেন। তাঁর শেষ চারটি গ্রন্থ রোগশয্যায়, আরোগ্য, জন্মদিনে এবং শেষ লেখা জীবনের প্রতি তাঁর বিশ্বাসের জ্বলন্ত স্বাক্ষর। এটা কোনও আকস্মিক ঘটনা নয় যে, এই রচনাগুলিতে কখনও কখনও ঋকবেদের প্রতিধ্বনি শোনা যায়।

আরোগ্য-র অন্তর্গত প্রথম কবিতাটি ঋকবেদের ‘মধু’ স্তোত্রের প্রতিধ্বনি দিয়ে শুরু হয়। একই কাব্যগ্রন্থের তৃতীয় কবিতাটিতে সূর্যকে একেবারেই ঋকবেদীয় ঢঙে বর্ণনা করা হয়:

মনে মনে ভাবিয়াছি, প্রাচীন যুগের
বৈদিক মন্ত্রের বাণী কণ্ঠে যদি থাকিত আমার,
মিলিত আমার স্তব এই আলোকে আলোকে;
ভাষা নাই, ভাষা নাই;

পঞ্চম কবিতাটিও বহু ঋক্‌বেদীয় শ্লোকের প্রতিধ্বনি। জন্মদিনে-র অন্তর্গত ত্রয়োদশ কবিতাটিতে তিনি ঋক্‌বেদের ভাষা ব্যবহার করেন এবং বলেন যে তাঁর বৈদিক ঋষিদের কথা মনে আসছে। ত্রয়োবিংশ কবিতার শেষ পাঁচ পংক্তিতে বৈদিক স্তোত্রের সরাসরি প্রতিধ্বনি শোনা যায়। পঞ্চবিংশ কবিতায় ‘সাম’ গানের জন্য তাঁর প্রাণ আকুল হয়। ‘শেষ লেখা’-র অন্তিম কবিতাটিতেও তিনি জীবনের বিজয়ে তাঁর প্রগাঢ় বিশ্বাস ব্যক্ত করেন। এমনকী ঋকবেদের শ্লোকের সুরভি শরীরে মেখে ভাষাও হয়ে ওঠে স্মৃতি সুরভিত। ঋকবেদের এই প্রভাবেই সম্ভবত তাঁর কবিতার এক অন্য উত্তরণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *