বাংলা প্রবন্ধ
Essays in English
পরিশিষ্ট

রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ আজ বেঁচে থাকলে ৮৮ বৎসর অতিক্রম করতেন। জর্জ বার্নার্ড শ ওদিকে ৯৩ বছর বয়সে পরিহাসচটুল সতেজ চিন্তাধারার পরিচয় দিচ্ছেন। মানুষ শতায়ু হয়ে জীবনধারণ করবে—এইটিই সাধারণভাবে আকাঙ্ক্ষিত, আর রবীন্দ্রনাথের মতো লোকোত্তর মানুষের পক্ষে সুস্থ সবল মন নিয়ে সকলের কাম্য দীর্ঘায়ু হয়ে বেঁচে থাকা জাতির পক্ষে সৌভাগ্যের কথা হত। আমরা যাঁরা জীবনে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য আর তাঁর স্নেহ পেয়ে ধন্য হয়েছি—তাঁদের কাছে এটা একটা বিশেষ ক্ষোভের কথা যে, রবীন্দ্রনাথ দেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারলেন না। হয়তো দেশের উপস্থিত অবস্থায় বেঁচে থাকা তাঁর পক্ষে কষ্টকর হত, কিন্তু তাঁর উদার দৃষ্টি আর উপদেশ থেকে আমরা জাতীয় জীবনে কিছু-না-কিছু পথ্য আর পাথেয় সংগ্রহ করতে পারতুম। রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে শ্রীযুক্ত সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ যে উক্তি করেছিলেন তাঁর জীবৎকালে অনুষ্ঠিত শেষ জন্মদিনে, সেই উক্তির অন্তর্নিহিত সত্য আমরা মর্মে মর্মে অনুভব করছি—‘That is he is still with us shows that God has not yet forsaken us.’

রবীন্দ্রনাথের মতো বিরাট পুরুষের সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলেই তিনটি বিষয়ের অবতারণা করতে হয়—(১) তিনি ব্যাপকভাবে আমাদের সমগ্র জাতির জন্য কী করেছেন বা কী দিয়ে গিয়েছেন, (২) তিনি সংকীর্ণভাবে তাঁর সমভাষাভাষীদের জন্য কী করেছেন—আর (৩) ব্যক্তিগতভাবে আমরা তাঁর কাছে কী জন্য ঋণী। শেষোক্ত বিষয়টি সম্বন্ধে বিচার বা আলোচনা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সূত্রে হতে পারে। কিন্তু আর দুটি বৃহত্তর অপেক্ষাকৃত ব্যাপক দিক থেকে আমাদের যে বিচার হবে সেটা অনেকটা বস্তুতান্ত্রিক বিচারই হবে—একেবারে নিছক আত্মকেন্দ্রিক নয়। প্রথমে আমরা সমগ্রভাবে ভারতীয় জাতির জন্য রবীন্দ্রনাথ কী দিয়ে গিয়েছেন সেটার একটু বিচার করে দেখি—আর তা থেকেই নিখিল ভারতের জনগণ রবীন্দ্রনাথের কাছে কতটা কৃতজ্ঞ থাকবে তার একটা দিগদর্শন আমরা করতে পারবো।

আর একটা কথা আছে। আমাদের ব্যক্তিগত, প্রদেশগত বা সমগ্র দেশ বা জাতিগত সত্তার বা জীবনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সংযোগের কথা অতিক্রম করে বিশ্বমানবের সঙ্গে তাঁর যোগের কথাও বিচার্য। অবশ্য সে-সম্বন্ধে স্পষ্ট অভিমত দেবেন—ভারতের বাইরের লোকেরা—আমাদের মুখে তাঁরা ঝাল খাবেন না। তবে তাঁরা কীভাবে রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন ও দেখছেন—তার ধারণা আমরা বিদেশে গিয়ে বা বিদেশীদের সঙ্গে মিশে বা বিদেশীদের লেখা পড়ে করতে পারি।

আমেরিকার সুপরিচিত লেখক Will Durant রবীন্দ্রনাথকে তাঁর লেখা একখানি বই পাঠিয়ে দেন—এই বইতে তিনি এইভাবে রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন—‘You are the reason why India should be free.’ একজন নিরপেক্ষ বিদেশীর কাছে এইরকম কথা শুনে বুঝতে পারা যায় যে, বাইরের লোকদের কাছে ভারতবর্ষের মর্য্যাদা—এই একটিমাত্র মানুষ কত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বাস্তবিক আমাদের সংস্কৃততে যে কথা আছে যে, সৎ পুত্রের দ্বারা ‘কুলং পবিত্রং জননী চ কৃতার্থা’ হয়ে থাকে, তা এই রকম ঘটনা বা অবস্থা থেকে বোঝা যায়। এখন থেকে ২৬/২৭ বছর পূর্বেকার কথা, রবীন্দ্রনাথ তার ১০/১১ বৎসর পূর্বে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন, কিন্তু ইউরোপের সব দেশেই তাঁর লোকপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান দেখে প্যারিসে ছাত্ররূপে আমাদের অবস্থানের সময়ে মহারাষ্ট্র দেশ থেকে আগত একজন সতীর্থ আমায় বলেছিলেন—‘Rabindranath is the greatest ambassador who can be sent out by any country to the world.’—কথাটা অতি সত্য। রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবে সাধারণ ভারতবাসীই বিদেশের সহৃদয় শিক্ষিত জনগণের কাছে যে মর্য্যাদা পেয়েছেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেসব জাতির লোক পৃথিবীতে অগ্রণী—তাদের প্রাপ্য মর্যাদার চাইতে তা কোনো অংশে কম নয়। এটা ভারতের বাইরে নানা দেশে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা। খালি মর্যাদা নয়—তার সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের গৌরবের জন্য, তাঁর বিশ্বমানবিকতার জন্য আরও একটা জিনিস বিদেশীদের কাছ থেকে পেয়েছি—সেটা হচ্ছে হৃদ্যতা বা মিত্রতা, যেটা ইংলণ্ড আর আমেরিকার মতো দোর্দন্ডপ্রতাপ জাতির মানুষও সর্বত্র সেভাবে পায় না। এইসব অভিজ্ঞতার কথা এর আগে বলেছি, এখন আর পুনরুক্তি করবো না। কাজেই আধুনিক ভারতবাসীর পক্ষে, বিশেষ করে ইংরেজের অধীন ভারতবাসীর পক্ষে, রবীন্দ্রনাথের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবার এই একটা মস্ত বড়ো কারণ। রবীন্দ্রনাথ বাইরের লোককে কোনো কিছুর চটকে কোনো কিছু sensational বা রোমাঞ্চকর ব্যাপার দেখিয়ে মুগ্ধ করেন নি—আর এইখানেই তাঁর গৌরব—আর ভারতেরও গৌরব। তিনি সহজভাবে নিতান্ত আপনার জনের মতো নানা জাতির বিদেশী লোকের মনে একটা ভালোবাসার আসন পেয়েছিলেন। একটি ছোটো ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছে—এটি বন্ধুবর শ্রীযুক্ত কালিদাস নাগের অভিজ্ঞতা। একবার প্যারিসে রবীন্দ্রনাথ কিছুকাল অবস্থান করেন। কালিদাসবাবু তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন। প্যারিসের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে একটা বক্তৃতা দিতে রবীন্দ্রনাথকে যেতে হবে। লম্বা পাড়ি। ট্যাক্সি আনা হল। রবীন্দ্রনাথের হোটেলের দরজায় ট্যাক্সি হাজির—উনি সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। গাড়ি পর্যন্ত প্রত্যুদগমনের জন্য কতকগুলি লোক সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ সৌম্য আকৃতি আর সর্বোপরি তাঁর প্রশান্ত স্নিগ্ধ দৃষ্টি আর ঋষিজনোচিত মুখমন্ডল, যা দেখে সকলেরই শ্রদ্ধা বা সম্ভ্রম জাগতো, ট্যাক্সিচালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো—কালিদাসবাবু নেমে রবীন্দ্রনাথের জন্য ট্যাক্সির দরজা খুলতে আসছেন, ট্যাক্সিচালক নিজে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো, এসেই চুপি চুপি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলো—‘মশাই, ইনি কে?’ কালিদাসবাবু বললেন, ‘ইনি হিন্দু বা ভারতীয় কবি রবীন্দ্রনাথ তাগোর’। শুনেই লোকটি সসম্ভ্রমে তাঁর দিকে তাকালো আর সঙ্গে সঙ্গে মাথার টুপি খুলে হাতে নিলে—আর নিজে এগিয়ে এসে রবীন্দ্রনাথের জন্য গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইল। রবীন্দ্রনাথ গাড়িতে চড়লেন—যথাস্থানে ট্যাক্সি এসে পৌঁছলো, সেখানে তাঁর জন্যে অপেক্ষমান লোকেরা—তাঁকে স্বাগত করে ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে, কালিদাসবাবু এলেন ট্যাক্সির মিটার দেখতে, ভাড়া কত দিতে হবে। বেশ একটা মোটা অঙ্ক উঠেছিল, কিন্তু ট্যাক্সিওয়ালা কল ঘুরিয়ে দিলে আর বললে, ‘আমি ভাড়া নেব না—আমি ওঁর বই পড়েছি।’ কালিদাসবাবুর কৌতূহল হল—তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী কী বই পড়েছ—আর কোন বইটা তোমার সব চাইতে ভালো লেগেছে?’ ‘ফরাসীতে ৩/৪ খানা বই যা বেরিয়েছে, সব পড়েছি, তবে সবচেয়ে ভালো লেগেছে ‘সাধনা’।’ বলেই বেশি বাক্যব্যয় না করে খালি ট্যাক্সি নিয়ে সে চলে গেল। এ থেকে এ কথা বলবো না যে, প্যারিসের প্রত্যেক বা বেশির ভাগ ট্যাক্সিওয়ালা রবীন্দ্রনাথের বই পড়ে থাকে। তবে একটা জিনিস বুঝতে পারা যায়, কীরকমভাবে সাধারণ লোকের কাছে তাঁর বাণী পৌঁছেছে—আর তাঁর কাছ থেকে তার কিছু অন্তত পেয়েছে মনে করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা—এমনকী ভালোবাসার ভাব পোষণ করেছে। আর রবীন্দ্রনাথ কবি হিসাবে এই ভালোবাসাটুকুই কামনা করে গিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতি এবং সঙ্গে সঙ্গে ভারতবাসীর প্রতি এই আকর্ষণ আর শ্রদ্ধার মূলে কোনো রাজনৈতিক কারণ নেই, আছে এক সাধারণ মানবধর্ম যেটা সংকীর্ণ জাতীয়তা অথবা দলগত ভাবুকতা বা স্বার্থের বহু ঊর্ধ্বে অবস্থিত।

এইখানেই রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমানবের চিত্তজয়ের মূল কারণ নিহিত। তিনি মানুষকে ভালোবেসেছিলেন আর বিশ্বমানবের প্রতি প্রেম তাঁর জীবনে এ যুগে যে মহনীয়ভাবে প্রকাশ পেয়েছিল, সেরকমটি আর কোথাও দেখা যায় নি। রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধে কে যেন বলেছেন, তিনি ছিলেন ‘most stupendous mind of modern times’—এটা যেমন সত্য কথা, তেমনি সঙ্গে সঙ্গে এটাও সমানভাবে সত্যি কথা যে, তাঁকে ‘The greatest lover of man’-এর দলে প্রথম শ্রেণিতে স্থান দিতে হয়। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা এত নানামুখী যে, তার বর্ণনা করে অসংখ্য বিরুদ্ধ বা বর্ণনামূলক উপাধি তাঁর সম্বন্ধে তৈরি করে প্রয়োগ করতে পারা যায়, আর তাতেও তাঁর গুণের পার আমরা পাবো না। উড়িষ্যার কবি সদানন্দ চৈতন্যদেবকে নাকি ‘হরিনাম মূর্তি’ এই আখ্যা দিয়েছিলেন—চৈতন্যদেবের নামধর্ম প্রচারের কথা মনে করলে এই বিষয়টিকে তাঁর সম্বন্ধে সার্থক বলা যায়। তেমনি রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে অন্যতম বিরুদ বা আখ্যা হতে পারে—‘মানব-প্রেম-মূর্তি’ বা ‘মানবিকতা-বিগ্রহ’।

বিশ্বমানবের কাছে এই সম্মান আর বিশ্বমানবের মনে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে উচ্চ ধারণা—এই দুটি জিনিস বহু স্থলে অঙ্গাঙ্গীভাবে গ্রথিত দেখেছি। রবীন্দ্রনাথ যেমন ওদিকে বিশ্বজগতে আমাদের মর্যাদা বাড়িয়েছেন, তেমনি তিনি আমাদের ঘরের মানুষই রয়ে গিয়েছেন। এই দুটি জিনিসের একত্র অবস্থান—বড়োই অপূর্ব, এক অদ্ভুত রহস্য। ওয়ার্ডসওয়ার্থ যে বলেছেন, স্কাইলার্ক পাখি একদিকে গগনবিহারী, আকাশ আপনার সংগীতে সে ভরিয়ে দেয়—আর একদিকে সে মাটির উপরে তার বাসা ভোলে না। ওদিকে ফিনল্যাণ্ডের অনুরাগী ভক্ত রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে সংস্কৃতে কবিতা লিখছেন—

ন কর্হিচিৎ কিল প্রাচী প্রতীচ্যা সংগমিষ্যতি।

পুরস্তাদ বৈ রবিস্তূদয়ন প্রতীচীমপ্যরোচয়ৎ।।

দক্ষিণামপ্যুদীচীং চ ব্যভাসয়দ উরুক্রমঃ।

তৎ পূজ্যসে, রবীন্দ্র! ত্বম উত্তরস্যাং বিশেষতঃ।।

বাঙলায় যার অর্থ হচ্ছে—

পূর্বদেশ পশ্চিমের সঙ্গে কখনো মিলিত হবে না, কিন্তু পূর্বদেশে উদিত হয়ে রবি পশ্চিমকেও আলোকিত করেন—উরুক্রম অর্থাৎ বিষ্ণুর মতো দূরগামী হয়ে দক্ষিণ আর উত্তরদিককেও রবি উদ্ভাসিত করেছেন; সেইজন্য হে রবীন্দ্র! তুমি বিশেষ করে আমাদের উত্তরদেশেও পূজিত হও।

আবার যবদ্বীপের ভাবুক রবীন্দ্রনাথের কবিতার তিনহাত ঘুরে-আসা অনুবাদ ‘বাঙলা থেকে ইংরিজি, ইংরিজি থেকে ডাচ, ডাচ থেকে যবদ্বীপীয় ভাষা’ পড়ে ভাবাবেগে প্রকাশ্য সভায় কেঁদে ফেলেছিলেন—আর লেবাননের আরব কবি শান্তিনিকেতন এসে রবীন্দ্রনাথকে দর্শন করে নিজেকে কৃতার্থ মনে করে যাচ্ছেন, তেমনি এদিকে বাঙলা দেশের মেয়েরা সভা করে রবীন্দ্রনাথকে আহ্বান করে এনে তাঁকে জানাচ্ছেন—আপনি আমাদের ঘরের কবি, আমাদের গৃহকর্মের ভিতরে, আমাদের রান্নাঘরের ভিতরেও আপনাকে পেয়েছি। কথাটা যে বলা হয়েছে—অতি সার্থক কথা— ‘He alone is truly international who is most intensely national.’ শেকসপিয়র সম্বন্ধেও বলা হয়েছে যে, একদিকে যেমন ইংলণ্ডের জাতীয় কবি, তেমনি তিনি সমগ্র জগতের কবি।

আধুনিককালের ভারতীয় চিন্তানেতাদের কারো কারো বাণী বা শিক্ষা বা চরিতকথা ভারতের বাইরে মানুষদের মধ্যে পৌঁছেছে। কিন্তু এঁদের সকলের সব কথা কিংবা চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য যে বাইরের লোক ঠিকমতো ধরতে পেরেছে, তা মনে হয় না, আর ধরতে পারাও সম্ভব নয়। স্বামী বিবেকানন্দের মহিমা কিছু কিছু তাঁর বাইরের শিষ্যেরা তাঁর সঙ্গে এসে বা তাঁর লেখা পড়ে বুঝতে পেরেছিলেন, ভগিনী নিবেদিতার মতো দু-চারজন, তিনি যেভাবে বেদান্তকে আধুনিক জীবনে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন, তারও ধারণা করতে পেরেছেন, কিন্তু সাধারণ শিক্ষিত অ-ভারতীয়ের কাছে ভারতীয় সভ্যতারই মতো দুর্বোধ্য প্রহেলিকা হয়ে থাকতেন, যদি না রোমা রোঁলার মতো অনুভবী ও দরদী চিন্তানেতা তাঁর স্বরূপ পাশ্চাক্ত্যের সামনে সার্থকভাবে প্রকাশ করে দিতে সমর্থ হতেন। গান্ধীজীর অহিংসা আর সত্যাগ্রহ, তাঁর আদর্শ আর কার্যক্রম ইউরোপে আমেরিকায় সাধারণ লোক তো বুঝতেই পারে না, অ-সাধারণ লোকের মাথাতেও ঢোকে না, কিন্তু তিনি যে ইংরেজকে বিব্রত করেছিলেন, এটা তারা বুঝেছিল। আর ইংরেজদের প্রতি প্রীতির আধিক্য আর তার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের যোগী ফকির সন্ন্যাসীদের বিভূতি সম্বন্ধে একটা আবছা আবছা ভীতিমিশ্র বিস্ময়ের ভাব—এই দুইয়ে জনসাধারণের মনে একটা অস্পষ্ট ধারণা এনেছিল—যদিও একথা স্বীকার করতে হবে যে, সত্যকার উচ্চ মনোভাবের মনীষীদের অনেকে মহাত্মাজীর অহিংসার বাণীর আবশ্যকতা বেশ প্রণিধান করেই মেনে নিয়েছিলেন—কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে আলাদা কথা। তাঁকে লোকে পেয়েছিল কবি-রূপে। যাঁর লেখায় তারা তাদের মনের মধ্যে নিহিত আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, নীতি-আদর্শ প্রভৃতির প্রতিধ্বনি পেয়েছিল— ‘One touch of nature maketh the whole world keen.’ এই touch of Nature রবীন্দ্রনাথকে সকল দেশের মানুষের আত্মীয় করে তুলেছে।

রবীন্দ্রনাথ সমগ্রভাবে ভারতবর্ষের আর ভারতবাসীদের মর্যাদা বাড়িয়েছেন—কিন্তু তাঁর সমভাষাভাষী আমরা বাঙালি—আমাদের জন্য বিশেষভাবে, তিনি যা দিয়ে গিয়েছেন—তার মূল্য আমরা ঠিকমতো হয়তো বুঝি না, আর মূল্য দিতেও হয়তো আমরা পারবো না। রোদ, হাওয়া, জলের মতো, এমন অনেক জিনিস আছে, আমাদের ভাব-জগতে আর সামাজিক জীবনে যা না হলে আমাদের একদন্ড চলে না—আর যার কথা আমরা সাধারণতঃ মনে রাখি না। আমাদের এই যে বাঙলাভাষা, যেটা উপস্থিতকালে বাঙালির প্রতিষ্ঠার একটি প্রধান অবলম্বন বলে আমরা মেনে নিয়েছি, রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে সেই বাঙলা ভাষায় গর্ব করার আর যা থাকে, তা কতটা বিশ্বসাহিত্যের কোঠায় পৌঁছে (আমাদের বাঙলার আর ভারতের জীবনে তার সার্থকতা যা-ই থাক না কেন), সেটা বিবেচনা করবার বিষয়। ইংরেজ সাহিত্যিক গোল্ডস্মিথ সম্বন্ধে অতি উচ্চ প্রশংসা করে ডা. জনসন যে-কথা বলেছিলেন, সে-কথা রবীন্দ্রনাথের মতো মনীষার সম্বন্ধেই প্রযোজ্য— ‘He touched nothing which he did not adorn.’ রবীন্দ্রনাথের মতো এমন সার্বভৌম সাহিত্যসম্রাট জগতের বা’য় ইতিহাসে আর কোথায় দেখা গিয়েছে? এ সম্বন্ধে মাতৃভাষার সাহিত্যের সঙ্গে স্বল্প পরিচয়ও যার আছে—এমন বাঙালিকে কিছু বলবার আবশ্যকতা নেই। সোফোক্লেস সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, তিনি ‘Saw life steadily and saw it whole’, রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে সে-কথা তো বলতে পারা যায়-ই, উপরন্তু তিনি কেবল জীবন-নাট্যের spectator বা দর্শক মাত্র ছিলেন না। তাঁর মধ্যে zest of life, জীবন-রস সম্বন্ধে সচেতনতা আর আগ্রহ এত ছিল যে, তিনি নিজে তাতে পুরোপুরি অংশ নিতে দ্বিধা করেন নি। এইজন্যে সাহিত্যের বাইরে অথচ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাহিত্যের সঙ্গে সংযুক্ত সংগীত, অভিনয়সজ্জা, রূপকলা প্রভৃতি তাবৎ সুকুমার শিল্প তাঁর এলাকার অধীনেই ছিল। আবার ওদিকে রাষ্ট্রজীবনের সঙ্গেও তাঁর সংযোগ যে কত ঘনিষ্ঠ ছিল, সেকথা আধুনিক ইতিহাসের অনেক পৃষ্ঠা জুড়ে আছে। বাঙালিকে পরিপূর্ণ ভারতীয় আর পরিপূর্ণ মানুষ হতে রবীন্দ্রনাথের দান যে কতখানি, তা অল্প কথায় বুঝিয়ে বলবার নয়। ভগবানের আশীর্বাদস্বরূপ এ-যুগে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব না হলে মানবিক সংস্কৃতিতে, আত্মসম্মানে, জাতীয়তার প্রতিষ্ঠায় বাঙালি কতটুকু দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো সে-বিষয়ে আমরা প্রশ্ন করতে পারি। তিন রকম ঋণ নিয়ে মানুষ পৃথিবীতে জন্মায়, দেব-ঋণ, পিতৃ-ঋণ আর ঋষি-ঋণ। মানুষের জীবন আর জীবনের সাধনা এই তিন ঋণের পরিশোধ চেষ্টাতেই হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথের লেখার সঙ্গে পরিচয় সংস্থাপন এবং দেশবাসীর মধ্যে তাঁর বাণীর প্রচার আমাদের জীবনের অন্যতম ঋষি-ঋণ পরিশোধ বলে আমরা ধরতে পারি। এইজন্যেই প্রত্যেক সহৃদয় মানসিক-সংস্কৃতিকামী বাঙালির এদিকে একটা কর্তব্য আর দায়িত্ব আছে। রবীন্দ্রনাথের বাণী ইংরিজি মারফত প্রধানত ভারতের অন্য প্রদেশে পৌঁছেছে, সম্প্রতি নাগরী অক্ষরে রবীন্দ্রনাথের মূল বাঙলা রচনা প্রকাশনের যে প্রস্তাব বিশ্বভারতী কার্যে পরিণত করবার চেষ্টা করছেন, সেটি একটি বিশেষ সময়োপযোগী কাজ হবে—এর দ্বারা রবীন্দ্রনাথের আর সঙ্গে সঙ্গে বাঙলা সাহিত্যের আদর নিখিল ভারতে আরও বাড়বে, এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই। এই কাজে রবীন্দ্র-ভারতীরও অংশগ্রহণ করা কর্তব্য বলে মনে করি।

এখন বিশ্বমানব, ভারতবর্ষ আর বাঙালি সমাজের কথা ছেড়ে নিজের ব্যক্তিগত কথায় বলতে পারা যায়, আমার নিজের ব্যক্তিত্বের স্ফুরণে রবীন্দ্রনাথ যতটা স্থান নিয়ে আছেন, তার-ই পটভূমিকার সামনে ব্যাপকতর পরিধির মধ্যে তাঁর প্রভাবের কথা আমি বিচার করতে পারি। এ বিষয়ে ব্যক্তিগত কথা সব বলবার নয়, বলতে পারাও যায় না, তবে আমার জীবনে যে-সমস্ত বস্তু আমাকে আমার মানসিক আর আধ্যাত্মিক সার্থকতার পথে পরিচালিত করেছে, তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য আর তাঁর ভাবধারার সঙ্গে স্বল্পাদপি স্বল্প পরিচয় একটি প্রধান। স্কুলে পড়বার সময় ১৪ বৎসর বয়সে রবীন্দ্র-রচনার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে—চিত্রা-র আর কথা ও কাহিনী-র কতকগুলি কবিতার মাধ্যমে তাঁর লোকোত্তর প্রতিভার একটি ঝলক চোখের সামনে আসে—অনির্বচনীয় এক সৌন্দর্যময় স্বপ্নরাজ্যের দ্বার যেন আমার জন্যে উন্মুক্ত হয়ে যায়। যার পাত্র যতটুকু, সে ততটুকুই নিতে পারে—আমার মতো সাহিত্যিক-রসবোধ-বর্জিত নীরস ভাষাতত্ত্বের আলোচকের মত যতটা আপ্লুত হবার তা হয়েছে, জীবনে এক নতুন অমৃতরসের আস্বাদ রবীন্দ্র-রচনা আমার কাছে এনে দিয়েছে। ভাষাতত্ত্বের আলোচক হিসাবে আমার পক্ষে একটা বিশেষ আত্মপ্রসাদের কথা এই যে, রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের একটা দিক আমাদেরই পর্যায়ে পড়ে—ব্যাকরণিয়া রবীন্দ্রনাথকে আমাদের আলোচ্য বিদ্যার একজন পথিকৃৎ বলে আমরা মেনে নিতে পারি। রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য, সেটা জীবনে এক অপূর্ব সৌভাগ্যরূপে আমি পেয়েছি। তাঁর সঙ্গে কথা কওয়াটাই ছিল এক শ্রেষ্ঠ মানসিক রসায়ন। তাঁর স্নেহ পেয়েও ধন্য হয়েছি। তাঁর স্নেহ আমার মতো অনেকেই পেয়েছেন, কিন্তু মহাপুরুষদের সঙ্গে যাঁদের সংযোগ বা সাহচর্য ঘটে, তাঁদের প্রত্যেকেরই বৈশিষ্ট্যের আধারের মধ্যে এই সংযোগের সূত্র মিলবে। তানসেন তাঁর এক ধ্রুপদের বাণীতে তাঁর আরাধ্য দেবতার সম্বন্ধে বলেছেন যে, তুমি বহুবল্লভ কিন্তু তানসেনের কাছে তুমি একবল্লভ। রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী ব্যক্তিত্বের মধ্যে আমি এমন একটা দিক পেয়েছি, যেখানে কেবল তিনি আছেন আর আমি আছি—আর কারো স্থান সেখানে নেই। একথা আমার মতো আরও অনেকে নিশ্চয়ই বলতে পারবেন। মহাপুরুষের সর্বন্ধরত্বের এই একটা প্রমাণ। ব্যক্তিগত কথা এসে পড়লে মূক হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আর এই কথা বলেই আমি আমার বক্তব্যের উপসংহার করছি— ‘The highest tribute is tribute of Silence.’

সাপ্তাহিক দেশ, বঙ্গাব্দ ১৩৫৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *